যাব না। যাব না। সাহায্য চাই।
কচু সাহায্য। তুমি দূর হয়ে যাও।
যাব না। স্বর্ণ চাই। প্রাটিনাম চাই।
নিজে জোগাড় করে নাও।
পারছি না। আমার গতিবেগ রুদ্ধ। আমি গতিহীন। শক্তিহীন। চোখ খোল। চোখ খুলে আমাকে দেখ।
আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম। সত্যি সত্যি আমার চোখের সামনে ছোট একটা কালো বিন্দুর মতো কী-একটা ঝুলছে। টুকুনজিলের মহাকাশযান, নাকি আমার কল্পনা? আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম। বললাম, চলে যাও তুমি।
যাব না। যাব না। যাব না।
কেন যাবে না?
যেতে পারব না। সাহায্য চাই। আমাকে খুঁজছে। আমাকে ধরতে আসছে। আমার বিপদ।
তোমার বিপদ, তুমি কচুপোড়া খাও।
আমি কচুপোড়া খাই না। আমাকে সাহায্য কর তুমি।
কিন্তু তুমি তো নেই, তুমি কল্পনা।
আমি কল্পনা না। আমি প্রমাণ করব। তমি হাত বাড়াও।
আমি আস্তে আস্তে হাত বাড়ালাম, দেখলাম বিন্দুটি আমার হাতের উল্টোপৃষ্ঠায় নেমে এল, হঠাৎ একঝলক আলো জ্বলে উঠল, আর আমি চিৎকার করে হাত টেনে নিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম গোল হয়ে পুড়ে গেছে হাতের চামড়া, মুহূর্তে ফোস্কা পড়ে গেছে হাতে। প্রচণ্ড জ্বালা করছে হাত, কিন্তু আমি যন্ত্রণার কথা ভুলে গেলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম হাতের দিকে। তাহলে কি সত্যিই টুকুনজিল আছে?
তোমার অন্য হাত দাও।
কেন?
আরেকটা বৃত্তাকার উত্তপ্ত চিহ্ন করে দেখাই।
না, আর দেখাতে হবে না।
এখন তুমি বিশ্বাস কর আমি সত্যি?
প্রচণ্ড জ্বালা করছে হাত। কিন্তু এটাও কি কল্পনা হতে পারে? কাউকে দেখাতে হবে আমার। আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম, বাসার কাজের ছেলেটিকে খুঁজে পেলাম না, তাকে দেখাতাম। বল্টু হেঁটে যাচ্ছিল, তাকেই ডাকলাম আমি, বল্টু, দেখ তো একটা জিনিস।
কি?
আমার হাতের উপর কি তুমি কিছু দেখতে পাও?
দেখি বল্টু হাতটা একনজর দেখেই চিৎকার করে উঠল, সিগারেটের ছ্যাকা! ইয়া আল্লাহ, তুমি সিগারেট খাও?
তারপর সে গরুর মতো চেঁচাতে শুরু করল, আম্মা, আম্মা দেখে যাও। বিলু সিগারেট খায়। সিগারেটের ছ্যাক
ছোট খালা দৌড়ে এলেন, কি হয়েছে? কি?
দেখ, বিলু সিগারেট খেতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছে। দেখ, গোল ছ্যাঁকা।
ছোট খালা হাতের পোড়া দাগটা খুব ভালো করে দেখলেন, তারপর আমার দিকে ভুরু কুচকে তাকালেন, আমার শরীরে সিগারেটের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলেন কয়েকবার, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে পুড়েছে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, না মানে—ইয়ে–।
টুকুনজিলের কথা শুনতে পাই আমি, দেখেছ? আমি সত্যি। আমি কল্পনা না।
আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম। ছোট খালা বা বল্টু টুকুনজিলের কথা শুনতে পায় নি, শুধু আমি শুনেছি।
ছোট খালা বললেন, কথা বলছিস না কেন? কেমন করে পুড়েছে?
বল্টু চিৎকার করে বলল, সিগারেট। সিগারেট!
টুকুনজিল বলল, অকাট্য প্রমাণ আমি সত্যি। অকাট্য প্রমাণ।
আমি চোখ বন্ধ করলাম, মহা ঝামেলায় ফেঁসে গেছি আমি, কিন্তু একটা কথা তো সত্যি।
আমি পাগল না।
মহাকাশের রহস্যময় প্রাণী সত্যি আছে।
সত্যি আছে।
০৯. সোনার আংটি
মহাকাশের আগন্তুক টুকুনজিল সত্যি আছে, সে সুদূর এন্ড্রোমিড়া নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে পৃথিবীতে এসেছে, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা পাগলের মতো তাকে খুঁজছে, সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আমি জানি সে সত্যি আছে এবং কোথায় আছে। শুধু আমার সাথে তাঁর যোগাযোেগ হয়েছে, শুধু আমি জানি সে দেখতে কেমন। সে কথা আমি কাউকে বলতে পারছি না, ডাক্তার চাচাকে বলেছিলাম, তিনি বিশ্বাস তো করেনই নি, উল্টো ধরে নিয়েছেন আমিও আমার বাবার মতো পাগল! একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, কারণ যতক্ষণ টুকুনজিল তার মহাকাশযান ঠিক করতে না পারছে ততক্ষণ সে চায় না অন্য কেউ জানুক সে কোথায় আছে। আমাকে তাই বলেছে, সারা পৃথিবীর মাঝে আমি তার একমাত্র বন্ধু, আমি যদি তার কথা না শুনি কে শুনবে? কাজেই আমার পেটের মাঝে এত বড় খবরটা ভুটভুট করতে থাকে, কিন্তু আমি বের করতে পারছি না।
টুকুনজিল এক টুকরা সোনা বা প্রাটিনামের জন্যে একেবারে জান দিয়ে ফেলছে। সকালে উঠে ঠিক করলাম আজ তাকে সেটা জোগাড় করে দেব। প্লাটিনাম কোথায় পাব আমি, তবে সোনা হয়তো পাওয়া যেতে পারে। ছোট খালার শরীর-ভরা গয়না, হাতে কয়েকটা আংটি, কানে দুল, হাতে চুড়ি। কোনো-একটা কি আর কিছুক্ষণের জনে সরিয়ে নেয়া যাবে না? টুকুনজিল নেবে মাত্র ছয় দশমিক তিন মিলিগ্রাম সোনা, ছোট খালা জানতেও পারবেন না।
সকালে নাস্তা করার সময় দেখতে পেলাম ছোট খালার আঙুলে আংটিগুলো নেই, তার মানে নিশ্চয় খুলে রেখেছেন। খুলে রাখার জায়গা খুব বেশি নেই, হয় শোয়ার ঘরে, ড্রেসিং টেবিলের উপরে, নাহয় লাগানো বাথরুমে। আমি ব্যবহার করি বল্টু আর সীমার বাথরুম, কাজেই কোনোরকম সন্দেহ সৃষ্টি না করে শোওয়ার ঘরে বাথরুমে যাওয়া সহজ নয়। তবে কপাল ভালো থাকলে হয়তো বাথরুম পর্যন্ত যেতে হবে না, ড্রেসিং টেবিলের উপরেই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে জন্যে আমাকে শোওয়ার ঘরে যেতে হবে। কী ভাবে যাওয়া যায়?
ছোট খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ছোট খালা, আজকের পেপার কি এসেছে?
এসেছে নিশ্চয়ই। কেন?
আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে বলেছে তার চাচার একটা খবর উঠবে আজকে। সরল মুখ করে একটা নির্দোষ মিথ্যা কথা বললাম।
কী খবর?
অবিরাম সাইকেল চালনা। ছিয়াত্তর ঘন্টা নাকি হয়েছে। মিথ্যা কথা বলার এই হচ্ছে সমস্যা, একটা বললে শেষ হয় না; সেটাকে সামলে নেবার জন্যে একটানা মিথ্যা বলে যেতে হয়।