খালু মাথা নাড়লেন, না, নেই।
ডাক্তার চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তোমার বাবাকে খুব ভালবাস, খুব কম বাচ্চা তার বাবাকে এত ভালবাসে।
আমি মাথা নাড়লাম।
কিন্তু তোমার বাবা পুরোপুরি স্বাভাবিক নন, তাই তাঁর সাথে তোমার কখনো সত্যিকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে নি। তোমার বুকের ভিতরে সেটা নিয়ে বুভুক্ষের মতো একটা ক্ষুধা আছে।
আমি আবার মাথা নাড়লাম।
এখানে এসে স্কুলে তোমার যে-স্যারের সাথে পরিচয় হয়েছে, সেই স্যারের সাথে তোমার বাবার একটু মিল রয়েছে। তুমি তোমার নিজের বাবার কাছে যেটা পাও নি, সেটা তোমার স্যারের মাঝে তুমি খোঁজা শুরু করেছ। তোমার স্যার খুব ভালো মানুষ, ছাত্রদের নিজের সন্তানের মতো করে দেখেন তুমিও গোপনে তাঁকে তোমার বাবার মতো করে দেখা শুরু করেছ। তোমার স্যার যেটাই বলেন তুমি সেটা গভীরভাবে বিশ্বাস করা তাঁকে খুশি করার জন্যে তোমার অবচেতন মন নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে। তাই যখন তোমার স্যার মহাকাশের প্রাণীর কথা বলেছেন, সেটাও তুমি এমনভাবে বিশ্বাস করেছ, যে—
ডাক্তার চাচা একটু থেমে খালুর দিকে তাকালেন, তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সত্যিই বিশ্বাস করা শুরু করেছ যে সত্যি সত্যি মহাকাশের একটা আগন্তুক তোমার কাছে এসে গেছে। এরকম হয়—একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষকে খুব ভালবাসে বা শ্রদ্ধা করে, তখন এরকম হয়। এর একটা ডাক্তারি নামও আছে।
আমি ঢোক গিলে বললাম, তার মানে আপনি বলছেন টুকুনজিল আসলে নেই?
টুকুনজিল?
হ্যাঁ। মহাকাশের আগন্তুককে আমি টুকুনজিল নাম দিয়েছি।
ও।
আপনি বলছেন টুকুনজিল আসলে নেই?
না। আসলে সব তোমার কল্পনা। মানুষ একটা জিনিস যদি খুব বেশি চায়, সেটা নিয়ে যদি তার ভিতরে একটা বড় ধরনের দুঃখ কিংবা ক্ষোভ থাকে, সেটা যদি সে তার প্রকৃত জীবনে না পায়, তখন সে সেটা কল্পনায় পেতে চেষ্টা করে। সেটা কোনো দোষের ব্যাপার নয়, সবার জীবনেই নানারকম ফ্যান্টাসি থাকে। খানিকটা ফ্যান্টাসি। থাকা ভালো। কিন্তু কখনো যদি কেউ কল্পনা এবং সত্যিকার জীবনে গোলমাল করে ফেলে, বুঝতে না পারে কোনটা কল্পনা এবং কোনটা সত্যি, তখন অসুবিধে। আমরা তাদের বলি মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। তোমার বাবা সেরকম একজন মানুষ। কল্পনা এবং বাস্তব জীবনের মাঝে পার্থক্যটা ধরতে পারেন না। তোমার ভিতরেও তার লক্ষণ আছে—
আমার ভিতরে?
হ্যাঁ। তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে, তাই তোমাকে সোজাসুজি বললাম। যদি তুমি নিজে একটু সতর্ক থাক, তাহলে নিজেই বুঝবে কোনটা সত্যি, কোনটা কল্পনা। যখন বুঝতে পারবে তুমি কল্পনাকে সত্যি মনে করছ, তখন নিজেকে জোর করে কল্পনার জগৎ থেকে সরিয়ে আনবে। কল্পনা করতে কোনো দোষ নেই, কিন্তু কল্পনাকে কখনো সত্যি বলে ভুল করতে হয় না। বুঝেছ?
বুঝেছি। আমার গলা শুকিয়ে গেল। তার মানে আমিও বাবার মতো পাগল।
তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমার ভিতরে অসম্ভব মনের জোরের চিহ্ন পেয়েছি। তুমি এর ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। আমি জানি। তোমার বাবার যেটা হয়েছে তোমার সেটা হবে না। কখনো হবে না। ঠিক আছে?
আমি মাথা নাড়লাম।
বাসায় এসে বালিশে মাথা রেখে আমি খানিকক্ষণ কাঁদলাম। আমি ভেবেছিলাম মহাকাশের রহস্যময় এক প্রাণীর সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। আসলে সব আমার পাগল-মাথার কল্পনা। সবাই এখন জেলে যাবে যে আমি পাগল। ছোট খালু বলবেন ছোট খালাকে ছোট খালা থেকে জানবে বল্টু আর মিলি। তাদের থেকে জানবে তাদের অন্য বন্ধুরা। সেখান থেকে একসময় জানরে আমার ক্লাসের ছেলেরা। সবাই তখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। কী লজ্জার কথা। একবার মনে হল ছাদ থেকে। লাফিয়ে পড়ে জীবন শেষ করে দিই। আরেকবার মনে হল সব ছেড়েছুড়ে আমি এখনই বাড়ি চলে যাই, সেখানে বাবার হাত ধরে আমরা দুইজন পাগল মানুষ নীল গাঙের তীরে বসে থাকি।
অনেকক্ষণ বসে বসে আমি ভাবলাম, তারপর নিজেকে সাহস দিলাম। ডাক্তার চাচা বলেছেল আমার মনের জোর আছে, আমি ভালো হয়ে যেতে পারব। আমি নিশ্চয়ই তার চেষ্টা করব। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। মন-খারাপ করে থেকে লাভ কি?
আমি সোজা হয়ে বিছানায় বসেছি আর সাথে সাথে ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর শুনলাম পরিষ্কার গুলায় কে যেন বলল, তোমার মস্তিষ্কের দুই পাশে অন্ত তরঙ্গ। অসামঞ্জস্য এবং ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম।
আমি চমকে উঠলাম। কী সর্বনাশ! আবার আমি টুকুনজিলের কথা শুনছি। আমি দুই হাতে কান চেপে ধরলাম, টুকুনজিলের কথা শুনতে চাই না আমি পাগল হয়ে যেতে চাই না। মনে মনে বললাম, চলে যাও চলে যাও তুমি।
আমি যাব না।
তুমি যাও। তুমি কল্পনা। তুমি মিথ্যা। আমি মনে মনে উচ্চারণ কতে থাকি, তুমি কল্পনা, তুমি কল্পনা, তুমি কল্পনা।
আমি কল্পনা না না না না। আমি টুকুনজিল।
আমার গলা শুকিয়ে গেল, আমি মুখে কোনো কথা উচ্চারণও করি নি, কিন্তু টুকুনজিল আমার কথার উত্তর দিচ্ছে। ডাক্তার চাচা তাহলে কি সত্যি কথাই বলেছেন? আসলেই সব কল্পনা? আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। আমি ভালো হয়ে যাব, এইসব উল্টোপাল্টা ব্যাপারকে কোনো পাত্তা দেব না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে বললাম, সব কল্পনা। সব কল্পনা।
না। কল্পনা না।
তুমি চলে যাও। আমার মন থেকে চলে যাও।