চল্লিশ দশমিক চার।
সেটা কম না বেশি?
কম? বেশি? কম বেশি? জিনিসটা উপরে-নিচে করতে থাকে।
আমি হাল ছাড়লাম না, জিজ্ঞেস করলাম, পিঁপড়াগুলো কি তোমাকে সাহায্য করতে পেরেছে?
লৌহ তাম্ৰ কোবাল্ট এবং অ্যান্টিমনি।
এগুলো এনে দিয়েছে?
বাস্তবিক। স্বর্ণ কিংবা প্রাটিনাম চাই। স্বর্ণ। স্বর্ণ।
সোনা দরকার তোমার?
বাস্তবিক।
সোনা না হলে কী হবে?
গতিবেগ রুদ্ধ।
কার গতিবেগ রুদ্ধ?
মহাকাশযানের।
কতটুকু দরকার?
ছয় দশমিক তিন মিলিগ্রাম। সেটা কতটুকু?
ছয় দশমিক তিন—ছয় দশমিক তিন—বলে জিনিসটা আবার ঘুরপাক খেতে থাকে। ছয় দশমিক তিন মিলিগ্রাম সোনা খুব বেশি নয়, কিন্তু যত কমই হোক, সোনা। আমি কোথায় পাব? আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
এন্ড্রোমিড। এন্ড্রোমিডা!
আমি অবাক হয়ে বললাম, এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে? সত্যি?
সত্যি? সত্যি? সত্যি?
সে তো অনেক দূরে। কেমন করে এলে?
স্পেস টাইম সংকোচনের অস্থিতিশীল অবস্থায় মূল কম্পনের চতুর্থ পর্যায়ের সর্বশেষ বিফোরণের ফলে যে সময় পরিভ্রমণের ক্রান্তিধারা হয় তার দ্বিতীয় পর্যায়ে……
আমি হাত তুলে থামালাম, তুমি একা এসেছ?
একা? একা? একা?
কতদিন থাকবে তুমি?
স্বর্ণ স্বৰ্ণ স্বর্ণ চাই। ছয় দশমিক তিন মিলিগ্রাম স্বর্ণ চাই। আমার গতিবেগ রুদ্ধ।
ঠিক এই সময়ে দরজা খুলে ছোট খালা মাথা ঢোকালেন। বললেন, বিলু–
আমি ভীষণ চমকে উঠলাম, ছোট খালা?
এত রাতে জেগে একা একা কথা বলছিস কেন?
আমি মানে ইয়ে মানে আমি থতমত খেয়ে থেমে গেলাম। ছোট খালা ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে, তারপর বললেন, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমা।
আমি তাড়াতাড়ি মশারি ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ছোট খালা বাতি নিভিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলেন। সাথে সাথে ঘরের কোনা থেকে জিনিসটি বের হয়ে এল, বলল, বিভ্রাম্ভ হোমোস্যাপিয়েন।
আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি?
নাম? নাম? নাম?
হ্যাঁ, নাম।
সাত তিন আট দশমিক চার চার দুই মাত্রা সাত নয় উল্টো মাত্র ছয় ছয় পাঁচ–
এটা তো নাম হতে পারে না। নাম হতে হবে ছোট।
ছোট?
হ্যাঁ, ছোট।
জিনিসটা এবার অদ্ভুত একটা শব্দ করল। হাঁচি আটকে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ হাঁচি বের হয়ে গেলে নাক এবং মুখ দিয়ে যেরকম অদ্ভুত একটা শব্দ বের হয়, শব্দটা অনেকটা সেরকম। আমি দু’বার সেটা অনুকরণ করার চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ হল না। বললাম, তোমাকে অন্য একটা নাম দিই, যেটা ডাকা যায়?
অনা নাম? নূতন নাম?
হ্যাঁ। তুমি যখন ছোট, তাই ছোট একটা নাম। ছোটন কিংবা টুকুন।
টুকুন? টুকুন? জিনিসটি ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ করতে শুরু করল।
হ্যাঁ, তুমি যদি চাও তাহলে টুকুন ঝিঁঝি হতে পারে। কিংবা টুকুনজিল–
টুকুনজিল টুকুনজিল টুকুনজিল জিনিসটা আমার মশারির চারদিকে ঘুরতে থাকে। আমার মনে হয় নামটা তার পছন্দ হয়েছে।
ঠিক আছে, তা হলে তোমার নাম হোক টুকুনজিল।
টুকুনজিল হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, বিভ্রান্ত হোমোস্যাপিয়েন।
বিভ্রান্ত কে?
বিভ্রান্ত এবং আতঙ্কিত হোমোস্যাপিয়েন।
আতঙ্কিত কে?
বিভ্রান্ত এবং আতঙ্কিত এবং স্তম্ভিত হোমোস্যাপিয়েন।
আমি হঠাৎ করে ছোট খালার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার দরজার কাছ কেদূত হেঁটে নিজের ঘরে যাচ্ছেন। এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিলেন। কী সর্বনাশ।
০৮. ডাক্তার
সকালে ছো খালু জামাকাপড় পরে আমার ঘরে এসে বললেন, বিলু, আজকে তোমার স্কুলে যেতে হবে না।
স্কুলে যাব না?
না।
কেন খালু?
আমার সাথে একটু বাইরে যাবে।
বা-বাইরে? কোথায়?
একজনের সাথে দেখা করতে।
ছোট খালু বেশি কথা বলেন না, আমার তাই কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। কাল রাতের ব্যাপার নিয়ে কি কিছু হয়েছে?
কি ব্যাপার একটু পরেই বল্টুর কাছে জানতে পারলাম। সে আমার ঘরে উঁকি দিয়ে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বল্টুর পিছনে মিলি। বল্টু মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, কাছে যাস না, কামড়ে দেবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কে কামড়ে দেবে?
তুমি।
আমি? কেন?
তোমার বাবার মতো তুমিও পাগল হয়ে যাচ্ছ। মা বলেছে।
আমি? আমি পা–পা–
মিলি বণ্টকে ধমক দিয়ে বলল, ভাইয়া, মা বলতে না করেছে না?
চুপ।
আমি উঠে দাঁড়াতেই বল্টু ছুটে বের হয়ে গেল, তার পিছনে পিছনে মিলি। দু’জনেই ভয় পেয়েছে আমাকে দেখে। আমার এমন মন-খারাপ হল যে বলার নয়।
গাড়িতে ছোট খালু বেশি কথা বললেন না। একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন, রাতে ভালো ঘুম হয়েছে, বিলু?
জ্বি, হয়েছে।
কখনো ঘুমাতে অসুবিধে হয় তোমার?
না, খালু।
বেশ, বেশ।
সারা রাস্তা আর কোনো কথা হল না। আমি গাড়িতে বসে এদিকে-সেদিকে দেখছিলাম, তখন দেখলাম একটা মাইক্রোবাস আমাদের গাড়ির পিছনে পিছনে আসছে। আমার মনে হল এই মাইক্রোবাসটাকে কয়দিন থেকে বাসার সামনে দেখছি। একটু পরে অবশ্যি মাইক্রোবাসটার কথা ভুলে গেলাম, এখানে তো কত মাইক্রোবাসই আছে।
মতিঝিলের কাছে একটা উঁচু দালানে লিফট দিয়ে আমাকে নিয়ে উঠে গেলেন ছোট খালু। একটা সরু করিডোর ধরে হেঁটে একটা বন্ধ দরজায় টোকা দিলেন। দরজায় সোনালি অক্ষরে লেখা ডঃ কামরুল ইসলাম, নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ।
ডাক্তার ছোট খালুর খুব বন্ধুমানুষ হবেন। দেখলাম একঞ্জন আরেকজনকে দেখে বাচ্চাদের মতো পেটে খোঁচা দিয়ে কথা বলছেন। আর একটু পরপর হো হো করে হাসছেন। আমি এর আগে ছোট খালুকে কখনো জোরে হাসতে দেখি নি। একটু পর দু’জনেই সরে গিয়ে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, কারণ দু’জনেই খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন, আর “প্রেশার কালচার” ডিজওর্ডার” “ব্রাইট” এরকম কঠিন কঠিন কয়েকটা শব্দ শুনতে পেলাম আমি। একটু পর ছোট খালু আমার কাছে এসে বললেন, বিলু, এ হচ্ছে ডক্টর কামরুল, তোমার ডাক্তার চাচা। তোমার সাথে খানিকক্ষণ কথা বলবেন। তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করবেন তুমি তার ঠিক উত্তর দেবে। ঠিক আছে?