আমি আমতা আমতা করে বললাম, কারো সাথে না, ছোট খালা।
প্রাণীটা তখনও চিৎকার করছে, দায়িত্বহীন হোমাস্যাপিয়েন।
ছোট খালা মনে হল কিছু-একটা শুনলেন, ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন, ঘরে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে?
আমি ঢোক গিলে বললাম, হ্যাঁ।
ছোট খালা খানিকক্ষণ ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। আমি তখন আর শিশিটা বের করার সাহস পেলাম না। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হবে। খুব সাবধানে।
রাতে খাবার টেবিলে আমি ছোট খালুকে জিজ্ঞেস করলাম, খালু, কেউ যদি মহাকাশের সেই প্রাণীকে দেখতে পায় তাহলে তার কী করা উচিত?
খালু অবাক হয়ে বললেন, মহাকাশের কী প্রাণী?
আমি বললাম, খবরের কাগজে যে উঠেছে।
কী উঠেছে?
আমি খবরটা বললাম, ছোট খালু খবরটাকে মোটেও গুরুত্ব দিলেন না। হাত নেড়ে বললেন, ধুর, সব লোকঠকানোর ফন্দি। খবরের কাগজ বিক্রি করার জন্যে যত সব গাঁজাখুরি গল্প।
কিন্তু যদি সত্যি হয় তাহলে কার সাথে যোগাযোগ করবে?
সত্যি হবে না। যদি হয়?
ছোট খালু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর ইতস্তত করে বললেন, পুলিশকে নিশ্চয়ই।
সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি বালিশের নিচে থেকে ছোট শিশিটা বের করলাম, ভিতর থেকে একটা হালকা নীল আলো বের হচ্ছে। কাছে মুখ নিয়ে বললাম, হে মহাকাশের আগন্তুক।
ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল, তারপর শুনলাম সেটি বলল, বিলু। দায়িত্বহীন হোমোস্যাপিয়েন।
প্রাণীটা আবার আমাকে গালি দিচ্ছে, আমার এত খারাপ লাগল যে বলার নয়। ধতমত খেয়ে বললাম, আমি আসলে বুঝতে পারি নি, একেবারেই বুঝতে পারি নি–
ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল, তারপর একটা কাতর শব্দ করল প্রাণীটা, বলল, বিপদ, মহাবিপদ, আটানব্বই দশমিক তিন চার বিপদ–
কার বিপদ?
আমার।
কী বিপদ?
প্রাণীটা কোনো কথা না বলে বিবি পোকার মতো শব্দ করতে স্বাক। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী বিপদ? কী হয়েছে?
প্রাণীটা কোনো উত্তর দিল না, ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ করতে থাকল। আমার মনে হল শব্দটা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসছে। প্রাণীটা যদি মরে যায় তখন কী হবে?
আমার তখন এই প্রাণীটার জন্যে এত মন-খারাপ হয়ে গেল, বলার নয়। আহা বেচারা, না-জানি কোন দূর-দূরান্তের এক গ্রহ থেকে এসে এখানে কী বিপদে পড়েছে। কি বিপদ বলতেও পারছে না। বাংলা যে বলতে পারে সেটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। মানুষের মতো কথা বলে না, অন্যরকমভাবে বলে, তাই সবাই শুনে বুঝতে পারে না। ছোট খালা যেরকম বোঝেন নি। এখন এত দুর্বল হয়ে গেছে যে আর কথাও বলতে পারছে না। কী করা যায় আমি চিন্তা করে পেলাম না। ছোট খালুকে কি ডেকে তুলে বলব? কিন্তু কী বলব? মহাকাশের প্রাণী একটা হোমিওপ্যাথিক শিশিতে অসুস্থ হয়ে আছে? একজন ডাক্তার ডাকা দরকার? হোট খালু তো বিশ্বাসই করবেন না। স্যারকে বলতে পারলে হত, কিন্তু এই মাঝরাতে স্যারকে আমি কোথায় পাব?
আমি অনেকক্ষণ বসে বসে চিন্তা করলাম। প্রাণীটাকে যখন পেয়েছি তখন সেটাকে ঘির ছিল অসংখ্য পিঁপড়া। পিঁপড়াগুলো মনে হচ্ছিল প্রাণীটাকে কোনোভাবে সাহায্য করছিল। প্রাণীটা যদি আমার সাথে কথা বলতে পারে, নিশ্চয়ই তাহলে পিঁপড়াদের সাথেও কোননারকম কথা বলতে পারে। মানুষের মতো পিঁপড়াদের এত বুদ্ধি নেই, তাদের সাথে কথা বলা হয়তো আরো সহজ। আমি আবার যদি প্রাণীটাকে পিঁপড়াদের মাঝে ছেড়ে দিই, তাহলে কি কোনো লাভ হবে?
কোনো ক্ষতি তো আর হতে পারে না।
আমি খুঁজে খুঁজে কয়েকটা পিঁপড়া বের করে শিশিটার কাছে এনে ছেড়ে দিলাম। পিঁপড়াগুলো সাথে সাথে শিশিটাকে ঘিরে ঘুরতে শুরু করল, আর কী অবাক কাণ্ড, কিছুক্ষণের মাঝে দেখি পিঁপড়ার একটা সারি শিশিটার দিকে এগিয়ে আসছে। শিশিটাকে গোল হয়ে ঘিরে পিঁপড়াগুলো দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।
ভিতর থেকে আবার ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ হতে থাকে, শব্দটি আগের থেকে অনেক দুর্বল। আমি সাবধানে শিশিটার মুখ খুলে দিলাম, সাথে সাথে একটা পিঁপড়া ভিতরে ঢুকে গেল। সেটা বের হয়ে এল একটু পরে, তখন আরেকটা পিঁপড়া ভিতরে গিয়ে ঢুকল। সেটা বের হয়ে এলে আরেকটা। পিঁপড়াদের মাঝে একটা উত্তেজনা, ছুটে যাচ্ছে ছুটে আসছে, মুখে করে কিছু-একটা আনছে, কিছু-একটা নিয়ে যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।
আমি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দটা অনেক বেড়েছে। আমি শিশিটার ভিতরে তাকালাম, সেখানে কিছু নেই। শব্দটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্যে আমি এদিকে-সেদিকে তাকালাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা নীল আলো ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করে সেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে ঠিক নাকের কাছাকাছি থেমে গেল, শুনলাম সেটা বলল, মস্তিষ্কের কম্পন স্তিমিত, শারীরিক নিয়ন্ত্রণ লুপ্ত–।
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম?
হ্যাঁ।
সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় সময়ের অপচয়। সময়ের অপচয়—
জিনিসটা ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠে গিয়ে আবার নিচে নেমে এল। বলল, বুদ্ধিমত্তার হার শতকরা চুয়াল্লিশ দশমিক তিন।
কার?
তোমার।
সেটা ভালো না খারাপ?
ভালো? খারাপ? ভালো খারাপ জিনিসটা উত্তর না দিয়ে আবার ঘুরপাক খেতে থাকে। মনে হচ্ছে এর সাথে কথাবার্তা চালানো খুব সহজ নয়। কিন্তু যে-বিপদের কথা বলছিল সেটা মনে হয় কেটে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মহাবিপদ হয়েছিল বলেছিলে, সেটা কেটেছে?