পুরো ক্লাস স্যারের সাথে একমত হল। স্যার খানিকক্ষণ হেঁটে আবার বললেন, তারপর চিন্তা করে দেখ, পৃথিবীটা কত সুন্দর, সেই মহাকাশের প্রাণী দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষের সাথে যখন তার পরিচয় হবে তখন মনে হয় সে পৃথিবী ছেড়ে যেতেই চাইবে না। কী বলিস তোরা?
আমরা সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। স্যার বাচ্চা মানুষের মতো ছটফট করতে করতে বললেন, কিন্তু মহাকাশযানটাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? বিজ্ঞানীরা সেটাকে দেখতে পেল না কেন?
লিটন বলল, আমি একটা বইয়ে পড়েছি, বোমা ফেলার জন্যে প্লেন তৈরি করেছে যেটা নাকি রাডারে দেখা যায় না। সেরকম কিছু–
স্যার চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু সেটা তো যুদ্ধ করার প্লেন। মহাকাশের একটা প্রাণী কি যুদ্ধ করতে আসবে?
লিটন বলল, আমি যে সিনেমাটা দেখেছি—
তারিক বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু টেলিস্কোপ দিয়েও তো দেখতে পারে নাই।
স্যার মাথা নাড়লেন, তা ঠিক। তা ঠিক।
মাহবুব বলল, অদৃশ্য কোনো জিনিস দিয়ে হয়তো তৈরি।
অদৃশ্য জিনিস তো কিছু নেই, স্যার মাথা নাড়লেন, যেখান থেকেই আসুক সেটা তৈরি হতে হবে একই জিনিস দিয়ে, যে-এক শ’ চারটা মৌলিক পদার্থ আছে, তার বাইরে তো কিছু থাকতে পারে না।
ক্লাসে সবচেয়ে যে কম কথা বলে, সুব্রত, আস্তে আস্তে বলল, এমন কি হতে পারে যে মহাকাশের প্রাণী সাইজে অনেক ছোট হয়, পিঁপড়ার মতো, কিংবা আরো ছোট, যে খালিচোখে দেখা যায় না?
সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। স্যার নিজেও হাসতে হাসতে ধমক দিলেন সবাইকে, হাসছিস কেন তোরা বোকার মতো? হাসছিস কেন? ছোট তো হতেই পারে—
হাসতে হাসতে হঠাৎ আমি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো করে চমকে উঠলাম। আমার সেই বিচিত্র পোকাটার কথা মনে পড়ল আর হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সুব্রত ঠিকই বলেছে, বিজ্ঞানীরা সেটাকে দেখতে পায় নি, কারণ সেটা অনেক ছোট, আমি সেটাকে পেয়েছি, পেয়ে হোমিওপ্যাথিক শিশির মাঝে আটকে রেখেছি।
চিৎকার করে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠছিলাম, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম। স্যার একটু অবাক হয়ে বললেন, কি রে বিলু, কিছু বলবি?
না না না, স্যার। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ইয়ে, মানে—বলছিলাম, মহাকাশের প্রাণী তো ছোট হতে পারে। পারে না, স্যার?
পারবে না কেন? অবশ্যি পারে। সব প্রাণীরই যে আমাদের মতো সাইজ হতে হবে কে বলেছে? ডাইনোলোর কত বড় ছিল, জীবাণু কত ছোট। কাজেই একটা প্রাণীকে কত বড় হতে হবে তার তো কোনো নিয়ম নেই।
স্যার আরো কি কি বললেন, কিন্তু আমি কিছু শুনছিলাম না। আমার বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ডে ঢাকের মতো শব্দ করছে, উত্তেজনায় নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, হাত অল্প অল্প কাঁপছে। আমি সত্যিই কি মহাকাশের সেই প্রাণীটাকে ধরেছি?
বাসায় গিয়ে সেই প্রাণীটাকে আবার দেখতে হবে, কিন্তু স্কুল ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছিলাম না, তাই অঙ্ক ক্লাসে পেট চেপে কোঁ কোঁ করে স্যারকে বললাম, খুব পেটব্যথা করছে সার, বাসায় যেতে হবে এক্ষুণি।
অঙ্ক-স্যার যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন জানতাম না। সকালে কি খেয়েছি, রাতে কি খেয়েছি, দাস্ত হয়েছে কি না, বাহ্যি হয়েছে কি না এইসব একগাদা প্রশ্ন করে দুই দানা আন্টিমনি সিক্স হানড্রেড খাইয়ে বেঞ্চে শুইয়ে রাখলেন। স্যার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন আর পকেটে নানারকম ওষুধ নিয়ে ঘুরে বেড়ান জানলে কখনোই সারকে পেটব্যথার কথা বলতাম না! শক্ত বেঞ্চে শুয়ে থাকা আরামের কিছু ব্যাপার নয়, তাই একটু পরে বললাম যে আমার পেটব্যথা কমে গেছে। শুনে অজ্ঞ স্যারের মুখে কী হাসি।
বিকেলে বাসায় এসে আমি দৌড়ে আমার ঘরে গেলাম। বালিশের নিচে হোমিওপ্যাথিক শিশিতে সেই পোকাটি রেখেছিলাম যেটা হয়তো আসলে মহাকাশের সেই রহস্যময় প্রাণী। আমি সাবধানে সেই শিশিটা হাতে নিলাম, এক কোনায় কালো বিন্দুর মতো সেই জিনিসটি। আমি আস্তে আস্তে শিশিতে একটা টোকা দিলাম, সাথে সাথে ঝিঁঝি পোকার মতো একটা শব্দ হল, তারপর ভিতর থেকে কে যেন ক্ষীণ স্বরে বলল, সাবধান।
উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হল। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা বের করে ভালো করে সেটাকে দেখার চেষ্টা করলাম, অবিশ্বাস্য রকম জটিল একটা যন্ত্র। তার ভিতর থেকে একটা ফুটো দিয়ে মাথা বের করে একটি অত্যন্ত ছোট। প্রাণী আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সত্যি সত্যি একটা বড় মাথা আর দুটি চোখ। বুদ্ধিমান প্রাণীর যে-রকম থাকার কথা। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
প্রাণীটি খানিকক্ষণ ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ করল, তারপর বলল তুমি কে?
আমি বিলু।
বিলু। বিলু দায়িত্বহীন হোমাস্যাপিয়েন।
হোমোস্যাপিয়েন মানে মানুষ, প্রাণীটি আমাকে দায়িত্বহীন মানুষ বলছে, আমি নিশ্চয়ই কিছু-একটা কাজ খুব ভুল করেছি। ঢোক গিলে বললাম, আমি আসলে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই নি, আমি তোমাকে সাহাযা করতে চাই
ঠিক তখন ছোট খালা ঘরে উঁকি দিলেন, আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে কথা বলছিস রে, বিলু?
আমি চট করে শিশিটা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেললাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না, প্রাণীটা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, দায়িত্বহীন হোমোস্যাপিয়েন। দায়িত্বহীন হোমোস্যাপিয়েন!!
ছোট খালা প্রাণীটির কথা শুনতে পেলেন বলে মনে হল না, আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে কথা বলছিলি?