আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবার মতো আমিও কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? পোকামাকড়ের কথা শুনতে পাচ্ছি? কী সর্বনাশ।
খানিকক্ষণ আমি ছাদে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বিচিত্র পোকাটাকে একটা রাম-থাবড়া দিয়ে চ্যাপ্টা করে ফেলৰ কি না ভাবলাম একবার। কিন্তু করলাম না, নিচে থেকে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি নিয়ে এলাম। পোকাটাকে ঘিরে পিঁপড়াগুলো এখনো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবে মনে হল তাদের মাঝে উত্তেজনা অনেক বেড়েছে। আমি একটা কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে জিনিসটাকে শিশির ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করলাম। ব্যাপারটা সোজা নয়, মনে হল সেটা থেকে কিছু আগুনের ফুলকি বের হয়ে এল। আর তার থেকেও বিচিত্র ব্যাপার, কে জানি বলল, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমাকে।
আমি ছেড়ে দিলাম না, সেই বিচিত্র পোকাটিকে হোমিওপ্যার্থিক শিশির মাঝে ভরে ফেললাম।
পোকাটির কথা কাউকে বলার ইচ্ছা করছিল। প্রথমে বল্টুকে বলার চেষ্টা করলাম, বললাম, ছাদে একটা পোকা দেখেছি আমি। দেখলে অবাক হয়ে যাবে।
কেন?
পোকাটা কথা বলে—বলতে গিয়ে থেমে গেলাম আমি, বাবার কথা মনে পড়ল হঠাৎ।
বললাম, নিচে দিয়ে আগুন বের হয়। ও।
এটার নাম জোনাকি পোকা।
না, জোনাকি পোকা না, জোনাকি পোকা আমি চিনি। জোনাকি পোকা থেকে অনেক ছোট।
জোনাকি পোকার বাচ্চা।
কাছে মিলি দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ইয়াক থুঃ, পোকা। ছিঃ ছিঃ।
কাজেই আলাপ বেশি দূর এগুতে পারল না। দুলাল থাকলে হত। বিচিত্র ব্যাপারে তার খুব উৎসাহ। দুই মাথাওয়ালা বাছুর হয়েছে শুনলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে সে দশ মাইল হেঁটে দেখতে যায়। বাবা থাকলেও হত, পোকামাকড়ের কথা এমনিতেই শুনতে পান, এটার কথা নিশ্চয়ই আরো ভালো করে শুনতেন।
রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যি আমি মোটামটি পোকাটার কথা ভুলে গেলাম। একটা পোকা কথা বলছে, সেটা তো হতে পারে না। ত রাস্তায় অন্য কোনো মানুষ কারো সাথে কথা বলেছে, আর আমার মনে হয়েছে আমার সাথে কথা বলেছে। বাতি নেতানোর জন্যে যখন উঠেছি, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালাম, রাস্তায় বাসার সামনে দুটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। এত রাতে এখানে। মাইক্রোবাস করে কে এসেছে কে জানে!
০৭. মহাকাশের প্রাণী
ক্লাসে ঢুকেই স্যার পকেট থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে বললেন, কে কে আজ খবরের কাগজ পড়েছে?
দেখা গেল কেউ পড়ে নি। লিটন বলল, কাগজে শুধু রাজনীতির খবর থাকে, স্যার, তাই পড়তে ইচ্ছা করে না।
স্যার বললেন, যে-খবরই থাকুক, খবরের কাগজ পড়তে হয়। স্যার জোরে জোরে পড়লেন, মহাকাশের আগন্তক।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, রেডিওতে শুনেছি স্যার এটা আমি! এটা কি সত্যি?
স্যার মাথা নেড়ে বললেন, মনে তো হচ্ছে সত্যি!
অন্য সব ছেলেরা তখন কৌতূহলী হয়ে উঠেছে, স্যার তাই পুরো খবরটা পড়ে শশানালেন। আমি রেডিওতে যেটা শুনেছি মোটামুটি সেই খবরটাই, তবে খুঁটিনাটি আরো কিছু বর্ণনা আছে। আমেরিকার এক মানমন্দিরের ডিরেক্টরের কথা আছে, অস্ট্রেলিয়ার একজন মহাকাশবিজ্ঞানীর কথা আছে। সবাই বলেছে যে তারা মোটামুটি নিঃসন্দেহ যে সত্যি একটি রহস্যময় মহাকাশযান পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছিল। তার সাথে নাকি যোগাযোগও করা হয়েছিল। মহাকাশযানটি দেখার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, বেশ কয়েকটি কত্রিম উপগ্রহ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে রাডার দিয়ে চেষ্টা করা। হয়েছে, পৃথিবীর সব টেলিস্কোপ দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মহাকাশযানটি পৃথিবীতে নামার চেষ্টা করেছিল, হয়তো ঠিকমতো নামতে পারে নি, হতে পারে কোনোভাবে বিধ্বস্ত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা যে–এলাকায় সেটা বিধ্বস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন, তার মাঝে বাংলাদেশ, বার্মা, ভিয়েতনাম, প্রশান্ত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চল রয়েছে। পুরো এলাকায় খুব খোঁজাখুজি হচ্ছে। আশ্চর্যজনক কিছু দেখলে সাথে সাথে কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা বলা হয়েছে।
সারা ক্লাস খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। স্যার পায়চারি করতে করতে বললেন, চিন্তা করতে পারিস, যদি সত্যি সত্যি অন্য একটা গ্রহ থেকে একটা প্রাণী এসে হাজির হয় তাহলে কী মজাটাই হবে? দেখতে কেমন হবে বলে মনে হয় তোদের?
লিটন বলল, আমি সেদিন একটা সিনেমা দেখেছিলাম, স্যার। সেখানে দেখিয়েছিল, দেখতে খুব ভয়ঙ্কর।
স্যার বললেন, সিনেমা তো গাঁজাখুরি, আসলে কেমন হবে?
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম, বুদ্ধিমান প্রাণীরা দেখতে নাকি মানুষের মতনই হওয়ার কথা। বড় একটা মগজ থাকবে তার কাছাকাছি থাকবে চোখ, দূরত্ব বোঝার জন্যে সবসময় হতে হবে দুটো চোখ–
হাত?
আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটা কিছু বলে নি। কিন্তু কিছু ধরার জন্য আঙুল না হয় গুড় থাকতে হবে।
স্যার মাথা নাড়লেন, ঠিকই বলেছিস। কোন গ্রহ থেকে আসছে তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে। সেই গ্রহ কত বড়, মাধ্যাকর্ষণ বল কত বেশি, বাতাস আছে কি নেই, থাকলে কি কি গ্যাস আছে, এইসব। কী মনে হয় তোদের? প্রাণীটা কি হাসিখুশি হবে, নাকি বদরাগী?
লিটন বলল, বদরাগী হবে, স্যার। মহাকাশের প্রাণী সবসময় খুব ডেঞ্জারাস হয়। সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে। টিভিতে একটা সিনেমা দেখিয়েছিল—
স্যার বললেন, ধুর। সিনেমা সবসময় গাঁজাখুরি হয়। আমার মনে হয় প্রাণীটা হবে খুব মিশুক। কদুর থেকে পন্ধিবীতে বেড়াতে এসেছে ভেবে দেখ। সে যদি মিশুক না হয় তাহলে কে মিশুক হবে?