বুদ্ধিজীবী রবোট খানিকক্ষণ অবাক হয়ে হাসা এবং হাসির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, আমরা গত দুই শতাব্দী চেষ্টা করে যেটা করতে পারি নি আপনারা এক সপ্তাহে সেটা করে ফেলেছেন। আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
টুকি এতক্ষণে নিজেকে সামলে ফেলেছে, এক গাল হেসে বলল, এটা কোন ব্যাপারই নয়। এর থেকে হাজার গুণ কঠিন কাজ আমরা করতে পারি।
বুদ্ধিজীবী রবোট কোনমতে নিজের তাল সামলে রেখে বলল, এ ব্যাপারে আমাদের এখন বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
ঝা ইতস্তত করে বলল, আমরা কী এখন আমাদের মহাকাশযানে ফিরে যেতে পারি?
অবশ্যি। অবশ্যি ফিরে যেতে পারেন। আমরা রবোটেরা যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে খল, ফন্দিবাজ, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব তখন কৃতজ্ঞতার সাথে আপনাদের সাথে স্মরণ করা হবে।
টুকি মুখে জোর করে হাসি ফুটয়ে বলল, শুনে খুব খুশী হলাম।
রবোটদের নেতা অনেকক্ষণ কোন কথা বলে নি এবারে এগিয়ে এসে বলল, আপনাদের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া যেন আরো আনন্দময় হয় সে জন্যে আমরা একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
টুকি শুকনো মুখে বলল, কী ব্যবস্থা?
আপনারা মাত্র দুজন মানুষ, তৃতীয়জন রবোট। আপনাদের নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে আপনাদের রবোট রোবির আপনাদের মতই রাগ দুঃখ আনন্দ ঘৃণা এরকম অনুভূতি থাকুক।
টুকি বিস্ফারিত চোখে রবোটটির দিকে তাকাল। সেটি গলায় এক ধরনের আনন্দের ভাব ফুটিয়ে বলল, রোবির ভিতরে আমরা আমাদের বিভিন্ন অনুভূতির ল্যাবরেটরি থেকে অনুভূতিগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছি।
কী-কী-কী বললে?
হ্যাঁ। এখন তোমাদের দীর্ঘ ভ্রমণ হবে আনন্দময়। রোবি এখন আর শুধু যন্ত্র নয়। সে অনুভূতিপ্রবণ একটি সত্তা। শুধু একটি জিনিস খেয়াল রেখ।
কী জিনিস?
কখনো যেন রোবিকে রাগিয়ে দিও না। জানই তো রোবট রেগে গেলে কী সাংঘাতিক অবস্থা হয়।
টুকি এবং ঝা শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। ঝা বিড় বিড় করে বলল, না, ভয় নেই। আমরা রোবিকে রাগাব না। কখনোই রাগাব না।
০৭. জানালার কাছে বসে
জানালার কাছে বসে টুকি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে রাবি বসেছিল সে বিরক্ত ভঙ্গী করে ঘুরে টুকির দিকে তাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, কী হল? এরকম লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছ কেন? মহাকাশযানের ভিতরে ভাল লাগছে না?
টুকি সাথে সাথে বিগলিত ভঙ্গী করে বলল, না, না, কী যে বল। চমৎকার লাগছে আমাদের। চমৎকার লাগছে।
ঝাও যন্ত্রের মত মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার লাগছে।
রোবি গলার স্বরে অধৈর্যের ভাব ফুটিয়ে বলল, দিনরাত দেখি ভ্যাবলার মত বসে আছ। একটু কাজকর্ম করতে পার না?
সাথে সাথে টুকি এবং ঝা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, অবশ্যি করতে পারি। কী করতে হবে বল?
মহাকাশযানটা যে একটা আঁস্তাকুড় হয়ে আছে খেয়াল করেছ? এটা একটু পরিষ্কার করা যায় না?
টুকি এবং ঝা সাথে সাথে মহাকাশযানটাকে ঘসে মেজে পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। রবোটদের গ্রহে রোবির কপোট্রনে নানারকম অনুভূতি জুড়ে দেবার পর রোবির বড় পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ সময় সে তিরিক্ষ মেজাজে থাকে, মাঝে মাঝে অকারণে তার মন খারাপ হয়ে যায় তখন কয়েকঘন্টা উচ্চস্বরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। তার কাছে তখন যাওয়া যায় না। কারণ সে যেভাবে হাত পা ছুড়তে থাকে যে ধারে কাছে গিয়ে বেকায়দা লেগে গেলে কম্পাউন্ড ফ্রাকচার হয়ে যাবার আশংকা থাকে। টুকি এবং ঝায়ের কোন কোন কাজকর্ম দেথে হঠাৎ হঠাৎ রোবির মাঝে প্রবল ঘৃণাবোধ জেগে উঠে তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে টুকি ঝা এবং সমস্ত মনুষ্য জাতিকে গালি-গালাজ করতে থাকে। কখনো কখনো তার মনে আনন্দের ভাব এসে যায়, সেটি আরো বিপজ্জনক তখন সে টুকি এবং ঝাকে ধরে নাচানাচি করার চেষ্টা করতে থাকে। টুকি কিংবা ঝ দুজনেরই মধ্যবয়স, নাচানাচি করার সময় অনেক দিন হল চলে গিয়েছে, চেষ্টা করে তাদের বিশেষ বিড়ম্বনা হয়। সব মিলিয়ে বলা যায় তাদের জীবন এই মহাকাশযানে বিষময় হয়ে আছে। কবে আরো তিন সপ্তাহ পার হবে, তারা ছোট নক্ষত্রটির পাশে পৌঁছে হাইপার ডাইভ দিয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দেবে সেই আশায় হা করে বসে আছে।
কিন্তু তার আগেই তাদের গতিপথে একটা ছোট গ্রহ পাওয়া গেল। রোবি গ্রহটাকে একপাক ঘুরে এসে বলল, এইখানে নামা যাক।
টুকি ভয়ে ভয়ে বলল, নামার দরকারটা কী? কে না কে আছে আবার নতুন কোন ঝামেলায় পড়ে যাব।
রোবি গলার স্বরে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, এখানে কেউ নেই। কেমন করে জান?
কারণ মানুষ রবোট যাই থাকুক তাদের জন্যে শক্তির দরকার। শক্তি খরচ হলে বায়ুমণ্ডলে তার চিহ্ন থাকে। রেডিয়েশান হিসেবে, বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড, ওজোন লেয়ার বা অন্য কোনভাবে। এখানে সেরকম কিছু নেই।
ঝা বলল, কিন্তু গ্রহটা ফাঁকা বলেই কী নামতে হবে? সবকয়টা ফাঁকা গ্রহে যদি নামতে নামতে যাই তাহলে তো একশ বছর লেগে যাবে–
রোবি একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর বেকুব কোথাকার। আমরা কী মশকরা করার জন্যে নামছি? হাইপার ডাইভ দেবার আগে বড় ইঞ্জিনটা সার্ভিস করতে হবে, সে জন্যে নামছি।
ঝা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যি অবশ্যি।
ফাঁকা গ্রহটিতে মহাকাশযানটি মোটামুটি নিরাপদভাবে নামল। রোবির কথা সত্যি, ধূ ধূ প্রান্তর কোথাও জন-মানব সভ্যতার চিহ্ন নেই। লাল রংয়ের পাথর ছড়ানো, দেখে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।