আমি আসলে রোবট।
ইরন চমকে উঠে বলল, কী বললে?
হ্যাঁ। একটু আগে আমি জানতে পেরেছি।
কী বলছ তুমি? আমি তোমার রক্ত পরীক্ষা করে দেখেছি–
সেটা কীশার রক্ত। আমার শরীরটা কীশার মস্তিষ্কটা কীশার নয়। অ্যাক্সিডেন্টের পর সেটা পাল্টে দিয়েছে। আমার রক্তে তুমি নিশ্চয়ই গ্রুপ থ্রি ধাতব পদার্থের অবশিষ্ট পেয়েছ। পাও নি?
হ্যাঁ।
আমার কপোট্রনের চিহ্ন, নতুন ধরনের কপোট্রন রক্ত দিয়ে শীতল করতে পারে।
ইরন তার বিছানা থেকে নেমে এল, বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, আমি বিশ্বাস করি না কীশা।
তাতে কিছু আসে–যায় না। আমি বিশ্বাস করি। আমার কপোট্রনে সব প্রোগ্রাম করে রাখা ছিল, যখন যেই তথ্যের প্রয়োজন হয়েছে তখন সেই তথ্যটি বের করে দেওয়া হয়েছে। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলে। এখন আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। এখন আর কিছু গোপন রাখার নেই, তাই আমাকে পুরো তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন সবকিছু জানি? প্রজেক্ট আপসিলন কী, কেন শুরু হয়েছে, কারা শুরু করেছে, আমি সবকিছু জানি।
কারা শুরু করেছে? কেন শুরু করেছে?
জানতে চেয়ো না, ঘেন্নায় বমি করে দেবে।
ইরন একটু অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা মাথা নিচু করে বলল, এই অভিযানে আমরা সবাই পরিত্যাগযোগ্য তুচ্ছ ব্যবহারিক সামগ্রী। আমাদের নিজেদের কারো কিছু করার নেই। আমাদেরকে অত্যন্ত কৌশলে এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন ব্যবহার শেষ হবে আমাদেরকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। বর্গেনের কথা মনে আছে?
ইরন মাথা নাড়ল।
তার পরিণতিটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল। আমি তখন জানতাম না, এখন জানি।
আমার ব্যাপারটা?
তোমারটাও। তুমি একমাত্র বিজ্ঞানী যে ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পার। তাই তোমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তোমার জীবনকে ইচ্ছে করে দুর্বিষহ করে দেওয়া হয়েছিল যেন তুমি প্রজেক্ট আপসিলনে যোগ দাও।
ইরন অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। তার অবাক হবার ক্ষমতাও শেষ হয়ে গেছে। ইরন খানিকক্ষণ মেঝেতে হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকা কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, এখন কী হবে কীশা?
খুব খারাপ একটা জিনিস হবে ইরন। তুমি জানতে চেয়ো না।
যদি খুব খারাপ একটা জিনিস হবে তা হলে তুমি সেটা বন্ধ করছ না কেন?
কারণ আমার বন্ধ করার ক্ষমতা নেই। কারণ আমি তুচ্ছ একটা রোবট। কারণ আমাকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমাকে ঠিক সেভাবেই কাজ করতে হবে।
ইরনের বুকের ভিতরে হঠাৎ ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়, সে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে?
তুমি দেখতে পাবে ইরন।
ইরন কীশার আরো কাছে এগিয়ে যাবার জন্য এক পা এগুতেই হঠাৎ বিদ্বেগে কীশা তার পাশে শুইয়ে রাখা অস্ত্রটি তুলে ইরনের দিকে তাক করল, মুহূর্তে তার মুখ ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে যায়, তার চোখ ধিকিধিকি করে জ্বলতে শুরু করে। কীশা হিসহিস করে যান্ত্রিক গলায় বলল, আমার কাছে এসো না ইরন। আমাকে আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করি না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় তোমাকে খুন করে ফেলতে পারি।
কী বলছ তুমি কীশা? তুমি কেন আমাকে খুন করে ফেলবে– ইরন কীশার দিকে আরো এক পা এগিয়ে গেল। সাথে সাথে কীশা অস্ত্রটির ট্রিগার চেপে ধরে, প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত মহাকাশযান কেঁপে ওঠে, বিস্ফোরকের ধোঁয়ায় এবং ঝাঁজালো গন্ধে সমস্ত ঘর মুহূর্তে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কিছু একটার প্রচণ্ড আঘাতে ইরন দেয়ালে ছিটকে গিয়ে পড়ে। দেয়ালে আঁকড়ে কোনোমতে উঠে বসে ইরন বিস্ফারিত চোখে একবার কীশার দিকে এবং আরেকবার নিজের দিকে তাকাল। কাঁধের কাছে খানিকটা অংশ ঝলসে গেছে, কপালে কোথাও কেটে গেছে, রক্তে বাম চোখটা ঢেকে যাচ্ছে।
কীশা হাঁটু গেড়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে কাতর গলায় বলল, ইরন, দোহাই তোমার, তুমি আমার কাছে এসো না। আমি কীশা নই–আমি একটা রোবট। আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
ইরন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে বলল, আসব না।
কীশা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইরন। আমার ভিতরের মানবিক একটা অংশে এখনো তোমাদের সবার জন্য ভালবাসা রয়েছে। আর রবোটের অংশ বলছে প্রয়োজন হলে সবাইকে শেষ করে দিতে। আমি জানি না, আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারব কি না– কীশা হঠাৎ হাউমাউ করে কেদেঁ উঠল।
ইরন হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ক্ষতস্থান মুছে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটি সত্যি ঘটছে। মনে হচ্ছে পুরোটা বুঝি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। বিস্ফোরণের শব্দে ত্ৰালুস এবং শুমান্তি ছুটে এসেছে। তারা ইরনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।
কীশা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে ধরে উঠে দাঁড়াল। কাউকে সরাসরি উদ্দেশ্য না করে নিচু গলায় বলল, আমি খুব দুঃখিত যে এটা ঘটছে, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।
কেউ কোনো কথা বলল না। কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে এসো। ইরনের রক্ত বন্ধ করা দরকার।
ত্রালুস বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এখানে কী ঘটছে। আমি–