- বইয়ের নামঃ এই মেঘ, রৌদ্রছায়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ভাদ্র মাস
০১.
ভাদ্র মাস।
মেঘ বৃষ্টির কোনো ঠিক নেই। এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। মাহফুজ বিরক্ত মুখে হাঁটছে। তার বাঁ হাতে ভারী একটা স্যুটকেস। এমন ভারী যে মনে হয় স্যুটকেসসহ হাত ছিঁড়ে পড়ে যাবে। ডানহাতে ছাতা। এখন রোদ নেই, সূর্য বড় এক খণ্ড মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সহজে বের হবে না। তারপরও ছাতাটা মাথায় ধরা। মাহফুজ মাঝেমধ্যেই চিন্তিত চোখে ডানহাতের স্যুটকেসের দিকে তাকাচ্ছে। স্যুটকেসের হাতলের অবস্থা সুবিধার না। হাত না ছিড়লেও যে-কোন মুহূর্তে হাতল ছিঁড়ে যেতে পারে। স্যুটকেস এত ভারী কেন তা মাহফুজের মাথায় ঢুকছে না। কাপড়-চোপড়ের বদলে কি সীসা ভরা হয়েছে? মেয়েদের এই সমস্যা তারা যখন স্যুটকেস গোছায় তখন স্যুটকেস ভারী হচ্ছে কিনা হালকা হচ্ছে এইসব মনে থাকে না, কারণ এই স্যুটকেস হাতে নিয়ে তাদের হাঁটতে হয় না। মাহফুজ পেছনে ফিরে সীসাভরা স্যুটকেসের মালিকের দিকে তাকাল। মালিক না– মালেকাইন, উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণী। নাম চিত্রা।
মেয়েটা কেমন গুটগুট করে হাঁটছে। যেন হেঁটে খুব মজা পাচ্ছে। মেয়েটার চেহারা তেমন কিছু না। দশে চার দেয়া যায়। কিন্তু এখন তাকে বেশ ভাল দেখাচ্ছে। গায়ের রং আগের মতো ময়লা লাগছে না। ট্রেন থেকে নেমেই কোনো এক ফাঁকে মুখে পাউডার-ফাউডার দিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। টিউবওয়েলে যখন মুখ ধুতে গেল তখনই মনে হয় কাজটা সেরেছে। চোখে যে কাজল দিয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। ট্রেনে আসার সময় চোখ ছিল ছোট ছোট, এখন এত বড় বড় হবে কেন? বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তো আর, বড় হয় না। আচ্ছা, শাড়িও বদলেছে না-কি? শাড়িটাও তো সুন্দর। সবুজের মধ্যে শাদা ফুল। এই মেয়ে দেখি সাজগোজে ওস্তাদ। এক ফাঁকে মুখে কোনো একটা কারুকাজ করেছে। ওমি খুঁটেকুড়ানি থেকে রাজরাণী।
একটু আগেই আকাশ মেঘলা ছিল এখন আঁ করে রোদ উঠে গেছে। যে মেঘ রোদ ঢেকে রেখেছিল সেও নেই। আকাশ ঘন নীল। ভাদ্রমাসের চিকন রোদ চামড়া ভেদ করে শরীরের রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নেশা হয়ে যায়। কেউ যদি ভাদ্রমাসের রোদে কিছুক্ষণ থাকে সে আর রোদ ছেড়ে আসতে চায় না।
মাহফুজের মাথায় ছাতা। মেয়েটা রোদের মধ্যেই হাঁটছে। ছাতার নিচে আসার জন্যে মাহফুজ তাকে ডাকছে না। আগবাড়িয়ে এত খাতির দেখাবার কিছু নেই। এই টাইপের মেয়েদের খাতির দেখালে বিপদ আছে, প্রথমে কোলে চেপে বসে, কোল থেকে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে মাথায়। একবার মাথায় চড়লে কার সাধ্য মাথা থেকে নামায়। এদের রাখতে হয় শাসনে।
মাহফুজ ভাই!
মাহফুজ বিরক্ত মুখে পেছন ফিরল। তার বিরক্তির প্রধান কারণ মেয়েটার গলার স্বর ভাল না। খসখসা। মেয়েদের গলার স্বর হবে চিকন। চট করে কানের ভেতর ঢুকে যাবে। এই মেয়ের গলার স্বর এমন যে চট করে কানের ভেতর ঢুকবে না। কানের ফুটার কাছে কিছুক্ষণ আটকে থাকবে। তাছাড়া, ভাই ব্রাদার, ডাকার দরকার কী? এত খাতির তো হয় নি। মাহফুজ মেয়েটার উপর রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না।
মেয়েটার হাঁটা সুন্দর। গুটুর গুটুর করে হাঁটছে। শাড়িটা পরেছে ভদ্রভাবে। মাথায় ঘোমটা দেয়ায় বউ-বউ লাগছে। এটা অবশ্যি ঠিক না। যে বউ না, সে কেন বউ সাজবে? সাজ পোশাকের মধ্যে যদি এরকম কোনো ব্যবস্থা থাকত যে সাজ দেখে ধরা যেত কে কী রকম মেয়ে তাহলে ভাল হত। কুমারী মেয়েদের একরকম পোশাক, সধবাদের একরকম পোশাক, খারাপ মেয়েদের একরকম পোশাক। আগে নিয়ম ছিল খারাপ মেয়েরা পায়ে কিছু পরতে পারবে না। তারা সাজসজ্জা সবই করবে শুধু পা থাকবে খালি। পায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে মেয়েটা কোন পদের। আজকাল বোধ হয় এইসব নিয়ম নেই।
মাহফুজ চিত্রার পায়ের দিকে তাকাল। লাল ফিতার স্যান্ডেল পরেছে। আচ্ছা পরুক। এই মেয়ে তো স্যান্ডেল পরতেই পারে। সে নিশ্চয়ই পাড়ার মেয়েদের মতো না। স্যান্ডেল জোড়া মনে হয় নতুন চকচক করছে। কালো মেয়ের পায়ে লাল স্যান্ডেল খুব মানায় তো!
তিয়াস লেগেছে। পানি খাব।
মাহফুজ বিরক্ত গলায় বলল, পথের মধ্যে পানি কই পাব? নৌকায় উঠে নেই। ঘাটলায় যাই, তারপর পানি
ঘাটলা কত দূর?
দূর নাই।
ঘাটলা দূর আছে এখনো প্রায় এক পোয়া মাইল। রিকশা পাওয়া যায়। রিকশায় যাওয়া যেত। স্টেশন থেকে নাও-ঘাটা পাঁচ টাকা ভাড়া। মাহফুজের কাছে টাকা আছে। স্কুল ফান্ডের টাকা। এই টাকা হুটহাট করে খরচ করা যায় না। তাছাড়া রিকসা নিলে দুটা রিকসা নিতে হয়। সে নিশ্চয়ই ঝপ করে এই মেয়ের সঙ্গে এক রিকসায় উঠে পড়তে পারে না।
নৌকায় কতক্ষণ লাগে?
তিন চার ঘন্টা।
এতক্ষণ লাগে?
এতক্ষণ কই দেখলে, নৌকায় পাটি পাতা আছে। শুয়ে ঘুম দিবে। ঘুম ভাঙলে দেখবে সোহাগীর ঘাটে নৌকা বাঁধা।
আপনাদের জায়গাটার নাম সোহাগী?
হু। ছাতাটা একটু ধর তো আমি সিগারেট খাব।
চিত্রা এগিয়ে এসে ছাতা ধরল। চিত্রা মেয়েটার নকল নাম। এই টাইপের মেয়েরা নকল নাম নিয়ে ঘুরেফিরে বেড়ায়। আসল নাম কেউ জানে না। আসল নাম জিজ্ঞেস করলে অন্য একটা নাম বলে সেটাও নকল।
মাহফুজ সিগারেট ধরাল। তার সিগারেট ধরানোটা উদ্দেশ্যমূলক। চিত্রা মেয়েটা রোদে কষ্ট পাচ্ছে। সিগারেট ধরাবার উছিলায় ছাতাটা তার হাতে পার করে দেয়া। মুখে বলতে হল না- নাও, ছাতা নাও। বললে মেয়েটা বলবে, জ্বি না লাগবে না। সে তখন বলবে- আহা নাও না। কথা চালাচালি হবে। কী দরকার? ছোট ট্রিকসের কারণে আপসে ছাতা তার হাতে চলে গেল। মাহফুজের এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ছাতা সে ধরবে কী ভাবে? তার তো আর হনুমানের মতো লেজ নেই যে লেজ দিয়ে পেঁচিয়ে ছাতা ধরে রাখবে।
চিত্রাকে নৌকায় উঠিয়ে মাহফুজ গেল চায়ের দোকানে। চায়ের তৃষ্ণা হয়েছে- এককাপ চা খাবে। মেয়েটাকে এককাপ চা পাঠাবে। মাটির কলসিতে করে ঠাণ্ডা এক কলসি পানি আর গ্লাস নিতে হবে। ভাদ্রমাসে ঘন ঘন পানির তৃষ্ণা হয়। পথে খাওয়ার জন্যেও কিছু নিতে হবে। চিড়া-মুড়ি। ভাতের ক্ষিধে চিড়া-মুড়ি দিয়ে দূর হবে না। উপায় কী? ডাল-চাল নিয়ে গেলে হয়। নৌকায় চুলা থাকে, মাঝিকে বললেই খিচুড়ি বেঁধে দেবে। তেল মশলা আর লাকড়ির দাম ধরে দিলেই হবে।
চায়ের দোকানের মালিকের নাম নিবারণ। মাহফুজের চেনা লোক। ঠাকরোকোনা এলেই নিবারণের দোকানে চা খায়। দুপুরে ভাত খায়। ভাত খাবার পর ভাতঘুমের ব্যবস্থা আছে। দোকানের পেছনে পাটি পেতে শুয়ে থাকা। মাহফুজ শুয়ে থাকে। চা দোকানের এক ছেলে তালপাখা দিয়ে বাতাস করে। মাথা বানিয়ে দেয়। যতক্ষণ ঘুম ততক্ষণ বাতাস। ফাঁকে ফাঁকে মাথা বানানো। ওস্তাদ ছেলে। একই সঙ্গে বাতাস করা এবং মাথা বানানো সহজ ব্যাপার না।
নিবারণ গ্লাসভর্তি চা মাহফুজের সামনে রাখতে রাখতে বলল, সাথের কইন্যাটা কে?
মাহফুজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, দূর সম্পর্কের বোন হয়। তার জন্যেও চা পাঠাতে হবে! চা আর একটা লাঠি-বিসকুট।
বোন শহরে থাকে?
হু।
কলেজে পড়ে?
হু।
বিবাহ হয়েছে?
না।
মেয়েটা বড়ই সৌন্দর্য।
মাহফুজ হাই তুলতে তুলতে বলল, নিবারণ কাউকে নিয়ে মাথা ধরার টেবলেট আনিয়ে দাও, মাথা ধরেছে।
মাহফুজের সত্যি সত্যি মাথা ধরেছে। পরপর এতগুলো মিথ্যা কথা বলার জন্যেই মাথা ধরেছে। মিথ্যা বলার কোনো দরকার ছিল না। সত্যি কথাটা বলে ফেললেই হত।
মিথ্যা হলো শয়তানের বিয়ের মন্ত্র। মিথ্যা বললেই শয়তানের বিয়ে হয়। বিয়ে হওয়া মানেই সন্তানসন্ততি হওয়া। একটা মিথ্যার পর আরো যে অনেকগুলো মিথ্যা বলতে হয় এই কারণেই। পরের মিথ্যাগুলো শয়তানের সন্তান। এইসব মাহফুজের কথা না, তার দাদীজানের কথা। মাহফুজের দাদী আতরজান সবসময় বলতেন- মিথ্যা কথা কইলে কি হয় জানস? শয়তানের বিবাহ হয়। শয়তানের স্ত্রীর গর্ভে শয়তান শিশুর জন্ম হয়। এই জন্যেই একটা মিথ্যা কথা কইলেই সাথে আরো তিনটা চাইরটা মিথ্যা বলতে হয়। সেই মিথ্যাগুলো হইল শয়তানের সন্তান। বুঝছস কিছু?
দাদীজানের গল্পের কারণে মাহফুজ ছেলেবেলায় যখনি মিথ্যা কথা বলেছে– আতংকে শিউরে উঠেছে সর্বনাশ, শয়তানের বিয়ে হয়ে গেল। এক্ষুণি তাদের ছেলেপুলে হওয়া শুরু হবে। সেই আতংকের ছায়া এখনো খানিকটা আছে। ছোটবেলায় মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সহজে বের হয় না।
মিথ্যা বললে সঙ্গে সঙ্গে কিছু কঠিন সত্য কথা বলে শয়তানের বিয়ে ভেঙে দিতে হয়। এও দাদীজানের শেখানো বুদ্ধি। মাহফুজ বিরস মুখে শয়তানের বিয়ে ভাঙার প্রস্তুতি নিল। সত্যি কথা বলতেই হবে।
নিবারণ।
জ্বে।
আমার দূর সম্পর্কের যে খালাতো বোনের কথা বললাম না– কলেজে পড়ে?
জ্বে।
আসলে কলেজে পড়ে না। বিয়ে-শাদি দিতে হবে এই জন্যে বাড়ায়ে বলা। বুঝতে পারছ?
জ্বে পারছি। না বোঝার কিছু নাই। এই সব মিথ্যা বলা যায়। এত ভগবান দোষ ধরেন না।
মেয়েটা নাটক করে। সোহাগীতে টিপু সুলতান প্লে হচ্ছে এই মেয়ে সুফিয়ার পার্ট করবে। এরা খুবই দরিদ্র। নাটক করে টাকা যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে।
ভাইজান, মেয়েটা তো খুবই সৌন্দর্য।
সৌন্দর্য কি দেখলা। গায়ের রং ময়লা।
ঠিক বলছেন- সৌন্দর্যের আসল জিনিসটা নাই– রং ময়লা। ভগবানে সব এক লগে দেন না। কিছু দেন। কিছু হাতে রেখে দেন।
মাহফুজের মাথা ধরা কমে গেছে। তারপরেও নিবারণের এনে দেয়া প্যারাসিটামল দুটা খেয়ে ফেলল। রোগ হবার আগেই অষুধ খেয়ে রাখা, যাতে দীর্ঘ যাত্রাপথে মাথা না ধরতে পারে। টুকটাক দু একটা জিনিস কেনা দরকার। টর্চের ব্যাটারি, মোমবাতি। এই দুটা জিনিস ময়মনসিংহ থেকে কিনলে সস্তা পড়ত। এত কিছু কেনা হয়েছে এই দুটা জিনিস কেন কেনা হল না কে জানে।
ভাইজান, চা আরেক কাপ দিব?
দাও।
চা খেতে ইচ্ছা করছে না, তারপরেও খাওয়া। মাহফুজের ধারণা তার জ্বর আসছে। কোনো কিছুই ভাল লাগছে না। চায়ে চুমুক দিতেই জিহ্বায় সর আটকে গেল। বমি ভাব হল। বমি ভাব হলেও খাওয়ার জিনিস নষ্ট করা যায় না।
দাদীজান বাঁশের চোঙায় খটখট করে সুপুরি হেঁচতে হেঁচতে বলতেন- মানুষ যখন খাওয়া-খাইদ্য খায় তখন তার পায়ের কাছে কে বইস্যা থাকে ক দেহি? শয়তান বইস্যা থাকে, আর কানের কাছে কুমন্ত্রণা দেয়- খাইস নারে ভাত খাইস না। পাতে ভাত রাইখ্যা উইঠ্যা আয়। লক্ষীমনা পাতের ভাত সব শেষ করনের কোনো দরকার নাই। কুমন্ত্রণা শুইন্যা মানুষ পাতে ভাত রাইখ্যা উইঠা যায়। তখন শয়তানের খুশির সীমা থাকে না। বাহাতুরটা দাঁত বাইর কইরা হাসে। মানুষের দাঁত বত্রিশ, শয়তানের বাহার। শয়তান দাঁত বাইর কইরা ক্যান হাসে জানস? হাসে কারণ হইল পাতের প্রত্যেকটা না খাওয়া ভাত রোজ হাশরে সঙ্কুরটা কইরা সাপ হইয়া দংশন করব। বুঝছস?
চায়ের কাপে দুই চুমুক দিয়ে রেখে দিলে কী হবে? যে চা খাওয়া হয় নাই সেই চা কি সাপ হয়ে দংশন করবে? আতরজান বেঁচে থাকলে মাহফুজ জিজ্ঞেস করত। তিনি গত বৎসর ইন্তেকাল করেছেন। শয়তানের গল্প বলার মানুষটা আর নেই। না থাকলেও সুপুরি হেঁচার শব্দটা তিনি রেখে গেছেন। মাহফুজ বাঁশের চোঙ্গায় সুপুরি হেঁচার শব্দ প্রায়ই পায়। খট খট, খট খট– কে যেন সুপুরি ভেঁচছে। এই তো শব্দটা হচ্ছে। ঠিক মাহফুজের মাথার ভেতর থেকেই শব্দ আসছে। স্পষ্ট শব্দ। আশে পাশে কেউ থাকলে তারো শোনার কথা। খট খট, খট খট, খট খট।
চা খাওয়া যাচ্ছে না। পেটের ভেতর পাক দিতে শুরু করেছে। মাহফুজ ক্লান্ত গলায় বলল, নিবারণ একটা পান আনায়ে দাও, কাঁচা সুপারি। শরীরটা জুত লাগতেছে না।
জর্দা?
না, জর্দা না।
আফনের ইস্কুলের কি অবস্থা?
এই শীতে ইনশাল্লাহ্ বিল্ডিংয়ের কাজ ধরব। রাজমিস্ত্রী বলা আছে।
একবার গিয়া দেইখ্যা আসব।
আস, দেইখ্যা যাও। এখন একবার দেখ। চাইর বছর পরে আরেকবার দেখ। কিছুই চিনবা না। গ্রামের মধ্যে পাকা সড়ক।
পাকা সড়ক?
অবশ্যই পাকা সড়ক। পুলাপানের খেলার জন্যে শিশুপার্ক। গ্রামের চাইরদিক ঘেইরা লাগাইছি রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছ। এই গাছগুলা হইল গ্রামের সীমানা। চাইর বছর পর গাছে যখন ফুল ফুটব তখন মনে হইব লাল ফিতা দিয়া গ্রাম বন্ধন করা হয়েছে।
বাহ।
অসুখবিসুখ হলে কোনে চিন্তাই নাই। গ্রামের মধ্যেই চিকিৎসালয়। পাস করা ডাক্তার।
চাইর বৎসরের মইধ্যে এইসব হইব?
অবশ্যই।
কাঁচা সুপারির পান চলে এসেছে। পান মুখে দিয়ে মাহফুজ সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোয়াটা ভাল লাগছে না, মাথা ঘুরাচ্ছে। জ্বর বোধ হয় এসেই পড়ল। না খেয়ে সিগারেটটা যদি ফেলে দেয় তাহলে কী হবে? রোজ হাশরে কি এই সিগারেট কাঁকড়া-বিছা হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরবে?
মাহফুজ উঠে পড়ল। দাম দিতে গিয়ে এক বিপত্তি, নিবারণ দাম নেবে না। এই ঝামেলা নিবারণ সবসময় করে। মাহফুজ বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যবসা করতে বসেছ। দানের অফিস তো খোল নাই।
নিবারণ হাসিমুখে বলল, সবের সাথে ব্যবসা করি না। আফনের সাথে ব্যবসা নাই। আচ্ছা দেন, হাফ দাম দেন।
মাহফুজ হাফ দাম দিয়ে ঘাটলার দিকে রওয়ানা হল। রোদ এমন তেজী যে চোখ জ্বালা করছে। মাহফুজ ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না, এলোমেলো পা পড়ছে। জ্বর মনে হয় চেপে আসছে। দাদীজান মাথার ভেতর বসে ক্রমাগত পান ঘেঁচে যাচ্ছেন। বুড়ি ভাল যন্ত্রণা শুরু করেছে। আরো দুটা প্যারাসিটামল খেয়ে ফেললে হত। পানির পিপাসাও হচ্ছে। অথচ এই একটু আগেই পানি খেয়েছে।
কে, মাহফুজ না?
জ্বি।
কি হইছে তোমার এমন কইরা হাঁটছ কেন?
কিছু হয় নাই।
তোমার স্কুলের খবর কি?
ইনশাল্লাহ এই শীতে কাজ শুরু হবে।
ইটা কিননের আগে আমার সাথে যোগাযোগ করবা।
জ্বি আচ্ছা।
ইসকুল ঘরের জন্যে ইটা। একটা পাবলিক কাজ। কোন লাভ রাখব না। এক নম্বরী ইটা দিব তয় একটা কথা বাকি না। খরিদ করবা নগদ পয়সায়। এক নম্বুরী ইটা বাইশ শ হাজার।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার কি শরীর খারাপ?
জ্বি না।
চউখতো দেখি লাল টুকটুকা।
দাড়িওয়ালা রোগা লোকটাকে মাহফুজ চিনতে পারছে না। লোকটা কে? বিড়ালের মতো চোখ। চোখে সুরমা। গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। লোকটা কথা বলছে পরিচিত ভঙ্গিতে। নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ। মাহফুজ চিনতে পারছে না কারণ এই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর দাদীজান বসে সুপুরি হেঁচছেন। মহিলা যখন এই কাণ্ডটা করেন তখন ঘোরের মতো লাগে।
মাহফুজ মনে মনে বলল, পান ছেঁচা বন্ধ কর দাদী। অনেক সুপারি খাইছ আর না।
আতরজান বললেন, কাজটা ভালো করস নাইরে আবু। কাজটা মন্দ করছস।
কোন কাজটা মন্দ করছি?
মেয়েটার নিয়া আসলি। খারাপ পাড়ার খারাপ মেয়ে।
কে বলছে খারাপ মেয়ে?
আমি জানি।
সে খারাপ হইলেও কিছু যায় আসে না। আমার তো তারে দরকার নাই। আমার দরকার তার কাজ।
তিন চাইরটা শয়তান তোর পিছে পিছে সব সময় ঘুরে। বড় সাবধান।
শয়তান ঘুরে কেন?
যে মন্দ তার পিছে কোনো শয়তান থাকে না। হে এমেই মন্দ। তার শয়তান দরকার নাই। যে যত ভালো তার পিছনে তত শয়তান। তোর সাথে আছে চাইরটা। খুব সাবধান।
দাদীজান, পান ছেঁচা বন্ধ করবা? অসহ্য!
যে চাইরটা শয়তান তোর পিছে পিছে ঘুরতাছে তার মধ্যে দুইটা নারী দুইটা পুরুষ। তুই একটা মিথ্যা কথা বলবি আর লগে লগে এরার বিবাহ হইব। শয়তান সংখ্যায় বাড়ব।
চুপ কর।
আমি তো চুপ কইরাই থাকতে চাই। তোর জন্যে মন কান্দে বইল্যা পারি না। তোর শইল দেখি বেজায় খারাপ।
হুঁ খারাপ। তুমি পান ছেঁচা বন্ধ কর।
মহিলা পান ছেঁচা বন্ধ করল না। প্রবল উৎসাহে বুড়ি পান ছেচছে। মাথার ভেতর শব্দ হচ্ছে খট খট, খট খট, খট খট।
.
নৌকা ছেড়েছে সকাল এগারোটায়।
এখন বাজছে বারোটা দশ। নৌকার ইনজিন থেকে বিকট শব্দ আসছে। ইনজিনের নৌকায় চিত্রা আরো চড়েছে, কখনো এত শব্দ হতে শুনে নি। শুধু শব্দ না, শব্দের সঙ্গে পেট্রোলের গন্ধ, ধোয়ার গন্ধ বিশ্রী অবস্থা। মাঝে মাঝে কুচকুচে কালো তেল জাতীয় কী যেন ইনজিন থেকে ছিটকে চারদিকে পড়ছে। ইনজিন চালাবার দায়িত্বে আছে নদশ বছর বয়েসী একটা ছেলে। ইনজিন থেকে তেল ছিটার ঘটনা যতবার ঘটছে ততবারই সে আনন্দে দাঁত বের করে দিচ্ছে। পর মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় বলছে– ইনজিল গরম হইছে গো। নৌকার যে হাল ধরে আছে সে বলছে, বেশি গরম? ছেলেটা আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলছে, মিডিয়াম গরম। তখন মাঝি চোখমুখ কুঁচকে ইনজিনকে কুৎসিত একটা গালি দিচ্ছে ইনজিনের মাকে সে কী করবে তা নিয়ে গালি। গালির অর্থ বুঝতে পারলে ইনজিনের খুবই রাগ করার কথা।
চিত্রা ইনজিন থেকে দূরে থাকার জন্যেই নৌকার প্রায় মাথায় বসে আছে। রোদ খুবই কড়া। চিত্রা মাথায় ছাতা ধরে আছে। মনে হচ্ছে ছাতাও রোদ আটকাতে পারছে না।
মাঝি বলল, ছাত্তিটা গাঙের পানিতে ভিজাইয়া লনগো আফা। মজা পাইবেন।
ছাতা রোদ আটকাবার জন্যে। এর মধ্যে মজা পাবার কী আছে কে জানে। চিত্রা পানিতে ছাতা ভিজিয়ে নিল। তেমন কোন মজা পাওয়া যাচ্ছে না। ভেজা ছাতা থেকে পানি গড়িয়ে শাড়িতে পড়ছে- শাড়ি নোংরা হচ্ছে এটাই রোধ হয় মজা।
চিত্রা নদীর দুপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো কোন দৃশ্য না। কিছু মানুষ মাছ মারছে। জাল ফেলছে, তুলছে– জালে কোন মাছ দেখা যাচ্ছে না। ক্লান্তিকর কাজটা তারা করেই যাচ্ছে।
নদীর পানিতে মহিষ নামানো হচ্ছে। গরুকে গোসল দেয়া হচ্ছে। কিছু ছেলেপুলে পানিতে ঝাপাঝাপি করছে। ঘুরেফিরে একই দৃশ্য। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ ক্লান্ত হয়। চোখ ক্লান্ত হলেই মন ক্লান্ত হয়। তখন ঘুম-ঘুম পায়। তবে নদীর দুধারেই প্রচুর কাশফুল ফুটেছে। দূর থেকে কাশফুল দেখতে ভাল লাগছে। চিত্রার সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে সে অবশ্যই কাশফুলের ছবি তুলতো। সস্তা ধরনের একটা ক্যামেরা তার আছে। সে যখন বাইরে যায়, ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে যায়। এবারই শুধু আনা হয় নি কারণ ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া যায় নি। চিত্রার ধারণা তার মা ক্যামেরাটা গোপনে বিক্রি করে দিয়েছেন। মহিলা এই ধরনের কাজ প্রায়ই করেন। ঘরের টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে দেন। কাজটা নিরুপায় হয়েই তাঁকে করতে হয়। তারপরও চিত্রার ভাল লাগে না। ক্যামেরাটা তার খুব শখের ছিল। মহিলাকে যদি সে জিজ্ঞেস করে- মা ক্যামেরা বিক্রি করলে কেন? সেই মহিলা তখন খুবই ওজনদার কোন কথা বলবেন। ওজনদার কথা বলতে এই মহিলা খুব পছন্দ করেন। ওজনদার কথা বলবার সময় তিনি আবার চোখে চশমা পরে নেন। চশমা পরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গলার স্বরও বদলে যায়।
চিত্রার আসল নাম- মেহের বানু। ডাক নাম বানু। তার নাটকের নাম সুচিত্রা। সুচিত্রা থেকে চিত্রা। নাটকের জন্যে সুচিত্রা নাম তার মায়ের রাখা। সুচিত্রা-উত্তমের সুচিত্রা। মফঃস্বল থেকে কেউ যখন তাকে নিতে আসে তখন তার মা চোখে চশমা পরে গম্ভীর ভঙ্গিতে পার্টির সঙ্গে কথা বলতে বসেন। পার্টির বয়স যাই হোক, তিনি কথা শুরু করেন তুমি সম্বোধনে।
বুঝছ বাপধন, আমার মেয়ের ভাল নাম সুচিত্রা। সুচিত্রা-উত্তমের সুচিত্রা। তার অভিনয় যখন দেখবা তখন বুঝবা নাম তার সার্থক। বৃক্ষরে যদি জিজ্ঞাস কর বৃক্ষ তোমার নাম কি? বৃক্ষ বলে– ফলে পরিচয়। আমার কন্যারও ফলে পরিচয়।
কয়েকটা কথা বাপধন তোমারে আগেভাগে বলি– সুচিত্রারে তোমরা দিবা এক হাজার এক টেকা। পুরা টেকা আমার হাতে বুঝাইয়া তারপর তারে নিবা। বাকির নাম ফাঁকি। টাকা আছে? আন নাই? পরে দিবা? আইচ্ছা তাইলে যাও। আল্লাহ হাফেজ।
এই বলেই তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেন। অর্থাৎ তার কথা শেষ। পার্টি যদি বলে টাকা তারা এনেছে তবে এত আনে নাই- একটু কমাতে হবে তখন তিনি আবারও চশমা পরেন আবারও কথাবার্তা শুরু হয়। আবারও এক পর্যায়ে কথা বন্ধ হয়। তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলে দুঃখিত গলায় বলেন, শোন বাপধন, আমি কি মাছ বেচতে বসছি? আমি মাছের একটা দাম বললাম, তুমি বলো আরেকটা। শুরু হইল মূলামূলি। সুচিত্রারে তোমার নেওনের দরকার নাই। তুমি মাছ-হাটা থাইক্যা একটা চিতল মাছ কিইন্যা লইয়া যাও। এই দামে তুমি ভাল চিতল মাছ পাইবা। নয়া আলু আর টমেটো দিয়া চিতল মাছ বড়ই স্বাদ।
একসময় দরদাম ঠিক হয়। চিত্রার মা পার্টির হাত থেকে টাকা নিয়ে গুনতে বসেন। খুশি খুশি গলায় বলেন- ও চিত্রা ইনারারে চা দে। হুদা মুখে বইস্যা আছে। পার্টি যত আপত্তিই করুক চা না খেয়ে তারা উঠতে পারে না। চা খাবার সময় তিনি নানান ধরনের মজার মজার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে প্রয়োজনীয় কিছু কথাও সেরে নেন- একটা কথা বলতে ভুইল্যা গেছি বাপধন। আমিও কিন্তু মেয়ের সঙ্গে যাব। আমার জোয়ান মেয়ে আমি একলা ছাড়ব না। তোমরার উপরে আমার বিশ্বাস আছে। দেইখ্যাই বুঝতেছি তোমরা ভালোমানুষের পুলাপান। আমার মেয়ের উপরে বিশ্বাস নাই। দুইটা জিনিসরে বিশ্বাস করণ নাই- জোয়ান কন্যা আর কালসর্প। আমার কথা না বই পুস্তকের কথা।
.
চিত্রার মা চিত্রাকে কখনো একা ছাড়েন নি। এখন ছাড়ছেন কারণ এখন তার মেয়ের সঙ্গে আসার উপায় নেই। তার বা পায়ে কী যেন হয়েছে- পা মাটিতে ছুঁয়াতে পারেন না। অসহ্য যন্ত্রণা। ওষুধপত্রে এই যন্ত্রণা কমে না– শুধু যখন সিগারেটের শুকা ফেলে সেখানে গাঁজা পাতা ভরে টানেন তখন ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে আসে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। মেডিকেল কলেজের ভাল ডাক্তার। তিনি বলেছেন– হাসপাতালে ভর্তি হতে। হাঁটু পর্যন্ত কেটে বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই। চিত্রার মা রাজি হন নি। তিনি রাগি গলায় চিত্রাকে বলছেন– রোজ হাশরের দিন আমি আল্লাহপাকের সামনে এক ঠ্যাং নিয়া খাড়ামু? তুই কস কি? সবেই হাসতে হাসতে দৌড় দিয়া বেহেশতে ঢুকব আর আমি ল্যাংটাইতে ল্যাংচাইতে যামু?
তুমি বেহেশতে যাইবা?
অবশ্যই।
বেহেশতে যাওনের মতো সোয়াব তুমি করছ?
না, করি নাই। আল্লাহপাক তোর-আমার মতো না। তাঁর দিল বড়। পাপী লোক তার সামনে দাঁড়াইয়া একবার যদি বলে ভুল করছি মাপ দেন। তিনি মাপ দিবেন।
.
চিত্রার মাথার উপর দিয়ে দুটা বক ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। সে চমকে উঠল বকের ডাক শুনে। কী বিকট শব্দ। এমন সুন্দর পাখি! কী সুন্দর ধবধবে শাদা রং অথচ তার গলার স্বর ভয়াবহ। বকের ডাকে শুধু যে চিত্রা চমকে উঠেছে তা না, সঙ্গের মানুষটাও চমকে উঠেছে। মানুষটা এতক্ষণ শুয়ে ছিল। এখন উঠে বসেছে। অদ্ভুতভাবে চারদিকে দেখছে। মানুষটার শরীর মনে হয় খারাপ। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো হেলতে দুলতে এসে নৌকায় উঠল। চোখ টকটকে লাল। একটা চোখে পানি পড়ছে। নৌকায় উঠেই লোকটা শুয়ে পড়েছে। এতক্ষণ সে একবারও মাথা তুলে নি। বকের ডাকে এই প্রথম মাথা তুলল। লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তাকে চিনতে পারছে না। জ্বর খুব বেশি হলে এরকম হয়। চেনা মানুষকে অচেনা লাগে। আবার অচেনা মানুষকে মনে হয় খুব চেনা কেউ। চিত্রা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অসুস্থ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে না। তার মা বিছানায় শুয়ে কাতরায়। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সে মার ঘরে ঢুকে না। ঘরে ঢুকলেই হোসনে আরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। অভিশাপ দেন। কঠিন সব অভিশাপ। চিত্রা তাতে চিন্তিত হয় না কারণ মার অভিশাপ কখনো সন্তানের গায়ে লাগে না। দোয়া গায়ে লাগে অভিশাপ লাগে না। হাঁসের গায়ের পানির মত অভিশাপ ঝরে পড়ে যায়।
গতকাল ঘর থেকে বের হবার সময় হোসনেআরা কঠিন কিছু অভিশাপ দিলেন। চাপা গলায় বললেন, নিজের মারে এই অবস্থায় ফালাইয়া তুই রওয়ানা হইছস?
চিত্রা বলল, হুঁ। না যদি যাই উপাস থাকবা।
হোসনেআরা তখন কুৎসিত কিছু গালি দিলেন। গালির বিষয় হচ্ছে আশ্বিন মাসে মেয়েকুকুরের শরীর গরম হয়, সে তখন খুঁজে পুরুষ কুকুর। তার কন্যার শরীর সব মাসেই গরম থাকে। সে অভিনয় করার জন্যে যায় না। সে যায় শরীর ঠাণ্ডা করতে। সে আশ্বিন মাইস্যা কুকুরী না- সে বার মাইস্যা কুকুরী।
চিত্রা শান্ত মুখে গালি শুনেছে। তারপর বলেছে- মা, আমি ব্যবস্থা করে গেছি– তুমি ঠ্যাং কাটায়ে নিও।
হোসনেআরা তখন ভয়াবহ চিৎকার শুরু করলেন। চিত্রা মাকে এই অবস্থায় রেখে চলে এসেছে। সে যে-ব্যবস্থা করে এসেছে তাতে মনে হয় ঠ্যাং আজ কাটা হবে। মতি মামাকে বুঝায়ে দিয়ে এসেছে। হাতে টাকা পয়সা দিয়ে এসেছে। যে ডাক্তার ঠ্যাং কাটবেন চিত্রা তার সঙ্গেও কথা বলেছে। ডাক্তার সাহেবের কী সুন্দর চেহারা। হাসি খুশি। এই লোক মানুষের ঠ্যাং কাটে ভাবাই যায় না।
কাটা ঠ্যাং ডাক্তাররা কী করেন? ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে দেন? না-কি কবর দেয়া হয়?
ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। চিত্রা মাথা ঘুরিয়ে দেখল। লোকটা পানি খাচ্ছে। প্লাস্টিকের জগভর্তি পানি উঁচু করে মুখে ধরেছে। পানি গড়িয়ে লোকটার পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। চিত্রা বলল, আপনার শরীর খারাপ? লোকটা পানির জগ মুখ থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণে জন্যে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আবার পানি খেতে শুরু করল। চিত্রার প্রশ্নের জবাব দিল না।
চিত্রা বলল, আপনার কি জ্বর এসেছে?
লোকটা বলল, হু।
চিত্রা এগিয়ে গেল। একজন অসুস্থ মানুষের কাছে এগিয়ে যাওয়া যায়। কপালে হাত রেখে তার জ্বর দেখা যায়। এতে দোষের কিছু নেই। জ্বর খুব বেশি হলে মাথায় পানি ঢালতে হবে। সেটাও কোন সমস্যা না। তারা পানির উপর দিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়ালেই পানি।
চিত্রা কপালে হাত রাখতে গেল। মাহফুজ একটু সরে গিয়ে বলল, গায়ে হাত দিও না।
চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আমার কি কুষ্ঠ হয়েছে যে আপনার গায়ে হাত দিতে পারব না?
মাহফুজ বলল, দরকার কী?
চিত্রা বলল, দরকার আছে।
জ্বর বেশি বললে কম বলা হয়- মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরে গ্যাসের একটু চুলা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। চুলার আগুনে চামড়ার নিচের রক্ত ফুটছে।
চিত্রা বলল, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন- আমি মাথায় পানি ঢালব।
মাহফুজ বলল, বাজে ঝামেলা করবে না। দরকার নাই।
দরকার আছে কি-না আমি দেখব। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
মাহফুজ নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলল, তোমার নাম কি?
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, নাম জিজ্ঞেস করেন কেন? নাম তো জানেন। চিত্রা।
চিত্রা তো নকল নাম। আসল নাম কি?
আসল নাম, নকল নাম– কোনটায়ই আপনার দরকার নাই। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
তুমি পড়াশুনা কতদূর করেছ?
অল্প অ-আ জানি।
কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ? এত কথা বলছেন কেন? আপনাকে-না শুয়ে থাকতে বললাম।
মাহফুজ ঘোর পাওয়া মানুষের মতো আবারও একই প্রশ্ন করল তুমি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?
ক্লাস টেন।
সায়েন্স না আর্টস?
আর্টস।
ভাল হয়েছে। তুমি আমাদের স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে পারবে।
আপনি শুয়ে পড়েন।
জ্বি আচ্ছা।
চিত্রা হকচকিয়ে গেল। মানুষটা জ্বি আচ্ছা বলছে কেন? জ্বর যখন খুব বাড়ে তখন শরীরের তাপ মাথার মগজে ঢুকে যায়। তখন মানুষ অদ্ভুত কথা বলে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে।
মাহফুজ শুয়ে পড়েছে। তার চোখ খোলা। অবাক হয়ে সে চারদিক দেখছে। চিত্রার ভয় ভয় লাগছে। মানুষটা মরে যাবে না তো? যদি সত্যি সত্যি মরে যায় সে কী করবে। নৌকা ঠাকরোকোনা স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর লাশ ফেলে রেখে স্টেশনের দিকে যাবে। ময়মনসিংহ যাবার ট্রেন কখন কে জানে। এটা করা কি সম্ভব?
কেন সম্ভব না। এই লোক কে? তার কেউ না। মৃত মানুষটাকে নিয়ে তার গ্রামে উপস্থিত হবার কোন মানে হয় না। সে নাটকের মেয়ে। যাচ্ছে। টিপুসুলতান নাটক করতে। নাটকের প্রধান উদ্যোক্তা মারা গেছে। নাটক অবশ্যই হবে না। সে সোহাগী গ্রামের উপস্থিত হয়ে কী করবে? তার টাকা পাওয়ার কথা, সে পেয়ে গেছে। এই টাকায় মার ঠ্যাং কাটা হচ্ছে।
চিত্রা নদীর পানিতে প্লাস্টিকের জগভর্তি করে মাহফুজের মাথায় ঢালছে। নদীর পানি গরম। রোদে পানি তেতে উঠেছে। গরম পানি মাথায় ঢাললে কি জ্বর কমে?
ইনজিনের নৌকা ভটভট করে চলছে। ছোট ছেলেটা আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। যে বুড়ো মাঝি হাল ধরে ছিল- সেও একবার উঁকি দিল। চিত্রা বলল- আপনি কি ইনাকে চিনেন?
বুড়ো মাঝি বলল, জ্বি না।
যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গাটা চেনেন তো? গ্রামের নাম সোহাগী।
জ্বে চিনি। নিমঘাটা।
নিমঘাটা না, সোহাগী।
নিমঘাটায় নাও থামব। হাঁটা পথে সোহাগী যাইবেন।
কতক্ষণ হাঁটতে হবে?
ক্যামনে কই?
ক্যামনে কই মানে? সোহাগী কখনো যান নি?
জ্বে না। নিমঘাটা গেছি। বুধবারে নিমঘাটায় হাট বসে। বড় হাট।
নিমঘাটায় ডাক্তার আছে?
জানি না।
নিমঘাটায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
ফুল ইসপিডে দিলে দেড় ঘণ্টা। যেমনে যাইতেছি– দুই আড়াই ঘণ্টা লাগব।
ফুল স্পিড দিন।
দেওন যাইব না। ইনজিন ডিসটাব আছে।
যখন সমস্যা হয় একের পর এক সমস্যা হতে থাকে। নৌকা একটা নেয়া হয়েছে ইনজিন ডিসটাব। হয়ত দেখা যাবে কিছুক্ষণ পর ইনজিন পুরোপুরি থেমে যাবে।
রোদ মরে আসছে। আকাশে চিল উড়ছে। বাচ্চা ছেলেটা বলল তুফান হইব। ছেলেটার মুখ হাসি-হাসি। যেন তুফান হওয়া ইনজিন থেকে তেল ছিটকে যাওয়ার মতোই কোন আনন্দময় ঘটনা। পুরোপুরি নৌকা ডুবলে তার আনন্দ মনে হয় আরো বেশি হবে।
চিত্রা বলল, তুফান হবে কেন? আকাশে তো মেঘ নেই।
এট্টু পরেই দেখবেন আসমান আন্ধাইর।
ঝড়ের সময় নৌকা কি নদীর উপর থাকবে? না কুলে ভিড়বে?
বুড়ো মাঝি বলল, অবস্থা বুইঝা ব্যবস্থা। যেমন অসুখ তেমন দাওয়াই।
নৌকাডুবি অসুখের দাওয়াই কী হবে? চিত্রা সাঁতার জানে না। সাঁতার না জানা অসুখের কোন দাওয়াই থাকার কথা না।
আকাশের চিল নিচে নেমে আসছে। রোদের তেজ দ্রুত কমছে। তবে আকাশের কোথাও কোন মেঘ নেই। মেঘ ছাড়া রোদের তেজ কমে যাচ্ছে। কী ভাবে সেও এক রহস্য।
মানুষটা এতক্ষণ চোখ মেলে ছিল। পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এখন চোখ বন্ধ। জ্বর বোধ হয় একটু কমেছে। এখন ঘুমুচ্ছে। ক্রমাগত পানি ঢালার কারণে কপালে হাত দিয়ে জ্বর টের পাওয়া যাচ্ছে না। চিত্রা ডাকল– এই যে শুনুন। আপনি কি ঘুমুচ্ছেন?
মানুষটা জবাব দিল না। তবে বড় করে নিশ্বাস ফেলল।
আপনার শরীরটা কি এখন একটু ভাল লাগছে?
এই প্রশ্নেরও জবাব নেই। চিত্রা বুঝতে পারছে না সে পানি ঢালা বন্ধ করবে না চালিয়ে যাবে।
নৌকার ছেলেটা আঙুল উঁচিয়ে বলল- এই দেখেন মেঘ।
চিত্রা মেঘ দেখল। কালো একখণ্ড মেঘ দেখা যাচ্ছে। ভীতিজনক কিছু না। কিংবা কে জানে হয়ত এই মেঘই ভয়াবহ। সাপুড় যেন সাপের হাঁচি চেনে– যারা নৌকা চালায় তারা চেনে মেঘের হাঁচি।
চিত্রা বলল, ঝড় কখন হবে?
দিরং আছে।
ছেলেটা কথাটা বলল দুঃখিত গলায়। ঝড় আসতে দেরি আছে এই দুঃখে সে মনে হয় কাতর।
চিত্রা বলল, ঝড় আসতে আসতে কি আমরা নিমঘাটায় পৌঁছব?
জানি না।
বিপদ যখন আসে একটার পর একটা আসে। বিপদরা পাঁচ ভাইবোন। এদের মধ্যে খুব মিল। এই ভাইবোনরা কখনো একা কারো কাছে যায় না। প্রথম একজন যায়, তারপর তার অন্য ভাইবোনরা উপস্থিত হয়। ঝড় যে হবে তা নিশ্চিত। এবং ঝড়ে অবশ্যই নৌকা ডুবে যাবে।
ইনজিনের ভটভট শব্দ হচ্ছে না। চিত্রা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বুড়ো মাঝি বলল, ইনজিলে ডিসটাব আছে। ঠিক করতাছি। চিন্তার কিছু নাই।
ইনজিন ঠিক করতে জানেন?
ইনজিন গরম হইছে। ঠাণ্ডা হইলে আপছে ঠিক হইব।
মাঝি নৌকা তীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কালো মেঘের টুকরাটা দ্রুত বড় হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটা মরে যায়নি তো?
না, মরে নি। এইতো বুক উঠানামা করছে। চিত্রা মাথায় পানি দেয়া বন্ধ করে ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
কালো মেঘ ঘন হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন মেঘের নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে আসছে। তীব্র অসহনীয় গরমটা আর নেই। বরং শীত শীত লাগছে। ঝড়ের আগে ঠাণ্ডা বাতাস বয় না-কী?
চিত্রা শোন!
চিত্রা মেঘ দেখছিল। সে চমকে তাকাল। মানুষটা দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করেছে। চিত্রা বলল, কিছু বলবেন?
মানুষটা হড়বড় করে বলল, সুলতান সাহেব আমাদের প্রধান অতিথি। উনি অনেক বড় মানুষ। তাকে বললেই তিনি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কি ব্যবস্থা?
পড়াশোনা, চাকরি।
চিত্রা তাকিয়ে আছে। মানুষটা ঘোরের মধ্যে কথা বলছে। তার সঙ্গে তর্ক বিতর্কে যাওয়া ঠিক না। চিত্রা বলল, আপনি শুয়ে পড়ুন।
মাহফুজ বলল, জ্বি আচ্ছা। বলেই আগের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝড় এসে পড়ল।
দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস
০২.
দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস সুলতান সাহেবের নেই। সেই সুযোগও অবশ্যি নেই। লাঞ্চের পর তিনি গা এলিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন। শুয়ে থাকতে থাকতে যেন ঘুম না এসে যায় তারজন্যে হাতে ইন্টাররেস্টিং কোন বই থাকে। ঘুম যখন চোখ জড়িয়ে আসে তখন তিনি বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করেন। আজ ঘুম তাড়াবার জন্যে তাঁর হাতে আছে সালভাদর ডালির বিখ্যাত ডায়েরী। ডায়েরীর কথাগুলো এই বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী সত্যি সত্যি লিখেছেন না নিজেকে বিশিষ্ট করার জন্যে লিখেছেন সুলতান সাহেব ঘুম ঘুম চোখে তা ধরার চেষ্টা করছেন। তাতেও ঘুমটা ঠিক কাটছে না। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে সে সত্যি লিখুক বা মিথ্যা লিখুক জগতের তাতে কিছু যায় আসছে না। সে ছবি কেমন এঁকেছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
সালভাদর ডালি লিখেছেন- আমি শিশুদের পছন্দ করি না। একজন শিল্পী শিশুদের পছন্দ করেন না তা-কি হয়? শিল্পীর অনুসন্ধান হচ্ছে। সৌন্দর্য এবং সত্যের অনুসন্ধান। শিশুরা একই সঙ্গে সত্য ও সুন্দর।
চোখে ঘুম নিয়ে জটিল ধরনের চিন্তা করা যায় না। তখন ঘুম আরো বেশি পায়। সুলতান সাহেব বই বুকের উপর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন- শো শো শব্দ হচ্ছে। সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ। সেই সঙ্গে দুলুনি। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন তাঁর মেয়ে রানু তাকে ডাকছে- বাবা উঠ, বাবা উঠ। ঝড় হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়।
স্বপ্নের মধ্যেই তিনি ঝড় দেখলেন। স্বপ্নে ভয়াবহ বিপর্যয় দৃশ্যগুলোতেও আনন্দ মেশানো থাকে। তিনি স্বপ্নে ঝড় দেখছেন। সেই দৃশ্য তাঁর কাছে খুবই সুন্দর লাগছে। তিনি দেখছেন খড়কুটোর মতো ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে তার মনে হচ্ছে পাখির পালকের মতো। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন রানুকে দেখা যাচ্ছে। ঝড় তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে গেলেও রানুকে উড়িয়ে নিচ্ছে না। রানুর লম্বা চুল বাতাসে উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। এবং সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে ডাকছে- বাবা বাবা।
সুলতান সাহেবের ঘুম ভাঙ্গল। তিনি দেখলেন এই বিকেলেও ঘর অন্ধকার। এবং সত্যি সত্যি ঝড় হচ্ছে। বাড়ির জানালায় খট খট শব্দ হচ্ছে। ঘর ভর্তি ধুলোভরা বাতাস। সুলতান সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন। রানু আনন্দিত গলায় বলল, বাবা ঝড় হচ্ছে।
আশ্বিন মাসের ঝড়ে এত আনন্দিত হওয়া ঠিক না। আশ্বিনা ঝড় প্রবল হয়ে থাকে। বাড়ি-ঘর তুলে নিয়ে যায়। ঝড় তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে।
রানু বলল, বাবা আমি ঝড় দেখতে বাগানে যাব।
সুলতান সাহেব বললেন, পাগলামী করবি না। ঝড় দেখার জন্যে বাগানে যেতে হয় না। ঘরের ভেতর থেকে ঝড় দেখা যায়।
আমার বাগানে যেতে ইচ্ছে করছে বাবা।
ডাল ভেঙ্গে মাথার উপর পড়বে।
রানু শাড়ির আঁচল কোমরে জড়াতে জড়াতে বলল, পড়ক। সুলতান সাহেবকে রানু আর কোন কথা বলার সুযোগ দিল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নেমে গেল। বাগানের গাছপালা যে হারে দুলছে-ডাল ভেঙ্গে পড়বে এটা প্রায় নিশ্চিত। মেয়েকে যুক্তি দিয়ে এখন ফেরানো যাবে না। কিছু মুহূর্ত আসে যখন মানুষ কোন যুক্তি মানে না। সুলতান সাহেব দেখলেন রানু প্রায় ঝড়ের মতোই এক গাছের নিচ থেকে আরেক গাছের নিচে যাচ্ছে। সে মনে হয় নিজের মনে চেঁচাচ্ছেও। ঝড়ের কারণে তার চিৎকার শোনা যাচ্ছে না।
সুলতান সাহেবের মনে হলো রানুকে একা একা বাগানে ছোটাছুটি করতে দেয়া ঠিক না। তার উচিত মেয়ের কাছে যাওয়া। সেটাও করা যাবে না রানুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে একা একা ছোটাছুটি করতে তার ভাল লাগছে। ঝড়ের মাঝখানে সে তার নিজের একটা জগত তৈরি করে ফেলেছে। এই জগতে সুলতান সাহেবের কোন মূল্য নেই। মেয়ের আনন্দে তিনি ভাগ বসাতে পারছেন না। ডাল ভেঙ্গে মেয়ের মাথায় পড়বে এই দুঃশ্চিন্তাটাও তিনি দূর করতে পারছেন না। যা ঘটার তা ঘটবেই ফেটালিস্টদের মতো এই চিন্তাও করতে পারছেন না। জটিল কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। আচ্ছা সালভেদর ডালি কি কোন ঝড়ের ছবি এঁকেছেন? প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে সেরকম কোন ছবি? না আঁকেন নি। মাইকেল অ্যাঞ্জালো আঁকেন নি, গঁগা আঁকেন নি। আধুনিক কালের মন্টে আঁকেন নি, পিকাসো আঁকেন নি। কেন আঁকেন নি? তাঁরা কি ঝড় দেখেন নি। তাঁরা সবাই কি ভীতু প্রকৃতির ছিলেন? ঝড়ের সময় তাঁরা দরজা বন্ধ করে ছিলেন?
.
সোহাগী গ্রামে ভয়ংকর একটা ব্যাপার হয়েছে। বিকাল পাঁচটা দশম মিনিটে গ্রামের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। ভাদ্রমাসের শেষে আশ্বিনের শুরুতে এরকম ঝড় হয়। এই ঝড়কে বলে আশ্বিনা ঝড়। কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে পড়ে। টিনের চালা উড়ে যায়। গ্রামের মানুষ এ ধরনের ঝড়ের সঙ্গে পরিচিত। তাদের কাছে একটা ভয়ংকর কিছু না।
ভয়ংকর ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে ঝড়ের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ধুপ করে একটা শব্দ হল। চাপা আওয়াজ কিন্তু ঝড় ছাপিয়েও সেই আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজটার মধ্যেই অশুভ কিছু ছিল। অশুভ ব্যাপারটা জানা গেল ঝড় থামার পর। সোহাগী গ্রামের পাঁচশ বছরের পুরনো এক মসজিদ ভেঙে পড়ে গেল। মসজিদের নাম জমুন খাঁ মসজিদ। অনেক দিন ধরেই মসজিদ ভেঙে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দেয়াল এবং ছাদ ফেটে গিয়েছিল। বৃষ্টির সময় ফাটা ছাদ দিয়ে পানি পড়ত। ভাঙা দেয়ালে সাপ আশ্রয় নিয়েছিল। একবার জুমা নামাজের খোৎবা পাঠের সময় সাপ বের হয়ে পড়েছিল। মসজিদের ইমাম মওলানা ইসকান্দার আলি সাপটা প্রথমে দেখেন এবং খোত্বা পাঠ বন্ধ করে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে ওঠেন। সাপটা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে চলে যায়। জুমার নামাজের শেষে মসজিদে যে সাপ বাস করে তাকে মারা যায় কি যায় না তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আল্লাহর ঘরে যে আশ্রয় নিয়েছে তাকে মারা কি ঠিক? সে তো কারো কোনো ক্ষতি করে নাই।
মওলানা ইসকান্দর আলি বয়স পঞ্চাশ। রোগা শরীর। অতিরিক্ত লম্বা বলে খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন। হাতে ছড়ি নিয়ে হাঁটার বয়স তার হয় নি। তারপরও তার হাতে বিচিত্র একটা বেতের ছড়ি সবসময় থাকে। হাঁটার সময় ছড়িটা তিনি হাত বদল করতে থাকেন। এই বাঁ হাতে এই ডান হাতে। মোটামুটি দেখার মতই দৃশ্য। মওলানা ইস্কান্দার আলি নিজের চারদিকে রহস্য তৈরি করে রাখতে পছন্দ করেন। মওলানা সাহেব শুরু থেকেই মসজিদেই ঘুমাতেন। কারণ আল্লাহর ঘর কখনোই পুরোপুরি খালি রাখা ঠিক না। তাছাড়া ইবাদত ছাড়াও মসজিদে বসে থাকার মধ্যে সোয়াব আছে। সাপ বের হবার পরে অবশ্যি ইসকান্দার আলি মসজিদে ঘুমানো ছেড়ে দিলেন।
মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ তৈরির প্রস্তাব এক জুম্মা বারে করা হল। মওলানা ইসকান্দর আলি কঠিন গলায় বললেন, প্রস্তাব যিনি করেছেন তিনি তওবা করেন। আল্লাহর ঘর মেরামত করা যায়, ভাঙা যায় না। উনার ঘর উনি যদি ভাঙতে চান তিনি নিজে ভাঙবেন।
সেই ঘটনাই ঘটেছে। জয়ুন খাঁ মসজিদ ধুপ করে ভেঙে ঢিবির মতো হয়ে আছে। পুরো ঘটনাটা ঘটেছে মওলানা ইসকান্দর আলির সামনে। মওলানা সাহেব এই বিভীষিকা দূর করতে পারছেন না। তিনি আতঙ্কে কাঁপছেন। মসজিদ থেকে বের হতে আর দুটা মিনিট দেরি হলে তিনি স্কুপের নিচে চাপা পড়তেন। ঘটনা কিভাবে ঘটল মওলানা তার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা দিলেন এই ভাবে :
আছরের নামাজ শেষ করলাম আমি একা। দিন খারাপ দেখে কোনো মুসুল্লি আসে নাই। যাই হোক, কী আর করা। আমি তো দড়ি দিয়ে বেঁধে মুসুল্লি আনতে পারব না। ঐটা বাদ থাকুক। যে কথা বলছিলাম আছরের নামাজ শেষ করে তসবি নিয়ে বসেছি। আপনারা হয়তো জানেন আছর থেকে মাগরের পর্যন্ত সময়টা খুব জটিল। কেয়ামত হবে আছর থেকে মাগরেবের মাঝখানের সময়ে।
আমি একমনে তসবি পড়তেছি। শুধু হয়েছে ঝড়। আমি ভাবলাম হোক না ঝড়। আমি বসে আছি আল্লাহর ঘরে। আমার আবার ভয় কী? আমি চোখ বন্ধ করে তসবি পাঠে মন দিয়েছি। তখন কলবের ভিতরে কে। যেন বলল- ইসকান্দর বাইরে যাও, সময় খারাপ। আমি বাইর হইলাম আর সঙ্গে সঙ্গে ধুপ।
মওলানা ইসকান্দর আলি যেরকম রোমহর্ষক বর্ণনা দিতে চেয়েছিলেন তেমন দিতে পারলেন না। ঘটনা বর্ণনার উত্তেজনার কারণে ধুপ শব্দটার অদ্ভুত উচ্চারণ করলেন। অদ্ভুত উচ্চারণের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি যুক্ত হওয়ায় এবং হাতের বেতের ছড়িটাও ধুপ করে পড়ে যাওয়ায় কিছু হাস্যরস তৈরি হল– কয়েকজন হেসে ফেলল।
মওলানা বললেন, হাসেন কে? আল্লাহ পাকের ঘর ভেঙে গিযেছে এর মধ্যে হাসির কিছু আছে? হাসি বন্ধ করে এই ঘটনা কেন ঘটল বিবেচনা করেন। এই সোহাগী গ্রামে কী গজব আসতেছে এইটা একটু ভাবেন। আল্লাহপাক এই অঞ্চলে তার ঘর চায় না। কেন চায় না?
ইসকান্দর আলি বক্তব্য শেষ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। শ্রোতাদের ভেতর তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এরা কি নতুন মসজিদ তৈরি করবে? নতুন মসজিদ না হলে তার চাকরির কী হবে? সে বিদেশি মানুষ। মসজিদের ইমামতি বাবদ তাকে মাসে পাঁচশ টাকা দেয়া হয়। গ্রামের মসজিদের ইমামতির টাকা কখনোই ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার, এটা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল। বিয়ে, আকিকা, মিলাদে টাকাপয়সা খারাপ আসছিল না। তবে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের যে-ব্যাপারটা আছে তা হচ্ছিল না। গ্রাম্য বিচার বা সালিসিতে তাকে কখনো কেউ ডাকে না। গ্রামে একটা স্কুল হবে। সেই বিষয়ে প্রায়ই সভা-সমিতি হয়, সেখানেও তাঁর ডাক পড়ে না। ডাক পড়লে স্কুলের চেয়ে মাদ্রাসার প্রয়োজন যে বেশি তা তিনি গুছিয়ে বলতে পারতেন। যে শিক্ষায় আল্লাহকে পাওয়া যায় সেই শিক্ষাই আসল শিক্ষা। স্কুল কলেজের শিক্ষা ইহকালের জন্যে। মাদ্রসার শিক্ষা ইহকাল-পরকাল দুই জাহানের জন্যে। সোহাগীতে একটা ঈদগা দরকার। যে ঈদগায় আশেপাশের মানুষও নামাজ পড়তে আসবে। সেই বিষয়েও কারো কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ঈদগা বানাতে তো আর দালান কোঠা তুলতে হয় না। ইমাম সাহেবের খোবা পড়ার একটা জায়গা হলেই হয়। তিন শ ইট দুই বস্তা বালি এক বস্তা সিমেন্ট।
মওলানা ইসকান্দর আলি খুবই মন খারাপ লাগছে। মসজিদ ভাঙার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটার পরও মানুষ কী স্বাভাবিক আছে! যে এটা কোন ব্যাপার না।
মওলানা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আপনাদের কথা জানি না। আমি অতি ভয়ে আছি। আমাদের উপর বিরাট গজব আসতেছে।
গনি মিয়া বললেন, গজবের কথা আসতেছে কেন? বহুদিনের পুরানা মসজিদ। কোনোদিন মেরামতি হয় নাই। বাতাসের ধাক্কা লাগছে। ভাইঙ্গা পড়ছে। এতদিন যে টিকেছে এটাই যথেষ্ট।
ইসকান্দার আলি বিরক্ত-চোখে গনি মিয়ার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। গনি মিয়া এই অঞ্চলের ক্ষমতাবান মানুষদের একজন। পরপর তিনবার চেয়ারম্যান ইলেকশন করেছেন। পাশ করতে পারেন নাই। সেটা কোন কথা না। তিনবার ইলেকশন করার ক্ষমতা কয়জনের থাকে? জমি-জিরাত ছাড়াও নেত্রকোনা শহরে তাঁর রাইসমিল আছে। একটা করাত কল কেনার চিন্তাভাবনা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষের মুখের উপর কথা বলা যায় না। সত্য কথাও বলা যায় না। দিনকাল পাল্টে গেছে, এখন আর মানুষ আগের মতো নাই। মওলানা ধরনের মানুষের দিকে। এখন আর আগের মতো ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে কেউ তাকায় না। মওলানাও যে বিবেচনায় রাখার মতো একজন, কেউ তাও বোধ হয় মনে করে না। ছট্ফট্ ভাবে।
সোহাগী গ্রামটা অনেক ভেতরের দিকে হলেও থাকার জন্যে ভালো। গ্রামের মানুষ হতদরিদ্র না। সবারই অল্প-বিস্তর হলেও জমি-জিরাত আছে। এরা খাটাখাটনি করে। আমোদ ফুর্তি হৈচেও করে। ক্লাবঘরের মতো আছে। ক্লাবঘরে পত্রিকা আসে। একটা লাইব্রেরি আছে। লাইব্রেরিতে দুই আলমারি বই। ব্যাটারিতে চলে এমন টিভি আছে। যেদিন যেদিন নাটক চলে, ভাড়া করে ব্যাটারি আনা হয়।
মওলানা ইসকান্দর আলি এদের সাথে যোগ দিতে পারেন না, তিনি মওলানা মানুষ। টিভির সামনে বসে প্রেম-ভালবাসার নাটক দেখবেন এটা কেমন কথা? ইচ্ছা থাকলেও গ্রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হয়। আমোদ ফুর্তির সবটাই আসলে শয়তানি কর্মকাণ্ড। এইসব কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়ানোও ঠিক না। আবার এদের কাছ থেকে খুব দূরে থাকাও ভুল। গ্রামের মানুষদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে তাদের সঙ্গে থাকতে হবে। দুধকে দই বানাতে হলে দইয়ের বীজ হয়ে দুধের সঙ্গে মিশতে হবে। দই-এর বীজ দশ হাত দূরে রেখে দিলে দুধ দুধই থাকে দই হয় না।
সোহাগী গ্রামে স্কুল হবে খুব ভাল কথা। বিদ্যাশিক্ষায় দোষ কিছু নাই। আমাদের নবী করিম বিদ্যাশিক্ষার কথা বলেছেন। তবে স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে টিপু সুলতান নাটক করতে হবে এটা কেমন কথা? সেই নাটকের জন্যে পাড়া থেকে মেয়ে নিয়ে আসতে হবে এটাই বা কেমন কথা। মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে এর সঙ্গে কি নাটকের মেয়ের কোনো যোগ নাই? ইসকান্দর আলি তার এই জাতীয় সন্দেহের কথা কাউকে বলবেন কিনা এখনো বুঝতে পারছেন না। মিটিং করে সবাইকে বলার দরকার নাই। এক দুইজনকে ঠিকঠাক মতো বলতে পারলেই কথা চলা শুরু করবে। কথা শুরু করাটাই কঠিন। একবার শুরু করলে কথা চলতে থাকে
গ্রামের মানুষ তাঁর কথায় কতটা গুরুত্ব দেবে তাও তিনি ধরতে পারছেন না। বিদেশি মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। তিনি বিদেশি মানুষ। আর দশটা মানুষের সঙ্গে যে মিশ খায় না, তাকেও কেউ পছন্দ করে না। তিনি আর দশটা মানুষের সঙ্গে মিশ খান না। যারা সারাক্ষণ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে তাদের মানুষ ভয়ের চোখে দেখে। তিনি তাই করেন। দিনের পর দিন রোজা করেন। রোজার একটা সোয়াব তো আছেই, তাছাড়াও রোজার অনেক সুবিধা আছে- সারাদিন খাওয়াখাদ্যের কোনো ঝামেলা নাই। সন্ধ্যাবেলা ইফতারের সময় কোনো-এক বাড়িতে উপস্থিত হন। যার বাড়িতে যান সে খুবই আনন্দের সঙ্গে ইফতার ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে শেষরাতের খাবার একটা বাটিতে করে সেখান থেকেই নিয়ে যান। কবে কোন বাড়িতে খাবেন এটা আগে থেকে বলেন না। এতে একধরনের রহস্য তৈরি হয়। সাধারণ মানুষ রহস্য পছন্দ করে।
দিনের পর দিন রোজা রাখার একটা উপকারিতা তিনি ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছেন। তার ব্যাপারে এই কথাটা চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। এখন অনেক দূর থেকে তাঁর কাছে লোকজন পানিপড়া নিতে আসে। তিনি ফিরিয়ে দেন। মুখে বলেন, এখনো সময় হয় নাই। সময় হোক পানিপড়া দিব।
এতেও খানিকটা রহস্য তৈরি হচ্ছে। তার মতো মানুষের জন্যে যত বেশি রহস্য তৈরি হয় তত ভালো। তিনি আরেকটা কাজ খুবই গুরুত্বের সঙ্গে করেন– কোরান পাক মুখস্থ করা। ছোটবেলায় হাফেজিয়া মাদ্রাসায় চার বছর ছিলেন। তাতে লাভ হয় নি। তার সঙ্গের সবাই হাফেজ হয়ে গেছে, তিনি পারেন নাই। কোরানে হাফেজ সবাই হয় না। যার উপর আল্লাহপাকের খাস দয়া আছে সেই হতে পারে। তার উপর আল্লাহপাকের যে খাস দয়া নাই তা তিনি বুঝতে পারেন। তারপরেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যে-কোনো একদিন সফল হয়ে যাবেন। সেটা আজ রাতেও হতে পারে, কালও হতে পারে। আবার আরো একবছর লাগতে পারে।
মওলানা ইসকান্দর আলি ঝড়ের পর হাঁটতে বের হয়েছেন। আজ তার পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। মনের উপর চাপ গিয়েছে বলেই বোধ হয় এই তৃষ্ণা। বুক মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। কোন বাড়িতে ইফতার করবেন তিনি। এখনো ঠিক করেন নি। হুট করে কোনো বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ইফতারের কথা বললে তাদের বিপদেই ফেলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত খারাপ ইফতার, কোনো বাড়িতে করেন নি। কাটা পেঁপে, শশা, দুধ-চিড়া, একটা ডিম সেদ্ধ, একটা কলা, তেল মরিচ দিয়ে মাখানো চাল ভাজা। নাই নাই করেও অনেক কিছু হয়ে যায়।
ঝড় এই গ্রামের মোটামুটি ভালোই ক্ষতি করেছে। ঘরবাড়ি না ভাঙলেও বেশকিছু গাছপালা ভেঙেছে। সুলেমানের নতুন বানানো টিনের ঘরের সব টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে। অথচ সুলেমানের পাশেই বিষ্ণুর কাঁচা খড়ের বাড়ির কিছুই হয় নি। আল্লাহপাকের কর্মকাণ্ড বোঝা সাধারণ মানুষের কর্ম না।
মওলানা ইসকান্দর আলি একবার ভাবলেন, ইফতারের জন্যে বিষ্ণুর বাড়িতে উপস্থিত হলে কেমন হয়। অন্য ধর্মের মানুষের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ করা যাবে না এমন তো কোনো কথা হাদিস কোরানে নাই। তাছাড়া বিষ্ণু লোক অত্যন্ত ভালো। সে কখনো মিথ্যাকথা বলে না, এবং সুযোগ পেলেই মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে। বিষ্ণু তার জন্যে একটা শীতল পাটি বুনে দিয়েছে। একটা তালের পাখা বানিয়ে দিয়েছে।
নবী করিমের একটা হাদিস আছে। এক সাহাবা নবী (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম কী? নবী উত্তরে বললেন, ইসলাম হল সত্য ভাষণ এবং পরোপকার।
এই বিবেচনায় বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বলা যায়, ও বিষ্ণু আইজ তোমার ঘরে ইফতারি করব। বিষ্ণু ছোটাছুটি করে ভাল যোগাড়ই করবে। আর যোগাড় করতে না পারলেও কিছু করার নেই। রিজিক উপর থেকে আসে। মানুষভাবে তার খাওয়া খাদ্য সে যোগাড় করে। আসল ঘটনা ভিন্ন। পিপীলিকা জানে না তার খাদ্য কে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে পিপীলিকা যায় হঠাৎ দেখে দুইটা চিনির দানা। পিপীলিকা খুশি। সে জানে না এই চিনির দানা তার চলার পথে কে ফেলে গেল। সে মহানন্দে চিনির দানা ঘরে নিয়ে যায়। পিপীলিকা যেমন চিন্তা করে না, মানুষও চিন্তা করে না। অথচ মানুষকে চিন্তা করার বুদ্ধি আল্লাহপাক দিয়েছেন।
ইস্কান্দার আলি বিষ্ণুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন- বিষ্ণুকে ডাকবেন কী ডাকবেন না মনস্থির করতে পারছেন না। ইফতার ওয়াক্তের বেশি দেরি নাই। মনস্থির করা দরকার।
কে, মওলানা সাহেব না?
ইস্কান্দার আলি চমকে তাকালেন। তার পেছনে সুলতান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সুলতান সাহেবের সঙ্গে তাঁর আগে পরিচয় হয় নাই। এই প্রথম দেখা। কেউ না বলে দিলেও তাঁর চিনতে অসুবিধা হল না। শহরবাসী মানুষের শরীরে শহরের চিকন লেবাস চলে আসে। এই লেবাস চোখে দেখা যায় না। তবে লেবাসের ফলে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। একজন শহরবাসী মানুষ যদি খালি গায়ে হাঁটু উঁচু লুঙ্গি পরে গ্রামের কোনো ক্ষেতের আলের উপর বসে থাকে তখনও তাকে চেনা যায়। শিক্ষার লেবাসও আছে। এই লেবাসও চোখে দেখা যায় না। একই পোষাক পরিয়ে একজন শিক্ষিত এবং একজন মূর্খকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখলেও চেনা যায়– কে শিক্ষিত কে মূর্খ।
সুলতান সাহেব গ্রামের এসেছেন এই খবর তিনি পেয়েছেন। অসম্ভব মানী একজন মানুষ তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে এসেছেন। মওলানা ইস্কান্দার আলির উচিত ছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসা। উচিত কাজটি করা হয় নি।
মানী লোককে সম্মান দিতে হয়। এও হাদিসের উপদেশ। মানী, জ্ঞানী এবং গুণী এই তিন সব সময় সম্মান পাবে। কারণ মান, জ্ঞান এবং গুণ আল্লাহপাকের পুরষ্কার। আল্লাহপাক নিজে যাকে পুরষ্কার দিয়েছেন– সাধারণ মানুষ তাকে সম্মান দিবে না কেন?
কেমন আছেন মওলানা সাহেব।
জ্বি ভাল আছি। আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গিয়েছি– এই বেয়াদবী ক্ষমা করে দিবেন। আসোলামু আলায়কুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার কথা শুনেছি। আপনাকে দেখার শখ ছিল।
জনাব, আমি খুবই নাদান মানুষ। ঝড়ের পর গ্রামের অবস্থা দেখতে বের হয়েছি। ক্ষয় ক্ষতিটা দেখি ভালই হয়েছে। শুনলাম মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে।
জ্বি জনাব।
মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে শুনে খুবই খারাপ লাগছে– এত দিনের পুরনো মসজিদ। কত ইতিহাস এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম আর্কিওলজি বিভাগকে মসজিদটার ব্যাপারে উৎসাহী করতে। সম্ভব হয় নি। এই মসজিদের সবচে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা কী আপনি লক্ষ্য করেছেন?
ইস্কান্দার আলি বললেন, কোন ব্যাপারটার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।
ইমাম যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ান সেই জায়গাটাকে কি বলে? মনে হয় মিম্বর। এই মসজিদে এ রকম দুটা জায়গা। পাশাপাশি। দুজন ইমাম তো নিশ্চয়ই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াবেন না। তাহলে দুটা জায়গা কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা কি? …
ব্যাপারটা ইস্কান্দার আলি লক্ষ্য করেছেন। মাথা ঘামান নি। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘামানোর দরকার ছিল। ইফতারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। একজন মানী লোক কথা বলছেন ফট করে তার মুখের উপর বলা যায় না– জনাব আমি যাই। মাগরেবের আজান দেয়া দরকার। আজানটা তিনি কোথায় দেবেন। জামাতে নামাজ পড়তে যদি কেউ আসে তারা কোথায় নামাজ পড়বে?
মওলানা সাহেব!
জ্বি।
চলুন আমার সঙ্গে চা খাবেন।
জ্বি আচ্ছা জনাব। বহুত শুকরিয়া।
মওলানা সুলতান সাহেবের পেছনে হাঁটছেন। তাঁর কাছে সুলতান সাহেব মানুষটাকে অস্থির প্রকৃতির বলে মনে হচ্ছে। অতি দ্রুত হাঁটছেন। অস্থির প্রকৃতির মানুষ দ্রুত হাঁটে। অস্থির প্রকৃতির মানুষ কথাও বেশি বলে। হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। তবে মানুষটার অহংকার মনে হয় কম। এত বড় মাপের মানুষ বাংলাদেশ সরকারের একজন রাষ্ট্রদূত। আগে ছিলেন বার্মার রাষ্ট্রদূত, এখন সম্ভবত নেপালের। মানুষটা হাঁটছেন লুঙ্গি পরে। গায়ে সৃতির পাঞ্জাবী। তার মত সামান্য মানুষকে প্রথম দেখাতেই চা খাবার দাওয়াত করে নিয়ে যাচ্ছেন।
মওলানা সাহেব।
জ্বি।
.
ইস্কান্দার আলি সুলতান সাহেবের বারান্দায় বসে আছেন। সুলতান সাহেব ভেতরে গিয়েছেন খুব সম্ভব চায়ের কথা বলতে। ইস্কান্দার আলি একটু চিন্তিত বোধ করছেন। চা আনতে আনতে রোজা খোলার সময় হয়ে যাবে না তো। শুধু চা নিশ্চয়ই আসবে না। চায়ের সঙ্গে নাশতা থাকবে। পানি থাকবে। ইস্কান্দার আলির সঙ্গে ঘড়ি নেই। মাগরেবের ওয়াক্ত বোঝার জন্য তাকে প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হয়। আজ আকাশ ঘোলা। সূর্য ডোবার ঠিক সময়টা ধরা মুশকিল। এই বাড়িতে হাঁস-মুরগি থাকলে ভাল হত। হাঁস-মুরগি সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘরে ঢুকে যায়। মোগর বাগ দেয় সূর্য ওঠার সময়। তবে আজকাল বোধ হয় নিয়ম পাল্টে গেছে। তাঁর নিজের বাড়িতে একটা মোরগ ছিল রাত দুটা আড়াইটার দিকে বাগ দিয়ে সবার ঘুম ভাঙ্গাতো।
সুলতান সাহেবের বাড়ির বারান্দাটা ভাল। সামনেই বাগানের মত আছে। দেশী ফুলের বাগান। একটা জবা ফুলেরগাছ জবা ফুলে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। জবা হিন্দুদের পূজায় লাগে। মুসলমান বাড়িতে এই ফুলের গাছ থাকা ঠিক না। মানুষ এবং জ্বীনের ভেতর যেমন হিন্দু মুসলমান আছে, গাছপালার মধ্যেও আছে। জবা তুলসি এইগুলা হিন্দু গাছ। নারিকেল-সুপারি মুসলমান গাছ। বাতাসের সময় এরা সিজদার মত নিচু হয় বলেই মুসলমান।
চারদিক পরিষ্কার ঝকঝক করছে। ঝড়ের কারণে শুকনো পাতা পড়ে থাকার কথা। একটা শুকনো পাতাও নেই। মনে হয় ঝট দেয়া হয়েছে। সুলতান সাহেবের বাড়িটা পাকা। এই গ্রামের তিনটা পাকা বাড়ির মধ্যে সুলতান সাহেবের বাড়িটা সবচেয়ে সুন্দর। সুন্দর বাড়ি আল্লাহর রহমত স্বরূপ। এই মানুষটার উপর আল্লাহর রহমত আছে।
ইস্কান্দার সাহেব খুবই অবাক হয়ে দেখলেন সুলতান সাহেব দুহাতে দুটা চায়ের কাপ নিয়ে নিজেই বারান্দায় এলেন। চায়ের সঙ্গে আর কিছু নেই। অথচ রোজা খোলার সময় হয়ে গিয়েছে বলে তার ধারণা।
সুলতান সাহেব বললেন, আমি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আছি। এর মধ্যে কোন এক রাতে এসে আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আমার বড় মেয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করতে চায়।
ইস্কান্দার আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
জানি না কেন। আপনার সম্পর্কে নানান গল্প-গুজব শুনেছে। আপনি নাকি সারা বছর রোজা রাখেন। সত্যি না-কি?
জ্বি না, সত্যি না। বছরে অনেক দিন আছে রোজা রাখা নিষিদ্ধ।
সেই নিষিদ্ধ দিনগুলো ছাড়া বাকি দিনগুলোতে রোজা থাকেন?
ইস্কান্দার আলি চুপ করে রইলেন। সুলতান সাহেব বললেন, আজ কি রোজা আছেন?
জ্বি।
আপনার তো ইফতারের সময় হয়ে গেল।
ইস্কান্দার আলি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, কোন সমস্যা নাই। এক গ্লাস পানি দিলেই হবে। পানি দিয়ে রোজা খুলব।
সুলতান সাহেব ব্যস্ত ভঙিতে উঠে ভেতরে চলে গেলেন। ইস্কান্দার আলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ইফতার আসবে। বড়লোকের বাড়ির ইফতার অতি উন্নত মানের হবারই কথা। দেখা যাক আল্লাহপাক আজ তার কপালে রিজিক কী রেখেছেন।
ইস্কান্দার আলি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন- মাগরেবের আজানটা তিনি এই বাড়ির উঠান থেকেই দেবেন। আজান তো তাকে দিতে হবে। মসজিদ নেই আজানটা তিনি দিবেন কোথায়। সুলতান সাহেব নিশ্চয়ই বলবেন না আপনি আমার বাড়ির উঠানে আজান দিতে পারবেন না। কোনো মুসলমানের পক্ষেই এই কথা বলা সম্ভব না।
সুলতান সাহেব আবার ঢুকলেন। এই বার তাঁর হাতে এসট্রে এবং সিগারেট। তিনি বসতে বসতে বললেন, রানুকে আপনার ইফতার তৈরি করতে বলে এসেছি। রানু আমার বড় মেয়ে। দেখি সে কী করে।
হুমায়ূন আহমেদ ইস্কান্দার আলি বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
সুলতান সাহেব বললেন, আজানের এখনো কিছু দেরি আছে। আজকের সূর্যাস্ত ছটা আটে বা দশে। এগজেক্টলি বলতে পারছি না। তিন দিনের আগের পত্রিকা দেখে বলছি।
আপনার মেহেরবাণী।
আমি সিগারেট খেলে কি আপনার অসুবিধা হবে?
জ্বি-না।
আমাদের গ্রাম আপনার কেমন লাগছে?
জ্বি-ভাল। অতি উত্তম।
গ্রামের মানুষরা কেমন?
অতি ভাল। সবাই আমাকে বড় পিয়ার করেন।
এই গ্রামের ছেলে, নাম মাহফুজ তার সঙ্গে কি পরিচয় আছে?
ভাল পরিচয় আছে। বুদ্ধিমান অন্তর পরিষ্কার। অতি উত্তম ছেলে।
যে তিন বারে ইন্টারমিডিয়েট পাস করতে পারে না সে অতি উত্তম হয় কীভাবে? বুদ্ধিমান যে বলছেন, তাকে বুদ্ধিমান তো বলা যায় না। একটা গ্রাম বদলে ফেলবে– স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বানাবে। পাকা রাস্তা করবে। এ ধরণের অবাস্তব চিন্তা কোন বুদ্ধিমান ছেলে করবে না। কাজ কর্মহীন অলস মানুষ দুধরণের চিন্তা করে হয় অসৎ চিন্তা কিংবা সৎ চিন্তা। ছেলেটা সৎ চিন্তা করছে। তার চিন্তার ধরণ থেকেই বোঝা যায় কাজ কর্মহীন মানুষ।
ইস্কান্দার আলি চুপ করে রইলেন। কারো আলোচনা সমালোচনার সময় চুপ করে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। মনে হচ্ছে সুলতান সাহেব মাহফুজ নামের মানুষটার উপর বিরক্ত হয়েছেন। ইস্কান্দার আলি বিরক্তির কারণটা ধরতে পারছেন না। বিরক্তিটা কোন পর্যায়ের তাও ধরা যাচ্ছে না। মনে হয় খুব বেশি পর্যায়ের। বড় মানুষরা রাগ-বিরক্তি-ভালবাসা-ঘৃণা সবই মাত্রার মধ্যে রাখেন। তারা কখনো মাত্রা অতিক্রম করেন না। এটা ভাল। পাক কোরানে মানুষকে বার বার বলা হয়েছে- সীমা অতিক্রম না করার জন্যে।
মওলানা সাহেব!
জ্বি জনাব।
আমি কাজের মানুষ। আমি কাজ পছন্দ করি। স্বপ্ন বিলাস পছন্দ করি না। স্কুল ফান্ডের জন্যে নাটক হবে। নাটকের জন্যে শহর থেকে নায়িকা আসবে– এইসব খুবই ফালতু ব্যাপার। স্কুলটা সেখানে মূল না। নাটক করাটাই মূল বিষয়। নাটক থিয়েটার নিয়ে কয়েকদিন হৈ চৈ করা।
হৈ চৈ করার দরকার আছে। আনন্দ ফুর্তি সবই প্রয়োজন কিন্তু শিখণ্ডি দাঁড় করানো কেন? স্কুল কলেজ পেছনে রেখে নাটক থিয়েটার কেন? আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। বিরক্তির প্রধান কারণ আমাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা। আমি কিছুই জানি না, হঠাৎ দেখি হাতে লেখা পোস্টার টিপু সুলতান নাট্যানুষ্ঠান– আমি প্রধান অতিথি। পোস্টারে দুটা বানান ভুল। আমি এসেছি রানুকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিরিবিলি সময় কাটাতে, এর মধ্যে একি উপদ্রব!
.
ইস্কান্দার আলির মনে হল এই মানুষটার বিরক্তি সহজ পর্যায়ের না, জটিল পর্যায়ের। বিরক্ত মানুষের সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক না, কারণ বিরক্তি যে-কোন সময় দিক বদলায়। একজনের বিরক্তি অন্য জনের উপর চলে আসে। মাহফুজের উপর বিরক্তিটা হঠাৎ তার উপর এসে পড়তে পারে। ভালবাসা বা রাগের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে না। এক জনের ভালবাসা আরেক দিকে যায় না, বা এক জনের রাগ অন্যজনের দিকে যায় না।
রানু ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঢুকল। ইস্কান্দার আলি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হল দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের জীবনে তিনি এমন রূপবতী তরুণী দেখেন নি। বেহেশতবাসী প্রত্যেককে সেবার জন্যে সাতটা করে হুর দেয়া হবে। ইস্কান্দার আলির মনে হল সেই সাতটা হুরের কোনটাই এই মেয়ের পায়ের কড়ে আঙ্গুলের নখের কাছে যেতে পারবে না। এক দৃষ্টিতে কোন তরুণী মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা নিতান্তই অভদ্রতা, কিন্তু ইস্কান্দার আলি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছেন না। রানু ইস্কান্দার আলির দিকে তাকিয়ে বলল, চাচা স্লামালিকুম।
ইস্কান্দার আলি হড়বড় করে বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম মা। ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ।
ইস্কান্দার আলি তার দৃষ্টি মেয়েটির হাতের ট্রের দিকে নিয়ে গেলেন। অতি অল্প সময়ে সে অনেক আয়োজন করেছে। লেবুর সরবত, সমুচা, গোশত পরাটা, আরেকটা বাটিতে সবুজ রঙের কী-যেন দেখা যাচ্ছে। শহুরে কোন খাবার বোধ হয়। মিষ্টি জাতীয় কী-না কে জানে। ইফতারের মিষ্টি জাতীয় কিছু থাকা দরকার। নবীজীর সুন্নত। নবীজীর মতো হওয়া তো সম্ভব না। তাঁর দুএকটা কাজকর্ম অনুসরণ করার সামান্য চেষ্টা।
রানু বলল, মওলানা সাহেব, আপনি অবশ্যই আরেকদিন আমাদের এখানে ইফতার করবেন এবং রাতে খাবেন। আজ তাড়াহুড়া করে কী করেছি আমার খুবই খারাপ লাগছে।
ইস্কান্দার আলি বললেন, জ্বি আচ্ছা আম্মা। আপনি অনেক ইফতারের ব্যবস্থা করেছেন। অকারণে শরমিন্দা হচ্ছেন। তাছাড়া আম্মা, মানুষের রিজিক আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রাখেন। আজ আমি ইফতার কী করব সবই অনেক আগে ঠিক করা। আল্লাহপাক যা যা চেয়েছেন আপনি তাই তৈরি করেছেন। তার বেশিও না, কমও না। মা, ঘরে কি রেডিও আছে?
রানু বরল, জ্বি না। কেন বলুন তো।
আজান শোনার জন্য।
সুলতান সাহেব বললেন, এবারে রেডিও আনা হয় নি। তাড়াহুড়া করে এসেছি।
ইস্কান্দার আলি বললেন, কোন অসুবিধা নাই। অনুমানে রোজা ভাঙব। খালি চোখে যখন গায়ের পশম দেখা যাবে না তখন বুঝতে হবে সূর্য ডুবেছে।
রানু বলল, বা, ইন্টারেস্টিং তো। আমি কিন্তু আমার গায়ের পশম দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কি রোজা ভাঙবেন?
ইস্কান্দার আলি বললেন, আম্মা আরেকটু দেখি।
রানু বলল, আপনাকে দেখার এবং আপনার সঙ্গে কথা বলার আমার সখ ছিল। আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি।
কি গল্প?
আপনি সারাবছর রোজা রাখেন, সারারাত জেগে ইবাদত করেন।
আম্মা গল্পের মধ্যে মিথ্যা আছে। সত্য গল্পের মধ্যে মানুষ আনন্দ পায় না। এই জন্যে গল্পের মধ্যে মিথ্যা মিশায়। শরীর সুস্থ রাখবার ব্যাপারে আমাদের ধর্ম খুব জোর দিয়েছে। সারারাত ইবাদত বন্দেগী করলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আপনি কি আপনার সমস্ত কাজ-কর্ম হাদিস-কোরান দেখে করেন?
জ্বি-না আম্মা, করি না। করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া হাদিস-কোরান তেমন জানিও না।
আমার বাবা কিন্তু খুব ভাল জানেন। তিনি ধর্ম-কর্ম করেন না কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা।
ইস্কান্দার আলি এক পলক তাকালেন সুলতান সাহেবের দিকে তারপর সাহস করে বলে ফেললেন-যে বিদ্যা কাজে খাটে না সেই বিদ্যার কোন দাম নাই গো আম্মা।
সুলতান সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ইস্কান্দার আলি রোজা ভাঙছেন। সারাদিনের উপবাসী একজন মানুষ আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করবে। এই সময়টা তর্ক করে জটিল করা ঠিক না। তাছাড়া তর্ক তার সঙ্গেই করা যায় যে বোঝে। মওলানা সাহেবকে তিনি যদি বলেন কাজে খাটবে না ভেবে কী বিদ্যা অর্জন বন্ধ রাখা যায়? মওলানা কী ব্যাপারটা বোঝবেন? নবীজী বলেছেন-বিদ্যা অর্জনের জন্যে সুদূর চীনে যাও। তিনি তো বলেন নি যে বিদ্যা তুমি কাজে খাটাতে পারবে সেই বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেও না।
ইস্কান্দার আলি প্রথমেই সবুজ রঙের খাবারটা খাচ্ছেন। টক-মিষ্টি খাবার। বাদামের গন্ধ আসছে। আল্লাহপাকের দুনিয়াতে কত খাবারই না আছে। এই খাবারটার নাম জিজ্ঞেস করাটা কী অভদ্রতা হবে। রানু মেয়েটা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ইস্কান্দার আলির মনে হল মেয়েটার আসল নাম রাণী। আদর করে তারা ডাকে রানু। দুটা নামই সুন্দর। বড়ই সুন্দর।
সুলতান সাহেব বললেন, আপনি এ-পর্যন্ত কয়টা রোজা রেখেছেন?
ইস্কান্দার বিনীত ভঙিতে বলল, ইয়াদ নাই জনাব। রোজার হিসাব রাখার চেষ্টাও করি নাই। যার হিসাব তিনি রাখবেন। আমার দরকার ইবাদত করা। নেকি-বদির হিসাব রাখার জন্যে দুই কাঁধে দুই ফিরিশিতা আছে। মানুষের হিসাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়, ফিরিশতার হিসাবে হয় না।
সুলতান সাহেব বললেন, আপনি একদিন হাতে সময় নিয়ে আসবেন। ধর্ম নিয়ে আলোচনা করব।
আপনি আসতে বলছেন আমি অবশ্যই আসব। কিন্তু জনাব ধর্ম আলোচনা করতে পারব না। এই বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান-বুদ্ধি নাই।
রানু বলল, আমি তো শুনেছি পুরো কোরান শরীফ আপনার মুখস্ত।
ভুল শুনেছেন মা। মুখস্ত করার চেষ্টা করতেছি। হয়েও হয় না। গণ্ডগোল হয়ে যায়। আল্লাহপাক বিশেষ দয়া না করলে কোরান-মজিদ মুখস্ত হবে না। আম্মাজী, এই সবুজ মিষ্টি কি আরেকটু আছে।
জ্বি আছে। আমি নিয়ে আসছি।
মিষ্টিটার নাম কি?
মিষ্টিটার নাম রানু-পছন্দ। আমার আবিষ্কার করা মিষ্টি-এই জন্যে আমার নামে নাম। মিষ্টিটা আপনি ছাড়া আর কেউ এতো পছন্দ করে খায় নি।
আম্মাজী, একেবার বেহেশতী মিষ্টি।
রানু খুশি খুশি মুখে মিষ্টি আনতে গেল। যাবার আগে বলে গেল আপনি ধীরে সুস্থে অন্য খাবারগুলো খান। মিষ্টি তৈরী নেই, বানিয়ে আনতে সামান্য দেরি হবে।
তাহলে থাক।
থাকবে কেন? দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
ইস্কান্দার হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে সুলতান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, জনাব আপনার কন্যা উপস্থিত নাই এই ফাঁকে আপনাকে একটা কথা বলার ইরাদা করেছিলাম। যদি অনুমতি দেন।
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে ফেললেন। মওলানা-টাইপ মানুষের বিশেষ কথা মানেই সাহায্য। ভিক্ষা-বৃত্তি। একটা কোন ফাঁক পেলেই এরা অভাব-অনটনের কথা বলবে। সুলতান সাহেব গম্ভীর গলায় বলেন, বলুন কি বলবেন?
মাহফুজ ছেলেটার প্রসঙ্গে একটা কথা।
কি কথা?
সে অতি ভাল ছেলে। মানব-দরদী। তার চিন্তা-ভাবনা সবই অত্যন্ত পরিষ্কার। জগতের নিয়ম হল ভালর হাত ধরে মন্দ ঢুকে।
জগতের নিয়ম বলার দরকার নেই- মাহফুজ সম্পর্কে কি বলতে চাচ্ছেন বলুন।
ছেলেটা খারাপ-পাড়া থেকে একটা মেয়ে নিয়ে গ্রামে আসতাছে। নাটক করবে।
তাতে সমস্যা কি?
জ্বি-না কোন সমস্যা নাই। উদ্দেশ সৎ হলে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু জনাব জগতের নিয়ম হল…
আপনাকে জগতের নিয়ম ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। মূল ব্যাপারটা বলুন।
মেয়েটা থাকবে আপনার বাড়িতে। এটা জনাব ঠিক হবে না। আপনি যে বাড়িতে থাকেন- রানু মা যে বাড়িতে থাকে।
আমার বাড়িতে থাকবে মানে? কই আমি তো কিছু জানি না। আমাকে কিছু না জানিয়ে আমার বাড়িতে একটা প্রসটিটিউট এনে তুলবে? কি বলছেন এসব?
তাহলে জনাব আমি ভুল শুনেছি। এরা আলাপ-আলোচনা করছিল সেখান থেকে শুনলাম।
শুনুন ইস্কান্দার সাহেব, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিরিবিলিতে থাকার জন্যে এসেছি। বিশেষ কিছু দুর্ভাগ্যজনক কারণে আমার মেয়েটার মন অত্যন্ত খারাপ। কথাবার্তা বলে আমি মেয়েটার মন ভাল করতে চাই। এর মধ্যে বাইরের কেউ এসে আমাদের সঙ্গে থাকবে সে প্রশ্নই আসে না।
ইস্কান্দার আলি খাওয়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় বললেন রানু মার কি হয়েছে?
তার কি হয়েছে সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই।
জ্বি জনাব, অবশ্যই। আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন।
আপনি কিছু খাচ্ছেন না। খান।
রানু সবুজ মিষ্টির বাটির নিয়ে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, আপনাকে এই মিষ্টি রান্না করা শিখিয়ে দিয়ে যাব। খুব সহজ। সবুজ রং-টা কোন ব্যাপার না। এটা হল ফুড কালার। একটা শিশি আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি রান্না-বান্না করতে পারেন না?
জ্বি আম্মা পারি। ডাল-ভাত, আলু-ভর্তা এই সব। জটিল কিছু পারি না।
রানু-পছন্দ মিষ্টি বানানো জটিল কিছু না। ইনগ্রেডিয়েন্টসও সবই হাতের কাছে পাবেন। শুধু শাদা সির্কা লাগবে। শাদা সির্কা নিশ্চয়ই পাওয়া যায়? এখানে পাওয়া না গেলেও নেত্রকোনায় তো পাওয়া যাবেই। আপনি নেত্রকোনা থেকে আনিয়ে নেবেন।
ইস্কান্দার আলি মৃদু গলায় বললেন, আম্মাজী, আপনার অনেক মেহেরবানী।
রানু আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মওলানা সাহেবের খাওয়া দেখতে তার খুবই ভাল লাগছে। সুলতান সাহেব তাকিয়ে আছেন বিরক্ত চোখে। হঠাৎ কেন জানি খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। বিরক্তির কারণটা ধরতে পারছেন না। সন্ধ্যার এই সময়টা তিনি বাগানে হাঁটাহাঁটি করেন। মওলানার কারণে হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না– এটাই কি কারণ। তাকে ফেলে রেখে বাগানে চলে যাওয়া যায়। সেটাও ঠিক হবে না। মওলানাকে তিনিই চা খেতে ডেকে এনেছেন। অবশ্যি রানু আছে। মওলানার দায়িত্ব তার উপর দিয়ে চলে যাওয়া যায়। সেটাও বোধ হয় ঠিক হবে না। গ্রামের মানুষরা খুব সুক্ষ্মভাবে কিছু চাল চালে। শহুরে মানুষ সে-সব ধরতে পারে না। তাঁর সহজ-সরল মেয়েকে এসব চাল থেকে দূরে রাখতে হবে।
ভাল-মানুষ ভাবধরা এই মওলানা একটু আগে সুক্ষ্ম চাল চালল। মাহফুজ ছেলেটা একটা খারাপ মেয়ে নিয়ে আসছে সেই মেয়ে থাকবে তাঁর বাড়িতে। ঘটনার বড় অংশই মিথ্যা। তাঁর বাড়িতে মেয়েটার থাকার অংশটা। মাহফুজ কোন বোকা ছেলে না। সে তার বাড়িতে একজনকে রাখবে সেই বিষয়ে আগে কথাবার্তা বলে রাখবে না তা হয় না। তাহলে মওলানা এই মিথ্যা কথাটা কেন বলল?
এই ধরণের মানুষ কথায় কথায় নবীজীর প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। তার আদর্শ পালন করার জন্যে ব্যস্ততার সীমা থাকে না। আংগুলে আকিক পাথর পরা, চোখে সুরমা দেয়া এই সব সুন্নত কারণ নবীজী করতেন। আসল সুন্নতের ধারেকাছে কেউ নেই। আসল সুন্নত, তিনি মিথ্যা কথা কখনও বলেন নি।
সুলতান সাহেব থমথমে গলায় বললেন- মওলানা সাহেব, আপনার হাতে কি এটা আকিক পাথর?
ইস্কান্দার আলি বললেন, জ্বি জনাব।
আকিক পাথর কেন পরেছেন?
পাক-কোরানে আকিক পাথরের উল্লেখ আছে জনাব। তার চেয়েও বড় কথা নবীজী সাল্লাললাহু আলায়হে সালাম এই পাথর পরতেন।
ও আচ্ছা।
ইস্কান্দার আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। তিনি পরিস্কার বুঝতে পারছেন মানুষটা হঠাৎ রেগে গেছেন। হঠাৎ রাগার কারণটা কী? না-কী মানুষটার স্বভাবই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া?
জ্বরে অচেতনের মত
০৩.
কে বলবে যে মাহফুজ নামের মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও জ্বরে অচেতনের মত হয়েছিল। তার মাথায় খুব কম করে হলেও দশ কলসি পানি চিত্রা নিজে ঢেলেছে। জ্বরের ঘোরে মানুষটা উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছিল। চোখ হয়েছিল পাকা টমেটোর মত লাল।
এখন কি সুন্দর স্বাভাবিক। মাঝির কাছ থেকে নিয়ে পান চিবাচ্ছে। তার পান চাবানো দেখে মনে হচ্ছে খুব মজার পান। মানুষটার চোখের রঙও এখন প্রায় স্বাভাবিক। একটু লালচে আভা আছে। সে থাকাও না থাকার মত। চিত্রা বলল, আপনার শরীর এখন ভাল?
মাহফুজ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, ভাল। মাঝে-মধ্যে আমার ভালুক-জ্বর হয়। এই দুই ঘণ্টার জন্যে সব আউলা হয়ে যায়। তারপর সব ঠিকঠাক। সব ফিটফাট।
বলতে বলতে মাহফুজ হাসল। চিত্রা মানুষটার হাসি দেখে মুগ্ধ। এই প্রথম সে হাসল। তার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে চিত্রা তার মুখে হাসি দেখে নি। চিত্রা বলল, আমি আপনার অবস্থা দেখে ভয় পেয়েছিলাম।
তুমি প্রথম দেখছ এই জন্যে ভয় পেয়েছ। কয়েকবার দেখলে ভয় পেতে না।
ডাক্তার দেখিয়েছেন?
আরে দূর, কিসের ডাক্তার। সামান্য জ্বর-জ্বারিতে ডাক্তারের কাছে গেলে রোগ লাই পেয়ে যায়। আরো শক্ত করে চেপে ধরে। অসুখ-বিসুখকে কখনো লাই দিতে নাই। অসুখ-বিসুখ পায়ের নিচে চেপে রাখতে হয়। চল রওয়ানা দেই।
চলুন।
মাহফুজ ব্যাগ হাতে নিল। বাচ্চা একটা ছেলে জোগাড় হয়েছে। তার মাথায় স্যুটকেস। চিত্রা বলল, অনেক দূর হাঁটতে হবে?
আধঘন্টার পথ। আমি অবশ্যি দ্রুত হাঁটি। আমার হিসাবে দুমাইল। দুমাইল হাঁটতে পারবে না?
পারব। এদিকেও মনে হয় ঝড় হয়েছে।
হুঁ হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা কাদা তুমি এক কাজ কর স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে হাঁট। পারবে না?
চিত্রা অবাক হয়ে বলল, পারব না কেন?
গ্রাম কেমন লাগছে?
ভাল।
অল্প ভাল না বেশি ভাল?
মিডিয়াম ভাল।
অনেকগুলো কারণে চিত্রার খুব ভাল লাগছে। যে প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছিল, চিত্রা প্রায় নিশ্চিত ছিল নৌকা ডুবিয়ে সে মারা যাবে। সে রকম কিছু হয় নি। ঝড়ে শুধু মাঝির ছাতাটা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। মাহফুজ নামের অসুস্থ মানুষটার অসুখ সেরে গেছে। সে শুধু যে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে তা না, চিত্রার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলছে। এই সহজ-ভাবটা তার মধ্যে আগে ছিল না। আগে ছিল কেজো ভাব। কাজের জন্যে একজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। কাজ শেষ তার প্রয়োজনও শেষ। তার সঙ্গে দ্রভাবে কথা বলার দরকার নেই। গল্প-গুজব করারও দরকার নেই। ভাড়া করা একটা মেয়ের সঙ্গে কিসের গল্প? কিন্তু এখন মনে হয় মানুষটা গল্প করতে চাচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা মানুষটার মুখে হাসি। সে মনে হয় হাসি জমা করে রেখেছিল, বাড়ির কাছাকাছি এসে জমানো হাসি খরচ করছে।
মাহফুজ বলল, রাত অনেক হয়ে গেছে। দশটার উপর বাজে।
চিত্রা বলল, দশটা এমন কোন রাত না।
তোমাদের শহরে না, কিন্তু গ্রামে নিশুতি রাত। রাত আটটার আগেই গ্রামের মানুষরা কুপি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কেন বলতো?
ঘুম পায় বলে।
তা-না। বেশি রাত পর্যন্ত কুপি জ্বালালে বাড়তি কেরোসিন খরচ। তাছাড়া রাত জেগে করবে কী? করারো কিছু নাই। ইলেকট্রিসিটি চলে এলে দেখবে গ্রামের মানুষও রাত এগারটার আগে ঘুমুতে যাবে না।
গ্রামের মানুষ রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকলে আপনি মনে হয় খুশি হন।
মাহফুজ জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার হাতে টর্চ লাইট। বাচ্চা ছেলেটা স্যুটকেস মাথায় নিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে। আলো ফেলে সে এগুচ্ছে। তার পেছনে পেছনে আসছে চিত্রা। চিত্রা মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। তার এক হাতে স্যান্ডেল। অন্য হাতে ঘোমটার আঁচল ধরা। মাহফুজ বলল, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?
জ্বি-না।
গল্প করতে করতে হাঁটলে পথ টের পাওয়া যায় না।
আপনি গল্প করুন আমি শুনছি।
কাদা দেখে দেখে পা ফেল। টর্চটা কি রাখবে তোমার হাতে?
আপনার হাতেই থাকুক।
বছর দুই পরে এলে দেখবে রাস্তা পাকা। সাইকেল রিক্সায় উঠে বসবে সাঁ করে তোমাকে নিয়ে যাবে।
দুই বছর পরে এলে ইলেকট্রিসিটি পাব। পাকা রাস্তা পাব?
ইলেকট্রিসিটি সামনের বছরই পাবে। কথাবার্তা হয়ে স্যাংসান পর্যন্ত হয়ে গেছে। এখন দরকার সামান্য ধাক্কা।
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না। কিসের ধাক্কা?
আমাদের দেশের নিয়ম হল স্যাংসান হবার পরও কিছু হয় না। তখন গুরুত্বপূর্ণ কাউকে ধাক্কা দিতে হয়।
ইলেকট্রিসিটির জন্যে কে ধাক্কা দিবে?
সুলতান সাহেব দিবেন। অ্যাম্বেসেডর মানুষ। ইনার সামান্য একটা কথা দশটা ধাক্কার সমান। মানুষ হিসেবেও অত্যন্ত ভাল। নাক-উচা কোন ব্যাপার উনার মধ্যে নাই।
চিত্রা বলল, যাদের খুবই নাক উচা তারা তাদের নাক-উচা ব্যাপারটা খুব সাবধানে আড়াল করে রাখে। কাউকে বুঝতে দেয় না। যাদের নাক সামান্য উচা তাদেরটাই শুধু বোঝা যায়।
মাহফুজ আশ্চর্য হয়ে বলল, তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বল। তবে সুলতান সাহেব সম্পর্কে তোমার কথা ঠিক না। উনি খুবই সিম্পল মানুষ। খুবই অন্যরকম। লুঙ্গি পরে গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটেন। একবার কি হয়েছে। শোন, বিষ্ণুর ছোট মেয়েটা কলতলা থেকে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে ফিরছে। বাচ্চা মেয়ে কষ্ট হচ্ছে। সুলতান সাহেব দেখতে পেয়ে নিজের হাতে বালতি এগিয়ে দিলেন। একজন অ্যাম্বেসেডর পানির বালতি নিয়ে যাচ্ছেন– ভাবা যায়?
চিত্রা নিঃশব্দে হাসল। কিছু বলল না।
মাহফুজ বলল, তুমি তো তাদের বাড়িতেই থাকবে। তখন নিজেই কাছ থেকে দেখবে।
আমি তাদের বাড়িতে থাকব কেন?
তা ছাড়া থাকবে কোথায়? আমি একা থাকি। আমার বাড়িতে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। সুলতান সাহেবের বাড়িটা পাকা দালান। পিছনে পুকুর আছে। সামনে সুন্দর বাগান। বাইরের কোন বিশিষ্ট মেহমান এলে আমরা ঐ বাড়িতে রাখি। বাড়ি তো খালিই পড়ে থাকে। সুলতান সাহেব দুই বছরে তিন বছরে একবার কয়েকদিনের জন্যে আসেন।
চিত্রা বলল, আমাকে ঐ বাড়িতে রাখবেন কেন? আমি তো বিশিষ্ট কেউ না।
বিশিষ্ট না হলেও গ্রামের মেহমান। তবে বছর দুই পরে এলে তোমাকে আর অন্যের বাড়িতে থাকতে হবে না। আমাদের নিজস্ব ক্যুনিটি সেন্টার তৈরি হয়ে যাবে। সেখানে দুটা রুম থাকবে। গেস্ট রুম। গেস্ট এলে থাকবেন। অ্যাটাচড বাথরুম। ফ্যান থাকবে। টিভি থাকবে।
দুবছরের মধ্যে এত কিছু হয়ে যাবে?
অবশ্যই হবে। তুমি দেখ না আমি কী করি।
এত টাকা পাবেন কোথায়?
আমাদের দেশে প্রচুর টাকাওয়ালা মানুষ আছে যারা মানুষের কল্যাণে টাকা খরচ করতে চায়। কিন্তু টাকা বের করে না কারণ তাদের মনে ভয় শেষ পর্যন্ত টাকা কাজে লাগবে না। অন্য কেউ মেরে দেবে। আমার কাজ হচ্ছে ভয় ভাঙিয়ে টাকা বের করা।
চিত্রা খিলখিল করে হাসল। মাহফুজ বিরক্ত গলায় বলর, হাস কেন?
আপনার অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনে হাসি লাগছে।
কোনটা অদ্ভুত কথা? দুই বছর পরে আমি গ্রামের চেহারা বদলে ফেলব, এটা?
হ্যাঁ এটা। আপনি কিছুই করতে পারবেন না।
মাহফুজ হতভম্ব হয়ে বলল, আমি কিছুই করতে পারব না?
চিত্রা বলল, না। দুই বছর পর আমি যদি আসি তাহলেও দেখব রাস্তায় এমনই কাদা আছে, ইলেকট্রিসিটি আসে নি। কিছুই বদলায় নি। আপনিও বদলান নি। তখনো আপনি আমাকে বলবেন দুবছর পর এলে আমি কী কী দেখব। এই সব হাবিজাবি। আপনিও বদলাবেন না। আপনিও হাবিজাবি কথা বলতে থাকবেন।
তোমার ধারণা আমি এতক্ষণ হাবিজাবি কথা বলেছি?
হ্যাঁ।
মাহফুজ চুপ করে গেল। সে এখন আগের চেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলছে। তার ভাব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে পেছনের ঘোমটা দেয়া মানুষটাকে অন্ধকারে ফেলে রেখে চলে যেতে চাইছে। চিত্রা বলল, আপনি কি আমার কথায় রাগ করেছেন?
মাহফুজ গম্ভীর গলায় বলল, না। যার মনে যা আসে সে বলবে। রাগ করা-করির কী আছে?
রাগ করবেন না। এরকম কথা আমি বলব না। তবে দুবছর পরে আমি সত্যি সত্যি আসব।
মাহফুজ কিছু বলল না। চিত্রা বলল, আপনি কি আমার সঙ্গে আর কথাই বলবেন না। কথা না বললে এতো লম্বা পথ পার হব কি করে? আমি এখনই টায়ার্ড হয়ে পড়েছি। আপনি সুন্দর একটা গল্প বলুন শুনতে শুনতে যাই।
আমি গল্প জানি না।
নাটকটা সম্পর্কে বলুন।
নাটক সম্পর্কে কি বলব, তুমি তো জানই– টিপু সুলতান।
অভিনয় কারা করবেন? মেইন রোল কে করবে?
ভুজঙ্গ বাবু।
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, কোন ভুজঙ্গ বাবু? গৌরীপুরের?
মাহফুজ তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। তাঁকে চেন?
তাকে কেন চিনব না। আমি উনার সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলা করেছি। উনি এখানে এসে নাটক করতে রাজি হয়েছেন?
মাহফুজ পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। সিগারেট ধরাতে ধরাতে গম্ভীর গলায় বলল, রাজি হবে না মানে, তুমি ভাব কি আমাকে?
চিত্রা বলল, আপনি সিগারেট শেষ করুন। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করব।
বেশি টায়ার্ড?
হু।
আমরা কিন্তু এসে পড়েছি। অল্প একটু আলো দেখতে পাচ্ছ না? ঐ আলো পার হলে আর মাত্র দশ গজ।
আপনি কি গজফিতা দিয়ে মেপেছেন?
অনুমানে বলছি।
গ্রামের অনুমান খুব উল্টাপাল্টা হয়। যেটাকে আপনি দশ গজ বলছেন দেখা যাবে সেটা আসলে একশ গজ।
কি বলছ তুমি, একশ গজ হবে কেন?
অবশ্যই একশ গজ। আপনার সঙ্গে এক শ টাকা বাজি।
এটা নিয়ে বাজি ধরতে হবে কেন?
বাজি আপনাকে ধরতেই হবে।
মাহফুজ ধাঁধায় পড়ে গেল। মেয়েটা কি ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছে? নাকি বাচ্চা মেয়েদের মত ফাজলামি করছে?
মাহফুজ সিগারেট শেষ করে বলল, চল আস্তে আস্তে যাওয়া যাক।
চিত্রা বলল, আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে কাঁটা ফুটেছে। কাঁটা বের না করে আমি যেতে পারব না।
এখন কাঁটা বের করবে কিভাবে?
আপনি টর্চ লাইট ধরুন। আমার সঙ্গে সেফটিপিন আছে।
সেফটিপিন দিয়ে এখন খুঁচাখুঁচি করবে?
এত দেখি ভাল যন্ত্রণা হল।
আপনি আমার উপর রাগ করছেন কেন? কাটাতো আমি ইচ্ছা করে ফুটাই নি।
না, রাগ করি নি। আসলে তোমাকে খালি পায়ে হাঁটতে বলা ঠিক হয়নি। ভুলটা আমার।
আপনার তো বটেই, আপনি নিজে জুতা মচমচ করে যাচ্ছেন আর আমাকে বলছেন খালি পায়ে যেতে।
চিত্রা কাটা ওঠানোর নানান চেষ্টা করল। কাঁটা বের করা গেল না। মাহফুজ বলল, বুড়ো আঙ্গুলে ভর দিয়ে কষ্ট করে যেতে পারবে না?
পারব।
মাহফুজ ইতঃস্তত করে বলল, একটা কাজ কর। আমার হাত ধরে হাঁট।
চিত্রা বিরক্ত মুখে বলল আপনার হাত ধরে হাঁটব কেন? এটা কেমন কথা?
বিপদের সময় এত কিছু দেখলে চলে না।
এটা এমন কোন বিপদ না। চলুন হাঁটি।
হাঁটি বললেও চিত্রা ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। সেফটিপিন দিয়ে খোঁচাখুঁচিতে পায়ের অবস্থা কাহিল।
মাহফুজ কড়া গলায় বলল, তুমি আমার হাত ধরে হাঁট। কোন সমস্যা নাই। চিত্রা আপত্তি করল না।
তারা গ্রামে পৌঁছল রাত এগারটার পর। মাহফুজ চিত্রাকে সরাসরি সুলতান সাহেবের বাড়িতে নিয়ে গেল। সুলতান সাহেব এবং তাঁর মেয়ে দুজন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাতে সমস্যা কিছু নেই। বাড়ির কেয়ারটেকার রমিজ একতলার ঘর খুলে দিল। ঘরে বিছানা পাতা আছে। ঘরের সঙ্গের বাথরুমে বালতি ভর্তি পানি। মাহফুজ বলল, যা লাগে রমিজকে বলবে সে এনে দিবে। রমিজ আমার নিজের লোক। টিপু সুলতান নাটকে তার পাট আছে।
চিত্রা বলল, কিছুই লাগবে না। আমি এক্ষুণি ঝাঁপ দিয়ে বিছানায় পড়ব।
মাহফুজ বলল, আরাম করে ঘুমাও। আমি সকালে এসে খোঁজ নিব। আমি রমিজকে বলে যাচ্ছি সে সকালে তোমাকে চা দিয়ে যাবে।
চিত্রা ঘাড় কাত করে বলল, আচ্ছা।
মাহফুজ বলল, এখন পায়ের কাঁটা তোলার দরকার নাই। আলো কম। এই আলোতে কাটা দেখা যাবে না। সকালে আমি এসে কাটা তুলে দিয়ে যাব।
আপনি কাঁটা তুলবেন?
হ্যাঁ। কোন অসুবিধা আছে?
না, কোন অসুবিধা নেই।
আমি তাহলেই যাই?
আচ্ছা।
হাত মুখ ধুয়ে তারপর ঘুমুতেও যেও। সারা পা ভর্তি কাদা।
চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, আপনার কি ধারণা আমি কাদা পা নিয়ে বিছানায় উঠে পড়ব? যে যা বলে আপনি তাই বিশ্বাস করেন? আর আপনি যে আমার বাজির টাকা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন এটা কেমন কথা?
কিসের বাজির টাকা?
আপনি বলেছেন বাতি থেকে দশ গজ। আমি মেপেছি। তিন কদমে হয় এক গজ। আলো থেকে এই বাড়ি দুইশ দশ কদম। দুইশ দশ ভাগ তিন কত হল? সত্তুর না? অর্থাৎ সত্ত্বর গজ। কাজেই আপনি বাজিতে হেরেছেন।
মাহফুজ পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করল। চিত্রা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সেই নোটটা হতে নিল।
রানু লেট রাইজার
০৪.
রানু লেট রাইজার। সকাল নটার আগে সে বিছানা থেকে নামে না। কিন্তু গ্রামে এসে তার সিস্টেম কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। যত রাতেই সে ঘুমুতে যায় না কেন ভোরবেলা পাখির কিচিমিচিতে ঘুম ভাঙে। পাখিদের হল্লা এলার্ম বেলের চেয়েও তীব্র ও তীক্ষ্ণ। পাখিদের চেঁচামেচিতে সে অভ্যস্ত নয় বলেই ভোরবেলা ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা ঘটছে বলে রানুর ধারণা। রানু এতে বিরক্ত না। বরং সকালবেলা জেগে ওঠাটা তার ভাল লাগছে। ঘুম-ঘুম চোখে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা। সকাল হওয়া দেখা। পাখিদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে ঝাঁপ দেয়ে দেখা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নামা। একতলায় নামার সঙ্গে সঙ্গে রমিজ হাতে এককাপ চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়। আগুন-গরম ধোয়া ওঠা চা। সকালের এই অংশটাও রানুর পছন্দ। রমিজ অন্য কাজকর্ম তেমন পারে না বা পারলেও করে না, তবে রানুকে দেখামাত্র অতিদ্রুত চা বানানোর কাজটা খুব ভাল পারে। শুধু একটাই দোষ কাপটা থাকে কানায় কানায় ভর্তি। প্রতিবারই রানু বলে এমন ভর্তিকাপ দেবেন না। প্রতিবারই রমিজ মাথা কাত করে বলে, জ্বি আচ্ছা আপা। আবার প্রতিবারই এই ভুল করে।
আজ রানু অন্যদিনের চেয়েও সকালে উঠেছে। শীত শীত লাগছিল বলে চাদরটা গায়ে দিয়ে চলে এসেছে। বিছানার চাদর জড়ানোয় তাকে দেখাচ্ছে কোলবালিশের মত। মা দেখতে পেলে খুব রাগতেন। ভাগ্যিস তিনি এখানে নেই। উঠানে দাঁড়িয়ে রানু মুগ্ধ হয়ে গেল। প্রতিদিনই মুগ্ধ হয়, আজকের মুগ্ধতাটা অন্যদিনের চেয়ে বেশি। কারণ আজ রেলিং-এ অদ্ভুত সুন্দর একটা পাখি বসে আছে। পাখিটার গায়ের পালক ময়ূরের পালকের মতো গাঢ় নীল। ঠোঁট টকটকে লাল। পাখিটা রানুকে ঘাড় কাত করে দেখল। আশ্চর্যের ব্যাপার উড়ে চলে গেল না। যেন সে বুঝতে পেরেছে রানু নামের মেয়েটাকে ভয় পাবার কিছু নেই। বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে কোলবালিশ সেজে চলে এলেও সে খুব ভাল মেয়ে।
কাক ছাড়া অন্য কোন পাখি মানুষকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। কাজেই নীল-পালকের পাখি এক সময় উড়ে গেল বাগানের দিকে। রানু পাখি কোথায় গেল দেখতে গিয়ে অন্য একটা দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
তার বয়সী সুন্দর একটি মেয়ে বাগানে একা-একা হাঁটছে। মেয়েটির হাতে চায়ের কাপ। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মেয়েটার মাথা ভর্তি চুল। চা খেতে খেতে সে নানান দিকে মাথা দুলাচ্ছে বলে মাথার চুল। পর্দার মতো দুলছে। সে আবার বিড়বিড় করে পাগলের মত কি যেন বলছে। আবার হাসছেও।
অচেনা একটা মেয়ে চা খেতে খেতে তাদের বাগানে হাঁটার ব্যাপারটা কী? এটা স্বপ্নের কোন দৃশ্য না-তো। রানুর কিছু কিছু স্বপ্ন বাস্তবের মতো স্পষ্ট হয়। এখানেও কী তাই হচ্ছে।
মেয়েটি এখন তাকে দেখতে পেয়েছে। চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। রানুর মনে হল মেয়েটার গায়ে রঙ ময়লা হলেও খুবই মায়াকাড়া চেহারা। বয়সও মনে হচ্ছে তার চেয়ে কম। তবে কালোমেয়েদের বয়স সহজে বোঝা যায় না। যা তাদের বয়স তারচেয়েও তাদের অনেক কম দেখায়। রানু সিঁড়ি বেয়ে নামছে। একবার মনে হল মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার আগে গায়ের চাদরটা ফেলে যাওয়া দরকার। তারপরই মনে হল থাক না চাদর।
রমিজ মনে হয় চায়ের কাপ নিয়ে তৈরিই ছিল। রানু সিঁড়ির গোড়ায় নামতেই হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। রানু বলল, মেয়েটা কে?
রমিজ বলল, নাটকের মেয়ে।
নাটকের মেয়ে মানে কি?
টিপু সুলতান নাটক যে হইব তার মেয়ে। ময়মনসিংহ থাইক্যা ভাড়া কইরা আনছে।
আমাদের এই বাগানে সে কি করছে?
বেড়াইতেছে। শহরবন্দরে থাকে গেরামের বাগান দেখে নাই। দেইখ্যা মজা পাইতেছে।
তা মজা পাক কিন্তু আমাদের এই বাগানে সে কিভাবে এল?
রাত্তিরে আমরার বাড়িত ছিল। আফনেরা ঘুমাইয়া পড়ছিলেন তহন মাহফুজ ভাই নিয়া আসছে।
আমাদের এখানেই কি তার থাকার কথা ছিল?
এই বাড়ি ছাড়া আর কই থাকব? আর থাকনের জাগা আছে?
মেয়েটার নাম কি?
নাম জানি না আফা।
রানু এগিয়ে গেল। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা এখনো অদ্ভুত লাগছে। এবং এখন কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে তার ভাল লাগবে। গ্রামে আসার পর থেকে সারাক্ষণ বাবার বক্তৃতা ধরনের কথা শুনে শুনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসল বক্তৃতা তিনি এখনো দেন নি। এই কদিন যা হয়েছে তা আসল বক্তৃতার রিহার্সেল। আসল বক্তৃতা নিশ্চয়ই ভয়াবহ হবে। বক্তৃতা ছাড়াও বাবা আজকাল তুচ্ছ বিষয় নিয়েও অনেক বেশি কথা বলেন। ব্যাপারটা মনে হয় বয়সের কারণে হচ্ছে। বয়স্ক মানুষ যে কোন কাজে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শুধু কথা বলায় তাদের ক্লান্তি নেই।
রানু মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল, আপনি কেমন আছেন?
চিত্রা নিচু গলায় বলল, ভাল আছি।
আপনি যে রাতে আমাদের বাড়িতে ছিলেন জানতাম না। ঘুম ভেঙ্গেই আপনাকে দেখে চমকে গেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখছি। আপনার নাম কি?
চিত্রা।
আমার ডাক নাম রানু। আমি এই বাড়ির মেয়ে।
আমি জানি।
রমিজ নিশ্চয়ই আপনাকে সব বলেছে।
জ্বি।
আমাদের বাগানটা খুব সুন্দর না?
খুব সুন্দর।
পুকুর-ঘাট দেখেছেন? পুকুর-ঘাট আরো সুন্দর। পুকুরটা অবশ্যি সুন্দর না। সবুজ শ্যওলা এমনভাবে পড়েছে যে পানি দেখা যায় না। তবে বাঁধানো ঘাটটা খুব সুন্দর। চলুন আপনাকে পুকুর-ঘাট দেখাই। আপনি কদিন থাকবেন?
আজ রাতটা থাকব।
পরশু যাবেন?
জ্বি।
তাহলে খুবই ভাল। আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন। আমরাও পরশু যাচ্ছি। বাবার বোধ হয় আরো কয়েকদিন থাকার ইচ্ছা কিন্তু আমার অসহ্য লাগছে।
রানুর মনে হল মেয়েটা ঠিক সহজ হতে পারছে না। প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছে ঠিকই। নিজ থেকে কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পাচ্ছে। নাটক-থিয়েটারের মেয়েদের এত লজ্জা থাকার কথা না। তাদের অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়। অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
রানু বলল, রাতে আপনার ঘুম কেমন হয়েছে।
ভাল হয় নাই।
নতুন জায়গা ঘুম ভাল হবার কথা না। আমারও একই অবস্থা। কোন নতুন জায়গায় গেলে প্রথম রাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় না। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়লেই দরজা ভেঙে ছয়-সাত জন ষণ্ডাগুণ্ডা ঢুকে পড়বে। যতবার বিছানায় যাই ততবারই মনে হয় দরজা ঠিকমতো লাগান হল না। বিছানা ছেড়ে উঠে ছিটকিনি পরীক্ষা করি। বিছানায় আবারও ঘুমুতে যাই। তখন আবারও মনে হয় ছিটকিনি দেয়া হয়নি। অথচ আগেই ছিটকিনি দেখে এসেছি। আপনারও কি সেরকম হয়?
না। কাল রাতে আমার ঘুম হয় নি অন্য কারণে।
কারণটা কি আমাকে বলা যাবে?
জ্বি-না বলা যাবে না।
বলতে ইচ্ছা না হলে বলতে হবে না।
রানু চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। চিত্রা মাথা নিচু করে হাসল। চিত্রার মনে হল কাল রাতে ঘুম না হবার কারণটা এই অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটাকে বলা যেতে পারে। এতে দোষের কিছু হবে না। চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আপনাকে বলি। কাল রাতে ক্ষিধার জন্যে ঘুম হয় নি।
তার মানে?
সারাদিন নৌকায় কিছু খাওয়া হয় নি। মাহফুজ ভাই অনেক রাতে এ বাড়িতে রেখে গেছেন। তখনো খাওয়ার কথা কিছু বলেন নাই। রেখেই চলে গেছেন।
একটা পুরো দিন আর পুরো রাত আপনি না খেয়ে কাটিয়েছেন?
চিত্রা আবারও হাসল। রানু বলল, আমার খুব রাগ লাগছে। আপনি খাবার দেয়ার কথা মাহফুজ ভাইকে বলতে পারলেন না।
বলার ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলতে পারি নাই।
রানু বলল, আই এ্যাম সরি। আই এ্যাম সো সরি। আমার খুবই খারাপ লাগছে।
আপনার খারাপ লাগবে কেন?
আমার বাড়িতে একটা মেয়ে না খেয়ে থাকবে আর আমার মন খারাপ লাগবে না? আপনি এক মিনিট দাঁড়ান। আমি রমিজ ভাইকে নাস্তার কথা বলে আসছি। আরেকটা কথা, আপনার পায়ে কি কোন সমস্যা? পা টেনে টেনে হাঁটছেন।
কাল রাতে এখানে আসার সময় কাঁটা ফুটেছে। বের করতে পারি নি।
আচ্ছা দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।
কি ব্যবস্থা?
বাবাকে বলব। উনি ব্যবস্থা করবেন। যে কোন সমস্যা বাবা সমাধান করতে পারেন। সমস্যা জটিল হোক বা সহজই হোক। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, আমি আসছি। হাঁটাহাঁটি করার দরকার নেই।
চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। তার খুবই অবাক লাগছে। বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে একটা মেয়ে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছিল তখন মনে হচ্ছিল উড়তে উড়তে নামছে। এখন আবার পাখির মতই উড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত যাচ্ছে বলে গায়ের চাদর পাখির ডানার মত পাখা মেলেছে। মেয়েটা এত সুন্দর সেটাও একটা বিস্ময়কর ঘটনা। মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? চিত্রার বয়স উনিশ। সে তার উনিশ বছর বয়সে এত সুন্দর মেয়ে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে মেয়েটাকে পাশে নিয়ে সে ছবি তুলত। সেই ছবি মাকে দেখিয়ে বলত, মা দেখ পরীর মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলেছি।
মা অবশ্যই ছবি দেখে নানান খুঁত বের করত। চোখ ছোট, নাক মোটা, হাঁটা ভাল না।
সে তখন মাকে চেপে ধরত, ছবি দেখে কি করে বুঝলে হাঁটা ভাল না। ছবিতে কি মেয়েটা হাঁটছে? তোমার নিজের ঠ্যাং নেই বলে তোমার কাছে মনে হয় জগতের সব মেয়ের হাঁটা খারাপ।
চিত্রার মন একটু খারাপ হয়ে গেল। নৌকা থেকে নামার পর থেকে একবারও মার কথা মনে হয় নি। এই প্রথম মনে হল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার সে মাকে কত দ্রুতই না ভুলে যেতে পারছে। ময়মনসিংহ ফিরে গিয়ে সে যদি দেখে মা মারা গেছেন তাহলে সে খুব কি কষ্ট পাবে? হ্যাঁ, কষ্ট পাবে। তবে ভয়াবহ কষ্ট না। কষ্টের চেয়ে বেশি হবে দুঃশ্চিন্তা। সে থাকবে কোথায়? যাবে কার কাছে?
রানু এসে পাশে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, পরোটা বানাতে বলে এসেছি। পরোটা আর গোশত। রাতের গোশত আছে। ঐটা গরম করে দেবে। আর ডিম ভেজে দেবে। ঠিক আছে?
চিত্রা গম্ভীর গলায় বলল, না হবে না। আমি পোলাও কোর্মা খাব। আর রুই মাছ ভাজা খাব।
চিত্রা কথাগুলো এমনভাবে বলল যে রানুর প্রথমে মনে হল মেয়েটা সত্যি সত্যি পোলাও কোর্মা খেতে চাচ্ছে। রহস্য করে যে কথা বলে সে
কথা শেষ করে ফিক করে হসে ফেলে। এই মেয়ে হাসছেও না। কথা শেষ করে আরো গম্ভীর হয়ে গেছে। বাহ্ মজার মেয়ে তো।
রানু বলল, আমি তোমাকে তুমি করে বলি? আমার বয়েসী কোন মেয়েকে আমি বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না। তোমার বয়স কত?
উনিশ।
রানু প্রায় চেঁচিয়ে বলল, কি আশ্চর্য আমার বয়সও উনিশ। আমার একটা স্বভাব কি জান? যাকে আমার পছন্দ হয় আমি শুধু তার সঙ্গে আমার মিল খুঁজে বের করতে থাকি।
চিত্রা বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে বড় একটা মিল আছে। তুমি অনেক মিল খুঁজে বের করলেও এই মিল কখনো বের করবে না।
রানু বলল, কি মিল?
চিত্রা বলল, আমরা দুজনই মেয়ে।
রানু হেসে ফেলল। মেয়েটাকে এত অল্প সময়ে তার এত পছন্দ হচ্ছে। কেন সে বুঝতে পারছে না।
রানু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আচ্ছা শোন, তোমার মাথায় কি মাঝে মাঝে অদ্ভুত পাগলামী আসে।
কি রকম পাগলামী?
যেমন ধর এক গাদা ঘুমের অসুধ খেয়ে ফেলা। ব্লেড দিয়ে হাতে আঁচড় দেয়া?
না, এরকম পাগলামী আমার মধ্যে নেই।
আমার কিন্তু আছে। একবার আমি কি করেছিলাম শোন, পেন্সিল কাটারের যে ব্লেড আছে, সেই ব্লেড স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলেছি। তারপর সেই ব্লেড দিয়ে হাতের গোড়া থেকে কব্জি পর্যন্ত কেটেছি। তুমি ভেবেছ একটা দাগ দিয়েছি? তা না অসংখ্য দাগ দিয়েছি। সেই গদা এখনো আছে। আমি যে ফুল হাতা ব্লাউজ পরেছি এই জন্যে পরেছি। নাশতা খাওয়া হোক তারপর আমি তোমাকে দাগ দেখাব।
চিত্রা অবাক হয়ে তাকাল। রানু বলল, এখন তোমার কাছে মনে হচ্ছে না আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ? শুধু যে হাতে দাগ দিয়েছি তা না, সারা শরীর দাগ দিয়েছি। এমন সব জায়গায় দিয়েছি যা কাউকে দেখানো যায় না। তবে তোমাকে দেখাব।
কেন এরকম কর?
রানু হাসতে হাসতে বলল, জানি না কেন করি।
.
শুধু যে অধিক শোকে মানুষ পাথর হয় তা-না অধিক রাগেও মানুষ পাথর হয়। সুলতান সাহেব হয়েছেন। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে চা খাচ্ছেন। প্রচণ্ড রাগের কিছুই তার চোহরায় নেই। তিনি বরং অন্যদিনের চেয়েও শান্ত। তবে সিগারেট ধরাবার সময় তিনি লক্ষ করলেন তার হাতের আংগুল সামান্য কাঁপছে। ঘটনাটা রাগ চেপে রাখার কারণেই ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে। তিনি এই কিছুক্ষণ আগে রানুর কাছে শুনেছেন থিয়েটারের একটি মেয়ে গত রাতে তার বাড়িতে ছিল। মেয়েটার নাম চিত্রা।
সুলতান সাহেব বললেন, ও আচ্ছা।
এমনভাবে বলছেন যেন থিয়েটারের মেয়ে থাকতেই পারে।
রানু বলল, কি কাণ্ড দেখ বাবা। মেয়েটা চব্বিশ ঘণ্টা কিছু খায় নি। এক লোক গভীর রাতে তাকে এ বাড়িতে ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেছে। আর তার কোন ট্রেস নেই। ভোরবেলায় যে সে এসে খোঁজ নেবে তাও এখন পর্যন্ত নেয় নি।
সুলতান সাহেব আবারও বললেন, ও আচ্ছা।
তারপরও ঘটনা আছে। মেয়েটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে। বাবা তোমাকে পায়ের কাঁটা বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুলতান সাহেব মেয়ের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন।
তুমি চা খাও বাবা। আমি চিত্রার সঙ্গে গল্প করতে করতে নাস্তা খাব।
রানু ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। প্রচণ্ড রাগে সুলতান সাহেব জমে গেলেন। মওলানা ইস্কান্দার আলির কথা তিনি অবিশ্বাস করেছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে মওলানা সত্যি কথাই বলেছে। খারাপ একটা মেয়েকে সত্যি সত্যি তার বাড়িতে এনে তুলেছে। এরা তাকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন মনে করে নি।
এই মুহূর্তেই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া দরকার। কিন্তু তা তিনি রানুর জন্যেই করতে পারবেন না। জগতের জটিলতা সম্পর্কে রানুর ধারণা নেই। সে পৃথিবীকে দেখছে শাদা চোখে। রানুর দৃষ্টি আহত না করে তাকে আগাতে হবে। মেয়েটিকে বের করে দিতে হবে এমনভাবে যে রানুর কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হবে। মাহফুজ নামের ছেলেটিকেও একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা যেন তার অনেক দিন মনে থাকে। ধরাকে কেউ কেউ সরা মনে করে। এই ছেলে সরাও মনে করছে না। পিরিচ মনে করছে। রমিজকে পাঠিয়ে স্কাউভ্রালটাকে কান ধরে নিয়ে আসা দরকার। তবে তিনি তা করবেন না। তিনি একজন ডিপ্লোমেট। কোন ডিপ্লোমেটই কখনো হুট করে কিছু করে না। তারা সময় নেয়। মহেন্দ্রক্ষণের জন্যে অপেক্ষা করে। তিনিও করবেন। হাসিমুখেই অপেক্ষা করবেন। রোজ যেমন গ্রামের ভেতর দিয়ে একটা চক্কর দেন, আজও দেবেন। ভেঙে পড়া মসজিদটা একবার দেখতে যেতে হবে। মসজিদের ইটগুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আর্কিওলজি বিভাগের কেউ এসে দেখুক। মসজিদ দেখতে গিয়ে মাহফুজ ছেলেটাকে ডেকে পাঠানো যেতে পারে। সেটা ঠিক হবে না। নিজের বাড়ির বাইরে তিনি যেখানেই গেছেন তাঁকে ঘিরে লোকজন জমা হয়েছে। কঠিন কথা সাক্ষী রেখে বলতে হয় না। মাহফুজকে নিজের বাড়িতেই ডেকে পাঠাতে হবে। তখন তার সঙ্গে যে কথাগুলো বলবেন সব ঠিক করে রাখতে হবে। প্রথম কথাটা হল
মাহফুজ সন্ধেবেলা তোমাদের নাটকে আমি যেতে পারব না। আমি পাবলিক ফাংশান থেকে দূরে থাকতে চাই। সারাজীবন তাই থেকেছি ভবিষ্যতেও তাই থাকব।
আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাকে কিছু না বলে কোয়েশ্চেনেবল ক্যারেক্টারের একটা মেয়েকে রেখে গেছ। এই কাজটা শুধু যে ঠিক করো নি তা না। অপরাধ পর্যায়ের একটা কাজ করেছ। আধঘন্টার মধ্যে মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। এবং এই কাজ যে তুমি আমার নির্দেশে করেছ তা যেন আমার মেয়ে না জানে। এখন আমার সামনে থেকে বিদেয় হও।
এই মেঘ, রৌদ্রছায়! কোনো মানুষই ভেবে রাখা কথা ঠিকঠাক বলতে পারে না। কোথাও না কোথাও গুবলেট করে ফেলে। সুলতান সাহেবের ব্যাপারে এরকম কখনো হয় না। যে-কথা যেভাবে বলবেন বলে তিনি ভাবেন সেই কথা তিনি ঠিক সেই ভাবেই বলতে পারেন।
সুলতান সাহেব সকালের নাশতা একা একা করলেন। এই সময় রানু তার সামনে থাকে। আজ সে খুব সম্ভব নষ্ট মেয়েটির সঙ্গে আছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। ভালমানুষের সঙ্গ কখনোই ইন্টারেস্টিং হয় না। মন্দ মানুষের সঙ্গ ইন্টারেস্টিং হয়। যে যত মন্দ তার সঙ্গ ততই আনন্দময়।
নাশতা শেষ করে সুলতান সাহেব কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা করছে। কী লিখবেন বুঝতে পারছেন না। গুছিয়ে কাউকে একটা চিঠি লিখতে পারলে হত। চিঠি লেখার তার মানুষ নেই। তিনি লিখেন সরকারি চিঠি। সেই চিঠি কোন মানুষকে লেখা হয় না। সরকারি কোন পদধারীকে লেখা হয়। সেইসব চিঠিতে কখনো লেখা থাকে না– ভাই আপনার শরীর এখন কেমন যাচ্ছে?
রানু দরজা ধরে দাঁড়াল। সুলতান সাহেব বললেন, কিছু বলবি?
রানু বলল, আমি কিছু বলব না। তোমার কি আরেক কাপ চা লাগবে?
না।
কি লিখছ?
কিছু লিখছি না।
কিছু লিখছ না তাহলে কলম হাতে বসে আছ কেন?
বন্দুক হাতে বসে থাকলেই যে গুলি করতে হবে এমন কথা নেই। ঠিক তেমনি কলম হাতে বসলেই লিখতে হবে এমন কথা নেই। তুই নাশতা করেছিস?
হ্যাঁ।
মেয়েটা নাশতা করেছে।
চিত্রার শরীরটা ভাল না বাবা। একটা পারাটার সামান্য একটা টুকরা মুখে দিয়ে বেচারী আর খেতে পারেন নি। আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি জ্বর। বেশ জ্বর, এখন শুয়ে আছেন।
জ্বর নিয়ে নাটক করবে কিভাবে?
আমিও সেই কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, কোন অসুবিধা হবে না। একবার না-কি একশ তিন জ্বর নিয়ে নাটক করেছেন।
মাহফুজ ছেলেটা কি জানে তার অভিনেত্রী অসুস্থ?
আমি খবর পাঠিয়েছি।
মাহফুজ এলেই ওকে আমার কাছে পাঠাবি।
আচ্ছা।
দুই কাপ চা নিয়ে আয়।
দুই কাপ কেন?
এক কাপ তোর জন্যে এক কাপ আমার জন্যে। আয় চা খেতে খেতে বাপ-বেটিতে কিছুক্ষণ গল্প করি।
বিশেষ কিছু বলবে?
হ্যাঁ।
দিনেরবেলা বিশেষ কথা শুনতে ইচ্ছে করে না বাবা। বিশেষ কথা শুনতে হয় রাতে। তোমার বিশেষ কথা রাতে শুনব।
কথা না শুনলি, আয় একসঙ্গে চা খাই।
আসছি। বাবা, তুমি কিন্তু এখনো চিত্রার পায়ের কাঁটা তোলার ব্যবস্থা কর নি। আমার মনে হচ্ছে পা খুঁচাখুঁচি করেই সে ইনফেকশন বাঁধিয়েছে। একজন ডাক্তার আনাও।
গণ্ডগ্রামে হৈ করে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। দেখি কি করা যায়।
.
সুলতান সাহেব রানুর সঙ্গে যেসব কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন তা গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। কোন কথাটার পর কোনটা বলবেন। সিঁড়ি গেঁথে গেঁথে ওঠা। স্টেপগুলো এমন হবে যে খুব সহজে টপকানো যায়। যেন হাঁপ না ধরে।
প্রথম শুরুটা করবেন ধর্ম বিষয়ক আলোচনা দিয়ে বুঝলি রানু আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু যে পৃথিবী নামক গ্রহেই মানুষ এসেছে তা তো না। আরো অনেক গ্রহেই এসেছে। এর উল্লেখ কিন্তু কোরান শরীফে আছে। সূরা জাসিয়ার ৩৬ নং আয়াতে বলা আছে–
All praise be to Allah Sustainer and nourisher. Of the Heavens, and Sustainer and nourisher Of the Earth. Sustainer and nourisher Of the worlds
এই সূরায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছে তিনি পৃথিবীর পরিচালক, আসমানের পরিচালক এবং জগতসমূহের পরিচালক। রানু তখন নিশ্চয়ই বলবে কি আশ্চর্য, কোরান শরীফে এই কথা আছে? তিনি বলবেন– কোরান শরীফে আরো অনেক আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞান বলছে। যেমন ধর ইউনিভার্স সৃষ্টি হল বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। তারপর থেকে কি হচ্ছে বিশ্বব্রাহ্মণ্ড ছড়িয়ে পড়ছে। একে বলা হয় expanding Universe. সূরা যরিনার সাতচল্লিশ নম্বর আয়াতে আছে —
We created the Heaven with a
Twist of the (Divine) Hand.
And surely we are expanding it.
গেট দিয়ে সংকুচিত ভঙ্গিতে একজন ঢুকছে। যে ঢুকছে তাকে রানু আগে কোনদিন দেখেনি তবু সে চট করে চিনে ফেলল– লোকটা আর কেউ না মাহফুজ। লোকটা এমন সংকুচিতভাবে ঢুকল কেন? সে-তো কোন রাজবাড়িতে ঢুকছে না। গেটে দারোয়ান নেই যে দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেবে না। মানুষটার সার্টের একটা বোতাম লাগানো নেই। এই ব্যাপারটা খুব চোখে পড়ছে। খাবার সময় কারো ঠোঁটের কাছে যদি একটা ভাত লেগে থাকে এবং সে সেটা না জানে তখন অস্বস্তিতে রানুর গা কিটকিট করে। তার ইচ্ছে করে পেপার নেপকিন দিয়ে সে নিজেই ভাতটা সরিয়ে দেয়।
ঘরে কি কোন বোতাম আছে? লোকটার শার্টে একটা বোতাম কি লাগিয়ে দেয়া যায় না? আচ্ছা লোকটার গলার স্বর কেমন? গলার স্বর রানুর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারো গলার স্বর পছন্দ না হলে তাকে রানুর কখনোই পছন্দ হবে না। সে যত ভাল লোকই হোক কিছুই যায় আসে না। মাহফুজ নামের মানুষটা দেখতে সুন্দর। অবশ্যি চোখের কাছে একটা বোকা বোকা ব্যাপার।
মাহফুজ রানুর সামনে দাঁড়াতেই রানু বলল, মাহফুজ সাহেব, আপনি ভাল আছেন?
মাহফুজ থতমত খেয়ে বলল, জ্বি।
রানু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল-মানুষটার গলার স্বর ভাল। শুধু ভাল না বেশ ভাল। গলার স্বর শুনলেই মনে হয় মানুষটা তার নিজের কেউ। যার সঙ্গে ফাজলামি করা যাবে। রসিকতা করা যাবে। ধমক-ধামক দেয়া যাবে। রানু বলল, আপনি সারা গ্রামে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফেলেছেন, আপনি কি জানেন বিজ্ঞাপনে দুটা বানান ভুল? প্রধান বানান ভুল, অতিথি বানানও ভুল। যেহেতু বাবা প্রধান অতিথি তিনি ভুল বানান দেখে খুব রাগ করেছেন। আপনি আজ যাবার সময় আমার কাছ থেকে শুদ্ধ বানান জেনে যাবেন এবং বিজ্ঞাপনের বানানগুলো ঠিক করবেন।
মাহফুজ বলল, জ্বি আচ্ছা।
আপনার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আছে। আপনি একটা মেয়েকে এখানে রেখে গেছেন রাতে খাবার ব্যবস্থা করেন নি।
মাহফুজ বিব্রত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। রানু বলল, আপনার বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে চিত্রার পায়ে কাঁটা ফুটেছে, আপনি কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন নি। শাস্তি হিসেবে এখন আমি আপনাকে পায়ে একটা কাঁটা ফুটিয়ে দেব। মুখ হাসি হাসি করে লাভ নেই। আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না।
মাহফুজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়েটির রূপ আগুনের মতো। বিস্ময়ের জন্যে এটাই যথেষ্ট। এমন রূপবতী মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়। কিন্তু সবচে বড় কথা হচ্ছে মেয়েটির সহজ কথা বলার ভঙ্গি। মেয়েটিকে লাগছে দীঘির মতো, যার পানি কাকের চোখের মতো পরিষ্কার। পুকুরের মাঝখানের বালু কণাগুলোও দেখা যাচ্ছে। কণাগুলোও সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে।
রানু বলল, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো শেষ হয় নি। আপনি চিত্রাকে ধমক দিয়েছেন কেন?
মাহফুজ বলল, ধমক দেই নাই।
অবশ্যই ধমক দিয়েছেন। যখন ঝড় শুরু হল, নৌকা দুলছে। তখন আপনি চিত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জান?
সেই বেচারী এমি ঝড়ের কারণে ভয়ে অস্থির। সে বলল, সাঁতার জানি না। তখন আপনি ধমকাতে শুরু করলে-কেন সাঁতার জান না। বিরক্তিতে ভূরু-টুরু কুঁচকে ফেলেছিলেন। সে সাঁতার জানে না সেটা তার ব্যাপার। তার ব্যাপারে আপনি ধমকা-ধমকি করবেন কেন? আপনি কি প্লেন চালাতে পারেন? নিশ্চয় পারেন না। এখন যদি আপনাকে আমি ধমকাতে শুরু করি কেন প্লেন চালাতে পারেন না, সেটা কি ঠিক হবে?
প্লেন চালানো আর সাঁতার তো এক জিনিস না।
অবশ্যই এক জিনিস। প্লেনও আকাশে সাঁতার কাটে। এখন আপনি ভেতরে যান। চিত্রা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনার আসার কথা ছিল খুব ভোরে-এখন বাজে দশটা। এই আপনার খুব ভোর?
মাহফুজ চিত্রার ঘরে ঢুকে গেল।
.
ট্রেতে করে চা নিয়ে রানু উপস্থিত হল। ট্রেতে দুকাপ না তিন কাপ চা। সুলতান সাহেব দেখলেন রানুর পেছনে মাহফুজ মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রানু বলল, বাবা মাহফুজ সাহেব এসেছেন। তোমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তোমাকে দেখলেই না-কি উনার ভয় লাগে আমি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। তুমি বকা দিয়ে দাও তো।
বকা দেব?
উনি চিত্রা মেয়েটিকে চব্বিশ ঘন্টা না খাইয়ে রেখেছেন। ওর পায়ে কাঁটা ফুটেছে। কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন নি।
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এটা তার শোবার ঘর। রানু তার শোবার ঘরে একজনকে নিয়ে উপস্থিত হবে এটা তিনি ভাবেন নি। মাহফুজ এসে তার পা ধরে সালাম করতে করতে বলল- মনটা খুবই খারাপ ছিল স্যার। একঘণ্টা আগে মনটা এত ভাল হয়েছে যে বলার না।
সুলতান সাহেব বললেন, এক ঘন্টা আগে বিশেষ কি ঘটনা ঘটল?
ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছেন। অ্যাসিসটেন্ট বলল, ভুজঙ্গ বাবু সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসবেন। ভুজঙ্গ বাবু বলেছিলেন আসবেন কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হয় নাই। এই জন্যে বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছিলাম।
ভুজঙ্গ বাবুটা কে?
টিপু সুলতানের পাঠ করবেন। বাড়ি গৌরীপুর। মারাত্মক অভিনেতা। আসল নাম মনোয়ার হোসেন। একবার যাত্রায় ভুজঙ্গ নামে পাঠ করলেন। তারপর থেকে নাম হয়ে গেল ভুজঙ্গ বাবু।
ও আচ্ছা।
ভোটার লিস্টেও উনার নাম ভুজঙ্গ বাবু।
ও।
এদিকে চিত্রা বাবার বিছানায় কাত হয়ে পড়েছে। আমার টেনশান আর কিছুতেই কমে না। একটা কমে তো আরেকটা তৈরি হয়।
মাহফুজ তাঁর সামনে বসেই চুকচুক করে চা খাচ্ছে। তিনি তাকে কিছুই বলতে পারছেন না।
প্লে একটু রাত করে শুরু হবে স্যার। দূর দূর থেকে লোকজন আসবে। এদের ঠিকঠাক মতো বসতে দিতে হবে। আরেকটা ভাল খবরও স্যার আছে–মেরাজকান্দার ছদরুল ব্যাপারী আসবেন।
ছদরুল ব্যাপারীটা কে?
ব্যবসা করেন।
কিসের ব্যবসা?
উনার অনেক ধরণের ব্যবসা আছে। তবে সবচে চালু ব্যবসা হল বিড়ির ব্যবসা। উনি বিশেষ অতিথি। উনার সম্পর্কে অনেক আজেবাজে বদনাম আছে। তবে উনি বিরাট দানশীল মানুষ।
সুলতান সাহেব বিরস মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আজকের অনুষ্ঠানে একজন বিড়ির ব্যবসায়ীর পাশে তিনি বসবেন। তিনি নিশ্চিত সেই ব্যবসায়ী লুঙ্গি পরেই মঞ্চে উপস্থিত হবে। তার সারা গা থেকে বিড়ির গন্ধ আসবে এটাই স্বাভাবিক।
ছদরুল ব্যাপারীর অবশ্যি আমাদের অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল না। উনি আসবেন মওলানা ইস্কান্দার আলির দোয়া নিতে। এই খবর পেয়ে আমি চেপে ধরলাম। আপনার কথাও বললাম-তখন রাজি হয়েছেন।
সুলতান সাহেব শুকনো মুখে বললেন, আমার কথা বলার দরকার হল কেন?
আপনি এত বড় একজন মানুষ। আপনার কথা আমি বলব না?
.
মাহফুজ আনন্দে ঝলমল করছে। আনন্দের উৎস ছদরুল ব্যাপারী। ব্যাপারী সাহেব বড় ধরনের কোন দান করবেন এটাই কী মাহফুজ আশা করছে? সেই আশাতেই তাকে বিশেষ অতিথি করা হল। তাকে প্রধান অতিথি করার মূলেও এই আশা কাজ করছে। এই গ্রামে তার জায়গা-জমি আছে। তেমন হুলুস্থুল ধরনের কিছু না, কিন্তু আছে। এই বাড়িটা আছে। সে-সব দান করার কথা তিনি ভাবছেন না। জমি-জমা কিছু আছে বলেই তিনি ছুটি ছাটায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসতে পারেন। সামান্য হলেও একটা যোগসূত্র আছে। সেটা যাতে থাকে সেই চেষ্টা তাকে করতে হবে।
তাছাড়া কয়েকটা পাকা দালান বানিয়ে স্কুল-কলেজ চালু করে দিলেই হয় না। সেই স্কুল-কলেজ যাতে চালু থাকতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হয়। শিক্ষকদের বেতন, ছাত্র-ছাত্রী জোগাড়। অনেক কিছুই আছে। সেই অনেক কিছুর কথা স্কুল-কলেজের উদ্যোক্তাদের মনে থাকে না। মানুষ অতি বুদ্ধিমান প্রাণী হলেও তার দৃষ্টি মোটামুটি বর্তমানেই আটকে থাকে। ভবিষ্যৎ সে দেখতে পারে না। বা দেখতে পারলেও দেখতে চায় না। সুলতান সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে রানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, রানু মা, আমি মাহফুজের সঙ্গে কিছু কথা বলব।
রানু বলল, তুমি চাও না আমি সেই কথাগুলো শুনি? আমাকে চলে যেতে বলছ।
সুলতান সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রানু উঠে চলে গেল। মনে হল সে খানিকটা হলেও অপমানিত বোধ করছে। সুলতান সাহেব পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, মাহফুজ তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্যে রানুকে সরিয়ে দিলাম। রানু অসুস্থ। আমি চাই না সে এইসব কথা শুনুক বা এইসব কথা তাকে কোনভাবে অ্যাফেক্ট করুক।
মাহফুজ অবাক হয়ে বলল, উনার কি অসুখ?
তার কি অসুখ সেটা আমাদের আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ না তারপরেও বলছি তার অসুখটা শারীরিক না। মানসিক। সে কিছু ব্যাক্তিগত দুর্যোগের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। যার চাপ সে সহ্য করতে পারে নি। তার কিছু মানসিক সমস্যা হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট তার চিকিৎসা করছে। আমি যে মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছি এই কারণেই এসেছি। তাকে আলাদা করে একা কিছু সময় দেবার জন্যে এসেছি।
মাহফুজ কিছু বলল না। সে তাকিয়ে রইল। তার তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে সে খুবই দুঃখিত বোধ করছে। সুলতান সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন- আমি আমার মেয়েকে সবরকম ঝামেলার বাইরে রাখতে চাই। অথচ তুমি ঝামেলাই তৈরি করেছ। তুমি কোন রকম কথাবার্তা ছাড়া কোয়েশ্চেনেল চরিত্রের একটি মেয়েকে আমার বাড়িতে এনে তুলেছ।
স্যার আপনি…।
কথার মাঝখানে কথা বলবে না। আমার কথা শেষ হোক তারপর যা বলার বলবে। তুমি ঐ মেয়েটিকে আমার এখান থেকে নিয়ে যাবে। এখনি নিয়ে যাবে।
জি আচ্ছা।
রাতে তোমার এই নাটকের যন্ত্রণায় আমাকে জড়াবে না। কাউকে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি করতে হলে তাঁর পূর্ব সম্মতির প্রয়োজন আছে। তুমি আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস কর নি…
স্যার আপনি না গেলে…
কথার মাঝখানে কথা বলতে তো নিষেধ করেছি। তারপরেও কথা বলছ কেন? নেভার ডু দ্যাট এগেইন। আমি কয়েকটা দিন একা থাকতে এসেছি। আমাকে একা থাকতে দাও। আমার যা বলার বলেছি এখন তুমি যেতে পার। মেয়েটিকে নিয়ে যেও।
মাহফুজ শুকনো গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।
সুলতান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আর শোন মেয়েটির পায়ে না কি কাঁটা ফুটেছে। দয়া করে কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করবে।
.
রানু খুবই অবাক।
একটা মেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তাকে এখন নিয়ে যেতে হবে কারণ নাটকের রিহার্সের হবে। কি উদ্ভট কথা। মাহফুজ মাথা নিচু করে বলল, রিহার্সেল লাগবেই। ভুজঙ্গ বাবু বলে পাঠিয়েছেন। উনি খুবই মেজাজী মানুষ। শেষে দেখা যাবে নাটক ফেলে উনি চলে গেলেন।
চলে গেলে চলে যাবেন। প্রয়োজন হলে আমি ভুজঙ্গের সঙ্গে কথা বলব। আমাকে ভুজঙ্গের কাছে নিয়ে চলুন।
চিত্র বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল, এত ঝামেলা করে লাভ নেই আমি যাই। রিহার্সেল শেষ করে চলে আসব।
রানু বলল, আমি কি রিহার্সেল দেখার জন্যে যেতে পারি?
মাহফুজ বলল, না। ভুজঙ্গ বাবু বাইরের কারো সামনে রিহার্সেল করেন না।
রানুর মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। চিত্রা মেয়েটাকে তার অসম্ভব ভাল লেগেছে। এত ভাল লেগেছে যে তাকে তার চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করছে না। তার প্রধান সমস্যা এটাই, যাকে ভালো লাগে তাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষরা সবাই চোখের আড়ালে চলে যায়। চিত্রা রিহার্সেল শেষ করে এখানে চলে আসবে এটা এখন আর তার মনে হচ্ছে না। চিত্রা আর আসবে না। মেয়েটার সঙ্গে গল্পই করা হল না। রানু ঠিক করে রেখেছিল পুকুরঘাটটা পরিষ্কার করে সেখানে ইটের চুলা পেতে আজ সে নিজে রান্না করবে! পাশে থাকবে চিত্রা। রান্না করতে করতে গল্প করবে। বনভোজন বনভোজন ভাব চলে আসবে। শ্যাওলা পরিষ্কারের পর যদি দেখা যায় পুকুরের পানি টলটল পরিষ্কার তাহলে তারা দুজন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পানিতে নামবে। কিছুই করা হল না। রানু বাগানে চলে গেল।
নীল পালকের পাখিটা বাগানে নিশ্চয়ই কোথাও আছে। পাখিটাকে খুঁজে বের করতে হবে। সঙ্গে একটা দূরবীন থাকলে ভাল হত। চোখে দূরবীন লাগিয়ে পাখি খোঁজা।
সুলতান সাহেবকে বারান্দায় দেখা যাচ্ছে। তিনি নেমে আসছেন। রানু জানে তিনি এখন বারান্দায় আসবেন। কোন জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন। ভাবতেই রানুর অসহ্য লাগে। রানু এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। বাবাকে সে কি কঠিন গলায় বলতে পারে না যে তুমি আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। তুমি সঙ্গে থাকলে পাখিটা আমি খুঁজে পাব না। হ্যাঁ, নিশ্চয় পারে।
কী করছিস রে মা?
পাখি খুঁজছি।
কী পাখি খুঁজছিস?
নীল পালকের একটা পাখি।
ঠোঁট কী লাল?
হু।
তাহলে মাছরাঙ্গা। মাছরাঙ্গা পাখির বিশেষত্ব জানিস?
রানু শান্ত গলায় বলল, বিশেষত্ব জানি না। এবং বিশেষত্ব জানার আমার কোন ইচ্ছাও নেই। তুমি দয়া করে এখন পাখি বিষয়ক কোন বক্তৃতা শুরু করবে না। আমি একা একা বাগানে বেড়াতে এসেছি। বক্তৃতা শুনতে এখন ইচ্ছা করছে না।
সুলতান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন কারণে কি তোর মনটা বিক্ষিপ্ত?
হা বিক্ষিপ্ত।
কারণটা বলা যাবে?
হ্যাঁ যাবে। কারণ হচ্ছ তুমি।
আমি?
হ্যাঁ তুমি। তুমি মাহফুজ সাহেবকে বলেছ চিত্রা মেয়েটিকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে। বল নি?
সুলতান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তাঁর মেয়ে থরথর করে কাঁপছে। এটাতো ভাল কথা না।
রানু বলল, চিত্রাকে যে তুমি বিদেয় করেছ এ ব্যাপারে আমি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত।
কিভাবে নিশ্চিত হলি?
মাহফুজ সাহেবের সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ গল্প করেছি। তাকে বলেছি চিত্রা অসুস্থ। তিনি বলেছেন বিশ্রাম নিক। সন্ধেবেলা নাটকের আগে গেলেই হবে। আর তারপরই তোমার সঙ্গে উনার কথা হল। সুলতান সাহেব তখন বলতে শুরু করলেন ভুজঙ্গ বাবুর সঙ্গে রিহার্সেল। এতক্ষণ ভুজঙ্গ বাবু ছিলেন না। তোমার সঙ্গে কথা বলার পরই ভুজঙ্গ বাবু উদয় হলেন। বাবা তুমি কি সুলতান সাহেবকে বল নি চিত্রা মেয়েটিকে নিয়ে চলে যেতে।
বলেছি। কেন বলেছি জানতে চাস?
না, আমি জানতে চাই না। জানতে চাইলেই তুমি দশ বারোটা সুন্দর যুক্তি দেখাবে। যুক্তিগুলো খুবই গ্রহণযোগ্য মনে হবে। আমি যুক্তি শুনতে যাচ্ছি না। শুধু যুক্তি কেন আমি তোমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছি না।
আমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছিস না।
না। কারণ তুমি একজন ভান সর্বস্ব মানুষ। আমি ভান পছন্দ করি।
আমি ভান সর্বস্ব মানুষ?
অবশ্যই। তুমি কখনো লুঙ্গি পর না। তুমি অনেকবার বলেছ লুঙ্গি হচ্ছে একটা নোংরা এবং অশালীন পোষাক, অথচ তুমি যখনই গ্রামে আস তখনি লুঙ্গি নিয়ে আস। এবং গ্রামের পথে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াও। কারণ গ্রামের লোকজন এই ব্যাপারটা দেখে বলবে- আহা মানুষটা কত সহজ সরল।
রানু তুই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিস। এরকম উত্তেজিত হবার মত কোন ঘটনা ঘটে নি।
আমি তোমার মত না বাবা। আমি সাধারণ মানুষের মত। উত্তেজিত হবার মত কোন ঘটনা দেখলে আমি উত্তেজিত হই। তুমি কখন হও না। তোমার মাথা সব সময় ঠাণ্ডা। পনের বছর আগে তুমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পেরেছিলে। আমার তখন বয়স কত? দুবছর। আমাকে মার সঙ্গে যেতে দাও নি। আমার দেখাশোনার জন্যে আরেকটি বিয়ে তুমি করেছ। সেটিও করেছ খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
Young lady compose yourself.
Thanks. I will try.
সুলতান সাহেব সিঁড়ি বেয়ে আবারও উঠে গেলেন। রানু একা একা পাখি খুঁজতে লাগল। পাখিটা বাগানেই কোথাও আছে। লুকিয়ে আছে পাতার আড়ালে। রানুর ধারণা এক্ষুণি পাখিটাকে পাওয়া যাবে।
.
চিত্রা কেমন এলোমেলো পা ফেলছে। মাহফুজ চিন্তিত বোধ করছে। সুলতান সাহেবের বাড়ি থেকে তার বাড়ি অনেকখানি পথ। মেয়েটার জ্বর যদি খুব বেশি হয় তাহলে সে এতখানি পথ হেঁটে যেতে পারবে না। কপালে হাত দিয়ে কি দেখবে জ্বর কত? এটা কি ঠিক হবে? না, ঠিক হবে না।
চিত্রা বলল, ভুজঙ্গ বাবু কখন এসেছেন?
মাহফুজ বলল, উনি এখনো আসেন নি। তার অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছে।
আপনি যে বললেন, ভুজঙ্গ বাবু এসেছেন। রিহার্সেল করবেন।
মিথ্যা কথা বলেছি। তোমাকে নিয়ে আসার জন্য বলেছি।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?
আমার বাড়িতে।
ঐ বাড়িতেই তো আমি খুব ভাল ছিলাম।
মাহফুজ নিচু গলায় বলল, আমার বাড়িতেও খুব ভাল থাকবে। চাদর গায়ে গিয়ে শুয়ে থাকবে। বিশ্রাম হবে। শরীর খারাপ করেছে এখন বিশ্রাম দরকার। ভাল বিশ্রাম না হলে রাতে নাটক টানতে পারবে না।
চিত্রা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, ঐ বাড়ি থেকে কি আমাকে বের করে দিয়েছে? সুলতান সাহেব নামের মানুষটা কি বলেছে আমাকে এক্ষুণি বিদেয় করে দিতে হবে।
মাহফুজ বলল, আরে না। কি বল তুমি। সুলতান সাহেব এরকম মানুষই না। তুমি অসুস্থ শুনে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে বললেন- এক্ষুণি ডাক্তার জোগাড় করতে। আমার মাথায় একশ ঝামেলা, এর মধ্যে কোথায় ডাক্তার পাব তুমিই বল।
চিত্রার চোখমুখ কঠিন হয়ে গিয়েছিল মাহফুজের কথায় আবার স্বাভাবিক হল। সে হাঁটতে শুরু করল। তবে মেয়েটার শরীর মনে হয় বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে হাঁটতেই পারছে না।
মাহফুজ বলল, তুমি দেখি খুবই আশ্চর্য মেয়ে। তুমি ভেবে বসলে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হা হা হা।
চিত্রা গম্ভীর গলায় বলল, এ রকম হা হা করবেন না। বাড়ি থেকে বের করে দেবার ঘটনা আমার জীবনে আগে ঘটেছে বলেই আমি বলেছি। একবার রাত দুটার সময় আমাকে বের করে দিল। রাত একটার সময় নাটক শেষ হয়েছে। আমি ঘরে গিয়ে মেকাপ তুলছি তখন যে বাড়িতে আমার থাকার জায়গা সেই বাড়ির একজন বুড়ো মানুষ এসে খুবই খারাপ ভাষায় আমাকে বের হয়ে যেতে বললেন। যারা আমাকে সেই বাড়িতে তুলেছিল তারাও কেউ নেই। আমাকে রেখে চলে গেছে। কি যে বিপদে পড়লাম।
সুলতান সাহেব সেরকম না। ইনি অন্য ধরনের মানুষ।
চিত্রা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, তিনি যে অন্য রকম মানুষ তা তাঁর মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যায়। মেয়েটা কি আশ্চর্য রূপবতী। মনে হয় তুলি দিয়ে আঁকা।
.
মাহফুজের বাড়িতে যেতে হলে ক্লাবঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়। ক্লাবঘরের সামনে বেশ ভিড়। কাঠের সবকটা চেয়ার রোদে পাতা হয়েছে। একটা বেঞ্চও বের করা হয়েছে। হাতলওয়ালা চেয়ারটায় ছদরুল ব্যাপারী বসে আছেন। ছদরুল ব্যাপারী কখনো একা ঘুরাফেরা করেন না। সঙ্গে চার পাঁচজন লোক থাকে। এখনো আছে। গ্রামের লোকজন তাদের ঘিরে আছে। ছদরুল ব্যাপারী মাহফুজকে দেখে হাত ইশারায় ডাকল। মাহফুজ অবাক হয়ে এগিয়ে গেল। ছদরুল ব্যাপারী এখন আসার কথা না। তার আসার কথা সন্ধ্যার আগে আগে। তিনি মওলানা ইস্কান্দার আলির জন্যে ইফতার নিয়ে আসবেন। ইস্কান্দার আলিকে ইফতার খাইয়ে নাটক দেখে চলে যাবেন। কি মনে করে সকালে এসেছেন কে জানে।
ছদরুল ব্যাপরীর মুখ ভর্তি পান। তিনি অনেক আয়োজন করে গলা খাকাড়ি দিয়ে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন মাহফুজ মিয়া ভাল আছ?
জি, ভাল আছি।
একটু আগে আগে চইলা আসলাম। ভাবলাম তোমাদের অঞ্চলটা ঘুরা দিয়া দেখি।
জ্বি খুব ভাল করছেন।
ঐ যে দূরে দাঁড়ায় আছে মেয়েটা কে, নাটকের না?
জ্বি।
নাটক কেমন করে?
খুব ভাল করে।
নাম কি?
চিত্রা।
মেয়েটার কি শইল খারাপ?
জ্বি, জ্বর এসেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তারে কোথায় নিয়া যাইতেছ যাও। তোমার কাজকর্ম কর। আমারে নিয়া ব্যস্ত হবা না। আমি তোমাদের অঞ্চলটা ঘুরা দিয়ে দেখব। ইস্কান্দার সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলব।
জ্বি আচ্ছা।
সুলতান সাবের সাথেও দেখা করা দরকার- এমন বিশিষ্ট মানুষ।
আপনি দেখা করতে চাইলে নিয়ে যাব।
নিয়ে যাইতে হবে না। আমার যেখানে যাইতে ইচ্ছা করে নিজেই চইল্যা যাই।
ছদরুল ব্যাপারী আবারও পানের পিক ফেলল। এবারও আগের মতো আয়োজন করে পিক ফেলা। শুধু পিক ফেলাতেই ঘটনা শেষ হয় না। পিক ফেলে সেই পিকের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘটনার ইতি হয়।
চিত্রা দূর থেকে মানুষটাকে দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে একজন মৃত মানুষ চেয়ারে বসে আছে। রক্ত শূন্য মুখ। হলুদ চোখ। বসে থাকার ভঙ্গির মধ্যেই ক্লান্তি এবং অবসাদ। মনে হচ্ছে এই মানুষটা অনেকদিন ধরে ঘুমুতে পারে না। তার খুব ভাল ঘুম দরকার। চেয়ারে সে বসে আছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি জেগে নেই।
ইস্কান্দর আলি রোজা ভাঙ্গলেন
০৫.
অনেকদিন পর আজ ইস্কান্দর আলি রোজা ভাঙ্গলেন। ইচ্ছাকৃত রোজা ভাঙ্গা না। জোহরের আজানের আগে আগে কোন কারণ ছাড়াই মুখ ভর্তি করে বমি করলেন। রোজা ভাঙ্গার কারণ ঘটল। তাঁর মন বেশ খারাপ হয়ে গেল। এমন যদি হত তার কোন অসুখ করেছে তাহলে একটা সান্ত্বনা থাকত। অসুখ বিসুখ কিছু না, শরীর ভাল। বমি করার ফলে শরীরটা মনে হয় আরো ঝরঝরে হয়ে গেছে। চনমনে ক্ষিধে হচ্ছে। চিকন চালের ভাত এবং সর্ষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে। অনেক দিন ইলিশ মাছ খাওয়া হয় না। এই অঞ্চলে ইলিশ পাওয়া যায় না।
বিশেষ কোন খাওয়া খাদ্যের জন্যে মন আনচান করাটা দোষনীয় কি না তিনি বুঝতে পারছেন না। খাওয়া খাদ্য আল্লাপাকের একটা নেয়ামত। কাজেই খাওয়া খাদ্যের জন্যে লোভ হলে সেটা দোষনীয় হতে পারে না। আবার অন্যদিকে সবুরের ব্যাপারটাও আছে। সর্ববিষয়ে সবুর করতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে সুখাদ্যের লোভকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। নবী করিম দিনের পর দিন শুধু খেজুর খেয়ে থাকতেন। ভাল খাদ্যের জন্যে তার কোন লালচ ছিল না।
ইস্কান্দর আলি রান্না চড়ালেন। রোজা যখন ভেঙ্গেই গেছে নিজের হাতে রান্নাবান্না করা যাক। চারটা চাল সেদ্ধ করবেন। সেদ্ধ চালের সঙ্গে একটা ডিম দিয়ে দেবেন। ভাত এবং ডিম একসঙ্গে সেদ্ধ হবে। শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ আবার লবণ দিয়ে ডিমের ভর্তা করে নেবেন। ডিমের ভর্তা দিয়ে গরম ভাত স্বাদু হবার কথা। ঘরে ভাল গাওয়া ঘি আছে। গরম ভাতের উপর গাওয়া ঘি। ফেনভাতে গাওয়া ঘির কোন তুলনা হয় না। ইস্কান্দর আলির জিভে পানি এসে গেল। তিনি খুবই লজ্জিত বোধ করলেন। জিভের পানি লোকজন দেখতে পায় না এটা একটা ভাল ব্যাপার। চোখের পানির মত যদি জিভের পানি টপটপ করে ঠোঁট গড়িয়ে পড়ত তাহলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হত। আল্লাহপাকের অসীম করুণা, তিনি মানুষকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। মানুষ একে অন্যকে লজ্জা দিতে পছন্দ করে কিন্তু আল্লাহপাক তার অতি নগণ্য বান্দাকেও লজ্জা দিতে চান না।
ভাত এবং আলু ভর্তার সঙ্গে ডাল থাকলে কেমন হয়? ঘরে মুগ ডাল আছে। কষ্ট করে একটু ডাল বেঁধে ফেললে হয় না? আজ যখন রোজা রাখা হয় নি, খাওয়া দাওয়াটা ভাল করে করা যাক। তিনি আরেকটা চুলায় আগুন দিলেন। হোক আজকের খাওয়া দাওয়াটা ভাল মত হোক। শুধু ইলিশ মাছটা মাথা থাকে দূর হচ্ছে না। বাটা রাই সরিষা, সামান্য লবণ, একটা দুফালা করে কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতায় ইলিশ মাছ মুড়ে সামান্য আঁচ দিতে হবে। খেতে হবে গরম গরম। ঠাণ্ডা হল কি স্বাদ চলে গেল। এক্কেবারে বেহেশতি খানা। বেহেশতে ইলিশ মাছ কি পাওয়া যাবে? পাখির মাংসের কথা কোরান মজিদে উল্লেখ আছে। তবে ইলিশ মাছও পাওয়া যাবে। বেহেশতী মানুষ যা চাবে তাই পাবে।
রান্না শেষ করে ইস্কান্দর আলি খাবার আয়োজন করলেন। পাটি পাতলেন। থালা সাজালেন। পিরিচে নিমক দিলেন। লেবু কাটলেন। খাওয়া শুরুর আগে নবী-এ করিম সাল্লাহু আলায়হি সালাম জিভে নিমক হুঁয়াতেন। তিনি পাতে লেবু নিতেন কি-না সে কথা কখনো শুনেন নাই। আরব জাহানে কি লেবু আছে?
আসোলামু আলায়কুম!
ইস্কানদর আলি চমকে তাকালেন। দরজা ধরে একজন রোগা অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা মনে হয় অসুস্থ। ঠোঁট মরা মানুষের মত শাদা। চোখ হলুদ। গায়ের চামড়া কুঁকড়ে আছে। মাথার চুল সামান্য মৃত মানুষের মাথার চুল যেমন আলগাভাবে মাথায় লাগান থাকে এরও তাই। মনে হচ্ছে মাথায় হাত বুলালেই হাতের সঙ্গে সব চুল উঠে আসবে।
কেমন আছেন ইস্কান্দর সাহেব?
জ্বি জনাব ভাল।
কী করছেন?
খাওয়ার আয়োজন করছি।
আমি তো শুনেছি আপনি সারাবছর রোজা রাখেন।
ভুল শুনেছেন জনাব। যেদিন যেদিন আল্লাহপাকের হুকুম হয় সেদিন সেদিন রাখি। আজ হুকুম হয় নাই। সকালবেলা বমি করেছি। বমি করলে রোজা ভেঙ্গে যায়।
বেছে বেছে আজকের দিনেই রোজা ভাঙ্গলেন। আজ আমি ঠিক করেছিলাম আপনাকে ইফতারী করাব।
অন্য আরেকদিন ইফতার করব জনাব।
আপনি কি আমাকে চিনেন? আমি ছদরুল বেপারী।
মওলানা লজ্জিত গলায় বললেন, জনাব আমি আপনার নাম শুনি নাই।
এটা খুবই আশ্চর্যের কথা যে আপনি আমার নাম শুনেন নাই। যাই হোক কি আর করা। কি রান্না করেছেন?
দরিদ্র মানুষের দরিদ্র আয়োজন জনাব। ডাল ভাত।
আমি যদি আপনার সঙ্গে খাই আপনার কি খাবারে কম পড়বে?
জ্বি না জনাব। আল্লাহপাক যদি আমার এখানে আপনার রিজিক রাখেন তাহলে কম পড়বে না। আসুন খেতে বসি।
ভয় নেই আমি খুব সামান্য খাব। ইদানীং হজমের সমস্যা হয়েছে কিছুই হজম করতে পারি না। জাউ ভাত খেলেও টক ঢেকুর উঠে।
ছদরুল বেপারীর সঙ্গের লোকজন ইস্কান্দর আলির বাড়ির উঠোনে ঘুর ঘুর করছিল। ছদরুল বেপারী হাত ইশারায় তাদের চলে যেতে বললেন।
গরম ভাতের উপর ঘি দিতে দিতে ইস্কান্দর আলি বললেন, অতি দরিদ্র আয়োজন, নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
ছদরুল বেপারী কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে খাবারের ব্যবস্থা দেখতে লাগলেন। তাঁকে সামান্য চিন্তিত মনে হল।
এই মেঘ, রৌদ্রছায়া– পাতে ঘি দিয়েছেন? ঘি খাওয়া আমার জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহপাকের নাম নিয়ে খান আল্লাহ পাকের নাম নিয়ে খেলে ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না।
এটাতো মওলানা ঠিক বললেন না, যা নিষিদ্ধ তা সব সময়ই নিষিদ্ধ। খুন নিষিদ্ধ। আল্লাহপাকের নাম নিয়ে খুন করলেও সেই খুন সিদ্ধ হবে না। যাই হোক বিসমিল্লাহ বলে আমি খাচ্ছি। এত নিষেধ মানলে চলে না।
হাত ধুবেন না জনাব? হাত ধোয়ার পানি দিয়েছি।
হাত ধোয়ার দরকার নাই।
ছদরুল বেপারী খাবার উদ্দেশ্যে বসলেন না। হঠাৎ খেতে চাইলে একজন মানুষ কি করে সেটা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কি মনে করে খাওয়া শুরু করলেন।
ছদরুল বেপারী এত আরাম করে দীর্ঘদিন খান নি। খাবার এমন স্বাদ হয় তা তিনি মনে হয় ভুলেই গিয়েছিলেন।
মওলানা সাহেব আপনার রান্নার হাত চমৎকার। খুবই আরাম করে খেয়েছি। খুবই তৃপ্তি পেয়েছি। সাধারণ খাবারে এত স্বাদ থাকে ভুলেই গিয়েছিলাম।
ইস্কান্দর আলি বললেন খাওয়া খাদ্যে স্বাদ দেবার মালিক আল্লাহপাক। স্বাদ উঠায়ে নেওয়ার মালিকও আল্লাহপাক।
ছদরুল বেপারী বললেন, আমি শুনেছিলাম মৃত্যুর আগে আগে খাওয়ার স্বাদ চলে যায়। এটা কি সত্যি?
এই বিষয় আমি কিছু জানি না জনাব।
আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। যা খাই কোনকিছুতে স্বাদ পাই না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার মৃত্যুর বেশি দেরি নেই। আজ মনে হচ্ছে মৃত্যুর দেরি আছে। খাওয়ার স্বাদ ফিরে এসেছে।
হায়ত-মউতের মালিক আল্লাহপাক। মানুষ এই বিষয়ে কিছুই জানে না। নবী-এ করিমের একমাত্র পুত্র কাশেম যে শৈশবেই মারা যাবে এটা নবী-এ করীম সাল্লালাহ আলাইহিস সালাম জানতেন না। অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহপাকের পেয়ারা দোস্ত।
ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনার সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা শুনেছি। কথা যা শুনেছি তা বোধ হয় সত্য না। মানুষ তিলকে তাল বলতে পছন্দ করে। নেংড়া বিড়াল দেখে এলে চোখ বড় বড় করে বলে, নেংড়া বাঘ দেখে এসেছি। তারপরেও আমার ধারণা আপনি সুখি মানুষ। আপনার কাছে কিছু উপদেশ চাই, উপদেশ দিন।
উপদেশ দেওয়ার মত যোগ্যতা আমার নাই জনাব।
যোগ্যতা আছে কি নাই সেটা আমি বিবেচনা করব। আপনাকে পরামর্শ দিতে বললাম আপনি পরামর্শ দিবেন। তার আগে জেনে রাখুন আমি খুবই দুষ্ট প্রকৃতির লোক। শয়তানের সঙ্গে আমার একটাই অমিল শয়তান অন্যদের খারাপ করার চেষ্টা করে আমি চেষ্টা করি না। নিজে খারাপ কাজ করি। এতেই আমি খুশি। অন্যকে খারাপ বানায়ে খুশি হবার প্রয়োজন আমার নাই। বুঝতে পারছেন কি বলছি?
ইস্কান্দর আলি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। তার সামনে বসে থাকা লোকটি যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি বুঝতে পারছেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কথা বলার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। এই ভঙ্গি সে আয়ত্ব করে না। আপনাতেই তার মধ্যে চলে আসে।
ইস্কান্দর আলির ধারণা তার নিজের মধ্যে এই ভঙ্গি চলে এসেছে। তার নিজের কথা বলার ভঙ্গি এখন তাঁর কাছেই অপরিচিত লাগে। কথা বলার সময় মনে হয় সে কথা বলছে না অন্য কথা বলছে।
মওলানা সাহেব?
জ্বি।
আমি অতি দুষ্ট একজন মানুষ। এটা আমি বিনয় করে বলছি না। বিনয় আমার মধ্যে নাই। অবশ্য আমার মধ্যে অহংকারও নাই। আমি যা, আমি তা। এ নিয়ে বিনয় করারও কিছু নাই, অহংকার করারও কিছু নাই। আমি কি ঠিক বলেছি মওলানা সাহেব?
বুঝতে পারছি না জনাব। আমার জ্ঞান বুদ্ধি অত্যন্ত কম। যে যা বলে আমার কাছে মনে হয় সেটাই সত্যি।
ছদরুল বেপারী আগের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে নতুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন– আপনি লোকটা হয় অতি চালাক নয় অতি বোকা। কোনটা এখনো ধরতে পারছি না। তবে ধরতে পারব।
জনাব, আপনি মানুষটা কেমন?
আমি বোকা। তবে শয়তানি চালাকি আমার আছে। শুধু আছে বললে কম বলা হয়- অনেক বেশি আছে। আমি আবার নিজের যা মন্দ তা বলে ফেলি। পেটে কিছু রাখি না। আমার হজমের গণ্ডগোল আছে এইজন্যই পেটে কিছু রাখতে পারি না। কথা হজম হয় না বলে বমি করে ফেলি। হা হা হা।
ইস্কান্দর আলি নিচু গলায় বললেন, নিজের মন্দটা বললে দোষ কাটা যায় না। যা মন্দ, বলে বেড়ালেও মন্দ। না বলে বেড়ালেও মন্দ।
দোষ কাটার জন্যে তো বলি না। বলতে ভাল লাগে এই জন্যে বলি। মানুষের এই এক বিচিত্র স্বভাব। যে ভাল কাজ করে সে ভাল কাজের কথা বলে আনন্দ পায়। যে মন্দ কাজ করে সে মন্দ কাজের কথা বলে আনন্দ পায়। আপনার এখানে পান আছে মওলানা সাহেব?
জ্বি না, পান নাই।
পান খাইতে ইচ্ছা করতেছে।
আপনে বসেন আমি নিয়া আসি।
দরকার নাই। তারচে বরং গল্পগুজব করি। আপনার চরিত্রে খারাপ কি আছে বলেন তো শুনি। ভাল মানুষ অন্য মানুষের চরিত্রে ভাল কি আছে। শুনতে চায়। খারাপ মানুষ চায় অন্যের খারাপটা শুনতে।
নিজের খারাপ জিনিসটাতো নিজের বলা মুশকিল।
মুশকিল হবে কেন? আপনার খারাপটাতে সবচে ভাল আপনি জানবেন। আমারটা যেমন আমি জানি। আমার খারাপ কি বলব?
দরকার নাই জনাব।
দরকার অদরকার কিছু নাই। শুনেন বলি, বলতে ইচ্ছা করতেছে। আমার সবচে বড় দোষ হল আপনার মেয়ে মানুষের দোষ। কোন মেয়ে মানুষ একবার যদি চোখে লেগে যায় তাহলে সর্বনাশ।
মওলানা তাকিয়ে আছেন। কি আশ্চর্য মানুষ কত সহজেই না কত ভয়ংকর কথা বলছে। যে মানুষ সহজে ভয়ংকর কথা বলে সে সহজে ভয়ংকর কাজও করে।
ছদরুল বেপারী গলা নিচু করে বললেন মেয়ে মানুষের দোষ কাটার কোন তাবিজ কি আছে?
মওলানা ইস্কান্দার বললেন, আমি তাবিজের বিষয়ে কিছু জানি না।
না জানলে কি আর করা?
ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটা পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, টাকাটা রাখেন মওলানা সাহেব। সামান্য উপহার।
চকচকে নতুন নোট। ইস্কান্দর আলির ইচ্ছা করছে বলেন, জনাব আমি আপনার টাকা নিব না। মন্দ মানুষের উপহার গ্রহণ করা নিষেধ আছে। ইস্কান্দর আলি তা বলতে পারলেন না। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলেন। টাকাটার দরকার। হাত একেবারে খালি। শীত আসছে এই অঞ্চল শীত বেশি পড়ে। লেপ কেনা দরকার। ভাল কাঁপাসি তুলার একটা লেপের দাম তিনশ টাকা। মশারিও কেনা দরকার। তাঁর মশারিটা ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে। বড় ইঁদুরের উপদ্রব। ইঁদুর মারা একটা কল কিনতে হবে।
ছদরুল বেপারী সামান্য হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, শুরুতে বলেছিলাম না আপনার উপদেশ চাইতে এসেছি। এটা ঠিক না। আমি কারো উপদেশে চলি না। আবার কারো দোয়ার ধারও ধারি না। আপনার সম্পর্কে নানান কথা শুনি, আপনাকে দেখার ইচ্ছা ছিল। দেখা হয়েছে এতেই আমি খুশি।
ভরপেট খাওয়ার পর ছদরুল বেপারীর শরীর সব সময় হাঁসফাঁস করে, নিশ্বাসেও সামান্য কষ্ট হয়। আর সে রকম কিছু হচ্ছে না। শরীর ঝরঝরে লাগছে। একটা পান খাওয়া দরকার। কাঁচা সুপারি সঙ্গে কড়া জদা। ডাবল একসান। এই গ্রামে চা পান সিগারেটের দোকান এখনো চোখ পড়ছে না। আছে নিশ্চয়ই এখনকার গ্রাম আর আগের মত না। পান ফুরিয়ে গেল তো গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা কর হাটবারের জন্য। বুধবার হাট। বুধবারের আগে পান পাওয়া যাবে না। সে গ্রাম আর নেই।
ছদরুল বেপারী মওলানার ঘর থেকে বের হতেই তার সঙ্গের লোকজনদের দেখা পেল। তারা আশেপাশেই ঘাপটি মেরে ছিল। তাদের দায়িত্ব ছদরুল বেপারীকে ছায়ার মত অনুসরণ করা, তারা সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। তাদের একজনের সঙ্গে পিস্তল আছে। চোরাই পিস্তল না। লাইসেন্স করা পিস্তল। পিস্তলের দাম সাত হাজার টাকা আর লাইসেন্স বের করার ঘুষের দাম এক লাখ দশ হাজার। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বের হওয়া ছদরুল বেপারীর মত মানুষের সমস্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে শুক্র। আগে শত্রু মিত্র চেনা যেত এখন তাও যায় না। মিত্র ভাবে যে খুব কাছে আসে দেখা যায় সে মহা শত্রু।
গত চার বছরে দুবার ছদরুল বেপারীকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম বার তো মেরেই ফেলেছিল। বর্শা পেটে ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল। সেই আঘাত সামলানো গেছে। দ্বিতীয়বারে অবশ্যি প্রথমবারের মত ভয়ংকার হয় নি। তবে হতে পারতো। এখন ছদরুল বেপারী অনেক সাবধান। তবে সাবধান হয়েও লাভ নেই। কপালে যা থাকবে তাই হবে। বেহুলার মত সাবধান স্ত্রীর স্বামীকেও সাপের কামড় খেতে হয়েছে। লোহার ঘর বানিয়েও রক্ষা হয়নি। তারপরও যতটুকু পারা যায় সাবধান থাকা।
ছদরুল বেপারী একজনকে কাঁচা সুপারি জদা দিয়ে পান আনতে পাঠালেন। সেই সঙ্গে বলে দিলেন মাহফুজকে খবর দিতে। মাহফুজের সঙ্গে জরুরি আলাপগুলো সেরে ফেলা দরকার। আলাপটা ক্লাবঘরে হবে। ক্লাবঘরের উঠানে না হয়ে ঘরের ভেতর হবে। উঠকো মানুষ যেন না থাকে। যদিও জরুরি সব আলাপ অনেক মানুষের সামনে হওয়া দরকার। যাতে সাক্ষী থাকে। ছদরুল বেপারী ক্লাবঘরের দিকে রওনা হলেন। মাহফুজের সঙ্গে কথা বলবেন, ভাঙ্গা মসজিদটা দেখবেন। নতুন একটা মসজিদ এই গ্রামে করে দেয়া যায়। মসজিদ বানিয়ে দেয়ার কথা কেউ এখনো তাকে বলে নি। না চাইতে তিনি কিছু দেন না। তার কাছে চাইতে হবে। বিকেলে যাবেন সুলতান সাহেবের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। তারপর সন্ধ্যায় টিপু সুলতান নাটক- ভুজঙ্গ বাবুর অনেক নাম ডাক। তার নাটক আগে দেখা হয় নি। এইবার দেখা যাবে। তিনি সোনার একটা মেডেল স্যাকরার দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন। যার অভিনয় ভাল হবে তাকে দেবেন। মেডেল ভুজঙ্গ পাবে এটাতো বলা বাহুল্য। আরেকটা মেডেল থাকলে ভাল হত। মেয়েটাকে দেয়া যেত। নাটকের মাঝখানে সোনার মেডেল ডিক্লেয়ার করা আনন্দময় ঘটনা। চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। নাটক যারা করে তাদের চেয়ে মেডেল যে দিচ্ছে সে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ছদরুল বেপারী ঠিক করলেন আরেকটা মেডেল কিনতে কাউকে পাঠাবেন। মেডেল যে দিতেই হবে এমন কোন কথা নেই, হাতে থাকল। এমনওতো হতে পারে তিনি নাটক দেখতেই গেলেন না। মানুষেরা সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত বদলায়। জোয়ার ভাটা হয় নির্দিষ্ট সময়ে। মানুষের জোয়ার ভাটার কোন সময় নেই। নিয়মও নেই। এই জোয়ার এই ভাটা। আবার উল্টোটাও হয়–এই জোয়ার, এই আবার জোয়ার। তারপর আবারও জোয়ার। ভাটার দেখা নেই।
.
আজ কি ছদরুল বেপারীর কপাল ভাল যাচ্ছে? পান খাচ্ছেন অথচ পান ঝাল লাগছে না। তাঁর জিভে কি যেন হয়েছে বলে পান খেতে পারেন না। ঝাল লাগে। ডাক্তার বলেছে ভিটামিন বি এর অভাব সেই ভিটামিনও গাদা খানিক খেয়ে দেখেছেন। লাভ হয় নি। তাকে পান খেতে হয় খুব কষ্ট করে। আজ কষ্ট হচ্ছে না। একটু পর পর পানের পিক ফেলতে হচ্ছে না। পানের পিকেও ঝাল নেই। আশ্চর্য তো।
তিনি বসে আছেন ক্লাবঘরের ভেতরে। জরুরি কিছু আলোচনা করবেন মাহফুজের সঙ্গে। মাহফুজ তার সামনে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে। সে কোন একটা ব্যাপারে চিন্তিত। তার নাটকের জোগাড় যন্ত্রে বোধ হয়। ঝামেলা হয়েছে। ভুজঙ্গ শেষ মুহূর্তে জানিয়েছে তার পাতলা পায়খানা হচ্ছে সে আসতে পারবে না।
ক্লাব ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। ক্লাবঘরের বাইরে ছদরুল সাহেবের লোকজন হাঁটাহাটি করছে। একজন শুধু ভেতরে। তার বগলে চামড়ার একটা ব্যাগ। তার গায়ে ছাই রঙের চাদর। চাদর দিয়ে সে চামড়ার ব্যাগ ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে ব্যাগের কোনা বেরিয়ে পড়ছে, সে তৎক্ষণাৎ অতিরিক্ত ব্যস্ততায় গায়ের চাদরে ব্যাগ ঢাকছে।
ছদরুল বেপারী একটু ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মাহফুজ মিয়া কেমন আছ?
মাহফুজের নামের শেষে মিয়া নেই ছদরুল বেপারী তার পছন্দের মানুষদের নামের শেষে আদর করে মিয়া যুক্ত করেন। মাহফুজকে তার পছন্দ হয়েছে।
মাহফুজ চিন্তিত গলায় বলল, জ্বি ভাল।
তোমারে চিন্তিত লাগছে কেন?
জ্বি-না, আমি চিন্তিত না।
ভুজঙ্গ এখনো আসে নাই?
জ্বি-না। তার অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছে।
মাঝেমাঝে এ রকম হয়- অ্যাসিসটেন্ট আসে। আসল আর আসে না। তখন কি করা লাগে জান? তখন এ্যসিসটেন্টকে ধরে মাইর দিতে হয় গরু চোরের মাইর। বস্তার ভিতরে ঢুকায়ে মাইর। শইল্যে দাগ পড়ব না। হা হা হা।
মাহফুজ কিছু বলল না। ছদরুল বেপারী হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাহফুজ বলল, আপনার কি ইস্কান্দর আলির সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ছদরুল বেপারী বললেন, দেখা হয়েছে। তার সঙ্গে খানাপিনা করলাম। বোকা লোক। তবে বোকা লোকরাই সংসারে ঝামেলা তৈরি করে। বুদ্ধিমান লোকদের কাছ থেকে সাবধান থাকার দরকার নাই। বুদ্ধিমান লোকরা নিজেরা ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চায় বলে ঝামেলা করে না। বোকারা এইসব বুঝে না বলে ঝামেলা করে। ইস্কান্দর আলির বিষয়ে তোমাকে সাবধান করে দিলাম। একে গ্রামে রাখা ঠিক না। এখন আমি কাজের কথা শেষ করি। তুমি এমন চিন্তিত মুখ করে বসে থাকবে না। চিন্তা দূর কর। সহজভাবে বস।
মাহফুজ সহজ হয়ে বসার চেষ্টা করল। ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমারে আমি সর্বমোট দশ লাখ টাকা দিব। ছয় লাখ নগদ। বাকি চার লাখ টাকার দিব ইট সুরকি। আমার ইটের ভাটা আছে। সেখান থেকে ইটা আনবা। আনার খরচ তোমার। সৎ কাজ করে আমি বেহেশতে যাব। হুরপরীদের সাথে রং ঢং করব এই ইচ্ছা আমার নাই। পরের টাকায় সৎ কাজ করে তুমি যদি বেহেশতে যাইতে পার যাও। সেইটা তোমার ব্যাপার। আমি আর দশটা লোকের মত না। মুখে বলব এত টাকা দিলাম তারপরে আর খোঁজ নাই। আমি যা করি নগদ নগদ করি। তোমার ছয় লাখ টাকা আমি নিয়া আসছি। ঐ কালো চামড়ার ব্যাগে টাকাটা আছে। টাকা গোণার দরকার নাই। টাকা গোণা আছে। তোমাকে কোন রশিদও দিতে হবে না। আমি তোমারেই পুরাপুরি দিলাম। আমি তোমার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছি। তুমি বেতাল কিছুই করবা না। টাকা নষ্ট হবে না। ঠিক বলেছি?
জ্বি ঠিক বলেছেন।
স্কুল কলেজের কাজ শুরু করে দেও। যদি কোনদিন ঠেকে যাও আমি বেঁচে থাকলে আমার কাছে আসবা। পথের ফকির লোক যারা কোটিপতি হয় তারার খুবই টাকার মায়া থাকে। একটা পয়সা খরচ করতে তাদের কলিজায় লাগে। আমার হয়েছে উল্টা। আমার কলিজায় কিছু লাগে না। কারণ আমার কলিজা নাই যাই হোক এখন তোমারে একটা প্রশ্ন বল দেখি আমি যে এত টাকা দান খয়রাত করি– কেন করি? পুণ্যের আশায় যে করি না এটাতো তোমকে আগেই বললাম। তাহলে করি কেন?
জানি না।
এইসব করি যাতে লোকজন আমার দিকে অন্য ভাবে চায়। আমাকে দেখে যেন ফিসফিস করে বলে- ঐ যায় ছদরুল বেপারী। তোমার স্কুল কলেজ তৈরি হবার পর আমি একদিন স্কুলের সামনে রাস্তা দিয়ে লুঙ্গি পরে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে হেঁটে যাব। তখন স্কুলের সব ছাত্র শিক্ষক পড়া বন্ধ করে আমারে দেখবে। ফিসফিস করে বলবে- ছদরুল সাব যায়। এই ফিসফিসানি শোনার জন্যে করি বুঝলা?
জ্বি।
আচ্ছা এখন অন্য একটা বিষয় নাটকের যে মেয়েটারে তুমি এনেছ তার নাম যেন কি?
চিত্রা।
চিত্রা? আমি প্রথমে ভুল শুনেছিলাম। আমি শুনেছিলাম চিতা, অবাক হয়ে ভেবেছিলাম বাঘের নামে মেয়েছেলের নাম হবে কেন? যাই হোক এই মেয়ে তুমি ময়মনসিংহ থেকে এনেছ?
জ্বি।
সে ময়মনসিংহ যাবে কবে?
কাল তাকে আমি দিয়ে আসব।
ছদরুল বেপারী হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমার দিয়া আসার দরকার নাই। আমি নিজে কাল ময়মনসিংহ যাব। আমি তারে যেখানে যেতে চায় দিয়া আসব। তোমার দায়িত্ব শেষ। সব দায়িত্ব এখন আমার। তুমি তারে নাটকের শেষে আমার ওখানে পৌঁছায়ে দিবা। ঠিক আছে? থাক তোমার পৌঁছায়া দেয়ার দরকার নাই। আমার লোকজন তারে নিয়া যাবে।
মাহফুজ খুবই অবাক হয়ে তাকাল। মনে হচ্ছে সে কথাগুলোর অর্থও ধরতে পারছে না। ছদরুল বেপারী হাসিমুখে বললেন আমার কথা শুইন্যা তুমি মনে হয় খুব অবাক হইলা।
জ্বি, অবাক হয়েছি।
অবাক হওয়ার কিছু নাই। এই ধরনের মেয়েরা নাটকের বাইরেও এইভাবে কিছু বাড়তি রোজগার করে। এতে তারার নিজেদের সংসার ভাল চলে আর আমার মত দুষ্ট লোকরারও কিছু সুবিধা হয়।
মেয়েটা এ রকম না।
তোমার কাছে হয়ত না। তোমার কাছে এই মেয়ে ভাল ভাল কথা। বলেছে। আমার সাথে বলবে না। যাই হোক তুমি এত দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। এই মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা যা বলার আমার লোকজন বলবে। তারপর যদি এই মেয়ে আমার সঙ্গে ময়মনসিং যেতে চায় আমার সঙ্গে যাবে। আর যদি যেতে না চায় থাকবে। জোর জবরদস্তির কোন ব্যাপার না। সবই হবে আপোষে। এতে কি তোমার অসুবিধা আছে।
জ্বি অসুবিধা আছে। আমি মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছি আমি নিজে তাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
তুমি তোমার কথা রাখার চেষ্টা কর। তুমি তোমার কাজ করার চেষ্টা করবে। আমি আমার কাজ করার চেষ্টা করব।
মাহফুজের মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। পান ঘেঁছার মত শব্দ হচ্ছে। খটখট খটখট খটাখট। খটখট খটখট খটাখট। দাদীজান শুধু যে পান খাচ্ছেন তাই না, মনে হচ্ছে মুচকি মুচকি হাসছেনও। এখন মনে হচ্ছে। কথাও বললেন– আবু ও আবু কি হইছে?
দাদীজান চুপ করেন। আমি বিপদের মইধ্যে আছি।
তোরে বলছিলাম না। মেয়েটারে নিয়া আইস্যা ভাল করস নাই। বলছিলাম, কি বলি নাই?
হ্যাঁ বলছিলেন।
এখন দেখতেছস কত বড় বিপদ?
হু।
বৃদ্ধা পান ঘেঁছে যাচ্ছেন। খটাখট খটখট শব্দ হচ্ছে। মাহফুজের মাথায় যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে।
ছদরুল বেপারী বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?
মাহফুজ কিছু বলল না। ছদরুল বেপারী নিচু গলায় বললেন, তোমার চোখ টকটকা লাল।
আমার মাথায় যন্ত্রণা।
বেশি?
হ্যাঁ বেশি।
আমার কথাবার্তা শুনে কি মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে?
জ্বি।
তাহলে আমি খুবই শরমিন্দা। যাই হোক, তুমি টাকাটা নাও। নিয়ে। চলে যাও।
মাহফুজ বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনার টাকা আমি নিব না। ছদরুল বেপারী মাহফুজের কথায় চমকালেন না, বা বিস্মিতও হলেন না। মনে হয় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন মাহফুজ এই ধরনের কথা বলবে। কিংবা তিনি যে কোন ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত।
তুমি আমার টাকা নিবে না?
জ্বি না।
কেন? আমি দুষ্ট লোক বলে? আমি যে দুষ্ট এটাতো তুমি আগেই জানতে। জানার পরেও তো টাকার জন্য গিয়েছ। যাও নাই?
মাহফুজ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
ছদরুল বেপারী সহজ গলায় বললেন, মানুষ মন্দ হয়। মানুষের টাকা মন্দ হয় না। টাকার গায়ে ভাল মন্দ লেখা থাকে না। ভাল মানুষের টাকা দিয়েও যেমন অতি মন্দ কাজ করা যায়, মন্দ মানুষের টাকা দিয়েও অতি ভাল কাজ করা যায়। এই দেশের বেশির ভাগ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কারা করেছেন? পয়সাওয়ালা লোকেরা করেছেন। যাদের প্রচুর টাকা পয়সা থাকে তারা সেই টাকা পয়সা কিভাবে জোগাড় করে? নানান ফন্দি ফিকির করে জোগাড় করে। ধান্ধাবাজি করে জোগাড় করে, কালোবাজারি করে জোগাড় করে। অতি সৎ যে মানুষ তার ঘরে টাকা জমে না। বুঝেছ? সৎ মানুষের ডাল থাকে তো নুন থাকে না।
জ্বি বুঝেছি।
কাজেই ধরে নিতে পারি এই দেশের বেশির ভাগ সৎ কর্ম করা হয়েছে– নষ্ট মানুষের দানে। যুক্তি কি তুমি মান?
মানি।
এখন তাহলে আমার টাকা নিতে তোমার অসুবিধা নাই।
আমার অসুবিধা আছে। আমি আপনার টাকা নিব না।
মাথার ভেতর খটখট শব্দটা বাড়ছে। বুড়ি বড় যন্ত্রণা করছে। বুড়ি আবার কথা বলা শুরু না করলেই হয়।
মাহফুজ উঠে দাঁড়াল।
ছদরুল বেপারী বললেন, চলে যাচ্ছ না-কি?
মাহফুজ বলল, জ্বি।
আচ্ছা ভাল। সৎ কাজ সৎ অর্থে করাই ভাল। তোমার চোখ যে রকম লাল হয়েছে, তোমাকে দেখে ভয় লাগছে। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম কর।
ছদরুল বেপারী একজনকে সোনার মেডেল কিনতে পাঠিয়ে দিল। তার এখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ক্লাব ঘরে খাট পাতা আছে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া যায়।
মাহফুজ ক্লাবঘর থেকে বের হল। সে ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। লক্ষণ ভাল না। তার শরীর এখন অতি দ্রুত খারাপ করবে। চোখ হবে পাকা করমচার মত লাল। সে রোদের দিকে তাকাতে পারবে না। তার দাদীজান মাথার ভিতরে এসে পান হেঁচতে হেঁচতে কথা বলা শুরু করবে। বুড়ো-বুড়ি এমিতেই কথা বলে। মৃত্যুর পর বুড়ির কথা বলা খুব বেড়েছে। বুড়ির সব কিছুতেই নাক গলাতে হবে। সব। বিষয়ে কথা বলতে হবে। বুড়ির কোন কথা এখন শোনার দরকার নেই। বুড়ি উল্টাপাল্টা কথা বলতে থাকুক। সে শুধু শুনে যাবে। জবাব দেবে না।
বুড়ির মাথার ভেতর ডেকে উঠল, আবু। ও আবু?
মাহফুজ জবাব দিল না। বুড়ি তাতে দমবার পাত্রী না। সে ডেকেই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মাহফুজ এক সময় বলল, কি চাও?
বুড়ি বলল, আমি কিছু চাই না। তুই ভয় পাইছস?
ভয় পাব কি জন্যে?
ছদরুল বেপারীর সাথে বিবাদ করছস ভয় তো পাওনেরই কথা। হে তরে চাইটা খাইয়া ফেলব। হে হইল চাইট্টা খাউড়া।
চুপ কর।
তরে একটা বুদ্ধি দেই।
কি বুদ্ধি?
বুড়ির বুদ্ধি তুই শুনবি?
না।
তাইলে আর বুদ্ধি দিয়া লাভ কি?
কোন লাভ নাই। তুমি তোমার পান খাও।
আইচ্ছা।
বুড়ি পান ঘেঁছা শুরু করল। খটখট খটখট। খটাখট খটাখট। এরচে বুড়ির কথা শোনা ভাল ছিল। বাঁশের চোঙে পান ঘেঁছার শব্দ অসহ্য লাগছে। সেই বাঁশও ফাটা বাঁশ। এক সঙ্গে দুই তিন রকম শব্দ হচ্ছে।
ও আবু। আবু।
হু।
নাটক বাদ দে, মাইয়াটারে তার মার কাছে পাঠাইয়া দে। এক্ষণ লইয়া রওনা দে। তোর সাথে বাদাইম্যা কিছু পুলাপান আছে। এবারে সাথে কইরা নে।
নাটক করব না?
দূর ব্যাটা নাটক- জানে বাঁচলে নাটক থিয়েটার।
এইসব কথা বইল্যা লাভ নাই দাদীজান। নাটক হবে। প্লের নাম টিপু সুলতান।
নাটকের শেষে ছদরুল বেপারী যখন মেয়ে তুইল্যা নিয়া যাবে তখন তুই কি করবি?
দুনিয়া কি অত সোজা দাদীজান?
হরে ব্যাটা দুনিয়া সোজা। যারার টাকার পয়সা আছে, ক্ষমতা আছে। এরা দুনিয়াটারে সোজা বানাইয়া ফেলতে পারে। ছদরুল বেপারী দুইটা খুন করছে। তার কিছু হইছে? কিছুই হয় নাই।
তুমি চিত্রারে ময়মনসিং পাঠাইয়া দিতে বলতেছ?
আরেকটা বুদ্ধি আছে।
কি বুদ্ধি?
তুই তো আমার বুদ্ধি শুইন্যা হাসবি। তয় আমি বুড়ি মানুষ, মনে যেটা আসে কইয়া ফেলি, আমার কথায় হাসনেরও কিছু নাই, কান্দনেরও কিছু নাই।
তোমার বুদ্ধিটা কি?
মাইয়াটারে বিবাহ কইরা ফেল।
কি কইলা?
ইস্কান্দর মাওলানারে খবর দিয়া আন তুই। গোসল কইরা একটা পাঞ্জাবী পিন্দা ফেল- ঈদের পাঞ্জাবীটা আছে না?
দাদীজান চুপ করেন।
মাইয়াটারে তো তর পছন্দ হইছে।
কে বলছে পছন্দ হইছে?
আচ্ছা যা পছন্দ হয় নাই মাইয়াটা বিপদে পড়ছে তারে বাঁচাইবি না? মাইয়াটারে বিবাহ করলে তর লাভ বিনে ক্ষতি নাই। তোর মহা লাভ।
কি লাভ?
ভাড়া কইরা নাটকের মেয়ে আননের দরকার হবে না। ঘরেই আছে। নাটকের মেয়ে। হি হি হি।
খবদার দাদী হাসবা না।
আইচ্ছা যা হাসব না। তুই এক কাম কর ছদরুল বেপারীরে গিয়া ক, মেয়েটারে তুই বিবাহ করতেছস। ছদরুল লোক খারাপ, তাই বইল্যা ঘরের বউ নিয়া চইল্যা যাবে না।
আর কথা না দাদী, চুপ।
আচ্ছা যা চুপ করলাম।
পানও খাইতে পারবা না। পান খাওয়া খাওয়ি বন্ধ।
এইটাতে পারব নারে ব্যাটা।
বুড়ি পান ঘেঁচা শুরু করল। মাহফুজ এলোমেলো পা ফেলে তার। বাড়ির দিকে রওনা হল। হাঁটা দূরের কথা, সে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে। অথচ তার এখন প্রাইমারী স্কুলের দিকে যাওয়া দরকার। স্কুলের মাঠে স্টেজ বানানো হচ্ছে। সামছু আছে স্টেজের দায়িত্বে। সামছুর কাজ খুবই গোছানো। কোন রকম ঝামেলা হবে না। তারপরও খোঁজ নেয়া দরকার। কিছু চেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশিষ্টজনরা আসবেন। তারাতো আর পা লেপ্টে চাটাইয়ের উপর বসবেন না। মেয়েদের বসার জন্যে আলাদা জায়গা করার জন্যে বলা হয়েছে। পুরুষ এবং মহিলাদের মাঝখানে চিকের পর্দা থাকার কথা। চিকের পর্দা পাওয়া যাচ্ছে না। হ্যাঁজাকের জন্যে একজনকে নেত্রকোনা পাঠানো হয়েছে। যাকে পাঠানো হয়েছে সে কোন কাজই ঠিকঠাক মত করতে পারে না। যে কাজে কোন ঝামেলা নেই সেই কাজেও সে ঝামেলা পাকায়। হ্যাজাক সে নিয়ে আসবে ঠিকই দেখা যাবে মেনটল আনে নি। নাটকের লোকরা রাতে খাবে। নাটক শুরু করার আগে হালকা কিছু খাবে। শেষ হবার পর ভালমত খাবে। খাবারের দায়িত্ব হয়েছে মনিরুদ্দিনকে, সে কি করল না করল তার খোঁজ নেয়াও দরকা। ভুজঙ্গ বাবুকে আমার জন্যে মনিরকে পাঠানো হয়েছে। ভুজঙ্গ বাবু আবার জিনিস না খেয়ে স্টেজে উঠতে পারেন না। স্টেজে ওঠার আগে এক গ্লাস কেরোসিন হলেও তাকে খেতে হবে। মনির যদি বুদ্ধি করে দুএকটা বোতল নিয়ে আসে তাহলে সমস্যা নেই, না আনলে আরেকজনকে নেত্রকোনা পাঠাতে হবে।
মাহফুজ হাঁটতে শুরু করল। কোন কিছু নিয়েই সে এখন দুঃশ্চিন্তা করবে না। সে চোখ বন্ধ করে সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত শুয়ে থাকবে।
মাহফুজ খাড়াও। তুমি দেখি আন্ধার মত চলতেছ। আমার সামনে দিয়া গেলা আমারে দেখলা না।
মাহফুজ থমকে দাঁড়াল। ক্ষুব্ধ মুখে গণি মিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। রোদ তেমন নেই, তারপরও একজন তার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে। মাহফুজ লজ্জিত গলায় বলল, গণি চাচা আমার দিশা নাই, শরীরটা খুব খারাপ করছে। মনে হয় জ্বর আসতেছে।
তোমার শরীর যে খারাপ এইটা বুঝতেছি। চউখ লাল।
গণি মিয়া কি বলছেন মাহফুজের কানে ঢুকছে না। সে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছে।
লোকমুখে শুনতেছি ছদরুল বেপারী ১০ লাখ টাকা নগদ দিতেছে। ঘটনা কি সত্য?
আমি এখনো কিছু জানি না।
দিলে আমি আচাৰ্য্য হব না। পথের ফকির থাইক্যা পয়সা হইছে এই জন্যে পয়সা লোকজনরে দেখাইতে চায়। ছদরুল বেপারীর মা বাজারের নটিবেটি ছিল এইটাতো জান? টাকা দেখাইয়া মার কলংক ঢাকতে চায়। টেকায় কলংক ঢাকে না।
চাচা আমি যাই, শরীরটা খুব খারাপ লাগতেছে।
শোন মাহফুজ, সুলতান সাবের সাথে আমার বসার ব্যবস্থা রাখবা। গেরামে আমার ইজ্জত আছে এইটা খিয়াল রাখবা। ছদরুল তো সুলতান সাবের সাথে বসব। দশ লাখ টাকা দিতাছে সে না বসলে কে বসব? এক ধার দিয়া হে বসুক, আরেকধার দিয়া যেন আমি বসি। দশ লাখ না দিলেও আমি কিছু দিব। আমারতো দশ লাখ দেওনের দরকার নাই। আমার মা তো নটিবেটি ছিল না। কি কও?
মাহফুজ চুপ করে রইল গণি মিয়া বললেন– তিনটা গদিওয়ালা চিয়ার আমি পাঠাইয়া দিছি।
জ্বি আচ্ছা।
পাঁচ দশ মিনিট কথা বলার সুযোগ থাকলে আমারে বলবা। কয়েকটা চুম্বক কথা পাবলিকরে বলব। এতে তোমার লাভ বিনে ক্ষতি হবে না। ঠিক আছে?
জ্বি, ঠিক আছে।
তোমার শরীরের অবস্থা বড়ই শোচনীয়। যাও বিশ্রাম কর গিয়া। আগে শরীর ঠিক রাখবা। ধন দৌলত কিছু না। স্বাস্থ্যই আসল। ছদরুল বেপারীরে দেখ তার কি টাকা পয়সার অভাব আছে? কিন্তু তার স্বাস্থ্যটা দেখ। শুনছি কিছুই হজম করতে পারে না। পানি খাইলেও না- কি বদ হজম হয়। চোকা ঢেকুর ওঠে।
.
মাহফুজ ঘরের দিকে রওনা হল। মাথার যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যই হুঁস জ্ঞান বলে কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা খারাপ না। যার হুঁস জ্ঞান নাই তার দুঃশ্চিন্তা নাই। সবচে সুখি মানুষ হল মৃত মানুষ।
.
চিত্রা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিল। তার হাতে নাটকের বই। পাঠ তার মুখস্ত। তারপরেও চোখ বুলিয়ে যাওয়া। মফঃস্বলের নাটকে মেয়েদের রিহার্সেলের দরকার হয় না। নাটকের আগে তাদের স্টেজে তুলে দেয়া হয়। চিত্রা বই থেকে মুখ তুলে খুবই আশ্চর্য হল। মাহফুজ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন নিজের বাড়িঘর চিনতে পারছে না। মাহফুজকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে টপটপ করে চোখ দিয়ে রক্ত। পড়বে। চিত্রা দেখে আঁৎকে উঠে বলল, আপনার কি হয়েছে? মাহফুজ চট করে জবাব দিতে পারল না। তাকিয়ে রইল। তার কেমন যেন ধাঁধার মত লাগছে। চিত্রা মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন? সকালেও তো এত সুন্দর লাগে নি। অবশ্যি এখন বিকাল। আকাশে সামান্য মেঘ আছে। মেঘলা বিকালে কন্যা সুন্দর আলো বের হয়। সেই আলো মনে হয় বের হয়েছে। সুলতান সাহেবের মেয়ে রানুর চেয়েও তাকে বেশি সুন্দর লাগছে। মনে হয় মেয়েটার শরীর এখন জ্বর নেই। সে গোসল করেছে। গোসলের পর পর যে কোন মেয়ের সৌন্দর্য দশগুণ বেড়ে যায়।
মাহফুজ থেমে থেমে বলল, তুমি কি গোসল করেছ?
চিত্রা বলল,আমি গোসল করেছি কি করি নাই তা দিয়ে আপনার দরকার কি?
জ্বর ছিল তো। জ্বর গায়ে গোসল করা ঠিক না এই জন্যে জিজ্ঞেস করেছি।
হ্যাঁ আমি গোসল করেছি। আপনার কি হয়েছে?
কিছু না।
মাহফুজের মাথা ঘুরছে। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। সে উঠোনেই বসে পড়ল। চিত্রা এগিয়ে এসে মাহফুজের সামনে দাঁড়াল। মাহফুজের মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে।
আপনার শরীর কি আবারও খারাপ করেছে?
হু।
প্রায়ই কি আপনার এরকম শরীর খারাপ করে?
কোন ঝামেলা হলে শরীর খারাপ করে।
কি ঝামেলা হয়েছে?
কোন ঝামেলা হয় নাই। একটু পানি খাব।
আপনি ঘরে এসে শুয়ে পড়ুন। আমি পানি এনে দিচ্ছি।
চিত্রা জ্বর দেখার জন্যে কপালে হাত দিতে গেল। মাহফুজ মাথা সরিয়ে নিল। চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আমি গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখলে কি কোন সমস্যা আছে।
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, না।
তাহলে মাথা সরিয়ে নিলেন কেন? আমি খারাপ মেয়ে, শরীরে হাত লাগলে শরীর নোংরা হয়ে যাবে, এই জন্যে?
আরে ছিঃ এইসব কি বল?
তাহলে আপনি আমার হাত ধরুন। আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দিব। মাথায় মনে হয় পানিও ঢালতে হবে।
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে।
চিত্রা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মানুষটা মনে হয় জ্বরের ঘোরে কথা বলা শুরু করেছে। জ্বর একবার মাথায় বসলে মাথার ভেতরের অনেক কথা আস্তে আস্তে বের হতে শুরু করে। চিত্রার মনে হয় এই লোকটার মাথার ভেতরে অনেক মজার মজার কথা আছে। কথাগুলো শুনতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। তবে মাথার গভীরে বসে থাকা কথা শুনতে নেই। পাপ হয় তার নিজের মাথার ভেতরেও অনেক ভয়ংকর কথা আছে। সেই কথাগুলো অন্য কেউ শুনলে নিশ্চয়ই তার ভাল লাগবে না। সব মানুষেরই কিছু না কিছু ভয়ংকর কথা থাকে। কথা যত ভয়ংকর মাথার তত গভীরে তার বাস। রানুর মত ভাল মেয়েরও ভয়ংকর কথা কিছু না কিছু থাকবে। মওলানা ইস্কান্দার থাকবে। থাকতেই হবে…।
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, দাদীজান একটু থামেন।
চিত্রা বলল, কি বলছেন?
মাহফুজ ক্ষীণ গলায় বলল, তোমাকে না। দাদীজানের সঙ্গে কথা বলি।
কোথায় আপনার দাদিজান?
মাহফুজ হতাশ ভঙ্গিতে চারদিকে দেখছে। চিত্রা শক্ত গলায় বলল, আর কথা না। এবার উঠুন। আপনাকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি।
মাহফুজ বলল, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে। অবেলায় গোসল করেছ তো। এই জন্যে। অবেলায় গোসল করলে মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে।
চিত্রা বলল, গোসল না করলেও আমি সুন্দর। আর বিড়বিড় করতে হবে না। হাত ধরুন।
মাহফুজ হাত ধরল। হাত ধরে যে তাকে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে কে? তার পরিচিত কেউ? তার গা থেকে অদ্ভুত গন্ধও আসছে। জদার গন্ধের মত গন্ধ। ভাল লাগে, কিন্তু মাথা ধরে যায়। দাদীজানের মুখের পান থেকে কি এই জদার গন্ধ আসছে। পান হেঁচার খটাখট শব্দটা হচ্ছে না। তার অর্থ একটাই- বুড়ি পান খাওয়া শুরু করেছে।
দাদীজান তুমি আছ?
বুড়ি মাথা দুলাতে দুলাতে ছড়া কাটল,
লাউ এর ভিতরে বইয়া বুড়ি
ছেঁচা গুয়া খায়।
একখান ঠেলা দেওছান দেহি
কদ্দুর দূরা যায়।
বুড়ি ছড়া বলতে বলতে খিকখিক করে হাসছে। মাহফুজ ভেবে পেল না বুড়ির মনে এত আনন্দ কেন!
.
চিত্রার খুবই অদ্ভুত লাগছে। সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় সে আছে, অচেনা একজন মানুষের মাথায় পানি ঢালছে অথচ ব্যাপারটা তার কাছে মোটেই অস্বাভাবিক লাগছে না।
মাহফুজের বাড়িটা মাটির। মাটির বাড়ি বলেই কি বেশি আপন লাগছে? ইটের দালান, টিন বাঁশের বেড়ার বাড়ি তো এত আপন লাগে না।
মানুষ মাটির তৈরি বলেই কি মাটির ঘর-বাড়ি এত আপন লাগে? চিত্রার মা বলতেন- মানুষের আসল ঘর মাটির-কব্বর।
চিত্রা তখন বলত, ওটা ঘর না মা, গর্ত। মাটির নিচে ঘর হয় সাপের আর ইঁদুরের। মানুষের ঘর হবে মাটির উপরে। মৃত্যুর পর মানুষ আর মানুষ থাকে না,তখন সে গর্তে ঢুকে যায়।
চিত্রার মা তখন অতি বিরক্ত হয়ে বলতেন– এর সাথে কথা কইলেও পাপ হয়। বিরাট পাপ।
তোমাকে কি কথা বলার জন্য পা ধরে সাধি? কথা না বললেই হয়। মেয়ের সাথে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া চিত্রার মা কথা বলতেন না। দুজন মানুষ পাশাপাশি বাস করছে, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না।
মাহফুজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। কি ভয়ংকর নির্জন বাড়ি। গ্রামের বাড়ি কখনো এমন নির্জন হয় না। কেউ না কেউ সারাক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকে। আজ কেউ নেই। সবাই জড় হয়েছে প্রাইমারী স্কুলের ময়দানে, কিংবা ক্লাবঘরের আশেপাশে। কাউকে পেলে ভাল হত। তাকে ডাক্তারের খোঁজে পাঠানো যেত। এই গ্রামে ডাক্তার থাকেন বলে চিত্রার মনে হয় না। তবে দুবছর পর থাকবে। ডাক্তার থাকবে, হাসপাতাল থাকবে, পাকা রাস্তা থাকবে। রোগীর খবর পেলে সাইকেল বিক্সায় টং টং করতে করতে পাকা রাস্তায় ডাক্তার চলে আসবে।
মাহফুজ পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, দাদীজান পানি খাব। চিত্রা পানি আনার জন্যে উঠে দাঁড়াল। একটা ব্যাপারে চিত্রা খুবই আশ্চর্যবোধ করছে। মানুষটা অসুস্থ হলেই বিড়বিড় করে তার দাদীজানের সঙ্গে কথা বলে।
নিন পানি এসেছি।
মাহফুজ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই সে মুখ হা করল। চিত্রা বলল, এই ভাবে তো পানি খেতে পারবেন না। আপনাকে উঠে বসতে হবে। উঠে বসতে পারবেন?
মাহফুজ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। গ্লাস হাতে নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে পানি খেয়ে খাট থেকে নামতে গেল। চিত্রা তাকে ধরে ফেলে বলল, কোথায় যাচ্ছেন?
ক্লাবঘরে যাব।
এই অবস্থায় ক্লাবঘরে যাবেন মানে?
তোমাকে তোমার মার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঝামেলা হয়ে গেছে। বিরাট ঝামেলা। নাটক বন্ধ। এখনই তোমাকে পাঠিয়ে দিব।
ঘটনা কি বলুন তো?
ঘটনা কিছু না তোমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।
কে আমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে?
আমার দাদীজান।
চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আপনি আমার কথা শুনুন। জ্বরে আপনার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনি কি বলছেন না বলছেন নিজেই জানেন না।
মাহফুজ ক্লান্ত গলায় বলল, এখন তোমাকে পাঠায়ে না দিলে বিরাট ঝামেলা হবে। ছদরুল বেপারীকে তুমি চেন না। ভয়ংকর মানুষ। নাটকের শেষে সে তোমাকে নিয়ে যাবে।
চিত্রা বলল, নিয়ে গেলে নিয়ে যাবে। আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না।
তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না।
বুঝতে পারব না কেন? এটা তো নতুন কোনো ঝামেলা না। পুরনো ঝামেলা। নাটকের মেয়ে মফঃস্বলে নাটক করতে গিয়েছে আর মফঃস্বলের ক্ষমতাবান মানুষদের কেউ মেয়েটার সঙ্গে রাত কাটাতে চায় নাই এটা তো এখনো হয় নাই।
ও
আমার জন্যে এটা নতুন কিছু না।
ও
এসব আমাদের হিসাবের মধ্যে ধরা থাকে।
ও
আমার মা ছিলেন খারাপপাড়ার খারাপ মেয়ে। আমি নিজেও সেই জিনিস। আপনার এত চিন্তা কি জন্যে? শুয়ে থাকেন।
মাহফুজ শুয়ে পড়ল।
চিত্রা নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছে। মাহফুজ কথাগুলো শুনছে কি শুনছে না তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।
আপনে যখন ছিলেন না তখন ছদরুল বেপারীর লোক আমার কাছে এসেছিল। তার সাথে কথা হয়েছে। এক রাতের জন্যে আমি পাব দশ এই হাজার টাকা। বুঝেছেন। এই টাকাটা আমার দরকার। আমার মার দরকার।
মাহফুজ তাকিয়ে আছে। তার মাথার তীব্র যন্ত্রণা কমে আসছে। মাথার ভেতর বসে থাকা দাদীজান মনে হয় পান খেয়ে খেয়ে এখন ক্লান্ত। কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমুতে যাবে।
আবু ও আবু!
মাহফুজ চমকে গেল। বুড়ি এখনো ঘুমায় নি। জেগে আছে।
আবুরে শোন।
শুনতেছি।
মেয়েটা মিথ্যা কথা বলতেছে। যা বলতেছে সবই মিথ্যা।
আইচ্ছা।
দুঃখ ধান্ধায় বড় হইছে তো। নানান সময়ে মিথ্যা বলতে হইছে।
আইচ্ছা ঠিক আছে।
তুই মন খারাপ করিস না।
আরে কি যন্ত্রণা, আমি মন খারাপ করব ক্যান?
মাহফুজের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। মেয়েটা শুধু যে পান ঢালছে তা না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা মাহফুজের এখন নেই কিন্তু তার কাছে সবকিছুই কেমন এলোমেলো লাগছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাথা অসম্ভব খালি খালি লাগছে। এরচে বুড়ি যদি পান ছেচতো ভাল লাগতো।
সুলতান সাহেব
০৬.
সুলতান সাহেব খুবই বিরক্তিবোধ করছেন। তিনি গ্রামের বাড়িতে এসেছেন বলেই যখন তখন যে কেউ তার ঘরে ঢুকে পড়বে তা মেনে নিতে পারছেন না। আবার কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি বলবেন- এখন দেখা হবে না। পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে। সেটাও তার কাছে। গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। গ্রামে তিনি সহজ সাধারণ একজন হিসেবে থাকতে চান। এমন একজন যার কাছে যে কেউ যে কোন সময় আসতে পারে A man has many faces. তার গ্রামের যে ছবি তা তাঁর কর্মজীবনের ছবির মত হবে না। কিন্তু তা বোধহয় হবার নয়। মানুষের খুব সম্ভব একটা Face ই থাকে।
তাঁর কাছে এই মুহূর্তে একজন দেখা করতে এসেছে। দর্শনপ্রার্থীরা নাম ছদরুল বেপারী। বেপারী কারো নাম হতে পারে না। ব্যবসা করলেই নামের শেষে বেপারী যুক্ত করার নিয়ম থাকলে তার নিজের নাম হত সুলতান অ্যাম্বেসেডর। লোকটার টাকা পয়সা আছে বলে সবাই তাকে তোয়াজ করছে। সেও নিশ্চয়ই তোয়াজ পেয়ে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ধরেই নিয়েছে সে যখন ইচ্ছা, যার সঙ্গে ইচ্ছা, দেখা করতে পারে। এ ধারণা ভেঙ্গে দেয়া দরকার। তিনি ঠিক করলেন রমিজকে বলবেন- আজ তিনি দেখা করবেন না। তার শরীর ভাল নেই।
তাঁর শরীর ভালই আছে। মনটা ভাল নেই। শরীর মনের ওজন বহন করে। কোন কারণে মন ভারী হলে শরীরের সেই ওজন বহন করতে কষ্ট হয়। এই কষ্টটা তার এখন হচ্ছে। রানু তার মন খারাপ করে দিয়েছে। তাঁর সম্পর্কে রানুর ধারণা যে এতটা খারাপ তিনি বুঝতে পারেন নি। তাঁর বোঝা উচিত ছিল। রানু তাকে বুঝতে দেয় নি। এই বিষয়েও রানুর সঙ্গে কথা বলা দরকার। সেই কথাগুলো গুছিয়ে নেবার জন্যেও সময় লাগবে।
প্রিয়জনদের সঙ্গে মানুষ সব সময় কঠিন যুদ্ধ করে। আদর্শের যুদ্ধ। পছন্দ অপছন্দের যুদ্ধ। মানসিকতার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ মধ্যযুগের তলোয়ার বশীর যুদ্ধের চেয়ে কম ভয়াবহ যুদ্ধ না। সেই যুদ্ধেও আহত হবার মত ব্যাপার ঘটে। রক্তক্ষরণ হয়। যে কোন যুদ্ধে প্রস্তুতি লাগে। অস্ত্র শানিয়ে নিতে হয়। তূণে ধারালো তীর জমা করতে হয়। তাঁকে এই কাজটা করতে হবে। যুদ্ধে নেমে যেন অস্ত্রের অভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে না হয়। এমন এক জটিল সময়ে ছদরুল বেপারীর সঙ্গে কেমন আছেন, ভাল আছি টাইপ কথা বলা সম্ভব না।
সুলতান সাহেব রমিজকে বললেন, আমার সঙ্গে যিনি দেখা করতে এসেছেন তাঁকে গিয়ে বল আমি এখন পড়াশোনা করছি। তিনি যেন পরে আসেন। তাঁর সঙ্গে পরে কথা বলব।
রমিজ অবাক হয়ে বলল, চলে যেতে বলব?
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, হ্যাঁ চলে যেতে বলবে। তবে খুব ভদ্রভাবে বলবে।
রমিজ ইতঃস্তত করে বলল, ছদরুল বেপারী খুবই বিশিষ্ট লোক।
যত বিশিষ্টই হোক আমি এখন নিচে নামব না।
সুলতান সাহেব বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন রমিজ দাঁড়িয়ে আছে যেতে চাচ্ছে না। রমিজকে প্রচণ্ড ধমক দেয়া উচিত। তিনি ধমক দিলেন না। সহজ গলায় বললেন, ঠিক আছে উনাকে বসতে বল, আমি আসছি। আর দুকাপ চা দাও। ঘরে কোন খাবার থাকলে দাও।
রমিজের মুখে হাসি দেখা গেল। মনে হল সে বিরাট বিপদের হাত থেকে অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছে। ছদরুল বেপারীর মত বিশিষ্ট লোককে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
সুলতান সাহেবকে দেখে ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়াল। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার আমি খুবই শরমিন্দা যে আপনারে বিরক্ত করতেছি। বিশ্রাম করতেছিলেন।
কোন অসুবিধা নেই। বসুন।
আপনাকে দেখার বড়ই শখ ছিল। শখ মিটানোর জন্যে এসেছি।
শখ মিটেছে?
জ্বি মিটেছে। আমার মনে যখন যে শখ উঠে শখ মিটায়ে ফেলার চেষ্টা করি। মওলানা ইস্কান্দর সাহেবকে দেখনের শখ ছিল, দেখলাম। আপনেরে দেখনের শখ ছিল, দেখলাম। লোকজন তাজমহল দেখতে যায়, সমুদ্র দেখতে যায়। আমি যাই মানুষ দেখতে। আসল মজা মানুষের মধ্যে। সুলতান সাহেব লোকটির কথা বলার কায়দায় অবাক হলেন অশিক্ষিত মানুষ এমন গুছিয়ে কথা বলে না। সুলতান সাহেব বললেন, আপনার প্রধান কাজ তাহলে মানুষ দেখে বেড়ানো?
ছদরুল বেপারী সঙ্গে সঙ্গে বলল, জ্বি না। এটা আমার শখ। কোন মানুষ সম্পর্কে যখন বিশেষ কিছু শুনি তখন মানুষটারে দেখতে ইচ্ছা করে।
আমার সম্পর্কে বিশেষ কি শুনেছেন?
অনেক কিছু শুনেছি জনাব। আপনি একটা বই লিখেছেন। সেই বই সংগ্রহ করে পড়েছি। অত্যন্ত তৃপ্তি পেয়েছি। কিছু অতি সত্য কথা বলেছেন।
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে গেল। একটি বই তিনি ঠিকই লিখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই। নাম The End game ইংরেজীতে লেখা এই বই সামনে বসে থাকা লুঙ্গি ফতোয়া পরা মানুষটা পড়েছে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। বই ছাপা হয়েছে মোট এক হাজার কপি। এই বই সংগ্রহ করাই মুশকিল।
আপনি আমার বইটা পড়েছেন?
জ্বি জনাব।
বইটা ইংরেজীতে লেখা।
জ্বি জনাব। আমার সেক্রেটারীকে বলেছি সে বাংলা করে আমকে শুনায়েছে।
বই এর কোন জায়গাটা আপনার ভাল লেগেছে?
ছদরুল বেপারীর হাসি মুখে বলল, আপনার বোধ হয় মনে সন্দেহ হয়েছে বইটা আমি পড়ি নাই। আপনার সঙ্গে দেখা করব ঠিক করার পর আপনার সম্পর্কে জানার জন্যে বইটা ঢাকা থেকে এনে পড়ার ব্যবস্থা করেছি। বইয়ের কোন জায়গাটা ভাল লেগেছে জানতে চেয়েছেন- নামটা ভাল লেগেছে। নাম দিয়েছেন শেষ খেলা অথচ বইটাতে বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার কথা। এইটা ভাল হয়েছে। জনাব যদি ইজাজত দেন তাহলে উঠি?
এখন উঠবেন কেন? চা খান।
জ্বি না, চা খাব না। জনাব উঠি।
ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়াল।
সুলতান সাহেব বললেন, বসুন বসুন। এসেই চলে যাচ্ছেন। আপনি যেমন আমার ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করছেন। আমিও করছি। আপনি একজন বিশিষ্ট মানুষ।
জনাব, আমি মাটির কৃমি। বিশিষ্ট কিছু না। তারপরও যদি আমার। বিষয়ে কিছু জানতে চান বলেন।
নামের শেষে বেপারী যুক্ত করেছেন কেন?
ছদরুল বেপারী বসলেন না, দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন, নিজে কিছু যুক্ত করি নাই। লোকের মুখে মুখে বেপারী হয়েছি। আমি এতেই খুশি। লোকজন ইচ্ছা করলে আমারে ছদরুল-চোরা বলতে পারত। ছোটবেলায় চুরি-চামারি করতাম। আমার ভাগ্য কেউ চোর বলে না।
এখানকার স্কুল ফান্ডে আপনি ডোনেশন দিচ্ছেন বলে শুনতে পাচ্ছি।
জ্বি দিচ্ছি। টাকা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আমি আবার নগদ কারবারে বিশ্বাস করি।
সুলতান সাহেব জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন দানের পরিমানটা কত। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালেন। এমন অরুচিকর একটা প্রশ্ন যে তাঁর মনে এসেছে। এজন্যেও তাঁর লজ্জা লাগছে।
ছদরুল বেপারী গলা খাকারি দিয়ে বললেন, স্যারের মনে হয় জানার ইচ্ছা কতটাকা দিতেছি। প্রথম দফায় দশ লাখ টাকা। এটা ছাড়া মসজিদটা করে দিব। পুরানা মসজিদটা ভেঙে পড়ে গেল। মনটা খারাপ হয়েছে। আমি নিজে নামাজ পড়ি না তাতে কি অন্য দশজন তো পড়ে। জনাব যাই। অনেক বিরক্ত করেছি। যাবার আগে আরেকটা কথা বলে যাই বেয়াদবী মাফ করে দেবেন। আপনি যে বইটা লিখেছেন তার নামটাই শুধু ভাল হয়েছে। বইটা ভাল হয় নাই।
ছদরুল বেপারী ঘর থেকেই বের হয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বাগানে একটা পরী হাঁটছে। পরী তো অবশ্যই। পৃথিবীর কোন মেয়ে এত সুন্দর হতে পারে না। নিশ্চয়ই সুলতান সাহেবের মেয়ে। সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। সবুজ গাছপালার ভেতর সুবজ রঙের শাড়ি। বাগানের সঙ্গে মেয়েটার মিশে যাবার কথা। মিশে যায় নি। মনে হচ্ছে সমস্ত বাগান এক দিকে আর মেয়েটি অন্যদিকে। ছদরুল বেপারীর চোখ চকচক করছে। মেয়েটা নিজের মনে হাঁটছে। ছদরুল বেপারীর দিকে তাকাচ্ছে না। এটা ভাল। চোখে চোখ পড়লে ছদরুল বেপারীকে চলে যেতে হবে। চোখ না পড়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকায় কোন দোষ নেই।
.
সুলতান সাহেব ইজিচেয়ার টেনে জানালার কাছে নিয়ে এলেন। তাঁর মন পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত। তারপরেও কেন জানি ঘুম ঘুম পাচ্ছে। অভ্যস্ত জীবন যাত্রা থেকে সরে এলে সিস্টেমে গণ্ডগোল হয়ে যায়। যখন ঘুম পাবার কথা না, তখন ঘুম পায়। ঘুমের সময় বিছানায় বসে থাকতে হয়।
আয়োজন করে ঘুমুতে গেলে ঘুম হবে না। তিনি বেশ আয়োজন করেই ইজিচেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। মাথার নিচে বালিশ। হাত-পা ছড়ানো। আয়োজন দেখেই ঘুমের পালিয়ে যাবার কথা।
বাবা, আমার দিকে একটু তাকিয়ে দেখ তো!
সুলতান সাহেব চোখ মেললেন। রানু তার সামনে দাঁড়িয়ে। রানুর মুখ হাসিহাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার জীবন স্বচ্ছ এবং আনন্দময়। বাবার সঙ্গে কথা বলেও সে তৃপ্তি পাচ্ছে।
আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বাবা?
খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। সবুজ শাড়ি পরার জন্যে বন-পরী লাগছে।
বন-পরী আবার তুমি কোথায় পেলে? জল-পরী আছে। বন-পরী বলে কিছু নেই।
গ্রীক মিথলজীতে বন-পরী আছে। এরা একগাছ থেকে আরেক গাছে। উড়ে উড়ে বেড়ায়। এদের স্বভাবও খানিকটা উগ্র।
উগ্র স্বভাবের বন-পরী হয়ে লাভ নেই। আমাকে খুবই সুন্দর লাগছে। কি-না সেটা বল।
যে সুন্দর তাকে সবসময় সুন্দর লাগে। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে বের হলেও তাকে দেখে মনে হবে– ছেঁড়া কাঁথাতে তার সৌন্দর্য ফুটেছে।
দশের মধ্যে তুমি আমাকে কত দেবে?
দশে সাড়ে আট।
আমি কিছুক্ষণ পর অন্য একটা শাড়ি পরে আসব। তখনো তুমি নাম্বার দেবে। তিনটা শাড়ি পরব। এর মধ্যে যে শাড়িটায় আমাকে সবচে সুন্দর লাগবে সেইটা পরে নাটক দেখতে যাব।
তিনটায় যদি একই রকম ভাল লাগে তখন কি করবি?
তখন টস করব। বাবা শোন, তুমি তো যাচ্ছ না, তাই না?
না, যাচ্ছি না।
আমি রমিজ ভাইকে নিয়ে যাব। তুমি কোন দুঃশ্চিন্তা করবে না।
আমি দুঃশ্চিন্তা করছি না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমে তোমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ, ঘুমুবে না। তুমি হচ্ছ বিউটি কনটেস্টের বিচারক।
তোকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?
নকল খুশি বাবা। চিত্রা অভিনয় করে স্টেজে অনেক দর্শকের সামনে। আমি করি বাড়িতে। আমার দর্শক একজন- তুমি।
সুলতান সাহেব শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে বললেন, একটা কথার জবাব দিয়ে যা, তুই কি আমাকে খুবই অপছন্দ করিস।
রানু বলল, হ্যাঁ।
কেন?
একবার তো বলেছি কেন।
আমার মধ্যে প্রচুর ভান এই জন্যে?
হ্যাঁ। তোমাকে আমার নকল মানুষ মনে হয়।
আধুনিক শিক্ষিত মানুষ মাত্রই নকল মানুষ। বোস আমার সামনে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি।
বক্তৃতা শুনতে একদম ইচ্ছা করছে না।
বক্তৃতা না। আসল মানুষ, নকল মানুষ ব্যাপারটা শুধু ব্যাখ্যা করব। দুমিনিটের বেশি লাগবে না।
রানু বাবার ডানপাশের খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। সে পা নাচাচ্ছে। সুলতান সাহেব লক্ষ্য করলেন, রানু পায়ে আলতা দিয়েছে। আলতা দেয়া ভাল হয় নি। রঙ লেপ্টে গেছে। তারপরেও সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে আলতা এভাবেই দিতে হয়। সুলতান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন– মনে করা যাক খনি থেকে একখণ্ড হীরক পাওয়া গেল। এই হীরাটাকে আমরা বলব আসল। কারণ হীরাটা আছে Crude ফর্মে। সেই হীরা পলিশ করা হল। হীরা কাটা হল। অর্থাৎ Crude হীরা আধুনিক হল। তুই আধুনিক হীরাকে বললি নকল।
রানু বলল, তোমার যুক্তি আমার কাছে খুবই এলোমেলো মনে হচ্ছে। হীরাকে পলিশ করলে বা কাটলে যা থাকে তাও হীরা। আগে আসল পরেও আসল। এক টুকরা কাঁচ যদি দেখতে হীরার মত হয় সেটা হল নকল।
হ্যাঁ।
তোর মার সঙ্গে আমার বনিবনা হয় নি এই কারণে আমি নকল?
উল্টো। মাকে তো আমি নকল বলছি না। বনিবনা তো মারও তোমার সঙ্গে হয় নি। মাকে আসল বলছি।
নকল হলেও তোমার আলো খুবই প্রবল। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এই জন্যে আমি ঠিক করেছি তোমার সঙ্গে থাকব না।
সুলতান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, কোথায় যাবি?
কোথায় যাব এখনো ঠিক করি নি। তবে মার কাছে গিয়ে মাকে বিব্রত করব না। হুট করে কোন এক জায়গায় চলে যাব। আসল কোন মানুষকে গিয়ে বলব– আমাকে আশ্রয় দিন।
আসল-নকল চিনবি কিভাবে তোর কাছে কষ্টিপাথর আছে?
হ্যাঁ আছে।
তুই কি জানিস তুই অসুস্থ? খুবই অসুস্থ।
যে অসুস্থ তার কাছেই সুস্থ মানুষকে অসুস্থ মনে হয়।
তোর ধারণা আমি অসুস্থ?
হ্যাঁ।
এবং তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
হ্যাঁ।
সেই ঘটনাটা কবে ঘটবে?
যে কোনদিন ঘটতে পারে। আজও ঘটতে পারে।
সুলতান সাহেব তাকিয়ে আছেন। রানু উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, বাবা এখন যাই। অন্য একটা শাড়ি পরে আসি। মনে রাখবে সবুজ শাড়িতে তুমি আমাকে দিয়েছ সাড়ে আট। সুলতান সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তার পর তার ঘুম চলে যাবার কথা। কিন্তু ঘুম যাচ্ছে না। তাঁর মনে হল তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মানসিক ক্লান্তি ছড়িয়েছে শরীরে। তাঁর শরীর ক্লান্ত হচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু তাকে ঘুমুলে চলবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে।
বাবা তাকাও।
সুলতান সাহেব তাকালেন। রানু এবার হলুদ শাড়ি পরে এসেছে হলুদ শাড়ি লাল পাড়। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান কিংবা পহেলা ফাল্গুনে মেয়েরা এধরণের শাড়ি পরে।
কেমন লাগছে বাবা।
খুব সুন্দর লাগছে।
দশে কত দেবে?
সাড়ে আট।
সামান্য বাড়ানো যায় না?
না।
প্লিজ বাবা, নয় করে দাও।
রানু হাত জোড় করে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। মেয়েটা আজ বড়ই আনন্দে আছে। সুলতান সাহেবের বুকে হঠাৎ ধাক্কার মত লাগল। তার মেয়েটা অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায় সে ভয়াবহ কাণ্ড মাঝে মধ্যে করে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার মত ভয়ংকর কিছু। কাণ্ডটা যখন করে তার আগে আগে সে খুব আনন্দে থাকে। এবং চোখে পড়ার মত সাজগোজ করে।
রানু বলল, বাবা তুমি এমন ঝিম মেরে আছ কেন? কিছু বল।
মওলানা ইস্কান্দর
০৭.
মওলানা ইস্কান্দর শুয়ে আছেন। ঘর অন্ধকার। এশার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। এই সময় বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না। শরীর খারাপ থাকলে একটা কথা ছিল। তার শরীর খারাপ না। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। এটাও বড় কিছু না। যারা পাক কোরান মজিদ মুখস্থ করার চেষ্টা করে তাদের কারো কারো মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণার মত হয়। এই যন্ত্রণা কখনো যায় না। কখনো বাড়ে কখনো কমে। এখন এই যন্ত্রণা সামান্য বেড়েছে।
মওলানা উঠে বসলেন। বারান্দায় গিয়ে অজু করলেন। এশার আজান দেয়া দরকার। অবশ্যি আজান দিয়ে লাভ নেই। আজান হচ্ছে নামাজের জন্যে আহ্বান। মসজিদই নেই, নামাজের জন্যে আসবে কে? তাছাড়া গ্রামে আজ বিরাট উৎসব। শুধু এই গ্রামের না, আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন চলে এসেছে। টিপু সুলতান প্লে হবে। ভুজঙ্গ নামের একজন টিপু সুলতানের পাট করবেন। খুবই নামি লোক। তিনি না-কি মানুষকে জাদু করে ফেলেন। অভিনয় শুরু করলে মানুষ নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যায়। দুধের শিশু মায়ের কোল থেকে টপ করে পড়ে যায়, মা বুঝতে পারে না। মা হা করে তাকিয়ে থাকে ভুজঙ্গের দিকে।
ইস্কান্দর আলি এশার নামাজে দাঁড়ালেন। রুকুতে যাবার সয় হঠাৎ তাঁর মনে হল তিনি যদি ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখতে যান তাহলে আল্লাহপাক কি তার উপর খুব নারাজ হবেন? চিন্তাটা মনে আসতেই ইস্কান্দর লজ্জা এবং দুঃখে কুঁকড়ে গেলেন। ছিঃ ছিঃ কি ভয়ংকর কথা। এরকম একটা চিন্তা নামাজে দাঁড়িয়ে তার মনে এল? নামাজে দাঁড়ানো মানে আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়ানো। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কি করে ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখার কথা ভাবতে পারলেন? এক বালতি টাটকা দুধে এক ফোঁটা গো-মূত্র পড়লে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। সারাজীবনের সুকর্মও এক মুহূর্তের অসৎ চিন্তায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ইস্কান্দার আলির চোখে পানি এসে গেল। তিনি নামাজ শেষ করলেন। কিছুক্ষণ বারান্দায় চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর মন বলছে আল্লাহপাক এই অপরাধের জন্যে তাঁকে ক্ষমা করবেন না। কঠিন শাস্তি দেবেন। তিনি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে কোরাণ শরীফ নিয়ে বসলেন। চোখ বন্ধ করে তিনি কোরাণ পাঠ করবেন। রেলের উপর কোরাণ শরীফ থাকবে। কোথাও আটকে গেলে পাতা উল্টে দেখে নেবেন। তার ধারণা তিনি আটকে যাবেন। তাঁর মত নিচ প্রকৃতির মানুষকে আল্লাহপাক এত দয়া করেন না। যে দয়ার যোগ্য আল্লাহ পাক তাকেই দয়া করেন।
মওলানা ইস্কান্দার আলি কোরাণ পাঠ শুরু করলেন।
.
ছদরুল বেপারীর হঠাৎ মনে হল, কোথায় একটা সমস্যা হয়েছে। খুব ছোট্ট সমস্যা, তিলের মতই ছোট তবে এই ছোট্ট তিল তাল হয়ে উঠতে পারে। সেই সম্ভাবনা আছে। সমস্যাটা ছদরুল বেপারী ধরতে পারছেন না। কিন্তু অনুভব করতে পারছেন। কেউ তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। সেই কেউটা কে? মানুষের ভেতর কি আরো কোন মানুষ বাস করে? যার প্রধান কাজ সতর্ক করে দেয়া? তার উচিত এই মুহূর্তে এই অঞ্চল ছেড়ে নিজের নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া। সেটা করতেও ইচ্ছা করছে না। ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখে যেতে ইচ্ছা করছে। ছদরুল বেপারীর পাঞ্জাবীর পকেটে সোনার মেডেল। সোনার মেডেলটা তিনি নিজেই ভুজঙ্গ বাবুর গলায় পরিয়ে দেবেন।
রাত নটা বাজে। এগারটার আগে নাটক শুরু হবে না। এর মধ্যেই মানুষের সমুদ্র হয়ে গেছে। এখনো স্রোতের মত লোক আসছে। এই ছোট্ট গ্রামের কি এত মানুষের জায়গা দেবার মত অবস্থা আছে? বিশৃঙ্খলা শুরু হলে সামলাবার ব্যবস্থা কি আছে? অল্প কিছু মানুষের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সেই বিশৃঙ্খলা সামলানো যায়। যেখানে অসংখ্য মানুষ সেখানে বিশৃঙ্খলা ডালপালা ছড়াতে থাকে।
ছদরুল বেপারী তার সঙ্গীদের দিকে তাকালেন। সবাই আশেপাশেই আছে। শুধু একজন নেই। তাকে স্যাকরার দোকান থেকে আরেকটা মেডেল কিনতে পাঠানো হয়েছে। সেই মেডেলটা দেয়া হবে চিতা নামের মেয়েকে। না চিতা না চিত্রা। মেডেল নিয়ে এখনো ফিরছে না। ফিরলে ভাল হত। রাতটা ভাল মনে হচ্ছে না। আজ রাতে সবারই আশেপাশে থাকা দরকার।
ছদরুল বেপারী বললেন, মাহফুজ কই। মাহফুজকে ডেকে আন। তারে দুটা কথা বলব। তারে কিছু পরামর্শ দিব। ছদরুলের এক সঙ্গি মুসলেম মিয়া কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, উনার শরীর খুবই খারাপ। বাড়িতে শুয়ে আছেন। মাথায় পানি ঢালা হইতেছে।
কস কি?
বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নাই।
বিছানায় উঠে না বসলে চলবে কি ভাবে? তোমাদের মধ্যে একজন যাও। ডাক্তার নিয়ে আস। ডাক্তাররে বলবা যেভাবেই হোক সে যেন মাহফুজকে উঠে বসাবার ব্যবস্থা করে। আইজ রাইতে তাকে প্রয়োজন হবে।
ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরালেন। মুসলেম মিয়া চলে গেল। তাঁর মন বলছে কাজটা ঠিক হয় নাই। কাজটা ভুল হয়েছে। তার দলের সবাইকে আশে পাশে থাকা দরকার। রাতটা ভাল না।
ছদরুল বেপারী ক্লাবঘর থেকে বের হলেন। এখন শুক্লপক্ষ। আকাশে চাঁদের আলো আছে। আশ্বিনমাসের চাঁদের আলোয় অস্পষ্টতা থাকে। তবে আজকের আকাশ পরিষ্কার। কুয়াশাও নেই। চাঁদের আলোয় চারদিক দেখা যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্রামে ভয়ংকর ব্যাপারগুলো অমাবশ্যাতেও হয় না, আবার পূর্ণিমাতেও হয় না। এরকম সময়ে হয়। তাঁকে প্রথমবার খুন করার চেষ্টা করা হয় আশ্বিন মাসে। চাঁদের কত তারিখ তা মনে নাই। আকাশে চাঁদ ছিল এটা মনে আছে। তার পেট থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছেন চাঁদের দিকে। তার পরিষ্কার মনে আছে। ছদরুল বেপারীর সঙ্গীরা তার পেছনে পেছনে আসছে। তারা হাঁটছে খানিকটা দূরত্ব রেখে। একজনের গায়ে চাদর। তার বগলে কালো চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। এই খবরটাও নিশ্চয়ই এরমধ্যে কেউ কেউ জেনে গেছে। টাকার জন্যেও সমস্যা হতে পারে। এতগুলো টাকা কখনোই সঙ্গে রাখা উচিত না। কিন্তু ছদরুল বেপারী বেছে বেছে অনুচিত কাজগুলোই করেন। তার ভাল লাগে।
তিনি নিজের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। এই ধরণের উত্তেজনার মুখোমুখি হওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে।
কুদ্দুস!
কুদ্দুস তাঁর দিকে দৌড়ে এল। সামান্য পথ দৌড়েই সে হাঁপাচ্ছে। এই হাঁপানোটা কি ইচ্ছাকৃত?
পান খেতে ইচ্ছা করতেছে। কাঁচা-সুপারি দিয়া পান।
কুদ্দুস বিস্মিত হয়ে বলল, আমি যাব?
হ্যাঁ। তুমি যাবে। তোমার যেতে কোন অসুবিধা আছে?
দুএকটা আজেবাজে লোক ঘুরাফিরা করতেছে।
হু।
কানা রফিকরে দেখলাম। চাদ্দর দিয়া শইল ঢাইক্যা আসছে। তার সাথে লোকজন আছে।
টিপু সুলতান দেখতে আসছে। আমি যদি আসতে পারি তার আসতে দোষ কি? আমরা নাটক দেখব দুই চউখে। কানা রফিক দেখব এক চউখে।
মনে হয় আপনার দিকে নজর আছে।
থাকুক নজর। তোমাকে পান আনতে বলছি তুমি পান আন।
কুদ্দুস নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে রওনা হল। পিস্তলটা তার কাছে থাকে। বড় সাহেবের উচিত তাকেই সবসময় পাশে রাখা। কিন্তু তিনি তা করেন না। যে কোন কাজে তাকে পাঠিয়ে দেন। পান আনার মত তুচ্ছ কাজে যেতে তার খুবই খারাপ লাগছে।
ছদরুল বেপারী স্কুল ঘরের দিকে রওনা হলেন। তার পেছনে এখন শুধু একজনই আছে। সে কালো চামড়ার ব্যাগ বগলে নিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটছে। ছদরুল বেপারী হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। মৃদু গলায় বললেন, আমার পিছে পিছে আসার দরকার নাই তুমি ক্লাবঘরে থাক। একা একা হাঁটতে আমার ভাল লাগতাছে। মাঝেমধ্যে একা থাকা ভাল। চান্নিটাও উঠছে ভাল। বহুত দিন চান্নি দেখি না।
.
মাহফুজ ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে চিত্রার খুবই মায়া লাগছে। যদিও মায়া লাগার কিছু নেই। ছোট বাচ্চারা যখন কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঘুমায় তখন দেখতে ভাল লাগে। ছোট বাচ্চারা ঘুমের মধ্যেই হাসে। ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট বাঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গি করে। তাদের জন্যে মায়া হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষ ঘুমুচ্ছে তার জন্যে মায়া হবে কেন? চিত্রার হচ্ছে। শুধু যে হচ্ছে তাই না খুব বেশি হচ্ছে।
মানুষটা এতক্ষণ ছটফট করছিল। এখন সেই ছটফটানি নেই। কেমন শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার ঘুমের মধ্যে ছোট বাচ্চাদের মত ঠোঁট বাকাচ্ছে। মানুষটা ঘামছে। তার মানে জ্বর কমে যাচ্ছে। চিত্রা নিশ্চিত, কিছুক্ষণ আরাম করে ঘুমানোর পর মানুষটা সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে বসবে। গম্ভীর গলায় বলবে- চল প্লে শুরু করা যাক। তখন আর তার আগের কথা কিছু মনে থাকবে না।
মাহফুজের ব্যাপারটা চিত্রা পুরোপুরি ধরতে পারছে না। মানুষটার মাথায় রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ এই সব ঘুরছে কেন? নিজের কোন কাজ-কর্ম নেই বলে? চিত্রার মা বলতেন– কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম নেয় ভূতের কিল খাওনের জন্যে। সারাজীবন এরা ভূতের কিল খায়। ভূতের কিল কি জিনিস? ভূতের কিল হইল দশভূতের জন্যে কাম করা। নিজের জন্যে কাঁচকলা। এরা ভূতের কাম করবে। ভূতের কিল খাইবে। এইটাই এরার কপাল।
চিত্রার ধারণা এই মানুষটাও জন্মেছে ভূতের কিল খাবার জন্যে। তার খুব কাছের কেউ নেই যে তাকে বলে দেবে ভূতের কিল খাওয়াটা এমন জরুরি কিছু না। আগে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে তারপর ভূত- প্রেতের কিল খেতে চাইলে খাওয়া।
এই মানুষটার নিজের মনে হচ্ছে কিছুই নেই। ঘর-বাড়ির খুবই ভয়াবহ অবস্থা। তার নিজের ধানী জমির সবটাই সে স্কুল ফান্ডে দিয়েছে। তার যুক্তি আমি নিজে যদি না দেই, অন্যরা আমারে দিব কেন? ভূতের কিল খাওয়ার জন্যে যাদের জন্য তাদের জন্যে এই যুক্তি খুবই ভাল। কিন্তু চিত্রার কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। চিত্রা ঠিক করেছে চলে যাবার আগে সে মানুষটাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলে যাবে।
এক. আপনি একটা বিয়ে করুন। এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করুন যে আপনাকে দেখবে এবং আপনি দেখবেন আপনার গ্রাম, রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ।
দুই. আপনি আপনার অসুখটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আপনি যেমন রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বানাচ্ছেন– আপনার অসুখটাও আপনার মাথার ভেতর বসে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বানাচ্ছে।
তিন. আমি অভিনেত্রী মানুষ তো। অভিনয় করে নানান সময়ে নানান কথা বলি। আপনি যেমন সবসময় সত্যি কথা বলেন আমিও তেমন সবসময় মিথ্যা কথা বলি। সত্যি কথা বলে বলে আপনার হয়ে গেছে। অভ্যাস তেমনি মিথ্যা কথা বলে বলে আমার হয়ে গেছে অভ্যাস। আপনাকে বলেছিলাম না ছদরুল বেপারীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি নাটকের পর তার সঙ্গে চলে যাব। দশ হাজার টাকা পাব। কথাটা মিথ্যা। কেন বলেছি জানেন? আমার কথাটা শুনে আপনি মনে কষ্ট পান কি-না দেখার জন্যে। আমি জানতাম আপনি কষ্ট পাবেন। কিন্তু এতটা কষ্ট পাবেন ভাবি নি।
চার. আমি তো আগেই বলেছি আমি মিথ্যা কথা বলি। এবং সুযোগ পেলেই একটু অভিনয় করে ফেলি। বলেছিলাম না আমার পায়ে কাঁটা ফুটেছে? আসলে মিথ্যা। আমি কাঁটা ফুটার অভিনয় করেছি। তবে অভিনয়টা জোরাল করার জন্যে সেফটিপিন দিয়ে খোঁচাখুচি করাটা খুব ভুল। তখন সত্যিকারই ব্যথা পেয়েছি। এটা করা ঠিক হয় নি। কাটার ফুটার অভিনয় কেন করলাম? আপনি বুদ্ধিমান হলে নিজেই বুঝতেন কেন করেছি। যেহেতু আপনি বুদ্ধিমান না, আমি বলে দিচ্ছি। কাঁটা ফুটার। অভিনয় করলাম যাতে আমি আপনার হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটতে পারি। রাগ করবেন না। সত্যি কথাটা বললাম। আমি খুবই খারাপ মেয়ে। অভিনয়ের বাইরেও আমাকে অনেক কিছু করতে হয়। নষ্ট মেয়েদেরও তো মাঝেমধ্যে মন কেমন করে। কারোর হাত ধরতে ইচ্ছা করে। করে না?
পাঁচ. আপনি ভুলেও ভাববেন না যে আপনাকে ভুলাবার জন্যে এইসব কথা বলছি। পুরুষ মানুষকে আমি মিষ্টি কথা দিয়ে ভুলাই না, শরীর দিয়ে ভুলাই। এরকম আঁৎকে উঠবেন না। আঁৎকে উঠার মত কিছু বলি নি।
চিত্রা মাহফুজের গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিল। তখনি ঘরে ঢুকল সামছু। সামছু খানিকটা উত্তেজিত এবং ভয়ংকর চিন্তিত। কারণ ভুজঙ্গ বাবু আসেন নি। শেষ মুহূর্তে খবর দিয়েছেন আসতে পারবেন না। সামছু মাহফুজকে ডেকে তুলতে গেল। চিত্রা চাপা গলায় বলল, খবর্দার উনাকে ডাকবেন না। ঘুমুচ্ছে ঘুমুতে দিন। যা বলার ঘুম ভাঙ্গার পর বলবেন।
মাহফুজ ভাইরে এখন দরকার।
দরকার হলেও উনাকে ডাকা যাবে না। আপনি বাইরে আসুন। উঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।
তারা উঠানে দাঁড়াল। সামুছ বলল, খুবই ভয় লাগতাছে। মনে হইতেছে বিরাট ঝামেলা হইব। মাহফুজ ভাইকে এক্ষণ দরকার। কানা রফিক তার দলবল নিয়া আসছে। কেন আসছে বুঝতেছি না।
চিত্রা বলল, যার ইচ্ছা সে আসুক। কানা রফিকটা কে?
টেকা নিয়া মানুষ খুন করে।
মানুষ খুন করতে কত টাকা নেয়?
মানুষ বুইজ্যা দাম। পাঁচশ টাকার মানুষ আছে। আবার ধরেন লাখ টেকার মানুষও আছে।
চিত্রা বলল, আপনি, স্কুল ঘরে থাকেন। উনার ঘুম ভাঙলেই আমি উনাকে নিয়ে চলে আসব। ভুজঙ্গ বাবু নেই তো কি হয়েছে? প্রমোটারকে টিপু সুলতানের ড্রেস পরে দাঁড় করিয়ে দেব। মফঃস্বলের নাটকে এরকম প্রায়ই হয়। এটা কোন ব্যাপার না।
.
চিত্রার খুব ক্লান্তি লাগছে। আজ নাটক না হলে ভালই হয়। তার ঘুম পাচ্ছে। নাটকের ঝামেলা না থাকলে সে শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে। সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় হাঁটতে ভাল লাগছে। নাটক নিয়ে তার মাথায় কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। নাটক হবে কি হবে না এই দায়িত্ব তার না। সে তৈরী হয়েই আছে। যখন তার ডাক পড়বে সে মঞ্চে উঠে যাবে। সে তার অংশটা শুধু যে ভাল করবে তা না খুবই ভাল করবে। টিপু সুলতানের ডায়লগ শেষ হবার আগেই তার প্রবেশ। টিপু একা একা কথা বলছেন
টিপু : পলাশীর বিষবৃক্ষ। মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠের দল স্বহস্তে রোপন করেছিল যে বিষবৃক্ষ- মীরমদন, মোহনলালের বক্ষ-রক্তে তো ভেসে গেল তবু সে বিষবৃক্ষের মূল শিথিল হল না।
এই সময় সোফিয়া ঢুকবে। টিপু সুলতানকে চমকে দিয়ে বলবে—
সোফিয়া : হায়দার আলি খাঁ বাহাদুর এবং ফতে আলি টিপুও বুকের রক্ত ঢেলে সে বিষবৃক্ষকে উৎপাটিত করতে পারবেন না।
টিপু : কে! কে কথা কইলে! কে তুমি?
সোফিয়া : বাদির নাম সোফিয়া
টিপু : সোফিয়া বালিকা তুমি কি করে জানলে ইংরেজ বিজয়ে আমরা অক্ষম!
সোফিয়া : ও জ্যোতিষীর গণনা। হাঃ হাঃ হাঃ
জোছনা-ভরা উঠানে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রা স্পষ্ট শুনল মহিশূরের মহাপরাক্রমশালী টিপু সুলতান হাসছেন। হাসির শব্দে চিত্রার শরীর ঝনঝন করতে লাগল। আর ঠিক তখনি স্কুলঘরের দিক থেকে হৈ চৈ এর শব্দ আসতে লাগল। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাচ্ছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিত্রা যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল।
মাহফুজ বিছানায় বসে আছে। সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে?
চিত্রা বলল, কিছু হয় নি। আপনার শরীর এখন কেমন?
মাহফুজ বলল, ভাল। চিৎকার কিসের?
চিত্রা বলল, আমি কি করে জানব কিসের চিৎকার। আপনার গ্রামের চিৎকার আপনি জানবেন।
.
সুলতান সাহেব ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন– ট্রেনে করে তিনি যাচ্ছেন। কামরায় তিনি এবং রানু। রানু জানালার পাশে বসে গল্পের বই পড়ছে। বইটা মজার। রানু একটু পর পর খিল-খিল করে হেসে উঠছে। তিনি বইটার নাম পড়তে চেষ্টা করছেন পারছেন না। রানু আড়াল করে রেখেছে। তিনি বললেন, বইটা উঁচু করে ধর তো মা। রানু কঠিন গলায় বলল, না। রানুর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তিন বিস্মিত। রাগ করার মত কথা তো বলেন নি। রানু এমন রাগ করছে কেন? এই সময় কিছু একটা ঘটল। ট্রেন থেমে গেল। ট্রেনের সমস্ত যাত্রিরা হৈ চৈ করতে শুরু করল। হৈ চৈ চিৎকার এবং কান্নাকাটি। তিনি জানালা দিয়ে গলা বের করে কি হয়েছে দেখতে চেষ্টা করছেন। শুধু তাদের কামরায় বাতি আছে। তাদের কামরা ছাড়া পুরো ট্রেন অন্ধকার। তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, রানু কি হয়েছে জানিস? রানু তাঁর কথার জবাব দিচ্ছে না। সে খিল-খিল করে হাসছে এই সময় তার ঘুম ভাঙল। তিনি দেখলেন সত্যি সত্যি হৈ চৈ হচ্ছে। চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ঘরে তিনি একা– রানু নেই। তিনি ডাকলেন- রমিজ রমিজ। কেউ সাড়া দিল না। সাড়া দেবার কথা না। রমিজ রানুকে নিয়ে নাটক দেখতে গিয়েছে। হৈ চৈ কি সেখানেই হচ্ছে?
সুলতান সাহেব একতলায় নামলেন। একতলা থেকে বাড়ির সামনের বাগানে গেলেন। হৈচৈ এবং চিৎকার স্পষ্ট হল। উত্তর দিকের আকাশ লাল হয়ে আছে। কোথাও আগুন লেগেছে। তিনি গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। সামনের রাস্তা দিয়ে কে যেন ছুটে গেল। একটা ক্রাইসিস তৈরী হয়েছে। ক্রাইসিসের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। উত্তেজিত হওয়া যাবে না। তার অসুস্থ মেয়েটা সেখানে আছে। বড় ক্রাইসিস সুস্থ মানুষ একভাবে দেখে অসুস্থ মানুষ একভাবে দেখে। তাকে এখন যা করতে হবে তা 2602- Taking notes is not the most intellectual job in the world. But during crises only thing you can do is taking notes.
এটা কার কথা? মার্ক টোয়েনের? কে যেন ছুটে আসছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি গেট খুলে বাইরে এলেন। যে আসছে তাকে থামাতে হবে। তিনি কড়া গলায় বললেন, কে? কে?
পায়ের শব্দ থেমে গেল। যে এগিয়ে এল তাকে তিনি চেনেন না। তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি না চিনলেও সে নিশ্চয়ই তাঁকে চেনে।
তোমার নাম কি?
আমার নাম বিষ্ণু।
হৈচৈ কিসের?
একটা মাডার হয়েছে।
কে মার্ডার হয়েছে?
বলতে পারব না।
আগুন কিসের?
ইস্কুল ঘরে আগুন লাগাইয়া দিছে।
গণ্ডগোলটা কি নাটকের মাঝখানে শুরু হয়েছে?
নাটক হয় নাই।
আমার মেয়েটাকে দেখেছ? রানু নাম?
উনারে চিনি। জ্বে না উনারে দেখি নাই।
তুমি দৌড়ে যাচ্ছ কোথায়?
শুনতাছি রায়ট হইব। সব হিন্দুবাড়ি জ্বালায়ে দিব।
রায়ট হবার কি আছে? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।
বিষ্ণু ছুটে যাচ্ছে রায়ট হবার সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা অকারণে নির্যাতিত হয়। যে কোন সমস্যার প্রথম বলি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
পূর্বদিকের আকাশ আরো লাল হয়েছে। মনে হয় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সুলতান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন– Taking notes is not the most intellectual job in the world… :
একদল মানুষ দৌড়ে আসছে। তাদের হাতে মশাল না-কি? মশাল মিছিল শহুরে ব্যাপার। গ্রামের মানুষ মশাল পাবে কোথায়? গ্রামের মানুষদের হাতে থাকে টর্চলাইট। সুলতান সাহেব এক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। গুলির শব্দ হল। একবার, দুবার, তিনবার। গাছপালার যত পাখি সব এক সঙ্গে ডেকে উঠল। সুলতান সাহেব চাপা গলায় ডাকলেন রানু, রানু, ও রানু। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন তার পায়ে স্যান্ডেল নেই। তিনি খালি পায়ে দৌড়াচ্ছেন।
.
মওলানা ইস্কান্দার আলি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর কোরাণ শরীফ পাঠ শেষ হয়েছে। তিনি পুরোটা মুখস্থ বলতে পেরেছেন। তাঁকে রেলের উপর রাখা কোরাণ শরীফের পাতায় চোখ বুলাতে হয় নি। তাঁর কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। উত্তেজনায় তাঁর বুক উঠানামা করছে। তার উচিত এই মুহূর্তে শোকরানা নামাজে দাঁড়ানো। কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। মনে হচ্ছে শরীরে কোন জোর নেই। ইস্কান্দার আলি বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। তাঁর চোখ শুকনো কিন্তু তিনি কাঁধে রাখা গামছায় একটু পর পর চোখ মুছছেন। বাইরে প্রচণ্ড হৈ চৈ হচ্ছে, সেই হৈ চৈ-এর কিছুই তার কানে ঢুকছে না। তাঁর মনে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে কোরাণ মজিদ পুরোটা মুখস্থ তিনি বলেছেন, কিন্তু পরে যদি তিনি আর না পারেন। যদি এমন হয় যে নামাজে দাঁড়িয়ে সূরার মাঝামাঝি জায়গায় সব ভুলে যান। তখন কি হবে? হাফেজ নুরুদ্দিন সাহেবের জীবনে এই ঘটনা ঘটেছিল। হাফেজ সাহেবের বাড়ি কুমিল্লার গুণবতী গ্রামে। তিনি ছিলেন হাফেজ ও ক্বারি। অতি সুকণ্ঠ। কোরাণ মজিদ পুরোটা ছিল কণ্ঠস্থ। শুধু নামাজে দাঁড়ালে সব গণ্ডগোল হয়ে যেত। এমনও হয়েছে সূরা ফাতেহার মাঝামাঝি এসে তিনি আটকে গেছেন। এমন ভয়ংকর কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে না তো? ইস্কান্দর আলির পানির পিপাসা হচ্ছে কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনার মত শক্তি তাঁর নেই। অবসাদ, উত্তেজনা আনন্দ এবং ভয়ে তার শরীর যেন কেমন করছে…
.
ছদরুল বেপারী একটা গাছের আড়ালে আছেন। পুরানো জামগাছ। এই গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব। তিনি তার গায়ের শাদা চাদরটা ফেলে দিয়েছেন। অন্ধকারে শাদা রঙ চোখে পড়ে। নিজেকে লুকিয়ে ফেলা এখন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন গণ্ডগোলটা হচ্ছে তাঁর জন্যে। কানা রফিকের দল আসলে তাঁকে খুঁজছে। কাজ উদ্ধারের জন্যে হঠাৎ একটা ঝামেলা তৈরী হয়েছে। নিরীহ একজন মানুষ মারা পড়েছে। ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্ট। গণ্ডগোলটা শুরু হয়েছে এইভাবে- কানা রফিক ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্টকে শার্টের কলার ধরে স্কুলের মাঠ থেকে একটু দূরে এনে বলেছে- তোর ওস্তাদ আসল না ক্যান।
অল্প বয়স্ক ছোকরা অ্যাসিসটেন্ট হয়ত এর উত্তরে অপমানসূচক কিছু বলেছে। কানা রফিককে সুযোগ করে দিয়েছে। কানা রফিক থমথম গলায় বলেছে- শুওরের বাচ্চা দেহি আমারে বাপ তুইল্যা গাইল দেয়। শুওরের বাচ্চারে একটু টিপা দিয়ে দেও দেহি। এই বলে নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে তাকে অন্যদের হাতে দিয়ে উঠে এসেছে। তারপরই স্কুলঘরে আগুন লেগে গেছে। স্কুলঘরে আগুন লাগানোর একটা উদ্দেশ্য ঝামেলা ছড়িয়ে দেয়া। ছদরুল বেপারী পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন গ্রামের চারদিকে পাহারা বসেছে। তিনি তখনই নিজের গা থেকে শাদা চাদর খুলে ফেললেন। আর সময় নেই লুকিয়ে পড়তে হবে। প্রথম থেকেই অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর নিজের দল এই ঝামেলার সঙ্গে যুক্ত। যতই সময় যাচ্ছে তার ধারণা ততই স্পষ্ট হচ্ছে। তাঁর দলের লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কখনোই এক সঙ্গে নেই। কানা রফিকের সঙ্গে কুদ্দুসকে আলাপ করতেও দেখলেন। দুজন একসঙ্গে সিগারেট ধরাল। দাবার খেলা শুরু হয়েছে। খুবই জটিল খেলা। তিনি নিজেই রাজা নিজেই মন্ত্রী। তবে রাজা মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর হাতী-ঘোড়া তার দিকেই ছুটে আসছে। এটা খারাপ না। খেলতে হলে এরকম খেলাই খেলা উচিত।
ছদরুল বেপারী পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পান বের করে মুখে দিলেন। কুদুসের এনে দেয়া কাঁচাসুপারির পানগুলো কাজে লাগছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পান চিবুতে মজা লাগছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট খাওয়া যাবে না। সিগারেটের আগুন দূর থেকে দেখা যাবে।
শুকনো পাতায় মড় মড় শব্দ করে কে যেন আসছে। অন্য সময় হলে ছদরুল বেপারী বলতেন– কে আসে? আজ কিছু বললেন না তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। না ভয় পাবার কিছু নেই। যে আসছে সেই বরং ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বার বার থেমে পড়ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে এখন চেনা যাচ্ছে। সুলতান সাহেবের মেয়ে। ভয়ে মেয়েটার মুখ ছোট হয়ে গেছে। মেয়েটা এখন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটা একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আকাশে সে কি দেখার চেষ্টা করছে? চাঁদ?
ছদরুল বেপারী গলা খাকারি দিলেন। রানু কান্না কান্না গলায় বলল, কে? গাছের ওপাশে কে?
ছদরুল বেপারী গাছের আড়াল থেকে বের হতে হতে বললেন, আমারে তুমি চিনবা না। আমার নাম ছদরু।
রানু বলল, আমি আপনাকে চিনব না কেন? আমি আপনাকে খুব ভাল করে চিনি। আপনার নাম ছদরুল বেপারী। শুনুন আপনি আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আসুন।
ছদরুল বেপারী বললেন, আমি এইখানে থেকে বের হতে পারব না। লোকজন আমারে খুঁজতাছে।
আপনাকে খুঁজছে কেন?
খুন করার জন্যে খুঁজতেছে।
কি আশ্চর্য! কেন?
ছদরুল বেপারী হেসে ফেললেন। এগিয়ে এলেন রানুর কাছে। মেয়েটা বোকার মত খোলা জায়গায় দাঁড়িয়েছে আছে। চাঁদের আলো পড়েছে তার গায়ে। অনেক দূর থেকে দেখা যাবে।
তোমার নাম কি?
আমার নাম রানু।
একটু আগায়ে অন্ধকারে দাঁড়াও।
কেন?
এত কেন কেন করবা না। যা বলতেছি কর।
আপনি এরকম করে কথা বলছেন কেন?
কি রকম করে কথা বলতেছি?
কেমন যেন অন্যরকম করে কথা বলছেন। তবে আপনাকে দেখে আমার ভয় কেটে গেছে। আমি আসলে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। আপনি কি জানেন চার-পাঁচটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
জানি।
পুলিশ কখন আসবে? গণ্ডগোল থামবে না?
আমারে যদি মারতে পারে তাহলে গণ্ডগোল থামবে। তবে আমাকে মারা সহজ না। আমি বিরাট খেলোয়াড়।
ছদরুল বেপারী ভুরু কুঁচকে ফেলল। মেয়েটা না থাকলে তার কোন সমস্যা ছিল না। মেয়েটা তাঁকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েটাকে ফেলে তিনি চলে যেতে পারছেন না। এই সময় আগুনের মত রূপবতী একটা মেয়ের সঙ্গে থাকা খুবই বিপদজনক ব্যাপার।
রানু কিছু বলতে যাচ্ছিল ছদরুল বেপারী হঠাৎ তার মুখ চেপে ধরলেন। মশাল জ্বালিয়ে চার-পাঁচ জন লোক আসছে। এদের দুজনের হাতে বর্শা। রানুর ভয় কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ প্রবল ভয় তাকে অভিভূত করে ফেলল। তার কাছে মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে।
ছদরুল বেপারী ফিসফিস করে বলল, ভয় নাই আমি জীবিত থাকতে তোমার কিছু হবে না। জীবিত কতক্ষণ থাকব এইটা হইল কথা। এরা আমারে খুঁজতেছে। এদের একজন আমার খুব আপন লোক। নাম কুদ্দুস।
রানু বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে চলুন। আমি আপনাকে লুকিয়ে রাখব।
তোমারে তোমার বাড়িতে নিয়া যাব। তবে তোমার বাবা সুলতান সাহেব আমারে জায়গা দিবে না।
অবশ্যই দেবেন। কি বলছেন আপনি?
ছদরুল বেপারী ক্লান্ত গলায় বললেন, দিলে তো ভালই। চল জঙ্গলের ভিতর দিয়া হাঁটি। আস্তে পা ফেলবা যেন শব্দ না হয়।
রানু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমার হাত ধরে নিয়ে যান। আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে।
ছদরুল বেপারী তার দীর্ঘ জীবনে কোন তরুণীকে মা ডাকেন নি হঠাৎ তার কি মনে হল, তিনি বললেন, মা হাতটা ধর। বললাম না আমি জীবিত থাকতে তোমার কোন ভয় নাই। মরে গেলে ভিন্ন কথা। মরে গেলে তুমি চলবা তোমার নিজের দিশায়।
বেশিদূর যাওয়া গেল না। মশাল হাতে দলটা আবার ফিরে আসছে। ছদরুল বেপারী মওলানা ইস্কান্দার আলির বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মেয়েটাকে মওলানার হাতে তুলে দিয়ে তাকে দ্রুত সরে পড়তে হবে। হাতে সময় বেশি নেই।
.
মাহফুজ তার বাড়ির উঠোনের জলচৌকিতে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একজন মৃত মানুষ। সে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। তার সামনে চিত্রা এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে সে চিত্রাকে দেখতে পাচ্ছে না। চিত্রা বলল, অবস্থা খুবই খারাপ। একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছে। আপনি বসে থাকলে তো হবে না। মাহফুজ বলল, আমি কি করব? আমার এখন কি করার আছে?
আপনি বাড়ি থেকে বের হবেন। আপনার নিজের লোক জোগাড় করবেন। আপনি আগাবেন আপনার দল নিয়ে।
দল কোথায় আমার?
একেকটা বাড়ির সামনে দাঁড়াবেন। তাদের ডাকবেন। অবশ্যই তারা বের হবে। আপনাকে এই গ্রামের মানুষ অসম্ভব পছন্দ করে। আপনার ডাক তারা শুনবে।
আমার মাথা ঘুরছে চিত্রা। আমি উঠে দাঁড়িতে পারছি না।
আপনি আপানকে হাত ধরে নিয়ে যাব।
মাহফুজের মাথার ভেতর তার দাদী কথা বলে উঠলেন– ও আবু এই মেয়েটা যেন তোরে ছাইড়া না যায়। অতি অবশ্যই এরে তুই বিবাহ করবি। ঝামেলা মিটলে আইজ রাইতেই। ইস্কান্দার মওলানারে ডাক দিয়া আইন্যা বিবাহ করবি। এইটা তোর উপর আমার হুকুম। ঐ বেকুব আমার কথা শুনতেছস?
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, চুপ কর।
আমার কথা না শুনলে নাই। মেয়েটা কি বলতাছে শোন। হে কোন ভুল কথা বলতাছে না।
মাহফুজ ঘর থেকে বের হল। তার হাতে একগাদা পাটখড়ি। পাটখড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মশাল নিয়ে বের হয়েছে। মাহফুজ ঘর থেকে বের হয়েই চিৎকার করে বলল, কে কোথায় আছেন। আসেন দেখি আমার সাথে। আমি মাহফুজ।
চিত্রা লক্ষ্য করল একজন দুজন করে আসছে। মাহফুজ আবারও চিৎকার করে ডাকল- কই আসেন। ঘরে বসে থেকে লাভ নাই। বের হন।
.
রানু ফিসফিস করে বলল, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ছদরুল বেপারী জবাব দিলেন না। হাসলেন। তাঁর চোখ-কান খোলা, হাঁটছেন কুঁজো হয়ে। তার মন বলছে দূর থেকে তাঁকে কেউ লক্ষ্য করছে। যে লক্ষ্য করছে সে একা বলেই কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে যাচ্ছে তার দল নিয়ে আসতে। রানু মেয়েটাকে অতি দ্রুত মওলানা ইস্কান্দার আলির হাতে তুলে দিয়ে তাকে অন্ধকারে মিশে যেতে হবে। সবচে ভাল হয় পাঞ্জাবী খুলে খালি গা হয়ে গেলে। নগ্ন-গাত্রের মানুষ অন্ধকারে চোখে পড়ে না।
ছদরুল বেপারী বললেন, তুমি দৌড়াতে পারবা?
রানু বলল, আমি হাঁটতেই পারছি না, দৌড়াব কিভাবে?
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যেভাবে যাইতেছ সেভাবেই যাও। ছদরুল বেপারী একটা ব্যাপার ভেবে সামান্য আনন্দ পাচ্ছেন তার হাতে যেমন সময় নেই, যারা তাঁকে খুঁজছে তাদের হাতেও সময় নেই। ঝড়ের প্রথম ঝাপটা পার হয়ে গেছে। সাধারণত প্রথম ধাক্কায় কিছু না হলে পরে আর হয় না। তিনি নিশ্চিত এর মধ্যে তাঁর নিজের জায়গায় খবর চলে গেছে। তার লোকজন ছুটে আসছে। মাহফুজ বের হয়েছে। তিনি তার গলা শুনতে পেয়েছেন। সে লোকজন সংগ্রহ করছে।
তাঁকে দাবা খেলায় আর কিছুক্ষণ টিকে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ টিকতে পারলেই হাতি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত চলে আসবে। তখন তিনি হাতীর চাল দেবেন না, সৈন্যও এগিয়ে দেবেন না। তিনি দেবেন ঘোড়ার চাল। ছদরুল বেপারীর ঘোড়ার চাল কি লোকজন দেখবে। ভুজঙ্গ বাবুর পাটের চেয়ে সেটা খারাপ হবে না। ভাল কথা, তিনি ভুজঙ্গ ব্যাটাকেও ধরে আনাবেন। স্কুলের মাঠে নাটক হবে। ভুজঙ্গকে টিপু সুলতানের পাট করতে হবে। তিনি নিজের হাতে ভুজঙ্গকে সোনার মেডেল পরিয়ে দেবেন। তবে তার আগে ভুজঙ্গকে একশ বার কানে ধরে উঠ-বস করাবেন। ভুজঙ্গ সোনার মেডেলের কথা সবাইকে বলে বেড়াবে কিন্তু কানে ধরে উঠ-বসের কথা কাউকে বলতে পারবে না।
মানুষ তার জীবনের সব ঘটনা বলতে পারে না। কিছু কিছু ঘটনা চেপে যায়। তিনি বলতে পারেন। কারণ তিনি ঠিক মানুষ শ্রেণির না, পশু শ্রেণির। এক সময় তার মা দেওয়ানগঞ্জে ঘর নিয়ে নটি-বেটি হয়েছিলেন এই কথা বলতে তার মুখে আটকায় না। তবে মায়ের উপর তার কোন রাগ নাই। স্বামীর মৃত্যুর পর এই মহিলা দুধের শিশু নিয়ে মরতে বসেছিলেন। কেউ তাকে খাওয়া দেয় নাই। সে শিশু-সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরেছে। দেওয়ান গঞ্জের লোকজন তাঁর কাছে এসেছিল একটা মাদ্রাসা হবে, গার্লস স্কুল হবে তার জন্যে সাহায্য। তিনি সাহায্য করেছেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল বলেন আমার মাকে তোমরা বাজারের নটি-বেটি বানিয়েছিলে। তার শাস্তি হিসেবে দেওয়ানগঞ্জের সবাই মিলে দশ বার কান ধরে উঠ-বোস কর। আমি মাদ্রাসা বানিয়ে দিব, মসজিদ বানায়ে দিব, স্কুল-কলেজ করে দিব। পাকা রাস্তা বানিয়ে দিব। তিনি তা বলেন নাই। তিনি ক্ষমা করেছেন। মাঝে-মধ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মানুষকে ক্ষমা করতে হয়।
রানু বলল, আর কতদূর?
ছদরুল বেপারী বললেন, ঐ তো দেখা যায়। বারান্দায় ইস্কান্দার মওলানা বসে আছে। তুমি কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকে যাবে। ঘরের ভিতর কুপী জ্বলতেছে। ফুঁ দিয়ে কুপী নিভায়ে দিবে। ইস্কান্দার মওলানার সঙ্গে কথা যা বলার আমি বলব।
.
মওলানা ইস্কান্দার আলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ছদরুল বেপারী বললেন, মেয়েটাকে রেখে গেলাম। ঝামেলা মিটলে তাকে পৌঁছায়ে দিবেন। বুঝতে পারতেছেন কি বললাম?
মওলানা ইস্কান্দার বিড়বিড় করে বললেন, জনাব আমার একটা খবর ছিল। আনন্দের খবর।
ছদরুল বেপারী বললেন, খবর শোনার সময় নাই। যা বললাম করবেন।
খুবই বড় একটা সংবাদ জনাব। আমি পাক কোরাণ মুখস্থ করেছি। আমার নাম এখন হাফেজ ইস্কান্দার আলি।
যাই হাফেজ সাহেব।
চাইরদিকে আগুন লাইগা গেছে ব্যাপারটা কি জনাব?
ছদরুল বেপারী ব্যাপার বলার সুযোগ পেলেন না। মওলানা ইস্কান্দারের উঠানে তিনজন এসে দাঁড়াল। তিনজনের একজনের নাম কুদ্দুস। কুদুসের হাতে খোলা পিস্তল। কুদুসের পাশেই কানা রফিক। কানা রফিকের গায়ে হলুদ রঙের চাদর! চাদরে সে মাথা ঢেকে রেখেছে। তার চোখ জ্বল জ্বল করছে। কানা রফিক একদলা থুথু ফেলল। ছদরুল বেপারী শান্ত গলায় বললেন, কুদ্দুস তুমি কি চাও?
কুদ্দুস গলা খাকারি দিল।
কানা রফিক চাপা গলায় বলল, কুদ্দুস দেরী করতেছ কেন? হাতে সময় সংক্ষেপ।
কুদ্দুস পিস্তল উঁচু করে এক পা এগিয়ে আসতেই মওলানা ইস্কান্দার আলি তার সামনে দুহাত তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর্তনাদের মত চেঁচিয়ে উঠলেন– কি করতেছ? কি সর্বনাশ! তোমরা কি করতেছ?
তাঁর চিৎকার ছাপিয়ে পরপর দুবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ হল। দূর থেকে হৈচৈ চিৎকার শোনা যাচ্ছে। মাহফুজ তার বিশাল দল নিয়ে এদিকেই আসছে। তারা গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে।
.
হাফেজ মওলানা ইস্কান্দার আলির উঠান ফাঁকা। তিনি উঠানে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর বুক থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মওলানার পাশেই ছদরুল বেপারী। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। মওলানার ঘরের দরজা ধরে রানু দাঁড়িয়ে আছে। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, উনার কি হয়েছে?
ছদরুল বেপারী দুটা টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে ইস্কান্দার আলির পাশে বসলেন। চাপা গলায় বললেন, মওলানা সাহেব মনে সাহস রাখেন। আমাকে কয়েক ঘন্টা সময় দেন। কয়েক ঘন্টা সময় যদি পাই আমি আপনাকে বাঁচায়ে ফেলব। আমার সমস্ত টাকা-পয়সা একদিকে আর আপনে একদিকে।
মওলানা ইস্কান্দার আলি ফিসফিস করে বললেন, হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহপাক। সব কিছুতেই উনি নির্ধারণ করে রেখেছেন। আপনার আমার করার কিছু নাই।
খুব কষ্ট হইতেছে, পানি খাবেন?
মওলানা না-সূচক মাথা নাড়লেন। কিছুটা সময় তিনিও আল্লাহপাকের কাছে চাচ্ছেন। আরেকবার যেন কোরাণ মজিদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারেন। সেই সময় কি তাঁর মত পাপী-বান্দাকে আল্লাহপাক দেবেন? এত দয়া কি তিনি দেখাবেন? হাফেজ ইস্কান্দার আলি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলেন। সময় নেই, অতি দ্রুত আবৃত্তি করতে হবে। তাঁর সুরমা দেয়া দুই চোখে অশ্রু। চাঁদের আলোয় সেই অশ্রু চিকচিক করছে।