- বইয়ের নামঃ এই মেঘ, রৌদ্রছায়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ভাদ্র মাস
০১.
ভাদ্র মাস।
মেঘ বৃষ্টির কোনো ঠিক নেই। এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। মাহফুজ বিরক্ত মুখে হাঁটছে। তার বাঁ হাতে ভারী একটা স্যুটকেস। এমন ভারী যে মনে হয় স্যুটকেসসহ হাত ছিঁড়ে পড়ে যাবে। ডানহাতে ছাতা। এখন রোদ নেই, সূর্য বড় এক খণ্ড মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সহজে বের হবে না। তারপরও ছাতাটা মাথায় ধরা। মাহফুজ মাঝেমধ্যেই চিন্তিত চোখে ডানহাতের স্যুটকেসের দিকে তাকাচ্ছে। স্যুটকেসের হাতলের অবস্থা সুবিধার না। হাত না ছিড়লেও যে-কোন মুহূর্তে হাতল ছিঁড়ে যেতে পারে। স্যুটকেস এত ভারী কেন তা মাহফুজের মাথায় ঢুকছে না। কাপড়-চোপড়ের বদলে কি সীসা ভরা হয়েছে? মেয়েদের এই সমস্যা তারা যখন স্যুটকেস গোছায় তখন স্যুটকেস ভারী হচ্ছে কিনা হালকা হচ্ছে এইসব মনে থাকে না, কারণ এই স্যুটকেস হাতে নিয়ে তাদের হাঁটতে হয় না। মাহফুজ পেছনে ফিরে সীসাভরা স্যুটকেসের মালিকের দিকে তাকাল। মালিক না– মালেকাইন, উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণী। নাম চিত্রা।
মেয়েটা কেমন গুটগুট করে হাঁটছে। যেন হেঁটে খুব মজা পাচ্ছে। মেয়েটার চেহারা তেমন কিছু না। দশে চার দেয়া যায়। কিন্তু এখন তাকে বেশ ভাল দেখাচ্ছে। গায়ের রং আগের মতো ময়লা লাগছে না। ট্রেন থেকে নেমেই কোনো এক ফাঁকে মুখে পাউডার-ফাউডার দিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। টিউবওয়েলে যখন মুখ ধুতে গেল তখনই মনে হয় কাজটা সেরেছে। চোখে যে কাজল দিয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। ট্রেনে আসার সময় চোখ ছিল ছোট ছোট, এখন এত বড় বড় হবে কেন? বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তো আর, বড় হয় না। আচ্ছা, শাড়িও বদলেছে না-কি? শাড়িটাও তো সুন্দর। সবুজের মধ্যে শাদা ফুল। এই মেয়ে দেখি সাজগোজে ওস্তাদ। এক ফাঁকে মুখে কোনো একটা কারুকাজ করেছে। ওমি খুঁটেকুড়ানি থেকে রাজরাণী।
একটু আগেই আকাশ মেঘলা ছিল এখন আঁ করে রোদ উঠে গেছে। যে মেঘ রোদ ঢেকে রেখেছিল সেও নেই। আকাশ ঘন নীল। ভাদ্রমাসের চিকন রোদ চামড়া ভেদ করে শরীরের রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নেশা হয়ে যায়। কেউ যদি ভাদ্রমাসের রোদে কিছুক্ষণ থাকে সে আর রোদ ছেড়ে আসতে চায় না।
মাহফুজের মাথায় ছাতা। মেয়েটা রোদের মধ্যেই হাঁটছে। ছাতার নিচে আসার জন্যে মাহফুজ তাকে ডাকছে না। আগবাড়িয়ে এত খাতির দেখাবার কিছু নেই। এই টাইপের মেয়েদের খাতির দেখালে বিপদ আছে, প্রথমে কোলে চেপে বসে, কোল থেকে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে মাথায়। একবার মাথায় চড়লে কার সাধ্য মাথা থেকে নামায়। এদের রাখতে হয় শাসনে।
মাহফুজ ভাই!
মাহফুজ বিরক্ত মুখে পেছন ফিরল। তার বিরক্তির প্রধান কারণ মেয়েটার গলার স্বর ভাল না। খসখসা। মেয়েদের গলার স্বর হবে চিকন। চট করে কানের ভেতর ঢুকে যাবে। এই মেয়ের গলার স্বর এমন যে চট করে কানের ভেতর ঢুকবে না। কানের ফুটার কাছে কিছুক্ষণ আটকে থাকবে। তাছাড়া, ভাই ব্রাদার, ডাকার দরকার কী? এত খাতির তো হয় নি। মাহফুজ মেয়েটার উপর রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না।
মেয়েটার হাঁটা সুন্দর। গুটুর গুটুর করে হাঁটছে। শাড়িটা পরেছে ভদ্রভাবে। মাথায় ঘোমটা দেয়ায় বউ-বউ লাগছে। এটা অবশ্যি ঠিক না। যে বউ না, সে কেন বউ সাজবে? সাজ পোশাকের মধ্যে যদি এরকম কোনো ব্যবস্থা থাকত যে সাজ দেখে ধরা যেত কে কী রকম মেয়ে তাহলে ভাল হত। কুমারী মেয়েদের একরকম পোশাক, সধবাদের একরকম পোশাক, খারাপ মেয়েদের একরকম পোশাক। আগে নিয়ম ছিল খারাপ মেয়েরা পায়ে কিছু পরতে পারবে না। তারা সাজসজ্জা সবই করবে শুধু পা থাকবে খালি। পায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে মেয়েটা কোন পদের। আজকাল বোধ হয় এইসব নিয়ম নেই।
মাহফুজ চিত্রার পায়ের দিকে তাকাল। লাল ফিতার স্যান্ডেল পরেছে। আচ্ছা পরুক। এই মেয়ে তো স্যান্ডেল পরতেই পারে। সে নিশ্চয়ই পাড়ার মেয়েদের মতো না। স্যান্ডেল জোড়া মনে হয় নতুন চকচক করছে। কালো মেয়ের পায়ে লাল স্যান্ডেল খুব মানায় তো!
তিয়াস লেগেছে। পানি খাব।
মাহফুজ বিরক্ত গলায় বলল, পথের মধ্যে পানি কই পাব? নৌকায় উঠে নেই। ঘাটলায় যাই, তারপর পানি
ঘাটলা কত দূর?
দূর নাই।
ঘাটলা দূর আছে এখনো প্রায় এক পোয়া মাইল। রিকশা পাওয়া যায়। রিকশায় যাওয়া যেত। স্টেশন থেকে নাও-ঘাটা পাঁচ টাকা ভাড়া। মাহফুজের কাছে টাকা আছে। স্কুল ফান্ডের টাকা। এই টাকা হুটহাট করে খরচ করা যায় না। তাছাড়া রিকসা নিলে দুটা রিকসা নিতে হয়। সে নিশ্চয়ই ঝপ করে এই মেয়ের সঙ্গে এক রিকসায় উঠে পড়তে পারে না।
নৌকায় কতক্ষণ লাগে?
তিন চার ঘন্টা।
এতক্ষণ লাগে?
এতক্ষণ কই দেখলে, নৌকায় পাটি পাতা আছে। শুয়ে ঘুম দিবে। ঘুম ভাঙলে দেখবে সোহাগীর ঘাটে নৌকা বাঁধা।
আপনাদের জায়গাটার নাম সোহাগী?
হু। ছাতাটা একটু ধর তো আমি সিগারেট খাব।
চিত্রা এগিয়ে এসে ছাতা ধরল। চিত্রা মেয়েটার নকল নাম। এই টাইপের মেয়েরা নকল নাম নিয়ে ঘুরেফিরে বেড়ায়। আসল নাম কেউ জানে না। আসল নাম জিজ্ঞেস করলে অন্য একটা নাম বলে সেটাও নকল।