- বইয়ের নামঃ ইরন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১.১ ইরন দীর্ঘসময় থেকে সমুদ্রের তীরে
ইরন দীর্ঘসময় থেকে সমুদ্রের তীরে নির্জন বিস্তৃত বালুবেলায় একাকী বসে আছে। তার মন বিষণ্ণ, বিষণ্ণতার ঠিক কারণটি জানা নেই বলে এক ধরনের অস্থিরতা তার মনকে অশান্ত করে রেখেছে। ইরন অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকায়–একটা ভাঙা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে বের হওয়ার মিথ্যে চেষ্টা করে আবার মেঘের আড়াল হয়ে গেল। মেঘে ঢাকা চাঁদের কোমল আলোতে চোখের রেটিনায় বর্ণ অসংবেদী রড–গুলো কাজ করছে–তাই চারদিক আবছা এবং ধূসর। মধ্যরাত্রিতে নির্জন বালুবেলায় সামনের বিস্তৃত নিস্তরঙ্গ সমুদ্রটিকে একটি অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য বলে মনে হয়। ইরনের পিছনে দীর্ঘ ঝাউগাছ, সমুদ্রের নোনা ভেজা হাওয়ায় সেগুলো দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করছে। হাহাকারের মতো সেই শব্দ শুনলেই বুকের মাঝে বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করে।
ইরন তার বুকের মাঝে দুর্বোধ্য সেই শূন্যতা নিয়ে নিজের হাঁটুর উপর মাথা রেখে নিঃশব্দে বসে থাকে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে সে বড় নিঃসঙ্গ এবং একাকী। তার বুকের ভিতরে যে বিষণ্ণতা তার সাথে সে পরিচিত নয়, যে হতাশা তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।
অথচ এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। ইরন সুদর্শন, সুস্থ, সবল, নীরোগ একজন পুরুষ, তার বয়স মাত্র সাতাশ, এরকম বয়সে একজন মানুষ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর প্রথমবার সত্যিকার জীবনে প্রবেশ করে। নিজে দায়িত্ব বুঝে নেয়, নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করে, আশপাশে অন্য মানুষেরা তার চিন্তা–ভাবনা–সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। ইরন মেধাবী এবং পরিশ্রমী মানুষ ছিল। তার ভিতরে তীক্ষ্ণ এক ধরনের সৃজনশীলতা ছিল, জীবনকে ভালবাসার ক্ষমতা ছিল, উপভোগ করার আগ্রহ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা তার ভিতরে সহজাত নেতৃত্বের একটা ক্ষমতা ছিল। তার সাতাশ বছর বয়সে সে সত্যিকারের সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে কেমন জানি সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। এক বছরের মাথায় তার যা–কিছু অর্জন সবকিছু যেন ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা হয়ে তার কাছে ফিরে এল। সে কিছুতেই হিসাবটি মিলাতে পারে না, কেন তার ভাগ্য হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পণ করে ফেলেছে, প্রতিটি পদক্ষেপ হঠাৎ করে ভুল হতে শুরু করেছে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছেলেমানুষি হাস্যকর ব্যর্থতা হয়ে তাকে উপহাস করতে শুরু করেছে। ইরন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে তার ভিতরে সেই একাগ্র জীবনীশক্তি নেই, সেখানে কেমন যেন খাপছাড়া শূন্যতা। আনন্দ নেই, ভালবাসা নেই, স্বপ্ন নেই, সাহস নেই। শুধু এক ধরনের অসহায় বিষণ্ণতা।
রাতের আকাশে হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে একটা রাতজাগা পাখি কর্কশ স্বরে শব্দ করে উড়ে গেল–এমন কিছু ভয়াবহ শব্দ নয় কিন্তু ইরন হঠাৎ করে চমকে ওঠে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, সমুদ্রের নোনা শীতল বাতাস ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু করে দিয়েছে, বাসায় ফিরে যাওয়া দরকার। নিজের বাসার কথা মনে করে ইরন আবার একটি লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ঠিক কী কারণ সে জানে না, তার আজকাল বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে করে না। দীর্ঘ রাত সে শহরতলির পথে–ঘাটে হেঁটে হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করে তবু বাসায় ফিরে যায় না। আজ অবশ্য সে বাসায় ফিরে যাবে। আজ তার সাতাশতম জন্মবার্ষিকী–হয়তো কেউ সেটা স্মরণ করে তার কাছে একটা শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। হয়তো কোনো পুরোনো বন্ধু বা বান্ধবী তার জন্য ভালবাসার কথা বলে গেছে, হয়তো সেটা দেখে আজ কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার মন ভালো হয়ে যাবে।
কিন্তু বাসায় ফিরে ইরনের মন ভালো হয়ে গেল না–বরং নতুন করে আবার বিচিত্র এক ধরনের বিষণ্ণতা এসে তাকে গ্রাস করল। তার কোনো পুরোনো বন্ধু বা বান্ধবী তাকে স্মরণ করে কোনো শুভেচ্ছা রেখে যায় নি। আকাশের কাছাকাছি ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টের স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিচে বহু দূরে শহরে জীবনের চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ইরন বুঝতে পারল তাকে কী করতে হবে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলল, কী আশ্চর্য আমি এটা বুঝতে এত দেরি করলাম!
ইরন স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালাটির দিকে তাকাল–চারপাশে কয়েকটি সাধারণ ক্রোমিয়াম স্ন্যাপার দিয়ে আটকানো– মাঝারি আকারের একটা স্কু ড্রাইভার হলেই সে জানালাটি খুলে নিতে পারবে। তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে সে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এক কিলোমিটার উঁচু এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিচে পড়তে তার প্রায় পনের সেকেন্ড সময় নেবে, পনের সেকেন্ডে তার বেগ হওয়ার কথা ঘণ্টায় প্রায় চার শ কিলোমিটার–কিন্তু বাতাসের বাধার জন্য সেটা তার অর্ধেকে গিয়ে থেমে যাবে। ঘণ্টায় দু শ কিলোমিটার বেগে সে যখন নিচের শক্ত কংক্রিটে আঘাত করবে তখন তার মৃত্য হবে। তাৎক্ষণিক। তার সকল হতাশা, বিষণ্ণতা এবং যন্ত্রণার অবসানও হবে তাৎক্ষণিক। ব্যাপারটি চিন্তা করে অনেকদিন পর হঠাৎ ইরন নিজের ভিতরে এক ধরনের উল্লাস অনুভব করে।
ইরন ঘরের ভিতর ফিরে এল, খাবারের কাবার্ড থেকে সে একটা পানীয়ের বোতল বের। করে তার বিছানায় বসে। নিজেকে শেষ করে দেবে সিদ্ধান্তটি নেবার পর সবকিছুকেই হঠাৎ করে খুব সহজ মনে হচ্ছে–কাজটি এই মুহূর্তে করা আর কয়েক ঘণ্টা পরে করার মাঝে সত্যিকার অর্থে কোনো পার্থক্য নেই।
ইরন তার অগোছালো বিছানায় পা তুলে বসে হাতের পানীয়ের বোতলটি থেকে এক ঢোক তরল গলায় ঢেলে নেয়। উত্তেজক বিতানীন মিশ্রিত পানীয়, হঠাৎ করে তার সারা শরীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
ইরন হাত বাড়িয়ে যোগাযোগ মডিউলের টিউবটি স্পর্শ করতেই ঘরের ঠিক মাঝখানে পৃথিবীর সাদামাঠা মানুষের জন্য তৈরি হালকা আনন্দের একটি নাচ–গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। অনুষ্ঠানটি স্বরুচির মানুষদের জন্য তৈরি, ইরন কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেখতে পারল না। বিতানীন মিশ্রিত পানীয়টি পুরো বোতল শেষ করার আগে সে এই অনুষ্ঠানটি দেখতে পারবে বলে মনে হয় না। টিউব স্পর্শ করে সে চ্যানেল পাল্টাতে থাকে, প্রকৃতির ওপর একটি অনুষ্ঠান, ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি থেকে ঘুরে আসা মহাকাশযানের কৃত্রিম ভ্রমণবৃত্তান্ত, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে মানুষের খাবারের জন্য তৈরি কৃত্রিম এক ধরনের প্রাণীর বিজ্ঞাপন, কিরি কম্পিউটারের কম্পোজ করা সঙ্গীত, দশ হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎদণ্ড দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করার এক ধরনের নির্বোধ খেলা–এই ধরনের কিছু অনুষ্ঠানে চোখ বুলিয়ে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ঘরের মাঝে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিতে মধ্যবয়সী একজন মহিলাকে দেখতে পেল। মহিলাটি সোজা ইরনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বিষণ্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত? তুমি কি নৈরাশ্যবাদী এবং যন্ত্রণাকাতর? তুমি কি তোমার নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছ? যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে তা হলে সব শেষ করে দেবার আগে আমাদের সাথে যোগাযোগ কর। মাত্র অল্প কিছু ইউনিটের বিনিময়ে আমরা হয়তো তোমার জীবন রক্ষা করতে পারব।
হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের মহিলাটি তার চোখে–মুখে এক ধরনের ব্যাকুলতার ভাব ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নতুন কিরি কম্পিউটারে তৈরি এ ধরনের অনেক প্রোগ্রাম মানুষের বিনোদনের জন্য তৈরি হয়েছে। টুরিন টেস্টে উত্তীর্ণ এই ধরনের কৌশলী প্রোগ্রাম দীর্ঘ সময় মানুষের সাথে কথা বলে যেতে পারে, বুদ্ধিবৃত্তির একেবারে নিচের দিকের মানুষেরা এদের। সাথে কথা বলে এক ধরনের তৃপ্তি পায় বলে জানা গেছে। ইরন কখনোই এ ধরনের প্রোগ্রামের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে নি, আজ হঠাৎ করে কৌতূহলী হয়ে সে প্রোগ্রামটি চালু করল। তার ব্যাংক থেকে ইউনিট স্থানান্তর করার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল এবং তারপর হঠাৎ করে মনে হল তার ঘরের ঠিক মাঝখানে মধ্যবয়সী একজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মহিলাটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে তৈরি একজন কৃত্রিম মানুষের প্রতিচ্ছবি জানার পরও একজন সত্যিকার মানুষ বলে ইরনের ভুল হতে থাকে। মহিলাটি তার। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, তোমার ঘরটি দেখে মনে হচ্ছে একটা ছোটখাটো বিপর্যয় ঘটে গেছে।
ইরন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ
মহিলাটির পিছনে একটা চেয়ার, সেটাও কৃত্রিম। মহিলাটি চেয়ারটির কাছে গিয়ে বলল, বসতে পারি?
হ্যাঁ, বস।
কাজের কথায় চলে আসা যাক, কী বল?
ইরন এক ধরনের কৌতুক অনুভব করে, সে আরো এক ঢোক পানীয় খেয়ে বলল, তুমি তো আসলে সত্যিকারের মানুষ নও–কাজেই তোমার সাথে যদি ভদ্রতাসূচক কথাবার্তা না বলি তুমি কিছু মনে করবে না তো?
ইরনের স্পষ্ট মনে হল তার এই রূঢ় কথাটিতে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের মহিলাটি একটু আহত হয়েছে। মহিলাটি অবশ্য সহজেই নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় বলল, না, আমি কিছু মনে করব না। তবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি–তুমি যদি খোলামেলাভাবে আমার সাথে কথা বল হয়তো সত্যিই তোমাকে সাহায্য করতে পারব।
মনে হয় না। ইরন সোজা হয়ে বসে বলল, তোমাদের তৈরি করা হয়েছে হালকা আমোদর জন্য
না, ইরন। মহিলার মুখে নিজের নাম শুনে ইরন একটু চমকে ওঠে কিন্তু মহিলাটি সেটা ঠিক লক্ষ করল না, মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল, আমি এখানে আসার আগে তোমার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিয়ে এসেছি। তথ্যকেন্দ্রে যেসব তথ্য আছে সেটা থেকে মনে হচ্ছে তুমি সত্যি সত্যি এক–দুই দিনের মাঝে আত্মহত্যা করবে। আমি সত্যিই তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আমি সত্যিকারের মানুষ না হতে পারি, কিন্তু আমি সত্যিকারের সাহায্য করতে পারি।
আমার সম্পর্কে তোমার কী কী তথ্য আছে?
আমরা জানি কিছুদিন আগেও তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলে। ওয়ার্মহোল রিসার্চে তোমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আছে। ওয়ার্মহোল তৈরির ব্যাপারে তোমার কিছু নিজস্ব ধারণা আছে–
এবং সেই ধারণা কাজে লাগাতে গিয়ে আমি পৃথিবীর সামনে নিজেকে গর্দভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি।
মহিলাটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ব্যবহারিক বিজ্ঞানের পরীক্ষাতে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে।
দুর্ঘটনা? তুমি এটাকে দুর্ঘটনা বলছ? একটা শহরের আধখানা উড়ে যাওয়া দুর্ঘটনা?
নিশ্চয়ই দুর্ঘটনা।
পর পর তিনবার একই দুর্ঘটনা!
মহিলাটি একটু নড়েচড়ে বলল, হ্যাঁ, পর পর একই ধরনের তিনটি দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু
কিন্তু কী?
মানুষের জীবনে খুব কম সম্ভাবনার ঘটনা তো ঘটে। তুমি নিশ্চয়ই জান যে একজন মানুষের মাথায় দুবার বজ্রপাত হয়েছিল।
ইরন মাথা নাড়ল, না, জানি না। কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। সেই হতভাগা মানুষের জীবনে কী হয়েছিল কে জানে! কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি তার আমার মতো অবস্থা হয় নি। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই, কথা বলার লোক নেই, একাকী উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি
মহিলাটি বাধা দিয়ে বলল, এটাই জীবন। এটাই মানুষের জীবন। কখনো আনন্দ, কখনো বেদনা, কখনো সুখ, কখনো।
ইরন হঠাৎ তার বিছানায় সোজা হয়ে বসে তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, চুপ কর। চুপ কর তুমি।
মহিলাটি বিভ্রান্তের মতো বলল, চুপ করব?
হ্যাঁ। তুমি মানুষের জীবনের কী জান? কিছুই জান না। তার কষ্টের কথা যন্ত্রণার কথা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই! তুমি একটা তৃতীয় শ্রেণীর প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছুই না ইরন চিৎকার করে বলল, তুমি আমাকে জীবন সম্পর্কে বক্তৃতা শোনাতে এসো না।
মহিলাটি আহত মুখে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার জীবনের কষ্ট, হতাশা আর যন্ত্রণার কথা নিয়ে আমার সাথে কথা বলবে। আমি তো নিজে থেকে আসি নি। তুমি আমাকে ডেকে এনেছ।
ইরন উত্তেজিত গলায় বলল, হ্যাঁ। তোমাকে আমি ডেকে এনেছিলাম, এখন আমিই তোমাকে বিদায় করে দিচ্ছি। তুমি দূর হও এখান থেকে।
মহিলাটি তুমি ধরনের বিস্ময় নিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তোমার কমিউনিকেশান্স মডিউলের টিউবে স্পর্শ করলেই আমি চলে যাব ইরন। আমি নিজে থেকে যেতে পারি না।
বেশ, তা হলে আমি তোমাকে সেভাবেই বিদায় করছি। ইরন টিউবটি স্পর্শ করতে হাতটি এগিয়ে দিতেই মহিলাটি স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, দাঁড়াও, ইরন।
কী?
তুমি কি সত্যিই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
হ্যাঁ।
তুমি কোনোভাবে তোমার মত পাল্টাবে না?
না।
তা হলে
তা হলে কী?
তা হলে তুমি তোমার আত্মহত্যাকে আরো একটু অর্থবহ কর না কেন? সম্পূর্ণ অকারণে নিজেকে মেরে ফেলে কী লাভ? তুমি যদি–
আমি যদি–
তুমি যদি একটা খুব বিপজ্জনক প্রজেক্টে অংশ নাও, যেখানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী–সেটি কি একটা মহৎ কাজ হয় না?
ইরন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
মনে কর প্রজেক্ট আপসিলনের কথা। এই প্রজেক্ট মানবসভ্যতার একটা নতুন দ্বার খুলে দেবে। অথচ এর মতো বিপজ্জনক প্রজেক্ট কখনো প্রস্তুত হয় নি। কারো বেঁচে আসার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য তিন। আত্মহত্যা না করে তুমি যদি এই প্রজেক্টে যোগ দাও।
ইরন আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পানীয়ের বোতলটি মহিলার উদ্দেশে ছুঁড়ে মারল। হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবির ভিতর দিয়ে বোতলটি ছুটে গিয়ে দেয়ালে আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ল। ইরন চিৎকার করে বলল, বেরিয়ে যাও তুমি, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। মানুষের প্রাণ নিয়ে তুমি ব্যবসা করতে এসেছ?
মহিলাটি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার চেহারায় এক ধরনের ভয়ের ছাপ পড়ল, সে আতঙ্কিত হয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আমি যদি তোমাকে ধরতে পারতাম, গলা টিপে খুন করে ফেলতাম।
কিন্তু তুমি তো ধরতে পারবে না। আমি–আমি তো সত্যি নই। আমাকে তো ধরা ছোঁয়া যায় না।
জানি। তোমাকে ধরা–ছোঁয়া যায় না। কিন্তু তুমি মানুষ মারা প্রজেক্টের জন্য লোক ধরে নিতে এসেছ? বেছে বেছে খোঁজ করছ আমার মতো মানুষদের!
মহিলাটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইরন তার আগেই কমিউনিকেশান্স মডিউলের টিউব স্পর্শ করে মহিলাটিকে অদৃশ্য করে দিল। ঘরের ভিতর হঠাৎ করে তার অবিন্যস্ত মন খারাপ–করা শোয়ার ঘরটি ফিরে আসে। দেয়ালে পানীয়ের লাল ছোপ, মেঝেতে ভাঙা বোতলের কাঁচ ছড়ানো। ইরন সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হেসে উঠল, কী আশ্চর্য, সে একটা কৌশলী প্রোগ্রামের সাথে রাগারাগি করছে। কেমন করে সে এরকম হাস্যকর ব্যবহার করতে পারল?
ইরন কোয়ার্টজের জানালার দিকে তাকাল, একটা বড় ভ্রু ড্রাইভার এনে ক্রোমিয়ামের স্ন্যাপারগুলো খুলে সে এখনই জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়তে পারে কিন্তু হঠাৎ করে তার কেমন জানি ক্লান্তি লাগতে থাকে। কিছু না করার ক্লান্তি। অবসাদের ক্লান্তি। সে শ্রান্ত পায়ে নিজেকে টেনে এনে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
বিছানায় মাথা স্পর্শ করার সাথে সাথেই কিছু বোঝার আগেই ইরন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে।
১.২ খুব ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে
খুব ভোরে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে প্রথম যে কথাটি ইরনের মাথার মাঝে খেলা করে গেল সেটি হচ্ছে প্রজেক্ট আপসিলন। কাল রাতে একটি নিম্নস্তরের কম্পিউটার প্রোগ্রাম তাকে এই বিপজ্জনক প্রজেক্টে জুড়ে দেবার চেষ্টা করছিল। ইরন বিছানায় উঠে বসে এবং খানিকটা চেষ্টা করেও মাথা থেকে প্রজেক্টের নামটি সরাতে পারে না। কুৎসিত বিকৃত কিছু দেখলে মানুষ যেরকম বিতৃষ্ণা নিয়েও তার থেকে চোখ সরাতে পারে না এটাও অনেকটা সেরকম। ইরন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কমিউনিকেশান্স মডিউলটি নিজের কাছে টেনে এনে সেটি চালু করল। নীলাভ স্ক্রিনে মডিউলের পরিচিত চিহ্নটি ফুটে উঠতেই ইরন নিচু গলায় বলল, তথ্য অনুসন্ধান।
কমিউনিকেশান্স মডিউল তার যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত হয়ে নেয়। ইরন আবার নিচু গলায় বলল, প্রজেক্ট আপসিলন।
কমিউনিকেশান্স মডিউলের যত দ্রুত তথ্য নিয়ে আসার কথা তার থেকে কয়েক সেকেন্ড বেশি সময় লেগে যায়। নীলাভ স্ক্রিনে প্রজেক্ট আপসিলনের সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ ত্রিমাত্রিক ভিডিও ক্লিপে ফুটে ওঠে। ইরন ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কারণ সেখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো তথ্যই নেই। ইরন নিচু গলায় বলল, পরবর্তী পর্যায়ের তথ্য।
সাথে সাথে প্রথমে স্ক্রিনটি বর্ণহীন হয়ে যায়, পর মুহূর্তে উজ্জ্বল কমলা রঙে নিষিদ্ধ তথ্য প্রতীকচিহ্নটি ফুটে ওঠে এবং সাথে সাথে যান্ত্রিক গলায় উচ্চারিত হয়, প্রজেক্ট আপসিলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য সংরক্ষিত। এটি সর্বসাধারণের মাঝে প্রচারের জন্য নয়।
ইরন ভুরু কুঁচকে স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যখন বিজ্ঞান গবেষণাগারে বড় একটি দল নিয়ে ওয়ার্মহোলের ওপর গবেষণা করছিল তখন পৃথিবীর যে কোনো তথ্য তার জন্য উনাক্ত ছিল, এক বছরের মাঝে সে নিচুস্তরের একটি প্রজেক্ট সম্পর্কে তুচ্ছ খানিকটা তথ্যও জানতে পারবে না ইরন কমিউনিকেশান্স মডিউলে গিয়ে চোখের রেটিনা স্ক্যান করিয়ে নিয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতেই হঠাৎ করে প্রজেক্ট আপসিলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তথ্য আসতে শুরু করে। মূল তথ্য কেন্দ্র এখন তাকে পুরোপুরি আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি।
প্রজেক্ট আপসিলন একটি মহাকাশ অভিযান। নতুন একটি জ্বালানি এবং মহাকাশযানের। একটি নতুন নকশা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হবে। মহাকাশযানটি সৌরজগৎ থেকে। বের হয়ে আবার ফিরে আসবে, এর গতিবেগ হবে আলোর গতিবেগের এক–দশমাংশ, ত্বরণ হবে অস্বাভাবিক। এই প্রচণ্ড তুরণে মানুষের দেহকে রক্ষা করার একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা চালানো হবে, পরীক্ষাটির বিপদসূচক সংখ্যা খুব বেশি। সে কারণে যারা জেনেশুনে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে চায় সেরকম অভিযাত্রী খোঁজা হচ্ছে। প্রজেক্ট আপসিলনে যোগ। দিতে চাইলে কোথায় এবং কবে যোগাযোগ করতে হবে সেটিও জানিয়ে দেওয়া আছে।
ইরন খানিকক্ষণ ঠিকানাটির দিকে তাকিয়ে থেকে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। আকাশের কাছাকাছি একটি অ্যাপার্টমেন্টের উপর থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে একটি বিপজ্জনক মহাকাশযানে সৌরজগৎ পাড়ি দেওয়া তার কাছে মোটেও বেশি আকর্ষণীয় মনে হল না।
কাজেই সেদিন অপরাহ্নে ইরন যখন প্রজেক্ট আপসিলনের নিয়োগ কেন্দ্রে একজন সুন্দরী তরুণীর সামনে নিজেকে আবিষ্কার করল সে নিজের ওপর নিজেই একটু অবাক না হয়ে পারল না। সুন্দরী তরুণটি অত্যন্ত সপ্রতিভ, ইরনকে তার নরম চেয়ারে বসিয়ে সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ইরন, তুমি কেন এই প্রজেক্টে যোগ দিতে চাও?
ইরন দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি আসলে চাই না।
মেয়েটি হেসে ফেলল, তা হলে তুমি কেন এখানে এসেছ?
আমি এখনো জানি না। আমার ওপর দিয়ে ভাগ্য এমন সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়েছে যে কিছুতেই কিছু আসে–যায় না।
তুমি তো জান এই প্রজেক্টের বিপদসূচক সংখ্যাটি অনেক উপরে।
জানি।
আমাদের রেকর্ড বলছে তুমি হতাশাগ্রস্ত একজন বিজ্ঞানী–তুমি কি আত্মহত্যার বিকল্প হিসেবে এটা বেছে নিয়েছ?
যদি বলি হ্যাঁ।
তা হলে তোমাকে আমরা নেব না।
কেন নয়?
আমরা চাই প্রজেক্টটি সফল হোক। হতাশাগ্রস্ত মানুষদের দিয়ে কোনো প্রজেক্ট সফল হয় না।
তা হলে তোমরা আমাকে নেবে না?
সুন্দরী মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, না।
ইরন সোজা হয়ে বসে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি এই প্রজেক্টে যেতে চাই।
কেন?
কারণ–কারণ– ইরন একটু ছটফট করে বলল, এই প্রজেক্টে যারা আসবে সবাই। নিশ্চয়ই আমার মতো। পৃথিবীর কোনো মানুষ আমাকে বুঝতে পারে না, কিন্তু এই প্রজেক্টের অভিযাত্রীরা আমাকে বুঝবে। আমিও তাদের বুঝব। আমরা একজন অন্যজনকে হতাশার। গহ্বর থেকে টেনে তুলব।
সুন্দরী মেয়েটি নরম চোখে খানিকক্ষণ ইরনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ। আমি তোমাকে মনোনয়ন দিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো আমি একজন সাধারণ মনোবিজ্ঞানী। আমি শুধুমাত্র প্রাথমিক মনোনয়ন দিই। তোমাকে এরপর সত্যিকারের পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাঝে দিয়ে যেতে হবে, শুধু তারপর ঠিক করা হবে তোমাকে এই প্রজেক্টে নেওয়া যায় কি না।
ইরন হঠাৎ হেসে ফেলল, বলল, আত্মহত্যা করার জন্য এত ঝামেলা করতে হয় কে জানত!
মেয়েটি ইরনের দিকে কোমল চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। ইরন বলল, তুমি একটি জিনিস জান?
কী?
আমি আজ অনেকদিন পর হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলে গিয়েছিলাম।
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে ইরনের কাধ স্পর্শ করে বলল, তুমি আবার হাসবে ইরন। আমি নিশ্চিত আবার তোমার জীবনে আনন্দ ফিরে আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।
.
পরের কয়েকদিন ইরন খুব ব্যস্ততার মাঝে কাটাল। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে তার শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষকে পরীক্ষা করে দেখা হল, বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেওয়া হল, মানসিক ভারসাম্যের সূচক বের করা হল, জরুরি অবস্থায় তার ধীশক্তির পরিমাপ করা হল। রক্তচাপ, মেটাবলিজম, নিউরন বিক্রিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে রেটিনার সংবেদনশীলতা পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখা হল।
চতুর্থ দিনে গম্ভীর ধরনের মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ ইরনের হাতে ছোট এক টুকরো ক্রিস্টাল ডিস্ক তুলে দিয়ে বলল, তোমাকে প্রজেক্ট আপসিলনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
ইরন ক্রিস্টাল ডিস্কটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান আমি অনেকদিন পর একটি কাজে সফল হলাম!
গম্ভীর মানুষটি কোনো কথা না বলে স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন চোখ মটকে বলল, তবে আত্মহত্যা করতে যাবার প্রতিযোগিতায় সফল হওয়াটাকে কি সাফল্য বলা যায়?
গম্ভীর মানুষটি এবারেও কোনো কথা বলল না, ইরন আবার বলল, তোমার কি মনে হয় না আমি মানুষটা আসলেই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যবান? গত এক বছর প্রত্যেকটা কাজে ব্যর্থ হয়েছি–একমাত্র কাজে সাফল্য পেয়েছি আর সেটি হচ্ছে একটি ডাহা মারা যাবার টিকিট!
ইরন হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে, গম্ভীর ধরনের মানুষটি ইরনের কথায় কোনো কৌতুক খুঁজে পায় না, একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ করে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নখ পরীক্ষা করতে শুরু করে।
ইরন হাসি থামিয়ে বলল, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
হ্যাঁ, পার। তবে আমি যেটুকু জানি তার সবই ক্রিস্টাল ডিস্কে আছে।
তবু তোমাকেই জিজ্ঞেস করি।
বেশ।
এই প্রজেক্টে কি কোনো রোবট থাকবে?
গম্ভীর ধরনের মানুষটি ভুরু কুঁচকে ইরনের দিকে তাকাল, তাতে কী আসে–যায়?
কিছু আসে–যায় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে রোবট পছন্দ করি না।
তুমি যদি এই কথাটি আগে বলতে সম্ভবত তোমাকে এই প্রজেক্টে নেওয়া হত না।
ইরন চোখ মটকে বলল, সেই জন্য আগে বলি নি।
তুমি কেন রোবটদের পছন্দ কর না? নবম প্রজন্মের রোবটের বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত তোমার কিংবা আমার থেকে বেশি।
সেটাও একটা কারণ।
একটা শক্তিশালী ঘোড়ার জোর তোমার থেকে অনেক বেশি। সেজন্যে তুমি কি ঘোড়াকে অপছন্দ কর?
ইরন বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তুমি খুব খারাপ একটা উদাহরণ বেছে নিয়েছ। আমার বয়স যখন এগার তখন আমি একবার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আমি ঘোড়াকে দুই চোখে দেখতে পারি না।
গম্ভীর ধরনের মানুষটি এই প্রথমবার একটু হাসল। হাসলে যে কোনো মানুষকে সুন্দর দেখায় এবং ইরন প্রথমবার আবিষ্কার করল, মানুষটি সুদর্শন। সে হাসিমুখেই বলল, ঘোড়াকে অপছন্দ করার কারণ থাকতে পারে কিন্তু রোবটকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই। তাদের তৈরি করা হয় মানুষকে সাহায্য করার জন্য।
ইরন মাথা নাড়ল, কিন্তু মানুষ থেকে বুদ্ধিমান একটা বস্তু মানুষের পাশে পাশে বোকার ভান করে থাকছে
রোবট কখনো বোকার ভান করে না।
করে। মানুষকে সরিয়ে নিজেরা যে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে না সেটা হচ্ছে। ভান। তারা ইচ্ছা করলেই পারে।
কিন্তু তারা তৈরি হয়ে আছে সেভাবে, তাদেরকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে তারা কখনোই মানুষের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করবে না। কিন্তু মহাকাশযানে–যেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, প্রয়োজন হলেই রোবট মানুষের নেতৃত্বকে অপসারণ করে ফেলবে।
গম্ভীর ধরনের সুদর্শন মানুষটি হেসে বলল, এটি তোমার একটা অমূলক সন্দেহ। তুমি নিশ্চয়ই নবম প্রজাতির সর্বশেষ রোবটগুলো দেখ নি। সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে মানুষ থেকে ভালো। বুদ্ধিমান, কৌতূহলী এবং সহানুভূতিসম্পন্ন। যে কোনো মানুষ থেকে তাদের রসবোধ অনেকে বেশি তীক্ষ্ণ।
ইরন আবার মাথা নাড়ল, বলল, তাতে কিছু আসে–যায় না। একটি রোবট সবসময়েই রোবট।
মানুষটি কোনো কথা না বলে স্থির চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন বলল, তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি। প্রজেক্ট আপসিলনে কি কোনো রোবট থাকবে?
আমার জানা নেই। তবে
তবে?
তবে না থাকার সম্ভাবনা বেশি। এই প্রজেক্টে মানুষের ওপর পরীক্ষা করার কথা।
চমৎকার। আশা করছি তোমার কথা যেন সত্যি হয়। না হয়—
না হয় কী?
না, কিছু না। ইরন আপন মনে বলল, আমি রোবটকে খুব অপছন্দ করি। ব্যাপারটা প্রায় ঘৃণার কাছাকাছি।
সুদর্শন মানুষটি এবারে একটু অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল।
১.৩ বড় হলঘরের দরজা খুলে
বড় হলঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে ইরন তার বুকের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে–এই ঘরটিতে প্রজেক্ট আপসিলনের অন্যান্য অভিযাত্রীদের থাকার কথা। ঘরটি বড়, উঁচু ছাদ, অর্ধস্বচ্ছ দেয়াল এবং বিশাল কোয়ার্টজের জানালা। জানালা দিয়ে বাইরে যে নীল হ্রদ, তুষার ঢাকা পর্বতশ্রেণী এবং পাইন গাছের সারি দেখা যাচ্ছে সেগুলো নিঃসন্দেহে কৃত্রিম একটি ছবি, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি বোঝার উপায় নেই। কিছু একটাকে যদি এত জীবন্ত মনে হয় তা হলে সেটা কৃত্রিম হলেই কি কিছু আসে–যায়? ঘরের মাঝামাঝি কালো গ্রানাইটের মসৃণ টেবিল এবং সেই টেবিলকে ঘিরে বেশ কিছু সুদৃশ্য চেয়ার। টেবিলের দুপাশের দুটি চেয়ারের একটিতে একজন সুদর্শন সপ্রতিভ যুবক এবং অন্যটিতে কোমল চেহারার একজন তরুণী বসে আছে। জানালার কাছে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, মানুষটির সোনালি চুল তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য নিয়ে এসেছে। মানুষটির আকাশের মতো নীল চোখ কিন্তু সেই চোখেও এক ধরনের আনন্দহীন দৃষ্টি।
ইরন দরজা খুলে ঢুকতেই ঘরের তিন জন তার দিকে মাথা ঘুরে তাকাল। ইরন জোর করে মুখে একটা স্বচ্ছন্দ ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই প্রজেক্ট আপসিলনের সদস্য।
সুদর্শন তরুণ এবং কোমল চেহারার মেয়েটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, যা। ক্রিস্টাল ডিস্কের তথ্য অনুযায়ী এখানে অবশ্য আরো এক জনের আসার কথা।
ইরন হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি এসে বলল, সে নিশ্চয়ই এসে যাবে।
কেউ কোনো কথা বলল না, ইরন একটা নরম চেয়ারে গা ডুবিয়ে বসে বলল, আমি তোমাদের কথা জানি না, কিন্তু আমার খুব কৌতূহল ছিল তোমাদের দেখার।
সোনালি চুলের মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন?
কারণ প্রজেক্ট আপসিলনে যারা যাবে তাদের সবার মাঝে এক ধরনের মিল থাকার কথা।
সোনালি চুলের মানুষটি হঠাৎ এক ধরনের আনন্দহীন হাসি হাসতে শুরু করে। ইরন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমি কি হাসির কোনো কথা বলেছি?
সেটা নির্ভর করবে একজনের রসবোধের ওপর।
তোমার রসবোধ খুব তীক্ষ্ণ?
না। উল্টোটা, আমার রসবোধ নেই।
তা হলে?
তুমি বলছ আমাদের সবার মাঝে এক ধরনের মিল রয়েছে। মিলটি কী জান?
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
আমি বলতে চাইছি যে মিলটি হচ্ছে আমরা সবাই আগামী ছিয়ানব্বই ঘণ্টার মাঝে মারা যাব।
ইরন হঠাৎ কেমন জানি শিউরে ওঠে। সে আবার মাথা ঘুরিয়ে সোনালি চুলের মানুষটির দিকে ভালো করে তাকাল। মানুষটির চেহারা যেরকম কঠোর, তার কথার মাঝেও এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় রূঢ়তা রয়েছে। এটি কি তার চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নাকি প্রথম পরিচয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার সূক্ষ্ম একটা প্রচেষ্টা কে জানে।
ইরন মুখের মাংসপেশি শক্ত করে বলল, তুমি কেমন করে এত নিশ্চিত হলে যে আমরা সবাই মারা যাব?
সোনালি চুলের মানুষটি এক পা এগিয়ে এসে কালো গ্রানাইটের টেবিলের দুই পাশে বসে থাকা তরুণ–তরুণীকে দেখিয়ে বলল, ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ।
ইরন ঠিক বুঝতে পারল না, ভুরু কুঁচকে বলল, কী জিজ্ঞেস করব?
ওরা কারা?
ইরন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুদর্শন তরুণ এবং কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকাল। তারা দুজনেই হঠাৎ কেমন জানি অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তরুণটি ইতস্তত করে বলল, আমরা, আসলে প্রকৃত মানুষ নই।
ইরন চমকে উঠে বলল, তোমরা রোবট?।
না। যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, আমরা ক্লোন।
ক্লোন?
হা, বিভিন্ন বিপজ্জনক অভিযানে পাঠানোর জন্য আমাদের পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করা হয়েছে।
ইরন বিস্ফারিত চোখে এই সুদর্শন যুবক এবং কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আমি–আমি কিছু বুঝতে পারছি না। মানুষকে ক্লোন করা সম্পূর্ণ বেআইনি। একবিংশ শতাব্দীতে।
সোনালি চুলের মানুষটি বলল, তুমি নেহায়েত সাদাসিধে একজন মানুষ। পৃথিবীর কোনো খবর রাখ না।
এই রূঢ় কথাটি শুনে যতটুকু ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত ছিল, ইরন কেন জানি ততটুকু ক্রুদ্ধ হতে পারল না। সে সবিস্ময়ে এই ক্লোন তরুণ এবং তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইল।
তুমি এখন বুঝতে পারছ আমি কেন বলেছি যে আমরা সবাই আগামী ছিয়ানব্বই ঘন্টার মাঝে মারা যাব?।
ইরন মানুষটির কথার কোনো উত্তর দিল না। সোনালি চুলের মানুষটি স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রথমত আমরা এমন একটা জিনিস জেনেছি যেটি পৃথিবীর মানুষের জানার কথা নয়–বিপজ্জনক অভিযানের জন্য মানুষকে ক্লোন করা হয়। দ্বিতীয়ত এই অভিযানে মানুষের ক্লোন পাঠানো হচ্ছে। যার অর্থ–
যার অর্থ?
যার অর্থ এখানে মানুষ ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা পড়বে। মানুষ যেখানে ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যায় সেখানে ক্লোনকে পাঠানো হয়। কারণ মানুষের ক্লোন আসলে মানুষ নয়।
অবশ্যই মানুষ। ইরন গলা উঁচিয়ে বলল, অবশ্যই তারা পরিপূর্ণ মানুষ। তারা সত্যিকার একজন মানুষের পরিপূর্ণ কপি। তাদের বুকে হৃৎপিণ্ড স্পন্দন করছে, ধমনিতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।
হ্যাঁ। যুবকটি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু পৃথিবীর সংবিধান অনুযায়ী আমরা মানুষ নই। যার জিনেটিক কোড ব্যবহার করে আমাকে তৈরি করা হয়েছিল তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমরা নই।
আমি বুঝতে পারছি না। ইরন বিভ্রান্তের মতো বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সোনালি চুলের মানুষটি ইরনের কাছে এক পা এগিয়ে এসে বলল, এর মাঝে না বোঝার কিছু নেই। আমি যদি তোমাকে আঘাত করি সাথে সাথে প্রতিরক্ষা দপ্তরের লোক এসে আমাকে বেঁধে নিয়ে যাবে। শরীরে ট্রাকিওশান১০ ঢুকিয়ে বিচারের জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু যদি মনে কর আমি একটা শক্ত টাইটেনিয়ামের রড দিয়ে এই দুজনের কারো মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে দিই–আমার কোনো অপরাধ হবে না।
কী বলছ?
হ্যাঁ। ঘরের মেঝে নোংরা করার জন্য কয়েক শ ইউনিট জরিমানা হতে পারে কিন্তু মানুষ হত্যা করার জন্য বিচার হবে না।
কী বলছ তুমি?
সোনালি চুলের মানুষটি হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখতে চাও আমি সত্যি কথা বলছি কি না?
ইরন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে সোনালি চুলের নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল ঠিক তখন ঘরটির দরজা খুলে যায় এবং প্রজেক্ট আপসিলনের অন্য অভিযাত্রী ঘরে এসে ঢুকল। ইরন মাথা ঘুরিয়ে দেখল, লালচে চুলের একজন মহিলা। বয়স অনুমান করা কঠিন, চব্বিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ যে কোনো কিছু হতে পারে, কিন্তু যেরকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রবেশ করেছে বয়স খুব কম হবার সম্ভাবনা কম। মহিলাটিকে সুন্দরী বলা যাবে না তবে আকর্ষণীয় বলা যেতে পারে, চেহারায় একটা ভিন্ন ধরনের সতেজ ভাব রয়েছে। মহিলাটি এগিয়ে এসে সবার দিকে তাকাল এবং একটি চেয়ার টেনে বসে বলল, আমি তোমাদের আলোচনার মাঝে বিঘ্ন করে ফেললাম বলে মনে হচ্ছে।
ইরন বিড়বিড় করে বলল, সেজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আরেকটু হলে আমাদের একজন সদস্য আমাদের আরেকজন সদস্যের মাথার ঘিলু বের করে একটা। উদাহরণ তৈরি করতে চাইছিল।
লাল চুলের মহিলাটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। তবে সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, পুরোটা শুনলে নিশ্চয়ই বুঝব। আমার পরিচয় দিয়ে নিই, আমি কীশা। আমি প্রজেক্ট আপসিলনের একজন অভিযাত্রী। তোমাদের সাথে এই অভিযানে অংশ নিতে পেরে আমি গৌরব অনুভব করছি।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ইরন। আমি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। ঠিক কী কারণে জানি না আমার জীবন পুরোপুরি ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল, এই অভিযানে অংশ নিয়ে আমি আবার আমার জীবনে খানিকটা সমন্বয় ফিরিয়ে আনতে চাই।
সোনালি চুলের মানুষটি আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠল। ইরন তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমার কোন কথাটি তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?
জীবনের সমন্বয় ফিরিয়ে আনার অংশটা। জীবন একটা দ্বিঘাত সমীকরণ নয় যে সেটাকে সমন্বয় করে সেখান থেকে সমাধান বের করে আনা যায়। যারা জীবনকে সমন্বয় করার কথা বলে তারা জীবনের অর্থ বোঝে না, সমন্বয়ের অর্থও বোঝে না।
কীশা সোনালি চুলের মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কী?
আমার নাম বর্গেন।
বর্গেন, প্রথম পরিচয়ে যারা এভাবে কথা বলতে পারে ধরে নেওয়া যেতে পারে তারা সামাজিক পরিবেশে অভ্যস্ত নয়। আমার ধারণা তুমি সম্ভবত একটি রোবট।
বর্গেনের মুখে একটা ক্রোধের ছায়া পড়ে, আমি রোবট নই।
তা হলে তোমাকে নিয়ে আমাদের একটু সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে।
বর্গেন কোনো কথা না বলে কুদ্ধ চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন জিজ্ঞাসু চোখে কীশার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, আমাদের কেন সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে?
বর্গেন সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন আসামি। এই অভিযানে যারা এসেছে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থাকে।
ইরন এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে বর্গেনের মুখের দিকে তাকাল, মানুষটির মুখে সত্যি এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুরতার ছাপ রয়েছে। সে ঘুরে কীশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই অভিযানে কেন এসেছ?
আমার ভাগ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর জন্য। আমার খুব আপনজন ছিল, ভালবাসার মানুষ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি দুর্ঘটনায় তারা শেষ হয়ে গেছে। কীশা পাথরের মতো মুখ করে একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে পালাতে চাই। তোমরা আমাকে একটু সাহায্য কোরো।
করব কীশা।
কালো গ্রানাইটের টেবিলের দুই পাশে বসে থাকা সপ্রতিভ চেহারার যুবকটি কীশার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত কীশা। খুবই দুঃখিত। কিন্তু এ রকম পরিবেশে কী বলতে হয় আমি জানি না।
কীশা একটু অবাক হয়ে যুবকটির দিকে তাকাল, ইরন নিচু গলায় বলল, এরা দুজন ক্লোন।
ক্লোন?
যুবকটি মাথা নাড়ল–হ্যাঁ। আমরা ক্লোন। আমাদের যে মানুষ থেকে ক্লোন করা হয়েছে তারা অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং সফল মানুষ। তাদের ভিতর সহজাত নেতৃত্ববোধ রয়েছে, তারা সহানুভূতিশীল এবং উদাসী। তাই আশা করা হচ্ছে আমরাও তাদের মতো চরিত্রের মানুষ হব। এই অভিযানে তোমাদের সাহায্য করতে পারব।
নিশ্চয়ই সাহায্য করতে পারবে। কীশা মাথা নেড়ে বলল, আমি নিশ্চিত তোমরা চমৎকার সহযোগী হবে।
জীবন সম্পর্কে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশে আমাদের বড় করা হয়েছে তাই আমরা স্বাভাবিক সামাজিক ব্যাপারগুলো জানি না।
কী বললে–তোমরা কোথায় বড় হয়েছ?
গবেষণাগারে। আমরা সব মিলিয়ে আঠার জন ক্লোন ছিলাম।
আঠার জন? ইরন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, একই মানুষের আঠার জন ক্লোন?
হ্যাঁ। আমরা সবাই এক জন মানুষের ক্লোন ছিলাম।
কীশা কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আর তুমি? মেয়েটির চোখে এক ধরনের ভয়ের ছায়া পড়ে, কাঁপা গলায় বলল, আমিও ক্লোন। আমি অত্যন্ত নগণ্য একজন ক্লোন।
এখানে কেউ নগণ্য নয়। এখানে সবাই প্রয়োজনীয়।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, না, আমরা জানি আমরা নগণ্য। মানুষের প্রয়োজনে আমাদের তৈরি করা হয়। সত্যিকারের মানুষের জীবন খুব মূল্যবান, কিন্তু আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। সহজে খরচ করে ফেলবার জন্য আমাদের তৈরি করা হয়।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ তোমরা?
আমরা সত্যি বলছি। আমাকে যে গবেষণাগারে বড় করা হয়েছে সেখানে আমরা ছিলাম একুশ জন। পরের বার তৈরি করা হয়েছে আরো চব্বিশ জন। আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে। যার জিনস ব্যবহার করে আমাদের ক্লোন করা হয়েছে সে অত্যন্ত চমৎকার একজন মহিলা ছিল। আমরা সবাই তার সম্মান রাখার চেষ্টা করি। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। আমরা–_
তোমার নাম কী মেয়ে?
কীশার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি থতমত খেয়ে থেমে গেল। নাম? আমার নাম?
হ্যাঁ।
আমাদের কোনো নাম থাকে না। শুধু নম্বর দেওয়া থাকে। আমার নম্বর সতের।
ইরন এক ধরনের বেদনাতুর দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু একজন মানুষের নাম নেই, সেটা তো হতে পারে না।
আমরা মানুষ নই, মানুষের ক্লোন।
মানুষের ক্লোনও মানুষ। তোমার একটা নাম থাকতে হবে। আমি তোমাকে একটা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করব না।
মেয়েটি খানিকটা হতচকিত হয়ে পুরুষসঙ্গীর দিকে তাকাল। দুজন দুজনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার ইরনের দিকে ঘুরে তাকাল। যুবকটি ইতস্তত করে বলল, সত্যি যদি কোনো একটি নাম দিয়ে ডাকতে চাও তা হলে একটি নাম দিতে হবে। কারণ আমাদের কোনো নাম নেই।
তুমি যে মানুষটির ক্লোন তার নাম কী?
আমি যতদূর জানি তার নাম ত্ৰালুস।
বেশ তা হলে তুমিও ত্রালুস।
ইরন এবারে কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আর তোমার?
আমাকে ক্লোন করা হয়েছে মহামান্যা শুমান্তি থেকে।
বেশ। আজ থেকে তা হলে তুমিও হচ্ছ শুমান্তি।
কীশা মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলল, চমৎকার! তা হলে প্রজেক্ট আপসিলনের সকল সদস্যের নামকরণ করা হয়ে গেল।
বর্গেন আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে বলল, সেই নাম কতক্ষণ কাজে লাগবে দেখা যাক।
কীশা ভুরু কুঁচকে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
বর্গেন কিছু একটা বলতে চাইছিল, ইরন বাধা দিয়ে বলল, ওর কথা থাক। ওর কথা। শুনলে মন খারাপ হয়ে যাবে।
কেন?
কারণ বর্গেন দাবি করে এই অভিযানে আমরা নাকি ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যাব।
কীশা বর্গেনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেন এ রকম বলছ?
আমি জানি তাই বলছি।
তুমি কেমন করে জান?
কারণ আমি এই প্রজেক্টের দলপতি।
সবাই একসঙ্গে চমকে উঠে বর্গেনের দিকে তাকাল। বর্গেন আবার কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে মাথা নেড়ে বলল, না, তোমরা যেটা ডাবছ সেটা আর হবার নয়।
আমরা কী ভাবছি?
তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ যে এই অভিযানে তোমরা যাবে না। তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমাকে তোমাদের খুব পছন্দ হয় নি।
ইরন এবং কীশা স্থির চোখে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে রইল। বর্গেন তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, কিন্তু তোমাদের আমার ভারি পছন্দ হয়েছে। এ রকম ক্রু না নিয়ে আমি এই অভিযানে যাচ্ছি না।
বর্গেন আবার আনন্দহীন একটি হাসি হাসতে শুরু করে। যেভাবে হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেরকমভাবে হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, তোমরা এখন চল। মহাকাশে অভিযানের আগে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। অত্যন্ত নিরানন্দ একঘেয়ে প্রশিক্ষণ–কিন্তু জরুরি, খুব জরুরি। কারণ মানুষ আসলে ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যেতে পছন্দ করে না। বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে যায়। সে জন্য তোমাদের নানারকম প্রশিক্ষণ নিতে। হবে। তোমাদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য কয়েক ডজন টেকনিশিয়ান, ডাক্তার, নার্স আর রোবট অপেক্ষা করছে।
ইরন পাথরের মতো মুখ করে বলল, আমরা যদি না যাই?
বর্গেন হাসিমুখে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই যাবে। কারণ যারা প্রজেক্ট আপন্সিলনে নাম লিখিয়েছে তাদের নিজের ইচ্ছা–অনিচ্ছার বিশেষ কোনো মূল্য নেই! মানুষের আর ক্লোনের মাঝে সে ব্যাপারে এখন আর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। ইরন স্থির চোখে বর্গনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে খুব অবাক হয়ে লক্ষ করল তার ভিতরে অসহ্য ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছে না, বরং বিচিত্র এক ধরনের কৌতূহল দানা বেঁধে উঠছে।
১.৪ ইরনকে একটি আরামদায়ক চেয়ারে
ইরনকে একটি আরামদায়ক চেয়ারে শুইয়ে যে মেয়েটি নিওপলিমারের স্ট্র্যাপ দিয়ে তাকে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছিল তাকে মোটামুটিভাবে সুন্দরী বলা চলে। ইরন খানিকটা কৌতূহল নিয়ে তার দক্ষ হাতের কাজ দেখতে দেখতে বলল, আমি জানতাম মহাকাশযানে আর এ রকম নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই।
তুমি ঠিকই জানতে।
তা হলে?
এই মহাকাশযানটা একটা পরীক্ষামূলক মহাকাশযান। তোমরা দেখবে, খুব অল্প সময়ে এটা অনেক বেগে পৌঁছে যাবে। সেইজন্য এই ব্যবস্থা।
আমাদের কী হবে?
বিশেষ কিছুই হবে না। শরীরের মাঝে বিশেষ ট্রাকিওশান দেওয়া হয়েছে। সেটা আমাদের সব তথ্য জানাবে। আর তোমাদের যে ক্যাপসুলে ঢোকানো হচ্ছে তার ভিতরে তোমরা খুব নিরাপদ। মায়ের গর্ভে ভ্রুণ যেরকম নিরাপদ অনেকটা সেরকম।
ইরন কৌতুক করে বলল, পূর্ণ বয়সে আবার আমরা মাতৃগর্ভে ফিরে যাচ্ছি?
অনেকটা সেরকম। মেয়েটা ইরনের করোটিতে সুচালো কিছু একটা প্রবেশ করিয়ে বলল, এখন কথা বোলো না, আমাদের ক্যালিব্রেশানে গোলমাল হয়ে যাবে।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। তার দুপাশে আরো চারটি খোলা স্টেইনলেস স্টিলের ক্যাপসুল, কালচে ধাতব রং হঠাৎ দেখে মনে হয় অতিকায় ড্রাগন মুখ হাঁ করে আছে। একেকটি ক্যাপসুলে একেকজনকে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একসময় ক্যাপসুলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। মহাকাশযানের জীবনরক্ষাকারী মডিউল তখন তাদের জীবনের দায়িত্ব নিয়ে নেবে, তাদের নিশ্বাসের জন্য অক্সিজেন, জীবনরক্ষার জন্য চাপ, রক্তের মাঝে পুষ্টির নিশ্চয়তা দেবে কিছু কৌশলী যন্ত্র। মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিন একসময় গর্জন করে উঠবে, তীব্রগতিতে আয়নিত পরমাণু ছুটে আসবে আর এই মহাকাশযানটি বায়ুমণ্ডলকে ভেদ করে উঠে যাবে মহাকাশে। দেখতে দেখতে নীল আকাশ প্রথমে গাঢ় নীল, তারপর কালচে বেগুনি, সবশেষে নিকষ কালো হয়ে যাবে। পরিচিত পৃথিবী একটি নীলাভ গ্রহ হয়ে পিছনে পড়ে থাকবে। সেই গ্রহটি কি শুধু একটি স্মৃতিই হয়ে থাকবে তাদের কাছে নাকি তারা আবার ফিরে আসবে এই গ্রহে?
ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল এবং ঠিক তখন টেকনিশিয়ান মেয়েটি তার হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলল, তোমার যাত্রা শুভ হোক, ইরন।
ইরন মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, তোমার কথা সত্যি হোক মেয়ে?
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে কোথায় একটা সুইচ টিপে দিতেই খুব ধীরে ধীরে স্টেইনলেস স্টিলের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল, সাথে সাথে ভিতরে আবছা অন্ধকার হয়ে আসে। পায়ের কাছে কোনো এক জায়গা থেকে মিষ্টি গন্ধের এক ধরনের শীতল বাতাস এসে ক্যাপসুলের ভিতরটা শীতল করে দিতে শুরু করেছে। ইরন হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে নীলাভ স্ক্রিনটা চালু করে দিতেই মহাকাশযানের ভিতরটা দেখতে পেল। টেকনিশিয়ানরা চারটি ক্যাপসুল বন্ধ করে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়েছে, সবকিছু শেষবার পরীক্ষা করে তারা নেমে যেতে শুরু করে। গোলাকার দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে যেতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে তাদেরকে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলল। ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কে জানে সে আবার কখনো পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে কি না।
ইরন একটা মৃদু কম্পন অনুভব করে। নিশ্চয়ই মহাকাশযানের বিশাল শক্তিশালী ইঞ্জিনগুলো চালু হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই আয়োনিত গ্যাসের প্রবাহে বিস্তৃত প্রান্তর ভস্মীভূত হয়ে যাবে। ইরন তার মুখের সামনে নীল স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ইচ্ছে করলে সে এখানে দৃশ্যটি পাল্টে দিয়ে বাইরে থেকে মহাকাশযানটি কেমন দেখায় সেটি দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে অন্য ক্যাপসুলগুলোতে সবাই কেমন আছে সেটাও দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে কন্ট্রোল প্যানেলের ঘুঁটিনাটিও সে পর্যবেক্ষণ করতে পারে কিন্তু ইরন তার কিছুই করল না। হঠাৎ করে সে অনুভব করে তার শরীরে খুব ধীরে ধীরে একটা আরামদায়ক অবসাদ ছড়িয়ে পড়ছে, ঘুমের মতো এক ধরনের অনুভূতি কিন্তু ঠিক ঘুম নয়, প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেখান থেকে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখতে পারে না। ইরন তার মুখের কাছাকাছি রাখা নীল স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
ইরনের জ্ঞান ফিরে এল খুব ধীরে ধীরে, চোখ খুলে সামনে নীল স্ক্রিনটাতে পরিচিত নীলাভ গ্রহটা দেখেও সে প্রথমে কিছু মনে করতে পারল না। সমস্ত শরীরে এক ধরনের অবসাদ এবং মাথায় এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা নিয়ে সে ধীরে ধীরে পুরোপুরি সজাগ হয়ে ওঠে। ক্যাপসুলের ভিতরে কনকনে এক ধরনের শীতলতা, ইরন তার দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে ক্যাপসুলের ভিতরকার কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল। মহাকাশটির অসংখ্য তথ্য সেখানে দ্রুত খেলা করে যাচ্ছে, অনভিজ্ঞ চোখে তার কিছুই অর্থবহ নয় কিন্তু ইরন খুব সহজেই সেগুলো বিশ্লেষণ করতে পারে। মিনিট দুয়েক সে তথ্যগুলো দেখে হঠাৎ চমকে উঠল, কোথাও কিছু একটা বড় গোলমাল রয়েছে। গতিবেগ অনেক কম, ত্বরণ যেটুকু থাকার কথা তার এক ভগ্নাংশও নয়, এই সময়ের মাঝে পৃথিবী থেকে যেটুকু যাবার কথা মহাকাশযানটি তার ধারেকাছেও যায় নি। মহাজাগতিক কো–অর্ডিনেট থেকে মনে হচ্ছে এটি মঙ্গল এবং বৃহস্পতির কাছাকাছি কোথাও থেমে আসছে। ক্যাপসুলের ভিতর উঠে বসার উপায় থাকলে ইরন উত্তেজনায় উঠে বসত, কিন্তু এখন তার উপায় নেই। সে সুইচ টিপে বর্গেনের ক্যাপসুলে যোগাযোগ করে এবং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে সেটি খালি, ভিতরে কেউ নেই। ইরন যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করতেই বর্গেনকে দেখতে পেল সে মহাকাশযানের মূল কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ডাকতে গিয়ে ইরন থেমে যায়। বর্গেনের চোখের দৃষ্টি কেমন জানি অস্বচ্ছ এবং দুর্বোধ্য। ইরন তার ক্যাপসুলের ঢাকনা খোলার জন্য জরুরি সুইচটি স্পর্শ করল, এবং ভোঁতা একটি শব্দ করে খুব ধীরে ধীরে স্টেইনলেস স্টিলের কালো ঢাকনাটা উপরে উঠতে শুরু করে। ক্যাপসুলের ভিতরে সাথে সাথে মহাকাশযানের উষ্ণ বাতাস এসে প্রবেশ করে।
ইরন উঠে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরে ওঠে, মনে হচ্ছে মহাকাশযানের বাতাসে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই। ইরন তার পোশাক থেকে অক্সিজেন মাস্কটি বের করে তার মুখের ওপর লাগিয়ে নিয়ে টলতে টলতে হাঁটতে শুরু করে। বর্গেনের খোলা ক্যাপসুলের পাশেই কীশার ক্যাপসুল, স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তার ঘুমন্ত মুখটি দেখা যাচ্ছে। যে। কোনো মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় কেন জানি অসহায় দেখায়। ইরন একমুহূর্ত দ্বিধা করে উজ্জ্বল লাল রঙের জরুরি সুইচটি স্পর্শ করতেই ক্যাপসুলটি কীশাকে জাগিয়ে তোলার কাজ শুরু করে দেয়। ইরন কীশার জন্য অপেক্ষা না করে মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কন্ট্রোল প্যানেলের হালকা নীল আলোর সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বর্গেনকে একটি অতিপ্রাকৃত মূর্তির মতো মনে হচ্ছে। ইরন দেয়াল ধরে টলতে টলতে আরো একটু এগিয়ে যেতেই বর্গেন মাথা ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকাল।
বর্গেন কয়েক মুহূর্ত ইরনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
বের হওয়ার কথা নয়।
বর্গেন, তোমারও বের হওয়ার কথা নয়।
আমি এই প্রজেক্টের দলপতি। প্রয়োজনে আমি বের হতে পারি।
বেশ! আমি এই অভিযানের একজন সদস্য। কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ হলে আমিও বের হতে পারি।
বর্গেন হঠাৎ পুরোপুরি ঘুরে ইরনের দিকে তাকাল, বলল, তোমার কী নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে, ইরন?
যেমন মনে কর এই মহাকাশযানের ত্বরণ আর এই মহাকাশযানের গতিবেগ। যত হওয়ার কথা তার এক ভগ্নাংশও নয়। কেন?
তার কারণ আমরা এখন এস্টরয়েড বেন্ট পার হচ্ছি। এর মাঝে গতিবেগ বেশি করা যায় না। নিরাপত্তার ব্যাপার।
ইরন স্থির চোখে বর্গেনের দিকে তাকিয়ে রইল–এক শ বছর আগে এই উত্তরটি যথার্থ উত্তর হত, এখন নয়। মহাকাশযান এস্টরয়েড বেল্টের১১ ভিতর দিয়ে যে কোনো বেগে যেতে পারার কথা। বর্গেন মিথ্যা কথা বলছে, কিন্তু কেন?
বর্গেন কন্ট্রোল প্যানেলের উপর আবার ঝুঁকে পড়ে বলল, ক্যাপসুলে ফিরে যাও ইরন।
আমি এখন ক্যাপসুলে ফিরে যাই কি না যাই তাতে কিছু আসে–যায় না।
বর্গেন আবার ইরনের দিকে ঘুরে তাকাল, তুমি কী বলতে চাইছ?
ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল বর্গেন, মহাকাশযানে অক্সিজেন খুব কম। আমাকে মুখে একটা মাস্ক লাগাতে হয়েছে। তোমার মুখে মাস্ক নেই কেন?
বর্গেন তীক্ষ্ণ চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। ইরন আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, বর্গেন, এই মহাকাশযানে তোমার নিশ্বাস নিতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না, কারণ তোমার আসলে নিশ্বাস নিতে হয় না। তুমি একজন রোবট।
বর্গেনের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল। ইরন বাধা দিয়ে বলল, বর্গেন, আমি রোবটকে দুই চোখে দেখতে পারি না। প্রজেক্ট আপসিলনে একটা রোবটকে পাঠানো হয়েছে জানলে আমি এখানে আসতাম না।
তোমার কথা শেষ হয়েছে ইরন?
আমি আসলে রোবটের সাথে কথাবার্তা বলতে চাই না বর্গেন। কাজেই আমার কথা শেষ হয়েছে কি না সেটা বলতে পারব যখন নিঃসন্দেহে হব যে তুমি সত্যিই একটা রোবট।
সেটা তুমি কীভাবে হবে, ইরন?
ইরন দেয়াল থেকে টাইটানিয়ামের একটা বড় রড টেনে খুলে নিয়ে বলল, এটা দিয়ে। একটা আঘাত করে তোমার খুলি ফাটিয়ে দিয়ে দেখব, ভিতরে কপোট্রন না অন্য কিছু।
বর্গেন এবারে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তুমি নেহায়েত একজন নির্বোধ মানুষ ইরন। আমি যদি সত্যিই রোবট হয়ে থাকি তা হলে আমার এই যান্ত্রিক হাত দিয়ে আমি তোমাকে পিষে ফেলতে পারব। তোমার মস্তিষ্ক আমি থেতলে দিতে পারব।
ইরন শক্ত হাতে টাইটানিয়ামের রডটা ধরে রেখে আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে–যায় না। প্রজেক্ট আপসিলন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তার কিছুই সত্যি নয়। আমাদের নিয়ে তোমরা কিছু একটা ষড়যন্ত্র করেছ। তোমাকে খুন করা গেলে কিংবা আমি খুন হয়ে গেলে সেই ষড়যন্ত্রটা কাজে লাগাতে হবে না। আপাতত সেটাই আমার উদ্দেশ্য।
ইরন হিংস্র চোখে বৰ্গেনের দিকে তাকিয়ে আরো এক পা এগিয়ে গেল। বর্গেন শীতল চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, নির্বুদ্ধিতা কোরো না, ইরন। আমি তোমাকে শেষবার সতর্ক করে দিচ্ছি
বর্গেন কথা শেষ করার আগেই ইরন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বর্গেন প্রস্তুত ছিল বলে। ইরন তাকে আঘাত করতে পারল না, বরং তার শক্ত হাতের আঘাতে সে নিজে ছিটকে গিয়ে পড়ল। কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সে এগিয়ে যায়, টাইটানিয়ামের রডটি ঘুরিয়ে আবার সে আঘাত করার চেষ্টা করে, কিন্তু বর্গেন বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে গিয়ে তার হাতে আঘাত করতেই টাইটানিয়ামের রডটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। ইরন শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং বর্গেন শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে এক পা এগিয়ে আসে। ইরন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার বর্গেনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বর্গেন তার শক্ত হাতে ইরনের মুখে আঘাত করল, মুহূর্তের জন্য ইরন চোখে অন্ধকার দেখে, তাল হারিয়ে সে দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ল। ইরন তার মুখে রক্তের লোনা স্বাদ পায়, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এসেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু উঠতে পারল না। বর্গেন তার দিকে এগিয়ে আসে, দুই হাত দিয়ে নিওপলিমারের১৩ তৈরি তার বুকের কাপড় ধরে তাকে উপরে টেনে তুলল, তার মুখে একটা বিচিত্র হাসি খেলা করতে শুরু করেছে। শক্ত লোহার মতো দুই হাতে তার গলা চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমি যদি বলতে পারতাম জীবনের শেষ মুহূর্তে তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে ইরন, তা হলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু আমার এতটুকু দুঃখ হচ্ছে না। তোমার কার্টিলেজ১৪ আমি এক হাতে ভাঙতে পারি নির্বোধ মানুষ–
ইরন বুঝতে পারে তার গলায় বর্গেনের হাত শক্ত সঁড়াশির মতো চেপে বসেছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। সমস্ত বুক বাতাসের জন্য হাহাকার করতে থাকে। প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে, দুই হাতে বর্গেনের চোখে–মুখে খামচে ধরার চেষ্টা করে, নখ বসিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পাথরের মতো শক্ত শরীরে তার হাত পিছলে আসে।
ইরনের চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ তার মাঝে সে কীশাকে দেখতে পেল। দুই হাতে টাইটানিয়ামের রডটি শক্ত করে ধরে রেখে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ইরন প্রাণপণ চেষ্টা করে তাকিয়ে থাকে, দেখতে পায় বর্গেনের পিছন থেকে। ধীরে ধীরে কীশা টাইটানিয়ামের রডটি উদ্যত করেছে। তারপর কিছু বোঝার আগে কীশা প্রচণ্ড শক্তিতে বর্গেনের মাথায় আঘাত করল।
ভয়ঙ্কর একটি চিৎকারের শব্দ শুনল ইরন, কিছু বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ ছুটে গেল এবং উষ্ণ এক ধরনের চটচটে তরল ছিটকে এসে পড়ল তার মুখে। ইরন হঠাৎ করে অনুভব করল তার গলায় বর্গেনের হাত শিথিল হয়ে এসেছে। বুকভরে একবার নিশ্বাস নিতে চাইল ইরন কিন্তু কাশির দমকে সে নিশ্বাস নিতে পারলনা। দুই হাতে বুক চেপে ধরে অনেক কষ্টে একবার নিশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকাল, পিছনে কীশা, তার চোখে বিস্ময় এবং আতঙ্ক। ইরন কীশার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝের দিকে তাকায়। সেখানে বর্গেনের মাথাটি পড়ে আছে, গলার অংশবিশেষ ছিঁড়ে এসেছে, সেখান থেকে কিছু ছেঁড়া তার, সূক্ষ্ম ফাইবার আর টিউব বের হয়ে এসেছে। চটচটে হলুদ এক ধরনের তরল সেখান থেকে গলগল করে বের হয়ে আসছে।
কীশা হতচকিতভাবে হাতের টাইটানিয়ামের রডটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, হলুদ রক্ত! হলুদ
ইরন বর্গেনের মস্তকহীন দেহ এবং শিথিল হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে সরে এসে বলল, রক্ত নয়। কপোট্রনকে শীতল করার তরল।
কপোট্রন?
হ্যাঁ।
তার মানে বর্গেন একটা রোবট?
হ্যাঁ।
কী আশ্চর্য! কীশা পা দিয়ে বর্গেনের মাথাটিকে সোজা করে দিয়ে বলল, আমাদেরকে বলেছিল এখানে কোনো রোবট নেই।
বর্গেনের বিচ্ছিন্ন মাথাটি হঠাৎ কেঁপে ওঠে এবং মুখ হাঁ করে কিছু বলার চেষ্টা করে।
ইরন মুখে একটা বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটিয়ে বলল, তুমি কিছু বলছ?
বর্গেনের মাথাটি বিচিত্র একটি শব্দ করে বলল, হা।
কী?
তোমাদের দিন শেষ। বর্পেনের বিচ্ছিন্ন মাথাটি হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করে। হাসির সাথে সাথে ঠোঁটের কষ বেয়ে হলুদ রঙের চিটচিটে তরলটি চুঁইয়ে চুঁইয়ে বের হতে থাকে। ইরন অনেক কষ্ট করে একটা লাথি দিয়ে মাথাটি দূরে ছুঁড়ে ফেলার ইচ্ছে দমন করে নিচু হয়ে বসল। হাত দিয়ে বর্গেনের চুলের মুঠি ধরে মাথাটি উপরে তুলে বলল, আমাদের দিন শেষ কেন বলছ?
বর্গেন বিচিত্র এক ধরনের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, একটু পরেই তোমরা বুঝবে।
বর্গেন।
বল।
তুমি আর কতক্ষণ এভাবে থাকবে?
বেশিক্ষণ নয়। কপোট্রন শীতল করার তরলটা বের হয়ে গেছে, কপোট্রনটা কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে।
তোমার কি দুঃখ হচ্ছে?
দুঃখ? আমার? বর্গেনের মাথাটি হঠাৎ আবার কেঁপে কেঁপে হাসতে শুরু করে, আমাদের দুঃখ হয় না। একটা দায়িত্ব দিয়েছিল। দায়িত্বটা ঠিকভাবে শেষ করেছি তাই খুব আনন্দ হচ্ছে।
কীশা অবাক হয়ে বলল, দায়িত্ব ঠিকভাবে শেষ করেছ?
হ্যাঁ।
সেটা কখন করলে?
এই যে তোমাদের একটা মহা গাড্ডার মাঝে এনে ফেলেছি। মহাকাশযানের কন্ট্রোল এখন কারো কাছে নেই। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হত আমাকে দিয়ে আমাকেও তোমরা শেষ করেছ। এখন তোমরা বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণে সেখানে গিয়ে শেষ হবে! তোমরা বর্গেন কথা শেষ করার আগেই আবার খিকখিক করে অপ্রকৃতিস্থর মতো হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে হঠাৎ হেঁচকি দিয়ে সে থেমে গেল। বর্গেনের কান এবং চোখ দিয়ে কালো আঁজালো এক ধরনের ধোঁয়া বের হতে শুরু করে, ইরন তার হাতে উত্তাপ অনুভব করে বিচ্ছিন্ন মাথাটি মেঝেতে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
শেষ। কপোট্রনটা জ্বলে গেছে।
রক্ষা হয়েছে। কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কী ভয়ানক ব্যাপার!
ইরন কথা না বলে চিন্তিত মুখে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যায়। কীশা পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমার কাছে এখনো পুরো ব্যাপারটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
ইরন কীশার দিকে তাকিয়ে বলল, দুঃস্বপ্ন?
হ্যাঁ। আমার কাছে কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে একটা নাটক। আমরা সবাই সেই নাটকের একটা করে চরিত্র।
কেন? কীশা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার কাছে এ রকম মনে হচ্ছে কেন?
জানি না।
কীশা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন কী করব আমরা?
প্রথমে দেখব বর্গেনের শেষ কথাগুলো সত্য কি না। অর্থাৎ আসলেই আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃহস্পতির আকর্ষণে সেদিকে যাচ্ছি কি না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। আমি দেখেছি অশুভ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আশ্চর্যভাবে সবসময় মিলে যায়। সম্ভাবনার মূল্যবান সূত্রগুলো সেখানে আশ্চর্যভাবে দুর্বল!
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
আমার মনে হয় ত্ৰালুস আর শুমান্তিকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া দরকার।
কেন?
কী করব সেটা ঠিক করা যাক। যত বেশি মানুষ বসে সিদ্ধান্তটা নেওয়া যায় ততই ভালো।
১.৫ কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিল
কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিলটা ঘিরে চার জন বসে আছে। ইরনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট, সে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছে। ত্রালুস এবং শুমান্তি শান্তমুখে ইরনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কীশা একটা লম্বা বিশ্বাস ফেলে বলল, কিছু একটা বল ইরন।
ইরন মাথা তুলে তাকাল, বলল, বলব আমি?
হ্যাঁ।
বলার মতো কিছু আছে? আমাদের অবস্থা হচ্ছে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো। আমরা জানি আগুনে আমরা নিশ্চিতভাবে পুড়ে মরব কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।
কিন্তু এটা কি একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়? একটা মহাকাশযান পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় বৃহস্পতি গ্রহের দিকে ছুটে যাচ্ছে?
না, মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারণ এটি ইচ্ছে করে করা হয়েছে। আমরা যখন ঘুমিয়েছিলাম তখন বর্গেন উঠে এসে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণে বড় পরিবর্তন করেছে। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ মডিউলটি সরিয়ে দিয়েছে। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করেছে। কেন করেছে সেটা একটা রহস্য। আমাদেরকে মেরে ফেলাই যদি এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সেটা কি পৃথিবীতে আরো সহজে করা যেত না?
কীশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আমরা এখন বৃহস্পতির ওপর আছড়ে পড়ব?
হ্যাঁ।
আমাদের হাতে কতটুকু সময় আছে?
পৃথিবীর হিসাবে দিন সাতেক। তবে শেষের অংশটুকুর কথা ভুলে যাও, প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাব বলে আমাদের জ্ঞান থাকবে না।
মৃত্যুটি কি খুব ভয়ঙ্কর হবে?
ইরন হেসে ফেলে বলল, জানি না। আমি আগে কখনো এভাবে মারা যাই নি।
ত্রালুস এবং শুমান্তি এতক্ষণ চুপ করে দুজনের কথা শুনছিল, এবারে ত্রানুস একটু সোজা হয়ে বসে বলল, আমি একটা কথা বলতে পারি?
বল।
তোমরা আমাদের দুজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলে মহাকাশযানে কী কী আছে খুঁজে দেখতে।
হ্যাঁ।
আমরা দেখা শুরু করেছি–পুরোটা এখনো শেষ হয় নি। আর্কাইভ ঘরে কিছু জিনিস রয়েছে যার কোনো তালিকা নেই।
ইরন অবাক হয়ে বলল, তালিকা নেই?
না। শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে কোনো তালিকা নেই।
অসম্ভব! ইরন মাথা নেড়ে বলল, মহাকাশযানের প্রত্যেকটি স্কুর পর্যন্ত তালিকা থাকতে হবে।
শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু আমরা আর্কাইভ ঘরে গেছি সেখানে অনেকগুলো নানা আকারের বাক্স আছে, যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু সেগুলোতে কী আছে কোথাও বলা নেই।
কীশা মাথা নেড়ে বলল, ইরন। আমি যতই দেখছি ততই তোমার ষড়যন্ত্র থিওরিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
ইরন টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ষড়ষন্ত্র নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রটা কী আমাদের জানা দরকার?
যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা যদি চায় তা হলে আমরা নিশ্চয়ই জানব!
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কি মজার ব্যাপার কী জান? পুরো ব্যাপারটা যদি দেখ তা হলে মনে হবে আমরাও সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। আমি টাইটানিয়ামের রড দিয়ে বর্গেনকে মারতে গিয়েছি তুমি মেরেই ফেলেছ।
কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ওভাবে বল না, রোবটের বেলায় মেরে ফেলা কথাটা খাটে না। তা ছাড়া আমি সেটাকে মারতে চাই নি তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। এত সহজে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে কে জানত?
অত্যন্ত দুর্বল ডিজাইন। ইরন মাথা নেড়ে বলল, কে জানে সেটাও নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্রের অংশ।
ত্রালুস নড়েচড়ে বলল, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
আর্কাইভ ঘরে বাক্সগুলোতে কী আছে আমরা যদি খুলে দেখতে পারি তা হলে হয়তো কিছু একটা বুঝতে পারব।
ইরন মাথা নাড়ল, ঠিক বলেছ।
কাজটা অবশ্য খুব সহজ হবে না। তথ্যকেন্দ্রে যেহেতু এদের তালিকা নেই, এটা খোলারও কোনো উপায় নেই। বাক্সগুলো ভাঙতে হবে।
ভাঙতে হবে?
হ্যাঁ। ঠিক যন্ত্রপাতি খুঁজে বের করতে হবে।
কীশা মাথা নেড়ে বলল, যদি ভিতরে বিপজ্জনক কিছু থাকে?
ইরন হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠে বলল, তা হলে আমরা এক সপ্তাহের মাঝে মারা না গিয়ে হয়তো আরো দুদিন আগে মারা যাব! খুব কি ক্ষতি–বৃদ্ধি হবে?
কীশা আবার একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, না। তা হবে না।
ইরন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, শুমান্তি বাধা দিয়ে বলল, আমরা এই মহাকাশযানে আরো একটি বিচিত্র জিনিস পেয়েছি।
কী?
এন্টি ম্যাটার১৬। প্রতিপদার্থ।
ইরন চমকে সোজা হয়ে বসে বলল, এন্টি ম্যাটার? কী বলছ?
হ্যাঁ।
কতখানি?
অনেক। মহাকাশযানের সামনে পুরোটাই এন্টি ম্যাটার। চৌম্বক ক্ষেত্রে আটকে রেখেছে। মনে হয় খুব সুরক্ষিত। তারপরও প্রচুর গামা রেডিয়েশন হচ্ছে। আসলে– শুমান্তি একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি তো স্বাভাবিকভাবে বড় হই নি, পড়াশোনার সেরকম সুযোগ হয় নি, তাই বিজ্ঞান বিশেষ জানি না। কতটুকু এন্টি ম্যাটার আছে, কীভাবে আছে দেখলে তোমরা বলতে পারবে।
ইরন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তুমি বিজ্ঞান না জেনেও চমৎকার বিজ্ঞানীর মতো কাজ করছ শুমান্তি!
কীশা একটু সামনে ঝুঁকে বলল, কিন্তু মহাকাশযানে এন্টি ম্যাটার কেন? তাও এই বিশাল পরিমাণের?
এন্টি ম্যাটার হচ্ছে শক্তি তৈরির সবচেয়ে সহজ উপায়। কোনো ম্যাটার বা পদার্থের সাথে জুড়ে দাও সাথে সাথে বুম প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
কিন্তু সেটা তো অনিয়ন্ত্রিত শক্তি। সেটা কী কাজে লাগবে?
যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবেই থাকে তা হলে বিশেষ কোনো কাজে আসবে না। যদি ব্যবহার করার জন্য বিশেষ ইঞ্জিন থাকে সেটা ব্যবহার করা যেতে পারে।
কীশা ত্রালুস আর শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কি দেখেছ সেরকম ইঞ্জিন?
দুজনে একসাথে মাথা নাড়ল, বলল, না দেখি নি।
এ রকম কি হতে পারে যে, দেখেছ কিন্তু বুঝতে পার নি?
হতে পারে। ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, তবে তার সম্ভাবনা খুব কম। মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র আর্কাইভ ঘরে কী আছে সেটা গোপন রেখেছে, কিন্তু অন্য সবকিছু খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। সেখানে নেই।
কীশা ভুরু কুঁচকে বলল, তা হলে?
ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, ধরে নাও তোমার কাছে যে পরিমাণ এন্টি ম্যাটার আছে সেটা দিয়ে আধখানা পৃথিবী কিংবা বৃহস্পতির একটা চাঁদ উড়িয়ে দিতে পারবে! পৃথিবীর কোনো মানুষ আগে এ রকম কিছু করে নি–সেটা চিন্তা করে তুমি যদি একটু আনন্দ পেতে চাও পেতে পার।
কীশা বিমর্ষ মুখে বসে রইল, তাকে দেখে মনে হল না সে ব্যাপারটি থেকে কোনো আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে।
পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা তারা আর্কাইভ ঘরের বাক্সগুলো খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রথম কয়েক ঘণ্টার মাঝেই বুঝতে পারল ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব। বাক্সগুলো অত্যন্ত যত্ন করে রাখা আছে, বাইরে থেকে সেগুলো মসৃণ এবং কোথাও খোলার মতো কোনো জায়গা নেই। ক্রোমিয়াম এবং টাইটানিয়ামের যে সংকর ধাতু দিয়ে বাক্সগুলো তৈরি করা হয়েছে সেগুলো কাটার মতো কোনো যন্ত্রপাতি মহাকাশযানে নেই। বাক্সগুলোর কোনো কোনোটি স্পর্শ করলে ভিতরে খুব সূক্ষ্ম কম্পন অনুভব করা যায়, ভিতরে কোনো এক ধরনের যন্ত্রপাতি চলছে, কিন্তু সেগুলো কী ধরনের যন্ত্রপাতি বোঝার কোনো উপায় নেই।
প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তারা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল। মহাকাশযানের যারাই এই বাক্সগুলো রেখেছে তারা চায় না এগুলো ভোলা হোক। এর মাঝে রহস্যটুকু যেন আড়াল থাকে সেটাই তাদের উদ্দেশ্য। মহাকাশযানটি এর মাঝে বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ বলের আওতার মাঝে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে তার গতিবেগ বাড়ছে এবং সবাই সেটা বুঝতে পারছে। বিশাল মহাকাশযানটি বৃহস্পতির প্রবল আকর্ষণে তার দিকে ছুটে চলছে, তাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় নেই।
আর্কাইভ ঘরের বাক্সগুলো খুলতে না পেরে মহাকাশযানের চার জন আবার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে একত্রিত হয়েছে। ত্ৰালুস এবং শুমান্তি যে করেই হোক পুরো ব্যাপারটিকে বেশ সহজভাবে নিয়েছে। জন্মের পর থেকেই ক্লোন হিসেবে বড় করার সময় সম্পূর্ণ অকারণে মৃত্যুবরণ করার জন্য তাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, কাজেই এই পরিবেশটুকু তাদের জন্য একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগামী কয়েক দিনের মাঝে যে ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটবে সে সময় তারা যেন সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় থেকে মহাকাশযানের সত্যিকার মানুষ দুজনকে সাহায্য করতে পারে এখন সেটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
কীশা এর মাঝে বেশ ভেঙে পড়েছে, তার চেহারায় উদভ্রান্ত মানুষের একটি ছাপ পড়েছে। ইরন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, কীশা! তুমি মনে হয় বেশি ভেঙে পড়েছ–তুমি সম্ভবত জান না মৃত্যু খুব খারাপ কিছু নয়।
মৃত্যু নিয়ে আমার খুব একটা চিন্তা নেই ইরন। কিন্তু তার আগে আমাদের কিছু করার নেই, পুরো সময়টা বসে বসে দেখব আমরা বৃহস্পতিতে আছাড় খেয়ে পড়ছি, আমি সেটা মানতে পারছি না।
তুমি কী করতে চাও?
কিছু একটা করতে চাই। কোনোভাবে চেষ্টা করতে চাই।
আমাদের কোনোরকম চেষ্টা করার কিছু নেই। মহাকাশযানটির কক্ষপথ এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন আমরা সরাসরি বৃহস্পতিতে গিয়ে আঘাত করি। ইরন স্ক্রিনের দিকে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ, বৃহস্পতি গ্রহ। মাঝখানের লাল অংশটুকু দেখে মনে হয় না যে একটা লাল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে?
কীশা মাথা নেড়ে বলল, আমি দেখতে চাই না। একটা গ্রহ যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
ত্রালুস ইতস্তত করে বলল, কীশা, তোমাকে আমরা ক্যাপসুলে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। ঘুমের মাঝেই এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না।
কীশা মাথা নাড়ল, বলল, না, আমি ঘুমাতে চাই না। আমি শেষটুকু দেখতে চাই।
ইরন অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করতে থাকে, তাকে খুব চিন্তিত দেখায়, কিছু একটা জিনিস তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কিন্তু সে ঠিক ধরতে পারছে না।
দেখতে দেখতে আরো চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে, মহাকাশযানের গতিবেগ আরো বেড়ে গেছে, বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডলের সূক্ষ্ম স্তরের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। মহাকাশযানের সুচালো অ্যান্টেনাগুলোতে এক ধরনের নীলাভ আলো দেখা যাচ্ছে–সম্ভবত আয়োনিত১৮ গ্যাসের কারণে। স্ক্রিনে বৃহস্পতি গ্রহটি আরো স্পষ্ট হয়েছে, তার উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রবাহ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে গ্রহটিকে জীবন্ত একটি কুৎসিত প্রাণী বলে মনে হয়। এক ধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে সবাই গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গত চব্বিশ ঘণ্টা কীশা মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অনেকভাবে পুনরায় নতুনভাবে চালু করতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে আবার কন্ট্রোল প্যানেলের চতুষ্কোণ টেবিলটা ঘিরে। মহাকাশযানের চার জন এসে বসেছে। ইরনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট এবং সে অন্যমনস্কতাবে আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর শব্দ করছে। কীশা খানিকটা ইরনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ইরন।
ইরন মাথা তুলে কীশার দিকে তাকাল, বল।
তুমি কী চিন্তা করছ?
সেরকম কিছু নয়।
কিছুক্ষণ আগে দেখলাম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কম্পিউটারে কিছু একটা হিসাব করছ।
হ্যাঁ।
কী হিসাব করছ?
সেরকম কিছু নয়।
আমাদের বলতে চাইছ না?
ইরন কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। কীশা একটু আহত স্বরে বলল, ইরন তুমি আমাদের মাঝে একমাত্র বিজ্ঞানী। আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচানোর যদি কোনো উপায় থাকে সেটা শুধু তুমিই ভেবে বের করতে পারবে।
কোনো উপায় নেই।
হয়তো সাধারণ হিসাবে নেই। কিন্তু কোনো অসাধারণ হিসাবে। কোনো বিচিত্র উপায়ে–যে উপায়ে সাফল্যের সম্ভাবনা খুব কম?
ইরন তীক্ষ্ণ চোখে কীশার দিকে তাকাল, বলল, তুমি কোন উপায়ের কথা বলছ?
আমি জানি না। কীশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অস্বাভাবিক কোনো উপায়।
যেমন?
যেমন একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে যাওয়া।
ওয়ার্মহোল? শুমান্তি মাথাটা একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কী?
ইরন নিচু গলায় বলল, দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থান এবং সময়কে একটা ফুটো দিয়ে জুড়ে দেওয়া যায়। সেটাকে বলে ওয়ার্মহোল।
তার মানে হঠাৎ করে সামনের স্থানটুকুর মাঝে একটা ফুটো তৈরি করা যাবে এবং সেই ফুটো দিয়ে বের হয়ে আমরা অন্য একটি জায়গায় অন্য একটি সময়ে বের হয়ে আসব?
অনেকটা সেরকম?
সেই জায়গাটা কোথায়?
অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে, অন্য কোনো শতাব্দীতে।
তুমি সেটা করতে পার?
ইরন হেসে ফেলল, বলল, না পারি না। তবে আমি এ বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। পৃথিবীতে একবার একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে গিয়ে প্রায় আধখানা শহর ধ্বংস করে ফেলেছিলাম।
কীশা সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি এখন আবার চেষ্টা করে দেখ। এখানে ধ্বংস করার কিছু নেই। আমাদের মহাকাশযানে প্রচুর এন্টি ম্যাটার আছে, স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রকে
হয়তো প্রচণ্ড চাপ দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারবে।
ইরন সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি তাই মনে কর?
চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। আমরা তো এমনিতেই মারা যাব।
যদি সত্যি সত্যি ওয়ার্মহোল দিয়ে বের হয়ে অন্য কোনো জগতে চলে যাই?
সেটা তো আর এর থেকে খারাপ হবে না।
ইরন কীশার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার তাই ধারণা?
হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা।
.
ইরন কাজে লেগে গেল। পৃথিবীর একটি সম্ভ্রান্ত ল্যাবরেটরিতে যে কাজটি করার কথা, মহাকাশযানের সীমিত সুযোগ–সুবিধার মাঝে সেই কাজটি মোটামুটি অসম্ভব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেখা গেল সেটি তত কঠিন নয়। মহাকাশযানটি যে প্রচণ্ড বেগে বৃহস্পতির দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটি ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় সঠিক বেগ হিসাবে বের হয়ে এল। এন্টি ম্যাটারকে সামনে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত হিসাবে দুটি শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন পাওয়া গেল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের জন্য এন্টি ম্যাটারের সমান পরিমাণ ভরকে প্রস্তুত। করা হল। এখন বাকি রয়েছে হিসাব করে বের করা কখন ঠিক কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো এবং ওয়ার্মহোলের মুখটি খোলার পর তার ভিতরে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। মহাকাশযানের কম্পিউটারকে এই ধরনের হিসাবে বিশেষ পারদর্শী পাওয়া গেল। শুমান্তি প্রচলিত শিক্ষা পায় নি, কিন্তু এই মেয়েটি অসাধারণ বিজ্ঞানমনস্ক এবং কিছু জিনিস বুঝিয়ে দেবার পর সে প্রয়োজনীয় হিসাব করার কাজটি খুব সুচারুভাবে করতে শুরু করল। ত্রালুস এবং কীশা এন্টি ম্যাটারকে গতিপথের নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানোর জন্য রকেট ইঞ্জিন দুটিকে প্রস্তুত করতে শুরু করল।
পরবর্তী ছত্রিশ ঘণ্টার মাঝে ইরন বৃহস্পতির পৃষ্ঠদেশে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে। তার ভিতর দিয়ে অন্য কোনো একটি জগতে পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। মহাকাশযানের কম্পিউটারের হিসাব অনুযায়ী সাফল্যের সম্ভাবনা দশমিক শূন্য তিন। যদি কিছু না করার চেষ্টা করে তা হলে বৃহস্পতির বায়বীয় পৃষ্ঠে ডুবে ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় এক শ ভাগ, কাজেই এই চেষ্টাটুকু করে দেখতেই হবে।
প্রস্তুতি পুরোপুরি শেষ করে চার জন নিজেদের ক্যাপসুলে আশ্রয় নেয়। সত্যি সত্যি যদি একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারে তা হলে মহাকাশযানটিকে যে গতিতে তার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে সেটি অচিন্তনীয়, এর আগে কেউ কখনো ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করে নি, ভিতরে কী ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে কেউ জানে না। ছোটখাটো বাধার সম্মুখীন হলেই তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
ইরন সুইচ অন করে অন্য তিন জনের সাথে যোগাযোগ করল। কীশা পাথরের মতো মুখ করে অপেক্ষা করছে। ইরন জিজ্ঞেস করল, তোমার কি ভয় করছে?
হ্যাঁ।
চমৎকার–কারণ আমরা যেটা করতে চাইছি সেটা খুব ভয়ের ব্যাপার। ভয় পাওয়ারই কথা।
কীশা কোনো কথা বলল না। ইরন আবার বলল, আমরা যে ক্যাপসুলের মাঝে আছি সেটি অত্যন্ত নিরাপদ, অনেকটা মাতৃগর্ভে থাকার মতো। কাজেই তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পার।
আমি ঘুমাতে চাই না।
বেশ। যেরকম তোমার ইচ্ছা। আমরা যখন ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করব তখন কী দেখব আমি জানি না। স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রে অনেক বড় ওলটপালট হয়ে যাবে, আশা করছি এই মহাকাশযানটি এক জায়গায় থাকবে, এর একেকটি অংশ যেন একেক শতাব্দীতে একেক। গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে না পড়ে।
সেরকম হতে পারে?
ইরন হেসে ফেলল, বলল, নিশ্চয়ই হতে পারে। বিস্ফোরণের প্রচও ঝাঁপটায় আমরা ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারি। তোমরা তো শুনেছ সাফল্যের সম্ভাবনা মাত্র দশমিক শূন্য তিন!
ক্যাপসুলের ভিতরে মনোযোগ আকর্ষণ করে বিপ ধরনের একটি শব্দ হল এবং সাথে সাথে একটি যান্ত্রিক গলা শোনা গেল, মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের সতর্ক করা যাচ্ছে। আর ষাট সেকেন্ড পর এই মহাকাশযানটি একটি বিস্ফোরণের সম্মুখীন হবে।
ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল, মহাকাশযান থেকে এন্টি ম্যাটার নিয়ে রকেট দুটি রওনা দিয়েছে। মহাকাশযানের ভর কেন্দ্রের পরিবর্তন হওয়াতে পুরো মহাকাশযানটি ভয়ানকভাবে দুলে উঠল। ক্যাপসুলের বাইরে থাকলে বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। সে ক্যাপসুলের ভিতরে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকায়। ভয়ঙ্করদর্শন উজ্জ্বল লাল রঙে সময় দেখানো হচ্ছে, এক মিনিট খুব বেশি সময় নয় কিন্তু সেই সময়টাকে হঠাৎ খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
ইরন শান্ত গলায় বলল, কীশা, ত্ৰালুস এবং শুমান্তি, আমরা সত্যি সত্যি ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব কি না জানি না, যদি না পারি তোমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছি। যদি এই মুহূর্তটিই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত হয়ে থাকে তা হলে সেই মুহূর্তটিকে অর্থবহ করার জন্য তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ত্রালুস নিচু গলায় বলল, আমি এত সুন্দর করে বলতে পারব না কিন্তু একই জিনিস বলতে চাই। তোমাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ।
শুমান্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি বিদায় নেব না, আমি সবার জন্য শুভ কামনা করছি।
কীশা কাঁপা গলায় বলল, ধন্যবাদ শুমান্তি।
এবং ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত মহাকাশযানটি দুলে উঠল। মহাকাশযানের আলো নিভে গিয়ে নিভুনিভু হয়ে জ্বলতে থাকে। কর্কশ এলার্মের শব্দ মহাকাশযানটিকে এক ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে নেয়।
ইরন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। পদার্থ–প্রতিপদার্থের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে অচিন্তনীয় ভরকে কেন্দ্রীভূত করে স্থান এবং সময়ের ক্ষেত্রকে ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ছিন্ন ক্ষেত্রের অন্যপাশে এক বিচিত্র জগৎ অপেক্ষা করছে। ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন স্থান। হয়তো দূর কোনো গ্যালাক্সি, অন্য কোনো নক্ষত্র, কোনো ব্ল্যাকহোল বা কোয়াজারের কাছাকাছি। কোনো অজানা গহ, অজানা জগৎ। সেই দূর জগতে ভিন্ন এক সময়ে তারা পৌঁছাবে কয়েক মুহূর্তে। ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
চারপাশের দৃশ্য দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বৃহস্পতি গ্রহটি যেন চোখের সামনে গলে তরল পদার্থের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের গ্রহ নক্ষত্র গ্রহাণুপুঞ্জ যেন বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে, তার মাঝে ধীরে ধীরে নিকষ কালো একটি অন্ধকার গহ্বর বের হয়ে এল। সেই গহ্বরের মাঝে তাদের মহাকাশযান ছুটে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল, মহাকাশযানের আলো নিভে গেল। ইঞ্জিনের গর্জন, এলার্মের তীব্র শব্দ সবকিছু থেমে গেল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ ধদ্ধ করছে। ইরন কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, বুকের শব্দও ধীরে ধীরে থেমে আসছে। আলো নেই, অন্ধকার নেই, শব্দ নেই, নৈঃশব্দ্য নেই, বিচিত্র বোধশক্তিহীন এক জগতে সে ডুবে যাচ্ছে। পুরো মহাকাশযানটি অদৃশ্য এক জগতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইরন নিজের সমস্ত চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু বুঝতে পারে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে।
এটাই কি মৃত্যু? নাকি এটা নতুন জীবন?
১.৬ পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে
পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে বিশাল স্ক্রিনে মহাকাশযানটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটি কাঁপা গলায় বলল, ওয়ার্মহোলে প্রবেশ করেছে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি বলল, কী মনে হয় তোমার প্রজেক্টটি কি সফল হবে?
আমরা এক্ষুনি সেটি দেখতে পারব! যদি সফল হয় তা হলে তারা এক্ষুনি বের হয়ে আসবে। তাদের হিসাবে যত সময়ই লাগুক আমাদের হিসাবে সেটা হবে কয়েক মুহূর্ত।
নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মানুষগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
২.১ মহাকাশযানটি আশ্চর্য রকম নীরব
মহাকাশযানটি আশ্চর্য রকম নীরব। গতিবেগ বাড়ানোর বা কমানোর সময় তার শক্তিশালী ইঞ্জিনটি চালু করা হয় তখন তার চাপা গুমগুম শব্দ অনুভব করা যায়। এখন এটি একটি বোয়াইট ডোয়ার্ফ২২ ধরনের সাধারণ নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলে আটকা পড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ইঞ্জিনগুলো চালু করে রাখা নেই বলে কিছু বোঝার উপায় নেই। মহাকাশযানের গোলাকার জানালাগুলো দিয়ে বাইরে তাকালে অপরিচিত নক্ষত্রগুলো চোখে পড়ে, সেগুলো দেখে মহাবিশ্বের কোথায় তারা চলে এসেছে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই।
মহাকাশযানের অপ্রয়োজনীয় আলোগুলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে বলে পুরো মহাকাশযানে এক ধরনের কোমল আলো এবং অন্ধকার। মহাকাশযানের তীব্র চোখ ধাঁধানো আলো নেই বলে এখানে এক ধরনের শান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ইরন মহাকাশযানের গোল জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকার মহাকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মহাকাশযানের এই শান্ত পরিবেশটুকু আসলে তাদের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন নয়। তারা ভিতরে ভিতরে অশান্ত এবং অস্থির। কোথায় আছে এবং কোথায় যাচ্ছে জানে না বলে কিছুতেই স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছে না, ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছে না। মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার গত কয়েকদিন থেকে হিসাব করে যাচ্ছে, মহাকাশযানের তথ্যকেন্দ্রে রাখা মহাকাশের গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের তালিকার সাথে চারপাশের নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে বের করার চেষ্টা করছে তারা এখন কোথায়। কিন্তু এখনো কোনো লাভ হয় নি।
ইরন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে মহাকাশযানের ডকিং বে৩ এর দিকে হাঁটতে থাকে। জায়গাটা মহাকাশযানের বাইরের দিকে, সেখানে বিশাল গোলাকার স্বচ্ছ ছাদের ভিতর দিয়ে বাইরে দেখা যায়, বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় তারা কত ক্ষুদ্র ব্যাপারটি হঠাৎ করে নতুনভাবে যেন তারা অনুভব করতে পারে।
ইরন মহাকাশযানের মূল লিফটে করে উপরের দিকে যেতে থাকে। বড় একটা করিডোর ধরে হেঁটে দ্বিতীয় একটি লিফটে করে ডকিং বেতে হাজির হল। গোলাকার ঘরটির মাঝামাঝি জায়গায় বসার জন্য আরামদায়ক কিছু চেয়ার সাজানো রয়েছে। তার একটিতে ত্রালুস এবং শুমান্তি পাশাপাশি অন্তরঙ্গভাবে বসে আছে। ইরনকে দেখে দুজনেই অবাক হয়ে। তার দিকে তাকাল। এই ডকিং বেতে সে আগে কখনো আসে নি। ইরন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমরা এখানে? সময় কাটানোর জন্য ভালো একটা জায়গা পেয়েছ মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, খুব সুন্দর জায়গা। ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, এখানে বসে বাইরে তাকাতে খুব ভালো লাগে।
শিল্ডিংয়ের কী অবস্থা কে জানে। বাড়াবাড়ি রেডিয়েশান হলে এখানে থেকো না।
ত্রালুস মাথা নাড়ল, বলল, না, থাকব না।
ইরন একটা চেয়ারে বসে উপরের দিকে তাকাল। নিকষ কালো অন্ধকারে নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করছে। মাঝামাঝি একটা স্পাইরাল গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে। দূরে দুটি নক্ষত্রপুঞ্জ। এই আকাশের একটি নক্ষত্রকেও তারা আগে কখনো দেখে নি। ইরন আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকাল, বলল, তোমরা নিশ্চয়ই খুব অস্থির হয়ে আছ, নিশ্চয়ই খুব অশান্তিতে রয়েছ। আমি দুঃখিত যে এ রকম একটা অবস্থায় আছি অথচ কিছু করতে পারছি না।
ত্রালুস এবং শুমান্তি অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকাল। ত্ৰালুস একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু ইরন
কী?
আসলে আমরা কিন্তু একেবারেই অশান্তিতে নেই। আমরা খুব আনন্দের মাঝে আছি। আমাদের আসলে খুব ভালো লাগছে।
ভালো লাগছে?
হ্যাঁ। কী চমৎকার শান্ত একটা পরিবেশ। নিরিবিলি সুমসাম। তা ছাড়া
তা ছাড়া?
তা ছাড়া আমরা তো আসলে খুব অস্বাভাবিক একটা পরিবেশে বড় হয়েছিলাম, কখনো নিজেদের ক্লোন ছাড়া অন্য কাউকে দেখি নি। নিজেদের ক্লোন আসলে নিজের মতো–তাদের সাথে থাকা আসলে নিজের সাথে থাকার মতো। তাদের সাথে কথাও বলতে হত। না, কারুণ, আমরা জানতাম অন্যেরা কখন কী ভাবছে, কখন কী বলবে!
তাই নাকি?
হ্যাঁ। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। এই যে আমার শুমান্তির সাথে দেখা হল, তার সাথে কথা বলছি, এটা যে কী আনন্দের তোমাকে বোঝাতে পারব না। সে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটা মানুষ, তার ব্যক্তিত্ব ভিন্ন, সব ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত আছে, চিন্তা করতে পার?
ইরন একটু অবাক হয়ে ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল, সে কখনোই চিন্তা করে নি মানুষের একেবারে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার–ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ব্যক্তিত্ব বা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারার ব্যাপারটি কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। সে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, তোমরা বলছ যে তোমরা খুব ভালো আছ!
হ্যাঁ। শুমান্তি এবং ত্রালুস একসাথে মাথা নাড়ল, বলল, আমরা খুব ভালো আছি।
তোমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাও না?
ত্রালুস এবং শুমান্তির মুখে ভয়ের একটা ছায়া পড়ল। কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে থাকে। তারপর শুমান্তি নিচু গলায় বলে, না, আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই না। এখানেই আমরা খুব ভালো আছি। পৃথিবীতে ফিরে গেলে আবার আমাদের ছোট একটা জায়গায় অন্য ক্লোনদের সাথে রাখবে। আমাদের নাম থাকবে না, পরিচয় থাকবে না। শুমাস্তি ভয়ার্ত মুখে মাথা নাড়তে থাকে।
ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে নিজের চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করত না যে কোনো মানুষ পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া থেকে এই মহাকাশযানে জীবন কাটিয়ে দেওয়াকে বেশি আনন্দদায়ক মনে করে। নামপরিচয়হীনভাবে থাকার ব্যাপারটি সে জানে না। ক্লোন করা বেআইনি, যারা করেছে তারা বড় অপরাধ করেছে। কিন্তু একবার করা হয়ে গেলে তাকে নিশ্চয়ই মানুষের সম্মান দিতে হবে। ইরন চিন্তিত মুখে বলল, পৃথিবীতে আমরা ফিরে যেতে পারব কি না জানি না। যদি যেতেও পারি তা হলে সেটি পৃথিবীর সময়ে কবে যাব জানি না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এই মহাকাশযানের মাঝে তো কেউ সারা জীবন কাটাতে পারবে না।
কেন পারবে না? আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি এখানে সবকিছু রি–সাইকেল২৪ করা যায়। কৃত্রিম খাবার তৈরি করা যায়–
ইরন হেসে বলল, সারা জীবন কৃত্রিম খাবার খেয়ে কাটিয়ে দেবে? একটা মহাকাশযানে?
কেন, তাতে অসুবিধে কী?
ইরন মাথা নাড়ল, তুমি যদি নিজে অসুবিধেটা বুঝতে না পার তা হলে কেউ তোমাকে বোঝাতে পারবে না। তা হলে বুঝতে হবে আসলেই কোনো অসুবিধে নেই।
ইরন মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। মহাকাশযানের অনেক ঘুঁটিনাটি তথ্য সে জানতে পারে যেটা অন্য কোনোভাবে তার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। যেমন সে জানত না মহাকাশযানে ব্যবহারের জন্য দেহের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে, যুদ্ধ করার জন্য প্রচুর অস্ত্র রয়েছে, বিনোদনের জন্য পৃথিবীর প্রাচীনতম সংগীতের সংগ্রহ রয়েছে এবং প্রার্থনা করার জন্য পৃথিবীর সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু তারা কোথায় আছে সেই তথ্যটি কোথাও নেই। উদ্দেশ্যহীনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই তাদের করার নেই।
ইরন তথ্যকেন্দ্র থেকে সরে এসে কীশাকে খুঁজে বের করল। সে মহাকাশযানের যোগাযোগ কেন্দ্রে বেশ কিছু যন্ত্রপাতির সামনে চিন্তিত মুখে বসে আছে। ইরনকে দেখে কীশা তার মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, কী খবর ইরন?
কোনো খবর নেই। আমার ধারণা অদূর ভবিষ্যতেও কোনো খবর থাকবে না। আমরা হারিয়ে গেছি।
হারিয়ে গেছি?
হ্যাঁ। মহাকাশযানকে যদি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম তা হলে একটা কথা ছিল!
তা হলে কী করতে?
ঠিক যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিক দিয়ে ফিরে যেতাম। মহাকাশযানের লগে পুরো গতিপথ রাখা আছে, ফিরে যাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। কিন্তু মহাকাশযানের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
কীশা কোনো কথা না বলে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে কীশার কাছে এগিয়ে যায়, তুমি কী করছ?
কীশা একটু ইতস্তত করে বলল, আমি মহাকাশের চারপাশে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়২৫ তরঙ্গ মাপছি।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, কেন?
কোথাও অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায় কি না দেখছি।
অস্বাভাবিক কিছু?
হ্যাঁ।
ইরন কীশার সামনে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো দেখল, এগুলো দৈনন্দিন ব্যবহারের যন্ত্র নয়, মহাকাশযানের প্রস্তুতির সময়েও তাদেরকে এগুলো দেখানো হয় নি। কীশা এগুলো খুঁজে পেল কেমন করে? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সে থেমে গেল। খানিকক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিক কী ধরনের অস্বাভাবিক সিগন্যাল খুঁজছ?
একটা বিশেষ কম্পন বা একাধিক বিশেষ কম্পন।
যদি খুঁজে পাও তা হলে কী হবে?
যদি খুঁজে পাই তার অর্থ আশপাশে কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে।
ইরন চমকে উঠে কীশার দিকে তাকাল, বুদ্ধিমান প্রাণী?
হ্যাঁ। পৃথিবী থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী এভাবেই খোজা হয়েছিল, মহাকাশের কোনো বিশেষ অংশ থেকে বিশেষ কোনো কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে কি না সেটা দেখা হয়। —
ও! ইরন কিছুক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কোনো বিশেষ সিগন্যাল পেয়েছ?
কীশা একটু হেসে বলল, না।
ইরন সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের একটি বিশেষ আলোকিত বিন্দুকে দেখিয়ে বলল, এটা কী?
এটা কিছু নয়। কীশা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, এটা ক্যালিব্রেশান সিগন্যাল।
ইরন আবার হেঁটে হেঁটে মহাকাশযানের খোলা অংশের দিকে যেতে থাকে, ঠিক কী কারণ সে জানে না কিন্তু কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে তার ভিতরে অস্বস্তি বাধছে, কিন্তু ব্যাপারটি কী সে বুঝতে পারছে না। খোলা ডকে একটা কালো আসনে সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, পাশের সুইচ স্পর্শ করতেই একটা ছোট পোর্ট হোল খুলে গিয়ে সেখানে কালো মহাকাশ ফুঠে ওটে। পোর্ট হোলের ঠিক মাঝখানে স্পাইরাল গ্যালাক্সিটিকে দেখা যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে বেশ কষ্ট করে খালি চোখে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে দেখা যায়। কিন্তু এখান থেকে এই গ্যালাক্সিটিকে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাঝখানে নক্ষত্রপুঞ্জের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল আলো, দুটি প্যাচানো অংশে লক্ষ কোটি নক্ষত্রের আলোক বিন্দু। দেখে মনে হয় সে বুঝি কোনো একটি টেলিস্কোপে চোখ রেখে বসে আছে। স্পাইরাল গ্যালাক্সিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইরনের চোখে ঘুম নেমে আসে। সে চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে বিচিত্র স্বপ্ন দেখে, অজানা একটি গ্রহে যেন সে হারিয়ে গেছে। গ্রহের লালচে মাটিতে সে হাঁটছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না, তার পা মাটিতে বসে যাচ্ছে। সে শুনতে পাচ্ছে দূরে কোথায় যেন একটি শিশু কাঁদছে, শিশুটির কাছে সে যেতে চাইছে কিন্তু যেতে পারছে না। যত তাড়াতাড়ি সে হাঁটতে চাইছে ততই যেন তার পা মাটিতে আরো শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে। মাটিতে শুয়ে সে শক্ত লাল পাথরে খামচে খামচে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু যেতে পারছে না। ধারালো পাথরের আঘাতে তার হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে ওঠে এবং সাথে সাথে তার ঘুম ভেঙে গেল।
ইরন ধড়মড় করে উঠে বসল। মহাকাশযানের আবছা অন্ধকারে পুরোপুরি জেগে উঠতে তার আরো কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটি ধধ করে শব্দ করছে। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। সে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে পোর্ট হোলের দিকে তাকাল, বাইরে এখনো নিকষ কালো অন্ধকার। এখনো সেখানে জ্বলজ্বলে কিছু নক্ষত্র এবং সেই বিচিত্র আলোকোজ্জ্বল স্পাইরাল গ্যালাক্সি। গ্যালাক্সিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইরন হঠাৎ চমকে উঠল, এটি পোর্ট হোলের ঠিক মাঝখানে ছিল কিন্তু এখন সেটি মাঝখানে নেই, ডান পাশে একটু সরে গেছে।
এটি হতে পারে শুধুমাত্র একটি জিনিস ঘটে থাকলে, মহাকাশযানটি যদি তার গতিপথের দিক পরিবর্তন করে থাকে।
ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, মহাকাশযানটিকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না, হঠাৎ করে কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল? কীভাবে?
ইরন উঠে দাঁড়ায়, ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কী হচ্ছে তাকে বুঝতে হবে, সবচেয়ে আগে কীশাকে খুঁজে বের করতে হবে। যোগাযোগ মডিউলটি হাতে নিয়ে কীশাকে ডাকতে গিয়ে সে থেমে গেল। যোগাযোগ কেন্দ্রে কীশা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের পরিমাপ করছিল, এখনো হয়তো সেখানেই আছে। ঘরটির সামনে গিয়ে ইরন থমকে দাঁড়ায়, বাইরের দরজাটি বন্ধ। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে সে ভিতরে তাকাল। বড় হলোগ্রাফিক মনিটরে বিশেষ আলোকিত বিন্দুটি ধীরে ধীরে আরো বড় হয়ে উঠছে। বিন্দুটিকে কীশা ক্যালিব্রেশান বলে দাবি করছে কিন্তু তা হলে তার বড় হওয়ার কথা নয়–সব সময় একই আকারের থাকার কথা। এটি ক্যালিব্রেশানের বিন্দু নয়, এটি সত্যিকারের সিগন্যাল।
ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে হলোগ্রাফ্রিক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য। কিন্তু পুরো ব্যাপারটিকে শুধুমাত্র একভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। মহাকাশের এই অংশে কোথাও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে, তাদের সিগন্যাল লক্ষ্য করে এই মহাকাশযানটি দিক পরিবর্তন করে এখন সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
ইরন যোগাযোগ মডিউলটি হাতে নিয়ে কীশাকে ডাকতে গিয়ে আবার থেমে গেল, কেন তার মনে হচ্ছে কীশা পুরো ব্যাপারটি জানে?
কেন তার মনে হচ্ছে কীশা পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করছে?
২.২ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সামনে
নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সামনে বড় টেবিলটা ঘিরে চার জন বসে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সামনে বিশাল স্ক্রিনটাতে একটা ছোট বিচিত্র গ্রহ দেখা যাচ্ছে। গ্রহটি প্রায় অস্পষ্ট ছিল, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে। গত কয়েক ঘণ্টায় এই স্ক্রিনে গ্রহটির আকার বড় হতে শুরু করেছে। গ্রহটির রং সবুজ এবং বেগুনি মেশানো, রংগুলো দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে বলে এটিকে একটি জীবন্ত প্রাণী বলে মনে হয়। সবুজ এবং বেগুনি রং পাশাপাশি খুব বেশি দেখা যায় না, তাই পুরো গ্রহটিকে হঠাৎ দেখে বীভৎস কিছু মনে হয়। এই গ্রহটি থেকে নির্দিষ্ট কিছু কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সংকেত আসছিল, এই সংকেত লক্ষ্য করে মহাকাশযানটি তার দিক পরিবর্তন করে গ্রহটির দিকে ছুটে যেতে শুরু করেছে।
ইরন তার আঙুল দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে শব্দ করছিল, হঠাৎ করে থেমে গিয়ে সে নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল, কীশা, আমরা কি তোমার সাথে খোলাখুলি কথা বলতে পারি?
কীশা একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, পার।
ইরন সোজা হয়ে বসে কীশার দিকে তাকাল, তুমি কি আমাদের বলবে এখানে কী হচ্ছে?
আমি? কীশা একটু অবাক হয়ে বলল, আমি কেমন করে বলব?
কারণ তুমি নিশ্চিতভাবে কিছু জিনিস জান, যেটা আমরা জানি না।
যেমন?
যেমন তুমি জান যে চতুর্দিক থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করার যন্ত্রপাতি এই মহাকাশযানে রয়েছে। আমরা কেউ সেটা জানতাম না। যেমন তুমি সেই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জান, একই অভিযানের ক্রু হয়েও সেটা আমরা জানি না। যেমন তুমি জান এখানে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শক্তি পরিমাপ করা হলে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। যেমন তুমি–।
কীশা হাত তুলে ইরনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি যেটা বলছ তার বেশিরভাগই তো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার।
না। ইরন মাথা নেড়ে বলল, সাধারণ না। এর যে কোনো একটি ব্যাপার যদি ঘটত আমি বলতাম সাধারণ ব্যাপার, কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু একটি ঘটে নি। অনেকগুলো ঘটেছে। তুমি সবসময় বলে এসেছ তুমি বিজ্ঞানী নও, তুমি বিজ্ঞানের কিছু জান না। কিন্তু তোমার প্রত্যেকটি কথা প্রত্যেকটি কাজ প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর মতো। মনে আছে তুমি আমাকে ওয়ার্মহোল তৈরি করে তার ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসার কথা বলেছিলে? তুমি জান পৃথিবীর কতজন মানুষ এটা বলতে পারবে?
কীশা অবাক হয়ে বলল, কিন্তু আমি সেটা একটা ছেলেমানুষি তথ্যকেন্দ্র থেকে শিখেছি! আমি কখনোই এর বেশি কিছু জানি না।
তুমি টাইটানিয়াম রড দিয়ে আঘাত করে বর্গেনের মাথা খুলে দিয়েছিল। তুমি নিশ্চিতভাবে জানতে একটা রবোটের ঠিক কোথায় কত জোরে আঘাত করতে হয়।
না জানতাম না।
ইরন হিংস্র চোখে বলল, জানতে।
না। জানতাম না।
আমি বলব, তুমি কেন জানতে?
কেন?
কারণ তুমি আমাদের দেখাতে চাইছিলে যে বর্গেন এই মহাকাশযানের রোবট। তুমি তাকে শেষ করে দিয়ে এই মহাকাশযান থেকে রোবটদের দূর করেছ। আমাদেরকে নিশ্চিন্ত রাখতে চেয়েছিলে।
কীশা তীক্ষ্ণ চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
তুমি খুব ভালো করে জান, আমি কী বলতে চাইছি। ইরন দাতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, তুমি এই মহাকাশযানের প্রকৃত রোবট।
আমি? কীশা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমি?
হ্যাঁ। ইরন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি দেখতে চাও?
কীশা কাতর মুখে বলল, কীভাবে দেখাবে?
আমি টাইটানিয়ামের রডটি নিয়ে তোমার মাথায় আঘাত করব, আর তোমার মাথাটি খুলে ছিটকে গিয়ে পড়বে। তোমার নাক মুখ দিয়ে কপোট্রনের শীতল করার হলুদ রঙের তরল ফিনকি দিয়ে বের হবে, তোমার চোখের ফটোসেল ঘোলা হয়ে যাবে
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। ইরন প্রায় ছুটে গিয়ে দেয়াল থেকে টাইটেনিয়ামের রডটি খুলে নেয়। এবং সাথে ত্ৰালুস আর শুমান্তি ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। ত্রালুস ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী করছ তুমি ইরন?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না আমি কী করছি। কিন্তু আমি হঠাৎ করে অনেক কিছু বুঝতে পারছি। অনেক কিছু।
কী বুঝতে পারছ?।
সেটি এখন বলে কোনো লাভ নেই ত্রাস। শুধু জেনে রাখ আমাদের নিয়ে একটি খুব ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়েছে। আমরা সেই খেলার খেলোয়াড় নই। আমরা সেই খেলার গুটি।
শুমান্তি ইরনের হাত থেকে টাইটানিয়ামের রডটি সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলল, ইরন। আমি খুব সাধারণ একজন ক্লোন, আমি হয়তো কিছু বুঝি না। কিন্তু তবু আমার কেন জানি মনে হয়, আমাদের এখন প্রত্যেকের প্রয়োজন রয়েছে। এখন কাউকে আঘাত করার সময় নয়।
রোবট হলেও?
রোবট যদি মানুষের মতো হয় তাহলে কেন মিছিমিছি তাকে রোবট বলে সরিয়ে রাখবে?
ইরন অদ্ভুত একটি দৃষ্টিতে শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। শুমান্তি নরম গলায় বলল, ইরন। তুমি কেমন করে জানো আমরা রোবট নই?
আমি জানি না।
শুমান্তি একটা নিশ্বাস ফেলে ফলল, আমিও জানি না।
কীশা এতক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিল। এবারে উঠে এসে বলল, কিন্তু আমি জানি আমি রোবট নই। আমার স্বামী ছিল, দুজন সন্তান ছিল। আমি আমার সন্তানদের পেটে ধরেছিলাম, তাদের জন্ম দিয়েছিলাম। একটা দুর্ঘটনায় তাদের সবাইকে আমি হারিয়েছিলাম– আমার নিজেরও বেঁচে থাকার কথা ছিল না। কীভাবে কীভাবে জানি বেঁচে গেছি।
ইরন শীতল চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুমি সত্যিই দেখতে চাও আমি সত্যিই মানুষ নাকি রোবট?
ইরন কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে দেখল কীশার হাতে একটা ধারালো ছোরা এবং কিছু বোঝার আগেই কীশা তার হাতটা টেবিলে রেখে ধারালো ছোরাটি হাতের তালুতে বসিয়ে দেয়। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে।
শুমান্তি একটা আর্তচিৎকার করে কীশাকে ধরে ফেলল। কীশা নিচু গলায় বলল, এটা সত্যিকার রক্ত। একফোঁটা নিয়ে বায়ো মডিউলে প্রবেশ করিয়ে দেখ। আমার পুরো জিনেটিক কোডও সেখানে পেয়ে যাবে।
ত্রালুস এবং শুমান্তি কীশাকে ধরে মহাকাশযানের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে থাকে। কীশা তার কেটে যাওয়া হাতটি ধরে কাতর গলায় বলল, ইরন। আমি আজ তোমার ব্যবহারে খুব দুঃখ পেলাম। খুব দুঃখ পেলাম।
ইরন তবু কোনো কথা বলল না, স্থির চোখে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর সে টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। টেবিল থেকে সাবধানে একফোঁটা রক্ত তুলে নেয়। সে সত্যি সত্যি এই রক্তকে বায়ো মডিউলে প্রবেশ করিয়ে দেখবে।
বায়ো মডিউলের ভিতরে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল, প্রায় সাথে সাথেই বড় স্ক্রিনে কীশার রক্তের বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেল, ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে, কীশা মিথ্যে কথা বলে নি, সত্যি সত্যি এটি মানুষের রক্ত। তার ডি, এন, এ. বিশ্লেষণ করে জৈবিক গঠনের পুরো তথ্য চলে আসতে থাকে, কীশা একজন তেজস্বী এবং সাহসী মহিলা। আবেগপ্রবণ এবং স্নেহশীল। একাধিক সন্তানের মাতা। বড় দুর্ঘটনায় দীর্ঘ সময় শয্যাশায়ী। ঠিক যেরকম কীশা দাবি করেছিল। ইরন বায়ো মডিউলটি বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল, রক্তের মাঝে অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণের গ্রুপ তিনের ধাতব পদার্থ। মানুষের শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় এটি থাকার কথা নয়, কীশার শরীরে কেন আছে কে জানে।
ইরন খানিকক্ষণ বায়ো মডিউলের সামনে বসে থেকে অন্যমনস্কভাবে উঠে এল। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বড় স্ক্রিনটিতে কুৎসিত গ্রহটি আরো একটু বড় হয়েছে, যার অর্থ মহাকাশযানটি আরো কাছে এগিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের মনিটরটি থেকে একটা চাপা শব্দ আসছে, নিশ্চয়ই তরঙ্গের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। ইরন একটা নিশ্বাস ফেলল, এর আগে সে কখনো এত অসহায় অনুভব করে নি। বুদ্ধিমান প্রাণীর একটা গ্রহের দিকে তাদের মহাকাশযানটি এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাদের কিছু করার নেই। তারা কেন যাচ্ছে সেটিও তারা। জানে না। প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কেও তাঁদের কোনো ধারণা নেই। বুদ্ধিমত্তায় তারা কি সেই প্রাণীদের সমান নাকি অনেক নিচে? যদি অনেক নিচে হয়ে থাকে তা হলে কী করবে? কিছু কি করার আছে?
ইরন খানিকক্ষণ স্ক্রিনটার নিচে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। কীশা তার ঘরের মাঝামাঝি বিছানায় নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় প্রাণহীন কিন্তু ভালো করে তাকালে দেখা যায় খুব ধীরে ধীরে তার বুক ওঠানামা করছে, কীশা প্রাণহীন নয়, গভীর ঘুমে অচেতন। কীশার মুখের দিকে তাকিয়ে ইরনের নিজের ভিতরে এক ধরনের অপরাধবোধের সৃষ্টি হল। মেয়েটি খুব দুঃখী, তাকে আবার সে নতুন করে আজ দুঃখ। দিয়েছে।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে শুমান্তি আর জালুসের ঘরে উঁকি দিল, তারা তাদের ঘরে নেই। নিশ্চয়ই অবজারভেটরিতে বসে আছে। নিজের অজান্তেই ইরনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, এই দুজন একেবারে ছোট শিশুদের মতো। একজনের কাছে আরেকজন হচ্ছে একটা খেলনা, সেই খেলনা যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ইরন নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা স্পর্শ করতেই সেটা খুলে গেল। ঘরের মাঝামাঝি তার বিছানাটি ঝুলছে। ইরন পোশাক পাল্টে বিছানার মাঝে ঢুকে গেল। ঘরের আলো কমে আসে, তাপমাত্রা নেমে যেতে থাকে, মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসে ঘরে, তার সাথে হালকা এক ধরনের সঙ্গীত। ইরন দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে একসময় গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
ইরনের ঘুম ভাঙল হঠাৎ করে, কেন ভাঙল সে বুঝতে পারল না, শুধু মনে হল খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে। সে ধড়মড় করে তার বিছানায় উঠে বসে। তার ঘরে কর্কশ এক ধরনের উজ্জ্বল আলো, সেই আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘরের মেঝেতে হাঁটুতে মুখ রেখে কীশা বসে আছে। কীশার পাশে একটা ভয়াবহ ধরনের অস্ত্র শক্তিশালী, লেজারচালিত, বিস্ফোরকনির্ভর এবং আধুনিক। এটি ব্যবহার করে প্রয়োজনে সম্ভবত পুরো মহাকাশযানকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে।
ইরন অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকাল, বলল, কীশা, তুমি এখানে কী করছ?
কীশা খুব ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল, ইরন দেখতে পেল তার গালে চোখের পানি চিকচিক করছে। হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে সে নিচু গলায় বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে ইরন।
আমি কী ঠিক বলেছিলাম?
আমি আসলে রোবট।
ইরন চমকে উঠে বলল, কী বললে?
হ্যাঁ। একটু আগে আমি জানতে পেরেছি।
কী বলছ তুমি? আমি তোমার রক্ত পরীক্ষা করে দেখেছি–
সেটা কীশার রক্ত। আমার শরীরটা কীশার মস্তিষ্কটা কীশার নয়। অ্যাক্সিডেন্টের পর সেটা পাল্টে দিয়েছে। আমার রক্তে তুমি নিশ্চয়ই গ্রুপ থ্রি ধাতব পদার্থের অবশিষ্ট পেয়েছ। পাও নি?
হ্যাঁ।
আমার কপোট্রনের চিহ্ন, নতুন ধরনের কপোট্রন রক্ত দিয়ে শীতল করতে পারে।
ইরন তার বিছানা থেকে নেমে এল, বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, আমি বিশ্বাস করি না কীশা।
তাতে কিছু আসে–যায় না। আমি বিশ্বাস করি। আমার কপোট্রনে সব প্রোগ্রাম করে রাখা ছিল, যখন যেই তথ্যের প্রয়োজন হয়েছে তখন সেই তথ্যটি বের করে দেওয়া হয়েছে। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলে। এখন আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। এখন আর কিছু গোপন রাখার নেই, তাই আমাকে পুরো তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন সবকিছু জানি? প্রজেক্ট আপসিলন কী, কেন শুরু হয়েছে, কারা শুরু করেছে, আমি সবকিছু জানি।
কারা শুরু করেছে? কেন শুরু করেছে?
জানতে চেয়ো না, ঘেন্নায় বমি করে দেবে।
ইরন একটু অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। কীশা মাথা নিচু করে বলল, এই অভিযানে আমরা সবাই পরিত্যাগযোগ্য তুচ্ছ ব্যবহারিক সামগ্রী। আমাদের নিজেদের কারো কিছু করার নেই। আমাদেরকে অত্যন্ত কৌশলে এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন ব্যবহার শেষ হবে আমাদেরকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। বর্গেনের কথা মনে আছে?
ইরন মাথা নাড়ল।
তার পরিণতিটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। পরিকল্পিত ব্যাপার ছিল। আমি তখন জানতাম না, এখন জানি।
আমার ব্যাপারটা?
তোমারটাও। তুমি একমাত্র বিজ্ঞানী যে ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পার। তাই তোমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তোমার জীবনকে ইচ্ছে করে দুর্বিষহ করে দেওয়া হয়েছিল যেন তুমি প্রজেক্ট আপসিলনে যোগ দাও।
ইরন অবাক হয়ে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। তার অবাক হবার ক্ষমতাও শেষ হয়ে গেছে। ইরন খানিকক্ষণ মেঝেতে হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকা কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, এখন কী হবে কীশা?
খুব খারাপ একটা জিনিস হবে ইরন। তুমি জানতে চেয়ো না।
যদি খুব খারাপ একটা জিনিস হবে তা হলে তুমি সেটা বন্ধ করছ না কেন?
কারণ আমার বন্ধ করার ক্ষমতা নেই। কারণ আমি তুচ্ছ একটা রোবট। কারণ আমাকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমাকে ঠিক সেভাবেই কাজ করতে হবে।
ইরনের বুকের ভিতরে হঠাৎ ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়, সে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে?
তুমি দেখতে পাবে ইরন।
ইরন কীশার আরো কাছে এগিয়ে যাবার জন্য এক পা এগুতেই হঠাৎ বিদ্বেগে কীশা তার পাশে শুইয়ে রাখা অস্ত্রটি তুলে ইরনের দিকে তাক করল, মুহূর্তে তার মুখ ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে যায়, তার চোখ ধিকিধিকি করে জ্বলতে শুরু করে। কীশা হিসহিস করে যান্ত্রিক গলায় বলল, আমার কাছে এসো না ইরন। আমাকে আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করি না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় তোমাকে খুন করে ফেলতে পারি।
কী বলছ তুমি কীশা? তুমি কেন আমাকে খুন করে ফেলবে– ইরন কীশার দিকে আরো এক পা এগিয়ে গেল। সাথে সাথে কীশা অস্ত্রটির ট্রিগার চেপে ধরে, প্রচণ্ড শব্দে সমস্ত মহাকাশযান কেঁপে ওঠে, বিস্ফোরকের ধোঁয়ায় এবং ঝাঁজালো গন্ধে সমস্ত ঘর মুহূর্তে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কিছু একটার প্রচণ্ড আঘাতে ইরন দেয়ালে ছিটকে গিয়ে পড়ে। দেয়ালে আঁকড়ে কোনোমতে উঠে বসে ইরন বিস্ফারিত চোখে একবার কীশার দিকে এবং আরেকবার নিজের দিকে তাকাল। কাঁধের কাছে খানিকটা অংশ ঝলসে গেছে, কপালে কোথাও কেটে গেছে, রক্তে বাম চোখটা ঢেকে যাচ্ছে।
কীশা হাঁটু গেড়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে কাতর গলায় বলল, ইরন, দোহাই তোমার, তুমি আমার কাছে এসো না। আমি কীশা নই–আমি একটা রোবট। আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
ইরন দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে বলল, আসব না।
কীশা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ইরন। আমার ভিতরের মানবিক একটা অংশে এখনো তোমাদের সবার জন্য ভালবাসা রয়েছে। আর রবোটের অংশ বলছে প্রয়োজন হলে সবাইকে শেষ করে দিতে। আমি জানি না, আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারব কি না– কীশা হঠাৎ হাউমাউ করে কেদেঁ উঠল।
ইরন হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ক্ষতস্থান মুছে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটি সত্যি ঘটছে। মনে হচ্ছে পুরোটা বুঝি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। বিস্ফোরণের শব্দে ত্ৰালুস এবং শুমান্তি ছুটে এসেছে। তারা ইরনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।
কীশা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে ধরে উঠে দাঁড়াল। কাউকে সরাসরি উদ্দেশ্য না করে নিচু গলায় বলল, আমি খুব দুঃখিত যে এটা ঘটছে, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।
কেউ কোনো কথা বলল না। কীশা একটা নিশ্বাস ফেলে ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে এসো। ইরনের রক্ত বন্ধ করা দরকার।
ত্রালুস বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এখানে কী ঘটছে। আমি–
এই মহাকাশযানে এখন কেউ আর কিছু বুঝতে পারবে না। শুধু জেনে রাখ আমি তোমাদের পরিচিত কীশা নই। আমি একটি রোবট। ইরন যেটা সন্দেহ করেছিল, সেটা সত্যি।
ও।
যাও।
ত্রাস এবং শুমান্তি ছুটতে ছুটতে চলে গেল। ইরন হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে রেখে বলল, এখন কী হবে কীশা?
তোমরা দেখতে পাবে।
দেখতে পাব?
হ্যাঁ। আমি–আমি এই গ্ৰহটাতে যাব।
ইরন চমকে উঠল, এই গ্ৰহটাতে যাবে?
হ্যাঁ।
তুমি কেন এই গ্ৰহটাতে যাবে?
কারণ সেখানে নিনীষ স্কেলে পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিমান প্রাণী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?
হ্যাঁ।
কেন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে?
কারণ তাদের জন্য আমার একটি জিনিস নিয়ে যাবার কথা।
কী জিনিস?
সেটা এখন আর্কাইভ ঘরে আছে।
কী আছে আর্কাইত ঘরে?
কীশা কাতর গলায় বলল, আমাকে তুমি সেটা জিজ্ঞেস কোরো না। দোহাই তোমার। তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার খুব কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়।
ঠিক আছে জিজ্ঞেস করব না।
ত্রাস এবং শুমান্তি দুই হাতে টেনে মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে এসে ইরনের ঘরে ঢুকল। ভিতর থেকে টেনে যন্ত্রপাতি বের করে তারা ইরনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। মেডিক্যাল কিটের মনিটরে আঘাতের বর্ণনা বের হয়ে এসেছে। এমন কিছু গুরুতর আঘাত নয়, দ্রুত সেরে উঠবে।
ইরন জানত সে দ্রুত সেরে উঠবে। তাকে ওরা হত্যা করবে না। কিছুতেই হত্যা করবে না। ত্রালুস এবং শুমান্তিকে নিয়ে সে নিশ্চিত নয়, কিন্তু তাকে ওরা এত সহজে হত্যা করবে না।
২.৩ ছোট করিডোর ধরে ওরা চার জন
ছোট করিডোর ধরে ওরা চার জন আর্কাইভ ঘরটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের একেবারে অন্য মাথায় একটা ছোট এলিভেটরে করে ওরা উপরে উঠে এল। সরু আরেকটা করিডোর ধরে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ওরা আর্কাইভ ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ায়। সুইচ স্পর্শ করে দরজা খুলতে গিয়ে শুমান্তি হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
ইরন জিজ্ঞেস করল, কী হল শুমান্তি?
শুমান্তি ইরনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ভিতরে কী একটা শব্দ শুনেছি।
ইরন কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, সত্যি ভিতরে একটা শব্দ হচ্ছে। টুক টুক করে এক ধরনের শব্দ।
কীশা কঠিন গলায় বলল, দরজা খোল শুমান্তি।
শুমান্তি দরজা খুলল, এবং সাথে সাথে ভিতরে কী একটা যেন ঘরের এক পাশ থেকে ছুটে অন্য পাশে সরে গেল। শুমান্তি চমকে ওঠে, কে?
আর্কাইভ ঘরে নানা আকারের বাক্স এবং যন্ত্রপাতি ছড়ানো–ছিটানো রয়েছে। ঘরের মাঝামাঝি একটা চতুষ্কোণ বাক্স খোলা এবং তার ভিতরে একটা খোলা ক্যাপসুল। আকার দেখে বোঝা যাচ্ছে এটি একজন মানুষের জন্য তৈরি। মানুষটি এই ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে সে এখানে লুকিয়ে আছে। ইরন একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেল–সে মনে মনে আশা করছিল কীশা যে জিনিসটি নিনীষ স্কেলের পঞ্চম মাত্রার প্রাণীদের কাছে নিয়ে যাবে সেটি আর যা–ই হোক, কোন মানুষ যেন না হয়।
কীশা আলগোছে অস্ত্রটি ধরে রেখেছে, তার সামনে অন্য তিন জন হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে এবং ঠিক তখন আর্কাইভ ঘরের এক কোনায় একটি মাথা উঁকি দিল। কমবয়সী কিশোরী একটি মেয়ে, কুচকুচে কালো রেশমি চুল, কালো বড় ভীত চোখ। কেউ কোনো কথা না বলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, এই ফুটফুটে কিশোরী মেয়েটিকে একটি গ্রহে ভিন্ন এক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়া হবে?
মেয়েটি খানিকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? কেন এসেছ?
কেউ কোনো কথা বলল না, সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
কী হল? তোমরা কথা বলছ না কেন?
কীশা এবারে এক পা এগিয়ে যায়, নিশি, তুমি জান আমরা কে। তুমি জান তুমি এখানে কেন এসেছ।
মেয়েটি এবারে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আমি আসতে চাই নি। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে।
কীশা আরো এক পা এগিয়ে গেল, না নিশি, তোমাকে জোর করে পাঠায় নি, তুমি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছ।
না! মেয়েটি ভয় পেয়ে একটি আর্তচিৎকার করে উঠল, না। আমি ইচ্ছে করে আসি নি। আমি বুঝতে পারি নি।
তুমি তো বাচ্চা মেয়ে নও যে তুমি বোঝ নি। তোমাকে সবকিছু বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের একটা বিশাল পরীক্ষায় তুমি রাজি হয়েছ। তোমার দরিদ্র বাবা–মাকে অনেক সম্পদ দেওয়া হয়েছে। তারা পৃথিবীতে এখন সুখী মানুষ। তোমার ছোট একটা আত্মত্যাগের জন্য
আমি আত্মত্যাগ করতে চাই না। আমি আমার বাবা–মায়ের কাছে যেতে চাই! মেয়েটি হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল।
নিশি তুমি তো এখন আর তোমার বাবা–মায়ের কাছে যেতে পারবে না। তোমাকে এখানে পাঠানোর জন্য পৃথিবীর সকল সম্পদ একত্র করে এই মহাকাশ অভিযানটি শুরু হয়েছে। আমরা এখন সৃষ্টি জগতের অন্যপাশে। পৃথিবীর সময়ের সাথে এখানকার সময়ের কোনো মিল নেই।
মেয়েটি আর্কাইভ ঘরের আরো কোনায় সরে যেতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি তবুও পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাই। আমি এখানে থেকে যেতে চাই না।
নিশি! তুমি কী বলছ এসব? কীশার গলার স্বর হঠাৎ কঠোর হয়ে ওঠে। তুমি জিনেটিক পরিমাপে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ, তোমার চেহারা তোমার শরীর যেরকম নিখুঁত তোমার মস্তিষ্ক তোমার বুদ্ধিমত্তাও সেরকম নিখুঁত। আমি তোমার কাছে এ রকম ব্যবহার আশা করি না।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ হতে চাই নি। আমি সাধারণ একজন মানুষ হতে চাই–সাধারণ, খুব সাধারণ।
নিশি। তুমি এখন আর সাধারণ মানুষ হতে পারবে না। সাধারণ মানুষের সবকিছু হয় সাধারণ। তাদের আত্মত্যাগ হয় সাধারণ। তাদের অবদানও হয় সাধারণ। তুমি একজন অসাধারণ মানুষ, তোমার আত্মত্যাগ হতে হবে অসাধারণ, সেরকম তোমার অবদানও হবে অসাধারণ।
নিশি নামের কিশোরীটি তবুও আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।
শান্ত হও নিশি। তুমি জান তোমাকে শান্ত হতেই হবে।
নিশি ধীরে ধীরে মুখ তুলে কীশায় দিকে তাকাল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ইরনের দিকে তাকাল। ইরন মেয়েটির দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিশি এবারে তালুসের দিকে তাকাল, জালুস তার চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে মাথা নিচু করল। নিশির চোখে–মুখে এক ধরনের অসহায় ভাব ফুটে ওঠে। সে অনেক আশা নিয়ে শুমান্তির দিকে তাকাল, শুমান্তি কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। নিশি হঠাৎ করে। হাল ছেড়ে ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। খুব ধীরে ধীরে তার চোখ–মুখের ব্যাকুল অসহায় ভাব কেটে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। সে চোখ মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, এ রকম করে বিচলিত হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। আমি আর বিচলিত হব না। বল আমাকে কী করতে হবে?
চমৎকার! কীশা মিষ্টি করে হেসে বলল, চল আমার সাথে।
নিশি আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। পাতলা এক ধরনের নিও পলিমারের কাপড় তার ছিপছিপে কিশোরী দেহকে ঢেকে রেখেছে। জীবন রক্ষাকারী যন্ত্র থেকে বাতাস বের হচ্ছে, সেই বাতাসে নিশির চুল উড়ছে। দেহের কাপড় উড়ছে, সে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে এ দৃশ্যটি কেন জানি এক গভীর বেদনায় ইরনের বুক ভেঙে ফেলতে চায়। অনিন্দ্যসুন্দরী এই কিশোরীটি যেন পৃথিবীর কোনো প্রাণী নয় যেন স্বর্গ থেকে কোনো দেবী নেমে এসেছে। ইরন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল, দেখতে পেল কীশা হাত ধরে স্বর্গের এই দেবীকে নিয়ে যাচ্ছে।
কয়েক মিনিট পর তারা স্কাউটশিপের গর্জন শুনতে পায়, মহাকাশযান থেকে একটা স্কাউটশিপে করে কীশা গা ঘিনঘিন করা সবুজ এবং বেগুনি রঙের গ্রহটিতে নেমে যাচ্ছে। গ্রহটি যেন নরক। স্বর্গ থেকে নেমে আসা একটি দেবীকে সেই নরকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। তাদের কারো কিছু করার নেই, পুরো ব্যাপারটি অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
.
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ইরন মাথা নিচু করে দুই হাতে তার মাথার চুল আঁকড়ে বসে আছে। তার সামনে কাছাকাছি এলুস এবং শুমান্তি। ইরন একসময় মাথা তুলে তাকাল, একবার ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল, আমরা কী করতে পারি বলবে?
ত্ৰালুস এবং শুমান্তি কিছু বলল না, ইরন আবার বলল, আমাদের কি কিছু করার আছে?
এবারেও ত্রাস আর শুমান্তি চুপ করে রইল। ইরন হাত দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বলল, ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়েকে পৃথিবী থেকে ধরে এনেছে এখানকার প্রাণীদের হাতে তুলে দেবার জন্য; বিশ্বাস করতে পার তোমরা? অথচ পুরো ব্যাপারটি আমাদের দেখতে হল, আমরা একটা কিছু করতে পারলাম না। ইরন ভাঙা গলায় বলল, আমি সারা জীবনে এ রকম অসহায় অনুভব করি নি!
শুমান্তি ইতস্তত করে বলল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি? তুমি যদি কিছু মনে না কর।
ইরন শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, বল।
আমি এই কথাটি নিশিকেও বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরিবেশটি এত ভয়ঙ্কর ছিল যে তখন কিছু বলতে পারি নি।
তুমি নিশিকে কী বলতে চেয়েছিলে
আমি তাকে বলতে চেয়েছিমান, নিশি তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমরা তোমাকে উদ্ধার করে আনব।
ইরন চমকে উঠে শুমান্তির দিকে তাকাল, মেয়েটির মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। ইরন অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে উদ্ধার করে আনবে?
আমি জানি না।
তা হলে?
তা হলে কী?
তা হলে কেন নিশিকে বলবে যে একে উদ্ধার করে আনবে?
শুমান্তি একটু অবাক হয়ে ইরনের দিকে তাকাল, তাকে দেখে মনে হল এত সহজ একটি জিনিস ইরন বুঝতে পারছে না দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। সে মাথা নেড়ে বলল, আমাদের কাছে তো নিশি সেটাই শুনতে চেয়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমরা তো সেটা করতে পারব না।
আমরা তো চেষ্টা করতে পারি।
চেষ্টা করব? ইরন অবাক হয়ে বলল, তুমি জান চেষ্টা করলে কী হবে? তুমি দেখেছ আমাকে কীভাবে কীশা গুলি করেছিল?
শুমান্তি এবারে একটু লজ্জা পেয়ে গেল, সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বলল, হ্যাঁ, সেটা অবশ্য সত্যি। চেষ্টা করলে আমরা নিশ্চয়ই মারা পড়ব। কিন্তু আমরা যদি চেষ্টা
করি তা হলে নিশি মেয়েটির মানুষের ওপর বিশ্বাস তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে।
ইরন ছটফট করে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ শুমান্তি। নিশি মেয়েটি যেন মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখে সে জন্য সবাই মারা পড়বে?
হ্যাঁ। শুমান্তি মাথা নাড়ল, আজ হোক কাল যোক আমরা তো সবাই মারা যাব।
ইরন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, ত্রানুস তখন একটু এগিয়ে এসে বলল, আসলে আমরা একটু অন্যভাবে চিন্তা করি। আমাদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা হয় বলে আমরা মারা যেতে একটুও দ্বিধা করি না। যে কারণে মারা যাচ্ছি সেটা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হলে নিজের ভিতরে এক ধরনের আনন্দ পাই।
ইরন দীর্ঘ সময় ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, তোমরা বলতে চাইছ নিশিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে মারা যেতে তোমাদের কোনো ভয় নেই?
শুমান্তি মাথা নাড়ল। বলল, একেবারেই নেই। সত্যি কথা বলতে কী তুমি যদি অনুমতি দাও তা হলে আমি আর ত্রাস নিশিকে উদ্ধার করার জন্য এই গ্রহটাতে যেতে চাই।
ইরন কয়েক মুহূর্ত ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি যদি তোমাদের সাথে যেতে চাই আমাকে নেবে?
শুমান্তি হেসে বলল, কেন নেব না? নিশ্চয়ই নেব।
ত্রালুস বলল, আমি জানতাম তুমিও নিশ্চয়ই আমাদের সাথে যাবে।
ইরন উঠে দাঁড়িয়ে বড় স্ক্রিনটা চালু করে দিয়ে বলল, দেখা যাক স্কাউটশিপটা কোথায়?
খানিকক্ষণ চেষ্টা করতেই স্কাউটশিপটাকে খুঁজে পাওয়া গেল। যোগাযোগ মডিউল স্পর্শ করতেই স্কাউটশিপের ভেতর কীশাকে দেখা গেল, পিছনে জানালায় মাথা রেখে নিশি বসে আছে। তার কিশোরী–মুখে এক অসহায় বিষণ্ণতা।
যোগাযোগ মডিউলের শব্দ শুনে কীশা ঘুরে তাকাল, ইরনের ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হল কীশার চেহারায় এক ধরনের অমানবিক যান্ত্রিক ছাপ চলে এসেছে। সে এক ধরনের নিস্পৃহ গলায় বলল, কে?
ইরন স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি। ইরন।
কী চাও ইরন?
আমি নিশির সাথে একটু কথা বলতে চাই।
কী বলবে তাকে?
তুমিও শুনতে পাবে।
ইরন নিশিকে ডাকল, নিশি।
নিশি মাথা তুলে তাকাল, কিছু বলল না।
নিশি, আমরা তোমাকে একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি।
কী জিনিস?
আমরা তোমাকে উদ্ধার করে নিতে আসছি। কীশা তোমাকে সাহায্য করতে পারছে কারণ সে রোবট। আমরা পারব।
সত্যি? নিশির চোখমুখ হঠাৎ আনন্দে ঝলমল করে উঠল।
হ্যাঁ। তুমি চিন্তা কোরো না নিশি। আমরা আসছি।
ইরন আরো কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে ত্রাস এবং শুমান্তির দিকে তাকাল, বলল, এবারে বল আমরা কী করব?
ত্রালুস হেসে বলল, আমরা তো কিছু জানি না। কী করব সেটা আমরা তোমার মুখেই শুনতে চাই।
২.৪ স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে
পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের বিশাল স্ক্রিনে কিছু নেই। স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার বুকের মাঝে আটকে থাকা একটি নিশ্বাস বের করে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল, কতক্ষণ হয়েছে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, সাত সেকেন্ড।
সাত সেকেন্ড? সাত সেকেন্ড হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
তা হলে এখনো বের হয়ে আসছে না কেন?
আমি জানি না।
প্রজেক্টটা কি বৃথা গেল?
আমি জানি না।
এতদিনের পরিকল্পনা, এত পরিশ্রম, এত গোপনীয়তা, এত অর্থ ব্যয়–তারপর প্রজেক্টটা বৃথা হয়ে গেল?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বিরক্ত হয়ে বলল, আহ! তুমি দশ সেকেন্ড চুপ করে থাকতে পার?
বৃদ্ধ মানুষটি মাথা নাড়ল, অধৈর্য হয়ে বলল, না পারি না। কখনো কখনো পারি না।
৩.১ স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে
স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে ত্রালুস চিন্তিত মুখে বসে আছে। মহাকাশযানে সব মিলিয়ে তিনটি স্কাউটশিপ, তার মাঝে একটি কীশা নিয়ে গেছে। এটি দ্বিতীয় স্কাউটশিপ, প্রথমটির মতো এটি অত্যাধুনিক নয়–ত্রালুস সেটি নিয়ে চিন্তিত। অনেক ক্ষেত্রেই এটা চালানোর জন্য নিজের বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করতে হয়। তৃতীয় স্কাউটশিপটি একেবারেই দায়সারা। সেটি যদি কখনো ব্যবহার করতে হয়, সফল উড্ডয়নের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি।
পিছনে নিরাপত্তা মডিউলটি নিয়ে শুমান্তি বসেছিল, সে ত্রাসের চিন্তিত মুখ দেখে বলল, কী হল ত্ৰালুস? কোনো সমস্যা?
আলাদাভাবে নতুন কোনো সমস্যা নয়, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে খানিকটা সমস্যা।
স্কাউটশিপটা চালাতে ভয় পাচ্ছ?
ভয়টা সঠিক শব্দ নয়, বলতে পার আতঙ্ক।
ইরন হেসে বলল, আমাদের এই প্রজেক্টে নতুন করে ভয় পাবার বা আতঙ্কিত হবার। কিছু নেই। মোটামুটিভাবে ধরে নাও একঘণ্টা পর নাকি দুই ঘণ্টা পর আমরা মারা পড়ব। সেটা নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে আমার উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ, এভাবে দেখলে পুরো ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে যায়।
এভাবেই দেখ।
বেশ! স্কাউটশিপে তোমাদের ভ্রমণ খুব আনন্দদায়ক হবে না আগেই বলে রাখছি।
শুমান্তি হাসিমুখে বলল, আমাদের অভিযান শুরু করার আগে কীভাবে স্কাউটশিপ চালাতে হয় তার ওপর একটি লম্বা ট্রেনিং হয়েছিল মনে আছে?
মনে আছে। তবে ট্রেনিঙে কী বলেছিল সেসব এখন আর মনে নেই।
ইরন যোগাযোগ মডিউলের বিভিন্ন সুইচ টেপাটিপি করে পরীক্ষা করতে করতে বলল, তুমি এসব নিয়ে চিন্তা না করে শুরু করে দাও। যদি সেরকম কিছু বিপদ হয় স্কাউটশিপের নিজস্ব নিয়ন্ত্ৰণ দায়িত্ব নিয়ে নেবে।
ঠিক আছে।
স্কাউটশিপে কী কী নিয়েছ?
বাইরে বের হওয়ার জন্য দ্বিতীয় মাত্রার স্পেস স্যুট, কিছু খাবার এবং পানীয় এবং অস্ত্র।
অস্ত্র?
হ্যাঁ। মহাকাশযানে যা ছিল প্রায় সব তুলে এনেছি। দরকার হলে নিনীষ স্কেলের পঞ্চম মাত্রার দুই–চারটা প্রাণীর মাথা উড়িয়ে দেব।
শুমান্তি বলল, সত্যি?
ত্রালুস হেসে বলল, আমি বলেছি দরকার হলে।
ইরন যোগাযোগ মডিউলটি সামনে রেখে নিজেকে চেয়ারের সাথে সংযুক্ত করে বলল, তুমি ধরে নিয়েছ এই গ্রহটিতে যে প্রাণীরা আছে তাদের আমাদের মতো মাথা রয়েছে?
কী করব বল! মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি, কোথাও এই প্রাণীদের সম্পর্কে এতটুকু তথ্য নেই। এরা কি বড় না ছোট, কার্বনভিত্তিক না সিলিকনভিত্তিক, ভিন্ন বা সামগ্ৰকি_
শুমান্তি বাধা দিয়ে বলল, হাসিখুশি না বদরাগী?
ইরন বলল, তার মানে তুমি ধরে নিয়েছ এদের আমাদের মতো অনুভূতি রয়েছে? কখনো হাসিখুশি থাকে কখনো রেগে থাকে?
আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু যেহেতু বুদ্ধিমানের একটা পরিমাপ করা হয়েছে। মস্তিষ্কের মতো কিছু একটা নিশ্চয়ই থাকবে–যেখানে সব তথ্য বিশ্লেষণ করবে।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে তুমি ধরে নিয়েছ তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়াটি আমাদের মতো? নিউরন সেল থাকবে, সিনাল থাকবে, তার ভিতর যোগাযোগ হবে সঙ্কেত আদান–প্রদান হবে?
শুমান্তি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি জানি না। মানুষ ছাড়া যেহেতু আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী দেখি নি, তাই মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর কথা মনে হলেই কেন জানি মনে হয় সেটা মানুষের মতোই হবে। হাত–পা থাকবে, নাক–মুখ, চোখ থাকবে–তবে সেটা হবে খুব ভয়ঙ্কর! হয়তো মস্তিষ্কটা শরীরের বাইরে, চোখগুলো সাপের মতো, হয়তো খুব নিষ্ঠুর!
ইরন একটু হেসে বলল, আমাদের সেটাই হয়েছে সমস্যা! আমরা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের বাইরে চিন্তা করতে পারি না। হয়তো এই প্রাণীর সাথে আমাদের কোনো মিল নেই। হয়তো এটার ঘনত্ব এত কম যে আমরা দেখতে পাই না! কিংবা আসলে পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী। কিংবা প্রাণীটা পদার্থের নয়, প্রাণীটা শক্তির। আলো বা বিদ্যুৎ বা যান্ত্রিক শক্তি! কত কিছু হতে পারে!
শুমান্তি বলল, ইরন, তুমি যেভাবে বলছ, শুনে আমার তো একটু ভয়ই লাগছে।
ভয়? ইরন হেসে বলল, আমাদের কেন জানি ভয় থেকে বেশি হচ্ছে কৌতূহল। প্রাণীটি দেখতে কী রকম? বিশাল মস্তিষ্কসহ কিলবিলে অক্টোপাসের মতো কোনো প্রাণী, নাকি এমন একটি প্রাণী যার অস্তিত্ব আমরা কল্পনাও করতে পারি না!
ত্রালুস বলল, হয়তো একটু পরেই দেখব।
হয়তো।
ত্রালুস কন্ট্রোল প্যানেলের সবকিছু দেখে বলল, তা হলে কি শুরু করব?
হ্যাঁ। শুরু করা যাক।
ত্রালুস সুইচ স্পর্শ করামাত্রই প্রচণ্ড একটা শব্দ করে স্কাউটশিপটি থরথর করে কেঁপে উঠল। খানিকক্ষণ তার শক্তিশালী ইঞ্জিনটি থেকে আয়োনিত গ্যাস বের হতে থাকে, ভিতরে একটা সতর্ক ধ্বনি শোনা গেল এবং হঠাৎ করে পুরো স্কাউটশিপটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
স্কাউটশিপটা মহাকাশযানকে ঘিরে একবার ঘুরে আসে, মহাকাশযানটি যে কত বিশাল সেটি আবার নতুন করে সবার মনে পড়ল। নিচে গা ঘিনঘিন করা গ্রহটির মহাকর্ষ বলে মহাকাশযানটি স্থিতি হয়েছে, প্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটারব্যাপী একটি কক্ষপথ নিয়ে এখন সেটি এই গ্রহটাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মহাকাশযানটির নিয়ন্ত্রণ এখনো তাদের হাতে নেই, এই গ্রহটিকে কেন্দ্র করে বিশাল একটি কক্ষপথ নিয়ে ঘোরার ব্যাপারটিও পূর্বনির্ধারিত।
স্কাউটশিপটি মহাকাশযান থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে, চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। দূরে কোনো একটি আলোকিত নেবুলা থেকে নীলাভ এক ধরনের আলো এসে এই গ্রহটাকে আলোকিত করছে। এই আলোতে সবকিছুকেই অতিপ্রাকৃত মনে হয়, এই গ্রহটিকে শুধু অতিপ্রাকৃত নয় অশুভ বলে মনে হতে থাকে।
ইরন স্কাউটশিপের গোলাকার জানালা দিয়ে নিচে গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, এই গ্রহটা সম্পর্কে তথ্যগুলো এনেছ?
হ্যাঁ। ত্রালুস একটা সুইচ টিপে দিতেই তার সামনে আরো একটা ছোট স্ক্রিন বের হয়ে এল। স্ক্রিন থেকে তথ্যগুলো সে পড়ে শোনাতে থাকে, গ্রহটির ব্যাসার্ধ ছয় হাজার কিলোমিটার, এর ভর পৃথিবীর দেড়গুণ। গ্রহটির এক ধরনের বায়ুমণ্ডল রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের বেশিরভাগ কার্বন–ডাই অক্সাইড। অল্প পরিমাণ ক্লোরিন এবং মিথেন রয়েছে। গ্রহের পৃষ্ঠদেশে বাতাসের চাপ বারশত মিলিবার। বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ হচ্ছে সত্তর থেকে দুইশত কিলোমিটার। গ্রহটির পৃষ্ঠদেশ এক ধরনের নরম পদার্থের তৈরি, স্থানে স্থানে তরল পদার্থ থাকতে পারে। তরল পদার্থের পি. এইচ. তিনের কাছাকাছি। মানুষের জন্য গ্রহটি বাসযোগ্য নয়–অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ। গ্রহটি কাছাকাছি একটি নেবুলা দিয়ে আলোকিত হচ্ছে। গ্রহটির নিজস্ব কিছু আলোর উৎস রয়েছে, আলোর বেশিরভাগ অবলাল, খালি চোখে ধরা পড়ে না।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি গ্রহটির যে বর্ণনা দিয়েছ, শুনে মনে হচ্ছে ফিরে যাই, গিয়ে আর কাজ নেই।
ঠিকই বলেছ।
এখানে যদি সত্যিই বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে তা হলে তার কোনো চিহ্ন থাকা উচিত। সেই চিহ্ন কি দেখা যাচ্ছে?
ত্রালুস আবার স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করে স্ক্রিনটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে বলল, না। সভ্যতার চিহ্ন বলতে আমরা যা বোঝাই সেরকম কিছু নেই। কোনো দালানকোঠা রাস্তাঘাট বা শক্তি কেন্দ্র সেরকম কিছু নেই।
ইরন অবাক হয়ে বলল, কিছু নেই?
না, কিছু নেই। শুধু
শুধু?
শুধু মাঝে মাঝে কোনো কোনো স্থান থেকে অবলাল আলোর একটা বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। কোথা থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। পুরোপুরি সামঞ্জস্যহীন বিচ্ছিন্ন অবলাল আলোর বিচ্ছুরণ।
হুঁ। ইরন ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকে। সত্যি সত্যি যদি এই গ্রহটি বুদ্ধিমান প্রাণীদের গ্রহ হয়ে থাকে তা হলে তার কোনো চিহ্ন কি দেখা যাওয়ার কথা নয়?
শুমান্তি ইতস্তত করে বলল, হয়তো এই গ্রহটা ফাঁপা, হয়তো প্রাণীগুলো গ্রহটার ভিতরে থাকে।
ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই হতে পারে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ রকম আরো এক হাজারটি সম্ভাবনা থাকতে পারে–আমরা কোনটাকে সত্যি বলে ধরে নেব?।
ইরন বলল, আমরা এখন কোনো বিচার–বিবেচনা–বিশ্লেষণে যাব না। আমরা আগের স্কাউটশিপটার পিছনে পিছনে যাব। যদি সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী থেকে থাকে তা হলে নিশ্চয়ই কীশার সাথে দেখা করে নিশিকে নিতে আসবে।
শুমান্তি জানালা দিয়ে নিচে গ্রহটির দিকে তাকিয়ে বলল, কী মন–খারাপ–করা একটি জায়গা!
শুমান্তির কথা শেষ হবার আগেই স্কাউটশিপটা একটা বড় ঝাঁকুনি খেল, ভিতরে একটা লাল আলো জ্বলে ওঠে এবং কর্কশ স্বরে সতর্কসূচক এলার্ম বাজতে শুরু করে। শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?
ত্রালুস স্কাউটশিপটার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে করতে বলল, এতক্ষণ বাতাসহীন অবস্থায় ছিলাম বলে সহজে নেমে এসেছি। এখন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছি। তোমাদের আরো ঝাঁকুনি সহ্য করতে হবে।
ইরন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, সত্যি সত্যি বাইরের অন্ধকার আকাশকে হালকাভাবে আলোকিত দেখা যাচ্ছে। স্কাউটশিপের দুই পাশে বাতাসে ওড়ার জন্য দুটি ফিন বের হয়ে এসেছে। ফিন দুটিকে ঘিরে বেগুনি রঙের এক ধরনের আলো দেখা গেল, বাতাসের ঘর্ষণে তৈরি হচ্ছে। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসছে, গ্রহটির বায়ুমণ্ডল নিশ্চয়ই অত্যন্ত সক্রিয়।
এতক্ষণ মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে স্কাউটসজিপটি নিচে নেমে এসেছে, গ্রহটির কাছাকাছি পৌঁছে যাবার কারণে এখন তার গতিবেগ কমিয়ে আনার প্রয়োজন হল। লুস আবার স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিনটি চালু করে দেয়, সাথে সাথে ভয়ঙ্কর শব্দ করে স্কাউটশিপটি থরথর করে কাঁপতে থাকে। স্কাউটশিপটি প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় নিচে নামতে থাকে, শক্ত করে বাঁধা না থাকলে স্কাউটশিপের ভিতরে সবাই বড় ধরনের আঘাত পেয়ে যেত। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমরা কি ঠিকভাবে নামছি?
ত্রালুস ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে উঁচু গলায় বলল, ঠিকভাবে কি না জানি না, কিন্তু নামছি!
ইরন বলল, শুধু নামলেই হবে না। কীশা যেখানে নেমেছে, সেখানে নামতে হবে।
হ্যাঁ। কীশার স্কাউটশিপের সিগন্যালকে এই স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ মডিউল লক করে নিয়েছে। এখন সেটার পিছু পিছুই যাচ্ছে।
চমৎকার।
শুমান্তি স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণহীন ঝাঁকুনি সহ্য করতে করতে বলল, কীশা স্কাউটশিপটিকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?
গ্রহটির মাঝামাঝি একটা জায়গায়। মনে হচ্ছে একটু উঁচু পাথুরে জায়গা।
অন্য কোনো বিশেষত্ব আছে জায়গাটার?
ত্রালুস খানিকক্ষণ স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে বলল, না নেই। শুধু—
শুধু?
শুধু এর আশপাশে অবলাল আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে একটু বেশি।
ইরন আবার ভুরু কুঁচকে জানালা দিয়ে নিচে তাকাল। সবুজ এবং বেগুনি রঙের এই কুৎসিত গ্রহটিতে তারা নামতে যাচ্ছে, সেখানে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তারা জানে না। নিনীষ স্কেলে পঞ্চম শ্রেণীর বুদ্ধিমত্তার একটি প্রাণী তাদের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করবে কে জানে? ইরনের বুকের ভিতরে একটা অশুভ চাপা আশঙ্কা পাক খেতে শুরু করে। সে তখন মুখ তুলে ত্রালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকাল, দুজন হাসিখুশি তরুণ–তরুণী। মনে হয় এই দুজনই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেয়েছে–তাই এত সহজে এই ভয়ঙ্কর অভিযানে রওনা দিয়েছে, যে অভিযান থেকে বেঁচে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ইরন জোর করে তার ভিতরকার সকল চাপা ভয় এবং অশান্তিকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সত্যিই তো–বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই হিসেবে তারা কত ক্ষুদ্র একটি সময় বেঁচে আছে! এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়টুকু একটু বেশি বা একটু কম হলে কী ক্ষতি–বৃদ্ধি হতে পারে? তার পরিবর্তে যদি একটি প্রাণীকেও অল্প কিছু ভালবাসা দেওয়া যায় সেটাই কি বড় কথা নয়?
ইরন যখন সত্যি সত্যি পুরো ব্যাপারটি নিয়ে নিজের ভিতরে এক ধরনের আনন্দময়। অনুভূতি প্রায় সৃষ্টি করে ফেলেছে ঠিক তখন সে শুমান্তির একটি আর্তচিৎকার শুনতে পেল।
ইরন মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল শুমান্তির সামনে শূন্য থেকে একটি বীভৎস কদাকার জিনিস ঝুলছে।
৩.২ ইরন চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে
ইরন চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্কাউটশিপের মাঝ দিয়ে শুমান্তির কাছে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল, ঠিক সেই মুহূর্তে স্কাউটশিপটা একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়ে পুরোটা প্রায় উল্টে যেতে যেতে কোনোমতে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ইরন দেয়াল আঁকড়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, স্কাউটশিপের এক কোনায় গিয়ে ছিটকে পড়ে। কোনো রকমে আবার সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর মেঝেতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে শুমান্তির কাছাকাছি গিয়ে হাজির হল।
যে জিনিসটি তাদের সামনে ঝুলছে এর থেকে কদাকার কিছু তারা কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। জিনিসটি জীবন্ত সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, এর ভিতরে নানা অংশ নড়ছে, কিলবিল করছে, পুরো জিনিসটি সরসর শব্দ করে হঠাৎ বড় হতে শুরু করল। জিনিসটি থেকে উড়ের মতো কিছু একটা বের হয়ে এল, হঠাৎ করে গোলাপি রঙের চটচটে ভেজা জিনিসটি তাদেরকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতেই ইরন শুমান্তিকে নিয়ে লাফিয়ে পিছনে সরে গেল। জিনিসটি আবার নড়তে শুরু করে এবং হঠাৎ করে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, শুমান্তি আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে এবং ইরন আবার তাকে ধরে নিচে লাফিয়ে পড়ল, ভেজা থলথলে জীবন্ত জিনিসটি তাদের উপর দিয়ে স্কাউটশিপের অন্যদিকে যেতে শুরু করে, ঠিক তাদের উপর দিয়ে যাবার সময় টপটপ করে তাদের উপর চটচচে এক ধরনের তরল গড়িয়ে পড়ল। ঝাজালো কটু এক ধরনের দৃষিত গন্ধে হঠাৎ করে স্কাউটশিপের বাতাস ভারী হয়ে আসে। তাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, শুমান্তি নিশ্বাস নেবার। চেষ্টা করে কাশতে শুরু করে।
প্রাণীটি দেয়াল আঁকড়ে ধরে একটি ছোট ফুটো দিয়ে বাতাস বের হয়ে যাবার মতো এক ধরনের অনিয়মিত শব্দ করতে থাকে, সমস্ত স্কাউটশিপে চটচটে আঠালো গাঢ় বাদামি রঙের এক ধরনের তরল ছিটকে ছিটকে পড়ে।
ত্রালুস স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে ভল্টের দিকে ছুটে গেল, ঢাকনা খুলে তার ভিতর থেকে একটা ভয়াবহ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে এল। প্রাণীটির দিকে অস্ত্র তাক করতেই ইরন নিচু গলায় বলল, খবরদার। গুলি কোরো না।
ঠিক আছে। এলুস একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, কিন্তু আবার যদি আমাদের আক্রমণ করে?
করলে দেখা যাবে। এখনো তো করে নি।
ওরা তিন জন স্কাউটশিপের মেঝেতে উঁচু হয়ে বসে প্রাণীটির দিকে এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইল। এটি দেখলে প্রথমেই যে জিনিসটি মনে হয় সেটি হচ্ছে যে জীবন্ত কোনো একটি প্রাণীর চামড়া ছিলে ফেলা হয়েছে, এখন হঠাৎ করে ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো দেখা যাচ্ছে। থলথলে ভেজা আঠালো জিনিস নড়ছে, এবং কিলবিল করছে। এর নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। প্রথমে একটা বড় অক্টোপাসের মতো দেয়াল আঁকড়ে ধরে রইল এবং সেই অবস্থায় শূন্যে ঝুলতে থাকে। ছোট ছোট পুঁড়ের মতো জিনিস ঝুলতে থাকে এবং সেগুলো হঠাৎ করে বুজে যায়। জিনিসটি স্কাউটশিপের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে একটু ছোট হয়ে আসে, তীব্র আলোর একটা ঝলকানি হল এবং হঠাৎ করে প্রাণীটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইরন হতচকিতের মতো স্কাউটশিপের ভিতরে তাকায়, এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে জলজ্যান্ত এ রকম একটা প্রাণী তাদের চোখের সামনে থেকে এভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। ত্ৰালুস শক্ত করে অস্ত্রটি ধরে রেখে কয়েক পা এগিয়ে গেল, এদিক–সেদিক তাকিয়ে বলল, কোথায় গেছে?
শুমান্তি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শরীরের নানা জায়গায় লেগে থাকা কুৎসিত চটচটে আঠালো তরলের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, চলে গেছে।
কিন্তু কেমন করে চলে গেল?
তা হলে আগে জিজ্ঞেস কর কেমন করে ভিতরে এল?
ত্রালুস বিভ্রান্তের মতো শুমান্তির দিকে তাকাল, মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ, কেমন করে ভিতরে এল?
শুমান্তি এক টুকরো নিও পলিমারের টুকরো নিয়ে শরীরের নানা জায়গায় লেগে থাকা আঠালো তরল মুছতে মুছতে বলল, এটাই কি সেই বুদ্ধিমান প্রাণী?
ইরন চিন্তিত মুখে স্কাউটশিপের ভিতরে চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে বলল, মনে হয়।
শুমান্তি বলল, আমার তো এটাকে বুদ্ধিমান মনে হল না। কদাকার মনে হল।
সৌন্দর্যের ধারণা খুব আপেক্ষিক। মাকড়সা যদি আমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী হত তা হলে তারা মানুষকে খুব কদাকার প্রাণী বলে বিবেচনা করত।
ত্রালুস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ভল্টের ভিতরে রাখতে রাখতে বলল, প্রাণীটি অন্তত আমাদেরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে নি।
হ্যাঁ। অন্তত আমরা বুঝতে পারি নি।
শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, এটি যদি সত্যি সত্যি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত তা হলে আমি ভয়েই মারা যেতাম।
ইরন অন্যমনস্কের মতো বলল, হুঁ।
শুমান্তি স্কাউটশিপের ঝাঁকুনির মাঝে সাবধানে সামনের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ইরন।
ইরন কোনো কথা বলল না, খুব চিন্তিতভাবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
শুমান্তি কাছে গিয়ে বলল, ইরন।
ইরন একটু চমকে উঠে বলল, কী হল?
তুমি কী ভাবছ?
না, আমি জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করছি। একটা রক্তমাংসের প্রাণী—
রক্তমাংসের? শুমান্তি মুখ বিকৃত করে বলল, রক্তমাংস?
দেখে তো সেরকমই মনে হল। স্কাউটশিপে যে তরলগুলো ছিটিয়েছে তার নমুনা মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলে বিশ্লেষণ করে বলতে পারবে। আমার মনে হয় আমরা দেখব এটা জীবিত কোনো প্রাণীর দেহ থেকে এসেছে।
শুমান্তি শরীর থেকে চটচটে তরল মোছার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদের শরীরে লেগে গেছে, কোনো ক্ষতি হবে না তো?
এখনো যখন হয় নি, মনে হয় আর হবে না। যেহেতু এটা ভিন্ন ধরনের প্রাণীসত্তা, আমার মনে হয় না আমাদের শরীরকে আক্রমণ করতে পারবে। ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার মতো এটা তো নিশ্চয়ই আর. এন. এ, ডি. এন. এ দিয়ে তৈরি নয়। তাদের নিজস্ব জিনিস দিয়ে তৈরি। ঘরে কেমন কাঁজালো কটু গন্ধ দেখেছ?
কিসের গন্ধ এটা?
মনে হয় ক্লোরিনের। আমরা যেরকম অক্সিজেন দিয়ে নিশ্বাস নেই, এটা মনে হয় সেরকমভাবে ক্লোরিন দিয়ে নিশ্বাস নেয়!।
ক্লোরিন? কিন্তু সেটা তো ভয়ঙ্কররকম বিক্রিয়াশীল গ্যাস।
ইরন হেসে ফেলল, বলল, অক্সিজেনও অত্যন্ত বিক্রিয়াশীল গ্যাস। লোহার মতো ধাতুকে সেটা আক্রমণ করে ক্ষয় করে ফেলে। কিন্তু আমরা তার মাঝে দিব্যি বেঁচে থাকতে পারি।
সেটা ঠিক বলেছ, আমি আগে কখনো এভাবে চিন্তা করি নি।
ত্রালুস স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে ছোট স্ক্রিনটার উপর ঝুঁকে পড়ল। সাবধানে স্কাউটশিপটাকে আবার নিচে নামাতে শুরু করে। বাতাসের ঘনত্ব আরো বেড়েছে–বাইরে এখন ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলি পাকানো সবুজ মেঘ ভেসে যাচ্ছে, প্রতিবার এ রকম একটা মেঘে আঘাত করা মাত্র স্কাউটশিপটি থরথর করে কেঁপে উঠছিল। বহু নিচে স্থানে স্থানে বেগুনি রঙের উঁচুনিচু ভূমি। সেখানে কী বিস্ময় লুকিয়ে আছে কে জানে।
ইরন স্কাউটশিপের গোলাকার জানালার সামনে বসে আবার বাইরে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গেল। একটি প্রাণী কীভাবে বন্ধ স্কাউটশিপে এসে হাজির হতে পারে আবার কীভাবে বন্ধ স্কাউটশিপ থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? এটি তো অলৌকিক কিছু হতে পারে না, বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলো নিশ্চয় মানতে হবে। কোনো জিনিস তো হঠাৎ করে সৃষ্টি হতে পারে না, আবার এ রকম হঠাৎ করে অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে না। প্রাণীটি কোথায় গেল?
কীশার স্কাউটশিপটা নিচে নেমে গেছে। ত্রালুসের গলার স্বর শুনে ইরন মাথা তুলে তাকাল।
কেমন করে বুঝতে পারলে?
খুব ঝড়ো হাওয়া হচ্ছে তাই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সিগনালে আর ডপলার শিফট নেই। স্কাউটশিপটা থেমে গেছে।
আমাদেরও কাছাকাছি থামতে হবে।
ঠিক আছে। নিচে নেমে আমি একবার ঘুরে আসি।
বেশ।
স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এর মাঝে ত্রাসের নিজের মাঝে বেশ একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সে বেশ সাবলীলভাবে স্কাউটশিপটাকে ঘুরিয়ে নিচে নামিয়ে নিতে থাকে। বাইরে গাঢ় সবুজ রঙের মেঘ কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠে আসছে, তার মাঝে নীলাভ বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ খেলা করছে। নিচে বেগুনি রঙের প্রান্তর, কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার। মাঝে মাঝে বড় বড় ফাটল, তার ভিতর থেকে ঈষৎ কমলা রঙের এক ধরনের আলো বের হয়ে আসছে। পুরো দৃশ্যটি একটি অতিপ্রাকৃত দৃশ্যের মতো, তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে মনে হয় এর কোনোটিই সত্যি নয়, পুরোটুকু বুঝি শক্তিশালী কোনো মস্তিষ্ক–বিকলন ড্রাগের ফল। ইরন জানালা থেকে মাথা ঘুরিয়ে ভিতরে তাকাল এবং হঠাৎ করে স্কাউটশিপের ভিতরে আবার সেই ভয়াবহ কদাকার প্রাণীটিকে দেখতে পেল। কোনো বীভৎস প্রাণীকে যেন কেউ খুলে তার ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বাইরে নিয়ে এসেছে।
স্কাউটশিপের ভিতরটুকু তীক্ষ্ণ ঝুঁজালো গন্ধে ভরে গেল–আঠালো চটচটে তরল প্রাণীটির দেহ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে স্কাউটশিপের ভিতর গড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রাণীটি থরথর করে কাঁপছে। ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরসর করে নড়ছে। ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে বীভৎস প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে একটা জিনিস বুঝতে পারে, সে ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠে বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ইরন শুমান্তির আর্তচিৎকার শুনতে পেল। ত্রালুস ছুটে গিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে ইরনের পাশে এসে দাঁড়ায়। ভয়ঙ্কর দর্শন প্রাণীটি থেকে হঠাৎ করে গুঁড়ের মতো কিছু একটা ছুটে আসে, ত্রালুস অস্ত্রটি উঁচু করে ধরতেই ইরন খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, না, ত্রালুস, না।
এটা তোমাকে আক্রমণ করছে।
আমার ধারণা করছে না।
তা হলে কী করছে?
কিছুই করছে না।
ত্রালুস নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে এবং থলথলে ভেজা আঠালো ঔড়গুলো তাদের গা ঘেঁষে গিয়ে হঠাৎ করে প্রাণীটির শরীরে মিশে গেল।
শুমান্তি হেঁটে ইরনের পাশে এসে দাঁড়াল, নিচু গলায় বলল, তুমি কেন বলছ এটা কিছুই করছে না?
কারণ এটা আমাদের দেখছে না।
দেখছে না?
না।
কেন দেখছে না, এর কোনো চোখ নেই?
না, চোখ–কানের কথা নয়। অন্য কোনো ধরনের প্রাণী হলেই যে চোখ–কান থাকতে হবে তা ঠিক নয়, তারা অন্য কোনোভাবেও তাদের তথ্য নিতে পারে।
তা হলে?
এটি একটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী। ত্রিমাত্রায় কিছু থাকলে সেটি এত সহজে সেটা দেখতে পারে না।
চতুর্মাত্রিক প্রাণী?
হ্যাঁ। শুধুমাত্র চতুর্মাত্রিক প্রাণীই ত্রিমাত্রিক জগতে হঠাৎ করে হাজির হতে পারে, হঠাৎ করে অদৃশ্য হতে পারে। এরা চতুর্মাত্রিক প্রাণী বলেই চতুর্থমাত্রা ব্যবহার করে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিল।
হ্যাঁ, আমরা ত্রিমাত্রিক জগতে এই প্রাণীটির প্রজেকশনটুকু দেখছি। প্রাণীটি দেখতে আসলে কী রকম আমরা কোনোদিন জানতে পারব না।
ত্ৰালুস অস্ত্রটি তাক করে রেখে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি নিশ্চিত এটা আমাদের দেখতে পারছে না?
পুরোপুরি নিশ্চিত কেমন করে হব? কিন্তু আমার ধারণা এটা আমাদের দেখতে পাচ্ছে। যদি দ্বিমাত্রিক একটা জগৎ থাকত তা হলে আমরা যেরকম দেখতে পেতাম না অনেকটা সেরকম।
শুমান্তি বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটার দ্রুত পাল্টে যাওয়া বীভৎস দেহটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন আমরা দ্বিমাত্রিক জগৎ দেখতে পেতাম না?
কারণ একটি ত্রিমাত্রিক জগতে অসীম সংখ্যক দ্বিমাত্রিক জগৎ থাকে, কোনটি তুমি দেখবে? শুধু একটি হলে তুমি দেখবে, কিন্তু একটি তো নেই, কোনটা তুমি আলাদা করে দেখবে?
ত্রালুস অস্ত্রটি আলগোছে ধরে রেখে বলল, তুমি বলছ আমি যদি এটাকে গুলি করি এটা জানবে না কে তাকে গুলি করেছে?।
সম্ভবত জানবে না, কিন্তু বুঝতে পারবে, কোনো একটি ত্রিমাত্রিক জগতে সে আঘাত পেয়েছে। চতুর্মাত্রিক প্রাণী তখন ত্রিমাত্রার জগৎকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারে।
শুমান্তি আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, এটা আসলে তার আকার পরিবর্তন করছে না। এটা আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। যখন যেটুকু আমাদের জগতে রয়েছে তখন সেটুকু আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ইরন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। এইজন্য এটা হঠাৎ করে এখানে আসতে পারে, আবার হঠাৎ করে চলে যেতে পারে।
ইরনের কথা শেষ হবার আগেই অদৃশ্য একটা আলোকের ঝলকানি দেখা গেল এবং হঠাৎ করে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ইরন মাথা নেড়ে বলল, একটা বদ্ধ জায়গায় কোনো জিনিস হঠাৎ করে আসা এবং হঠাৎ করে বের হয়ে যাওয়ার একটি মাত্র ব্যাখ্যা, এটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী।
ত্রালুসকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখায়। সে শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি মনে হয়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ। আমি এখনো বুঝতে পারি নি।
ইরন ত্রালুসের কাধ স্পর্শ করে বলল, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব, আগে দেখ মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র বিশ্লেষণ করে নতুন কিছু পাঠিয়েছে কি না।
যোগাযোগ মডিউলে মহাকাশযানের মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে পাঠানো তথ্যগুলো তিন জন মিলে দেখতে থাকে। প্রাণীটার শরীরে প্রচুর ধাতব পদার্থ রয়েছে, বিশেষ করে এলকালী ধাতু। ক্লোরিনের সাথে বিক্রিয়া করে শক্তি সংগ্রহের একটি সহজ পদ্ধতি। পৃথিবীর প্রাণিজগৎ যেরকম পুরোপুরি ডি. এন. এ. নির্ভর এখানে সেরকম কিছু দেখা গেল না, দীর্ঘ সুতার মতো ক্রিস্টালের অবকাঠামো রয়েছে যার ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক সঙ্কেত যেতে পারে। মাঝে মাঝে গোলাকার অংশে গেলিয়াম৩১ এবং আর্সেনাইডের প্রাচুর্য দেখা গেল, সম্ভবত বৈদ্যুতিক সঙ্কেত বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাণীটির দেহ থেকে বের হওয়া তরল থেকে আরো নানা ধরনের অসংখ্য তথ্য দেওয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগই অল্প সময়ে বোঝার কোনো উপায় নেই। ঠিক কোন অংশটি ব্যবহার করে এটি চতুর্মাত্রিক জগতে বিচরণ করতে পারে সেই তথ্যটুকু খুঁজে পাওয়া গেল না।
ত্রালুস বিশাল তথ্যভাণ্ডারের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইরনকে জিজ্ঞেস করল, ইরন, তুমি বুঝতে পারলে?
পুরোপুরি বুঝতে সময় নেবে। তবে যেটুকু বোঝার সেটুকু বুঝেছি।
কী বুঝেছ?
এটি চতুর্থমাত্রায় বিচরণ করতে পারে সত্যি কিন্তু এটি তৈরি আমাদের পরিচিত পদার্থ দিয়ে। যার অর্থ– ইরন একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা প্রয়োজন হলে আমাদের প্রযুক্তি দিয়েই তার সামনাসামনি হতে পারব।
শুমান্তি একটু হেসে বলল, তুমি বলতে চাইছ প্রয়োজন হলে আমাদের অস্ত্র দিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে।
ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি এটা বলতে চাইছি না–বোঝাতে চাইছি। প্রথমবার যখন কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে দেখা হয় তখন তাদের সাথে যুদ্ধ করার কথা নয়!।
ত্রালুস স্কাউটশিপের সামনে থেকে উচ্চকণ্ঠে বলল, তোমরা তোমাদের নিজেদের জায়গায় বস, কীশার স্কাউটশিপটা পাওয়া গেছে, আমরা এখন নামব।
কিছুক্ষণের মাঝেই স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করতে শুরু করে। আয়োনিত গ্যাসের আলোতে হঠাৎ করে চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে।
৩.৩ স্কাউটশিপের নিচের ঘরটিতে ইরন
স্কাউটশিপের নিচের ঘরটিতে ইরন, ত্রাস এবং শুমান্তি মহাকাশযান থেকে নিয়ে আসা দ্বিতীয় মাত্রার স্পেসস্যুটগুলো পরে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইরের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত হাওয়ায় এই স্পেসস্যুট দিয়ে যথার্থ নিরাপত্তা পেতে হলে তার বিভিন্ন স্তরকে সক্রিয় করতে হবে, কাজটি জটিল এবং শ্রমসাপেক্ষ। মহাকাশযানে এই ধরনের কাজে সাহায্য করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, স্কাউটশিপে পুরোটুকুই নিজেদের করতে হয়।
অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সঠিক মিশ্রণ পরীক্ষা করে ক্ষুদ্র প্যালেটগুলো সিলিন্ডারে রেখে বাইরে নিশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থাটুকু নিশ্চিত করতে করতে ত্রানুস ইরনের কাছে এগিয়ে যায়।
ইরন।
বল।
আমি তোমার চতুর্মাত্রিক প্রাণীর ব্যাপারটি বুঝতে পারি নি। আমরা যেখানে বড় হয়েছি সেখানে বিজ্ঞান শেখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
এর মাঝে বিজ্ঞান খুব বেশি নেই। সত্যি কথা বলতে কী বিজ্ঞান বেশি শিখে নিলে মস্তিষ্ক খানিকটা রুটিনের মাঝে চলে আসে, তখন প্রচলিত নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
ত্রালুস মাথা নেড়ে বলল, শুমান্তিকে যার ক্রোমোজম৩ দিয়ে ক্লোন করা হয়েছে সে নিশ্চয়ই বড় বিজ্ঞানী ছিল, বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলো তাই সহজে বুঝে ফেলে। আমি পারি না।
শুমান্তি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ইরন বাধা দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ। আমিও লক্ষ করেছি।
ব্যাপারটা আমাকে বোঝাতে পারবে?
চেষ্টা করতে পারি। ইরন খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করে বলল, প্রাচীনকালে তথ্য আদান–প্রদান করার জন্য এক ধরনের জিনিস ব্যবহার করা হত, তার নাম ছিল বই। কাগজ নামের পাতলা এক ধরনের পরদার মতো জিনিসে লিখে অনেকগুলো একসাথে বেঁধে রাখা হত। তুমি কি সেগুলো কখনো দেখেছ?
না। সামনাসামনি দেখি নি। হলোগ্রাফিক ছবি দেখেছি।
চমৎকার। মনে করা যাক এই বইয়ের একেকটি পৃষ্ঠা হচ্ছে একেকটি ত্রিমাত্রিক জগৎ। মনে করা যাক আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ হচ্ছে এক শ এগার নম্বর পৃষ্ঠা। আমরা, মানুষেরা শুধুমাত্র এই পৃষ্ঠায় বিচরণ করতে পারি, এর বাইরে যেতে পারি না। মনে কর আমরা ছোট পিপড়ার মতো এই বইয়ের পৃষ্ঠায় ঘুরে বেড়াই। এক শ এগার নম্বর পৃষ্ঠা থেকে এক শ বারো নম্বর পৃষ্ঠায় যেতে হলে পুরো পৃষ্ঠা পার হয়ে বইয়ের শেষ মাথায় এসে ঘুরে এই নতুন পৃষ্ঠায় যেতে হবে–বলতে পার বিশাল দূরত্ব পার হতে হবে।
আমরা এই মহাকাশযানে করে এ রকম একটা বিশাল দূরত্বে চলে এসেছি তবে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে আসি নি, ওয়ার্মহোল তৈরি করে এসেছি। ওয়ার্মহোল হচ্ছে পৃষ্ঠা ফুটো করে চলে আসার মতো–বইয়ের পৃষ্ঠায় একটা ছোট ফুটো করলেই এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় চলে যাওয়া যায়, এটাও সেরকম।
এখন মনে করা যাক এই বইয়ের মাঝে অন্য এক ধরনের কীট এসেছে। সে বইয়ের পৃষ্ঠা কেটে কেটে যেতে পারে। আমাদের কাছে এই পোকাকে মনে হবে চতুর্মাত্রিক প্রাণী। কারণ এরা সহজেই বইয়ের ভিতর দিয়ে একটার পর অন্য একটা জগতের মাঝে চলে যেতে পারে। এরা যখন আমাদের জগতের ভিতর দিয়ে অর্থাৎ আমাদের পৃষ্ঠার ভিতর দিয়ে যাবে আমরা তখন তাদের দেখব কিন্তু শুধু আমাদের পৃষ্ঠার অংশটুকুই। তার প্রকৃত রূপ আমরা কখনো দেখব না, কখনো জানব না।
ইরন একটু থেমে বলল, বুঝতে পেরেছ?
হ্যাঁ, খানিকটা বুঝতে পেরেছি। পুরোটুকু না বুঝলেও ধারণাটুকু পেয়েছি।
শুমান্তি স্পেসসটটার ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলল, চতুর্মাত্রিক প্রাণী যেহেতু আছে, তার অর্থ চতুর্মাত্রিক জগৎও নিশ্চয়ই আছে। আমরা মানুষেরা সেখানে যেতে পারি না।
না, পারি না। এর অস্তিত্বের কথা জানার পরই নিশ্চয়ই প্রজেক্ট আপসিলন দাঁড়া করানো হয়েছে। পৃথিবীর একজন মানুষকে পাঠানো হয়েছে চতুর্মাত্রিক প্রাণীর কাছে। উপহার হিসেবে। বিনিময়ে এই প্রাণী আমাদের কাছে চতুর্মাত্রিক জগতে যাওয়ার প্রযুক্তি দেবে।
তোমার তাই ধারণা?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, হ্যাঁ। আমার তাই ধারণা।
দ্বিতীয় মাত্রার স্পেসস্যুট পরা যতটুকু কঠিন মনে হয়েছিল দেখা গেল সেটি তার থেকে অনেক বেশি কঠিন। ইরন, শুমান্তি এবং ত্ৰালুস একজন আরেকজনকে সাহায্য করার পরও স্পেসস্যুটগুলো পরতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগে গেল। জীবনরক্ষাকারী মডিউলটি পরীক্ষা করে লুস বলল, এটি ছয় ঘণ্টার মডিউল।
যার অর্থ ছয় ঘণ্টার মাঝে আমাদের এই স্কাউটশিপে ফিরে আসতে হবে?
জীবন্ত অবস্থায় স্কাউটশিপে ফিরে আসার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই, কিন্তু ইরন সেটি কাউকে মনে করিয়ে দিল না, বলল, হ্যাঁ ছয় ঘণ্টার মাঝে আমাদের ফিরে আসতে হবে।
ত্ৰালুস ভন্ট খুলে ভয়ঙ্কর ধরনের কয়েকটি অস্ত্র বের করে ইরন এবং শুমান্তির দিকে এগিয়ে দেয়। শুমান্তি মাথা নেড়ে বলল, আমি অস্ত্র চালাতে জানি না।
এর মাঝে জানার কোনো ব্যাপার নেই। যে জিনিসটাকে আঘাত করতে চাও সেটার দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরবে।
শুমান্তি তবুও অস্ত্রটি নিতে চাইল না, বলল, না, আমি এটা স্পর্শ করতে চাই না।
ইরন একটু হেসে বলল, না চাইলেও তোমাকে নিতে হবে। আমরা ঠিক জানি না আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। হয়তো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু হয়তো অস্ত্র দেখাতে হবে।
শুমান্তি নেহায়েত অনিচ্ছার সাথে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্রটি হাতে তুলে নেয়। সেফটি সুইচটি টেনে নিয়ে সে অস্ত্রটি পিঠে ঝুলিয়ে নিল। ত্ৰালুস ভল্ট থেকে চতুষ্কোণ একটা ভারী বাক্স টেনে বের করে এনে বলল, ইরন, তুমি যেহেতু বলছ অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানোর প্রয়োজন হতে পারে তা হলে কি এই এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা সাথে নিয়ে নেব?
এন্টি ম্যাটার? সেটা দিয়ে কী করবে?
এটা চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে আটকে রাখা আছে। গুলি করে বাক্সটা ভেঙে দিলে গ্রহের অর্ধেকটা উড়ে যাবে।
ইরন কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, হ্যাঁ, তা হলে নিয়ে যাওয়া যাক। কিন্তু এত ভারী এটা টেনে নিতে পারবে?
টেনে নিতে হবে না, ছোট একটা জেট প্যাক আছে।
.
বালুস জেট প্যাকের উপর এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা রেখে জেট প্যাকের ইঞ্জিনটা চাল করে দিতেই সেটা মিটারখানেক উপরে উঠে আসতে শুরু করে। ত্ৰালুস স্কাউটশিপ থেকে আরো কিছু যন্ত্রপাতি তুলে নিয়ে বলল, আমি প্রস্তুত।
চমৎকার। ইরন এগিয়ে গিয়ে স্কাউটশিপের দরজার সামনে দাঁড়াল। লাল রঙের একটা লিভার টেনে দিতেই ঘড়ঘড় শব্দ করে চারপাশের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে তাদেরকে পুরো স্কাউটশিপ থেকে আলাদা করে ফেলল। দরজার কাছে একটা কমলা রঙের উজ্জ্বল আলো জ্বলছে এবং নিভছে, তার নিচে একটা বড় চতুষ্কোণ সুইচ। সেটা চাপ দিয়ে দরজাটি খোলার আগে ইরন ত্ৰালুস এবং শুমান্তির দিকে ঘুরে তাকাল, একমুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা আমাদের কী হবে জানি না। যদি আমরা বেঁচে ফিরে না আসি, তা হলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ করে দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
শুমান্তি নরম গলায় বলল, তোমার ক্ষমা চাওয়ার বা দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেখে নিশি মেয়েটি কত খুশি হবে চিন্তা করে দেখ। সেই আনন্দটুকুর জন্য। জীবন দেওয়াটা এমন কিছু খারাপ নয়।
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তোমাদের ওপর আমার একটু হিংসাই হচ্ছে। জীবনকে এভাবে দেখতে পারাটা মনে হয় খারাপ নয়।
ত্রালুস হেসে বলল, তুলনা করার জন্য আমরা অন্য কোনো জীবন পাই নি তাই বলতে পারছি না কোনটা ভালো কোনটা খারাপ।
চল তা হলে, রওনা দেওয়া যাক।
ইরন চতুষ্কোণ সুইচটা চেপে ধরতেই প্রথমে স্কাউটশিপের বাতাস বের হয়ে বাইরের সাথে বাতাসের চাপ সমান হয়ে গেল। তারপর গোলাকার একটা দরজা ধীরে ধীরে উপরে। উঠে গেল। বাইরে সবুজাভ এক ধরনের আবছা আলো, কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। এক ধরনের ঝড়ো বাতাস বইছে এবং বাতাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে শিশুর কান্নার মতো তীক্ষ্ণ এক ধরনের ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। স্কাউটশিপটি যেখানে নেমেছে সেই জায়গাটি মোটামুটি সমতল, কিন্তু সামনে যতদূর দেখা যায় উঁচুনিচু বিচিত্র আকারের পাথর। দেখে মনে হয় কেউ অনেক কষ্ট করে পাথরগুলো খোদাই করে এ রকম বিচিত্র রূপ দিয়েছে। বাইরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের অনেক অংশ তরল পদার্থে ঢাকা, বেগুনি রঙের তরল কোথাও টগবগ করে ফুটছে, কোথাও বিষাক্ত বাষ্প বের হয়ে ধোঁয়ার মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। বড় পাথরগুলো এবং সমতল স্থানগুলোর স্থানে স্থানে বড় বড় ফাটল এবং সেই ফাটল দিয়ে সবুজাভ এক ধরনের আলো বের হয়ে পুরো এলাকাটি এক ধরনের অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।
ইরন খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, সর্বনাশ! কী মন–খারাপ–করা একটা জায়গা। দেখে মনে হয় এখানে অভ কিছু একটা আছে।
ত্রালুস সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নিচে নামতে নামতে বলল, ঠিকই বলেছ।
এ রকম জায়গায় যে প্রাণীরা থাকে তারা বুদ্ধি কি না জানি না, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই খুব বিষণ্ণ প্রকৃতির। শুমান্তি তরল গলায় বললু এখানে আনন্দ পাবার কিছু নেই।
সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে ত্ৰালুস সাবধানে মাটিতে পা রেখে বলল, মাটি শক্ত নয়, অনেকটা ভেজা বালির মতো।
ইরন বলল, সাবধানে যাও ত্রালুস।
হা, ত্ৰালুস খুব সাবধান।
ভাসমান জেট প্যাকের উপর এন্টি ম্যাটারের ভারী বাক্স এবং যন্ত্রপাতি রেখে এক হাত দিয়ে সেটাকে টেনে ত্রাপুস সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে, অন্য হাতে ভয়ঙ্করদর্শন অস্ত্রটি ধরে রাখে। ত্ৰালুসের পর শুমান্তি এবং সবার শেষে ইরন, দুজনেই অনভ্যস্ত হাতে একটি করে অস্ত্র ধরে রেখেছে।
সবুজাভ আবছা আলোতে তিন জন নিজেদের মাঝে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে থাকে। ঝড়ো হাওয়া কখনো সামনে থেকে কখনো পিছন থেকে আসছে। বাতাসে এক ধরনের সূক্ষ্ম বেগুনি রঙের ধুলো উড়ছে। স্পেসসটের চোখের সামনে ভিজরটি বারবার মুছেও পরিষ্কার রাখা যাচ্ছে না।
তিন জন বাতাসের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে শুনতে সামনে এগুতে থাকে। বড় বড় বিচিত্র পাথরের মাঝে জায়গা করে হাঁটতে হাঁটতে শুমান্তি জিজ্ঞেস করল, আমরা কোন দিকে। যাচ্ছি?
ত্রালুস ভাসমান জেট প্যাকে একটা মনিটর দেখে বলল, কীশার স্কাউটশিপ থেকে একটা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে। সেটা লক্ষ্য করে যাচ্ছি।
কতদূর যেতে হবে?
খুব বেশি দূরে নয়। বড়জোর এক কিলোমিটার।
যদি সোজাসুজি যেতে পারি তা হলে এক কিলোমিটার। কিন্তু যেরকম পথ দিয়ে যাচ্ছি কোনো কি নিশ্চয়তা আছে?
নেই। সত্যি কথা বলতে কী, হঠাৎ যদি বেগুনি রঙের একটা বিষাক্ত হ্রদের সামনে এসে পড়ি তা হলে বিপদ হয়ে যাবে।
ইরন বলল, তখন এক জন এক জন করে এই জেটপ্যাকে করে হ্রদ পার হতে হবে।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ।
সৌভাগ্যক্রমে পথে হঠাৎ করে টগবগে বেগুনি রঙের তরলের কোনো হ্রদ ছিল না, নানা আকারের পাথরের মাঝে পথ করে ভেজা বালুর মতো মাটির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তারা শেষ পর্যন্ত কীশার স্কাউটশিপের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। কয়েক শত মিটার উঁচু কয়েকটা পাথরের পিছনে, ধূসর আকাশের খোলা আলোতে স্কাউটশিপটিকে একটি অতিকায় পশুর মতো দেখায়। ত্ৰালুস দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল চোখে লাগিয়ে কীশা এবং নিশিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণ খুঁজেই তাদের পাওয়া গেল। স্কাউটশিপ থেকে দু শ মিটার দূরে কয়েকটা গোলাকার মসৃণ পাথরের সামনে অপেক্ষা করছে। নিশি হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে কীশা। নির্জন একটি গ্রহে ঝড়ো বাতাসের কুদ্ধ গর্জনের মাঝে দুজনকে এভাবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটিকে হঠাৎ করে একটি অপার্থিব অশরীরী দৃশ্য বলে মনে হয়।
ত্রালুস তার অস্ত্রটিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এখন আমরা কী করব?
ইরন বহুদূরের কীশা এবং নিশির অবস্থানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা কথা বলার জন্য গোপন চ্যানেল ব্যবহার করছি, তাই কীশা সম্ভবত আমাদের কথা শুনতে পায় নি, এখনো জানে না আমরা তার এত কাছে চলে এসেছি।
ত্রালুস বলল, কিন্তু অনুমান করতে পারছে।
হ্যাঁ, সম্ভবত পারছে। আমার মনে হয় আমরা এখন তিনটি ভিন্ন জায়গা থেকে কীশার দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যাই।
ত্রালুস মাথা নাড়ল, বলল, সরাসরি তাকে বলতে হবে, এই মুহূর্তে নিশিকে চলে আসতে দিতে হবে। যদি না দেয় আমরা তাকে শেষ করে দেব। রোবটকে শেষ করায় কোনো অপরাধ নেই।
ইরন ত্রালুসের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, দেখ, আমি কীশাকে এখনো একটা রোবট বলে ভাবতে পারছি না।
কিন্তু
শুমান্তি ত্রালুসকে বাধা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ব্রালুস। আমিও পারছি না। আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না, শুধু ব্যবহার করার ভয় দেখাব।
সেটা করতে হলে তোমাকে সত্যিই বিশ্বাস করতে হবে যে তুমি অস্ত্র ব্যবহার করবে।
না–তার প্রয়োজন নেই
শুমান্তি এবং ত্রালুসের মাঝে একটা ছোট বিতর্ক শুরু হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ইরন হাত তুলে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন কী ঘটবে আমরা জানি না, কাজেই কী করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে আমরা সেটাও জানি না। তাই ঘুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। তিন দিক থেকে কীশাকে ঘিরে ফেলা যাক। ট্রিগারে হাত দেবার আগে খুব সাবধান, কীশা আর নিশি কিন্তু খুব কাছাকাছি।
ঠিক আছে।
ইরন আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বলে কয়েকটা জরুরি বিষয় ঠিক করে নেয়। তারপর একজন আরেকজনের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তিন জন তিন দিকে যেতে শুরু করে। জেট প্যাকটা এবারে ইরনের কাছে, সে সাবধানে সেটাকে টেনে নিতে থাকে।
আবছা অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে কীশার যেটুকু কাছে যাবার ইচ্ছে ছিল ইরন ততটুকু কাছে যেতে পারল না। তার আগেই হঠাৎ করে কীশা সচকিত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কে? কে ওখানে?
ইরন জেট প্যাকের পিছনে নিজেকে আড়াল করে বলল, আমি। আমি ইরন।
কীশাকে হঠাৎ করে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে হল, মনে হল কিছু একটা নিয়ে সে ভারি দুশ্চিন্তায় ছিল, হঠাৎ করে সেই দুশ্চিন্তার বিষয়টি অপসারিত হয়ে গেছে। সে খানিকটা খুশি খুশি গলায় বলল, ও, তোমরা এসেছ?
হ্যাঁ।
কেন এসেছ?
নিশিকে নিতে।
নিশিকে নিতে? কিন্তু তোমরা তো নিশিকে নিতে পারবে না।
কেন পারব না?
কারণ আমি নিশিকে ওদের দিয়ে দিয়েছি। ওরা এক্ষুনি ওকে নিতে আসবে।
তুমি জান ওরা কারা? তুমি কি ওদের দেখেছ?
না। আমি দেখি নি।
ইরন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা দেখেছি, তুমি নিশিকে ওদের দিতে পারবে না।
কীশা কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ইরন গলার স্বর উঁচু করে নিশিকে ডাকল। বলল, নিশি তুমি আমার কাছে চলে এস। তিন দিক থেকে তিন জন কীশার দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। সে তোমাকে কিছু করার চেষ্টা করলেই তাকে শেষ করে দেবে।
নিশি সোজা হয়ে বসল, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমি কেমন করে আসব? এই দেখ আমাকে বেঁধে রেখেছে।
নিশি দেখাল তার স্পেসস্ট থেকে শক্ত ধাতব শেকল বের হয়ে এসেছে। শেকল দিয়ে সে চতুষ্কোণ একটা বাক্সের সাথে বাধা।
ইরন সাবধানে আরো কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, ওটা কিসের বাক্স? ওর ভিতরে কী আছে?
নিশি মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না।
ইরন আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়। কীশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কীশা।
বল।
এই বাক্সটি কী?
আমি ঠিক জানি না।
এই বাক্সটির সাথে নিশিকে বেঁধে রেখেছ কেন?
আমার মনে হয় এখান থেকে কোনো ধরনের সঙ্কেত বের হচ্ছে। ওরা এই সঙ্কেত থেকে বুঝতে পারবে নিশি কোথায়।
ও। ইরন মাথা নেড়ে বলল, নিশি তুমি বাক্সটি থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরে দাঁড়াও।
নিশি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন?
আমি গুলি করে এই বাক্সটি ধ্বংস করে দেব।
কীশা হাসির মতো শব্দ করে বলল, না ইরন, তুমি সেটা করবে না।
কেন?
কারণ আমি তোমাকে করতে দেব না। কীশা তার কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে নিশিকে জাপটে ধরে চতুষ্কোণ বাক্সটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিশিকে বাক্সটার উপর চেপে রেখে বলল, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। আমাকে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে আমি তার বাইরে কিছু করতে পারব না।
কীশা ইরন চিৎকার করে বলল, কীশা—
আমি দুঃখিত ইরন। ঐ দেখ ওরা আসছে।
ইরন আকাশের দিকে তাকাল, আকাশের নানা জায়গায় বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আলো জ্বলছে। চারদিক থেকে কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটা কিলবিল করে আবার অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করে।
নিশি চিৎকার করে ওঠে আতঙ্কে, কীশা তাকে শক্ত করে ধরে রেখে শান্ত গলায় বলে, আর কয়েক সেকেন্ড নিশি। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
ইরন শুনতে পেল ত্ৰালুস এবং শুমান্তি ছুটে আসছে। এলুস অস্ত্র উদ্যত করে বলল, সরে যাও কীশা, সরে যাও। ছেড়ে দাও নিশিকে। ছেড়ে দাও।
কীশা ত্রালুসের কথা শুনতে পেল বলে মনে হল না। নিশিকে চেপে ধরে রেখে নিচু গলায় বলল, নিশি লক্ষ্মী মেয়ে। তুমি ছটফট কোরো না, চুপ করে শুয়ে থাক। তারা আমাদের খুঁজে পেয়েছে। ঐ দেখ তারা আসছে।
নিশি আতঙ্কে একটা আর্তচিৎকার করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে, একটি ঝটকা দিয়ে উঠে বসে, ত্রালুস এবং শুমান্তি কীশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টেনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক তখন খুব কাছে হঠাৎ করে একটা তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল, কালো ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে যায় এবং হঠাৎ করে কীশা একটা আর্তনাদ করে ওঠে।
ত্রালুস এবং শুমান্তি চিৎকার করে পিছনে সরে এল, কীশার স্পেসস্যুট ভেঙে তার ভিতর থেকে কুৎসিত থলথলে মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটা বের হয়ে আসছে। ইরন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল–নিশিকে নেবার জন্য চতুর্মাত্রিক প্রাণীটি যেখানে হাজির হয়েছে ঠিক সেখানে কীশা ছিল, প্রাণীটি নিশিকে নিতে পারে নি কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে কীশার শরীরের ভিতর দিয়েই বের হয়ে এসেছে। ইরন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল, অবাক হয়ে দেখল, তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে ভিতর থেকে থলথলে মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটা বের হয়ে আসছে। কীশা থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার মুখ যন্ত্রণায় বিবর্ণ হয়ে উঠছে–দাতে দাঁত চেপে সে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে ওঠে।
ত্রালুস আর সহ্য করতে পারল না, অস্ত্রটি উপরে তুলে থলথলে মাংসপিণ্ডের মতো জিনিসটা লক্ষ্য করে গুলি করে বসে। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, কালো ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে যায়। এক ধরনের জান্তব শব্দ শুনতে পেল সবাই, থলথলে জিনিসটি জান্তব। এক ধরনের শব্দ করতে থাকে, ভিতর থেকে সাদা কষের মতো আঠালো এক ধরনের তরল ফিনকি দিয়ে বের হতে শুরু করে। মাংসপিণ্ডটি হঠাৎ বিশাল বড় হয়ে যায়, সেখান থেকে। অসংখ্য শুড়ের মতো জিনিস বের হয়ে আসে। সেগুলো কিলবিল করতে করতে হঠাৎ করে পুরো জিনিসটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
পুরো ব্যাপারটি বুঝতেই তাদের কয়েক মুহূর্ত সময় লেগে যায়। যখন বুঝতে পারল তখন তারা দৌড়ে কীশার কাছে গেল, তার শরীর এবং স্পেসস্যুটটা দেখে মনে হয় তার শরীরের ভিতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। ইরন কীশার হাত ধরে দেখল সেটি নিশ্চল, দেহে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। শুমান্তি ফ্যাকাসে মুখে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে। কীশার?
আমার ধারণা একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিশিকে নেওয়ার জন্য প্রাণীটা আসছিল, ঠিক যেখানে বের হয়েছে সেখানে কীশা ছিল। হুটোপুটি হওয়ার কারণে প্রাণীটা ওর শরীরের ভিতর দিয়ে বের হয়ে এসেছে।
ত্রালুস একটু এগিয়ে এসে বলল, কীশা কি মারা গেছে? রোবট কি মারা যায়?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কীশা আসলে পুরোপুরি রোবট ছিল না। একটা সত্যিকার মানুষের মাথায় তার মস্তিষ্কের একটা অংশে কপোট্রন লাগিয়ে ওকে তৈরি করা হয়েছে। কপোট্রনটা শরীরের উপর নির্ভর করে ছিল। শরীর ধ্বংস হয়ে গেলে কপোট্রনটা আর থাকতে পারে না। আমার ধারণা ওর কপোট্রনটাও আর কাজ করছে না।
ইরন কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে শুনতে পেল খুব চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে কেউ তাকে ডাকছে। ইরন চমকে উঠল, কে?
আমি। আমি কীশা।
ইরন কীশার উপর ঝুঁকে পড়ল, কীশা তুমি বেঁচে আছ?
আমি জানি না। এটা বেঁচে থাকা কি না। যদি এটা বেঁচে থাকাও হয় তা হলেও আমি আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকব না। রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে বলে খুব দ্রুত আমার সবকিছু একটি একটি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন আর কিছু দেখতে পারছি না।
কীশা, আমরা খুব দুঃখিত। আমরা
আমি জানি। আমাকে তারা রোবট হিসেবে তৈরি করেছিল কিন্তু আমার ভিতরে যেটুকু স্মৃতি, যেসব অনুভূতি সব আমার নিজের। আমার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ নিশ্চয়ই এখনো কোথাও রয়ে গেছে। মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা কী আমি জানি ইরন।
আমরা কি তোমার জন্য কিছু করতে পারি, কীশা?
না। কিছু করতে পারবে না। কীশার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে, কষ্ট করে বলে, আমি ভোকাল কর্ডকে আর ব্যবহার করতে পারছি না, আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ইরন
বল কীশা।
আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের ভয়াবহ বিপদে এনে ফেলেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি নিজের ইচ্ছায় করি নি। আমার কোনো উপায় ছিল না।
আমরা জানি।
তোমাদের কথাও এখন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। ভালো করে আর শুনতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে আমি ভেসে ভেসে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না, কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কিছু বুঝতে পারছি না।
কীশা। কীশা। ইরন চিৎকার করে ডাকল, কীশা।
বল ইরন।
ইরন চিৎকার করে উঠল, আমরা তোমাকে ভুলব না। আমরা সবসময় তোমাকে মনে রাখব। তোমার জন্য সবসময় আমাদের বুকে ভালবাসা থাকবে কীশা।
ভালবাসা। কীশার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে, ফিসফিস করে বলে, মানুষের ভালবাসা। আহা! কেন ওরা আমাকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দিল না? কেন?
ইরন কীশার উপর ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করে বলল, কীশা শরীরের গঠন দিয়ে মানুষ হয় না, নিউরন৩৪ আর সিনাপ্সের সংযোগ দিয়ে মানুষ হয় না, কপোট্রনের নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়েও মানুষ হয় না। মানুষ হচ্ছে তার বুকের ভিতরের অনুভূতি। তুমি মানুষ কীশা, তুমি মানুষ, তুমি পুরোপুরি একজন মানুষ।
আমি শুনতে পাচ্ছি না ইরন। মনে হচ্ছে আমি বহুদূরে চলে যাচ্ছি, বহুদূরে। বহুদূরে–
ইরন চিৎকার করে বলল, তুমি মানুষ কীশা। তুমি আমাদের মতো মানুষ। তোমার জন্য আমাদের ভালবাসা। ভালবাসা।
কীশা ফিসফিস করে বলল, ভালবাসা? আমার জন্য ভালবাসা? তার গলার স্বর একেবারে অস্পষ্ট হয়ে আসে, অনেক চেষ্টা করেও আর তার কথা শোনা গেল না।
ইরন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল, বলল, কীশার কপোট্রন থেমে গেছে।
৩.৪ শুমান্তি আর ত্রালুস
শুমান্তি আর ত্রালুস কোনো কথা বলল না, শূন্য দৃষ্টিতে কীশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরন ঘুরে ত্রালুস এবং শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। চতুর্মাত্রিক প্রাণী এক্ষুনি নিশ্চয়ই আবার নিশিকে নিতে আসবে।
ত্ৰালুস জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব ইরন?
প্রথমে খুব সাবধানে নিশির শরীরের সাথে বাধা ঐ সিগন্যাল বিকনটি৩৬ ধ্বংস করে দাও। তারপর নিশিকে মুক্ত করে স্কাউটশিপে ফিরে চল।
শুমান্তি বলল, আমাদের নিজেদের স্কাউটশিপে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কীশার স্কাউটশিপটাই ব্যবহার করতে পারব।
হঁ। ঠিকই বলেছ। ইরন চিন্তিত মুখে বলল, শেষ পর্যন্ত কী হবে আমরা জানি না। চতুর্মাত্রিক প্রাণীর সাথে ত্রিমাত্রিক প্রাণী যুদ্ধ করতে পারে না। আমরা বেশিরভাগ সময় তাদের দেখতে পর্যন্ত পাই না।
কিন্তু তুমি বলেছ, তারাও পায় না। অসীমসংখ্যক ত্রিমাত্রিক জগৎ আছে তার কোনটার মাঝে আমরা আছি তারা জানে না।
কিন্তু এখন জানে–নিশির শরীরের সাথে সিগন্যাল বিকন বেঁধে রেখেছে, সেখান থেকে সঙ্কেত বের হচ্ছে। তারা সেই সঙ্কেত দিয়ে আমাদের খুঁজে বের করেছে।
ত্রালুস বলল, তা হলে প্রথমে এই বিকটাই উড়িয়ে দিই।
ত্রালুস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে নিশির দিকে এগিয়ে যায়। নিশিকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে সে বিকনটির দিকে অস্ত্র তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে। একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, কালো ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেল বিকনটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। নিশি তার শরীরের সাথে বাধা শেকলটি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ত্রালুসের দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে।
আমার নাম ত্রালুস।
ধন্যবাদ ত্রালুস।
শুমান্তি এগিয়ে এসে বলল, আমি শুমান্তি।
নিশি শুমান্তির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বাঁচানোর জন্য এসেছ বলে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
ইরন আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ধন্যবাদ দেওয়ার কিংবা নেওয়ার সময় মনে হয় নেই। চতুর্মাত্রিক প্রাণী আবার আসছে। আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাবার চেষ্টা করা উচিত।
সবাই আকাশের দিকে তাকাল। ধূসর আকাশে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে। থলথলে কুৎসিত মাংসপিণ্ড দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ইরন কঠোর গলায় বলল, সবাই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাক।।
শুমান্তি অস্ত্র হাতে তুলে চারদিকে তাকাল, বলল, ওরা কি আমাদের দেখছে?
ইরন মাথা তুলে তাকাল, চারদিক থেকে ঘিরে আসা আলোর বিচ্ছুরণগুলো আরো কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, থলথলে মাংসপিণ্ডগুলোকে আরো জীবন্ত বলে মনে হচ্ছে। ইরন গলার স্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল, ওরা আমাদের দেখছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা নিজেরা নিজেদেরকে যেভাবে দেখি ওরা তার চাইতে অনেক ভালোভাবে। দেখছে।
শুমান্তি ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ!।
ইরন হাতের অস্ত্রটি শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আমাদের যেহেতু দেখে ফেলেছে, আমার মনে হয় তা হলে ভালো করেই দেখুক। জানুক যে আমরা কিছুতেই নিশিকে নিতে দেব না। তোমরা অস্ত্র তাক করে নিশিকে ঘিরে দাঁড়াও।
ত্রালুস আর শুমান্তি নিশির দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ত্রালুস কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, যদি হঠাৎ করে হাজির হয় তা হলে কী করব।
গুলি করবে। আমরা যে নিশিকে নিতে দেব না সেটা বোঝানোর আর কোনো পথ আমার জানা নেই।
যদি সত্যিই ওরা বুদ্ধিমান প্রাণী হয়ে থাকে তা হলে ওরা কি আমাদের মনের কথা বুঝতে পারছে না?
আমি জানি না। যদি জেনে থাকে তা হলে ভালো।
কিন্তু দেখা গেল চতুর্মাত্রিক প্রাণীরা ওদের মনের কথা জানে না। নিশিকে ঘিরে রেখে তিন জন স্কাউটশিপের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে তাদের সামনে প্রথমে একটা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ এবং প্রায় সাথে সাথে থলথলে একটা মাংসপিও হঠাৎ করে তাদের সামনে এসে হাজির হল। মাংসপিণ্ডটি সামনে একবার দুলে উঠে তারপর ধাক্কা দিয়ে তাদের নিচে ফেলে দেয়। কিছু বোঝার আগেই থলথলে মাংসপিণ্ড থেকে অনেকগুলো শুড় বের হয়ে আসে, শুড়গুলো সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে। তারপর হঠাৎ সেগুলো বিদ্যুদ্বেগে নিশির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, নিশি ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, তার। মাঝেই খুঁড়গুলো নিশিকে জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নেয়। মাংসপিণ্ডের এক অংশ হঠাৎ করে অন্ধকার গহ্বরের মতো খুলে যায় এবং ঔড়গুলো যাচকা টানে নিশিকে সেই অন্ধকার গহ্বরের মাঝে টেনে নিয়ে যায়। নিশির আর্তচিৎকার হঠাৎ করে থেমে গিয়ে এক ভয়াবহ। নীরবতা নেমে আসে।
ইরন অস্ত্র হাতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, থলথলে এই মাংসপিণ্ডের মাঝে নিশি আটকা পড়ে আছে, তাকে কি সে এখন গুলি করতে পারবে? গুলির বিস্ফোরণে নিশিও কি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে না? ত্ৰালুস এবং শুমান্তিও উঠে দাঁড়াল। অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।
ইরন দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করে। একটি চতুর্মাত্রিক প্রাণী ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণীকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে কি কোনোভাবে থামানো যায় না? চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে কি ত্রিমাত্রিক জগতে আটকানো যায় না? ত্রিমাত্রিক প্রাণী যদি দ্বিমাত্রিক জগতের ভিতর দিয়ে যেত তা হলে কী হত? একটি দ্বিমাত্রিক প্রাণী যদি ত্রিমাত্রিক প্রাণীকে আটকানোর চেষ্টা করত তা হলে কী করত? চিন্তা করার খুব বেশি সময় নেই, কিছু একটা করতে হবে, সামনে ঝুলে থাকা এই থলথলে মাংসপিণ্ডটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে আর কখনো তারা এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীটিকে খুঁজে পাবে না। নিশিকে নিয়ে সে চিরদিনের জন্যে মহাবিশ্বের বিশাল চতুর্মাত্রিক জগতে হারিয়ে যাবে। ইরন থলথলে কুৎসিৎ মাংসপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে, এখানে নিশ্চয়ই প্রাণীটির চোখ, নাক, মুখ বা অন্য স্পর্শ ইন্দ্রিয় লুকিয়ে আছে, প্রাণীটি হয়তো তাদের। দেখছে, তাদের নির্বুদ্ধিতা দেখে পরিহাস করছে। হয়তো প্রচণ্ড ক্রোধে তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, হয়তো তাদের নিয়ে কৌতুক করছে। কিন্তু এই থলথলে মাংসপিণ্ডটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে আর তারা এর নাগাল পাবে না। কিন্তু প্রাণীটি অদৃশ্য চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে তাদের দেখতে পারবে। তাদের নিয়ে পরিহাস করতে পারবে, তাদের ওপর ক্রোধান্বিত হতে পারবে। কৌতুক করতে পারবে। এই প্রাণীটিকে কিছুতেই চলে যেতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।
ইরন দেখতে পায় সরূসর শব্দ করে এই মাংসপিণ্ডটি তার আকৃতি পরিবর্তন করছে, কখনো বড় হচ্ছে কখনো ছোট হচ্ছে, কখনো তার ভিতর থেকে বিচিত্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের হয়ে আসছে। ইরন জানে প্রাণীটি আসলে তাদের এই জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, তাই তাদের। কাছে মনে হচ্ছে এটি আকৃতি পরিবর্তন করছে। প্রাণীটির যে অংশ এই জগতের মাঝে রয়েছে সেইটুকুকে এখানে আটকাতে হবে। যেভাবে সম্ভব।
ইরন দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করে, সময় চলে যাচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে প্রাণীটি অদৃশ্য। হয়ে যেতে পারে, যেটাই করতে হয় সেটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। তার মাথায় হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা উঁকি মারে, ব্যাপারটা আদৌ সম্ভব কি না সে নিশ্চিত নয় কিন্তু এখন আর ভেবে দেখার সময় নেই। সে চিৎকার করে ত্রাস আর শুমান্তিকে ডাকল। তারা গুঁড়ি মেরে কাছে এগিয়ে আসে। ইরন চাপা গলায় বলল, প্রাণীটিকে আটকাতে হবে, যেভাবে, যেভাবে সম্ভব।
কীভাবে আটকাবে?
আমাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রকে শক্তিশালী লেজার৩৭ রশ্মি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
হ্যাঁ, ত্রালুস মাথা নাড়ল, মেগাওয়াট শক্তি বের হয়।
মনে হয় কাজ চালানোর জন্য যথেষ্ট। আমরা প্রাণীটার তিন দিকে দাঁড়াব, আমি সামনে, ত্রালুস বামে এবং মান্তি নিচে। আমি সামনে থেকে লেজার রশ্মি দিয়ে প্রাণীটাকে গেঁথে ফেলব। খুব সূক্ষ্ম রশ্মি, সম্ভবত প্রাণীটার বড় কোনো ক্ষতি হবে না। ঠিক একই সময় ত্রালুস বাম থেকে ডান দিকে লেজার রশ্মি দিয়ে গেঁথে ফেলবে, শুমান্তি নিচে থেকে উপরে। একই সাথে তিনটি ভিন্ন মাত্রা থেকে আটকে ফেললে প্রাণীটা এই ত্রিমাত্রিক জগতে আটকা পড়ে যাবে, এখান থেকে আর বের হতে পারবে না। লেজার রশ্মিটুকু বন্ধ করবে না, এটাকে জ্বালিয়ে রাখবে।
কিন্তু বেশিক্ষণ তো রাখা যাবে না। একটানা খুব বেশি হলে পনের মিনিট।
যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণই রাখ। কিছু করার নেই। দেরি করা যাবে না, তোমরা নিজেদের জায়গায় যাও, এই আমাদের শেষ আশা।
নিশিকে এতক্ষণে চতুর্মাত্রিক জগতে নিয়ে গেছে, আমি নিশ্চিত সে এখানে নেই। যাও–দেরি কোরো না।
ত্রালুস অস্ত্রটি লেজার রশ্মির জন্য প্রস্তুত করতে করতে বাম দিকে সরে গেল। শুমান্তি প্রাণীটির নিচে গিয়ে দাঁড়াল। ইরন অস্ত্রটিকে পূর্ণ শক্তির জন্য প্রোগ্রাম করে ট্রিগারে হাত দেয়। তারপর প্রাণীটির দিকে তাক করে চিৎকার করে বলল, টানো ট্রিগার।
তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে শক্তিশালী লেজার রশ্মির আলো ঝলকে উঠল, প্রাণীটি মুহূর্তের জন্য ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল, হঠাৎ করে মনে হল পায়ের নিচে মাটি বুঝি থরথর করে কেঁপে উঠেছে।
প্রাণীটির শরীর থেকে হঠাৎ সহস্র ওঁড়ের মতো জিনিস বের হয়ে কিলবিল করতে লাগল, দেখে মনে হল তাদেরকে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদেরকে নাগালে না পেয়ে ক্রুদ্ধ আক্রোশে ছটফট করতে থাকে। ইরন, ত্রাস আর শুমান্তি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তীব্র লেজার রশ্মির বেগুনি আলো দিয়ে কদাকার প্রাণীটিকে শূন্যে আটকে রাখল।
ইরন বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে এই প্রথমবারের মতো প্রাণীটির আকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে না, সত্যি সত্যি এটি এই জগতে আটকা পড়ে গেছে। ইরন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণী হয়ে সত্যি তারা চতুর্মাত্রিক জগতের একটি প্রাণীকে আটকে ফেলতে পেরেছে। প্রাণীটা নিজের শরীরকে দ্বিখণ্ডিত না করে এখন আর চতুর্মাত্রিক জগতে যেতে পারছে না। যতক্ষণ লেজার রশ্মি প্রাণীটির ভিতর দিয়ে যাবে প্রাণীটি এখান থেকে নড়তে পারবে না। তাদের লেজার রশ্মি। আর মিনিট পনের পর্যন্ত থাকবে তার ভিতরে কিছু একটা করতে থাকবে। শুধু তাই নয় ক্রুদ্ধ প্রাণীটি নিশ্চয়ই নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে তার অন্য অংশ নিশ্চয়ই তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। সেই আক্রমণ থেকেও তাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে তিন জন তিনটি অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে, নিজের জায়গা থেকে কেউই নড়তে পারছে না। ইরন গলা উঁচিয়ে ত্ৰালুস আর শুমান্তিকে ডেকে বলল, তোমরা কোনো অবস্থাতেই লেজার রশ্মি বন্ধ কোরো না, যতক্ষণ এই রশি বের হতে থাকবে ততক্ষণ প্রাণীটা আটকে থাকবে।
ঠিক আছে।
আমি আমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা এই পাথরের উপর রাখছি। এখান থেকেই লেজার রশি তাক করে রাখব।
কেন?
প্রাণীটা যদি চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে আক্রমণ করে তা হলে পাল্টা আক্রমণ করা দরকার।
কী দিয়ে আক্রমণ করবে?
দেখি কী আছে।
ইরন লেজার রশ্মিটুকু চালু রেখে খুব সাবধানে অস্ত্রটি একটি পাথরের উপর নামিয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকাল। বহুদূরে আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে, তা হলে কি চতুর্মাত্রিক প্রাণী তাদের দিকে আসছে? ইরন কাছাকাছি ভেসে থাকা জেট প্যাকটির দিকে ছুটে গেল, উপরে কিছু দ্বিতীয় মাত্রার বিস্ফোরক, মাঝারি পাল্লার অস্ত্র, ব্যবহারী যন্ত্রপাতি এবং একটি চতুষ্কোণ বাক্স। ইরন চতুষ্কোণ বাক্সটির কাছে গিয়ে সেটি চিনতে পারে, এটি এন্টি ম্যাটারের বাক্স। এখানে যে পরিমাণ এন্টি ম্যাটার রয়েছে সেটি দিয়ে এই গ্রহের অর্ধেকটুকু উড়িয়ে দেওয়া যাবে। ইরন একটি নিশ্বাস ফেলে, চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে জানাতে হবে তারা প্রয়োজন হলে এই গ্রহটির অর্ধেকটুকু উড়িয়ে দেবে, লেজার রশ্মি দিয়ে বেঁধে রাখা প্রাণীটার অংশটুকুসহ।
ইরন মাঝারি পাল্লার একটি অস্ত্র হাতে তুলে নিল। কিছু বিস্ফোরক তুলে নিতে গিয়ে থেমে গিয়ে সে পুরো জেট প্যাকটি টেনে নিয়ে আসে। ত্ৰালুস তার লেজার রশিটুকু স্থিরভাবে। ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে ইরনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জেট প্যাক দিয়ে কী করবে?
এখানে এন্টি ম্যাটারের বাক্সটা রয়েছে।
কী করবে এন্টি ম্যাটার দিয়ে?
এই গ্রহটার অর্ধেকটুকু উড়িয়ে দেব।
শুমান্তি কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, উড়িয়ে দেবে?
হ্যাঁ।
উড়িয়ে দেবার ভয় দেখাবে, না সত্যি সত্যি উড়িয়ে দেবে?
সত্যি সত্যি উড়িয়ে দেব। এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীটা যদি চায় শুধুমাত্র তা হলেই সে। আমাদের থামাতে পারবে।
অর্থাৎ নিশিকে যদি ফিরিয়ে দেয়?
হ্যাঁ। নিশিকে যদি ফিরিয়ে দেয়।
ইরন জেট প্যাকটি চতুর্মাত্রিক প্রাণীর একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যায়। এন্টি ম্যাটারের বাক্সটি জেট প্যাকের মাঝামাঝি রেখে সেটিকে বিস্ফোরক দিয়ে ঢেকে দেয়। বড় একটি টাইমার দেওয়া বিস্ফোরককে আলাদা করে নিয়ে ইরন সেখানে সময় নির্ধারিত করে দেয়। লেজার রশ্মিটুকু সম্ভবত আরো দশ মিনিট পর্যন্ত থাকবে, সেগুলো শেষ হবার আগেই এই বিস্ফোরণটি ঘটতে হবে, কাজেই সাড়ে সাত মিনিট সম্ভবত পর্যাপ্ত সময়। এর মাঝে যদি কিছু না করা হয় তা হলে ঠিক সাড়ে সাত মিনিট পরে বিস্ফোরণ ঘটবে। এই বিস্ফোরণে এন্টি ম্যাটারের নিরাপদ শীল্ডিং চূর্ণ হয়ে যাবার কথা, সেটি তার ভারী ধাতব বাক্স স্পর্শ করামাত্রই পদার্থ–প্রতিপদার্থের সংঘাতে পুরো পদার্থ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে, এ ধরনের বিস্ফোরণ সচরাচর দেখা যায় না, ইরন একটি নিশ্বাস ফেলল, বিস্ফোরণে তারা সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে–কিছু বোঝার আগেই। দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা কোনোকিছুর অনুভূতিই তারা পাবে না–যদি দেহটিই না থাকে তা হলে ব্যথা বা দুঃখ–কষ্টটি হবে কোথায়?
এতক্ষণ নিজের ভিতরে যে উত্তেজনা ছিল হঠাৎ করে সেই উত্তেজনাটি কেন জানি কমে গিয়ে ইরন নিজের ভিতরে একটি বিচিত্র ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে, তার পক্ষে যেটুকু করার ছিল সে তার পুরোটুকু করেছে, এখন কিছুতেই আর কিছু আসে–যায় না। চতুর্মাত্রিক প্রাণী যদি নিশিকে ফেরত না দেয় এই গ্রহের অর্ধেকটুকুসহ তারা তিন জন কিছু বোঝার আগেই ভস্মীভূত হয়ে যাবে। মৃত্যুর ব্যাপারটিও এখন আর সেরকম ভয়ানক মনে হচ্ছে না।
ইরন হেঁটে হেঁটে শুমান্তির কাছে গিয়ে তাকে ডাকল, শুমান্তি।
বল।
লেজারটা এভাবে শক্ত করে ধরে রাখতে তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।
না সেরকম কষ্ট হচ্ছে না।
আমরা খুব বেশি হলে আর মিনিট সাতেক বেঁচে থাকব। জীবনের এই শেষ সময়টা এ রকম কষ্ট না করলেই হয়। লেজারটা সাবধানে নিচে রেখে চলে এস। দূরে দাঁড়িয়ে দেখি কী হয়।
শুমান্তি কিছু বলার আগেই ত্রানুস বলল, ঠিকই বলেছ। শুমান্তি আগে তুমি রাখ, তারপর আমি রাখব।
শুমান্তি বেগুনি রঙের মেগাওয়াট রশিটুকু, যার ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে মেগাজুল শক্তি বের হয়ে যাচ্ছে, অপরিবর্তিত রেখে খুব সাবধানে লেজারটি নিচে নামিয়ে রাখে। অস্ত্রটি থেকে তিনটি ধাতব খণ্ড বের হয়ে আসে, তার উপর ভর করে সেটি স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
শুমান্তির লেজারটি স্থির করে দুজন লালুসের কাছে এগিয়ে গেল, তাকেও লেজারটি নিচে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করে তারপর তিন জন ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লেজার থেকে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী তিনটি লেজার রশ্মি মাটি থেকে কয়েক মিটার উপরে চতুর্মাত্রিক প্রাণীটির একটি অংশকে আটকে রেখেছে, প্রাণীটি এতটুকু নড়তে পারছে না, একটু নড়লেই লেজারের ভয়ঙ্কর রশ্মি সেটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে, নিজেকে ধ্বংস না করে এই প্রাণীটির চতুর্মাত্রিক জগতে ফিরে যাবার আর কোনো উপায় নেই।
ইরন একটি নিশ্বাস ফেলে প্রাণীটার নিচে রাখা জেট প্যাকটির দিকে তাকাল। সেখানে টাইমার লাগানো বিস্ফোরকটি অস্পষ্ট এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করছে। এখান থেকেও টাইমারের সময়টুকু স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, আর মাত্র ছয় মিনিট বাকি।
ত্রালুস হালকা স্বরে বলল, এটি একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা বলা যায়। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি সবকিছু নিয়ে ধ্বংস হওয়ার জন্য।
শুমান্তি কোনো কথা বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরন হাসার চেষ্টা করে বলল, এত নৈরাশ্যবাদী হচ্ছ কেন? নিশিকে ফিরিয়ে তো দিতেও পারে।
ত্রালুস, ফিরিয়ে দেওয়ার খুব বেশি সময় নেই। আর মাত্র ছয় মিনিট।
ত্রালুস টাইমারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় নিতে চাই না, কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চয়ই জান?
কী?
নিশিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু ছয় মিনিট সময় নেই। যদি সত্যিই তাকে ফিরিয়ে দেয় তা হলে আমাদের এই বিস্ফোরকের সাথে লাগানো টাইমারটি বিকল করতে হবে। সেটা করতে কমপক্ষে দুই মিনিট সময় লাগবে। কাজেই নিশিকে ফিরে পাবার জন্য আমাদের হাতে আসলে চার মিনিট থেকেও কম সময়।
ঠিক বলেছ। ইরন মাথা নাড়ল, আর চার মিনিটের মাঝে যদি চতুর্মাত্রিক প্রাণী নিশিকে ফেরত না দেয় তা হলে ধরে নেওয়া যায় আমাদের বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে।
ত্রালুস অন্যমনস্কর মতো একবার আকাশের দিকে তাকাল, ঘোলা আধো আলোকিত আকাশ, চারদিকে বড় বড় পাথর, সবুজাভ কুণ্ডলী পাকানো মেঘ, চারপাশে এক ধরনের বিষাক্ত ধোঁয়া। সে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, কে জানে কাজটা ঠিক করলাম কি না?
কী কাজ?
এই যে সবাইকে নিয়ে এত বড় একটা জুয়া খেলা।
ইরন হেসে বলল, ছোটখাটো জুয়া খেলার কোনো অর্থই হয় না। সত্যি যদি খেলতেই হয় তা হলে বড় জুয়াই খেলা উচিত।
ঠিকই বলেছ।
তিন জন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুমান্তি ত্ৰালুসের পাশে কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বায়ু নিরোধক স্পেসস্যুটের মাঝে সবাই আটকা পড়ে আছে, তা না হলে সে নিশ্চয়ই এখন ত্রালুসের হাত ধরে রাখত। ত্ৰালুস শুমান্তিকে নিজের কাছে টেনে নরম গলায় বলল, ভয় করছে শুমান্তি?
শুমান্তি মাথা নাড়ল, বলল, জানি না এটাকে ভয় বলে কি না। কেমন জানি ফাঁকা ফঁকা লাগছে। কোনোকিছু নিয়ে আর চিন্তা করতে পারছি না।
ত্রালুস তরল গলায় বলল, চিন্তা করে কী হবে? এস দেখি কী হয়।
চার মিনিটের ভিতর নিশিকে ফেরত দেওয়া হল না। ইরন বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ত্রালুস, জুয়ায় আমরা হেরে গেলাম।
ত্রালুস ইরনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত ইরন।
শুমান্তি হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের কারণে তোমাকে এভাবে মারা যেতে হচ্ছে ইরন, আমরা সত্যিই দুঃখিত
আমি ঠিক জানি না, তোমরা ব্যাপারটিকে নিজেদের দোষ বলে কেন ধরে নিচ্ছ।
ত্ৰালুস মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এই শেষ মুহূর্তে কার দোষে কী হয়েছে সেটি নিয়ে হিসাব করে কী হবে? তার চাইতে যেটা করে একটু শান্তি পাব সেটাই করি?
কী করে তুমি শান্তি পাবে?
এই চতুর্মাত্রিক প্রাণীকে কষে কিছু গালিগালাজ করলে।
শুমান্তি শব্দ করে হাসল এবং ত্রালুস সত্যি সত্যি তিনটি লেজার দিয়ে আটকে রাখা কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো চতুর্মাত্রিক প্রাণীটির দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, এই যে চতুর্মাত্রিক প্রাণী তোমরা নাকি নিনীষ স্কেলে পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী? কাজকর্ম দেখে তো মনে হয় না– আহাম্মক কোথাকার! মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিলে বেঁচে যেতে, এখন পুরো গ্রহ নিয়ে তোমরা ধ্বংস হও। ত্রানুস হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ধ্বংস হও– ধ্বংস হও ধ্বংস হয়ে নরকে যাও!
শুমান্তি লালুসের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, আহ! কী পাগলামো করছ?
ত্ৰালুস হেসে বলল, সময়টা তো কাটাতে হবে। বিস্ফোরণ ঘটাতে এখনো এক মিনিট সময় বাকি। এক মিনিট সময় দীর্ঘ সময় তুমি জান?
ত্রালুসের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে একটা আলোর বিচ্ছুরণ দেখা গেল, সাথে সাথে তাদের সামনে কুৎসিত মাংসপিণ্ডের মতো চতুর্মাত্রিক প্রাণীর একটা অংশ এসে হাজির হল। প্রাণীটি একবার দুলে ওঠে এবং হঠাৎ করে তার ভিতরে একটা কালো গহ্বরের মতো অংশ বের হয়ে আসে। সেখান থেকে প্রথমে আঠালো এক ধরনের তরল গড়িয়ে পড়ে এবং কিছু বোঝার আগেই তার ভিতর থেকে নিশি গড়িয়ে বের হয়ে আসে, তার সারা স্পেসস্যুট চটচটে আঠালো এক ধরনের তরলে মাখামাখি হয়ে আছে। যেরকম হঠাৎ করে প্রাণীটি এসেছিল সেরকম হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিশি কোনোমতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। কাছাকাছি একটা পাথর ধরে আবার সে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে মাথা তুলে তাকাল।
শুমান্তি হঠাৎ অপ্রকৃতিম্ভের মতো হেসে বলল, ত্রালুস, তোমার বকুনিতে কাজ হয়েছে!
উত্তরে কেউ কিছু বলল না, কারো কিছু বলার নেই। ইরন মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করার চেষ্টা করে, চতুর্মাত্রিক প্রাণী নিশিকে সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরকের সাথে লাগানো টাইমারটিকে এখন বিকল করা গেলে সবাই বেঁচে যেত। তার আর সময় নেই। পুরো ব্যাপারটি আসলে একটি নিদারুণ রসিকতার মতো হয়ে গেল। অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি রসিকতা।
ত্রালুস ফ্যাকাসে মুখে বলল, এখন আমরা কী করব ইরন?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, করার বিশেষ কিছু নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক। আমি আর শুমান্তি লেজারগুলো বন্ধ করে প্রাণীটিকে মুক্ত করে দিই। তুমি চেষ্টা করে দেখ বিস্ফোরকের টাইমারকে বিকল করতে পার কি না।
ঠিক আছে।
ত্ৰালুস ছুটে যেতে যেতে শুনল, ইরন বলছে, আমাদের হাতে সময় মাত্র আটচল্লিশ সেকেন্ড।
লেজার তিনটি বন্ধ করামাত্রই প্রাণীটি তার আকৃতি পরিবর্তন করে প্রথমে ছোট হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। এই পুরো গ্রহটিতে এখন শুধুমাত্র চার জন মানুষ–চারজন অসহায় ত্রিমাত্রিক মানুষ।
ইরন জেট প্যাকের কাছে ছুটে গেল, সেখানে ত্রালুস খুব সাবধানে বিস্ফোরকটি আলাদা করে টাইমারের দিকে একটি বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইরনকে দেখে মাথা নেড়ে বলল, অসম্ভব, দুই থেকে তিন মিনিটের আগে এই টাইমার বন্ধ করার কোনো উপায় নেই।
ইরন হঠাৎ কেমন জানি দুর্বল অনুভব করে, সবকিছু কেমন যেন অর্থহীন মনে হতে থাকে। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার শুমান্তির দিকে আরেকবার ত্ৰালুসের দিকে তাকাল। নিশি টলতে টলতে এগিয়ে আসছে, সে কিছু জানে না, একদিক দিয়ে সেটি চমৎকার একটি ব্যাপার। ইরন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ত্ৰালুস একটি বিচিত্র দৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন শুধুমাত্র একটি জিনিসই আমরা করতে পারি।
ইরন চমকে উঠল, বলল, কী জিনিস?
সেটা বলতে গেলে সময় নষ্ট হবে। কাজেই আমি বলছি না, আমি করছি, তোমরা দেখ।
ত্রালুস এগিয়ে গিয়ে টাইমার লাগানো ভারী বিস্ফোরকটি কষ্ট করে হাতে তুলে নেয়, তারপর সে ছুটতে শুরু করে। ইরন অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল, কী করছ তুমি? ত্রালুস, তুমি কী করছ?
ত্ৰালুস একমুহূর্তের জন্য থেমে বলল, আমি এই বিস্ফোরকটি সরিয়ে নিচ্ছি, ত্রিশ সেকেন্ড সময়ের ভিতরে ওই বড় পাথরটির আড়ালে যদি বিস্ফোরকটি নিতে পারি বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটি পাথরটা নিয়ে নেবে। তোমরা বেঁচে যাবে।
আর তুমি?
ত্ৰালুস ইরনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিস্ফোরকটি নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলে, বিদায়। শুমান্তি হতচকিতের মতো একবার ত্ৰালুসের দিকে তাকাল, আরেকবার ইরনের দিকে তাকাল, তারপর দ্রুত গলায় বলল, ত্ৰালুস ঠিকই বলেছে, এটিই একমাত্র সমাধান। বিদায়।
ইরন কিছু বোঝার আগেই অবাক হয়ে দেখল শুমান্তিও ত্রাসের দিকে ছুটে যাচ্ছে, ছুটে যেতে যেতে বলল, ত্রালুস একা এত বড় বিস্ফোরক এত দূরে নিতে পারবে না। আমিও সাহায্য করি।
ইরন চিৎকার করে বলল, কী করছ তোমরা? কী করছ?
শুমান্তি ছুটে গিয়ে ত্রালুসকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুজন জড়াজড়ি করে বিস্ফোরকটি টেনে নিতে থাকে। এত দূর থেকেও টাইমারের প্যানেলটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটি বিস্ফোরিত হতে আর মাত্র পনের সেকেন্ড বাকি।
ইরন চিন্তা করতে পারছিল না, কী করবে বুঝতে পারছিল না, ঠিক তখন নিশি এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে ধর, দোহাই তোমার আমাকে একটু ধর।
কেন নিশি? কী হয়েছে তোমার?
আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে। আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো–আমাকে ছেড়ে দিও না। দোহাই তোমার। আমাকে ছেড়ে দিও না।
ইরন নিশিকে শক্ত করে ধরে রেখে দূরে তাকাল। এই অপরিচিত গ্রহের একটি বিশাল পাহাড়ের আড়ালে ত্রালুস আর শুমান্তি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, দুজনে মিলে একটি বিস্ফোরককে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার থেকেও শক্ত করে ওরা একজন আরেকজনকে ধরে রেখেছে। আর কয়েক সেকেন্ড পর যে বিস্ফোরণটি ঘটবে সেই বিস্ফোরণ কি তাদের ছিন্নভিন্ন করে আলাদা করে দেবে না?
ইরন নিশির অচেতন দেহকে ধরে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিচিত্র এই গ্রহটিতে একটি ঝড়ো বাতাস শুরু হয়েছে। বাতাসের ঝাঁপটায় বেগুনি রঙের ধুলো উড়ছে, মানুষের কান্নার মতো করুণ এক ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে, বাতাসের প্রবাহে পাথরের গা থেকে এই শব্দ আসছে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কেউ যেন ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।
ইরন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পায়। আর কয়টি হৃৎকম্পন শেষ হবার পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে এই গ্রহটি কেঁপে উঠবে? ইরন নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
৩.৫ বৃদ্ধ মানুষটি
পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের বিশাল স্ক্রিনের সামনে বৃদ্ধ মানুষটি দুই হাত বুকের কাছাকাছি ধরে রেখে নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্ক্রিনের উপর বড় ঘড়িটিতে এইমাত্র সে দেখতে পেয়েছে দশ সেকেন্ড সময় পার হয়ে গেছে। বৃহস্পতি গ্রহের কাছাকাছি যে মহাকাশযানটি একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে গেছে সেটি যদি তার দায়িত্ব শেষ করতে পারে তা হলে সেটি দশ সেকেন্ডের মাঝে ফিরে আসবে। মহাকাশযানটি ফিরে আসে নি, অভিযানটি ব্যর্থ হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষটি বুকের মাঝে আটকে রাখা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে একটি কুৎসিত গালি দিল।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে এ রকম খিস্তি করবে জানলে তোমাকে কখনোই এখানে আসতে দিতাম না।
বৃদ্ধ মানুষটি দ্বিতীয়বার একটি গালি দিয়ে বলল, এত কষ্ট করে ওয়ার্মহোল তৈরি করা হল–এক বছর শুধু ইরন নামের মানুষটির পিছনেই খরচ করা হয়েছে। অ্যাকসিডেন্ট করে পুরো পরিবারকে খুন করা হল কীশা মেয়েটাকে রোবট বানানোর জন্য। আর জিনেটিক কোডে নিখুঁত মেয়েটার জন্য কত দিন ধরে কাজ করছি সেটার কথা তো ছেড়েই দাও।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি দাঁত খিঁচিয়ে বলল, তুমি চুপ করবে? চুপ করবে তুমি?
বৃদ্ধ মানুষটি রেগে গিয়ে বলল, কেন চুপ করব? কেন চুপ করব আমি? পুরো বিজ্ঞান একাডেমির চোখে ধুলা দিয়ে এই প্রজেক্ট দাঁড় করিয়েছ, বলেছ চতুর্মাত্রিক জগতের প্রযুক্তি নিয়ে আসবে, আর এখন?
মধ্যবয়স্ক মানুষটির ফরসা গালে হঠাৎ ছোপ ছোপ লাল রং ফুটে ওঠে, ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেটে পড়তে গিয়ে হঠাৎ করে সে থেমে যায়। বিশাল স্ক্রিনে একটা ছোট বিন্দু ফুটে উঠেছে, ওয়ার্মহোলের ভিতর দিয়ে মহাকাশযানটি বের হয়ে আসছে অস্বাভাবিক গতিতে, তার পিছনে ওয়ার্মহোলটি বন্ধ হয়ে আসছে, প্রচণ্ড আলোর বিকিরণে চোখ ধাধিয়ে যায় ওদের।
বৃদ্ধ মানুষটি স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে তারপর দুই হাত তুলে চিৎকার করে বলল, আমরা করেছি! অসাধ্য সাধন করেছি! চতুর্মাত্রিক জগতের প্রযুক্তি নিয়ে এসেছি!
হ্যাঁ, এনেছি। বিশ্বাস হল এখন?
হয়েছে। বিশ্বাস হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, এখন আমরা পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখব।
হ্যাঁ। নতুন করে লিখব।
কেউ আমাদের থামাতে পারবে না।
না পারবে না। কেউ আমাদের প্রযুক্তি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না।
আধা রোবট মেয়েটাকে সেভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে?
হ্যাঁ। এই মুহূর্তে যারা যারা বেঁচে আছে সে তাদের খুন করে ফেলছে! তারপর নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে। মূল মহাকাশযানটি যখন নামবে তখন সেখানে কোনো জীবিত প্রাণী থাকবে না।
কোনো ত্রিমাত্রিক জীবিত প্রাণী থাকবে না। বৃদ্ধ মানুষটি আনন্দে হা হা করে হাসতে থাকে।
মধ্যবয়স্ক মানুষটিও হাসিতে যোগ দেয়। হ্যা কোনো ত্রিমাত্রিক জীবিত প্রাণী থাকবে না।
দুজন আনন্দে হাসতে হাসতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেখানে মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করেছে। আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝেই ওটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর প্রবেশ করবে!
বৃদ্ধ মানুষটি তার পাকা চুলের ভিতর আঙুল প্রবেশ করিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে হঠাৎ একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে মাথা ঘুরিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে। বলল, সেটি যদি ঠিক করে নামতে না পারে? নামতে গিয়ে যদি ধ্বংস হয়ে যায়?
তাতে কিছু আসে–যায় না, এক হিসাবে বরং সেটি আরো ভালো, পুরো মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে কোনো কিছুর কোনো প্রমাণ থাকবেনা! আর্কাইভ ঘরে যে ভল্টটি আছে সেটি কিছুতেই ধ্বংস হবে না। ওর ওপর নিউক্লিয়ার বোমা ফাটালেও ওটার কিছু হবে না। আমরা যেটা চাইছি সেটা ঠিক ঠিক পৃথিবীতে নেমে আসবে। আর্কাইত ঘরের জন্য পুরোপুরি আলাদা নিয়ন্ত্রণ, ইঞ্জিন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবকিছু আছে! আমাদের এই প্রজেক্টে কোনো খুঁত নেই!
বৃদ্ধ মানুষটি তার কুতকুতে চোখ ছোট করে আবার আনন্দে হাসতে থাকে!
৪. শেষ পর্ব
নিশি তার বাম হাত দিয়ে কাঁচের গ্লাস থেকে ঈষৎ গোলাপি রঙের পানীয়টুকু চুমুক দিয়ে খেয়ে বলল, দেখেছ? আমি এখন বাম হাতের মানুষ হয়ে গেছি। সব কাজ এখন বাম হাত দিয়ে করতে পারি। ডান হাতে জোর নেই।
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি বলছ আগে তুমি সব কাজ ডান হাত দিয়ে করতে, এখন বাম হাত দিয়ে কর?
হ্যাঁ।
তুমি বুকে হাত দিয়ে দেখ তো তোমার হৃৎপিণ্ড কোনদিকে, ডানদিকে না বামদিকে।
নিশি হেসে বলল, হৃৎপিণ্ড তো বামদিকেই থাকবে।
তুমি হাত দিয়ে দেখ না কোন দিকে স্পন্দন হচ্ছে!
কী বলছ তুমি ইরন! তুমি ভুলে গেছ আমি জিনেটিক কোডিঙে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ? আমার মাঝে কোনো ত্রুটি নেই। আমার হৎপিণ্ড অবশ্যই বামদিকে।
আহা–দেখই না একবার পরীক্ষা করে।
নিশি হাসি চেপে তার বুকে হাত দেয় এবং হঠাৎ করে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, সে কী!
ইরন চোখ মটকে বলল, দেখেছ?
নিশি তখনো বিশ্বাস করতে পারে না, কঁপা গলায় বলল, সত্যিই দেখি আমার হৃৎপিণ্ড ডানদিকে।
আমি তাই ভেবেছিলাম।
কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি জানতাম আমার হৃদপিণ্ড বামদিকে। আমি একেবারে নিশ্চিতভাবে জানতাম
আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না নিশি। সত্যি তুমি ডান হাতের মানুষ ছিলে, তোমার হৃৎপিণ্ড বামদিকে ছিল–কিন্তু তোমাকে যখন চতুর্মাত্রিক প্রাণীরা তাদের জগতে। নিয়ে গেছে তাড়াহুড়োর মাঝে তোমাকে উল্টো করে ফেরত দিয়েছে! আয়নায় যেরকম প্রতিবিম্ব হয় সেরকমভাবে। কে জানে হয়তো ইচ্ছে করেই এভাবে ফেরত দিয়েছে–একটা প্রমাণ হিসেবে।
আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ। কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝিয়ে দিচ্ছি–তার আগে চল দেখে আসি স্কাউটশিপটার কী অবস্থা।
চল।
ইরনের পিছু পিছু নিশি মহাকাশযানের করিডোর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। একটু পরে পরে সে বুকে হাত দিয়ে নিজের হৃৎপিণ্ডের কম্পন অনুভব করছে। এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে তাকে আয়নার প্রতিবিম্ব হিসেবে ফেরত দিয়েছে। সে আর আগের নিশি। নেই–নিশির প্রতিবিম্ব!
স্কাউটশিপের দরজা খুলতেই দেখা গেল কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে শ্রালুস কিছু একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ইরনকে দেখে বলল, আমি দুঃখিত ইরন, একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি চিন্তা কোরো না, আমি কিছুক্ষণের মাঝে সব ঠিক করে দেব।
স্কাউটশিপের পিছনে দাঁড়ানো শুমান্তি খিলখিল করে হেসে বলল, ইরনকে বলবে না কেন তোমার দেরি হল?
ইরন হাত নেড়ে বলল, বলতে হবে না। তোমাদের দুজনের আসলে সাতখুন মাপ! সত্যি বলতে কী সাত নয়, সাত–সাতে উনপঞ্চাশ খুন মাপ।
কেন?
কারণ, তোমাদের জীবন্ত ফিরে আসার কথা ছিল না। চতুর্মাত্রিক প্রাণীরা যদি শেষ মুহূর্তে তোমাদের হাত থেকে বিস্ফোরকটা নিয়ে না নিত–তোমরা এখানে থাকতে না! এখনো আমি যখন ব্যাপারটা চিন্তা করি আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
শুমান্তি নরম গলায় বলল, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না।
ত্রালুস হেসে বলল, আমার কিন্তু বেশ ভালোই বিশ্বাস হচ্ছে। জীবনের প্রথম সত্যিকার জুয়া খেলা, সেই জুয়ায় জিতে গেলাম!
ইরন মাথা নেড়ে বলল, এটাই যেন তোমার প্রথম এবং শেষ জুয়া হয়!
স্কাউটশিপের দরজা খুলে বের হতে গিয়ে ইরন আবার থেমে গেল, বলল, তোমরা জান নিশির কী হয়েছে?
শুমান্তি এবং ত্ৰালুস এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী?
নিশি মুখ কালো করে বলল, আমি উল্টে গেছি। আমার ডান হাত ডান পা–বাম হাত বাম পা হয়ে গেছে। আমার হৃৎপিণ্ড উল্টোদিকে
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, কিন্তু সত্যি সত্যি আয়নার প্রতিবিম্বের মতো হয়ে গেছি।
ত্রালুস ভুরু কুঁচকে বলল, কেমন করে হল?
চতুর্মাত্রিক জগতে।
আমি বুঝতে পারছি না, ভ্রালুস মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে পারছি না মানুষ কেমন করে তার প্রতিবিম্ব হয়ে যায়!
আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। বলে ইরন একটা টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। পকেট থেকে একটা পাতলা কার্ড বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, মনে কর টেবিলের উপরটা হচ্ছে। দ্বিমাত্রিক জগৎ আর এই কার্ডটা হচ্ছে দ্বিমাত্রিক জগতের প্রাণী। ইরন কার্ডটাকে ডানে বামে নাড়িয়ে বলল, এই প্রাণীটা দ্বিমাত্রিক জগতে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে, কিন্তু কখনো একটা জিনিস করতে পারে না–সেটা হচ্ছে উল্টে যাওয়া। তাকে উন্টাতে হলে– ইরন কার্ডটিকে উপরে তুলে উল্টে নিয়ে টেবিলের উপর রেখে বলল, ত্রিমাত্রিক জগতকে ব্যবহার করতে হয়।
শুমান্তি মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। ঠিক সেরকম ত্রিমাত্রিক জগতে মানুষ কখনো তার প্রতিবিম্বে পাল্টাতে পারে না কিন্তু চতুর্মাত্রিক জগতে সেটা পানির মতো সোজা।
ত্রালুস চোখ মটকে বলল, তার মানে নিশিকে আবার সোজা করতে হলে চতুর্মাত্রিক জগতে ফেরত পাঠাতে হবে?
নিশি মাথা নেড়ে বলল, দোহাই তোমাদের আমাকে ফেরত পাঠিও না। আমি প্রতিবিম্ব হয়েই খুব ভালো আছি। কোনো সমস্যা নেই আমার।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ইরন নিশির মাথার কালো রেশমের মতো চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আমারও তাই ধারণা।
ইরন স্কাউটশিপ থেকে বের হয়ে আসে, তাদের পিছু পিছু ত্ৰালুস এবং শুমান্তিও বের হয়ে আসে। ত্রালুস তার নিও পলিমারের পোশাকে নিজের কালিমাখা হাত মুছতে মুছতে বলল, আর্কাইভ ঘরের ভন্টে কী রেখেছি দেখবে না?
ইরন ভুরু কুঁচকে বলল, ভন্টে কিছু রেখেছ?
রাখব না? ত্ৰালুস হাসি চেপে রেখে বলল, এত কোটি কোটি ইউনিট খরচ করে এত মানুষজনকে খুন করে, জীবন ধ্বংস করে একটি মহাকাশ অভিযান পাঠিয়েছে ভন্টে করে চতুর্মাত্রিক জগৎ থেকে কিছু আনার জন্য–সেটা খালি রাখি কেমন করে?
কী রেখেছ?
আমাদের এই মহাকাশযানে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে জান?
জানি।
জিনেটিক কোডিং দিয়ে একটার সাথে আরেকটা জুড়ে দেওয়া যায়। আমি প্রায় সতেরটা হাত, ছয়টা পা, পঞ্চাশটার মতো চোখ, কিছু যকৃৎ, কয়েকটা হৃৎপিণ্ড, কিডনি একসাথে জুড়ে দিয়েছি–
ইরন চোখ কপালে তুলে বলল, কী করেছ? একসাথে জুড়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ! সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় সেগুলো কিলবিল করে নড়তে থাকে, কাছাকাছি যেটাই পায় হাত সেটাকেই ধরে ফেলে, পা–গুলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, দমাদম লাথি কষিয়ে দিচ্ছে! চোখগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। থলথলে যকৃৎ, নড়তে থাকা হৃৎপিণ্ড, সব মিলিয়ে একটা ভয়ানক জিনিস!
ইরন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ত্ৰালুসের দিকে তাকিয়ে থাকে, তালুস হা হা করে হেসে বলল, পৃথিবীর ঐ বদমাইশ মানুষগুলো যখন আর্কাইভ ঘরের ভল্ট খুলবে তখন সেখান থেকে ওটা কিলবিল করে বের হয়ে আসবে। কী মজা হবে বুঝতে পারছ?
ইরন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
শুমান্তি খিলখিল করে হেসে বলল, সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জান?
কী?
মানুষগুলো মনে করবে সত্যিই ওটা চতুর্মাত্রিক প্রাণী। ওটা নিয়েই হয়তো বছরের পর বছর গবেষণা করবে!
ঠিকই বলেছ। আমরা যদি ধরা পড়ে যাই তা হলে অন্য কথা।
ত্ৰালুস মাথা নেড়ে মুখ শক্ত করে বলল, আমরা ধরা পড়ব না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় বাতাসের ঘর্ষণে পুরো মহাকাশযান ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে–এর নানা অংশ পৃথিবীতে ছিটিয়ে পড়বে। স্কাউটশিপটার মাঝে থাকব আমরা কেউ জানবে না!
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, ভাগ্য যদি নেহায়েৎ আমাদের বিপক্ষে না থাকে, আমাদের কেউ ধরতে পারবে না।
শুমান্তি একটু হেসে বলল, যদি ভাগ্যের কথা বল, তা হলে কেউ অস্বীকার করবে না যে আমাদের মতো ভাগ্য পৃথিবীতে কারো নেই।
নিশি মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ তোমরা। বিশেষ করে আমার ভাগ্য। পুরোপুরি উল্টে গিয়েও বেঁচে আছি!
সবাই হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে। ত্ৰালুস হাসি থামিয়ে বলল, ভাগ্যের কথাই যদি বল তা হলে সম্ভবত আমি আর শুমান্তি সবার উপরে! ক্লোন হিসেবে আমাদের ব্যাকটেরিয়ার মতো মারা যাবার কথা ছিল! অথচ আমরা চেষ্টা করেও মারা যেতে পারছি না!
শুমান্তি মাথা নাড়ল, বলল, বেঁচে থাকাটা আমার সেরকম ভাগ্যের ব্যাপার মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তোমাদের মতো চমৎকার মানুষের সাথে পরিচয় হওয়াটা আমার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য!
ইরন নরম গলায় বলল, সেই সৌভাগ্য আমাদের সবার। ইরনের গলায় কিছু একটা ছিল যে কারণে সবাই হঠাৎ চুপ করে যায়। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ইরন হেঁটে হেঁটে একটা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দূরে নীল পৃথিবীকে দেখা যাচ্ছে। যখন সেখানে ছিল বুঝতে পারে নি, দূর থেকে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে সে এই গ্রহটার জন্য, এই গ্রহের মানুষের জন্য গভীর ভালবাসা অনুভব করে। সে একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যদের দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসছি। সবার মনে হয় প্রস্তুত হওয়া দরকার।
শেষ কথা
চতুর্মাত্রিক প্রাণীদের জগৎ থেকে ফিরে আসা মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মহাকাশযানটির মাঝামাঝি রেখে দেওয়া বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সেখানে একটা বড় গর্ত তৈরি করেছিল। মহাকাশযানের বাতাস বের হওয়ার সময় গতিপথ পরিবর্তন করে ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মহাকাশযানের নানা অংশ পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, স্কাউটশিপটি বিধ্বস্ত হয়েছিল দক্ষিণের পার্বত্য এলাকায়। উদ্ধারকারী দল স্কাউটশিপটিকে উদ্ধার করতে পারে নি, সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারী দল সেই নির্জন পার্বত্য এলাকায় চার জনের ছোট একটি ভ্রমণকারী দলকে দেখতে পায়। প্রত্যক্ষদর্শী সেই ভ্রমণকারীরা বলেছে, স্কাউটশিপটিতে সম্ভবত কেউ ছিল না–কারণ সেটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পাহাড়ে আঘাত করে ধ্বংস হয়ে গেছে। ভ্রমণকারী ছোট দলটি এত বড় একটি বিস্ফোরণ দেখেও বিশেষ বিচলিত হয় নি। পার্বত্য এলাকায় তারা আরো কিছুদিন সময় কাটানোর জন্য রয়ে গেছে। উদ্ধারকারী দল ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে নি, দুজন তরুণ–তরুণী একজন অপরূপ সুন্দরী কিশোরী এবং তাদের দলনেতা এই স্কাউটশিপে করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য পাশ থেকে ঘুরে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কী, এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে সেটি জানার মতো মানুষও পৃথিবীতে তখন কেউ নেই।
ইরন, ত্রালুস, শুমান্তি এবং নিশি পৃথিবীতে আবার তাদের জীবন শুরু করেছে। পৃথিবীর হিসেবে তারা তিন–চার দিনের জন্য অনুপস্থিত ছিল, আবার জীবন শুরু করার কোনো সমস্যা হয় নি। ত্রানুস এবং মান্তি সৌরশক্তির একটি কারখানায় কাজ নিয়েছে। পরিচয়হীন দুজন মানুষের রেজিস্ট্রেশনের জন্য কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কিন্তু যেটুকু সমস্যা হওয়ার কথা ছিল সেটুকু হয় নি। কারণটি এখনো কারো জানা নেই। ত্ৰালুস এবং শুমান্তি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা করে নি, কিন্তু ইরন মোটামুটি নিশ্চিত তারা জীবনের সঙ্গী হিসেবে একজন আরেকজনকেই বেছে নেবে।
ইরন আবার তার গবেষণা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছে। তার যেসব কাজ পুরোপুরি ব্যর্থতা বলে পরিচিত হয়েছিল হঠাৎ করে সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হচ্ছে। ওয়ার্মহোলের ওপর তার গবেষণাটি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান একাডেমি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছে। গবেষণাটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রয়োজনীয় ইউনিট বরাদ্দ করা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ইরন প্রজেক্ট আপসিলন নিয়ে তথ্য কেন্দ্রে একটু খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিশেষ কোনো তথ্য পায় নি। তবে বিজ্ঞান একাডেমিকে প্রতারণা করে একটি অনৈতিক বেআইনি এবং মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করার জন্য মহাকাশ কেন্দ্রের দুজন বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে একটি বুলেটিন চোখে পড়েছে। একজন বৃদ্ধ এবং অন্য একজন মধ্যবয়স্ক কর্মকর্তা ঠিক কী ধরনের অনৈতিক অভিযান পরিচালনা করেছে সে সম্পর্কে কিছু লেখা হয় নি, কিন্তু ইরন মোটামুটি নিঃসন্দেহ তারা প্রজেক্ট আপসিলনের সঙ্গে জড়িত। ব্যাপারটি নিয়ে একটি তথ্য–অনুসন্ধান কমিটি কাজ শুরু করেছে। ইরন লাল তারকাযুক্ত একটি চিঠি পেয়েছে যেখানে তার কাছ থেকে সহযোগিতা আহ্বান করা হয়েছে। ইরন তথ্য–অনুসন্ধান কমিটিকে জানিয়েছে তাদেরকে সহযোগিতা করার মতো কোনো তথ্য তার জানা নেই।
ইরন সম্ভবত পুরো ব্যাপারটি প্রকাশ করে দিত কিন্তু একটি বিশেষ কারণে সেটি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণটির সাথে নিশির একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
পৃথিবীতে ফিরে আসার কিছুদিন পর ইরন নিশির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তাকে দেখে নিশি অত্যন্ত খুশি হয়ে ছুটে এসেছিল। ইরন তার জন্য উপহার হিসেবে জেড পাথরের তৈরি হরিণের একটি ছোট মূর্তি এনেছিল। পকেট থেকে বের করে সে যখন মূর্তিটা নিশির দিকে এগিয়ে দিল, নিশির চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে যায়। ইস্! কী সুন্দর বলে মূর্তিটা নেওয়ার জন্য নিশি তার হাত বাড়িয়ে দিল।
ইরন চমকে উঠল। কারণ নিশি তার যে হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছে সেটি ছিল তার ডান হাত।