- বইয়ের নামঃ ইরন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১.১ ইরন দীর্ঘসময় থেকে সমুদ্রের তীরে
ইরন দীর্ঘসময় থেকে সমুদ্রের তীরে নির্জন বিস্তৃত বালুবেলায় একাকী বসে আছে। তার মন বিষণ্ণ, বিষণ্ণতার ঠিক কারণটি জানা নেই বলে এক ধরনের অস্থিরতা তার মনকে অশান্ত করে রেখেছে। ইরন অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকায়–একটা ভাঙা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে বের হওয়ার মিথ্যে চেষ্টা করে আবার মেঘের আড়াল হয়ে গেল। মেঘে ঢাকা চাঁদের কোমল আলোতে চোখের রেটিনায় বর্ণ অসংবেদী রড–গুলো কাজ করছে–তাই চারদিক আবছা এবং ধূসর। মধ্যরাত্রিতে নির্জন বালুবেলায় সামনের বিস্তৃত নিস্তরঙ্গ সমুদ্রটিকে একটি অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য বলে মনে হয়। ইরনের পিছনে দীর্ঘ ঝাউগাছ, সমুদ্রের নোনা ভেজা হাওয়ায় সেগুলো দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করছে। হাহাকারের মতো সেই শব্দ শুনলেই বুকের মাঝে বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করে।
ইরন তার বুকের মাঝে দুর্বোধ্য সেই শূন্যতা নিয়ে নিজের হাঁটুর উপর মাথা রেখে নিঃশব্দে বসে থাকে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে সে বড় নিঃসঙ্গ এবং একাকী। তার বুকের ভিতরে যে বিষণ্ণতা তার সাথে সে পরিচিত নয়, যে হতাশা তার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।
অথচ এ রকমটি হওয়ার কথা ছিল না। ইরন সুদর্শন, সুস্থ, সবল, নীরোগ একজন পুরুষ, তার বয়স মাত্র সাতাশ, এরকম বয়সে একজন মানুষ দীর্ঘ প্রস্তুতির পর প্রথমবার সত্যিকার জীবনে প্রবেশ করে। নিজে দায়িত্ব বুঝে নেয়, নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করে, আশপাশে অন্য মানুষেরা তার চিন্তা–ভাবনা–সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। ইরন মেধাবী এবং পরিশ্রমী মানুষ ছিল। তার ভিতরে তীক্ষ্ণ এক ধরনের সৃজনশীলতা ছিল, জীবনকে ভালবাসার ক্ষমতা ছিল, উপভোগ করার আগ্রহ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা তার ভিতরে সহজাত নেতৃত্বের একটা ক্ষমতা ছিল। তার সাতাশ বছর বয়সে সে সত্যিকারের সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে কেমন জানি সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। এক বছরের মাথায় তার যা–কিছু অর্জন সবকিছু যেন ভয়ঙ্কর ব্যর্থতা হয়ে তার কাছে ফিরে এল। সে কিছুতেই হিসাবটি মিলাতে পারে না, কেন তার ভাগ্য হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পণ করে ফেলেছে, প্রতিটি পদক্ষেপ হঠাৎ করে ভুল হতে শুরু করেছে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছেলেমানুষি হাস্যকর ব্যর্থতা হয়ে তাকে উপহাস করতে শুরু করেছে। ইরন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে তার ভিতরে সেই একাগ্র জীবনীশক্তি নেই, সেখানে কেমন যেন খাপছাড়া শূন্যতা। আনন্দ নেই, ভালবাসা নেই, স্বপ্ন নেই, সাহস নেই। শুধু এক ধরনের অসহায় বিষণ্ণতা।
রাতের আকাশে হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে একটা রাতজাগা পাখি কর্কশ স্বরে শব্দ করে উড়ে গেল–এমন কিছু ভয়াবহ শব্দ নয় কিন্তু ইরন হঠাৎ করে চমকে ওঠে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, সমুদ্রের নোনা শীতল বাতাস ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু করে দিয়েছে, বাসায় ফিরে যাওয়া দরকার। নিজের বাসার কথা মনে করে ইরন আবার একটি লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ঠিক কী কারণ সে জানে না, তার আজকাল বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে করে না। দীর্ঘ রাত সে শহরতলির পথে–ঘাটে হেঁটে হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করে তবু বাসায় ফিরে যায় না। আজ অবশ্য সে বাসায় ফিরে যাবে। আজ তার সাতাশতম জন্মবার্ষিকী–হয়তো কেউ সেটা স্মরণ করে তার কাছে একটা শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। হয়তো কোনো পুরোনো বন্ধু বা বান্ধবী তার জন্য ভালবাসার কথা বলে গেছে, হয়তো সেটা দেখে আজ কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার মন ভালো হয়ে যাবে।
কিন্তু বাসায় ফিরে ইরনের মন ভালো হয়ে গেল না–বরং নতুন করে আবার বিচিত্র এক ধরনের বিষণ্ণতা এসে তাকে গ্রাস করল। তার কোনো পুরোনো বন্ধু বা বান্ধবী তাকে স্মরণ করে কোনো শুভেচ্ছা রেখে যায় নি। আকাশের কাছাকাছি ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টের স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিচে বহু দূরে শহরে জীবনের চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ইরন বুঝতে পারল তাকে কী করতে হবে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলল, কী আশ্চর্য আমি এটা বুঝতে এত দেরি করলাম!
ইরন স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালাটির দিকে তাকাল–চারপাশে কয়েকটি সাধারণ ক্রোমিয়াম স্ন্যাপার দিয়ে আটকানো– মাঝারি আকারের একটা স্কু ড্রাইভার হলেই সে জানালাটি খুলে নিতে পারবে। তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে সে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এক কিলোমিটার উঁচু এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিচে পড়তে তার প্রায় পনের সেকেন্ড সময় নেবে, পনের সেকেন্ডে তার বেগ হওয়ার কথা ঘণ্টায় প্রায় চার শ কিলোমিটার–কিন্তু বাতাসের বাধার জন্য সেটা তার অর্ধেকে গিয়ে থেমে যাবে। ঘণ্টায় দু শ কিলোমিটার বেগে সে যখন নিচের শক্ত কংক্রিটে আঘাত করবে তখন তার মৃত্য হবে। তাৎক্ষণিক। তার সকল হতাশা, বিষণ্ণতা এবং যন্ত্রণার অবসানও হবে তাৎক্ষণিক। ব্যাপারটি চিন্তা করে অনেকদিন পর হঠাৎ ইরন নিজের ভিতরে এক ধরনের উল্লাস অনুভব করে।
ইরন ঘরের ভিতর ফিরে এল, খাবারের কাবার্ড থেকে সে একটা পানীয়ের বোতল বের। করে তার বিছানায় বসে। নিজেকে শেষ করে দেবে সিদ্ধান্তটি নেবার পর সবকিছুকেই হঠাৎ করে খুব সহজ মনে হচ্ছে–কাজটি এই মুহূর্তে করা আর কয়েক ঘণ্টা পরে করার মাঝে সত্যিকার অর্থে কোনো পার্থক্য নেই।