- বইয়ের নামঃ ইরাকাস
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১.১ সমুদ্রের পানিতে সূর্যটা
উৎসর্গ
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর প্রথমবার যখন কয়েক ঘণ্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেয়া হয় তখন একজন মা তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সন্তানকে নিয়ে শহরে বের হলেন। যেদিকেই তাকান সেদিকেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষর।
মা তার সন্তানকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, এখন কী করতে হবে?
সন্তান বলল, মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে।
মা বললেন, আমার দুই পুত্রের মাঝে তুমিই এখন উপযুক্ত। আমি তোমাকেই আমাদের দেশের জন্যে দিতে চাই। তুমি যুদ্ধে যাও। এই দেশকে স্বাধীন করে ফিরে এসো। মনে রেখো তোমাকে কিন্তু বীরের মতো ফিরে আসতে হবে।
যুদ্ধে পাঠানোর জন্যে মা সন্তানের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। যখন সে বিদায় নিচ্ছিল মা তখন হাসিমুখে তাকে বিদায় দিলেন। ছেলে চোখের আড়াল হবার পর মা প্রথমবার আকুল হয়ে কাঁদলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস পর সেই তরুণ বীর-যাদ্ধা হয়ে তার দেশ এবং তার গর্ভধারিণী মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল।
সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ওয়াকার হাসান এবং তার বীর প্রসবিনী মাতা শামসুন নাহার ইসলামের জন্যে আমার ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৪ জানুয়ারি, ২০০৮
———-
ডেডালস ও তাহার পুত্র ইকারাস সমুদ্রবেষ্টিত ক্রীট দ্বীপ হইতে পলায়ন করিরার জন্যে তাহাদের শরীরে পাখির পালকে তৈরি ডানা সন্নিবিষ্ট করিল। উড্ডয়নের পূর্বে ডেড়ালাস তাহার পুত্র ইকারাসকে বলিল, বৎস, আকাশে উড়িবার সময় সূর্যের নিকটবর্তী হইও না। আমাদের শরীরে এই পালকগুলি মোম দ্বারা সংযুক্ত হইয়াছে। সূর্যের উত্তাপে মোম গলিয়া পালকগুলি দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে তুমি সমুদ্রে পতিত হইবে।
উড্ডয়নকালে চপলমতি ইকারাস তাহার সাবধানবাণী বিস্মৃত হইয়া সূর্যের নিকটবর্তী হইল। সূর্যের উত্তাপে তাহার শরীরে সন্নিবিষ্ট মোম গলিয়া পালকগুলি খুলিয়া গেল।
হতভাগ্য ইকারাস তখন অনেক উচ্চ হইতে সমুদ্রে পতিত হইল।
একটি গ্রিক উপাখ্যান
———–
১.১
প্রথম পর্ব
সমুদ্রের পানিতে সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে না যাওয়া পর্যন্ত জহুর বালুবেলায় চুপচাপ বসে রইল। সে প্রতিদিন এই সময়টায় সমুদ্রের তীরে আসে এবং চুপচাপ বসে সূর্যটাকে ড়ুবে যেতে দেখে। ঠিক কী কারণে দেখে তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই। সে খুবই সাধারণ মানুষ। প্রকৃতি বা প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এসব ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। যারা তাকে চেনে তাদের ধারণা সে বাউণ্ডুলে এবং ভবঘুরে ধরনের মানুষ। সেটি পুরোপুরি সত নয়—অল্প সময়ের ব্যবধানে তার একমাত্র মেয়ে এবং স্ত্রী মারা যাবার পর। হঠাৎ করে সে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর জন্যেই আকর্ষণ অনুভব করে না।
সূর্যটা পুরোপুরি ড়ুবে যাবার পর জহুর উঠে দাঁড়াল এবং নরম বালুতে পা ফেলে হেঁটে হেঁটে ঝাউগাছের নিচে ছোট টংঘরটাতে হাজির হলো। সেখানে কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চটাতে বসে জহুর এক কাপ চায়ের অর্ডার দেয়। তার যে চা খেতে খুব ইচ্ছে করে তা নয়, তারপরেও সে রুটিনমাফিক এখানে বসে এক কাপ চা খায়। যে ছেলেটা দুমড়ানো কেতলি থেকে কাপে গরম পানি ঢালে, দুধ চিনি দিয়ে প্রচণ্ড বেগে একটা চামচ দিয়ে সেটাকে ঘুটে তার সামনে নিয়ে আসে জহুর বসে বসে তার কাজকর্ম লক্ষ করে। কেন লক্ষ করে জহুর নিজেও সেটা জানে না। এখন তার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, একদিন থেকে পরের দিনের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।
জহুর অন্যমনস্কভাবে চায়ের কাপে চুমুক দেয়, চা-টা ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে জহুর সেটাও বুঝতে পারল না। অনেকটা যন্ত্রের মতো কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সে সামনের দিকে তাকালো এবং দেখল মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। জহুরের ভাসা ভাসাভাবে মনে হলো এই মানুষটা সে আগে কখনো দেখেছে কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না। মানুষটার সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে এসেছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং গায়ে একটা ভুসভুসে নীল রঙের শার্ট।
জহুর মানুষটাকে এক নজর দেখে আবার তার চায়ের কাপে চুমুক দেয়, এবারে তার মনে হলো চায়ে চিনি একটু বেশি দেয়া হয়েছে—তকে তাতে তার কিছু আসে-যায় না। কোনো কিছুতেই তার কখনো কিছু আসেযায় না। জহুর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে আবার সামনের দিকে তাকালো, দেখাল মাথার সামনে চুল পাতলা হয়ে যাওয়া মধ্যবয়স্ক মানুষটা এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।
জহুর একটু অস্বস্তি অনুভব করে, সে নিজে সুযোগ পেলেই তার চারপাশের মানুষকে লক্ষ করে, কিন্তু সেটা সে করে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। এই মানুষটি তাকে লক্ষ করছে সরাসরি, এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। জহুর একটু ঘুরে বসবে কি না চিন্তা করছিল তখন মধ্যবয়স্ক মানুষটা সামনের বেঞ্চ থেকে উঠে তার পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করল, ভাই। আপনি কী করেন?।
জহুর কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, একজন মানুষ—যার সাথে চেনা পরিচয় নেই তাকে সরাসরি এভাবে এ রকম একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারে কি না সেটা সে একটু চিন্তা করল। যে আসলে কিছুই করে না, সে কী বলে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে? জহুর অবশ্য বেশ সহজভাবেই উত্তর দিল, বলল, কিছু করি না।