ইরন যোগাযোগ মডিউলটি হাতে নিয়ে কীশাকে ডাকতে গিয়ে আবার থেমে গেল, কেন তার মনে হচ্ছে কীশা পুরো ব্যাপারটি জানে?
কেন তার মনে হচ্ছে কীশা পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করছে?
২.২ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সামনে
নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সামনে বড় টেবিলটা ঘিরে চার জন বসে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সামনে বিশাল স্ক্রিনটাতে একটা ছোট বিচিত্র গ্রহ দেখা যাচ্ছে। গ্রহটি প্রায় অস্পষ্ট ছিল, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে। গত কয়েক ঘণ্টায় এই স্ক্রিনে গ্রহটির আকার বড় হতে শুরু করেছে। গ্রহটির রং সবুজ এবং বেগুনি মেশানো, রংগুলো দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে বলে এটিকে একটি জীবন্ত প্রাণী বলে মনে হয়। সবুজ এবং বেগুনি রং পাশাপাশি খুব বেশি দেখা যায় না, তাই পুরো গ্রহটিকে হঠাৎ দেখে বীভৎস কিছু মনে হয়। এই গ্রহটি থেকে নির্দিষ্ট কিছু কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সংকেত আসছিল, এই সংকেত লক্ষ্য করে মহাকাশযানটি তার দিক পরিবর্তন করে গ্রহটির দিকে ছুটে যেতে শুরু করেছে।
ইরন তার আঙুল দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে শব্দ করছিল, হঠাৎ করে থেমে গিয়ে সে নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল, কীশা, আমরা কি তোমার সাথে খোলাখুলি কথা বলতে পারি?
কীশা একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, পার।
ইরন সোজা হয়ে বসে কীশার দিকে তাকাল, তুমি কি আমাদের বলবে এখানে কী হচ্ছে?
আমি? কীশা একটু অবাক হয়ে বলল, আমি কেমন করে বলব?
কারণ তুমি নিশ্চিতভাবে কিছু জিনিস জান, যেটা আমরা জানি না।
যেমন?
যেমন তুমি জান যে চতুর্দিক থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ আসছে সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করার যন্ত্রপাতি এই মহাকাশযানে রয়েছে। আমরা কেউ সেটা জানতাম না। যেমন তুমি সেই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জান, একই অভিযানের ক্রু হয়েও সেটা আমরা জানি না। যেমন তুমি জান এখানে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শক্তি পরিমাপ করা হলে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। যেমন তুমি–।
কীশা হাত তুলে ইরনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি যেটা বলছ তার বেশিরভাগই তো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার।
না। ইরন মাথা নেড়ে বলল, সাধারণ না। এর যে কোনো একটি ব্যাপার যদি ঘটত আমি বলতাম সাধারণ ব্যাপার, কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু একটি ঘটে নি। অনেকগুলো ঘটেছে। তুমি সবসময় বলে এসেছ তুমি বিজ্ঞানী নও, তুমি বিজ্ঞানের কিছু জান না। কিন্তু তোমার প্রত্যেকটি কথা প্রত্যেকটি কাজ প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর মতো। মনে আছে তুমি আমাকে ওয়ার্মহোল তৈরি করে তার ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসার কথা বলেছিলে? তুমি জান পৃথিবীর কতজন মানুষ এটা বলতে পারবে?
কীশা অবাক হয়ে বলল, কিন্তু আমি সেটা একটা ছেলেমানুষি তথ্যকেন্দ্র থেকে শিখেছি! আমি কখনোই এর বেশি কিছু জানি না।
তুমি টাইটানিয়াম রড দিয়ে আঘাত করে বর্গেনের মাথা খুলে দিয়েছিল। তুমি নিশ্চিতভাবে জানতে একটা রবোটের ঠিক কোথায় কত জোরে আঘাত করতে হয়।
না জানতাম না।
ইরন হিংস্র চোখে বলল, জানতে।
না। জানতাম না।
আমি বলব, তুমি কেন জানতে?
কেন?
কারণ তুমি আমাদের দেখাতে চাইছিলে যে বর্গেন এই মহাকাশযানের রোবট। তুমি তাকে শেষ করে দিয়ে এই মহাকাশযান থেকে রোবটদের দূর করেছ। আমাদেরকে নিশ্চিন্ত রাখতে চেয়েছিলে।
কীশা তীক্ষ্ণ চোখে ইরনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
তুমি খুব ভালো করে জান, আমি কী বলতে চাইছি। ইরন দাতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, তুমি এই মহাকাশযানের প্রকৃত রোবট।
আমি? কীশা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমি?
হ্যাঁ। ইরন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি দেখতে চাও?
কীশা কাতর মুখে বলল, কীভাবে দেখাবে?
আমি টাইটানিয়ামের রডটি নিয়ে তোমার মাথায় আঘাত করব, আর তোমার মাথাটি খুলে ছিটকে গিয়ে পড়বে। তোমার নাক মুখ দিয়ে কপোট্রনের শীতল করার হলুদ রঙের তরল ফিনকি দিয়ে বের হবে, তোমার চোখের ফটোসেল ঘোলা হয়ে যাবে
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। ইরন প্রায় ছুটে গিয়ে দেয়াল থেকে টাইটেনিয়ামের রডটি খুলে নেয়। এবং সাথে ত্ৰালুস আর শুমান্তি ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। ত্রালুস ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী করছ তুমি ইরন?
ইরন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না আমি কী করছি। কিন্তু আমি হঠাৎ করে অনেক কিছু বুঝতে পারছি। অনেক কিছু।
কী বুঝতে পারছ?।
সেটি এখন বলে কোনো লাভ নেই ত্রাস। শুধু জেনে রাখ আমাদের নিয়ে একটি খুব ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়েছে। আমরা সেই খেলার খেলোয়াড় নই। আমরা সেই খেলার গুটি।
শুমান্তি ইরনের হাত থেকে টাইটানিয়ামের রডটি সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলল, ইরন। আমি খুব সাধারণ একজন ক্লোন, আমি হয়তো কিছু বুঝি না। কিন্তু তবু আমার কেন জানি মনে হয়, আমাদের এখন প্রত্যেকের প্রয়োজন রয়েছে। এখন কাউকে আঘাত করার সময় নয়।
রোবট হলেও?
রোবট যদি মানুষের মতো হয় তাহলে কেন মিছিমিছি তাকে রোবট বলে সরিয়ে রাখবে?
ইরন অদ্ভুত একটি দৃষ্টিতে শুমান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। শুমান্তি নরম গলায় বলল, ইরন। তুমি কেমন করে জানো আমরা রোবট নই?
আমি জানি না।
শুমান্তি একটা নিশ্বাস ফেলে ফলল, আমিও জানি না।