তিনি তাঁর স্ত্রীকে পি থার্টি টু কেনার খবর দেবার জন্যে ফোন করলেন। রোবটদের মতো ভাবলেশহীন গলায় বললেন, আমি আজ একটি পি থার্টি টু কিনেছি।
সে কি! সত্যি?
হ্যাঁ।
বিরাট ভুল করেছ।
কেন?
আমাদের মত দম্পতিদের সরকার থেকে একটি করে এই যন্ত্র দেয়া হবে বলে কথা হচ্ছে। তুমি কি জানতে না?
জানতাম।
তাহলে?
কবে না কবে দেয়—আগেভাগেই কিনে ফেললাম। তুমি কি রাগ করেছ?
না। যন্ত্রটা কি ব্যবহার করেছ?
এখনো করিনি। এখন করব।
আচ্ছা। তোমার যন্ত্র তোমার জীবনকে আনন্দময় করে তুলুক। আমাদের মত দম্পতিদের যন্ত্রের আনন্দের প্রয়োজন আছে।
তোমাকে ধন্যবাদ।
তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। কাগজের মোড়ক খুলে কালো বক্সটি বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে মনে মনে বললেন, আমাদের মত দম্পতি–এই বাক্যটি আমার ভাল লাগে না।
ভাল না লাগলেও তাঁর স্ত্রী এই বাক্যটি তাঁকে দিনের মধ্যে কয়েকবার বলেন। হয়ত এই নিয়ে তাঁর মনে গোপন ক্ষোভ আছে। ক্ষোভ থাকার কোনই কারণ নেই। তাঁদের মত দম্পতি পৃথিবীতে অসংখ্য আছে যারা সন্তান জন্মাবার অধিকার পাননি। মানব জাতির স্বার্থেই তা করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমিয়ে আনার একটি শর্তই হচ্ছে একদল সন্তানহীন দম্পতি।
মানুষ মৃত্যুকে যদি সত্যি সত্যি জয় করে ফেলে তাহলে জনসংখ্যা আরো কমাতে হবে। তাঁদের মত দম্পতির সংখ্যা আরো বাড়বে।
তিনি যন্ত্র হাতে নিয়ে সোফায় এসে বসলেন। ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়েল মন। দিয়ে পড়লেন। যন্ত্রটি ব্যবহার করা খুব সহজ-যন্ত্র থেকে বের হওয়া ঋণাত্মক ইলেকট্রোড ঘাড়ের ঠিক মাঝামাঝি লাগাতে হয়। ধনাত্মক ইলেকট্রোড থাকবে বা কপালে। স্ট্যান্ড বাই বোতাম টিপে কারেন্ট ফ্লো এ্যাডজাস্ট করতে হবে যাতে এক মাইক্রো এ্যাম্পায়ারেরও কম বিদ্যুৎপ্রবাহ স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে প্রবাহিত হয়। কারেন্ট এ্যাডজাস্ট হবার সঙ্গে সঙ্গেই নীল আলো জ্বলে উঠবে। তখন চোখ বন্ধ করে স্টার্ট বাটন টিপতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কিছুই হবে না। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতে হবে।
পি থার্টি টু যন্ত্রটি বেশ কিছু শ্বাপদ জন্তুর মস্তিষ্কের স্মৃতি ধরে রেখেছে। এই স্মৃতি বায়ো কারেন্টের মাধ্যমে মানুষের মাথায় সঞ্চারিত করা হয়।
তিনি যন্ত্র চালু করে বসে আছেন। মাথায় ভোঁতা ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে অল্প পিপাসাও বোধ হচ্ছে। হঠাৎ সেই পিপাসা হাজারো গুণে বেড়ে গেল। তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে—এই তৃষ্ণার কারণেই বোধ হয় তার ঘ্রাণশক্তি লক্ষগুণ বেড়ে গেল। তিনি এখন সব কিছুর ঘ্রাণ পাচ্ছেন। মাটির ঘ্ৰাণ, ফুলের ঘ্ৰাণ, গাছের শেকড়ের ঘ্রাণ। তাঁর জগতটি ঘ্রাণময় হয়ে গেছে। এবং তিনি বুঝতে পারছেন তিনি শহরের সাতানব্বই তলার সাজানোগোছাননা কোন এ্যাপার্টমেন্টে বাস করেন না। তিনি বাস করেন বনে। গহীন বনে। তিনি কে? তিনি কি…
বোঝা যাচ্ছে, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তিনি একটি চিতাবাঘ। বাঘ নয় বাঘিনী। তাঁর তিনটি শিশু শাবক আছে। গত দুদিন এদের তিনি আগলে রেখেছেন। আজ প্রবল তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে এদের ছেড়ে পানির সন্ধানে বের হয়েছেন। পানি কোথায় আছে তা তিনি জানেন পানিরও গন্ধ আছে। সেই গন্ধ মাটির গন্ধের মতই তীব্র। পানি আছে, কাছেই আছে। এক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি পানির কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেন কিন্তু যেতে পারছেন না। কাছেই কোথায় যেন পুরুষ বাঘটা ঘুরঘুর করছে। এর মতলব ভাল না। বাচ্চাদের হয়ত মেরে ফেলবে। এদের একা রেখে কোথাও যাওয়া যাবে না। অথচ তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে।
আকাশে বিরাট চাঁদ। তার আলোয় বনভূমি ঝলমল করছে। কনকন করে বইছে শীতের বাতাস। বাতাসে কী অদ্ভুত শব্দেই না গাছের পাতা নড়ছে। যে সব পাতা নড়ছে তার থেকে এক ধরনের গন্ধ আসছে। আবার স্থির পাতা থেকে অন্য ধরনের গন্ধ। কী বিচিত্র, কী বিচিত্র চারপাশের জগত। কোন্ স্তরেই না পৌঁছে গেছে অনুভূতির তীব্রতা!
তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে—অথচ কী আনন্দই না তিনি রক্তের ভেতর অনুভব করছেন। তিনি জলের সন্ধানে এগুচ্ছেন অথচ তার সমস্ত ইন্দ্ৰিয় তাঁর শাবকদের দিকে।
একমাত্র আনন্দ
তারও অনেক পরের কথা।
ডেথ হরমোন রক্তের ভেতরই ভেঙে ফেলার অতি সহজ পদ্ধতি বের হয়েছে। মানুষ জরা রোধ করেছে। মানুষকে এখন অমর বলা যেতে পারে। বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁর আর মৃত্যু হবে না। জীবাণু এবং ভাইরাসঘটিত কোন অসুখও পৃথিবীতে নেই। মানুষকে এখন কি তাহলে অমর বলা যাবে? হয়ত বা।
অমর মানুষরা এখন দিনরাত ঘরেই বসে থাকে। তাদের কাজ করার প্রয়োজন নেই। কাজের জন্যে আছে রোবট শ্রেণী। চিন্তা-ভাবনারও কিছু নেই। অমরত্বের বেশি আর কিছু তো মানুষের চাইবারও নেই। এখনকার মানুষ দিনের পর দিন একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে বসে থাকে। পি থার্টি টু যন্ত্ৰ লাগিয়ে পশুদের জীবনের অংশবিশেষ যাপন করতে তাঁদের বড় ভাল লাগে। এই তাঁদের একমাত্র আনন্দ।