- বইয়ের নামঃ শূন্য
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
চোখ দিয়ে পানি পড়ছে
সকাল থেকেই তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শুরুতে ব্যাপারটা তিনি বুঝতে
পারেননি। স্কুলে রওনা হবার আগে আয়নার চুল আঁচড়াতে গিয়ে মনে হল—বা চোখের কোণাটা ভেজা ভেজা। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়নায় ভালো করে তাকিয়ে দেখেন শুধু বা চোখ না, দুচোখ দিয়েই পানি পড়ছে। অথচ চোখে কোনো জ্বালা-যন্ত্ৰণা নেই। রহস্যটা কি? বয়সকালে শরীরবৃত্তির নিয়ম-কানুন কি অন্য রকম হয়ে যায়?
খানিকটা বিস্ময় এবং খানিকটা বিরক্তি নিয়ে তিনি স্কুলে গেলেন। প্রথম পিরিয়ডে বীজগণিত। ক্লাস নাইন। সেকশান বি। ফার্স্ট পিরিয়ডে রোলকল করতে হয়। শুধু শুধু সময় নষ্ট। চুয়ান্নজন ছেলে। প্ৰতি ছেলের পেছনে চার সেকেন্ড করে ধরলে—দুইশ ষােল সেকেন্ড। অর্থাৎ তিন দশমিক ছয় মিনিট। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাসের আঠারো ভাগের একভাগ সময় চলে গেল। সময়ের কি নিদাৰুণ অপচয়! কোনো মানে হয় না।
হেডমাস্টার সাহেবের কঠিন নিয়ম। রোলকল করতে হবে। বত্রিশ বছর মনসুর সাহেব নিয়ম পালন করেছেন। রোলকল করে সময় নষ্ট করেছেন। আজই নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন। রোলকল না করে সরাসরি বোর্ডে চলে গেলেন।
চোখ দিয়ে পানি পড়াটা এই সময় বেড়ে গেল। বোর্ডে যা লেখেন পড়তে পারেন না। চোখের পানির জন্যে সব ঝাপসা দেখা যায়। তিনি এক সময় বিব্রত গলায় বললেন, থাক, আজ আর পড়াব না। চোখে সমস্যা।
ছাত্ররা কেউ শব্দ করল না। আগে যেমন বোর্ডের দিকে তাকিয়েছিল এখনো তেমনি তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেব বললেন—চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বোর্ডের লেখা পড়তে পারছি না।
এই কথার পরেও ছাত্ররা বোর্ডের লেখা থেকে চোখ সরাল না, যেন তারা পাথরের মূর্তি। মনসুর সাহেবের মন কিছুটা খারাপ হল। ছেলেরা তাকে এত ভয় পায় কেন? তিনি তাঁর বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে—কোন ছাত্রকে ধমক পর্যন্ত দেননি। তাহলে এরকম হচ্ছে কেন?
পাশের ক্লাসের বীরেন বাবু জিওগ্রাফি পড়াচ্ছেন–জলবায়ু। পড়ার ফাঁকে ফাকে কি সব বলছেন ছাত্ররা হো হো করে আসছে। হাসি শুরু হয় আর থামতে চায় না। বীরেন বাবু রাগী গলায় ধমকান, থামবি? না ধরে আছাড় দেব? কানে চাবি দিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দেব, বুঝলি? ছাত্ররা আরো হাসে। মনসুর সাহেবের মনে হল, ক্লাস এরকমই হওয়া উচিত। ছাত্ররা আনন্দে থাকবে। যা শেখার শিখবে আনন্দে। এমন যদি হতবীরেন বাবু বাজে টিচার, ভালো পড়াতে পারেন না, তাহলে একটা কথা ছিল। ব্যাপার মোটেই সে রকম নয়। শিক্ষক হিসেবে বীরেন বাবুর কোনো তুলনা নেই।
মনসুর সাহেব চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করছেন—তাঁর এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে কখনো কি তাঁর কোনো কথায়, কোনো রসিকতায় ছাত্ররা প্রাণখুলে হেসেছে?
তিনি মনে করতে পারলেন না। ছাত্রদের মুগ্ধ করার কোনো বিদ্যা তার জানা নেই। তিনি গল্প করতে পারেন না। গল্প শুনতেও তার ভালো লাগে না। কোনো কিছুই তাঁর বোধহয় ভালো লাগে না। তিনি আগ্রহ বোধ করেন না। এই যে এতগুলি ছাত্র তাঁর সামনে বসে আছে তিনি এদের কারোর নাম জানেন না। রাস্তায় এদের কারোর সঙ্গে দেখা হলে তিনি চিনতে পারবেন না। অথচ তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয়। আজ ছাত্র কতজন আছে? আজ সবাই কি উপস্থিত? তিনি গোনার চেষ্টা করছেন। চোখে অস্পষ্ট দেখছেন বলে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে।
তোমরা আজ কতজন উপস্থিত?
ফর্সা একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বলল—স্যার ৪১ জন।
তিনি একটু চমকালেন—একচল্লিশ জন উপস্থিত। একচল্লিশ একটা মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। একচল্লিশ জন উপস্থিত হলে অনুপস্থিত হল ১৩ জন। ১৩ আরেকটি মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। বাহ্, পরস্পর দুটা প্রাইম সংখ্যা পাওয়া গেল। ইন্টারেস্টিং তো।
মনসুর সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়া বেড়েছে। চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তিনি রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আবারও বললেন আমার চোখে একটা সমস্যা হয়েছে। পানি পড়ছে। আজ তোমাদের পড়াব না। বাবারা, আমি দুঃখিত ও লজ্জিত।
তিনি নিজের চেয়ারে বসলেন। ক্লাস শেষ হতে এখনো অনেক বাকি। এতক্ষণ কি করবেন? বসে থাকবেন চুপচাপ? এতে ছাত্রদের ক্ষতি হবে। সেটা ঠিক হবে না। উপদেশমূলক কোনো গল্প বলতে পারলে ভালো হত। উপদেশটা গল্পচ্ছলে শিখলেও লাভ। ঈশপের একটা গল্প বলা যেতে পারে। ঈশপের গল্পগুলি কি যেন? একটা গল্প আছে নাথােপাদের নীলের গামলায় একবার এক শেয়াল পড়ে গেল। তার গা হয়ে গেল ঘন নীল—এটা কি ঈশপের গল্প, না অন্য কারো গল্প। এই গল্পের উপদেশটা কি? আশ্চর্য! উপদেশটা মনে পড়ছে না।
মনসুর সাহেব তাঁর সামনের টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা রাখলেন এই ভাবেই গল্পটা মনে করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা পড়ল। তার ঘুম ভাঙল না। ছাত্ররাও কেউ কোনো শব্দ করল না। পরের পিরিয়ডে হেডমাস্টার সাহেবের ইংরেজি পড়াবার কথা। তিনি মনসুর সাহেবকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?
জ্বি না।
দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। চোখে কি হয়েছে?
বুঝতে পারছি না। পানি পড়ছে।
এই শরীর নিয়ে ক্লাসে এসেছেন কেন? যান যান-বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন।
মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, বাসায় কি নিজে নিজে যেতে পারবেন, না কেউ গিয়ে দিয়ে আসবে?
যেতে পারব। নিজেই যেতে পারব।
বজলুর ফার্মেসিতে আগে যাবেন। বজলু আছে। ওকে চোখটা দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে তারপর যাবেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনার বয়স হয়েছে। শরীর দুর্বল। এই বয়সে শরীরের দিকে খুব যত্ন নিতে হয়।
মনসুর সাহেব খুবই লজ্জিত বোধ করছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই কারণে লজ্জা। তারচেয়েও বড় লজ্জা তাঁর কারণে হেডমাস্টার সাহেব কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। ছাত্রদের না পড়িয়ে–অকারণ উদ্বেগ দেখাচ্ছেন অন্যের স্বাস্থ্য নিয়ে। অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়। তিনি চেয়ার থেকে নামলেন, নামতে গিয়ে মনে হল, পায়েও তেমন জোর পাচ্ছেন না। পড়ে যাচ্ছিলেন। হেডমাস্টার সাহেব হাত ধরে ফেলে আবারও বললেন, আমি আপনার উপর খুবই রাগ করেছি মনসুর সাহেব। এক্সট্রিমলি এনয়েড। আগে শরীর, তারপর অন্য কথা। শরীর গেল তো সবই গেল। সংস্কৃতিতে এ বিষয়ে একটা শ্লোক আছে। শ্লোকটা হচ্ছে…। যাই হোক, মনে পড়ছে না। শরীরং…
মনসুর সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেললেন—অকারণে একটা মানুষ এত কথা বলে কেন? একই কথা বারবার বলার অর্থ কি? তিনি ক্লাস থেকে বেরুবার সময়ও ধরজায় ধাক্কা খেলেন। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাঁকে দেখছে।
হেডমাস্টার সাহেব গ্রামার পড়াবেন। চক হাতে ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হল। ব্ল্যাকবোর্ড বিচিত্র সব জিনিস লেখা। সাঙ্কেতিক চিহ্নের মতো চিহ্ন বোর্ডের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঠাসা।
হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, এইসব কি? কে লিখেছে এসব? হু হাজ রিটেন দিজ?
ক্লাস ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়াল।
জবাব দিচ্ছ না কেন? কে এইসব হিবিজিবি লিখেছে? হু ইজ দ্য কালপ্রিট?
মনসুর স্যার।
মনসুর সাহেব লিখেছেন।
জ্বি। কি
এইসব?
জানি না স্যার।
জান না মানে? তোমরা জিজ্ঞেস করনি?
জ্বি না।
তোমাদের জানার আগ্রহ ছিল না?
ভয় লাগে স্যার।
উনার কী পড়াবার কথা ছিল?
এলজেব্র্যা।
হেডমাস্টার সাহেব ডাস্টার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। বোর্ডের লেখাগুলি মুছে ফেলা উচিত কি-না তিনি বুঝতে পারছেন না। কাউকে কি ডেকে এনে দেখাবেন? মানুষটার হয়েছে কি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ তো বড় চিন্তার বিষয় হল। মানুষটাকে একা একা বিদেয় করা ঠিক হয়নি। একজন কাউকে সঙ্গে দেয়া উচিত ছিল।
মনসুর সাহেব ক্লাস থেকে বের হয়ে কমনরুমে খানিকক্ষণ বসলেন। ছুটির দরখাস্ত লিখে রেখে যাওয়া দরকার। হেডমাস্টার সাহেব ছুটি দিয়েছেন বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি রওনা হবেন এটা ঠিক না।
কমনরুমে ফজলুর রহমান বসে আছেন। খবরের কাগজ পড়ছেন। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে গেছে, তারপরেও উনি বসে আছেন কেন? এই মানুষটা সব সময় ক্লাসে যেতে দেরি করেন। অনুচিত একটা কাজ। তার থেকে ছাত্ররা ফাঁকি শিখবে। এই বয়সটা হল তাদের শেখার বয়স। এই বয়সে তারা যা দেখে তাই শেখে।
ফজলুর রহমান সাহেব!
জ্বি!
ক্লাস নেই?
আছে।
যাবেন না?
খবরের কাগজটায় একটু চোখ বুলিয়ে যাই। বাংলা ফার্স্ট পেপার। এটা পড়ানো না পড়ানো একই।
বাংলার কথা শুনে মনসুর সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন ভালো কথা, আপনি কি ঈশপের ঐ গল্পটা জানেন?
কোন্ গল্প?
ঐ যে একটা শেয়াল ধোপার নীলের গামলায় পড়ে গেল। তার গা হয়ে গেল নীল…
শেয়াল না। একটা গাধা পড়েছিল।
ঐ গল্পের মোরালটা কি?
ফজলুর রহমান সাহেব খবরের কাগজ মুড়ে রাখতে রাখতে বললেন, ঈশপের গল্পের মোরাল সবই ফালতু মোরাল। এইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই—এই যুগের মোরাল হল—Eat, drink and be happy.
মনসুর সাহেব ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। ছুটির দরখাস্ত লিখতে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে খুব পানি পড়ছে।
মনসুর সাহেব
মনসুর সাহেব থাকেন আজিজ খাঁ বেপারির গুদামঘরের উপরে। কেরোগেটেড টিনের দেয়ালে ঘেরা গুদামঘর। তার উপরে দুটা ঘর। একটায় থাকেন মনসুর সাহেব। অন্য ঘরটা খালি। আজিজ খাঁ বলেছেন—স্যার, ইচ্ছা করলে এই ঘরটাও আপনি ব্যবহার করতে পারেন। একটায় ঘুমাবেন, অন্যটায় লেখাপড়ার কাজ করবেন।
মনসুর সাহেব রাজি হননি। তাঁর জন্যে একটা কামরাই যথেষ্ট। দুটা কামরা মানেই বাহুল্য। তিনি সারাজীবন বাহুল্য বর্জন করতে চেয়েছেন।
নিজের ঘরটা তিনি তার প্রয়োজনমতো সাজিয়ে নিয়েছেন। বড় একটা খাট আছে। ছোট খাটে তিনি শুতে পারেন না। ঘুমুবার সময় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে ভালো লাগে। খাটের সঙ্গেই টেবিল। টেবিলটাও বড়। ঘরে কোনো চেয়ার নেই। খাটে বসেই যেহেতু টেবিলে লেখালেখি করা যায় কাজেই চেয়ার তাঁর কাছে বাহুল্য বলে মনে হয়েছে। একটা আলনা আছে। আলনা তাঁর কাছে প্রয়োজনীয়। কাপড়-চোপড় সামনে থাকে। যখন যেটা দরকার হাত বাড়িয়ে নিতে পারেন।।
তাঁর ঘরে শৌখিন জিনিসের মধ্যে একটা সিলিং ফ্যান আছে। নতুন সিলিং ফ্যান। এর পাখা খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া। আজিজ খা বেপারি সিলিং ফ্যান। লাগিয়ে দিয়েছেন। ইলেকট্রিসিটি নেই বলে সিলিং ফ্যান কখনো চলে না।
নেত্রকোনা শহরে ইলেকট্রিসিটি আছে। আজিজ বেপারির গুদাম শহরের বাইরে বলে ইলেকট্রিসিটির লাইন এখনো দেয়নি। তবে পোল বসাচ্ছে। খুব শিগগিরই ইলেকট্রিসিটি চলে আসার কথা।
মনসুর সাহেবের জায়গাটা খুব পছন্দ। নিরিবিলির কারণেই পছন্দ। গুদামে যখন মাল তোলা হয় কিংবা মাল খালাস করা হয় তখন কিছু চৈ-চৈ থাকে। বাকি সময়টা সুনসান নীরবতা। গুদামের দুজন দারোয়ান। এর একজন কোনো কথাই বলে না। অন্যজনের কথা বলার প্রচণ্ড নেশা। কথা বলার লোক পায় না। বলে সেও কথা বলতে পারে না। এই দারোয়ানের নাম হরমুজ মিয়া। সে মনসুর সাহেবের খাওয়া-দাওয়া দেখে। এই কাজের জন্যে মাসে তাকে পঞ্চাশ টাকা করে দেয়া হয়। মনসুর সাহেবের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা অত্যন্ত সরল। তিনি বলে দিয়েছেন, এক পদের বেশি দ্বিতীয়পদ যেন কখনো রান্না করা না হয়। দ্বিতীয়পদ মানেই বাহুল্য।
হরমুজ মিয়ার উপর কঠিন নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই এটা-ওটা বেঁধে ফেলে। সিমের ভর্তা, পাকা টমেটোর ভর্তা, কুমড়ো ফুলের বড়া। মনসুর সাহেব বিরক্ত হন, কিন্তু হরমুজকে কিছু বলতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন মানুষ মাত্ৰই বাহুল্যপ্রিয়। একটা বাড়িই মানুষের জন্যে যথেষ্ট, তারপরেও টাকা থাকলেই সে দুটা-তিনটি বাড়ি বানাবে। আজিজ বেপারির নেত্রকোনা শহরেই তিনটা বাড়ি। এখন আবার ঢাকার সোবাহানবাগ এলাকায় বাড়ি বানাচ্ছে। বাড়ি বানানোর খবর দেয়ার জন্যে কে মনসুর সাহেবের কাছে এসেছিল। মনসুর সাহেব বলেছেন—এতগুলি বাড়ির তোমার দরকার কি? একটা মাকড়সাকে দেখ। সে একটাই বাড়ি বানায়। সুতার তৈরি একটাই ঘর। কোনো মাকড়সা দেখবে না যে চার-পাঁচটা ঘর বানিয়ে রেখেছে।
আজিজ খ বিনয়ের সঙ্গে বলেছে, যথার্থ বলেছেন স্যার। যথার্থ কথা। তবে ব্যাপার হল কিবাড়িগুলি ভাড়া দিলে আয় হয়। ফিক্সড ইনকাম। মাসের শেষে হাতে চলে আসে। চিন্তা-ভাবনা করা লাগে না।
এত ইনকাম দিয়ে-ই বা তোমার প্রয়োজন কি?
খরচ-বরচ আছে। টাকার দরকার কখনো শেষ হয় না। তারপর ধরেন, টাকার কারণে দান-খয়রাত করতে পারি। এতে সোয়াব হয়। স্যার শুনলে সুখী হবেন—নিজের খরচে আমি একটা হাফেজিয়া মাদ্রাসা করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে
একটা মসজিদ বানানোর ইচ্ছা আছে। মাকড়সার তো আর মাদ্রাসা দিতে হয় না, মসজিদও বানাতে হয় না।
আজিজ বেপারির হাস্যকর যুক্তিতে রাগে গা জ্বলে যাবার কথা। মনসুর সাহেবের তেমন রাগ হয় না। নির্বোধ মানুষের সকল কথা ধরতে নেই। নির্বোধ মানুষের যুক্তিও শুনতে নেই। আজিজকে তিনি নির্বোধ শ্রেণীর একজন হিসেবেই জানেন। নির্বোধদের প্রতি এক ধরনের মমতা মানুষের থাকে। তারও আছে। আজিজ খাঁ ঘোর বৈষয়িক মানুষ। বৈষয়িক মানুষ বিষয় ছাড়া অন্য কিছু ভালবাসতে পারে না। তাদের সেই ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু আজিজ খাঁ সত্যিকার অর্থেই মনসুর সাহেবকে ভালবাসেন। নতুন ফ্যান কিনে এনে লাগিয়ে দেয়ার পেছনে তাঁর ভালোবাসাই কাজ করেছে। অন্য কিছু না। তাঁর গুদামঘর পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটির লাইন আনার জন্যে তিনি সাবডিভিশনাল ইনজিনিয়ারকে এক হাজার টাকা ঘুস দিয়েছেন।
মনসুর সাহেবকে যেন পোলাওয়ের চালের ভাত রান্না করে দেয়া হয় সে জন্যে মাসের শুরুতেই তিনি আধমণ চিনিগুড়া চাল হরমুজের কাছে পাঠিয়ে দেন। হরমুজকে বলা হয়েছে এই ব্যাপারটা সে যেন গোপন রাখে। হরমুজ সেই পোলাওয়ের চাল বাজারে বিক্রি করে দেয়। কারণ সে লক্ষ করেছে মনসুর সাহেব পোলাওয়ের চাল এবং সাধারণ চালের পার্থক্য ধরতে পারেন না। কয়েকবার সে পোলাওয়ের চালের ভাত বেঁধে দিয়েছে। মনসুর সাহেব একটা শব্দও করেননি।
আজিজ বেপারির এই বাড়িতে মনসুর সাহেব আছেন গত এগারো বছর ধরে। প্রতি মাসে ঘরে থাকার ভাড়া বাবত ত্ৰিশটা টাকা নিজে আজিজ বেপারিকে দিয়ে তার কাছ থেকে রসিদ নিয়ে আসেন। তিনি জানেন না এগারো বছর আগে ত্রিশ টাকার যে মূল্য ছিল আজ সে মূল্য নেই। এক কেজি চিনির দামই ত্ৰিশ টাকা। জগৎ-সংসার থেমে নেই—শুধু মনসুর সাহেব থেমে আছেন। তিনি তা জানেন না।
চোখের সমস্যা নিয়ে মনসুর সাহেব অসময়ে তাঁর ঘরে ফিরে এলেন। তালা খুলে বিছানায় শুয়ে রইলেন। দুপুরে তাঁর ঘুমানোর অভ্যাস নেই। আজ বিকেল। পর্যন্ত ঘুমুলেন। ঘুম ভেঙে মুখ ধুতে গিয়ে লক্ষ করলেন—চোখ জ্বালা করছে। তার ভুরু কুঞ্চিত হল। চোখ জ্বালা করলে তো সমস্যা। রাত জেগে কাজ করতে হবে। চোখ জ্বালা করলে কাজ করবেন কীভাবে? ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসাই ভালো। তা ছাড়া ঘরে কাগজ নেই। কাগজ কিনতে হবে। কলমের কালি কিনতে হবে। বল পয়েন্টে তিনি লিখতে পারেন না। আরো কিছু টুকটাক জিনিস বোধহয় লাগবে। চিনি নেই। লেবু নেই। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে এক গ্লাস লেবুর সরবত খান। এটাও এক অর্থে বাহুল্য। তবে অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস। অভ্যাস মানুষকে বিলাসী করে।
স্যার কি ন্দ্রিা করতেছেন?
হরমুজ মিয়া দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। কঠিন কঠিন বাক্য ব্যবহার করে সে আনন্দ পায়।
কি ব্যাপার হরমুজ?
আপনের কাছে একটা আবেদন ছিল। বল।
হরমুজ ঘরে ঢুকল। দীর্ঘ কোনো গল্পের প্রস্তুতি সে নিচ্ছে। এক দুই কথায় সে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না।
স্যার, আমার মধ্যম কন্যার শাদি হয়েছে—সান্দিকোনায়। জামাই ঘরামির কাজ করে। চৈত্র মাসে এরার কোনো কাজকাম থাকে না…
মনসুর সাহেব হরমুজের গল্প সংক্ষেপ করার জন্যে বললেন সাহায্য চাও?
জ্বি না। সাহায্য না।
তাহলে কি?
মেয়েটার সন্তান হবে। এর আগে একবার গর্ভ নষ্ট হয়েছে। আমাকে বলেছে মদনপুরের পীর সাহেবের ফুল গাছ থেকে একটা পুষ্প তার জন্যে নিয়ে যেতে…
ছুটি চাও?
জ্বি। দুই দিনের ছুটি।
যাও।
আপনার খাওয়া-দাওয়া?
আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। একজন তো আছেই–। বসির আছে না?
জ্বি না। বসির ছুটি নিয়ে চলে গেছে।
অসুবিধে কিছু নেই।
বাইরে-টাইরে ভ্রমণের জন্যে গেলে গেইটে তালা দিয়ে যাবেন। এই যে স্যার তালাচাবি।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
ভয় পাবেন না তো স্যার?
না, ভয় পাব কেন? ভয় পাবার কিছু আছে?
জ্বি না। ভয়ের কিছু নাই। তবে স্যার সত্য কথা বলতে কি জিনের সামান্য উদ্রব আছে। একটা দুষ্ট জিন আছে—গ্রামেই থাকে। মাঝে মধ্যে ফাইলামি করে। একবার কি হয়েছে স্যার শুনুন-শ্ৰবণ মাস—বুম বৃষ্টি…
তুমি এখন যাও হরমুজ। আমার শরীরটা ভালো না। আমি একটু বিশ্রাম করব।
জ্বি আচ্ছা। আরেকটা ছোট্ট আবেদন ছিল স্যার। অপরাধ না নিলে নিবেদন করি–আমি স্যার এই যে ছুটি নিয়ে চলে গেলাম এটা সাহেবকে বলবেন না।
আজিজ কিছু জিজ্ঞেস না করলে অবশ্যই বলব না। তবে জিজ্ঞেস করলে তো বলতেই হবে। আমি মিথ্যা কথা বলি না।
মাঝে মধ্যে দু-একটা মিথ্যা বললে কিছু হয় না স্যার। সত্য যেমন আল্লাহপাকের সৃষ্টি মিথ্যাও তেমন তারই সৃষ্টি।
তুমি এখন যাও হরমুজ।
হরমুজ চলে গেল, তবে যাবার আগে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মনসুর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল।
স্যার, গরিবের জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।
আচ্ছা রাখব। দোয়া রাখব। এখন তুমি যাও।
আপনাকে একা ফেলে যেতে খুব পেরেসান, কিন্তু…
তুমি যাও তো।
মনসুর সাহেব সন্ধ্যার আগে নেত্রকোনা শহরের দিকে রওনা হলেন। যে কাজগুলি সারতে হবে সেগুলি হচ্ছে :
১. কাগজ কিনতে হবে।
২. চিনি কিনতে হবে।
৩. লেবু কিনতে হবে।
৪. ডাক্তার বজলুর রহমানকে চোখ দেখাতে হবে।
৫. ফাউনটেনপেনের কালি কিনতে হবে। মোট পাঁচটা কাজ।
পাঁচ সংখ্যাটা ইন্টারেস্টিং। মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। সংখ্যার জগতে চতুর্থ প্রাইম নাম্বার। প্রথমটা হল ১, তারপর ২, তারপর ৩, তারপরই ৫, পাঁচের পর ৭, সাতের পর ১১, এগারোর পর ১৩, তেরোর পর ১৭, সতেরোর পর ১৯…
এক থেকে দশের ভেতর প্রাইম নাম্বার হল পাঁচটা।
দশ থেকে কুড়ির ভেতর চারটা…
কুড়ি থেকে ত্রিশের মধ্যে মাত্র দুটা সংখ্যা বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাইম নাম্বারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
ত্ৰিশ থেকে চল্লিশের ভেতর…
মনসুর সাহেব মাথা থেকে মৌলিক সংখ্যার চিন্তা-ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। সারাক্ষণ মাথায় এইসব ঘুরলে ভালো লাগে না।
আকাশে মেঘ জমছে। চৈত্রমাসে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করার অর্থ ভালো না। ঝড় হবে। ভোলা মাঠে ঝড়ের ভেতর পড়ার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ হবার কথা। মনসুর সাহেবকে তেমন উদ্বিগ্ন দেখা গেল না। অথচ তাঁর মতো আরো যারা শহরের দিকে যাচ্ছে তারা উদ্বিগ্ন। দ্রুত হাঁটছে। বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। সবচে বড় আশঙ্কা হল শিলাবৃষ্টির। চৈত্রের শেষাশেষি আকাশ ঘন কালো হয়ে উঠলে শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা থাকেই। খোলামাঠে শিলাবৃষ্টির হাতে পড়লে ভয়াবহ সমস্যা। আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। ইউনিয়ন বোর্ডের এই রাস্তা নতুন হয়েছে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা কিছু নেই। বছর দুই আগে বনবিভাগ চারা লাগিয়েছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে ছাগলে খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছে।
ছোটবাজারে আজিজ বেপারির একটা স্টেশনারি দোকান আছে। মনসুর সাহেব সেখান থেকেই কাগজ, কালি কিনলেন। দাম দিতে হল না। তারা খাতায় লিখে রাখে। মাসের শুরুতে বিল করে টাকা নেয়। মনসুর সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ এরা হিসেবে কোনো গণ্ডগোল করে, কারণ তিনি প্রচুর কাগজ কেনেন, কিন্তু বিল এত কম হয়। আজিজ বেপারিকে তিনি তাঁর সন্দেহের কথা বলেছিলেন। আজিজ বলেছে, এইসব নিয়ে আপনি ভাববেন না তো স্যার। আমরা পাইকারি হিসেবে বিল করি। এতে খানিকটা কম হয়।
আজিজ আজ দোকানে ছিল না। তার এক কর্মচারী বদরুল কাগজ এবং কালি পলিথিনের ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল, দিনের অবস্থা ভালো না, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান স্যার। ঝড় হবে। স্যারের সঙ্গে কি ছাতা আছে?
না।
একটা ছাতা নিয়ে যান।
ছাতা নিব না। আমার ছাতা খুব হারায়।
হারালে হারাবে, ছাতাটা নিয়ে যান। আমি বরং একটা রিকশা ঠিক করে দেই। রিকশা আপনাকে নিয়ে যাবে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে রিকশাও পাবেন না-কাঁচা রাস্তায় রিকশা যাবে না।
না না, রিকশা লাগবে না। রিকশায় আমি চড়ি না। রিকশার কঁকুনিতে আমার চিন্তার অসুবিধা হয়।
দোকানি বিস্মিত হয়ে বলল, কি চিন্তা?
মনসুর সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, তেমন কিছু না। হাঁটতে হাঁটতে যা মাথায় আসে। যেমন ধর প্রাইম সংখ্যা…
সেটা কি?
মৌলিক সংখ্যা, যে সংখ্যাকে সেই সংখ্যা এবং ১ এই দুটি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ভাগ দেয়া যায় না। যেমন ধর তিন একটা মৌলিক সংখ্যা, আবার চার মৌলিক সংখ্যা না। চারকে তুমি দুই দিয়ে ভাগ দিতে পারছ। তারপর আসে পাঁচ। পাঁচ মৌলিক সংখ্যা। পাঁচের পর আসছে সাত…
বদরুল হতচকিত গলায় বলল, আর বলতে হবে না স্যার। মাথা আউলা হয়ে যাচ্ছে। আপনি হাঁটতে হাঁটতে এইসব চিন্তা করেন?
হ্যাঁ। কি হয় এসব চিন্তা করে? কিছু হয় না। মনের আনন্দ।
স্যার, এর মধ্যে আনন্দের কি আছে?
মনসুর সাহেব আনন্দের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। ব্যাখ্যা তার নিজেরও জানা নেই। চিন্তা করলে আনন্দ হয়—এটাই শুধু জানেন।
মনসুর সাহেব বললেন, কাগজ কতগুলি দিয়েছ?
তিন দিস্তা দিয়েছি। স্যার, আরো লাগবে?
আরো কিছু দিয়ে দাও। কাগজ এখন বেশি লাগছে।
প্রতি সপ্তাহে কাগজ নেন। আপনি স্যার এত কাগজ দিয়ে করেন কি?
হিসাব-নিকাশ করি।
কীসের হিসাব-নিকাশ?
ইয়ে মানে একটা অঙ্ক করছি। জটিল অঙ্ক…মানে ঠিক…
বদরুল হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে এই দোকানে কাজ করছে বেশিদিন। নাতিন বছরের মতো হবে। এই তিন বছর ধরেই সে এই মানুষটাকে কাগজ দিয়ে যাচ্ছে। কোনো সপ্তাহে তিন দিস্তা, কোনো সপ্তাহে পাঁচ।
স্যার, অঙ্কটা কি?
তেমন কিছু না। শখের একটা ব্যাপার। যাই কেমন?
চা খেয়ে যান স্যার। ঝড়-বাদলের দিন, চা খেলে ভালো লাগবে।
ঝড়-বাদলা কোথায়?
এখনো নাই, তবে স্যার শুরু হবে।
চা খেতে ইচ্ছা করছে না।
একটু খান স্যার। আপনি কিছু না খেয়ে শুধু-মুখে চলে গেলে সাহেব রাগ করবেন। চা আনতে ফ্ল্যাস্ক নিয়ে লোক গেছে। এসে পড়বে।
মনসুর সাহেব বসলেন। বদরুল বলল—আপনার অঙ্কটার বিষয়ে কিছু বলেন স্যার শুনি। শখের একটা অঙ্ক করছেন। শুনেই কেমন লাগে। অঙ্ক আর মানসাঙ্ক এই দুইয়ের নাম শুনলেই এখনো কলিজা কঁপে। তাও ভালো, এখনকার ছাত্রদের মানসাঙ্ক করতে হয় না…মণের দামের বামে ইলেক মাত্ৰ দিলে…ওরে বাপরে, কী জিনিস ছিল! স্যার, আপনার অঙ্কটা কি?
ঐটা হল তোমার ফিবোনাক্কি রাশিমালা নিয়ে একটা কাজ।
বদরুল হতভম্ব হয়ে বলল, কি রাশিমালা বললেন?
ফিবোনাক্কি। ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত গণিতবিদ লিওনার্ডো ফিবোনাক্কি এই রাশিমালা বের করেছিলেন। মরবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন প্রকৃতির মূল সমস্যা এই রাশিমালাতে আছে।
স্যার, বলেন কি?
মৃত্যুর সময় তিনি খুব আফসোস নিয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আফসোস কি জন্যে?
রহস্যময় এক রাশিমালা বের করলেন কিন্তু সেই রাশিমালা নিয়ে কাজ করে যেতে পারলেন না—এই নিয়ে আফসোস। মৃত্যুর সময় চিৎকার করে বলছিলেন–হে ইশ্বর, আমাকে আর মাত্র তিন বছর আয়ু দাওমাত্র তিন…
আহা বেচারা! আর তিন বছর বচলে ফাটাফাটি হয়ে যেত। তাই না স্যার?
মনসুর সাহেব এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না। চা এসে গেছে। তিনি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন। ঠাণ্ডা চিনির সরবত। না খেলে বদরুল মন খারাপ করবে বলেই খাওয়া।
ফিক্কি রাশিমালা ব্যাপারটা কি স্যার? ফিল্কি না, ফিবোনাক্কি। আমাদের সাধারণ রাশিমালা তো তুমি জানই।
জানি না স্যার। অঙ্কে আমি মারাত্মক কাঁচা। মেটিকে একচল্লিশ পেয়েছিলাম। অঙ্কের স্যার আমি এত নাম্বার পেয়েছি শুনে কী যে অবাক হয়েছিলেন! আমি স্যার কিছুই জানি না।
মনসুর সাহেব সহজ গলায় বললেন, অবশ্যই জান। ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, …এই হল সাধারণ রাশিমালা।
এটা জানি।
এরকম আরো রাশিমালা আছে, যেমন—শুধু মৌলিক সংখ্যার রাশিমালা ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১… ফিবোনাক্কি রাশিমালা হল—১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯…
একেবারে বেড়াছেড়া অবস্থা।
না, বেড়াছেড়া না। এই রাশিমালার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাশিমালার প্রতিটি সংখ্যা হল আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। যেমন ধর, এই রাশিমালার চতুর্থ সংখ্যা হল পাঁচ। পাঁচ হল ২য় এবং ৩য় সংখ্যার যোগফল। বড়ই রহস্যময় রাশিমালা।
আমি তো স্যার কোনোই রহস্য দেখতে পাচ্ছি না।
তুমি তো অঙ্ক নিয়ে চর্চা কর না, তাই এই রাশিমালার রহস্য ধরতে পারছ। না। এই রাশিমালার ১১ নম্বর সংখ্যা হল ৮৯। রাশিমালার প্রথম সংখ্যা এককে যদি তুমি ৮৯ দিয়ে ভাগ দাও তাহলে আবার এই রাশিমালা দিয়ে আসে।
যেমন…
১/৮৯= .০১১২৩৫৮১৩২১…
বদরুল চোখ বড় বড় করে তাকাল। কিছু না বুঝেই চোখ বড় করল। পাগলা ধরনের লোক আগ্রহ নিয়ে একটা কথা বলছে—সেই সব কথা বিস্মিত হয়ে না শুনলে ভালো দেখায় না। এই কারণেই বিস্মিত হওয়া।
মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, প্রকৃতিতে ফিবোনাকি সিরিজের খুব প্রয়োগ দেখা যায়। সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির বিন্যাস এই রাশিমালা অনুসারে হয়। শামুকের যে স্পাইরেল ও এই রাশিমালা অনুসারে হয়। সমুদ্রে এক ধরনের লাল কাঁকড়া থাকে। সেই কাঁকড়া যে সব নকশা বালিতে তৈরি করে তার মধ্যে থাকে ফিবোনাক্কি রাশিমালা…
বলেন কি?
শীতের সময় সাগর পাড়ি দিয়ে অতিথি পাখিরা যে আসে, ওরা ঝাক বেঁধে উড়ে। ঝুকে পাখির সংখ্যা ফিবোনাক্কি রাশিমালায় যে সব সংখ্যা আছে তার বাইরে কখনো হয় না। যেমন ধর, একটা ঝুঁকে ২১ টা পাখি থাকতে পারে, কিন্তু কখনো ২২ বা ২৩টা পাখি থাকবে না। কারণ ২২ বা ২৩ ফিবোনাক্কি রাশিমালায় নেই। ২১ আছে। আজ উঠি বদরুল?
জ্বি আচ্ছা, স্যার। আপনার কাছ থেকে জ্ঞানের কথা শুনে মনটা বড় ভালো হয়েছে।
তুমি তো মনে হয় কিছু বুঝতে পারনি।
স্যার বুঝেছি। আপনি জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন। আপনার মতো একজন শিক্ষক পেলে মেট্রিকে অঙ্কে লেটার থাকত। স্যার, ছাতাটা নিয়ে যান। বৃষ্টি নামলো বলে। আচ্ছা স্যার, বৃষ্টির ফোঁটাও কি ফিবোনাক্কি রাশিমালার মতো পড়ে?
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হল, ছেলেটা তাঁর সাথে রসিকতা করার চেষ্টা করছে।
রাস্তায় নামতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিনি ডাক্তার বজলুর রহমানের ফার্মেসিতে উঠলেন। ফার্মেসি অন্ধকার। কাটআউট জ্বলে গেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে বজলুর রহমান সাহেব জমিয়ে গল্প করছেন। কয়েকজন আগ্রহী শ্রোতা তাঁকে ঘিরে আছে। টেবিলে মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি। মরিচ এমন ঢেসে দেয়া হয়েছে যে ঘরে পা দিতেই মরিচের গন্ধ নাকে এল।
মনসুর সাহেবকে দেখেই বজলুর রহমান বললেন, স্যার আসুন, মুড়ি খান। হেডস্যার বলেছেন আপনার চোখের সমস্যার কথা। বাতি নেই, চোখ দেখতে পারব না। কাম্পাউন্ডার ইলেকট্রিসিয়ান আনতে গেছে। বাতি আসুক, তারপর চোখ দেখব।
আড্ডার একজন বলল, গল্পটা শেষ করুন।
ভূতের গল্প হচ্ছিল। গল্পে বাধা পড়ায় সবাই খানিকটা বিরক্ত। মনসুর সাহেব এক কোণায় চেয়ারে গুটিগুটি হয়ে বসলেন। বজলুর রহমান ভূতের গল্প আবার শুরু করলেন। ছেলেমানুষি সব ভূতের গল্প শুনতে ইচ্ছা করে না। মনসুর সাহেব বাধ্য হয়ে শুনছেন।
ঘটনাটা বরিশালের।
বরিশালের ঠিক না—পিরোজপুর সাবডিভিশনের গোয়ারেখা গ্রামে। আমার নিজের দেখা। অন্যের কাছে শোনা গল্প হলে আপনাদের বলতাম না। তখন ঢাকা মেডিক্যালে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার ছোটমামা বিয়ে করেছেন গোয়ারেখা গ্রামে। আমাকে একবার পাঠালেন মামিকে পৌঁছে দিয়ে আসতে। আমি ভেবেছি যাব মামিকে পৌঁছে দিয়ে পরদিন চলে আসব। মেডিক্যাল কলেজ খোলা। ইচ্ছা করলেও থাকার উপায় নেই। পৌছার পর এমন বিপদে পড়লাম। শুরু হল লঞ্চ স্ট্রাইক। ঐসব অঞ্চলের কায়দাকানুনই অন্যরকম। একটা কিছু শুরু হলে আর শেষ হয় না। দশদিন ধরে চলল স্ট্রাইক। আমি তিক্ত-বিরক্ত। যার কীভাবে? যোগাযোগের একটাই ব্যবস্থা—লঞ্চ বা স্টিমার। ইচ্ছা করছে সাঁতরে রওনা দিয়ে দেই। এই সময়ের ঘটনা। গোয়ারেখা গ্রামের জঙ্গলে একটা ডেডবডি পাওয়া গেল। কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে। টাটকা ডেডবডি। নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে তখনো রক্ত পড়ছে। এক গরুর রাখাল জঙ্গলে গিয়েছিল গরুর খোঁজে—সে-ই ডেডবডি প্রথম দেখল। গ্রামের সমস্ত লোক ভেঙে পড়ল।
অপরিচিত মানুষের ডেডবডি। আগে কেউ কখনো দেখেনি। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পরনে নীল লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়ার মতো একটা জিনিস। মাদ্রাসার কম বয়েসী। তালেবুল এলেমদের যেমন অল্প কয়েক গোছা দাড়ি থাকে, সেরকম দাড়ি।
পুলিশে খবর দেবে সেই উপায় নেই। স্বরূপকাঠি থানা সতেরো মাইল দূরে। গ্রামের লোকজন পরামর্শ করে জানাজা পড়ে গোর কবর দিয়ে ফেলল। সকাল বেলা কবর দিয়েছে, সন্ধ্যাবেলা পুলিশ এসে উপস্থিত। ওদের নিজেদের স্পিড বোট আছে। ফটফট করে স্বরূপকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার চারজন কন্সটেবল নিয়ে হাজির। এসেই বিরাট হস্থিতম্বি। কেন পুলিশে খবর না দিয়ে ডেডবডি কবর দেয়া হল। এর মধ্যে রহস্য আছে। তিনি কাউকে ছাড়বেন না। প্রয়োজনে গ্রামসুদ্ধ বেঁধে নিয়ে যাবেন।
পয়সা খাওয়ার মতলব আর কি? গ্রাম অঞ্চলে খুনখারাবি হওয়া মানে। পুলিশের জন্যে ঈদ উৎসব। আসামি-ফরিয়াদি দুই তরফ থেকেই স্রোতের মতো টাকা আসতে থাকে।
গ্রামের মুরুঝিরা চাঁদা তুলে হাজার খানিক টাকা সেকেন্ড অফিসার সাহেবকে দিয়ে আপাতত ঠাণ্ডা করল।
ডাব-টাব কেটে আনল। সেকেন্ড অফিসার সাহেব বললেন—গোর খোদাই করে ডেডডি তোল। আমি দেখব। সবাই বলল সন্ধ্যাবেলা এই কাজটা করা ঠিক হবে না।
ভদ্ৰলোক হুংকার দিয়ে বললেন, পুলিশের কাছে আবার সকাল-সন্ধ্যা কি?
কবর খোঁড়া শুরু হল। গ্রামের সব লোক ভেঙে পড়ল। আমিও কৌতূহলী হয়ে গেলাম। দুটা হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। অনেকেই এসেছে হ্যারিকেন হাতে।
কবর খুঁড়ে সবাই হতভম্ব। কারণ ডেডবডির গায়ে কাফনের কাপড়টা নেই। ডেডবডি তার কাফনের কাপড় নিজেই খেয়ে ফেলেছে। সবটা খেতে পারেনি—খানিকটা কাপড় মুখ থেকে বের হয়ে আছে…
আড্ডায় অস্ফুট গুঞ্জন উঠল।
দুজন একসঙ্গে বলল, তারপর তারপর?
বজলুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধারতে বললেন—পরের ব্যাপার আরো ভয়ংকর। দাঁড়ান বলছি, চা-টা খেয়ে নেই। কথা বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গেছি।
মনসুর সাহেবের অসহ্য লাগছে। এই গল্পের বাকি অংশ শোনার তার আর। ধৈর্য নেই। তিনি উঠে দাঁড়ালেন—বজলুর রহমান সাহেব! আমি আজ উঠি। আরেকদিন আসব।
আরে বসুন বসুন। চোখটা দেখে দেই। বাতি নেই, দেখবেন কি? গল্পের শেষটা শুনে যান। শেষটা ভয়ংকর। ইচ্ছা করছে না।
মনসুর সাহেব ঘরের বাইরে পা দিলেন। ফোঁটা ফেঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তিনি দ্রুত হাঁটছেন। তাঁর মন বলছে কী একটা জিনিস যেন বাকি আছে। একটা কিছু ভুল হয়ে গেছে। তিনি সেই ভুল ধরতে পারছেন না। মনের অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। ছোটবাজার ছাড়িয়ে যখন কাঁচা পথে উঠে এলেন তখনি নিজের অস্বস্তির কারণ ধরতে পারলেন। ছাতা ফেলে এসেছেন। এখন ফিরে গিয়ে ছাতা আনতে যাবার অর্থ হয় না।
বৃষ্টি কেঁপে আসছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। তিনি ভিজে সার হয়েছেন। কাগজগুলি না ভিজলেই হল—কাগজগুলির জন্যেই তার দুশ্চিন্তা। চিনি আর লেবু কেনা হয়নি। আজ রাতে লেবুর সরবত খাওয়া যাবে না। তার চেয়েও বড় সমস্যা—ভাত রাঁধতে হবে। ডিম নিশ্চয়ই আছে। ভাত আর ডিমভাজি। রান্না তেমন জটিল নয়—চুলা ধরানোটাই জটিল।
এঁটেল মাটির রাস্তা
এঁটেল মাটির রাস্তা। বৃষ্টি পড়তেই কাদা হয়ে গেছে। জুতা কাদায় আটকে যাচ্ছে। বাতাস দিতে শুরু করেছে। মনসুর সাহেব ঠিক করলেন ছোটবাজারে ফিরে যাবেন। ঝড়-বৃষ্টির ভেতর এতটা পথ যাওয়া বড় ধরনের বোকামি হবে। শিলাবৃষ্টি শুরু হলে মাথা বাঁচানোর উপায় নেই। বৃষ্টির ফোঁটা হিমশীতল। এর মানে হল অনেক উঁচুতে বৃষ্টি তৈরি হচ্ছে যেখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি। চশমার কাচে পানি জমছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না।
ছোটবাজারে ফিরে যাবার ব্যাপারে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেবার পরেও মনসুর সাহেব এগুচ্ছেন তাঁর বাসার দিকে। এবং পা বেশ দ্রুত ফেলছেন। ঘোর অন্ধকার। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বলে পথ চলতে অসুবিধা। বিদ্যুৎচমকে কি ফিবোনাক্কি রাশিমালা কাজ করে? প্রথম একবার, তারপর আবার একবার, তারপর পরপর তিনবার।
তিনি মারা নদীর বাঁধের উপর উঠে এলেন। এই রাস্তাটা মোটামুটি ভালো। কাদা নেই। বাঁধের নিচে নৌকা বাঁধা থাকে। আজ কোনো নৌকাও নেই। বাঁধের উপর উঠে ঝড়ের ঝাপ্টা অনুভব করা যাচ্ছে। তিনি কুঁজো হয়ে হাঁটছেন এবং প্রতিমুহূর্তেই তাঁর মনে হচ্ছে এই বুঝি ধাক্কা দিয়ে বাতাস তাকে নদীতে ফেলে দিল।
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। খুব কাজেই পড়ল। এত কাছে যে বিদ্যুতের নীল শিখার পাশে পাশে তিনি কমলা শিখাও দেখতে পেলেন। এটা একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ঝড়ের মধ্যে বের না হলে তিন হাত সামনে বজ্ৰপাত দেখতে পেতেন না। ঘটনাটা বিপজ্জনক তো বটেই। বজ্র উঁচু জায়গায় আঘাত করে। বাঁধে কোনো গাছপালা নেই। উঁচু জায়গা বলতে তিনি। বজ্রটার উচিত ছিল তাঁর উপর পড়া। পড়ল না কেন? প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। সে কাউকে করুণা করে না। তাঁকে এই করুণা করার মানে কি?
প্রকৃতির এই আচরণে মনসুর সাহেব খানিকটা বিরক্তই হলেন আর তখন দ্বিতীয় বজ্ৰপাত হল—তিনি ছিটকে বাঁধের নিচে পড়ে গেলেন। যখন তাঁর জ্ঞান হল তখননা অঝাের ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। কাদায়-পানিতে তিনি মাখামাখি। শীতে কিংবা অন্য কোনো কারণে তাঁর হাত-পা শক্ত। তিনি কি মারা গেছেন না জীবিত আছেন—এই বোধ স্পষ্ট হচ্ছে না। মারা যাবার সম্ভাবনাই বেশি। শরীরের ভেতর দিয়ে কয়েক লক্ষ ভোল্ট ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। শরীর ভস্ম হয়ে যাবার কথা। তিনি মারা গেছেন এটাও মনে হচ্ছে না। মৃত মানুষের শীত লাগার কথা না। কিন্তু তাঁর শীত লাগছে। ঠকঠক করে শরীর কাঁপছে। মুখের উপর কেউ একজন মনে হয় ঝুঁকে আছে। মানুষ না অন্য কিছু অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বললেন—এখানে কে?
প্রশ্নের জবাব পাবেন মনসুর সাহেব সেই আশা করেননি। কিন্তু জবাব পেলেন। মিষ্টি এবং সহজ গলায় কেউ একজন বলল
–আপনি আমার হাত ধরুন। হাত ধরে উঠে দাঁড়ান।
কে কথা বলছে?
আমি।
আমিটা কে?।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আমার পরিচয় দেব। তার আগে আপনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া দরকার।
আমি কি বেঁচে আছি-না-কি?
অবশ্যই বেঁচে আছেন। বাঁধের উপর থেকে নিচে পড়ে ব্যথা পেয়েছেন?
বিদ্যুৎ চমকাল। বিদ্যুতের আলোয় মনসুর সাহেব মানুষটাকে দেখলেন। একুশ-বাইশ বছরের একজন যুবক। শার্ট-প্যান্ট পরে আছে। প্যান্ট খানিকটা গুটানো। কাপড়-চোপড় ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে।
যুবকই তাঁকে টেনে তুলল।
স্যার, আপনি কি হাঁটতে পারবেন?
মনসুর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, হাঁটতে না পারলে তুমি কি করবে? আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবে?
যুবক হেসে ফেলল। মনসুর সাহেব বললেন—এখন কটা বাজে জান?
জ্বি না। আমার সঙ্গে ঘড়ি নেই। স্যার চলুন, আমরা আস্তে আস্তে হাঁটি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার কোনো অর্থ নেই। আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে পা ফেলুন।
হাত ধরতে হবে না। আমি হাঁটতে পারব। তোমার নাম কি?
যুবক জবাব দিল না। তুমি করে বলায় সে কি রাগ করল না-কি? নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষ তুমি করে বললে ফট করে রেগে যায়। দীর্ঘদিন মাস্টারির কুফল হল—মুখে তুমি আগে চলে আসে। মৃত্যুর সময় আজরাইলকে ঘরে ঢুকতে দেখলে পুরানো স্কুল মাস্টাররা বলে বসবেও তুমি? জান কবজ করতে এসেছ? আজরাইল তাতে রাগ করলেও এই যুবকের রাগ করার কিছু নেই। তিনি বৃদ্ধ একজন মানুষ। সামনের মাসেই তাঁর রিটায়ার করার কথা। কুড়ি-একুশ বছরের একজন যুবককে তুমি বলার অধিকার তো তার থাকাই উচিত।
তুমি বলায় রাগ করেছ না-কি?
জ্বি না স্যার, রাগ করিনি।
রাগ করনি, তাহলে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন?
কোন্ প্রশ্ন?
একটু আগে যে জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম কি?
আমার নাম নেই।
নাম নেই মানে? নাম থাকবে না কেন?
আপনি একটা নাম দিয়ে দিন।
তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। নাম নেই বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ? তোমার বাবা-মা তোমার কোনো নাম দেননি?
জ্বি না।
বৃষ্টি কমে এসেছে। বাতাস এখনো আছে। এত ঠাণ্ডা বাতাস সারাজীবনে মনসুর সাহেবের গায়ে লাগেনি। পৌষ মাসের বাতাসও এত ঠাণ্ডা থাকে না। এটা হল চৈত্র মাস।
তুমি বলতে চাচ্ছ তোমার বাবা-মা তোমার কোনো নাম রাখেননি?
আমার বাবা-মা নেই।
তাঁরা অল্প বয়সে মারা গেছেন?
স্যার, ব্যাপারটা ঠিক তাও না। বাবা-মার যে ধারণা পৃথিবীর মানুষদের আছে—সেই ধারণা আমাদের জন্যে প্রযোজ্য নয়। আমি এই পৃথিবীর কেউ না।
তুমি এই পৃথিবীর কেউ না?
জ্বি না।
মনসুর মোটেই চমকালেন না। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায়—বজ্ৰপাতের মানসিক চাপে তার মাথা কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এক যুবক ছেলে তাকে বলবে সে এই পৃথিবীর কেউ না আর তিনি তা বিশ্বাস করে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠবেন, তা হয় না।
তুমি আমাকে পেলে কোথায়?
আমি আপনার খোঁজেই এসেছি।
ও আচ্ছা। তুমি কর কি?
স্যার, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
জটিল কথা তো কিছু বলছি না। জানতে চাচ্ছি তুমি কি কর। চাকরি বাকরি কর না এখনো ছাত্র?
আমি একজন ছাত্র।
কোন্ ক্লাসের ছাত্র? কলেজ শেষ করেছ?
স্যার, আপনাদের যেমন পড়াশোনার নানান স্তর আছে—আমার সে রকম নয়…ব্যাখ্যা করতে সময় লাগবে। চলুন আগে বাসায় যাই।
যুবকটি মনসুর সাহেবের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনসুর সাহেব কিছুটা বিভ্রান্তি বোধ করছেন। মাথা ঝিম ঝিম করছে। বাঁধের উপর থেকে নিচে পড়ে যাবার সময় মাথায় ব্যথা পেয়েছেন। যা ঘটছে তা কি মাথায় ব্যথা পাওয়ার জন্যেই হচ্ছে? ফিবোনাক্কি রাশিমালার কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করলে অবশ্য বোঝা যাবে চিন্তাশক্তি ঠিক আছে না তাতে কোনো সমস্যা আছে।
ফিবোনাক্কি রাশিমালার প্রথম বৈশিষ্ট্য কি? প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই রাশিমালার পরপর যে কোনো চারটি সংখ্যা নেয়া হলে প্রথম এবং চতুর্থ সংখ্যার যোগফল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার যোগফলের চেয়ে এক কম। যেমন–
১, ১, ২, ৩
প্রথম এবং চতুর্থ সংখ্যার যোগফল ৪।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার যোগফল ৩।
না মাথাটা তো ঠিকই আছে। মাথায় তেমন সমস্যা হয়নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে চোখও সেরে গেছে। চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়েছে। যুবকটি হঠাৎ বলে বসল,
ফিবোনাক্কি রাশিমালার বড় বৈশিষ্ট্য হল আপনি যে নিয়মের কথা বলছেন সে নিয়মের কিছু কিছু ব্যতিক্রম আছে। এই ব্যতিক্রমগুলিই হল রাশিমালার বৈশিষ্ট্য…
তুমি ফিবোনাক্কি রাশিমালা জান?
হ্যাঁ জানি, তবে এই রাশিমালা নিয়ে আমি তেমন উৎসাহী নই। আমার উৎসাহ অন্য জায়গায়।
কোথায়?
আপনি নিজে যে রাশিমালা তৈরি করেছেন সেই রাশিমালায়…
আমি তো কোনো রাশিমালা তৈরি করিনি…
করতে যাচ্ছেন। আপনার রাশিমালার প্রথম সংখ্যাটি শূন্য। দ্বিতীয়টি শূন্য শূন্য…
মনসুর সাহেব রাগী গলায় বললেন আমি কোনো রাশিমালা তৈরি করিনি। আমি করছি ফিবোনাক্কি নিয়ে…
ফিবোনাক্কিকে আপনি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন। আপনার মূল চিন্তা নতুন রাশিমালা এবং এই রাশিমালার নিয়ম-কানুন…
মনসুর সাহেব অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন—তুমি নিতান্তই মূখের মতো কথা বলছ। প্রথমত শূন্য কোনো রাশিমালার সংখ্যা হতে পারে না। শূন্য হচ্ছে একটা প্রতীক, যে প্ৰতীক আমরা ব্যবহার করি কোনো সংখ্যার অবস্থান নির্দেশের জন্যে। যেমন ৮ একটি সংখ্যা। এর অবস্থান এককের ঘরে। এই আটকে আমরা দশকের ঘরে নিয়ে যেতে চাই। আটের ডানে একটি শূন্য বসাই। আট হয়ে গেল আশি। তার অবস্থানের পরিবর্তন হল।
আপনার কথা মেনে নিচ্ছি—তারপরেও শুনুন, শূন্য যদি শুধু কোনো প্রতীকই হয় তাহলে কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে আপনি গুণফল শূন্য লিখতে পারেন না। আপনি লিখতে পারেন না–
৩ x ০ = ০ বা
৪ X ০ = ০
একই সঙ্গে আপনি বলছেন শূন্য একটি প্রতীক, আবার সঙ্গে সঙ্গে শূন্যকে গাণিতিক প্রক্রিয়ায় কাজে লাগাচ্ছেন, তা কি করে হয়?
মনসুর সাহেব চুপ করে গেলেন, অকাট্য যুক্তি। এবং ভালো যুক্তি। যুবকটি শব্দ করে হাসল।
মনসুর সাহেব বললেন, তোমার যুক্তি মেনে নিলাম। ধরলাম, শূন্য একটি সংখ্যা হতে পারে। কিন্তু শূন্য/শূন্য তো সংখ্যা হতে পারে না।
কেন পারবে না? হতে পারে। এই পৃথিবীর একজন মহান আঙ্কিক শূন্য/শূন্য অনেকবার ব্যবহার করেছেন। একে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন।
কার কথা বলছ?
স্যার আইজাক নিউটন। তিনি ক্যালকুলাস বের করেন।
সেখানে শূন্য/শূন্য কোথায়?
আছে। তো dy/dx শূন্য / শূন্য ছাড়া আর কিছুই না। dy হচ্ছে y-এর অতিক্ষুদ্র অংশ। প্রায় শূন্য। তেমনি dy হল x-এর অতি ক্ষুদ্র অংশ, প্রায় শূন্য। অর্থাৎ তিনি কাজ করেছেন প্রায় শূন্য/প্রায় শূন্য নিয়ে। আপনি কাজ করছেন শূন্য/শূন্য নিয়ে। এই একটি কারণেই আমার আপনার কাছে আসা।
তুমি কে? আমার কোনো নাম নেই এবং আমি আমার অবস্থান আপনাকে এই মুহূর্তে ব্যাখ্যাও করতে পারছি না…
কোত্থেকে এসেছ? আমি এসেছি শূন্য থেকে।
শূন্য থেকে?
জ্বি স্যার, শূন্য থেকে। শূন্য সংক্রান্ত রাশিমালার প্রতি এ কারণেই আমার এত আগ্রহ।
তোমার নাম কি?
আপনি বারবার নামের মধ্যে ফিরে যাচ্ছেন। যে এসেছে শূন্য থেকে তার নাম থাকতে পারে না। তারপরেও কথাবার্তা চালানোর সুবিধার জন্যে আপনার যদি একান্তই নামের প্রয়োজন হয় আপনি আমাকে একটা নাম দিতে পারেন। আপনার পছন্দসই কোনো নাম…আপনি আমাকে ফিবোনাক্কি ডাকতে পারেন।
ফিবোনাক্কি?
জি। তবে যদি এই নামটা কঠিন মনে হয় তাহলে আরো সহজ কোনো নামে ডাকতে পারেন স্যার, নিউটন নামটা কি আপনার কাছে সহজ মনে হয়?
নিউটন?
হ্যাঁ নিউটন। বিদেশী নাম যদিও তারপরেও নামটার এক ধরনের সহজ ভাব আছে। আপনি দেশী নামও রাখতে পারেন–রহিম, করিম, যদু, মধু…স্যার, আমরা এসে পড়েছি।
মনসুর সাহেব পাঞ্জাবির পকেটে গেটের চাবির জন্য হাত ঢুকালেন। চাবি নেই। বাঁধ থেকে যখন তিনি ছিটকে নিচে পড়ে গেছেন। তখন চাবিও নিশ্চয়ই পড়ে গেছে। গুদামঘরের গেটে যে বিশাল তালা ঝুলছে সেই তালা খোলা তাঁর কর্ম নয়।
স্যার কি চাবি খুঁজছেন?
হুঁ।
এই নিন চাবি।
মনসুর সাহেব যন্ত্রের মতো চাবি হাতে নিলেন। গেটের তালা খুলতে খুলতে বললেন, চাবি কোথায় পেলে?
আপনি যখন বাঁধের নিচে পড়ে গেলেন তখন পকেটের চাবিও ছিটকে পড়ে গেল। কাজে লাগবে বলে চাবি তুলে এনেছি।
তোমাকে ধন্যবাদ।
এক বোতল প্যালিকেন কালি ছিল, তা আনতে পারিনি। কালির বোতলটা ভেঙে গেছে।
ও।
আপনার সঙ্গে কাগজের যে প্যাকেট ছিল তাও আনতে পারিনি। ইচ্ছা করলে আনতে পারতাম কিন্তু কাদায়-পানিতে মাখামাখি হয়ে কাগজের যে অবস্থা—আনাটা অর্থহীন হত।
ও।
গেটের তালা খোলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু গেট সরানো যাচ্ছে না। জাম হয়ে আছে। ছেলেটি তাঁকে সাহায্য করল। দুজনে ঠেলে ঠেলে গেট সরালেন। ভালো পরিশ্রম হয়েছে। তিনি হাঁপাচ্ছেন। ছেলেটাও হাঁপাচ্ছে।
স্যার চলুন, ঘরে যাই। বাইরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা লাগাবেন। আপনার ঘরে কি বাড়তি কাপড় আছে? আমার কাপড় বদলাতে হবে।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তুমি মন দিয়ে আমার কথা শোন।
আপনি বরং আমাকে একটা নাম দিয়ে দিন। নাম দিলে আপনার সুবিধা হবে। ফিবোনাক্কি ডাকেন। এই নাম আমার পছন্দ।
শোন ফিবোনাক্কি, তোমাকে আমি একটা গল্প বলব। গল্পটা তুমি খুব মন। দিয়ে শুনবে।
এখানে দাঁড়িয়ে গল্প শোনার প্রয়োজন কি? চলুন যাই। শুকনো কাপড় পরি। চা খেতে খেতে আপনার গল্প শুনি।
না, তুমি এখানে দাঁড়িয়েই গল্প শুনবে।
আপনার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ইতিমধ্যে লেগে গেছে বলে আমার ধারণা।
ঠাণ্ডা লাগুক আর না লাগুক—এখানে দাঁড়িয়ে তুমি গল্প শুনবে।
স্যার বলুন।
আমার শৈশবের একটা ঘটনা। আমার দূর সম্পর্কের এক খালাতো ভাই ছিল। রমিজ নাম। বার-তের বছর বয়স। এক বর্ষাকালে সে জাম পাড়ার জন্যে জাম গাছে উঠল। বর্ষাকালে জাম গাছ থাকে পিছল…
স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনি নিজেও কিন্তু আপনার দারোয়ান হরমুজ মিয়ার মতো বেশি কথা বলছেন—মূল ব্যাপারটা বলতে দেরি করছেন।
রমিজ গাছে উঠল…পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেল। ঘণ্টাখানিক অজ্ঞান হয়ে রইল মাথায় পানি-টানি ঢেলে তার জ্ঞান ফেরানো হল। জ্ঞান আসার পরই সে তার মার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করল। কথা বলে, হাসে। কিন্তু তার মা বেঁচে নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। অথচ সে এরকম ভাব করছে যেন মা বেঁচেই আছেন। তার সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার ওষুধপত্র দিলেন। সে সেরে গেল।
রমিজ সাহেব কি এখনো জীবিত আছেন?
হ্যাঁ আছে। ঢাকা কাস্টমস-এ কাজ করে। প্রচুর পয়সা করেছে মালিবাগে তার দোতলা বাড়ি। বাড়ির নাম কেয়া ভবন। কেয়া হল তার প্রথম স্ত্রীর নাম। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে আবার বিয়ে করেছে। সেই বৌয়ের নাম মিতা। এখন শুনছি বাড়ির নাম পালটে মিতা ভবন…
স্যার, আপনি যে বেশি কথা বলছেন সেটা বুঝতে পারছেন?
পারছি।
মূল গল্পে কি ফিরে যাবেন, না যা বলার বলে ফেলেছেন?
না, আসল ব্যাপারটা বলা হয়নি–রমিজ মাথায় ব্যথা পেয়ে তার মৃতা মাকে দেখতে পেয়েছিল। সেটা ছিল তার মনের কল্পনা। ব্যাপারটা ঘটেছে মাথায় ব্যথা পাওয়ার কারণে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে—আমি মাথায় ব্যথা পেয়েছি। ব্যথা পাওয়ার কারণে তোমাকে দেখছি। তুমি হচ্ছ আমার মনের কল্পনা। এর বেশি কিছু না।
যুবক হাসল। মনসুর সাহেব তাঁর হাসি দেখলেন না তবে তার হাসির শব্দ শুনলেন।
শোন যুবক। যুবক না—বলুন, শোন ফিবোনাক্কি।
শোন ফিবোনাক্কি—তুমি আমার কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। তুমি এই মুহূর্তে বিদেয় হবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার। শুধু…
শুধু কি?
ঠাণ্ডায় কাহিত হয়েছি। আপনার ঘরে বসে এক কাপ চা খেতে পারলে…
বিদেয় হও বলছি।
জি আচ্ছা স্যার। গেটটা তো বন্ধ করা দরকার। আপনি একা পারবেন না। আপনি ভেতর থেকে ঠেলা দিন। আমি বাইরে থেকে টানি।
মনসুর সাহেব আপত্তি করলেন না। একা তাঁর পক্ষে গেট সরানো আসলেই কষ্টকর।
গেট বন্ধ করে মনসুর সাহেব ভেতর থেকে তালা দিলেন। ছেলেটি গেটের বাইরে থেকে বলল, স্যার, আমি দেয়ালের বাইরেই থাকব। যদি প্রয়োজন মনে করেন।
মনসুর সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন।
সমস্ত শরীর ভিজে জবজব
সমস্ত শরীর ভিজে জবজব করছে। কাদায় মাখামাখি হয়েছেন। গা ধোয়া দরকার। কাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরা দরকার। তারচেয়েও বেশি যা দরকার তা হচ্ছে গরম এক কাপ চা। আগুন-গরম চা। নেত্রকোনার লোকজন বলে আগুইন্যা চা। যে চা জিভ-মুখ পুড়িয়ে পাকস্থলিতে নেমে যায়। মনসুর সাহেব ক্ষুধার্ত বোধ করছেন। তারচেয়েও হাজারগুণে যা বোধ করছেন তার : নাম ক্লান্তি। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি জীবিত কোষ ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো এরমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভেজা কাঠের চুলা এই মুহূর্তে ধরানো সম্ভব নয়। চোঙা দিয়ে ক্রমাগত যুঁ দিতে হবে। তার ফুসফুসে সেই জোর নেই। ছেলেটাকে নিয়ে এলে হত। যুবক ছেলে জোরালো ফুসফুস। আগুন জ্বালালে শরীর আরাম পেত। কোনোমতে চারটা ভাত ফুটাতে পারলে ভাতের উপর ঘি ছড়িয়ে দিয়ে খেয়ে ফেলা যেত। আজিজ খাঁ হরলিক্সের কৌটা ভর্তি এককৌটা ঘি দিয়ে গেছে। গরম ভাত-ঘি, সঙ্গে একটা ভাজা শুকনা মরিচ।
ক্লান্তি লাগছে, ক্লান্তি। তিনি শুয়ে পড়বেন। আরাম করে ঘুমুবেন। তাঁর মতে আজকের রাতের মতো আরামের ঘুম তার আর কোনো দিনও হবে না। এই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না। কাপড় বদলানোর দরকার নেই। ভেজা কাপড়েই শুয়ে পড়বেন।
মনসুর সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানার দিকে এগুচ্ছেন। আর তখন শুনলেন। ফিবোনাক্কির গলা—স্যার! স্যার।
দেয়ালের বাইরে থেকেই ডাকছে। তবে ডাকছে তার ঘরের জানালার ঠিক নিচে থেকে। কষ্ট করে উঁকি দিলে দেখতে পাওয়ার কথা। মনসুর সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছায় জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন—আবছা আবছা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
কি চাও?
স্যার, আপনি ভেজা কাপড়ে বিছানায় যাবেন না।
আমি কি করি না করি সেটা সম্পূর্ণই আমার ব্যাপার।
ভেজা কাপড়ে ঘুমুতে গেলেই ভয়ংকর ঠাণ্ডা লেগে যাবে। নিওমোনিয়া তো হবেই। আপনার যে বয়স! নিওমোনিয়ার ধকল সামলাতে পারবেন না।
তাতে তোমার কি সমস্যা?
আমার খুব সমস্যা। আপনি যে জটিল অন্ধটি শুরু করেছেন তার শেষটা আমাদের দরকার। আপনি যে কাজটি করতে পারছেন—আমরা তা পারছি না। আপনি কিছু ছোট ছোট ভুল করছেন। সেই ভুলগুলি ধরিয়ে দিলে আপনার জন্যে কাজ সহজ হয়…
আমি কি ভুল করছি?
স্যার, সবই বলব। আমাকে ভেতরে আসতে দিলে ভালো হয়। গেট খুলতে হবে না। আমি দেয়াল বেয়ে উঠে আসব।
তোমাকে উঠে আসতে হবে না—তুমি যেখানে আছ সেখানে থাক।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আমি কি ভুল করছি বল।
স্যার বলব, তার আগে আপনি কাপড়গুলি বদলে শুকনো কাপড় পরে আসুন।
আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। ভুল কি করেছি বল…
ভুল ঠিক না—একটা ব্যাপার আপনাদের চোখে পড়েনি।
বল কি সেটা।
আপনি শুকনো কাপড় না পরলে আমি বলব না।
মনসুর সাহেবের কৌতূহলই শেষ পর্যন্ত জয়ী হল। তিনি কাপড় ছাড়লেন। শুকনো কাপড় পরলেন। গায়ের কাদা এখনো আছে। থাকুক। তিনি জানালার কাছে মুখ নিয়ে ডাকলেন–ফিবোনাক্কি। ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
কাপড় বদলেছি। আমার ভুলটা কি বল।
স্যার শূন্য এবং ১ এই দু-এর ভেতরের মিল কি আপনি লক্ষ করেছেন?
কি রকম মিল?
১×১=১
আবার
১×১x১= ১
একইভাবে ০ x০ = ০
০ X ০ x ০ = ০
১-এর বর্গমূল বা কিউব রুট যেমন ১
তেমনি ০-এর বর্গমূল বা কিউব রুটও ১।
মনসুর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, এই সামান্য তথ্য আমার অজানা নয়।
ফিবোনাক্কি বলল, অনেক সময় সামান্যের মধ্যে অসামান্য লুকানো থাকে। এই দুটি সংখ্যার ভেতর রহস্যময় মিল আছে।
মিল আছে তো বটেই। রহস্যময় বলছ কেন?
জর(১) কে নিয়ে আপনারা মাথা ঘামাচ্ছেন। এর আলাদা নাম দিয়েছেন—কাল্পনিক সংখ্যা ইমাজিনারি নাম্বার। কিন্তু জর(-০) নিয়ে আপনাদের মাথাব্যথা নেই।
মাথাব্যথার কারণ নেই বলেই মাথাব্যথা নেই।
স্যার, আপনি খুব ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। আপনি ঘুমিয়ে পড়ন। একটা চাদরটাদর কিছু গায়ে দিয়ে ঘুমান। তুমি বিদেয় হও।
আমি তো বিদেয় হয়েই আছি। গেটের বাইরে ঠাণ্ডায় হাঁটাহাঁটি করছি। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।
তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি হচ্ছ কল্পনা। আমার মনের কল্পনা। ঠিক বলিনি?
অবশ্যই ঠিক বলেছেন। আমি এসেছি শূন্য জগৎ থেকে। আমি তো শূন্য হবই। কল্পনাও শূন্য।
শাট আপ!
স্যার, ঘুমুতে যান। তবে আমাকে অনুমতি দিলে আমি ছোট্ট একটা কাজ করতে পারি। আমি দেয়াল বেয়ে উঠে এসে চারটা ভাত ফুটিয়ে দিতে পারি। দেয়াল বেয়ে উঠা আমার জন্যে কোনো সমস্যা নয়।
শাট আপ!
স্যার, আপনি এমন রাগারাগি করছেন কেন? রাগারাগি করা, গালাগালি করা এইসব তো আপনার মধ্যে কখনো ছিল না। স্যার, আপনার ঘুম দরকার। খুব ভালো ঘুম। আমি তো আপনার সঙ্গে কোনো অভদ্র ব্যবহার করছি না। অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করছি। কথায় কথায় স্যার বলছি। আপনার কাছ থেকে সামান্য ভদ্ৰতা কি আমার প্রাপ্য নয়?
ফিবোনাক্কি, কিছু মনে করো না।
আমি কিছুই মনে করছি না। আমি বাইরেই আছি। আপনি ডাকলেই আমি আসব। স্যার, শুয়ে পড়ুন। আমি যদি আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মনসুর সাহেব বিছানায় গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেলেন। তাঁর ঘুম ভাঙল সকাল নটায়। ঘরে ঝলমলে রোদ। কাল রাতের কাণ্ডকারখানা মনে হয়ে তাঁর হাসি পেতে লাগল।
তাঁর ঠাণ্ডা লাগেনি। শরীর ভালোই আছে। প্রচণ্ড ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। দশটায় স্কুল। চারটা খেয়ে স্কুলে যেতে হবে। তার আগে গোসল করতে হবে। কাদা শুকিয়ে শরীরে শক্ত হয়ে গেলে বসে আছে।
স্কুলে পা দিতেই হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন—শরীর ঠিক আছে?
মনসুর সাহেব হাসলেন। হেডমাস্টার সাহেব বললেন বজলুর সঙ্গে দেখা। সে আপনাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিল। আপনি না-কি ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলেন। কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
জ্বি না।
চোখের সমস্যা দূর হয়েছে?
জ্বি।
গতকাল স্কুলে না আসায় খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। আপনি তো স্কুলে না। আসার লোক না। ভেবেছিলাম, আজও যদি না আসেন তাহলে খোঁজ নিতে যাব।
মনসুর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আজ ক তারিখ?
আঠারো তারিখ।
আঠারো তারিখ? আজ কি মঙ্গলবার।
হ্যাঁ। তারিখ জিজ্ঞেস করছেন কেন?
মনসুর সাহেব ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হাসতে চেষ্টা করলেন। তিনি তারিখ জিজ্ঞেস করছেন সঙ্গত কারণেই। হেডমাস্টার সাহেবের কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা এক নাগাড়ে ঘুমিয়েছেন। মাঝখানের একটা দিনের কোনো হিসেব নেই।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, কি ব্যাপার, এমন করে তাকাচ্ছেন কেন?
শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না।
শরীর ভালো না লাগে এসেছেন কেন? আপনারা সিনিয়র লোক। দুদিন পর রিটায়ার করবেন—বিশ্রাম তো আপনাদের প্রাপ্য।
মনসুর সাহেব বিরক্ত বোধ করছেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ক্লাসে যাওয়া দরকার। যে ধরনের আলাপ শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে না হেডমাস্টার সাহেব সহজে থামবেন। মনসুর সাহেব বললেন, ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে। স্যার।
পড়ক না। ঘণ্টা তো পড়বেই। জীবনেরই ঘণ্টা পড়ে গেছে আর ক্লাস! রবার্ট ব্রাউনিং-এর এই বিষয়ে একটা কবিতা আছে Ring Ring-ding ding…না, এটা বোধহয় ব্রাউনিং-এর না—অন্য কারো।
যদি অনুমতি দেন ক্লাসে যাই।
ক্লাসে যাবেন তার আবার অনুমতি কি? আপনার পাংচুয়ালিটির কথা আমি সর্বত্র বলি। সবাইকে বলি–এই লোকটাকে দেখ। দেখে শেখ। শিক্ষার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। কটা পুরুষ পারে? চিরকুমার একজন মানুষ।
আমি চিরকুমার না। বিবাহ করেছিলাম। অল্পবয়সে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তারপর আর বিবাহ করিনি।
ঐ একই হল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিয়ে করে না এমন লোক আমাকে দেখান তো। বুড়ো হাবড়াগুলি চক্ষুলজ্জায় বিয়ে করতে পারে না—এ ছাড়া সবাই করে। আমার এক শ্যালক আছে। ক্যানসারে তার স্ত্রী মারা গেল। শোকে সে উন্মাদ। রাতে ঘুমায় না। হাঁ হাঁ করে কাঁদে। মনে হয় হায়না ডাকছে। কী গভীর প্ৰেম! দশ দিনের মাথায় শুনি—সে বিয়ের জন্যে মেয়ে খোঁজাখুঁজি করছে। শালা বলে গালি দিতে ইচ্ছা করে। গালি কি দেবসে আসলেই আমার শালা। আপন শালা।
আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
যান যান, ক্লাসে যান। ভালো কথা—ঐদিন ব্ল্যাকবোর্ড কি লিখেছিলেন?
বুঝতে পারছি না। কীসের কথা বলছেন?
ব্ল্যাকবোর্ড দেখলাম কি সব হাবিজাবি লেখা-ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ-খাঁজকাটা খাঁজকাটা সার্কেল…ছেলেদের বললাম, এইসব কে লিখেছে? ওরা বলল–আপনি।
মনসুর সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি নিজেও কিছু বুঝতে পারছেন না। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আচ্ছা যান, পরে এই নিয়ে কথা বলব। এটা এমন জরুরি কিছুও না। আপনার ব্লাডপ্রেসার নেই তো?
জানি না।
ব্লাডপ্রেসার থাকলে মাথায় মাঝে মাঝে ইয়ে হয়। আপনি বজলুকে দিয়ে প্রেসারটা মাপাবেন।
জ্বি আচ্ছা।
ওর প্রেসারের যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি-না কে জানে। ঐদিন প্রেসার মাপতে নিয়েছি, সে প্রেসার-ট্রেসার মেপে বলল—আবার মাপতে হবে। রিডিং ভুল আছে। আমি বললাম, কত আসছে? সে বলল ২৫। এখন আপনিই বলুন ২৫ কি কোনো প্রেসার? একটা মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছের প্রেসারও পঁচিশের চেয়ে বেশি হয়।
মনসুর সাহেব পনেরো মিনিট দেরি করে ক্লাসে ঢুকলেন। প্রথমেই তাকালেন ববার্ডের দিকে। তারিখ এবং বার বোর্ডের মাথায় লেখা আছে। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ ছিল হয়তো হেডমাস্টার সাহেব তারিখ ভুল করছেন।
না, হেডমাস্টার সাহেব তারিখ ভুল করেন নি। তারিখ ঠিকই বলেছেন। মনসুর সাহেব রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো পুরো চব্বিশ ঘণ্টাই ঘুমিয়েছেন।
মনসুর সাহেব বললেন, বাবারা, তোমরা কেমন আছ?
ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। মনসুর সাহেবের কাছ থেকে তারা এ জাতীয় কথা আগে শুনেনি।
আজ ক্লাসে আসতে দেরি করে ফেললাম। আজ আমরা কি পড়ব?
কোনো ছাত্র জবাব দিচ্ছে না। মনসুর সাহেব রেজিস্ট্রার খাতা খুলে ডাকলেন—রোল নাম্বার ওয়ান।
ক্লাস ক্যাপ্টেন উঠে দাঁড়াল।
তাকে প্রেজেন্ট মার্ক দিয়েই মনে হল—শূন্য কোনো প্রতীক না। শূন্য একটা সংখ্যা অথচ আমরা তাকে বাদ দিয়ে সংখ্যা শুরু করছি। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
মনসুর সাহেব বললেন, রোল নম্বর ওয়ান, তোমার নাম কি?
মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন।
শূন্য কাকে বলে সাব্বির হোসেন?
সাব্বির ভীত মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে শূন্য শব্দটা এই প্রথম শুনল।
শূন্য কাকে বলে তুমি জান না? জ্বি না। তোমরা কেউ জান?
মনসুর সাহেব ছাত্রদের মুখের দিকে তাকালেন। কেউ শব্দ করছে না। মনে হচ্ছে কেউ নিশ্বাস ফেলছে না।
আশ্চর্য ব্যাপার, তোমরা জান না শূন্য কি?
শূন্য হল স্যার গোল্লা।
মনসুর সাহেব বোর্ডে একটা চক্র আঁকলেন—সহজ গলায় বললেন, এই কি শূন্য?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা শোন, আমার হাতের এই ডাস্টারটার দিকে তাকাও। ডাস্টারটা যদি আমরা ভাঙতে থাকি তাহলে ভেঙে কি পাব?
অণু পাব।
হ্যাঁ, অণু পাব। অণুটা যখন ভাঙব তখন কি পাব?
পরমাণু?
পরমাণু ভাঙলে?
ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। এদের যদি ভাঙা যায় তাহলে কি পাব?
জানি না স্যার।
আমার ধারণা, ভাঙতে ভাঙতে এক সময় দেখব কিছুই নেই। এই জগৎ সংসার, বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড, গাছপালা, পৰ্বত-নদী সব তৈরি হয়েছে শূন্য দিয়ে সব কিছুই শূন্যের উপর। শুরুটা হল শূন্যে। যার শুরু শূন্যে তার শেষ কোথায়?
ছাত্ররা ভীত চোখে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মনসুর সাহেব বললেন–তার শেষও শূন্যে। বিশ্বজগৎ হল আঙটির মতো। আঙটির যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। তোমরা কি বুঝতে পারছ?
সব ছেলে এক সঙ্গে মাথা নাড়ল। মনে হচ্ছে তারা সবাই ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে।
ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে। ঘণ্টা পড়ার পরেও ব্ল্যাকবোর্ড আঁকা বিশাল শূন্যের দিকে মনসুর সাহেব তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে ব্ল্যাকবোর্ডে তিনি অপরূপ কোনো চিত্র এঁকেছেন। চিত্রকলার সৌন্দর্য থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না।
আকাশে চাঁদের আলো নেই
মনসুর সাহেব বাসার দিকে রওনা হলেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। পথ অন্ধকার। আকাশে চাঁদের আলো নেই শুধু নক্ষত্রের আলো। নক্ষত্রের আলোয় পথ চলতে তাঁর ভালোই লাগছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরবৃত্তির নিয়মে পরিবর্তন হয়—আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি ভালো লাগে।
বাঁধের উপর যে জায়গায় বজ্ৰপাত হয়েছিল মনসুর সাহেব ঐ জায়গাটা খুঁজতে শুরু করলেন। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন যেখানে বজ্ৰপাত হয়। সেখানে গর্ত হয়ে থাকে। গর্ত খুঁড়লে লৌহ জাতীয় কিছু পাওয়া যায়। বাঁধের উপর তিনি এমন কোনো গর্ত খুঁজে পেলেন না, যাকে বজ্ৰপাতজনিত গর্ত বলে ভাবা যায়। গরুর গাড়ির চাকায় তৈরি গর্ত, মাটি ডেবে যাবার গর্ত প্রচুর আছে; কিন্তু বজ্রপাতের গর্ত কই? তাঁর হাত থেকে কাগজের প্যাকেট পড়ে গিয়েছিল—সেই প্যাকেটটাই বা কোথায়?
স্যার কী খুঁজছেন?
মনসুর সাহেব চমকে উঠলেন। এতটা চমকানোর কোনো কারণ ছিল না। প্ৰশ্নকর্তা তাঁর অপরিচিত কেউ নয়। ফিবোনাক্কি। তিনি শুকনো গলায় বললেন, ও।
আমাকে চিনতে পেরেছেন তো স্যার আমি ফিবোনাক্কি।
হুঁ।
বজ্ৰপাতের জায়গাটা খুঁজছেন?
হুঁ।
ঐ রাতে বজ্ৰপাত হয়েছিল আপনার শরীরে। আপনার গা বেয়ে বিদ্যুৎ নিচে নেমে যায়।
আমার গায়ে বজ্ৰ পড়ল আর আমার কিছু হল না? তালগাছে বজ্ৰপাত হলে তালগাছ জ্বলে যায়।
স্যার আপনিতো আর তালগাছ না।
ফিবোনাক্কিও রসিকতা করছে। আশ্চর্য।
স্যার চলুন হাঁটা শুরু করি। গল্প করতে করতে আপনার সঙ্গে যাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। হটাও শুরু করলেন না। ফিবোনাক্কির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করা মানে তাকে শুধু যে স্বীকার করে নেয়া তাই না তাকে প্রশ্রয় দেয়া। স্বীকার করা বা প্রশ্রয় দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। মনের ভ্ৰান্তি মনেই থাকুক। তাঁর প্রেসার নিশ্চয়ই অনেক বেশি। ডাক্তার বজলুর রহমানের নষ্ট যন্ত্রে ধরা পড়ে নি। প্রেসার বেশি না হলে ফিবোনাক্কি নামক ব্যাপার স্যাপার চোখের সামনে উপস্থিত হত না।
স্যার ঐ রাতেতত এক ম্যারাথন ঘুম দিলেন। আমি হিসেব করে দেখেছি আপনি সর্বমোট ২৩ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট ১১ সেকেন্ড ঘুমিয়েছেন। আপনি কি স্যার লক্ষ করেছেন—২৩, ৩৭, ১১ তিনটাই প্রাইম নাম্বার। আবার এদের যোগফলও প্রাইম নাম্বার। এদের যোগফল হল ৭১, ইন্টারেস্টিং না?
হ্যাঁ ইন্টারেস্টিং। বেশ ইন্টারেস্টিং।
ফিবোনাক্কি লজ্জিত গলায় বলল, আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন স্যার। আসলে আপনি ঘুমিয়েছেন ২৫ ঘন্টা ২০ মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড। কোনোটাই প্রাইম নাম্বার না। আপনাকে মিথ্যা করে প্রাইম নাম্বারের কথা বলেছি যাতে আপনি আগ্রহী হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। প্রাইম নাম্বারের প্রতি আপনার এই আগ্রহের কারণ কি?
মনসুর সাহেব বললেন, একটা সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে না। অখণ্ড অবস্থায় থাকছে এই জন্যেই ভালো লাগে।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত গণিতবিদ জন্মেছেন সবারই প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে কৌতূহল। ভারতের মাদ্রাজের এক গণিতবিদ ছিলেন—আপনি তাঁর নাম শুনেছেন রামানুজন?
হ্যাঁ শুনেছি।
প্রাইম নাম্বার সম্পর্কে উনার আগ্রহ ছিল সীমাহীন। উনার সেই বিখ্যাত গল্পটা কি স্যার জানেন?
কোন গল্প?
ঐ যে নিদারুণ অসুস্থ হয়ে তিনি শুয়ে আছেন। শরীরের এমন অবস্থা যে, যে কোনো মুহূর্তে তিনি মারা যাবেন। এই সময় তাঁকে এক ভদ্রলোক দেখতে এলেন। রামানুজন বললেন—তুমি যে গাড়িতে করে এসেছ তার নাম্বারটা কত। ভদ্রলোক নাম্বার বললেন। রামানুজন আনন্দিত ভঙ্গিতে বললেন-আরে প্রাইম নাম্বার! তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কি কৌতূহল।
মনসুর সাহেব রাগী গলায় বললেন, প্রাইম নাম্বার তুচ্ছ বিষয়?
অবশ্যই তুচ্ছ বিষয়। মৌলিক সংখ্যায় এমন কি বিশেষত্ব আছে যে একে মাথায় নিয়ে নাচতে হবে? পৃথিবীর রহস্যের সবটাই শূন্যের ভেতর। যে কোনো রাশিকে শূন্য দিয়ে গুণ দিলে উত্তর হবে ০, আবার সেই রাশিকে শূন্য দিয়ে ভাগ দিন হয়ে যাবে অসীম।
তুমি আমাকে এইসব শেখাতে এসো না। এসব আমার অজানা নয়।
স্যার আমরা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি?
চল।
আপনার কাগজের প্যাকেটটা আমার হাতে দিন।
তোমার হাতে দিতে হবে না—তুমি হাঁট। এটা এমন কিছু ভারি নয়।
ফিবোনাক্কি পাশপাশি হাঁটছে। নিজের উপর রাগে মনসুর সাহেবের গা জ্বলে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটার মানে তাকে স্বীকার করে নেয়া।
ফিবোনাক্কি তুমি কি ধূমপান কর?
জ্বি না স্যার। তবে আপনি যদি দেন একটা সিগারেট টেনে দেখতে পারি।
আমার কাছে সিগারেট নেই, আমি ধূমপান করি না।
না করাই ভালো হার্টের বারোটা বাজিয়ে দেয়।
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার?
ব্যাঙের পেটে মণি থাকে তুমি জান?
আমি শুনেছি। ব্যাঙের পেটের মণিকে বলে–লাল। ভাদ্ৰ আশ্বিন মাসে ব্যাঙ এই লাল উগরে মাটিতে ফেলে। এতে জায়গাটা আলো হয়ে যায়। আলো দেখে পোকা মাকড় আসে। ব্যাঙ তখন এইসব পোকামাকড় ধরে ধরে খায়। এইসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?
তোমার জ্ঞান কতটুকু তা জানার চেষ্টা করছি।
কি জানলেন?
জানলাম যে আমার যে জ্ঞান এবং তোমার যে জ্ঞান তা একই। তুমি আমার চেয়ে বেশি কিছু জান না। অর্থাৎ তুমি ফিবোনাকি নাও-কিছুই নও তুমি আমার কল্পনা। এবং এই সত্য আমি খুব সহজে প্রমাণ করতে পারি।
কীভাবে করবেন?
কাউকে না কাউকে আমি পাব যে নেত্রকোনার দিকে যাচ্ছে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করব সে তোমাকে দেখতে পাচ্ছে কি না। সে যদি তোমাকে দেখতে না পায় তাহলে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের সৃষ্টি।
ফিবোনাক্কি চুপ করে রইল। মনসুর সাহেব বললেন আমার এই ক্ষুদ্র পরীক্ষা তোমার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?
খুব ভালো পরীক্ষা স্যার!
তুমি কি এই পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে চাও?
অবশ্যই যেতে চাই। কেন যেতে চাইব না। পরীক্ষাটা হলে আমারই লাভ।
কি লাভ?
আপনি বুঝবেন যে আমি কল্পনা নই। আমার অস্তিত্ব আছে। এবং আমার কথা আপনার মন দিয়ে শোনা উচিত। আমি আপনাকে বিপদে ফেলার জন্যে বা বিভ্রান্ত করার জন্যে আসিনি। আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্যে এসেছি।
মনসুর সাহেব কথা বললেন না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলেন। এই মুহূর্তে একজন কাউকে তার প্রয়োজন যে নেত্রকোনা যাচ্ছে, বা নেত্রকোনা থেকে ফেরত আসছে।
কাকে যেন আসতে দেখা যাচ্ছে। বাঁধের উপর উঠে এল। সিগারেট বা বিড়ি টানছে। আগুনের ফুলকি উঠানামা করছে। মনসুর সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ফিবোনাক্কির গলাতেও আগ্রহ ঝরে পড়ল, স্যার কেউ একজন আসছে।
মনসুর সাহেব এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলেন। এই বয়সে উত্তেজনা ভালো না। তাছাড়া ডাক্তার বলে দিয়েছে তার প্রেসারের সমস্যা আছে নরম্যালের চেয়ে বেশি। প্রেসারের মানুষদের জন্যে উত্তেজনা-শুভ না।
সিগারেট টানতে টানতে যে আসছিল সে মনসুর সাহেবের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। সিগারেট ফেলে দিয়ে চুপ করে বসে মনসুর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। মনসুর সাহেব চিনতে পারলেন না। অন্ধকারে চেনার কথাও না। তার পুরানো ছাত্রদের কেউ হবে। মনসুর সাহেব বললেন, থাক থাক সালাম লাগবে না। বলেই বিরক্ত হলেন—এই বাক্যটা সব সময় সালাম শেষ হবার পর বলা হয়। কাজেই এটা অর্থহীন বাক্য।
স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। রোগা হয়ে গেছেন।
শরীর তেমন ভালো যাচ্ছে না।
কি স্যার।
চোখে সমস্যা, তারপর তোমার ইদানিং প্রেসারও সম্ভবত বেড়েছে। নরম্যালের চেয়ে বেশি।
খুব হাঁটাহাঁটি করবেন। প্রেসার আর ডায়াবেটিস এই দুইয়ের একটাই ওষুধ-হন্টন।
ফিবোনাক্কি হঠাৎ কথা বলল, ভাই আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আমার নাম ফিবোনাক্কি।
কি নাক্কি।
ফিবোনাক্কি। একটু অদ্ভুত নাম।
আপনি কে?
আমিও আপনার মতোই আপনার স্যারের ছাত্র।
ও।
ফিবোনাক্কি হাসতে হাসতে বলল, ছাত্রে ছাত্রে ধুল পরিমাণ। ছাত্রে ছাত্রে ধুল পরিমাণ, মানে কি?
কথার কথা বললাম। সব কথাকে গুরুত্ব দিতে নেই। ভাই আপনি এখন চলে যান। আমরা হাঁটা শুরু করি। স্যারের সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।
আপনার নামটা কি যেন বললেন–?
ফিবোনাক্কি।
আপনি কি বাঙালি।
এই মুহূর্তে ১০০ ভাগ বাঙালি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনও জানি। শুনবেন?
জি না।
শুনুন না। ভালো লাগবে–।
জ্বি না কবিতা শুনব না।
তাহলে আপনি আর আপনার স্যারকে আটকে রাখবেন না। ছেড়ে দিন। উনার সঙ্গে আমার ভয়াবহ ধরনের জরুরি কিছু কথা আছে।
মনসুর সাহেব নিঃশব্দে হাঁটছেন। ফিবোনাক্কি হাঁটছে তার পাশে পাশে। ফিবোনাক্কি বলল, স্যার আপনার পরীক্ষার ফলাফল তো মনে হয় পজেটিভ। আপনার ঐ ছাত্রতো আমাকে দেখতে পেল এবং কথাবার্তাও বলল।
হু।
এখন কি আপনি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন যে আমার একটা অস্তিত্ব আছে। আমি কল্পনার কেউ না।
মনসুর সাহেব কিছু বললেন না।
স্যার বাঁধের নিচে নৌকা বাঁধা আছে। খালি নৌকা। ঐখানে একটু বসবেন? জরুরি কথা দ্রুত সেরে ফেলতাম।
ঢালু বাঁধ। নামতে কষ্ট। ফিবোনাক্কি মনসুর সাহেবের হাত থেকে কাগজের প্যাকেট নিয়ে নিল। মনসুর সাহেবকে হাত ধরে সাবধানে নামাল।
দুজন চুপচাপ নৌকার গলুইয়ে মুখোমুখি বসে আছে। প্রথম কথা বললেন। মনসুর সাহেব বল কি বলবে?
স্যার আপনি খুব বড় একটা কাজ করছেন। কত বড় কাজ যে করছেন সেই সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
তুমি কে?
আমি এসেছি শূন্য জগত থেকে।
মনসুর সাহেব দীৰ্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। সবই কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কি বলল, আমার জগতটা কি আমি ব্যাখ্যা করব?
করতে পার।
আপনার ভেতর কোনো আগ্রহ দেখছি না। আপনি যদি কোনো আগ্রহ না দেখান তাহলে আমি কথা বলে আরাম পাব না।
আগ্রহ বোধ করছি না বলেই তুমি আগ্রহ দেখছ না।
আগ্রহ না দেখালেন-কি বলছি মন দিয়ে শুনুন।
শুনছি।
স্যার এই পৃথিবীর বস্তু জগৎ হচ্ছে ত্রিমাত্রিক। পৃথিবীর বস্তু জগতের প্রতিটি বস্তুর আছে তিনটি মাত্রা–দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। ঠিক না স্যার।
হ্যাঁ।
আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে সময় নিয়ে এসে, সময়কে একটা মাত্রা ধরে পৃথিবীর বস্তুজগতকে কেউ কেউ চার মাত্রার জগতও বলেন, তবে আমাদের বোঝার জন্যে পৃথিবীর জগতটাকে তিন মাত্রার জগত বলা চলে। ঠিক আছে স্যার?
হুঁ।
তিন মাত্রার জগতের মতো দুই মাত্রার জগততো হতে পারে। পারে না স্যার?
যে জগতে শুধু দৈৰ্ঘ্য আছে, প্রস্থ আছে। উচ্চতা বলে কিছু নেই।
থিওরিটেক্যালি থাকতে পারে।
দুই মাত্রার জগতের মতো একমাত্রার জগতও থাকতে পারে যে জগতের সব বস্তুর শুধু দৈৰ্ঘ্য আছে আর কিছু নেই। থাকতে পারে না স্যার?
হুঁ।
এখন তাহলে সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে চলে আসুন। শূন্য মাত্রার জগত। তো থাকতে পারে। যে জগতে কোনো মাত্রা নেই। মাত্রা নেই বলে মাত্রার বন্ধনও নেই। শূন্য মাত্রার জগত এবং অসীম মাত্রার জগত কি একই নয়?
মনসুর সাহেব তাকিয়ে আছেন।
ফিবোনাক্কি বলল, শূন্য এবং অসীম এই দুটি সংখ্যার ধর্ম এক রকম। যে কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে উত্তর হয় শূন্য। আবার যে কোনো সংখ্যাকে অসীম দিয়ে গুণ করলে উত্তর হয় অসীম। এখন স্যার আপনিই বলুন শূন্যকে অসীম দিয়ে গুণ করলে কি হবে?
মনসুর সাহেব ছোট্ট নিশ্বাস ফেললেন।
ফিবোনাক্কি বলল— আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। আপনার সমাধান মানব জাতির জন্যে বিরাট ব্যাপার হবে। এই সমাধানের জন্যে মানুষ শূন্যের প্রবেশ…
মনসুর সাহেব তার কথা থামিয়ে মেঘস্বরে ধমকে উঠলেন–স্টপ।
ফিবোনাক্কি থমতো খেয়ে চুপ করে গেল। মনসুর সাহেব বললেন, তুমি কোনো কথা বলবে না। তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা…এর বেশি কিছু না।
একটু আগেই কিন্তু তৃতীয় এক ব্যক্তি—আপনার ছাত্র আমাকে দেখতে পেরেছে। আমার সঙ্গে কথা বলেছে।
আমার ঐ ছাত্রও আমার মনের কল্পনা। তুমি যেমন আমার কল্পনা থেকে এসেছ—সেও এসেছে। সে যে আচরণ আমার সঙ্গে করেছে কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করবে না। আমাকে উপদেশ দিচ্ছে। বলছে হন্টন করবেন। হন্টন আবার কি?
সামান্য রসিকতাও আপনার ছাত্র আপনার সঙ্গে করতে পারবে না?
পারা উচিত কিন্তু পারে না। আমার বত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কোনো ছাত্র আমার সঙ্গে রসিকতা করেনি। তারচেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ঘুঘুটে অন্ধকারে আমার সঙ্গে তার দেখা। সে অন্ধকারে আমাকে চিনে ফেলল?
কেমন করে চিনল?
মনসুর সাহেব উঠে পড়লেন। ফিবোনাক্কি বলল, স্যার চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ চলে যাচ্ছি। আর শোন খবৰ্দার আমার পেছনে পেছনে আসবে না।
বাঁধে তুলে দেই। খাড়া বাঁধ। একা উঠতে পারবেন না।
খুব পারব। তুমি আসবে না। বললাম…
মনসুর সাহেব দেখলেন তারপরেও ফিবোনাক্কি তাঁকে অনুসরণ করছে। মনসুর সাহেব বাসার কাছাকাছি এসে আবারো কড়া করে ধমক দিলেন। ফিবোনাক্কি বলল, ঠিক আছে স্যার আমি চলে যাচ্ছি। তবে কাছাকাছিই থাকব। যদি প্রয়োজন হয়…
ফিবোনাক্কি ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। গেট খুলে কম্পাউন্ডের ভেতর মনসুর সাহেব বললেন-হরমুজ ফিরে এসেছে। একদিন থাকার কথা বলে দুদিন কাটিয়ে এসেছে। মেয়ের বাড়ি থেকে আসার পর প্রথম কয়েকদিন হরমুজের মেজাজ খুব ভালো থাকে। আজ তার মেজাজ অত্যন্ত ভালো। কথা বলার জন্যে সে ছটফট করছে, বলার লোক পাচ্ছে না।
মনসুর সাহেবকে দেখে তার আনন্দ তীব্র হল। সে গ্যারাজের বারান্দায় কেরোসিনের চুলায় ভাত চড়িয়েছে। ডাল ইতিমধ্যে নেমে গেছে। ইচ্ছা করলে কয়েক টুকরা বেগুন ভেঙ্গে ফেলা যায়। ঘরে বেগুন আছে। তবে না ভাজলেও ক্ষতি নেই–ডাল ভাত দিলেই স্যারের চলবে। বেগুন ভাজা দেখলে উনি বিরক্ত হতে পারেন।
হরমুজ একগাল হেসে বলল, স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
আপনারে নিয়া খুব চিন্তায় ছিলাম।
কেন?
আপনার খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থাকি খাইলেন, না খাইলেন।
কোনো অসুবিধা হয় নি। তোমার মেয়ে ভালো?
আপনের দোয়া স্যার। মেয়ে ভালো আছে। তবে স্যার শরীর দুর্বল। ডাক্তার ওষুধ একটা দিয়েছে সত্তুর টাকা দাম। চিন্তা করেন—নয় আঙ্গুলের এক বোল তার দাম সত্তুর টাকা।
মনসুর সাহেব প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বললেন, একটা কাজ করে দিতে পারবে হরমুজ।
অবশ্যই পারব।
গেটের বাইরে গিয়ে দেখতে কোনো ছেলে আছে কি-না।
কি ছেলে?
যুবক এক ছেলে। আমার কাগজগুলি ছিল তার হাতে। পাঁচ দিস্তা কাগজ।
হরমুজ তৎক্ষণাৎ বের হয়ে গেল। লোকটাকে সে পেল না।
কেউ ছিল না?
জ্বি না কেউ ছিল না।
ভালো করে দেখেছ?
খুব ভালো করে দেখেছি।
স্যার খানা হয়ে গেছে দিয়ে দেব?
না। খিদে নেই। আজ কিছু খাব না।
মনসুর সাহেব রাত নটা বাজার আগেই ঘুমুতে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত দুটায়। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের ক্ষীণ আলোয় সব কেমন ভৌতিক লাগছে। দীর্ঘকাল পর তার একটু ভয় ভয় করতে লাগল।
তিনি হারিকেন জ্বালালেন। ঘুম যখন ভেঙেছে তখন একটু কাজ করা যাক। ফাইলপত্র নিয়ে বসা যাক। অনেকদিন কিছু লেখা হয় নি। অবহেলা করা হচ্ছে। বয়স হচ্ছে—বয়সের প্রধান ধর্ম আলস্য। কাজ এড়ানোর অজুহাত খোজা। অথচ উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। অল্প বয়স্করা আলস্য দেখাতে পারে তাদের হাতে সময় আছে। তাঁর হাতে সময় কই? বৃদ্ধরা কাজ করবে যন্ত্রের মতো কোননাদিকে তারা তাকাবে না। কারণ তাদের ঘণ্টা বেজে গেছে। ঢং টং টং ঘণ্টা বেজেই যাচ্ছে। একদিন শেষ ঘণ্টা বাজবে তখন…
আচ্ছা শূন্য জগতের ব্যাপারগুলি কেমন? ফিবোনাকি কথাটা মন্দ বলে নিমাত্রাহীন জগত হল—অসীম মাত্রার জগত। তাঁর পিপাসা বোধ হচ্ছে। লেবুর সরবত খেয়ে ঘুমতে যান নি। পিপাসা হবারই কথা। চিনি লেবু কিছুই কেনা হয়নি। আজও ছোটবাজারে গিয়ে শুধু কাগজ কিনে ফিরেছেন।
তাঁর একজন এ্যাসিসটেন্ট থাকলে মন্দ হত না। হরমুজের মতো এ্যাসিসটেন্ট না—ফিবোনাক্কির মতো এ্যাসিসটেন্ট। যার সঙ্গে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। যে যুক্তি নির্ভর কথা বলবে প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজও করে দেবে। যেমন চট করে গ্লাস ভর্তি লেবুর সরবত নিয়ে এল। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখল।
ভালো কথা, তিনি যে পাঁচ দিস্তা কাগজ কিনেছিলেন—সেই কাগজতো রয়ে গেছে ফিবোনাক্কির কাছে। স্পষ্ট মনে আছে—দুজন নৌকোয় বসে কথা বলছেন। কাগজের প্যাকেটটা ফিবোনাক্কির হাতে। নৌকা থেকে তিনি রাগ করে উঠে এলেন। প্যাকেট নেয়া হল না। বাসার কাছাকাছি এসে ফিবোনাক্কিকে ধমকে বিয়ে করলেন। প্যাকেট ফেরত নিতে ভুলে গেলেন।
কাগজ ছাড়া তিনি হারিকেন জ্বালিয়ে করবেন কি? মনসুর সাহেব বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে দেয়ালের বাইরের খানিকটা অংশ দেখা যায়। ফিবোনাক্কি কি আছে সেখানে?
আচ্ছা তিনি হাস্যকর চিন্তা করছেন কেন? কল্পনার মানুষকেই বাস্তব মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথা খারাপ রোগ তাঁদের বংশে আছে। তাঁর দাদাজান চল্লিশ বছরে হঠাৎ একদিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন। রাতে ঘুমুচ্ছিলেন ঘুম ভেঙে স্ত্রীকে ডেকে তুলে বললেন, ওগো ওই। আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। আমার মাথায় পানি ঢাল। দাদিজান ভয়ে অস্থির হয়ে পানি আনতে গেলেন। দাদাজান বললেন—বউ শোন পানি আনতে যাবার আগে দড়ি এনে আমাকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখ, নয়ত দেখবে আমি ঝাপ দিয়ে দোতলা থেকে নিচে পড়ে গেছি। পাগল মানুষতো কিছুই বলা যায় না।
মনসুর সাহেবের দাদিজান দড়ি আনার আগে বালতি ভর্তি পানি এনে দেখেন মানুষটা বিছানায় নেই। ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েছে। তখনো জ্ঞান আছে। কথা বলতে পারছে। মৃত্যুর আগে মানুষটা বিড়বিড় করে বলল তোমার মনে কোনো কষ্ট রাখবে না। এটা আত্মহত্যা না। আমি আত্মহত্যার মানুষ না। মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে এই কাজ করেছি। মাথাটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। বড় আফসোস।
তার মাথাটাও কি হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে? তিনি নিশিরাতে বারান্দায় দাড়িয়ে ফিবোনাক্কি নামক কল্পনার এক যুবককে ভাবতে শুরু করেছেন।
মনসুর সাহেব ডাকলেন, ফিবোনাক্কি।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, জ্বি স্যার আমি আছি।
হ্যাঁ সে আছে তো বটেই। ঐতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাদের মরা আলোয় সুদর্শন এক তরুণ দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
আমার কাগজের প্যাকেটতো তোমার কাছে ছিল।
জ্বি!
কোথায় সেগুলি?
নষ্ট করে ফেলেছি।
নষ্ট করে ফেলেছি মানে?
আপনি আমার উপর রাগ করলেন। আমার মনটা হল খারাপ। আমি মন খারাপটা ঝাড়লাম কাগজের উপর।
তুমি কি করলে—এতগুলি কাগজ কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেললে?
জ্বি না। কাগজগুলি দিয়ে নৌকো বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।
কি বললে?
কাগজের নৌকা বানিয়ে নদীতে ভাসিয়েছি। অনেকগুলি নৌকা হয়েছে। দেখতে খুব ভালো লাগে। সকালে মর্নিং ওয়াক করার জন্যে যদি নদীর পাড়ে আসেন তাহলে দেখবেন। একটা নৌকাও নষ্ট হয়নি।
আচ্ছা।
নৌকাগুলি ছেড়েছিও আপনার প্রিয় রাশিমালা অনুযায়ী প্রথম ছাড়লাম একটা, তারপর একটা, তারপর একসঙ্গে দুটা। তারপর একসঙ্গে তিনটা, তারপর পাঁচটা।…
চুপ কর।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
সত্যি করে বলতে আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? মাথা খারাপের ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে আছে। আমার দাদাজানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আমি জানি।
তুমি জান?
আমি শূন্য জগতের একজন, সবকিছুই আমার জানা থাকার কথা। আপনার দাদাজানের হঠাৎ পাগল হয়ে যাবার ব্যাপারটা আমি জানি…একদিন তিনি ছাদে পাটি পেতে ঘুমুচ্ছিলেন—হঠাৎ তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ওগো ওঠ। আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে…
মনসুর সাহেব ফিবোনাক্কিতে থামিয়ে দিয়ে বললেন—তুমি এসব জান কারণ তুমি এসেছ আমার কল্পনা থেকে। সঙ্গত কারণেই আমি যা তুমি তাই জানবে।
আপনার দাদাজানও আপনার মতো অঙ্ক করতে ভালোবাসতেন। তাই না স্যার।
হুঁ।
তার ট্রাংক ভর্তি ছিল গুটি গুটি হাতে লেখা কাগজ।
হুঁ।
স্যার আপনি কি সেইসব দেখেছেন?
দেখেছি। বেশির ভাগই উইপোকায় কেটে ফেলেছিল।
অল্প যা রক্ষা পেয়েছিল আপনি তা আপনার ফাইলে যত্ন করে রেখেছেন।
আমি রাখিনি। আমার বাবা রেখেছিলেন। বাবার কাছ থেকেই আমি পেয়েছি।
আপনার বাবাওতো স্যার অঙ্কের ছাত্র ছিলেন?
হুঁ। কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে এম. এ ডিগ্রি নেন। গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন।
আপনারা তাহলে তিনপুরুষের গণিতজ্ঞ।
হুঁ।
অঙ্কে তো আপনারও এম. এ ডিগ্রি আছে। আপনি নিজেও তো কালি নারায়ণ স্কলার।
হুঁ।
ইউনিভার্সিটি বা কলেজে ইচ্ছা করলেই আপনি ভালো চাকরি পেতে পারতেন, তা না করে স্কুলে চাকরি নিলেন–কেন?
চট করে পেয়ে গেলাম। ঝামেলা কম, নিরিবিলি–।
আপনার বাবাও ঝামেলা পছন্দ করতেন না। নিরিবিলি কাজ করতে চাইতেন। তিনিও তো অতি অল্প বয়সে মারা গেছেন।
হু।
তাঁর মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু, না অস্বাভাবিক মৃত্যু?
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর কপালে ঘাম জমছে। শরীর কঁপছে। ফিবোনাক্কি বলল-স্যার একটা জটিল রাশিমালার সমাধান আপনারা তিন পুরুষ ধরে চেষ্টা করছেন। চতুর্থ পুরুষ বলে আপনাদের কিছু নেই। কিছু করার হলে আপনাকেই করতে হবে। যদি কিছু করতে না পারেন তাহলে আপনাতেই সব শেষ। স্যার আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
তুমি কেউ না। তুমি আমার অবচেতন মনের কল্পনা।
যদি কল্পনাও হয়ে থাকি তাতেও তো ক্ষতি নেই। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।
তুমি কী ভাবে সাহায্য করতে চাও?
আপনি অনেক রাশিমালা নিয়ে কাজ করছেন—একটি রাশিমালা আছে যার যোগফল শূন্য।
অনেকগুলি রাশিমালার যোগফলই শূন্য।
ফিবোনাক্কি রাশিমালার একটি আছে যার ফলাফল শূন্য।
মনে পড়ছে না।
খুঁজে বের করুন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনসুর সাহেব বললেন, তোমাদের শূন্য জগতটা কেমন?
অন্য রকম। সে জগতে সবই শূন্য। সেখানে আনন্দ, দুঃখ, বেদনা কিছুই নেই।
আনন্দ, দুঃখ, বেদনা নেই। শূন্য জগত তো ভয়াবহ জগত।
স্যার আপনি ভুলে যাচ্ছেন-শূন্যের সঙ্গে অসীম সম্পর্কিত। আনন্দ, দুঃখ, বেদনা যেমন শূন্য—তেমনি একই সঙ্গে অসীম। আপনি রহস্যের খুব কাছাকাছি আছেন। খুব কাছাকাছি। আপনি নিজেও তা জানেন। জানেন না?
হ্যাঁ জানি।
স্যার আপনি খুব কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। রহস্যের খুব কাছাকাছি এসে মানুষ ভেঙে পড়ে। আপনার দাদাজান ভেঙে পড়েছিলেন। আপনার বাবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে।
মনসুর সাহেবের শীত করতে লাগল। চৈত্র মাসের রাতে এরকম শীত লাগার কথা নয়।
স্যার আমি এসেছি আপনাকে সাহস এবং শক্তি জোগানোর জন্যে। তুমি আমার অবচেতন মনের ছায়া।
তাতে কোনো ক্ষতি নেই। আপনি কাজ শুরু করুন যে ভাবে বলছি সেই ভাবে…
থ্যাংক য়্যু।
স্যার আমি আপনাকে কি পরিমাণ ভালোবাসি তা আপনি জানেন না।
তুমি তো ভালোবাসবেই। তুমি আমারই অংশ।
সব সময় মানুষের নিজের অংশই যে মানুষকে ভালোবাসে তাতো নয়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে বেঁচে থাকে।
তোমাকে ধন্যবাদ। আচ্ছা শোন–আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
আমি যে জগতে বাস করি সে জগতে স্বপ্ন ও বাস্তবের কোনো সীমারেখা নেই। স্বপ্ন যা বাস্তবও তা।
ফিবোনাক্কি!
জ্বি স্যার। তুমি কি চা বানাতে পার?
কেন বলুনতো?
তাহলে চা বানাতে বলতাম। চা খেয়ে অঙ্ক শুরু করতাম।
ফিবোনাক্কি হেসে ফেলল।
হাসছ কেন?
এমি হাসছি স্যার। আপনি চা খেতে পারবেন না। ঘরে চিনি নেই। আপনি চিনি ছাড়া চা খেতে পারেন না। তাছাড়া রাত প্রায় শেষ হতে চলল—কিছুটা হলেও বিশ্রাম আপনার দরকার।
শুয়ে পড়তে বলছ?
হ্যাঁ।
একটা কথা ফিবোনাক্কি, শূন্য জগতে মানুষের আয়ু কি? মানুষ সে জগতে কতদিন বাঁচে?
সেই জগতে মানুষের আয়ু একই সঙ্গে শূন্য এই সঙ্গে অসীম?
বুঝতে পারছি না।
সেটা হচ্ছে অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতার জগত।
বুঝতে পারছি না।
স্যার আপনি বিশ্রাম করুন। ঘুমুতে যান।
আমার ঘুমুতে ভয় লাগছে।
কেন?
হঠাৎ হয়তো ঘুম ভেঙে আমার দাদাজানের মতো…
উনার সমস্যা আপনার হবে না।
কেন?
উনার পাশে সেই দুঃসময়ে কেউ ছিল না। আপনার পাশে আমি আছি।
তুমি কি সত্যি সত্যি আমার কল্পনা, নাকি তুমি শূন্যের জগত থেকে উড়ে এসেছ?
আমি আপনার কল্পনা কিন্তু আমার বাস শূন্য জগতে।
কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারবেন। খুব শিগগিরই বুঝতে পারবেন। আপনার কাজ শেষ করুন।
কাগজ তো নেই। কীভাবে কাজ করব?
মনসুর সাহেব ঘরে ফিরে এলেন। হারিকেন নিভিয়ে বিছানায় গেলেন। ভয়াবহ ক্লান্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আকাশে মরা চাদ, সেই আলো এসে পড়েছে তাঁর বিছানার এক অংশে।
শূন্য জগতে কি চন্দ্ৰলোক আছে? সেই জগতে কি জোছনার ফুল ফুটে। পাখি গান গায়?
Everything was once created from nothing.
শূন্য থেকে সব সৃষ্টি হয়েছে। শূন্যতেই সব ফিরে যাবে।
মনসুর সাহেবের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। ভোতা যন্ত্ৰণা। মানুষের প্রধান অংশ কি?
মানুষের প্রধান অংশ তার চেতনা। এই চেতনাকে ধারণ করছে শরীর। শরীরকে বাদ দিয়ে চেতনার যে অস্তিত্ব সেই অস্তিত্বের জগতই কি শূন্যের জগত, না-কি এর বাইরেও কিছু।
খাটের নিচে ইদুর খচখচ করছে। এই অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর চেতনা কি আদি চেতনারই অংশ? বিরাট এক রাশিমালা? যে রাশিমালার যোগফল শূন্য।
শরীরে এত ক্লান্তি অথচ ঘুম আসছে না। ঘুম আনতে হলে কি করতে হয় মেষ গুণতে হয়।
মনসুর সাহেব মেষের বিশাল পাল কল্পনা করতে লাগলেন। একটি মেষ আসছে। আবার একটি। এখন একটির সঙ্গে আসছে দুটি। এইবার তিনটি…মেষ পাল আসছে ফিবোনাক্কি রাশিমালায়–
১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩…
আচ্ছা এখন এই মেষের পালে কয়েকটা নেকড়ে ঢুকিয়ে দেয়া যাক। নেকড়েগুলি মেষ খেতে শুরু করবে। ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটবে যে মেষ এবং নেকড়ের সংখ্যা শুরুতে সমান থাকলেও সময়ের সঙ্গে কমতে শুরু করবে। নেকড়ে যেমন মেঘ মারবে তেমনি মেষরা নেকড়ে মারবে…কাজেই নেকড়ের জন্যে একটি রাশিমালা প্রয়োজন…
মনসুর সাহেব উঠে বসলেন পাওয়া যাচ্ছে। কিছু একটা পাওয়া যাচ্ছে। কাগজ ঘরে নেই। কাগজের খুব প্রয়োজন ছিল।
ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি
বদরুল চোখ বড় বড় করে বলল, আবার কাগজ?
মনসুর সাহেব বললেন, হ্যাঁ।
মনসুর সাহেবের চোখ লাল। চুল উস্কুখুম্বু। গায়ে জ্বর আছে। আজ তিনি ক্লাসেও যাননি।
কাগজ কতগুলো দেব? পাঁচ দিস্তা?
না। দশ দিস্তা।
গতকালই তো স্যার পাঁচ দিস্তা কাগজ নিয়ে গেছেন। শেষ হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
এক রাতে অঙ্ক করে ভরিয়ে ফেলেছেন?
না। অন্য কাজে…
বদরুল কৌতূহল চাপতে পারল না। আগ্রহ নিয়ে বলল, পাঁচ দিস্তা কাগজ দিয়ে কি করেছেন?
নৌকা বানালাম। নৌকা বানালেন?
কাগজের নৌকা?
হুঁ।
সেই নৌকা দিয়ে কি করলেন স্যার?
মনসুর সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন—নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি।
বদরুলের মুখ হা হয়ে গেল। সে গলার বিস্ময় চাপা দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বলল—মগরা নদীতে সব কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছেন?
হুঁ।
খুব ভালো করেছেন। পুলাপানরা কাগজের নৌকা ভাসাবে, আমরা ভাসাব না তা হয় না। বসেন স্যার চা খান।
না চা খাব না। শরীর ভালো না।
চা না খেলেও একটু বসুন। আপনার মতো জ্ঞানী লোকের পাশে কিছুক্ষণ থাকলেও গায়ে জ্ঞানের বাতাস লাগবে। প্লিজ স্যার চেয়ারটায় বসুন।
মনসুর সাহেব কথা বাড়ালেন না। বসলেন।
আপনি হলেন স্যার জ্ঞান-সমুদ্র। ছোটখাটো জ্ঞানী প্রায়ই দেখা যায় জ্ঞান-চৌবাচ্চা, জ্ঞান-ডোবা, জ্ঞান-পুকুর। কিন্তু জ্ঞান-সমুদ্র কখনো দেখা যায়। না। আপনি যে এসে বসে থাকেন এত ভালো লাগে।
মনসুর সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা ভালো রসিকতা করছে। সে সবার সঙ্গেই রসিকতা করে না শুধু তার সঙ্গেই করছে।
বদরুল চোখ বড় বড় করে বলল, আমি স্যার একটা কাজ করব। আপনার কিছু পায়ের ধুলা ডেনোর একটা টিনে ভয়ে রাখব। জীবনের একটা সঞ্চয় হয়ে থাকবে। লোকজনদের বলতে পারব হায়াৎ মউতের কথাতো বলা যায় না। হঠাৎ একদিন মরে গেলেন তখন ধুলা পাব কোথায়?
আমি আজ উঠি বদরুল?
জ্বি আচ্ছা।
মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–রসিকতা আমি করতে পারি না। সবাই সব জিনিস পারে না। রসিকতা করার বিদ্যা আমার অনায়ত্ত। তুমি করতে পার। তোমার রসিকতা শুনতে ভালো লাগে। তোমার রসিকতা শোনার ললাভেই মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে থাকি।
বদরুল হা করে তাকিয়ে রইল। মনসুর সাহেব বললেন—তোমাকে দেখি আর ভাবি প্রকৃতি মানুষকে কত বিচিত্র ক্ষমতা দিয়েই না পাঠিয়েছেন। রসিকতা করতে হলে তীক্ষ্ণবুদ্ধির প্রয়োজন। তুমি নির্বোধ। তারপরেও তুমি অসাধারণ সব রসিকতা কর। তোমাকে এই ক্ষমতা দিয়ে প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের একটা জিনিস বুঝিয়ে দেন—তা হচ্ছেদেখ আমাকে দেখ। দেখ কি করতে পারি। বদরুল যাই। শরীরটা ভালো লাগছে না। নয়ত আরো কিছুক্ষণ বসতাম।
তিনি সরাসরি বাসার দিকে রওনা হলেন। স্কুলে গেলেন। তাঁর পকেটে একটা দরখাস্ত সেখানে লিখলেন
…আমার শরীর খুবই অসুস্থ। স্কুলের দায়িত্ব পালনে বর্তমানে অক্ষম। আমার অতি জরুরি কিছু ব্যক্তিগত কাজও শেষ করা প্রয়োজন। কাজেই আমি আর স্কুলে আসব না বলে স্থির করেছি। অবসর গ্রহণের আগেই আমি অবসর প্রার্থনা করছি।…
হেডমাস্টার সাহেব স্কুলে ছিলেন না। ফুড ফর ওয়ার্ক প্রগ্রামে সরকার গম দিচ্ছে তিনি সেই গমের ব্যাপারে সিও সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই। মনসুর সাহেব হেডস্যারের টেবিলে দরখাস্ত রেখে বাসার দিকে রওনা হলেন। তাঁর গায়ের তাপ আরো বেড়েছে, তিনি ঠিকমতো পা ফেলতেও পারছেন না। তাঁর মনে হল প্রকৃতির একটা নিষ্ঠুর দিক আছে। এই নিষ্ঠুরতা তিনি মানুষের ক্ষেত্রেই সবচে বেশি প্রয়োগ করেন। বয়সের সঙ্গে মানুষের জ্ঞান বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, বিচক্ষণতা বাড়ে, যুক্তি বাড়ে কিন্তু এই সবের সমন্বয় করে কাজ করার যে ক্ষমতা তা কমতে থাকে। পরিপূর্ণ মাত্রায় সব দেয়ার শেষে হঠাৎ একদিন তিনি একসঙ্গে সব কেড়ে নেন।
হরমুজ বলল, স্যার আপনের কি হইছে?
শরীর ভালো না জ্বর আসছে। আর কিছু না। দুপুরে আমি কিছু খাব না। উপাষ দিব।
ডাক্তার আনি।
না ডাক্তার লাগবে না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।
আপনার শরীরের এই অবস্থা আমি ব্যস্ত হব না। এটা স্যার কি বলেন।
তুমি ভালো করে আমাকে লেবুর সরবত দাও। আর কিছু লাগবে না।
লেবুর সরবত বানিয়ে এনে হরমুজ মনসুর সাহেবের গায়ে হাত রেখে প্রায় কেঁদে ফেলল। জ্বরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে। সে ভীত গলায় বলল, এত জটিল অবস্থা।
মনসুর সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, অবস্থা মোটেই জটিল না। অবস্থা সহজ। তুমি এখন আমার সামনে থেকে যাও আমি কাজ করব।
এই শরীরে কি কাজ করবেন।
কাজ শুরু করলে শরীরের কথা মনে থাকবে না।
আপনার পায়ে ধরি স্যার আপনি বিশ্রাম করেন।
হরমুজ সত্যি সত্যি পা ধরতে এগিয়ে এল। মনসুর সাহেব ধমক দিয়ে তাকে বিয়ে করে সত্যি সত্যি কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। পুরানো সব ফাইল বের করলেন। সব হাতের কাছে থাকুক। একটা ভালো ক্যালকুলেটর থাকলে খুব উপকার হত। হিসেবগুলি দ্রুত করা যেত। আজিজ বেপারিকে বললে সে এনে দেবে। এই লোক তাকে পছন্দ করে। খুবই পছন্দ করে। এই জীবনে তিনি তেমন কিছু পান নি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। হরমুজের কথা ধরা যাক। তাকে অসুস্থ দেখে সে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। হেডমাস্টার সাহেবের কথাই ধরা যাক। তিনি অসুস্থ শুনলে দ্রলোক স্কুল ছুটি দিয়ে সব ছাত্র নিয়ে চলে আসবেন। ডাক্তার বজলুর রহমান…এমনকি বদরুল…
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণা। একটু আগে লেবুর সরবত খেয়েছেন এখন আবার পিপাসা বোধ করছেন। শরীরও কাঁপছে। ঘরে থার্মোমিটার থাকলেও জ্বর মাপা যেত। ঘরে কোনো থার্মোমিটার নেই।
মনসুর সাহেব উবু হয়ে বসেছেন—বসার ভঙ্গির জন্যেই কি লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বুকে হাঁপ ধরছে। ধরুক। ঘরে আলো কমে আসছে। আকাশে কি মেঘ আছে। চৈত্র মাসে এসব কি শুরু হল দুদিন পর পর বৃষ্টি—মনসুর সাহেব অঙ্কের পাশাপাশি লিখলেন–
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান।
স্যার কেমন আছেন?
মনসুর সাহেব মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন–ফিবোনাক্কি। দিনের বেলা এই প্রথম তাঁর দেখা পাওয়া। বাহ সুন্দর চেহারাতে। এত সুন্দর চোখ। যে কোনো সুন্দর জিনিস দেখামাত্র হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছা করে, শুরু চোখ ঠুতে ইচ্ছে করে না। ফিবোনাক্কি আবার বলল, কেমন আছেন স্যার?
ভালো।
কাজতো অনেকদূর করেছেন।
চেষ্টা করছি।
ঐ দুটা লাইন কি স্যার কবিতা?
হুঁ।
হঠাৎ কবিতা লিখলেন যে?
বুঝতে পারছি না।
আমার মনে হয় আপনার এখন বিশ্রাম করা উচিত। শুয়ে থাকুন।
শুয়েই তো আছি।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন।
অল্প কিছু বাকি আছে ঐটা শেষ হলেই…
মনসুর সাহেব কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন। ফিবোনাক্কি বলল আমাকে কিছু কাগজ দেবেন স্যার।
কি করবে?
নৌকা বানাব। কাগজের নৌকা। ঐদিন নৌকা বানিয়ে খুব আরাম পেয়েছি। আপনি কি স্যার মগরা নদীতে আমার ভাসানো কাগজের নৌকা দেখেছেন?
না।
সবগুলি নৌকা যখন চলছিল দেখতে খুব মজা লাগছিল।
তোমার কথায় আমার কাজের অসুবিধা হচ্ছে।
তাহলে স্যার আর কথা বলব না। আমি যদি নিঃশব্দে নৌকা বানিয়ে যাই তাহলে কি কাজের অসুবিধা হবে?
না।
স্যার ঘরে কি মোম আছে।
কেন?
নৌকা পানিতে ভাসালে সমস্যা যা হয় তা হল কাগজ ভিজে যায়। কাগজ ভিজে নৌকা পানিতে তলিয়ে যায়। আমি ভাবছি মোম গলিয়ে নৌকার পেছনে লাগিয়ে দেব। তাহলে নৌকা আর ডুববে না।
ঘরে মোম নেই।
হরমুজকে দিয়ে আনানো যায় না?
ফিবোনাক্কি তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
নৌকার নিচটায় মোমতো মাখিয়ে দিলে নৌকা ভারি হবে বাতাসে সহজে দুলবে না।
তুমি অকারণ কথা বলছ ফিবোনাক্কি—আমার চিন্তায় অসুবিধা হচ্ছে।
আমি খুব দুঃখিত—স্যার পাই সংখ্যাটির রহস্যময়তা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? পাই হল বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাত। আপাত দৃষ্টিতে কত সহজ একটা ব্যাপার। আপনার রাশিমালায় এই পাই নিয়ে আসা যায় না…
তুমি আমাকে আমার মতো কাজ করতে দাও।
আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
আমার কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
স্যার খুব ভুল কথা বলছেন—একা একা আগানো যায় না। আগাতে হলে সাহায্য লাগে…
সবার লাগে না। গণিতজ্ঞ এবেলিয়ানের লাগেনি, রামানুজনের লাগেনি, আমার দাদাজানের লাগেনি…
আপনার দাদাজানকে এঁদের সঙ্গে তুলনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে?
হ্যাঁ ঠিক হচ্ছে। তিনি মহান গণিতজ্ঞ ছিলেন তার প্রতিভা বাইরের কেউ জানতে পারেনি।
ফিবোনাক্কি হাসছে। শব্দ করে হাসছে। মনসুর সাহেব বললেন, হাস কেন?
হাসছি কারণ গণিতজ্ঞরা দুর্ভাগা। বেশির ভাগ গণিতজ্ঞের প্রতিভা অজ্ঞাত থেকে গেছে। সেই তুলনায় নিম্নমানের প্রতিভা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
যেমন?
যেমন ধরুন গানের প্রতিভা। একজনের সুন্দর গানের গলা—তার প্রতিভা কখনোই চাপা থাকবে নাসে গান গাইবে। কেউ তা শুনবে। তারা অন্যদের জানাবে প্রতিভার খবর ছড়াবে জিওমেট্রিক্যাল প্রসেনের নিয়মে কিন্তু আপনাদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন। আপনারা কাজ করবেন সেই কাজ ফাইলবন্দি পড়ে থাকবে। এক সময় ফাইল যাবে হারিয়ে।
তুমি আমাকে বিরক্ত করছ ফিবোনাক্কি। তোমার জন্যে আমি কাজ করতে পারছি না।
আর বিরক্ত করব না কাজ করুন। আপনার মাথার যন্ত্রণার অবস্থা কি? এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ।
খুব বেশি?
হ্যাঁ।
হরমুজকে বলুন যন্ত্রণার কোনো ওষুধ নিয়ে আসতে।
তুমি আমাকে খুব বিরক্ত করছ।
আপনার কষ্ট দেখে খারাপ লাগছে বলেই করছি। আর করব না।
মনসুর সাহেব লিখে যাচ্ছেন। তাঁর চোখ আবার সমস্যা করছে—পানি পড়ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় দেখতে অসুবিধা হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভালো হত। একবার ঘুমুতে গেলে সেই ঘুম আর ভাঙবে না। ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে না-কি?
ফিবোনাক্কি।
জ্বি স্যার।
বৃষ্টি হচ্ছে না-কি।
হচ্ছে স্যার। এই জন্যেইতো নৌকা বানিয়ে এত আরাম পাচ্ছি।
ফিবোনাক্কি নৌকা বানাচ্ছে। একটা দুটা না অসংখ্য। দ্রুত বানিয়ে যাচ্ছে। সে ঘর ভর্তি করে ফেলছে কাগজের নৌকায়।
ফিবোনাক্কি গুন গুন করে গাইছে
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
একই লাইন বার বার, বার বার। গান শুনতে শুনতেই মনসুর সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন।
হরমুজ হেডমাস্টার সাহেবকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। হেডমাস্টার সাহেব সত্যি সত্যি স্কুল ছুটি দিয়ে এসেছেন। এসেছেন আজিজ খা, বদরুল।
মনসুর সাহেব চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মুখের কষ বেয়ে রক্তের ক্ষীণ ধারা। বুক ওঠা নামা করছে। প্রাণ এখনো আছে। কতক্ষণ থাকবে সেটাই কথা।
ঘরময় কাগজ ছড়ানো—লেখা কাগজ, ভেঁড়া কাগজ, আর অসংখ্য কাগজের নৌকা।
আজিজ খাঁ বললেন, এসব কি? কাগজের নৌকা।
বদরুল বলল, স্যারের মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল—আমার কাছ থেকে কাগজ নিতেন—নৌকা বানিয়ে নদীতে ছাড়তেন।
আজিজ খাঁ হুংকার দিয়ে বললেন, আগে বলনি কেন? কেন আগে বলনি?
বদরুল কাঁদছে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ পানি পড়ছে। হরমুজ কাদোকাদো গলায় বলল, এই কাগজগুলাই স্যারের সর্বনাশ করেছে। স্যার দিন রাত লেখতেন-লেখতে লেখতে…
হেডমাস্টার সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন—সব কাগজ নিয়ে আগুন দিয়ে। পুড়িয়ে ফেল। সব কাগজ। একটাও যেন না থাকে। হারামজাদা কাগজ।
অচেতন অবস্থাতেও মনসুর সাহেব কথা বলার চেষ্টা করলেননা না। বলতে পারলেন না—শুধু তাঁর ঠোট কাপল।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন—এক্ষুণি উনাকে ঢাকায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা। করতে হবে। এক সেকেন্ডও দেরি করা যাবে না—আশ্চর্য কেউ একজন বললও না লোকটার এই অবস্থা? আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে… বলতে বলতে হেডমাস্টার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
আজিজ খা গাড়ি নিয়ে এসেছেন। গাড়ি সরাসরি ঢাকা যাবে। হরমুজ সব কাগজ আগুনে দিয়েছে। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে
হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কিছুক্ষণের জন্যে মনসুর সাহেবের জ্ঞান ফিরল। অপরিচিত ঠাণ্ডা ঘর। শরীরে নানা যন্ত্রপাতি লাগানো। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। কয়েকজন ডাক্তার এবং নার্স উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। মনসুর সাহেব ব্যস্ত হয়ে খুঁজলেন ফিবোনাক্কিকে। ঐ তো ফিবোনাক্কি। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু ঠোট ফাঁক করার ক্ষমতা তার নেই কথাতো অনেক দূরের ব্যাপার। তিনি মনে মনে ডাকলেন—ফিবোনাক্কি।
ফিবোনাক্কি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, জি স্যার।
ওরা আমার সমস্ত কাগজপত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে।
স্যার আমি জানি।
তুমি কি খুশি হয়েছ ফিবোনাক্কি?
ফিবোনাক্কি জবাব দিল না। মনসুর সাহেব বললেন–আমি তোমাকে আমার কল্পনার একটি অংশ ভেবে ভুল করেছিলাম। তুমি আমার কল্পনার অংশ নও। তুমি আসলেই শূন্য জগতের কেউ।
স্যার আপনি ঠিকই ধরেছেন।
তোমাকে পাঠানো হয়েছিল আমার কাজ নষ্ট করে দেয়ার জন্যে।
জ্বি স্যার।
যখন বুঝতে পারলাম তখন আর করার কিছু নেই। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাচ্ছি তাই না ফিবোনাক্কি।
স্যার আমার তাই ধারণা।
মৃত্যু কেমন ফিবোনাক্কি?
মৃত্যু কেমন আমি বলতে পারছি না স্যার। আমাদের জগতে মৃত্যু নেই। আমরা বাস করি মৃত্যুহীন জগতে।
ও।
আমরা যদি আমাদের জগতটাকে সুরক্ষিত রাখতে চাই সেটা কি অন্যায়?
না অন্যায় নয়।
পৃথিবীর মানুষরা আমাদের জগতে ঢুকে পড়তে চাচ্ছে। তারা শূন্যের রহস্য একবার ধরে ফেললে আমাদের কি হবে? আমরা থাকতে চাই আমাদের মতো। সেখানে কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। আমরা কিছুতেই এ রহস্য ভেদ করতে দেব না। যারাই এই চেষ্টা করবে তাদেরই আমরা দূরে সরিয়ে দেব। তাদের কাজ নষ্ট করে দেব।
আমি এখন তোমাদের রহস্য জানি। আমিতো সমাধান করেছি।
স্যার আমি জানি। এই জন্যেইতো আপনার কাজ পুড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে।
আমাতেই তো সব শেষ হচ্ছে না। আবারো একজন আসবেন।
আমরা লক্ষ রাখি। কিছুই আমাদের লক্ষের বাইরে নয়।
মনসুর সাহেবের ঘুম পাচ্ছে। চোখ আর মেলে রাখতে পারলেন না। মনে হচ্ছে। এটাই শেষ ঘুম। ফিবোনাক্কি বলল-স্যার শুনুন। তিনি বললেন, শুনছি।
আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আমি যা করেছি আমার জগতের দিকে তাকিয়ে করেছি। আপনিও নিশ্চয়ই আপনার পৃথিবী, আপনার প্রিয় জগৎ রক্ষার জন্যে যা করণীয় তা করবেন। করবেন না স্যার?
হ্যাঁ করব।
স্যার আমি কি কিছু করতে পারি আপনার জন্যে।
আমার সময় শেষ—এই শেষ সময়ে তুমি কি করবে?
আপনার মস্তিষ্কে অনেক সুখ স্মৃতি আছে। তার একটি দেখতে দেখতে যেন আপনার জীবনের ইতি হয় সেই ব্যবস্থা করব।
তার প্রয়োজন নেই ফিবোনাক্কি।
আপনার জন্যে কিছু একটা করতে ইচ্ছা হচ্ছে স্যার। আমাকে দয়া করে অনুমতি দিন আপনার মস্তিষ্কের অতি গোপন একটা জায়গা থেকে মিষ্টি একটা স্মৃতি আমি বের করে আনি—আপনার ভালো লাগবে। আপনার খুব ভালো লাগবে।…
মনসুর সাহেব কিছু বলার আগেই ঝমঝুম শব্দ শুনতে পেলেন। বৃষ্টির শব্দ। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে। তিনি দেখলেন তিনি তাদের গ্রামের বাড়িতে শোবার ঘরে আধাশোয়া হয়ে আছেন। হাতে একটা বই। গভীর রাত। পাশের টেবিলে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় তিনি বৃষ্টির রাতে বই পড়ছেন দরজা ঠেলে কে ঢুকছে? আরে রূপা না! হাঁ রূপা। তাঁর কিশোরী বধূ। আহা কতদিন পর দেখলেন রূপাকে। এত সুন্দর মেয়ে। এত মিষ্টি চেহারা। রূপা বলল—এই বৃষ্টি হচ্ছে! বৃষ্টিতে ভিজবে?
না না-পাগল হয়েছ দুপুর রাতে বৃষ্টিতে ভিজব কি? তোমার কি সব পাগলামি।
রূপা মন খারাপ করে বসে আছে। তার চোখ ভিজে উঠেছে। ফিবোনাক্কি এই স্মৃতি কেন দেখাল। এই স্মৃতি তাঁর জীবনের দুঃখময় স্মৃতির একটি। তিনি সে রাতে স্ত্রীর সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে যাননি। এইসব ছেলেমানুষি তার চরিত্রে ছিল না।
তিনি দেখছেন অভিমানে রূপার চোখ ভিজিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তখন তিনি বই ফেলে দিয়ে বললেন—চল যাই ভিজি। রূপা আনন্দে হেসে ফেলল।
ঘটনা এ রকম ঘটে নি। তিনি রূপাকে অগ্রাহ্য করে সে রাতে বই পড়েছেন—এখানে ঘটনা বদলে যাচ্ছে। ফিবোনাক্কি তাঁর স্মৃতি পাল্টে দিচ্ছে
তিনি দেখছেন–রূপাকে নিয়ে উঠোনে নেমে গেছেন। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রূপা হাসছে খিলখিল করে…আহ কী সুন্দর স্মৃতিকী মধুর স্মৃতি। ফিবোনাক্কি চমক্কার একটি স্মৃতি তৈরি করে তাঁকে উপহার দিচ্ছে। তিনি গাঢ় স্বরে বললেন—ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি। ধন্যবাদ।
রূপার হাত ধরে তিনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। এক একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় দেখছেন জলভেজা আশ্চর্য মায়াবী এক মুখ…তিনি আবারো বললেন—ধন্যবাদ ফিবোনাক্কি।