- বইয়ের নামঃ যন্ত্র
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
সাইড এফেক্ট
তিনি নরম গলায় বললেন, ভাই এর কোন সাইড এফেক্ট নেই তো?
সেলসম্যান জবাব দিল না, বিরক্ত চোখে তাকাল। তিনি আবার বললেন, তাই এই যন্ত্রটার কোন সাইড এফেক্ট নেই তো? সেলসম্যানের বিরক্তি চোখ থেকে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ভ্রূ কুঁচকে গেল, নিচের ঠোঁট টানটান হয়ে গেল। সে শুকনো গলায় বলল, সাইড এফেক্ট বলতে আপনি কী বুঝাচ্ছেন?
মানে নেশা ধরে যায় কি না। শুনেছি একবার ব্যবহার শুরু করলে নেশা ধরে যায়। রাতদিন যন্ত্র লাগিয়ে বসে থাকে…।
আপনার যদি সন্দেহ থাকে তাহলে কিনবেন না। আপনাকে কিনতে হবে। এমন তো কোন কথা নেই।
তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। এতগুলি টাকা দিয়ে যন্ত্রটা কিনবেন অথচ লোকটা তার প্রশ্নের জবাব পর্যন্ত দিতে চাচ্ছে না। এমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে যেন তিনি..
আপনি কি যন্ত্রটা কিনবেন না দাঁড়িয়ে থাকবেন?
তিনি পকেট থেকে চেক বই বের করলেন। খসখস করে টাকার অংক বসালেন। হাতের লেখাটা ভাল হল না। কারণ এত বড় অংকের চেক তিনি এর আগে কাটেননি। মাত্র আটশ গ্রাম ওজনের কালো চৌকোণা একটা বক্স। অথচ কী অসম্ভব দাম! টাকার অংক লিখতে গিয়ে হাত কেঁপে যাচ্ছে।
সেলসম্যান বলল, আপনার কোন ক্রেডিট কার্ড নেই?
জ্বি না।
আপনাকে তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আপনার ব্যাংক একাউন্ট চেক করব। কম্পিউটারটা ট্রাবল দিচ্ছে—একটু সময় লাগবে। আপনি ইচ্ছা করলে পাশের রুমে বসতে পারেন।
আমি বরং এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। অবশ্য আপনার যদি কোন অসুবিধা না হয়।
সেলসম্যান জবাব দিল না। তার কাছে মনে হল সেলসম্যানের মুখের বিরক্ত ভাব একটু যেন কমেছে। কমাই উচিত—তিনি তো শেষ পর্যন্ত যন্ত্রটা কিনেছেন। তার পঞ্চাশ বছরের জীবনের সঞ্চিত অর্থের সবটাই চলে গেছে। এর পরেও কি লোকটা তাঁর সঙ্গে সহজভাবে দু একটা কথা বলবে না? তিনি বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত আবার বললেন, ভাই এর কোন সাইড এফেক্ট নেই তো?
এবার জবাব পাওয়া গেল। সেলসম্যান রোবটদের মত ধাতব গলায় বলল, না নেই।
নেশা হয় না।
না, হয় না। তবে আপনি ইচ্ছা করে যদি নেশা ধরান তাহলে তো করার কিছু নেই। যন্ত্রটির সঙ্গে ইনস্ট্রাকশান ম্যানুয়েল আছে। ম্যানুয়েল মেনে যদি ব্যবহার করেন তাহলে কোন অসুবিধা হবে না। প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করবেন না। সপ্তাহে অন্তত একদিন যন্ত্রটায় হাত দেবেন না।
তিনি এবার আনন্দের একটা নিশ্বাস ফেললেন। লোকটি শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলছে। তিনি হাসিমুখে বললেন, যন্ত্রটা নিয়ে নানান কথাবার্তা হয় তো। তাই…
আমাদের স্বভাবই হচ্ছে নতুন আবিষ্কার নিয়ে কথা বলা। পি থার্টি টু হচ্ছে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। এই বিষয়ে কি আপনার কোন সন্দেহ আছে?
জ্বি না।
তাহলে ভয় পাচ্ছেন কেন?
ভয় পাচ্ছি না তো।
পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। আরো আধ ঘণ্টার মতো লাগবে।
জ্বি আচ্ছা।
একটা জিনিস শুধু মনে রাখবেন, এই শতাব্দীর সবচে বড় আবিষ্কার পি থার্টি টু। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার যেমন টেলিভিশন। আপনি কি আমার সঙ্গে একমত?
জ্বি একমত।
তিনি মোটেই একমত না। বিংশ শতাব্দীর টেলিভিশন ছাড়াও আরো অনেক বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে। এই শতাব্দীতে দশটি বড় বড় আবিষ্কার হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচে বড় আবিষ্কার হচ্ছে ডেথ হরমোন। ডাক্তার পিটার স্লীম্যান প্রমাণ করেছেন, একটা নির্দিষ্ট বয়সে পিটুইটারি গ্র্যান্ড থেকে ডেথ হরমোন শরীরে চলে আসে। শরীর তখন মৃত্যুর জন্যে নিজেকে তৈরি করে। শুরু হয় বার্ধক্য প্রক্রিয়া। যে হারে জীবকোষ মরে যায় সেই হারে তৈরি হয় না। জরা শরীরকে গ্রাস করে। ডাক্তার পিটার শ্লীম্যান দেখালেন, সালফার এবং অক্সিজেন ঘটিত একটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ যৌগ অণু এই কাজটি করে। তিনি যৌগটি শরীর থেকে বের করে দেবার প্রক্রিয়াও বের করলেন। এই অসম্ভব ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া ব্যবহার করে পৃথিবীর কিছু ভাগ্যবান মানুষ তাদের শরীর থেকে ডেথ হরমোন বের করে দিয়েছে। জরা আর তাদের স্পর্শ করতে পারছে। না।
তিনি পাশের ঘরে চুপচাপ বসে আছেন। এই ঘরে একটি কফি ডিসপেনসিং রোবট আছে। সে তাকে এক পেয়ালা কফি দিয়ে হাসিমুখে বলেছে, আশা করি এক পেয়ালা উষ্ণ কফি আপনার হৃদয়ের শৈত্য দূর করে দেবে।
তিনি রোবটের কথার কোন জবাব দিলেন না। এদের তৈরিই করা হয় বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে মানুষকে চমকৃত করার জন্য। এদের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেই মানুষ হিসাবে নিজেকে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে হয়। তিনি সামনের গোল টেবিলের উপর রাখা চকচকে কিছু ম্যাগাজিন থেকে একটি তুলে নিলেন। পাতা উল্টিয়ে তাঁর মুখ বিকৃত হল। ভুল ম্যাগাজিন বেছে নিয়েছেন—জেনো-কোড নিউজ। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে রগরগে সব খবরে ভর্তি। এইসব খবরের কোনটির প্রতিই তার কোন আগ্রহ নেই। প্রাণীর জিনের সঙ্গে উদ্ভিদের জিন লাগিয়ে কত সব অদ্ভুত জিনিস তৈরি হচ্ছে তার রগরগে বর্ণনা—পড়তে তার ভাল লাগে না। টমেটো জিনের সঙ্গে গোলাপ গাছের জিন লাগানো হচ্ছেসাফল্য দোরগোড়ায়। এর শেষ কোথায় কে জানে? মানুষ এবং উদ্ভিদের এক সংকর প্রজাতি তৈরি হবে? আগামী পৃথিবীতে কারা বাস করবে? মানব-উদ্ভিদ।