- বইয়ের নামঃ সম্পর্ক
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, উপন্যাস
মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে
মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে তরকারির বাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কী? তাঁর গলার স্বরে অদূরবর্তী ঝড়ের আভাস। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে।
মনোয়ারা অদূরবর্তী ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী হয়েছে?
এটা কিসের তরকারি?
কৈ মাছের ঝোল।
কৈ মাছের ঝোলে তরকারি কী?
চোখে দেখতে পাচ্ছ না কী দিয়েছি! ফুলকপি, সিম।
তোমাকে কতবার বলেছি-ফুলকপির সঙ্গে সিম দেবে না। ফুলকপির এক স্বাদ, সিমের আলাদা স্বাদ। আমার তো দুটা জিভ না যে একটায় সিম খাব আর অন্যটায় ফুলকপি?
মনোয়ারা হাই তুলতে তুলতে বললেন, যে তরকারি খেতে ইচ্ছা করে সেটা নিয়ে খেলেই হয়। খেতে বসে খামাখা চিৎকার করছ কেন?
এই তরকারি তো আমি মরে গেলেও খাব না।
না খেলে না খেয়ো। ডাল আছে ডাল খাও।
শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাব?
মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা তো হোটেল না যে চৌদ্দ পদের রান্না আছে।
মোবারক হোসেনের প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে তরকারির বাটি ছুড়ে মেঝেয় ফেলে দিতে। এই কাজটা করতে পারলে রাগটা ভালো দেখানো হয়। এতটা বাড়াবাড়ি করতে সাহসে কুলাচ্ছে না। মনোয়ারা সহজ পাত্রী না। তার চীনামাটির বাটি ভাঙবে আর সে চুপ করে থাকবে এটা হবার না। মোবারক হোসেন কৈ মাছের ঝোলের বাটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কাটা হিসাব করে দিলেন, যেন তরকারি পড়ে যায় আবার বাটিটাও না ভাঙে।
মনোয়ারা বললেন, কী হল? খাবে না?
মোবারক হোসেন কিছু না বলে ভাতের থালায় হাত ধুয়ে ফেললেন। থালায় ভাত বাড়া ছিল। কিছু ভাত নষ্ট হল। হাত ধোয়ার দরকার ছিল না। তার হাত পরিষ্কার-খাওয়া শুরুর আগেই গণ্ডগোল বেধে গেল।
মনোয়ারা বললেন, ভাত খাবে না? মোবারক হোসেন বললেন, না। তোমার ভাতে আমি ইয়ে করে দেই।
বাক্যটা খুব কঠিন হয়ে গেল। রাগের সময় হিসাব করে কথা বলা যায় না। তবে কঠিন বাক্যেও কিছু হল না। মনোয়ারা খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তরকারির বাটি, ডালের বাটি তুলে ফেলতে শুরু করলেন। যেন কিছুই হয় নি। মোবারক হোসেন স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। পরিবারের প্রধান মানুষটা রাগ করে বলছে—ভাত খাবে না, তাকে সাধাসাধি করার একটা ব্যাপার আছে না? মনোয়ারা কি বলতে পারত না ভুল হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কখনো সিম আর ফুলকপি একসঙ্গে রাধা হবে না। কিংবা বলতে পারত—দুমিনিট বোসসা চট করে একটা ডিম ভেজে দেই। শুকনা মরিচ আর পেঁয়াজ কচলে মরিচের ভর্তা বানিয়ে দেই। মরিচের ভর্তা তার অত্যন্ত প্রিয়। এই জিনিসটা বানাতে কতক্ষণ লাগে? তানা, ভাত তরকারি তুলে ফেলছে! ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের এই হল ফসল।
মোবারক হোসেনের তীব্র ইচ্ছা হল বাড়িঘর ছেড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো বের হয়ে পড়েন। এ রকম ইচ্ছা তার প্রায়ই হয়। বাড়ি থেকে বের হন। রেলস্টেশনে গিয়ে ঘণ্টখানেক বসে থাকেন। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। তাঁর রেলস্টেশন পর্যন্ত। মোবারক হোসেন নান্দাইল রোড রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার। রাত নটায় একটা আপ ট্রেন ছেড়ে দিয়ে খেতে এসেছিলেন। খেতে এসে এই বিপত্তি সিম আর ফুলকপির ঘোঁট বানিয়ে বসে আছে।
মোবারক হোসেন মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে শুরু করলেন। এটা হল তাঁর ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার সংকেত। অতি সহজে তাঁর কানে ঠাণ্ডা লেগে যায় বলে সব সময় মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে হয়। আর এ বছর তুন্দ্রা অঞ্চলের শীত পড়ছে। আগুনের উপর বসে থাকলেও শীত মানে না।
মনোয়ারা বললেন, যাচ্ছ কোথায়?
তিনি জবাব না দিয়ে গায়ে চাদর জড়ালেন।
স্টেশনে যাচ্ছ?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হাতমোজা পরতে লাগলেন। হাতমোজা পরা ঠিক হচ্ছে না। মনোয়ারা মাত্র কিছুদিন আগে হাতমোজা বুনে দিয়েছেন। তার উচিত হাতমোজা জোড়া নর্দমায় ফেলে দেয়া কিন্তু বাইরে মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীত। খোলা মাঠের উপর রেলস্টেশন। শীত সহ্য হবে না। গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে না থেকে যদি নান্দাইল রোডে থাকতেন এবং মাঘ মাসে গৃহত্যাগ করতেন তা হলে তিনিও হাতমোজা পরতেন। গলায় মাফলার বাঁধতেন।
রাতে ফিরবে? না ফিরলে বলে যাও। দরজা লাগিয়ে দেব।
যা ইচ্ছা করো।
আমি কিন্তু শুয়ে পড়লাম। রাতদুপুরে ফিরে এসে দরজা ধাক্কাধাব্ধি করবে না।
তোর বাপের দরজা? সরকারি বাড়ির সরকারি দরজা। আমার যখন ইচ্ছা ধাক্কাধাব্ধি করব।
তুই তোকারি করবে না। আমি তোমার ইয়ার বন্ধু না।
চুপ। একদম চুপ। No talk.
মোবারক হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টির অর্থ তুমি জাহান্নামে যাও। তিনি ঘরের কোনায় রাখা ছাতা হাতে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হওয়ামাত্র দরজা বন্ধ করার ঝপাং শব্দ হল। মোবারক হোসেন ফিরে এসে বন্ধ দরজায় প্রচণ্ড লাথি বসালেন। এতে তার রাগ সামান্য কমল। তিনি রেলস্টেশনের দিকে রওনা হলেন।
রাত নিশুতি
রাত নিশুতি। ভয়াবহ ঠাণ্ডা পড়েছে। রক্ত-মাংস ভেদ করে শীত হাড়ের মজ্জায় চলে যাচ্ছে। কুয়াশায় চারদিক ঢেকে গেছে। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। অথচ শুক্লপক্ষ, আকাশে চাঁদ আছে। মোবারক হোসেনের পকেটে দুই ব্যাটারির টর্চও আছে। টর্চ জ্বালাতে হলে চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করতে হয়। তিনি তার প্রয়োজন বোধ করছেন না। গত দশ বছর তিনি এই রাস্তায় যাতায়াত করছেন। চোখ বেঁধে দিলেও চলে আসতে পারবেন।
রেলস্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। পয়েন্টসম্যান হেদায়েত স্টেশনেই ঘুমায়। সে মনে হয় আছে। আজ তার বোনের বাড়িতে যাবার কথা। মনে হয় যায় নি। যে শীত নেমেছে যাবে কোথায়? মোবারক হোসেন স্টেশনের বাতি দেখে খানিকটা স্বস্তি বোধ করলেন। হেদায়েত থাকলে তাকে দিয়ে চিড়-মুড়ি কিছু আনানো যাবে। খিদেয় তিনি অস্থির হয়েছেন। উপোস অবস্থায় রাত পার করা যাবে না। বিকেলেও কিছু খান নি। বিকেলে নাশতা হিসেবে মুড়ি এবং নারিকেলকোরা দিয়েছিল। এমন গাধা মেয়েছেলে! নারিকেলকোরা হল ভেজা ন্যান্যতা একটা জিনিস। মুড়িকে সেই জিনিস মিইয়ে দেবে এটা তো দুধের শিশুও জানে। দুই মুঠ মুখে দিয়ে তিনি আর খান নি। এখন অবিশ্যি মনে হচ্ছে ন্যাতন্যাতা মুড়িই তিনি এক গামলা খেয়ে ফেলতে পারবেন। তবে শীতের রাতের আসল খাওয়া হল আগুন গরম গরুর গোশত তার সঙ্গে চালের আটার রুটি। এই গরুর গোশত ভুনা হলে চলবে না। প্রচুর ঝোল থাকতে হবে। মনোয়ারাকে বললে সে ইচ্ছা করে করে ঝোল শুকিয়ে ভূনা করে ফেলবে। চালের আটার রুটি না করে আটার রুটি করবে এবং পরে বলবে…
মোবারক হোসেনের চিন্তার সূত্র হঠাৎ জট পাকিয়ে গেল। কারণ তার চোখে ধক করে সবুজ আলো এসে পড়ল। তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেন। আলোটা এসেছে স্টেশনঘর থেকে। কেউ মনে হয় টর্চ ফেলেছে। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ বা এ রকম কিছু। হঠাৎ চোখে পড়েছে বলে সবুজ রং মনে হয়েছে। টর্চের আলো সবুজ হবার কোনো কারণ নেই।
নান্দাইল রোড রেলস্টেশনটা এই অঞ্চলের মতোই দরিদ্র। একটি ঘর। সেই ঘরে জানা নেই। টিকিট দেয়ার জন্যে যে ফাকটা আছে তাকে জানালা বলার কোনো কারণ নেই। মোবারক হোসেন যখন এই ঘরে বসে টিকিট দেন তখন। তার মনে হয় তিনি কবরের ভেতর বসে আছেন। মানকের নেকের তাঁর সওয়াল জওয়াব করবে। সওয়াল জবাবের ফঁাকে ফঁাকে তিনি টিকিট দিচ্ছেন। সব স্টেশনে একটা টিউবওয়েল থাকে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে পানি খায়। ফ্লাস্ক ভরতি করে পানি নিয়ে ট্রেনে ওঠে। এই স্টেশনে কোনো টিউবওয়েল নেই। যাত্রীদের বসার জায়গা নেই। বছর তিনেক আগে দুটা প্ৰকাণ্ড রেইনট্রি গাছ ছিল। গাছ দুটার জন্য স্টেশনটা সুন্দর লাগত। আগের স্টেশনমাস্টার গাছ কাটিয়ে এগার হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। এতে পরে তার সমস্যা হয়েছিল—তাকে বদলি করে দেয়া হয়, তার জায়গায় আসেন মোবারক হোসেন। তাঁর চাকরি এখন শেষের দিকে। এই সময় কপালে কোনো ভালো স্টেশন জুটল না। জুটল ধ্যাদ্দাড়া নান্দাইল রোড। স্টেশনের লাগোয়া কোনো চায়ের স্টল পর্যন্ত নেই। হঠাৎ চা খেতে ইচ্ছা হলে কেরামতকে পাঠাতে হয় বোয়াইল বাজার। চা আনতে আনতে ঠাণ্ডা পানি। মুখে দিয়েই থু করে ফেলে দিতে হয়। রেলস্টেশনের সঙ্গে চায়ের দোকান থাকবে না এটা ভাবাই যায় না। এর আগে তিনি যে স্টেশনে ছিলেন সেখানে দুটা চায়ের দোকান ছিল। হিন্দু টি স্টল, মুসলিম টি স্টল। দুটা চায়ের দোকানের মালিকই অবিশ্যি মুসলমান।
মোবারক হোসেন স্টেশনঘরের মাথায় এসে দাঁড়ালেন। চারদিক ধু-ধু করছে। জনমানব নেই। স্টেশনঘরের সামনে থেকে তাঁর চোখে যে আলো ফেলেছিল তাকেও দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছে না। মোবারক হোসেন ঠিক করলেন লোকটাকে দু-একটা কঠিন কথা বলবেন মানুষের চোখে টর্চ ফেলা অসম্ভব বেয়াদবি। মহারানী ভিক্টোরিয়াও যদি কারো চোখে টর্চ ফেলেন সেটাও বেয়াদবি।
স্টেশনঘরে বাতি জ্বলছিল বলে তিনি দূর থেকে দেখেছেন। এটা সত্যি না। স্টেশনঘরে বাতি জ্বলছে না। হেদায়েত নিশ্চয়ই বোনের বাড়ি চলে গেছে। মোবারক হোসেন তালা খুলে স্টেশনঘরে ঢুকলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঘরটা বাইরের মতো হিমশীতল না। উত্তরে বাতাস তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। বাতাসের হাত থেকে জীবন রক্ষা পেয়েছে। তিনি হারিকেন জ্বালালেন। তাঁর ভয় ছিল হারিকেনে তেল থাকবে না। দেখা গেল তেল আছে। সারা রাত জ্বলার মতোই আছে।
স্টেশনঘরে তাঁর বিছানা আছে। তোশক লেপ, চাদর, বালিশ। খাওয়া এবং ঘুমানোর ব্যাপারে তার কিছু শৌখিনতা আছে বলে লেপ-তোশক ভালো। বিছানার চাদরটাও ভালো। যদিও মোরক হোসেনের ধারণা মাঝে মধ্যে হেদায়েত নিজের বিছানা রেখে তার বিছানায় শুয়ে থাকে। কারণ তিনি হঠাৎ হঠাৎ বিছানা চাদরে উৎকট বিড়ির গন্ধ পান। হেদায়েতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে চোখ কপালে তুলে বলেছে—আমার কি বিছানার অভাব হইছে? ব্যাটাকে একদিন হাতেনাতে ধরতে হবে।
মোবারক হোসেন বিছানা করতে শুরু করলেন। শীত যেভাবে পড়ছে অতি দ্রুত লেপের ভেতর ঢুকে যেতে হবে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘুম আসবে নাকী আর করা! নিজের বোকামির উপর তাঁর এখন প্রচণ্ড রাগ লাগছে। রাগ করে ভাত না খাওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে। তারচেয়েও অন্যায় হয়েছে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসা। তিনি কেন বাড়ি ছাড়বেন? এককাপ গরম চা পাওয়া গেলে এই ভয়ঙ্কর রাতটা পার করে দেয়া যেত। মোবারক হোসেন ঠিক করে ফেললেন এবারের বেতন পেয়েই একটা কেরোসিনের চূলা কিনবেন। একটা সসপেন, চাপাতা, চিনি। যখন ইচ্ছা হল নিজের চা বানিয়ে খেলেন। মুড়ির টিনে কিছু মুড়ি থাকল। মুড়ির সঙ্গে খেজুর গুড়। শীতের রাতে মুড়ি আর খেজুর গুড় হল বেহেশতি খানা। ডিম থাকলে সসপেনে পানি ফুটিয়ে একটা ডিম সেদ্ধ করে ফেলা। গরম ভাপ ওঠা ডিমসিদ্ধ লবণের ছিটা দিয়ে খাওয়া…উফ! মোবারক হোসেনের জিভে পানি এসে গেল।
মোবারক হোসেনের খাদ্যসংক্রান্ত চিন্তার সূত্রটি আবারো জট পাকিয়ে গেল। আবারো তার চোখে সবুজ আলো ঝলসে উঠল। এমন কড়া আলো যে আলো নিভলে চারদিকে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকারে ডুবে যায়। হারিকেনের আলো সেই অন্ধকার দূর করতে পারে না। চিকাদের কিচমিচ জাতীয় কিছু শব্দ শুনলেন। শব্দটা আসছে দরজার কাছ থেকে। ছায়ামূর্তির মতো কিছু একটা দরজায় দাঁড়িয়ে। সবুজ আলোর ঝলক চোখ থেকে না গেলে ছায়ামূর্তির ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। ভূতপ্রেত না তো? আয়াতুল কুরসিটা পড়া দরকার। সমস্যা হচ্ছে এই সুরাটা তাঁর মুখস্থ নাই। মনোয়ারার আছে। সে কারণে অকারণে আয়াতুল কুরসি পড়ে। কে জানে এখনো হয়তো পড়ছে। খালি বাডি মেয়েছেলে একা আছে। ভয় পাবারই কথা। শীতকালে আবার ভূতপ্রেতের আনাগোনা একটু বেশি থাকে।
মোবারক হোসেনের চোখে আলো সয়ে এসেছে। তিনি হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। চিকার কিচকিচ শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। দরজা ধরে একজন মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিচকিচ শব্দটা সেই করছে। যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর যাই হোক ভূতপ্রেত না। ভূতপ্রেত হলে টৰ্চলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। ভূতের পায়ে বুটজুতা থাকবে না। মাথায় হ্যাটজাতীয় জিনিসও থাকবে না। চোখে রোদচশমাও থাকবে না। মোবারক হোসেন বিড়বিড় করে বললেন, আপনার পরিচয়?
বলেই মোবারক হোসেন মেয়েটির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কারণ তাঁর ভয় হতে লাগল মেয়েটি বলে বসবে আমি মানুষ না, অন্য কিছু। এখন তার মনে হচ্ছে ভূতপ্রেতের হাতে টৰ্চলাইট থাকতেও পারে। এটা বিচিত্র কিছু না। একবার তিনি একটা গল্পে শুনেছেন, রাতে এক ভূত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে সাইকেলের চাকা রাস্তায় ছিল না। রাস্তা থেকে আধা ফুটের মতো উপরে ছিল। ভূত যদি সাইকেল চালাতে পারে তা হলে টৰ্চলাইটও হাতে নিতে পারে। চোখে রোদচমশাও পরতে পারে। চিকার মতো কিচকিচও করতে পারে।
আমার নাম এলা। আপনি কি আমার কথা এখন বুঝতে পারছেন?
মোবারক হোসেন আবারো বিড়বিড় করে বললেন, জ্বি।
পরিষ্কার বুঝতে পারছেন?
জ্বি। বাংলা ভাষায় কথা বলছেন বুঝব না কেন?
না, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলছি না। আমি আসলে কোনো ভাষাতেই কথা বলছি না। আমার চিন্তাগুলো সরাসরি আপনার মাথায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন সেই ভাষাও আমি বুঝতে পারছি না, তবে আপনার মস্তিষ্কের চিন্তা বুঝতে পারছি।
মোবারক হোসেন ক্ষীণ স্বরে বললেন, জ্বি আচ্ছা। ধন্যবাদ।
আপনি এই ক্ষমতাকে দয়া করে কোনো টেলিপ্যাথিক বিদ্যা ভাববেন না। এই ক্ষমতা আমার নেই। আমি এই কাজটার জন্যে ছোট্ট একটি যন্ত্র ব্যবহার করছি। যন্ত্রটার নাম এল জি ৯০০০।
মোবারক হোসেন আবারো যন্ত্রের মতো বললেন, জ্বি আচ্ছা, ধন্যবাদ।
আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
জ্বি না।
আয়াতুল কুরসি ব্যাপারটা কী? আপনি মনে মনে সারাক্ষণ আয়াতুল কুরসির কথা ভাবছেন। সে কে?
এটা একটা দোয়া। আল্লাহপাকের পাক কালাম। এই দোয়া পাঠ করলে মন থেকে ভয় দূর হয়। জিনভূতের আশ্রয় থেকে আল্লাহপাক মানবজাতিকে রক্ষা করেন।
তার মানে আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
মোবারক হোসেন শুকনো গলায় বললেন, জ্বি না।
ভয় না পেলে ভয় কাটানোর দোয়া পড়ছেন কেন?
মোবারক হোসেন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং বেশ ভালো ভয় পাচ্ছেন। মেয়েটা কথা বলছে, কিন্তু তার ঠোট নাড়ছে না। ভয় পাবার জন্যে এইটাই যথেষ্ট। তার উপর এমন রূপবতী মেয়েও তিনি তার জীবনে দেখেন নি। পরীস্থানের কোনো পরী না তো? নিৰ্জন রাতে পরীরা মাঝে মাঝে পুরুষদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পরীস্থানে নিয়ে যায়। নানান কুকর্ম করে পুরুষদের ছিবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেয়। এই জাতীয় গল্প তিনি অনেক শুনেছেন। তবে পরীরা যুবক এবং সুদর্শন অবিবাহিত ছেলেদেরই নিয়ে যায়। তার মতো আধবুড়োকে নেয় না। তাকে ছিবড়া বানাবার কিছু নেই। তিনি ছিবড়া হয়েই আছেন।
মোবারক হোসেন।
জ্বি।
আমি আপনাকে আমাদের দেশে নিতে পারব না। ইচ্ছা থাকলেও পারব না। আমার সেই ক্ষমতা নেই। আমি এসেছি ভবিষ্যৎ পৃথিবী থেকে, পরীস্থান থেকে নয়। আপনাকে ছিবড়া বানানোরও কোন ইচ্ছা আমার নেই।
সিস্টার আপনার কথা শুনে খুব ভালো লেগেছে। থ্যাংক য়্যু।
আজকের তারিখ কত দয়া করে বলবেন?
মাঘ মাসের ১২ তারিখ।
ইংরেজিটা বলুন, কোন সন?
জানুয়ারি ৩, ১৯৯৭।
আমি আসছি ৩০০১ সন থেকে।
আসার জন্য ধন্যবাদ। সিস্টার ভিতরে এসে বসুন। দরজা বন্ধ করে দেই। বাইরে অত্যধিক ঠাণ্ডা।
মেয়েটি ভেতরে এসে দাঁড়াল। মোবারক হোসেন দরজা বন্ধ করলেন। তারপর মনে হল কাজটা ঠিক হয় নি। দরজা খোলা রাখা দরকার ছিল, যাতে প্রয়োজনে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। মনোয়ারার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই ভুল হয়েছে।
দরজা বন্ধ করার পর এলা টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। মোবারক হোসেন চেয়ার এগিয়ে দিলেন। এলা বসতে বসতে বলল, মনোয়ারা কে? আপনি সারাক্ষণ এই নামটি মনে করছেন।
জ্বি, আমার স্ত্রী।
এলা বিস্মিত হয়ে বলল, স্ত্রী? আপনার স্ত্রী আছে! কী আশ্চর্য।
মোবারক হোসেন তাকিয়ে আছেন। তার স্ত্রী থাকা এমন কী বিস্ময়কর ঘটনা যে মেয়েটা চোখ কপালে তুলল! রাস্তায় ভিক্ষা করে যে ফকির, তারও একটা ফকিরনী থাকে। তিনি রেলে কাজ করেন। ছোট চাকরি হলেও সরকারি চাকরি। কোয়ার্টার আছে।
স্ত্রীর উপর কি কোনো কারণে আপনি বিরক্ত হয়ে আছেন?
ইয়েস সিস্টার। তার উপর রাগ করেছি বলেই স্টেশনে এসে একা একা বসে আছি।
খুবই ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, এল জি ৯০০০ এই পয়েন্ট নোট করছে। বিজ্ঞান কাউন্সিলে আমরা আপনার কথা বলব। র্যানডম স্যাম্পলের আপনি সদস্য হচ্ছেন। আশা করি আপনার বা আপনার স্ত্রীর এই বিষয়ে কোনো আপত্তি হবে না।
কোনো কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন খুবই বিনীত গলায় বললেন, জ্বি না ম্যাডাম।
এতক্ষণ সিস্টার বলছিলেন এখন ম্যাডাম বলা শুরু করলেন।
সিস্টার ডেকে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সিস্টার ডাকের মধ্যে হাসপাতালের গন্ধ আছে। হাসপাতাল মানেই অসুখবিসুখ। সেই তুলনায় ম্যাডাম ডাকটা ভালো।
স্ত্রীর উপর যখন রাগ করেন তখন আপনি স্টেশনে থাকার জন্যে চলে আসেন। আর যখন স্টেশনে আসেন না তখন স্ত্রীর প্রতি থাকে আপনার ভালবাসা?
জ্বি না। রাগ করেও অনেক সময় বাসায় থাকি। গতকাল রাগ করেছিলাম, তারপরেও বাসায় ছিলাম।
কী কারণে রাগ করেছেন বলতে কি কোনো বাধা আছে?
জ্বি না ম্যাডাম। বলতে বাধা নেই।
তা হলে বলুন।
আজ রাগ করেছি—কারণ, আজ সে ফুলকপি আর সিম একসঙ্গে দিয়ে কৈ মাছের ঝোল রান্না করেছে।
এটা কি বড় ধরনের কোনো অন্যায়?
সিম এবং ফুলকপি একসঙ্গে রান্না করা যায়। অনেকে পছন্দ করে। আমি করি না। অনেককে দেখবেন সব তরকারির সঙ্গে ডাল নিচ্ছে। মাছ ভাজা নিয়েছে, তার সঙ্গেও ডাল। মাছ ভাজার এক রকম টেস্ট, ডালের আরেক রকম টেস্ট। দুটাকে কি মেশানো যায়? তা হলে দুধ দিয়ে আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে মাখিয়ে খেলেই তো হত! আমার পয়েন্টটা কি সিস্টার ধরতে পারলেন?
ধরার চেষ্টা করছি। আপনি আমাকে একেক সময় একেকটা ডাকছেন কখনো সিস্টার, কখনো ম্যাডাম। আপনি সরাসরি আমাকে এল ডাকতে পারেন।
ধন্যবাদ।
রাগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গতকাল কী নিয়ে রাগ করেছেন?
চা দিতে বলেছি। চুমুক দিয়ে দেখি ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডাই যদি খাই তা হলে চা খাবার দরকার কী? শরবত খেলেই হয়! শুধু ঠাণ্ডা হলেও কথা ছিল। দেখি এলাচের গন্ধ। চা কি পায়েস নাকি যে এলাচ দিতে হবে? ম্যাডাম ঠিক বলেছি না?
আমি বলতে পারছি না। কারণ, চা নামক বস্তুটি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।
শীতের সময় খুবই উপকারী। নেক্সট টাইম আসেন ইনশাল্লাহ আপনাকে চা খাওয়াব। চা-চিনি-দুধ-সব থাকবে।
আর কখনো আসব বলে মনে হচ্ছে না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আর যেসব কারণে রাগারাগি হয় সেটা কি বলবেন? আপনাদের সব রাগরাগির উৎস কি খাদ্যদ্রব্য?
জ্বি না ম্যাডাম। ওর খাসিলত খারাপ। সবকিছুর মধ্যে উল্টা কথা বলবে। আমি যদি দক্ষিণ বলি—আমার বলাটা যদি তার অপছন্দও হয় দক্ষিণ না বলে তার বলা উচিত পূর্ব বা পশ্চিম—তা বলবে না। সে সোজা বলবে উত্তর।
আপনি বলতে চাচ্ছেন বিপরীত?
একশ দশ ভাগ বিপরীত।
একশ দশ ভাগ বিপরীত মানে কী? একশ ভাগের বেশি তো কিছু হতে পারে না।
আপা কথার কথা।
আপা বলছেন কেন?
আপনাকে বড় বোনের মতো লাগছে এই জন্যে আপা বলেছি। দোষ হয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী।
দোষ-ত্রুটি না, আপনার কথাবার্তা সামান্য এলোমেলো লাগছে। যাই হোক পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই আপনার এবং আপনার স্ত্রীর সম্পর্ক তা হলে ভালো না।
আপনিই বলুন ম্যাডাম ভালো হবার কোনো কারণ আছে?
আপনারা কি একে অন্যকে কোনো গিফট দেন?
একেবারে যে দেই না তা না-ঈদে চান্দে দেই। না দেওয়াই উচিত।
তারপরেও দেই এবং তার জন্যে যেসব কথা শুনতে হয়-উফ্।
একটা বলুন শুনি।
ঘরের কিচ্ছা বাইরে বলা ঠিক না
ঘরের কিচ্ছা বাইরে বলা ঠিক না। তারপরেও জানতে চাচ্ছেন যখন বলি–গত রোজার ঈদে আমি নিজে শখ করে একটা শাড়ি কিনে আনলাম। হালকা সবুজের উপর লাল ফুল। বড় ফুল না, ছোট ছোট ফুল। সে শাড়ি দেখে মুখ বাঁকা করে বলল, তোমাকে শাড়ি কে কিনতে বলেছে! লাল শাড়ি আমি পরি? আমি লম্বা মানুষ। বহরে ছোট জাকাতের শাড়ি একটা কিনে নিয়ে এসেছ!
জাকাতের শাড়ি ব্যাপারটা বুঝলাম না।
গরিব-দুঃখীকে দানের জন্যে দেয়া শাড়ি। শাড়ি বলা ঠিক না। বড় সাইজের গামছা।
শেষ প্ৰশ্ন করি–আপনার স্ত্রীর প্রতি আপনার এখন তা হলে কোনো ভালবাসা নেই?
ভালবাসা থাকবে কেন বলুন। ভালবাসা থাকলে এই শীতের রাতে আমি স্টেশনে পড়ে থাকি?
এলা নামের মহিলা হাতের টর্চলাইট জ্বালিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে চারদিক সবুজ আলোেয় ছয়লার করে আবার বাতিটা নেভাল। মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আপনি স্টেশনে থাকতে আসায় আমার জন্যে খুব লাভ হয়েছে।
কী লাভ?
আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। আপনার মতামত পেয়েছি। মতামত রেকর্ড করা থাকবে।
ম্যাডাম কি এখন চলে যাবেন?
হ্যাঁ চলে যাব।
তেমন খাতির-যত্ন করতে পারলাম না, দয়া করে কিছু মনে নেবেন না। নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
খাতির-যত্ন যথেষ্টই করেছেন এবং আমি আপনার দ্রুতায় মুগ্ধ। আপনাকে একটা সুসংবাদ দিতে যাচ্ছি। আমি মনে করি এই সুসংবাদ শোনার অধিকার আপনার আছে।
জ্বি ম্যাডাম সুসংবাদটা বলেন। দুঃসংবাদ শুনে শুনে কান ঝালাপালা। একটা সুসংবাদ শুনে দেখি কেমন লাগে।
আপনার ভালো লাগবে। ভবিষ্যৎ পৃথিবী, যেখানে থেকে আমি এসেছি সেই পৃথিবীতে পুরুষ সম্প্রদায় নেই। শুধুই নারী।
মোবারক হোসেনের মুখ হা হয়ে গেল। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে পুরুষ নেই! শুধুই নারী! এর মধ্যে সুসংবাদটা কোথায় মোবারক হোসেন ধরতে পারলেন না। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে শুধুই পুরুষ, নারী নেই এটা শুনলেও একটা কথা ছিল।
এলা বলল, পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার শতকরা আশি ভাগ ছিল নারীপুরুষঘটিত সমস্যা। প্রেমঘটিত সমস্যা। একসঙ্গে জীবনযাপনের সমস্যা। ইতিহাসে এমনও আছে যে শুধু একটি নারীর জন্যে একটি নগরী ধ্বংস হয়ে গেছে। আছে না?
জ্বি আছে। ট্রয় নগরী।
গ্যালাকটিক ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে সংঘটিত অপরাধের শতকরা ৫৩ ভাগ নারীঘটিত।
মোবারক হোসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন-খাঁটি কথা বলেছেন। ধর্ষণ, এসিড মারা, নাবালিকা হত্যা পত্রিকা খুললেই এই জিনিস। আল্লাহপাক দয়া করেছেন, এখানে পত্রিকা আসে না।
এলা বলল, মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে বিজ্ঞান কাউন্সিল একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে পৃথিবীতে পুরুষ এবং মহিলা বলে দুধরনের মানবসম্প্রদায় থাকবে না। হয় থাকবে শুধু পুরুষ অথবা শুধু মহিলা। যুক্তিসঙ্গত কারণেই শুধু মহিলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ মহিলাদের ভেতরই দুরকমের ক্রমোজোম x এবং y আছে। বুঝতে পারছেন তো?
কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন বললেন, জ্বি। আপনার কথাবার্তা পানির মতো পরিষ্কার। দুধের শিশুও বুঝবে।
বংশবৃদ্ধির জন্যে একসময় পুরুষ এবং রমণীর প্রয়োজন ছিল। এখন সেই প্রয়োজন নেই। মানবসম্প্রদায়ের বংশ বৃদ্ধি এখন মাতৃগর্ভে হচ্ছে না। ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে। শিশুপালনের যন্ত্রণা থেকেও মানবসম্প্রদায়কে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
ও।
এলা বলল, বর্তমান পৃথিবী সুন্দরভাবে চলছে। সমস্যাহীন জীবনযাত্রা। তারপরেও বিজ্ঞান কাউন্সিলে মাঝে মধ্যে প্রশ্ন ওঠে-পুরুষশূন্য পৃথিবীর এই ধারণায় কোনো ত্রুটি আছে কি না। তখনই তথ্য সংগ্রহের জন্যে প্রাচীন পৃথিবীতে স্কাউট পাঠানো হয়। আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের পাঠানো তথ্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে-পুরুষশূন্য পৃথিবী আদর্শ পৃথিবী।
মোবারক হোসেন ভয়ে ভয়ে বললেন, আমরা পুরুষরা কি খারাপ?
আলাদাভাবে খারাপ না, তবে পুরুষ যখন মহিলার পাশে থাকে তখন খারাপ।
সবুজ আলো আবারো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আলো নিভে যাবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত মোবারক হোহাসেন চোখে কিছু দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর তিনি দেখলেনঘরে আর কেউ নেই। তিনি একা। মোবারক হহাসেন সিগারেট ধরলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত হলেন এতক্ষণ যা দেখেছেন সবই চোখের ধান্দা। মন মেজাজ ছিল খারাপ, শীতও পড়েছে ভয়াবহ। সব মিলিয়ে চোখে ধান্দা দেখেছেন। একা একটা স্টেশনে থাকা ঠিক না। আবারো চোখে ধান্দা লাগতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে বের হয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়াটাও অত্যন্ত অপমানকর। কিন্তু কী আর করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে বারবার অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাসায় ফিরে গেলেও খাওয়াদাওয়া করা যাবে না। কিছুটা রাগ তাতে দেখানো হবে।
মোবারক হোসেন বাড়িতে ফিরলেন। মননায়ারা বলামাত্র হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। মননায়ারা এর মধ্যেই ফুলকপি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল করেছেন। এবং সেই ঝোল এত সুস্বাদু হয়েছে যা বলার না! রান্নাবান্নার কোনো ইতিহাসের বই থাকলে কৈ মাছের এই ঝোলের কথা স্বর্ণাক্ষরে সেই বইয়ে লেখা থাকার কথা। মোবারক হোসেনের খুব ইচ্ছা করছে এই কথাটা স্ত্রীকে বলা। শুনলে বেচারি খুশি হবে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। কারণ মননায়ারার চোখ লাল এবং ফোলা। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। মোবারক হোসেন যতবারই রাগ করে বাইরে চলে যান ততবারই মনোয়ারা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেন। এই তথ্যটা মোবারক হোসেনের মনে থাকে না। মোবারক হোসেন নরম গলায় বললেন–বউ ভাত খেয়েছ।
মনোয়ারা ভেজা গলায় বললেন, না।
মোবারক হোসেন ভাত মাখিয়ে নলা করে স্ত্রীর মুখের দিকে এগিয়ে বললেন, দেখি হা করো তো।
মনোয়ারা বললেন, টং করবে না তো। তোমার টং অসহ্য লাগে।
অসহ্য লাগলেও এ ধরনের ঢং মোবারক হোসেন প্রায়ই করেন। এলা নামের মেয়েটাকে এই গুরুত্বপূৰ্ণ কথাটা বলা হয় নি।
মোবারক হোসেন মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে বললেন, কই খাও! ভাত হাতে কতক্ষণ বসে থাকব!
মনোয়ারা বললেন, বুড়ো বয়সে মুখে ভাত! ছিঃ!
ছিঃ বললেও তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর মুখভরতি লজ্জামাখা হাসি।