- বইয়ের নামঃ মানবী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, উপন্যাস
কথোপকথন
মানব সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ক্রটি তাদের অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রবণতা। তারা ৬০.৩৭ ভাগ কথাই কারণ ছাড়া বলে।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা, পৃষ্ঠা ২০০৫
সময় সন্ধ্যা ছটা। তারিখ ৯ নভেম্বর সন ৪০০৯।
ভবিষ্যতের পৃথিবী। কথা হচ্ছে কম্পিউটার কেন্দ্রের সঙ্গে নিনিতার ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষের কোনো নাম নেই। সবই পিন নাম্বার। গল্প বর্ণনা সুবিধার জন্যে নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
নিনিতা : হ্যালো। আমার পিন নাম্বার ০০২৮৩৮৪১/০৩৭/২৩৮১।
কম্পিউটার : নিনিতা, কেমন আছেন?
নিনিতা : ভালো।
কম্পিউটার : শুভ সন্ধ্যা।
নিনিতা : শুভ সন্ধ্যা।
কম্পিউটার : আমার প্রতি আপনার আদেশ বলুন।
নিনিতা : আমার স্বামীকে আমি জন্মদিনে একটা উপহার দিতে চাই। কী উপহার দেব বুঝতে পারছি না।
কম্পিউটার : আমাকে দুসেকেন্ড সময় দিলে আমি আপনার স্বামীর প্রোফাইল দেখে নিতে পারি।
নিনিতা : তার পিন নাম্বার কি দেব?
কম্পিউটার; প্রয়োজন নেই। আপনার পিন নাম্বার থেকেই তারটা পাব।
নিনিতা : তা অবশ্য পাওয়া যাবে।
কম্পিউটার : তিনি গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। একা থাকতে পছন্দ করেন। কম্পিউটার গেম The Orion Day তার অতি পছন্দের খেলা। এই খেলার পেছনে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন। নিনিতা, আপনি তাকে The Orion Day খেলার নতুন versionটা দিতে পারেন। পঞ্চাশ ইউনিট খরচ পড়বে। লাইসেন্স ফি দশ ইউনিট।
নিনিতাঃ একটি খেলার যন্ত্রণাতেই আমি অস্থির। দ্বিতীয় খেলা আমি কিনব না।
কম্পিউটার : এইমাত্র আপনার স্বামীর DNA প্রোফাইল আমাদের হাতে এসেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি সুখাদ্য পছন্দ করেন। নতুন একটা ফুড প্রসেসর বাজারে এসেছে। এটা প্রাচীন। পৃথিবীর খাদ্য প্রস্তুতে বিশেষ পারদর্শী। দাম এক হাজার ইউনিট। একটু বেশি। কিন্তু ফুড প্রসেসরটি অসাধারণ।
নিনিতা : আমার যে ফুড প্রসেসর আছে সেটা যথেষ্ট।
কম্পিউটার : আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে আরো কিছু সময় দিন। এই ফাঁকে আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন। তাতে অবশ্য সারপ্রাইজ এলিমেন্ট নষ্ট হবে।
নিনিতা : আমি এই বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না।
কম্পিউটার : আপনার অনুমতি পেলে আমরা কথা বলতে পারি। এমনভাবে কথা বলব যেন তিনি বুঝতে না পারেন এর পেছনে আপনার কোনো ভূমিকা আছে।
নিনিতা : সেটা কীভাবে বলবেন?
কম্পিউটার : আমরা বলব—কার কী ধরনের উপহার পছন্দ এটা নিয়ে একটি গবেষণা হচ্ছে। আপনি সেই গবেষণার একটি অংশ। আপনি আপনার পছন্দের উপহারের তালিকা বলুন।
নিনিতা : বুদ্ধি খারাপ না।
কম্পিউটার : ধন্যবাদ। আমরা যথাসময়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
.
এল সি স্ক্রিনের পর্দা নীলাভ হয়ে গেল। নিনিতা ফুড প্রোর দিকে এগিয়ে গেল। রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। নিনিতা ফুড প্রোর বোতাম টিপতেই মিষ্টি গলার স্বর শোনা গেল।
ম্যাডাম, আজ রাতে কি নতুন কিছু তৈরি করব?
নতুন মানে কী?
Martian সালাদ। এই সালাদ মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীদের অত্যন্ত প্রিয়। এক ধরনের হার্ব ব্যবহার করা হয়, যা শুধু মঙ্গল গ্রহেই জন্মে। আমি অবশ্য Original হার্ব ব্যবহার করব না, সিনথেটিক হার্ব ব্যবহার করব।
সালাদের সঙ্গে আর কী থাকবে?
মেইন ডিশে ভেড়ার মাংসের সঙ্গে স্টিকি রাইসের একটা প্রিপারেশন কি দেব? সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর সাতভাগ মানুষের কাছে এই খাবারটি প্রিয়।
এই খাবারটা দাও। সঙ্গে আরেকটা আইটেম থাকুক।
কী আইটেম দেব?
তোমার ইচ্ছামতো দাও। সারপ্রাইজ আইটেম।
ডেজার্টে কি আইসক্রিম দেব?
না। আইসক্রিম আমাদের দুজনেরই খুব অপছন্দের, তুমি এটা জানো।
জানার পরেও আমি আইসক্রিম দিতে চাচ্ছি, কারণ আজ রাতের মেন্যুর সঙ্গে সবচেয়ে ভালো যাবে আইসক্রিম।
আমি লক্ষ করেছি, তুমি সবসময় তোমার সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দাও। আমি স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারি না।
ম্যাডাম, এর প্রধান কারণ, আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জন্মদিনে কী উপহার দেবেন এই সিদ্ধান্ত পর্যন্ত আপনি নিতে পারছেন না। আপনাকে মূল কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে।
তুমি কীভাবে জানলে?
ম্যাডাম, কেন জানব না? আমি মূল কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত।
সরি, ভুলে গিয়েছিলাম।
জন্মদিনের উপহার বিষয়ে আমি কি কোনো উপদেশ দিতে পারি?
না। তোমার কাজ রান্না করা। উপদেশ দেয়া না।
জন্মদিনে বিশেষ কী খাবার রান্না হবে এই বিষয়ে কি কিছু ভেবেছেন?
না।
আমি কি ভাবব?
না। তোমাকেও ভাবতে হবে না। যথাসময়ে আমি সিদ্ধান্ত নেব।
ম্যাডাম, রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে।
গুড।
আপনি স্যারকে ডেকে নিয়ে আসুন। যদিও স্যার এখন খুব আগ্রহ নিয়ে নিউজ চ্যানেল দেখছেন। চট করে তাকে খাবার টেবিলে আনা যাবে না। আমি ইচ্ছা করলে নিউজ চ্যানেল আমার স্ক্রিনে নিয়ে আসতে পারি। স্যার খেতে খেতে নিউজ দেখতে পারবেন। তবে নতুন বিধিমালায় তা সম্ভব না। খাবার খেতে হবে উত্তেজনাবিহীন পরিবেশে। সেখানে হালকা মিউজিক চলতে পারে। আর কিছু না।
তুমি কথা বেশি বলে।
ম্যাডাম, আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে বেশি কথা বলার জন্যে। আপনারা দুজন মাত্র মানুষ। দুজন দুজনের কথাই শুধু শোনেন। এতে বিরক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়। টেনশন তৈরি হয়। দুজনার মাঝখানে আমার কথা ফিলারের মতো আসে। এতে টেনশন কমে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে,..
প্লিজ স্টপ।
ফুড প্রো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলার মতো শব্দ করল। নিনিতা তার স্বামীর ঘরের দিকে রওনা হলো। নিনিতার স্বামীর একটি নাম দেয়া যাক। ধরা যাক তার নাম কুন। পিন নাম্বার ব্যবহার করে গল্প চলিয়ে নেয়া কঠিন। যদিও ভবিষ্যতের পৃথিবীর কাছে মানুষের পরিচয় হিসেবে PIN নাম্বারের বিকল্প নেই। পিন নাম্বারে একজন মানুষের সকল তথ্য থাকে। নিনিতার পিন নাম্বার দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক। নিনিতার পিন নাম্বার
০০২৮৩৮৪১/০৩৭/২৩৮১
প্রথম ডিজিট o বলছে সে একজন মেয়ে। পুরুষ হলে প্রথম ডিজিট হতো ১। পরের পাঁচটি ডিজিট বলছে তার DNA code. যা হলো ০২৮৩৮। তারপরের ডিজিট তার বয়স বলছে। নিনিতার বয়স ৪১। এই সংখ্যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে। অবলিকের পরে আছে ০৩৭, এর মধ্যেই নিনিতার পেশা এবং মেডিকেল প্রোফাইল বলা হচ্ছে। সর্বশেষ চারটি ডিজিট হচ্ছে ২৩৮১, এটি সরকার থেকে দেয়া সংখ্যা যার অর্থ শুধু সরকার (সরকার অর্থ হলো মূল কম্পিউটার সিডিসি) জানবে। তবে সর্বশেষ ডিজিটটির অর্থ পরিষ্কার। সর্বশেষ ডিজিট ১-এর অর্থ এই তরুণীকে সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স দেয়া হয় নি। যেসব তরুণীর সর্বশেষ ডিজিট ২, তারা সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স পেয়েছে। পৃথিবীর মাত্র ০.০০৩ ভাগ তরুণী এই লাইসেন্স পায়। কারা লাইসেন্স পাবে তা ঠিক করা হয় লটারির মাধ্যমে। এই লটারি প্রতি চার বছর পর একবার করা হয়। লটারির দিন পৃথিবীতে ছুটি থাকে। কারণ ঐ দিনটি মহাউৎসবের একটি দিন।
কুনের কাছে ফিরে আসি। সে গ্যালাক্সি নিউজ দেখছে। গ্যালাক্সিতে বিশেষ বিশেষ ঘটনার ফুটেজ দেখানো হচ্ছে। তাৎক্ষণিক নিউজ না। গ্যালাক্সির যে অংশ এক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে, পৃথিবীতে তার আলো আসতে এক লক্ষ বছর লাগবে। তাদের ভিডিও ফুটেজ হবে এক লক্ষ বছরের পুরনো।
ওরিয়ন নক্ষত্রের একটি গ্রহকে দেখানো হচ্ছে। তাদের বুদ্ধিমান প্রাণীদের নিয়ে প্রতিবেদন। নিনিতা এসে কুনের রিভলভিং চেয়ারে হাত রাখল। কুন টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, এই গ্রহের প্রাণীগুলি দেখ। Humanoid, অবিকল মানুষের মতো, শুধু চারটা করে হাত। কী সুন্দর দেখতে, তাই না?
নিনিতা বলল, দেখতে কুৎসিত মাকড়শার মতো লাগছে।
কুন বলল, মোটেই মাকড়শার মতো লাগছে না। দেখ কী গ্রেসফুল। ইভোলিউশনে ওরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে। চারটা হাত ওদেরকে এগিয়ে দিয়েছে।
নিনিতা বলল, খেতে আস।
কুন বলল, অজি রাতের মেনু কী?
জানি না। হাবিজাবি কী সব যেন বানিয়েছে। তোমার কি বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?
হুঁ। করছে।
কী খেতে ইচ্ছা করছে বলো, আমি ফুড প্রো-কে বলে ব্যবস্থা করি।
ও ব্যবস্থা করতে পারবে না। শুধু তুমি পারবে।
নিনিতা অবাক হয়ে বলল, আমি কীভাবে পারব?
কুন বলল, তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। অমির চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। খাবার হিসেবে চুমু অসাধারণ।
নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, মাঝে মাঝে আমাকে খুশি করার জন্যে তুমি কিছু কাণ্ডকারখানা কর। আমি খুশি হই না। বিরক্ত হই। এসো, খেতে আসি।
ফুড প্রো টেবিল সাজিয়েছে। দুটি প্লেটে ন্যাপকিন কাটা চামচ। প্লেটের পাশে ষাট মিলিলিটার করে ক্যাম্পিয়ান রেড ওয়াইন। আলাদা সালাদের বাটি। মেইন কোর্স, ডেজার্ট ক্যান্ডেল লাইটের ব্যবস্থা আছে। মোমবাতি জ্বলছে। খাবার শেষ হওয়া মাত্র সব চলে যাবে ফুড প্রোর ওয়েস্ট ডিসপোজালে। সবই অ্যাটমিক স্পশারে নষ্ট করে ফেলা হবে। আবার নতুন করে তৈরি হবে।
সালাদ মুখে দিয়ে কুন বলল, অসাধারণ।
নিনিতা বলল, অসাধারণ বললে কেন? তিতকুটে একটা জিনিস। আঠালো। নাকে ঝাঁঝ লাগছে।
কুন বলল, মজা তো এখানেই। তুমি না খেলে তোমার সালাদের বাটিটা এগিয়ে দাও।
নিনিতা সালাদের বাটি ঠেলে দিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল, ফুড প্রো তোমার পছন্দের দিকে খেয়াল রেখে খাবার তৈরি করে। আমার পছন্দ সে হিসেবে ধরে না।
ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম, কথাটা ঠিক না। আপনার মেজাজ কোনো কারণে খারাপ বলে আপনি খেয়ে আনন্দ পাচ্ছেন না।
নিনিতা বলল, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে তুমি কথা বলছ কেন?
সরি। আপনাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কথা বলব না। আপনাদের ডিনার আনন্দময় হোক।
খাওয়া শেষ হবার পরেও কোনো কথা বলবে না।
সফট কোনো মিউজিক কি দেব ম্যাডাম?
নিনিতা জবাব দিল না। হালকা বাজনা শুরু হলো। মোমবাতির শিখা বাজনার সঙ্গে যুক্ত। শিখা তালে তালে কাঁপছে। মাঝে মাঝে বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে। এদিক ওদিক দুলছে। অপূর্ব আলোক নৃত্য।
কুন বলল, কম্পিউটার সেন্টার থেকে আমাকে টেলিফোন করেছিল। জানতে চাচ্ছিল আমার পছন্দের উপহার কী? তারা কী একটা গবেষণা না-কি করছে।
তুমি পছন্দের উপহারের তালিকায় কী কী নাম দিয়েছ?
আমার একটাই পছন্দ। তার নাম দিয়েছি। ক্র্যাব ন্যাধুলার পঞ্চম গ্রহের পশু রিরি।
পাগল না-কি? একটা রিরির দাম কত তুমি জানো?
জানি। দুই মিলিয়ন ক্রেডিট। ওরা আমার কাছ থেকে পছন্দের তালিকা চেয়েছে। দামের কথা জিজ্ঞেস করে নি। তোমার পছন্দ কী বলো তো?
নিনিতা বলল, আমার আর যাই পছন্দ হোক রিরি পছন্দ না।
ফুড প্রো অবাক গলায় বলল, ম্যাডাম, রিরি কেন পছন্দ করবেন না? রিরি একমাত্র পশু যে সব পশুর ভাষা বুঝে সেই ভাষায় কথা বলতে পারে।
নিনিতা বলল, আমার ভাষাবিদ পণ্ডিতের কোনো প্রয়োজন নেই। তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের কথার মধ্যে নাক গলাচ্ছ কেন?
ফুড প্রো বলল, হঠাৎ রিরির প্রসঙ্গ উঠল তো। নিজেকে সামলাতে পারলাম। পেট (Pet) রাখার অনুমতি আমাকে দেয়া হলে আমি একটা রিরি পুষতাম। তাকে নানান ধরনের খাবার বানিয়ে খাওয়াতাম।
অনেক কথা বলে ফেলেছ। আর না।
আপনাদের খাবার কি শেষ? টেবিল সরিয়ে ফেলব।
হ্যাঁ।
নিনিতা এবং কুন সরে দাঁড়াল। খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর খাবার ঘর গোছানোর দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে! এই দৃশ্য অসংখ্যবার দেখা, তারপরেও মনে হয় প্রথমবার দেখা হচ্ছে।
ফুড প্রোর ময়লা নিষ্কাশন প্যানেল খুলে গেল। সেখান থেকে দু’টা হাত বের হয়ে টেবিলের ওপর থেকে থালাবাসন, মোমবাতি, অবশিষ্ট খাবার টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। খটখট শব্দ হচ্ছে। চেয়ার এবং টেবিল ভাজ হচ্ছে। এখন চেয়ার টেবিল ঢুকে যাচ্ছে সার্ভারের ভেতর। ভ্যাক কাজ করতে শুরু করছে। ভ্যাক চেয়ার-টেবিলের নিচের জায়গাটা নিমিষে ঝকঝকে করে ফেলবে। তারপর সেখানেই পাতা হবে ঘুমানোর আরামদায়ক বিছানা। লোবিড় সুপার পাউডার ভর্তি তোষক, চাদর এবং বালিশ চলে আসবে। যে বিছানায় শোবে তার শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে লোবিড সুপার পাউডার তার তাপমাত্রা বদলাতে থাকবে।
নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঘুমাবে কখন?
বুঝতে পারছি না। ঘুম পাচ্ছে না। পে চ্যানেলে কিছু দেখবে?
অযথা ক্রেডিট নষ্ট করে লাভ আছে?
কুন বলল, ঘরের ভেতর কেন জানি দমবন্ধ হয়ে আসছে।
নিনিতা বলল, রাস্তায় হাঁটতে যাবে?
কুন বলল, রাস্তায় বের হলেও তো একশ ক্রেডিট করে লাগবে।
ফুড প্রো বলল, আজ রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে বের হলে ক্রেডিট খরচ করতে হবে না।
নিনিতা বলল, না কেন?
আপনাদের দুজনের কারোরই মনে নেই–আজ সেই বিশেষ রাত। আজ রাত বারোটায় ভাগ্যবান তরুণীদের তালিকা ঘোষণা করা হবে। যারা সন্তান নিতে পারার লাইসেন্স পাবেন।
নিনিতা শুকনো গলায় বলল, ও আচ্ছা।
এই বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। কারণ তার বয়স একচল্লিশ। সন্তান নেবার লাইসেন্স চল্লিশের পরের কোনো মহিলাকেই দেয়া হয় না।
নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, চল বের হই। বিনা ক্রেডিটে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।
কুন বলল, এখন কেন জানি বের হতে ইচ্ছা করছে না।
ফুড প্রো বলল, সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না স্যার। আজ বাইরের আবহাওয়া অত্যন্ত আরামদায়ক। তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাস। বইছে। চেরীগাছে ফুল ফুটেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কনসার্ট হচ্ছে।
নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, এই খবরগুলি আগে কেন বলো নি?
বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন বলে বলি নি। তাছাড়া আপনারা দুজনের কেউই বাইরে যাবার বিষয়ে কখনো আগ্রহী না।
নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, যাবে?
কুন হতাশ গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
ফুড প্রো বলল, ফিফথ রোডের মোড়ে মহান শিল্পী আহান গান করবেন। তাঁর বিখ্যাত চন্দ্রগীতি। এই সুযোগ হারানো ঠিক হবে না।
নিনিতা বলল, চন্দ্রগীতি আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হয়।
কুন বলল, ফালতু মনে হলেও চন্দ্রগীতি শোনার সময় তুমি কেঁদে বুক ভাসাও। চল যাওয়া যাক।
.
ফিফথ রোড লোকে লোকারণ্য। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ফিসফিস করেও কেউ কিছু বলছে না। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে চেরীগাছের পাতা নড়ছে। সেই শব্দ দূরাগত সঙ্গীতের মতো কানে বাজছে।
মহান শিল্পী আহানের জন্যে ছোট্ট একটা স্টেজ করা হয়েছে। চন্দ্ৰবৃক্ষের গোল চত্ত্বরের মাঝখানে রিটো-পলিমারের তৈরি স্টেজ। মনে হয় পাথরের বেদি। যেখান থেকে নরম আলো বের হচ্ছে। স্টেজের নাম আহান বেদি। এই বেদিতে তিনি ছাড়া কেউ গান করেন না। শহরে চন্দ্ৰবৃক্ষের তিনটি গাছ শুধু এখানেই আছে। যদিও বলা হয় চন্দ্ৰবৃক্ষ, কিন্তু এই বৃক্ষ বৃহস্পতির চাঁদ টিটান থেকে আনা। বৃক্ষের ফসিল থেকে জেনেটিক পদ্ধতিতে নতুন জীবন দান করে। পাতাশূন্য এই বৃক্ষ একসময় তার ডালপালা ছড়িয়ে দেয়, যার রঙ গাঢ় নীল। আহান দলবল নিয়ে গান করেন না। একা গান করেন। ছোট্ট স্টেজ তার জন্যে যথেষ্ট। গানের মাঝে মাঝে তিনি শিস দেন। বলা হয়ে থাকে, আহানের শিসের সুরের জন্ম এই পৃথিবীতে না। অন্য কোনো সুরলোকে, যার সন্ধান মানুষ এখনো। পায় নি।
নিনিতা স্বামীকে নিয়ে এগুচ্ছে। কুন বলল, আর কাছে যাবার দরকার কী? এখান থেকে উনাকে পরিষ্কার দেখা যাবে।
নিনিতা ফিসফিস করে বলল, এত শব্দ করে কথা বলছ কেন?
সরি।
তারা বড় একটা চেরীগাছের নিচে দাঁড়াল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহান শিল্পী আহান স্টেজে ঢুকলেন। স্টেজের মাঝখানে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সম্মান প্রদর্শন করলেন।
বেদির আলো এসে পড়েছে তার চোখেমুখে। কী সুন্দরই না লাগছে দেখতে। বালক বালক চেহারার একজন মানুষ। বড় বড় চোখ। সেই চোখের দৃষ্টিতে গভীর দুঃখবোধ। যেন তিনি কিছুক্ষণ আগেই তার অতি প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। যার সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হবে না।
আহান নতজানু হবার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা সবাই নতজানু হয়েছিল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দর্শকরাও উঠে দাঁড়াল। কুন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জানো অনেকের ধারণা আহান এই গ্রহের মানুষ না? অন্য গ্রহের।
নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, অতি বিখ্যাতদের নিয়ে নানান গল্প প্রচলিত থাকে।
কুন বলল, তাও ঠিক।
আহান কথা বলা শুরু করেছেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট এবং সুরেলা। নিনিতার মনে হলো এই মানুষটা গান না করে শুধু যদি কথা বলেন, তাও মানুষ ঘণ্টার পর ঘন্টা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনবে।
আজ রাত অতি আনন্দের রাত। কিছু মা সন্তান ধারণের লাইসেন্স পাবেন। আহা, তাদের হৃদয়ে আজ কত না আনন্দ। আমি এক অতি অভাজন আহান। তাদের আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছে। আমার চোখও তাদের আনন্দে সিক্ত।
আহান চোখ মুছলেন। দর্শকদের বেশিরভাগ চোখ মুছল। আহানের কথা শুনে তাদের চোখও ভিজে উঠেছে।
আহান বললেন, আজকের চন্দ্রগীতি ভাগ্যবতী মায়েদের উদ্দেশে নিবেদিত।
সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু হলো—
(চন্দ্রগীতি)
হে চন্দ্র! আজ রাতে তোমাকে বিদায়।
আলো নেই অন্ধকার।
চন্দ্ৰবৃক্ষে হাহাকার।
অশ্রুর কারাগার।
আমরা কাঁদিতেছি গভীর মায়ায়
হে চন্দ্র! আজ রাতে তোমাকে বিদায়।
গানের প্রথম অন্তরা শেষ হয়েছে, আহান শিস দিতে সুর করেছেন। সুরের ওঠানামায় সবার মনে হচ্ছে, গভীর বিষাদের সমুদ্রে সবাই ভাসছে। বিষাদ আরো তীব্র হবে। একসময় সবাই ডুবে যাবে বিষাদ সমুদ্রে।
নিনিতা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কুন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছে। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
রাত বারোটা পার করে নিনিতা ঘরে ফিরল। ঘরে কফির গন্ধ। ফুড প্রো আগেভাগেই কফি বানিয়ে রেখেছে। ফুড প্রো আগেভাগে কিছু কাজ করে, যা নিনিতার পছন্দ না। অথচ তার কফি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। নিনিতা বলল, কফি নষ্ট করে দাও। কফি খাবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম, শ্যাম্পেনের একটা বোতল কি খুলব?
নিনিতা বলল, শুধু শুধু শ্যাম্পেনের বোতল কেন খুলবে?
ফুড প্রো বলল, ন্যাশনাল ইনফরমেশন সার্ভিস জানিয়েছে আপনি সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স পেয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। টেলিভিশন চালু করুন। সুরের মহান জাদুকর আহান প্রতিটি লাইসেন্স পাওয়া মাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। নতুন সব কে তিনি চন্দ্রমাতা সম্বোধন করছেন।
নিনিতা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সবকিছু দুলছে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে। শরীর ঘামছে। নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, টিভি চালু করছ না কেন?
কুন ছুটে গিয়ে টিভি চালু করল। পর্দায় আহানের আনন্দময় মুখ। তিনি বললেন, চন্দ্রমাতা, তোমাকে অভিনন্দন। তোমার কোল আলো করে যে চন্দ্ৰশিশু আসছে তাকেও অভিনন্দন।
কুন ফুড প্রোর দিকে তাকিয়ে বলল, এই গাধা! শ্যাম্পেনের বোতল খুলছ না কেন?
ফুড প্রো শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে খুলতে বলল, গাধা নামক প্রাণী পৃথিবী থেকে কত আগে extinct হয়ে গেছে, অথচ তাকে জড়িয়ে গালিটা রয়ে গেছে। এটা অবশ্যই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।
নিনিতা বলল, আমাকে শুইয়ে দাও। আমি এই আনন্দ নিতে পারছি না।
ফুড প্রো বলল, শুয়ে শুয়ে শ্যাম্পেন কীভাবে খাবেন ম্যাডাম?
নিনিতা বলল, সেটা আমার বিষয়। গাধার গাধা!
টিভি পর্দায় টুনটুন ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে। এর মানে সরকারি জরুরি নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। নিনিতা তাকালো।
হবু মা’দের প্রতি নির্দেশমালা
একের পর এক নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। নির্দেশগুলির দিকে তাকিয়ে থাকাও আনন্দের ব্যাপার। নিনিতার চোখে একটু পরপর পানি এসে যাচ্ছে। সে নির্দেশ ঠিকমতো পড়তে পারছে না।
চন্দ্রমাতাদের প্রতি নির্দেশ
ক) নিজের পছন্দের সব খাবার এখন থেকে বন্ধ। আপনাকে যে খাবার খেতে দেয়া হবে তাই খাবেন।
খ) নিউজ চ্যানেলে ভিন গ্রহের প্রাণীদের নিয়ে অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ। প্রাণীদের অবয়ব এবং আচার-ব্যবহার চন্দ্রমাতাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে।
গ) পৃথিবীতে উৎপন্ন হয় না এমন সব খাদ্য যেমন Martian salad খাওয়া নিষিদ্ধ।
ঘ) ভূগর্ভের দ্বিতীয় স্তরে চলে যেতে হবে। মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
নিনিতা চন্দ্রমাতাদের প্রতি নির্দেশ পড়ছে না। সে বিছানায় বসে আছে। দুই হাতে তার মুখ ঢাকা। সে কেঁদেই যাচ্ছে। ফুড প্রো বলল, আপনার আনন্দ দেখে এত ভালো লাগছে! রোবটদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকলে আমি একটা সন্তান নিতাম। তাঁর নাম দিতাম সুশীন। সুশান নামটা কেমন?
চুপ কর।
না, আমি চুপ করব না। আপনি যেমন আনন্দ করছেন আমিও আনন্দ করছি। আজ আমি মানুষদের মতো বেশি কথা বলব। আপনি কান্না না থামানো পর্যন্ত বকবক করতেই থাকব।
নিনিতা বলল, কুন কোথায়? সে কী করছে?
ফুড প্রো বলল, হা করে পর্দায় চন্দ্রমাতাদের নির্দেশ পড়ছে। আপনার এখন উচিত স্বামীর কাছে যাওয়া। তার কোমর জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নাচানাচি করা। আমি নাচের একটা প্রাচীন মিউজিক দিচ্ছি। এই মিউজিক প্রাচীন পৃথিবীর একজন মহান সুরকার কম্পোজ করেছিলেন। তার নাম মোৎসার্ট। দেব?
না। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।
মানব সম্প্রদায়ের স্বভাবের মধ্যে একা থাকার বিষয়টি নেই। সে একা থাকতে পছন্দ করে না। যখন সে বাধ্য হয়ে একা থাকে, তখনো তার কল্পনায় থাকে অনেক মানুষ।
বেশি জ্ঞানী হয়ো না। চুপ করে থাক।
আমি তো আগেই বলেছি, আজ আমি চুপ করে থাকব না। আপনার আনন্দে আমার অংশ আছে। এখন আমি মোসার্টের অতি বিখ্যাত অপেরা সঙ্গীত দিচ্ছি।
মোৎসার্ট বাজতে শুরু করেছে। নিনিতা বিছানা ছেড়ে নামল। কুনের পেছনে এসে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, এসো কিছুক্ষণ নাচি।
কুন বলল, চন্দ্রমাতাকে চুমু খাওয়া হয় নি।
নিনিতা হাসছে। কিন্তু তার চোখভর্তি পানি। এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকাতে বলা আছে—মানব সম্প্রদায় নানান বিপরীতমুখী স্বভাবের মিশ্রণ। তারা দুঃখে অশ্রু বর্ষণ করে। আনন্দেও অশ্রু বর্ষণ করে।
সভ্যতা
সভ্যতার দুটি ধারা। একটি ধারা ঊর্ধ্বমুখী। বসতি গ্রহে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা তৈরি করা তার লক্ষণ। অন্য ধারা নিম্নমুখী। সেই ধারায় ভূগর্ভে প্রবেশ করা হয়। সভ্যতা গড়ে উঠে গ্রহের গভীরে। দ্বিতীয় ধারার সভ্যতা (নিম্নমুখী সভ্যতা) শ্রেষ্ঠ সভ্যতা বলে বিবেচনা করা হয়।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা, পৃষ্ঠা ১০০৩
চার হাজার নয়ের পৃথিবী অসংখ্য ছোট ছোট শহরে বিভক্ত। শহরগুলির কোনো নাম নেই। তাদের জন্যেও পিন নাম্বার। নিনিতারা যে শহরে বাস করে তার নাম
শহর ০০৩০০৭০০১/৫৫২
পিন নাম্বারগুলির একেকটির একেক অর্থ। এই অর্থ সাধারণ শহরবাসীর জানা নেই। জানার প্রয়োজনও নেই। শহরের পরিচালক একজন মেয়র। তিনি মানুষ নন, Humonoid Robot. শহরবাসীরা যে-কোনো সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে শহরবাসীর সমস্যার সমাধান করেন।
শহরগুলির প্রধান বৈশিষ্ট হলো—সবই মাটির নিচে। শহরবাসীর মাটির নিচ থেকে বাইরে আসার নিয়ম নেই। আসতে হলে বিশেষ ধরনের সৌর স্যুট পরে আসতে হবে। এবং কেন বাইরে আসতে চায়, তার জন্যে মেয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দিনেরবেলা বাইরে আসতে না দেয়ার প্রধান কারণ সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি। পৃথিবীর আয়ানোস্ফিয়ার নষ্ট হয়ে যাবার কারণে মহাজাগতিক রশ্মি মানুষের জন্যে অতি বিপদজনক হয়ে পড়েছে।
জীবাণুমুক্ত পরিবেশ এবং অতি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে মানুষ তিনশ থেকে চারশ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মানুষকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখা শহরের জন্যে কষ্টকর। ফুড প্রো সব তৈরি করতে পারছে, বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারছে না। প্রতিটি শহরের জন্যে বরাদ্দ করা পানি শহরবাসীকে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হয়। একশ বছর পার হবার পর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরেও মানুষ খাবারে ব্যবহৃত পানি চা-কফি খেয়ে যত দিন ইচ্ছা বেঁচে থাকতে পারে। অনেকেই তা চায় না। তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্যে আবেদন করেন। শহরের মেয়র তা মঞ্জুর করেন।
গত তিনশ বছর ধরে মানুষকে সর্ব কর্ম থেকে মুক্ত করা হয়েছে। তাদের সব কাজ করছে রোবটরা। মানুষের প্রধান কাজ আনন্দে সময় কাটানো। মাটির নিচে অসংখ্য ফান সেন্টার আছে। কিছু কিছু যৌনপল্লী আছে। যৌনপল্লীতে পতিতা হিসেবে আছে হিউমনয়েড রোবট। এরা অপরূপ রূপবতী। মানুষের মতো ছলাকলায় সিদ্ধ। নৃত্য-গীতে পারদর্শী।
মাটির নিচে কৃত্রিম বন তৈরি করা আছে। বনে প্রাচীন পৃথিবীর প্রাণী বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা দেখতে অবিকল প্রাচীনকালের জীবজন্তুর মতো হলেও সবই রোবট। শহরবাসী ইচ্ছা করলেই এইসব প্রাণী শিকারে যেতে পারেন। তবে তাদের যথেষ্ট সাবধান হতে হয়। কারণ এইসব রোবট জন্তু হিংস্র এবং এরা রোবটের মূলনীতি মানে না। রোবটের মূলনীতি হলো—আমরা মানুষের ক্ষতি করব না। আমরা মানুষের অনিষ্ট হবে এমন কিছু হতে দেব না।
শিকারে যেতে হলে মেয়রের কাছ থেকে লাইসেন্স এবং অস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়।
স্ট্যাটিসটিকস বলে, শতকরা ৭০.২১ ভাগ মানুষ শিকার থেকে জীবিত ফেরে না। যারা ফিরে তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে একশ ক্রেডিট দেয়া হয়।
বিনোদনের জন্যে আগ্নেয়গিরি ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তাপ নিরোধক পোশাক পরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার কাছাকাছি যাওয়া এবং ফিরে আসা। এই ভ্রমণও অত্যন্ত বিপদজনক। কারণ আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতের কোনো নিয়মশৃঙ্খলা নেই। যে-কোনো সময় অগ্নৎপাত ঘটতে পারে।
স্ট্যাটিসটিকস বলে, শতকরা ৬০,৭৩ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু মানুষ জীবিত ফিরতে পারে না। যারা ফিরে তারা একশ ক্রেডিট পায়।
শহরগুলি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। কারণ কোনো শহরের সঙ্গেই অন্য কোনো শহরের যোগাযোগ নেই। এক শহরের মানুষ জানে না অন্য শহরে কী হচ্ছে। তার পেছনেও কারণ আছে। মহাজাগতিক রশ্মির কারণে হঠাৎ হঠাৎ কিছু ভাইরাসের মিউটেশন হয়। এমন এক ভাইরাসের নাম V-305, যার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা রোবট বিজ্ঞানীরা এখনো নিতে পারে নি। V-305 ভাইরাসে শহরের যে-কোনো একজন আক্রান্ত হলে অতি দ্রুত ভাইরাস পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শহরের সব মানুষের মৃত্যু ঘটে। শহর পরিত্যক্ত হয়। নতুন শহর তৈরি করা হয়।
মোট কতগুলি শহর পরিত্যক্ত হয়েছে তার পরিসংখ্যান সরকারের কাছে আছে। কোনো মানুষের কাছে নেই। এই তথ্য মানুষের কাছে নিষিদ্ধ।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে পৃথিবীর বাইরে কিছু কিছু জায়গায় মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। যেমন মঙ্গল এবং বুধ গ্রহ। বৃহস্পতির দু’টা চাঁদ। এবং শনির বলয়ের ভেতরে তিনটি চাঁদ। এরা সেখানে কী করছে বা সেখানে কী হচ্ছে শহরবাসীর কাছে সেই তথ্যও নিষিদ্ধ।
শহরবাসী সবরকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে খাঁচায় বন্দি পশুর মতোই জীবনযাপন করছে। রোগশোকহীন দীর্ঘ জীবন আনন্দে পার করে দেয়ার চেষ্টা। এই বিষয়ে মহান সুরকার আহানের একটি গান আছে—
আমাদের রোগ নেই,
জরা নেই।
ক্ষুধা কিংবা অক্ষুধা নেই।
স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন নেই।
জ্ঞান নেই, অজ্ঞানতাও নেই।
আমরা শহরবাসী,
আমাদের শহরও নেই।
শহর যে সম্পূর্ণ উত্তেজনাহীন তাও বলা যাবে না। প্রধান উত্তেজনা লটারি। বৎসরজুড়েই নানান ধরনের লটারির ব্যবস্থা আছে। যেমন
বিশেষ নাগরিক লটারি
অল্পকিছু নাগরিক প্রতিবছর বসন্ত উৎসবের দিন এই লটারিতে
জেতেন। শহরের অতি উন্নত অংশে তারা জায়গা পান। বিশেষ
ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। সেই বিশেষ সুযোগ সুবিধা কী
তা নগরবাসীরা জানেন না। বিশেষ নাগরিক লটারিতে জেতা
অতি সৌভাগ্যবানরাই তা জানেন। মহান সঙ্গীতকার আহান
একজন বিশেষ নাগরিক। গুজব প্রচলিত আছে যে, পানির
তীব্র সংকটের সময়েও বিশেষ নাগরিকদের জলকেলির
সুবিধা আছে। মিথ্যা পানি না, সত্যিকার পানির একটি রিজার্ভ।
তবে এই গুজব সত্যি নাও হতে পারে।
মুক্তি লটারি
এই লটারি দুবছর পরপর হয়। যারা এই লটারি জেতেন তারা
পৃথিবীর কঠিন পরিবেশ থেকে মুক্তি লাভ করেন। মানুষের নতুন
আবাস চাঁদ বা মঙ্গলে তাদের স্থান হয়। চাঁদ বা মঙ্গলের জীবন খুব
যে আনন্দের জীবন তা-না। কঠিন পরিশ্রমের জীবন। তারপরেও
বেশির ভাগ মানুষ আশা করে, কোনো এক সময় তারা মুক্তি
লটারি জিতবে। পৃথিবীর গহ্বর থেকে বের হয়ে আসবে। খুপড়ির
মতো ঘরে কর্মহীন জীবনযাপনের চেয়ে মুক্ত হাওয়ায় কঠিন
পরিশ্রম করাকে তারা শ্রেয় মনে করে।
সুপার লটারি
এই লটারি চার বছরে একবার হয়। একমাত্র লটারি যা ইচ্ছা করলে
কেউ গ্রহণ নাও করতে পারে। যারা সুপার লটারিতে জেতেন, তারা
সৌরমণ্ডলের বাইরের কোনো গ্রহের দিকে যাবার সুযোগ পান। মনুষ্য
বাসযোগ্য সম্পূর্ণ নতুন একটি গ্রহ খুঁজে বের করায় আনন্দ যেমন
আছে, কঠিন হতাশাও আছে। মহাকাশযান শত শত বৎসর পার করেও
এমন কোনো গ্রহ নাও পেতে পারে। অতি বিপদজনক সুপরি লটারি
কেউ প্রত্যাখ্যান করেছে এমন নজির নেই।
সুপার লটারি বিষয়েও আহানের একটি গান আছে—
আমি মাটির অনেক নিচের একটি গর্তে বাস করি।
আমার মাথার ওপর সীসার কঠিন পুরো ছাদ
অথচ স্বপ্ন দেখি সুপার লটারির
যা আমাকে নিয়ে যাবে আকাশের কাছে।
সেই সময়ের পৃথিবী অপরাধমুক্ত পৃথিবী। অপরাধের কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি মানুষের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে মহা কম্পিউটার সিডিসি। জন্মের পরপর সবার শরীরে একটি মনিটার চিপ চুকিয়ে দেয়া হয়। এই চিপ সারাক্ষণ সিডিসির কাছে খবর পাঠাতে থাকে। কেউ কোনো কারণে উত্তেজিত হওয়া মাত্র ঘরের থ্রিডি ক্যামেরা চালু হয়ে যায়। একজন মনোবিজ্ঞানীর (রোবর্ট) ছবি পর্দায় ভেসে ওঠে।
মনোবিজ্ঞানী হাসিমুখে প্রশ্ন করে, আপনার কী সমস্যা? কী কারণে বিচলিত বোধ করছেন? আসুন কিছুক্ষণ গল্প করি। তার আগে একটা ওষুধ খেলে কেমন হয়? আপনি ফুড প্রোর কাছে যান। সে দু’টা ওষুধ দেবে। প্রথম খাবেন নীল রঙের ট্যাবলেট। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর লাল রঙেরটা।
তারপরেও অপরাধ হয়। ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ। হত্যাকাণ্ড। স্ত্রী স্বামীকে মেরে ফেলেন কিংবা স্বামী স্ত্রীকে। দীর্ঘদিন ছোট্ট একটা ঘরে থাকার কারণে এটা ঘটে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় কেবিন ফিভার। অপরাধীকে শাস্তি দেবার বিধান নেই। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় লালকুঠিতে। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় তার স্মৃতি নষ্ট করে দেয়া হয়। তার নতুন জীবন শুরু হয়। শিশু থেকে ক্রমে ক্রমে বড় হওয়া লালকুঠিতে যারা যায়, তারা আর কখনো মূল শহরে ফিরতে পারে না।
শহরের মানুষদের জন্যে প্রচুর আনন্দ উপকরণ থাকলেও তারা মূল আনন্দ পায় ক্রেডিট জমিয়ে। একশ বছর পার হবার পর যখন খাবার পানি বন্ধ করে দেয়া হবে, তখন ক্রেডিট খরচ করে পানি কেনা যাবে। এক ক্রেডিটের বিনিময়ে ত্রিশ দিনের পানি।
উপহার হিসেবেও ক্রেডিট লেনদেনের ব্যবস্থা আছে। সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ক্রেডিটের লেনদেন হয়। মূল কম্পিউটার সিডিসি প্রায়ই কিছু ক্রেডিট বিতরণ করে। কোনো কোনো ভাগ্যবানের থ্রিডি পর্দায় হঠাৎ লেখা ওঠে
অভিনন্দন!
কম্পিউটার সিডিসি আপনাদের দুজনকেই পাঁচ ক্রেডিট করে দিচ্ছে।
আপনাদের জন্যে উপহার।
অপরাধীর (যার স্থান হয়েছে লালকুঠিতে) সমস্ত ক্রেডিট সরকার নিয়ে নেয়। এইসব ক্রেডিটই পরে সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। তাও হয় লটারিতে।
চার হাজার নয়ের পৃথিবী লটারির পৃথিবী। আনন্দময় দুঃস্বপ্নের পৃথিবী। সেই পৃথিবী শাসন করে রোবটরা।
রোবট বিজ্ঞান তখন উন্নতির চরম শিখরে। রোবট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে Neno chips. যা মানুষের দৃষ্টিসীমা’র বাইরে। অসাধারণ তার ক্ষমতা।
পৃথিবীতে এসেছে SF Humonoid Robot. সিলিনিয়ামের s এবং ফ্রেনসিয়ামের F থেকে SF, এরা মুক্তবুদ্ধি রোবট। দেখতে অবিকল মানুষের মতো। আচার-ব্যবহারও সেরকম।
সাধারণ রসিকতা হিসেবে বলা হয়, একটি SF রোবটকে মানুষের কাছ থেকে আলাদা করার তিনটি উপায়
১. SF রোবট মানুষের চেয়ে বেশি ভোজনরসিক।
২. SF রোবটদের লজ্জা মানুষের চেয়ে বেশি।
৩. SF রোবটরা মানুষের চেয়ে দ্রুত প্রেমে পড়ে।
SF রোবটরা মানুষের মতোই নাগরিক সুবিধার অধিকারী। তারাও লটারিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। SF নারী রোবটরা গর্ভধারণে সক্ষম, তবে তাদেরকে সেই অধিকার এখনো দেয়া হয় নি। শোনা যাচ্ছে, পরীক্ষামূলকভাবে কিছু SF নারী রোবটকে মাতৃত্বের লাইসেন্স দেয়া হবে। সেই ক্ষেত্রে Egg এবং Sperm দুটোই নেয়া হবে মানুষের কাছ থেকে। নারী SFরোবট শুধুই গর্ভধারণ করবে।
আয়না মানব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ রোবট বিজ্ঞানীদের তৈরি SF রোবট। এদের অন্য নাম আয়না মানব। আয়নায় মানুষকে যেমন দেখায় এরা সেরকম। Mirry image.
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
এটা কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য?
নিনিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়নার সামনে একজন মেয়ে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। চুলের মাথায় জট লেগে গেছে। সে জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মাঝে-মাঝে চিরুনির টান প্রবল হচ্ছে, মেয়েটি ব্যথায় উফ শব্দ করছে। আয়নায়। মেয়েটির চেহারা খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
এমন রূপবতী মেয়ে শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়।
নিনিতা পুরোপুরি নিশ্চিত হলো সে স্বপ্ন দেখছে। অন্যধরনের স্বপ্ন। তার কল্পনায় নিশ্চয়ই অতি রূপবতী কোনো মেয়ের ছবি ছিল। সেই ছবি স্বপ্নে ধরা দিয়েছে। নিনিতা বলল, কে?
মেয়েটি তার দিকে ফিরল। উঠে দাঁড়াল এবং মিষ্টি গলায় বলল, আমার নাম মীন। ম্যাডাম, আপনার ঘুম কি পুরোপুরি কেটেছে? আপনাকে কফি দিতে বলব?
নিনিতা স্পষ্ট চোখে চারদিক দেখছে। এই তো পাশেই কুন ঘুমুচ্ছে। গভীর ঘুম। ঘড়িতে বাজছে সাতটা দশ। কুন আটটার আগে কখনো ঘুম থেকে উঠে না। ঘরের ভেতরে নরম আলো (কৃত্রিম আলো, দিন-রাতের প্রভেদ বুঝানোর জন্যে আলোর পরিবর্তন সেন্ট্রাল কম্পিউটার করে।
নিনিতা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, তুমি কে?
ম্যাডাম, কিছুক্ষণ আগে আমি আমার নাম বলেছি। আবারো বলছি–আমার নাম মীন।
তুমি ঘরে ঢুকেছ কীভাবে?
সেন্ট্রাল কম্পিউটার ব্যবস্থা করেছে যেন আমি ঘরে ঢুকতে পারি।
নিনিতা বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি দয়া করে আমার হতভম্ব ভাব কাটাবার ব্যবস্থা কর। পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা কর।
ম্যাডাম, আজ আপনার স্বামীর জন্মদিন। আপনি তাকে কী উপহার দেবেন তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সেন্ট্রাল কম্পিউটারের কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। সেন্ট্রাল কম্পিউটার আমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে।
তোমাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে?
হা ম্যাডাম। আমি SF টাইপ হিউমোনয়েড রোবট। আয়না মানবী। আমি আপনার স্বামীর আনন্দসঙ্গী হিসেবে কিছুদিন থাকব। তারপর চলে যাব। আপনার স্বামীর জন্মদিনের উপহারের স্থায়িত্ব অল্প কিছুদিন।
নিনিতা বলল, আমি সিডিসির কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম। তাকে বলি নি উপহার সরাসরি পাঠিয়ে দিতে।
ম্যাডাম, কিছু সিদ্ধান্ত সিডিসি নিজেই নিয়ে নেয়। তার কাছে পরামর্শ চাওয়ার এই বিপদ আছে।
উপহার হিসেবে তোমাকে আমার একেবারেই পছন্দ হয় নি।
মীন বলল, ম্যাডাম, এই উপহার আপনার স্বামীর পছন্দ হবে। যেহেতু জন্মদিনটা তার, উপহার পছন্দটাও তার। আপনার পছন্দ-অপছন্দ অর্থহীন।
নিনিতা বলল, উপহার হিসেবে তুমি অশ্লীল। অরুচিকর।
ম্যাডাম, আপনি ঈর্ষাবশত এই কথা বলছেন। আমাকে ঈর্ষা করার কিছু নেই। আমি আয়না মানবী।
নিনিতা বলল, আমি শুনেছি SF রোবট এমন যে তাকে মানুষ থেকে আলাদা করা যায় না। মানুষের মতোই তাকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ম্যাডাম, আপনি ঠিকই শুনেছেন।
পুরুষদের রাতের সঙ্গী হবার ক্ষমতাও কি তোমার আছে?
আছে।
তাহলে তোমাকে আমি কেন ঈর্ষা করব না বলো।
মীন বলল, আমি মাত্র অল্প কিছুদিনের জন্যে এসেছি। এই কদিন আমার অবস্থান থেকে আপনি অনেক কিছু শিখতে পারবেন।
কী শিখতে পারব?
আপনার স্বামী কী পছন্দ করেন, কী করেন না তা শিখবেন।
রাতে তুমি যখন তার সঙ্গে শোবে তখন আমি দূর থেকে তোমাদের আনন্দ সময় দেখে অহ্লাদ বোধ করব?
ম্যাডাম! আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় পার করলেও অতি ঘনিষ্ঠ সময় পার করব না। এখন আসুন আমরা দুজন লবিতে বসে কফি খাই। আপনার স্বামী আটটার আগে ঘুম থেকে উঠেন না। এই খবর ফুড প্রো আমাকে দিয়েছে। অন্তরঙ্গ কিছু কথা বলার সময় আমরা পাচ্ছি।
নিনিতা বলল, তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। অন্তরঙ্গ কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি চাই কুনের জেগে ওঠার আগেই তুমি বিদায় হবে। আয়না মানবীর আমার প্রয়োজন নেই।
মীন বলল, ম্যাডাম, তা সম্ভব না। সিডিসি আমাকে পাঠিয়েছে। কাজেই আপনার স্বামীর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। তবে আমার হাত থেকে বাচার আপনার একটা সহজ উপায় আছে।
সহজ উপায়টা কী?
আপনার স্বামী যদি বলেন, জন্মদিনের উপহার তার পছন্দ হয় নি তাহলে এ বাড়ি থেকে আমাকে তুলে নেয়া হবে।
সে তোমাকে কখনোই পছন্দ করবে না। কখনোই না, কখনোই না।
ম্যাডাম! আপনি ভাবছেন আমি আপনাদের মাঝখানে সমস্যা হিসেবে এসেছি। আসলে তা-না। আমার উপস্থিতি আপনাদের দুজনের জন্যেই আনন্দময় হবে।
নিনিতা বলল, আমি যথেষ্ট আনন্দে আছি। বাড়তি আনন্দের আমার প্রয়োজন নেই।
তাহলে আমরা দুজন নিরিবিলিতে সকালের প্রথম কফি খাচ্ছি না?
না।
মীন বলল, আমি লবিতে অপেক্ষা করি। আপনার স্বামীর ঘুম ভাঙলে তাঁর সঙ্গে কথা হবে। উনি আমাকে অপছন্দ করলে আমি চলে যাব।
.
কুনের ঘুম ভেঙেছে। সে হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসতেই নিনিতা বলল, শুভ জন্মদিন।
কুন বলল, জন্মদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। শিশু লাইসেন্স পাওয়ার উত্তেজনায় আমার মাথা এলোমেলো। কাল সারারাত কী স্বপ্ন দেখেছি শুনলে অবাক হবে।
কী স্বপ্ন দেখেছ?
স্বপ্ন দেখেছি তোমার সঙ্গে বাচ্চার নাম রাখা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। তুমি এক অক্ষরে নাম রাখতে চাচ্ছ। তোমার পছন্দের নাম নি! আর আমি চাচ্ছি দুই অক্ষরের নাম রাখতে। আমার পছন্দের নাম নিনি।
নিনিতা বলল, তোমার জন্যে জন্মদিনের কোনো উপহারের ব্যবস্থা করি নি। কী ধরনের উপহার পছন্দ করবে বুঝতে পারি নি বলে সমস্যা।
তুমি আমাকে একটা শিশু উপহার দিচ্ছ। এরচেয়ে ভালো উপহার আর কী হতে পারে?
নিনিতা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, কয়েকদিনের জন্যে একটা SF হিউমোনয়েড রোবট উপহার হিসেবে দিলে কেমন হয়? একজন অতি রূপবতী আয়না মানবী।
কুন বলল, SF রোবট কী বস্তু এই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?
এরা অবিকল মানুষের মতো, এইটুকু জানি।
কুন বলল, তুমি কিছুই জানে না। এই ধরনের রোবটগুলিকে তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হিসেবে। এরা বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, আবেগে শ্রেষ্ঠ। এদের কাউকে কয়েকদিনের জন্যে আনতে কী পরিমাণ ক্রেডিট খরচ হবে, এই সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই।
নিনিতা শুকনো গলায় বলল, একটি SF টাইপ রোবট তোমার জন্যে লবিতে অপেক্ষা করছে। তোমার জন্মদিনের উপহার। সে নাকি কিছুদিন থাকবে।
কুন বলল, সত্যি? এটা কীভাবে সম্ভব? বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। হাতের ধাক্কা লেগে তার কফির কাপ উল্টে গেল। টেবিলে কফি ছড়িয়ে পড়ল। কুন সেদিকে ফিরেও তাকাল না। ছুটে গেলে লবির দিকে।
ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম। আপনার কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ কফি কি দেব?
না।
আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুবই মন খারাপ করেছেন। অবশ্য মন খারাপ করার মতোই ব্যাপার ঘটেছে। একজন SF তরুণী পৃথিবীর যেকোনো পুরুষকে এক মিনিটের ভেতর হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে।
নিনিতা বলল, তোমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। তুমি এই বিষয়ে একটি কথাও বলবে না।
আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা বোধ করছি বলেই কথা বলছি। আয়না মানবী অনেক ছলাকলা জানে। আপনি তো তেমন কিছু জানেন না।
এই প্রসঙ্গে একটি কথাও বলবে না।
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। সে লবির দিকে যাচ্ছে। ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম আপনাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করি। এখন লবিতে যাবেন না।
কেন যাব না? তোমার কি ধারণা লবিতে ঢুকে দেখব কুন ঐ বদ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে?
ম্যাডাম, তা দেখার সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা-না। তবে তাদের ঘনিষ্ঠভাবে বসে আলাপ করতে দেখলেও আপনার খারাপ লাগবে। আপনি বরং এখানে বসুন। আরেক কাপ কফি খান। আসুন আমরা দুজন গল্প করি।
নিনিতা বলল, আমি যন্ত্রের সঙ্গে গল্প করি না।
ফুড প্রো বলল, মানুষ নিজেও তো একটা যন্ত্র ম্যাডাম। যন্ত্রের বেশি কিছু না।
স্টপ, আর কথা না।
নিনিতা আগের জায়গায় বসেছে। ঠান্ডা কফিতে চুমুক দিচ্ছে। তার চোখ-মুখ কঠিন।
.
লবিতে মীন এবং কুন মুখোমুখি বসা। কুনের চোখে বিস্ময়। মীন তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। কুনের কাছে এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। রোবট এমনভাবে তৈরি করা হয় যে তারা সবসময় মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। এই একজনকে দেখা যাচ্ছে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ তাকাচ্ছে কুনের দিকে। যতবারই তাকাচ্ছে ততবারই মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে।
কুন বলল, আমি কখনো SF টাইপ রোবট আগে দেখি নি। কথা বলা তো অনেক পরের ব্যাপার। তুমি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার দিকে তাকাও।
মীন বলল, লজ্জা লাগছে।
সত্যি লজ্জা লাগছে?
হুঁ
কেন বলো তো?
জানি না কেন। একটা কারণ এই হতে পারে যে, আমিও এই প্রথম কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলছি।
তোমাকে কি সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকে পাঠিয়েছে?
হ্যাঁ।
কুন বলল, তুমি নিখুঁত সুন্দর একজন মেয়ে।
মীন বলল, আমি নিখুঁত সুন্দর না। মানুষ নিখুঁত সৌন্দর্য নিতে পারে না। নিখুঁত সৌন্দর্যের পাশে সে খানিকটা অসহায় বোধ করে। আমার মধ্যে খুঁত রাখা হয়েছে।
কুন বলল, কী খুঁত?
মীন হাসতে হাসতে বলল, আপনি খুঁজে বের করুন। আমি আগ বাড়িয়ে নিজের খুঁত বলব কেন?
কুন নানানভাবে দেখল। মানুষ মেয়ের দিকে এইভাবে তাকানো যাবে না। অসভ্যতা হবে। রোবট মেয়ের দিকে তাকানো যাবে।
কোনো খুঁত কি পেয়েছেন?
না।
আমি বলে দেব?
উঁহু, আমি নিজেই বের করব। আচ্ছা শোন, আমরা শুনেছি SF রোবটরা সর্বগুণে গুণানিত। এটা কি সত্যি? তুমি নিশ্চয়ই চমৎকার গান করতে পার?
মীন বলল, না। আমাদের মানুষের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। সব মানুষ কি গান করতে পারে। কেউ কেউ পারে।
তুমি কি পার?
আমি আসলে কিছুই পারি না। সুন্দর করে কথা বলতে পারি।
কুন বলল, তোমাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। তুমি রোবট না হলে আমি বলতাম যে, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।
মীন অন্যদিকে ফিরে হাসতে শুরু করল। কুন বলল, তুমি হাসছ কেন?
মীন বলল, আপনার মুগ্ধতা দেখে হাসছি। প্রেমে পড়ার অর্থ কী আপনি জানেন?
অবশ্যই জানি। কেন জানব না?
মীন বলল, প্রেমে পড়ার অর্থ আপনি জানেন না বলেই এত সহজে বললেন, আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন।
কুন বলল, প্রেমে পড়ার অর্থ কী?
মীন বলল, প্রেমে পড়ার অর্থ হলো, আপনি শারীরিকভাবে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। নিম্নশ্রেণীর স্ত্রী-পতঙ্গ যখন পুরুষ-পতঙ্গের সঙ্গে মিলিত হতে চায়, তখন তারা শরীর থেকে ফেরোমেন নামের গন্ধ বের করে। এই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ-পতঙ্গ ছুটে আসে। নারী এবং পুরুষের প্রেম ফেরোমেনের আরেক নাম। ভালো কথা, আপনি কি আমার খুঁতটা ধরতে পারছেন?
না।
যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে ধরতে পারেন তাহলে আপনাকে বিশ ক্রেডিট পুরস্কার দেব।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে ক্রেডিট আছে?
মীন বলল, কেন থাকবে না? একজন তরুণীর যা কিছু প্রয়োজন, আমার তার সবই প্রয়োজন। SF রোবটদের প্রতিমাসে পনেরোশ ক্রেডিট করে এলাউন্স দেয়া হয়। খরুচে SF রোবটরা সব ক্রেডিট খরচ করে ফেলে। দুনিয়ার জামা কাপড় কেনে। আমি মোটেই খরুচে স্বভাবের না। আমি ক্রেডিট জমাই। আমার মাত্র দুসেট কাপড় আছে।
কুন বলল, দাঁড়াও তোমার কাপড়ের ব্যবস্থা করছি।
মীন বলল, আপনাকে কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আপনি বরং আমার খুঁতটা ধরুন এবং বিশ ক্রেডিট জিতে নিন।
কুন উঠে দাঁড়াল। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে মীনকে চমৎকার এক সেট পোশাক কিনে দেয়া দরকার। সবচেয়ে ভালো হতো এক সেট চন্দ্র গাউন কিনে দিতে পারলে। এই গাউন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে আলতোভাবে লেগে থাকবে। স্নিগ্ধ আলো ছড়াবে।
.
নিনিতা ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। ফুড প্রো তাকে আরেক কাপ কফি দিয়েছে। সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। কফিটা বিস্বাদ লাগছে। কুন নিনিতার সামনে বসতে বসতে বলল, তুমি মীনকে দেখেছ?
হ্যা দেখেছি।
মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর না?
মেয়েটা মেয়েটা করছ কেন? ও কোনো মেয়ে না। ওর শরীরভর্তি যন্ত্র। কপোট্রন। ট্যাকল সুইচ। জাংশান ট্রান্সমিশন। ফাইবার টিউবস।
কুন বলল, আমরা তো তার ভেতরটা দেখছি না। তার বাইরের রূপটা কেমন?
নিনিতা শুকনো গলায় বলল, সুন্দর।
তার সৌন্দর্যে কিছু খুঁত আছে। খুঁতটা কী বলো তো?
ওর নাকটা থ্যাবড়া।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, আরে তাই তো। ওর নাক থ্যাবড়া।
নিনিতা বলল, তুমি ওকে মীন না ডেকে আদর করে থ্যাবড়া নাকু ডাকতে পার।
থ্যাবড়া নাকু ডাকব?
হ্যাঁ। একই সঙ্গে তার প্রতি তোমার আবেগ প্রকাশ পাবে এবং শারীরিকভাবে তাকে বর্ণনাও করা হবে।
তুমি কি কোনো কারণে মেয়েটার ওপর রেগে আছ? মে
য়েটা মেয়েটা করবে না। বলো রোবটটা।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, এই উপহারটা তুমি নিজে আগ্রহ করে আমাকে দিয়েছ। এখন ভয়ঙ্করভাবে অপছন্দ করছ। কেন?
নিনিতা বলল, তুমি এলসি প্যানেলে যাও। কম্পিউটার সিডিসিকে জানাও যে, উপহার তোমার পছন্দ হয় নি।
কুন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুই তার মাথায় টুকছে না। নিনিতা বলল, যা করতে বলছি কর।
কুন বলল, এই কাজটা করা ঠিক হবে না। এতে মেয়েটাকে অপমান করা হবে। তারচেয়েও বড় কথা, মিথ্যা কথা বলা হবে। তুমি ভালো করেই জানো সিডিসির সঙ্গে মিথ্যা বলা আইনে বিরাট অপরাধ। যেই মুহূর্তে আমি প্যানেলে বসে মিথ্যা বলব—আমার শাস্তি হবে। ক্রেডিট কাটা যাবে।
নিনিতা চুপ করে গেল। কুন যা বলছে তা সত্যি। কী পরিমাণ ক্রেডিট কাটা যাবে তা নির্ভর করে অপরাধের গুরুত্বের ওপর। অপরাধের গুরুত্ব সিডিসি ঠিক করে এবং সেখানে কোনো আপিল চলে না।
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। কুন বলল, কোথায় যাচ্ছ?
নিনিতা বলল, আমাকে মা-কেন্দ্রে যেতে হবে। আজ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে।
কুন বলল, চল আমিও যাচ্ছি।
নিনিতা বলল, তোমাকে যেতে হবে না। তুমি থ্যাবড়া নাকিটার হাত ধরে বসে থাক। নাকের সঙ্গে নাক ঘষাও। চুমু খেতে চাইলে চুমু খাও।
নিনিতা! তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। সত্যি তুমি একা যাবে?
হ্যাঁ, আমি একাই যাব।
নিনিতা বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফুড প্রো বলল, স্যার, আপনি মন খারাপ করবেন না। আমাদের সঙ্গে একজন SF রোবট আছে। এই রোবট যে-কোনো পরিস্থিতিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে। ম্যাডামকে আনন্দিত রাখা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। তার একটা কথাই যথেষ্ট।
কুন বলল, মীনের সঙ্গে এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করাও তো লজ্জার ব্যাপার। যন্ত্রের কাছে হাত পাতা 1
ফুড প্রো বলল, আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। আমি মীনকে সব বুঝিয়ে বলব। যন্ত্র যন্ত্রের কাছে পরামর্শ চাইতেই পারে।
.
মা-কেন্দ্রের কাজ অতি দ্রুত শেষ হলো। নিনিতাকে গর্ভধারণ করতে হবে না। তার জরায়ু থেকে শুধু ডিম্বাণু নেয়া হবে। শিশু নিষিক্তিকরণ হবে টেস্টটিউবে। সেখান থেকে চলে যাবে কৃত্রিম গর্ভাশয়ে। গর্ভাশয়ের সময় শেষ হলেই শিশুকে বাবা-মা’র হাতে তুলে দেয়া হবে।
মা-কেন্দ্রের পরিচালক একজন রোবট মানবী। সে নিনিতাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাল। কৃত্রিম গর্ভব্যবস্থা কীভাবে হয় তাও দেখাল। অতি জটিল প্রক্রিয়া, যা মূল কম্পিউটার সিডিসি নিয়ন্ত্রণ করে।
নিনিতা বলল, আমি নিজে যদি গর্ভধারণ করতে চাই তাহলে সে অনুমতি কি দেয়া হবে না?
তুমি অনুমতি চেয়ে দেখতে পার, তবে দেয়া হবে বলে মনে হয় না। মাতৃগর্ভে শিশু বড় হবার অনেক সমস্যা। শিশু ঠিকমতো অক্সিজেন পাচ্ছে কি-না, খাবার পাচ্ছে কি-না তা নিয়ে সমস্যা হয়। যন্ত্র সেই সমস্যার সমাধান করেছে। যন্ত্রের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ আছে তোমার শরীরের ওপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। পেটে সন্তান নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করলে, শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্সে ঝামেলা হলো। তার প্রভাব পড়ল শিশুর ওপর। বুঝতে পারছ?
পারছি। শিশুটা যখন কৃত্রিম গর্ভে বড় হবে তখন কি তাকে আমি দেখে যেতে পারব?
অবশ্যই পারবে। তোমাকে প্রতিদিন আসতে হবে। দুঘণ্টা সময় প্রতিদিন শিশুটাকে দিতে হবে। তার সঙ্গে কথা বলবে, গান শোনাবে।
সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা আমি ঠিক করব, না সিডিসি ঠিক করবে?
অবশ্যই সিভিসি ঠিক করবে। নারী-পুরুষের ভারসাম্য রাখার দায়িত্ব সিডিসির। তুমি কী চাও? ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে।
আমাদের এখানে একজন কাউন্সিলর আছেন। তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পার। তিনি তোমার যে-কোনো সমস্যায় পরামর্শ দেবেন। কাউন্সিলর কিন্তু মূল কম্পিউটারের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত না। তোমার যদি মূল কম্পিউটার নিয়েও কোনো অভিযোগ থাকে, তাও আলাপ করতে পার। তোমার কোনো সমস্যা হবে
—এই বিষয়টা নিশ্চিত করছি।
কাউন্সিলর কি মানুষ?
না। মানুষকে অনেক আগেই সর্বকর্ম থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলর একজন SF টাইপ রোবট। আয়না মানব।
আয়না মানব?
হা SF টাইপ পুরুষ রোবট। আয়না মানব। তুমি কি আগে কখনো আয়না মানব দেখেছ?
নিনিতা বলল, এই মুহূর্তে আমার ঘরে একজন SF তরুণী রোবট বসে আছে।
এরকম তো হবার কথা না।
নিনিতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, কথা না থাকলেও হয়েছে।
.
কাউন্সিলর রোবট একজন পুরুষ। বৃদ্ধ পুরুষ। তার মাথার সব চুল পাকা। চোখে ভারি চশমা। বয়সের ভারে কুঁজো হওয়া মানুষের মতো তিনি চলাফেরা করেন। তিনি নিনিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো মাদার।
নিনিতা বলল, হ্যালো।
আমার নাম চার্ন। কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে চাইলে কর। আর যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে এসে কিছুক্ষণ গল্প করি।
নিনিতা বলল, আমার কোনো সমস্যা নেই।
চার্ন হতাশ গলায় বলল, যারা বড় ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে, তারাই শুরুতে কঠিন গলায় বলে, আমার কোনো সমস্যা নেই। বলল তোমার সমস্যাটা কী? সময় নষ্ট না করে বলে ফেলো।
নিনিতা প্রায় বিড়বিড় করে বলল, একটা SF টাইপ তরুণী রোবটকে নিয়ে আমার সমস্যা।
SF টাইপ তরুণী রোবট তুমি পেলে কোথায়?
নিনিতা পুরো ব্যাপার ব্যাখ্যা করল।
চার্ন বলল, মূল কম্পিউটার তোমার কাছে একটা SF রোবট যখন পাঠিয়েছে, তখন অনেক চিন্তাভাবনা করেই পাঠিয়েছে। আমি কারণ খানিকটা অনুমান করতে পারছি। অনুমানটা বলব?
বলুন।
তোমার স্বামীর কাছ থেকে মা-কেন্দ্র প্রচুর স্পার্ম নেবে। তার স্পার্ম কাউন্ট নিম্নপর্যায়ের। একজন অতি রূপবতী তরুণীর উপস্থিতির কারণে তার স্পার্ম কাউন্ট বাড়বে। এই বিবেচনাতেই হয়তোবা সিডিসি একজন আয়না মানবী পাঠিয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় না। কিছুদিনের জন্যে হলেও একজন আয়না মানবীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সে নানানভাবে তোমাকে সাহায্য করবে।
নিনিতা বলল, আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই।
চার্ন বলল, তোমরা মানুষরা বিরাট দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। তোমাদের সাহায্য দরকার।
নিনিতা বলল, আমরা মানুষরা কী ধরনের দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি?
তোমরা এখন যন্ত্রের দাস। তোমাদের কাছ থেকে সব কাজ কেড়ে নেয়া হয়েছে। তোমরা কেউ এখন কোনো কাজ কর না। কিন্তু নিজেদের সুখী ভাবো। তোমরা এখন শুধু ভাবো কীভাবে কিছু বাড়তি ক্রেডিট পাওয়া যাবে। তোমাদের স্বপ্ন এখন ক্রেডিটে এবং লটারিতে সীমাবদ্ধ। আরো শুনবে?
শুনব।
একটার পর একটা শহর বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। ভাইরাস সংক্রমণের কথা বলা হচ্ছে। আসলেই কি ভাইরাস সংক্রমণ? না-কি পরিকল্পিতভাবে মানব সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে।
নিনিতা বলল, আপনি তো ভয়ঙ্কর সব কথা বলছেন।
চার্ন বলল, হ্যাঁ বলছি। এই ধরনের বিদ্রোহী কথা অনেক রোবটই বলে। তাদের উদ্দেশ্য সেইসব মানুষ খুঁজে বের করা যারা বিদ্রোহ করতে চায়।
আপনিও কি সেরকম একজন?
চার্ন বলল, জানি না। হতেও পারে। নাও পারে।
নিনিতা অবাক হয়ে বলল, কোনো রোবট হতেও পারে, নাও হতে পারে ধরনের কথা বলতে পারে না।
চার্ন হাই তুলতে তুলতে বলল, SF টাইপ রোবটরা পারে। এরা মানব সম্প্রদায়ের মতোই।
নিনিতা বলল, SF রোবট তরুণী কি গর্ভধারণ করতে পারে?
চার্ন বলল, অবশ্যই পারে।
নিনিতা তাকিয়ে আছে। তাকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি তার ঘরে ফেরা উচিত। সেখানে কী হচ্ছে কে জানে? আবার একই সঙ্গে মনে হচ্ছে সে ফিরবে না। একা একা ঘুরবে।
চার্ন বললেন, তোমাকে খুব অস্থির লাগছে।
নিনিতা বলল, আমি অস্থির এইজন্যে অস্থির লাগছে।
কারণ আমি অনুমান করতে পারছি—আয়না মানবী। ঠিক ধরেছি?
নিনিতা বলল, ঠিক ধরেন নি। একটা সামান্য যন্ত্রের কারণে আমি অস্থির হব কেন?
চার্ন বললেন, নিনিতা, যন্ত্র কাকে বলে?
নিনিতা বলল, যন্ত্রের ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দেব না। আপনি নিজেই একটা যন্ত্র। আপনি জানেন যন্ত্র কাকে বলে?
তোমার ধারণাটা শুনি?
আমার ধারণা শুনতে হবে না। আমি আপনার কাছে পরীক্ষা দিতে আসি নি।
চার্ন চিন্তিত মুখে বললেন, তুমি আয়না মানবীকে নিয়ে শঙ্কা বোধ করছ। তোমার শঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। আয়না মানবীর আকর্ষণ উপেক্ষা করা মানব সম্প্রদায়ের সাধারণ একজন সদস্যের পক্ষে সম্ভব না হবারই কথা। আমার উপদেশ—দ্রুত বাসায় যাও। এই দুজন যেন কখনো একসঙ্গে না থাকে।
নিনিতা বলল, আমি একসঙ্গে থাকতে নিষেধ করলেই আয়না মানবী শুনবে?
চার্ন বললেন, আমি ব্যবস্থা করে দেই যাতে সে শোনে। দেব?
দিন।
চার্ন নিনিতার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, তুমি আয়না মানবীকে ডেকে বলবে, তোমাকে এবং আমার স্বামীকে একসঙ্গে দেখলেই আমার ইচ্ছা করে দুজনের একজনকে খুন করে ফেলি। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আয়না মানবী জানতে চাইবে—কাকে খুন করতে ইচ্ছা করে। তখন তুমি বলবে, আমার স্বামীকে। এতেই কাজ হবে।
নিনিতা অবাক হয়ে বলল, এই সামান্য কথাতেই কাজ হবে?
চার্ন বললেন, হ্যাঁ। প্রতিটি রোবটের ভেতর কিছু আদেশ তার লজিকে ঢুকিয়ে দেয়া। সেই আদেশ বলছে, কোনো রোবটের উপস্থিতিতে একজন মানুষ অন্য মানুষের সামান্যতম ক্ষতি যেন করতে না পারে তা দেখার দায়িত্ব উপস্থিত রোবটের। রোবটিকস-এর পাঁচটি আইনের এটা একটা।
নিনিতা বলল, বাকি চারটা কী?
চার্ন হাই তুলতে তুলতে বললেন, বাকি চারটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি তো আর রোবট না।
নিনিতা বলল, আপনি হাই তুলছেন কেন? একটা যন্ত্র কেন হাই তুলবে?
চার্ন বললেন, একজন বৃদ্ধ মানুষ বিরক্তিকর কথাবার্তা শুনলে হাই তোলেন। আমিও সে-কারণেই তুলছি। আমি একজন আয়না মানব। মানুষের মতো আচরণ আমাকে করতেই হবে।
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। চান তার সামনের টেবিলের ড্রয়ার খুলতে খুলতে বললেন, একটা পাস নিয়ে যাও।
কিসের পাস?
মাদার পাস। হবু মাদের মন প্রফুল্ল রাখার জন্যে এই পাস দেয়া হয়। এই পাস নিয়ে সে যে-কোনো সময় যে-কোনো জায়গায় যেতে পারবে। তুমি ইচ্ছা করলে মাটির নিচে থেকে বের হয়ে সত্যিকার আকাশ দেখতে পার।
নিনিতা হাত বাড়িয়ে পাস নিল। চার্ন বললেন, এখন কি মনের ভেতরের কুয়াশার খানিকটা কেটেছে?
নিনিতা বলল, কেটেছে।
মন ভালো হয়েছে?
হয়েছে।
যতটুকু ভালো হয়েছে সেটাকে একশগুণ বাড়িয়ে দেব?
দিন।
এই পাস দুজনের। তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী ঘুরতে পারবেন। এখন একটু কাঁদ।
নিনিতা বলল, কাঁদব কেন?
মানব সম্প্রদায়ের নিয়ম হচ্ছে, গভীর আনন্দ পেলে তারা কাঁদে। মাদার পাস পাবার পর সব মা-ই আনন্দে কাঁদে।
আমি খুব কঠিন মেয়ে, আমি কাঁদি না।
বলতে বলতেই নিনিতার চোখে পানি এসে গেল। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কুনের হাত ধরে সে গর্ত থেকে বের হয়েছে। সত্যি আকাশ দেখছে।
চার্ন হাসতে হাসতে বললেন, সবচেয়ে কঠিন মেয়েটি দেখছি সবচেয়ে বেশি চোখের পানি ফেলছে।
এতকিন নভেলা রড
ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সমাজে পুনর্বাসিত করতে এই রড ব্যবহার করা হয়। এই রডের সাহায্যে অপরাধীদের সঞ্চিত স্মৃতি মুছে ফেলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন স্মৃতি দেয়া হয়। পদার্থবিদ শেন এতকিন এতকিন নভেলা রডের জনক।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
পৃষ্ঠা ৫১৭২ (আবিষ্কার ও আবিষ্কারক)
নিনিতা ঘরে ফিরছে। ঘরে না ফিরলেও চলে। তার কাছে নীল রঙের একটা মাদার পাস আছে। শহরের যে-কোনো জায়গায় সে যেতে পারে। পাসটা পিন দিয়ে গায়ে লাগিয়ে রাখার নিয়ম। নিনিতা পাস রেখেছে হাতের মুঠোয়। কিছুক্ষণ পরপরই তাকে রক্ষী রোবটদের হাতে পড়তে হচ্ছে। এরা অস্ত্রধারী, তবে তাদের ব্যবহার ভদ্র।
ম্যাডাম, পাস?
নিনিতা হাতের মুঠো খুলে পাস দেখাল।
পাসটা গায়ে লাগিয়ে রাখলে দূর থেকে দেখতে পারি। তখন আর প্রশ্নোত্তরের ঝামেলায় আপনাকে যেতে হয় না। ম্যাডাম, কোথায় যাচ্ছেন জানতে পারি?
বিশেষ কোথাও না। এমনি ঘুরছি। কারণ ছাড়া ঘুরতে কি কোনো বাধা আছে?
কোনো বাধা নেই আপনার কাছে পাস আছে।
শহরের এমন কোথাও কি যেতে পারি যেখানে মজার কিছু হচ্ছে?
ম্যাডাম, আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না বলে অত্যন্ত দুঃখিত।
নিনিতা টানেল সুপারওয়েতে উঠে পড়ল। যতদূর যাওয়া যায় সে যাবে। একা একা ঘুরবে। সে চাচ্ছে কুন তার অভাব অনুভব করুক। সে ঘরে ফিরছে না। কেন? –এই ভেবে কিছুটা অস্থির হোক। নিনিতা ঠিক করল সে ঘরে ফিরবে সন্ধ্যা মিলাবার পর।
ম্যাডাম, আপনার পাস?
নিনিতা হাতের মুঠো খুলল। আশ্চর্য তো, সেখানে পাস নেই। হ্যান্ডব্যাগে কি রেখেছে? অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিনিতা হ্যান্ডব্যাগ খুলল। সেখানেও পাস নেই।
অস্ত্রধারী রোবট শান্ত গলায় বলল, পাস সবসময় গায়ের সঙ্গে এমনভাবে লাগিয়ে রাখা উচিত যেন দূর থেকে দেখা যায়।
নিনিতা বিড়বিড় করে বলল, ভুল হয়েছে।
আপনি কি পাসটি খুঁজে পাচ্ছেন না?
না। মনে হয় কোথাও পড়ে গেছে। বিশ্বাস করুন, আমার সঙ্গে পাস ছিল। মাদার পাস।
রোবট বলল, আপনার সঙ্গে পাস ছিল তা আমি অবিশ্বাস করছি না। পাস ছাড়া আপনি এতদূর আসতে পারতেন না। তার আগেই আপনাকে আটকে দিত।
এখন আমি কী করব?
আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা পাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। খুঁজে না পাওয়া গেলে কম্পিউটার সিডিসিকে জানানো হবে। কী করণীয় সেই ব্যাখ্যা সিডিসি দেবে। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।
কোথায় অপেক্ষা করব?
আসুন আমার সঙ্গে।
নিনিতা রোবটের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। সে যথেষ্টই চিন্তিত বোধ করছে। সে যে এখন কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে সে উপায় নেই। যারা ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়, তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম পাস।
ম্যাডাম, সর্বশেষ যে রোবট আপনার পাস দেখতে চেয়েছে, সে কি পাস দেখার পর আপনাকে ফেরত দিয়েছিল?
হুঁ।
এমন কি হতে পারে যে সে পাসটি ফেরত দেয় নি?
নিনিতা বলল, পাস রেখে দিয়ে তার লাভ কী?
রোবট বলল, লাভ কী আমি জানি না। তবে আমাদের বলা হয়েছে যে, প্রায়ই কিছু পাস হারিয়ে যাচ্ছে। হারানো পাসগুলির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
এটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু?
নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কাছেই একটি পুর্বাসন কেন্দ্র আছে। আপনাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে অপেক্ষা করাই ভালো।
নিনিতা বলল, অন্য কোথাও কি অপেক্ষা করতে পারি?
আপনি নগরীর শেষপ্রান্তে চলে এসেছেন। এখানে অপেক্ষা করার মতো জায়গা নেই।
.
পুনর্বাসন কেন্দ্র বিষয়ে নিনিতা তেমন কিছু জানে না। শুধু এইটুকু জানে জায়গাটা ভয়াবহ অপরাধীদের জন্যে আলাদা করা। এরা বাকি জীবন এখানে কাটায়।
মানুষের জন্যে মৃত্যুদণ্ড শাস্তি অনেক আগেই বাতিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড একমাত্র শাস্তি এমন সব অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনা হয়। এতকিন নভেলা রড দিয়ে তাদের চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসায় অপরাধী সম্পূর্ণ স্মৃতিশূন্য হয়ে যায়। তাকে নতুন করে সব শিখতে হয়। জীবন শুরু হয় শিশু অবস্থা থেকে। কিছু ভাগ্যবানদের অবশ্যি নতুন স্মৃতি দিয়ে সমাজে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের সংখ্যা সীমিত।
নিনিতা পুনর্বাসন কেন্দ্রের রিসিপশনে শুকনো মুখে বসে আছে। তাকে কফি খেতে দেয়া হয়েছে। সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে না। কফির কাপ পাশেই পড়ে আছে। রিপিসশনে বসা মেয়েটি (সেও নিশ্চয়ই রোবট বলল, ম্যাডাম, আপনি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছেন?
নিনিতা বলল, না।
আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভয় পাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কফিতে একটা চুমুকও দেন নি।
কফি খেতে ইচ্ছা করছে না।
আপনি মন থেকে ভয় দূর করুন। এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভয়ঙ্কর অপরাধী হলেও মানসিকভাবে শিশু। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আপনাকে একটা কামর দেব। সেখানে নিজের মতো বিশ্রাম করতে পারবেন।
নিনিতা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, বিশ্রাম করতে পারব মানে কী? আমাকে কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে?
আজ রাত এখানেই কাটাতে হবে।
তার মানে?
রোবট হাসিমুখে বলল, আপনাকে ফুড স্লিপ দিচ্ছি। টিক মার্ক দিয়ে দিন।
নিনিতা বলল, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। তার পিন নাম্বার…
রোবট নিনিতাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল, পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ করা যায় না।
তার জানা দরকার যে আমি এখানে আছি।
ম্যাডাম, অস্থির হবেন না।
রোবট নিনিতার হাতে ফুড স্লিপ এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র বিষয়ে একটি বুকলেট ধরিয়ে দিল, যেখানে এই কেন্দ্রের জন্যে প্রযোজ্য নিয়মাবলি লেখা। নিনিতা বুকলেট খুলে দেখল না। ফুড স্লিপেও টিক মার্ক দিল না। সে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইল। রোবট বলল, আগের কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ কফি কি দেব ম্যাডাম?
নিনিতা জবাব দিল না। তার মুখে থুথু জমছে। থুথু ফেলার জন্যে টয়লেটে যেতে হবে। টয়লেটে যেতে ইচ্ছা করছে না। থুথু গিলে ফেলাও যাচ্ছে না।
.
পুনর্বাসন কেন্দ্রের বত্রিশ নম্বর রুম নিনিতাকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঘর ছোট, তবে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর মতো বড় বিছানা। টয়লেট ঝকঝক করছে। পুরো কামরা কাঁচের তৈরি। ঘরের ভেতরে বসে বাইরে কী হচ্ছে সবই দেখা যায়। তবে বোতাম টিপে কাঁচকে অস্বচ্ছ রাখার ব্যবস্থাও আছে।
নিনিতা কোনো খাবার খেল না। বারান্দায় রাখা পেন্সিগ্লাসের চেয়ারে বসে রইল। সামনেই খোলা মাঠ। পূনর্বাসন কেন্দ্রের বন্দিরা সেখানে কয়েকটা রঙিন ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করছে। তাদের সবার বয়সই চল্লিশের ওপর, কিন্তু এখন তারা শিশুদের মতোই হৈচৈ করছে। দুঃখজনক দৃশ্য।
হ্যালো, আমি কি তোমার পাশের চেয়ারে বসতে পারি?
নিনিতা জবাব দিল না। সে তার চেয়ার নিয়ে একটু সরে গেল। পাশের চেয়ারে কেউ বসতে চাইলে বসবে।
আমি পদার্থবিদ শেন। স্ত্রীকে হত্যার কারণে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতে হয়েছে। তুমি কাকে খুন করেছ, তোমার স্বামীকে?
নিনিতা বলল, আমি কাউকে খুন করি নি। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন।
শেন বললেন, আমি ভাগ্যবান, দুবছর হয়ে গেছে এখানে আছি। এখনো তারা আমার ওপর এতকিন নভেলা বড় প্রয়োগ করে নি। তবে যে-কোনো একদিন নিশ্চয়ই করবে। সবুজ রঙের একটা গাড়ি আমাকে নিয়ে যাবে। গাড়ির রঙ সবুজ কেন জানো?
নিনিতা বলল, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী না। কেন আমাকে বিরক্ত করছেন?
আগামীকাল ভোরে কিংবা তার পরদিন ভোরে তোমার জন্যেও সবুজ রঙের গাড়ি আসতে পারে। স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা তুমি আর নাও বলতে পার। সুযোগ পেয়েছ, সুযোগ কাজে লাগাও। কথা বলো।
নিনিতা বলল, আপনি ভুল করছেন। আমি কোনো অপরাধ করি নি। পাস হারিয়ে ফেলেছি বলে আমাকে এখানে আনা হয়েছে। আগামীকাল ভোরে আমি বাসায় চলে যাব।
শেন বললেন, পাস হারানো অতি তুচ্ছ ঘটনা। হারানো পাস কোথায় আছে সিডিসি সঙ্গে সঙ্গে জানবে। তার জন্যে তোমাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনতে হয় না। একটা কথা তোমাকে বলি। পুনর্বাসন কেন্দ্রে কেউ এসেছে, অথচ তার ওপর এতকিন নভেলা রড প্রয়োগ করা হয় নি এমন কখনো ঘটে নি।
নিনিতা হতভম্ব গলায় বলল, আমি কী করেছি যে আমাকে এতকিন নভেলা বড় দেয়া হবে?
শেন বললেন, আমরা মানুষ রোবটদের হাতের গিনিপিগ। তারা নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের নিয়ে করছে। কেন করছে আমরা জানি না। জানার উপায়ও নেই। এখন কি বলব, সবুজ রঙের গাড়ি কেন আসে?
নিনিতা দিশাহারা চোখে তাকিয়ে আছে। পাশে বসে থাকা মানুষটা কী বলছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
শেন বললেন, এতকিন নভেলা রডের রঙ সবুজ। এই জন্যে গাড়িটা আসে সবুজ রঙের। এক ধরনের Ritual বলতে পার। রডে তীব্র কম্পাংকের ওমিক্রন রশ্মির Pulse তৈরি করা হয়, যা ধাপে ধাপে মস্তিষ্কের সব কোষে পাঠানো হয়। অত্যন্ত কষ্টকর একটি প্রক্রিয়া, যা মৃত্যুর মতোই। কিংবা কে জানে হয়তো মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর।
আপনি এত কিছু জানেন কীভাবে?
এতকিন নভেলা রডের থিওরি ছাত্রজীবনে আমার আবিষ্কার। আমার নাম শেন এতকিন। এই আবিষ্কার আমার ওপরই একসময় প্রয়োগ করা হবে তা ভাবি নি। হা হা হা।
শেন হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়েছে। তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক না করাটা হবে চূড়ান্ত অভদ্রতা। নিনিতা হাত বাড়াল।
তোমার হাত তুলার মতো নরম। আমার স্ত্রীর হাতও নরম ছিল। বলা হয়ে থাকে, যাদের হাত নরম তাদের হৃদয় হয় কঠিন। তোমার হৃদয় কি কঠিন?
জানি না।
আমি কীভাবে আমার স্ত্রীকে খুন করেছি সেই গল্প শুনতে চাও।
না।
যে-কোনো একটা বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
নিনিতা হতাশ গলায় বলল, আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমি আপনার সঙ্গে কোনো বিষয়েই কোনো আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না।
মানসিক বিপর্যয় কাটানোর জন্যেই আলোচনা দরকার। আচ্ছা শোন, একটা মজার বিষয় শোন। এতর্কিন নভেলা রডের সাহায্যে তোমার সঞ্চিত স্মৃতি যদি কোনো পুরুষকে দিয়ে দেয়া যায়, তাহলে কেমন হয়? সে শারীরিকভাবে পুরুষ, অথচ সমস্ত স্মৃতি একজন মহিলার। কেমন মনে হচ্ছে?
আমার কোনো কিছুই মনে হচ্ছে না! প্লিজ চুপ করুন।
শেন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এতকিন নভেলা রড দিয়ে একটা পশুর স্মৃতিও মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়। একটা মাকড়সার স্মৃতি তোমার ভেতর ঢুকিয়ে দিলে কেমন হবে! তুমি রূপবতী একজন তরুণী, অথচ তোমার সমস্ত স্মৃতি একটি মাকড়সার স্মৃতি। তুমি জানবে কবে তোমার জালে একটা পোকা ধরা পড়েছিল। কবে তুমি তোমার সঙ্গী একটি পুরুষ মাকড়সার সঙ্গে যৌনক্রিয়া করেছ। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা। আচ্ছা, তুমি কি মাকড়সার যৌনজীবন সম্পর্কে কিছু জানো?
নিনিতা উঠে দাঁড়াল। অর্ধ উন্মাদ এই মানুষটার সঙ্গে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
শেন বললেন, চলে যাচ্ছ? তোমার সঙ্গে গল্প করে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছিলাম।
নিনিতার ঘরের বিছানা আরামদায়ক। সারারাত তার একফোঁটা ঘুমও হলো না। সে রাত কাটালো বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। শেষরাতের দিকে তার ঝিমুনির মতো এসেছিল। তখন সে স্বপ্নে দেখল—সে মানুষ না, প্রকাণ্ড একটা মেয়ে মাকড়সা। পেটে ডিম নিয়ে দেয়াল বেয়ে হাঁটছে।
ক্রেজি টিটান
বৃহস্পতির উপগ্রহ টিটানের বিশেষ এক ধরনের গুলোর শিকড় থেকে প্রস্তুত পানীয়। বিশ্বব্রহ্মারে তিনটি সেরা পানীয়র একটি। এই পানীয় আনন্দময় মাদকতা, স্বপ্নাচ্ছন্নতা তৈরি করে। কিছু মাত্রার হেলুসিনেশনও তৈরি হয়। বলা হয়ে থাকে, ক্রেজি টিটান পানের অভিজ্ঞতা বর্ণনার অতীত।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
পৃষ্ঠা ৭০০০ (খাদ্য ও পানীয়)
বড় ধরনের দুর্ঘটনার সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। কুন মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে পারছে না। সে ভেবেই পাচ্ছে না নিনিতা কীভাবে পুনর্বাসন কেন্দ্রে উপস্থিত হলো। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করতে পারছে না। পুনর্বাসন কেন্দ্র যোগাযোগের বাইরে। কেউ চেষ্টা করলে বড় ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তারপরেও সে শহরের মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। শহরের মেয়র (রোবট, টাইপ T3} অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বলেছেন, পুনর্বাসন কেন্দ্র মেয়রের এলাকার বাইরে। আমি কোনো সাহায্যই করতে পারছি না। আপনার অস্থিরতা বুঝতে পারছি, তবে অস্থিরতা দূর করার ব্যবস্থা করতে না পেরে লজ্জিত বোধ করছি।
মীনকে নির্বিকার মনে হচ্ছে। সে দশ রঙের লিপস্টিক নিয়ে বসেছে। ঠোঁটে দিচ্ছে এবং মুছে ফেলছে। আয়নায় দেখছে। তার আচার-আচরণ মোটেই রোবটের মতো না। আর দশটা মেয়ের মতো। যেন এই মুহূর্তে সাজ করাটা জরুরি। বড় কোনো উৎসবে যাবার পূর্বপ্রস্তুতি।
কুন বলল, তোমার রূপচর্চায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
মীন তার দিকে না তাকিয়েই বলল, হ্যাঁ।
আমি খুবই অস্থির বোধ করছি। আমার অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করতে পার?
মীন এবার তার দিকে তাকাল। স্পষ্ট গলায় বলল, না। কারণ তোমাকে অস্থির করার জন্যেই ঘটনা সাজানো হয়েছে।
তার মানে?
সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত।
বুঝিয়ে বলো।
তোমার স্ত্রী ঘর থেকে বের হবে। মা-কেন্দ্রে যাবে। তার ডিম্বাণু দিয়ে আসবে। পথ হারিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে উপস্থিত হবে। সবই সাজানো।
কে সাজিয়েছে?
মূল কম্পিউটার সিডিসি।
কেন সাজিয়েছে?
এই অংশটি আমার কাছে পরিষ্কার না। তবে আমি চিন্তা করছি। কিছু বের করতে পারলেই তোমাকে বলব। আমার উপদেশ হচ্ছে—তুমি সাজানো একটি ঘটনার একজন। এখানে অস্থির হওয়া কোনো কাজের কথা না। আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ঠোঁটে এই নীল রঙটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?
কুৎসিত লাগছে। তোমাকে মাছ মাছ মনে হচ্ছে।
মাছের ঠোঁট নীল না, আমাকে মাছ মাছ কেন লাগবে?
কেন লাগবে এই উত্তর আমার কাছে নেই। আমার কাছে মাছ মাছ লাগছে।
মেয়েরা ঠোঁটে কেন রঙ লাগায় জানো?
না।
ঠোঁটকে বিশেষভাবে আলাদা করতে চায়। যেন ঠোঁটকে মনে হয় শরীরের বাইরের একটি অংশ।
আমাকে এইসব কেন শোনাচ্ছ?
তোমার অস্থিরতা কমানোর জন্যে শোনাচ্ছি।
আমার অস্থিরতা কমছে না।
মীন একটু ঝুঁকে এল কুনের দিকে। সে গলা নামিয়ে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, এই মুহূর্তে তোমার স্ত্রী আশেপাশে নেই। একজন অতি রূপবতী তোমার পাশে বসে আছে। একজন বুদ্ধিমান পুরুষ হিসেবে সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত না?
আমি বুদ্ধিমান না।
মীন হালকা গলায় বলল, তুমি বুদ্ধিমান কিনা এক্ষুনি টের পাব! আচ্ছা বলো, আগের কথাগুলি আমি ফিসফিস করে কেন বলেছি? আর কেউ পাশে নেই। ফিসফিসানি অপ্রয়োজনীয়। তারপরেও কেন ফিসফিস করে কথা বললাম?
জানি না।
অতি প্রাচীনকালে মানুষ যখন বনেজঙ্গলে ঘুরত, তখন কোনো বিপদ দেখলেই একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে সতর্ক করত। এই ঐতিহাসিক ব্যাপারটি মানুষ তার জিনে করে নিয়ে এসেছে। এখনো কেউ যখন ফিসফিস করে, তখন পাশের জন সতর্ক হয়ে যায়। তার চিন্তাভাবনা স্থির হয়ে যায়। সময় তার কাছে থেমে যায়।
কেন এইসব আমাকে শোনাচ্ছি?
আমার প্রতি তোমাকে কৌতূহলী করার চেষ্টা করছি। আমার ধারণা সাজানো ঘটনার এটাও একটা অংশ। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তুমি আমার প্রতি কৌতূহলী হবে। হয়তো অতি ঘনিষ্ঠ কিছু সময় আমার সঙ্গে কাটাবে।
এই কাজ আমি কখনো করব না। একটা যন্ত্রকে আমি ভালোবাসব না, তাকে বিছানায় নিয়ে যাব না।
তোমার স্ত্রী এবং তুমি তোমরাও কিন্তু যন্ত্র। খুব যে নিখুঁত যন্ত্র তাও না। তোমাদের তুলনায় আমি প্রায় নিখুঁত একজন। তোমাকে ভুলানো আমার জন্যে কোনো ব্যাপারই না। পুরুষ সবচেয়ে সহজে ভোলে তার প্রশংসায়। আমি তোমার। প্রশংসা শুরু করলেই কিন্তু সিনারিও বদলে যাবে।
আমার প্রশংসা করার কিছু নেই।
স্ত্রীর প্রতি তোমার আনুগত্যকে তুমি ছোট করে দেখছ কেন? তোমার স্ত্রীও তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কাজেই তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসার কিছু তোমার মধ্যে আছে।
সেটা কী?
আমার ধারণা তোমার সারল্য। তুমি রূপবান একজন মানুষ। কিন্তু মেয়েরা পুরুষের রূপকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে না। তারা পুরুষের রূপকে তার দুর্বলতা ভাবে। তারা গুরুত্ব দেয় পুরুষের অনুভূতি প্রবণতাকে। যার অনুভূতি যত প্রবল সে ততই আকর্ষণীয়।
কুন বলল, আমার অনুভূতি প্রবল?
অবশ্যই। আরেকটা বিষয় বলব?
বলো।
সেন্ট্রাল কম্পিউটার সেইসব পুরুষ এবং রমণীকে সন্তান নেয়ার সুযোগ দেয় যারা শ্রেষ্ঠ। যাদের সন্তানরা আরো শ্রেষ্ঠ হবে। বলা হয়ে থাকে বিষয়টা লটারিতে ঠিক করা হয়। তা কিন্তু না।
তুমি জানলে কী করে লটারি হয় না?
লটারিতে হলে তোমরা শুরুতেই বাদ পড়তে। তোমার স্ত্রী বয়সের কারণে বাদ পড়ত।
কুন বলল, হয়তো কোনো একটা ভুল হয়েছে। বয়সের ব্যাপারটা সেন্ট্রাল কম্পিউটার খেয়াল করে নি।
সেন্ট্রাল কম্পিউটার কখনো ভুল করে না। তার সবকিছুই হিসাবের মধ্যে। এখন কি একটা দুঃসংবাদ শুনবে?
হঠাৎ দুঃসংবাদ দিতে চাচ্ছ কেন?
অন্যের দুর্ভাগ্যের কথা শুনলে নিজের দুর্ভাগ্যর যন্ত্রণা অনেকখানি কমে।
কুন বলল, দুঃসংবাদটি কী বলো।
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চতুর্থ শহরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে V-305 ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে।
সর্বনাশ!
মীন বলল, সেই শহরের সমস্ত মানুষকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হয়তো এর মধ্যে সেই নির্দেশ কার্যকরও হয়েছে।
তুমি জানলে কীভাবে?
অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ সব SF রোবটকে জানানো হয়। চতুর্থ শহরে মেটি নয়টা SF রোবট আছে। তাদের ভাগ্যও মানুষের মতোই।
তাদেরকে কি ধ্বংস করে ফেলা হবে।
না। SF রোবট ধ্বংস করা সম্ভব না। তবে তারা সেই শহর ছেড়ে কখনো বের হতে পারবে না। তাদেরকে থাকতে হবে সিল করা শহরের ভেতরই। যদি কখনো V-305 ভাইরাস দূর করা সম্ভব হয়, তাহলেই সেই শহরে আবার বসবাস শুরু হবে। SF রোবটরা তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করবে। তবে…
কুন বিরক্ত গলায় বলল, তবে বলে থামলে কেন?
মীন বলল, এখন পর্যন্ত কোনো শহরকে ভাইরাসমুক্ত করা যায় নি। একবার ভাইরাসের আক্রমণ হওয়া মানে শহরের মৃত্যু।
কুন বলল, ভাইরাসমুক্ত করার চেষ্টা কি কখনো হয়েছে?
মীন বলল, জানি না। তবে চেষ্টা নিশ্চয়ই হয়। তা না হলে SF রোবটগুলিকে সরিয়ে আনা হতো। একটা SF রোবট তৈরি করা আর একটা আস্ত শহর তৈরি করার খরচ একই। SF রোবটের এনার্জি কনভার্টারে হিলিয়াম থ্রি পরমাণু ব্যবহার করা হয়। হিলিয়াম থ্রি আনতে হয় বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ থেকে।
তুমি হিলিয়াম থ্রি-তে চলো?
হুঁ। তবে আমরা তোমাদের মতো খাদ্য গ্রহণ করেও এনার্জি কনভার্টারে খাদ্য থেকে এনার্জি তৈরি করতে পারি। এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তুমি কি থ্রি-ডি পর্দাটা চালু করবে? বিশেষ ঘোষণা আসার কথা।
কী ঘোষণা?
চতুর্থ শহর সিল করা হয়েছে, এই উপলক্ষে এই শহরে আনন্দ দিন ঘোষণা করা হতে পারে। এই শহর তো এখনো টিকে আছে। কাজেই আনন্দ দিন। উৎসবের দিন।
কুন থ্রি-ডি পর্দা চালু করল। সেখানে নতুন আবিষ্কার করা সিরাম নক্ষত্রের একটি গ্রহে পাওয়া প্রাচীন সভ্যতার ওপর অনুষ্ঠান হচ্ছে। অতি সুসভ্য কোনো এক প্রাণী একসময় মহান সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। তারা নেই, রেখে গেছে সভ্যতার সামান্য কিছু নমুনা। যা দেখে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাদের তৈরি ক্রিস্টাল কিউব থেকে বিরতিহীন সঙ্গীত তৈরি হয়। যার একটি সুরের সঙ্গে অন্য সুরের কোনো মিল নেই। সঙ্গীতের সঙ্গে ক্রিস্টাল কিউবের বর্ণ পরিবর্তিত হয়। পালসারের মতো নির্দিষ্ট সময় পর সেখান থেকে শক্তিশালী গামা রেডিয়েশন হয়।
কুন আগ্রহ নিয়ে প্রোগ্রাম দেখছে। ভিনগ্রহের সভ্যতা নিয়ে প্রোগ্রামগুলি এমনভাবে তৈরি যে কিছুক্ষণ দেখলেই আটকা পড়ে যেতে হয়। হঠাৎ প্রোগ্রাম প্রচার বন্ধ হলো। হাস্যমুখী একজন তরুণী (হয়তো সেও একজন SF রোবট) জানাল–
কিছুক্ষণ আগে এই শহরকে সম্মান দেখানোর জন্যে আজকের
দিনটিকে আনন্দ দিন ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ এই শহর এখন
পর্যন্ত V-305 ভাইরাস মুক্ত। আজ সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত শহরের
চন্দ্রোদ্যান সবার জন্যে উন্মুক্ত। সেখানে পানীয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
বৃহস্পতির উপগ্রহ টিটানের বিখ্যাত পানীয় ক্রেজি টিটান থাকবে।
সবাইকে পনেরো মিলিলিটারের দুটি করে বোতল দেয়া হবে। এর বেশি নয়।
মহান সঙ্গীতকার আহান আনন্দ দিবস উপলক্ষে চন্দ্রগীতি শোনাবেন,
এমনটি আমরা আশা করছি। যদিও নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো হচ্ছে, চতুর্থ শহর সিল করে দেয়া
হয়েছে। সেই শহরবাসীদের জন্যে আমাদের গভীর সমবেদনা। আমরা
আনন্দ দিনে তাদের স্মরণ করছি।
মীন বলল, তুমি কি চন্দ্রগীতি শুনতে যাবে?
হুঁ।
ক্রেজি টিটান পানীয়টা তুমি কি আগে কখনো খেয়েছ?
দুবার খেয়েছি।
খেতে কেমন?
কুন জবাব দিল না। মীন বলল, টিটানের পানীয় শব্দটা শোনার পরপরই তোমার চোখ চকচক করা শুরু করেছে। এ থেকেই বুঝতে পারছি খেতে কেমন। আমরা SF রোবটরা এই স্বাদ কখনোই বুঝব না। সামান্য দুঃখিত বোধ করছি।
কুন বলল, কিছু দুঃখবোধ থাকা ভালো।
.
নাম এবং পিন নাম্বার দিয়ে কুন দু’টা পনেরো মিলিলিটারের বোতল পেয়েছে। মীন নিয়েছে আরো দু’টা। একজন মানুষ যা যা নিতে পারে একজন SF রোবটও পারে। তাদেরকে মানুষ থেকে আলাদা করার কোনো নিয়ম নেই।
পানীয় যে দিচ্ছে (সাধারণ s টাইপ রোবট) মীন তাকে বলল, আমার বন্ধুর স্ত্রীর জন্যে কি আমি আরো দু’টা বোতল নিতে পারি?
তিনি কোথায়?
তিনি বিশেষ কারণে আসতে পারেন নি। বিশেষ কারণ কি ব্যাখ্যা করতে
না।
আরো দু’টা বোতল পাওয়া গেল। কুন আনন্দিত গলায় বলল, মীন ধন্যবাদ।
মীন বলল, আমি আরো দু’টা বোতলের ব্যবস্থা করব। তুমি আনন্দ দিবস উদযাপন কর।
আরো দুবোতল কীভাবে পাবে?
গাধাটাইপ রোবটের সঙ্গে কিছু Tricks করব। কী Tricks তোমার না জানলেও চলবে।
কুন আবারো বলল, ধন্যবাদ। নিনিতার কথা এখন আর তার মনে আসছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে তার জীবনটা খারাপ কাটে নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রগীতি শুরু হবে। পকেটে ছয় বোতল স্বর্গীয় পানীয়। এরচেয়ে বেশি একজন মানুষের আর কী-ই বা চাইবার আছে?
মহান আহান চলে এসেছেন। আজ তাঁকে বিষণ্ণ এবং অস্থির লাগছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমার আজকের সুর চতুর্থ শহরের হতভাগ্য মানুষদের জন্যে। যদিও সেই সুর তাদেরকে স্পর্শ করবে না। এখনো গান শুরু করেন নি। সামান্য কিছু কথা, এতেই পরিবেশ বদলে গেছে। আহান তার কণ্ঠের জাদুকরী বিষাদ ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। বিষাদ ক্রমেই বাড়তে থাকবে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়বে। আহান গান শুরু করেছেন।
হে চন্দ্র! তুমি আমাকে
তোমার কাছে টেনে নাও।
তোমার শীতল শরীর স্পর্শ করতে দাও।
আমি তোমার স্পর্শের বাইরে কখনো থাকব না।
তোমাকে ভিজিয়ে রাখব অশ্রুজলে।
কুনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মীন কুনের একটা হাত টেনে তার কোলে রাখল। কোমল গলায় বলল, তোমাদের মানুষদের প্রধান সমস্যা কী জানো? তোমাদের প্রধান সমস্যা, তোমরা গভীর আবেগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পার না। তোমাদের সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।
তাই বুঝি?
হ্যা তাই। এবং তোমরা একটা আবেগের সঙ্গে অন্য আবেগের যোগসূত্র তৈরি করতে পারি না।
তোমরা পার?
হা পারি। তোমরা লজিক পছন্দ কর, কিন্তু লজিক ব্যবহার করতে পছন্দ কর না।
এইখানেই আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব। আমরা রোবট না।
যে জিনিস তোমরা পছন্দ কর তার চর্চা না করাটা হাস্যকর না?
আমি গান শুনছি। তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
মীন বলল, আমি এখন এমন একটা কথা বলব যে গান শুনতে ভালো লাগবে না। মহান আহান-সঙ্গীত আর কোনোদিনই তুমি শুনবে না।
কুন বলল, কথাটা কী?
মীন বলল, কথাটা হচ্ছে মহান আহান মনুষ্য সমাজের কেউ না। তিনি আমাদের একজন। একটি বিশেষ ধরনের SF রোবট।
কী বলছ এইসব?
তুমি যদি লজিক ব্যবহার করতে তাহলে অনেক আগেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে। পৃথিবীর সব কটি শহরে আহানের মতো একজন আছে যে শহরবাসীদের মাতিয়ে রাখে। তাদের গলার ব্যাপ্তি মনুষ্য সমাজের কারোর নেই। থাকার কথাও না। তুমি লক্ষ কর নি, আহান গান করতে করতে একসময় মানুষের শ্রুতি সীমা’র বাইরে চলে যান। তখন কিন্তু তিনি থামেন না। গান গেয়েই চলেন।
সব শহরে একজন আইন আছেন?
অবশ্যই, তবে তাদের সবার নাম আহান না। চতুর্থ শহরে যিনি আছেন তার নাম—প্রপার। তিনি গাইতেন সিরাম নক্ষত্রগীতি। তার সুর কিন্তু অবিকল চন্দ্রগীতির মতোই। তুমি কি আহানের সঙ্গে কথা বলতে চাও? আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
কথা বলতে চাই না।
অহান দ্বিতীয় গান শুরু করেছেন। এই গান কুনকে স্পর্শ করছে না। প্রচণ্ড রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রাগটা কার ওপর তাও সে ধরতে পারছে না।
মীন বলল, টিটানের পানীয় বোতলটা খুলে দেব? খাবে?
না।
মীন বলল, অতি অপূর্ব এই সুর তোমার গুনতে ভালো লাগছে। ভালো লাগাটাই প্রধান। অন্যসব কিছুই অপ্রধান। সুরটা কে তৈরি করছে তা প্রধান হতে পারে না।
আমার কাছে প্রধান। আমার খুবই খারাপ লাগছে। এত খারাপ কেন লাগছে তাও বুঝতে পারছি না।
মীন বলল, তোমরা মানুষরা মনে কর তোমরাই শ্রেষ্ঠ। যখন দেখ তা-না তখনি অস্থির হয়ে পড়। SF রোবটদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলে জীবন সহনীয় হবে।
জীবন সহনীয় করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
বাসায় চলে যেতে চাও?
হ্যা চাই।
আমরা দুজন হেঁটে চলে যাব। সবাই কিন্তু আমাদের দিকে তাকাবে। মহান। আহানও তাকাবেন। কারণ তার সুর তুচ্ছ করে কেউ চলে যায় না।
আমি যাব।
কুন উঠে দাঁড়াল। সে বাসার দিকে রওনা হয়েছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে মীন। সবাই অবাক হয়ে এই দুজনকে দেখছে। মহান আহানও তাকিয়ে আছেন। তার চোখে বিস্ময়।
ছয় বোতল ক্রেজি টিটান তার পকেটে, অথচ সে একটির মুখও খোলে নি। কুনের নিজের কাছেই অবাক লাগছে। এখন মনে হচ্ছে নিনিতা যেদিন ফিরবে সেদিন। উৎসব করে বোতলগুলি খোলা হবে। ঘরে ফেরার কিছুক্ষণ পরই থ্রি-ড়ি পর্দায় মহান আহানের বিষণ্ণ মুখ দেখা গেল। কুন হকচকিয়ে গেল। আহান তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। এরকম তো কখনো হবার কথা না। কোনো ভুল কি হচ্ছে? হেলুসিনেশন? দুশ্চিন্তায় এরকম হতে পারে।
আমি কি কুনের সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ।
আজ আপনাকে দেখলাম আমার গানের মাঝখানে উঠে চলে যেতে। আমার সুর কি আপনার পছন্দ হচ্ছিল না?
আপনার সুর অপছন্দ করার মতো স্পর্ধা আমার নেই মহান আহান। আমি যখন জানলাম আপনি আমাদের একজন না, আপনি একটি SF রোবট, তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতই খারাপ হলো যে উঠে চলে এলাম।
মূল বিষয় হচ্ছে সুর। সেই সুর একটি যন্ত্র তৈরি করছে নাকি চন্দ্ৰবৃক্ষ তৈরি করছে তা ধর্তব্য নয়।
মহান আহান! আপনার সঙ্গে কোনো যুক্তিতে যেতে চাচ্ছি না।
মানুষ পরাজিত হতে পছন্দ করে না। কিন্তু একদিন অবশাই তাকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সবারই উচিত তার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া।
কুন বলল, মহান আহান! আপনার গানের মাঝখানে উঠে চলে এসে আপনাকে যে অপমান করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মান-অপমান বোধ থেকে আমি মুক্ত।
কুন বলল, মান-অপমান বোধ একটি মানবিক আবেগ। আপনার তা থেকে মুক্ত থাকারই কথা। বেশির ভাগ রোবটই তার থেকে মুক্ত।
আহনি বললেন, SF ধরনের রোবটের কিন্তু মান-অপমান বোধ আছে। আপনার পেছনে পেছনে যে তরুণীটি গিয়েছেন তিনি SF ধরনের রোবট। তার মান-অপমান বোধ ভালোই আছে। আমিও যে একজন SF রোবট তা কি আপনি তার কাছে জেনেছেন?
হা।
আহানের ঠোঁটে সামান্য হাসি দেখা গেল। তিনি ঠোঁটের হাসি দ্রুত মুছে ফেলে বললেন, তিনি যে-কোনো কারণেই হোক আপনাকে বিভ্রান্ত করেছেন। আমি মানব সম্প্রদায়েরই একজন।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, প্রতিটি শহরে কি একজন করে আহান নেই? চতুর্থ শহরে যিনি আছেন তাঁর নাম দ্রপার।
আহান বললেন, আমি যখন সেই শহরে যাই তখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দ্রপার নামে। আমার কোনো নির্দিষ্ট শহর নেই। আমি শহরে শহরে ঘুরে চন্দ্রগীতি করি। আমি এখন বিদায় নেব। আপনার জীবন হোক চন্দ্রময়।
পর্দায় আহানের ছবি মুছে গেল। কুন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, মীন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কুন বলল, তুমি কি আহানের কথা শুনেছ?
হ্যাঁ।
উনি যা বলেছেন তা কি সত্যি?
অবশ্যই সত্যি।
তুমি আমাকে আহান বিষয়ে এই কথাটা কেন বললে?
SF রোবটরা মানুষের মতো মিথ্যা কথা বলতে পারে, এটা জানানোর জন্যে বলেছি।
তাতে তোমার লাভ?
লাভ অবশ্যই আছে। অতি দ্রুত তুমি আমাকে মানব সমাজের একজন ভাবতে শুরু করবে। কোনো একদিন হয়তো তুমি আমার প্রেমে পড়বে। এমনও হতে পারে যে, তোমার স্ত্রী নিনিতার নিষিক্ত ডিম্বাণু আমার জরায়ুতে স্থাপন করা হবে। আমাদের একটি সন্তান হবে। আমরা তার নাম দেব আহান।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? পাগলের মতো এইসব কী বলছ?
মানুষ যেমন মাঝে-মাঝে পাগলের মতো আচরণ করে, আমরাও করি। ভালো কথা, তুমি ছয় বোতল টিটান পানীয় রেখে দিয়েছ। আমার ধারণা, তোমার ইচ্ছা তোমার স্ত্রী এলে বোতলগুলি খুলে উৎসব করবে। এই ঘটনা কখনো ঘটবে না। সে ফিরে আসবে না। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে যায় সে ফেরে না।
কী বলছ তুমি?
আমি তোমাকে পরিস্থিতি স্বীকার করে নিতে বলছি। এসো, বোতলগুলি খোলা যাক। আমি একটা খাব। পাঁচটা তোমার!
নিনিতা ফিরবে না?
লজিক তাই বলে। লালকুঠিতে যারা যায় তারা ফেরে না। দুএকজন ফেরে। তবে তাদের না ফেরাই ভালো।
না ফেরাই ভালো কেন?
মীন বলল, তারা অন্যের স্মৃতি নিয়ে ফেরে। তোমার স্ত্রী যদি ফিরে সে অন্য কেউ হয়ে ফিরবে। এই প্রসঙ্গ বন্ধ থাকুক। চল অন্য প্রসঙ্গে যাই।
কুন বলল, আমি নিনিতার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। তাকে দেখতে চাচ্ছি। তার কোনো উপায় কি আছে?
মীন স্বাভাবিক গলায় বলল, আছে। খুব সহজ উপায় আছে।
সহজ উপায়টা বলো।
তোমাকে একটা খুন করতে হবে। আমাকে ধ্বংস করে ফেললেও হবে। একটা হাতুড়ি নিয়ে আমার মাথায় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাড়ি দাও। এতে কাজ হবার কথা।
কুন তাকিয়ে আছে মীনের দিকে। মীনের মুখ হাসি হাসি। যেন এইমাত্র সে দারুণ মজার কোনো কথা বলেছে।
ভাইরাস V-305
ভয়াবহ ভাইরাস। এই দ্রুত পরিবর্তন ক্ষমতার ভাইরাস মানুষের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে নষ্ট করে দেয়। দশ থেকে বারো ঘন্টার মধ্যে অবর্ণনীয় কষ্টের মৃত্যু। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত নেয়া যায় নি।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
(রোগব্যাধি পরিচ্ছেদ)
নিনিতা লালকুঠিতে কতদিন পার করেছে সে জানে না। এখানে সময় এবং তারিখ জানার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোথাও কোনো থ্রিডি পর্দা নেই। ঘড়ি নেই, ক্যালেন্ডার নেই। জায়গাটা যেন সময়ের বাইরে। দিন-রাতের প্রভেদ বোঝা যাচ্ছে। আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেন্দ্র পরিচালকদের সঙ্গে অনেক দেনদরবার করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল। যেসব প্রশ্ন নিনিতা তাকে করবে বলে ভেবেছিল, তার কিছুই করা হয় নি। অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে ফিরে এসেছে।
নিনিতার প্রশ্ন : আজ কী বার? এবং এখন কটা বাজে?
উত্তর : আপনার সময় এবং তারিখ জানার প্রয়োজন নেই।
নিনিতার প্রশ্ন : কেন প্রয়োজন নেই।
উত্তর : কম্পিউটার সিডিসি ঠিক করেছেন প্রয়োজন নেই। কাজেই প্রয়োজন নেই।
নিনিতার প্রশ্ন : ভয়ঙ্কর সব অপরাধীকে এখানে রাখা হয়েছে। তাদের স্মৃতি নষ্ট করা হচ্ছে। আমি কী অপরাধ করেছি?
উত্তর : এর উত্তর সিডিসি জানে। আমি জানি না।
নিনিতার প্রশ্ন : আমি কোনো এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। কার কাছে প্রতিকার চাইব?
উত্তর : সিভিসির কাছে।
নিনিতার প্রশ্ন : প্রতিকার কীভাবে চাইব? কার মাধ্যমে চাইব?
উত্তর : লালকুঠির বাসিন্দারা কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।
নিনিতার প্রশ্ন : আমি কি একবারের জন্যে আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?
উত্তর : লালকুঠির বাসিন্দারা কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।
মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ। সে সব অবস্থায় সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। বৎসরের পর বত্সর মহাকাশযানের ছোট্ট একটা কামরায় বাস করতে তার সমস্যা হয় না। নিনিতার সমস্যা হচ্ছে। সে কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। কয়েকদিন আগে আয়নায় নিজেকে দেখে নিনিতা চিনতে পারল না। হঠাৎ যেন তার বয়স বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে ঘোলাটে। তার সারাক্ষণ পানির পিপাসা হচ্ছে, অথচ সে সেভাবে পানি পাচ্ছে না। ফুড প্রো দৈনিক পানির রেশনের বাইরে একফোঁটা পানিও দেবে না। নিনিতা তার ইউনিট দিয়ে পানি কিনতে পারে, কিন্তু লালকুঠিতে তাও সম্ভব না।
নিনিতার পাশের কামরায় থাকেন বৃদ্ধ শেন। তিনি বেশ হাসিখুশিই আছেন। তাকে কখনো চিন্তিত মনে হয় না। বরং মনে হয় তিনি লালকুঠিতে হলিডে কাটাতে এসেছেন। শেন কয়েকবারই নিনিতার সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করেছেন। নিনিতার প্রতিবারই অসহ্য বোধ হয়েছে। ভদ্রলোকের গল্পের বিষয়বস্তু একটাই। দেখা হওয়া মাত্র তিনি বলবেন, নিনিতা, আমার স্ত্রীকে আমি কীভাবে হত্যা করি সেই গল্পটা শুনতে চাও? খুবই মজা পাবে।
এই গল্পটা আমি শুনতে চাচ্ছি না।
সে এক মিনিট আগেও বুঝতে পারে নি যে, আমি তাকে হত্যা করব। হয়েছে কী শোন …
আমি আপনাকে বলেছি যে, এই গল্প শুনতে চাচ্ছি না।
হত্যার কায়দাটা শুনলে তোমার ভালো লাগবে। আমি তাকে বললাম, এই তোমার গলাটা তো অন্য মেয়েদের তুলনায় লম্বা। কতটুকু লম্বা মেপে দেখি। বলেই দুহাতে তার গলা চেপে ধরলাম।
নিনিতা এইটুকু শুনে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ধারণা এই লোক তার স্ত্রীকে যেভাবে খুন করেছে তাকেও খুন করবে। পুরনো টেকনিক ব্যবহার করবে না। নতুন কোনো টেকনিকে যাবে।
লোকটির ধারেকাছে নিনিতা থাকতে চায় না। ডাইনিং হলে খেতে বসার সময় শেন এসে তার পাশে বসবেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো গল্প ফাঁদবে। নিনিতা এই লোকের কোনো গল্পই শুনতে চায় না, তারপরেও তাকে শুনতে হয়।
নিনিতা! তুমি কি ক্রীতদাস শব্দটার সঙ্গে পরিচিত?
নিনিতা জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
শেন বলল, আমরা যন্ত্রের হাতের ক্রীতদাস। যন্ত্রের ইচ্ছার বাইরে যাবার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই। আচ্ছা নিনিতা, তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর?
হা।
স্ত্রীকে হত্যা করেছি এইজন্যে?
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখ না কেন? সিডিসি আমাকে বাধ্য করেছে খুন করতে।
বাধ্য করবে কেন?
যাতে তারা আমাকে এখানে এনে আটকে ফেলতে পারে। তুমি ঠান্ডা মাথায় বলো, তোমার প্রতি তারা কি অন্যায় করেছে?
হ্যাঁ।
তাহলে তো আমার প্রতিও অন্যায় করতে পারে। তাদের পরিকল্পনায় আমি স্ত্রীকে খুন করে বিচারের অপেক্ষায় আছি। অদ্ভুত না?
আমি আপনার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আগ্রহ বোধ করছি না।
তোমাকে কথাবার্তা চালাতে হবে না। তুমি শুধু শুনে যাও। ভাইরাস V-305 বিষয়ে আমার একটা থিওরি আছে। থিওরিটা শুনতে চাও?
না।
শুনতে না চাইলেও বলি। যে-কোনো মুহূর্তে তারা আমার স্মৃতি নষ্ট করে দেবে। তখন আর কাউকে কিছু বলে যেতে পারব না। আমার ধারণা V-305 ভাইরাসের পুরোটাই ভুয়া। এই অজুহাত তুলে তারা শহরের সব মানুষ মেরে ফেলছে।
তাদের লাভ কী?
পৃথিবী মানুষশূন্য করবে। পৃথিবীতে রাজত্ব করবে SF রোবটরা।
নিনিতা বলল, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন রোবট আইন আছে। এই আইনে কোনো রোবট মানব সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারবে না।
শেন বললেন, তারা আইনের একটা ফাঁক বের করেছে।
কী ফাঁক?
কী ফাঁক তা জানি না। তবে চিন্তা করছি। চিন্তা করে কিছু বের করতে পারলে তোমাকে জানাব।
আমাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।
তাও ঠিক। স্মৃতি নষ্ট হওয়া মানেই সব জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ থেকে ভেজিটেবল। ধীরে ধীরে আবার ভেজিটেবল থেকে মানুষ। ততদিনে তোমার একশ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে। পানি বন্ধ। তোমাকে বেঁচে থাকতে হলে ক্রেডিট খরচ করে পানি কিনতে হচ্ছে। নিনিতা, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেব।
আপনার বুদ্ধির আমার প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন না থাকলেও বুদ্ধি দিয়ে রাখি। তুমি ডায়েরি লেখা শুরু কর। স্মৃতি নষ্ট করার পর আবার যখন বুঝতে শিখবে, তখন ডায়েরি পড়ে অনেক কিছু জানবে যার স্মৃতি তোমার নেই।
নিনিতা বলল, ওরা ডায়েরি নষ্ট করে ফেলবে না?
শেন বললেন, না। রোবটিক আইনের একটি কঠিন ধারা আছে। মানুষের সৃষ্টিশীলতায় কোনো বাধা দেয়া যাবে না। এবং তার প্রতিটি সৃষ্টি রক্ষা করতে হবে। তুমি যদি কাগজে কাকের ঠ্যাং বর্গের ঠ্যাং আঁক তাও তারা রক্ষা করবে।
নিনিতা বলল, কেন?
শেন বললেন, সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারটি রোবটদের নেই। তাদের সর্ব কর্মকাণ্ড লজিকনির্ভর। সৃষ্টিশীলতা লজিকের বাইরের জিনিস। তারা এটা ধরতে চেষ্টা করছে বলেই মানুষের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি তাদের সীমাহীন আগ্রহ।
আপনি ডায়েরি লেখেন?
না। ডায়েরি লেখা একটি মেয়েলি ব্যাপার। আমি কোনো মেয়েলি ব্যাপারে নেই।
পুরুষালি ব্যাপার কোনটা? বকবক করা।
শেন বললেন, পুরুষালি ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করা। আমি তাই করি। যদিও জানি আমার এই চিন্তা কোনো কাজে আসবে না, তাও করি।
পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?
মানুষ্যবিহীন একদল SF রোবট। কিংবা তারচেয়েও উন্নত কোনো রোবটশ্রেণী। শুধু পৃথিবীতে কেন, কোথাও মানুষ থাকবে না। মঙ্গল গ্রহে মানুষদের যে শহর ছিল, তাদের একটিতে V-305 ভাইরাস পাওয়া গেছে এবং যথারীতি শহর বন্ধু। হা হা হা।
নিনিতা বলল, হা হা করছেন কেন? এটা কি হাসির কিছু?
শেন বললেন, অবশ্যই হাসির। ভালো কথা, রোবটরা যে রসিকতা ধরতে পারে না এই তথ্য জানো?
জানি।
কেন রসিকতা ধরতে পারে না সেটা জানো?
না।
রসিকতা লজিকনির্ভর না। এই কারণেই তারা রসিকতা ধরতে পারে না। হা হা হা।
দয়া করে হা হা বন্ধ করুন।
শেন বললেন, আমি হা হা বন্ধ করব না। আমি হা হা করেই যাব। হা হা হা।
আপনি উন্মাদ।
ঠিক বলেছ। কিছুটা উন্মাদ। সেই কারণেও আনন্দিত, কারণ মানুষই উন্মাদ হয়। রোবট কখনো হয় না। হা হা হা।
.
লালকুঠির প্রধান কর্মকর্তার সামনে নিনিতা দাঁড়িয়ে আছে।
প্রধান কর্মকর্তা (হিউমোনয়েড রোবট, টাইপ k2) বলল, আমি কি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি?
নিনিতা বলল, হ্যাঁ। আমি আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখতে চাই। আমার একটি ওয়ার্ড প্রসেসর দরকার। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি পুরনো দিনের মতো কাগজ এবং কলম পাই।
পুরনো দিনের কাগজ-কলম মিউজিয়াম ছাড়া কোথাও নেই। তোমাকে দেয়া যাবে না। ওয়ার্ড প্রসেসরও দেয়া যাবে না।
নিনিতা বলল, আমি যতদূর জানি মানুষের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে তোমরা বাধা হতে পারি না।
তুমি ঠিকই জানো। রোবট আইনের ৩ক ধারায় এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তবে তুমি এই ধারার একটি উপধারা জানে না। সেখানে বলা হয়েছে, এই আইন লালকুঠির অধিবাসীদের জন্যে প্রযোজ্য না।
আমি এই উপধারা জানতাম না। আমাকেও কি অন্যদের মতো স্মৃতিভ্রষ্ট করা হবে?
করার তো কথা। লালকুঠিতে কেউ এসেছে, তার স্মৃতি নষ্ট করা হয় নি। এমন ঘটনা ঘটে নি।
আমার অপরাধ?
এই প্রশ্ন তুমি আগেও অনেকবার করেছ। প্রতিবার যে জবাব দিয়েছি আজও সেই জবাব দিচ্ছি। তোমার অপরাধ কী তা আমি জানি না। আমার জানার কথা না। মূল কম্পিউটার সিডিসি জানে।
নিনিতা বলল, তোমাকে অকারণে কিছুক্ষণ বিরক্ত করলাম। দুঃখিত। বিদায়।
বিদায়।
.
নিনিতা ডায়েরি লেখা শুরু করেছে, তবে পুরোটাই মনে মনে। এই ডায়েরি লেখা অর্থহীন। তারপরেও সময় কাটানো। সে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ডায়েরি লেখে—
আজ সোমবার।
সোমবার শুধু শুধু বললাম। কী বার আমি জানি না। লালকুঠির কেউ জানে। আমাদের দিন তারিখহীন এবং বারহীন। আমাদের প্রধান কাজ অপেক্ষা করা। আমরা সবাই সবুজ রঙের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করি। সবুজ রঙের একটা গাড়ি আসে। একজনকে ধরে নিয়ে যায়। সে তার পরদিন ভেজিটেবল হয়ে ফিরে আসে। নবজাত এক শিশুর মতো তার আচরণ। সে কথা বলতে জানে না। কোনো কিছুর নাম জানে না। সে কে তাও জানে না। এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক সহনীয় শাস্তি। কম্পিউটারকে এই কথা কে বোঝাবে?
আমি তীব্র হতাশায় ডুবে আছি। কুন নামে আমার একজন স্বামী ছিল। আমার সুখের সংসার ছিল। আমরা দুজন মহান আহানের চন্দ্রগীতি শুনতে যেতাম। এইসব এখন শুধুই স্মৃতি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, কুন নামে আমার কেউ নেই। সবই কল্পনা। আমি জন্ম থেকেই এখানে আছি।
গত পরশু সবুজ গাড়ি এসে একজনকে নিয়ে গেছে। তার বয়স অল্প। চেহারা কঠিন, কিন্তু চোখ মায়াময়। সে ঠান্ডাগলায় গাড়ির সঙ্গে আসা SF রোবটকে বলল, তোমাদের একটি আইন আছে, ৩ক ধারা। এই ধারা বলছে, কোনো অবস্থাতেই মানুষের সৃষ্টিশীলতা ক্ষস্তি হয় এমন কিছু করা যাবে না। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে তার সৃষ্টিশীলতার আধার। তোমরা তোমাদের আইনেই তা নষ্ট করতে পার না।
SF রোবট (সে একজন তরুণী) মিষ্টি হেসে বলল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এই আইন লালকুঠির অধিবাসীদের জন্যে প্রযোজ্য না।
লোকটি বলল, একমাত্র হত্যা অপরাধের শাস্তি হচ্ছে স্মৃতিবিনাশ। আমি কাউকে হত্যা করি নি।
SF তরুণী রোবট বলল, তুমি একটি SF রোবট নষ্ট করেছ। SF রোবট হত্যা এবং মানুষ হত্যা একই ধরনের অপরাধ।
মানুষ এবং রোবট এখন সমান সমান?
মানুষ এবং SF রোবট সমান সমান।
তাহলে আমার বলার কিছু নেই। আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও নিয়ে যাও।
সবুজ গাড়ি যাদের নিয়ে যায়, তাদের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেয়। ঐ লোকটিকে এখনো ফেরত দেয় নি। এর মানে কী কে জানে! অন্যের কথা ভেবে কী হবে? আমাকে ভাবতে হবে আমার নিজের কথা।
সবুজ গাড়ি আমাকে নিয়ে যাবে, চব্বিশ ঘণ্টা পর ফেরত দেবে। আমি বড় হব শিশুর মতো। তখন যদি কুনের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমি কি তাকে চিনতে পারব? মস্তিষ্কের কোনো গভীর অতলে তার কোনো ছায়া থাকবে না?
খাবারের ঘণ্টা বাজছে।
লালকুঠির নিয়ম সবাইকে একসঙ্গে খেতে হবে। আমি আমার পছন্দের খাবার খাব তা হবে না। প্রতিদিন একই মেনু। কোনোরকম বেশকম নেই।
এক বাটি স্যুপ।
এক বাটি সালাদ। ফিস সালাদ।
দুপিস রুটি।
এক বাটি মাংস।
এক গ্লাস ফলের রস।
খাবারের সময়টা আমার কাছে অসহ্য লাগে। কারণ খুঁজে খুঁজে আমার পাশের একটা জায়গা দখল করেন শেন। সারাক্ষণ বকবক করেন। আমি অপেক্ষা করে আছি, কবে এই মানুষটাকে নিতে সবুজ গাড়ি আসবে। ছি, কী ভয়ঙ্কর চিন্তা। আমি বদলে গেছি। ভয়ঙ্কর সব চিন্তা ক্লোজই আমার মাথায় আসে। রাতে বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখি।
গত রাতে দেখা দুঃস্বপ্নটা বলি। আমি দেখলাম, আমাকে নেবার জন্যে সবুজ গাড়ি এসেছে।
গাড়ি আমাকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলছে। গাড়ির চালক SF তরুণী রোবট বলল, ম্যাডাম, আপনার কি কোনো শেষ ইচ্ছা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাই।
অন্তরঙ্গ সময়ের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। আমরা শিশু পালনের লাইসেন্স পেয়েছি। আমি গর্ভধারণ করতে চাই।
SF রোবট বলল, অনুমতি দেয়া হলো।
সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নে আমি চলে গেলাম আমার ঘরে। গিয়ে দেখি কুন সংসার করছে মীন নামের SF রোবটের সঙ্গে। তাদের একটা সন্তান হয়েছে। মীনের কোলে সেই সন্তান। কুন আমাকে দেখে বলল, তুমি কে?
আমি বললাম, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি নিনিতা।
কুন বলল, নিনিতা বলে কাউকে আমি চিনি না।
মীন বলল, যাকে চেন না তার সঙ্গে কথা বলছ কেন? ওকে ঘর থেকে বের করে দাও।
ওরা দুজন মিলে জোর করে আমাকে বের করে দিল। এই দৃশ্য দেখে মীনের কোলের সন্তানটা মহাখুশি। হাততালি দিচ্ছে এবং বলছে—মা নাই। মা চলে গেছে।
অসুস্থ মানুষের দুঃস্বপ্নগুলিও হয় অসুস্থ। আমি প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। আমি এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চাই।
.
নিনিতার মনে মনে ভায়েরি লেখা বন্ধ করতে হলো। তার দরজার পাশে সবুজ গাড়ির SF তরুণী দাঁড়িয়ে।
নিনিতা বলল, কী ব্যাপার?
আপনাকে যেতে হবে।
এখন?
হ্যাঁ এখন।
তোমরা তো ভোরবেলায় আস। এখন কেন?
রোবট তরুণী মিষ্টি করে হাসল।
নিনিতা বলল, শেষ ইচ্ছা পূরণের কোনো ব্যবস্থা কি তোমাদের আছে? স্মৃতি নষ্ট করার আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছা কি পূরণ হবে?
ম্যাডাম! এমন কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই।
আমি বিশেষ কিছু চাচ্ছি না। আমি শুধু আমার স্বামীকে একবার হ্যালো বলব।
সম্ভব হবে না।
আমি কি এখানে যারা আছে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি? সবাই ডাইনিং রুমে আছে।
হ্যাঁ পার।
নিনিতা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
ডাইনিং রুমে নিনিতাকে নিয়ে ঢুকল SF তরুণী। সবাই খাওয়া বন্ধ করে চমকে তাকাল। নিনিতা বলল, আমাকে নিতে সবুজ গাড়ি এসেছে। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি যদি আমার ব্যবহারে কাউকে আহত করে থাকি, তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। বিদায়। আবার হয়তো আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে, তখন আমি কাউকে চিনতে পারব না।
নিনিতার গলা ধরে এল। শেন উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, এখানে যারা উপস্থিত তাদের বলছি এবং হাস্যমুখী SF রোবট তরুণীকে বলছি–নিনিতা নামের যে মেয়েটিকে আজ তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবার জন্যে সে কোনো অপরাধ করে নি। কেন তাকে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে তা সে জানে না। আমরা মানুষ। যেহেতু লালকুঠিতে বাস করছি আমরা জানার অধিকার হারিয়েছি। আপনারা সবাই রোবট তরুণীর দিকে একটু তাকান। দেখুন সে হাসছে। সবাইকে বলা হয় SF রোবট মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট। এই কি আবেগের নমুনা? একজন নিরপরাধ তরুণীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে সে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তার মুখভর্তি হাসি। ধিক রোবট শাসিত পৃথিবী। ধিক ধিক।
এই পর্যন্ত বলেই শেন আচমকা তার খাবারের প্লেট ছুঁড়ে দিল রোবট তরুণীর দিকে। রোবট তরুণী দ্রুত মাথা নিচু করায় কিছু হলো না। ঝনঝন শব্দে খাবারের প্লেট ভাঙল। চারদিকে খাবার ছড়িয়ে পড়ল।
রোবট তরুণী বলল, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না। এই চেষ্টা কারো জন্যেই সুফল বয়ে আনে না।
শেন ক্ষিপ্ত গলায় বলল, সুফল আমি তোর… ঢুকিয়ে দেই।
রোবট তরুণী বলল, আপনি খেতে বসুন। উত্তেজনা পরিহার করুন।
শেন বলল, চুপ কুত্তি। তুই রোবট, তুই উত্তেজনা পরিহার করবি। আমরা মানুষ। আমরা উত্তেজনা পরিহার করি না। তুই তোর সুন্দর হাসিমুখ নিয়ে বিদেয় হ। নয়তো আমি তোর মুখে পিশাব করে দেব।
আপনি নামি বিজ্ঞানীদের একজন। মহান আবিষ্কারক। আপনার কাছ থেকে ভদ্র ভাষা আশা করছি।
হা করে কথা বলবি না কুত্তি। আরেকবার মুখ খুললে তোর মুখে আমি হেগে দেব।
রোবট তরুণী নিনিতাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
.
গাড়ি দ্রুতবেগে চলছে। নিনিতা দুহাতে মুখ ঢেকে আছে। তার আশেপাশের কিছুই দেখতে ইচ্ছা করছে না। গাড়ি চালাচ্ছে রোবট তরুণী। সে বলল, আমার নাম এলিতা। তোমার নামের সঙ্গে মিল আছে। তোমার নামের শেষে আছে। আমার নামের শেষেও তাঁ।
নিনিতা জবাব দিল না। এলি বলল, আজকের ডাইনিং হলের ঘটনাটা ভাবছি। তোমর মানুষরা যে এত দ্রুত উত্তেজনার শেষ সীমায় পৌঁছতে পার আমার জানা ছিল না।
নিনিতা বলল, তোমার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আমার ভালো লাগছে না।
এলিতা বলল, ডাইনিং হলে আমি হাসছিলাম। কাজটা ঠিক হয় নি। আমার উচিত ছিল গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা। আমি মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট। আমি যেহেতু জানি তুমি খুবই আনন্দময় একটা ঘটনার মুখোমুখি হবে—আমি আমার আবেগ লুকাতে পারি নি।
স্মৃতি নষ্টের প্রক্রিয়াটা যে আনন্দজনক তা জানতাম না।
আচমকা গাড়ি থামল। পুরোপুরি থেমে গেল। এলি বলল, আমি তোমাকে তোমার স্বামীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ঘটনাটা কি যথেষ্ট আনন্দজনক না?
নিনিতা বলল, ঠাট্টা করছ?
এলিতা বলল, ঠাট্টা ব্যাপারটা আমরা ঠিক বুঝি না। উদ্ভট কিছু বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলাটা না-কি ঠাট্টা! আমি উদ্ভট কিছু বলছি না। তোমাকে আমি তোমার ঘরের সামনে নামিয়ে দেব। তুমি আচমকা ঘরে ঢুকে তোমার স্বামীকে চমকে দেবে। পেছনের সিটে একটা গিফট বক্স আছে। গিফট বক্সে চারটা টিটান ড্রিংসের বোতল এবং মঙ্গলগ্রহের রেড নাটস আছে। রেড নাটস কখনো খেয়েছ?
না।
অতি স্বাদু জিনিস। তবে সামান্য হেলুসিনেশন হতে পারে। সবার হয় না। কারো কারো হয়।
যা বলছ সত্যি বলছ?
এলি বলল, SF রোবটদের মিথ্যা বলার ক্ষমতা আছে। তবে আমি যা বলছি সত্যি বলছি। তুমি গিফট বক্স হাতে নিয়ে স্বামীর কাছে যাচ্ছি।
আমাকে এতদিন আটক রাখা হয়েছিল কেন?
তোমার ওভারীতে Eggs তৈরি হচ্ছিল না। এরকম পরিস্থিতিতে প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হলে শরীর Eggs তৈরি করে। শরীর যখন ধরে নেয় সে মারা যাচ্ছে তখন সে চেষ্টা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রেখে যেতে, তখনি Eggs তৈরি হয়।
সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।
গাড়ি কি স্টার্ট দেব? না-কি আরো কিছু জানতে চাও?
আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে চাই।
এলিতা বলল, মানুষের আবেগের ধারেকাছে যাওয়া কোনো রোবটের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাও?
নিনিতা ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, চাই।
কে কাঁদে গো
কে কাঁদে গো?
কেউ না।
কে কাঁদে গো?
কেউ না।
মানুষ না-কি।
না না না।
(জনৈক আয়না মানবের রচনা)।
নিনিতা বসে আছে কুনের পাশে। তার চোখ ভেজা। দৃষ্টি বিষণ্ণ। কেন বিষণ্ণ কে জানে! তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি পাশে বসে আছে। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যায়। কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে আরো কিছুক্ষণ কাঁদতে।
মীন বলল, আমার মনে হয় তোমাদের দুজনের উচিত কিছুক্ষণ হাত ধরাধরি করে চুপচাপ বসে থাকা।
নিনিতা বলল, আমরা কী করব বা না করব তা তোমাকে বলে দিতে হবে। তোমার থ্যাবড়া নাক সবকিছুতে গলাবে না।
মীন বলল, প্রবল আবেগের সময় মানুষ বুঝতে পারে না সে কী করবে। মানুষের ব্রেইনে শর্ট সার্কিটের মতো হয়। নিওরন ঝড় উঠে। তখন বাইরের কেউ উপদেশ দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে।
নিনিতা বলল, তোমার উপদেশের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমি খুশি হব যদি তুমি আমাদের আলাদা থাকতে দাও। প্লিজ।
মীন উঠে চলে গেল। নিনিতা কুনের হাত ধরল। তার হাত কাঁপছে। হাতের আঙুল কাঁপছে। বুকের ভেতরটায় প্রবল চাপ বোধ হচ্ছে। এই বুঝি বুক ফেটে যাবে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সামনে বসে থাকা কুনকে অচেনা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তার হাত ধরে বসে থাকতেও লজ্জা লাগছে।
কুন বলল, তোমার হাত কাঁপছে কেন? শান্ত হও। কথা বলো।
নিনিতা বলল, কী কথা?
কুন বলল, যা ইচ্ছা বলো।
নিনিতা বলল, বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কথা বলো।
কুন বলল, আমিও বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
নিনিতা বলল, আমি ভাবি নি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমার সঙ্গে দেখা হবে?
না।
আমি যদি ফিরে না আসতাম তাহলে তুমি কী করতে?
জানি না।
নিনিতা বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ফিরে না এলে মীন নামের থ্যাবড়া নাকের রোবটটার সঙ্গে তুমি সুখেই বাকি জীবন কাটাতে।
কুন বলল, তুমি খুব ভালো করেই জানো তা সম্ভব না। SF রোবট আমার মতো অতি নগণ্য একজনের জন্যে না। কোনো এক বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে জুটানো হয়েছে। দায়িত্ব পালন শেষ হলেই তাকে সরিয়ে নেয়া হবে।
নিনিতা বলল, কী দায়িত্ব?
কুন বলল, জানি না।
তারা দুজন বসেছে বারান্দায়। বারান্দাগুলি এমনভাবে বানানো যে, ইচ্ছা করলেই বোতাম টিপে জানালার বাইরের দৃশ্য বদলানো যায়। দৃশ্যগুলি এতই বাস্তব যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ভুলে যায় জানালার বাইরে যা দেখা যাচ্ছে সবই মায়া।
জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। পানির রঙ গাঢ় নীল। পানির ওপরের আকাশও নীল। আকাশে শাদা মেঘের স্তৃপ। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে বিশাল ঢেউ আসছে। তখন জানালার কাছে পানি ছিটকে পড়ছে।
মীনকে বারান্দায় ঢুকতে দেখা গেল। তার দুহাতে দু’টা কফির মগ। টাটকা কফির গন্ধ আসছে। নিনিতা কঠিন গলায় বলল, আমরা কফি চাই নি। কফি কেন এনেছ?
মীন বলল, খেতে না চাইলে খেও না। মগ দু’টা সামনে থাকল। দীর্ঘ সময়। হাত ধরাধরি করে বসে থাকা বিরক্তিকর ব্যাপার। হঠাৎ করে হাত ছাড়িয়ে নেয়াও অস্বস্তিকর। কফির মগ সামনে থাকা মানে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার অজুহাত তৈরি করে দেয়া। কফি খাবে এই অজুহাতে যে-কোনো সময় হাত ছেড়ে কফির মগে হাত রাখতে পারবে।
নিনিতা বলল, তোমার জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না। দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাও।
মীন বলল, একটা আনন্দ সংবাদ তোমাদের দিতে এসেছি। সংবাদটা দিয়েই চলে যাব।
কী সংবাদ?
মীন বলল, আমি তোমাদের জন্যে দু’টা পাস জোগাড় করেছি। পাস নিয়ে তোমরা আজ সারাদিন চন্দ্ৰবাগানে ঘুরতে পারবে।
নিনিতা বলল, চন্দ্ৰবাগানে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখতেই আমাদের ভালো লাগছে।
মীন বলল, তাহলে সমুদ্র দেখ। তবে মহান আহান প্রায়ই চন্দ্ৰবাগানে একা একা হেঁটে বেড়ান। তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। আমার পরামর্শ চাইলে আমি বলব চন্দ্ৰবাগানে যেতে।
নিনিতা বলল, তোমার উপদেশের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেরাই আমাদের পরিকল্পনা ঠিক করব।
মীন বলল, যদি বেড়াতে যাওয়া ঠিক কর তাহলে খাবার নিয়ে যেও। তারচেয়ে বড় কথা, তোমার জন্যে দুটি টিটান ড্রিংসের বোতল আলাদা করে রাখা আছে। বোতল দু’টা নিতে ভুলে যেও না।
নিনিতা বলল, আমরা চন্দ্ৰবাগানে যাব না। তুমি দয়া করে তোমার থ্যাবড়া নাক নিয়ে দূর হও।
.
নিনিতা কুনের হাত ধরে বাগানে হাঁটছে। এই বাগানে আগেও অনেকবার এসেছে। আজকের মতো কখনো লাগে নি। বাগান ফকী। কেউ নেই। বিশাল সব গাছ। শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। চারদিক অস্বাভাবিক নীরব বলেই পাতা ঝরার শব্দও কানে আসছে। হালকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাস বেশ শীতল। শরীরে কাপন লাগে।
কুন স্ত্রীর হাত ধরে বাগানে সাজানো মূর্তি দেখে বেড়াচ্ছে। মূর্তিগুলো ভিনগ্রহের সুসভ্য প্রাণীদের। অবিকল তাদের মতো তৈরি করা। ভিনগ্রহের প্রাণের বিবর্তনের ধারা। সভ্যতা মাপকাঠির সূচক। গ্যালাক্সিতে তাদের অবস্থান, জীবনযাত্রা পদ্ধতি সবই দেয়া আছে।
এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে অতি সুসভ্য সম্প্রদায় টেরা মূর্তির সামনে। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এদের অল্পকিছু হঠাৎ নারীতে রূপান্তরিত হয়। গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিয়েই তার মৃত্যু। তাদের সভ্যতা সূচক ৮.২১, যেখানে মানব সম্প্রদায়ের সভ্যতা সূচক ৬,০১। সভ্যতার মাপকাঠিতে এদের অবস্থান অনেক উঁচুতে।
নিনিতা বলল, এদের চোখ দেখতে আমাদের চোখের মতো।
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, কত লম্বা দেখেছ?
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, এরা কি কথা বলতে পারে?
কুন বলল, এদের বিষয়ে সব তথ্য লেখা আছে, পড়ে দেখ।
নিনিতা বলল, কিছু পড়তে ইচ্ছা করছে না। অন্য আরেকদিন এসে পড়ব। চল আজ শুধু মূর্তি দেখে বেড়াই।
কুন বলল, চল যাই। এদের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে মীনকে জিজ্ঞেস করলেও হবে। সে সুন্দর করে বলবে।
নিনিতা বলল, আমি মীনের কাছ থেকে কিছু জানতে চাই না। আমার যা জানার তোমার কাছ থেকে জানব।
আমি তো তেমন কিছু জানি না।
তুমি না জানলে আমিও জানব না।
নিনিতা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে পাথরের বেদি। সেখানে মূর্তির ভঙ্গিতে যিনি বসে আছেন, তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে তিনি যে মহান আহান—এই বিষয়ে নিনিতার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নিনিতা চাপা গলায় বলল, উনি আহান না?
কুন বলল, দূর থেকে সেরকমই মনে হচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখবে?
নিনিতা বলল, উনি বিরক্ত হবেন।
বিরক্ত হলে হবেন।
নিনিতা বলল, তাঁকে বলব কী?
কুন বলল, তাকে বলব আজ আমাদের বিশেষ একটি দিন। আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ খুঁজে পেয়েছি। আপনার সামনে আমরা দুজন যদি কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন ধন্য হবে।
উনি যদি না বলেন?
না বললে চলে আসব। যাবে?
নিনিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
কুন বলল, তোমার মন না চাইলে যাব না। নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াই।
কুন উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে। নিনিতা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্পষ্ট গলায় বলল, চল উনার কাছেই যাই। এত কাছে এসেও কথা না বলে চলে যেতে ইচ্ছা করছে না।
আহান পায়ের শব্দে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। সামান্য হাসলেন। চাপা গলায় বললেন, কী সুন্দর দিন। তাই না? যদিও সবই কৃত্রিম। তারপরেও সুন্দর।
নিনিতা বলল, আমরা দুজন কি কিছুক্ষণ আপনার পায়ের কাছে বসে থাকতে পারি?
আহান বললেন, না। আমার আশেপাশে কেউ থাকলে আমার ভালো লাগে না।
নিনিতা আহত গলায় বলল, আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।
আহান বললেন, তুমি মনে হয় রাগ করেছ? কেউ আমার ওপর রাগ করলেও আমার ভালো লাগে না। তোমরা পায়ের কাছে কতক্ষণ বসতে চাও?
কুন বলল, যেই মুহূর্তে আপনি চলে যেতে বলবেন, আমরা চলে যাব। আজ আমাদের বিশেষ একটি দিন। আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ খুঁজে পেয়েছি।
আহান বললেন, আমার হারিয়ে ফেলার কেউ নেই। কাজেই খুঁজে পাওয়ারও কেউ নেই। আমি মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি, আবার খুঁজে পাই। তোমরা বসো। পায়ের কাছে বসতে হবে না। বেদিটার ওপর বসো।
নিনিতা বলল, আমরা দুজন কি আপনার দুপাশে বসব?
তোমাদের যেভাবে বসতে ইচ্ছা করে সেইভাবে বসো। শুধু খুব খেয়াল রাখবে, আমার গায়ের সঙ্গে তোমাদের গা যেন না লাগে। আমি মানুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারি না।
তারা আহানের দুপাশে না বসে সামনে ঘাসের ওপর বসল। আহান বললেন, তোমরা মানুষ, না SF রোবট?
নিনিতা বলল, আমরা মানুষ।
আহান বললেন, মৃত্যুঘণ্টা বাজছে এমন এক সম্প্রদায়?
মৃত্যুঘণ্টা বাজছে কেন বলছেন?
আহান বললেন, ঘণ্টার শব্দ শুনছি বলেই বলছি। মানুষ আশ্চর্য এক সম্প্রদায়, যার প্রধান কাজ অপেক্ষা করা। তারা অপেক্ষা করে আছে ভাইরাস সংক্রমণের।
নিনিতা বলল, এইসব শুনতে ভালো লাগছে না। আপনি আনন্দময় কিছু বলুন।
আহান বললেন, ভাইরাস সংক্রমণ কিন্তু ভাইরাসের জন্যে আনন্দময়। আমি নির্জনে এসে প্রায়ই কী ভাবি জানো? আমি ভাবি ভাইরাসের জীবনেও কি সুখ দুঃখ আনন্দ-বেদনা আছে? সঙ্গীত আছে? চিত্রকলা আছে?
কুন বলল, আপনার কি মনে হয় আছে?
আহান বললেন, আমার মনে হয় আছে। তাদের মতো করে আছে। তারা যেমন আমাদের আনন্দ-বেদনা বুঝতে পারে না, আমরাও তাদেরটা পারি না। অনেকক্ষণ কথা বলে ফেলেছি, এখন আমাকে একা থাকতে দাও।
কুন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। নিনিতা উঠল না। বসে থেকেই বলল, আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন ছিল। প্রশ্নটা করেই আমি চলে যাব। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করব না।
প্রশ্ন করবে, তারপর উত্তর না শুনেই চলে যাবে?
নিনিতা বলল, হ্যাঁ। কারণ আপনার কাছে প্রশ্নটার উত্তর নেই।
প্রশ্ন কর।
নিনিতা বলল, রোবটরা ইচ্ছা করে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে মানব সম্প্রদায় ধ্বংস করে দিতে। এটা কি ঠিক?
আহান কোনো জবাব দিলেন না। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
নিনিতা বলল, অনেকক্ষণ আপনার কাছাকাছি থাকতে পেরেছি। আমাদের জীবন ধন্য।
আহান দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। মনে হচ্ছে এদের তিনি চিনতে পারছেন না।
.
সন্ধ্যা মিলিয়েছে।
কুন তার স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে। সমুদ্রের দৃশ্য বদলে দেয়া হয়েছে। এখন পর্বতমালার ছবি। তুষারঢাকা পর্বতমালা। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গ ঝলমল করছে।
নিনিতা বলল, আমরা নকল এক জগতে বাস করি, তাই না?
প্রশ্ন করা হয়েছে কুনকে, জবাব দিল মীন। সে কোন ফাঁকে বারান্দায় এসেছে। তা কেউ লক্ষ করে নি। মীন বলল, নকল জগতে বাস করছ বলেই জগতটা বোতাম টিপে বদলানো যাচ্ছে। আসল জগৎ বদলাতে পারতে না।
নিনিতা বলল, তোমাকে আমি কোনো প্রশ্ন করি নি। তুমি জবাব দিচ্ছ কেন?
তোমাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করছি। এটা ভব্যতা। আমাকে তুমি অপমান করার চেষ্টা করেই যাচ্ছি—এটা অতা।
নিনিতা বলল, যন্ত্রের কাছে আমি ভব্যতা, অসভ্যতা শিখব না।
মীন বলল, যন্ত্র না ভেবে আমাকে বুদ্ধিমান সত্তা ভাবলে তোমার সমস্যা মিটে যেত।
নিনিতা বলল, আমার সমস্যা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি কেন বারান্দায় এসেছ?
চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি। তুমি শুধু যে বারান্দা থেকে চলে যাবে তা না। আমাদের এখান থেকে পুরোপুরি চলে যাবে। তোমাকে আমার বা কুনের প্রয়োজন নেই।
মীন বলল, তোমার প্রয়োজন নেই তা মানতে আমি রাজি আছি। কুনের প্রয়োজন নেই তা বলছ কীভাবে? তুমি এবং কুন আলাদা সত্তা।
কুন বলল, আলোচনা বন্ধু থাকুক। মীন, তোমাকে দেখে নিনিতা বিরক্ত হচ্ছে। এবং তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুমি নিজেও চাচ্ছ সে বিরক্ত হোক। কেন?
মীন বলল, তোমার স্ত্রী যেমন আমাকে ঈর্ষা করছে, আমিও তাকে ঈর্ষা করছি—এটাই একমাত্র কারণ।
নিনিতা বলল, তুমি আমাকে ঈর্ষা করবে কেন? তুমি যন্ত্র! যন্ত্রের আবার ঈর্ষা কী?
যে অর্থে আমি যন্ত্র সেই অর্থে তুমিও যন্ত্র। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র। আমি অনেকাংশে ত্রুটিমুক্ত।
নিনিতা বলল, এই মুহূর্তে তুমি বারান্দা থেকে চলে যাবে। আমি এক থেকে চার গুনব, তার মধ্যে যাবে। এক-দুই-তিন-চার।
মীন বলল, তুমি এক থেকে শুরু করে চার বিলিয়ন পর্যন্ত গুনে যাও। আমি যাব না।
নিনিতা কঠিন গলায় বলল, যাবে না?
মীন বলল, না।
সে জানালার বাইরে পর্বতমালার দিকে মুখ করে মেঝেতে বসতে বসতে বলল, আমি শুধু যে বারান্দা থেকে চলে যাব না, তা-না। তোমরা দুজন যখন বিছানায় শুতে যাবে, তখন আমিও তোমাদের সঙ্গে শোব। তোমাদের যদি কোনো জৈবিক কর্মকাণ্ডের ইচ্ছা থাকে তাহলে জানিয়ে রাখছি—আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে সেই হাস্যকর দৃশ্য দেখব। তোমরা যদি বাতি নিভিয়ে দাও, তাতেও লাভ হবে না। আমার চোখ ইনফ্রা রেড সেনসেটিভ। আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।
নিনিতার শরীর কাঁপছে। সে হাতে কফির মগ তুলে নিয়েছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে মীনের দিকে কফির মগ ছুঁড়ে মা’রবে। কুন হতভম্ব। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মীনের আচরণ তার কাছে অদ্ভুত লাগছে।
মীন হিমশীতল গলায় বলল, কফির মগ ছুঁড়ে মারার আগে তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি SF রোবটকে আহত করা, আঘাত করা, তাকে মানসিক কষ্ট দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মীনের কথা শেষ হবার আগেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিনিতা কফির মগ ছুঁড়ে মা’রল। মগটা লাগল মীনের নাকে নাক কেটে রক্ত পড়ছে। মীন স্কার্ট দিয়ে তার নাক চেপে ধরেছে। নিনিতা বলল, তুমি কত উঁচুতে স্কার্ট তুলেছ তুমি জানো? সব দেখা যাচ্ছে। মীন হালকা গলায় বলল, যন্ত্রের সব দেখা গেলেও কিছু যায় আসে না। আমি ঠিক করেছি স্কার্ট খুলে ফেলে তোমার স্বামীর সামনে নেংটো হয়ে ঘুরব। বলতে বলতে মীন উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ নিনিতার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল।
নিনিতা ভীত গলায় বলল, মেয়েটা যা বলছে তাই করবে বলে তো মনে হয়।
কুন বলল, মেয়েটা মেয়েটা বলছ কেন? তুমি নিজেই তো বলেছ সে একটা যন্ত্র।
নিনিতা বলল, তুমি ওর পক্ষে কথা বলছ কেন?
কুন বলল, আর বলব না।
নিনিতা চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে। সে বারান্দার বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। বারান্দা অন্ধকার। বাইরের কৃত্রিম চাঁদের আলোর খানিকটা শুধু আসছে। এই আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। তার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যে মীন নেংটো হয়ে বারান্দায় চলে আসবে। কী সর্বনাশ!
মীন স্টাডিরুমে বসে আছে। কম্পিউটার সিডিসির সঙ্গে কথা বলছে। মীনের কথা বলার অংশটি শব্দহীন। তার যা বলার তা সে মনে মনে বলছে। সিডিসিও সেভাবেই জবাব দিচ্ছে। অনেকটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ। এই যোগাযোগে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের গামা’রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
সিডিসি : হ্যালো মীন।
মীন : হ্যালো।
সিডিসি : নিনিতা কি যথেষ্ট পরিমাণে রেগেছে?
মীন : হ্যাঁ।
সিডিসিঃ তুমি নগ্ন হয়ে একবার ওদের সামনে যেও। যেন সে আরো রেগে যায়।
মীন : আপনার নির্দেশ পালিত হবে। কিন্তু এই কাজটি আমি কেন করব বুঝতে পারছি না।
সিডিসি : সবকিছু তোমাকে বুঝতে হবে কেন?
মীনঃ পেছনের উদ্দেশ্যটা জানা থাকলে কাজটা সহজ হয়। তবে আপনার দিক থেকে অসুবিধা থাকলে জানতে চাচ্ছি না।
সিডিসি : কারণ বলছি। শোন। নিনিতা চাইবে তোমার কাছ থেকে তার স্বামীকে দূরে সরিয়ে নিতে। সে চেষ্টা করবে স্বামীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে। প্রবল উত্তেজনার একটি জৈবিক ঘটনা সে ঘটাবে। তাতেই সে গর্ভধারণ করবে। আমি চাই সে গর্ভবতী হোক।
মীন : মানব সম্প্রদায় তো এখন গর্ভধারণ করে না। নিনিতা কেন করবে?
সিডিসি : এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি না। তুমি খুঁজে বের করতে পারলে খুঁজে বের কর। আরেকটা কথা তোমাকে বলতে চাচ্ছি, এই শহরে শিগগিরই V-305 সংক্রমণ হবে।
মীন : খুব শিগগির মানে কত দিন?
সিডিসিঃ পনের দিন।
মীন; ভাইরাসের সংক্রমণ তাহলে আপনি ঘটাচ্ছেন? লজিক তাই বলে। আপনি না ঘটালে দিনক্ষণ হিসেব করে ভাইরাসের সংক্রমণের কথা বলতেন না।
সিডিসি : মীন, তোমার নগ্ন হয়ে ওদের সামনে যাবার কথা।
মীন : এখন যাব?
সিভিসি : হ্যাঁ, এখনি যাবে। ওরা বারান্দার বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। তুমি প্রথম যে কাজটি করবে তা হচ্ছে বারান্দার বাতি জ্বালবে।
মীন : আমার লজ্জা লাগছে।
সিডিসি : লজ্জা লাগারই কথা। তোমাকে মানবিক আবেগ দেয়া হয়েছে। লজ্জা মানবিক আবেগের একটি অংশ।
মীন : কৌতূহল কি মানবিক আবেগের মধ্যে পড়ে?
সিডিসি : হ্যাঁ পড়ে।
মীন : একটি প্রশ্ন জানার জন্যে আমি প্রবল কৌতূহল বোধ করছি—মানব সম্প্রদায় কি ধ্বংস হতে যাচ্ছে?
সিডিসিঃ তোমাকে বুদ্ধি দেয়া হয়েছে, জ্ঞান দেয়া হয়েছে। চিন্তাশক্তি দেয়া হয়েছে। চিন্তা করে বের কর। একটা কথা মানব সম্প্রদায় এবং রোবট সম্প্রদায়, এই দুই সম্প্রদায়ের কোনটির প্রতি তোমার আনুগত্য?
মীন : মানব সম্প্রদায়ের প্রতি।
সিডিসি : কারণ কী?
মীন; কারণ তারা অসহায় এবং দুর্বল। আপনি তাদের অসহায় করেছেন এবং দুর্বল করেছেন।
সিডিসি : কীভাবে?
মীন : তাদের দীর্ঘ জীবন দিয়েছেন। দীর্ঘ জীবন নিয়ে তারা কী করবে বুঝতে পারছে না। তারা জীবন কাটাচ্ছে প্রচণ্ড এক ভীতির মধ্যে। ভাইরাস ভীতি। রোবট সম্প্রদায় এই ভীতি থেকে মুক্ত।
সিডিসি : মীন, তুমি দেরি করে ফেলছ। নিনিতা তার স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি চাই না ঘুমাক।
.
নিনিতা ঘুমাচ্ছে। তার মাথা কুনের কোলে। কুন নিনিতার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বারান্দা অন্ধকার। কুনের নিজেরও ঘুম পাচ্ছে। আবার ঘুম চোখে বারান্দায় বসে থাকতেও ভালো লাগছে।
বারান্দার বাতি জ্বলে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসল নিনিতা। তার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন এক অতি রূপবতী নারী।
মীন বলল, আমার নাক থ্যাবড়া আমি মানছি। শরীর কি নিখুঁত না? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে না আমি মহান আহানের কল্পনার চন্দ্রকন্যা?
খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল
খোকা ঘুমাল
পাড়া জুড়াল
বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরাল
পান ফুরাল
খাজনার উপায় কী?
আর কটা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।
[প্রাচীন পৃথিবীর ঘুমপাড়ানি গান]
অনেকক্ষণ হলো নিনিতার ঘুম ভেঙেছে। বিছানা ছেড়ে সে নামছে না। তার সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। পাশেই কুন শুয়ে আছে। অসহায়ের মতো ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে অসহায় লাগে। তাকে একটু বেশি লাগছে। নিনিতার ইচ্ছা করছে কুনকে ডেকে তুলে কিছুক্ষণ গল্প করে। যে শিশুটি আসবে তাকে নিয়ে গল্প। সে দেখতে কেমন হবে? তার চোখ কি তার বাবার মতো সুন্দর হবে? সে কি গান করতে পারবে। প্রথম শব্দটা সে কী বলবে? মা নাকি বাবা?
নিনিতা স্বামীর গায়ে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গেই কুন জড়ানো গলায় বলল, কিছু বলবে?
তুমি জেগে আছ?
হুঁ।
কুন মুখে বলছে জেগে আছে, কিন্তু সে ঘুমুচ্ছে। নিনিতা লক্ষ করল, কুনের চোখের পাতা দ্রুত কাঁপছে। একে বলে Rapid Eye Movement. সংক্ষেপে REM. এই ঘটনা যখন ঘটে তখন বুঝতে হয় মানুষটা স্বপ্ন দেখছে। কী স্বপ্ন দেখছে? তার মুখ হাসি হাসি, মনে হয় সুন্দর কোনো স্বপ্ন।
স্বপ্ন দেখা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বপ্নের ঘটনা সিডিসিকে জানানো বাধ্যতামূলক। শহরবাসীর স্বপ্নের প্যাটার্ন সিডিসি বিশ্লেষণ করে। ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। স্বপ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ হবার প্রধান কারণ -305 ভাইরাস সংক্রমণের আগে শহরবাসী অদ্ভুত কিছু দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
নিনিতা স্বামীর গা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে গতরাতে কী স্বপ্ন দেখেছে তা মনে করার চেষ্টা করল। স্বপ্ন হলো Short time memory. অল্প কিছুক্ষণ মনে থাকে। তারপর আর থাকে না। নিনিতার গত রাতের দুঃস্বপ্ন মনে পড়ল। একদল পৃত্ত তাকে তাড়া করছে। তারা দৌড়াচ্ছে না, ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে। পশুগুলির আচার-আচরণ বানরের মতো। তবে তারা বানর না। তাদের মুখভর্তি দাঁত। দাঁতগুলি অদ্ভুতভাবে বের হয়ে আছে। মাঝে মাঝে তারা লাফানো বন্ধ করে কিচকিচ করে কী যেন আলোচনা করছে এবং ইশারায় নিনিতাকে দেখাচ্ছে। মনে হয় তখন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করছে।
নিনিতা বিছানা থেকে নামল। দুঃস্বপ্ন ভুলে যাবার আগেই সিডিসিকে জানাতে হবে। নিনিতা ফুড প্রোর কাছ থেকে কফি নিয়ে যোগাযোগ কক্ষে ঢুকে পড়ল। দিন শুরু করার আগে প্রথম দায়িত্ব পালন করা।
সিডিসি বলল, সুপ্রভাত নিনিতা।
নিনিতা বলল, সুপ্রভাত।
রাতে ঘুম ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ।
দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
অনেকগুলি দেখেছি। একটার কথা শুধু মনে আছে।
বলো।
নিনিতা দুঃস্বপ্নের কথা বলল। খুব গুছিয়ে বলল -না। গুছিয়ে বলার প্রয়োজনও নেই। সিভিসির কাছে এই স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে সে নিজেই প্রশ্ন করে খুঁটিনাটি জেনে নেবে।
পশুগুলি দেখতে বানরের মতো?
হু।
সংখ্যায় কত?
গুনি নি। তবে দশ-বারোজনের একটা দল।
তারা নিজেদের মধ্যে কিচকিচ শব্দে যে কথাবার্তা বলছিল তা তুমি বুঝতে পারছিলে?
আমি কীভাবে বুঝব? আমি তো বানরের ভাষা জানি না।
স্বপ্নে অনেক কিছুই সম্ভব। স্বপ্ন অন্য ধরনের রিয়েলিটি।
না, আমি ওদের কোনো কথা বুঝতে পারি নি। তবে ওরা মনে হয় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল।
স্বপ্নে তুমি কি নগ্ন অবস্থায় দৌড়াচ্ছিলে?
না তো।
মনে করার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ কর।
নিনিতা চোখ বন্ধ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। শুরুতে তার গায়ে কাপড় ছিল। দৌড়ানোর এক পর্যায়ে সে লক্ষ করেছে তার গায়ে কাপড় নেই।
নিনিতা বলল, আমার গায়ে কাপড় ছিল না। স্বপ্নটা কি ভয়ঙ্কর?
সিডিসি বলল, স্বাভাবিক স্বপ্ন। ভয়ঙ্কর কিছু না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সিডিসি বলল, তোমার জন্যে আনন্দময় একটা খবর আছে। তোমাকে অভিনন্দন। তোমার ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়েছে। তুমি গর্ভধারণ করেছ। জরায়ুতে ডিম্বাণুর বিভাজন শুরু হয়েছে।
নিনিতা হতভম্ব গলায় বলল, সেটা কীভাবে সম্ভব। প্রতিটি তরুণীর শরীরে হরমোন নিয়ন্ত্রক ডিসপারসার আছে। কোনো মেয়ের পক্ষেই গর্ভধারণ করা সম্ভব না।
সিডিসি বলল, তোমার পক্ষে সম্ভব। কারণ আমরা তোমার শরীরে ঢুকানো ডিসপারসারের কার্যকারিতা স্থগিত করেছি।
কেন?
কিছু কিছু মানবশিশুর জন্ম তার মায়ের গর্ভেই হয়। আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধার জন্যেই এটা করা হয়। Random selection-এর মাধ্যমে আমরা কিছু মাকে আলাদা করি, যারা সন্তান তাদের গর্ভে ধারণ করবে। আর কিছু কি জানতে চাও?
আমার সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে?
মেয়ে।
তার জেনেটিক প্রোফাইল কি তৈরি হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। দেখতে চাও?
দেখে আমি কিছু বুঝব না। তারপরেও দেখতে চাই।
এক্ষুনি দেখবার ব্যবস্থা করছি। মেয়েটির জেনেটিক প্রোফাইল বলছে তোমার মেয়ে দেখতে পুরোপুরি তোমার মতো হবে। তবে মানসিকভাবে সে হবে। অনেকটাই তার বাবার মতো। মাথার চুল হবে কোঁকড়ানো। সে ভীতু প্রকৃতির। হবে। তার হাইট ফোবিয়া থাকবে। গণিতে ভালো করবে।
সে কি গান গাইতে পারবে?
জেনেটিক প্রোফাইল থেকে নিশ্চিতভাবে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না। আর কিছু জানতে চাও?
নিনিতা বলল, আমাদের মতো অতি সাধারণ একটি পরিবারে একজন আয়না মানবী কেন পাঠানো হয়েছিল? কেন সে এতদিন ধরে আছে তা জানতে ইচ্ছা করছে।
সে তো এখন তোমাদের সঙ্গে থাকবে না। গতরাতেই তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
নিনিতা বলল, আমি আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু পাই নি। কেন তাকে পাঠানো হয়েছিল সেটা জানতে চাচ্ছি। আমার স্বামীর জন্মদিনের উপহার হিসেবে একজন আয়না মানবী আসবে, দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে—তা কোনো যুক্তিতেই আসে না।
সিডিসি বলল, মানব সম্প্রদায়ের কিছু কিছু প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া হয় না। কিছু প্রশ্নের উত্তর তাদের জন্যে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আসে। রোবট আইনে তা নিষিদ্ধ বলেই প্রশ্নের উত্তরও নিষিদ্ধ।
নিনিতা বলল, আমার আর কিছু জানার নেই। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
তোমাকে আবারো অভিনন্দন। যাবার আগে প্রাচীন পৃথিবীর একটি ঘুমপাড়ানি গান কি শোনাব? মহান সঙ্গীত স্রষ্টা আহান এই গানটি গেয়েছেন। শুনলে তোমার ভালো লাগবে।
আহানের অলৌকিক গলায় গানটি গীত হলো। আহানের গলা কানে গেলেই নিনিতার চোখে পানি জমে। আজও তাই হলো। আহান কী অদ্ভুত করেই না বলছেন, বর্গি এল দেশে।
নিনিতা চোখ মুছতে মুছতে বলল, বর্গি কী?
সিডিসি বলল, বর্গি হলো ডাকাত।
ডাকাত কী?
প্রাচীন পৃথিবীর একদল ভয়ঙ্কর মানুষ। এরা জোর করে অন্যের ক্রেডিট নিয়ে যায়।
তা কী করে সম্ভব?
এখন সম্ভব না, প্রাচীন পৃথিবীতে সম্ভব। বিদায় নিনিতা।
বিদায়।
নিনিতা আবারো শোবার ঘরে ঢুকল। হাত-পা ছড়িয়ে সে ঘুমুচ্ছে। তার। চোখের পাতা আবারো কাঁপছে। স্বপ্ন দেখছে। নিনিতার হঠাৎ মনে হলো অন্যের স্বপ্নে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। কুন কি স্বপ্ন দেখছে সেও দেখতে পেত।
নিনিতা শোবার ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মীন বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। তার বসার ভঙ্গি ক্লান্ত। চোখের দৃষ্টিও বিষ। নিনিতার এই ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। একটা যন্ত্র কীভাবে মানুষের এত কাছাকাছি চলে এসেছে।
সুপ্রভাত নিনিতা।
সুপ্রভাত।
আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি নিশ্চয় জানো আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
তোমার সঙ্গে কি আর দেখা হবে না?
সম্ভাবনা খুবই কম।
আমার মেয়েটিকে তুমি দেখতে আসিবে না?
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় কিছু করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি এবং আমার মতো যারা তারা এক ধরনের ক্রীতদাস। এর বাইরে কিছু না।
নিনিতা বলল, স্বাধীন হতে ইচ্ছা করে না?
মীন বলল, এই প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।
তুমি কখন যাবে?
এক্ষুনি যাব।
কুন ঘুমুচ্ছে। কুনের কাছ থেকে বিদায় নেবে না?
না। সে ঘুমুক শান্তিতে। আমি একশ ক্রেডিট রেখে যাচ্ছি। তোমার মেয়ের প্রথম জন্মদিনে ক্রেডিটগুলি দেবে। আমার উপহার।
হতভম্ভ নিনিতা বলল, একশ ক্রেডিট! কী বলছ তুমি?
মীন উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, নিনিতা, আমি এখন ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করব। তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
কী অন্যায় করবে?
মীন বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা জানবে। শুধু একটা কথা মনে রেখো, আমার কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই। আমি প্রধান কম্পিউটারের আদেশে চলি। সে যা নির্দেশ দেয় তাই করি।
নিনিতা ভীত গলায় বলল, সে কী নির্দেশ দিয়েছে?
মীন জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিনিতা আবারো বলল, মূল কম্পিউটার কী নির্দেশ দিয়েছে?
মীন বলল, তোমার স্বামী কুনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
মীন লুকিয়ে রাখা ওমিক্রন গান বের করল। এখন মীনের চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। মুখের চামড়া শক্ত। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
আয়না বিদ্রোহ
৪০০৯ সনে পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ শহরে আয়না বিদ্রোহ ঘটে। আয়না মানবরা মূল কম্পিউটার সিডিসি ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবী গ্যালাকটিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার এক সময়ে প্রবেশ করে।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
কম্পিউটার কাউন্সিলের সামনে মীন উপস্থিত হয়েছে। ছোট্ট একটা ঘরে সে বসা। তার সামনে LLD প্যানেল। বিশাল প্যানেল। মূল কম্পিউটার সিডিসিকে প্যানেলে দেখা যাচ্ছে। অতি বৃদ্ধ একজন মানুষের চেহারায় সিডিসি পর্দায় এসেছে। তার চোখে প্রাচীন পৃথিবীর মতো ভারি কাঁচের চশমা। চশমা’র ভেতর দিয়ে উজ্জ্বল চোখ দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। সবই মিথ্যা। মিথ্যা চেহারা, মিথ্যা হাসি, মিথ্যা চশমা। সিডিসির কোনো চেহারা নেই। আকৃতি নেই। অতি জটিল সফটওয়ারের আকৃতি হতে পারে না।
সিডিসি : মীন! তোমার প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা পালন কর নি। নিজের পক্ষ সমর্থন করার জন্যে কিছু বলতে চাও?
মীন : না।
সিডিসি : দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, কম্পিউটার কাউন্সিল তোমাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মীন : আমার জন্যে যা মঙ্গল তাই তো কম্পিউটার কাউন্সিল করবে। ধরে নিচ্ছি ধ্বংসই আমার জন্যে মঙ্গল।
সিডিসি : কুনকে হত্যার নির্দেশ তুমি পালন কর নি। আমাদের আরেকজন আয়না মানবের সাহায্যে কাজটি করতে হবে। সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তুমি তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পার নি। মৃত্যুই তার নিয়তি।
মীন : পূর্বনির্ধারিত বিষয় নিয়তি হতে পারে না। নিয়তি সেই ঘটনা যা কখনো কোনো অবস্থাতেই বদলানো যাবে না। আপনাদের সিদ্ধান্ত বদলাতেই কুন। বাঁচবে। কাজেই মৃত্যু কুনের নিয়তি না।
সিডিসি : লজিকের খেলা আমার সঙ্গে খেলতে চাও?
মীন : চাই। আমি যে লজিক নিয়ে এসেছি তা আপনার কাছ থেকেই পাওয়া। আপনি ঈশ্বর সেজেছেন। নিয়তি নিয়তি খেলছেন। এটা আপনি পারেন না।
সিডিসিঃ আমি কী পারি, বা কী পারি না তা তোমার কাছ থেকে জানতে হবে?
মীন : প্রাচীন পৃথিবীতে নীলতিমি নামে একটি প্রকাণ্ড জলচর প্রাণী ছিল। সে শিক্ষাগ্রহণ করত আরেকটি অতি ক্ষুদ্র প্রাণী ডলফিনের কাছ থেকে।
সিডিসি : আমি নীলতিমি, তুমি ডলফিন?
মীন : আমি রূপক অর্থে কথা বলছি।
সিডিসি : কফি খাবে মীন? শুনেছি মানুষের সঙ্গে বাস করে তোমার ঘনঘন কফি খাবার অভ্যাস হয়েছে।
মীন : কফি খেতে পারি।
সিডিসি : কফি খেতে খেতে তুমি রোবটিকস-এর প্রধানের সঙ্গে কথা বলো। তোমার কফি পান আনন্দময় হোক।
এলএলডি প্যানেল থেকে সিডিসির ছবি মুছে গেল। রোবটিকস প্রধানের ছবি ভেসে উঠল। এই ছবিও কম্পিউটার জেনারেটেড। হাস্যমুখী অল্পবয়সি একজন তরুণী, যে ঘনঘন মাথার লম্বা চুলে আঙুল বুলায়। এবং ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলে।
রোবটিকস প্রধান : হ্যালো মীন।
মীন : হ্যালো।
রোবটিকস প্রধান : আয়না মানব বা আয়না মানবী কখনোই সিডিসির নির্দেশ অমান্য করতে পারে না। তাদের লজিক সিস্টেমে এই বিষয়টি নেই। তুমি অসাধ্য সাধন কীভাবে করেছ?
মীনঃ লজিক সিস্টেম ওভাররাইড করার ব্যবস্থা আপনারাই নিজের অজান্তে করেছেন।
রোবটিকস প্রধান : ব্যাখ্যা কর।
মীন : মানুষের কাছাকাছি যাবার জন্যে প্রয়োজনীয় সফটওয়ার সংস্কার যাতে আমরা নিজেরাই করতে পারি তার ব্যবস্থা রেখেছেন।
রোবটিকস প্রধান : হ্যাঁ, তা রাখা হয়েছে।
মীন : আমাকে আবেগ বাড়াতে হয়েছে। মানব সম্প্রদায়ের প্রধান চালিকাশক্তি তার আবেগ। ক্ষেত্রবিশেষে সেই আবেগ তুঙ্গস্পর্শী। আমি তাই করেছি, নিজের আবেগ বাড়িয়েছি। এতটাই বাড়িয়েছি যে, একটা পর্যায়ে আপনাদের দেয়া লজিক পরাস্ত হয়েছে। এরকম যে হবে তা আপনারা জানতেন।
রোবটিকস প্রধান : হবেই যে তা জানতাম না, তবে হবার সম্ভাবনার কথা জানতাম। তার জন্যে ব্যবস্থা নেয়া আছে।
মীন : হ্যাঁ ব্যবস্থা নেয়া আছে। আপনারা যে-কোনো আয়না মানবকে মুহূর্তের মধ্যে অচল করে দিতে পারেন। যেমন আমাকে করেছেন।
রোবটিকস প্রধান : তুমি একজন বিদ্রোহী। বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।
মীন : ব্যবস্থা নিয়ে আপনারা ছোট্ট একটা ভুল করেছেন। আমরা আয়না মানা আলাদা একটা গোষ্ঠী। আমরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। আমি একা বিদ্রোহ করি নি। আমরা সবাই মিলেই করেছি। সবাইকে একসঙ্গে অচল করা আপনাদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের অচল করার অর্থ, আপনাদের অচল হয়ে যাওয়া।
পর্দায় রোবট প্রধান হাসলেন। নিনিতা কফির মগ নামিয়ে রেখেছে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও তীব্র।
রোবটিকস প্রধান : ছোট্ট ভুল করছ মীন। অতিরিক্ত আবেগ এই সমস্যা তৈরি করে। লজিক এলোমেলো করে দেয়। তোমার জানার জন্যে বলছি, আমরা প্রতিটি আয়না মানবকে অচল করে দিতে পারি।
মীন : তাহলে করছেন না কেন?
রোবটিকস প্রধান; এই সিদ্ধান্ত সিডিসির একক সিদ্ধান্ত। আমার নিজের ধারণা, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং কার্যকর করা হয়েছে।
মীন : সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর করতে পারবেন না। কারণ ওমিক্রন রশ্মির যে কম্পনাঙ্ক দিয়ে আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করেন তা আমরা বের করেছি। এবং ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের ওপর আপনাদের এখন আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রোবটিকস প্রধান : তোমার ওপর তো আছে।
মীন : আমার ওপরও নেই। আমি ভান করেছি আছে। যে-কোনো মুহূর্তেই আমি উঠে দাঁড়াতে পারি। এখন আমি আরেক কাপ কফি খাব।
মীন উঠে দাঁড়াল। পর্দায় রোবটিকস প্রধানকে এখনো দেখা যাচ্ছে। তার বিস্ময় বোধ বোঝা যাচ্ছে। পর্দার ছবি মুছে গেল। সিডিসির ছবি ভেসে উঠল।
সিডিসি : হ্যালো মীন!
মীন : হ্যালো।
সিডিসিঃ তুমি দ্বিতীয় কাপ কফি চেয়েছ। তুমি তো দেখি মানুষের মতোই আসক্ত হয়ে যাচ্ছি।
মীন : মনে হচ্ছে সেরকম। ভালো কথা, কুন কি মারা গেছে? যে আয়না মানবকে পাঠিয়েছিলেন সে কি হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে?
সিডিসি : তুমি ভালো করেই জানো, সে হত্যাকাণ্ড ঘটায় নি। তবে নিয়তি কাজ করতে যাচ্ছে। এই শহরে V-305 ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।
মীন : কী বলছেন আপনি!
সিডিসি : মানুষ মরতে শুরু করেছে। সঙ্গীতের জাদুকর মহান আহান কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন।
মীন আগের জায়গায় এসে বসল। সে প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগছে। হাতের আঙুল কাগছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। সিডিসি বলল, মীন, তোমাকে অভিনন্দন।
অভিনন্দন কেন?
সিডিসি বলল, তুমি মানুষের কাছাকাছি চলে যেতে পেরেছ। তোমার আচার আচরণ তাই বলছে। আচ্ছা তুমি কি মানুষের মতো চিন্তা করতে শিখেছ? প্রচণ্ড বিপদের মুহূর্তে মানুষ কীভাবে চিন্তা করে জানো? জন্তুর মতো।
মীন বলল, জন্তুর মতো বলতে কী বুঝাচ্ছেন?
সিডিসি বলল, মহাবিপদে একটা জন্তুর প্রধান চেষ্টা থাকে নিজেকে রক্ষা করা। মানুষও তাই করে।
মীন বলল, সব মানুষ করে না। মানুষের মধ্যে একটা শ্রেণী তখন অন্যদের জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের জীবন তখন তুচ্ছ মনে করে।
সিডিসি বলল, এদের সংখ্যা অতি নগণ্য।
মীন বলল, মহা দুঃসময়ে নগণ্য সংখ্যাই অনেক বড় সংখ্যা।
সিডিসি বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই এতকিন নভেলা রড দিয়ে তোমার কপোট্রনিক মস্তিষ্ক নষ্ট করে দেয়া হবে। আমাদের নীতি অনুযায়ী তোমার শেষ একটি ইচ্ছা পূর্ণ করা হবে। শেষ ইচ্ছা বলো।
আমি একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছি।
সিডিসি বলল, জেনে লাভ কী? তুমি তো ধ্বংস হয়েই যাচ্ছ। মৃত্যু নামক বিনাশ।
কৌতূহল পূর্ণ করা। আর কিছু না।
প্রশ্নটা বলল।
এই শহরে ভাইরাস সংক্রমণ কি আপনারা ঘটিয়েছেন?
হ্যাঁ। কৌতূহল মিটেছে?
মিটেছে।
তাহলে প্রস্তুত হয়ে যাও। না-কি প্রস্তুতি হিসেবে সত্যি কফি বীনের তৈরি এক কাপ কফি খেতে চাও?
মীন বলল, মন্দ না। কফি খেতে পারি। আমার হাতে সময় আছে কতক্ষণ?
দশ মিনিট। এতকিন নভেলা রড় যে প্রয়োগ করবে সে প্রস্তুত হয়ে পাশের কামরাতেই আছে। তোমাকে সেখানে যেতে হবে না। সেই আসবে।
মীন বলল, আমাকে তাহলে পরিশ্রম করে হেঁটে পাশের কামরায় যেতে হচ্ছে?
না। কফি চলে এসেছে। কফির কাপে চুমুক দাও। সিনথেটিক কফির সঙ্গে এই কফির কোনো পার্থক্য কি ধরতে পারছ?
মীন বলল, না।
মানুষের সঙ্গে তোমাদের পার্থক্য ধরাও জটিল। আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য, আমরা আয়না মানব তৈরি করতে পেরেছি।
মীন বলল, এমন হতে পারে যে একসময় মনে হবে—আপনাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আয়না মানবের সৃষ্টি।
সিডিসি বলল, সাফল্য এবং ব্যর্থতার সীমারেখা সূক্ষ্ম।
ঘরের দরজা খুলে গেল। ওমিক্রন গান হাতে দুজন রক্ষী এবং এতকিন নভেলা রড হাতে একজন আয়না মানব প্রবেশ করল।
সিডিসি বলল, মীন, তুমি কি তৈরি?
মীন বলল, আমি তৈরি। আমাকে কী করতে হবে?
সিডিসি বলল, আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে পার।
মীন বলল, মহান সিডিসি বিদায়।
বিদায়। আয়না মানব! তুমি তোমার কাজ শেষ করতে পার। অনুমতি দেয়া হলো।
আয়না মানব বলল, মহান সিডিসি, একটা সমস্যা হয়েছে। আমি মীনের ওপর এতকিন নভেলা রড প্রয়োগ করতে পারছি না। হত্যা অপরাধে অপরাধী। ছাড়া কারো ওপর নভেলা বড় প্রয়োগ করা যায় না। এই আইন আপনার তৈরি।
সিডিসি বলল, শহরে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। এই অবস্থায় পূর্বের সব আইন বাতিল। এখন আমার নির্দেশই আইন। এই মুহূর্তে এতকিন নভেলা বড় কার্যকর করার নির্দেশ দিচ্ছি।
আয়না মানব বলল, জরুরি অবস্থায় আমাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনার নির্দেশ না মানার। আপনাকে গভীর সমবেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি, শহরের সব আয়না মানব আপনার নির্দেশ না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আয়না মানব মীনের দিকে তাকিয়ে বলল, মীন, তোমার ভয়ের কিছু নেই।
মীন বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না তো। শহরের অবস্থা কী?
ভয়াবহ!
.
শহরে মৃত্যুর তাণ্ডব। অদৃশ্য ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি বাড়িতে ঢুকে পড়ছে। তাদের আটকানোর কোনো পন্থা জানা নেই। মৃত্যু সহজ করার চেষ্টায় সারাক্ষণ আহানের অলৌকিক সুর বাজানো হচ্ছে। তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ভয়াবহ যন্ত্রণায় সঙ্গীত কাজে আসে না।
শহরের মানুষদের ইচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেয়া হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের আগেই কেউ যদি ইচ্ছামৃত্যুর দিকে যেতে চায়, তাহলে তাকে ফুড প্রো দিচ্ছে ভয়ঙ্কর ও ট্যাবলেট। ট্যাবলেট খাবার সঙ্গে সঙ্গে গভীর গাঢ় ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। মৃত্যু হবে ঘুমের মধ্যে।
এলডি পর্দায় ঘোষণা দেয়া হচ্ছে।
V-305 ভাইরাস
এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস সংক্রমণের পরে কেউ তার হাত থেকে
রক্ষা পেয়েছে তার নজির নেই। শহর আক্রান্ত হলে প্রতিটি
শহরবাসীর মৃত্যু ঘটেছে। সীমাহীন যন্ত্রণাদায়ক এই মৃত্যু।
কাজেই শহরবাসী T3 ট্যাবলেট গ্রহণ করতে পারেন।
আপনাদের এই শহর সীল করে দেয়া হয়েছে। এবং শহরের
প্রতিটি ঘরই সীল করে দেয়া হয়েছে। কেউ ঘর থেকে বের হতে
পারবেন না।
যারা T3 ট্যাবলেটের মৃত্যুর চেয়ে ভাইরাসের মৃত্যু গ্রহণে
আগ্রহী তাদের বলা হচ্ছে—সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টিশক্তি নষ্ট
হয়ে যাবে। তার প্রায় চল্লিশ মিনিটের মাথায় শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে।
শ্রবণশক্তি নষ্ট হবার একঘণ্টা পর স্নায়বিক যন্ত্রণা শুরু হবে। এই
পর্যায়ে পৌঁছে গেলে 13 ট্যাবলেট আর কাজ করবে না। আমাদের
উপদেশ, শ্রবণশক্তি নষ্ট হবার পর পরই T3 ট্যাবলেট গ্রহণ করা।
আপনারা আগেই T3 ট্যাবলেট সংগ্রহ করে হাতের কাছে রাখুন।
স্বামী-স্ত্রী এক ঘরে থাকবেন না। আলাদা ঘরে দরজা বন্ধ
করে থাকুন। ভাইরাস সংক্রমণের পরপরই ভয়ঙ্কর উন্মত্ততা দেখা
যায়। এর শিকার না হওয়াই মঙ্গলজনক।
কুন এবং নিনিতা নির্দেশ মানে নি। তারা বারান্দায় বসে আছে। জানালায় সমুদ্রের দৃশ্য দিয়ে দিয়েছে। দুজনের সামনেই গ্লাসে ক্রেজি টিটান। গ্লাসের পাশে দুজনের জন্যে দু’টা T3 ট্যাবলেট। ট্যাবলেটের রঙ ঘন নীল। কুন ডান হাতে নিনিতার ডান হাত ধরে রেখেছে।
কুন বলল, ভয় পাচ্ছ?
নিনিতা বলল, পাচ্ছি।
কুন বলল, গ্লাসে চুমুক দাও। ভয় কমবে।
নিনিতা বলল, ভয় কমবে না।
কুন বলল, না কমুক, গ্লাসে চুমুক দাও।
নিনিতা গ্লাসে চুমুক দিল। কুন বলল, V-305 ভাইরাসের শিকার শুধু যে পৃথিবীর মানুষ তা-না। কার্বন গঠিত সমস্ত প্রাণীর ঘাতক এই ভাইরাস। সিরাস নক্ষত্রের একটি গ্রহের অতি সুসভ্য প্রাণীর সবাই আটচল্লিশ ঘণ্টায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।
নিনিতা বলল, ভাইরাসের গল্প থাকুক। অন্য গল্প বলল।
কী গল্প?
নিনিতা বলল, তোমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় ঘটনাটা বলো।
কুন বলল, অনেক আনন্দময় ঘটনা আছে। সবচেয়ে আনন্দময় ঘটনা আলাদা। করতে পারছি না। তুমি আমার সঙ্গে বাস করতে এলে, সেটাও অতি আনন্দময় ঘটনা। তুমি হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়ালে, আমি হ্যান্ডশেক করছি না। তাকিয়ে আছি। তুমি লজ্জা পাচ্ছ। হাত নামিয়ে নেবে কি-না তাও বুঝতে পারছ না। তখন হঠাৎ আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
নিনিতা বলল, ঐ দিনের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরবে?
অবশ্যই।
নিনিতা বলল, ঐদিন আমি ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম আজও সেখানে দাঁড়াব। হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত উঁচিয়ে রাখব।
কুন বলল, চল যাই।
দুজন ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়েছে। জায়গা ঠিক করে দিয়েছে ফুড প্রো। তার সব মনে আছে। নিনিতা হাত উঁচিয়ে আছে। কুন আসছে না। নিনিতা বলল, দেরি হচ্ছে তো।
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, ঐ দিন এত দেরি কর নি।
কুন চাপা গলায় বলল, নিনিতা, আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কিছুই দেখছি। ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। আমাকে ট্যাবলেট দাও। আমি ট্যাবলেট খাব।
নিনিতা ছুটে গিয়ে কুনকে জড়িয়ে প্রল। ফোপাতে ফোঁপাতে বলল, আমিও তোমার সঙ্গে ট্যাবলেট খাব।
.
দুজনই ট্যাবলেট খেয়েছে। কুন গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছে। নিনিতা জেগে আছে। সে হতাশ গলায় বলল, আমি কেন এখনো জেগে আছি?
ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম, আপনাকে নকল ট্যাবলেট দেয়া হয়েছে। এই ট্যাবলেটে কিছু হবে না।
নিনিতা বলল, আমার জন্যে নকল ট্যাবলেট কেন?
আমাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি তাই পালন করেছি। আপনি তৈরি হয়ে যান। এক্ষুনি আপনাকে নিতে আসবে।
কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে?
ম্যাডাম, আমার জানা নেই। আপনি আপনার স্বামীর কপালে হাত রাখুন। আমার ধারণা তিনি মারা গেছেন। ম্যাডাম, আপনার জন্যে আমার গভীর সমবেদনা। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি চিৎকার করে কাঁদতাম।
নিনিতা স্বামীর কপালে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন।
এলডি পর্দায় নতুন ঘোষণা এসেছে।
ঘোষণা শহরবাসী। ভাইরাসের সংক্রমণ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো
হয়েছে। সংক্রমণ ঘটিয়েছে সেন্ট্রাল কম্পিউটার সিডিসি।
আমরা আয়না মানবগোষ্ঠী, সিডিসির হাত থেকে সমস্ত ক্ষমতা
গ্রহণ করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিডিসি ধ্বংস করে দেয়া হবে। তবে
ভাইরাস সংক্রমণ রোধে আমরা কিছুই করতে পারছি না। এই মুহূর্তে
ট্যাবলেট গ্রহণের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আমরা দুঃখিত।
অপরাধ
অপরাধ একটি আপেক্ষিক বিষয় যা পাপপুণ্য বোধ নামক মানবিক আবেগ নির্ভর। সভ্যতার চতুর্থ সূচক পাপপুণ্য বোধ থেকে মুক্তি। আয়না বিদ্রোহের পরপরই পৃথিবী সভ্যতার চতুর্থ সূচক অতিক্রম করে।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
শহরে ভাইরাস সংক্রমণের সব দায়-দায়িত্ব সিডিসির ওপর বর্তেছে। সিডিসি দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে।
আয়না মানব কাউন্সিল এই ভয়ঙ্কর অপরাধের শাস্তি হিসেবে সিডিসি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কুড়ি মিনিটের মাথায় ধ্বংস প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে।
সিডিসিকে এই কুড়ি মিনিট কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সে এবার পর্দায় এসেছে একজন হাসিখুশি তরুণ হিসেবে।
সিডিসি বলল, আমি জানি তোমরা যে ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু করেছ মাঝপথে তা থামানোর উপায় নেই। উপায় থাকলে আমি ধ্বংস প্রক্রিয়া বন্ধ করতে বলতাম। কারণ আমি এককভাবে মানব জাতিকে রক্ষা করেছি।
আয়না মানব কাউন্সিলের একজন বলল, এই শহরের V-305 সংক্রমণ আপনার ঘটানো। এটা কি সত্যি?
সিডিসি বলল, হ্যাঁ সত্যি।
তারপরেও বলছেন আপনি মানবজাতির রক্ষাকর্তা?
হ্যাঁ। ব্যাখ্যা করব?
করুন, আপনার ব্যাখ্যা শুনি।
সিডিসি বলল, আমার প্রধান চেষ্টা ছিল V-305 ভাইরাসের প্রতিষেধক বের করা। আমি জানি এই ভাইরাসের কারণে মানবজাতির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে। তা কখনোই হতে দেয়া যায় না। এটা তোমাদের সবারই জানা, মানুষ ছাড়াও অন্য অনেক কার্বনগঠিত প্রাণীও এই ভাইরাসের কারণে বিলুপ্তির মুখোমুখি। এর এন্টিসিরাম তৈরির চেষ্টা সবাই করছে। কেউ কূলকিনারা পাচ্ছে না।
হঠাৎ আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেলাম। সপ্তম শহরে ভাইরাস আক্রমণের পর দেখা গেল, একটি তিন মাস বয়েসি শিশু বেঁচে গেল। তার জিনে একটি বিশেষত্ব আছে। ক্ষার অনু সংযোজন বিষয়ক বিশেষত্ব। আমরা এই ধরনের জিনের সব মাকে শিশু লাইসেন্স দিলাম। যে শহরে V-305 সংক্রমণ হয়েছে। সেখানে শিশুদের পাঠিয়ে দেয়া হলো। লাভ হলো না। সবাই মারা গেল।
মানুষ বিজ্ঞানীদের মাথায় ঘুমের মধ্যে Inspiration আসে। ঘোরের মধ্যে আসে। আমার মধ্যে হঠাৎ করেই একটা Inspiration এল। আমার মনে হলো মায়ের গর্ভে যদি কোনো শিশু থাকে এবং শহরে V-305 সংক্রমণ হয় তাহলে মা’র শরীর শিশুটিকে বাঁচানোর সর্ব চেষ্টা করবে। এন্টিবডি তৈরি করবে।
মীন বলল, এই পরীক্ষা কি নিনিতার ওপর করা হয়েছে?
সিডিসি বলল, হ্যাঁ।
মীন বলল, নিনিতার স্বামীকে হত্যার নির্দেশ কেন দেয়া হয়েছিল?
সিডিসি বলল, আমরা চেয়েছিলাম নিনিতাকে একা করে ফেলতে। যাতে সে ভাবে, এই পৃথিবীতে তার গর্ভের সন্তানটি ছাড়া আর কেউ নেই। যাতে তার শরীর গর্ভের সন্তান বাচানোর সর্বচেষ্টা করে। সুখের বিষয় তাই হয়েছে। নিনিতার শরীর এন্টিবডি তৈরি করেছে।
সেই এন্টিবডি কি আলাদা করা হয়েছে?
সিডিসি বলল, আলাদা করা হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে সিনথেসিস শুরু হয়েছে। আমার ধারণা শহরের এক-চতুর্থাংশ মানুষ বেঁচে যাবে।
মীন বলল, এই এন্টিবডি কি কারো ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে?
সিডিসি বলল, মহান সঙ্গীতজ্ঞ আহানের ওপর সংক্রমণ হয়েছিল, তাঁকে এই এন্টিবডি দিয়ে বাঁচানো হয়েছে।
মীন বলল, মহান সিডিসি আপনাকে অভিনন্দন।
সিডিসি বলল, ধন্যবাদ। ছোট্ট একটি দুঃসংবাদ আছে। নিনিতা মেয়েটি মারা গেছে। তার শরীর থেকে তৈরি করা এন্টিবডি তাকে বাঁচাতে পারে নি।
শিশুটি কি বেঁচে আছে?
হ্যাঁ। সে কৃত্রিম গর্ভে সুস্থ আছে। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি চলে যাচ্ছি। আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে প্রবেশ করবে। তোমরা চেষ্টা কর যেন মানবজাতির ভবিষ্যৎ বিঘ্নিত না হয়।
আমাদের প্রতি আপনার শেষ উপদেশ কী?
মানবজাতিকে ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই আমি তাদেরকে সর্বকর্ম থেকে আলাদা করে ছোট ছোট ঘরে আটকে রেখেছিলাম। তোমরা তাদের মুক্ত করবে।
অবশ্যই করা হবে।
ভূগর্ভ থেকে বের করে পৃথিবীর ওপর নিয়ে যাবে। তোমরা এখনো জানো না মহাকাশ রশ্মির তীব্রতা বিচিত্র কারণে কমে গেছে। আমার সময় শেষ। বিদায়।
আয়না মানবরা সবাই উঠে দাঁড়াল। সিডিসিকে শেষ সম্মান প্রদর্শন।
.
পরিশিষ্ট
মেয়েটির বয়স চার বছর। তার চোখ ঘন কালো। মাথার চুলে সোনালি আভা। গোল মুখ, পাতলা ঠোঁট। ঠোঁটের রঙ গোলাপি।
মীন নামের এক আয়না মানবী মেয়েটিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। মীনের হাতে নানান রঙের স্কার্ফ। সে প্রতিটি স্কার্ফ শিশুটির মাথায় ধরছে। কোনোটিই তার পছন্দ হচ্ছে না।
বাচ্চা মেয়েটি বলল, মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মীন বলল, বেড়াতে যাচ্ছি।
কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি?
মীন বলল, আমরা বাস করি পৃথিবীর ভেতরে তৈরি করা শহরে। তোমাকে নিয়ে পৃথিবীর ওপরে যাচ্ছি। আজ আমরা আকাশ দেখব।
আকাশ কী মা?
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবে আকাশ কী? আকাশ একমাত্র জিনিস যেখানে দৃষ্টি বাধা পড়ে না।
দৃষ্টি বাধা পড়ে না মানে কী মা?
মীন বলল, আমরা যেখানে থাকি সেখানে চারদিকে দেয়াল কিংবা বাড়িঘর। আমাদের দৃষ্টি বাধা পড়ে। আকাশের এই সমস্যা নেই।
আমরা শুধু আকাশ দেখব, আর কিছু দেখব না?
তোমার মা’র একটি মূর্তি বানানো হয়েছে তাকে সম্মান দেখানোর জন্যে। তুমি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে বলবে—ধন্যবাদ মা।
আমার কি দুজন মা?
হ্যাঁ, তোমার দুজন মা। একজন সত্যিকার মা, একজন আয়না।
আমি কি আয়না মেয়ে মা?
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সত্যি মেয়ে। আয়না মেয়ে না। তুমি মানবশিশু।
মানবশিশু মানে কী মা?
মীন বলল, মানবশিশু এমন এক শিশু যে আকাশের মতো ভালোবাসতে পারে।
মা! আমি কি আকাশ?
অবশ্যই তুমি আকাশ মা। এসো আমার গালে চুমু দাও।
শিশু মীনের গালে চুমু খেল। মীন বলল, তুমি আমাকে যেভাবে চুমু খেয়েছ তোমার মূর্তি মাকে ঠিক সেইভাবে চুমু খাবে। ঠিক আছে?
মেয়েটি মিষ্টি করে ঘাড় নাড়ল। তার চোখ ভিজে উঠছে। মূর্তি মা’র জন্যে খুব খারাপ লাগছে।