তারাপদরা কিকিরার বাড়িতে হরেকরকম পুরনো নতুন, নানান ধরনের জিনিসপত্র দেখেছে। এসব তাঁর জমিয়ে রাখার শখ। ওরা অবাক হল না।
জহর বলল, অবাক হয়েই, “ঘড়ি নিয়ে আমি কী করব, কাকা?”
“তুমি কী করবে আর! সময়মতন চালু করে দেবে। কেমন করে দেবে আমি দেখিয়ে দেব। ভেরি ইজি ব্যাপার।”
“তারপর?”
“পাঁজাবাবুকে যা বলার বলতে দেবে। তুমি চেষ্টা করবে তাঁকে দিয়ে বেশি কথা বলাবার।”
“মানে?”
“মানে যতটা পারো নিরুদ্দেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবে। কোথায় কবে কেমন করে নিরুদ্দেশ হলেন মহিলা? এতকাল পরে ফোটোটা এনলার্জ করার দরকার পড়ল কেন? কী হবে এনলার্জ করিয়ে? অত রিটাচ করারই বা দরকার কেন?”
“ফোটোই হল না, তো রিটা।”
“যদি ওঁর নেগেটিভ থেকে হয়?”
“কিন্তু কাকা, এসব ওঁর ফ্যামিলির ব্যক্তিগত ব্যাপার। বলবেন কেন?”
“না বলতেও পারেন! আই অ্যাডমিট।”
“তবে?”
“জহর! আমি পাঁজামশাইকে দেখিনি। তাঁর সম্পর্কে জানি না কিছু। তবু তোমায় বলছি, ভেতরে কোনও বড় রহস্য আছে। সাম্ মিস্ট্রি। নয়তো এতকাল পরে ভদ্রলোক ফোটো নিয়ে এত ব্যস্ত, উতলা হতেন না।”
জহর চুপ করে থাকল।
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। তারাপদরাও যেন গন্ধ পাচ্ছিল রহস্যের।
“আমরা এখন উঠি,” কিকিরা বললেন জহরকে। “ঘাবড়ে যেয়ো, না। কাল আমি যথাসময়ে তোমার স্টুডিয়োর কাছাকাছি হাজির থাকব। দেখাও হবে। নার্ভাস হবে না একেবারে। চলি।” কিকিরা উঠে পড়লেন।
.
৫.
হালদার স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা এগিয়ে কিকিরা দাঁড়িয়ে পড়লেন।
কলকাতা শহরে কদাচিৎ বসন্তকালের মোলায়েম ফুরফুরে স্নিগ্ধ হাওয়া অনুভব করা যায়। এখন যে হাওয়া দিচ্ছিল তা মনোরম, খানিক এলোমেলো। ফুটপাথের পাশেই পুরনো এক গির্জা, সামান্য ফাঁকা মাঠ, কয়েকটা সাবু গাছ।
“কটা বাজল, চাঁদু?”
চন্দন ঘড়ি দেখল হাতের। “সাড়ে সাত বেজে গিয়েছে।”
কিকিরা একবার আকাশের দিকে তাকালেন। পূর্ণিমার কাছাকাছি কোনও তিথি। দ্বাদশী ত্রয়োদশী হবে।
“ভাবছি একবার পানু মল্লিকের কাছে যাবা”
“ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার?” তারাপদ বলল।
“ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার আবার কী হে! ক্রিমিন্যাল কেসের প্র্যাকটিস করেন।”
“ওই হল!… তা তাঁর কাছে কেন?”
“পানুদাকে বলেছিলাম, আপনার পাড়ার কাছাকাছি পাঁজামশাই থাকেন, একটু খবরাখবর নেবেন।”
“ও! কোথায় থাকেন আপনার পানু মল্লিক?”
“কেশব সেন স্ট্রিট।” বলেই হাত বাড়ালেন কিকিরা, “দেখি একটা ফুঁ দাও তো!” ফুঁ মানে সিগারেট। কিকিরা নিজের মনেই বললেন, “পানুদার ঠিকানা কেশব সেন স্ট্রিট হলেও ওঁর বন্ধুবান্ধব আজ্ঞা থিয়েটার ক্লাব বরাবরই বউবাজারের দিকে ছিল।”
সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে তারাপদ বলল, “এখন যাবেন। বেটাইম হয়ে যাবে না। গিয়ে হয়তো দেখবেন, ভদ্রলোক মক্কেল নিয়ে বসে আছেন। উকিল আর ডাক্তার– সন্ধেবেলায় কামাই দেয় না শুনেছি। টাকা কামাবার টাইম ওটা।” বলে চোখ টেরা করে চন্দনকে দেখল।
চন্দন পাত্তাই দিল না তারাপদকে, কথাটা যেন তার কানেই যায়নি। “আপনি একা যাবেন তো চলে যান, আমরা কেটে পড়ি।”
“তা হয় না। তোমরাও চলো। …আরে আমি বুড়োমানুষ, অর্ধেক কথা মাথায় আসে না, যা শুনি ভুলেও যাই। চলো।”
“আমাদেরও টেনে নিয়ে যাবেন!”
“বা, তোমরাই তো আমার কমান্ডো।”
তারাপদরা হেসে উঠল। কিকিরা নজর করে ফাঁকা ট্যাক্সি দেখছিলেন। পেয়েও গেলেন একটা।
ট্যাক্সিতে বসে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “চাঁদু, তোমাদের ডাক্তারিতে কী বলে! এমন তো অনেক সময় দেখো, আপাতত, গোড়ায় গোড়ায় যে রোগটাকে সিম্পল বলে মনে করছ, পরে দেখলে সেটা ভীষণ জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক কি না?”
চন্দন মাথা হেলিয়ে বলল, হয়।
“আমার সন্দেহ হচ্ছে, পাঁজাবাবুর কেসটা জলবৎ নয়।”
তারাপদ বলল, “সার, জলবৎ না জটিলবৎ সেকথা বাদ দিন। এই কেসটা তো আপনাকে কেউ নিতে বলেনি। ক্লায়েন্ট নেই। তবু নিজেই আপনি নাক গলাচ্ছেন।”
কিকিরা বললেন, “আমার যে স্বভাব ওইরকম। নেই কাজ তো। খই ভাজ।” বলে হেসে উঠলেন।
.
পানু মল্লিক নীচেই ছিলেন। তাঁর বাড়ির চেম্বারে। এক মক্কেলকে সবেই ঘর থেকে সরিয়েছেন, কিকিরা মুখ বাড়ালেন।
“আরে কিঙ্কর!”
“আসব?”
“ন্যাকামি কোরো না! এসো।”
“আপনার আরেক মক্কেল বাইরে বসে আছে।”
“কালী!” পানু মল্লিক ডাকলেন।
ঘরের একপাশে আধবুড়ো একটি লোক টাইপ মেশিন আর কাগজপত্র নিয়ে বসে ছিল। কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
পানু মল্লিক বললেন, “বাইরে বলরাম শীল বসে আছে। তাকে বলে দাও, কাল কোর্টে গিয়ে যেন দেখা করে। জজসাহেবকে কাল পাব না। এ হপ্তায় কাজের কাজ কিছুই হবে না। সবুর করতে হবে ক’টা দিন।”
কালী চলে গেল।
পানু মল্লিক কিকিরাদের বসতে বললেন। “ও দুটি তোমার নন্দীভৃঙ্গী নয়!”
কিকিরা হাসলেন। তারাপদদের চেনেন পানু। চোখের চেনা।
দু-চারটে সাধারণ কথা। তারপর কিকিরা বললেন, “আমার সেই পাঁজামশাই, বিনয় পাঁজার খোঁজ নিয়েছেন?”
“নিয়েছি কিছু কিছু। …আরে ওই ভদ্রলোক তো এখন লাটে উঠে বসে আছেন। টোটালি ডুবে গিয়েছেন।”
“মানে?”
“আমি শুনলাম, ভদ্রলোক দেনায় দেনায় মাথা ডুবিয়ে বসে আছেন। সবচেয়ে বড় দেনা হল, তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে বারো কাঠা জমি ওইরকম হবে, একটা লোককে মর্টগেজ দেন। জমির মালিকানা ছিল বিধবা মায়ের নামে। সত্তর আশি হাজার টাকায় মর্টগেজ ছিল। সুদ ধরা ছিল টাকার ওপর। এখন সুদ সমেত তার পাওনা ছ’সাত লাখ টাকা।