“গম্ভীর।”
“হিজ মাস্টার্স ভয়েস?” চন্দন ঠাট্টা করে বলল।
“মেজাজ আছে।”
“তা থাক। কড়া হলে অন্যরকম মনে হত।”
ততক্ষণে জহর ফিরে এল। এসেই বলল, “আমার একটু দেরি হয়ে গেল কাকা। আসলে আমি বুলুবাবুর দোকানে গিয়েছিলাম। ওঁর বাবাকে বিকেলে নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে। হার্ট অ্যাটাক। খবর নিয়ে এলাম। পাশাপাশি সব দোকান, একসঙ্গে আছি..”
“তোমার বিনয়বাবু ফোন করেছিলেন।”
জহর যেন ঘাবড়ে গেল। “কিছু বললেন?”
“আবার ফোন করবেন।”
মাথা নাড়তে নাড়তে জহর টেবিলের সামনে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। “কাল থেকে এই নিয়ে বারচারেক হয়ে গেল। এক
একবার ফোন আসে আর আমার বুক ধড়ফড় করে।”
“তুমি কাল পাঁজামশাইকে ফোন করে খবরটা জানিয়েছ তা হলে!”
“জানিয়েছি। তবে একটু ঘুরিয়ে।”
“মানে?”
“বললাম, যে-লোকটিকে পাঠিয়েছিলাম, আমার দোকানের পাতকীদা, সে ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তার ব্যাগটা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় হারাল…”
“অশ্বত্থামা হত ইতি গজ…”
“হ্যাঁ, এইরকম আর কী! শুনে তো উনি একেবারে আগুন। রাগে ফেটে পড়লেন। যা মুখে এল বললেন আমাকে। ….আমি তখনকার মতন ওঁকে ঠাণ্ডা করার জন্যে বললাম, আমি খোঁজখবর করছি। ব্যাগটার। পতাকীদা বাড়িতে পড়ে আছে বিছানায়, নয়তো…”
“ওতে কি আর ভবি ভোলে?”
“ভুলছে না। কাল দু’বার ফোন এসেছে। আজ ও-বেলা একবার। আবার এখন একবার। আরও তো আসবে বলছেন।”
চন্দন বলল, “একটা পুরনো ফোটোর জন্যে এমন পাগলামি! ভদ্রলোকের এত হইচই করার মানেটা কী?”
দোকানের ভেতরের দরজাটা হালকা কাঠের ঠেলা-দরজা। বাইরের দিকেও একটা দরজা আছে, কাঠের। দরজা ঠেলে যে ঢুকল তার হাতে চায়ের কেটলি আর কাপ৷ জহরকে বলতে হল না, আগেই বলে এসেছে। কিকিরাদের চা দিল লোকটি। জহরও চা নিল।
লোকটি চলে যাওয়ার পর জহর বলল, “পতাকীদা আমায় ডুবিয়ে দিল। এখন আমি কী করব! বিনয়বাবুকে সামলাই কেমন করে!”
তারাপদ তামাশা করে বলল, “এক কাজ করুন। বাড়ির কেউ হারিয়ে গেলে লোকে কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, অমুক চন্দ্র অমুক নিরুদ্দেশ। বয়েস এত, চেহারার একটা বর্ণনা…। আপনি ভদ্রলোককে বলুন-ফোটো নিরুদ্দেশের একটা বিজ্ঞাপন দিতে কাগজে।” বলে হাসল।
চন্দন বলল, “কেন! শুধু মানুষ কেন, দরকারি কাগজপত্র, চাবি, লাইসেন্স হারানোর বিজ্ঞাপনও তো কাগজে থাকে।”
জহর কোনও জবাব দেবে না ভেবেছিল। যার জ্বালা সে বোঝে, অন্যে কী বুঝবে! ওরা রসিকতা করছে করুক।
কিছু বলব না ভেবেও জহর হঠাৎ বলল, “যাঁর ফোটোর কথা হচ্ছে–তিনি অবশ্য সত্যিই নিরুদ্দেশ।”
কিকিরা একবার তারাপদদের দেখলেন, তারপর জহরের দিকে তাকালেন। “নিরুদ্দেশ। মানে মিসিং।”
“হ্যাঁ। নিখোঁজ।”
“কবে? কই, তুমি তো আগে আমায় বলোনি।”
“আমি কেমন করে বলব! জানতাম আগে?”
“জানতে না!… কবে জানলে?”
“গতকাল,” জহর বলল। চুপ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর কেমন হতাশ গলায় বলল, “কাল যখন উনি আবার ফোন করলেন, দ্বিতীয়বার, তখন আমি কিছু না ভেবেই বলেছিলাম, “আপনি রাগ করছেন কেন? একটা ফোটো তো! আপনি বলুন, যেদিন বলবেন, আমি আপনার বাড়ি গিয়ে তুলে আনব।… উনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, কার ফোটো তুলবে! যে-মানুষ নেই তার ফোটো তুলবে। ননসেন্স। কাজটা অত সহজ হলে আমি তোমায় পুরনো ফোটোটা পাঠাতাম না, বলতাম না–তুমি ওই পুরনো থেকে আমায় একটা এনলার্জ কপি করে দাও।”
“নেই মানে?” কিকিরা বললেন।
“মানে আমি জানি না। তবু বোকার মতন বলেছিলাম, সে কী! মারা গিয়েছেন। আমার কথা শুনে কী ভাবলেন কী জানি, শুধু বললেন, মিসিং, খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
“মিসিং! তারপর।”
“আর কিছু বলেননি। আমিও সাহস করে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি।”
কিকিরা বেশ অবাক। চন্দনদের দিকে তাকালেন। তারাও বোকার মতন বসে আছে। বুঝতে পারছে না ঠিক কী হয়েছে, হতে পারে।
এমন সময় ফোন বাজল।
ফোন তুলল জহর।
“হ্যাঁ, জহর বলছি।” ওপাশ থেকে বিনয়বাবুই কথা বলছেন। কী বলছেন কিকিরা শুনতে পাচ্ছিলেন না; শোনার কথাও নয়। জহর শুধু সাড়া দিয়ে যাচ্ছিল।
সামান্য পরেই ফোন রেখে দিল জহর। “পাঁজামশাই?”
“হ্যাঁ।”
“কী বললেন?”
“বললেন,কাল বিকেলে উনি নিজেই আসবেন দোকানে। অনেক খুঁজে একটা নেগেটিভ তিনি পেয়েছেন। অন্য নেগেটিভ। পড়ে থেকে থেকে ফেড হয়ে গিয়েছে। নষ্ট হয়ে যাওয়াই সম্ভব। তবু সেটা নিয়ে তিনি আসবেন, যদি কাজে লাগে।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “তা আগে এলেই তো পারতেন।”
জহর বলল, “উনি অসুস্থ মানুষ। বয়েস হয়েছে। কী করে বুঝবেন যে-ফোটোটা পাঠাচ্ছিলেন সেটা হারিয়ে যাবে ওভাবে।”
“উনি অসুস্থ। কী অসুখ?” কিকিরা জানতে চাইলেন।
“আমি তো শুনলাম, সবসময় মাথা ঘোরে। বললেন, ভারটিগো।”
“ভারটিগো!” চন্দন বলল, “ভারটিগো সাধারণত ঘোরানো সিঁড়ি-টিড়ি উঠতে গেলে হয়, খুব উঁচু জায়গায় গিয়ে নীচে তাকালেও হয়। আরও নানা কারণে হতে পারে। উনি কি হাইপার টেনশান–মানে হাই ব্লাড প্রেশারে ভোগেন?”
অসহায় মুখ করে জহর বলল, “আমি জানি না। হতে পারে…”
কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। চোখ বুজে ডান হাতটা কপালে রেখে বসে থাকলেন। খানিকটা পরে চোখ খুললেন। বললেন, “শোনো উনি কাল আসছেন আসুন। ভালই হল। আমিও আসব। তবে দোকানে নয়। উনি যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ নয়। তার বদলে একটা জিনিস আমি রেখে যাব।” বলে কিকিরা হাত বাড়িয়ে টেবিলের একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখালেন। “শোনো জহর, কাল একসময় এই বেলার দিকে এসে আমি তোমার টেবিলেই ওই জায়গায় একটা ডেস্ক পে-হোল্ডার রেখে যাব। ছ’ সাত ইঞ্চি লম্বা। হোল্ডারের মাঝখানে একটা ছোট ঘড়ি। টেল ঘড়ি৷ দেখতে কালো, ছোট, হালকা, স্মল পিস। ঘড়িটার দু পাশে দুটো খোপ আছে। একটাতে পেন-হোল্ডার-মানে কলম রাখার ব্যবস্থা, অন্যটায় পেপারকাটার, ক্লিপ এ-সব। আসলে টেক্ল ঘড়ি হলেও এটা কিন্তু টেপ রেকর্ডার। পেন হোল্ডারের মুখটা আসলে মাইক। তলায় টেপ আর ব্যাটারি রাখার ব্যবস্থা। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। জাপানি মাল তো, পাক্কা অ্যারেঞ্জমেন্ট। ফ্যান্সি মার্কেট থেকে কিনেছিলুম। … আমার কাছে এরকম দু-একটা জিনিস আরও আছে, অন্য কায়দার। তবে সেগুলোয় এখানে সুবিধে হবে না। ঘড়িটাই একদম মানিয়ে যাবে।”