“পরে সেটা ভাবা যাবে। আগে তুমি একটা ফোন করো পাঁজামশাইকে। তাঁর রি-অ্যাকশানটা দেখো। তারপর যা করার করতে হবে।”
“আপনি যদি দেখেন তার চেয়ে ভাল আর কী হবে!” জহর অনুরোধের গলায় বলল।
কিকিরা হাসলেন। সমেহ হাসি। “দেখা যাক..!”
.
৪.
তারাপদদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর জহরকে বললেন কিকিরা, “এরা অ্যামেচার। আমারই মতন। যেমন গুরু, তেমনই চেলা। তবে কাজের বেলায় অপদার্থ নয় একেবারে।” বলে হাসলেন।
জহরকে আগে কোনওদিন দেখেনি তারাপদরা। দেখার কথাও নয়। দুজনেই দেখছিল জহরকে। একেবারে সমবয়েসি না হলেও প্রায় কাছাকাছি বয়েস। চোখমুখের চেহারাতেই বোঝা যায়, ভদ্র সাদাসিধে মানুষ। ঘোরপ্যাঁচে থাকার লোক নয়। বরং. খানিকটা বেশি সরল।
পতাকী আজও দোকানে আসেনি। তবে অনেকটাই ভাল। পাশের দোকানের একটি আধবুড়ো লোককে মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে জহর তার দোকান সামলে যাচ্ছে। আগামীকাল হয়তো পতাকী আসতে পারে।
কিকিরাদের দোকানে বসিয়ে জহর বলল, “কাকা, আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি। পাঁচ-সাত মিনিট…”
সন্ধে হয়ে গিয়েছে। এখন সাত, সোয়া সাত। দোকান বন্ধ হবে আরও ঘণ্টাখানেক পরে। আটটায়। বাইরের বড় রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় এখনও কম নয়। তবে কমে আসছে ক্রমশ। একটা বাসের হর্ন কানের পরদা কাঁপিয়ে চলে গেল এই মুহূর্তে।
তারাপদরা দোকানের ভেতরটা দেখতে দেখতে বলল, “এ একেবারে ভেরি ওল্ড দোকান, সার। চেয়ার টেবিলগুলো পর্যন্ত সে আমলের। কাঠের বাজারে দাম আছে।”
কিকিরা নিস্পৃহ গলায় বললেন, “ওল্ড ইজ গোল্ড।”
তারাপদ মজা করে বলল, “পিওর, না খাদ মেশানো?”
চন্দন দোকানের দেওয়ালে টাঙানো কয়েকটা ফোটো দেখছিল। ফ্রেমে বাঁধানো বড় আর মাঝারি ছবি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি, একটি বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, মড়ক বা দুর্ভিক্ষের অসাধারণ এক ফোটোগ্রাফ। আরও আছে। পুরনো হাওড়া ব্রিজ, ময়দানে দাঁড়ানো একটা ফিটন…. মায় একটা ভাঙা কলসি আর কাক, কলকাতার গঙ্গার ঘাট– বাবুঘাট বোধ হয়।
চন্দনের কৌতূহল হচ্ছিল। কিছু ফোটোগ্রাফ এত পুরনো যে, ওসব দৃশ্য যখন তোলা হয়েছে জহর তখন জন্মায়নি, বা শিশু।
কিকিরা চন্দনকে দেখছিলেন। অনুমান করতে পারলেন সে কী ভাবছে। বললেন, “ভেরি সিল ব্যাপার, চাঁদুবাবু! জহরের বাবার হাতে ভোলা ফোটো অনেক, দু-একটা আবার বাবার গুরুর, মানে যিনি হাত ধরে জহরের বাবাকে বিদ্যেটা রপ্ত করাতেন। বাকি যা দেখছ…”
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে চন্দন বলল, “আপনি দেখছি নাড়ি নক্ষত্র জানেন?”
“জানি মানে, শুনেছি। আড্ডা মারা স্বভাব, দোকানে এলে গল্প-গুজব হত–তখন শুনতাম। বিখ্যাত বিপ্লবী হেম কানুনগো একজন মাস্টার ফোটোগ্রাফার ছিলেন, জানো?”
চন্দন মাথা নাড়ল, জানে না।
স্টডিয়োর এটা অফিসঘর। হাতকয়েক জায়গা। টেবিল চেয়ার। একটা পুরনো আলমারি। কাঁচের পাল্লা। ভেতরে বিক্রিবাটার জন্যে শস্তা দু-তিনটে বক্স ক্যামেরা, ফিল্ম রোল, বাঁধানো অ্যালবাম। ডানপাশে বোধ হয় স্টুডিয়ো ঘর। কাঠের খুপরি ঘরের দরজা
তারাপদ হঠাৎ হেসে বলল, “কিকিরা, আপনি কি কোনও সময়ে ক্যামেরা কাঁধে ঘুরতেন নাকি?”
“আমি! …না তারাবাবু, নেভার। আমার দুটো জিনিস নেই, ধৈর্য আর তৃতীয় নয়ন।”
“সে কী, সার! আপনার তো দুটোই প্রবল।”
“ঠাট্টা করছ! …তা হলে তো তোমাদের ভজুদার বাণী শোনাতে হয়!”
“কে ভজুদা?”
“ফিশ ক্যাচার। ছেলেবেলার, আমার ছেলেবেলার কথা বলছি, ভজুদা আমাদের পাড়ার পয়লা নম্বর ওস্তাদ ছিল মাছ ধরার। এগারোটা নানা টাইপের ছিপ, এক কৌটো বঁড়শি, সাত কিসিমের চার বানাতে পারত। ভজুদার কাছে তালিম নিতে গিয়েছিলাম। একটা পুঁটিমাছও ধরতে পারিনি। ভজুদা তখন মাথায় চাঁটি মেরে বলেছিল, তোর দ্বারা হবে না! ওরে গাধা, তোর না আছে ধৈর্য, না চোখ। না ধৈর্য, না দৃষ্টি…. ওরে ভূত, অর্জুন কি সাধে অর্জুন! চোখের দৃষ্টি একেবারে নিবাত নিষ্কম্প…. তুই গর্দভ– গো ব্যাক। ভাতের পাতে যে মাছভাজা পাবি, তুলে নিয়ে মুখে পুরগে যা। পুকুরের মাছে তোর নো চান্স।”
তারাপদ হাসতে হাসতে বলল, “সংস্কৃত বাণীটাও ভজুদার?”
“ও ইয়েস। ভজুদার ইংলিশও ছিল আমার মতন। হোম মেইড ইংলিশ।”
ওরা হেসে উঠল।
এমন সময় ফোন বাজল দোকানের। টেবিলের ওপর ফোন। কিকিরারা ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। জহর ফেরেনি এখনও। তিনি ইতস্তত করে উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন।
সাড়া দিলেন না কিকিরা। সরাসরি নয়। তবে শব্দ করলেন। কাশলেন যেন।
ওপাশ থেকে গম্ভীর গলা, “জহর…!”
কিকিরা টেলিফোনের মুখের কাছটায় হাত চাপা দিলেন। তারাপদদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। চুপ করতে বললেন।
“উনি একটু বাইরে গেলেন; আসবেন এখনই,” কিকিরা ফোনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সাধারণ ভাবে বললেন।
“তুমি কে?” ওপার থেকে প্রশ্ন।
“আমি ওঁর চেনা কাস্টমার। …আমাকে বসিয়ে একটু বাইরে গেছেন দরকারি কাজে এসে পড়বেন।”
“ঠিক আছে। আমি পরে ফোন করছি।”
“কী নাম বলব?
“বিনয়বাবু?” ওপাশে ফোন নামিয়ে রাখলেন ভদ্রলোক।
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। “পাঁজাবাবুর ফোন।” গলায় ঈষৎ উত্তেজনা। সরে এলেন টেবিলের সামনে থেকে।
তারাপদ বোধ হয় আগেই আন্দাজ করেছিল। চন্দনের দিকে তাকাল।
“কড়া গলা নাকি, সার?” তারাপদ বলল।