“তেতলায় কে থাকে?”
“বলতে পারব না। আমি তো তেতলায় উঠিনি। ওপরে কোনও শব্দও শুনিনি!”
“ফাঁকা পড়ে থাকত?”
“কী জানি!…আমি তো ফোটো তুলতে একবারই মাত্র গিয়েছি।”
“ছবি দিতে যাওনি?”
“না। উনি এসে দোকান থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।”
চা প্রায় শেষ। কিকিরা চুমুক দিলেন চায়ে। আলগাভাবে। বললেন, “ওঁকে একবারই দেখেছ?”
“না, না, আরও দু-তিনবার দেখেছি। পথেঘাটে।” জহর জল খেল আবার। চায়ের কাপ টেনে নিল। “ভদ্রলোক খুব ইন্টারেস্টিং। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, না হলে ফিনফিনে আদ্দির। পরনে মিহি ধুতি- দুইই বেশ দামি। গলায় একটা সোনায় গাঁথা পাথরের মালা। কী পাথর জানি না। হালকা নীল দেখতে। দানাগুলো ছোট ছোট। কাঁধে রঙিন চাদর। মাথার চুল ঝাঁকড়া, ফোলানো। হাতের আঙুলে অদ্ভুত সব আংটি…. লোহা, সিসে, তামা, সোনা, রুপো। বাঁ হাতে পাথর বসানো একটা বড় আংটি। কী পাথর জানি না। কালো কুচকুচে দেখতে।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করছিলেন। “আচ্ছা! জ্যোতিষী ভক্ত। ভাগ্য বিশ্বাসী। কী করেন উনি? ভাল কথা, বয়েসটা বললে না?”
“বয়েস হয়েছে৷ ফোটো তুলতে যখন গিয়েছিলাম তখন ওনার বয়েস পঞ্চাশ-টঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এখন ষাটের মতন হবে।”
“মানে ঠিক বুড়ো নয়, প্রৌঢ়! কলসির জল গড়িয়ে খান? না, কিছু করেন? ব্যবসাপত্র?”
জহর বলল, “তা আমি জানি না, কাকা! তবে চাকরিবাকরি করার লোক নয়। ওসব পুরনো বনেদি বাড়িতে চাকরি করার রেওয়াজ থাকে না। গোলামির ধাতই নয় ওঁদের। ব্যবসাপত্র কী করেন বা করতেন, বলতে পারব না। শুধু জানি বা শুনেছি, বীরভূমের কোথায় যেন বিস্তর জমিজমা, বাগান, পুকুর, চালকল, এটাসেটা ছিল। জমিদার বংশ।”
“আর কলকাতায়?”
“এখানেও ছিল। তবে এটা পৈতৃক। আর বীরভূমে ওঁর মাতুল বংশের বাড়ি। সেই বংশ একেবারে ফাঁকা। বিনয়বাবুই একমাত্র জীবিত স্বজন। তিনিই মাতুলবংশের যাবতীয় সম্পত্তি ভোগদখলের উত্তরাধিকার পেয়েছেন।”
কিকিরা কেমন ধাঁধায় পড়ে গেলেন। বীরভূমে মাতুলবংশের জমিদারি আর কলকাতায় পৈতৃক সম্পত্তির একমাত্র মালিক।
কী ভেবে কিকিরা বললেন, “ভদ্রলোককে তুমি চিনলে কেমন করে?”
মাথা নাড়ল জহর। “সেভাবে আমি চিনি না, কাকা। বাবার সঙ্গে আলাপ ছিল। বাবার কাছে মাঝেসাঝে আসতেন। তখন দেখেছি। যেটুকু শুনছি তাও বাবার মুখে। আপনি তো জানেন, বাবা আজ প্রায় আট বছর আগে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।”
অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন কিকিরা! চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে একটা চুরুট ধরালেন।
শেষে কিকিরা বললেন, “পতাকীর ব্যাগ তো খোয়া গিয়েছে। বিনয়বাবুর পাঠানো ফোটো তো তুমি হাতে পেলে না। এরপর–?”
জহর মাথা চুলকে হতাশ গলায় বলল, “আমি বুঝতে পারছি না কী করব?”
“ফোটোটা যে খোয়া গিয়েছে, জানিয়েছ পাঁজামশাইকে?”
“না।”
“কেন?” ‘সাহস হচ্ছে না।”
“সাহস!”
জহর ইতস্তত করে বলল, “বিনয়বাবু বারবার বলে দিয়েছিলেন, ওটা খুব জরুরি। সাবধানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে। কাজটাও পনেরো দিনের মধ্যে করে দিতে হবে।” বলে একটু থেমে জহর কেমন সন্দেহের গলায়, বা খুঁতখুঁতে গলায় বলল, “আশ্চর্য কী জানেন। ফোটোটার–মানে ওটা এনলার্জ করার পর কোথায় কী রিটাচ করতে হবে তাও বলে দিয়েছিলেন।”
“মানে?”
“মানে রিটাচের সময় বাঁ চোখটা ডান চোখের তুলনায় সামান্য ছোট করতে হবে, চোখের দৃষ্টি একটু টেরা, মাথার কাপড় কপাল পর্যন্ত নামিয়ে দিতে হবে, নাক অতটা খাড়া রাখা চলবে না, গাল বসা, ভাঙা গোছের… আরও ছোটখাট দু-চারটে ব্যাপার!”
কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “কেন?”
“সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। কতকাল আগে এক বৃদ্ধা মহিলার ফোটো তুলেছিলাম– মুখের ফোটো একেবারে নিখুঁত হয় না সাধারণত। তবু একটা মুখ নিয়ে কাজে বসলে আমরা–আমি অন্তত যেমন প্রয়োজন রিটাচ করে থাকি। বাবা অনেক ভাল পারতেন কাজটা। আমি অতটা পারি না। তবু খারাপ করি না। তা বলে, মুখের চেহারাটাই আমি দেখলাম না, মনেও নেই, উনি আমায় ফোনে কী কী করতে হবে বলে দিচ্ছেন, এটা কী ধরনের কথা!”
“তুমি কিছু বলেনি?”
“না। মুখে আসছিল, বলতে পারলাম না। বুড়োমানুষ; বাবার সঙ্গে আলাপ ছিল একসময়। ভাবলাম, আগে তো ফোটোটা দেখি, কী অবস্থা হয়েছে সেটার, তারপর বলা যাবে। ফোটো কম-বেশি নষ্টও হয়ে যেতে পারে।”
‘যত্ন করে না রাখলে হতেও পারে,” কিকিরা বললেন। চুপ করে গেলেন হঠাৎ। পায়ের দিকে একটুকরো কাগজ উড়ে এসেছিল হাওয়ায়। সরিয়ে দিলেন। বাইরে রোদ বাড়ছে। উজ্জ্বল রোদ আলোর সঙ্গে তাত। বাতাস সামান্য গরম।
কিকিরা বললেন, “তুমি একটা ফোন করো পাঁজামশাইকে, বা নিজে তাঁর বাড়ি যাও। ব্যাপারটা বলো। ওঁর কথামতন কাজ যখন নিয়েছ তখন তো তোমার জানানো উচিত, ফোটোটা তুমি পাওনি, সেটা খোয়া গিয়েছে।”
“তা তো বলতেই হবে। ভাবছি, আজ ফোন করব। নম্বরটা উনি বলেছিলেন।”
“দেখো কী বলেন! …আচ্ছা জহর, তোমার কি মনে হয়, কেউ জেনেশুনে পতাকীর কাছ থেকে ব্যাগটা হাতিয়েছে? তা যদি হয় তবে মামুলি পকেটমারের কাজ এটা নয়। টাকা-পয়সার জন্যেও ব্যাগ হাতায়নি। তার উদ্দেশ্য ছিল ওই ফোটোটা হাতিয়ে নেওয়া!”
জহর গলা ঘাড় মুছে নিল রুমালে। কিকিরাকে দেখছিল। বলল, “আমি বুঝতে পারছি না কাকা। আপনি যা বলছেন, সেরকম সন্দেহ আমারও হয়েছে। কিন্তু ভাবছি, সামান্য একটা ফোটো হাতাবার জন্যে এত কাণ্ড কে করবে? কেনই বা করতে পারে? …আমি পতাকীদাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, কেউ তাকে কিছু বলেছে কি না! কিংবা তার পিছু নিয়েছিল বলে মনে হয়েছে কি না! পতাকীদা বলছে, একটা লোক তার পিছু নিয়েছিল। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার কথাটা উড়িয়ে দিতেও পারছি না। হয়তো একটা গোলমাল, আছে। হয়তো…?”