কিকিরা বললেন, “এসো। আমি ভাবছিলাম তোমার না দেরি হয়!”
কিকিরাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল জহর। বড় পরিবারের ছেলে; সহজ শিষ্টাচার, সহবত ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
জহরকে দেখতে সাধারণ। মাঝারি লম্বা। স্বাস্থ্য ভালই। পলকা নয় আবার মেদবহুল নয়। মাথার চুল কোঁকড়ানো। চোখ-নাক পরিষ্কার। সামনের একটা দাঁত আধ-ভাঙা। তবে ওর চোখ দুটিতে কেমন একটা আবেগ মাখানো। মনে হয়, ভাবুক বা কল্পনাপ্রবণ।
“বোসো, চা-টা খাও। তাড়া নেই তো?” জহর বসবার আগেই কিকিরার জন্যে অপেক্ষা করল। “আপনি বসুন।”
কিকিরা বসলেন।
“আমি প্রথমে পতাকীদার বাড়ি গিয়েছিলাম। কেমন আছে খবর নিয়ে এলাম।”
“কেমন আছে?”
“পায়ে হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। রাত্রে জ্বরও এসেছিল। সকালে কম। এখন দু-তিনদিন বসে থাকতে হবে বাড়িতে।”
“জোরেই পড়েছিল। …তা ও আসবে না। তোমার দোকান?”
“ও ব্যবস্থা করে নেব। আজ একজনকে বলে এসেছি দোকানটা খুলে দেবে। দশটায় খুলি। এখান থেকে ফিরতে ফিরতে যদি দশটা বেজে যায়–তাই বলে এসেছি। দুপুরে একবার বাড়ি যাব, খাওয়া দাওয়া সেরে আসতে। বিকেল থেকে দোকানেই থাকব।”
জহরের বাড়ির খবরাখবর নিলেন কিকিরা অভ্যাসমতো।
“তারপর,” কিকিরা বললেন। “কাজের কথা শুনি। ব্যাপারটা কী, জহর?”
জহর বলল, “কাকা, আমি নিজেই জানি না ভেতরের ব্যাপারটা কী! গত পরশুদিন আমায় এক ভদ্রলোক, পাঁজাবাবু, দোকানে ফোন করে বললেন যে, আমাদের ভোলা ভোলা ফোটো, তাঁর মায়ের, ওঁদের বাড়িতে রয়েছে। সেই ফোটো থেকে ফুল সাইজ, মানে পুরো বড় সাইজের একটা এনলার্জড কপি করে দিতে হবে। কোথাও কোথাও রিটাচ’ দরকার।”
“তোমাদের দোকানের, মানে স্টুডিয়োতে ভোলা ফোটো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের ভোলা, তবে স্টুডিয়োতে নয়। ওঁদের বাড়িতে গিয়ে ভোলা।”
“তা ও বাড়ি থেকে ফোটো পাঠাবে কেন? তোমাদের স্টুডিয়োয় ছবিটার নেগেটিভ নেই?”
জহর মাথা নাড়ল। আলগা ধরনের হাসি। বলল, “না। সব ফোটোর কি নেগেটিভ রাখা যায়! স্পেশ্যাল হলে রাখা যায়। আছেও আমাদের। এমনি অর্ডিনারি ফোটোর নেগেটিভ রাখব কেন! সম্ভব নয়। কাস্টমারকেই দিয়ে দিই। আমাদের স্টুডিয়োয় ইস্পট্যান্ট ঘটনা, বিশিষ্ট বিখ্যাত মানুষজনের কারও কারও ফোটোর নেগেটিভ এখনও আছে। প্রিন্টও আছে কিছু। কিন্তু রাম-শ্যাম যদু মধুর নেগেটিভ নেই। রাখি না? কেউ রাখে না। তা ছাড়া, কাকা, আগেকার দিনের ফিল্মের কোয়ালিটি আজকের মতন ছিল না। রাখলেও নষ্ট হয়ে যেত।”
“ফোটোটা কে তুলেছিল?”
“আমি।”
“কতদিন আগে?”
“আমার সঠিক মনে নেই। উনি যা বললেন তাতে মনে হল, ছ’সাত বছর আগে।”
“তোমার স্টুডিয়োতে নয়!”
“না, পাঁজাবাবুর বাড়িতে গিয়ে। তাঁর বিধবা মায়ের ছবি। বৃদ্ধা মহিলা। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস হবে। মাথায় কাপড়–মানে থান। গায়ে নামাবলি চাদর। হাতে মালা। আসনে বসে ছিলেন।”
কিকিরা বুঝতে পারলেন। এরকম ফোটো অনেক বাড়িতেই দেখা যায়, জীবনের শেষবেলায় তুলে রাখা ঠাকুমা-মা-দিদিমার ছবি। ঠাকুরদা বা বাবারও হতে পারে। সব ফোটোরই ধরন প্রায় এক। হেরফের বিশেষ থাকে না।
বগলা চা জলখাবার নিয়ে এল। রেখে দিল সামনে। জহর বলল, “এত?”
“আরে খাও।”
“এত আমি পারব না, কাকাবাবু?”
“খুব পারবে। ইয়াং ম্যান। সেই কোন দুপুরে বাড়ি গিয়ে ভাত খাবে। ওমলেট, রুটি আর দুটো মিষ্টি খেতে না পারলে হজমযন্ত্রটা শরীরে রেখেছ কেন! নাও, হাত লাগাও।”
কিকিরা নিজের চায়ের মগ তুলে নিলেন। সকালের দিকে তাঁর তিন মগ চা বাঁধা। খাদ্য যৎসামান্যই খান।
জহর যেন বাধ্য হয়েই খাবারের প্লেটটা তুলে নিল। তার আগে জল খেল গ্লাস তুলে নিয়ে।
“জহর, তোমার ওই পাঁজাবাবুর নাম কী? …বিনয় পাঁজা?”
জহর অবাক! তাকিয়ে থাকল। “আপনি জানলেন কেমন করে! পতাকীদা বলেছে?”
“না। পতাকী কি নাম জানত?”
“কই! আমি তো নাম বলিনি। ঠিকানা বলেছিলাম আর একটা স্লিপ, টুকরো স্লিপ দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, আমার লোক পাঠালাম, যা দেওয়ার দিয়ে দেবেন। খামের ওপর পেনসিলে শুধু মিস্টার বি. পাঁজা লেখা ছিল। ওঁর পুরো নাম বিনয়ভূষণ না, বিনয়রঞ্জন– আমি মনে করতে পারিনি।”
“মিস্টার?”
“হ্যাঁ। শ্ৰী লিখিনি। …আপনি কেমন করে নাম জানলেন। চেনেন নাকি?”
“আমি কেমন করে চিনব! তোমার ফোন পেয়ে কী মনে হল, পরে একজনকে ফোন করলাম। কাছাকাছি পাড়ায় থাকে। পুরনো লোক। ক্রিমিন্যাল কেসের প্র্যাকটিস করেন। পাকা উকিল।”
“ও! …চেনেন তিনি বিনয়বাবুকে?”
“নামে চেনেন। আলাপ নেই,” বললেন কিকিরা। জহরের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকলেন। জহর খাওয়া শুরু করেছে। চোখ সরিয়ে জানলার দিকে তাকালেন একবার। বোদ এখনও জানলার ওপারে। অনেকটা বেলায় ঘরে ঢুকবে। আবার চোখ ফেরালেন কিকিরা। বললেন, “অনেককালের পুরনো বাড়ি শুনলাম পাঁজাবাবুদের। এখন শুধু ইট ছাড়া চোখে পড়ে না কিছু।”
“ঠিকই শুনেছেন। বহু পুরনো জরাজীর্ণ বাড়ি। বাইরে থেকে ইটই চোখে পড়ে। ভেতরে নীচের তলায় খুপরি খুপরি ঘর। হরেকরকম লোক। তারা কেউ দরজিগিরি করে, কেউ স্টিলের বাসন মাথায় নিয়ে ফেরি করে পাড়ায় পাড়ায়, কারও বা হাওয়াই চপ্পলের ব্যবসা-ফুটপাথে বসে কেনাবেচা…”
“পাঁজামশাই থাকেন কোথায়?”
“দোতলায়। আমি দোতলায় দেখেছি তাঁকে। সেকালের দোতলা, মানে যত ঘর তত প্যাসেজ! ফোটোও তুলেছিলাম দোতলার পিছন দিকের একটা ঘরের সামনে। বোধ হয় পাশেই ঠাকুরঘর।”