স্তব্ধ ঘরে যে যার মতন দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণকান্ত চোখের পাতা বুজে ফেলেছেন। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
না।
বাসুদেব ঘরে এল৷ সঙ্গে মুনশি। এমনভাবে এল বাসুদেব যেন সে জানতে এসেছে, ঘরে এরা কারা, বেপরোয়া রূঢ় গলায় বলল, “কে? আপনারা কারা? এখানে কেন?”
কৃষ্ণকান্ত চোখ খুললেন। কিকিরা যে কখন আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ভয়ংকর বস্তু বার করেছেন, কেউ দেখতে পায়নি। এগিয়ে গিয়ে ছকুর হাতে গুঁজে দিলেন, নজরে পড়ল না কারুর।
বাসুদেব হাত তুলে ঘরের দরজা দেখাল। “বেরিয়ে যান। ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকে গুণ্ডামি?”
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছকু অদ্ভুত কায়দায় বাসুদেবের গলা চেপে ধরল। একটা হাত তার গলায় পেঁচিয়ে আছে, অন্য হাতে সরু পাতলা অস্ত্র। সাইকেলের চাকার স্পোকের মতন সরু। কিন্তু অতি তীক্ষ্ণ, ধারালো।
বাসুদের নড়তে পারল না। অস্ত্রের সূক্ষ্ম মুখটা তার গলায় লাগছে। সামান্য নড়লেই গেঁথে যাবে।
কিকিরা দু পা এগিয়ে গেলেন। “টাকাটা কোথায়?”
“টাকা!”
“আড়াই লাখ টাকা! কোথায় টাকা?”
“আমি কী জানি! কী যা-তা বলছেন?”
“ছকু!”
ছকু হাতের অস্ত্রটা প্রায় গলায় চামড়ার সঙ্গে ছুঁইয়ে ঈষৎ চাপ দিল।
“আমি জানি না।”
কিকিরা বললেন, “আমাদের সঙ্গে পুলিশ আছে। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। ডাকব?” বাসুদেবকে ভয় দেখাবার জন্যে ধাপ্পা দিলেন কিকিরা। ঠাট্টার গলায় বললেন, “উর্দিপরা নয়, প্লেন ড্রেস! ডাকব?”।
ছকু এবার হাতের অস্ত্রটা বাসুদেবের থুতনির তলায় এমনভাবে চেপে ধরল যে, সামান্য নড়াচড়া করলেই গলায় বিধে যাবে ধারালো মুখটা।
কিকিরা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন, চন্দনকেই পুলিশের অফিসার বলে চালাবেন। প্লেন ড্রেস অফিসার তো! মানিয়ে যাবে। চন্দনের চেহারা ভাল, ডাক্তারি করতে করতে দিব্যি গাম্ভীর্যও রপ্ত করে ফেলেছে।
ছকু যেন সাঁড়াশির মতন আঁকড়ে ধরেছে গলাটা। বাসুদেবের নিশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
বাসুদেব কোনওরকমে বলল, “বলছি। আমার গলা ছেড়ে দিন। জিভ বেরিয়ে আসছে।” ঘামে ভয়ে তার মুখ অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। চোখ লালচে হয়ে উঠেছে।
কিকিরার ইশারায় গলার কাছ থেকে হাত সামান্য সরিয়ে নিল ছকু।
বাসুদেব শ্বাস নিল। তারপর বাইরের দিকে হাত দেখাল। “বাইরে জলের রিজার্ভারের মধ্যে মোটা পলিথিন শিট জড়িয়ে অ্যাটাচিটা ফেলে রেখেছি।”
“নিয়ে যাওনি?”
“না। পারিনি। এখন ওই টাকা নিয়ে গোলমাল চলছে এবাড়িতে। পরে নিয়ে যেতাম।” বলে কৃষ্ণকান্তকে দেখাল। “উনি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর।”
“টাকা তুমি নিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি তো শুনলাম এ-বাড়িতে ছিলে না তখন?”
মুনশি হঠাৎ বলল, নিজের থেকেই, “কর্তাবাবু জানেন না। বাসুবাবু আগের দিন ছিলেন। রাত পর্যন্ত। পরের দিনও দুপুরে এসেছিলেন লুকিয়ে। আমি জানি।”।
“বাসুদেববাবু কেমন করে জানবে টাকা দেওয়ার কথা? কে বলেছে যে, কুমারকে টাকা দেওয়া হবে?”
মুনশি বলল, “আজ্ঞে, এসব কথা বাসুবাবুর না জানার কথা নয়। কর্তামশাই নিজেই বলেছেন। তবে টাকা দেওয়ার কথাই। কবে কখন তা কি বলেছেন!”
কৃষ্ণকান্ত এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন কিকিরাদের। কথা শুনছিলেন। এবার বিরক্তির গলায় বললেন, “হ্যাঁ, বলেছি। বলব না কেন? দোষটা কোথায়! টাকাপয়সা জড়ো করা হচ্ছে নগদ, ও জানতে পারবে। একথাও বলেছি, আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। অসুখটাও এখন পাকাপাকি জড়িয়ে ধরেছে। ডাক্তারদের ওপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। কবে কী হয় কে জানে! তা আমি চাই না, আমাদের বাড়ির এই ঝামেলা টিকে থাকুক। আমি মারা যাওয়ার পর কুমার আমার স্ত্রীকে জ্বালিয়ে মারবে! তার চেয়ে ওকে কিছু দিয়ে-থুয়ে বরাবরের মতন ঝঞ্জাটটা চুকিয়ে দেওয়া ভাল।”
কিকিরা বললেন, “তাহলে তো সবই জানিয়ে দিয়েছিলেন আপনি।”
“না”, মাথা নাড়লেন কৃষ্ণকান্ত। “কত টাকা দেব এখন তা হয়তো বলেছি কথায় কথায়। তবে কোনদিন কখন, তা বলিনি। টাকার ব্যবস্থা করে যেদিন মুনশি আর আমি গোনাগুনি করছিলাম, সেদিন বাসুদেবকে দেখিনি। আমাদের কাজকর্ম হচ্ছিল ঘরের দরজা বন্ধ করে রাত্তিরবেলায়। ও তখন কোথায়?”
মুনশি ঘাড় নাড়ল। আবার বলল, “কতামশাই জানেন না। আগে যা বলেছি। আমি–সেটাই ঠিক। বাসুবাবু সেদিন এ বাড়িতে অনেকটা রাত পর্যন্ত ছিলেন। হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন আমরা কী নিয়ে ব্যস্ত থাকব।”
“কিন্তু সে ছিল কোথায়, মুনশি?” কৃষ্ণকান্ত বললেন।
“এ বাড়িতে লুকিয়ে থাকার জায়গার অভাব কোথায় কর্তাবাবু!” মুনশি বলল। “আমিও তো আগে ওঁকে দেখিনি। পরে দেখলাম। দোতলায় ঠাকুরঘরের পাশে কোঠাটায় ছিলেন। পরে চলে গেলেন।”
“আমি তো জানি না।” কৃষ্ণকান্ত বললেন।
কিকিরা সামান্য হেসে বললেন, “আপনার চোখ কতটা আর দেখতে পারে! বাসুদেব অনেক চালাক। বাহাদুরিও আছে। ও সবই নজরে রেখেছিল।…কী বলো বাসুদেব?”
কেমন হতাশ ভেঙে পড়া গলায় বাসুদেব বলল, “আমি কিন্তু একটা কথা জানতাম না। ভাবতেও পারিনি।”
“কী কথা?”
“টাকা নিতে এসে কুমার দেখবে, উনি–মানে চৌধুরীমশাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আর ও চলে যাবে। ভয়ে কুমার পালিয়ে গেল–আমি দেখেছি। ওই জানলার ওপাশে আমি সব দেখছিলাম লুকিয়ে।”
“ও।”
“অ্যাটাচি সরাবার সুযোগটা হঠাৎ এসে গেল আমার।”