কিকিরা বললেন, “তাহলে আপনি তাকে কয়েক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন কেন? দয়া করে?”
“হ্যাঁ। দয়া করে।..বছরের পর বছর সে আমায় চিঠি লিখে লিখে উত্যক্ত করত। তার চিঠির বয়ান ছিল ইতরের মতন। আমার স্ত্রী, জামাই, মেয়ে, সকলেই সেটা জানে।…আপনি নিজেই জানেন আমি অসুস্থ। বয়েস হয়েছে। এই অসুখ সারার নয়। কবে কী হয়ে যায় ভেবে আমি ওকে কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম–যাতে ভবিষ্যতে আর না গণ্ডগোল করে।”
“মানে, আপনি ওকে টাকা দিয়ে বরাবরের মতন মিটমাটের একটা চুক্তি সই করে নিতে চেয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ।”
“প্রথম কিস্তির টাকাটা তো ও পায়নি।”
“পেয়েছে। টাকা নিয়ে ও পালিয়েছে।”
“কেমন করে আপনি জানলেন? ও যখন এই ঘরে আসে–আপনি আর্মচেয়ারে শুয়ে, মাথা ঘাড় হেলিয়ে মরা মানুষের মতন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনার গলায় চাদর জড়ানো। ও ভয় পেয়ে বোকার মতন পালিয়ে যায়।”
কৃষ্ণকান্ত প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। “মিথ্যে কথা। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে টাকা নিয়েই ও পালিয়েছে..” বলে গলা তুলে ডাকলেন, “কে আছে রে বাইরে, মুনশিকে ডেকে দে।”
কিকিরা ইতস্তত করলেন। মুনশি কি দেখেছে নবকুমারকে। কিন্তু তা কেমন করে হবে?
হঠাৎ কী মনে করে কিকিরা বললেন, “চৌধুরীমশাই, একটা কথা আপনাকে বলি। আজ এই বাড়ির বাইরে আমাদের লোকজন আছে। নজর রাখছে। নবকুমারও আছে। যদি বলেন তাকেও ডাকাতে পারি।”
কৃষ্ণকান্ত খেপাটে গলায় বললেন, “চুপ করুন। আমাকে ভয় দেখাবেন না। চোরের হয়ে আমায় শাসাতে এসেছেন!” বলতে বলতে গলা কর্কশ হয়ে এল। অভ্যাসবশে পানের ডিবে খুলে একটা পান নিলেন। পানের ওপরে ভিজে কাপড়ের টুকরো! জরদার কৌটো সামনেই।
মুনশি এল।
বছর পঞ্চাশ বয়েস। দোহারা গড়ন। পরনে ধুতি আর বড় ফতুয়া। চোখের চশমা হাতে।
কাছে এসে মুনশি আড়ষ্ট গলায় বলল, “বাবু!”
“মুনশি! সেদিন, ওই ছোঁড়াটাকে টাকা দেব বলে আগেরদিন আমার দোতলার ঘরে, তুমি আমার চোখের সামনে গুনে আড়াই লাখ নগদ টাকা অ্যাটাচিতে রাখলে না?”
“হ্যাঁ, বাবু। রেখেছি।”
“টাকার অ্যাটাচিটা চেস্টে রাখা হল। পরের দিন বিকেলে আমি যখন এ ঘরে এলাম, চেস্ট খুলে টাকার ব্যাগটা তুমি আমার হাতে দিলে।”
“দিয়েছি বাবু।”
“শুনুন মশাই-” “কিকিরাকে বললেন কৃষ্ণকান্ত, “আপনি নিজের হাতে ওই টাকা এনে এখানে রেখেছি। এই টেবিলে। আমাদের কুলদেবতা চণ্ডীর নামে শপথ!…আর কিছু বলতে চান?”
কিকিরা কথাটা অস্বীকার করলেন না। নবকুমার টেবিলের ওপর রাখা অ্যাটাচি দেখেছে। “টাকাটা–ওই অ্যাটাচি গেল কোথায়?”
“কোথায় গেল! আপনার মক্কেল জানে না? চুরি করেছে।”
“তাহলে তো আপনার থানা-পুলিশ করা উচিত ছিল। কেন করেননি?..না করে লোক পাঠিয়ে নবকুমারকে ভয় দেখিয়েছেন! অ্যাটেম্পট টু মার্ডার, আর চুরি।”
কৃষ্ণকান্ত মুখ মুছে নিলেন চাদরে। পাখাটা জোরেই চলছিল। ঘরের আলো অতটা উজ্জ্বল নয়। কৃষ্ণকান্তর যেন দম ফুরিয়ে আসছিল। গলা ভেঙে আসছে। বললেন, “পারতাম। কেন করিনি জানেন?”
“কেন?”
“কুমারকে ঘরে ঢুকতে বা বেরিয়ে যেতে আমি দেখিনি। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অঘোরে। যেমন হয় আমার হঠাৎ হঠাৎ.. প্রমাণ ছিল না যে!..তা ছাড়া দ্বিতীয় কারণ, আপনি বুঝতে পারবেন না ঠিক। চৌধুরীবংশে, কোর্ট কাছারি, মামলা মোকদ্দমা অনেক হয়েছে। তাতে আমাদের লজ্জা নেই। ওটা আভিজাত্যের লক্ষণ। তা বলে ঘরের কেচ্ছার জন্যে থানা-পুলিশ আমরা করি না।”
কিকিরা অবাক হয়ে গেলেন। অদ্ভুত তো!
“কিন্তু টাকা সে নেয়নি,” কিকিরা বললেন। বলে দরজার কাছে গিয়ে ডাকলেন–”ছকু।” আসলে ঘন্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গে ছকু তৈরি ছিল।
কোথায় কোন আড়ালে লুকিয়ে ছিল ছকু চোরের মতন, হাজির হয়ে গেল।
কিকিরা বললেন, “নবকুমারকে ডাকো। ওদেরও আসতে বলতে পারো।”
কৃষ্ণকান্ত মুনশিকে জল আনাতে বললেন। তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। মুনশি চলে গেল।
কিকিরা বললেন, “টাকাটা আর কে নিতে পারে বলে আপনি সন্দেহ করেন?”
“জানি না।”
“আপনার কর্মচারীদের কেউ?”
“না।”
“বাসুদেব?”
“বাসুদেব! সে তখন কোথায়?”
“এ বাড়িতে ছিল না?”
“না।”
“আপনি তার ওপর ভরসা করে এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন কেন?”
“আমি যখনই কলকাতায় আসি, কাউকে না কাউকে দেখাই। লাভ কিছুই হয় না। এবারে ও নিজেই…”
মুনশি জল নিয়ে এল।
কৃষ্ণকান্ত জল খেলেন। স্বস্তি পেলেন যেন।
এমন সময় ছকু ঘরে এল, সঙ্গে নবকুমার।
কৃষ্ণকান্ত দেখলেন নবকুমারকে। “তুমি এইসব দলটল জোগাড় করেছ! আমায় অপদস্থ করতে চাও?”
“আমি টাকা নিইনি।” নবকুমার বলল।
কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সকলকে চমকে দিয়ে প্রাণপণে এক চড় মারলেন নবকুমারের গালে। “স্কাউন্ড্রেল। লায়ার। চোর।” কাঁপতে কাঁপতে আবার তিনি বসে পড়লেন আর্মচেয়ারে। হাঁফাচ্ছিলেন। ঘামছেন দরদর করে।
হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কিকিরা। অন্যরাও বিমূঢ়। নবকুমার মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে।
মুনশি হঠাৎ বলল, “বাবু, বাসুবাবুকে ডাকব?”
“কোথায় সে?”
“ওপরে। সামান্য আগে এসেছেন।”
“ডাকো।”
মুনশি বাসুদেবকে ডাকতে গেল।
কিকিরা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন কৃষ্ণকান্তকে। বললেন না। ভদ্রলোকের মানসিক উত্তেজনা তাঁকে যেন ক্ষিপ্ত করেছে।