কবিরাজমশাই ওষুধ খুঁজতে খুঁজতে বললেন, “আমাদের অসুবিধে কী তা জানেন! এ তো এলাপ্যাথি হোমিওটোমিও নয়, চাইলেই দু’-এক শিশি বার করে দেব! বড়িও নয়। কারখানার জিনিস নয়, মশাই। আমাদের হল গাছগাছড়া খুঁজেপেতে নিজের হাতে তৈরি। সময় লাগে। দেখি কী পাই।”
কিকিরা বসে থাকলেন। লাটুকে তুলে নিয়ে এসেছেন দোকান থেকে। তাঁর উদ্দেশ্য ওষুধ নয়।
“আপনার তেলটা আমার বড় উপকারে লেগেছে।”
“সুনিদ্রা হচ্ছে।”
“ভালই হচ্ছে।”
“আর ওই ক্ষুধাবৃদ্ধির চূর্ণটা?”
“বোধহয় ধাতে লেগেছে…”
কবিরাজমশাই হাতড়া-হাতড়ি করে পেলেন কিছু।
বসলেন।
“আপাতত এটা দিচ্ছি। জ্বালার উপশম হবে। দুটি করে বটিকা দিনে তিনবার, সামান্য দুধ দিয়ে খাবেন। চামচ পরিমাণ। মধু দিয়ে খাবেন না। দুধের বদলে জল হতে পারে।…ভাল কথা, অল্প কিছু খাবেন না। দধিও নয়।”
ওষুধের বড়ি নিয়ে কিকিরা পঞ্চাশ টাকার একটি নোট সামনে এগিয়ে দিলেন।
কবিরাজমশাই টাকাটা নিয়ে নিলেন।
“আপনার কথা আমি অন্য দু-একজনকে বলেছি। তারাও হয়তো আসবে।”
কবিরাজ বললেন, “কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আমরা তো এখন বাতিল। দু’-একটা অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ খসড়া করে রাখলেই কি চলে মশাই? চলে না। অথচ দেখুন বাজারে হঠাৎ ভেষজ ভেষজ রব উঠেছে কেমন। কত কোম্পানি। লাখ লাখ টাকা ঢালছে! কোটির হিসেবে ব্যবসা। আমরা আর কী করতে পারলাম।”
কিকিরা কথা পালটালেন। “একটা কথা মনে পড়ল।”
“কী?”
“তেমন জরুরি ব্যপার নয়।…আচ্ছা, আপনার প্রতিবেশী কৃষ্ণকান্তবাবুর এক আত্মীয়কে আমি চিনতাম। সেদিন আপনার কাছ থেকে ফেরার সময় তাকে দেখলাম ওই বাড়ির সামনে। আমায় চিনতে পারল না।”
“কে বলুন তো?”
“নামটা মনে হচ্ছে বাসুদেব।”
“বাসুদেব। বাসুদেব পাঁজা!”
“চেনেন?”
“মুখে চিনি। তবে আমার সঙ্গীটি, ওই যে বিপিন সাধু, যে দাবা খেলতে আসে চৌধুরীমশাইয়ের বাড়ি থেকে, কর্মচারী ওই বাড়ির, তার মুখে ওর কথা শুনেছি। ওকে আপনি চিনলেন কেমন করে! শুনেছি, ছোকরার স্বভাব মন্দ, ধাপ্পাবাজ, বড় বড় কথা বলে। দু’ নম্বর তিন নম্বরি কারবার… ও বাড়ির লোকই নিন্দে করে ছোকরার।”
“মানে, লেজ গজিয়েছে এখানে থাকতে থাকতে, তাই আমাদের আর চিনতে পারল না।”
“দুর্জন না চিনলেই ভাল।”
“ও কি ওই বাড়িতেই থাকে!”
“না। ওবাড়িতে থাকে না। বেলেঘাটায় থাকে।” বলে একটু ভেবে একটা পাড়ার নাম বললেন। “তবে এবাড়িতেও আড্ডা গাড়ে মাঝে মাঝে।”
কিকিরা আর বসলেন না। তাঁর যা জানার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে।
হয়তো এতটা জানতে পারবেন, আশা করেননি।
“আজ আমি চলি কবিরাজমশাই, আবার আসব।”
চলে এলেন কিকিরা।
.
লাটুর কাছে এসে শুনলেন, একটা ছোকরা এইমাত্র ট্যাক্সি করে এসে কৃষ্ণকান্তবাবুদের বাড়ি ঢুকল। আগের দিনও দেখেছে একে।
.
০৯.
কৃষ্ণকান্ত দরজার দিকে ঘাড় ঘোরালেন। পায়ের শব্দ পেয়েছিলেন তিনি।
“ও, আপনি?”
কিকিরা নমস্কার করলেন। আগের দিনের মতনই সন্ন্যাসীর বেশ। মাথায় গেরুয়া টুপি। চোখে চশমা। গলায় ছোট চাদর, রুদ্রাক্ষের মালা।
“আপনাদের যে তর সইছে না, মশাই।” কৃষ্ণকান্ত শ্লেষের গলায় হয়তো নয়, কিন্তু বিরক্তির সঙ্গে বললেন। বসতেও ইশারা করলেন না।
কিকিরা বিনীতভাবে বললেন, “আপনি কয়েকদিন পরই আসতে বলেছিলেন। কলকাতায় থাকবেন না, দেশে ফিরে যাবেন জানিয়েছিলেন।”
“ঠিক আছে।…আমি মুনশিবাবুকে বলে যাব। পরে এসে শ’ পাঁচেক টাকা নিয়ে যাবেন। পাকা রসিদ দেবেন।”
“পাঁচ শো!”
“কেন! কম হল!” কৃষ্ণকান্ত এবার বিদ্রূপ করেই বললেন, “চাইছেন ভিক্ষে, তাও আবার মন উঠছে না।”
কিকিরা হাসির মুখ করলেন। “আজ্ঞে, মানুষের স্বভাবই এই রকম। যা পায় তাতে মন ওঠে না। আদ্যিকালের কথাই ধরুন। মহাভারত তো পড়েছেন। দুর্যোধনের কি কম ছিল? কুরুবংশ…”
কৃষ্ণকান্ত ধমকের গলায় চুপ করিয়ে দিলেন কিকিরাকে। “জ্ঞান দিতে এসেছেন আমাকে? কোথাকার সাধু, এসেছেন ভিক্ষে চাইতে, বড় বড় কথা বলছেন?”
“বড় কথা কেন হবে চৌধুরীমশাই, মানুষের স্বভাবের কথা। এই সংসারে সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি–! আপনি নিজেও কি তার বাইরে?”
কৃষ্ণকান্ত থমকে গেলেন। দেখলেন কিকিরাকে। “মানে?”
কিকিরা হাসি হাসি মুখেই বললেন, “মানেটা আপনি যথেষ্ট বোঝেন। নুরপুরের রাজত্ব একাই আপনি ভোগ করে যাচ্ছেন কেন? কোন অধিকারে? রজনীকান্তবাবুর?…”
কৃষ্ণকান্ত চমকে উঠলেন। সোজা হয়ে বসলেন আর্মচেয়ারে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখলেন কিকিরাকে। “আপনি কে?”
“আমি কে জানার আগে আপনি নিজেই বলুন আপনার অধিকার কতটা সঙ্গত?” বলতে বলতে কিকিরা হঠাৎ শূন্যে হাত বাড়িয়ে একটা ছোট্ট ঘন্টি বার করলেন। ঠাকুরপুজোর সময় বাড়িতে যেমন ঘন্টি বাজায়। ঘন্টিটা বাজালেন। অদ্ভুত শোনাল টুংটুং শব্দটা।
কৃষ্ণকান্ত চমকে উঠলেন। অত্যন্ত অপ্রসন্ন ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। তবু কী মনে করে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন কিকিরাকে। সন্দেহের গলায় বললেন, “আপনি সেই চোর নচ্ছার ছেলেটার টাকা-খাওয়া লোক নাকি!..ঘন্টি বাজিয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছেন!”
“যা ভাবেন।”
“তাহলে শুনুন, আমার ছোট ভাই রজনীকান্ত–একটা ছেলেকে নিজের কাছে রেখে লালন করেছিল মাত্র। গোরু-ভেড়া বামুন চাকর-যাকে ইচ্ছে পালন করা যায়। অনাথ অবোধকে এভাবে অনেকেই পালন করে। তাকে আইনত দত্তক নেয়নি। অন্তত সে রকম কোনও প্রমাণ নেই। আপনার মক্কেল কোর্ট কাছারি করেছিল। হেরে গিয়েছে। আপনি কি বলতে চান একটা রাস্তার ছেলেকে আমি চৌধুরীবংশের অন্দরমহলে ঢুকিয়ে নেব, তাকে উত্তরাধিকার দেব, মেনে নেব? না। আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না।”