“কী করে?”
“ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করত শুনেছি। আর তো কিছু জানি না।”
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি চান করতে যাও। পারলে এক কাপ চায়ের কথা বলে যেও। আমি নবকুমারের সঙ্গে দুটো কথা বলে নিই।”
“তা বলুন। তবে ওই বাসুদেবকে কোথায় পেলেন আপনি?”
“ছকু।…তোমরা চলে আসার পর ছকু এসেছিল। তার কাছে শুনলাম। কৃষ্ণকান্তবাবুর দেখাশোনার দায়িত্ব এখন তার হাতে। মানে, চৌধুরীমশাইকে সে বড় বড় ডাক্তারবদ্যির কাছে নিয়ে যাচ্ছে।”
“ও! কনট্যাক্ট ম্যান…!” তারাপদ আর দাঁড়াল না। স্নানে চলে গেল।
কিকিরা নবকুমারকে বসতে বললেন।
বসল নবকুমার।
“বাসুদেবের বয়েস কত?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“ক-ত! আমার চেয়ে বড়। ত্রিশ-বত্রিশ বছর হবে।”
“কেমন মানুষ? দাদার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?”
নবকুমার বিপদে পড়ে গেল যেন। সে নিজেই কত দিন-বছর হল নুরপুরে যায় না। দিদিরা অন্য জায়গায় থাকে, তবু বাড়িতে গেলে হয়তো দিদির কথা শুনতে পেত। দিদির সঙ্গেও দেখা নেই। ওদের সংসারের খোঁজখবরও রাখে না। তবে দুই ভাইয়ের মধ্যে মাখামাখি বেশি নেই, সেটা জানে।
কিকিরা অপেক্ষা করছেন দেখে নবকুমার আরও অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, “আমি ঠিক জানি না। তবে বাসুদা শুনেছি বেশিদিন কোথাও কাজ করতে পারে না। ঘন ঘন কোম্পানি পালটায়।”
“ফ্যামিলি নিয়ে থাকে?”
“না। বিয়ে-থা করেছে বলে জানি না।”
“তোমার সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে?” নবকুমার মনে করার চেষ্টা করল। দু’-চার মাসের মধ্যে তো নয়ই। প্রায় আচমকা মনে পড়ল, আরে–এই তো সেদিন–শীতের শেষাশেষি ম্যাডান স্ট্রিটের একটা ইলেকট্রিকের দোকানের সামনে দেখা। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাকে খুঁজছিল। নবকুমারকে দেখতে পেয়ে ডাকল। দু-একটা কথার পরই বলল, তোর কাছে শ’ দুই তিন টাকা আছে? দে তো! একজনের আসার কথা, আসছে না এখনও, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। দু দিন পরে ফেরত দিয়ে আসব তোকে!
নবকুমারের কাছে তখন বাড়তি টাকা শ’খানেক ছিল। বলল, “দু-তিনশো টাকা নেই।”
বাসুদা কেমন বিরক্তির মুখ করল। “পকেটে দু-তিনশো টাকাও থাকে না? ফাঁকা! তোর দোকান চলে কেমন করে! রাবিশ।”
নবকুমারের গায়ে লাগেনি কথাটা। বাসুদাকে সে যতটা দেখেছে তাতে জানে, চালিয়াতি করার, অন্যকে উপেক্ষা করার, ছোট করার অভ্যেস তার আছে। বোধহয় মিথ্যেবাদীও।
“মনে পড়ছে না?” কিকিরা বললেন।
নবকুমার ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল। অবশ্য এমনভাবে বলল, যেন, বাসুদেবের কথায় সে বিশেষ কিছু মনে করেনি।
“তোমার দোকান, বাড়ি ও চেনে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“দোকানটা দেখেছে।”
বোর্ডিংয়ের একটা ছেলে এসে চা দিয়ে গেল কিকিরাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা বললেন, “বাসুদেবকে এর মধ্যে তুমি আর দেখোনি?”
“না।”
“আচ্ছা–এত লোক থাকতে তোমার জেঠামশাই এবার হঠাৎ বাসুদেব মানে জামাইয়ের ভাইয়ের ওপর ভরসা করলেন কেন?”
“আমি জানি না। বাসুদার ওপর ভরসা করেছিলেন তাও বা জানব কেমন করে। আপনি বলছেন বলে শুনছি।”
কিকিরা মাথা নাড়লেন।
তারাপদ ফিরে এল। স্নান শেষ! মাথা মুছছে তখনও।
“চা খেয়েছেন? তা এত বেলায় আরও কোথাও যাবেন নাকি?”
“না।“
“কেসটা ভাল বুঝলাম না।”
“বোঝার মতন হয়নি এখনও। সময়ে বুঝবে। আমি চলি। তুমি আজ আমায় সন্ধেবেলায় বাড়িতে পাবে না। কাল পাবে।” কিকিরা উঠে পড়লেন।
“চাঁদুকে কিছু বলার আছে?”
“না। কাল তোমরা দেখা কোরো।”
“অপারেশন কৃষ্ণটা কবে হবে সার?”
“পরশু বা তরশু।”
“পাঁজিতে ভাল দিন আছে?” তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল।
“দেখে নিও। আমি চলি৷”
কিকিরা চলে গেলেন।
নবকুমার বোকার মতন বসে থাকল। দেওয়ালে টাঙানো আয়নায় মুখ মাথা দেখতে দেখতে চুল আঁচড়াচ্ছিল তারাপদ।
“তারাপদদা?”
“বলো?”
“বাসুদার কথা উনি তুললেন কেন আমি বুঝতে পারছি না।”
তারাপদ বলল, “তোমায় বুঝতে হবে না। কিকিরা বরাবরই মিস্টিরিয়াস। অপেক্ষা করো, বুঝতে পারবে।”
কবিরাজমশাইকে পাওয়া গেল।
কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলেন। বিকেলের পর খানিকটা হাঁটাচলা না। করলে এই বয়েসে শরীর টেকে না।
বাড়ির সামনে আসতেই কিকিরাকে দেখতে পেলেন।
আজ বাতাস রয়েছে বিকেল থেকেই। এলোমেলো। মাঝে মাঝে ধুলো উড়ছে। ঝড় উঠবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। উঠলেও কালবৈশাখীর আশা নেই, দু-একবার দমকা ঘূর্ণি উঠেই থেমে যাবে হয়তো।
“আপনি?” কবিরাজ চিনতে পারলেন কিকিরাকে। “সাঁইবাবু না?”
কিকিরা হাসলেন। “বালাই বড় দায়।”
“কেন, কী হল?”
“আমার সেই বুক জ্বালার ওষুধটা আরও দিনতিনেকের মতন ছিল, কিন্তু নিজের দোষে হাত থেকে পড়ে একেবারে ময়লার মধ্যে। এদিকে আজ কষ্টটা বড় বেড়েছে।… এদিকেই একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম যদি একবার আপনার দেখা পাই!”
“কেমন জ্বালা? গলার কাছে, না অন্ত্রে?” চন্দ্রকান্ত কবিরাজ বললেন।
“পেটে।”
“আসুন, দেখি।”
কবিরাজমশাইয়ের বাড়ির সদর বন্ধ ছিল। কড়া নাড়ার পর একটি ছোট মেয়ে এসে খুলে দিল।
নিজের ঘরটিতে ঢুকে আলো জ্বাললেন কবিরাজ।
“বসুন।”
কিকিরা বসলেন। “কোথাও গিয়েছিলেন?”
“না, বিকেলে একটু পায়চারি করার অভ্যেস। আর মশাই পথে বেরুলে চেনাশোনা লোক, পাড়াপড়শির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দুটো গল্পগাছা..।” বলতে বলতে ঘরের পেছন দিকে রাখা পুরনো আলমারির পাল্লা খুললেন।
আলমারির গোটাদুয়েক কাচ ফাটা। ভাঙা কাঁচে কাগজের তাপ্লি। ভেতরে পাঁচ-সাতটা ওষুধের শিশি বোতল। কাঁচের বয়াম।