“এসো।”
চন্দনরা চলে গেল।
কিকিরা একই ভাবে বসে থাকলেন।
.
সামান্য পরেই ছকু এল।
“এসো। আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
ছকু বলল, “দোকানের কাজকর্ম মিটিয়ে এলাম। চেনা একটা স্কুটার ভ্যান আসছিল। বললাম, একটু নামিয়ে দিয়ে যা ভাই।”
“বোসো।”
ছকু বসল। একেবারে কিকিরার পায়ের কাছে। কিকিরা অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করেন এভাবে ছকু মাটিতে বসলে। কিন্তু সে কিছুতেই শোনে না, কী করা যাবে।
“খবর বলো?” কিকিরা বললেন।
ছকু আগের দিনের বিবরণ দিতে শুরু করল। বলল, কৃষ্ণকান্ত যে বাড়িটায় থাকেন, সেটা বেশ পুরনো। ভাড়া-নেওয়া বাড়ি। নীচের তলায় সদর ঘেঁষে একপাশে দফতর, ব্যবসাদারদের গদির মতন। সেখানে জনাদুই বসে। কী করে কে জানে! অন্যপাশে মুনশির কামরা। মুনশিবাবু মানে ম্যানেজারবাবু। ভেতরে একটা হলঘর। পেছন দিয়ে দোতলার সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। কৃষ্ণকান্তর বসার ঘর হলঘরের শেষদিকটায়, সিঁড়ির গায়ে গায়ে। গোটা দুই সরু প্যাসেজ এপাশে ওপাশে। বাড়ির পেছনদিকে একফালি জমি। একটা ছোট নিমগাছ, জলের রিজারভার, পাঁচিল।
কর্মচারীদের দু’জন আছে ওই বাড়িতে। রিজারভারের কাছে সাধারণ একটা ঘরে তাদের আস্তানা। ঠাকুর চাকর থাকে নীচে, উত্তর দিকে। উঠোন রয়েছে। সামনে।
দোতলায় ছকু যায়নি।
একতলায় ঘুরঘুর করার সময় মুনশিজির সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। কথায় কথায় জানতে পারল, মুনশিবাবু বললেন–তাঁর মালিক কৃষ্ণকান্তর শরীর ভাল যাচ্ছে না। কলকাতায় এসেছেন–ডাক্তার দেখাতে। কাজেকর্মে যখনই আসেন এখানে, একবার ডাক্তার দেখিয়ে যান। এবারে অবশ্য মূল উদ্দেশ্য ডাক্তার দেখানো! বড় ডাক্তার। দু-তিনজনকে দেখানো হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষাও হয়েছে। নানারকম।
ছকু নিজের থেকে জানতে চায়নি, মুনশিবাবু নিজেই বললেন, “কর্তামশাইয়ের ডাক্তারবদ্যি দেখানোর ভারটা এবার নিয়েছেন বাসুদেববাবু। তাঁর ব্যবস্থা মতনই আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে কর্তাকে।
“বাসুদেববাবু? সে আবার কে?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“কৃষ্ণকান্তবাবুর জামাইয়ের ভাই।”
“কোথায় থাকে?”
“এখানেই, কলকাতায়।”
“কী করে?”
“তা জানি না।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন। “ওই বাড়িতেই থাকে?”
“মুনশিবাবু থাকার কথা বললেন না তো!”
নিজের মাথায় দুটো টোকা মারলেন কিকিরা। “ইস, তুমি একটু আগে এলে জানা যেত হয়তো। নবকুমাররা ছিল।…আচ্ছা, দাঁড়াও দেখি।”
সামান্য ঝুঁকে টেলিফোন তুলে নিলেন কিকিরা। লাটু দওকে ফোন করলেন বাড়িতে।
পাওয়া গেল লাটুকে; সবেই বাড়ি ফিরেছে।
“লাটু?”
“রায়দা! বলুন।”
“বাসুদেব বলে কারুর নাম শুনেছ নবকুমারের মুখে?”
“বা-সু-দেব!..বাসুদেব! কই না, মনে পড়ছে না।”
“কৃষ্ণকান্তবাবুর জামাইয়ের ছোট ভাই। কলকাতায় থাকে। চৌধুরীমশাইয়ের ডাক্তারবদ্যি দেখানোর দায়িত্ব এবার তার ঘাড়ে বর্তেছে।”
লাটু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “না, রায়দা, আমি জানি না। কুমারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তবে সে কি জানবে? জেঠার বাড়ির সঙ্গে তার যা সম্পর্ক!”
“আরে, খানিকটা আগেই তো ওরা আমার কাছে ছিল। ওরাও চলে গেল, ছকু এল। ছকুর মুখে শুনলাম এইমাত্র।”
“কাল খোঁজ করব?”
“আমি করে নেব।… শোনো, পরশু একবার এসো। আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চৌধুরীবাবুকে আর পাব না। উনি দেশে ফিরে যাবেন।”
“আপনি কি ভেবেছেন কিছু?”
“হ্যাঁ। পরশু এসো, বলব। এবারে সম্মুখ সমর। কৃষ্ণ ভার্সেস কিকিরা। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসব..” কিকিরা হেসে ফেললেন।
.
০৮.
অফিস যাওয়ার তোড়জোড় করছিল তারাপদ। পৌনে ন’টা বেজে গেল। দাড়ি কামানো শেষ করেছে সবে, স্নানে যাবে, হঠাৎ দেখল কিকিরা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
“এ কী! আপনি?”
ঘরে ঢুকলেন কিকিরা। “তুমি কি মাথায় ফুলেল তেল মাখো?”
“ফুলেল তেল?”
“এত গন্ধ ছুটছে…!”
“না সার,” তারাপদ হাসল, “আমার মাথার চুল চাপড়া ঘাসের মতন, সিমপিল কোকোনাট মাখি। হ্রাস বৃদ্ধি একই রকম।”
“মোবিল অয়েল চেষ্টা করে দেখতে পারো।”
তারাপদ হেসে উঠল। কিকিরাও।
“আপনি হঠাৎ আমার কাছে, এখন?”
“তোমার কাছে নয়, নবকুমারের কাছে। কোথায় সে? একবার ডাকো।”
তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার! কাল সন্ধেবেলায় আপনার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম; আর আজ সকালেই? সামথিং হ্যাঁপেন্ড?”
“ওকে ডাকো। কোথায় ও?”
“এই তো কাছেই এগারো নম্বর ঘরে ডেকে আনছি।”
এগারো নম্বর ঘরটা ফাঁকা আছে ক’দিন। চুনিবাবু মালদায় গিয়েছেন অফিসের কাজে। দিন পনেরোর আগে ফিরবেন না। নতুন বোর্ডার নেওয়ার কথা ওঠে না। তারাপদর কথায় নবকুমারকে থাকতে দিয়েছেন ম্যানেজারবাবু।
কিকিরা বসলেন। বিছানার ওপরেই।
তারাপদ গেল আর ফিরে এল। সঙ্গে নবকুমার।
কিকিরা একবার দেখলেন নবকুমারকে। তারপর ভণিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “বাসুদেবকে চেনো?”
নবকুমার কেমন ঘাবড়ে গেল। “বাসুদেব–?”
“চেনো না?”
“চিনি। জামাইবাবুর ছোট ভাই।…কেন?”
“বাসুদেব কলকাতায় থাকে? কী করে?”
স্নানে যাওয়ার তাড়া ভুলে তারাপদও দাঁড়িয়ে থাকল।
নবকুমার বলল, “বাসুদাকে আমি চিনি। কুটুম মানুষ। তবে তার সঙ্গে আমার এমনিতে কোনও যোগাযোগ নেই। ন’মাসে ছ’মাসে ট্রামে বাসে পথেঘাটে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। এমনি কথা হয় দু-চারটে।… আমি তো জানি বাসুদা বেলেঘাটা না ওদিকে কোথাও থাকে।”