“তুমি নিজে কোনওদিন দ্যাখোনি?”
“না। তা ছাড়া তখন হয়তো বাড়াবাড়ি ছিল না।”
“এখন কি বাড়াবাড়ি হয়েছে?”
“আমি কেমন করে জানব! আপনি যেদিন গিয়েছিলেন আপনার চোখের সামনে হয়েছে–এ কথা তো আমি তারাপদবাবুর মুখে শুনলাম।”
কিকিরা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। আমার সামনেই হয়েছে। উনি এখানে এসেছেন, আছেন–তার একটা বড় কারণ শুনলাম ডাক্তার দেখানো।”
“তা আমি জানি না। রোগটা কী? মৃগী–!”
চন্দনের দিকে তাকালেন কিকিরা। চন্দন বলল, “না মৃগী নয়, এপিলেপসি নয়। এর নাম আমি জানি না। সিনিয়ারদের জিজ্ঞেস করেছি। বইপত্র ঘেঁটে বলবেন বলছেন। তবে রোগটা কমন বা নর্মাল নয়। ভেরি রেয়ার। লাখে একটা পাওয়া যায় কিনা তাও সন্দেহ।… আর আশ্চর্যের কথা, এরা নিজেরাও বুঝতে পারে না, কখন আচমকা ঘুমিয়ে পড়বে। ব্যাপারটা নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেয় হয় না।”
“অদ্ভুত!”
“মানুষের শরীরের স্বাভাবিক একটা গঠন আছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও মিল আছে। তবু কখনও কখনও অস্বাভাবিক পার্থক্য থেকে যায়। কেন যায় বলা মুশকিল। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। কিন্তু দেখা গিয়েছে, এই ধরনের অ্যাবনর্মালিটি যাদের থাকে তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণ্ডগোলটা জন্মকাল থেকেই থেকে যায়। প্রথম বয়েসে, মাঝবয়েসে বা প্রায় প্রৌঢ় বয়েসে–কখন ধরা পড়বে তাও বলা যায় না।”
তারাপদ বলল, “আরে সেই যে বিখ্যাত গল্প…. একটা লোকের হার্ট বাঁদিকে না থেকে ডানদিকে ছিল…।”
“গল্প নয়, এরকম হয়, হতেই পারে। তবে রেয়ার। আবার সৃষ্টির এমনই মহিমা যে–যদি কারও হার্ট ডানদিকে থাকে তবে এমনও দেখা গিয়েছে, তার ক্ষেত্রে অন্য অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গগুলো–যা বাঁদিকে থাকার কথা, সব ডানদিকে জায়গা করে নিয়েছে।…এসব অবশ্য কদাচিৎ দেখা যায়। সৃষ্টি রহস্য! এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।”
“আমাদের অফিসে ডেসপ্যাঁচ সেকশনের কড়িদার বাঁ হাতে ছ’টা আঙুল,” তারাপদ বলল, “এটাও তো স্বাভাবিক নয়।”
কিকিরা বললেন, “যাক গে, আসল কথা হল কৃষ্ণকান্তর একটা অস্বাভাবিক রোগ আছে। আমার পরের প্রশ্ন–” বলে নবকুমারের দিকে তাকালেন, “তুমি একেবারেই খেয়াল করে দ্যাখোনি কৃষ্ণকান্ত সত্যিই বেঁচে আছেন কিনা! তুমি তাঁকে হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখোনি।”
“না।”
“ওঁর গলায় যে গলগণ্ড কিংবা টিউমারের মতন ফোলা মাংসপিণ্ড আছে, তুমি নিশ্চয় জানতে।”
“দেখেছি।”
“লোকের চোখ এড়াতে কৃষ্ণকান্ত গলায় একটা চাদর চাপিয়ে রাখতেন, তুমি জানো না?”
“বাইরের লোকের সামনে বেরুতে হলে গলা চাপা দিতেন, অন্য সময় নয়। বাড়ির মধ্যে দেখিনি।”
“তুমি বলেছিলে, সেদিন তুমি দেখেছ, কৃষ্ণকান্তর গলায় বাসন্তী-গেরুয়া রঙের চাদর ছিল।”
“হ্যাঁ। জেঠামশাই রঙিন চাদরও পছন্দ করেন।”
“আমি তো দেখলুম, ওঁর গলায় সাদা উড়নি। উড়নির পাড়ে অবশ্য রং ছিল বাসন্তী ধরনের।”
নবকুমার কিছু বলল না।
“সেদিন তুমি ঘরে ঢুকে তোমার জেঠামশাইয়ের সামনে টেবিলের ওপর একটা অ্যাটাচি কেস দেখেছিলে তো?”
“হ্যাঁ দেখেছি।”
“তুমি ওটা ছুঁয়েও দেখোনি?”
“না”
“ঠিক বলছ?”
নবকুমার বিরক্ত হল। “আমি বার বার বলেছি, অ্যাটাচি কেসটায় হাত দিইনি আমি।”
“কী রঙের অ্যাটাচি? মনে আছে?”
“অ্যাশ কালার, ছাই রঙের।”
কিকিরা অল্প সময় চুপ করে থাকলেন। ভাবলেন কী যেন, শেষে বললেন, “তবু ওরা রটিয়ে বেড়াচ্ছে, তুমি নাকি তোমার জেঠামশাইয়ের গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাঁকে মারবার চেষ্টা করেছ, টাকা ভরতি অ্যাটাচিকেসটা নিয়ে পালিয়ে এসেছ!”
“আমি তাই শুনেছি। ওদের লোক এসে আমার দোকানে বলে গিয়েছে।”
“ওরা বেশি চালাক। তবে চালাকিটা ধোপে টিকবে না জানে। আর সেজন্যে থানাপুলিশ করেনি।… যাক গে, আমি ভেবে দেখলাম, ওটা এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, আড়ালে আড়ালে লড়ে লাভ হবে না। মুখোমুখি হওয়া দরকার। সামনাসামনি না দাঁড়ালে সত্যি কথাটা জানা যাবে না। কাজেই স্ট্রেট ফাইট।”
তারাপদ বলল, “আপনি ফাইট করবেন?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন, হেসে যাত্রার ভঙ্গি করে বললেন, “সম্মুখ সমর বিনা গতি নাহি আর। কৃষ্ণকান্ত পর্বটা শেষ করে ফেলতে হবে। না করলে ভদ্রলোককে আর কলকাতায় পাব না। দেশে ফিরে যাবেন উনি।”
তারাপদ হালকাভাবে বলল, “সার, অপারেশন কৃষ্ণকান্তটা কবে হচ্ছে?
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দেরি করলে ভদ্রলোককে কলকাতায় পাচ্ছ কোথায়? উনি তো বললেন, হপ্তাখানেক থাকবেন আর।”
“এই সপ্তাহে তবে লাগিয়ে দিন।…তা আমাদের করণীয় কী?”
“তোমরা থাকবে। তবে বাড়ির বাইরে গেরিলা কায়দায় পজিশন নেবে। ভুলে যেও না ওটা কৃষ্ণকান্তর পাড়া। তাঁর নিজের কর্মচারী ছাড়াও ওঁর হাতে লোক আছে। পাড়ার ছেলে। গণ্ডগোল বাঁধলে তোমাদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।”
“শুধু হাতে?” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল। “নো বোমা, নো পাইপগান, নো হ্যান্ডমেড পিস্তল? ভীষণ রিস্কি হবে, সার?”
কিকিরা গম্ভীরভাবে বললেন, “মুরগিহাটা থেকে কিছু পটকা কিনে নিয়ে যেও। চিনেবাজারেও পেতে পারো।”
তারাপদরা হেসে উঠল। “মুরগিহাটায় পটকা–! সে তো চিকেন কোয়ালিটি হবে।”
চন্দন উঠে পড়ল। তার অন্য একটা কাজ আছে। “আমি চলি।”
“তুই যাবি?” তারাপদ হাতঘড়ি দেখল। “আটটা বাজতে চলল। আমরাও তাহলে যাই। চল, একসঙ্গেই যাব।”… বলে কিকিরার দিকে তাকাল। “আমরা আসি সার। পরে খবর নেব…!”