ডায়েরি খাতাটা ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে কিকিরা মুখ নামিয়ে কী যেন হাতড়ালেন। তারপর একটা কাগজের ঠোঙা বার করে বললেন, “মায়ের পায়ে দেওয়া ফুল আর সামান্য প্রসাদী আপনাকে দিয়ে যাই।”
চেয়ার থেকে উঠে কয়েক পা এগিয়ে কৃষ্ণকান্তর দিকে যাবেন, হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, ভদ্রলোক আর্মচেয়ারে ঘাড় হেলিয়ে দিয়েছেন। মাথামুখ বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছে।
কিকিরা অবাক!
কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ালেন তিনি কৃষ্ণকান্তর। ভদ্রলোকের চোখের পাতা বোজা। ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক হয়ে রয়েছে। মনে হল, ওঁর কোনও হুঁশ নেই। অচৈতন্য।
বিস্মিত বিমূঢ় কিকিরা কী করবেন বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি কাগজের ঠোঙাটা টেবিলের ওপর রেখে কৃষ্ণকান্তর নাকের কাছে ডান হাতের একটি আঙুল ধরে রাখলেন। নিশ্বাস-প্রশ্বাস আছে, তবে দুর্বল বলে মনে হল। বুক ওঠানামা করছে এত ধীরে যে, সতর্ক হয়ে নজর করতে হয়।
কিকিরা স্বাভাবিক বোধবুদ্ধির বশে তাড়াতাড়ি কৃষ্ণকান্তের গলায় জড়ানো উড়নি বা পাতলা চাদরটা আলগা করে খুলে দিলেন। শ্বাসকষ্ট কমা উচিত। আর তখনই তাঁর নজরে পড়ল, কৃষ্ণকান্তর গলার মাঝামাঝি সামান্য বাঁদিক ঘেঁষে একটি টিউমার। গলগণ্ডর মতন দেখায়। বিসদৃশ অবশ্যই। তবে কি এইজন্যেই কৃষ্ণকান্ত গলার কাছটা চাপা দিয়ে রাখেন?
একবার মনে হল কিকিরা চিৎকার করে কাউকে ডাকেন! জানলার দিকে তাকালেন। বাড়ির ভেতর দিকে জানলা। মেঝে থেকে সামান্যই উঁচু, আড়াই কি পৌনে তিন ফুট। জানলায় গরাদ নেই। ওপাশে বোধ হয় প্যাসেজ। সহজেই টপকে যাওয়া যায়।
কৃষ্ণকান্তকে সামান্য নাড়া দিলেন কিকিরা। “কৃষ্ণকান্তবাবু! শুনছেন! কৃষ্ণকান্তবাবু!”
জলের জন্যে তাকালেন চারপাশ। জল নেই। পানের ডিবে খুললেন। ভিজে ন্যাকড়া চাপা দেওয়া ছিল। সেটা তুলে নিয়ে কৃষ্ণকান্তর কপালে, চোখে বোলাতে লাগলেন।
সামান্য পরে নড়ে উঠলেন কৃষ্ণকান্ত। মনে হল, ঘুমের ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠছেন। আলস্য, আবেশ, দুর্বলতা–সব যেন কেমন মেশানো রয়েছে দৃষ্টিতে। শ্বাস নিলেন। শূন্য চোখে তাকালেন। “কে?”
“আমি শ্যামাদাস।”
“শ্যামা-দাস! ও!”
“আপনার কী হয়েছিল? হঠাৎ…?”
কৃষ্ণকান্ত উড়নি দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “কিছু না। এরকম আমার হয়। আগে কম হত। এখন প্রায়ই হয়। কাজ করতে করতে, কথা বলতে বলতে হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়ি। নিজেই বুঝতে পারি না।”
“ডাক্তার দেখাচ্ছেন না?”
“দেখাই। এবারও দেখাচ্ছি।… যাক, আপনি এখন আসুন। আমার ভাল লাগছে না।”
কিকিরা নমস্কার জানিয়ে চলে আসার আগে টেবিলে রাখা কাগজের ঠোঙাটা দেখালেন। “মায়ের প্রসাদী ফুল রেখে গেলাম। আসি।”
.
বাইরে এসে রিকশা ডাকল ছকু। কথাই ছিল কৃষ্ণকান্তর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠবেন কিকিরা। সঙ্গে ছকু থাকবে। বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে রিকশা ছেড়ে দেবেন ওঁরা।
লাটু গাড়ি নিয়ে পিছু পিছু আসবে। গাড়িতে তারাপদ আর চন্দনও আছে।
শেষে রিকশা ছেড়ে কিকিরা গাড়িতে উঠবেন। ছকু চলে যাবে নিজের জায়গায়।
রিকশায় বসে কিকিরা বললেন, “ছকু, আমি এমন দেখিনি। সমস্ত গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার।”
ছকু বলল, “কী হল গুরুজি?”
“পরে বলব। তুমি কাল সন্ধের পর একবার বাড়িতে এসো।…তোমার নিজের কাজ কতটা হল।”
ছকু জানাল, “আমার কাজ হয়েছে থোড়া বহুত। আপনি ভাববেন না।”
.
০৭.
তারাপদই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল নবকুমারকে।
নবকুমার এখন কয়েকদিন তারাপদর বোর্ডিংয়েই রয়েছে। তারই হেফাজতে আবার যেন ও পালিয়ে না যায় তার জন্যে তারাপদ বোর্ডিংয়ের ম্যানেজারবাবুকে বলে রেখেছে ছোকরার ওপর নজর রাখতে বলেছে, একটু খেয়াল রাখবেন তো চারুবাবু; ছেলেটার মাথায় ছিট আছে, খেয়ালি, যখন-তখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। দু-চারদিন থাকুক এখন, ওর গার্জেন এলে হাতে তুলে দেব।
কিকিরার ঘরে চন্দন বসে ছিল। কথা বলছিল।
তারাপদরা আসতেই কিকিরা বসতে বললেন তাদের। দেখলেন নবকুমারকে। একই রকম। উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত মুখ। খানিকটা হতাশ।
কিকিরা দু-চারটে মামুলি কথা বলে নবকুমারকে সহজ করার চেষ্টা করলেন। হাসি তামাশাও করলেন। শেষে বললেন, “তোমার জেঠামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে এসেছি, শুনেছ তো?”
শুনেছে নবকুমার। তারাপদই বলেছে।
“এবার তোমায় কটা কথা জিজ্ঞেস করি। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। লুকোবে না কোনও কথা।”
“বলুন?”
“কৃষ্ণকান্তবাবু, মানে তোমার জ্যাঠামশাইয়ের যে একটা অদ্ভুত রোগ আছে, উনি যখন-তখন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন, তুনি জানো?”
নবকুমার তাকিয়ে থাকল সামান্য সময়। পরে বলল, “শুনেছি। আগে শুনতাম মৃগী। কখনও-সখনও হত। আমি নিজে দেখিনি।”
“দ্যাখোনি?”
“না।..আজ পাঁচ-ছ’ বছরের মধ্যে আমি মাত্র তিন-চারবার নুরপুরের বাড়িতে গিয়েছি। তাও হয়তো দু-একদিনের জন্যে। ওখানে কেউ আমায় আদর আপ্যায়ন করে না। মা-মাসি থাকলে নিশ্চয় করত। অন্য যারা আছে তারা দুটো খেতে দেয়, ঘরের দরজা জানলাগুলো খুলে দেয়, এই পর্যন্ত। এক-আধটা কথা যা বলে তা নেহাতই দয়া করে।”
“ও বাড়িতে তোমায় পছন্দ করে এমন কেউ নেই?”
“না, এখন নেই। জলধরদা ছিল। মারা গিয়েছে।”
“তুমি তা হলে ঠিকমতন জানো না, কৃষ্ণকান্তবাবুর অসুখটা কেমন? কতদিনের?”
“না। শুনেছি এই মাত্র। তাও কেউ বলতে পারত না কেমন অসুখ। মা-মাসির মুখেও শুনেছি। বলত, মৃগী রোগীর মতন অনেকটা। আবার কেউ বলত, এপিলেপসি ধরনের।”