কৃষ্ণকান্ত পাথরের টেবিলের ওপর পানের বড় ডিবে আর জরদার কৌটো রেখে কিকিরার কথা শুনছিলেন। কতটা খেয়াল করছিলেন বলা মুশকিল। পান মুখে দিলেন। পরে জরদা।
হঠাৎ যেন, খেয়াল হল তাঁর। কিকিরাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
বসলেন কিকিরা। মাতৃমন্দিরের বিবরণ শোনাচ্ছেন নম্র গলায়। অতীত, বর্তমান; আশ্রমের কথাও।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “তা আমার কাছে কেন?”
কিকিরা বললেন, “ভিক্ষার আশায়। অনেকের কাছেই যাই। কেউ সাহায্য করেন; কেউ বা করেন না। আমাদের অন্য কী উপায় আছে বলুন! যাঁরা সহৃদয় হয়ে সাহায্য করেন তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। যাঁরা বিমুখ করেন, বুঝি তাঁরা এইসব সাধারণ সৎ কাজে দানধ্যান করতে চান না। সংসারে সবরকমেরই মানুষ আছে, কেউ দয়াদাক্ষিণ্য করেন, কেউ করেন না।”
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “আপনারা কেমন করে বুঝলেন আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ নই?”
কৃষ্ণকান্ত আরও একটু জরদা মুখে দিলেন।
কিকিরা বিনীত হাসি হেসে বললেন, “ভিক্ষাপাত্র যে বাড়ায় সে কি আগে থেকে অনুমান করতে পারে কে ভিক্ষা দেবে, কে দেবে না। …আপনি তো ভক্ত মানুষ।”
“ভক্ত! কে বলল মহারাজ, আমি ভক্ত! আর ভক্ত হলেই কি দান করতে হয়। আপনি আমাকে চিনলেন কেমন করে, আপনাকে তো আমি চিনি না।”
কিকিরা এমন মুখভঙ্গি করলেন, সলজ্জভাবে যে, মনে হল, তিনি বলতে চাইছেন–এ আপনি কী কথা বললেন, মশাই। মুখে বললেন, “আজ্ঞে, সাধক রামদাস বলেছেন, আরে তুই তো ভেরা গাছ, তোর কাছে কোন বোকা আশ্রয় নিতে আসবে, লোকে দু’দণ্ড ছায়ায় জিরোবার জন্যে বট, অশ্বত্থ, নিমগাছের তলায় গিয়ে বসে।… আমি সেইরকম নগণ্য ভেরান্ডা; আর আপনি বট, অশ্বত্থ। আপনাকে চিনতে পারব না।”
কৃষ্ণকান্ত হাসলেন। “বা, কথাবার্তা তো ভালই বলতে শিখেছেন। তবে আমি বট, অশ্বত্থ নই।”
“আপনি কে আমি জানি।” কিকিরা বললেন, “আপনি নুরপুরের বিখ্যাত জমিদার বাড়ির কর্তা। আগে আপনাকে আমি দেখিনি। নামধাম অনেক শুনেছি। ছেলেবেলায় আপনাদের দেশবাড়ি জমিদারির পাঁচ-সাত ক্রোশ দূরে আমার মামার বাড়ি ছিল। তখনই নুরপুরের কত গল্প শুনেছি।”
“ও! আপনি বর্ধমান জেলার লোক?”
“বাঁকুড়া জেলার…পুরনো কথা আমাদের বলতে নেই। যৌবনে কেমন করে কী কারণে ঘরছাড়া হই, কী খোঁজে বেরিয়েছিলাম তাও জানি না। আজ্ঞে–সেই যে বলে, ঘুরি পথে পথে হইয়া সাধুর শিষ্য-তাই। নানা জায়গায় ঘুরে আমার আসল গুরু লাভ হয়। স্বামী মহেশ্বরানন্দ। তাঁর কাছে ছিলাম অনেকদিন। গুরুজি দেহ রাখার আগে আমায় আদেশ করেছিলেন, নিজের দেশে ফিরে যেতে। দেশে অবশ্য ফেরা হয়নি, তবে তিনি আমায় কদমকাননে টেনে আনেন।”
“কদমকানন?”
“আজ্ঞে, জায়গাটার নাম বড়জালি। তারই একপাশে একটি জঙ্গল ছিল। কদমগাছ হয়তো ছিল অনেক। সেই থেকে কদমকানন। সেখানে প্রাচীন একটি কালীমূর্তি পাওয়া যায়। ভাঙা মন্দির। মূর্তিরও একটি হাত ভাঙা। মায়ের পায়ের তলায় শিব নেই। কিংবদন্তি বলে, এখানে সতীমায়ের বাঁ পায়ের একটি আঙুলের নখকণা ছিটকে এসে পড়েছিল। …তা সে যাই হোক, ওখানে কেউ একজন কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন মূর্তি। ওটি প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। আমরা চেষ্টাচরিত্র করে মন্দিরটি গড়ে তুলেছি। আশ্রম আছে। পুজোপাঠ ছাড়াও সেবাধর্মের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজও কিছু হয়।”
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “সবই বুঝলাম। কিন্তু এতকাল পরে হঠাৎ আমায় মনে পড়ল কেন? কার কাছে খবর পেলেন আমি এখন কলকাতায় রয়েছি? ঠিকানা জোগাড় করলেন কেমন ভাবে?”
কিকিরা কোলের ওপর রাখা গেরুয়া রঙের কাঁধ-ঝোলা তুলে নিয়ে কী যেন খুঁজলেন ভেতরে। বইয়ের মাপের একটি ডায়েরি বই বার করে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন, “এটি আমার নামধাম এটা-ওটা লিখে রাখার খাতা। যাঁদের কাছে যাই তাঁদের নাম-ঠিকানা আছে। আবার কেউ যদি নতুন কারও কথা বললেন, তাঁর নামধামও টুকে রাখি। আমাদের কাজই হল ছোট-বড় সকলের কাছে যাওয়া। যে যেমন পারেন সাহায্য করেন।…এই যে আপনার নাম-ঠিকানা। এটি পেয়েছি হরিবাবুর কাছে। আপনাদের দেশের লোক।”
কৃষ্ণকান্ত বুঝলেন না, হরিবাবু কোনজন! তবে নামটা এতই প্রচলিত যে, দেশগ্রামে হরিবাবু দু’-একজন থাকতেই পারে।
কৃষ্ণকান্তর দ্বিধা দেখে কিকিরা তাড়াতাড়ি বললেন, “একটা কথা কী জানেন! ঠাকুর বলতেন, রামকৃষ্ণদেব, ওরে বনের মধ্যে ফুল ফুটলেও ভ্রমর তা খুঁজে নেয়। সে যে গন্ধ পায় বাতাসে।… আপনি কাকে জানলেন না জানলেন কিছুই যায়-আসে না। লোকে যে আপনাদের জানে চৌধুরীমশাই।”
কৃষ্ণকান্ত চুপ।
ঘড়ির কাঁটার দিকে আড়চোখে চেয়ে নিলেন কিকিরা। ছকুকে বললেন, “তুমি ঘরের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমরা দুটো কথা সেরে নিই।”
ছকু চলে গেল। সে জানে তাকে কী করতে হবে। বাড়ির বাইরেও কিকিরা লোক রেখেছেন। তারাপদ, চন্দন, লাটু দত্ত। বলা তো যায় না কোথাকার জল কোথায় গড়াবে! ঝাট ঝামেলা হলে বাঁচতে হবে নিজেদের।
কৃষ্ণকান্ত বললেন, “আমি ভেবে দেখব।” গলার স্বরে ক্লান্তি। কিকিরা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “অবশ্যই ভাববেন। আমি শুধু আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলাম। আরজি জানিয়ে যাচ্ছি। আজই আপনাকে কিছু দিতে হবে না। পরে আসব।”
“তাই আসুন। আমি সপ্তাহখানেক আছি এখানে।”