মহারাজ যাবেন কালীভক্ত কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে দেখা করতে।
কেন? সহজ কারণ। কিছু আর্থিক সাহায্য ভিক্ষা করতে। মাতৃমন্দিরের জন্যে।
কদমকানন মাতৃমন্দিরটির পরিবেশ চমৎকার। নির্জন। কোথাও উপদ্রব নেই। ভক্তজন যায়-আসে। তবে আর্থিক অনটন থাকায় অনেক কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। আশ্রমের আর মন্দিরের সাধুজিরা তাই মাঝে মাঝে অর্থসংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন।
ছকু বলল, “গুরুজি, চাঁদার রসিদ বই হাতে হরেক রকম বাবাজিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে দেখেছি। এটা কি সেইরকম?”
কিকিরা বললেন, “চাঁদার রসিদ বই কে নিচ্ছে হে! ওসব মঠঅলাদের মানায়। আমি যাব ভদ্রলোককে দেখতে আর বাজাতে। দেখি না কী বলেন?”
“তা মন্দির আখড়ার জায়গাটা কোথায় গুরুজি?”
কিকিরা মুচকি হাসলেন, বললেন, “তুমি বুঝবে না। ক্যানিং লাইনে। …আরে, ওই মন্দির কি আজকের? কোনকালের পুরনো। ভাঙা পাথরের টিবি হয়ে পড়ে ছিল জায়গাটা। পরে কে যেন দেখল, পাথরের আড়ালে এক-দু হাতের ভাঙাচোরা কালীমূর্তি পড়ে আছে। তখন আবার”।
ছকু বুদ্ধিমান। হেসে বলল, “ক্যানিং নয়, বনগাঁ লাইনে করে দিন। লাইনের নামে বাবু যেতে চাইবেন না।”
জোরে হেসে উঠলেন কিকিরা। বাহবা জানালেন ছকুকে।
বগলা চা দিয়ে গেল।
চা খেতে খেতে কিকিরা ছকুকে সব বুঝিয়ে দিলেন। অর্থাৎ তিনি কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন যখন, কথার বহর ছোটাবেন, ভদ্রলোককে দু-চারটে ভেলকিবাজি দেখাতেও পারেন,তখন ছকুর কাজ হবে ঘরের বাইরে চলে যাওয়া। তার নজর থাকবে ভেতর মহলে। দোতলায় সে উঠতে পারবে না, কিন্তু নীচের তলার ঘরদোর জানলা, আসা-যাওয়ার পথ, কে কোথায় ঘোরাফেরা করছে ভাল করে লক্ষ করা। পারলে এক-আধজনের সঙ্গে গল্প জমানো।
ছকু বলল, “বুঝে গেলাম। কব যাবেন?”
কিকিরা বললেন, “পরশু। দেরি করলে কৃষ্ণকান্তবাবু যদি দেশে ফিরে যান– ধরতে পারব না। তবে মনে হয় না যাবেন।”
ছকু উঠে পড়ল।
কিকিরা বললেন, “তুমি কাল আমাকে একটা ফোন করে জেনে নিয়ো। …ভাল কথা, আমরা কিন্তু সকাল দুপুরে যাব না। শেষ বিকেলে যাব। সন্ধে হব-হব সময়ে। বেশি আলো ভাল নয়, ছকু। ধরা পড়তে রাজি নই।”
ছকু চলে গেল।
কাজটা সহজ হবে কিনা তিনি জানেন না। কৃষ্ণকান্তকে ধোঁকা দেওয়া কঠিন। ঠিকমতন চাল না চাললে ধরা পড়ে যেতে পারেন। আর ধরা পড়লে বিসদৃশ ব্যাপার হবে। তখন হয় পালাতে হবে, না হয়!
চন্দন বলছিল, “সার, আপনি বড় বেশি রিস্ক নিচ্ছেন। আমার মনে হয় ব্যাপারটা অন্যভাবে সেটেল হলে ভাল হত। কলকাতায় আজকাল প্রাইভেট এজেন্সি, বুরো হয়েছে। তারা প্রফেশনাল। ইনভেস্টিগেশন করাই কাজ তাদের। নবকুমার ওদের সাহায্য নিলে পারত।”
কিকিরা বলেছেন, “তুমি পাগল। যে-ছেলে ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে যাবে ওইসব জায়গায়! বরং দেখাই যাক আমরা কী করতে পারি। না পারলে হাত গুটিয়ে নেব। তখন অন্য ভাবনা ভাবা যাবে। নট নাউ।”
.
০৬.
কৃষ্ণকান্ত তখনও আসেননি।
কিকিরা কাঠের চেয়ারে বসে ঘরটি দেখছিলেন। ছকু একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বসেনি।
নীচের তলায় ভেতর দিকের এই ঘরটি কৃষ্ণকান্তর বসার ঘর। মাঝারি মাপের ঘরের চেয়ে সামান্য বড়। দুটি দরজা, বাইরে থেকে আসার একটি, আর অন্যটি ভেতর দিকে যাওয়ার। প্রথমটি উত্তর দিকে। দ্বিতীয়টি ঘরের বাঁদিকে, পুবে। জানলা তিনটি। দক্ষিণের দিকে দুটি, পেছনে–পুব দিকে একটি। আসবাবপত্র বেশি নেই। জানলা ঘেঁষে পুরনো আমলের এক বিরাট আর্মচেয়ার, সামনে পাথর বসানো গোল টেবিল। ঘরের অন্য পাশে তিন-চারটি কাঠের চেয়ার। এক কোণে দেরাজ একটিমাত্র। দেওয়ালে তিন-চারটি বাঁধানো ছবি। কালীর পট, দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরবাড়ির রঙিন ফোটো, হাতে আঁকা কোনও পাহাড়ি এলাকার পথ আর অদ্ভুত এক অবধূত সন্ন্যাসীর ছবি–তেলরঙে আঁকার মতন দেখায়। উত্তরের দেওয়ালে বড় দেওয়াল ঘড়ি।
সন্ধে হয়ে আসছিল। ঘরে একটা বাতি জ্বলছে। টিউব লাইট নয়, শেড পরানো দেওয়াল-বাতি।
কিকিরা নিজেকে সামান্য গুছিয়ে নিলেন যেন। শ্যামাদাস মহারাজের ছদ্মবেশটি মন্দ হয়নি। বাড়াবাড়ি সাজসজ্জা নেই। মাথার বাবরিচুলও বড় নয়, তবে খানিকটা এলোমেলো। টুপিটা প্রায় গোল। মাথার সঙ্গে চমৎকার এঁটে গিয়েছে। মুখের দাড়ি গোঁফও ছিমছাম, অল্প। চোখের চশমাটি নিকেল ফ্রেমের। গায়ের আলখাল্লা কটকটে গেরুয়া রঙের নয়, বাসন্তী-গেরুয়া। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।
ছকুর বেশবাস সাধারণ। তবে সে ধুতি পরেছে, গায়ে গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি। মাথায় কিছু নেই।
কৃষ্ণকান্তর পায়ের শব্দ।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকতেই কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।
“কী ব্যাপার? আপনারা?”
কিকিরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নমস্কার জানালেন কৃষ্ণকান্তকে। ছকুও নমস্কার করল।
নিজের পরিচয় দিলেন কিকিরা। শ্যামাদাস মহারাজ। আসলে তিনি সেবক। লোকে বলে মহারাজ। বলে ছকুকে দেখালেন, “আমার সঙ্গী। আশ্রমের দেখাশোনা করে অন্য দু-একজনের সঙ্গে।”
“কীসের আশ্রম?” কৃষ্ণকান্ত নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন।
মাতৃমন্দিরের বর্ণনা দিতে দিতে কৃষ্ণকান্তকে দেখে নিচ্ছিলেন কিকিরা। ভদ্রলোক বৃদ্ধ নন, তবে প্রৌঢ়। স্বাস্থ্য মোটামুটি স্বাভাবিক। বয়েসের তুলনায় সক্ষম বলে মনে হয়। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ। গলার স্বর ভারী, গম্ভীর। জমিদারি দাপট রয়েছে যেন।