“বলব। আগে খবর পাই।”
“পাবে। …একটা ব্যাপার কী জানো? কৃষ্ণকান্তর সামনাসামনি আমাদের হতেই হবে। ভদ্রলোকের তরফ থেকেও চালে বড় ভুল হয়েছে। না হলে এতদিন থানা পুলিশ ডায়েরি না করে বসে থাকতেন না।”
.
০৫.
পরের দিন সকালে আবার ফোন এল। লাটুর ফোন।
“রায়দা, কাল বাড়ি ফিরে এসে কুমারের ফোন পেলাম। ও বার দুয়েক চেষ্টা করেছিল সন্ধেবেলায়। আমায় পায়নি। আমি তো তখন আপনাদের সঙ্গে…।”
“কোথায় আছে ও?”
“রামরাজাতলায়। এক চেনা লোকের বাড়ি।”
“পালিয়ে গিয়েছিল কেন?”
“আপনি যা ভাবছিলেন ঠিক তাই। সকালে পুলিশের জিপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।”
“তুমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিয়েছ তো?”
“হ্যাঁ।…বলেছি, তুই আজই চলে আয়। তোকে মাঠকোঠায় থাকতে হবে না। তারাপদবাবুর সঙ্গে বোর্ডিংয়ে থাকবি। ব্যবস্থা হয়েছে। চলে আসবি আজ। ভয়ের কিছু নেই। …আপনার ফোন নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। দরকারে ফোন করবে।”
“বেশ করেছ। এখনকার মতন ছাড়ছি। পরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।” কিকিরা ফোন রেখে দিলেন।
আজ কেমন একটা চাপা গুমোট সকাল থেকেই। রোদ দেখলে মনে হয় লাল লাল চোখ করে সব দেখছে। অনবরত গা মুখ ঘামে ভিজে যাচ্ছিল।
কিকিরা আর পারলেন না। স্নানটা সেরে নিলেন।
আরাম লাগছিল। বেলা প্রায় দশটা।
এমন সময় ছকু এসে হাজির।
“আরে ছকুবাবু যে, এসো, এসো। তুমি একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে উঠলে যে!” তামাশা করে বললেন কিকিরা।
ছকু পিঠ নুইয়ে অতি বিনয়ের সঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল কিকিরাকে। “আজ্ঞে, খবর পেতে দেরি হল।”
“বোসো।”
ছকু চেয়ারে সোফায় বসবে না। কিকিরার সামনে সে উঁচু আসনে বসে না। অনেক বলেছেন কিকিরা, ছকু মাথা নাড়ে, কান ধরে, “আরে ছি ছি, তাই কি হয়, গুরুজির সামনে চেয়ারে বসা!”
ছকুকে দেখতে রোগা। গায়ের রং তামাটে ফরসা। নিরীহ মুখ। চোখ দুটি সামান্য ধূসর। একটু টেরা। মুখে দু-চারটি বসন্তের দাগ। মাথার চুল ছোট ছোট। বাঁ পাশে টেরি কাটে। ওর পরনে পাজামা। গায়ে হাফহাতা শার্ট।
ছকুর পুরো নাম ছবিলাল। ওটা কেউ জানে না। দেওঘর থেকে বাপের সঙ্গে চলে এসেছিল কলকাতায়। মা ছিল না। অনেক ঘাটের জল খেয়েছে। নিজে তো বিশ বাইশ বছর পর্যন্ত বাস কন্ডাক্টরের কাজ করেছিল। তারপর মালিক আর ড্রাইভারদের সঙ্গে টাকাপয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল, ঝগড়া। খেপে গিয়ে সে পকেটমারের দলে ভিড়ে গেল। তবে পেশাটা তার ইজ্জতে লাগছিল। ফলে নিজে আর লাইনে থাকল না সরাসরি, অন্যদের হাত সাফাই, চালাকি এইসব শেখাতে লাগল। এখন তার বয়েস অন্তত চল্লিশ। লন্ড্রির দোকান দিয়েছে একটা বাগবাজারের দিকে। মন্দ চলে না। সেইসঙ্গে পকেটমারদের মাস্টারি করে। মাস্টারি মানে নিজেদের গল্প শোনায়।
ছকু অত্যন্ত চালাক। বুদ্ধি প্রখর। ওর হাতসাফাইয়ের আশ্চর্য কায়দাকানুন দেখে কিকিরা ওকে দু-চারজন জুনিয়ার ম্যাজিশিয়ান ছেলের (যারা বারো আনা অ্যামেচার) তাদের দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। অ্যাসিস্ট করত। ছকু শেষ পর্যন্ত আর তাদের সঙ্গে থাকেনি। ছকুর কোনও বদ নেশা নেই। তবে পান বিড়ি খায়।
কিকিরার সামনে মাটিতে বসে পড়ল ছকু।
কিকিরা বললেন, “তোমাকে নিয়ে আর পারলাম না। না হয় ভেতর থেকে একটা টুল বা মোড়া নিয়ে এসে বোসো।”
“এই ঠিক আছে।”
“তাহলে আর কী বলব! …যাক, কেমন আছ?”
“আছি! আমার দুখ নেই, গুরুজি। বালবাচ্চা ভাল আছে।” ছকু কিকিরাকে গুরুজি বলে। খুব দুঃখের দিনে গুরুজি একবার তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন।
কিকিরা এবার কাজের কথা পাড়লেন।
খুঁটিনাটি সব কথা বলার দরকার ছিল না, সংক্ষেপে যা জানানোর ছিল– জানিয়ে কিকিরা বললেন, কৃষ্ণকান্তর কলকাতার আস্তানা বি. কে. পাল অ্যাভিনিউয়ের অত নম্বর বাড়ি। সেই বাড়িতে ঢুকতে হবে।
ছকু বলল, “এ আর এমন কী শক্ত কাজ গুরুজি! সদরের কোলাপসিবল গেট, দরজার তালা, গ্রিল, কী ভাঙতে হবে বলুন! ভেঙে দিচ্ছি।”
ছকুর হাতযশ জানা আছে কিকিরার। বললেন, “না; তালা ভেঙে ঢোকার দরকার নেই। তাতে লাভ হবে না। সরাসরি ঢুকতে চাই।”
মাথা চুলকে ছকু বলল, “সিধে যাবেন! কীভাবে!”
“তুমি বলো?”
খানিকক্ষণ ভাবল ছকু। বলল, “গুরুজি, আমি বাড়িটা আগে নজর করে নিই। যদি বলেন, টাইমে হল্লা লাগিয়ে দেব। আপনি ঢুকে যাবেন।”
কিকিরা হাসলেন। “না, হল্লা লাগিয়ে কাজ হাসিল হবে না!”
“তো ক্যায়সা হবে?”
কিকিরা বললেন, “আমি একটা মতলব ভাবছি। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। কৃষ্ণকান্তবাবুর সঙ্গে আমি যখন কথা বলব, তুমি সরে গিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। দেখবে কোথায় কোন ঘর, কে কে আছে, বাড়ির পেছন দিক দিয়ে কীভাবে ঢোকা যায়। ও-বাড়িতে দু-তিনজন কর্মচারী আছে বাবুর। তাদের তুমি সামলাবে। দরকার হলে তোমার হাতসাফাই দেখাবে।”
“ওসব ঠিক আছে; মাগর আপনি যাবেন কেমন করে?”
“মহারাজ হয়ে। শ্যামদাস মহারাজ।”
ছকু অবাক! “সাধুজি মহারাজ হয়ে?”
কিকিরা হাসলেন। “কৃষ্ণকান্ত ধর্মকর্ম করেন। কালীভক্ত। সাধুসন্তকে তাড়িয়ে দেবেন না মনে হয়।”
ছকুর বিশ্বাস হচ্ছিল না। পছন্দও করছিল না ব্যাপারটা।
কিকিরা তাকে বোঝাতে লাগলেন তাঁর মতলবটা।
অনেক ভেবে কিকিরা ঠিক করেছেন, বেশি ঝঞ্ঝাট ঝামেলায় না গিয়ে সহজভাবে এই কাজটা করা যেতে পারে। তিনি সাজবেন নকল মহারাজ, সঙ্গে থাকবে চেলা ছকু। ছকুকে জটা দাড়ি গোঁফ কিছুই লাগাতে হবে না। যেমন আছে তেমন থাকলেই চলবে, শুধু একটা গেরুয়া জামা গায়ে চাপালেই যথেষ্ট। কিকিরাকে অবশ্য সামান্য ভোল পালটাতে হবে। মাথায় জটার দরকার নেই, তবে বাবরি ধাঁচের পরচুলা পরতে হবে। সাধুসন্ন্যাসীর কানঢাকা টুপির বদলে তাঁকে গেরুয়া পাগড়িও বাঁধতে হবে না। মাথার নকল চুল সামলাবার জন্যে একটা গেরুয়া পট্টি টুপিই যথেষ্ট। গালে মুখে সামান্য দাড়ি গোঁফ লাগানো দরকার। চোখে চশমা। গোল চশমা হলেই ভাল। পরনে বাসন্তী-গেরুয়া আলখাল্লা। কাছাকোঁচাহীন বস্ত্র। জব্বর এক রুদ্রাক্ষের মালা ঝোলাবেন গলায়।