“হতে পারে। তবে অকারণ ভয় ছোকরার ভাল করছে না। এভাবে চললে ও নিজেই না একটা কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে৷” বলে সামান্য চুপচাপ থাকলেন কিকিরা। পরে বললেন, “লাটু, তুমি কি জানো, ওকে যিনি পালন করেছিলেন বা পোষ্য নিয়েছিলেন, সেই ভদ্রলোক রজনীকান্ত কোনও উইলটুইল করে রেখে গিয়েছিলেন কিনা?”
মাথা নাড়ল লাটু। গাড়িটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ অন্য পথের গাড়ি পার করাচ্ছিল।
ট্রাফিক পুলিশের হাত নামল। লাটু এগিয়ে গেল সোজা পথেই।
কিকিরা নিজের মনেই যেন বললেন, “এদিকে আমার ঘোরাফেরা কম। ভাল করে রাস্তাঘাটও চিনি না। দু-একজন আলাপী লোক থাকলে সুবিধে হত।”
“কেন। ধন্বন্তরি কবিরাজ মশাইয়ের সঙ্গে আপনার আলাপ…”
“আরও একটু জমাতে পারলে ভাল হত। দেখি।”
.
কৃষ্ণকান্তর বাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথে গাড়ি দাঁড় করাল লাটু। কিকিরাই চিনিয়ে দিলেন বাড়ি। “তোমরা বোসো, আমি আসছি”–গাড়ি থেকে নেমে গেলেন তিনি। “বাড়ির দিকে নজর রেখো।”
গাড়িটা ভাল জায়গাতেই দাঁড়িয়েছে। একফালি তেকোনা ছোট পার্ক। বাচ্চারা খেলা করে বোধহয়, পার্কে দোলনা, স্লিপ, ছোট সিঁড়ি। ধুলোয় ভরা মাঠ। ফুটপাথের কোল ঘেঁষে একটা আধ শুকনো কৃষ্ণচূড়া। শীতে পাতা ঝরে যাওয়ার পর সবে নতুন পাতা আসছে ডালে।
তারাপদরা সিগারেট ধরাল।
লাটু বলল, “কী হবে বলুন তো! কুমার আমায় এমন একটা অবস্থায় ফেলবে, ভাবিনি। একেবারে গাধা।”
তারাপদ হেসে বলল, “আমার মনে হয়, বয়েস কম বলে শুধু নয়, ও বোধহয় খানিকটা বেশি অস্থির।”
“আমি অনেকবার বলেছি, তুই তোর জেঠার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি ছেড়ে দে। তোর হাতে কী আছে যা নিয়ে ফাইট করবি! কোর্টে একবার হেরেছিস। আর কেন! তার চেয়ে নিজের দোকান নিয়ে থাক। তোর তো দিব্যি চলে যাচ্ছে। …আমার কথা শুনবে না। জেদ। জেঠা তাকে ফাঁকি দিচ্ছে।”
“দেখুন লাটুবাবু, আইন আমি জানি না। কিকিরাও তেমন জানেন না। তবে উনি খোঁজখবর করে যা শুনেছেন তাতে মনে হয়, আইনসঙ্গত ভাবে দত্তক না নিলে আজকাল তার কোনও দাবি থাকে না। সম্পত্তির কথা বলছি। আগে অনেক সময় সামাজিক আচরণ করে কাউকে দত্তক নিলে আদালত তবু সেটা বিবেচনা করত। এখন করতে চায় না। …তার ওপর কোন পক্ষ কীভাবে মামলা লড়ছে, কার কত জোর, জজসাহেবের মরজি”।
“মুশকিল তো সেখানেই,” লাটু বলল, “ছেলেবেলার কথা কুমারের মনে নেই। তার মা, মানে রজনীকান্তর স্ত্রী, যাকে কুমার মা-মাসি বলত, তিনিও বেঁচে নেই যে, পুরনো ব্যাপারটা জানা যাবে। তবে এখানেও একটা ফাঁক আছে। কুমার পুরোপুরি পালিত ছেলে হলে তার মা-মাসি তো বলেই দিতেন, তুমি আমাদের সম্পত্তির কিছুই পাবে না। তোমার কোনও অধিকার নেই।”
“বলেননি বোধহয়?”
“শুনিনি। কুমার বলেনি।”
ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। নজরও রাখছিল কৃষ্ণকান্তর বাড়ির দিকে। দু’-একজন ঢুকে যাচ্ছে বাড়িতে, কেউ বা বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ একটা ট্যাক্সি এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে কে একজন ঢুকে গেল ভেতরে। ছোকরা বয়েস, পরনে প্যান্ট শার্ট, হাতে ব্যাগ। গটগটিয়ে ঢুকে গেল ছোকরা। আধঘণ্টার মতন হবে, কিকিরা ঘোরাফেরা সেরে ফিরে এলেন।
“চলো।”
“গিয়েছিলেন কোথায়?”
“বাড়িটার পেছনের দিকে। একটা সরু গলি আছে। পাঁচমেশালি গলি। গলির শেষে ছোট বাড়ি। বাড়িটার পেছন দিকের কম্পাউন্ড ওয়ালের পাঁচিল বেশি উঁচু নয়। গাছপালা রয়েছে দু-একটা। পাঁচিল-লাগোয়া একপাশে একটা টিনের চালা। গলির ওপর ঝুঁকে পড়েছে।”
“গলির লোকজন?”
“বাড়ি রয়েছে রামশ্যামের, মুদিখানার ছোট দোকান, তামাক পাতার আড়ত, কামারের দোকান…”
“কথাবার্তা বললেন কারও সঙ্গে?”
“ না। শুধু দেখে এলাম।”
“তাহলে?”
“এখন কিছু বলতে পারছি না।” বলে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাইলেন তারাপদর কাছে। “ছকু বেটা যে কী করছে কে জানে!”
“ছকু কে?” লাটু বলল।
“ছকু একজন পাক্কা আর্টিস্ট। নর্থ ক্যালকাটার পিক পকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট!” কিকিরা গম্ভীরভাবে বললেন।
লাটু অবাক হয়ে বলল, “পকেটমার।”
“আগে মারত। তা বলে ছিঁচকে ছিল না। ওর বাজারে নাম ছিল ছা! মারলে ওভার বাউন্ডারি। ছকু এখন গুরু। ভেরি গিফটেড পারসন। হাত সাফাইয়ের কতরকম কায়দা বার করেছে।”
“বাঃ! শেষ পর্যন্ত পকেটমার!” তারাপদ বলল, “কলকাতা শহরের আর কত দাগি আসামিকে আপনি চেনেন, সার!”
“তা ওরকম চেনাচিনি আমাকে রাখতে হয়, তারাবাবু। ওরা আমার গুমটি। দরকারে কাজে লাগে। …তবে ছকু বেশি জেলেটেলে যায়নি। জেলটা ওর পছন্দ নয়। তাই হাতে-কলমে নিজে কিছু করে না, এখন তো ট্রেনিংয়ের লাইনে আছে। ট্রেনার। বা অ্যাডভাইসার।”
লাটু হেসে ফেলল। ভাবল, রায়দা তামাশা করছেন।
তারাপদ বলল, “ছকু আপনার কোন কাজে আসবে, সার?”
“দেখি কী কাজে আসে!…ছকুর আর একটা কোয়ালিফিকেশন কী জানো?”
“কী?”
“চালাক বেড়ালের মতন সে সব জায়গায় ঢুকে পড়তে পারে। তাকে আটকানো মুশকিল।”
“ও! আপনি তাহলে ছকুকে কৃষ্ণকান্তর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিতে চান?”
“পারলে ভাল।” বলে কিকিরা লাটুর দিকে মুখ বাড়ালেন। “শোনো লাটু, আমার ধারণা নবকুমার তোমাকে নিশ্চয় কোনও খবর দেবে। দিলে, তুমি তাকে বলবে, ও যেন পালিয়ে গিয়ে বসে না থাকে। তাতে লাভ হবে না, উলটে ক্ষতি হবে। ওকে ফিরে আসতে বলবে। আরও বলবে, কাঠগোলার মাঠকোঠার বাড়িতে থাকতে না চায় না থাকুক। তারাপদর বোর্ডিংয়ে থাকবে। ব্যবস্থা হয়েছে। ভয়ের কারণ নেই।”