কিকিরা হাসলেন। “আরে না, বলব না।…তোমার গাড়ি রেডি রেখো। দরকার হবে।”
“দোকানের কাছেই থাকবে।”
“ঠিক আছে।” কিকিরা ফোন ছেড়ে দিলেন।
চা খেতে খেতে ঠিক করে নিলেন, তারাপদকে অফিসে ফোন করবেন। আসতে বলবেন তাকে। চন্দনকে পাওয়া যাবে না। নবকুমার সত্যিই সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। বারবার সে পালিয়ে যাচ্ছে কেন? গোড়ায় সে না হয় ভয় পেয়ে ভুল করেছে। কিন্তু এবার তার কী হল? কেন পালিয়ে গেল? লাটুকেই বা একটা খবর দিল না কেন? আশ্চর্য!
.
লাটু দত্তরা বনেদি বংশ ধনী পরিবার বললে ভুল বলা হয় না। তাদের বাড়ি ওর ঠাকুরদার আমলে। পুরনো ধাঁচের। পরে রদবদল হয়েছে খানিক, প্রয়োজনে, তবু চেহারাটা সাবেকি ধরনের।
লাটুর নিজের একটা গাড়িও আছে। দাদারা আর পরিবারের অন্যরা বড় গাড়িটাই ব্যবহার করেন। লাটুর গাড়ি ছোট, পুরনো মডেলের, তবে তার শখের গাড়ি বলে কলকজাগুলো অতিরিক্ত নজর পায়। লাটুবাবু নিজেই গাড়ি চালায়, মামুলি খুঁতও সে রাখে না গাড়ির। তবু ওটা যন্ত্র তো! মাঝেসাঝে লাটুকে যে ভোগাবে তা বলাই বাহুল্য।
আলো না থাকার মতন। সন্ধে হয়ে আসছে প্রায়। কিকিরারা খালধারের মাঠকোঠায় এসে হাজির। তারাপদও এসেছে সঙ্গে।
মাঠকোঠার নীচের তলায় তিন চারজন মিস্ত্রি থাকে। তাদের দু’জন প্রফুল্লর কাঠগোলায় কাঠ চেরাইয়ের কাজ করে। অন্য দুই মিস্ত্রি সামান্য তফাতে কাঠের দোকানে জানলা দরজার ফ্রেম পাল্লা তৈরির কাজ করে। অবশ্য বাইরের মজুরও আসে দোকানে। মিস্ত্রিদের খাওয়াদাওয়া রান্না নীচেই। নিজেরাই করে।
প্রফুল্ল এ সময় কাঠগোলার গদিতে থাকে না। তার অন্য কাজও থাকে বাইরে। বিশেষ করে আজ মাস দুই বুড়ো বাবা আর ডাক্তার বদ্যি নিয়ে বড় ব্যস্ত।
কিকিরারা মিস্ত্রিদেরই ধরলেন।
তারা বলল, গতকাল সকালে এখানে পুলিশের গাড়ি ঘোরাঘুরি করেছে অনেকক্ষণ। থানার বড়বাবু মেজোবাবুরা সর্বত্র ঢুঁ মেরেছেন।
কেন?
কাল মাঝ বা শেষরাত্রে খালধারে একটা ডেডবডি’ পাওয়া গিয়েছে। জোয়ান বয়েস। গুলি খেয়ে মরেছে। হাতে কাঁধে চপারের ক্ষত।
লোকটা কে, কেউ জানে না। ঠিক এই এলাকারও নয়, নয়তো মুখ চেনা হত। মনে হয় অন্য কোথাও তাকে মেরে এখানে ধড়টা ফেলে গিয়েছে।
কিকিরারা অন্য দু-একটা জায়গাতে খোঁজ করলেন। একই কথা সকলের।
“লাটু, তোমার বন্ধু প্রফুল্ল তো খবরটা বলেনি তোমায়?” কিকিরা বললেন।
লাটু বলল, “কী জানি! ও যখন ফোন করেছে তখন হয়তো খবরটা চাউর হয়নি।”
“নবকুমার কি পুলিশের গাড়ি আর থানার বাবুদের ঘোরাফেরা দেখে ভয়ে পালাল?”
মাঠকোঠা থেকে শ’খানেক গজের তফাতে একটা চায়ের দোকান। মেঠো দোকান, মাথায় টিনের চালা, রাস্তার গা ঘেঁষে বেঞ্চি। তোলা উনুন জ্বলে, জল ফোটে হাঁড়িতে। মাটির খুরি কিংবা ছোট ছোট কাঁচের গ্লাসে চা। কাঁচের বয়ামে দিশি বিস্কুট। চাঅলা বিহারি।
অন্যদের চেয়ে তার দেওয়া খবরটাই বিস্তারিত। সে বলল, সকালে সবেই যখন উনুন ধরিয়েছে চাঅলা, মাঠকোঠার বাবু তার দোকানে চা খেতে এসেছিল। ক’দিনই আসছে। এমন সময় হঠাৎ একটা পুলিশ জিপ খালপাড়ের রাস্তায় ঢুকে পড়ে। তখন অন্য কোনও দোকান খোলেনি এধারের। আটটা ন’টার আগে খোলেও না। টায়ার সারাইয়ের দোকানটাও নয়।…পুলিশের জিপ একবার চর দিয়ে চলে গেল। কখনও কখনও পুলিশের জিপ আসে এপাশে। নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম, তখন কেউ বোঝেনি, জানতও না! বেলা বাড়ার পর দেখা গেল পুলিশের বড় গাড়ি, পুলিশ একদল। তারপরই শোনা গেল লাশ পড়ে থাকার কথা।
লাটু বলল, “তুমি বাবুকে যেতে দেখছ?”
দোকানি বলল, “জরুর। বাবু গোড়া বাদ ইধার সে কাঁহা…”
“বাবুর সঙ্গে ছিল কিছু?”
“ব্যাগ…।”
কিকিরা লাটুকে বললেন, “চলো। বুঝতে পেরেছি। পুলিশের জিপ দেখেই ও ভয়ে পালিয়েছে। এখানে কী ঘটেছে সে জানে না।”
গাড়ির কাছে ফিরে এসে লাটু বলল, “এখন কী করা যায় রায়দা?”
“কী করবে আর! ওয়েট করো। আমার মনে হয়, নবকুমার যেখানেই যাক– তোমায় একটা খবর দেবে। আজই হোক বা কাল…”
লাটু আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। তারা ফুটেছে আকাশে। খালের দিক থেকে হাওয়া আসছিল। ঝোপঝাড় আর পাঁক ময়লার গন্ধ-মেশানো হাওয়া।
“এখন তাহলে ফিরতে হয়!” তারাপদ বলল।
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন না। লাটুকে বললেন, “চলো তো একবার বি. কে. পাল ঘুরে আসি।”
“বি. কে. পাল অ্যাভিনিউ? মানে
“কৃষ্ণকান্তর বাড়ির দিকটায় চলো একবার। আমি পাড়াটা দেখে গিয়েছি। চলো।”
ওরা গাড়িতে উঠল।
তারাপদ বলল, “আপনি কৃষ্ণকান্তর বাড়ি যাবেন নাকি?” হালকাভাবেই বলল। সে জানে কৃষ্ণকান্তর বাড়ি যাওয়ার কথাই ওঠে না এখন।
কিকিরা বললেন, “যাব। যেতেই হবে। তবে আজ নয়। দু-তিন দিন পরে। আজ ও-পাড়ায় একটু ঘুরব। তোমরা গাড়িতে থাকবে। একটু আড়ালে গাড়ি রেখো। নজর করবে কৃষ্ণকান্তর বাড়িতে কেউ যাচ্ছে, না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে?”
“তাতে লাভ?”
“লাভ-লোকসান পরে দেখা যাবে।”
গাড়ি চলতে শুরু করেছিল।
লাটু বলল, “রায়দা, আমি ধোঁকা খেয়ে যাচ্ছি। এর পর কী হবে কে জানে!” কিকিরা বললেন, “আমার মাথাতেও আসছে না, নবকুমার বার বার কেন পালিয়ে যাচ্ছে? ছেলেটার এত ভয় কেন?”
“কী জানি! তবে খুনখারাপির ব্যাপার, ওর বয়েস কম, বোধহয় ঘাবড়ে যাচ্ছে।”