“কেমন?”
“আফিং দেওয়া জলে পানপাতা ভিজিয়ে রাখতে হবে কমপক্ষে একবেলা। তাতে গোলাপজলের ছিটে থাকবে। খয়ের আসে বেনারস থেকে, কাল্মি খয়ের, গুলতে হয়। গন্ধ মেশানো থাকে। সুপুরি দু’-এক কুচি। জরদা কাশীর। দেড়শো দুশো টাকা ভরি। পানের ডিবে এক বিঘতমানে ধরো ছ-সাত ইঞ্চি লম্বা। জার্মান সিলভারের ডিবে। জরদার কৌটো রুপোর। দিনে তিরিশ চল্লিশটা পান খান।”
চন্দনরা রীতিমতন অবাক হয়ে গিয়েছিল। একজন মানুষ সম্পর্কে জানার কত কী থাকতে পারে! কৃষ্ণকান্ত কালীভক্ত, পুজোআচা করেন, আবার আফিংয়ের জলে ভেজানো পানপাতায় সাজা পান ছাড়া অন্য কিছু মুখে তোলেন না, এ বড় আশ্চর্য জিনিস তো!
কিকিরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “দেখো চাঁদু, নবকুমারকে আমি অবিশ্বাস করতে চাইছি না, কিন্তু তার সেদিনের ব্যবহারটা অবশ্যই অদ্ভুত। আদালতের সামনে দাঁড়ালে তাকে বিস্তর নাজেহাল হতে হবে।…তা সে যাই হোক, আপাতত তাকে কেউ ফাঁসায়নি। পরের কথা জানি না।”
“লাটুবাবু কী বলেন?”
“লাটু এখনও সব কথা জানে না। কাল দেখা হবে। ফোনে কথা কমই হয়েছে। দেখা হলে বলব!”
“আপনি অন্য কিছু ভাবছেন নাকি?” তারাপদ বলল।
“হ্যাঁ। ভাবছি, কৃষ্ণকান্ত আর নবকুমারের মধ্যিখানে অন্য কেউ ছিল কিনা? থার্ড পারসন।”
“থার্ড পারসন? তৃতীয় কেউ?”
কিকিরা কোনও জবাব দিলেন না।
.
০৪.
সাতসকালে লাটু দত্তর ফোন।
কিকিরা চা জলখাবার খাচ্ছিলেন। হাতে তৈরি একটিমাত্র রুটি, সামান্য সবজি সেদ্ধ, একটা কলা। মগের মতন এক বড় কাপে চা, সকালের চায়ে দুধ থাকে না। সাধারণভাবে এটাই তাঁর জলখাবার। মাঝেসাঝে মুখের রুচি পালটান। তবে মুখে যতই বলুন কিকিরা, আহারের ব্যাপারে বরাবরই সংযমী।
ফোন তুললেন কিকিরা। ভেবেছিলেন, সুশীল কিংবা ছকু হবে। সুশীল ভাল মেকআপম্যান, তার হাতে পড়লে মামুলি ফেরিঅলা যে কেমন করে ছানাপট্টির দুলাল হয়ে যায় কে জানে! সুশীল আবার হাল আমলের কায়দায় মুখোশ তৈরি করতে পারে। সুশীলকে একটা খবর দেওয়া ছিল। হয়তো সে ফোন করেছে। আর ছকু হল চোর-ছ্যাঁচড়দের গুরুর মতন। তার নামযশ হাতযশ যথেষ্ট। ছকু কিকিরার বাধ্য চেলা। তাকেও একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলেন কিকিরা। যেটা আজকাল বাগবাজারে আস্তানা গেড়েছে। দোকান দিয়েছে লন্ড্রির। বান্ধব লন্ড্রি। নিজেও খবরটা জানিয়ে রেখেছিল কিকিরাকে।
ফোন তুলে কিকিরা সাড়া দিতেই লাটু দত্তর গলা পেলেন।
লাটুর গলায় উত্তেজনা, উদ্বেগ।
“কী হল? সাতসকালে…”
“রায়দা, সর্বনাশ হয়েছে। কুমার পালিয়ে গিয়েছে।”
“সে কী!” কিকিরা চমকে উঠলেন।
“একটু আগে আমি খবর পেলাম। ওকে যেখানে যার হেফাজতে রেখে এসেছিলাম–সেই প্রফুল্ল হাজরা আমায় ফোন করে জানাল, আজ সকাল থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে কেউ নেই।”
কিকিরা বললেন, “তুমি কি বাড়ি থেকে ফোন করছ?”
“হ্যাঁ।”
“হাজরা তোমায় কোত্থেকে ফোন করল? ওই মাঠকোঠা বাড়িতে কি ফোন আছে?”
‘না। হাজরা তার কাঠগোলা থেকে ফোন করেছে। আমি তাকে বলে রেখেছিলাম কুমারের ওপর নজর রাখতে। সে গোলায় এসে সকাল বিকেল কুমারের সঙ্গে দেখা করে যেত। আজ সকালে এসে মাঠকোঠায় গিয়ে দেখে কুমার নেই। দরজা ভেজানো।…ভেতরে গিয়ে দেখল, কুমার নেই।”
কিকিরা বললেন, “আশেপাশে কোথাও যায়নি তো?”
“কোথায় যাবে! তাকে বারণ করা আছে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে। তা ছাড়া এখন বেলাও হয়েছে। আটটা বেজে গেল।”
কিকিরা ভাবছিলেন। তারাপদকে বলা ছিল তার বোর্ডিংয়ে একটা ব্যবস্থা করে কুমারকে নিয়ে গিয়ে রাখতে। তারাপদ ব্যবস্থাও করে ফেলেছিল। আজ কিংবা কাল তাকে নিয়ে যেত। এরই মধ্যে নবকুমার উধাও!
“ওর ঘরে,” কিকিরা বললেন, “জিনিসপত্র? মানে ওর জামাপ্যান্ট এটা ওটা–যা ও ব্যবহার করত–সেসব আছে?”
“অত কিছু প্রফুল্ল দেখেনি। শুধু বলল, একটা বড় কিট ব্যাগ ছিল ঘরে, আগে সে দেখেছে। আজ ব্যাগটা দেখতে পেল না।”
কিকিরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “লাটু, আমার মনে হচ্ছে নবকুমার নিজেই পালিয়েছে। তাকে কেউ ধরে নিয়ে গেলে কিট ব্যাগ ঘরেই পড়ে থাকত। তা যখন নেই, ধরে নেওয়া যেতে পারে সে নিজেই পালিয়ে গিয়েছে। ব্যাগে নিশ্চয় ওর জামাপ্যান্ট টুকিটাকি ছিল।”
লাটু বলল, “কোথায় যাবে? কেনই বা হঠাৎ…!”
“হয় ভয় পেয়েছে, না হয় ওখানে থাকতে আর ভরসা হয়নি।”
লাটু চুপ করে থাকল। ফোনের মধ্যেই ওর বিহ্বলতা ধরা পড়ছিল। বলল, “এখন কী করি বলুন তো?”
“কী করবে!…তোমার করার কিছু দেখছি না। দুটো কাজ করতে পারো! ওর সেই দেশগ্রামের বন্ধু–যে নাগেরবাজারে থাকে, সেখানে একবার খোঁজ করতে পারো! আর ওর দোকানে একবার দেখতে পারো–যদি কোনও খোঁজ পাও!”
অল্প সময় চুপ করে থেকে লাটু বলল, “নাগেরবাজারের বাড়ি আমি চিনি না। দোকানে বরং একবার খোঁজ নিতে পারি।”
কিকিরা ভাবছিলেন। বললেন, “শোনো, আজ বিকেলে–মানে ছ’টা নাগাদ তুমি তৈরি থেকো। খালপাড়ের কাঠগোলায় যাব আমরা। খোঁজখবর করে দেখি কী জানা যায়!”
“আমি আপনাকে তুলে নেব?”
“না। তুমি দোকানেই থেকো। আমি যাব। মেজোবাবুর সঙ্গে ওই ফাঁকে দেখাও হয়ে যাবে।”
“রায়দা, প্লিজ…, মেজদাকে কিছু বলবেন না। আমি বাইরের উটকো ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি শুনলে খেপে যাবে।”