চন্দন অস্বীকার করতে পারল না।
“তা ছাড়া টাকা লেনদেনের সঙ্গে একটা শর্ত ছিল। কৃষ্ণকান্ত তখনই টাকা দেবেন যখন নবকুমার কিছু কাগজপত্রে সই করবে! কোথায় সেই কাগজপত্র? কী লেখা ছিল তাতে? নবকুমার জানে না।”
তারাপদ বলল, “বোধহয় তাতে লেখা ছিল রাজবাড়ির কোনও সম্পত্তির ওপর নবকুমার আর কোনওদিন কোনও দাবি-দাওয়া করবে না।”
“আমারও তাই মনে হয়।… তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে করতে হবে, কৃষ্ণকান্ত দয়ার অবতার সেজে ভাইপোর সঙ্গে একটা মিটমাট করতে চাননি। এমন কোনও কারণ ছিল যাতে তিনি আশঙ্কা করতেও ভবিষ্যতে একটা গণ্ডগোল হলেও হতে পারে,” কিকিরা বললেন। “লাটুকে আমি কালও রাত্রে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নবকুমার কি কখনও তাকে বলেছে রজনীকান্ত কোনও উইলটুইল করেছিলেন কিনা? …লাটু বলল, সে শোনেনি; নবকুমার তাকে বলেনি।”
বগলা লস্যির মতন শরবত তৈরি করেছিল। দিয়ে গেল তারাপদদের। কিকিরাকেও।
এই সময় শরবত খেতে ভালই লাগার কথা। চন্দন আরামের শব্দ করল।
“কাল আপনি সারাদিন কী করছিলেন?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।
“খোঁজখবরের চেষ্টা করছিলাম। সবই বৃথা! শেষে বি.কে. পাল অ্যাভিনিউতে উঁকি দিলাম। মানে, গেলাম ওখানে।”
“কৃষ্ণকান্তর গদিবাড়িতে?”
“আরে না; হুট করে সে বাড়িতে যাওয়া যায়!… চেনা লোকটোক খুঁজলাম, পেলাম না। ও-পাড়ার কাউকে চিনি না। শেষে কী করলাম জানো?”
“কী?”
“একটা মামুলি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি–আসলে ভাবছি কী করব, হঠাৎ উলটো দিকের একটা বাড়ির নীচের তলায় ফুটপাথ ঘেঁষে দেখি এক কবিরাজের নাম আর ছোট সাইনবোর্ড লটকানো।”
“কবিরাজ?” চন্দন অবাক হয়ে বলল।
“হ্যাঁ সার, কবিরাজ।…বৈদ্যরাজ চন্দ্রকান্ত সেনশর্মা, আয়ুর্বেদ ধন্বন্তরি। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, কবিরাজমশাই কেমন, মানে হাতযশ। তারা বলল, রোগী পায় না। নিজেই হাঁপানি রোগী।”
তারাপদরা জোরে হেসে উঠল।
কিকিরা বললেন, “আমি দেখলাম, একবার টোকা মেরে দেখি কী হয়! কেননা, কৃষ্ণকান্তর বাড়ির চার পাঁচটা বাড়ির পরই কবিরাজমশাইয়ের বাড়ি বা ডাক্তারখানা বা চেম্বার।”
“চলে গেলেন?”
“একেবারে সটান। তখন বেলা হয়ে যাচ্ছে। ধন্বন্তরির দেখা পাব কি পাব না জানি না। জয় মা দুর্গা বলে সটান চলে গেলাম। দেখাও পেলাম। একটা তক্তপোশের ওপর ময়লা ফরাস। কবিরাজমশাই বসে বসে খবরের কাগজের বাসি খবর পড়ছেন। রোগা খিটখিটে চেহারা, গালে দাড়ির কুচি, চোখে চশমা, পরনে আধময়লা ধুতি, গায়ে ফতুয়া।”
“দারুণ। ধন্বন্তরির এই অবস্থা?”
“খুব বিনয় করে নমস্কার সেরে বললুম, আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের মুখে ওঁর গুণপনার কথা শুনে আসছি। বলে একটা উটকো নাম বললুম। তারপর নিজের নাম বলতে হল। ভবানীপ্রসাদ সাঁই। একটা ঠিকানাও দিলাম। দুটোই ঝাড়া ফলস, যা মুখে এল বলে দিলাম।”
তারাপদ আর চন্দন হো হো করে হেসে উঠল।
“তারপর শোনো” কিকিরা বললেন, “কবিরাজমশাই আমায় বসতে বললেন। একটা চেয়ার ও একটা টুল সামনে। বসলাম। সেনশর্মা বললেন, ব্যাধি কী?…বললাম, অনিদ্রা, মাথাঘোরা, অগ্নিমান্দ্য, পেট ফাঁপা, অসম্ভব দুর্বলতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এলাপ্যাথি, হোমোপ্যাথি অনেক করেছি। কোনও উপকার হয়নি। শেষে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি।”
চন্দন হাসতে হাসতে বলল, “ফাইলেরিয়া ম্যালেরিয়া বাকি রাখলেন কেন? লাগিয়ে দিলে পারতেন।”
কিকিরা মুচকি হেসে বললেন, “গাছের সব ফল একসঙ্গে পাড়তে নেই। হাতে রাখতে হয়।…তারপর কী হল শোনো–! কবিরাজমশাই নাড়ি টিপে বায়ু পিত্ত কফ আন্দাজ করে নিয়ে মাথায় মাখার তেল, হজমের গুলি, তেঁতুল চটকানো চ্যবনপ্রাশ, কীসের এক আরিস্ট দিলেন। আমার পঁচাশি টাকা খসে গেল।”
“সারের টাকা হাতের ময়লা,” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল।
“আরে বাপু, আমার তো অন্য মতলব। কথায় কথায় কবিরাজকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর প্রতিবেশী কৃষ্ণকান্তবাবুকে চেনেন কিনা? বানিয়ে বানিয়ে দিব্যি বললাম, আমি ওঁর দেশের লোক। তবে এক গ্রামের নয়। জমিদারবাড়ির দুটো গ্রাম তফাতে আমার দেশ।”
চন্দন বলল, “বাঃ, বানিয়েছেন ভাল।”
“কী বললেন কবিরাজ?”
“বললেন, চেনেন। আলাপ অবশ্য তেমন নেই। তবে কৃষ্ণকান্তের যে ধর্মেকর্মে মতি আছে, শুনেছেন। নিত্য পুজোআচা করেন। কালীভক্ত। কলকাতায় এলেই একবার কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে যান দর্শন করতে।”
“কালীভক্ত?”
“দেশের বাড়িতে দু’ পুরুষের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি আছে, মন্দির আছে। এখানেও বাড়িতে কালী আছেন, ব্রাহ্মণ এসে পুজো করে যান।”
“যাঃ বাব্বা! মা কালীর সন্তান! তা ইয়ে এত কথা…”
“ও বাড়ির এক কর্মচারী, বিপিন সাধু, এখানেই থাকে, মাঝে মাঝে কবিরাজমশাইয়ের কাছে আসে। গল্পগুজব করে, দাবা খেলে, পদ্মমধু দিয়ে গোলমরিচ আর সন্ধব লবণের চূর্ণ খায়।”
“তাতে কী হয়?”
“জানি না।”
“আর কী শুনলেন?”
“কবিরাজ বললেন, মশাই কৃষ্ণকান্তবাবু বেশ মেজাজি মানুষ। এ-পাড়ার দুর্গা কালীপুজোয় তাঁর গদি থেকে পাঁচ সাতশো টাকা চাঁদা বরাদ্দ করা আছে।”
“পাড়ার ছোকরাদের হাতে রেখেছেন আর কি!”
কিকিরা শরবতের গ্লাস নামিয়ে রেখেছিলেন। আয়েসের ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে একটা চুরুট ধরালেন। বললেন পরে, “তাঁর পান খাওয়ার গল্পও শুনলাম। রাজকীয় ব্যাপার হে। কৃষ্ণকান্তর মুখে বাজারি পান রোচে না। তাঁর পানের রুচি অন্যরকম।”