“হ্যাঁ। কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীর মুখ। কাল পেয়েছি। লাটু দিয়ে গিয়েছে। আমি তখন বাড়ি ছিলাম না। রাত্রে লাটু ফোন করেছিল। বললাম, পেয়েছি। অন্য কথাও হল।”
চন্দন কাগজটা হাতে করে নিজের জায়গায় ফিরে এসে বসল। দেখতে লাগল মুখটা। খুঁটিয়ে।
কিকিরা একবার উঠে ভেতরের ঘরে গেলেন। ফিরে এলেন সামান্য পরে।
“দেখে তো মনে হচ্ছে কড়া ধাতের লোক। ধূর্ত, প্যাঁচোয়া।”
“চোখ দেখে তাই মনে হয়।… নবকুমার যদি বাড়াবাড়ি না করে থাকে তবে আমার মনে হয়, ভদ্রলোককে চতুর, ধূর্ত মনে হলেও পাক্কা ক্রিমিন্যালের মতন দেখায় না। খুনখারাপি করার লোক নয়।”
চন্দন আবার ছবির মুখটা দেখতে লাগল।
কিকিরা হঠাৎ তামাশার গলায় বললেন, “চাঁদু, ধরো আমি ফলস দাড়ি গোঁফ লাগালাম, চোখে কপালে খানিকটা কালিঝুলির মেকআপ নিলাম। মাথায় একটা উইগ চাপালাম। আমায় কেমন দেখাবে?”
চন্দন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত সময় নিল বুঝতে। তারপর হেসে ফেলল। “কেমন লাগবে!… তা খারাপ লাগবে না। যাত্রাদলের নারদ মনে হতে পারে।”
কিকিরা রেগে যাওয়ার ভান করে বললেন, “হোয়াট! আমাকে যাত্রার নারদ বলছ?… তুমি না দেখেছ যাত্রা, না দেখেছ নারদমুনি। নারদ মাথায় ঝুটি বাঁধে, দাড়ি গোঁফ থাকে না।”
চন্দন হো হো করে হেসে উঠল। “আপনাকে কেন বলব, আপনার সাজকে বলছি।”
“তুমি কি জানো না।… যাকগে, আসল কথা হল, আমার এই চোখ দুটো একেবারে ডাল’–মানে ফ্যাকাশে, জন্ডিস রোগীর মতন হলদেটে, একেবারেই ঝকঝক করে না।… বাইবেলে বলেছে, মানুষের চোখই আসল, তাকে চিনিয়ে দেয়।”
“আবার বাইবেল!” চন্দন হাসছিল। “আপনার চোখ ‘আই অব এ নিডল’।”
“সংস্কৃতে বলেছে, সজ্জনং পরিচীয়তে নয়নাৎ… মানে চক্ষু হইতে সজ্জন ও শয়তানকে পৃথক রূপে চেনা যায়।”
“দারুণ সাংস্কিট, ব্যাকরণ কৌমুদী হার মেনে যায়।… তা সার সংস্কৃত থাক। আপনি কী বলতে চাইছেন?” চন্দন হাসছিল।
“বুঝতে পারছ না?”
“না।”
“আমি বলছি, কৃষ্ণকান্তর মুখের গড়ন দেখে মনে হয় মানুষটির ব্যক্তিত্ব আছে। জমিদারদের রক্ত তো! দাপুটে মানুষ। তবে ওই চোখ থেকে বোঝা যায় কৃষ্ণকান্ত অত্যন্ত চতুর, হয়তো নিষ্ঠুর। তবে খুনে নয়।”
“সে তো নবকুমারের কথা থেকেই বোঝা গিয়েছে। নতুন আপনি কী বলছেন!”
“নতুন নয়, কিন্তু আমরা যা শুনেছি এ পর্যন্ত–তা একতরফা। নবকুমার যা বলেছে। এই ছবিও তার আঁকা। সাধারণ বুদ্ধি থেকে তুমি জানো, আমরা যাকে পছন্দ করি না, ঘৃণা করি, মনে করি শত্রু, তাকে যত পারি কালি মাখাই, তার দুর্নাম করি। কৃষ্ণকান্ত যে অত্যন্ত দুর্জন মানুষ, সেটা জানছি নবকুমারের মুখ থেকে। তাকে বিশ্বাস করছি। আমিও করছি বারো আনা। তবে আমার মনে হয়– কৃষ্ণকান্ত সত্যিই কেমন তা আমরা এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক জানি না।”
“মানে? আপনি”
“আমি কী বলছি বাদ দাও। অন্য পাঁচজন যদি বলে, নবকুমার টাকা নিয়েছে। যদি বলে সে সেদিন তার জেঠার ঘরে গিয়ে দেখে কৃষ্ণকান্ত বেহুঁশ অবস্থায় আর্মচেয়ারে পড়ে আছেন, সাড়াশব্দ নেই, আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, টেবিলের ওপর অ্যাটাচি রাখা রয়েছে, নবকুমার সুযোগ বুঝে সেটা উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তুমি কেমন করে প্রমাণ করবে সে টাকা নেয়নি?”
এমন সময় তারাপদ এসে ঘরে ঢুকল।
চন্দন তারাপদকে দেখল। “আয়-!” বলেই কিকিরার দিকে তাকাল। “আপনি কি বলতে চাইছেন, নবকুমার মিথ্যে কথা বলছে?”
“যদি বলে–?”
“তা কেমন করে হয় কিকিরা! লাটুবাবু ছেলেটিকে ভাল করে চেনে। নবকুমার যদি ওই ধরনের ছেলে হয়, লাটুবাবু নিশ্চয় ওর হয়ে আপনার কাছে আসতেন না।”
তারাপদ এতক্ষণে বসে পড়েছে। বলল, “কী ব্যাপার?”
চন্দন বলল, “কিকিরা কী সব বলছেন, উনি নবকুমারকে সন্দেহ করছেন।”
“কেন?”
কিকিরা বললেন, “আমি সন্দেহ করেছি বলিনি। বলছি যদির কথা–! আমি প্রথমেই বলেছি নবকুমার দু-তিনটে মারাত্মক ভুল করেছে। এক, ঘরে ঢুকে যখন তার জেঠাকে ওই অবস্থায় দেখল, তখন সে কেমন করে বুঝল, জেঠা মারা গিয়েছেন, সে তো জেঠার অঙ্গও স্পর্শ করেনি বলছে। সে কতবড় ডাক্তার যে, চোখে দেখেই বুঝে নিল জেঠা মারা গিয়েছেন। এক্ষেত্রে লোকে কী করে? নবকুমারের উচিত ছিল, তার জেঠাকে নাড়াচাড়া করে দেখা। যদি ভয়ে সেটা না পেরে থাকে তবে ঘরের বাইরে এসে লোকজন ডাকা। সে তাও ডাকেনি। পালিয়ে এসেছে। কেন? অ্যাটাচিটার কী হল। কুমার বলছে, আনেনি। ও বাড়ির লোক যদি বলে, নিয়ে পালিয়ে এসেছে কুমার! তাহলে?”
তারাপদ আর চন্দন পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। ধাঁধা লেগে গিয়েছে যেন!
শেষে তারাপদ বলল, “ভুল তো নবকুমার করেছে। কিন্তু আপনি হঠাৎ অ্যাবাউট টার্ন করছেন কেন?”
“না, করিনি। কোনটা সম্ভব তাই ভাবছি।… চাঁদু ডাক্তার তুমি, ওই আঁকা ছবিটা ভাল করে দেখেছ?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“তারাপদকে দেখতে দাও।”
তারাপদ পেন্সিলে আঁকা স্কেচটা নিল। দেখছিল।
কিকিরা চন্দনকে বললেন, “আচ্ছা ডাক্তার, কৃষ্ণকান্তর দাড়ি আছে দেখেছ তো!”
“হ্যাঁ।”
“ওকে চলতি কথায় বলে চাপ-দাড়ি, মানে গালের সঙ্গে যেন চেপে লেগে আছে। ঝুলো দাড়ি নয়, ঝুলে পড়ছে না গলায়।”
“তাতে কী!”
“এবার বলো, একটা লোককে যদি কেউ গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারার চেষ্টা করে, তার চোখমুখের চেহারা কেমন হতে পারে? আমি যতদূর বুঝি, আচমকা গলায় ফাঁস লাগলে মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে, মরিয়া হয়ে ওঠে, হাত পা ছোড়ে, ফাস আলগা করার চেষ্টা করে। যদি নাও পারে, তার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে, মুখ হাঁ হয়ে যায়, জিভ বেরিয়ে আসে।… কৃষ্ণকান্তর বেলায় তা হয়েছিল বলে নবকুমার বলেনি। আমি মেনে নিচ্ছি, কৃষ্ণকান্তর মুখে চাপ-দাড়ি ছিল বলে ভাল করে মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু চোখ? হাত পা? ফাঁস লেগে মরছে তবু ওভাবে নেতিয়ে কেউ পড়ে থাকে?”