কিকিরা কী যেন ভাবছিলেন। পকেট থেকে চুরুট বার করে ধরালেন। নবকুমারকেই বললেন, “রজনীকান্ত মানুষটি নিশ্চয় খুব ভাল ছিলেন?”
নবকুমার বলল, “ভাল মানে, মশাইবাবার মতন মানুষ হয় না। তার দয়ামায়ার কথা সকলে জানে। রাজবাড়ির ছোট কর্তা হয়েও একেবারে সাদাসিধে ভাবে থাকতেন। সেরেস্তার কাজকর্ম দেখতেন খানিকটা, বাকি সময়টায় বইটই পড়তেন, বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলতেন। তাস খেলা ছাড়া তার অন্য নেশা ছিল মাছধরা। কত যে ছিপ ছিল মশাইবাবার!”
“উনি কীভাবে মারা যান?”
নবকুমারের মুখ কেমন আরও মলিন বিষণ্ণ হয়ে গেল। বলল, “সে বড় অদ্ভুত ভাবে। আমি তখন বাইরে থাকি। স্কুল বোর্ডিংয়ে। হায়ার ক্লাসে পড়ি। হঠাৎ খবর এল, মশাইবাবা মারা গেছেন। সাপে কামড়েছিল। বিষাক্ত সাপ।”
“সাপ?”
“খবর পেয়ে ছুটলাম।… তখন শ্রাবণ মাস। ভরা বর্ষা। শুনলাম, সেদিন সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। মশাইবাবার ঝোঁক চাপল ওই বৃষ্টির মধ্যে পাশের গ্রামের ঘোষপুকুরে মাছ ধরতে যাবেন। ওই ঝিঁঝিপে বর্ষায় মাছধরায় আলাদা আনন্দ।… দুপুরের পর বিকেল যখন গড়িয়ে আসছে, বৃষ্টি নামল তোড়ে। চারদিক ঝাপসা। ঘোলাটে হয়ে এল গাছপালা। মশাইবাবা ফিরেই আসছিলেন, লতাপাতার ঝোপ থেকে কী করে যেন সাপের ছোবল খেলেন।… ওঁকে আর বাঁচানো গেল না।”
তারাপদ আর চন্দন নিশ্বাস ফেলল বড় করে। দুঃখই হচ্ছিল তাদের।
অল্পক্ষণ চুপ করে থাকার পর কিকিরা বললেন, “তুমি লেখাপড়া শেষ করার আগেই-”
“আমি স্কুল শেষ করে বর্ধমানে কলেজে পড়েছি। তারপর এসেছি কলকাতায়। অন্য কোনও জায়গায় পড়ার সুযোগ হল না। টেকনিক্যাল–মানে ওই পলিটেকনিকে পড়েছি। পরে আমার এক গুরু জোটে। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে হোটেলে দোকানে ফ্রিজ সারিয়ে বেড়াতাম। হাতে-কলমে শিখেছি। গুরু শেষে শিলিগুড়ি চলে যায়। আমি একটা দোকান দিই।”
“তোমার মা-মাসি তখন বেঁচে ছিলেন?”
“হ্যাঁ। মা-মাসি আমায় টাকাপয়সা দিয়েছেন। দোকান করার সময় নিজের কিছু গয়না। আমি নিতে চাইনি। মা-মাসি জোর করে দিয়েছেন। বলেছেন, আমি বেঁচে থাকতে এগুলো নিয়ে যা, নয়তো পরে কিছু পাবি না। আমি নিয়েছি। তখনই আমার লাটুদার সঙ্গে পরিচয়।–মাসির সোনাদানা যা পেয়েছিলাম লাটুদাই সেসব বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়।
লাটু কিকিরার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। কথাটা ঠিকই।
আবার খানিকটা চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “তোমার জেঠার কোনও ফোটো আছে?”
“এখানে নেই। আমার বাড়িতে আছে।”
“তোমার বাড়ি মানে—সেই…”
“না। আমি যেখানে আছি। সুরি লেনে।”
“সেখান থেকে ফোটো আনা–”
“পারা যাবে না। কে আনবে!” বলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে কী ভেবে যেন নবকুমার বলল, “আমি একটু আধটু ছবি আঁকতে জানি। ছেলেবেলা থেকেই। স্কেচ করতে পারি। জেঠার মুখ আমি কাগজ পেন্সিলে এঁকে দিতে পারি। খুব বেশি অমিল হবে না।”
কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন।
তারাপদ বলল, “ভালই তো! তাই দিক।”
কিকিরা বললেন, “বেশ। এঁকেই দাও।…এখন আমরা আর বসব না, অন্য কাজ আছে। তুমি ওটা এঁকে রাখো। কাল লাটু এসে নিয়ে যাবে।”
তারাপদ উঠে দাঁড়াল।
কিকিরা লাটুকে বললেন, “লাটু, এখান থেকে ওকে দু’-একদিনের মধ্যে অন্য কোথাও সরিয়ে দাও। আমার মনে হচ্ছে, এখানে থাকলে ওর ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। এখানে নয়, ওর গ্রামের সেই বন্ধুর বাড়িতেও নয়; অন্য কোথাও থাকুক আপাতত।”
“কোথায় সরাই, রায়দা? ভেবে দেখি।”
হঠাৎ তারাপদ বলল, “কিকিরা, ও না হয় আমার কাছেই থাকতে পারে ক’দিন!”
কিকিরা ভাবলেন দু’ মুহূর্ত। “নট এ ব্যাড আইডিয়া।” বলেই নবকুমারের দিকে তাকালেন। “তুমি সাবধানে থাকবে, এখন বাইরে যাবে না। কেউ এলে দেখাও করবে না। আর শোনো, ভয় পেয়ো না। তোমার জেঠা হুট করে কিছু করতে পারবে না। তোমার যেমন ভুল হয়েছে দু’-একটা ব্যাপারে, তোমার জেঠারও হয়েছে। এত সহজে তোমায় ফঁসাতে পারবে না।… যাই হোক, আমরা এখন চলি।… ভাল কথা, বি. কে. পাল অ্যাভিনিউতে যেখানে জেঠা আছে, তার ঠিকানাটা বলো।”
নবকুমার ঠিকানা বলল।
.
০৩.
মাঝের একটা দিন কিকিরাকে সকাল বিকেল বাড়িতে পাওয়া গেল না।
তারাপদ অফিস থেকে ফোন করেছিল বিকেলে, পায়নি। অবশ্য দুপুরে করলে পেতে পারত। বিকেলে উনি ছিলেন না বাড়িতে।
পরের দিন চন্দন এল বিকেলের পর। বড় গুমোট দিন। আকাশও ঘোলাটে। হয়তো ধুলোর ঝড় উঠতে পারে। এ সময়ে এমন হয়। ঠিক যে কালবৈশাখী তা বলা যাবে না। তবে ঝড় তো নিশ্চয়ই।
চন্দন এসে দেখল, কিকিরা নিজের জায়গাটিতে বসে কী একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। পুরনো বই বলে মনে হল, কাপড় দিয়ে বাঁধানো মলাট।
“কী সার? কী পড়ছেন?” চন্দন বলল।
“চাঁদু! বোসো৷… কী আর পড়ব!” বলে বইটা সরিয়ে রাখলেন।
“কাল আমার আসা হল না। অন্য কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম।”
“আমিও ছিলাম না বিকেলে। সন্ধের অনেক পরে ফিরেছি। এলে আমায় পেতে না। বাড়ি ফিরে শুনলাম তারা ফোন করেছিল।”
“আমার সঙ্গে দেখা হয়নি ওর। আজ নিশ্চয় আসবে।… তা নতুন খবর বলুন। কিছু পাওয়া গেল?”।
কিকিরা বললেন, “তোমায় একটা জিনিস দেখাই।” বলে পাশের ছোট টেবিল হাতড়ে একটা কাগজ বার করলেন। “এটা দেখো।”
চন্দন উঠে গিয়ে কাগজটা নিল। সাদা কাগজে পেনসিল দিয়ে একটা মুখ আঁকা রয়েছে। দেখল চন্দন। “নবকুমারের জেঠার মুখের স্কেচ?”