“পাক্কা কথা বলেছ। আদালত দেখত, ইটটা কেমন করে পড়ল, কে ফেলেছে? নিজের থেকেই আলসের আলগা ইট পড়ে গেছে কি না! যে বাড়ি থেকে ইটটা পড়ল সে বাড়িতে এমন কে আছে যে আমার শত্রু! আমাকে জখম করতে চায়! তার মোটিভ কী!… কিন্তু সেরকম কোনও ব্যাপারই নেই। কাজেই–”
কথাটা আর শেষ করলেন না কিকিরা।
তারাপদ বলল, “আপনার বেলায় না থাক, নবকুমারের বেলায় ছিল।”
“ছিল বলেই তো বলছি, নবকুমার ভুল করেছে পালিয়ে এসে। দু’ নম্বর ভুল হল, সে নিজের দোকান আর বাড়ি ছেড়েই বা পালিয়ে আসবে কেন? তাতে তার ওপর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এটা উচিত হয়নি।”
লাটু বলল, “ও ছেলেমানুষ, রায়দা! এতটা বোঝেনি।”
“তুমি যে ওকে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছ, তুমি কি ভাবছ ওর জেঠা বুঝতে পারবে না?”
“কেমন করে বুঝবে! এই মাঠকোঠার মালিক আমার চেনা লোক। বিশ্বাসী।”
“হতে পারে। কিন্তু, এটাও নিশ্চয় যে, ওর জেঠা খোঁজখবর রাখে, তুমি নবকুমারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কাজেই বিপদের সময় তুমিই তার প্রধান সহায় হবে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান তেমনই বলে।”
চন্দন একেবারে চুপচাপ ছিল। আগের দিনও সে কথা বলেছে কি বলেনি, আজও নীরব। এবার সে কথা বলল, “তা কিকিরা, ভুল শোধরাবার উপায় কী? ও কি নিজের ডেরায় ফিরে যাবে?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না। আর ফিরে গিয়ে লাভ নেই। আপাতত নয়। বরং এখানেই থাকুক। তবে চোখ খোলা রেখে!” কথা বলতে বলতে মাথার ওপর তাকালেন। বেশ গরম লাগছিল। ছোট একটা পাখা লোহার রডের সঙ্গে আংটায় ঝোলানো রয়েছে। ছোট পাখা। ইশারায় পাখাটা চালিয়ে দিতে বললেন।
লাটুই পাখাটা চালিয়ে দিল।
কিকিরা নবকুমারকে বললেন, “তোমার জেঠা যে তোমাকে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসে ফাসাবার চেষ্টা করছেন এ কথা তুমি জানলে কেমন করে?”
“বললাম যে, পালিতদা বলেছে। আমার দোকানের লোক। জেঠার কর্মচারী আমার দোকানে এসেছিল খোঁজ করতে আমাকে। সে বলে গিয়েছে।”
“খোঁজ করতে, না, ভয় দেখাতে।”
“জানি না।”
“তোমার জেঠা কৃষ্ণকান্তর নিশ্চয় অনেক বুদ্ধি। ধুরন্ধর মানুষ ভদ্রলোক। তা একটা কথা বলো তো বাপু, তোমাকে সম্পত্তি থেকে একেবারে বঞ্চিত করার অজুহাতটা কী ভদ্রলোকের?”
নবকুমার সামান্য চুপ করে থাকল। পরে ক্ষুব্ধ হতাশ গলায় বলল, “জেঠার কথা, আমি তাঁর ছোট ভাইয়ের পালিত পুত্র মাত্র। আমাকে আইনত দত্তক নেওয়া হয়নি। কাজেই আমি চৌধুরী বংশের ছোট তরফের উত্তরাধিকারী হতে পারি না।”
চন্দন অবাক হয়ে বলল, “এমন কোনও আইন আছে নাকি?”
“বর্ধমান কোর্টে আমি মামলা করেছিলাম। কিছু হয়নি।”
কিকিরা বললেন, “এটা তো আমিও জানি না। দত্তক আর পোয্য বা পালিত পুত্রকন্যাদের মধ্যে তফাতটা কী? তবে আইন বড় অদ্ভুত। কোনটা যে হ্যাঁ হয়ে যায়, কোনটা না, বলা মুশকিল।”
লাটু বলল, “আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, আইন বড় জটিল। যে কোনও লোক যাকে খুশি পালন করতে পারে। পালিত হলেই সে যে পালকের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে এমন কোনও কথা নেই। এই ধরনের মামলা অনেক হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে। কোর্ট হাইকোর্টে বছরের পর বছর মামলা চলে।”
কিকিরা আর মামলার কথায় গেলেন না। গিয়ে লাভ নেই। দেওয়ানি আর সম্পত্তির ওয়ারিশন নিয়ে যে এক একটা মামলা বিশ পঁচিশ বছর ধরে পড়ে থাকে আদালতে, তা তিনিও শুনেছেন। আপাতত ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তবু কয়েকটা কথা জানা দরকার।
কিকিরা বললেন, নবকুমারকেই, “লাটুর মুখে আমরা শুনেছি খানিকটা, তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“বলুন।”
“তোমার বাবা-মানে নিজের বাবার নাম কী? তিনি কোথায় থাকতেন, কী করতেন?”
নবকুমার বলল, “আমার নিজের বাবার নাম ভবনাথ রায়। বাবার মুখও আমার মনে নেই। একেবারে ছেলেবেলায়, আমার দেড় দু’বছর বয়েসে বাবা মারা যান, কেমন করে মনে থাকবে বাবাকে।… বাবা হরিপুর কোলিয়ারিতে কাজ করতেন। কম্পাসবাবু। আমার মায়ের নাম সরমা। মা আমাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়ে যান। কী করবেন, কেমন করে মানুষ করবেন ভেবে পেতেন না। মাসি–মানে মায়ের বড় বোন ছাড়া আমাদের অন্য কোনও আত্মীয় ছিল না। মাকে মাসির ওপরই নির্ভর করতে হত। শেষে মা বেচারিও অসুখে পড়লেন। কী অসুখ আমি বলতে পারব না। রক্তবমি হত মাঝে মাঝেই। বাঁচার আশা ছিল না।… তখন মাসি আর মেসোমশাই এসে আমাদের নুরপুরে তাদের কাছে নিয়ে যান।”
“তোমার মা নুরপুরেই মারা যান?”
“হ্যাঁ। বাবা মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে।”
“মাসি আর মেসোমশাই তোমাকে পালন করেন?”
“হ্যাঁ। ওঁরাই আমার মা বাবা হয়ে ওঠেন।”
“ওঁদের সন্তান–?”
“ছিল না। আমাকেই ছেলে হিসেবে পালন করেছেন।… আমি ভাল করে জ্ঞান হওয়ার পর ওঁদেরই মা বাবা হিসেবে পেয়েছি। আমরা তো রায় ছিলাম। পরে স্কুলে পড়ার সময় মশাইবাবা আমার পদবির সঙ্গে চৌধুরীও জুড়ে দেন।”
“মশাইবাবা? মানে”
“মেসোমশাইকে আমি ছোট্টবেলা থেকেই মশাইবাবা বলে ডাকতাম। মাসিকে মা-মাসি।”
“বুঝেছি। তোমার মশাইবাবার নাম যেন কী–?”
“রজনীকান্ত।”
“কৃষ্ণকান্ত আর রজনীকান্ত দুই সহোদর ভাই।”
“হ্যাঁ।”
“কৃষ্ণকান্তর সন্তান?”
“দিদি আর দাদা। দিদির কবেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জামাইবাবু ব্যবসা করে। দুর্গাপুর আসানসোল। কন্ট্রাক্টারি, দোকান, হোটেল…। দাদা কিছু করে না। ওর তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। বোকা গোছের। চোখ দুটো বড় বড়, টেরা, কথা বলার সময় তোতলায়।”