কিকিরা বললেন, “বাঁশরিলাল কোথায় থাকে?”
“নাগেরবাজার। সরকারি চাকরি। ফুড ডিপার্টমেন্ট।”
“তার সঙ্গে এর মধ্যে তোমার দেখা হয়েছে? সে এই ঘটনার কথা জানে?”
“না,”মাথা নাড়ল নবকুমার। “কেমন করে জানবে! আমি তো তারপর থেকেই লুকিয়ে আছি। এমনিতেও বাঁশরির সঙ্গে আমার রোজ দেখা হত না। মাঝে মাঝে হত। সে আসত আমার দোকানে–মানে কারখানায়। কিংবা আগে থেকে বলা থাকলে আমি তার কাছে যেতাম।”
কিকিরা বললেন, “তুমি গোড়া থেকেই কিছু ভুল করে ফেলেছ। প্রথমত, ভয় পেয়ে সেদিন সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে আসা উচিত হয়নি। আমি জানি, ভয়ে মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারায়। তুমি যে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলে, ভয় পেয়েছিলে, বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার উচিত ছিল–যদি ঘরে ঢুকে কৃষ্ণকান্তকে দেখেই মনে হয়ে থাকে তিনি মারা গিয়েছেন–তাহলে ঘরের বাইরে এসে চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করা। বাড়িতে লোক ছিল, তুমি নিজেই বলেছ। কর্মচারীদের দু’-একজনকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে আবার ঘরে ঢোকা।”
“কেন?”
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমিই বলে দাও তো কেন?”
তারাপদ বলল, “ওরা সাক্ষী থাকত।” বলে নবকুমারের দিকে তাকাল। “তুমি চোরের মতন ঘরে ঢোকোনি–” তারাপদ খেয়াল না করেই নবকুমারকে ‘তুমি’ বলে ডেকে ফেলল। নবকুমার বয়েসে ছোট বলেই বোধহয়। বলল, “ঘরে ঢোকার আগে একজন কর্মচারী তোমায় দেখেছে। কথা বলেছে। এমনকী একথাও বলেছে যে-কৃষ্ণকান্ত ভেতরের ঘরে তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।”
নবকুমার বলল, “বলেছে বইকী!”
“আর তুমি ঘরে ঢুকে দেখলে কৃষ্ণকান্ত মারা গিয়েছেন। মারা গিয়েছেন বুঝলে কেমন করে? শুধু চোখে দেখেই বুঝে নিলে! আর তুমি ঘরে ঢুকলে আর ভদ্রলোককে খুন করলে! অত তাড়াতাড়ি চোখের পলকে কাউকে গলায় কাপড় জড়িয়ে মারা যায়? এটা কি বিশ্বাস করার মতন? পাকা খুনিরাও পারবে বলে মনে হয় না। অ্যাকশান সিনেমায় এসব দেখা যায়, বাস্তবে নয়। তোমার যদি মিলিটারি কমান্ডো ট্রেনিং থাকত–তবু না হয় বলা যেত, তোমার সেই ক্ষমতা কায়দা জানা আছে। তবে তা তোমার জানা নেই।”
লাটু কিকিরার দিকে তাকাল। যেন বুঝতে চাইল, তারাপদ যা বলছে তা কি ঠিক!
কিকিরা আগেই তারাপদদের সঙ্গে ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জানেন তারাপদ যা বলেছে ঠিকই বলেছে।
“ওটাও বলো,” কিকিরা তারাপদকে বললেন।
তারাপদ বলল, নবকুমারকেও, “আর ওই যে ব্রিফকেস, সেটা যে তুমি নাওনি, মানে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে আসেনি, তার প্রমাণও থাকত। অবশ্য তুমি যদি লোক জড়ো করে আবার ঘরে ঢুকতে। যারা তোমার সঙ্গে ঘরে ঢুকত, তারা দেখত– কৃষ্ণকান্তর সামনে টেবিলে ব্রিফকেসটা রাখা রয়েছে।”
লাটু বলল, “ব্রিফকেস ও ছোঁয়নি।… ওর জেঠাকেও নয়।”
“সে তো আমরা বলছি।… ওরা যদি অন্য কথা বলে।”
“কী বলবে?”
“টাকা নিতেই নবকুমার ও বাড়ি গিয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল যেতে। ওরা যদি বলে ঘরে ঢুকে জেঠাকে দমবন্ধ করে মেরে টাকা ভরতি ব্রিফকেস উঠিয়ে নিয়ে ও চলে এসেছে– তাহলে কীভাবে প্রমাণ হবে যে, না সে টাকা নেয়নি। না নেওয়ার সাক্ষী কোথায়?… জেঠা হয়তো বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু টাকা!
এবার কিকিরা কথা বললেন। “বুঝলে লাটু, কাজটা বেশ কাঁচা হয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণকান্ত ছক কষে কুমারকে ফাঁসাবার চেষ্টা করেছেন বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। কুমার টাকা নিতে ও বাড়ি গিয়েছিল। যাওয়ার কথা ছিল। টাকা নিতে গিয়ে কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে তার বচসা হয়, রাগে ক্ষোভে বা মাথা গরম করে সে তার জেঠাকে খুন করতে যায়। তারপর টাকা নিয়ে পালিয়ে আসে।… কৃষ্ণকান্তর যদি এটা সাজানো ছক হয়, তবে আমার সন্দেহ-ব্রিফকেসে না পাওয়াই স্বাভাবিক। নিজেরাই সরিয়েছে।”
নবকুমার দু’হাতে মুখ ঢেকে যেন ফুঁপিয়ে উঠল। মাথা নাড়তে লাগল জোরে জোরে। “আমি টাকা নিইনি। ঝগড়াও করিনি। কার সঙ্গে ঝগড়া করব! জেঠা মারা গিয়েছে ভেবে ভীষণ ভয় পেয়ে আমি পালিয়ে এসেছি।”
কিকিরা কথা বললেন না।
সকলেই চুপচাপ।
নবকুমার নিজেকে সামলে নিল খানিকটা।
লাটু বলল, “রায়দা, এখন কী হবে?”
কিকিরা বললেন, “দেখা যাক কী হয়! তবে ওকে এখানে রেখো না। আমি তো বলব, কুমারের লুকিয়ে থাকাও উচিত হয়নি। সে টাকা নেয়নি, তার জেঠাকেও খুন করার চেষ্টা করেনি। তার উচিত ছিল নিজের আস্তানায় বসে থাকা, দোকানে যাওয়া, আর কোনও ঘুঘু উকিল-যারা ক্রিমিন্যাল কেসের প্র্যাকটিস করে, তার কাছে গিয়ে গোটা ব্যাপারটা খুলে বলা। কাউকে ক্রিমিন্যাল বললেই সে ক্রিমিন্যাল হয় না, অ্যাটেম্পট টু মার্ডার চার্জ আনলেই সেটা সত্যি হয়ে যায়? মামার বাড়ি!” বলে কিকিরা নিজের মাথার ওপরটা দেখালেন ডান হাতে। বললেন, “আমি একদিন মলাঙ্গা লেনের সরু গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম মাঝদুপুরে। হঠাৎ একটা দোতলা বাড়ির ছাদের কোণ থেকে একটা ইট এসে পড়ল। একেবারে পায়ের কাছে। মাত্র ফুটখানেক তফাতে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা তুলে ওপরে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। ইটটা আমার মাথায় পড়লে রক্ষে ছিল। কথা হচ্ছে, আমি যদি এটাকে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার বলে কেস ঠুকতাম, আইন কি মেনে নিত?”
লাটু মাথা নাড়ল। “না। তা কেমন করে মানবে! ওটা নিতান্তই অ্যাকসিডেন্ট। কাকতালীয়।”