“ভাইপোর সঙ্গে দেখা হল তাহলে?”
“হল। তবে একেবারে অন্যভাবে। কৃষ্ণকান্তর ঘাড় মাথা ঝুলে রয়েছে একপাশে আর্মচেয়ারে। যেন ঘাড় গুঁজে পড়ে আছেন। গলায় একটা গেরুয়া রঙের উড়নি জড়ানো। ফাঁস দেওয়ার মতন প্যাঁচানো। চোখ বন্ধ। হাত ছড়ানো। কোনও সাড়াশব্দ নেই।…কুমার বারকয়েক ডাকল। সাড়া পেল না। হঠাৎ তার ভীষণ ভয় হল। মনে হল, জেঠা মারা গিয়েছেন। গলায় উড়নির ফাঁস লাগিয়ে কেউ তাকে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলেছে। সমস্ত ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত যে, কুমার ভয় পেয়ে পালিয়ে এল।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করে সোজা হয়ে বসলেন। তারাপদরা হতবাক! লাটুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
কিকিরা অবাক গলায় বললেন, “কুমার পালিয়ে এল?”
লাটু মাথা নাড়ল। “ভয়ে।”
“অ্যাটাচিতে কি টাকা ছিল? সেটা!”
“কী ছিল কে জানে! কুমার অ্যাটাচি ছোঁয়নি। সে পালিয়ে এসেছে। অ্যাটাচি কেসটা নাকি পাওয়া যায়নি।”
“আর কৃষ্ণকান্ত? মারা গিয়েছিলেন গলায় ফাঁস লেগে?”
“না, মারা যাননি। সেটাও বিচিত্র ব্যাপার। তবে কুমার পালিয়ে আসার সময় মাত্র একজন রাজমিস্ত্রিকে দেখেছিল। তাও সে বাইরে নালা মেরামতির কাজ করছিল। দ্বিতীয় কাউকে চোখে পড়েনি।”
কিকিরা প্রথমে লাটু, পরে তারাপদদের দেখলেন। তিনিও কম বিস্মিত হননি। বললেন, “কৃষ্ণকান্ত তাহলে মারা যাননি! মানে গলায় ফাঁস লেগে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরেননি।”
“না।”
“তাহলে নট এ কেস অব মার্ডার?”
“সেভাবে খুন বা হত্যা নয়…”
“তবে?”
“অ্যাটেম্পট টু মার্ডার?”
“প্রমাণ কোথায়? কে বলেছে কুমার তার জেঠাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারতে গিয়েছিল? থানায় ডায়েরি করেছেন কৃষ্ণকান্ত বা তাঁর তরফের কেউ? পুলিশকে জানানো হয়েছে?”
মাথা নেড়ে লাটু বলল, “এখন পর্যন্ত নয় বলে জানি।”
“তাহলে?”
“কুমারের কানে গিয়েছে, কৃষ্ণকান্ত এবার তাকে জালে জড়াবেন। সে টাকার লোভে সেদিন তার জেঠাকে খুন করার চেষ্টা করছিল। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গিয়েছেন।”
কিকিরা গম্ভীরভাবে কী যেন ভাবছিলেন। চন্দনরা চাপা গলায় কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পরে কিকিরা লাটুকে বললেন, “তোমার বন্ধু কুমারের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। সে কোথায়? পালিয়ে বেড়াচ্ছে?”
লাটু বলল, দেখা হওয়ার ব্যবস্থা সে করবে, কাল বা পরশু।
.
০২.
নবকুমার ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় সে ঠিক পুরোপুরি শহুরে ছোকরা নয়। কোথায় যেন খানিকটা মফস্বলি বা গ্রাম্য ভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য ভাল, শক্ত গড়ন। হাত পায়ের হাড় বেশ খটখটে। মাথা ভরতি চুল। কোঁকড়ানো। সামান্য দাড়ি গালে। কপাল ছোট। মুখের আদল প্রায় গোল, বড় বড় চোখ, ঘন ভুরু, বসা নাক। দাঁত ঝকঝক করছে। গায়ের রং শ্যামলা। আর বয়েস বেশি হলেও পঁচিশ ছাব্বিশ বড়জোর। তারাপদদের চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটই হবে। লাটুর বন্ধু হলেও বয়েসে ছোট। লাটুকে সে লাটুদা’ বলে ডাকে।
লাটু কিকিরাদের যে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সেটা বেলগাছিয়ার খালের দিকে। আশেপাশে কাঠগোলা, ইট সুরকির আড়ত, পুরনো লোহা-লক্কড়ের গুদোম। মায় একটা কাঠ-চেরাই কল।
মাঠকোঠা ধরনের বাড়ির দোতলায় নবকুমারকে পাওয়া গেল। পেছনে খালের পাড়। মাটি, জংলা গাছগাছালির স্তূপ। খালের গন্ধ আসে হাওয়ায়।
নবকুমার একটা বারমুডা গোছের প্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে বসে ছিল।
লাটুর বোধহয় আগেই বলা ছিল, কিকিরাদের দেখে নবকুমার অবাক হল না। বরং এমনভাবে তাকিয়ে থাকল কিকিরার দিকে যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এরা কিছু করতে পারে তার জন্যে। ক্রিমিন্যাল কেস নিয়ে যারা কোর্টকাছারি মাতিয়ে দেয়–তেমন কোনও পাকা উকিলকে সামনে দেখলে হয়তো নবকুমার সামান্য আশ্বস্ত হত। কিন্তু লাটুদা তাকে বলে গিয়েছিল, আমি ঠিক লোক আনব তুই ভাবিস না।
কিকিরাও নবকুমারকে ভাল করে দেখছিলেন।
শেষে বললেন, “চলো বসা যাক ভেতরে।”
কাঠের সরু বারান্দা ঘেঁষে শেষপ্রান্তের একটা ঘরে গিয়ে বসল সবাই। ঘরে আসবাব বলতে একটা তক্তপোশ আর মাত্র একটা চেয়ার।
তক্তপোশে বিছানা পাতা ছিল। এলোমেলো হয়ে আছে চাদর বালিশ। ঘরের একপাশে মাটির কুঁজো, গ্লাস।
কিকিরা ঘরের চারপাশ দেখছিলেন। মাঠকোঠা ঘর যেমন হয়, পাকাঁপোক্ত দেওয়াল নেই, মাথার ওপর টিনের শেড। মামুলি ইলেকট্রিক লাইন। ঘর দেখতে দেখতে হঠাৎ নবকুমারকে বললেন, “তোমার জানাশোনা, বন্ধু গোছের আর কে কে আছে কলকাতায়?”।
প্রশ্নটা আচমকা। নবকুমার কেমন থতমত খেয়ে গেল। প্রথমটায় বুঝতে পারল না, কী ধরনের জবাব চাইছেন কিকিরা। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আছে; জানাশোনা তো অনেকের সঙ্গে আছে। তবে বন্ধু কম।”
“বিশ্বাসী বন্ধু?”
“বিশ্বাসী বন্ধু।…কেন! লাটুদাই তো আমার বিশ্বাসী বন্ধু।”
“আর কেউ নেই?”
নবকুমার লাটুর দিকেই তাকাল, যেন সে জানতে চাইছে কী বলবে!
“কেন?”
“পরে বলছি। তুমি লাটু ছাড়া আর কার ওপর ভরসা করতে পারো? বিশ্বাস করো পুরোপুরি?”
“বাঁশরি, বাঁশরিলাল। আমাদের দেশের লোক। আমার বন্ধু। আর ওই পালিত, রাধানাথ পালিত, দোকানের লোক আমার। পালিতদা বলি। বয়েসে বড়। খুব বিশ্বাসী।… পালিতদার কাছে এসেই ওদের লোক শাসিয়ে গিয়েছে।”
কিকিরা চেয়ারে বসলেন। তারাপদরা তক্তপোশের ওপর বসে পড়েছে আগেই, নবকুমার আর লাটু দাঁড়িয়ে।