.
২.
সন্ধেবেলায় ফোন। তারাপদদের সঙ্গে গল্পগুজব হাসি-তামাশা করছিলেন কিকিরা। এমন সময়ে ফোন।
কিকিরা মনে মনে আন্দাজ করে নিলেন কার ফোন হতে পারে। “হ্যালো?”
“রায়কাকা? আমি জহর।”
“হ্যাঁ, রায় বলছি। তোমার কথাই ভাবছিলাম। পাতকীর সঙ্গে দেখা হয়েছে?”
“আমি একটু বেরিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি পতাকীদা দোকানে বসে আছে। শুকনো মুখ, হাতে পায়ে তাপ্পি লাগানো। কাঁপছে। জ্বর এসে গিয়েছে যেন।”
“শুনলে সব?”
“শুনলাম। আপনার লেখা কাগজের টুকরোটাও পেলাম।”
“পাতকী আছে, না, চলে গিয়েছে?”
“চলে গেল খানিকটা আগে। আমিই বললাম, তুমি এভাবে তখন থেকে বসে আছ! যাও, বাড়ি যাও।”
“ভালই করেছ! ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। বেচারি পড়েছেও বিশ্রীভাবে। আর একটু বেকায়দায় পড়লে ট্রামের চাকার তলায় চলে যেতে পারত। ভাগ্য ভাল; অল্পের ওপর দিয়ে গিয়েছে।”
“আপনি সব দেখেছেন?”
“দেখেছি। …মানে চোখে পড়ে গিয়েছে হঠাৎ। এই সময় আমি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।”
জহর একটু চুপ করে থেকে বলল, “কী হল বলুন তো? পকেটমারের কেস? ছিনতাই? পতাকীদার কথা শুনে মনে হচ্ছে–” জহর কথাটা শেষ করল না।
“কী হল আমি কেমন করে বলব! তুমিই বলতে পারো। পাঁজাবাবুর বাড়ি থেকে পাতকী কী এমন আনতে গিয়েছিল যে–”
কিকিরাকে কথা শেষ করতে দিল না জহর। বলল, “ফোনে অত কথা বলা যাবে না রায়কাকা। আমি নিজেই বোকা হয়ে গিয়েছি। আপনি কাল সকালে বাড়ি আছেন?”
“কোথায় আর যাব। বাড়িতেই আছি।”
“তা হলে কাল আমি যাচ্ছি। দেখা হলে সব বলব।”
“চলে এসো।”
“তা হলে ফোন রাখছি। কাল দেখা হবে।”
কিকিরাও ফোন নামিয়ে রাখলেন। তারাপদরা কিকিরার কথা শুনছিল। অনুমান করছিল, কিছু একটা ঘটেছে। কী, তা তারা জানে না। কিকিরা বলেননি।
“কী কেস, সার? আপনি তো কিছু বলেননি আমাদের?” চন্দন বলল। বলে তারাপদকৈ আড়চোখে কীসের যেন ইশারা করল।
তারাপদ বলল, “আপনি আজকাল হাইডিং করছেন, কিকিরা। ভেরি ব্যাড।”
কিকিরা বললেন, “হাইডিং নয় হে, ওয়েটিং। দেখছিলাম,
ব্যাপারটা তুচ্ছ, না, পুচ্ছ।”
“কার সঙ্গে টক করছিলেন?”
“জহর। হালদার স্টুডিয়ো, মানে ফোটোগ্রাফির দোকানের একটি ছেলে। মালিক। আমাকে কাকা বলে। ওর বাবাকে আমরা দাদা বলতাম।”
“মোদ্দা ব্যাপারটা কী?”
“আজকের ঘটনাটা বলতে পারি শুধু। বাকিটা আমি জানি না। কাল জহর আসার পর জানতে পারব মোটামুটি।”
“আজকেরটা শুনি।”
কিকিরা দুপুরের ঘটনা বর্ণনা করলেন সবিস্তারে।
তারাপদরা মন দিয়ে শুনছিল।
কিকিরার বলা শেষ হলে তারাপদ উপেক্ষার গলায় বলল, “এটা আবার কোনও কেস নাকি সার! আপনি আমি চাঁদু সবাই জানি চাঁদনিচক একটা বাজে জায়গা। জ্যোতি সিনেমার চারদিকে পিকপকেট-অলাদের রাজত্ব। ওটা ওদের এলাকা। একবার পকেট কাটতে পারলে এ-গলি ও-গলি, মায় চাঁদনির ওই বাজারে ঢুকে পড়তে পারলে কার বাবার সাধ্য ওরকম গোলকধাঁধার মধ্যে তাকে খুঁজে বার করে। অসম্ভব।… আপনি যাই বলুন, এটা সিম্পল পিকপকেট কেস! তিলকে তাল করার কোনও দরকার নেই।”
কিকিরা মাথা দোলাবার ভঙ্গি করে বললেন, “আমারও প্রথমে সেরকম মনে হচ্ছিল। কিন্তু জহরের ফোন পাওয়ার পর খটকা লাগছে।”
“কেন?”
“মামুলি পকেটমারের ব্যাপার হলে ও বলেই দিত, চোর ছ্যাঁচড়ের ব্যাপার, পাতকী নিজের বোকামির জন্যে ব্যাগ খুইয়েছে। তা তো বলল না, বরং কাল দেখা করতে আসবে বলল।”
চন্দন কী যেন ভাবছিল। বলল, “আপনি পতাকীনা পাতকীকে কতদিন চেনেন?”
“তা অনেকদিন। কেন?”
“নোকটা চালাক, না বোকা?”
“চালাক-চতুর বলে জানি না। তবে নিরীহ। খানিকটা কাছাখোলা ধরনের। তুমি এসব কথা বলছ কেন?”
“ওই জহর না কী নাম বললেন, তাকেও চেনেন অনেকদিন, তাই?”
“চিনি। ওর বাবাকেই বেশি চিনতাম।”
“আপনার কাছে নানারকমের লোক আসে। পুরনো আলাপী লোককেও আসতে দেখেছি। কই জহর বলে কাউকে তো দেখিনি কোনওদিন।”
কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “তোমরা দেখোনি তাতে কী হয়েছে গো। আমার বয়েসটা কত হল খেয়াল করেছ! বুড়ো গাছের অনেক ডালপালা। তা সে যাকগে।… তুমি তারাবাবু যা বলতে চাইছ, আমি নিজেও ভাবছিলাম সেরকম। পাতকীর ব্যাগ হাতিয়ে পালানোর ব্যাপারটা নেহাতই চোর-পকেটমারের কাণ্ড। বোকা হাবাগোবা মানুষকে হাতের কাছে পেয়েছে, সুযোগ ছাড়েনি।”
“তা ছাড়া আবার কী!” তারাপদ বলল, “এ সেরেফ পাতি পকেটমারের কাণ্ড। একটা কথা, সার। লোকটা জেনেশুনে আপনার পাতকীর ব্যাগ ছিনতাই করেছে-হতেই পারে না। সে জানবে কেমন করে কী আছে ব্যাগে? টাকা-পয়সা থাকা স্বাভাবিক, তা পঞ্চাশ একশোই হোক বা কম-বেশি!”
“তোমার যুক্তি ঠিক। আমি আগেও বলেছি। কিন্তু জহরের ফোন পেয়ে মনে হচ্ছে, একটা গণ্ডগোল রয়েছে কোথাও!”
“কেন?”
“নয়তো জহর ফোনে ওভাবে কথা বলত না। বলত, পতাকীদার পকেটমার হয়েছে তো হয়েছে। অমন হয়, পতাকীদা অকারণ ভাবছে, এটা তার গাফিলতি। বারবার আপনাকে ফোন করে সাক্ষী মানতে বলছে। বোঝাতে চাইছে তার কোনও দোষ নেই।” কিকিরা পকেট হাতড়াতে লাগলেন, বোধ হয় নেশা খুঁজছিলেন। বললেন, “কিন্তু এখন দেখছি, ব্যাপারটা অত তরলং নয়।”
“তরলং মানে?”
“মানে জলবৎ তরলং নয় বোধ হয়। গোলমাল একটা আছে নিশ্চয়।”
“তরলং নয়। জটিলং..” চন্দন হাসল।
“ধরে নিচ্ছি। নয়তো জহর নিজে কেন কাল এসে দেখা করতে চাইছে! একটু খোঁচা থাকবে না হে!”