বগলা এসে চা দিয়ে গেল। কিকিরা নিয়ম করেছেন, এখন থেকে যেহেতু গরম পড়ে যাচ্ছে, গরমের বদলে ঠাণ্ডা চা খাওয়া হবে। মানে হালকা চা, দুধ থাকবে না, চিনি সামান্য, আর চায়ের মধ্যে এক টুকরো বরফ। অবশ্য বাজারের বরফ নয়, ফ্রিজের বরফ।
চা খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “জহর বলল, কাজ হয়নি,” বলে না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন।
তারাপদ বলল, “আপনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন।”
“মানে?”
“পরের চরকায় তেল দিচ্ছেন। পাঁজামশাইয়ের ঠিকুজি কোষ্ঠী জানতে আপনাকে কেউ লাগায়নি। জহরও বলেনি। আপনি নিজে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন। তাও যদি দু পয়সা আসত! কী লাভ, সার?”
কিকিরা বিরক্ত হলেন বোধ হয়। রাগ না করেই বললেন, “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।…আসলে কী জানো, এ হল অভ্যেস। এক রকম খেলাও বলতে পারো–চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। …তা সে যাই হোক, ওই পতাকীকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। বেচারি মানুষ। ভাল মানুষ। নিজের চোখে আমি দেখলাম লোকটা ট্রাম লাইনে কাটা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। পরে শুনলাম, ওটা নিছক অ্যাকসিডেন্ট নয়। তাই একটু খোঁজখবর করে দেখছি। টাকা কামানো আমার উদ্দেশ্য নয়, তারা।”
.
৭.
জহর কিকিরাকে দেখছিল।
কিকিরা শেষপর্যন্ত মাথা নাড়লেন। হতাশ গলায় বললেন, “না, এই প্রিন্ট থেকে কিছুই বোঝা যায় না। সত্যিই ভুতুড়ে।” বলে প্রিন্টটা তারাপদর হাতে দিলেন।
জহর তার সাধ্যমতো যতটা করা যায় করেছে। বিনয়বাবুর দেওয়া পুরনো নেগেটিভ থেকে, নয় নয় করেও তিনটে প্রিন্ট। সবই সমান। একপাশে কালো একটা ছোপ, যেন ঘন ছায়ার পরদা, বাকিটা সাদাটে বা ঈষৎ বাদামি ধোঁয়া ধোঁয়ার আকারটাও কেমন যেন কুণ্ডলী পাকানো।
তারাপদ আর চন্দনও দেখেছে প্রিন্টগুলো। কিছুই ধরতে পারেনি।
চন্দন বলল, “আনাড়ি কেউ শাটার টিপেছিল ক্যামেরার। না হয় কোনও সোর্স থেকে আলো ঢুকে ফিল্ম নষ্ট করে দিয়েছে।” চন্দন ফোটো তুলতে পারে। শখের ফোটোগ্রাফার।
তারাপদ বলল, কিকিরাকেই, ঠাট্টার গলায়, “যাই বলুন সার, ওই প্রিন্টটাকে, মৃতজনের আত্মা বলে চালানো যায়। স্পিরিট আর কী!”
কিকিরা কথাটা শুনলেন। কিছু বললেন না ওকে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কিকিরা বললেন, “জহর, আমাদের একবার পাঁজাবাবুর বাড়িতে যাওয়া দরকার। মানে, যেতে পারলে ভাল হত৷ ওঁর দর্শন পাওয়ার একটা ব্যবস্থা…”
কথার মাঝখানে জহর বলল, “ব্যবস্থা মানে আপনি আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ। আমরা সবাই যেতে চাই।”
কী যেন ভাবল জহর, বলল, “কীভাবে যাব? হঠাৎ একটা দল করে এত অচেনা লোক ওঁর কাছে গেলে…”
“অসন্তুষ্ট হবেন? কিছু মনে করবেন?” কিকিরা বললেন, “সেটা স্বাভাবিক। তবে তুমি ভেবো না। আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমি কাঁচা কাজ করব না।”
জহর সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “কবে যাবেন?”
“ক-বে! …কাল হবে না। কাল যদি ছকু আসে, ওর দ্বারা কতটা কী হল জেনে নিই। পরশু বা তার পরের দিন হতে পারে।”
জহর আপত্তি করল না।
কিকিরা হঠাৎ পতাকীকে ডাকলেন। পতাকী দোকানেই ছিল।
“পতাকী, তোমার হাতে সে ব্যাগটা ছিল–ঠিক ওইরকম, অন্তত ওর মতন একটা ব্যাগ কাল কিনে রাখবে। চাঁদনিতেই পাবে। নিউ সিনেমার উলটো দিকে ফুটপাথে। মনে রেখো ব্যাগটা যেন তোমার ব্যাগের মতন হয়। রং একই রকম।” বলে কিকিরা পকেট থেকে টাকা বার করে পতাকীর হাতে দিলেন।
জহর প্রথমটায় বোঝেনি, পরে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আপনি টাকা দিচ্ছেন কেন, কাকা! আমি দিচ্ছি।”
“আরে রাখো! কটাই বা টাকা!”
“আমার বড় খারাপ লাগছে কাকা। আমার জন্যে—”
“তোমার খারাপ লাগার কোনও কারণ নেই জহর। আমি নিজেই যখন নাক গলাচ্ছি, তখন তোমার খারাপ লাগবে কেন! …ও কথা থাক, তুমি ওই ভুতুড়ে প্রিন্টগুলোর একটা আমাকে দেবে। পাঁজাবাবুকে অন্য দুটো। কিন্তু তাঁকে বলবে না যে, আমায় দিয়েছ! বুঝলে!”
জহর মাথা নাড়ল। কিকিরার কথামতনই কাজ হবে।
চেয়ার সরিয়ে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আমরা চলি আজ। চলো তারাপদ। কলকাতা ঠনঠনিয়া বীরভূম হরিদ্বার মায়ের অন্তর্ধান ভূমিকম্প ধস নামা–ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। দেখি কত জট পাকিয়েছে, কেনই বা।”
বাইরে এসে তারাপদ বলল, “সার, আপনার পাগলামির মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারি না। হুট করে আপনি পাঁজাবাবুর বাড়ি যাবেন কেন? উনি আপনাকে ডাকেননি। কী করবেন আপনি ভুতুড়ে ওই প্রিন্ট নিয়ে! লাইফ আফটার ডেথ বইটইয়ে এরকম ছবি দেখা যায়। মৃতজনের আত্মা টাইপ। এদিকে আবার একটা ব্যাগ কিনতে বললেন পতাকীকে! সবই আপনার অদ্ভুত!”
কিকিরা হাসলেন, “শোনো তারাবাবু, ভাগ্য প্রসন্ন করার জন্যে জ্যোতিষীরা নানান রত্ন ধারণ করতে বলে। তাতে কী হয় জানি না। আমি বলি, বেস্ট রত্ন হল ধৈর্য। ওটাই ধারণ করা। মহাভারত পড়েছ? পাণ্ডবরা কতদিন ধৈর্য ধারণ করে বসে ছিল বলো তো?”
তারাপদ তামাশার গলা করে বলল, “সার কি আজকাল নতুন করে মহাভারত পড়ছেন?”
“তা মাঝে-মাঝে পড়ি৷ কেন, পড়লে আপত্তি কীসের!”
তারাপদ আর কিছু বলল না।
.
বাড়ি ফিরে কিকিরা দেখলেন, ছকু আর চন্দন দিব্যি গল্প করছে। বসার ঘরে বসে। হাসাহাসি হচ্ছিল। চন্দনের গলার জোরই বেশি। বোঝা যায়, ছকুই বক্তা, চন্দন শ্রোতা।
তারাপদ সঙ্গেই ছিল কিকিরার। এখনও রাত হয়নি। আটটাও নয়।