বগলা জল নিয়ে এল।
জল খেয়ে চন্দন বলল, “ইন ফ্যাক্ট, ডুমুরগ্রাম-পাঁজাবাবুর মামার বাড়ি বেশ বিখ্যাত। মামাদের একসময় জমিদারি-টমিদারি ছিল। তবে জমিদারদের এখন আর দাপট কোথায়! ওই লুকিয়েচুরিয়ে বেনামা করে যা রাখতে পেরেছে তাতেই পেট চলে। অবশ্য পাঁজাবাবুর মামার বাড়ির অতটা দীনদশা হয়নি। দু মহলা ভাঙা বাড়িটা আছে। দু’ মহলা হলেও বাড়ি বিশাল। কাছারি, দেউড়ি, ঠাকুর দালান সবই আছে। আছে মদনমোহনের মন্দির। দেবোত্তরের আয় থেকে বছরের দুর্গাপুজোটাও হয় এখনও…”
“কে থাকে ওখানে?”
“কেউ নয়। জনাদুই কর্মচারী আর একজোড়া বাস্তু সাপ। চন্দন হাসল। “বারোয়ারি লোকজনও ঢুকে পড়ে।”
কিকিরা যেন চোখ বুজে অনুমান করার চেষ্টা করলেন ডুমুরগ্রামের জমিদার বাড়িটা।
“চাঁদু, আমাদের বুঝতে একটু গোলমাল হচ্ছিল। একেবারে সঠিক করে বলতে গেলে বলতে হয়, বিনয়বাবুর পৈতৃক বাড়ি কলকাতায়, ঠনঠনিয়ার দিকে যেখানে এখন তিনি আছেন। এটা তাঁর নিজস্ব। আর ওই বীরভূমের বাড়ি এটা-ওটা যা রয়েছে সব তার মামার বাড়ির। ভদ্রলোকের কপালে ছিল তাই মামার বাড়ির প্রপাটি–যাই হোক না কেন–ইনহেরিট করেছেন। ঠিক তো!”
“পুরোপুরি ঠিক।”
“প্রশ্ন হচ্ছে, বিনয়বাবুর মামার বংশে এমন কেউ কি ছিল না যে-লোক সম্পত্তির ভাগীদার হতে পারে? অন্তত পার্টলি? ..কী বলে তোমার কলিগ?”
চন্দন বলল, “সার, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কথাটা। সজল বলল, আর-একজন ছিল। তবে তার থাকা না-থাকা সমান।”
কিকিরা কৌতূহল বোধ করলেন। বললেন, “কে?”
“ও-বাড়ির একটি ছেলে। বিনয়বাবুর মাসতুতো ভাই! ঘটনা হল, বিনয়বাবুর মায়েরা দু’বোন। ভাই নেই। বিনয়বাবুর মা-বোনদের মধ্যে বড়। ছোট বোন বয়েসে খানিকটা ছোট তো বটেই, কপালটাও খারাপ। কম বয়েসে বিধবা হন। মায়ের কাছেই অবশ্য থাকতেন। একটি ছেলে ছিল। তা একদিন ছেলেটির দিদিমা আর মা দুই-ইচলে গেলেন। ছেলেটা খেপাটে গোছের। ঘরবাড়ির সঙ্গে আলগা। সম্পর্ক। সাধুসন্ন্যাসী শ্মশান-মশান করে বেড়াত। শেষে বিশ-বাইশ বছর বয়েসেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। পরে শোনা গেল সে কোনও তান্ত্রিকের দলে গিয়ে ভিড়েছে।”
অবাক হয়ে কিকিরা বললেন, “সে কী! জমিদার বাড়ির ছেলে তান্ত্রিক।”
“চমকে যাচ্ছেন সার! চমকাবার কিছু নেই। সজল বলে, বীরভূমের রক্তে নাকি দুটো জিনিসেরই টান আছে। একদিকে বৈষ্ণব, অন্যদিকে তন্ত্র। একদল বাজায় একতারা,অন্যদল শ্মশানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।”
কিকিরার কৌতূহল ততক্ষণে তীব্র হয়েছে। বললেন, “একদিকে জয়দেব, অন্যদিকে বামাক্ষ্যাপা! তা পাঁজাবাবুর মাতুলবংশ কি…”
“ঘোরতর বৈষ্ণব।”
“বৈষ্ণববংশের ছেলে হয়ে গেল তান্ত্রিক।”
“সজল তো তাই বলে।”
“চাঁদু, এ তো দেখছি সেই ভক্তকুলে দৈত্য।”
তারাপদর গলা পাওয়া গেল। বগলার সঙ্গে কথা বলছে। কিকিরা বললেন, “চাঁদু, সেই তান্ত্রিকের আর খবর পাওয়া যায়নি। পরে কখনও বাড়িঘর ভিটেতে দেখা যায়নি তাকে?”
“না,” চন্দন বলল। বলে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। বলল, “সার, একটা কথা মনে রাখবেন। সজল ওই পাঁজাবাবুর মামার বাড়ির গ্রামের মানুষ নয়, তাদের বাড়ি নলহাটির দিকে। সে যা শুনেছে এ-মুখ সে-মুখে– তাই বলেছে। কোনটা কতদূর সত্যি, কোনটা লোকমুখে বানানো– তা সে জানে না।”
কিকিরা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “চাঁদু, আমার বুদ্ধিতে বলে, সামান্য ধোঁয়া দেখলেও অনুমান করতে হবে আগুন অল্পস্বল্প আছে কাছাকাছি; এখানে একটু ধোঁয়া দেখছি, কিন্তু আগুন…?”
তারাপদ ঘরে এল। শেষ কথাটা তাঁর কানে গিয়েছে। বলল, “কীসের ধোঁয়া সার?”
“ধুনির,” কিকিরা হালকা স্বরে বললেন।
“ধুনি! কার ধুনি? কোথায়?” বলে তারাপদ চন্দনের দিকে তাকাল। তাকিয়ে নিজের মাথা দেখাল। “অফিস থেকে বেরিয়ে ও-পাড়ার মডার্ন হেয়ার কাটিংয়ে একটা হেয়ার কাট দিলুম। শ্যাম্পুও করিয়ে নিলুম। কেমন হয়েছে রে?”
চন্দন গম্ভীর মুখে বলল, “কুমারটুলির কার্তিক!”
“যাঃ!” তারাপদ যেন খুশি হল না, মুখের ভাবে হতাশ হওয়ার ভান করে বলল, “তোর চোখ বলে কিছু নেই। দারুণ হেঁটেছে।”
“তো হেঁটেছে। বোস।”
বসল তারাপদ। মাথার চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ। সাবধানে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে গন্ধটা শুকল। কীসের ধুনি, সার? কার কথা বলছিলেন?” কিকিরার দিকে তাকাল তারাপদ।
কিকিরা বললেন, “চাঁদুকে জিজ্ঞেস করো।…তুমি শোনো, আমি একটা ফোন সেরে নিচ্ছি।”
চন্দন ডুমুরগ্রামের বৃত্তান্ত শোনাতে লাগল তারাপদকে।
কিকিরা হালদার স্টুডিয়োতে ফোন করলেন। বার দুই বৃথা চেষ্টা। কথা চলছিল ওপাশে। তিনবারের বার পেলেন।
“জহর! রায়কাকা বলছি। পতাকী আসছে?”
ওপার থেকে সাড়া এল। “এসেছে। ভালই আছে।”
“গুড। …ইয়ে তোমার সেই নেগেটিভের কী হল? পাঁজামশাই পরে যেটা দিয়েছিলেন?”
“ও কিছু হবে না। নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
“চেষ্টা করেছিলে?”
“চেষ্টা করেও হল না। একটা কালচে দাগ আর বাদবাকি একেবারে ধোঁয়া। দেখলে মনে হবে ভুতুড়ে…”
“ও! বিনয়বাবুকে জানিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“কী বললেন?”
“কী আর বলবেন! বললেন, জানতাম।”
“অল্পক্ষণ চুপচাপ। তারপর কিকিরা বললেন, “কাল তোমার সঙ্গে দেখা হবে। আমি যাব।”
ফোন রেখে দিয়ে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। চন্দন আর তারাপদদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল না আর। যা বলার বলা হয়ে গিয়েছে চন্দনের।