পাঁজাবাবুর পরিবারের একজন সেই দুর্যোগে চিরকালের মতন হারিয়ে গেলেন। পাঁজাবাবুর বৃদ্ধা মা। বৃদ্ধা হলেও একেবারে অক্ষম বা পঙ্গু নন।
কোথায় হারালেন?
সম্ভবত দিকদিশা পথ ঠিক করতে না পেরে ওই বৃষ্টি আর অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়ি সরু পথের কিনারা থেকে গড়িয়ে পড়েছিলেন নীচে। গভীর কোনও খাদে। সেখান থেকে কাউকে উদ্ধার করা অসম্ভব। ঘন গাছপালায় পাথরে মাটিতে অন্ধকার একেবারে। কোন অতলে নেমে গিয়েছে সেই খাদ কে জানে। তার ওপর ধস নেমেছিল কোথাও কোথাও। বৃষ্টি তো ছিলই।
যাই হোক, পরের দিন বিকেলে আবহাওয়া খানিকটা ভাল হলেও ওঁর খোঁজ করা সম্ভব হয়নি। তার পরের দিন উন্নতি হল আবহাওয়ার। বৃদ্ধার খোঁজ করা হল। পাওয়া যায়নি। সকলেরই ধারণা হল, উনি মারা গিয়েছেন, দেহটা কোথায় চাপা পড়ে আছে জানা সম্ভব নয়।
ঘটনাটা ঠিক পাঁচ বছর আগেকার।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এই সময়ের প্রায় বছরখানেক আগে বিনয় পাঁজা জহরকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে বৃদ্ধার ফোটোটি তুলিয়েছিলেন। উনি কী করে জানবেন, জানা সম্ভব যে, বছরখানেকের মধ্যে এই পরিণতি হবে মায়ের।
.
কিকিরা যেন একটা বিদঘুঁটে অঙ্ক নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন; কোন পথে যাবেন বুঝতে পারছেন না, নিজের ওপরেই অপ্রসন্ন হয়ে উঠছিলেন, এমন সময় ছকু এসে হাজির। গুরুজির তলব, না এসে সে থাকতে পারে!
ছকু এসে যথারীতি গড় হয়ে কিকিরার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল, তারপর হাতকয়েক তফাতে মাটিতে বসল। গুরুজির সামনে কোনওদিনই সে উঁচু জায়গায় বসে না।
“তোমায় আরও আগে খবর দিলে হত।” কিকিরা বললেন, “মাথায় এসেছিল একবার, কিন্তু ভাবলাম আগে থেকে খবর না দিয়ে এদিকের ব্যাপারটা বুঝে নিই আগে।”
“খবর ভেজলেই চলে আসতাম,”ছকু বলল। “কোই কাম আছে, গুরুজি?”
“আছে। আগে বলল তোমার বাড়ির সব ভাল?”
“বালবাচ্চা ভাল। বহুকে ঘোড়া ম্যালারু ধরেছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।”
কিকিরা হাসলেন। পরে বললেন, “ছকু, তুমি তো বড় ওস্তাদ ছিলে৷ এদিকেই আগে তোমার কারবার ছিল। এখন পাড়া পালটেছ, পেশাও পালটে ফেলেছ অনেকদিন।”
ছকু যেন লজ্জার মুখ করে হাসল।
“আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারো? ধর্মতলার লাইনে তোমার পুরনো চেলা কে কে আছে এখনও?”
ছকু একসময়ে পকেটমারদের মাস্টার ছিল। ভাল ট্রেনার। হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছে। তখন সে মাস্টার ওস্তাদ। এখন সে অন্য পাড়ায় লন্ড্রির দোকান দিয়েছে। মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প টেলারিং। এখনও তার চেলা আছে। তারা মাস্টার বলে ডাকে ছকুকে। ছকু নিজে পকেটমারের মতন ইতর কর্ম নিজে করে না। তবে চেলাদের ছোটখাটো টিপস দিতে আপত্তি কীসের!
ছকু বলল, “আছে। কেন গুরুজি?”
“আমার একটা কাজ করতে হবে।”
“হুকুম করুন।”
“একটা লোকের খোঁজ দিতে পারবে?”
“ক্যায়সা লোক?”
কিকিরা সেদিনের ঘটনার কথা বললেন। যে-লোকটা পতাকীর ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে গলির মধ্যে পালিয়ে গিয়েছিল তার একটা বর্ণনাও দিলেন যতটা পারেন। আচমকা ঘটনা; মন দিয়ে নিখুঁতভাবে সব দেখার মতন অবস্থা তখন নয়, তবু, যতটা পেরেছেন দেখেছেন কিকিরা। ছোকরার গায়ে ছিল চাকার মতন গোল গোল লাল-সাদা, ছাপ তোলা গেঞ্জি, ঘোড়ার মাঠের জকিদের মতন অনেকটা। মাথার চুলের সামনেটা সাপের মতন ফণা তোলা। লম্বা জুলফি।
ছকু সব শুনল। ভাবল কিছুক্ষণ। পরে বলল, “লাইনে নয়া নয়া ছোকরা চলে আসছে গুরুজি। আপনি যার কথা বললেন, আমি ওকে চিনি না। নয়া ছোকরা হবে। তো আমার পুরানা দোস্তরা আছে এখানে, পাত্তা নিয়ে নেব।”
কিকিরা বললেন, “ছকু, আমি জানতে চাই, যে-লোকটা রাস্তা থেকে ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে পালাল, সে সত্যিই ওই এলাকার পকেটমার, না, অন্য মতলব ছিল তার।”
ছকু বুঝতে পারল। আসলে লোকটা মামুলি পকেটমার, না, তাকে কেউ ওই কাজের জন্যে ভাড়া খাটাচ্ছিল–জেনে নিতে চান গুরুজি।
কাজটা সহজ। ছকু জেনে নেবে। কলকাতা শহরের প্রত্যেকটি এলাকায় সেখানকার পকেটমারদের ঘাঁটি থাকে। ঘাঁটির বাদশাও থাকে–মানে লিডার, কর্তা। তার হুকুম না মানার মতন বুকের পাটা কারও হয় না।
“তুমি তাড়াতাড়ি খবর নিয়ে আমায় জানাবে।”
ছকু মাথা নাড়ল। হয়ে যাবে কাজ।
আরও খানিকটা বসে চা খেয়ে ছকু চলে গেল।
.
বিকেলে চন্দন এল।
“তারা আসেনি?”
“এখনও নয়। আসবে।” চন্দন রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “কী গরম পড়ে গেল, সার! চৈত্র মাস কি শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে টেম্পারেচার…”
“জল খাও।” বলেই হাঁক দিলেন কিকিরা, বগলাকেই।
চন্দন একবার পাখাটার দিকে তাকাল। জোরেই চলছে। নিজের জায়গাটিতে বসতে বসতে চন্দন বলল, “আপনাকে বলেছিলাম না, হাসপাতালে আমার এক কলিগ রয়েছে বীরভূমে বাড়ি। সজল নাগ।”
“নাগ…! হ্যাঁ, বলেছিলে।”
“আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিনয় পাঁজাকে চেনো কি?”
“নাগ কি পাঁজামশাইয়ের দেশের লোক! বীরভূম তো একটা জেলা। পাজামশাইদের জমিদারির চৌহদ্দি ছিল কোন দিকটায়?”
“দিকটিক জানি না, সার। বীরভুম আমার ডিস্ট্রিক্ট নয়,” চন্দন বলল। “সজল বীরভূম জেলার ছেলে। নলহাটির দিকে তার বাড়ি। সে বলল, পাঁজাদের সে চেনে না। তবে নাম শুনেছে। ডুমুরগ্রাম বলে একটা জায়গা আছে ওদিকে। পাঁজারা সেখানকার লোক। মানে পাঁজার মামার বাড়ি ওখানে। চৌধুরীবাড়ি।”