তারাপদ আঁতকে উঠে বলল, “ছ’-সাত লাখ?”
“কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট হলে হতেই পারে। তার ওপর ওই জমিতে একটা ছোট সিনেমা হল তৈরি করেছিলেন ওই ভদ্রলোক– যিনি টাকা ধার দেন। বছর কয়েক হল– সিনেমা বন্ধ। চলছে না।”
“কেন?”
“জানি না। …ওসব থার্ডক্লাস হল আর চলে না বলেই বোধ হয়।”
“এ ছাড়া!”
“বরানগরের দিকে একটা বাজার ছিল। লিজ দিয়েছিলেন। সেটাও হাতছাড়া হয়েছে।
“আর?”
“আরও ছিল। চিৎপুরের দিকে একটা বাড়ি ছিল। বারো ভাড়াটের বাস। তারা ভাড়া তো দেয়ই না, বাড়ির মালিকানাও মানতে চায় না। কোর্ট দেখিয়ে দেয়।”
“আশ্চর্য!”
“ধুস, এতে আবার আশ্চর্য হওয়ার কী আছে! কলকাতা শহরের কত পুরনো বাড়ির এই হাল- তোমরা তার খোঁজ পাবে কেমন করে!”
কিকিরা চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। পরে বললেন, “শুনেছি, বীরভূমের দিকে পাঁজামশাইয়ের মাতুল বংশ। ওদিকেও ফাঁকা। সেখানে জমি জায়গা বাগান পুকুর..”
“জানি না কিঙ্কর। আমার কাছে তেমন খবর নেই। বীরভূমের দিকে মায়ের বাপের বাড়ি ছিল শুনেছি। তবে জমিজমা বাগান সত্যি কতটা ছিল– আর থাকলেও শেষ পর্যন্ত মায়ের বাপের বাড়ির সম্পত্তি ওঁর হাতে এসেছিল কি না, বলতে পারব না। খোঁজ করার উপায় আমার নেই।” বলতে বলতে পানু মল্লিক আয়াস করে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। “কালী, এদের চা কী হল? বাড়ির মধ্যে বলেছ?”
কালী বলল, বলে এসেছে।
“কিঙ্কর?”
“বলুন পানুদা?”
“ব্যাপারটা কী হে? তুমি হঠাৎ পাঁজা নিয়ে পড়লে কেন?.. ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় নেই, তবে দেখেছি। লোকটিকে। প্রায় বুড়ো, ষাট-বাষট্টি তো হবেই। বনেদি চেহারা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন। মাথার চুল বারো আনাই সাদা। পথেঘাটে বড় একটা চোখেই পড়ে না। শুনেছি নিজের ওই বাড়ি ছেড়ে বেরোন না একরকম। ওঁর আপাতত কোনও সংসারও নেই। মেয়ে-জামাই বিদেশে।”
কিকিরা মন দিয়ে পানুবাবুর কথা শুনছিলেন। যত শুনছিলেন ততই যেন ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছিলেন।
কাঠের ট্রে করে চা নিয়ে এল একটি ছোকরা।
“নাও চা খাও,” পানুবাবু বললেন। “ব্যাপারটা কী আমায় একটু বলবে?”
কিকিরা মাথা হেলালেন। চায়ের কাপ তুলে নিলেন টেবিল থেকে, তারপর সংক্ষেপে বললেন ঘটনাটা।
পানু শুনলেন। ভাল উকিলের চোখ কান যেন অনেক বেশি সতর্ক ও তীক্ষ্ণ হয়। বিশেষ করে ক্রিমিন্যাল প্র্যাকটিস নিয়ে যাদের দিন কাটে মাসের পর মাস।
কিকিরা চুপ করলেন। চন্দন আর তারাপদ কোনও কথাই বলেনি। তারা নেহাতই যেন সঙ্গী। মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিল, ওদের উদাসীন ভাব দেখে, বিষয়টা নিয়ে কিকিরার যত উৎসাহই থাক তাদের বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই।
পানু মল্লিক একটা অদ্ভুত শব্দ করলেন। তারপর বললেন, “কিঙ্কর, যত চোর গুণ্ডা বাটপাড় খুনে নিয়ে আমার দিন কাটে। এক্সপিরিয়ান্স কী কম হল! দেখলাম অনেক। হাই লেভেল লো লেভেন— কোথায় ক্রিমিন্যাল নেই! এভরি হোয়ার। পেশাদারি ভাবে কথার প্যাঁচে, অনেককে বাঁচিয়েছি, অনেকের জন্যে সরকারি খানাদানার ব্যবস্থা করেছি দু’-চার বছরের জন্যে। …তা সে কথা থাক। আসল কথাটা কী জানো ভায়া, ক্রিমিন্যালরা দু’-ক্লাসের হয়। মেইনলি। একটার কাজকর্ম হয় অনেকটা সরল গতির। এরা মুখ, টেম্পারামেন্টাল, গবেট। আর-এক ক্লাসের ক্রিমিন্যাল দেখেছি, তারা যত চতুর ততই জটিল। এদের হল বক্ৰগতি। ধরাই যায় না, বেটারা সত্যিই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, না, এক-একটা ভয়ঙ্কর শয়তান।…আমি পাঁজামশাই সম্পর্কে আগে থেকে কোনও কমেন্ট করব না। কিন্তু তুমি যদি ওঁকে নজরে রাখো হয়তো সত্যি-মিথ্যে অনেক কিছু জানতে পারবে।…আর শোনো, আমি ভদ্রলোক সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করব। জানাব তোমায়।”
কিকিরা উঠে পড়লেন। “চলি পানুদা। আপনি যা বলেছেন আমি তার সঙ্গে একমত।”
চন্দনরাও উঠে পড়ল।
রাস্তায় এসে চন্দন হঠাৎ বলল, “কিকিরা আমাদের হাসপাতালে বীরভূমের একটি ছেলে আছে। আমার কলিগ। বীরভূমের খোঁজ আমি নেব।”
.
৬.
দুটো দিন কেটে গেল। কিকিরা আশা করেছিলেন, জহরের টেবিলে যে যন্ত্রটি রেখে এসেছিলেন–সেই গোপনে রাখা টেপ রেকর্ডার থেকে বিনয় পাঁজার মুখে তাঁর নিজের তরফের কথা অনেকটাই জানা যেতে পারে।
পাঁজামশাই কম কথার মানুষ। জহরও ততটা চতুর নয়, তার সেই বুদ্ধি আর তৎপরতাও নেই যে খুঁচিয়ে ভদ্রলোকের মুখ থেকে, বলা ভাল পেট থেকে, দশটা কাজের কথা বার করে নেবে। জহর পারেনি।
ওরই মধ্যে কাজের কথা যা জানা গিয়েছে, তা হল–বিনয়বাবু তাঁর মা আর বাড়ির কাজকর্মের দু-তিনজনকে নিয়ে সে বছর হরিদ্বার হৃষীকেশ যান। ওই পথে যতটা পারেন যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। তখনও ঠিক বর্ষা পড়েনি। গরম শেষ হয়ে আসছে। বিনয়বাবু আগে থেকেই কোথায় কোথায় উঠবেন সে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সবই প্রায় কোনওনা-কোনও আশ্রম। বিনয়বাবুদের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত, দু’পুরুষ তো হবেই। তীর্থযাত্রীদের জন্যে ধর্মশালা বা ওইরকম কিছু তো আছেই। তা তীর্থযাত্রার মধ্যে একদিন হঠাৎ দুর্যোগ দেখা দিল। আচমকা। দুপুর থেকে বৃষ্টি। বিকেল-শেষে সেই বৃষ্টি প্রবল হল; তার সঙ্গে ঝড়। অন্ধকারে ডুবে গেল পাহাড়পর্বত গাছপালা। কিছুই আর ঠাওর করা যায় না।
তখন ঘন রাতও নয়, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, হঠাৎ সব কেমন দুলে উঠল। ভীষণ এক শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে রটে গেল ভূমিকম্প। তখন মাথা ঠাণ্ডা রাখার মতন মানুষই বা ক’জন। প্রাণের ভয়ে কে যে কীভাবে মাথার আশ্রয় সাধারণ ধর্মশালা ফেলে বাইরে বেরিয়ে পাগলের মতন ছোটাছুটি শুরু করল বোঝানো মুশকিল।