বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম মহিলার চোখের সলজ্জ হাসিটুকু ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে ব্যাকুলতায় গভীর হয়ে উঠল। ফিসফিস করে কী বলতেই বিজন দত্ত দুই ঊরুতে চাপড় দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ”গোলি মারো তোমার অসুখকে। ফাইন আছি।” এরপর ওর কণ্ঠস্বর আর শুনতে পেলাম না। আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখি নিচুগলায় কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল, নিঃশব্দে হেসে উঠেছে, এক সময় আপেল খেতে দেখলাম।
চলে যাবার জন্য আমি ঘরে ঢুকে ওকে বললাম, ”আজ চলি।”
আমার দিকে একবার তাকিয়ে, বিজন দত্ত এমন ভঙ্গিতে মাথাটা হেলিয়ে দিল যেন অনুমতি দিচ্ছে। ফেরার পথে ট্রেনে বসে আজই প্রথম ওর উপর বিরক্ত হলাম। দিনসাতেক আর স্যানাটোরিয়াম মুখো হলাম না। স্কুল থেকে সোজা স্টেশনে চলে যাই। ওর স্ত্রীকে দুদিন দেখলাম ট্রেন থেকে নামতে। একদিন সঙ্গে ছেলেটিও ছিল। সেই বিধবা মহিলাকে দেখলাম, স্যানাটোরিয়ামের দিক থেকে সাইকেল—রিকশায় স্টেশনে এল। টিকিট কিনে, প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কলকাতা থেকে একটা ট্রেন এসে দাঁড়াতেই ঘোমটায় মুখ আড়াল দিল। একদিন ডাঃ বসুরায়ের কোয়ার্টার্সে গেলাম। তিনি ব্যস্ত ছিলেন কয়েকজন নিকট আত্মীয়কে নিয়ে। চলে আসছি তখন আমায় বললেন, ”তোমার বন্ধু যে খোঁজ করছিল।” আমাকে অবাক হতে দেখে আবার বললেন, ”সেই ফুটবলার বিজন দত্ত। এখন তো ওকে বাইরে বেড়াবার পারমিশন দেওয়া হয়েছে।”
ডাক্তার ও কর্মচারীদের কোয়ার্টার্সগুলোর পিছনে একটা পুকুর, তার ধারেই এক চিলতে জমি। এখানকার বাচ্চচা ছেলেরা তাতে ফুটবল খেলে। পুকুরের কিনারে সীমানা—পাঁচিলের খানিকটা ভাঙা আছে জানি। সেখান দিয়ে বেরোলে মিনিটখানেকের পথ কম হাঁটতে হয়। তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছবার জন্য ওইদিকে যাচ্ছি, হঠাৎ ধমকানো গলার ‘বাঁ দিক কভার করো, বাঁ দিক’ চিৎকার শুনে দেখি কালো হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে বিজন দত্ত, বল দিয়ে ধাবমান একটা বছরবারো বয়সি ছেলের পাশাপাশি ছুটছে আর হাত নেড়ে নিজের ডিফেন্ডারদের নির্দেশ দিচ্ছে। দেখেই আমি কাঁটা হয়ে গেলাম। একটা ধাক্কা দিলেই রোগা ছেলেটা লাট্টুর মতো পাক খেয়ে ছিটকে পড়বে।
বিজন দত্ত পা দিয়ে আঁকসির মতো বলটা টেনে নিয়ে, দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল। ছেলেটা কী করবে ভেবে না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। ”দাঁড়িয়ে কেন, কেড়ে নাও আমার কাছ থেকে, কাম অন, চার্জ মী।” ছেলেটি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে বলে লাথি মারতে যেতেই বিজন দত্ত ঘুরে গিয়ে বলটাকে আড়াল করে দাঁড়াল। ”পুশ মী, জোরে, জোরে, আরও জোরে ধাক্কা দাও, ভয়…কি নাঃ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, ”ভয় পেলে ফুটবল খেলা হবে না। যখন পারে না তখন পুরুষমানুষ কী করে? হয় মারে নয় মরে। তুমি আমাকে মেরে বল কেড়ে নাও। ইজ্জতের খেলা ফুটবল, মরদের খেলা।”
ছেলেরা দাঁড়িয়ে হাঁ—করে ওর কথা শুনছে। এই সময় ও আমাকে দেখতে পেল। হাত তুলে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত জানিয়ে, এগোতে এগোতে ছেলেদের বলল, ”এবার তোমরা খেলো। কিন্তু মনে থাকে যেন, যখনই খেলবে জান লড়িয়ে দিয়ে খেলবে।”
সারা মুখ পরিশ্রম ও উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে, হাপরের মতো ওঠানামা করছে বুক, সারা দেহের রোম ঘামে সেঁটে গেছে চামড়ার সঙ্গে। কাছে এসেই বিজন দত্ত বলল, ”পারলুম না আর। ঘাস দেখলে গোরু মুখ না দিয়ে থাকতে পারে!”
”অন্যায়, আপনি খুবই অন্যায় করেছেন। এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি, অথচ দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। যদি রিল্যাপস করে?”
আমার ধমকটা যেন বেশ ভালোই লাগল ওর। হাত নেড়ে বলল, ”কিসসু হবে না। আমি সেরেই গেছি। কদিন আসেননি কেন?”
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে উঠল বিজন দত্ত। পুকুরের সিমেন্ট বাঁধানো ঘাটে এসে আমরা বসলাম। একটা কুকুর চাতালে কুণ্ডলী হয়ে ঘুমোচ্ছে। পুকুরের ওপারের ঘাটে কাপড় কাচছে দুজন স্ত্রীলোক। আকাশে মৃদু কোমল রৌদ্রের রেশ। বাতাস ধীরে বইছে। ঘাটের পাশে অজস্র হলুদ সন্ধ্যামণি ফুটে। বিজন দত্ত কপাল থেকে ঘাম চেঁছে ফেলে হাসল। বললাম, ”আপনার কেমন কাটছে?”
”আমার?”
বিজন দত্ত যেন বিব্রত হল! উঠে গিয়ে একটা কঞ্চি কুড়িয়ে কুকুরটাকে খোঁচা দিল। ‘ক্যাঁউ’ করে উঠে কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে কয়েকহাত সরে গিয়ে আবার বসে পড়তেই বিজন দত্ত বাতাসে কয়েকবার জোর কঞ্চিটা নাড়ল। কুকুরটা বোধহয় এসবে অভ্যস্ত। ভয় পেল না, শুধু অপেক্ষা করতে লাগল। বিজন দত্ত ফিরে এসে বসল। ”আমি লেখাপড়া শিখিনি, চাকরি করি বলতে গেলে বেয়ারারই। তখন তো ফুটবলাররা দশ—পনেরো লাখ করে টাকা পেত না, গাড়িভাড়া ছাড়া একটা পয়সা নয়, এখনকার মতো চাকরিও নয়।”
আকাশের আলো দিনের এই শেষবেলায় খুব তাড়াতাড়ি ম্লান হয়। বিজন দত্তকে শীর্ণ এবং অসহায় দেখাচ্ছে। আমি ওর পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ রাখলাম জলের উপর আবছা নারকেলগাছের ছায়ার উপর।
বললাম, ”আর বোধহয় বেশিদিন এখানে আপনাকে থাকতে হবে না।”
”হ্যাঁ, টেম্পারেচার তো কদিন ধরেই অফ—সাইড করছে না। এভাবে বন্দি—জীবন আর ডাক্তারদের হুকুম মেনে আর চলতে পারছি না। মাঝে মাঝে ভাবি, এখানে আমি কী করছি? একদিনের জন্যও কখনো শরীর খারাপ হয়নি, একদিনের জন্যও নয়। হাসপাতালে গেছি শুধু কার্টিলেজ আর ভাঙা পায়ের জন্য, ব্যস।”