- বইয়ের নামঃ মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ১ম খণ্ড
- লেখকের নামঃ মতি নন্দী
- প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০. ভূমিকা – বুদ্ধদেব গুহ
ভূমিকা
মতির লেখা এবং জীবনযাত্রার সঙ্গেও সমসাময়িক বাঙালি সাহিত্যিকদের বিশেষ মিল ছিল না। সে ছিল বড়ো বাঘের মতো। তার জীবনযাত্রাতে তো বটেই জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও কোনো ভিক্ষা বা করুণাভিক্ষার লেশ মাত্র ছিল না। সে ছিল পুরোপুরি খেলোয়াড়-স্পোর্টসম্যান। ঈর্ষা, দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা কোনোদিনও দেখিনি ওর মধ্যে। ওর মৃত্যুর পরে অনেককেই দেখেছি ওর কাছের মানুষ হিসেবে দাবি করতে, কিন্তু বাস্তবে সেই অর্থে, ওর ভায়রাভাই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন ছিল, তেমন অগণ্য স্তাবক ও পাঠকের দল নিয়ে তার দিন যাপন ছিল না। সে ছিল নির্জন এবং একাকী জীবনের পথিক।
শ্যামলের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র বিরূপতা নেই। ওর নামোল্লেখ করলাম নিছকই তুলনার জন্যে।
মতি লিখেছে অত্যন্তই কম, কিন্তু যতটুকু লিখেছে তা অতি উচ্চচমানের লেখা। প্রতিটি লেখাই স্বতন্ত্র এবং দিকদর্শক। প্রত্যেক লেখকেরই মতির লেখা পড়ে শেখার অনেক কিছু আছে। তরুণ লেখকদের তো বটেই, আমাদেরও। সাহিত্য যে নির্জন এককের গান হই-হুল্লোড়ের বিষয় নয়, তা মতি আমাদের প্রজন্মকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
ওর বইয়ের ভূমিকা লিখতে অনুরুদ্ধ হয়ে আমি গর্বিত বোধ করছি।
বুদ্ধদেব গুহ
নক্ষত্রের রাত
নক্ষত্রের রাত – মতি নন্দী – উপন্যাস
এক
ছোট ছোট তিনটে শব্দ করে দিনেশের কড়ানাড়ার অভ্যাস। রমা তখন শাড়ি বদলাবার জন্য আটপৌরেখানা আলনা থেকে নামাচ্ছিল, কিন্তু দিনেশের ফেরার শব্দ শুনে ঘরের দরজার আড়ালে এসে দাঁড়াল। চোখটুকু বার করে অপেক্ষা করতে লাগল কখন মাধবী দরজাটা খুলে দেবে। দরজা কে খুলবে তার কোন বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই, কাছে যে থাকে সেই খুলে দেয়। কিন্তু এখন রমার সাধ্যে কুলোল না ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। কে জানে কেমন খবর এনেছে দিনেশ।
দুটো লাগোয়া ঘরের সঙ্গে অন্ধকার-অন্ধকার দালানটার একদিকে রান্নাঘর, আর একদিকে দরজা। দরজাটা পলকা। কড়ানাড়ার সঙ্গে ওর কব্জাগুলোও কাঁপে। তখন বাড়তি আর একটা শব্দ হয়, কিন্তু দিনেশের কড়ানাড়ার মেজাজ এমনই যে বাড়তি শব্দটা আর হয় না। শুধু এইটুকু দিয়েই ওকে চিনে নেওয়া যায়।
কড়া দিনেশ নাড়ছে তাই ব্যস্ত হল না মাধবী। বিছানা থেকে টান দিয়ে পরিষ্কার সুজনিটা তুলে নিল। ছেঁড়া তোশক বেরিয়ে পড়ল। বালিখসা দেয়াল, বার্নিসচটা খাট, সিমেন্ট ফাটা মেঝে, নড়বড়ে একটা চেয়ার আর টেবিল, ঝাপসা গোটাকতক ছবি, এসবের মধ্যে পরিষ্কার সুজনিটা বেখাপ্পা দেখাচ্ছিল। মাননীয় বিদেশী অতিথিদের চোখ থেকে শহরের ময়লা এলাকা ঢাকবার আপ্রাণ চেষ্টারই একটা ছোট ধরনের উৎসাহ যেন এতক্ষণ ছিল। সুজনিটা তুলে নেওয়ায় ঘরটা স্বাভাবিক হল।
আর একবার কড়া নড়ল। নড়ুক। মাধবী ভাঁজ করতে শুরু করল সুজনিটা। পাশের ঘরে রমা আছে, খুলে দেবে। খাটের তলা থেকে ময়লা জামাকাপড়গুলো বার করে দড়ির আলনায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ তার মনে হল, দিনেশ যেন অন্যবারের তুলনায় শিগগির ফিরে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি কি কথাবলা শেষ হয়ে গেল, না কথা না-বলেই শুধু রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল!
মাধবী দরজা খুলল। খিল খোলার শব্দে একবার শুধু কেঁপে উঠল রমা।
-কি বলল?
দিনেশকে ঢুকতে না দিয়ে, দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় মাধবী জিগ্যেস করল।
-বলেছিলে তো?
-হ্যাঁ। বলল পরে জানাবে।
কথাটা বলেই দিনেশ ঢুকতে চাইল। মাধবী নড়ল না।
-হাবভাব দেখে কি মনে হল, পছন্দ?
-কি জানি।
-দেনা পাওনার কথা বলল কিছু?
-না।
-তাহলে কি করলে এতক্ষণ!
মাধবী সরে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে দিনেশ ওর পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকল। যেন সব দোষটুকু তারই। মাধবী তাকিয়ে আছে। ঘেন্না করছে। তাকে অপদার্থ ভাবছে। মিষ্টি কথায় পাত্রপক্ষের মন ভেজাতে না পারলে, কাজ বাগাতে না পারলে তাকে অপদার্থ ভাবতে মাধবীর একটুও দ্বিধা হবে না। ও এমন ধরনের মেয়েমানুষ।
কাঁধের হাড়গোড়ের মাঝে দিনেশের মাথাটা যেন আর একটু বসে গেল। দিনে দিনে ক্রমশ সে ছোট হয়ে আসছে।
আটাশ বছর আগের বিয়ের ছবিটা এখনো দেয়ালে ঝুলছে। দিনেশের পরিষ্কার মনে আছে কোথায় তোলা হয়েছিল ছবিটা। বিয়ের পরদিন রওনা হবার আগে, মাধবীর বাপের বাড়ির পাশের বাড়ির উঠোনে জোড়ে ছবিটা তোলা হয়েছিল। ওর অনেকগুলো কপি মাধবীর বাবা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলি করেছিল। কেউ কেউ নিজেদের ঘরে বাঁধিয়েও রেখেছিল। এখন, আটাশ বছর বয়সী কাচের ঐধার থেকে ছবিটা, যে কোন দম্পতির নামে খবরের কাগজে ছাপা যেতে পারে এত ঝাপসা!
মাঝে মাঝে দিনেশ ভাবত কাচটা পরিষ্কার করে দেবে। দেওয়া হয়নি। কেমন আলসেমিতে ধরে। এতে তার কি লাভ হবে। ছেলেমেয়েরা অবাক হবে শুধু, তাদের বাবার জোয়ান বয়সের চেহারা দেখে। রীতিমত সাঁতার-কাটা স্বাস্থ্য। এখন আর কেউ বিশ্বাস করবে না। না করলে কিছু লোকসান নেই। ছবিটার আজ কোন ধরনেরই মূল্য নেই। যে জিনিসের থাকা না-থাকা সমান, তার সম্পর্কে আলসেমি আসা স্বাভাবিক।
আজ কতদিন পরে ছবিটা যে ঘরে আছে, সে খেয়াল হল। চেয়ারে বসে দিনেশ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ছবিটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। ওটার কোন অর্থ নেই। এমন একটা অর্থহীন জিনিস যে এতদিন মাধবীর নজরে পড়েনি, এইটেই আশ্চর্যের। লাভ লোকসান না খতিয়ে তো মাধবী চলে না। যারা খতিয়ে চলে তারা বোধহয় এর মাঝামাঝিগুলোকে আমল দেয় না। আমাকেও ও আমল দেয় না। আমি লাভ লোকসান মেপে চলি না, চললে বোধহয় আরো চালাক চতুর হতে পারতুম; সংসারের এই হাল হত না। উৎসাহ থাকলে চালাক হওয়া যায়। মহিম আজ নিজের বাড়িতে অফিস করেছে, বাড়ির সামনে মোটরের ভিড় জমে। অথচ ও স্কুলে কি বোকাটাই না ছিল! স্কুল ছাড়লুম একসঙ্গেই প্রায়। আমি চাকরিতে ঢুকলুম, আর ও জ্যোতিষী মামার সাগরেদি শুরু করল। মহিমের সবকিছুতেই উৎসাহ ছিল। আজও আছে। আজও আগের মত ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলে, সাংসারিক পরামর্শ দেয়, আর সে পরামর্শ শুনলে লাভ ছাড়া লোকসান যে হবে না, তাই বোঝাতে নিজের দিকে আঙুল দেখায়। গল্পের মত শুনতে লাগে। নতুন টাকা আর আংটিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতেও বেশ লাগে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাইরে এসেই ভুলে যাই। কি হবে মনে রেখে। টাকা করার পথ বড় নোংরা। তার থেকে অনেক ভাল চুপচাপ যেমন আছি তেমনি থাকা।
চেয়ারে বসেই হাতের কাছে যে বইটা পেল তুলে নিল দিনেশ। বিবেকানন্দের চিঠি। কয়েক পাতা উলটিয়ে আর একটা তুলল। শরৎ গ্রন্থাবলী। মনযোগ করল।
এখন রাগ করে কোন লাভ নেই তবু রাগ হল মাধবীর। দিনেশের দোষ নেই। তারা যদি রমাকে না পছন্দ করে তাহলে কি-ই বা সে করতে পারে। কিন্তু একটা কিছু তো করা উচিত। মুখ বুজে বই পড়লেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। কিছু না পারুক অন্তত ভাবুক। চেঁচিয়ে সেই ভাবনার কথাটা জানাক। যত ভাবনা একাই ভেবে মরব; ওর কি কোন দায় দায়িত্ব নেই। সংসার খরচের কটা টাকা ফেলে দিয়েই খালাস! ঘাড় গুঁজে বই পড়ছে কেমন নিশ্চিন্তে। এতবড় যে একটা বোঝা ঘাড়ে চেপে আছে সে খেয়াল নেই। অন্যের ভাবনা বইয়ে লেখা আছে। তাইতে ডুবে গেছে। অন্যের ভাবনা ভেবে কি লাভ!
মাধবী শব্দ করে দরজায় খিল দিল।
সেই শব্দে আর একবার কেঁপে উঠল রমা। চোখ বুজে এল। এবারেও তাকে অপছন্দ করেছে। এই নিয়ে দু’বার হল। লজ্জা করছে। সেজেগুজে কতকগুলো অপরিচিত লোকের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা। বাঁধা মামুলি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আর মায়ের রাগ দেখা। এত করেও কিছু হল না। আমার জন্যই মা রাগে, বাবা মাথা গুঁজে বই পড়ে। এখনকার এই মনকষাকষি, অশান্তি আমার জন্যেই। আমায় অপছন্দ করেছে, তার মানে ওদের চোখে আমি কুচ্ছিত। নিজেকে কুচ্ছিত ভাবতে লজ্জা করে। এ খবর পাঁচজনে শুনলে নানান কথা বলবে, দয়ার কথা।
আয়নার সামনে দাঁড়াল রমা। জায়গায় জায়গায় পারা উঠে শুকনো পোড়া ঘায়ের মত দাগ ধরে আছে। খোঁপায় আঙুল চেপে কাঁটাগুলো বসিয়ে দিল। আয়নার আধখানা কাচ অদ্ভুত। মুখটা লম্বাটে দেখায়। দেখলে ভয় করে। হয়তো ভয় পেয়েছিল। ঘরে ঢুকেই ভ্রূ তুলল মাধবী।
-কাপ ডিশগুলো তখন থেকে ও ঘরে পড়ে রয়েছে, পরের জিনিস ফেরত দিতে হবে না।
তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোচ্ছিল রমা। আরো বিরক্ত গলায় মাধবী বলল-
-কাপড়টা ছাড়বি কখন?
খেয়াল হল রমার। কাপড়টা আগেই তুলে রাখা উচিত ছিল। লোকজনের সামনে বেরোবার মত এই একখানাই শাড়ি আছে। যদি দাগ ধরে বা ছেঁড়ে! এবার গলার স্বর ইচ্ছে করেই চড়িয়ে মাধবী বলল।
-বাহার দেওয়া হচ্ছে। যেন হাজার গণ্ডা শাড়ি কিনে দিয়েছে। তোলাগুলো পরে পরে আর একখানাও তো আস্ত নেই।
-এই একখানাই তো তোলা শাড়ি! আর ছিল নাকি?
-থাকবে কি করে? আমার বাপ তো তোর বাপের মত নয়, তোরঙ্গ ভর্তি করে শাড়ি দিয়েছিল। দিতে জানা চাই, বুঝলি-
মাধবী এই যে শুরু করল, যতক্ষণ না দিনেশ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে আর থামবে না। প্রতিদিনের ঘটনা। একটা ছুতো পেলেই হয়। রমা তাড়াতাড়ি বদলে নিল শাড়ি। তোরঙ্গের শেষ তলাতে পাট করে বিছিয়ে রাখতে হবে। রমার হাত থেকে মাধবী সে কাজটুকু তুলে নিল।
পাশের ঘরে এসে রমা ঢুকল। দিনেশ বেরিয়ে যায়নি। ছুটির দিন আজ। বিকেলের আলোও যাই যাই শুরু করেছে। জানলা থেকে টেবিল পর্যন্ত শুধু স্পষ্ট নজর করা যায়। নয়তো চোখ টান করে বাকি ঘরটুকুতে তাকাতে হয়।
মাথা ঝুঁকিয়ে বই পড়ছে দিনেশ। মাধবীর কথাগুলো নিশ্চয় কানে গেছে।
-বাবা, বাইরে যাবে না?
নরম গলায় বলল রমা। কিন্তু তাই বলে এত নরম নয় যে উত্তর পাওয়া যাবে না।
-বিকেল হয়ে গেছে। একটু ঘুরে এসো।
এবার পাশে দাঁড়িয়ে রমা বলল। একটু বেশি রকমের চমকাল দিনেশ। রমা বুঝল এতক্ষণ বই পড়ছিল না।
-বেশ লাগছে পড়তে।
-ওতো তোমার কতবার পড়া বই।
-তবু বেশ লাগে। এক একবার, এক একরকম লাগে।
হাসল দিনেশ। বড় ঠাণ্ডা হাসি। রমার কষ্ট লাগে এই ছোটখাট মানুষটার জন্য। কটুকাটব্যগুলো নির্বিবাদে হজম করেও হাসতে পারে। তখন চোখে চোখ রাখলে মন জুড়োয়। মন খারাপও হয়। হাসির কথায় হাসে না। হাসবেই বা কোত্থেকে। সংসারে হাসির কথা হয় নাকি!
দিনেশ তাকিয়ে আছে। ঘরের আলো এখন অনেক কম। তবু মুখের দিকে তাকান যায় না। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে চোখ দুটো। চোখ সরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল রমা।
দরজা পেরোলেই সরু একফালি জায়গা। একধারে ওপরে যাবার সিঁড়ি। আর একধারে উঠোন। সিমেন্টের রক উঠোন ঘিরে। রকের ধারে আর দুটো ঘর। যমুনারা থাকে।
উঠোনের একধারে কলতলা। বাইরে আর ভেতরে দুটো চৌবাচ্চচা পুরুষ আর মেয়েদের জন্য। মেয়েদেরটা পাঁচিলঘেরা টিনের চালা দেওয়া। বাসন মাজার কাজে বাইরেরটার ব্যবহার হয়। কাপগুলো ধুয়ে যমুনার দরজায় এসে রমা দাঁড়াল।
চুল বাঁধছিল যমুনা। ভেতরে ডাকল সে রমাকে। ছিমছাম থাকতে যমুনা ভালবাসে। ছেলেপুলে হয়নি। সে আর স্বামী। স্বামীর রোজগার ভাল। খাট, পুরু গদী, আয়না লাগান আলমারি, ঘেরাটোপে ঢাকা সুটকেশ, সবকিছুই এবাড়ির অন্যদের থেকে সিজিল-মিছিল। নিজেকেও যমুনা সাজগোজে অন্যদের থেকে তফাত করে রাখে। আজ তিন বছর আছে, তবু কেউ মন খুলে ওর সঙ্গে মিশতে পারল না।
মাধবী যমুনাকে পছন্দ করে না। কিন্তু মুখে তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলে না। ওর ঘরে রমার যাওয়া সে একদম পছন্দ করে না। কিন্তু মুখ ফুটে বারণও করেনি। যমুনার গ্রামোফোন আছে। গানগুলো রমার মুখস্থ। গুনগুনিয়ে দু’একটা কলিতে সুর তুললেই কপালে ভাঁজ ফেলে মাধবী তাকায়। রমার গান থেমে যায়। দু’একবার চুল বেঁধে দিয়েছিল যমুনা নতুন কায়দায়। মাধবী অবাক চোখে তাকিয়েছিল খোঁপার দিকে। রমা আর চুল বাঁধেনি যমুনার কাছে। সিনেমা দেখে এসে গল্প বলে যমুনা। এমন করে বলে যেন চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে রমার। কিন্তু মুখ ফুটে মাধবীকে বলতে সঙ্কোচ হয়।
রমা বোঝে যমুনার স্বচ্ছল অবস্থাকে সহ্য করতে পারে না মাধবী। তাই রাগ উসকে ওঠে। কিন্তু দায়ে-অদায়ে, টুকিটাকি সাহায্যের জন্য হাত পাততে হয়। রাগ আর অনুগ্রহ চাওয়া, এই দু’য়ে মিলে মাধবী শুধু ভদ্র সম্পর্কটুকুই রাখতে চায়। আর যতটুকু ঘনিষ্ঠ হলে এই সম্পর্ক বজায় থাকে তার বেশিতেই মাধবীর শাসন। তাই দরকার না পড়লে যমুনার ঘরে আসার উপায় নেই।
-কি, বলে গেল কিছু?
ফিতেটাকে দাঁতে চেপে আয়নায় চোখ রেখে যমুনা জিগ্যেস করল। রমা হাসল। কাপগুলো সাজিয়ে রাখল তাকে। ফিরে দাঁড়াল যমুনা।
-নাকি এবারেও সেই আগের মতন। পরে চিঠি দিয়ে জানাব!
মাথা নাড়ল রমা। তাতে হ্যাঁ এবং না দুই-ই বোঝায়। যমুনা কি বুঝে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। রমা দরজার দিকে তাকাল। অস্বস্তি ভোগ করার আগেই সে চলে যেতে চায়।
-যাই বৌদি। কাজ পড়ে আছে।
-উনি বলছিলেন চুঁচড়ো না কোথায় যেন একটা মেয়ে জলে ডুবে মরেছে।
-কেন!
-বাপ-মাকে রেহাই দেবার জন্য। এখনো এসব হয়।
-যাই বৌদি।
-আমার বেলায় হয়েছিল কি, যারাই দেখেছে পছন্দ করেছে। কিন্তু বাবার এক গোঁ, কারুর খাঁই মেটাব না। মেয়েতো কুচ্ছিত নয়।
হাসল যমুনা। পানখেয়ে দাঁতগুলোকে ফোকলা দেখায় এই অন্ধকার-অন্ধকার আলোতে। নয়তো মুখের গড়ন ভাল।
-তোমার দাদা নিজে এসেছিল আমায় দেখতে।
হাতের প্যাঁচে চুলগুলোকে কায়দা করে ফেলল যমুনা। বেশ ঘন চুল। রমা তাকিয়ে রইল চুপ করে।
-পাত্তর নিজে আসে নি?
-কি জানি।
-আহা, ন্যাকা! দেখলেই তো চেনা যায়।
হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল রমা। উঠোনের একধার দিয়ে একটা গলি এঁকেবেঁকে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। গলিতে কোন দরজা নেই। তাই উঠোনের কোন আব্রু নেই। বাইরের লোক যে কোন সময় হুট করে এসে পড়তে পারে। নতুন মেয়েরা প্রথমে অস্বস্তিতে ভোগে। ফেরিওয়ালারা একদম উঠোনে এসে হাঁক দেয়। পরিচিত হলে দরজায় এসে দাঁড়ায়।
মাথা নিচু করে সার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিশ্ব আসছিল। গলি আর উঠোনের মুখে পাল্লা-ভাঙা লেটার-বক্সটা দেখতে সে মুখ তুলল। চিঠি আসে নি কিন্তু রমাকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল তার।
বিব্রত হয়ে চারপাশ তাকাল রমা। বিশ্বর হাসিটা চোখে পড়ার মত। তবু রক্ষে, ধারে কাছে এখন কেউ নেই। উঠোন থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে সুস্থ মানুষের অতখানি সময় নেওয়া চোখে পড়ার মত। রমা আবার যমুনার ঘরে ঢুকে পড়ল। বিশ্ব আবার সার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, মাথা নিচু করে তার স্বাভাবিক গতিতেই তিনতলায় উঠে গেল। মা আর বিধবা দিদিকে নিয়ে সে থাকে।
-কি?
-কাবেরী আবার কবে আসবে?
কাবেরী যমুনার বোন। দিদির কাছে এসে সে মাঝে মাঝে থাকে।
-এই তো ক’দিন আগে গেল, কলেজের ছুটি না পড়লে আর আসবে কি করে।
-তার মানে সেই পুজো?
-হুঁ। ও বুঝি তোর দাদার একটা গল্পের বই নিয়ে গেছে?
-কি জানি।
-হ্যাঁ। বলেছে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।
-আচ্ছা বলব।
চলে যাচ্ছিল রমা। যমুনা ডাকল।
-কে চুল বেঁধে দিয়েছে রে?
-নিজেই।
-আহা বাঁধার কি ছিরি। মাথা ঘষিস নি ক’দিন?
-কাল পরশু ঘষব।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল রমা। দালানে পা দিয়েই মাধবীর গলার স্বর কানে এল।
-দোতলার বড়বৌয়ের ভাইপো। মাস ছ’য়েক হল চাকরিতে ঢুকেছে। বাপের এক ছেলে। বাড়ি আছে। অবস্থা ভাল।
-খরচ পত্তরের কথা বলেছে কিছু?
-আগে মেয়ে দেখুক, তারপর তো কথা হবে। চাকরে ছেলে, খাঁইতো থাকবেই। তোমার চাকরিরই বা আর ক’দিন, এই বেলা দেখেশুনে মেয়ের বিয়ে না দিলে মুশকিলে পড়তে হবে। শরীর তো দিনকে দিন ভেঙে পড়ছে।
যেমনভাবে ঢুকেছিল তেমনি চুপিসাড়ে রমা তিনতলার সিঁড়ি ধরল। ওরা কথা বলছে। সংসারের দরকারি কথা। আপাতত ভুলে থাকবে সব কিছু। থাকুক। ততক্ষণে তিনতলাটা চট করে ঘুরে আসা যায়। মাধবী খোঁজ করার আগেই। এখন বিকেল। এখন সংসার থেকে একটু ছুটি। খোঁজ করলেই বা, এ সময়টা আমার নিজের। তরতরিয়ে সিঁড়ি ভাঙল রমা। প্রতিটি ধাপই ক্ষওয়া, ভাঙা, পা ফেললেই পড়ে যাবার ভয় আছে। চারটে বাঁক নিয়ে সিঁড়িটা ছাদে পৌঁচেছে।
বিশ্বদের দরজাটা খোলা। ঝাঁট দেওয়ার শব্দ আসছে। বিশ্বর দিদি এখন সংসারের কাজে ব্যস্ত। ভালই হয়েছে। দরজাটা এড়িয়ে ছাতে এল রমা।
চারতলা বাড়িটার পাশে একটা বটগাছ। ওই দিকে সূর্য ডুবেছে। গাছের মধ্যে অজস্র আলোর ঘুলঘুলি। কাক নাচানাচি করছে গাছে। কালো কালো মাথা যেন পরের বাড়ির উঠোনে উঁকি দিচ্ছে। তারপর কোথায় কি ঘটল। হুস হুস করে কাকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। দু’একটা রমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
মেয়েরা বেড়াচ্ছে, গল্প করছে ছাতে। ছাতগুলো দূরে দূরে। কথা বলতে হলে চীৎকার করতে হবে। তাছাড়া আলাপও নেই, নিত্যি নতুন ভাড়াটে আসছে-যাচ্ছে। বাড়ি বয়ে ভাব করতে কে যায়! তাছাড়া চাইলেই বাড়ি থেকে বেরোন অত সোজা ব্যাপার নয়। উঠতি বয়সী মেয়ে, হট হট করে এবাড়ি সেবাড়ি করবে, সেটা মাধবী পছন্দ করে না।
মেয়ে দুটো হেসে গড়িয়ে পড়ল। আবার ছুটে এল পাঁচিলে। দুখানা বাড়ির পরের ছাতে, চা খাচ্ছে একটা লোক। মুচকে হাসছে। দুটো মেয়েই স্কুলে পড়ে। রমা প্রায় দিন ছয়েক হল লোকটাকে চা খেতে দেখছে।
পাঁচিলে একসার শিশি। গামছা পরে এক মাঝ-বয়সী বৌ ওগুলো তুলছে। দূর থেকে দেখেই দাঁত সিরসির করে। অনেক দূরে আর একটা বাড়িতে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। আজ সকালেই শাঁখের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। গায়ে হলুদ হল বোধ হয়।
যতটুকু দেখা যায়, চোখ বুলিয়ে দেখে নিল রমা। ছাতের একধারে গঙ্গার জলের ট্যাঙ্ক। ওপরের ঢাকনিটা অনেকদিন ভেঙেছে। হাত দিলেই ঝুরঝুর করে মরচে খসে পড়ে। তলাটুকু এখনো আস্ত আছে, কাজ চলে যায়।
ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে ছাতটা সরু ফালি হয়ে শেষ হয়েছে পাশের বাড়ির দেয়ালে। ফালি জায়গাটুকুতে কতকগুলো কুঁজো ভাঙা টব। ফুলগাছের জন্য তৈরি হয়েছিল। ফুল ফুটতোও। গাঁদা, বেল, দোপাটি। কেমন যেন পাগলাটে ধরনের ছিল মধুসূদনবাবু। মাঝরাতে বৌকে নিয়ে ছাতে আসত। গল্প করত। একটা ভাঙা সেতার ছিল। বাজাত। সারা বাড়ি হাসাহাসি করত। লুকিয়ে অনেকে দেখত ওদের গল্পকরা। বড় ঘরের ছেলে ছিল মধুসূদন। ঠাকুর্দা ঘোড়ায় চেপে গড়ের মাঠে হাওয়া খেত। ওর বাপ জোয়ান বয়সে জুড়ি হাঁকিয়েছে। একদিন মধুসূদন চাকরি থেকে ছাঁটাই হল। সেতারটা বিক্রি করে দিল। আর একদিন এ-বাড়ি ছেড়ে উঠে গেল বস্তিতে। সে ঘরে এল যমুনারা। সকলে বলল, এবার লোকটার পাগলামি ঘুচবে। রোজ টবে জল দিত মধুসূদন। এখন মাটি পাথুরে।
টবগুলো পার হয়ে বিশ্বর জানলার ধারে দাঁড়াল রমা। তিন দিক দেয়াল ঘেরা ছাতের এই ছোট্ট জায়গাটা প্রায় একটা লুকোন ঘরের মত। ভাঙা ট্যাঙ্ক, দেয়াল আর আকাশ।
রমা সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখল ঘরে কে! অবশ্য বিশ্ব ছাড়া আর কারুর থাকার কথা নয়। ঘরটা এত ছোট যে ঠাকুরঘর ছাড়া আর কোন কাজে লাগে না। ওই জন্যই বোধ হয় তৈরি হয়েছিল। এখন ও ঘরে সংসারের একমাত্র পুরুষ বিশ্ব থাকে।
চা খাচ্ছিল বিশ্ব। বিছানাটা একধারে গোটান। তার ওপর ছেড়ে রাখা জামাটা আর বই-খাতা; ভাঁড়ে বিড়ি সিগারেটের টুকরো। দেয়ালে কাত হওয়া সুভাষ বোসের ছবি। ঘরের দরজা বন্ধ।
একচিলতে কপাল জানলা থেকে সরে যেতেই বিশ্ব চায়ের কাপ হাতে উঠে এল।
-খুব সাহস হয়েছে দেখছি। মা বুঝি এখন বাড়ি নেই?
-যাবে কোথায়!
রমা তবু ছাদের দিকে তাকাল। বিকেল হয়েছে। ছাতে কেউ উঠে আসতে পারে। সিঁড়িতে কারুর পায়ের শব্দ হয় কিনা শোনার জন্য কান পাতল।
-শুনলুম, আজ দেখতে আসার কথা আছে?
-দেখা হয়ে গেছে।
-ও। কি হল?
-পছন্দ হয় নি।
শুকনো স্বরে বলল রমা। চায়ের বাটি মুখের কাছে তুলেও চুমুক দিল না বিশ্ব।
-রোজ একধরনের খোঁপা বাঁধ কেন?
-তাতে কি হয়েছে?
-দেখতে ভাল লাগে না।
-হাঙ্গামা অনেক।
-ও। চা খাবে?
বাটিটা এগিয়ে ধরল বিশ্ব। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে গলবে না বাটি। কাত করে চুমুক দিতে হবে।
-না।
-না কেন?
-ভাল লাগছে না।
-হঠাৎ।
আর কথা বাড়াল না রমা। পুরুষ মানুষের একঘেয়ে অনুরোধ সবসময় ভাল লাগে না। রাজী না হলে বিশ্ব এখন ঘ্যান ঘ্যান করবে।
বাটিটা গরাদের ফাঁকে ধরে চুমুক দিল রমা! চা’টা জুড়িয়ে গেছে। বোধ হয় বিশ্ব বাড়িতে ঢোকার আগেই তৈরি হয়েছিল। জুড়োন চা একদম ভাল লাগে না। এক চুমুক দিয়েই রমা মুখ সরিয়ে নিল।
-আমার এঁটো চা খেলে তো!
এমনি ভাবে প্রথম দিন চা খাওয়ার পর বিশ্ব ভয় দেখিয়েছিল। ঝাঁঝিয়ে উঠে রমা বলেছিল,-আচ্ছা, আচ্ছা, টি-বি হয়তো আমার হবে, তাতে তোমার কি। ঠাট্টা করতে করতে সত্যি যেদিন হবে, সেদিন বুঝবে।
আজ রমা চুপ। শুধু বিশ্বর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চা-টুকু এক চুমুকে শেষ করল বিশ্ব।
-মন খারাপ বুঝি?
-কেন?
-পছন্দ করেনি বলে।
-তাতে মন খারাপের কি আছে?
আগের বার যখন রমাকে দেখে অপছন্দ করে যায় তখন ঠাট্টা করেছিল বিশ্ব। ঠোঁট উলটিয়ে রমা বলেছিল,-হ্যাঁ, পছন্দ করবে না আর কিছু। কালো কুচ্ছিতকে কে বিয়ে করবে।
-তাহলে মন খারাপ হয়নি। তবে কথা বলছ না যে?
একটু যেন অভিমানী সুর বিশ্বর। কি কথা বলবে ভেবে পেল না রমা। মনের ওপর অসহ্য চাপ পড়েছে। চাপটা সরে গেছে। এখন আছে শ্রান্তি, মন জিরোতে চায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে।
-জানো মা উঠে পড়ে লেগেছে। এবার গেছে দোতলার জেঠিমার কাছে। ওর কে যেন আছে। ভাল চাকরি করে।
চুপ করে রইল বিশ্ব। সেদিনকার মত ঠাট্টা করে বলল না,-আমিই না কি এমন বেকার। হা-পিত্যেশ করে জানলার ধারে তাকিয়ে বসে থাকাটাও তো একটা কাজ!
-অনেক জায়গায় দরখাস্ত করেছি।
আপন মনে বিড়বিড়িয়ে কতকগুলো কথা বলে গেল বিশ্ব। তারপর সব কথা ফুরিয়ে গেল।
-সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
-হাঁ।
-উনুন ধরাতে হবে, সন্ধ্যে দেখাতে হবে, চলি।
কথাটা বলেও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রমা। তারপর নিচে নেমে গেল।
দিনেশ একা বই পড়ছে ঘরে। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। আলো জ্বালবার কথাও ভুলে গেছে। সুইচ টিপতেই চোখ খুলল দিনেশ। বই পড়েনি, চোখ বুজিয়ে বসে ছিল।
-মা কোথায়?
-এই তো দোতলায় গেল।
-তুমি বেরোবে না!
-কোথায় যাব?
-র’কে গিয়ে তো বসতে পার।
-ভাল লাগে না।
-তা হলে পার্কে।
-আচ্ছা যাচ্ছি। উনুন ধরেছে?
-চা খাবে তো!
উনুন ধরাবার তোড়জোড় শুরু করল রমা। তোলা উনুনে কয়লা সাজিয়ে উঠোনে গিয়ে আগুন দিতে হয়। নইলে ধোঁয়ায় ঘরে তিষ্ঠোন যায় না। এ বাড়ির সকলেরই তোলা উনুন।
কাঠ সাজাচ্ছিল রমা। সানু এসে পাশে দাঁড়াল। বিকেল হতে না হতেই সে বেরিয়েছিল বল খেলতে।
-মা কোথায় রে?
-দোতলায়।
সাবধানে কয়লা ফেলতে ফেলতে রমা বলল। ঘরে ঢুকেই গজগজ করে উঠল সানু।
-আমার ছবিতে কে হাত দিয়েছিল। ছিঁড়ে গেছে।
-কোন ছবিটা?
রাস্তার পোস্টারের একটা ছেঁড়া টুকরো এনে দেখাল সানু। সার্কাসের পোস্টার। একটা সিংহের মুখ, বিকট হাঁ করে আছে।
এটা সানুর বাতিক। পছন্দমত ছবি কোথাও দেখলেই যোগাড় করে এনে ঘরের দেয়ালে সেঁটে রাখবে। ঘরের এক দিকের পুরো দেয়াল, যতটুকু তার হাত পৌঁছায়, এখন তার দখলে চলে গেছে। ওর বাতিকে কেউ বাধা দেয় না।
দালানে ঝুঁকে পড়ে সানু খোঁজাখুঁজি করে একটা ভাত খুঁটে নিল।
-ফের আবার ওই সব হচ্ছে। আমি কিন্তু মাকে বলে দোব, এঁটো করেছিস। ঘরে লক্ষ্মী আছে না?
-আমিও বলে দোব তুই দালান পরিষ্কার করিসনি, সকড়ি ছিল।
-বলে দেখনা। কে মার খায় দেখব।
কথাগুলোতে কান না দিয়ে সানু ঘরে ঢুকল। ভাত টিপে, ছবিতে মাখিয়ে দেয়ালে সেঁটে দিল। তেল লেগে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে মস্ত এক এরোপ্লেন। এইখানে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পান সাজে মাধবী। এরোপ্লেনটা একটানে ছিঁড়ে ফেলল সে। চুন লেগেছে, মানকড়-পঙ্কজ রায়ের ছবিটায়। খুঁটে ফেলে দিল।
-খালি ছবি আর ছবি! ঘরটাকে কি নোংরা করে রেখেছে। দেব একদিন সব ছিঁড়ে খুড়ে।
দেশলাই নিতে ঘরে ঢুকেছিল রমা। শাসিয়ে উঠল সানুকে। রাগ করল না সানু। এমন শাসানি রমার কাছ থেকে দিনে অনেকবার শুনতে হয়।
রমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সানুর নজর পড়ল ইঁটের ওপর সাজান তোরঙ্গগুলোর তলায়। শালপাতার ঠোঙা উঁকি দিচ্ছে।
দালান থেকে রমা চীৎকার করল।
-চান করে আয় সানু। নইলে কিন্তু আজ আর পাশে শুতে দোব না। গা দিয়ে রোজ ঘেমো টোকো গন্ধ বেরোয়।
উনুন নিয়ে রমা বেরিয়ে গেল। ঠোঙাটা টেনে বার করল সানু। একটা নিমকি আছে। সেটা বাদ দিয়ে গুঁড়োগুলো খুঁটে খেতে শুরু করল।
.-ওতো চাকরি করে, তবে রেস খেলে কেন?
তখন ফুটপাথের মানুষেরা গভীর ঘুমের দিকে চলেছে। চিনু কথাটা জিগ্যেস করল। পার্ক থেকে বেরিয়ে ওরা দুজন হাঁটছিল। চিনু আর অমল।
-ওর বাড়ির অবস্থাও এমন কিছু খারাপ নয়।
-অবস্থা খারাপ হলেই কি কেউ রেস খেলে?
-তাছাড়া আর কি, শিগগির টাকা করার ওর চেয়ে সহজ পথ আর কি আছে?
পার্ক থেকে একটা শুকনো কাঠি কুড়িয়ে এনেছিল চিনু। তাই দিয়ে রেলিঙে খড় খড় শব্দ করল। অমল আঙুল দেখাল রাস্তার ঘুমন্ত মানুষদের।
-ওদের তো খুব টাকার দরকার, কই ওদের কজন রেস খেলে?
-ওদের কথা বাদ দে।
-কেন?
-ওদের আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনি না।
-মনীষের তো বিশেষ অভাব নেই তবে সে কেন খেলে?
-আমার প্রশ্নটাও তাই।
চুপ করে ওরা হাঁটল। শেষ ট্রিপের বাসগুলো পড়িমরি ছুটছে। বাসে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে মানুষ। নিওনের বিজ্ঞাপনগুলো নিভে গেছে। দোকানের আলো আর রাস্তায় নেই। প্রাইভেট মোটরগুলো চোখ খুলে ছুট লাগিয়েছে। ঠেলা গাড়িতে আনাজ চলেছে। ভিড়, বাস টার্মিনাসের চায়ের দোকানটায়।
-মনীষটা দারুণ মেজাজী। এক কথায় কেমন দশটাকার খাইয়ে দিল।
-কালকেই তিরিশ টাকা জিতেছে।
-ও কিন্তু প্রায়ই জেতে। খুব হিসেব করে খেলে।
-হ্যাঁ, খেলার সময় হিসেব করে, কিন্তু খরচ করে দুমদাম।
চিনু দাঁড়াল আগুনের দড়িটার কাছে। সিগারেট ধরিয়ে দড়িটা ছেড়ে দিল। ল্যাম্পপোস্টে আছড়ে কতকগুলো ফুলকি হাওয়ায় ছুটে গেল।
-একদিন ওর সঙ্গে মাঠে যাব।
ধোঁয়ায় রিং করার জন্য চিনু আস্তে আস্তে ফুকল। অমল বিরক্ত হয়ে তাকাল। যারা নেশার জন্য সিগারেট খায় তারা রিং করে না। সাঁই সাঁই টান দিয়ে ধোঁয়া গেলে। অমলের এখন গলা শুকিয়ে গেছে ধোঁয়ার জন্য।
-রেসটাও একধরনের খেলা, উত্তেজনা আছে।
-হবে। আমার কোন ধারণা নেই।
গম্ভীর সুরে অমল বলল। বোঝা যায় আলোচনাটা তার ভাল লাগছে না।
-না হলে বড়লোকরা খেলে কেন?
চিনু জোর টান দিয়ে সিগারেটটা এগিয়ে দিল। আঙুল থেকে তুলে নিল অমল। পরপর কতকগুলো টান দিয়ে ফেলে দিল।
-পরশু যাবি সুভাষদের গ্রামে? অনেকে যাবে। দু’দিন থাকা হবে।
-কত খরচ পড়বে?
-সব মিলিয়ে টাকা দশেকের মধ্যে হয়ে যাবে। চল না, আমিও যাচ্ছি।
-তুই কোত্থেকে টাকার যোগাড় করবি?
-এখন ধার-টার করে ব্যবস্থা করব। পরে শোধ করে দোব।
-তোরা আছিস বেশ। লিখতে জানার এই এক সুবিধে।
-নেহাত বোকা না হলে কোন লেখক উপোসী থাকে না?
হাসল অমল। পকেট থেকে কোঁচাটা ফেলে দিয়ে লাথি মারতে মারতে কিছুটা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল।
-ছুটবি? ওই আলোর থামটা পর্যন্ত।
-পাগল হয়েছিস!
-ছোট না। রাস্তা তো ফাঁকা। চিকেন রোস্টটাও হজম হবে, একসারসাইজও হবে।
-পুলিশে ধরবে।
-ঘেঁচু করবে।
বলেই ছুট লাগাল অমল। অনেক দূরে গিয়ে থামল। সেখান থেকেই চীৎকার করে ডাকল চিনুকে। জোরে হেঁটে চিনু ওকে ধরল।
-গেঁতো মেরে গেছিস।
-কোন মানে হয় না হঠাৎ এভাবে ছোটার।
-তুই বড় মানে খুঁজিস।
আর কথা বলল না অমল। এবার দুজনের রাস্তা আলাদা হবে। চৌমাথাটায় দাঁড়িয়ে চিনু দেখাল গাড়িবারান্দার তলায় একটা ছোট্ট পরিবারকে, ছেঁড়া কাঁথা, মাটির হাঁড়ি, আর কতকগুলো টিনের কৌটো মাথার কাছে রেখে ওরা ঘুমিয়ে।
-ওই ধারেরটার অবস্থা দেখেছিস। কমাস আগে হয়েছে, আবার হবে।
-ঘুমন্ত মেয়েমানুষের চেহারা বিচ্ছিরি ন্যাদগ্যাদে লাগে।
-দিনের বেলা দেখিস, ট্রাম স্টপেজে বসে ভিক্ষে করে। এই খোলা রাস্তায়, আলো জ্বলছে, লোক চলছে, এর মধ্যেই যে কি করে এইসব হয় ভেবে পাই না।
ছেলেমানুষের মত মুখ করে চিনু ভাবনার সমাধান চাইল যেন অমলের কাছে। মুচকি হেসে ওর পিঠে থাবড়া মেরে বাড়ির পথ ধরল অমল।
তখন খেতে বসেছে রমা, চিনু যখন বাড়ি ঢুকল রোজকার অভ্যাসমত একবার জিগ্যেস করল, বাবা ঘুমিয়েছে কিনা। হেসে ঘাড় নাড়ল রমা। নিঃশব্দে অন্ধকার ঘরে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে, লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এসে খেতে বসল চিনু।
রোজকার মতই রান্না। মনীষ আজ চিকেন রোস্ট খাইয়েছে, তাই, ক্ষিদে নেই। ভাতগুলো নাড়াচাড়া করে, থালাটা রমার দিকে ঠেলে উঠে পড়ল।
-খেলে না যে?
-আলুখোসা, কুমড়ো খোসার চচ্চচড়ি কি আর রোজ রোজ ভাল লাগে? ও তুই খা।
-যেমন বাজার আসবে তেমনি রাঁধব তো।
-রাঁধতে জানলে ওই দিয়েই রাঁধা যায়।
-একদিন রেঁধে দেখিয়ে দিও না!
চিনুর পাতের তরকারিগুলো নিজের পাতে তুলে নিল রমা।
-ভাতগুলো জল দিয়ে রেখে দে।
অন্ধকার ঘর থেকে হঠাৎ মাধবীর গলা শোনা গেল। এখনো জেগে আছে। চিনু পান খাবার জন্য ও ঘরে আর ঢুকল না। আলো না জ্বেলে দিনেশের খাটের ধারে মেঝেয় পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
রমা শুতে যাবার আগে চিনুকে পান দিয়ে এল। তখনও সে জেগে।
দুই
-ওরা এসেছে।
কড়া নাড়ার শব্দ হতেই মাধবী ছুটে এল। পাউডার পাফটা গালে কপালে ঘষছিল রমা। অনেকদিন আগেই পাউডার ফুরিয়েছে, তবু যতটুকু পাফে লেগেছিল তাই ঘষে ঘষে মাখছিল। মাধবীর গলার স্বরে ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার মুখ।
-ওরা এসে গেছে।
চাপা সুরে আর একবার কথাটা বলেই দরজা খুলতে চলে গেল মাধবী। ঘরের দরজা ঘেঁষে, শুধু চোখটুকু বার করে দাঁড়াল রমা।
মোটাসোটা এক গিন্নী। চওড়া কস্তাপাড় শাড়ী, গয়নার থেকেও পান চিবানোর ধরনই বুঝিয়ে দেয় তার অবস্থা স্বচ্ছল। স্বচ্ছল মনে হবার আর একটা কারণ রমার মনে হল, চটি পরে হাঁটার ঢঙটুকুতে। মাধবীর থেকে বয়সে কিছু বড়ই হবে, কিন্তু মাধবী কি চটি পরে অমন নিঃশব্দে হাঁটতে পারবে! গায়ে গতরে ভারী শরীর নিয়ে একমাত্র স্বচ্ছল মানুষেরাই অমন করে হাঁটতে পারে। তাছাড়া খাটিয়ে মেয়েমানুষের গোড়ালি অমন খোসা ছাড়ান আলুর মত হয় না। ওই গিন্নীর পাশে মাধবীকে বিশ্রী লাগল রমার, কিন্তু বুলাকে তার ভাল লাগল।
সংসারে এমন এক আধটা মানুষ আছে যাদের দেখলেই ভাল লেগে যায়। মধুসূদনবাবুকে লাগত। মানুষটা কেমন কেমন যেন ছিল, সরু সিঁড়িতে মেয়েদের মুখোমুখি হলেই হুড়মুড়িয়ে নেমে গিয়ে পথ করে দিত, সারা বাড়ি এই নিয়ে হাসাহাসি করত, রমা হাসত না। অনেকদিন আগে একটা বুড়ো চিনেবাদামওলা আসত, অদ্ভুত সুরে চিনাবাদাম বলে হাঁক দিত, ছোট বেলায় বাবা যেমন করে ডাকত মাথা টিপে দেবার জন্যে! রোজ বিকেলে চিনেবাদামওলার গলার স্বর শুনতে ভাল লাগত। ওর কাছ থেকে বাদাম কেনার জন্য, অফিস যাবার সময় দিনেশের কাছে দুটো পয়সার জন্য বায়না করতেও ভাল লাগত। বাদামওলাটা একদিন দেশে গিয়ে আর ফেরেনি।
মাধবী ওদের নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল, সঙ্গে দোতলার জেঠিমা অর্থাৎ বড় বৌও আছে। বুলাকে দেখে ভাল লাগল রমার। মুখখানি ঢলঢলে, মিষ্টি মিষ্টি। বড় বৌয়ের কাছ থেকে ওর কথা সে অনেক শুনেছে, এখন কথাগুলো সত্যি বলে মনে হচ্ছে। অথচ যমুনার কথামত তার ছোট বোনকে মনে হয়নি। সংসারে এমন মানুষও আছে যাদের দেখলেই মন খিঁচড়ে যায়। কাবেরী সেই ধরনের মানুষ। ক’দিনের জন্য দিদির কাছে এসে পাড়ার সব বাড়ির কেচ্ছা কেলেঙ্কারীর খবর জেনে নিয়েছিল। চিনু ঘুর ঘুর করত যমুনার ঘরের সামনে। আর একটা লোক বড় বৌয়ের স্বামী, দেখলেই একগাল হেসে ঘাড়ে হাত রাখবে। লোকটা দিনেশের বয়সী, তবু হাতটাকে নোংরা লাগে।
ওঘর থেকে কথার শব্দ আসছে। কে কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে না। দালানে বেরিয়ে এসে কান পাতল রমা। বুলার মা কথা বলছে, চুরি চামারি করার জন্য চাকরটাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর সে মাসকাবারি দোকান থেকে আধ মন চাল নিয়ে সটকান দিয়েছে। শুনতে ভাল লাগছে রমার। বুলাকে নিজের হাতে ঘরের কাজ করতে হয় না, চাকর আছে। জেঠিমা বলেছিল, পড়াশুনোয় বুলা খুব ভাল, হপ্তায় তিনদিন মাস্টার আসে, সামনের বার সে বি-এ পরীক্ষা দেবে। সংসারের কাজ শেখার ফুরসত কোথায়! শুনে অবাক লেগেছিল। দেখতে ইচ্ছে করেছিল বুলাকে। কে যেন কথা বলল, বুলা-ই বোধহয়, মেয়ে দেখতে চাইছে। রমার মনে পড়ে গেল, এখনো তার খাবার সাজানো হয়নি। এখনি তো মাধবী আসবে তাকে নিয়ে যেতে।
মাধবীর ইচ্ছে মেয়ে দেখবার আগে মিষ্টিমুখটুকু করিয়ে দিতে। এর আগে মেয়ে দেখবার পর রমাই খাবার নিয়ে আসত। এবার মাধবীর ইচ্ছেটা বদলে গেছে। কেননা, ঠকতে ঠকতে সে এটুকু শিখে নিয়েছে, আগে মানুষকে যাহোক করে ঋণী করে ফেলতে পারলে সে অনেক কিছু বিবেচনা করে দেখতে রাজী হয়। তাই সে অনুরোধ করেছিল যাহোক কিছু মুখে দেবার জন্য। বুলা আর তার মা একসঙ্গে না না করে উঠল। তখুনি মাধবী বুঝে নিল এরাও ঠেকে শিখেছে, ভাল করে না বাজিয়ে কাউকে ঘরে তোলার কথা বিবেচনা করতে বিন্দুমাত্রও রাজী নয়। এদের রাজী করাতে হলে বুদ্ধি খাটিয়ে লড়তে হবে। মনটাকে একটুখানির জন্যেও ঢিলে দিলে চলবে না।
মাধবী খুঁটিয়ে দেখে নিল ওদের। মেয়েটির মুখের গড়ন ভালো হলেও, হাঁ-টা বড়। কথা বলবার সময় মাড়িসুদ্ধ বেরিয়ে আসে। কাঁধটা সরু, হাতের কোন ছিরিছাঁদ নেই। কথাগুলো কেমন কাঠ-কাঠ, আর স্পষ্ট উচ্চচারণের। রমার পাশে ওকে তুলনা করা যায় না। মাধবী মনে মনে অনেকখানি স্বস্তি পেল। কিন্তু মেয়ে পছন্দ করার আসল মালিক বুলা নয়, তার মা। মা-টিকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবু মাধবীর মনে হল যেন সে বুঝে ফেলেছে খানিকটা। হাতে ভর দিয়ে পিছনে হেলে বসার ভঙ্গিটি মৃত্যুঞ্জয়ের পিসীর মত। পিসী বিধবা হবার পর ভাইপোর সংসারেই আছে, দিনরাত হেঁসেলেই কাটে, দুপুর বেলাটায় অমন ক’রে ব’সে গল্প করে। রুপোর পানের বাটাটা কোলের মধ্যে যেমন আগলে নিয়ে বসেছে, তাতে যমুনাকে মনে পড়ল মাধবীর। কোথাও যাবার আগে সাজগোজ দেখাতে আসে যমুনা, তখন ব্যাগটাকে অমন করে কোলে আঁকড়ে রাখে।
চেনাশুনো মানুষকে মনে পড়েছে মাধবীর, কিন্তু তবু গিন্নীটিকে পুরো চেনা হচ্ছে না। বুলার বাবা রেলে ভাল চাকরী করত। কাঁচা পয়সা করেছে, বাড়ী করেছে। মেয়ে বৌকে দেখে মনে হয় পয়সা খরচও করেছে। মাধবীর কাছে তারা হেঁয়ালি যারা আজে বাজে জিনিসে পয়সা খরচ করে। কি দরকার বুলার লেখাপড়ার জন্য পয়সা খরচ করে, ওই রোগা মেয়ে কি চাকরী করে সংসার প্রতিপালন করবে, না করার কোনদিন দরকার ঘটবে। পয়সা আছে, ভাল ঘর-বরে পড়বে। কি দরকার পানের বাটাটা রুপোর করার, পেতলেও তো কাজ চলে যায়। এই বাড়তি খরচ করে যারা তাঁদের সত্যিই বুঝতে পারে না মাধবী। ওরা কি বোকা? মাধবী আর একবার স্বস্তি বোধ করল।
-আমার কি খুব মত ছিল নাকি! উনিই বল্লেন, শেষ বয়েসটা গঙ্গার ধারে কাটিয়ে দি, তা’ছাড়া দুবেলা মায়ের চরণও দর্শন করা যাবে’খন। ভাবলুম কথাটা মন্দ না, বয়স তো হলো, তাছাড়া জায়গাটাও বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কোলকাতার অবস্থা যা দিন দিন হয়ে উঠেছে এরপর গরু ভেড়াও আর থাকতে পারবে না। এইসব ভেবে তো মত দিলুম বাড়ি করার। ওমা, দুদিন বাস কত্তে না কত্তেই বুঝলুম কি ঝকমারিই না করেছি, তার থেকে কোলকাতায় পঁচানব্বুই টাকা ভাড়ায় বেশ ছিলুম। কথা বলার একটা মানুষ পাওয়া যায় না! এপাশে এক ষোল টাকার ভিজিটওলা ডাক্তার, ওপাশে এক পেন্সনওলা এস.ডি.ও। গাড়ি নিয়ে ওদের বৌয়েরা তো হরদম কোলকাতা আসছে আর যাচ্ছে, উনি বল্লেন একটা গাড়ি কিনি, আমি বল্লুম, না বাপু অত বড়মানুষি দেখিয়ে আর কাজ নেই।
একটানা বকে যেতে পারে মানুষটা। সরল মানুষেরাই বেশী কথা বলে। যত কুটিল ততই ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়। সরল মানুষকে বশ করতে বেশী বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। মাধবী সহজ সুরে বলল,-যেখানে চিরটা কাল কাটল, তারাই তো বেশী আপনার জন হয়।
-থাকতে থাকতে ওরাও আপনার জন হয়ে পড়তে পারে।
অপ্রস্তুত বোধ করল মাধবী। কথাটা বুলা না বলে যদি তার মা বলত তাহলে অন্যরকম শোনাত।
-তবু, বাঁধন ছিঁড়তে যেমন, গড়তেও তেমনি দেরি হয়।
-সমান সমান হলে দেরি কেন হবে!
বুলার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল মাধবী। ওর চাউনিটা ফলার মত। খচ করে যন্ত্রণা দেয়। বুলার মা জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে, ভাবখানা যেন, যত টাকা খরচ করে মেয়েকে গড়ে তুলেছে, সেই টাকাগুলোকে একসঙ্গে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। বিরক্তি লাগছে মাধবীর, কিন্তু বিরক্তি জানাবার উপায় নেই। ওদের কথায় সায় দিয়ে চলতে হবে এখন। চলতে হবে রমার মুখ চেয়ে। রমার উপরেও তার বিরক্তি হচ্ছে, ওর জন্যই তাকে মুখ বুজিয়ে ওদের কথা মেনে নিতে হবে।
গোড়ায় সে ভেবেছিল বুদ্ধি দিয়ে লড়তে হবে, আসলে এটা লড়াই করার মত কোন ব্যাপারই নয়, কেননা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লড়াই চলতে পারে না। ওদের কথায় বার্তায়, মন থেকে যে কথাগুলো উঠে আসছে তা বলার স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নিয়েছে। ওরা জবরদস্তি না করলেও জুলুম করছে। অবস্থা বিশেষে মানুষ কিছু কিছু সুবিধা পেয়ে যায়, ওরাও পেয়ে গেছে। এমন সুবিধে মাধবী জীবনে একবারও পায়নি, পাবে কিনা সন্দেহ আছে। দিনেশ গোবেচারা, ওর উপর জুলুম করে লাভ নেই। শক্ত কথা বললে মাথা নামিয়ে থাকে। একতরফা ঝগড়ায় লাভ নেই। মেয়েটা খুব সহজেই বলল, সমান সমান হলে দেরি হবে কেন। সমান হওয়া যেন মুখের কথা। ওরা যেন ইচ্ছে করলেই সমান হবে। দিনেশ কি ইচ্ছে করলেই তার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারবে? এক একটা মানুষ এক এক ধাতের হয়।
-আমিই ওনাকে বল্লুম, লেখাপড়া জানা বৌ নিয়ে কি হবে। দেখেছিতো ঘর-সংসার শ্বশুর-শাশুড়ী ফেলে হুট হুট করে এখান সেখান করে বেড়ায়। তাছাড়া মেয়েরও তো বিয়ে দিতে হবে, তখন লেখাপড়া জানা বৌ কি আর আমার সঙ্গে বসে গপ্পো করবে। তার চেয়ে, ভালো ঘরের নরম সরম মেয়ে আমাদের উপযুক্ত।
-হ্যাঁ, খোকার বৌকে তো আর চাকরি করতে হবে না।
বড়বৌ এতক্ষণ পরে কথা বলল। ও আবার বেশীক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। গোটা বাড়িটার কেউই বোধহয় পারে না, দিনেশ ছাড়া। মাধবীর চোখে পড়ল বুলা ঘড়ি দেখছে। ও ঘরে রমা কি করছে কে জানে। এরাতো কিছুই খাবে না বলছে। মিছিমিছি খাবার কিনে পয়সাগুলো নষ্ট হল।
-খোকার অফিসের পরীক্ষা। পাশ করলেই অফিসার হবে। বলছিল এখন বিয়ে করবে না। এখন বিয়ে করবে নাতো কি চুল পাকলে করবে! আর বিয়ে করলে পর পরীক্ষার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। ফার্স্ট ছাড়া সেকেণ্ড হয় নি কোনদিন, পানটুকু পর্যন্ত খায় না। সেদিন একজন ফটো পাঠিয়েছিল মেয়ের। খোকাকে দেখাতে গেলুম, বলল ওসব তোমরা দেখ, আমি কিছু জানি না। ওনার খুব পছন্দ হয়েছিল। আমার আর বুলার হয়নি, কেমন পুরুষ পুরুষ ভাব।
বুকের ভেতরটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে মাধবীর। স্বামী, পুত্র, পরিবারের উপর অগাধ কর্তৃত্বের গর্বে টসটস করছে বুলার মা। সংসার মাধবীরও আছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে এমন করে বলার সুযোগ তার হবে না। সংসার তাকে বাইরে বলার মত কিছু দেয়নি। সে ভেবেছিল বুদ্ধি দিয়ে লড়বে, ওদের বশ করবে। কিন্তু আক্রমণটা এমন দিক দিয়ে এল, যেখানে কিছুই করার নেই। সংসার তাকে একটা হাতিয়ারও দেয় নি। মাধবী বুঝতে পারে তার হার হয়েছে। লজ্জায় সারা গা জ্বলছে। এখন কিছুই করার নেই। যদি ওদের দয়া হয় তাহলে মেয়ে পছন্দ করবে।
-তাহলে মেয়েকে আনি।
-বেশি সাজগোজ করাবেন না কিন্তু।
সকলেই হাসল বুলার মার কথায়। বড়বৌ শুধু বলল,
-না, তার দরকার হবে না।
.খাবার সাজিয়ে বসে ছিল রমা। মাধবী ঢুকেই তাড়া দিল। এর মধ্যেই মুখটা চিটচিটে হয়ে গেছে। কাপড়টা গুছিয়ে নিয়ে পাফটা আর একবার ঘষলো। আয়নায় চট করে দেখে নিল কাজলের টিপটা ধেবড়েছে কিনা। ঘর থেকে বেরোবার সময় হঠাৎ মনে পড়ল, প্রথম আলাপে কাবেরী তাকে হাত তুলে নমস্কার করেছিল।
-বুলাকে নমস্কার করবো তো?
ঘাড় নাড়ল মাধবী। আটাশ বছর আগেকার কথা মনে পড়ছে। এমনি করেই ঘাড় নেড়ে মা বলেছিল, হ্যাঁ, নামের আগে কুমারী বলবি আর সবাইকে প্রণাম ক’রে সবশেষে আমায় করবি। রমাকে এসব বলার দরকার নেই, এই প্রথম ওকে দেখতে আসছে না। মাধবীকে একবারই সেজেগুজে নিজেকে দেখাতে হয়েছিল। মা, বৌদি বলেছিল মেয়ের পয় আছে। মা কবে মরে গেছে, বৌদি বিধবা হবার পর আর আসেনি।
রমার চুল টেনে কান দুটো ঢেকে দিল মাধবী। তাদের সময় এমন কান বার করা চুল বাঁধার ফ্যাসান ছিল না। আলতা দেয়নি পায়ে, এর আগেও কোনবার দেয়নি। শুভ কাজেই আলতা পরে। আলতায় লক্ষ্মীছিরি আসে। রমার পায়ের পাতা খুঁটিয়ে দেখল সে। খড়ম পা। নখ কাটেনি অনেকদিন। এখন আর কাটার সময় নেই।
-পা ঢেকে বসবি।
ঘাড় নাড়ল রমা। কোনবার মাধবী পা ঢাকবার কথা বলে নি। তা নিজের পায়ের দিকে তাকাল। থ্যাবড়া, বেঁটে আঙুলগুলো, গোড়ালী চিড় খেয়ে ফেটে গেছে। বোকার মত মাধবীর মুখের দিকে তাকাল সে। আলতা পরে নি ভালই করেছে, তাহলেই ওদের নজর টানত। মাধবী নিঃশ্বাস ফেলল জোরে। আজকাল আর কেউ লক্ষ্য করে না শুভ আচার নিয়মগুলো মানা হচ্ছে কিনা। ভালোই হয়েছে।
-চল।
বুলার হকচকানি ভাবটুকু দেখে মজা লাগল রমার। খুব যেন অবাক কাণ্ড ঘটেছে। কাবেরী যখন নমস্কার করেছিল, তখন কেমন যেন অস্বস্তি লেগেছিল কিন্তু অমন তাড়াহুড়ো করে সে বুকের কাছে হাতদুটো মুঠো করেনি। আঙুলগুলো সরু, কড়ে আঙুলের নখ রঙ করা। তাছাড়া আর সবই তো মেয়েলি।
-বসুন।
বুলা সরে ব’সে খাটের একধারে জায়গা করে দিল রমার জন্য।
-বোসো।
বুলার মা বলল। খুশি হল মাধবী। সভ্যতা ভদ্রতায় রমা পাশ করা মেয়েদের থেকে কম নয়। মনের মধ্যে জ্বলুনিটা কমে এল। ভরসা আসছে, সাহস দিচ্ছে মনটা। নয়, অপছন্দ করল, তবু আড়ালে ওরা রমার নিন্দে করতে পারবে না। মেয়েরও না, মায়েরও না। সংসারের খাটাখাটনিতে রঙটা ময়লা হয়ে গেছে, নয়তো এত কালো রমা ছিল না। কালকেই ব্যাসন মাখিয়ে মুখটা পরিষ্কার করে দিতে হবে। নরম গলায় মাধবী বলল।
-ভালো করে উঠে বোস।
কাপড়ে পা ঢেকে বসল রমা। সকলে এখন তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। কেউ কথা বলছে না। এর আগের বারগুলোতেও এমনি হয়েছে। এই সময়টুকুই ভীষণ খারাপ লাগে। মানুষগুলো মনে মনে তখন তার সম্বন্ধে কি ভাবে কে জানে। এই একটু সময়ের ভালো লাগা মন্দ লাগা দিয়েই তো পছন্দ-অপছন্দের বিচার হবে। কিন্তু পছন্দ করুক আর নাই করুক, সকলে চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে ভালোমন্দ যা হোক কিছু একটা ভাবছে, তাই ভাবলেই তো বুকের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ভার ভার ঠেকে। বিচ্ছিরি লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ে। রাগ করে নিজের ওপর, সকলের ওপর। প্রাণপণ ইচ্ছে হয় চীৎকার করে, লণ্ডভণ্ড করে ছুটে বেরিয়ে যেতে, অন্ধকার সিঁড়ির কোণে ব’সে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে। কিন্তু ইচ্ছেটা যেমন ঝট করে হয় তেমনিভাবেই চলে যায়। পরে আর কিছু মনেই থাকে না। কাবেরীকে দেখে মনে হয়েছিল ঠিকমত লেখাপড়া করলে এতদিনে বি-এ পাশ করে যেতুম। ইচ্ছে হয়েছিল বইপত্তর নিয়ে লেখাপড়া শুরু করতে। ইচ্ছেটা দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ছিল। তারপর কাজের ঝঞ্ঝাটে কি যে হয়ে গেল! এমন কত ইচ্ছে সারাদিনে মনের মধ্যে তৈরী হয়, সব কি পূরণ করা যায়! এখন যদি জানা যেত বুলা তার সম্বন্ধে কি ভাবছে।
রমার নাকের ডগা ঘেমে উঠল, কানের গোড়া গরম লাগছে। আর আশ্চর্য, ক্ষিদে পাচ্ছে। শরীরের ভেতরটা যেন ফুলে ফুলে উঠতে চাইছে, গান ধরছে, আঙুল কাঁপছে। আগুনের মত গরম চা যদি খাওয়া যায় তাহলে হয়তো কমবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে পেটের মাংসগুলো কুঁকড়ে, থরথর করে কাঁপছে। শায়ার দড়িটা আরো শক্ত করে বাঁধলে এই কাঁপুনিটা কমবে বোধ হয়। ওরা কেউ কথা বলছে না, তার মানে খুঁটিয়ে দেখছে। বুলার ব্যাগটা কি মাদুর দিয়ে তৈরী! কাবেরীরটা উড়েদের বটুয়ার মত দড়ি বাঁধা। দেখে হাসি পেয়েছিল। বুলারটায় হাসি পাচ্ছে না। ওদের দু’জনের মধ্যে অনেক তফাত। বুলা কত সাদাসিধে। অনেক লেখাপড়া করেছে। ও নিশ্চয় পটের বিবি সেজে, গল্পের বই নিয়ে জানলার ধারে বসে থাকে না। চাকরির জন্যেই তো লেখাপড়া শেখা। বুলা চাকরি করবে, টাকা রোজগার করবে, ওর বাবার তো অনেক টাকা আছে, তবুও কি চাকরি করবে? কেন করবে না, বাইশ নম্বরে যে ভাড়াটেরা এসেছে, তাদের বাড়ির ছেলেবৌ সবাই রোজগার করে। অনেক টাকা রোজগার হয় ওদের সংসারে, টাকা না হলে কি সুখ আসে। বুলা নিশ্চয় রোজগার করবে, সুখী হবে। সুখী হ’তে তো সবাই চায়। টাকা আছে ওর ব্যাগটায়। তাড়া তাড়া নোট! মুঠো মুঠো পয়সা। কাবেরীর থলেটায় থাকে রুমাল আর খুচরো ক’টা পয়সা। বুলা নিশ্চয় পুরুষ মানুষের মত অফিস করবে দশটা পাঁচটা। রমার চোখ পড়ল বুলার ঘড়িতে। কতোটুকু ঘড়ি, সময় দেখে কি করে? কালো কাপড়ের পটিটায় সুন্দর দেখাচ্ছে কব্জির গড়ন। হাতে একগাদা চুড়ি নেই, ভালোই দেখাচ্ছে বালাটা। সরু হাত!
-চুপচাপ যে, যা জিগ্যেস করার করো।
বড়বৌ এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দুশ্চিন্তা মাধবীর থেকেও তার বেশি। পয়সাওলা ভাজ আর ভাইঝি সহজে তার কাছে আসে না। বাড়ির অনেকেই তার দাদার সংসারের গল্প শুনেছে। সেই সংসারের মানুষজনকে এনে এ বাড়ির সকলকে দেখানর সাধ তার অনেক দিনের। রমার কথা সাত কাহন করে বলে ওদের সে এ বাড়িতে এনেছে। রমাকে ছোট থেকে দেখেছে। মেয়েটা নরম স্বভাবের। লেখাপড়া না শিখলেও গেরস্তালি শিখেছে, উঁচু কথা শেখেনি। যে কোন ঘরে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। বাপ মায়ের সেই সঙ্গে বড় বৌয়েরও মান রাখতে পারবে। নিশ্চিন্ত ছিল বড়বৌ কিন্তু বুলার মায়ের কথায় বার্তায় এখন দুশ্চিন্তা দেখা দিল। বিয়ের আগে, বাপের বাড়ির সংসারে বড়বৌ যাকে জানত, এখন সে মানুষটার চালচলন কেমন দূরের হয়ে গেছে। তখন দাদা সামান্য কেরানীমাত্র ছিল, তারপর ধাপে ধাপে উন্নতি করেছে। কিন্তু তখন আর বড়বৌ বাপের বাড়িতে নেই। শ্বশুরবাড়ি থেকে সে আঁচও করতে পারেনি যে তার দাদা বড়মানুষ হয়েছে। মাঝে মধ্যে বেড়াতে গেছে, মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছে, মানুষগুলোর পরিবর্তনটা চোখে পড়েনি। এখন নিজের হাভাতে আওতার মধ্যে বড়বৌয়ের চোখ খুলছে।
-চুল দেখেছ কেমন, বলেছিলুম যা মিলিয়ে দেখ, সত্যি কিনা।
বড়বৌ রমার খোঁপাটা খুলে দিল। পিঠের উপর বেণীটা ঝুলে পড়ল। হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল বুলার মা আর ব্যাগটা কাছে টানল বুলা। রমার মনে হ’ল, অমন করে ব্যস্ত হ’য়ে সেও জলের ঘটিটা টানে যখন উনুনে ডাল পোড়ার গন্ধ বেরোয়।
-চুল বুলারও ছিল।
বুলার মার সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখ পড়ল বুলার দিকে।
রমাও মুখ তুলে দেখল। হাসল বুলা। হাসিটা শুকনো।
-কি করবো যা চুল উঠতে শুরু করেছে, মাথায় চিরুণী দিতে ভয় হতো।
বেশ সহজ সুরে হেসেই কথাগুলো বুলা বলল। ওর মা রাগের মাথায় তার উত্তর দিল।
-উঠবে না তো কি! সময়ে খাওয়া নেই, শোওয়া নেই। দিন দিন শরীরের যা হাল হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর কথামত গাদাখানেক ওষুধ এসে পড়েই আছে, খাওয়ার সময় আর হয় না।
-শরীর না সারলে কিন্তু বিয়ে হওয়া মুশকিল। বরের পছন্দ হবে না।
বড়বৌয়ের কথায় হাসল বুলা। হাসল সকলেই।
মাধবী এখন খুশী। মুখটুকু যতই সুন্দর হোক, সুন্দরী তাকেই বলে সব এড়িয়ে যাকে দেখতে ভালো লাগে। রমা সুন্দরী না হলেও লক্ষ্মীছিরি আছে। ওকে সামনে রেখে এখন ঘা দেওয়া যায়।
লেখাপড়াটাই তো সব নয়। আগে শরীর দেখতে হবে মা। শরীরই যদি গেল তা’হলে বিদ্যে দিয়ে কি হবে।
পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই ভাবছি মাসখানেক ওকে পাহাড়ে কোথায় পাঠিয়ে দোব। ওর এক বন্ধুর বাবা ইঞ্জিনিয়ার। পাঞ্জাবে থাকে, বেশ মোটা মাইনে পায় প্রায় দেড় হাজার, আমি তো বলেছি পরীক্ষাটা দিয়ে তোরা দুই বন্ধুতে চলে যা।
মাধবী চুপ করে রইল। বড়বৌ জুল জুল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল রমা আর মাধবী কেমনভাবে কথাটা গ্রহণ করল।
তোমার নন্দাই এবার পুজোর ছুটিতে মধুপুর যাবে ঠিক করেছে। অপিসের একজন দিন পনরো থেকেই নাকি হজমের গোলমাল সারিয়ে এসেছে।
-কোথাও গিয়ে যে হজমের ব্যায়রাম সারে এ কথা বাপু আমি বিশ্বাস করি না। খাঁটি জিনিস খাও, কোন অসুখ বিসুখের বালাই থাকবে না।
চুপ করে রইল বড়বৌ। সায় দেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। অবশ্য উত্তর একটা দেওয়া যায়, খাঁটি জিনিস আর কোথায় পাব? তা হলেই কথা বাড়বে। টাকা ফেললে বাঘের দুধ মেলে। সেই আবার টাকার কথার মত আসা। দরকার কি ওপথে যাবার। তার থেকে বরং পাত্রী দেখার প্রসঙ্গটুকু চলুক।
-কিগো বুলা, তুমি যে একেবারে চুপ?
সরু গলা খাঁকারি দিয়ে বুলা হাসল। তাকাল রমার মুখে। তারপর বড় বৌকে লক্ষ্য করেই বলল,
-গান জানে?
-ওইটি বাপু বলো না। এত মিষ্টি গলা, ওর মাকে কদ্দিন বলেছি মেয়েটাকে গান শেখাও, ওই তো সান্যালদের মেয়েটা কি ক্যারকেরে গলায় রেডিওয় গান গেয়ে মাস্টারি করে দিব্যি রোজগার করছে, বিদ্যে তো ঢুঁ ঢুঁ।
-দিন কতোক বুলারও বাতিক হল গান শিখব। মাস্টার রাখা হল। তারপর যা হবার তাই, মেয়ে বলল-ভাল লাগছে না।
বুলার মা মাধবীর দিকে তাকাল। মাধবীর মুখ কঠিন হয়ে গেছে। এ ঘরে যদি রমার বিয়ে হয় তাহলে মেয়ে সুখী হবে না। এরা উঠতি বড়লোক, নতুন সুখের মুখ দেখেছে, নতুন ধরনের কথাবার্তায় এদের আনন্দ। কিন্তু মনটা সেই ভাড়াটে বাড়ির মতই রয়ে গেছে। চট করে তো আর মনটাকে পাল্টে ফেলা যায় না, কিন্তু পাল্টাবার চেষ্টাটা খুব। তাই নতুন আর পুরোনোয় টানাটানি চলে যতক্ষণ না সম্পর্কটা ছিঁড়ে যায়। কিন্তু এ সম্পর্ক কি এক পুরুষে ছেঁড়ার? মধুসূদনবাবু বনেদী বড়লোকের ঘরের ছেলে। মাধবীর মধুসূদনকে মনে পড়ল এখন। ডালওলা একদিন নাকি দামের জন্য সামান্য গলা চড়িয়েছিল, তাই ক্ষেপে গিয়ে জুতো মেরেছিল। সারা বাড়ি অবাক হয়ে গেছল ওর পাগলামি দেখে। পাগলামি ছাড়া আর কি। নগদ দামে শুধু এ বাড়ি কেন, পাড়ার ক’জনই বা জিনিস কিনতে পারে। মিষ্টি কথায়, মিথ্যে কথায় ফিরিওয়ালাদের খুশি করে, আস্তে আস্তে দাম শোধ করতে হয়। গরীব হয়েও মধুসূদনবাবুর মান অপমান জ্ঞানটা টনটনে ছিল। পুরোনো সম্পর্কের বাঁধনটা একেবারে ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি। আমাকে যারা দেখতে এসেছে তারাও পারেনি। এই দোটানার সংসারে আমার মত মেয়েরা শুধু নিজের দুঃখ বাড়ায়। কি হবে মেয়েটাকে সারা জীবন অসুখী করে। তার চেয়ে এরা তাড়াতাড়ি বিদেয় হোক।
-তোমার নাম ঠিকানাটা একটু লিখে দাও তো মা।
রমা এই প্রথম বুলার মার চোখে চোখ রাখল। এতক্ষণ মাধবীর হাজা ঘা-পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকে গা ঘিন ঘিন করছিল। বেশ টসটসে ফরসা গাল, অল্প লোম নাকের নিচে, কানে মুক্তোর ফুল, হাসিখুশি মুখটা। লেখবার যা কিছু সরঞ্জাম ওঘরে। সানু ছাড়া এ সংসারে আর কারুর বিশেষ দরকার হয় না লেখার। দিনেশের একটা কলম আছে, সেটা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। সে এখন অফিসে। সানুর কলম নেই, পেন্সিল আছে। সানু এখন স্কুলে। রমা মুখ শুকিয়ে তাকাল মাধবীর দিকে। কেমন থমথমে যেন মুখটা। আর দেরি না করে রমা উঠে পড়ল।
হাতের লেখা আর অঙ্কের জন্য কালি দরকার হয় সানুর। বড়ি গুলে স্নো’র শিশিতে কালি তৈরি করা আছে। শিশিটা রমা মধুসূদনবাবুর মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল। শিশির অবস্থা দেখেই বুক শুকিয়ে গেল রমার। সেটাও শুকনো। জল দিয়ে কালি তৈরী করে নিল। কলমের হাতলের মাথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। ওরা দেখলে কি মনে করবে। এখন ছুটে গিয়ে যমুনার কাছ থেকে ফাউণ্টেনপেন আনা যায়। তা হলে ওঘরের সামনে দিয়েই যেতে হবে। ওরা দেখতে পাবে। যা করা যাবে না তা নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই। সানুর একটা খাতা নিয়ে রমা ওঘরে গেল।
জল বেশি পড়েছিল। কালিটা এত পাতলা লেখা পড়া যায় না। বুলা ব্যাগ থেকে তার কলমটা বের করে দিল। শুধু নিজের নয়, বাবার নামটাও লিখতে হল। ইংরেজীতে রমা নিজের নামটা লিখতে পারল। শুধু লেখা কাগজটা পাট করে বুলা ব্যাগে রাখল।
এরপর আর বেশিক্ষণ থাকেনি ওরা। বড়বৌ ওদের নিয়ে গেল, অন্য ভাড়াটেদের দেখাবার জন্য। সঙ্গে মাধবীও গেল। দেখার জন্য রমা দরজার পাল্লাটা ফাঁক করে উঁকি দিল। উঠোনের এক কোণায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যমুনা, হাতে ছাই, পোড়া কড়াইটা প্রায় ঝকঝকে হয়ে এসেছে। হাত নেড়ে বড়বৌ বুলাদের কি যেন বলল। যমুনা হাসল। চটপট করে ধুয়ে ওদের নিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল।
বিকেলে ছাদে গেল না রমা। কড়িকাঠের কোণায় যে এতদিন ঝুল জমে উঠেছে, হঠাৎ এখন চোখে পড়ল তার। ছবিগুলো বেঁকে আছে মনে হল। দালানে কয়লা রাখার জায়গাটা যদি ইঁট দিয়ে ঘিরে দেওয়া যায় তাহলে মন্দ দেখাবে না। বাজারের থলিটা অন্য কোথাও টাঙিয়ে রাখলে ভাল দেখাবে। গামছাগুলো আজকেই সেদ্দ করতে হবে। সংসারটাকে উলটে পালটে নতুন করে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছেটা আজই প্রথম মনে এল রমার। ইচ্ছে কখনো ফেলে রাখতে নেই। তাহলে কোনদিনই পূরণ হবে না। সারা বিকেল রমা ব্যস্ত রইল।
মাঝে মাঝে জ্বর ভাব হয় মাধবীর। তখন মেজাজটা বিগড়ে যায়। বিকেল থেকে তার শরীর খারাপ। আটা মাখতে গিয়ে বেশি জল দিয়ে ফেলেছে রমা। বরাদ্দের থেকে কিছুটা বেশি আটা মিশিয়ে সামলানোর চেষ্টা করায় মাধবীর মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ঘরে তখন দিনেশ বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। রমার হাত থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে নিজের মনে গজগজ করে মাধবী।
-কি করে যে সংসার চালাই তার খবর তো কেউ রাখে না। ছেলেরা মানুষ হচ্ছে কি না, মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করা, সব এ মাগীকেই করতে হবে। আর উনি গায়ে ফুঁ দিয়ে বই পড়বেন।
জুতো পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দিনেশ।
-যাচ্ছ কোন চুলোয়?
জবাব পেল না মাধবী।
-বলি, কথা বলতে পার না, মুখে কি কুড়িকুষ্ঠ হয়েছে?
-মহিমের কাছে যাচ্ছি।
দরজার খিল খুলল দিনেশ। ও যখন খোলে তখন শব্দ হয় না। সুর পালটে মাধবী বলল।
-ওকে ব’লোনা একটা ছেলে দেখে দিতে। কত তো দেখে গেল। শেষ পর্যন্ত শোনার জন্য দিনেশ দাঁড়িয়ে থাকে নি। প্রত্যেকটা কথা তার কানে গেছে। এমন কথা মাধবী রোজই বলে। আজ বিচ্ছিরি মনে হল রমার। সানু পড়ার নামে ঢুলছিল। সারাদিন বাইরে হুটোপাটি করে, সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসার সময়ই যত রাজ্যের ঘুম ওর চোখে নামে। রমার চড় পিঠে পড়তেই চমকে উঠল সানু। হতভম্ব ভাবটুকু কাটিয়ে লাথি ছুঁড়ল। লাগল না।
-মারলি কেন?
-মারব না? পড়াশুনো নেই, শুধু ঘুম! কালি নেই, কলম নেই, ইস্কুলের কি পড়া করিস? কালকেই দাদাকে খোঁজ নিতে পাঠাব।
কুঁকড়ে গেল সানু। যমুনাও বলাদের দেখে কুঁকড়ে গেছল। সানুরটা ভয়ে, কিন্তু যমুনারটা? রমা পায়ে পায়ে উনুনের কাছে এল। মাধবী রুটি বেলে রেখেছে, দেরী করলে জড়িয়ে যাবে। তখন বিচ্ছিরি সুরে চীৎকার উঠবে। আজকেই হঠাৎ চীৎকারটাকে কেন ভয় করছে? সানু কিংবা যমুনার মত মনটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। যমুনা লজ্জা পেয়েছিল। রমার মনেও কেমন যেন লজ্জা করছে।
সাবধানে পাট খুলে তাতানো চাটুতে রুটি রাখল রমা। খুন্তিতে ওলট পালট করল। মনের মধ্যেও কত কি জড়িয়ে রয়েছে। সেগুলোকে যদি আলাদা করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা যায়! রুটিতে শুকনো ঘায়ের মত পোড়া দাগ ধরেছে। তাড়াতাড়ি চাটুটা রমা নামিয়ে রাখল। বেশি চিন্তাভাবনা করলে লোকসান বই লাভ নেই। সেঁকা রুটি উনুনে রাখল সে। টসটসে হয়ে ফুলে উঠল রুটিটা।
রাত করে বাড়ি ফিরল দিনেশ। খাওয়ার পর ঘুমের তোড়জোড় শুরু করছে, তখন মাধবী কাছে এল। দিনেশ জানে মাধবী এবার কি বলবে। খুব আস্তে আস্তে কথা শুরু করবে। তাই শুনে মনটা খুশি হয়ে উঠবে। দুটো-চারটে হাল্কা কথা হবে। এটাসেটা থেকে সংসারের কথা আসবে। ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে নালিশ উঠবে। খুঁটিনাটি অভাব আর পাওনাদারদের বলে যাওয়া কথাগুলো আবার শুনতে শুনতে অসহ্য বোধ হবে। আর তখনই সরু গলায় সুরটাকে চেপে গালাগাল দেবে অদৃষ্টকে। বিটকেল শোনায় তখন ওর স্বর। চীৎকার যে ধরনেরই হোক, আসলে ওটা নোংরামি। নোংরামিকে দিনেশ ভয় করে। ঝগড়াঝাটিগুলো আসে অভাব থেকে। অভাব শুধু খাওয়া-পরারই নয়, মানসিকও। রবীনকাকার অবস্থা ভাল। লেখাপড়া জানা সংসার। তবু ঝগড়া হয়। ওর ছেলে-বৌ আলাদা সংসার পাততে চায়, তাই নিয়ে ঝগড়া। কিন্তু এমন গলা চড়িয়ে ওরা কথা বলে না! ওই ধরনের কথা বলাকে মাধবী হয়তো বলবে তর্ক করা। তাই করুক না মাধবী। কিন্তু তর্কে, যুক্তির দরকার। মাধবী যুক্তির ধার ধারে না, বেশ কিছু তলিয়ে বুঝতে চায় না। শুধু আঘাত দিতে চায়, নোংরামি চায়। শুনতে কষ্ট হয়, এই কষ্ট বোঝার ক্ষমতাটাও মাধবীর লোপ পেয়েছে। অথচ সে আগে কত বোঝদার ছিল।
কিন্তু মাধবী কেন ধীরে সুস্থে কথাবলার ক্ষমতাটা হারালো? আজকালকার কথা শুনলে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চেঁচামেচি করলে তো চেঁচামেচি বন্ধ করা যায় না। তখন নিজের গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তাতেও সাহসের দরকার। আশ্চর্য, সে সাহসটুকুও নেই। নিজেকে নিজে খুন করার আগে ভাবনা চিন্তা করতে হয়। তাতেও যুক্তি দরকার হয়। মল্লিকবাড়ির বৌটা পুড়ে মরার আগে চিন্তা করেছিল। না হ’লে চিঠিতে কেন লিখল তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। স্বামীটাকে বাঁচিয়ে গেল। দিনেশকেও ভাবতে হয়, সে মরলে আর কেউ কি বাঁচবে? ছেলেমেয়েগুলো ভেসে যাবে। মাধবীকে ভিক্ষে ক’রতে হবে। তা ছাড়া মরলেই তো সব ফুরিয়ে গেল। এই শরীরটা, মনটা, জন্ম থেকে এই পর্যন্ত গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতাটা। তার মধ্যে আছে মা’র আদর, বাবার শাসন, সতরো-আঠারো বছরের রোমাঞ্চ, বিয়ের প্রথম দু’টো বছর, চিনুর মুখে প্রথম কথা শোনা। আরো আছে-দুঃখ, বেদনা, ভয়। সব জড়িয়ে তিল তিল গড়ে উঠেছিল যে মানুষটা, তাকে এক নিমেষে শেষ করে দেওয়া কি সোজা ব্যাপার! ভাবতেও যন্ত্রণা হয়। অথচ বেঁচে থাকাটাও যন্ত্রণার। এর মাঝামাঝি আর কি করার আছে?
-গেছলুম মহিমের ওখানে। সব কথা বললুম, বললো খোঁজ পেলে জানাবে।
-কি জানাবে?
-রমার পাত্তর।
দিনেশ অবাক হ’ল, মাধবী যেন অন্য কিছু ভাবছে। হয়তো অন্য কথা বলতে এসেছে।
-গেছলে যখন, হাতটা দেখিয়ে এলে না কেন?
-কি হবে?
-কি আবার হবে, জানতে ইচ্ছে করে না ভবিষ্যতে কি ঘটবে? গ্রহ-চক্রের ফেরের কথা কিছু কি বলা যায়। জ্যোতিষীর কথা শুনে কানাই স্যাকরা তো বাড়ি হাঁকিয়েছে, লটারির টিকিট কিনে।
-জ্যোতিষীর পরামর্শেই কানাই লটারির টিকেট কিনেছিল একথা কে বললো? হতে পারে তখন ওর দুটো টাকা খরচ করার মত খোশ মেজাজ ছিল, কিংবা তখুনি শুনেছিল কোন লোকের লটারিতে টাকা পাওয়ার গল্প। তাছাড়া এও হতে পারে লটারির টিকিট বিক্রিওলার মুখ দেখে ওর দয়া হয়েছিল কিংবা ঝামেলা এড়াবার জন্য কিনে ফেলেছিল। জ্যোতিষীর গণনা যে অভ্রান্ত তার প্রমাণ কি লটারি জেতা দিয়ে বোঝা যায়?
-তাহলেও ভবিষ্যৎ জানতে তো ইচ্ছে করে।
-ওরা তো ভাল ছাড়া মন্দ বলবে না।
দিনেশকে হাসতে দেখে মাধবী অপ্রস্তুত স্বরে বলল,-ভাল শুনলেও তো মনে খানিকটা জোর পাওয়া যায়।
এমন কথা বিশ্বাস করে না দিনেশ। ভোটের আগে অনেকেই ভাল কথা বলেছিল। কিন্তু সেই ভাল ভাল কথাগুলো ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন দেশের মানুষ ভুলে গেছে। দেশে শিক্ষা বিস্তার কিংবা বেকার সমস্যার সমাধান নিয়ে দিনেশ মাথা ঘামায় নি। শুধু একটা ভরসা চেয়েছিল, চোখ বুজলে সংসারটা যেন ভেসে না যায়। কিংবা বুড়ো বয়সে অথর্ব হয়ে পড়লে না-খেয়ে মরতে না হয়। এইটুকুর জন্যই ভোট দিয়েছিল সে। কিন্তু আজও আশপাশের মানুষজনের হাবভাব কি, কথায় বার্তায় একমুহূর্তের জন্যও নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না। মাধবীও বোঝে তার ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। যদি না বুঝত তাহলে মাঝে মাঝে এমন করে ক্ষেপে ওঠে কেন? কিন্তু ওর ক্ষ্যাপামিটা ভুল লক্ষ্যের দিকে। নয়া পয়সা নিয়ে গোলমাল হলে যাত্রীরা যেমন ওপরওলাদের কাছে প্রতিকারের দাবী না জানিয়ে নিরীহ কণ্ডাক্টারদের মারধোর করে, এও তেমনি। আসলে মাধবী যুক্তি দিয়ে বিচার করে না। তাহলে তো সে বুঝতে পারত সংসারে এই দৈন্যদশার জন্য দিনেশের কোন হাত নেই।
-কথা বলছ না যে, কি ভাবছ?
চমকে উঠল দিনেশ। তাকাল মাধবীর দিকে। থুতনির নিচের মাংস কে যেন খুবলে নিয়েছে। চোয়ালের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কণ্ঠার হাড় দুটোর মাঝে গর্ত। চুল উঠে গিয়ে কপালটা বেখাপ্পা উঁচু দেখাচ্ছে। চোখদুটো ড্যাবড্যাবে। থ’ হয়ে তাকিয়ে রইল দিনেশ। এই মাধবীকে যদি ভালো ভালো কথা শোনান যায় তাহলে কোত্থেকে ও জোর পাবে? ওকে তো শুষে নিয়েছে। ভাল কথার রসে ওর শরীর কিংবা মনের স্বাস্থ্য ফিরবে না। শরীরের স্বাস্থ্যেই তো মনের স্বাস্থ্য।
অথচ এক সময় ছিল যখন টসটস করত মাধবী। ঝগড়া ক’রত, মুখ সরিয়ে নিত। সকালে নাকি মুখ দেখাতে পারে না। সারা গালে ছোপ ধরে থাকত জমে-ওঠা রক্তের। দিনেশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এই কি সেই মানুষটা! টানাটানা, ভাসাভাসা চোখদুটোর কি হাল হয়েছে! তখন মাইনে কম ছিল, তবুও দাদা, বাবা বেঁচেছিল, তাই সংসারের আঁচ তেমন গায়ে লাগত না। হাঁড়ি এক হলেও, সাধ-আহ্লাদের খরচগুলো ছিল যে যার নিজের। দুটো মানুষের তাতে স্বচ্ছন্দে কুলিয়ে যেত। তারপর সন্তান জন্মাল। সাধ-আহ্লাদের খরচ কমাতে হ’ল। সংসারে ছোটখাট ঝগড়া দেখা দিল। ঝগড়া যাতে পাকাপাকি বন্ধ হয় তাই দিনেশই একদিন কথা তুলল নিজেদের ছোট্ট একটা আলাদা সংসারের। শোনামাত্র মাধবীর সেকি চনমনানি! যেন সত্যিসত্যিই তার আলাদা সংসার হয়েছে। জমির দাম তখন সস্তা ছিল। প্রত্যেকদিনই মাধবী তাড়া দিত। কিন্তু জমি কিনে বাড়ি তোলার টাকা কোথায়? মাধবী সেই প্রথম গুম খেয়ে যায়। তখন থেকেই সে অল্পে চটে উঠতে শুরু করে।
কিন্তু জমি দেখা বন্ধ করে নি দিনেশ। কেমন নেশার মত হয়ে গেছল ব্যাপারটা। খবর পেলেই ছুটে যেত। দর দাম করত। বাড়িতে এসে হিসেব করত। নির্বিকার হয়ে মাধবী শুনে যেত।
আজকাল আর মাধবী চুপ করে থাকে না। কথার পিঠে কথা বলে, চেঁচায়, কেঁদে ওঠে। তখনকার নির্বিকার মাধবীকে দেখে ভয় হত। মনে অস্বস্তির যন্ত্রণা ধ’রত। নিজেকে ছোট মনে হ’ত। বাড়ি করা হয়নি, তার বদলে বাপ, দাদার সংসার থেকে আলাদা হয়ে ভাড়াবাড়িতে উঠতে হয়েছে। মাধবী তা’তেই খুশি হয়েছিল। হাসত, বায়না ধ’রত, আবার হিসেব ক’ষত খরচ কমাবার। সুখের দিন গেছে সেই সময়টা।
-ভাবছি, সেই দর্জিপাড়ার বাড়ির কথা। ও ঘরের আয়নাটা ওখানে উঠে গিয়েই কেনা হয়েছিল। এই খাটটাও।
হঠাৎ একথা বলল কেন দিনেশ! মাধবী অবাক হ’ল। সে তো কবেকার কথা! পুরনো কথা মনে পড়ে যখন মরণ ঘনিয়ে আসে। মাধবী তাকাল দিনেশের মুখে। চুলগুলো পাতলা হয়ে গেছে। মাথার বাদামী চামড়া দেখা যায়। চোখ দুটো ঘোলা ঘোলা। ঢেউয়ের মত গুটিয়ে এসে চোখের কোলে চামড়া জমেছে। বয়স হয়েছে দিনেশের। ও আর বেশিদিন বাঁচবে না। বুকের মধ্যে চিড়িক ধরল মাধবীর। ভয় করতে শুরু করেছে। দুনিয়ায় এই একটা মানুষ যার কথা সে ভাবে, আর যে তার কথা ভাবে। এই মানুষটাই থাকবে না। বুলাদের দেখে যমুনার জড়োসড়ো ভাব আর ঘরে নিয়ে গিয়ে তাদের বসাবার মধ্যে যে কাঙ্গালপনা ছিল, তাই দেখে জ্বলে উঠেছিল মাধবী। যমুনা যেন গোটা বাড়িটাকেই অপমান করেছে ওদের বেশি খাতির দেখিয়ে। অবস্থা ভাল হলে যমুনা নিশ্চয় তাকেও খাতির করত। আর তখনই মাধবী তার দুরবস্থার জন্য দিনেশকে দায়ী ক’রে অভিশাপ দিয়েছিল মনে মনে। অথচ তখন যদি সে বুঝত দিনেশের বয়স হয়েছে, সে আর বেশিদিন বাঁচবে না, তাহলে কি শাপমণ্যি করত!
-তোমার বালিশটা বড় পাতলা। অসুবিধে হয় না শুতে? মোটা বালিশ ছাড়া তো শুতে পারতে না!
খুশি হল দিনেশ। মাধবীর মনটা ভালো হয়ে আসছে। ভালোই হয়েছে ওকে সুখের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে। চারপাশের কষ্টের চাপে প্রাণ যখন হাঁপিয়ে ওঠে তখন পুরনো দিনের সুখকে সম্বল করা ছাড়া গতি কি! মনটাকে অনেক বছর হাঁটিয়ে পিছিয়ে নিতে হয়। অনেক কিছু দেখতে দেখতে যায়। পথের আনাচে কানাচে কত হীরে, মুক্তো পড়ে আছে!
-অসুবিধে হয় বৈকি। মাথা থেকে বালিশ সরে গেলে আগের মত যে আর কেউ বালিশ ঠিক ক’রে দেয় না।
স্নেহ চায়। জীবনের কামনা বাসনাগুলো মানুষ মেটাতে চায় যখন বুঝতে পারে আর সে বাঁচবে না। মাধবী হাত রাখল দিনেশের কাঁধে। যৌবনের দিনকে ফিরে চায়। অনেক দুঃখ কষ্ট পাওয়া মানুষের এই একটাই তো বেঁচে থাকার ভরসা। দিনেশ আঁকড়ে ধরল মাধবীর হাতটা।
-আমার বালিশ নিয়ে যে হঠাৎ দুর্ভাবনা হল?
-তোমারই বা হঠাৎ দর্জিপাড়ার বাড়ির কথা মনে এল কেন?
মাধবীর গালে হাত রাখল দিনেশ। চোখ বুজল মাধবী। সিরসির করে তার গোটা শরীর। বুলারা চলে যাবার পর বড়বৌকে জিগ্যেস করেছিল মেয়ে-পছন্দ সম্পর্কে ওরা কিছু বলেছে কিনা। মুখ কালো করে বিরক্তিতে জবাব দিয়েছিল বড়বৌ, কে জানে বাপু বড়লোকদের ঠ্যাকার-ঠোকর। পয়সার গুমোরেই ফুলছে। কথাগুলো শোনার পর, মাধবীর মনের অবস্থাটা এখনকার মত হয়েছিল।
গালে হঠাৎ চাপ দিল দিনেশ। কদিন থেকেই দাঁতটা নড়ছিল মাধবীর। মুখ বিকৃতি করে দিনেশের হাতটা সরিয়ে দিল।
-শুয়ে পড়ো। আর রাত করতে হবে না।
হুবহু সেই আগের মত কথা। দর্জিপাড়ার বাড়িতে মাধবী পাশ ফিরে অন্য দিকে মুখ করে কথাটা বলত। তখন তারা এক বিছানায় শু’ত। আলোর সুইচে হাত রেখে অপেক্ষা করছে মাধবী দিনেশের শুয়ে পড়ার।
-শোনো।
মাধবী কাছে এল। মাথা নামিয়ে দিনেশ আবার মাথা তুলল। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপরই মাধবীকে দু’হাতে জড়িয়ে কাছে টানল। টাল সামলে, জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে মাধবী আলো নিভিয়ে দিল।
-সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ন্যাকামি করা পোষায় না। তা’ছাড়া লাভই বা কি বুড়ো বয়সে এইসব ক’রে। এক পা তো বাড়িয়েছ ঘাটের দিকে।
মাধবী শু’তে গেল পাশের ঘরে। ভূতের মত দিনেশ বসে রইল।
.সারাদিন খাটাখাটুনির পর শোয়ামাত্রই রমা ঘুমিয়ে পড়ে। আজও ঘুম আসছে। কিন্তু জোর করে সে ঘুমকে ঠেকিয়ে রেখেছে। বেশ লাগছে নিজেকে বুলার বৌদি কল্পনা করতে, শান্ত, পরিপাটি ঘর। করার মত কোন কাজ নেই। নেই কে বললো, শাশুড়ীর পান সাজা, চা তৈরি করা, অফিসের জামা কাপড় ঠিক করে রাখা, টুকিটাকি কাজের কি অন্ত আছে। টুকিটাকি কি রকম! কেন, সকালে দাড়ি কামাবার যোগাড়-যন্তর, ভাজা মসলা তৈরি করা, খাওয়ার সময় কাছে বসা, বড়ি দেওয়া। বড়বৌ বুলাদের সম্পর্কে যা বলল রমা এখন মনে করতে চেষ্টা করল। লোকটা খুব শৌখিন। হয়তো বলবে, চলো সিনেমায় যাই। বুলার মত একটা ব্যাগ নিশ্চয় কিনে দেবে। বুলাকে না নিয়ে কি সিনেমা দেখা ঠিক হবে? কি মনে করবে তাহলে। প্রতিমার দাদা বিয়ের পর বৌকে নিয়ে একা সিনেমা গে’ছল। বোনকে সঙ্গে না নেওয়ার জন্য সবাই নিন্দে করেছিল। সব থেকে বেশি করেছিল আশা। তার ভাই অমন হলে নাকি বৌসুদ্ধ বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিত! আশাটা ভীষণ হিসকুটে। হবে না কেন, কোনদিন তো আরামের মুখ দেখেনি! কতো কষ্টেই ওর জীবন শেষ হবে। বিশ্ব কবে যে চাকরি পাবে তার ঠিক নেই।
সারাদিনে এই প্রথম বিশ্বকে মনে পড়ল রমার। আর তখনই যত রাজ্যের ঘুম এসে হুড়মুড়িয়ে ওর চোখের পাতা বন্ধ করে দিল।
তিন
এই মুহূর্তে চিনুর কাছে মাধবী অসহ্য। সেই এক কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু নিরুপায় সে। অফিসে অফিসে ধর্ণা দিলে চাকরি পাওয়া যায়। এ ধারণা, সিনেমায় দেখা শিক্ষিত বেকার নায়করা ছাড়া মেয়েমানুষেও করে না। মুরুব্বী না ধরলে এ বাজারে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। আর মুরুব্বীদের অফিস পাড়ার বাইরেই পাকড়াও করা যায়। মাধবীই খুঁজে বার করেছিল তার দূর সম্পর্কের এক মামাতো ভাইকে। ব্যাঙ্কের সাতশো টাকার অফিসার। চাকরি দেবার ক্ষমতা রাখে। মাধবী বারবার বলেছিল মামাকে প্রণাম করতে। চিনু করেনি। অবশ্য মামা অতটা লক্ষ্যও করেননি, বলেছিলেন স্ট্রাইক মিটলে ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা করতে। চিনু দেখা করেছিল। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, চেষ্টা করেও কাউকে ছাঁটাই করা যায়নি।
আর একজন মুরুব্বী পেয়েছিল সে। স্টেটবাসের কণ্ডাক্টারীর চাকরি ক’রে দেবে বলেছিল। চিনু রাজী হয়নি। বাসের ডিপোতে যদি কাজ পাওয়া যায় তাহলে সে রাজী ছিল। কেননা দেয়ালঘেরা ডিপোতে সে কি কাজ করছে চেনা পরিচিতের পক্ষে দেখে ফেলা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক বলে বিনিমাইনের এ্যাপ্রেণ্টিশ থাকার কথা। বিনিমাইনের খাটুনিতেও খরচ লাগে, কেননা খাটতে হবে মাইনে করা মিস্ত্রির সমান। আর শরীরের ক্ষয়পূরণের খরচা দেবার সামর্থ্য সংসারের নেই। টি-বিতে মরাকে চিনু ঘেন্না করে।
সংসারের কথা চিনু ভাবে। ভাবাটা বেশির ভাগই বুদ্ধি দিয়ে হয়। দেয়ালে সাঁটা সানুর ছবিগুলোর মত মনটা মাঝে মাঝে খাপছাড়া ভাবে বুদ্ধিকেও ছাপিয়ে ওঠে। বুদ্ধিরও একটা পরিসীমা আছে। যে কোন জিনিসের যা হোক গোছের একটা ব্যাখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু সংসারটা একটা জিনিস নয়। শুধু টাকা-পয়সা রোজগার, ভাল খাওয়া-পরা, হাসি-খুশির মানেই স্বচ্ছলতা নয়। প্রত্যেক মানুষেরই চিন্তা করার নিজস্ব ধরন আছে। তার আচার আচরণও সকলের থেকে কোনো না কোনো জায়গায় আলাদা। এই আলাদাগুলো যেমন মানুষের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলে তাকে অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র করছে, তেমনি এই স্বাতন্ত্র্যকে ঘুচিয়ে সকলের মধ্যে নিজেকে এক করে দেবারও অহরহ চেষ্টা চলেছে। না হ’লে মানুষ কেন ছবি দেখে বা গল্প উপন্যাস পড়ে, বা প্রেমে পড়ে? কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোচাতে কি মানুষ পেরেছে? তাই কি কখনো সম্ভব? অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব। মাধবী যে চীৎকার করে, সেটা তার পক্ষে একান্ত দরকার। চীৎকার করে সে তার মনের ক্ষতির দিকটাকে পূরণ করছে। ভারসাম্য বজায় রাখছে। তা না রাখতে পারলে এতদিনে পাগল হয়ে যেত। চীৎকার করাটা দিনেশেরও দরকার। কিন্তু তারও নিজস্ব ধরন আছে চিন্তা করার। আবার রমার ধারণা, অন্যে ভেবেচিন্তে তার সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেইটাই মঙ্গলকর। অনেক রীতির চিন্তার সমষ্টি নিয়ে সংসারটা গড়ে উঠেছে। তাই চিনুর কাছে সংসারটা একটা জিনিস নয়।
ভিন্ন উপাদানে তৈরি অনেকগুলো জিনিস একজায়গায় থাকলে ঠোকাঠুকি হবেই। তবু মানিয়ে চলতে হয়। এই মানিয়ে চলার একটা ছাঁচ তৈরি হয়ে আছে অনেক কাল ধরে। কালের বদল আছে, ছাঁচেরও। এই ছাঁচ যারা তৈরি ক’রে নিজেদের কাজে লাগায়, তারা যদি কালের সঙ্গে সঙ্গে ছাঁচটাকেও না বদলায় তাহলেই ঠোকাঠুকি লাগে। ঠোকাঠুকিটা সংসারের এই মানুষে মানুষে আবার সংসারের সঙ্গে পরিবেশেরও। মানুষকে তাই সামলে চলতে হয়। সংসারের গণ্ডির বাইরে কি ওলট-পালট হচ্ছে মাধবীর পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু দিনেশ জানে। তাকে বাইরে বেরোতে হয়। তাকে পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে সংসারটাকে টিঁকিয়ে রাখতে হচ্ছে।
বুদ্ধি দিয়ে চিনু বোঝে এ লড়াইয়ে তারও অংশ নেওয়া উচিত। কিন্তু উচিত বললেই আর পরিবেশ তা স্বীকার করে নেবে না। চিনু বুদ্ধির তাড়নায় চাকরি খুঁজেছে। চাকরি পায়নি, বুদ্ধি এই পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। মন তখন দেখেছে, দিনেশের ভেঙে-পড়া কাঁধ, তোবড়ান গাল, ঘোলাটে চোখ। চিনু লজ্জায় মুখ নামায় দিনেশকে দেখলেই। সে থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আবার, রমার ভীতু-ভীতু সরল চোখ দুটোও সে সহ্য করতে পারে না। মেয়েটা বড্ডো বোকা। উনিশ কুড়ি বয়সেও, এই বাড়িটার মধ্যে বেশ সুখেই আছে। ওর কামনা কতো স্বল্প। কি হবে ওর ভবিষ্যতে? ওকে দেখলে বিরক্তি আসে।
আর আছে সানু। চিনুর ধারণা, সানু আছে বলেই সংসারটা টাল সামলে টিঁকে আছে। ছোট বলেই সকলে ওকে আদর করে। ওর খেয়ালগুলোকে সহ্য ক’রে চলে। এইখানেই সানুর সার্থকতা। সংসারকে স্নেহ মমতা ক’রতে শেখায়। দুশ্চিন্তাকেও সহনীয় ক’রে তোলে। সানু সম্পর্কে ভাবনা সকলেরই কম, কেননা ওর কাছ থেকে এখুনি সংসার কিছু প্রত্যাশা করে না। আশা ক’রেও মানুষ অনেক জিনিসই পায় না। মনের কিছুটা অংশ খালি থাকে, ফলে মনটা যেমনভাবে থাকলে সুস্থ বলা যায়, তা আর থাকে না, একদিকে কাত হয়ে পড়ে। পৃথিবীর সব মানুষই যদি কাত হয়ে পড়ে তা’হলে সিধে বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু মানুষের স্বভাবই খাড়া থাকা। তাই মনের খালি অংশটাকে ভরাট করে গানের সুরে, কিংবা ছবির রঙে কিংবা অনেক কিছু দিয়ে। এ সংসারটাকেও সানু কাত হয়ে পড়তে দেয়নি।
সানুর মত এ সংসারে মাধবীর সার্থকতাও চিনু খুঁজে পেয়েছে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত, যেমনভাবেই হোক না কেন সংসারের একটা দিনকে আর একটা দিনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। মাধবী যেন মজুর। একটা সংসারকে গেঁথে চলেছে সারা জীবন ধরে। গাঁথুনীর কোন ছক নেই। ওর উদ্দেশ্য শুধু সুখী হওয়া আর সংসারকে সুখী করা। অত্যন্ত মামুলি ইচ্ছে। পরিবেশ বদলেছে কিন্তু ছাঁচ বদলায়নি। ফলে বাইরের সঙ্গে ভেতরের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সংসারকে বাইরের সঙ্গে যুক্ত না করলে এ দ্বন্দ্ব ঘুচবে না। মাধবী তার সংসারের বাইরে কি ঘটছে, সে সম্পর্কে অন্ধ। ও শুধু মজুরের মত ভার বয়ে চলেছে। যুক্তিহীন যে কোন চেষ্টাই চিনুর কাছে নির্বুদ্ধিতার সামিল। তাই অসহ্যও। মাধবীকেও অসহ্য লাগে। যেমন এই মুহূর্তে তার লাগছে।
-রমার বিয়ে দেবে দাও, তা’তে আমি কি করবো?
চিনু পাশ ফিরে শুল, যাতে না মাধবীর মুখ দেখে আরো বিরক্ত হতে হয়।
-চেষ্টা চরিত্তির ক’রে একটা ভাল ছেলে দেখে দে’না। উনি চাকরিতে থাকতে থাকতেই কাজটা চুকে গেলে নিশ্চিন্তি।
নিশ্চিন্তি মাধবী একার জন্য চায় না। চিনু নরম সুরে বলল।
-লেখাপড়া শেখেনি, তার ওপর বুদ্ধিশুদ্ধিও কম।
কথাটা বলেই দুঃখ পেল। রমা ঘরে নাই। শুনলে হয়তো আড়ালে কাঁদবে। বোকারা বেশি অভিমানী হয়। কিন্তু কথাটা সত্যি।
-তাছাড়া টাকা-পয়সা খরচ করবার ক্ষমতাও তো আমাদের নেই।
এইটুকু বলে চিনু যেন অনুপস্থিত রমাকেই সান্ত্বনা দিল। মেঝেয় শুয়ে আছে মাধবী। চোখ জোড়া উপর দিকে স্থির নিবদ্ধ। চিনুও তাকাল। কড়ি-বরগার কাটাকুটি জংশন ষ্টেশনের মত। কালকের কাগজে কোথায় যেন দুর্ঘটনার খবর ছিল। মুখোমুখি ধাক্কা দিয়েছে। চুরমার ইঞ্জিন দুটোর ছবি দেখে ভয় করে। দুর্ঘটনার জন্য দোষী কে? কে জানে। তদন্ত কমিশন সাক্ষিসাবুদ নিয়ে তার বিচার করুক। যে কোন জিনিস সে যন্ত্রই হোক আর মানুষই হোক, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পথে চলতে হয়। না হলে অনিবার্য ধাক্কা লাগবেই। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের চলার নির্দিষ্ট পথ কোনটে? হাজার পথ, হাজার চলার ঢঙ। তাহলে মাধবীর সঙ্গে তার ঠোকাঠুকি লাগে কেন? এ বয়সে এমন ক’রে গায়ে ফুঁ দিয়ে, সংসারের দায়িত্বকে অস্বীকার করে চলাটা নিশ্চয় ভুল। তা’হলে ঠিক পথ কোনটে? দিনেশের পথ? তার মানে, এখনই ঘাড় কুঁজো করে, রাত্রের শস্তা বাজার সেরে বাড়ি ফেরা, আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরের মধ্যে থুম্বো মেরে বসে থাকা! অফিসে বাবার বয়সীদের সঙ্গে মেয়েমানুষ নিয়ে আলোচনা! এমনি করে বয়স গড়াতে গড়াতে চিতায় গিয়ে উঠবে।
কিন্তু পরিণাম যে এমন হবেই তার কি ঠিক আছে! হয়তো এমন কোন সুযোগ আসতে পারে, যাতে আর যাই হোক মোটামুটি মানুষের মত দিন কাটান যায়। কিন্তু সুযোগের জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না, তাকে ফন্দি ফিকির ক’রে হাতাতে হয়। চিনু ভেবে খুশি হল, চাকরির যে কটা সুযোগ ছিল, তার প্রত্যেকটাই সে চেষ্টা করেছে। পায়নি, অথচ এখনই পাওয়াটা দরকার। দরকারের সঙ্গে সুযোগের সম্পর্কটা অদ্ভুত। কিছুতেই দুটো এক জায়গায় মেলে না। এক সময় মনে হয়েছিল কাবেরীকে দরকার, তার শরীরটাকে দরকার, অথচ কোন সুযোগ এল না। রমার বিয়ে একদিন দিতেই হবে। কিন্তু নিজের জন্য ওর কোন চেষ্টা নেই। সুযোগ কি কেউ কখনো তৈরি করে দেয়? ওটাকে তৈরি করে নিতে হয়। অথচ তাতে বাগড়া দেয় কতকগুলো সংস্কার। না হলে স্টেটবাসে কণ্ডাক্টারীর সুযোগ তো এসেছিল। তবু কিছু টাকা সংসারে দেওয়া যেত। সত্যিই এ সংস্কারগুলোকে চেষ্টা করে ধ্বংস করা উচিত। চিনু কথাটা দু’বার ভাবল অর্থাৎ সংস্কারের কথা। তারপরই মনে হ’ল সংস্কারটা শুধু তার একার। এই সংসারের সবকটা মানুষের মধ্যেই রয়ে গেছে। ওগুলো ভাঙা দরকার। না হলে সুযোগ এলেও তাকে ধরা যাবে না।
মাধবী তখন থেকে একইভাবে তাকিয়ে। কিছু একটা ভাবছে। গলা খাঁকারি দিয়ে চিনু বলল:
-দিনরাত ঘরের মধ্যেই থাকে, বাইরে বেরোতে-টেরোতে দাও না কেন? বন্ধুদের সঙ্গে না মিশলে কি চালাক হয়। তা ছাড়া বাইরে ঘুরলে পাঁচটা জিনিস দেখতে পাবে, বুদ্ধি পাকবে তাতে।
-বুদ্ধি পেকে হবে কি?
-নিজের ব্যবস্থা নিজেই তা হলে করে নিতে পারবে।
-নিজে তো যথেষ্ট বুদ্ধি পাকিয়েছিস, তবে রোজগার করতে পারিস না কেন?
এই মুহূর্তে মাধবী অসহ্য। উঠে পড়ল চিনু। আলনা থেকে সার্টটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। বিশ্ব তখন বাড়ি ফিরছিল। গলিতে চিনুর সঙ্গে দেখা। শুকনো হেসে ভদ্রতা করল চিনু।
-এখন ফিরছ?
-হ্যাঁ। গেছলুম এক জায়গায়। অনেকক্ষণ বসতে হল, তাই।
উঠোনের একধারে রোদ্দুরে পিঠ লাগিয়ে রমা কয়লার গুঁড়ো মাখছে। গুল তৈরি করবে। বিশ্ব সেদিকে মুখ ক’রে দাঁড়াল।
-চাকরির খোঁজে গেছলে তো?
বিশ্ব ঘাড় নাড়ল।
-ওরা ওই রকমের। একথা সেকথা বলে বসিয়ে রাখবে, কাজের কথাটি কিছুতেই পাড়তে দেবে না। দেখেছি তো।
-না না, ইনি লোক ভাল। বললেন তো চেষ্টা করবেন, সব মানুষ কি আর এক রকমের হয়?
চিনু হাসল। বেলা মাঝ-দুপুর। নিশ্চয় বিশ্ব এখনো ভাত খায়নি। তা সত্ত্বেও কি করে ওর মনটা এত উদার হল যে সব মানুষকেই ভালো ভাবতে পারছে? নাকি রমার উপস্থিতি ওকে খুশি করছে! তাই সম্ভব। এ বয়সটাই অমন। অমন বলতে কি বোঝায়? মানুষ সব থেকে ভালবাসে নিজেকে। তাই কি? তাহলে কি মানুষ অন্যকে ভালবাসতে পারে না? বিশ্ব কি রমাকে ভালবাসে? বাসুক, তাতে কিছু অন্যায় নেই। কিন্তু যদি ভালবাসে, তাহলে কেন বাসে। এটা কি শুধুই বয়সের জন্য?
চিনু রমার দিকে তাকাল। ভিজে চুলগুলো কানের পাশ দিয়ে কপালের ওপর এসে পড়েছে। মাথা দুলিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে দেবার সময় এদিকে তাকিয়ে হাসল। হাসিটা নিশ্চয় তার দাদাকে উদ্দেশ করে নয়। চিনু বিশ্বর দিকে তাকাল। রমার হাসিটা ওর মুখে লেগে ফেটে পড়ছে।
-যখন বলছ ভাল লোক, তখন দ্যা’খ চেষ্টা করে।
বার বার করে ফুঁ দিল চিনু। বিশ্বকে ঈর্ষা করার মত কিছুই নেই। অত্যন্ত সাধারণ, আর পাঁচটা ভদ্রলোকের মত জীবনটাকে কাটাতে পারবে। টিউশনী ক’রে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে। চেষ্টা করছে হয়তো একটা চাকরি পেয়ে যেতে পারে। তখন বিয়ে করবে। বিয়ে যদি করে, রমাকেই করুক না। কিন্তু কি এমন গুণ আছে রমার যে বিশ্ব ওকে ভালবাসবে? বিশ্ব শিক্ষিত, গ্র্যাজুয়েট। গ্র্যাজুয়েট হলেই যে শিক্ষিত হবে তার কোন মানে আছে? রামরতনবাবু তো সাধারণ নির্বাচনের সময় ভোট দিতে যান নি।
ভালবাসা জিনিসটা শিক্ষিত-অশিক্ষিত রুচির ওপর নির্ভর করে না। কাবেরীকে তার ভাল লেগেছিল। কাবেরী এখন কলেজে পড়ে, কিন্তু সে শিক্ষিত নয়। কিন্তু তাই ব’লে ভালবাসতে কি অরুচি হয়েছিল? আসলে ভালবাসা কথাটাই ঘোরপ্যাঁচে। তার থেকে ভাললাগা কথাটাই ঠিক। কাবেরীকে ভাল লেগেছিল তার শরীরের জন্য। এই ভাললাগা থেকেই কি ভালবাসা আসে? চুলোয় যাক ওসব কথা। বিশ্ব যদি চাকরি পায় আর রমাকে বিয়ে করে, সে ওরা ভালবাসুক বা না বাসুক তাতে কিছু এসে যায় না, তাহলে ওদের মেলামেশার সুযোগ দেওয়া উচিত। কথাটা শুনলে মাধবী চীৎকার করবে হয়তো।
এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে চিনু সেই দিকে তাকিয়েই বলল:
-সর্টহ্যাণ্ড শিখছিলে না?
-হ্যাঁ।
-ভাল। অনেক সুবিধে আছে।
-কই আর সুবিধে হচ্ছে।
যে-কোন দোকানীকে ব্যবসায় লাভ হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে সে বিশ্বর মত সুরে আর ভাষায় জবাব দেবে। জীবনটাকে এরা ভাবে কি ? বিরক্ত হতে শুরু করল চিনু। দোষটা বিশ্বর না তার পরিবেশের? কিন্তু এই একই পরিবেশের মধ্যে সে নিজেও তো রয়েছে! তাহলে কি গঠনের তারতম্য? চিনুর চোখ বিশ্বর মাথায় এসে পড়ল। সাধাসিধে চুল আঁচড়ান। চুলগুলোকে গুছিয়ে নেবার জন্য চিনু মাথায় হাত বুলোলে একই গড়ন বোধ হয়। যে উপাদানে মানুষ গড়ে ওঠে সেটা খুলির মত বোঝা যায় না। অন্ততঃ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। পৃথিবীটাকে আজও সহ্য করা যায় শুধু এইজন্য যে মানুষগুলো একই ধরনের নয়। সত্যিই কি নয়? একটা মেয়েকে দেখে একটা ছেলের মধ্যে কি কি অনুভূতি, আবেগ তৈরি হয়? কাবেরীকে দেখে যে রকম মনে হয়েছিল, বিশ্বর মধ্যেও কি তাই হচ্ছে না রমাকে দেখে?
হঠাৎ ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করল চিনু।
-খাওয়া হয়নি বোধ হয়। আচ্ছা যাও আর আটকে রাখব না।
বিশ্বকে যাবার অনুমতি দিয়ে চিনু নিজেই লম্বা পায়ে চলে গেল। দোতলার বারান্দা থেকে কে যেন কেশে উঠল। রমার দিকে তাকিয়ে হাসতে যাচ্ছিল বিশ্ব, চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। রোদ্দুরে চুল শুকোচ্ছে বড় বৌ। উঠোন থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত গোবেচারী ভঙ্গীতে হেঁটে গেল সে। এ বাড়ির সকলেই জানে বিশ্বকে পছন্দ করে না বড়বৌ। বিশ্বরা আসার আগে এ বাড়িতে একমাত্র গ্র্যাজুয়েট ছিল বড়বৌয়ের স্বামী।
.চারপাশের বাতাস যেন মাথাটাকে চেপে ধরেছে। ঝাঁকুনি দিল চিনু। ওতে কিছু হবে না। চাপটা আসছে ভেতর থেকে। ভেতর পরিষ্কার করতে হবে। কেমন করে? কোথাও যদি এখন যাওয়া যায়। কোথায়? কলেজে। যে কলেজে কাবেরী পড়ে। ওকে এখন দেখতে ইচ্ছে করছে।
আঁস্তাকুড়ে গুচ্ছেরখানেক পেঁয়াজের খোসা আর শালপাতা। মাংস এসেছে কোন বাড়িতে। চিনু আশ্চর্য হল, আজতো রোববার কিংবা ছুটির দিন নয়! এ পাড়ায় তো ফাল্গুন মাসেও বাঁধাকপির তরকারির গন্ধ পাওয়া যায়!
পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করছে অমূল্যর বৌ। কাগজওলা সের-প্রতি একপো না আধসের সাফাই করবে! অমূল্য থাকলে নিজে হাতে ওজন করে কাগজ বিক্রি করত। সে এখন অফিসে। বৌটার বোধহয় ছেলে হবে। অমূল্যটা ভীষণ কিপটে। কাগজ বিক্রির কথা জানতে পারলে হয়তো বৌকে ধরে ঠ্যাঙাবে। আবার ছেলের ভাতে ছাদে ম্যারাপ বাঁধবে। ব্যাপারটা চিনুর কাছে খুব আশ্চর্যের মনে হল না। অমূল্য বৌকে ভালবাসে। আবার খেটেখুটে পয়সাও রোজগার করতে হয়। রোজগারটা খুব আয়াসে হয় না। পরিবেশের সঙ্গে সংসারের খাপ খাওয়ানোর কথাই আসে। অমূল্য বাইরে ঘোরাফেরা করে। ও বোঝে একটা পয়সা রোজগার করতে কালঘাম ছুটে যায়। পয়সার মর্ম ও বুঝেছে। এই বোঝাটাই ওর কাল হয়েছে। কেননা ঘরের মানুষ তার মত করে ব্যাপারটা বোঝেনি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ঘর আর বাইরের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে বৌ ঠ্যাঙাতে হয় অমূল্যকে। ওতে যন্ত্রণা খানিকটা কমে।
অমূল্যর কথা ভেবে চিনুর মনটা নরম হয়। বাড়িতে অনেকগুলো পুষ্যি থাকলেও আবার ছেলে হবে অমূল্যর। হোক। যতদিন মানুষ হন্যে থাকবে, ততদিন জন্মের হার বাড়তেই থাকবে। কষ্ট করে টাকা রোজগার করতে হলেও, রাতে বৌকে পাবার জন্যে তো কষ্ট করতে হয় না। যেখানে কষ্ট নেই সেখানেই তো মানুষ যাবে। অমূল্যও তাই করছে। ওতে কোন দোষ নেই।
কাবেরীর কলেজে ঢুকে প্রথমেই চিনু রুটিনটা দেখল। এখন ক্লাশ নেই কাবেরীর। দোতলায় উঠল। হয়তো কমনরুমে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু ডাকা যায় কেমন করে। তার থেকেও বড় কথা ডাকার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে হবে। যাচ্ছিলুম এখান দিয়ে, অনেকদিন দেখা হয়নি ভাবলুম একবার দেখা করে যাই। কিন্তু অনেকদিন দেখা হয়নি বলে দেখা করতেই হবে, এমন কোন সম্পর্ক কি তাদের মধ্যে আছে? প্রতিবেশী ভাড়াটে, তার বোন, দিদির কাছে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। সেই আলাপের জের টেনে কলেজে গিয়ে দেখা করতে হবে, ব্যাপারটা কাবেরীর মনোমত নাও হতে পারে।
চিনু দাঁড়িয়ে পড়ল দোতলার বারান্দায়। ক্লাশে এখনো প্রফেসার আসেনি। কলেজটা মেছোবাজার হয়ে গেছে। মেয়েরা বারান্দায় নিরীহ ছাগল-ছানার মত দাঁড়িয়ে। ছাগল-ছানা শব্দটা মনে মনে বদলে নিল। কিন্তু ছানারা অমন শান্ত হয়ে থাকতে পারে না। মেয়েদের ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠল সে। না, ঠিক কাবেরীর মতই দেখতে গোলাপী শাড়িতে। ও যদি সত্যি সত্যিই কাবেরী হোত। তা হলে নিশ্চয় কাছে এসে জিগ্যেস করত, আপনি যে এখানে? তখন বলতেই হোত, এসেছিলুম একটা দরকারে। কিন্তু মিথ্যে বলতে হবে কেন? যদি সত্যি কথাটাই বলা যায় যে, তোমার জন্যই এসেছি কাবেরী, তোমায় একটু দেখব বলে। তাহলে ও কি বলবে?
ঘরের মধ্যে কয়েকটা ছেলে হুটোপাটি শুরু করেছে। কে যেন চীৎকার করে খিস্তি করল। মেয়েরা নড়েচড়ে নিজেদের মধ্যেই একটা কথা বলার ছুতোয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখল, প্রফেসার আসছে কিনা।
মিথ্যে বলতে হবে কেন। গোলাপী শাড়িকে লক্ষ্য করতে লাগল চিনু। কতকগুলো ক্ষেত্রে সত্যিকথা বলাটা বোকামী। তাতে ক্ষতি বই লাভ হয় না। এক্ষেত্রে লাভ কি হবে? যদি কাবেরী বলে, চলুন কোথাও গিয়ে বসা যাক, এখানে বড্ড গোলমাল। তাহলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসতে হয়, কেননা কলকাতা শহরে বসবার জায়গা বলতে কিছু নেই। রেস্টুরেন্টে বসলে কম করে চার আনা খরচ। খরচটা নিশ্চয় কাবেরী দেবে না। চার আনার বদলে কি পাওয়া যাবে। কিছু না। শুধু একটা উঠতি বয়সী মেয়ের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলা। এর জন্যে চার আনা! তাও পকেটে চার আনা পয়সা নেই। চিনুর মেজাজ চড়তে শুরু করল। কি জন্যে এখানে এলুম!
প্রফেসার আসছে। মেয়েরা ক্লাশে ঢুকল। নিচে নামবার আগে চিনু আর একবার তাকাল। গোলাপী শাড়ির বাহারটা বেশ।
রাস্তায় নেমে চিনু ভাবল কোথায় যাওয়া যায় এ সময়টা। সন্ধ্যে হলে বরং সোনাগাছির গলি দিয়ে যেতে যেতে সব দেখতে দেখতে সময় কাটান যেত। সন্ধ্যের এখনো অনেক দেরী। তার চেয়ে কফি হাউসে যাওয়া যেতে পারে।
.-ক’দিন আসনি কেন, সময় হয়নি? খুব কাজ ছিল?
চুপ করে রইল রমা। এক কথায় উত্তর দেওয়া যায় না। আসতে তার ভাল লাগছিল না। কিন্তু তা’হলেই প্রশ্ন উঠবে, কেন ভাল লাগছিল না। মুশকিল এই ‘কেন’ টাকে নিয়ে, ক’দিন ধরেই সে তন্নতন্ন করে বুঝতে চেষ্টা করেছে ঠিক আগের মত তার মনটা কাজ করছে না কেন? মাথামুণ্ডু কিছু খুঁজে পায়নি। শুধু একটু বুঝেছে, সে বদলে যাচ্ছে। কাউকে আর তার ভাল লাগছে না। বিশ্বকেও।
মুশকিলটাও আবার সেইখানে। কাউকে ভাল না লাগার জন্য আশপাশের যা কিছু দেখছে তাই বিচ্ছিরি লাগছে। আর সবকিছুর ওপর ঘেন্না নিয়ে একদণ্ডও তিষ্ঠোন যায় না। হাঁপ ছাড়ার একটা ছুতো চাই।
বিশ্ব সময় কাটাবার একটা ছুতোই! এ কথাটা রমা এই মুহূর্তে ভাবল। শুধু এই সময়টুকু তো নয়, সারা দিনরাতই ওর কথা ভাবতে ভাবতে হুশ করে কেটে যায়। কোন কিছুর আঁচ গায়ে লাগল কিনা বোঝাই যায় না। তাছাড়া শুধু মনটাই তো নয়, শরীরটাও আছে। বিশ্বর কাছে এলে বা ওর কথা ভাবলেই ঝিমঝিম করে ওঠে শরীর। নেশা নেশা লাগে। বিজয়ার দিন যমুনা সিদ্ধি করে। তাই খেয়ে একবার হৈ হৈ করে হেসেছিল। বেশ লেগেছিল তখন। অমনি বেশ লাগে বিশ্বর নেশা। এই নেশাটা কদিন যেন ফিকে লাগছে।
রোজ রোজ এইরকমভাবে আসা, জানলায় দাঁড়িয়ে কথা বলা, আর একই কথা বলা। কদ্দিন ভাল লাগে! সারা জীবন ধরে এমন করে চলে না, চলবেও না। এ ক’দিন ভাবতে ভাবতে রমা এইটেই বুঝেছে পুরুষদের থেকে মেয়েদের জীবনটা আলাদা ধরনের। মাধবী, বড়বৌ যমুনাদের দেখেই এই ধারণাটা হয়েছে। ওদের থেকে সে কোন অংশে আলাদা নয়। সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। বিয়ে হবে। নতুন সংসারে যেতে হবে, ছেলেপুলে হবে। সমাজের নিয়ম কানুনগুলোকে মানতে হবে। এতগুলো ‘হবে’ পুরুষরা ইচ্ছে করলে নাও স্বীকার করতে পারে। সুবিধেটা ওদের বেশি। কিন্তু সুবিধে যদি কোন মেয়ে পায় তাহলে ছেড়ে দেওয়াটা বোকামি। বুলাদের মত কোন সংসারে যদি বিয়ে হয়, তাহলে বিশ্বর না করতে তার মোটেই ইচ্ছে নেই। হয়তো বুলাদের সংসারে যাওয়া হবে। কিন্তু এমনও হতে পারে, ওদের থেকেও বড়লোকের ঘরে বিয়ে হ’ল। সবকিছুই তো সম্ভব হয়। তাহলে বিশ্বর ওপর ভরসা করেই বা কি লাভ!
-কি, কথা বলছ না যে। আসনি কেন?
-এমনি।
-শুধু এমনি?
রমা তাকাল বিশ্বর মুখে। জ্বলছে মুখটা। আকাশে মুখ তুলল রমা। সূর্যটা বাতাস ঝলসাচ্ছে। তিরতির করে দূরের বাড়িগুলো কাঁপছে। শরীরে নেশা লাগছে। এতক্ষণ ধরে যা ভাবছিল রমা, গুলিয়ে যেতে শুরু করল।
-কি ভাবছ?
-কই?
-কই! তোমার ভাবনা কি আমি জানব?
-না কিছু ভাবিনি তো।
গলা কেঁপে উঠল রমার। আহা এমন নেশা সারা জীবন কেন থাকে না। কি হবে দিনরাত সংসারের কথা ভেবে। এই মুহূর্তে শরীর আর মন যে অবস্থায় আছে, সেইটেই এখনকার মত বড় কথা। এখন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এই ভাললাগাটুকুকে নষ্ট করা বোকামি।
-আমি আসিনি বলে তুমিও তো খোঁজ নাওনি। মরলুম কি বাঁচলুম তাতে তো তোমার বয়েই গেল।
রমার ভাল লাগছে অপ্রস্তুত বিশ্বর মুখটাকে। কথা হাতড়াচ্ছে লাগসই গোছের কিছু একটা বলার জন্য। বলুক এমন কিছু একটা, যার কোন মানে হয় না। ভাল লাগবে।
-আমার না তোমার, বয়ে গেল? আমি তো কতবার ওপর-নীচ করেছি।
এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে বিশ্বর মনটা। হোক। সাজানো গোছানো কথা ভাল লাগে না এ সময়। তৈরি করা কথায় সময় কাটে না। এখন সময় কাটাতে হবে। তার জন্য আগোছাল কথা দেদার খরচ করতে হবে।
-কি করছিলে?
-কিচ্ছু না।
-রাগ করেছ?
-না।
বিশ্বর স্বরটা ভারি। জ্বরো রুগীর মত টসটস করছে চোখ দুটো। অধৈর্য হয়ে জানলার গরাদগুলো যেন বেঁকিয়ে ফেলবে।
-ভাবছি তোমায় বলব বাইরে আর কদ্দিন দাঁড়াবে? ভেতরে আসবে না?
-ভেতরে যাব কি, ওরা সব রয়েছে না!
-থাকলেই বা।
-বাঃ কি ভাববে না!
-ভাবলেই বা।
বেশ লাগছে রমার। বিশ্ব কি বলতে চায় তা সে অনেকক্ষণ বুঝেছে। সে কথাটা জানলেই তো কথা বলা ফুরিয়ে যাবে। তার চেয়ে না বোঝার ভান করলে, কথা গড়াবে অনেকক্ষণ ধরে। তবু সাবধান হওয়া দরকার। এ সময় এ ভান খসাতেই হবে। বরং অন্য কিছু নিয়ে কথা শুরু করা ভাল।
-আগে তুমি চাকরি পাও।
কথাটা বলে মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে শুরু করল রমা। কোন সাড়াশব্দ নেই। তাই সে মুখ তুলল। হাতের পেন্সিলটা চোখের সামনে তুলে কি কি দেখছে। চোখ দুটো সরু করার জন্য পাতলা ভাঁজ পড়েছে চামড়ায়, যেন বিরক্ত হয়েছে। এখন যদি হাল্কাধরনের কিছু বলা যায় তাহলে ভাঁজ মিলিয়ে যাবে। অথচ ভাঁজগুলো আরো গভীর করে তুলতে ইচ্ছে করে রমার। ভবিষ্যতে যদি ছাড়াছাড়ি হয়, তার জন্য এখন থেকেই তৈরি হওয়া ভাল। আস্তে আস্তে তারা পরস্পরের ওপর বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যাবে কেউ কিছু মনে করে রাখবে না।
-মন দিয়ে চাকরির চেষ্টা করো। এতলোক তো পাচ্ছে।
-আজ গেছলুম একজনের কাছে, বললতো করে দেবে।
-কিন্তু দাদা যে বলল, হয়রানি ক’রে শেষকালে দেবে না!
একটা কাক ট্যাঙ্কের ওপর বসেই উড়ে গেল। বিশ্রী ওর ডানার শব্দ, তার থেকেও বিশ্রী বিশ্বর গলার স্বরটা।
-তোমার দাদাতো মস্ত পণ্ডিত! নিজে কিছু করতে পারেনা, বড় বোলচাল মেরে বেড়ায় খালি।
-বোলচাল মারুক আর যাই করুক, তুমি কি করছ?
-আমি কি করছি না করছি, তা শুনে তোমার কি আরো দুটো হাত গজাবে?
-তাই বলে জানলায় দাঁড়িয়ে ফষ্টিনষ্টি করলেও পেট ভরবে না।
-আমার পেট আমি বুঝব তোমায় ভাবতে হবে না।
নিজেকে হাল্কা মনে হচ্ছে রমার। অনেকখানি দায় যেন মাথা থেকে নেমে গেল।
-বেশ ভাবব না। জানলায় হা-পিত্যেশ করে বসে থাক, তাহলেই আকাশ থেকে টুপ করে চাকরি খসে পড়বে।
-তোমার কি ধারণা আমি দিনরাত জানলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকি? ঘরের মধ্যেই তো সব সময় থাক, বুঝবে কি করে বাইরের হালচাল কেমন।
-ঘরে বসে থাকলে কি কিছু বোঝা যায় না ভেবেছ? নিজেকে দেখছি খুব চালাক ভাব।
আর কথা কাটাকাটি করল না বিশ্ব। রমাও চুপ করে গেল। মুখ তুলে একবার তাকাল আকাশে। ফোঁটা ফোঁটা কতকগুলো চিল। চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে চাকর শুকনো কাপড় তুলে নিয়ে গেল। দোতলার জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে পায়চারি করতে করতে বই পড়ছে। রেডিওর এরিয়ালে মরা কাকের মত একটা ঘুড়ি লটপট করছে। টবের মাটিতে চান করবার জন্য দুটো চড়ুই উড়ে এল। আবার তক্ষুনি উড়ে গেল। কালো পিঁপড়ের সার মুখে ডিম নিয়ে চলেছে জানলার চৌকাট ধরে। সে মুখ নামিয়ে কি যেন ভাবছে তখন থেকে।
-কথা বলছ না কেন, চলে যাব?
মুখে তুলে বিশ্ব হাসল। শুকনো হাসি।
-আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে। আমি কি করব বলতে পার? আমার সঙ্গে পরিচয় না হলেই ভাল হত। যেমন দিন কাটছিল তেমনিই কাটত।
কান্নার মত শোনাচ্ছে বিশ্বর কথাগুলো। রমার ইচ্ছে করছে দুহাতে ওর মুখটা ধরতে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। বিশ্বর আঙুলের ওপর সে হাত রাখল।
-কিচ্ছু হবে না। চাকরি হয়তো একটা পাব। কিন্তু আমাদের বিরক্তি কোনদিনই ঘুচবে না।
-কে বললো?
এইটুকু কথা বলতেই গলা আটকে গেল রমার। চোখে চোখ রাখল বিশ্ব।
-কে আবার বলবে? চাকরি পেলে আমাদের বিয়েটা হয়তো হয়ে যাবে, কিন্তু তা হলেই কি সুখী হব?
-এ রকম করে কথা বললে আর কিন্তু আসব না।
-আমরা বড্ডো একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছি। এই একঘেয়েমিটা কাটান উচিত।
কথা বলল না রমা। ক্লান্তি তারও এসেছে। এটা কাটিয়ে ওঠা দরকার। নয়তো এই ঘিঞ্জি বাড়িটায় একমুহূর্তও তিষ্ঠোন যাবে না। কিন্তু এ ক্লান্তি কাটবে কেমন করে? কি এমন যাদু জানে বিশ্ব যে একঘেয়েমি কাটিয়ে দিতে পারবে? এই ছোট বাড়িটাকে কি ও বড় করে দিতে পারবে। এ বাড়ির মানুষগুলোর স্বভাব কি ও বদলিয়ে দিতে পারবে? বাইরে থেকে চেষ্টা করে কি বদল করা সম্ভব, যতক্ষণ না ভেতর থেকে বদলাবার তাড়া আসে? এ বাড়িটাই তো ধুঁকছে। এর মানুষগুলো মরতে বসেছে। তাহলে বিশ্ব একঘেয়েমি কাটাবে কেমন করে। স্তোক দিচ্ছে। তার মনে কোন মতলব আছে। সেটা কি হতে পারে!
-কি করে কাটাবে?
-আমাদের সাধ্যে কুলোয়, এমন ভাবে।
রমার গলায় হাত রাখল বিশ্ব। হাতটা গলা বেয়ে আস্তে আস্তে নামাচ্ছিল, সরিয়ে দিল রমা।
-কলে জল এসে গেছে বোধ হয়। আমি যাই, নয়তো কল পাবনা, নিচের বৌদিকে এক ডাঁই কাপড় সেদ্দ করতে দেখেছি।
আর কিছু শোনার জন্য রমা দাঁড়াল না। ট্যাঙ্কের ভাঙা কোণায় আঁচল আটকে গেছল। সাবধানে ছাড়িয়ে নিল। তবু ছিঁড়ল একটুখানি। বিরক্ত হল রমা। পরবার মত কাপড় তো মোটে দু’খানা। সিঁড়িটা অন্ধকার। চড়া আলো থেকে এসেই হোঁচট খেল। জ্বালা করছে, বোধ হয় নখটা চোট খেয়েছে। বিরক্তি তো পদে পদে। শাড়িটা ছিঁড়ল, মন খিঁচড়ে গেল। পায়ে লাগল, মন বিগড়ে গেল। এই মনটাকে বিশ্ব মেরামত করবে কতক্ষণের জন্য? আবার তো কোথা থেকে ঘা পড়বে, অমনি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যাবে। এই ভাঙ্গা আর গড়ে তোলা তো সারাজীবন চালাতে হবে। তাতে কি একঘেয়েমি বাড়ে না? মাধবীর জীবনটা তো একঘেয়ে। কিন্তু তবু সে নিজেকে টিঁকিয়ে রেখেছে এই করেই। তা না হলে, একটানা জীবনটাও তো একঘেয়ে। এই একঘেয়ে বাড়ির মানুষগুলো মরে গেছে কি? বোধ হয় না। ওপরটা কেমন ঝিমোন মনে হয়, কিন্তু তলায় তলায় কি খাটুনিই না খাটছে। এই ভাঙ্গাগড়ার খাটুনি। এতেই মানুষ বেঁচে আছে।
তা হলে চলে এলুম কেন? এক তলায় পৌঁছে রমা ভাবল। আবার ফিরে গেলেই তো হয়। কলের জল তো সত্যি সত্যিই আর আসেনি। এখনকার মত একঘেয়েমিটা কাটত। সেইটেই তো আপাতত বড় কথা। পরের কথা পরে ভাবা যাবে। অনেকগুলো ‘কিছুক্ষণ’ নিয়েই তো গোটা জীবন। জীবনটা মস্ত বড়। একটা ‘কিছুক্ষণে’র পর কি ঘটবে তা কে বলতে পারে। তা’হলে এখন কি করা উচিত?
ওপরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরে এল রমা। জীবনটা মস্ত বড়। এত বড় যে ভাবাই যায় না। ভাবতে গেলে ক্লান্তি আসে। এই বাড়িটার মধ্যে জীবনটাকে ঠিক দেখা যায় না। দেখার চেষ্টা করলে ক্লান্তি আসে। এতখানি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে ভাবতেই রমার পায়ে ব্যথা শুরু হল।
পাড়ার ছেলেরা দলবেঁধে চিড়িয়াখানা দেখতে যাবে। সানু চিড়িয়াখানা দেখেনি। রাত্রে বিছানায় রমার কাছে চার আনা পয়সা চাইল সে চুপিচুপি। কোন উত্তর পেল না। অকাতরে রমা ঘুমোচ্ছে।
চার
বেলা করে বাড়ি ফিরল চিনু হাতে একটা ইলিশ মাছ ঝুলিয়ে। এতখানি ভারিক্কি চালে আর কোনদিন সে পা ফেলেনি আর এত ছেলেমানুষি সুরে অনেকদিন কথা বলে নি।
-চটপট কেটে ফেল। রমাটা কোথায়? নেই! যায় সে কোন চুলোয়, ব্যাটা তো বলল উলুবেড়ের।
রমা ঘরেই ছিল, চিনু দেখতে পায়নি। মাধবী আর রমা একসঙ্গে বেরিয়ে এল।
-ওমা, এযে মস্ত বড়! কত করে নিল?
মাধবী মাছটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। রমা দড়িটা ধরে হাতে ঝোলাল।
-একসের হবে, না?
-তোর মাথা হবে। কি রকম চওড়া দেখেছিস। ওর ডিমের ওজন হবে আধসের। ব্যাটা বলল উলুবেড়ের। আরে বাবা, আমি কি মাছ চিনি না। বরফ দেওয়া চালানি মাছ, বলে কিনা-
চিনু রমার হাত থেকে মাছটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করল।
-পাঁচপোর একটু বেশি। তিন টাকা করে নিল। খুব নরম হয়নি। ঠকিনি, কি বলো?
মাধবীও দেখছিল। চিনুর প্রশ্নে মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দ করল।
-কাটব?
আবার একটা শব্দ করল মাধবী। রমা আঁশ বটি বার করল।
-বঁটিটার অবস্থা দেখেছ, কেমন ভেঙে ভেঙে গেছে। এতে কি অত বড় মাছ কাটা যায়। বউদিরটা আনব?
-আন।
মাছটা হাতে নিয়েই রমা বেরোচ্ছিল! মাধবী মনে করিয়ে দিতে গেল। যমুনা খেয়ে উঠে দোক্তা পোড়াতে শুরু করেছে। সারা দুপুরটাই তার লাগবে দোক্তা তৈরি করতে। খুব ব্যস্ত হয়ে রমা হাজির হল।
-কি কাণ্ড দ্যাখোতো। এই দুপুরে দাদা এক দেড়সেরী ইলিশ এনে হাজির করেছে, উলুবেড়ের ইলিশ, টাটকা খুব। তাই বাবু এক কাঁড়ি দাম দিয়ে কিনে ফেলল। এখন আমার হয়েছে জ্বালা। কোথায় একটু ঘুমোব তা’ না-দাওতো তোমার বঁটিটা।
মাছটা আঙুলের ডগা দিয়ে টিপে পরীক্ষা করল মাধবী, মুখে বিশেষ ভাবান্তর ঘটল না।
-খুব নরম?
-নাঃ।
আশ্বস্ত হয়ে চিনু জামার বোতাম খুলতে শুরু করল।
-পেলি কোত্থেকে?
-কোত্থেকে আবার, বাজার থেকে।
-তা’ নয়, বলছি পয়সা পেলি কোত্থেকে?
জামাটা ততক্ষণে চিনু মাথার উপর টেনে এনেছে। বুক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট, কিছু খুচরো পয়সা আর ছোট্ট চটি বইটা পড়ে গেল মেঝেয়। দেখামাত্রই মুখ ঘুরিয়ে নিল মাধবী। হতভম্বের মত মাধবীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েই সম্বিৎ ফিরল চিনুর। আগে সে বইটা তুলে নিল।
-সেই ঘরভাড়ার দালালিটা পেয়েছিস বুঝি?
মাধবীর অস্বাভাবিক দ্রুত কথার পিছনে চিনু তাড়াতাড়ি তার উত্তরটা জুড়ে দিল।
-তোমার দেখছি এখনো মনে আছে। কবে যে বলেছিলুম।
আলনায় জামাটা টাঙিয়ে রাখার সময় চিনু মাধবীর মুখের পাশটুকু শুধু দেখতে গেল। গালের উঁচু হাড় থেকে চিবুক পর্যন্ত খোবলান গালটা, দপদপ করছে।
-আজ ন’মাস বাদে তাগাদা দিয়ে দিয়ে মাত্র তিরিশটা টাকা আদায় হল। একবার কাজ হয়ে গেলে কি আর কেউ মনে রাখে। অথচ, তখন তো প্রায় পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিল। একটা যাহোক কিছু ঘর দেখে দাও ভাই, একমাসের ভাড়া দালালি দোব।
চিনু অপ্রয়োজনে কথাগুলো বলে থামল। মাধবীর গাল এখনো দপ দপ করছে। আগের মতই সে মুখ ঘুরিয়ে কি যেন দেখছে। কি দেখছে? টেবিল, পাঁজি, জানলা, কালীর পট, বিয়ের ছবি, বালিখসা দেয়াল? ওগুলো তো এতবছর ধরে দেখে আসছে। ওতে নতুন কি আছে! তাহলে ভাবছে কিছু। কি ভাবছে? খুব একাগ্র হয়ে ভাববার সময় মানুষ অমন অন্যমনস্ক হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। নিশ্চয় ভাববার মত কিছু ঘটেছে। কে ঘটাল? আমি? চিনু অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। মাধবীকে আর বেশি ভাবতে দেওয়া উচিত নয়।
-ভদ্দরলোকের ছেলে, তুমি তো জানই কানাইবাবুর কতগুলো কাচ্ছা বাচ্ছা, ভেবেছিলুম দালালিটা নেব না। ওটা খুব বিচ্ছিরি দেখায়। তারপর মনে পড়ল পুজো তো আর ক’মাস পরেই, সানুটার একজোড়া জুতো দরকার। ছোটলোকের মত খালি পায়ে ঘোরে। তোমারো একটা গরদের শাড়ী, সেই একবার মামীমা এসেছিল গরদ পরে, তখন তুমি বলেছিলে-
কথা বন্ধ করল চিনু। জামার পকেট থেকে টাকাগুলো বার করে মাধবীর হাতে দিল।
-সব দিয়ে দিলি নাকি!
চিনু বোকার মত হেসে গামছায় ঘাড় ঘষতে লাগল।
-ঘর খোঁজার জন্য খাটাখাটুনি করতে হয়েছে। অমনি তো আর টাকা নিসনি। এতে আর বিচ্ছিরির কি আছে। সংসার তো এবার তোর ঘাড়ে এসে পড়বে। উনি বুড়ো হয়েছেন। ওনার আর কদিন। বোনের বিয়ে, ভাইকে মানুষ করা, সবই তো তোকেই করতে হবে। তারপর তুই নিজে গুছিয়ে নে, সংসার তো তোকেও করতে হবে।
খুব আস্তে, থেমে থেমে বলল মাধবী। চিনু শুনল, ঘাড়ের ময়লা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে। চেঁচামেচি করে চিনুর মাথায় কিছু ঢোকান যাবে না। বরং বলা যায় চিনু ইচ্ছে করেই ঢোকাবে না। যে কথায় গুরুত্ব আছে, চিনু শুধু তাই শোনে। আর গুরুতর কথা কখনো চেঁচিয়ে বলা যায় না। গেলেও এখন আর চেঁচাবার ক্ষমতা তার নেই। অবশ্য চীৎকার করার মত কিছু ঘটে নি। তবু মনের মধ্যে খুব জোর একটা চীৎকার উঠেছিল ওই ছোট্ট চটি বইটা দেখে। তার রেশ এখনো বুকের মধ্যে থরথর করছে। মনটাকে আগে সামলাতে হবে। এমন চীৎকার দিনে অনেকবার ওঠে, কিন্তু এটার সঙ্গে অন্যগুলোর তফাত আছে। অন্যগুলো আগে থাকতেই জানা, এটা হঠাৎ।
সংসার একটা সমুদ্রের মত। মানুষগুলো সব ছোট ছোট নৌকো। ঢেউয়ে টলমল করতে করতেও ঠিক ভেসে বেড়ায়। সেটা হয় মাঝির কেরামতিতে। কিন্তু হঠাৎ তুফান ওঠে, বড় বড় ঢেউ আচমকা ঝাপটা মারে, তখন ঠিকমত হাল সামলাতে না পারলেই নিশ্চিত ডুবে মরা।
মাধবী সত্যি সত্যি যেন মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখতে পেল। যমুনার ঝকঝকে মাছকোটার বঁটি নিয়ে ঢুকল রমা। মাধবী ঘর থেকে বেরিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মাছটার মৃত্যু অনেক আগেই ঘটেছে। তবুতো ওটা কাজে লাগবে! মানুষের মন যদি মরে যায়, তাহলে সেটা কি কাজে লাগবে? বঁটিটার মন নেই তবু ওটা কাজে লাগছে। কাজে লাগছে নয়, লাগান হচ্ছে। লাগাচ্ছে মানুষে। মানুষের যদি মন না থাকে বঁটিরও মন নেই। মন যদি না থাকে তাহলে এ সংসার বলে তো কিছু থাকে না।
মাধবী শিউরে উঠল মনে মনে। এ সংসারকে ভালবাসি। না হলে প্রাণপাত করে খাটছি কিসের জন্য। হঠাৎ ঢেউ আসে, আঘাত আসে। ওটাতো আসবেই। তরতর করে সুখে কার জীবনই বা কাটে! আঘাত অনেক রকমের হয়। সব কি আর একটা জীবন দেখে যেতে পারে। তবু সেই মানুষই অভিজ্ঞ, যে অনেক আঘাত পেয়েছে। সুখ কি অভিজ্ঞতা বাড়ায়? রমাটা মহা উৎসাহে এখন মাছের আঁশ ছাড়াচ্ছে। ওর জীবনে এখন এটা সুখের মুহূর্ত। মাছটা খাওয়া হয়ে যাবার পর, এই সুখ কি টিঁকে থাকবে? একদিনেই ফিকে হয়ে মুছে যাবে। আর দুঃখের মাঝে সুখের স্মৃতি, অসহ্য, অসহ্য। ফুলশয্যার কয়েকটা মাত্র ঘণ্টা, এখন মনেই পড়ে না। পড়লেও জ্বালা ধরায় মনে। কিন্তু তাই বলে কি অনন্তকাল দুঃখকেই বিয়ের কনের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে মনের মধ্যে তুলে রাখতে হবে নাকি! এ দুঃখ না কাটিয়ে উঠলেই তো ডুবতে হবে। তার মানে মৃত্যু। মরলে সংসার দেখবে কে? এই ছোট সংসারের মানুষগুলোকে দিন থেকে রাত পর্যন্ত আমিই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ওদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করছি, কাল ওরা কি খাবে তার কথাও ভাবছি। মেয়ের বিয়ে, ছেলের লেখাপড়ার চিন্তা করছি। আমি যদি মরি, ওরাও বাঁচবে না। রমার এই খুশি খুশি মুখ থাকবে না। সানুর লাফালাফি বন্ধ হয়ে যাবে। চিনুই বা কার হাতে টাকা তুলে দেবে!
-না-ধুয়ে, কুটে ফেলিস নি যেন।
-জানি জানি ইলিশ কি করে কুটতে হয়।
ঘাম জমে গেছে রমার কপালে নাকে। হাঁটুতে মুখ ঘষে, মাথার কাছের আঁশগুলো নখ দিয়ে ছাড়াতে লাগল।
-মুড়োর মাছে খুব কাঁটা হয়, সরু সরু, তাই না?
-মুখ তুলে একবার তাকাল রমা। মাধবী কোন কথা বলল না। মাছ ধুয়ে কাটতে বসল রমা। দুহাতে মুড়োটাকে বাগিয়ে সে আবার তাকাল মাধবীর মুখের দিকে।
-আর একটু ছেড়ে কাট। কাল ছ্যাঁচড়া করব’খন।
মুড়োর সঙ্গে বেশ কিছুটা মাছ রেখে কাটল রমা। মাধবীর নির্দেশমত মাছকোটা শেষ হল। চান করে ঘরে ঢুকল চিনু। যমুনাকে বঁটি দিয়ে আসতে বেরিয়ে গেল রমা।
গোটা ইলিশ এ বাড়িতে হঠাৎ কখনো আসে। নয়তো কাটা-মাছ, এত বেশি দাম দিয়ে কিনে মুখের স্বাদ বদলায় এ বাড়ির লোকেরা। যমুনা পূর্ববঙ্গের মেয়ে। তার কাছ থেকে দোতলার বড় বউ ইলিশ-ভাতে রান্না শিখে একদিন গোটা-ইলিশ এনেছিল। কদিন ধরে সে শুধু ইলিশ-ভাতেই করেছিল। রান্নাটা তার ভাল লেগেছিল। ইলিশ মরশুমি মাছ। সারা বছর পাওয়া যায় না। তা’ছাড়া খুব শস্তার মাছও নয়। আর, এক-টুকরো খেয়ে মন ভরে না।
মনমেজাজ ভাল থাকলে, হাতে বাড়তি কিছু পয়সা কোনরকমে জমে উঠলে, কি খাতিরের কোন অতিথি হাজির হলে কিংবা আর কোন কাজ ঘটলে, খাওয়া দাওয়ার কিছু ঘটা এ বাড়িতে হয়। মাছ দামি জিনিস, তাছাড়া সব সময় জোটেও না, আর জুটলেও সকলের পাতে পেট ভরিয়ে দেওয়া যায় না। মাছ না হলেও মাংস দেওয়া যায়। সেদিন উৎসব পড়ে যায় যে ঘরে মাংস রান্না হয়। কচি-কাঁচাগুলো ঘুর ঘুর করে উনুনের কাছে। জুলজুল করে তাকায় টগবগে হাঁড়িটার দিকে। বুক ভরে শ্বাস টেনে মিটিমিটি হাসে এ ওর দিকে তাকিয়ে। বিয়ের বয়সী মেয়েরা টুকরো টুকরো প্রশ্নে বিব্রত করে মায়েদের, কেননা মায়েরাই রান্না করে। মেয়েরা জানে, বিয়ে হবে তাদেরই মতো অবস্থার কোন ঘরে। সেখানে মাংস খাওয়ার দিন রোজ রোজ আসে না। বছরে হঠাৎ কয়েকটা জুটে যায়। তোয়াজ করে পেট ঠেসে খেয়ে নেবে সকলে, যেন অনেকদিন এই খাওয়ার আমেজটুকু মনে থাকে। বৌয়েরা যদি ভাল না রাঁধে,-পুরুষদের ধারণা কমবয়সীরাই ভাল মাংস রাঁধে-তাহলে খাওয়ার মেজাজ মাটি! তাই বৌ হবার আগে নিজেদের গরজেই মেয়েরা মাংস রাঁধা শিখে নেয়। ভাল রান্নার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির মন পাওয়ার যেন সম্পর্ক আছে। তাই আইবুড়ো মেয়েরা রান্নার উমেদারী করে, প্রশ্ন করে করে যতটা পারে জেনে নেয়। বছরে রোজ রোজ মাংস খাওয়ার দিন আসে না, তাই মায়েরাও ভরসা করে আনাড়ির হাতে রান্না ছেড়ে দেয় না। গলদা চিংড়ি এলেও এই একই অবস্থা ঘটে। কিন্তু ইলিশ খেতেই মজা। রান্নায় বিশেষ দড় না হলেও চলে।
-ভাতে করবে, মা?
উনুন খুঁচিয়ে ফেলা হয়েছিল। কাঠকুটো দিয়ে চিনুর জন্য দুটো মাছ ভেজে দেবার জন্য মাধবী তোড়জোড় শুরু করেছে।
-চিনুকে জিগ্যেস কর। ওতো ঝাল ভালবাসে না।
চুল আঁচড়াচ্ছিল চিনু। রমার কথায় ঝাঁঝিয়ে না বলে দিল। মুখ গোমড়া করে মাধবীর পিছনে এসে দাঁড়াল রমা।
-নিজে কিনে এনেছে কিনা তাই মেজাজ দেখান হল।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল চিনু। কথাটা তার কানে গেছে।
-কি বলছিস কি?
-কি আবার বলব। ওপরের জেঠিমারা সেবার ভাতে রেঁধেছিল। একদিন খেয়েছে, তার গল্পের ঠ্যালায় কান পাতা যায় না, যেন ওরা ছাড়া আর কেউ খেতে পারে না। ঝাল কম দিয়েও তো রাঁধা যায়।
একটু থেমে চিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রমা আবার বলল।
-ঝাল না দিয়ে রাঁধলেও চলে। যে যার ইচ্ছেমত ঝাল দিয়ে নেবে।
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল চিনু। ঘাড় ফিরিয়ে এই মুহূর্তে মাধবীর মনে হল, রমাটা এখনো কচি। সাত-তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে না দিলেও চলে।
-তাই ভালো। ঝাল পেলেই তো তোমার মেয়ের পেটটা রবারের হয়ে যায়। হাঁড়িসুদ্ধ ভাত সাবড়ে দেবে।
-আহা হা।
আর কথা জোগাল মা রমার। চিনুর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল। লজ্জা করছে তার। হলেই বা দাদা, শরীর নিয়ে কথা বললে এখন অস্বস্তি লাগে। শরীর নিয়ে কথা বিশ্বও বলে, তখনো কেমন কেমন লাগে। কিন্তু এ দুটোর মধ্যে তফাত আছে। দুজনেই এক বয়সী, দুজনেই পুরুষ মানুষ তবু তফাত। এটা কি একই মায়ের পেটে জন্মেছে বলে, না দুজনের বলার মধ্যে, উদ্দেশ্যের পার্থক্য আছে? নিশ্চয় পার্থক্য আছে, না হলে এখন খামকা বিশ্বর কথা মনে পড়ল কেন! এখন মনটা খুশি লাগছে তাই বিশ্বকে মনে পড়ছে। মনের সঙ্গে মনে-পড়ার একটা সম্পর্ক আছে নিশ্চয়।
-কৌটোটা খুলে দেখ সরষে আছে কি না।
কথাটা বলে মাধবী ঘরে গেল। শরীর খারাপ লাগছে। এবার সে শুয়ে পড়বে।
.গনগনে ক্ষিদে নিয়ে রোজই সানু স্কুল থেকে ফেরে। দালানে পা দিয়ে শুরু হয়ে যায় তার চীৎকার। হাতের কাজ ফেলে তখন রমাকে ছুটে আসতে হয়। ওইটুকু ছেলে সেই কোন সকালে দুটি খেয়ে গেছে। ক্ষিদে তো ওর পাবেই।
আজ রমা বিশেষ ব্যস্ত হল না। আঙুলে চুল পাকিয়ে চিরুণী দিয়ে তা ছাড়াচ্ছিল। ঘর থেকেই সে সানুকে ডেকে বলল:
-চট করে একবার মুদির দোকান যা। সরষে নিয়ে আয় চার পয়সার।
-কেন?
-দাদা একটা জিনিস এনেছে।
কথাটা অবিশ্বাস্য। তার সামান্য জীবনের অভিজ্ঞতায়, কখনো দাদাকে কোন জিনিস আনতে দেখে নি। বল্টু যখন আম্পায়ার থাকে তখন তার দলের কেউ বোল্ড আউট হলেও আউট দেয় না। সঙ্গে সঙ্গে নো-বল ডাকে। যদি কখনো বল্টু আঙুল তুলে আউট দেয় তা’হলে সেটা দাদার জিনিস আনার থেকেও আশ্চর্যের ঘটনা হবে না।
-মুদির দোকান তো এইখানে, যাবি আর আসবি!
-কি এনেছে দাদা?
সানু তার সন্দেহটা কথার সুরেই বলে দেয়। কেননা, আগেও রমা কাজ করিয়ে নেবার জন্য মিথ্যে কথা বলেছে। আঙুলটা আলগা হয়ে গেছল রমার। তাই জোরে চিরুণী টানতেই চুলের গোড়া জ্বালা করে উঠল।
-যাই আনুক না, ওইটুকু ছেলের অত কথায় কাজ কি।
-পারব না যেতে।
-আস্তে, মা শুয়ে আছে না পাশের ঘরে। হাত থেকে চিরুণীটা কেড়ে নিল সানু।
-কি বাঁদরামো হচ্ছে শুনি।
-যদি মিথ্যে হয় তা হলে চার আনা পয়সা দিবি, বল?
-কেন, মার কাছে চাইতে পারিস না। আমি কি পয়সার গাছ?
-তবে যাব না।
চিরুণী ফিরিয়ে দিল সানু।
-সরষে না আনলে একটা জিনিস আর খাওয়া হবে না। দালানে গামলা ঢাকা আছে তোর খাবার, খেয়ে নে।
সানুর সঙ্গে রমাও এল দালানে। গামলা সরিয়েই সানু তাকাল রমার দিকে। বল্টু আম্পায়ারের আঙুল আকাশমুখো হলে সে এতটাই আশ্চর্য হত।
-পয়সা দে।
-বা রে, আমার কথা কি মিথ্যে হয়েছে যে পয়সা দোব?
-তা হলে দোকানি কি অমনিতে সরষে দেবে!
.অন্ধকার ঘরে শুয়ে মাধবী ভাবছিল চিনুর কথা। এ বাড়িতে কি আশপাশের বাড়িতে যখনই সৎ, পরিশ্রমী, ভালো ছেলের কথা ওঠে, দৃষ্টান্ত দেওয়া হয় বিশ্ব’র। আর ঠিক তার উল্টোটি সম্পর্কে তাদের মনে পড়ে চিনুকে। গায়ে ফুঁ দিয়ে, বাপের অন্ন কি করে যে একটা জোয়ান ছেলে ধ্বংসাতে পারে, তারা তা বুঝতে পারে না। তার ওপর কারুর সঙ্গে মেশে না, মুখেও বড় বড় কথা। আজ চিনুর পকেট থেকে পড়ে যাওয়া বইটার মলাটে ঘোড়ার ছবি ছিল। চিনু রেস খেলছে। ভাবতে কষ্ট হয়। চিনু সৎ, পরিশ্রমী, ভালো ছেলে হতে পারল না।
চিনু তখন ছ’ বছরের, পাশের বাড়ির অরুণ চাকরির প্রথম মাইনেটা যখন তার মা’র হাতে তুলে দিল, তখন মাধবী সেখানে উপস্থিত। ছেলের কপালে সেই টাকা ছুঁইয়ে মা তার থেকে সত্যনারায়ণের শিরনীর জন্য টাকা সরিয়ে রেখেছিল। দেখে খুশি হয়েছিল মাধবী। অরুণের ফরসা মুখে রক্তের ছোপ, তার মায়ের চোখে স্নেহ আর সুখের চাউনি, স্নিগ্ধ করে দিয়েছিল মাধবীকে। তার মনেও সাধ জেগেছিল, কিন্তু চিনু তখন খুব ছোট। অরুণকে সে বলেছিল বায়োস্কোপ দেখাবার জন্য। তখন বয়স কতই বা আর, সাধ আহ্লাদ মরে যায় নি। বায়োস্কোপ দেখিয়েছিল অরুণ, সঙ্গে ছিল ওর মা, পিসি আর বামুন-দি। চিনুও জীবনে সেই প্রথম বায়োস্কোপ দেখল। খুব অবাক হয়েছিল, তারপরেও কতদিন সে হাতীর গল্প করেছে। সে বইটায় অনেকগুলো হাতী ছিল। মাধবী চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না বইটার নাম। গল্পটাও ভুলে গেছে। শুধু মনে আছে মেয়েটার স্বামী ছবি আঁকত। বেশ ছিপছিপে চেহারাটি ছিল।
শিরনী দিয়েছিল অরুণের মা। পাড়ার অনেকে এসেছিল সত্যনারায়ণের পাঁচালি শুনতে। সবাই আশীর্বাদ করেছিল অরুণকে। ওর মা’র হাঁটাচলা লক্ষ্য করেছিল মাধবী। তারও অমন করে হাঁটতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু চিনু তখন খুব ছোট। ওর লেখাপড়ার যত্ন নিতে শুরু করল সে। দিনেশকে মাস্টার রাখতে পর্যন্ত বলেছিল। কিন্তু অতটুকু ছেলের পড়ার কাজ তো দিনেশই চালিয়ে দিতে পারে। মাস্টার আর রাখা হয়নি। তাছাড়া লেখাপড়ায় সত্যি মাথা ছিল চিনুর। বেশ কিছুদিন দিনেশ যত্ন করে তাকে পড়িয়েছিল। চিনু বড় হবে। চিনু চাকরি করবে। চাকরির প্রথম মাইনেটা মা’র হাতে তুলে দেবে, সব টাকাটা। এমন কি বাসভাড়ার পয়সাটিও না রেখে। মাধবী সত্যনারায়ণের পুজো দেবে। পোস্টাপিসে কালকেই পাস বই খুলতে হুকুম দেবে আর পড়শীদের কেউ যখন বায়োস্কোপ দেখানোর কিংবা খাওয়ার কথা তুলবে, তখন মাইনের অঙ্কটা জানিয়ে লাজুক সুরে আপত্তি করবে চিনু। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা, সেই ছোট্ট চিনু আজ কতবড়টি হয়েছে, পাশ করে চাকরি করছে। মায়ের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে। এতে ওদেরও আনন্দ। ওরা কেন ছাড়বে! তখন অসহায়ের মতো চিনু তার মায়ের দিকে তাকাবে, এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য।
চিনু আজ রোজগার করার মতো বড় হয়েছে। চিনুকে আজ তার অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য অভিনয় করতে হল। বাড়িভাড়ার দালালির কথাটা কেমন করে যেন মুখে এসে গেল। অথচ একবার মাত্র চিনু কথাটা বলেছিল, তা’ও আট ন’মাস আগে। লজ্জা ঢাকতেই অভিনয় করতে হল। কিন্তু লজ্জাটা কার। চিনুর? এতদিনে মনের মধ্যে যে ইচ্ছাটা কুঁড়ি থেকে ডালপালা নিয়ে বিরাট হয়ে উঠল সেটা যখন এককোপে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তার ব্যথা ঢাকতে অভিনয় করতে হল। শুধু ব্যথা নয় লজ্জাও তো ছিল। নিজের কাছে নিজের লজ্জা। চিনুর ছোটবেলার মাধবীর বয়স যেন এখনকার মাধবীকে দেখে মুচকি হাসছে। তার হাসি থামাতে মিথ্যে কথা বলতে হল। আর পাঁচটা সাধারণ মায়ের মতো সে হয়ে উঠতে পারল না। সংসারটা আর পাঁচটা সংসারের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারল না, হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে টলমল করে উঠল। মাঝি হুঁশিয়ার। পাঁচজনের নানান উপদেশ, সহানুভূতি বিষ ঢেলে দেবে।
ছটফট করে উঠল মাধবী। অন্ধকারেরও জ্বালা আছে। কোথাও তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। এমন কোথাও যেখানে আলো নেই, অন্ধকার নেই। মানুষজন, শব্দ, ক্ষিদে, ঘাম, গন্ধ, কিচ্ছু নেই। ঘুম চাই। আধো জাগা আধো তন্দ্রার মতো একটা কিছু। বোঝা যাবে এ সংসার চলছে কখনো জোরে সানুর মতো লাফাতে লাফাতে, কখনো দিনেশের কড়ানাড়ার মতো ঠুকঠুক করে। কিন্তু সেটা শুধু বোঝাই যাবে আর কিছু নয়। বাদ বাকি তন্দ্রার মধ্যে ঘোরপাক খাবে। বড় বড় ঢেউ এলে সেই তন্দ্রাটাই টুক করে ঢেউটাকে ডিঙ্গিয়ে পার ক’রে দেবে।
জ্বলুনি কমছে না। চিনু অবুঝ নয়। মা’র মিথ্যা কথা বলা সে নিশ্চয় ধরে ফেলেছে। আর এই মিথ্যাটা সে ভাঙল না। সেকি মাধবী লজ্জায় পড়বে বলে। চিনু তো জানে তার ওপর কতখানি ভরসা রাখত তার মা। কিন্তু আজ দুজনেই লজ্জায় পড়লুম। স্বচ্ছন্দে পাড়ি দেবার জন্য যে পাল তোলা হয়েছিল সেটা আজ ছিঁড়েখুঁড়ে গেল। আর কি আপ্রাণ চেষ্টাই না সেটাকে জোড়াতালি দিয়ে আবার খাড়া করার জন্য! এমনি সম্পর্কই আজ সংসারে, মানুষে মানুষে। কিন্তু ধরা তো দুজনেই পড়েছি! চিনুও কেবল অভিনয় করে গেল। যেমন হওয়া উচিত ছিল তা’ হয়নি। কেমন বাঁকা পথ ধরে যেন সবাই চলেছে। সবাই নিজেকে লুকোতে ব্যস্ত। আর তাই করতেই জীবন ভোর হয়ে গেল। তা হলে এমন করে বেঁচে থাকার দরকারটা কি!
দরকার না থাকলে সব মানুষই তো জীবন ঘুচিয়ে দিত। কিন্তু দিচ্ছে কই! একটা দুটো মানুষ আত্মহত্যা করে মরে। অসহ্য হলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়। দাশেদের ভাড়াটেরা তাদের বৌয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে লজ্জায় উঠে গেল পাড়া ছেড়ে। সবাই বলল বৌটা মরেছে। আসলে বেঁচেই গেল। জীবনের খাত বদল করল। ঝুঁকি নিল। হয়তো বাঁচার অর্থ খুঁজে পাবে। নাও পেতে পারে। কিন্তু এমন করে বাঁচার থেকে মরে দেখানো অনেক ভাল। এইটেই আসল কথা। সংসারের কথা ভাবলে, সানু, চিনুর কথা ভাবলেই মনটা কেমন গলে গলে পড়ে, ওদের দুঃখ, লজ্জাগুলোকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছেটাই সাহস যোগায় ওদের ভালবাসি বলেই না বেঁচে আছি!
তাহলে দোষ কোথায় চিনুর! যারা বলে চিনু সংসারের জন্য না, পরিশ্রম করে না, তারা কি সাহায্য করবে, টাকা পয়সা যোগাবে, উঁকি দিয়েও দেখবে না। তা হলে চিনু কি এমন অন্যায় করেছে রেস খেলে। এই টাকায় দু’চার দিনের তো সংসার খরচ মিটবে। চিনু চেষ্টা করেছে সংসারের জন্য, তার সাধ্যমত। সেও ভালবাসে। এইটেই তো বড় কথা। চিনু যেমন করেই হোক বাঁচার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ কপালের ওপর হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠল মাধবী।
-পড়তে বসিস নি?
-তোমার অসুখ করেছে?
ভাল লাগল মাধবীর সানুর জিজ্ঞাসার ভঙ্গিটুকু। ছেলেমেয়েরা তেমন করে ভাল মন্দের খোঁজ নেয় না, ব্যস্ত হয় না তার শরীর খারাপ হলে। ওদের সঙ্গে সম্পর্কটুকু রাক্ষুসে বালির মত সংসার শুষে নিয়েছে। সানুর জিজ্ঞাসা যেন বালির তলা থেকে খুঁড়ে আনল ভালবাসা। কল কল ক’রে ভ’রে উঠছে মন।
-আমি আর বাঁচব না রে, এবার মরে যাব।
-না।
-না কেন! আমি মরলে তো তোরই ভাল, রোজ রোজ আর পড়তে বসতে বলবে না কেউ।
-আমি রোজ পড়ব।
সানুকে দুহাতে বুকের ওপর টেনে নিল মাধবী। কাঁপছে ওর শরীর। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মাধবী।
-খুব মন দিয়ে পড়বি। যত পরীক্ষা আছে সব কটা পাশ করবি। পাশ না করলে চাকরি পাওয়া যায় না। দেখেছিস তো ও বাড়ির অরুণদা কতোবড় চাকরি করে। ওর চেয়েও বড় চাকরি করবি, কেমন?
-হুঁ।
-চাকরি করে কি করবি?
সাড়া দিল না সানু।
-যদি তোর এক হাজার টাকা মাইনে হয়! এই ভাড়া বাড়িতেই থাকবি, না বাড়ি করবি?
সানু এবারও চুপ।
-তখন মা’র কথা ভুলে যাবিতো!
মাধবীর বুকে মুখ গুঁজে একটা শব্দ করল সানু।
-আঃ ধামসাচ্ছিস কেন, বল না, মনে থাকবেতো তখন। নাকি সাহেব হয়ে যাবি।
-মা আমি চিড়িয়াখানায় যাব।
মুখের ডগায় সাজানো কথাটা অপ্রস্তুত হয়ে আটকে গেল মাধবীর। সানু আবার পয়সার কথা তুলল।
-তোর বাবা এলে চেয়ে নিস।
-তুমি চেয়ে দাও।
সানুর নিশ্বাস পড়ল মাধবীর মুখে। মাংস ফোঁপরা ক’রে হাড় পর্যন্ত পৌঁছল যেন নিশ্বাস। যন্ত্রণায় ঝলসানো মাংসের মত চোখের কোল কুঁচকে উঠল। সানু থুতনি ধ’রে টানাটানি শুরু করল।
-ওমা তুমি চেয়ে দাও। আমি চাইলে বাবা দেবে না।
-আঃ জ্বালাসনি এখন, পড়াশুনো নেই নাকি তোর! পড়তে বসগে যা।
সানু চলে গেল। অন্ধকারেরও জ্বালা আছে। এখন কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে মাধবীর।
.তখনও ঘর অন্ধকার। অফিস থেকে ফিরেই দিনেশ কপালে ভাঁজ ফেলে মাধবীর পাশে দাঁড়াল। মুখের ওপর থেকে হাত সরাল না মাধবী। বুকের কাপড় গুছিয়ে নিল।
-জ্বর হয়েছে নাকি?
-না।
-তবে শুয়ে যে?
-এমনি।
জামা কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পরে ঘর থেকে দিনেশ বেরোল। রমা ভাত গামলায় ঢালছিল। সানু পাশে বসে চুপ করে দেখছে।
-কি কচ্ছিস, ঢালছিস কেন ভাত?
-ইলিশ ভাতে হবে। দাদা এনেছে।
চটপট জবাব দিল সানু। রমা ভারি ব্যস্ত, তবু মুখ তুলে হাসল।
-চিনু এনেছে?
দিনেশ কাছে এসে দাঁড়াল। ভাত ঢালতে গিয়ে মেঝেয় কিছু পড়েছে। খুঁটে খুঁটে রমা তুলে রেখে গামলাটায় থালা চাপা দিল।
-চিনু কোত্থেকে পেল!
দিনেশ আবার জিজ্ঞাসা করল অনেকটা স্বগতোক্তির মত।
-সেই কানাইবাবুকে ঘর দেখে দিয়েছিল, তার জন্য আজ তিরিশটা টাকা পেয়েছে। পাঁচপো ওজন। খুব বড় একটা ডিম বেরিয়েছে।
-একটা ডিম কোথায়? হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ ডিম, তাই না বাবা।
রমার কথায় বাধা দিয়ে সানু ভুল ধরিয়ে দিল। হাসল দিনেশ।
-গুঁড়ি গুঁড়ি সুজির মত যেগুলো থাকে সেগুলোতো এক একটা ডিম। তার থেকে এক একটা মাছ হয়, তাই না?
-হুঁ।
-একটা মাছের কতো বাচ্ছা হয়, লক্ষ লক্ষ?
-দূর বোকা, অত মাছ হলে তো পুকুর ভর্তি হয়ে যাবে।
রমা এবার সানুর ত্রুটিটুকু সেরে দিল।
-ইলিশ মাছ পুকুরে হয় না, নদীতে হয়।
দিনেশ উবু হয়ে বসল। ওরা দুজন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। বেশ লাগছে মুখ দুটো। অনেকদিন ওরা এমন করে তাকায় না। অনেকদিন এমন করে সেও ছেলেমেয়েদের কাছে পায় না। মাধবী শুয়ে আছে কেন, সেওতো এসে কাছে বসতে পারে। চিনুটাই বা গেল কোথায়। সবাই এসে বসুক। কিছুক্ষণ হাল্কা কথাবার্তা হোক। এমন সময়তো ন’মাসে ছ’মাসে আসে।
-ভাতে কি করে কত্তে হয় জানিস? বাঙালরা জানে, ওদের দেশে মাছ হয়, নানান রকম মাছের রান্না জানে।
-আমিও জানি। আজ খেয়ে তারপর বলবে।
-জান বাবা, দিদি কোত্থেকে শিখেছে?
-আচ্ছা আচ্ছা, খুব ডেঁপোমো হয়েছে, পড়তে বসগে যা।
সানু একচুলও নড়ল না। দিনেশের ভাল লাগছে ওদের কথা। ঘাম জমেছে রমার নাকের দুপাশে। আলোতে ঝিকঝিক করছে। বিয়ের পর ক’দিন নাকছাবি পড়েছিল মাধবী। রমার নাকটিও টিকোলো। ওর মা’র মতন। চার বছর বয়সে ওর নাক বিঁধিয়েছিল মাধবী। একটা সোনার তারও ক’দিন নাকে ছিল। সেটুকুও গেছে। গেছে ভালই হয়েছে, নাকছাবি পরাও আজকাল উঠে গেছে। পথে-ঘাটে মেয়েদের গায়ে আর গয়না দেখা যায় না। যাবে কোত্থেকে, গয়না কিনতে তো পয়সা লাগে। পয়সা কোথায়? সদ্য বিয়ে হওয়া দু’চার জনকে দেখা যায় বটে হাতে, গলায় সোনা পরে ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু বেশির ভাগেরই তো অন্য অবস্থা। দিনকাল পালটেছে। গয়না না-পরা মেয়ে দেখতে দেখতে ওইটেই চোখে সয়ে গেছে। চোখে এখন খালি হাত দেখতেই ভাল লাগে। পয়সার সঙ্গে চোখের সম্পর্কটা খুব কাছাকাছি।
অথচ বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ এক গা গয়নার বরাদ্দ দেবেই। রুচি পালটেছে ঠিকই, তবু গয়না চাই-ই। যেজন্য ব্যাঙ্কে টাকা জমায়, সেজন্যই গয়নার চাহিদা। নইলে স্যাকরারাতো না খেয়ে মরতো। রমার বিয়ের সময়ও গয়না দিতে হবে। অত টাকা কোথায়! মহিম আজ যে পাত্রের খবরটা দিল, সেটা যদি লেগে যায়, তাহলে সবদিক দিয়েই ভাল। কিন্তু মাধবীর কি তা পছন্দ হবে?
কড়ার তেল গরম হয়ে উঠেছে। মাছ ছেড়ে দিল রমা। শব্দ হল। তেল ছিটকে গায়ে লাগল দিনেশের। জ্বালা করছে গলার কাছটা।
-ঝাল করবি না ঝোল করবি রে?
-ইলিশমাছ ভেজে রাঁধা হয় না।
-কেন?
-হয় না।
ভরপেট খাওয়ার পর ধীরে সুস্থে ঢেকুর তোলার মত রমা কথাটা উত্তর করল। হা-ভাতের মত সানু আবার জিগ্যেস করল।
-তবে সেদিন ট্যাংরা মাছ ভেজে ঝোল করলি কেন?
-সব মাছ কি এক রকম করে রান্না হয়। চিংড়ি মাছ ভেজে কি মালাইকারি করে?
রমার মনে হল সানুটা কখনো মালাইকারি খায়নি। খাবে কি করে। সে নিজেও তো দু’একবার ছাড়া খায়নি। আভার বিয়েতে মালাইকারি হয়েছিল। আভা ছোটবেলার বন্ধু! বিয়েতে কিছু একটা না দিলে মান থাকে না। মাধবী বলেছিল, গিয়ে কাজ নেই। দিনেশ চুপিচুপি একটা বই কিনে এনেছিল। তাড়াহুড়োয় খুলেও দেখেনি সে। মলাটে ছবি ছিল না বলে মনটা শুধু একবার খচ করে উঠেছিল। কিন্তু তবু, যাহোক কিছু একটা হাতে নিয়ে বিয়ে বাড়ি যাচ্ছে, এইটেই তখন যথেষ্ট ছিল। বইটাই তো সব নয়, ভালবাসাটাই বড় কথা। সামান্য জিনিসেই তো ভালবাসা বোঝান যায়। বিশ্ব তাকে ভালবাসে বলেই না এঁটো চা অনায়াসে এগিয়ে দেয়। আজ কদিন ওর সঙ্গে ভাল করে কথা বলা হয়নি। ওকে দু’খানা মাছ দিয়ে এলে হয়! ভালমন্দ খাওয়া যখন-তখন তো আর জোটে না।
-সানু তুই মালাইকারি খাসনি কোনদিন?
মাথা নাড়ল সানু।
-আচ্ছা তোকে রেঁধে খাওয়াব। বাবা এনো না একদিন। সেই নীলরঙের বড় বড় দাড়াওলা গলদা। দাড়া দিয়ে বেশ চচ্চচড়ি হয়।
তেল লেগে জ্বলছে গলাটা। ফুটন্ত তেলের মত রমার কথাগুলো। দিনেশের গলায় কড়া কড়া কতকগুলো কথা জমে উঠেছে। সংসারের এই হাল, তার ওপর আর আবদার সয় না। কথাগুলো ছেলে ভুলোন সুরে রমা বলেনি। সানু মনে করে রেখে দেবে আর প্রত্যেকদিন খ্যাচ খ্যাচ করবে। তখন একটা লজ্জা আসে মনে। লজ্জা কাটাতে গেলে তিন চার টাকা খরচ করতে হয়। একদিন মাছ খেয়ে কি এমন পুণ্যি হবে! এই যে টাকাগুলো নষ্ট করে মাছ আনল চিনু, এতে কি লাভ হ’ল। পয়সাটা অনেক কাজে লাগত।
কিন্তু কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে এখন রমাকে। বসার ভঙ্গী, হাত নাড়ার ভঙ্গী, রমার সবকিছুর মধ্যেই বেশ ভারিক্কি ভাব। ওইটুকু মেয়েটা কেমন গিন্নী-গিন্নী চাল শিখে গেছে। একটা নাকছাবি থাকলে মানাতো ভাল। নাকের ঘাম এখনো ঝিকঝিক করছে। মুছতেও ভুলে গেছে। খাটে খুব মেয়েটা। দিনরাতই খাটে। সাধ-আহ্লাদগুলো বলে না। বোঝদার মেয়ে, সামলে সুমলে চলে। আজ মনটা ওর খুশি, তাই বোধ হয় ভুলে গেছে বাপের রোজগারের কথাটা। আহা ভুলে থাকি। কোন কালেই যেন ওকে দুর্দশার কথা না ভাবতে হয়। ওকে কেন, কাউকেই যেন না ভাবতে হয়। চিরটাকালইতো অনিশ্চিত ভাব নিয়ে ভয়ে ভয়ে কাটাতে হ’ল। এমন করে দিন কাটাতে কি ভাল লাগে। আজকের মত সহজ সুখ রোজ আসুক। ওদের হাসিখুশি মুখ দেখেও আনন্দ হয়।
-আজতো ইলিশ হচ্ছে, ও হপ্তায় পারিতো আনব।
-আবার পারি কেন?
-মাসটা কাটুক।
কান্না-কান্না গলায় সানু বলে উঠল।
-না, কালকেই আনো।
-থাম।
ধমক দিল রমা।
-বলা মাত্রই অমনি চাই। তোর ইস্কুলের মাইনে বাকি রয়েছে না?
সানু নয়, দিনেশও অপ্রতিভ বোধ করল। হাঁটুতে মুখ ঘষে ঘাম মুছে ফেলেছে রমা। ওর খুশি-খুশি ভাবটা নিমেষে মাধবীর মুখের মত হয়ে উঠেছে। বিশ্রি লাগছে এখন দিনেশের। একটু আগের মনের আনন্দটুকু মাটি করে দিল। সুখ কতটুকু থাকে জীবনে? দুঃখটাই যেন অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। আর তাতেই জ্বলে পুড়ে ভাজাভাজা হয়ে শেষ হতে হবে।
কড়া নামাল রমা। চমৎকার গন্ধ বেরোচ্ছে ভাজা ইলিশের। সানু এখনই একটা খেতে চাইল। এখন খেলে ভাতের সঙ্গে পাবে না। তাইতেই সানু রাজী। গরম মাছটা হাতে লোফালুফি করতে করতে ঘরে চলে গেল।
দিনেশও উঠে পড়ল। মহিম এক পাত্রের খবর দিয়েছে। এখানে বিয়ে হলে অনেক সুবিধে। মাধবীকে রাজী করাতে হবে। সংসারের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। চিনু রোজগার করে মাছ এনেছে। দালালির কাজে পয়সা আছে। যদি লেগে থাকে তাহলে দু’পয়সা আসবে, সংসারটা দাঁড়াবে। মাছ-টাছ খাওয়াটা এখন বাবুগিরির সমান। চিনু বাড়ি নেই, মাধবীকেই বুঝিয়ে বলতে হবে।
মাধবী সেই একভাবেই শুয়ে আছে। আলো জ্বেলে টেবিলের কাছে দাঁড়াল দিনেশ। বইয়ের গাদার ওপরেরটা ওল্টাল একবার। শরৎ গ্রন্থাবলী। চোখ বোলাল। কতকগুলো অক্ষর শুধু, দু একটা নাম, দাঁড়ি কমা, প্যারা। বই বন্ধ করল দিনেশ।
-চিনুকে বোলো না মন দিয়ে লেগে পড়তে। কিছুইতো করে না, শুধু শুধু,-
-কিসে লাগবে?
মাধবী কাত হয়ে দিনেশের দিকে তাকাল। মুখোমুখি হয়ে দিনেশ চেয়ারে বসল।
-যাহোক একটা কিছুতো করতে হবে। যে কাজটা ধরেছে তাই বা মন্দ কি।
-কি কাজ ধরেছে?
-বাড়ি ভাড়ার দালালি!
আবার শুয়ে পড়ল মাধবী। রাগ ধরছে তার দিনেশের ওপর। মানুষটার এখনো বুদ্ধিশুদ্ধি হল না। বিশ্বাস করে নিয়েছে ব্যাপারটা। চিনু যে ধাতের ছেলে তাতে দালালি করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে মনে একটু সন্দেহ পর্যন্ত ওঠেনি। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করাটা বোকামি। অনেকে ঠকিয়েছে তবু আক্কেল হয়নি। সন্দেহ থাকাটা খুব দরকার। ওতে মাথাকে সব সময় চালু রাখতে হয়। বুদ্ধিতে ধার পড়ে।
মাধবীকে চুপ করে থাকতে দেখে অস্বস্তি বোধ করে দিনেশ। বইটই বন্ধ করে তাড়াতাড়ি আর একটা বই খুলে ধরল চোখের সামনে। এখুনি মাধবীর মুখোমুখি হতে হবে আবার। দিশাহারা হলে চলবে না। মাধবী হয়তো রেগে উঠবে কিন্তু তাকে দাবিয়ে দিতে হবে। এতদিন ওর অনেক কথাই মানতে হয়েছে, সে শুধু চীৎকার অশান্তির ভয়ে। কিন্তু তাতে শান্তি আসেনি। মনের মধ্যে শুধু নিজের অভিযোগগুলোকে পুষে, গুমরে মরতে হয়েছে। জীবনে কৃতকার্য সবাই হয় না। আর কৃতকার্য কাকে বলে। টাকা-পয়সা, মান-সম্মান। লোকের ওইটেই ধারণা। আসলে খুব ভুল নয় ধারণাটা। সাধারণ জীবনে সুখ শান্তিটাকেই বড় বলে ধরা হয়। টাকা পয়সা না হলে সুখশান্তি আসে না। এটাকে যুক্তি, ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় না। নিজের সংসারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সম্মান দুর্লভ জিনিস। সুখী মানুষই সম্মানিত। সুখটা যে কি দুর্লভ বস্তু হয়ে উঠেছে এর থেকেই বোঝা যায়। একটু ভাল চাকরি পেলেই মানুষ সম্মানিত হয়ে পড়ছে।
মাধবী অসম্মান করে, দ্রুত বইয়ের পাতা ওল্টায় দিনেশ। হাত কাঁপছে। দেয়ালে শব্দ উঠল। টিকটিকি আরশুলা ধরেছে। আছড়াচ্ছে। মাধবী শুয়ে আছে চোখের ওপর হাত রেখে। পাঁজরার পাশ দুটো ফুলে ফুলে উঠছে নিশ্বাসের সঙ্গে। আরশুলাটার মতো ওকে আছড়ালে কেমন হয়।
দ্রুত পাতা ওল্টায় দিনেশ। মাধবী অসম্মান করে।
.দুটি মাত্র মাছের টুকরো। তাইতেই খুশি হল আশা। বিশ্ব মাছ ভালবাসে কিন্তু সংসারের যা হাল, কতদিনতো বিনা মাছেই খাওয়া সারতে হয়। মাছ একা বিশ্বই খায়, তবু টাকা পয়সার জন্য একটুকরো মাছও বাজার থেকে আনে না। ভাইয়ের প্রশংসা করার সময় আশার মুখের ভাব এমন হল যেন সে প্রশংসাই শুনছে। বিশ্বর গুণ যেন তার কৃতিত্বেই সম্ভব হয়েছে।
চুপ করে রমা শুনছিল। বিশ্ব টিউশনি থেকে এখনো ফিরেনি। উনুন কামাই যাচ্ছে। ফিরে আসছিল রমা, ওকে ডেকে আনল আশা সিঁড়ি থেকে।
-আসল খবরই তো দেওয়া হল না। বিশ্ব চাকরি পাচ্ছে জান।
ফ্যালফ্যাল করে রমা বুঝতে চেষ্টা করে প্রথমে। পায়ে পায়ে সে আবার ঘরে ঢোকে। আচমকা কথাটা বলেছে আশা। চাকরি মানেই টাকা, কতকগুলো দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি, একটু হাঁপছাড়া, সামান্য সাধ আহ্লাদ মেটান। একটা চাকরির সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে থাকে। হঠাৎ চাকরি পাওয়ার খবর আচমকাই মনে ধাক্কা দেয়। কেননা চাকরি আর মুড়ি-মুড়কি কেনা এক ব্যাপার নয়।
-আজ সকালেই চিঠি এসেছে। সেই কবে ছ’মাস আগে একবার পরীক্ষা দিয়েছিল, তাই ডেকে পাঠিয়েছে। শুরু হবে দেড়শো টাকার ওপর থেকে। তারপর পরীক্ষা দেবার সঙ্গে সঙ্গে মাইনেও বাড়বে। আর বিশ্বর যা মাথা, পরীক্ষায় কোনদিন ফেল তো করেনি!
আর শুনতে ইচ্ছে করছে না রমার। হাতের বাটিটা কাঁপছে। এখন ছুটে গিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে ভাল লাগবে। একটা কথাও আস্ত হয়ে মনে পড়বে না। টুকরো টুকরো কথা বুদবুদের মতো কেটে কেটে যাবে, শুধু সামান্য ঢেউ উঠবে। সেই ঢেউয়ের কাঁপনটাই তখন ভাল লাগবে মুখ গুঁজে উপভোগ করতে।
আশা বক বক করে চলেছে। কিছুই কানে ঢুকছে না। মাথার ওপরের এরোপ্লেনটা অনেক দূরে চলে গেলে শব্দটা একটানা হয়ে যায়। আশা একটানা শব্দ করে যাচ্ছে। রমার কৌতূহল আর নেই।
-দিদি আমি যাচ্ছি।
ভূতে পাওয়ার মত রমা নামছিল। সিঁড়িটা অন্ধকার। ধাপগুলো ভাঙা। কে যেন ওপরে আসছে। রমা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
-কোত্থেকে?
একধাপ নিচুতে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জিজ্ঞাসা করল।
-তোমাদের ঘর থেকে।
-এখন যে!
-এমনি। একটা খবর শুনলুম, সত্যি?
রমা একধাপ উঠে দাঁড়াল। ভীষণ কাছাকাছি তারা দাঁড়িয়েছিল। সিঁড়িটাও অন্ধকার। যে কেউ এখন এসে পড়তে পারে।
-আগে শুনি খবরটা কি?
-থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না। বলো না সত্যি?
বিশ্ব একধাপ উঠে এল। রমাও পিছিয়ে যাচ্ছিল। বিশ্ব হাতটা ধরে আটকে রাখল।
-বাটি! কি এনেছিলে?
-মাছ। হাত ছাড়।
-পিছিয়ে যাচ্ছিলে কেন। অমনি করে পিছিয়ে পিছিয়ে শেষকালে কিন্তু আমার ঘরেই পৌঁছতে।
কথার জবাব না দিয়ে রমা মোচড় দিয়ে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল।
-কি জবাব দিচ্ছ না যে?
বিশ্ব মুঠো আলগা করল। ছাড়া পেয়েই রমা ওপর দিকে উঠে যাচ্ছিল। আবার ধরল বিশ্ব। দুহাতে ওর দুই বাহু।
-ছাতে যাবে?
ওরা ছাতে এল। এ সময়ে কেউ ছাতে আসে না, তবু হয়তো কেউ এসে পড়তে পারে। কিন্তু আপাতত ওদের যেন কোন ভয়-ডর নেই।
-এই আর না।
মুখটা পিছনদিকে হেলিয়ে দিল রমা। দু’হাতে আবার টেনে আনল বিশ্ব।
-হাতে বাটি আছে, এবার কিন্তু এক ঘা বসিয়ে দোব।
-দাও।
ঘা দেওয়া হল না। বিশ্বর চুলের ধার ঘেঁষে একটা তারা দেখতে পেল রমা। এক তারা দেখতে নেই। দেখলে কি যেন হয়। আরো দুটো তারা খুঁজে দেখতে হবে। কিন্তু কে দেখে! এই বেশ লাগছে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।
-এই। এই মেয়েটা!
-উঁ।
-কথা বল।
-কি বলবো।
-যা খুশি।
ঘাড়ে, গলায় মুখ ঘষছে বিশ্ব। দাড়ি কামায় নি। জ্বালা করছে। এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বিশ্বর কাঁধে নাক চেপে ধরল রমা। নিঃশ্বাস জমে উঠছে বুকের মধ্যে। বুকটা ভারী হয়ে উঠছে। টলটল করছে। মরার কথা ভাবতে এখন ভারি ভাল লাগে।
-একটা চাকরি পাব বোধ হয়।
-দিদি তাই বলছিল।
-তোমার বাবা মা রাজী হবে তো?
-জানি না। ছাড় এখন, উনুন কামাই যাচ্ছে।
-যাকগে। যদি রাজী না হয় তোমায় নিয়ে পালাব।
-আর চাকরি!
-ওই তোমার দোষ। বড্ড খুঁত ধর কথার।
মজা লাগছে রমার। মিথ্যা বলা বিশ্বর উদ্দেশ্য নয়। তবু আবোল তাবোল কথা বলছে। শুনতে ভাল লাগে। চাকরি পাবে বলেই তাই অনায়াসে চাকরি ছেড়ে পালাবার কথা বলতে পারল। সত্যি সত্যি কি আর তাই বলে পালাবে! এটা শুধু ভালবাসা কতখানি গভীর, তারই জানান দেওয়া। রমার সত্যিই গর্ব হচ্ছে!
-চাকরি পেলে তো আমায় ভুলে যাবে।
-হুঁ।
-দেড়শো টাকার ওপর মাইনে। কত সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ আসবে।
-যে আপিসে চাকরি, সেখানে মেয়েরাও চাকরি করে।
-তাহলে তো আরো ভাল। মুখ্যু মেয়েকে তো আর মনেই থাকবে না।
-হ্যাঁ।
-তাহলে ছাড়, চলে যাই। আঃ আমি কি মানুষ নই, লোহা দিয়ে তৈরী? লাগে না বুঝি?
-না, তুমি মানুষ। মাংস দিয়েই তৈরী। আর একটু থাক। লক্ষ্মীটি আর একটু থাক।
.আরশুলাটাকে মুখে ধরে নিথর হয়ে আছে টিকটিকিটা। মাখমের মত নরম পেট। লেজে সরু সরু দাগ। কালজিরের মত চোখ। মুখের দুপাশে আরশুলার দাঁড়াগুলো গোঁপের মত বেরিয়ে। মাঝে মাঝে খেলার আমোদে যেন দাঁড়াগুলো নাড়াচ্ছে।
আরশুলাটা কি খুব মজা পাচ্ছে! দিনেশ একদৃষ্টে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই টিকটিকিটা ওকে ছেড়ে দেবে। এক ফোঁটা রসও আর তখন বাকি থাকবে না।
এমনি করেই মরতে হবে। মরার সময় মনে এক ফোঁটা কামনাও বাকি থাকবে না। নিঃশেষ হতে হতে তখন এমন অবস্থায় পৌঁছতে হবে যে বাঁচার আর কোন মানেই থাকবে না। কেউ একফোঁটা শোক করবে না। হাঁফ ছেড়ে বলবে সবাই, গেছে ভালই হয়েছে। করুণা পাবার জন্য দুঃখ নেই কিন্তু তার অনুপস্থিতিটা কারুর চোখে ঠেকবে না, দরকারের কথাতেও তাকে মনে পড়বে না, এটাই তো অসহ্য! মরতে যদি হয় তো তেমন করেই মরা উচিত, যখন তার প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যায় নি। প্রয়োজন থাকলেই তার সম্মান আছে। টাকার প্রয়োজন আছে বলেই তার সম্মান আছে। মাধবী তাকে সম্মান করে না, তার মানে কি প্রয়োজন ফুরিয়েছে?
জীবনে কৃতি হতে না পারাটা কি দোষের। প্রত্যেক মানুষের চেষ্টাই তার ক্ষমতার গণ্ডীতে বাঁধা। তাকে লঙ্ঘাতে পারে কে! মাধবীর উচ্চচাশা বড় বড়। তাই গণ্ডীতে পৌঁছেই ঘা খায়। ব্যথায় চীৎকার করে ওঠে। ও যদি মনের ইচ্ছেগুলোকে অতখানি বাড়তে না দিত তা হলে সুখী হ’ত। যেটুকু পেয়েছি তাতেই খুশি থাকা ভাল। কিন্তু সে খুশিটুকুও আর রাখা যাচ্ছে না। হাবে ভাবে মাধবী বুঝিয়ে দিচ্ছে, তার উপস্থিতির আর দরকার নেই। সাহায্য যে করে তাকেই দরকার পড়ে। পরিশ্রমী মানুষকেই দরকারী বলে মাধবীর চোখে নিজেকে দরকারী করে তুলতে হলে খাটতে হবে। কেমন করে, কি উপায়ে খাটতে হবে? ভগবান জানেন সে কথা। বয়স হয়েছে। এখন সব পথ বন্ধ। সব পথ বন্ধ। সব। আর ক্ষমতা নেই নতুন কিছু করার। বুড়ো সিংহের মত ভালমানুষ সেজে বসে থাকতে হবে যদি কখনো ভুল করে সুযোগ সুবিধে নাগালের মধ্যে এসে পড়ে। ভান করতে হবে, নিজের স্বভাব চরিত্র ত্যাগ করতে হবে। বাঁচার জন্য সব পারা যায়। কিন্তু এ বাঁচা কিসের জন্য?
কিসের জন্য বাঁচা একথা তুলে ভাবতে বসলে বাঁচা যায় না। এ সব প্রশ্নের মাথা খাটিয়ে একটা উত্তর খাড়া করা যায়। কিন্তু শরীরটাকে অস্বীকার করা যায় না। আসলে শরীরের মধ্যেই মনটা থাকে। ফুটো হাঁড়িতে জল থাকে না। সংসারের গোড়াকার দাবিদাওয়া এই শরীরটাকে বাঁচাবার জন্য। যেমন তেমন করে হোক আগে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে। ভালমন্দ বিচার করলে চলবে না। মাধবী সম্মান করল কি করল না তাই নিয়ে মন খারাপ করে কি লাভ! সংসার যদি জীবনের সব রস চুষে খায় তাতেই বা লোকসান কি। প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে যায় তখন লাভ কি বেঁচে থেকে? কোন রকমে যখন বাঁচতে হবেই, তখন সাত-পাঁচ না ভাবলেই কি লোকসান হবে কিছু?
লাভ-লোকসান দুটোকেই বিসর্জন দিলে মানুষের আর থাকে কি? কি অদ্ভুত অবস্থা! বিচার বুদ্ধি খাটাবার ক্ষমতাই যদি ফুরিয়ে যায় তাহলে বুঝব কি করে আমি আছি। আমি বেঁচে আছি। অথচ লাভ লোকসানের কথা উঠলেই যন্ত্রণা কামড়ায়। আরশুলাটা খেলার আমোদে নয়, যন্ত্রণায় দাড়া নাড়ছিল তাহলে। টিকটিকিটার ক্ষিদে পেয়েছে। ওর কিছু অন্যায় হয়নি আরশুলাকে মেরে ফেলায়। ক্ষিদে পেলে তাকে মেটাতেই হবে। সংসারের ক্ষিদে আছে। সংসারটা একটা রাক্ষস। টিকটিকি আর সংসার এক জাতের। মানুষে আর আরশুলায় কোন তফাত নেই।
-বসেই আছ যখন আলোটা নিভিয়ে দাও না।
নিজেকে বোকা মনে হল দিনেশের। বইয়ে চোখ রেখে সে বসে আছে অথচ মাধবী ঠিক বুঝে ফেলেছে সে পড়ছে না। বোধ হয় মাধবী এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।-কারেণ্ট খরচা করে না পড়ে, এসময়টা তো বাইরে কাটাতে পার। মহিম ঠাকুরপোর কাছেওতো যেতে পার।
-আজ গেছলুম মহিমের কাছে। অফিসে ফোন করেছিল ছুটির পর রমার জন্য। একটা সম্বন্ধের খোঁজ দিল।
উঠে বসল মাধবী। দিনেশ মুখ ঘুরিয়ে দেখল আরশুলাটাকে। টিকটিকিটা চলে যাচ্ছে। তুলতুলে ভাঁজ পড়ছে পেটে। লেজটা বাঁকানো। কোমল। আরশুলাটা এখনো বেঁচে আছে। বারদুয়েক আছড়াল। আবার যেতে শুরু করেছে টিকটিকিটা। লেজটা সাপের ফণার মত নড়ছে।
-হাঁ করে আছ কেন? সবটা বল।
-ভালই সম্বন্ধটা। কলকাতায় দুখানা বাড়ি আছে।
-কি আছে?
-বাড়ি। সাড়ে চারশো টাকা ভাড়া আদায় হয়। পোস্তায় ঝাড়াই মসলার কারবার আছে।
-ছেলে কেমন?
উঠে এল মাধবী টেবিলের পাশে। একটা কোণ আঁকড়ে ধরে দাঁড়াল। নীল সাপের মতো শিরা, কব্জী থেকে কনুই পর্যন্ত পাকিয়ে দপদপ করছে। হাতটা সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল দিনেশের।
-ছেলে ভালই।
-লেখাপড়া, বয়স, স্বভাব চরিত্র এসব কেমন?
-ভাল।
-কে বলল তোমায়?
-কে আবার বলবে? ভাল বলতে তুমি কি বোঝ? মদ খায়না, রেস খেলে না, তা হলেই ভাল ছেলে হয়? আজকের দিনে ভালমন্দের কোন তফাত আছে নাকি!
তীব্র চোখে তাকিয়ে রইল দিনেশ। নীল সাপটা ক্রমশ তাকে হিংস্র করে তুলছে। মাধবী আশ্চর্য হয়েছে দিনেশের আচরণে। রাগটাকে চেপে সে বলল:
-তফাত আছে বৈকি। শুধু পয়সা কড়ি দেখলেই চলে না। মেয়ের সুখটা আগে দেখতে হবে।
-তোমার মেয়েই বা এমন কি? ছেলেরাও তো সুখ চায়।
-আমার মেয়েকে পেলে যে ছেলে সুখী হবে, তেমন ছেলেই আমার দরকার। পয়সাওলা ঘরে মেয়েকে না দিলেও দুঃখ নাই।
-কেন পয়সাওলাদের কি হৃদয় বলে কিছু নেই, তারা কি গরীবের মেয়েকে কোনদিন বিয়ে করে না? তাছাড়া মহিম এ সম্বন্ধের খোঁজ দিয়েছে যখন তখন স্বভাব চরিত্রের কথাই ওঠে না।
-তবু আমাদের একটা কর্তব্য আছে।
-সে ত আছেই। জীবনে হাজার কর্তব্য আছে, তার কটা আমরা পালন করি?
-যে কটা পারা যায়, তা করতেই বা ক্ষতি কি! বিয়েটা হেলা-ফেলার জিনিস নয়। তর্ক করে ভালোকে মন্দ করা যায় না। মেয়ের সারা জীবনের সুখ এর ওপর নির্ভর করছে। ছেলের লেখাপড়া কদ্দূর?
-টাকা-পয়সা আছে।
-থাকলেই বা, মেয়ে কি টাকা-পয়সার সঙ্গে ঘর করবে?
-হ্যাঁ, তাই করবে। টাকা-পয়সা না থাকলে শিক্ষাদীক্ষার কোন মানে হয় না।
-বয়স কত?
-বয়স একটু হয়েছে। কিন্তু অত কথায় দরকার কি। কমবয়সী ক্ষয়া চেহারার শিক্ষিত ছেলে তো পথে-ঘাটে দেখা যায়, তুমি তাদের একটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী আছ?
-সে অন্য কথা। ছেলের কত বয়েস?
-দুটি মেয়ে আছে, বৌ মারা গেছে। বড় মেয়েটির বছর পনরো বয়স।
মাধবীর হাতের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল দিনেশ। শিকার ধরে সাপটা যেন গর্তে লুকোল। দিনেশের মেরুদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত ঠেলে উঠল। কোথায় লুকোল সাপটা? মাধবীর শরীরে চোখ রাখল সে।
-এর থেকে মেয়েটাকে বিক্রি করে দিলেই তো পার, ঘরে টাকাও আসবে, ঝঞ্ঝাটও চুকবে।
-কিন্তু সংসারের কথাটাও তো ভাবতে হবে। আমি আর ক’দিন। পয়সাওলা জামাই কি তোমাদের দেখাশুনো না করে পারবে! ব্যবসায়ীলোক, ছেলেটারও একটা হিল্লে করে দিতে পারবে?
-নিজের যা আছে তাইতেই চালাব, জামাইয়ের দয়ায় থাকব কেন? শুনে লাফিয়ে উঠল দিনেশ, থরথরিয়ে হাঁটু কাঁপছে। মুখে লালা উঠছে। ঢোক গিলল সে।
-খাবে কি? এরপর খাবে কি? তখন তো আমায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।
মাধবী আবার শুয়ে পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে দিনেশ তাকিয়ে রইল। মাধবী নয়, সেই টিকটিকিটা পরিতৃপ্ত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে।
সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল দিনেশ।
দেখতে দেখতে অবসাদে ঝাপসা হয়ে আসে দিনেশের চোখ। টেবিলে মাথা রাখে। হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে।
-বাবা।
সানু ডাকছে। মাথা তুলল দিনেশ।
-চার আনা পয়সা দেবে। বাবু, সাণ্টে, সোনা, ওরা সবাই চিড়িয়াখানা যাচ্ছে।
থেমে গেল সানু দিনেশের মুখের ভাঁজগুলোকে বিশ্রীভাবে নড়ে উঠতে দেখে। ভয়ে পিছিয়ে গেল সে। টেবিলের পাশেই ছাতাটা নজরে পড়ল দিনেশের।
-চিড়িয়াখানা যাবি, ফুর্তি করবি, পড়াশুনো বুঝি চুলোয় গেছে। খাবি কি দুদিন পরে, চিড়িয়াখানা দেখে কি পেট ভরবে?
নির্মমভাবে দিনেশ ছাতা দিয়ে সানুকে পিটতে শুরু করল। মাধবী উঠে এসে সানুকে বাঁচাল। সানু কাঁদেনি। মার খাওয়া ওর অভ্যাস আছে।
-ছেলেকে মেরে কি হবে। তেজ দেখাতে হয় তো বাইরে যাও। মুরোদ কত, তা’ত বোঝাই গেছে।
চেয়ারে বসে পড়ল দিনেশ। অবসন্ন লাগছে। বগলের তলা জবজব করছে। বুকের ওপর দিয়ে ঘাম নামছে। কোমরের কসিতে আটকে গেল। আবার আর একটা স্রোত নামছে। এটাও বাধা পেল। গলার কাছে একটা ব্যথা। ঢোঁক গেলা যাচ্ছে না। চোখের পাতা চটচট করছে, জড়িয়ে যাচ্ছে। আঙুলগুলো তখন থেকে বাঁকানোই আছে। বইয়ে কি অক্ষর লেখা। এটা কি বই? পাঁজি। আজ কি বার? বেস্পতির তেরস্পর্শ কাকে বলে। শুক্রপুষ্ট বটিকার বিজ্ঞাপন পাঁজিতে কেন! ধাড়ি লোকেরা এগুলো পড়ে? নিশ্চয় পড়ে, নইলে টাকা খরচ করে ব্যবসার বিজ্ঞাপন দেবে কেন! মাধবী রোগা হয়ে গেছে। ও খুব খাটে। ভাল কিছু খাওয়া উচিত। টনিক খাওয়া উচিত। মাধবী টিকটিকি। ওকেও শুষে নিয়েছে সংসার। আমরা সবাই টিকটিকির ছানা। সংসারটা টিকটিকি। আমরাই আবার কখনো কখনো আরশুলা হয়ে যাই। মাধবীকে কি কখনো চুষে খেয়েছি? হয় তো হবে। ও বড় ভাল। মেয়েকে ও ভালবাসে। আমিও বাসি। রমাকে একটা বুড়ো হাবড়ার হাতে তুলে দিচ্ছিলুম। মাধবী হ’তে দিল না। মাধবী ভালো। ওকি আজ আসবে না। আসতে আজ এত দেরি হচ্ছে কেন?
.ঘুমোতে চাইছে না রমা। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করলেই ঝুরঝুরে কয়লার গুঁড়ো পড়ে। পড়তে পড়তে ঢিপি হয়ে যায়। তখন চোখ আটকে যায়। অন্ধকার কয়লার গুঁড়োর মতো। ঘুম অন্ধকারের মতো। অন্ধকার এখন দরকার নেই। ঝকঝকে আলো, বিয়ে বাড়ির আলোর মতো রঙ বেরঙের আলো, মনের মধ্যে জ্বলে উঠেছে। সুর উঠছে। সানাইয়ের সুর। শাঁখ বাজছে। ছাঁদনাতলা, পিঁড়ি, সাতপাক, মালাবদল, শুভদৃষ্টি। বর বড় না কনে বড়। সম্প্রদান, বাসর।
ঘুম আসছে। রমা মুখের সামনে হাত নাড়ল। যেন ওতেই তাড়ান যাবে অন্ধকার। বাসরঘরে অন্ধকার কোথায়! ফিসফাস, শাড়ির খসখস, হাসি, একটা দুটো গান, ঠাট্টা, ছাদে হুড়োহুড়ি, গলিতে খুরি গেলাসের শব্দ, কুকুরের চীৎকার। সেণ্টের গন্ধ, ঘিয়ের গন্ধ, গা গুলোচ্ছে।
উঠে বসল রমা। জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কান্না, কান্না, কান্না। কনকাঞ্জলি, দুধ উথলানো, ল্যাটা মাছ ধরা, এবাড়ি-ওবাড়ির জানলা বারান্দায় অচেনা ভিড়, তারপর রাত পুইয়েই আর একটা দিন। তত্ত্ব আসবে, আবার হৈ চৈ, ছাদে ম্যারাপ, হাতভরা যৌতুক-উপহার, চেনা মুখ, সেণ্ট-ঘি’র গন্ধ। বাড়ি শান্ত, শরীর ভারভার, ঠাট্টা তামাসা, পা-চলে না, একটা ঘোর। ফুল, ফুল, ফুল। নতুন তোশকের গন্ধ, পরিষ্কার চাদর, বন্ধ দরজা, কেউ হেসে ফেলল, আলো নিভে গেল। ফুল, ফুল, ফুল।
এখন ঘুম পাচ্ছে। কালকেই বিশ্বকে বলতে হবে একটা আলাদা বাড়ির কথা। এ বাড়িটা নোংরা, নড়বড়ে, ঘিঞ্জি। আর কি! জানলায় পর্দা, একটা ভাল আয়নাতে নিজের মুখ দেখলে ভয় করবে না। সঙ্গে একটা যদি বারান্দা পাওয়া যায়! ফেরিওলা গেলেই চট করে ডাকা যাবে, পাশের বাড়ির সঙ্গে গল্প করা যাবে। দূর থেকে বিশ্বকে আসতে দেখা যাবে। আর কি? পাতলা চিনে মাটির কাপ। একটা ছেঁকনি। কলাই-চটা কাপে চা খেলে অসুখ করে, ন্যাকড়ায় চা ছাঁকলে বিশ্রী দেখায়। আর কি চাই! কি জানি, ঘুম পাচ্ছে। জুতো সাফ করার বুরুশ, ধোপাবাড়ির ফর্দ রাখার খাতা, আর, আর যদি একটা রেডিও হয়। রেডিও থাকলে ঘরটাকে ঝকমকে দেখাবে। যমুনার কলের গান আছে। দুবার শুনলেই গানগুলো একঘেয়ে হয়ে যায়। যমুনা বলেছিল, সিনেমায় নাকি মেয়েরা বাগানে ফুল তুলে খোঁপায় গোঁজার সময় গান গায়। ও ভীষণ সিনেমা দেখে। অত দেখা খারাপ। কথাবার্তা, চালচলন কেমন যেন আলাদা ঢঙের হয়ে যায়। গেরস্থ ঘরে ওসব আর ক’দিন মানায়। কিন্তু তাই বলে সিনেমা দেখা কি বন্ধ থাকবে! মোটেই না। মাঝে মাঝে দেখব। কান্নাকাটির বইগুলো একদম দেখব না। যাবার সময় হেঁটে যাব। পাশাপাশি। আভা বলেছিল রাস্তায় বেরোলে ও ঘোমটা দেয় না, বোঝাই যায় না বিয়ে হয়েছে কি না, সিঁদুর খুব সরু করে দেয়। এতে নাকি সুবিধেই হয়, ছেলে-ছোকরারা খাতির করে। আমার খাতিরে দরকার নেই। ওতে নিন্দে হয়।
পাশ ফিরল রমা। এবার আর জাগা নয়। অনেক রাত হয়েছে। পাশের বাড়ির নির্মল-কাকার বৌ ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে কলতলায় নিয়ে গেছে। ঠিক ঘড়ি ধরে ওর সব কাজ। এরপর দুধ খাওয়াবে। নির্মলকাকা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। সকাল হতে আর ক’ঘণ্টাই বা বাকি। আর জেগে থাকা নয়।
গরম লাগছে। আহা রে। সানু হাতটা এমনভাবে ছড়িয়ে রাখে যেন লেগেছে বোধ হয়। তবু ঘুম ভাঙল না ছেলেটার। সারাদিন যা দুষ্টামি করে, ঘুমোলেই কাদা, ঘুমোলে ছোট ছেলেরা ভারী হয়ে যায়। বড় মানুষ হয় কি? ছেলেটা রোগা হয়ে যাচ্ছে। এখন বাড়ের সময়, ক্ষিদেও বাড়ে। ভাত খেতেই ওর যত অরুচি। আলুকাবলি আর চাটনি খেলেই কি হাড়ে মাস লাগবে। ওরই বা দোষ কি। যা বাজার আসে, সেই একঘেয়ে রান্না, বড়দেরই তো অরুচি আসে।
ঘুমের ঘোরে রমাকে জড়িয়ে ধরল সানু।
মুখের নাল চক চক শব্দ করে গিলে ফেলল ও। খরখর করে নেংটি ইঁদুর কি যেন করছে তোরঙ্গের তলায়। মুখে হুশ শব্দ করল রমা। সানু চমকে উঠল। রমাকে জোরে আঁকড়ে ধরল।
শিরশির করছে বুকটা যেখানে সানুর মাথাটা ছুঁয়ে আছে। ওর একটু নিচেই চামড়াটা ছড়ে গেছে। একদিন বুকের কাছে, সানুর মত এমনি করে নরম তুলতুলে কাদার মত কেউ হয়তো শুয়ে থাকবে। কচি দুটো হাত দিয়ে হাতড়াবে বুকের কাছটা, ছেলেবেলায় সানু যেমন করত। মা’র কাছে ও আর ক’দিন ছিল, আমিই তো বুকে-পিঠে করে এতো বড়টি করলুম। আজ মিছিমিছি ছেলেটা মার খেল চার আনা পয়সার জন্য। কেউ জানে না তোরঙ্গগুলোর পেছনে লুকনো কৌটোটার কথা। টাকা আড়াই বোধ হয় জমেছে। গুনতে গেলেই তো দেখে ফেলবে। কালকেই সানুকে পয়সা দোব। না আর নয়। এবার ঘুম। সকাল থেকেই তো আবার কাজ। বিশ্ব চাকরি পাচ্ছে। বড় আশা, বড় কামনা করে লাভ কি। জীবন কি চায়। সুখ, নির্ঝঞ্ঝাট শান্তি, হাসি, সম্মান ব্যস। বিশ্ব টাকা আনবে। ঘর বাঁধবে। আমায় নিয়ে সংসার করবে। এবার ঘুম। এবার শান্তি। এবার ঘুম। এবার অন্ধকার। আলো নিভল। ফুল, ফুল, ফুল।
পাঁচ
চেনাশুনো কেউ আছে কিনা, খুঁজে বার করার জন্য এধার ওধার তাকাতে চায়। এতগুলো টেবিল চেয়ার, তাই চট করে চেনা মানুষদেরও খুঁজে বার করা যায় না। আলাদা করে প্রত্যেক টেবিলে নজর করতে হয়।
আবার প্রত্যেক টেবিলের লোকও, যখনই কেউ ঢোকে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। চেনা কাউকে দেখলে হাত তুলে জানান দেয়।
প্রথম দিন থেকেই চিনুর অস্বস্তি লেগেছিল এই খুঁজে বার করার ব্যাপারটায়। আজও ধাতস্থ হয়নি। সারা ঘরের লোক তাকিয়ে থাকে। অতগুলো চাউনি একপলকের জন্য হলেও বিব্রত করে। সকলেই বসে আর সে দাঁড়িয়ে, ফলে যেন সে একটু আলাদা হয়ে পড়ে। কিন্তু একবার বসে পড়লেই, সমান। আর আলাদা মনে হয় না।
চিনু যখন ঢুকল কেউ হাত তুলে জানান দেয়নি। ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা। দু’তিনটে টেবিল একদম খালি। আরগুলোয় দু’চারজন ক’রে।
অমল বসেছিল একটেরেয়। দক্ষিণ দিকের জানলাটার ধারে। জানলা থেকে ঝুঁকে ট্রাম রাস্তা দেখা যায়। চেয়ার থেকে দেখা যায় আকাশ আর একটা কি গাছ যেন।
দুটি ছেলে কথা বলছে অমলের সঙ্গে। চিনুকে দেখে ওরা একটুক্ষণ চুপ করল।
-আমাদের কিন্তু খুব আশা ছিল আপনি একটা দেবেন।
-বললুম তো লেখা ছেড়ে দিয়েছি।
-আবার লিখুন তাহলে। আপনারা যদি লেখা ছাড়েন,-
ছেলেটি হাসল। অমল বিরক্ত হয়ে চিনুর দিকে নজর দিল।
-তোকে খুঁজছিলুম। খুব দরকার আছে।
-তাহলে কবে নাগাদ আসব?
-বললুম তো, লেখাপত্তর ছেড়ে দিয়েছি।
স্বরটা রূঢ় শোনাল চিনুর কানে। ছেলে দুটি তবুও হাসল। নমস্কার করে চলে গেল।
-পত্রিকা বার করবে। ভগবান জানে কেন বার করবে। কবির জন্যে একটা পয়সাও খরচ করবে না। ভাবখানা এমন যেন ছাপিয়ে করবে। লিখতে যেন খাটনি নেই।
অনেকবার শোনা কথা। চিনু আলোচনাটা গায়ে না মেখে জিজ্ঞেস করল।
-দরকার কি বলছিলি!
-কিছু না, ওদের তাড়াবার জন্য বলেছিলুম।
-আর সব কোথায়?
-আসেনি। দুটো টাকা আছে, মানে যোগাড় করে দিতে পারিস? রেলওয়েতে লোক নেবে। একটা অ্যাপ্লিকেশন করব।
-কোথায় দেখলি, কাগজে?
-হ্যাঁ!
অমল চুপ করে গেল। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল।
-চিনু, তুইও একটা অ্যাপ্লিকেশন কর। পড়াশুনো যদি না করিস তাহলে এমন করে বসে থাকারও কোন মানে হয় না।
এটাও চিনুর অনেকবার শোনা কথা। আড্ডার হৈ চৈ-য়ের মধ্যে হয়ত কেউ বলেছে। কিন্তু আজকের শোনাটা একটু অন্যরকমের, কেন-না, অমলের বলার ঢঙ, সুর সবই আলাদা মেজাজের। চুপ করে রইল চিনু।
-এটা আমি ঠেকে শিখেছি। আর কিছু না হোক বি. এ. ডিগ্রিটার বাজার দাম আছে, সামাজিক মূল্যও আছে। তা তুই যতই নিজেকে পণ্ডিত ঠাওরাস না কেন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে তো হবে।
-কফি খেয়েছিস দেখছি।
চিনু টেবিলের তিনটে কাপ দেখল। জল ভর্তি তিনটে গ্লাসও রয়েছে।
-হ্যাঁ, ওরাই খাওয়াল। কেন যে ওরা কাগজ বার করে।
এক গ্লাস জল খেল চিনু। একটি মেয়ে দুটি পুরুষের সঙ্গে ঢুকল। কে যেন বলেছিল কলেজে পড়ার সময় ওর কী একটা খারাপ রোগ হয়। এখন পড়া ছেড়েছে, বাড়িতেও থাকে না। বাজি ফেলে ওকে চোখ দিয়ে কী যেন ইঙ্গিত করেছিল অমল। এক কাপ কফি পেয়েছিল।
অমল তাকিয়েছিল উঁচুতে। স্কাইলাইটগুলো দিয়ে আলো এসেছে। কাচের ধুলো ছেঁকে নিয়েছে আলোর তীব্রতা। সাদা দেয়ালে ঘা খেয়ে কতটুকুই বা আর এতবড় ঘরের অন্ধকারকে দুর্বল করতে পারে। মেয়েটি তার সঙ্গীদের নিয়ে বসল চিনুর পিছন দিকে। অমল চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিল সামান্য, যাতে চিনুর দিকে তাকাতে গেলে ওদের না দেখতে হয়।
ঘাড় ফিরিয়ে চিনু পিছন দিকে তাকাল।
-কি দেখছিস।
-আজকের দুটো নতুন মনে হচ্ছে।
-তা’তে কি হয়েছে?
অমলের সুরটা ঝাঁঝালো। উত্তর দিতে পারল না চিনু। পা দুটোকে আরো ঠেলে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসার মত করে বসল অমল। ঘাড়টা রাখল চেয়ারের পিঠের কানায়, হাত দুটো বুকে।
-ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলুম। ওই বয়সেই বোধ হয় যথার্থ ভালবাসা যায়। মেয়েটার স্বাস্থ্য ছিল। একে দেখে মনে পড়ল।
-সাধারণতঃ তাই হয়।
-মোটাদের আমি ঘেন্না করি।
-তা অনেকেই করে, ওটা এমন কিছু একটা কথা নয়।
-এক সময় আমি ব্যায়াম করতুম। পাড়ার মস্তান ছিলুম। মেয়েটা আমায় পছন্দ করত। ওর বাবা জানতে পেরে ওকে খুব মেরেছিল। তারপর কোথায় যেন উঠে গেল। মেয়েটা ঠিকানা দিয়েছিল নতুন বাসার। চেষ্টা করেও খুঁজে বার করতেও পারিনি। সে বছরই আই-এ ফেল করলুম।
থেমে থেমে, যেন নাটকের এক দীর্ঘ সংলাপ বলছে অমল। জানলার বাইরে থেকে চোখটাকে মাঝে মাঝে এনে ফেলছে চিনুর মুখে। টেবিলে খানিকটা চিনি পড়েছিল, তাই জড়ো করতে শুরু করল চিনু।
-পরের বছর পাশ করে আর পড়তে ইচ্ছে করেনি, বাবাই জোর করে কলেজে ঢোকাল। এখানে আর একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। দেখতে ভারি ভালো। মনে হত ও হচ্ছে পৃথিবীর শেষ মেয়ে যার মুখ শিশুর মতো নিষ্পাপ। একদিন আমরা দোকানে চা খাচ্ছিলুম। ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নামল। ও বলল, বৃষ্টিতে ভিজবে। সেদিনই সদ্য পাট-ভাঙা প্যাণ্ট পরেছি। রাজী হলুম না। তুই হলে কি করতিস?
-বলতে পারি না। অমন অবস্থায় না পড়লে কেউ বলতে পারে না।
-এখন যদি ঐ মেয়েটা বলে চলুন সিনেমায় যাই!
আঙুল তুলে অমল দেখাল চিনুর পিছনে।
-দুটো মেয়েকে তুই এক করে দেখছিস!
-তাই নাকি! আচ্ছা, ভুল হয়ে গেছে। সেদিন আমার মনে মনে ইচ্ছে থাকলেও রাজী হইনি। রাস্তাটায় একটা গর্ত ছিল। লেলাণ্ড কমেটগুলো কাদা ছিটিয়ে যাচ্ছিল। পথচারীদের সে কি সাবধানী ব্যস্ততা! চিনু তুই আমাদের বাসাটা দেখেছিস?
-আগেরটা? না।
-ইঁদুরে কাটা কাগজের মত গন্ধ। একটা ঘরে বাবা মা ছয় ভাই বোন থাকত। আমি শুতুম ঘরের বাইরের রকে। পাশেই নর্দমা। কুৎসিত আমাদের বেঁচে থাকাটা, তবু বেঁচে আছি। খুব সাবধানে বিপদ এড়িয়ে পথচলতি মানুষদের মতই। তবু বড় বড় বাসগুলোর মত এক একটা বিপর্যয় এসে নোংরা ছিটিয়ে চলে যায়। দেখে অন্যরা হাসে। এই হাসিটা আমি সহ্য করতে পারি না। মেয়েটাকে, নিষ্পাপ মুখ সত্ত্বেও, সহ্য করতে পারিনি। কেরানীর ছেলেদের বুদ্ধি অল্পবয়সেই পাকে, বুঝেছিলুম ওকে নিয়ে ঝামেলায় ভুগতে হবে, তাই অন্য একটা ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েই সরে পড়লুম। সেদিন ওদের বিয়ে হয়ে গেছে, নেমন্তন্ন করেছিল যাইনি, রজনীগন্ধার ডাঁটা দিতেও তো পয়সা লাগে।
হাসল অমল, চিনুও। চুপ করে রইল ওরা। ঠুকঠুক করে টেবিলে চামচ ঠুকে কে ওয়েটারকে ডাকল। দু তিনটে চেয়ার একসঙ্গে সরাবার শব্দ হল। চোখ বুজে অমল বলল:
-কাউকে ভালবাসলে মনে খচখচ করে, কি যেন অস্বস্তি হয়। কোথায় যেন একটা ভয় ধরে। ভয়টাকে বাধা দেবার মত জোর আমাদের কারুর নেই। পৃথিবীর সব মানুষের মত আমিও রুগ্ন, তাদের মত আমিও একজন; তাই অসহ্য লাগে স্বাস্থ্যবান মোটাদের, ঘেন্না হয় দেখলে। ওরা এ পৃথিবীর যেন কেউ নয়। আসলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই এখন বড় কথা। প্রেম-ফ্রেম পরের ব্যাপার।
চোখ খুলল অমল। ও যেন চোখ বুজলেই একটা অদৃশ্য বাইরের খোলা পাতা দেখতে পায়। আর গড়গড় করে তার থেকে পড়তে শুরু করে দেয়। আড্ডায় ও কম কথা বলে। আজ শুধুমাত্র দু’জন। তাই কথা ছুটিয়েছে।
পিছন থেকে হেসে উঠল মেয়েটি। চিনু ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। তখনও হাসছে। দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে।
-প্রেমে পড়লেই অনেক ভাবনা আসে।
চিনু বলল। বলার পিছনে কোন কিছুর তাগিদ নেই। চিনিগুলো টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছে। হাতে এখন কোন কাজ নেই। পাশের খালি চেয়ারটায় পা তুলে দিল।
-হ্যাঁ, সে কোন মেয়েকেই হোক বা বৃদ্ধ, শিশু, গাছপালা, পিঁপড়ে যাই হোক। প্রেমের সঙ্গে কতকগুলো দায়িত্ব আসে, বোধ হয় বিবেক থেকে। এই বিবেকটিকেই এড়িয়ে চলা বুদ্ধিমানের। ঝামেলা পোয়াতে যদি ভালবাসতুম তাহলে আরো আগে থেকেই চাকরির চেষ্টা করতুম। আমার মেজ বোনটাকে দেখেছিস তো, দেখলে কি মনে হয় ওর বয়স উনিশ। অপুষ্টির জন্যই অমন দশা। ফ্রক পরতে চায় না, ও আমার খুব প্রিয়, ইচ্ছে করে কাপড় কিনে দি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা দায়িত্বও ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে চায়। তখনই এই ভালবাসা, দয়া বা এই ধরনের জিনিসগুলোকে খারাপ লাগতে শুরু করে। পাড়ার একটা ছোকরা ওকে ভালবেসেছে, আমাদের বাসায় আসে, আমার বয়সী, আমাকে দাদা বলে। একদিন দেখি বোনটার সঙ্গে খুব মেলামেশা করছে। ভাবলুম চড় কসাই, কসাতে পারিনি কেন বলতো? ওরা কি অন্যায় করছিল!
-আর ভাল লাগছে না অমল। এবার ওঠ, একটু বাইরে বেরোই।
-বোস না, সিগারেট আছে?
-আছে।
-ক্যাপষ্টান?
-না। কাঁচি।
-দরকার নেই। দুটো আলোর রঙ লক্ষ্য কর। এই ঘরের মধ্যে আর বাইরের আলো দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়, কিন্তু ভেতরের আলো সেই একরকমই রয়ে গেছে। কোনদিন বিকেলেই সূর্যাস্ত দেখা হল না। এতে কিন্তু কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না, কোনদিন আপসোসও করিনি। মনে হয়নি জীবন ব্যর্থ। এই ঘর থেকে বাইরের দিকে তাকালে নিজেকে মস্ত মনে হয়। আবার ওই স্কাইলাইটগুলোকে দেখতেও ভাল লাগে। বিকেলের আলোর একটা আলাদা রঙ আছে। ওই কাচগুলোর দিকে তাকালে তা ধরা পড়ে। এই ঘর থেকেই রঙটা দেখা যায়। অস্ত যাবার সময় সূর্যের আলো শুধু ওপর দিকেই পড়ে। আমার মনে হয় এ সময় সকলেরই ওপর দিকে তাকানো উচিত। কিন্তু কে দেখছে বল, কলকাতার মানুষ যন্ত্র হয়ে গেছে। যে যার নিজের তালে ঘুরছে। বলেছি তো খাওয়া-পরার তাগিদটাই সব থেকে বড় জিনিস।
-এবার আমি উঠব অমল। একঘেয়ে সুরের কথা আমার ভাল লাগে না। ঘুম পায়।
-তা হলে ঘুমো।
-ফাজলামি হচ্ছে?
চোখাচোখ হতে দুজনে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আলো জ্বালাচ্ছে ঘরের। অমলের মাথার ওপরেই সুইচ। চিনু উঠে জ্বালিয়ে দিল। মণীষ এল অফিস থেকে।
-দুটো টাকা দিতে পারিস?
-তোর খালি এক কথা।
-খুব দরকার।
-একে ট্রামের ভিড়, তার ওপর উদ্বাস্তু মিছিলে একঘণ্টা আটকা থেকে, এই সবে আসছি। একটু জিরোতে দে, তা নয় অমনি শুরু করেছিস?
চেয়ারে বাবু হয়ে বসল মণীষ। চিনু ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। মেয়েটি উঠে গেছে কখন সঙ্গীদের নিয়ে। অমল বাইরের দিকে তাকিয়ে। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে গাল দুটো। তার নাকটা ফুলে উঠল একবার ভারী নিঃশ্বাসে। চেয়ারের হাতলে আনমনে হাত বুলোচ্ছে।
চিনু মনে মনে হাসতে লাগলো।
ছুটির পর রোজ হেঁটে আসতে হয় দিনেশকে লালবাজার পর্যন্ত। ট্রামের বোর্ডে তখনও লেখা থাকে ডালহৌসি। ট্রামে ওঠার জন্য জোর লাগাতে হয়। বয়স হয়েছে। ছেলে-ছোকরারা ধাক্কা দিয়ে আগে উঠে যায়। ফার্স্ট ক্লাশেই ভিড়টা বেশি হয়। এর কারণ বুঝে উঠতে পারেনি দিনেশ। লোকের পকেটে কি বেশি পয়সা এসেছে, না মানসম্মান এত বেড়ে গেছে যে দ্বিতীয়টায় উঠলে খোয়া যাবে! পয়সা বেশি হলেই কেউ ফার্স্ট ক্লাশে চড়ে না। ক্লাশটা করা হয়েছে সামাজিক অবস্থার স্তরগুলোকে স্পষ্ট করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার জন্য। সুতরাং টাকা বাড়লেই সেটাকে জাহির করে সমাজে কিছুটা খাতির আদায় তো লোকে করবেই। তার মানে কি ফার্স্ট ক্লাশে যারা চড়ে তারা বেশ ধনী? তাও নয়, ধনীরা কি দুঃখে ভিড়ে গাদাগাদি ক’রে মরবে!
তাহলে ব্যাপারটা কি? দিনেশ ট্রামে উঠলেই রোজ একবার ক’রে ভাবে, লোকে কেন ফার্স্ট ক্লাশে ওঠে! সে নিজে দু’একদিন ফার্স্ট ক্লাশে উঠে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিল। কিছুই বুঝতে পারে নি। তারমত কেরানীরাও ফার্স্ট ক্লাশে চড়ে। সেকেণ্ড ক্লাশে ভিড় কম থাকলেও চড়ে না। এক পয়সা বাঁচানোর জন্য কলকাতার মানুষ কি বিরাট আন্দোলনই না করেছিল। এক পয়সারও আজ অনেক দাম। তাহলে ওরা কেন সেকেণ্ড ক্লাশে চড়ে না!
এর একটা কারণই সে খুঁজে বার করেছে। সেটা মান-সম্মানের কথা। সব গিয়ে মানুষ যেন এই একটি জিনিসকেই আঁকড়ে ধরেছে। দুটো পয়সাও আপাতত তুচ্ছ মনে হয়। পরিচ্ছন্ন পোশাক, গদিমোড়া সিট, ভদ্র হবার চেষ্টা, এগুলোতেও মন কিছুক্ষণ প্রসন্ন থাকে। দু’পয়সায় শুধু এটুকু লাভ। আর লাভের লোভেই এত ভিড় ফার্স্ট ক্লাশে।
এত ক’রে তবুও তফাতটা ঠিক ঘুচলো না। কি ক’রে ঘুচবে, মানুষগুলো যে এক। দুটো ক্লাশেই যারা ওঠে, রোজগারের দিক থেকে তফাতটা খুব বিরাট নয়। স্বভাব, মেজাজ, চালচলনেরও খুব তফাত নেই। এটা দিনেশ দুটো ক্লাশে চড়েই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এটুকু বুঝতে গিয়েও আজ ধাঁধাঁ লাগে। তফাত যদি নেই-ই তাহলে মানুষ সেকেণ্ড ক্লাশে চড়ে না কেন? সেখানেও বোধ হয় ওই সম্মান বোধ কাজ করছে। যদি সকলের রোজগারই সমান হয় তাহলে কি ক্লাশ উঠে যাবে? শিক্ষা-দীক্ষা থেকে অহঙ্কার আসে। শিক্ষিতের মধ্যে কি স্তর ভাগ ঘোচান যায়? তফাত থাকবেই। অহঙ্কার থাকবেই। আইন করে ক্লাশ তুলে দিলেই কি অহঙ্কার ঘুচবে! ওটা ঘোচে ভেতর থেকে। যখন দেখবে শিক্ষায় বা রুচিতে পাশের মানুষটি খাটো নয়।
তাহলে মানতে হয় সেকেণ্ড ক্লাশে যারা ওঠে শিক্ষায় বা রুচিতে তারা ফার্স্ট ক্লাশের থেকে খাটো। এখানে রোজগারের কথাটা বড় নয়, এক রোজগারের মানুষের মধ্যেও অনেক তফাত থাকে। কিন্তু নিজেকে অশিক্ষিত ভাবতে কষ্ট হয় দিনেশের। রাগও হয়, ফার্স্ট ক্লাশে চড়া মানুষগুলোর ব্যবহারের কথা মনে পড়ে। অন্যকে বঞ্চিত করে সিটে বসার জন্য লোলুপতা দুটো ক্লাশেই আছে। ভাড়া ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগই দুটো ক্লাশ ছেড়ে দেয় না। ঝগড়া মারামারিতে কেউই অপটু নয়। তবু খাতির পায় ফার্স্ট ক্লাশে চড়া মানুষগুলো। মাধবীর মত গোটা সমাজটাই যেন অন্ধ হয়ে গেছে। দেখতে না পারলে বুঝবে কি! মান-সম্মান, টাকা থাকলেই দিতে হবে, এ নিয়ম বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু এরা তা বোঝেনি। মাধবীর কাছে শিক্ষা-রুচির দাম নেই, টাকাটাই সব।
কিন্তু টাকাকে অবহেলা করার মত বুকের পাটাই বা কোথায়। তাহলে রমার জন্য অমন সম্বন্ধই বা আনলুম কেন? কোন রুচিতে এ কাজ করলুম! পরিবারের কথাটা মিথ্যে নয়। তার থেকেও নিজেকে নিরাপদ ভাবার কথাই বড় হয়ে উঠেছে। মানুষ সব আগে বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচায়। অফিসে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে ছাঁটাই হবে। বুড়োবয়সে ছাঁটাই হলে ছেলে বৌ নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো। কোথায় থাকবে তখন মান-সম্মান। বিপদ কোথা থেকে যে হুড়মুড়িয়ে আসবে কেউ বলতে পারে না। আমি থাকতেই বিপদ ঠেকাতে চেয়েছি। আর্থিক নিরাপত্তাকে জোরালো করতে চেয়েছি। তখন এত কথা মনে পড়ে নি। বাঁচার কথাটাই বড় হয়েছিল। মাধবীর কাছে এই কথাটা বরাবরই বড় হয়ে রয়েছে। ও সব সময় কেমন করে বাঁচা যায়, সংসারের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়া যায়, তার চিন্তাতেই ব্যস্ত। মান-সম্মানের কথা ভাবার সময়টুকুও দিতে পারে না। সেটা সম্ভব হয়েছে মাধবী অশিক্ষিত ব’লে, কিন্তু নিজেকে অশিক্ষিত ভাবতে দিনেশের কষ্ট হয়, রাগ হয়।
টাকাকে অবহেলা করা যায় না। যাকে অবহেলা করা যায় না সেই মানী। ফার্স্ট ক্লাশের লোক মান্যগণ্য। সেকেণ্ড ক্লাশ থেকে যখন ফার্স্ট ক্লাশে ডিউটি দেয়, তখন কণ্ডাক্টারদের ব্যবহারও বদলে যায়। হঠাৎ রোজগার বাড়লে মাধবীও কি তার ব্যবহার বদলাবে? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে টাকার ঠাঁই কতটুকু? সম্পর্ককে টাকা কতখানি ভাঙ্গা-গড়া করতে পারে?
ভিড়, ঘাম আর ময়লা কাপড়ের বোদা গন্ধের মধ্যে, রড ধরে দাঁড়িয়ে দিনেশ ভাবল, পরিবেশ যদি দমচাপা হয়, নড়াচড়ার ইচ্ছে থাকলেও ক্ষমতা যদি না থাকে, দুশ্চিন্তা যদি মাথায় ভর করে, তাহলে কোনটে আগে ভাবা উচিত, টাকা-পয়সা, মানসম্মান, না শিক্ষা-দীক্ষা। কোনটে আগে কোনটে পরে হবে? একটার সঙ্গে অন্যগুলোর কি সম্পর্ক হতে পারে?
-টিকিট।
-তাই বলে গায়ে হাত দিচ্ছ কেন? মুখে বললে কি শুনতে পাই না?
কণ্ডাক্টার মুখখানাকে নির্বিকার করে রাখল। লোকটা গাঁইগুঁই করে পয়সা দিল। দিনেশ তাড়াতাড়ি পয়সা হাতে নিয়ে তৈরী হয়ে রইল।
-ঠেলবেন না।
-ইচ্ছে করে কি আর ঠেলছি দাদা।
-ঠেলাঠেলি যদি পছন্দ না হয় তা হলে ট্যাক্সিতে যান দাদু।
-অফিস টাইমের ট্রামে বুঝি নতুন!
মাথা গরম হয়ে উঠল দিনেশের। লোকগুলো সামান্য কথাটাকে নিয়ে অহেতুক ব্যঙ্গ করল। বাঙালী স্বভাবে ব্যঙ্গটা ভাল খোলে। তবু ইদানীং সেটা বেড়েছে যেন। অপরকে জ্বালা দিয়ে মানুষ আজকাল খুশি হচ্ছে। দিনেশ নিজের মধ্যেকার জ্বালা দিয়ে অন্যদের বুঝতে চেষ্টা করল। জ্বলছে এই মানুষগুলোর কথায়। এই মানুষগুলোকে জ্বালাচ্ছে কে?
-ঠিকই তো দিয়েছি। একটা আনি আর তিনটে নয়া পয়সা। ছ’পয়সা হল।
-টিকিটের দাম দশ নয়া পয়সা। আনিতে হয় ছ’ নয়া পয়সা তা হলে মোট হল নয় নয়া পয়সা।
-গরমেণ্ট যা বলেছে আমি তাই দিয়েছি, এই তো পাঁচটা লোক রয়েছে, জিগ্যেস করে দেখ আমি কিছু অন্যায্য বলেছি কিনা!
-গরমেণ্টের কথা শুনলে তো আমার চলবে না; আমি কোম্পানির চাকরি করি, তাদের কথা শুনতে হবে।
-কোম্পানিতো বিলিতি!
-তা’তে কি হবে।
-গরমেণ্টের উপর কি তার হুকুম চলবে!
-অত কথা জানি না, আর একটা নয়া পয়সা দিন।
-দোবো না।
-তা হলে নেমে যান।
কণ্ডাক্টারকে চার পাঁচ জন বেধড়ক মারল। কাঠ হয়ে দিনেশ দেখল। তর্কটা হয়েছিল তার সঙ্গেই। নেমে যাবার কথা বলায় ভীষণ রাগ হয়েছিল। অপমানে গলা ভারী হয়ে, চোখে ঝাঁজাল বাষ্প জমে উঠেছিল। পাশের মানুষগুলো তর্কাতর্কি শুনছিল। এরপর ওরাও দু’চারটে কথা বলে। কথার পিঠে কথা হয়। সুর চড়তে শুরু করে। শেষকালে কণ্ডাক্টার মার খেল।
যারা মারল তারাই একটু আগে ব্যঙ্গ করেছিল। ট্রাম থেমে গেছে। ভিড় জমেছে, পুলিশও এসেছে। সেই ফাঁকে সে সকলের চোখ এড়িয়ে কেটে পড়েছে। তাকে নিয়েই ঝগড়ার শুরু, সব আগে তারই খোঁজ পড়বে। এরপর থানা, পুলিশ, কোর্ট, ফাইন কিংবা জেল।
যারা মারল তাদের কি হবে! তারা মারতে গেল কেন? তাদের সঙ্গে তো তর্ক হয়নি। মারা উচিত ছিল আমার। আমায় অপমান করল। আমি কাঠ হয়ে রইলুম। মাধবী অপমান করে, তখনও চুপ করে থাকি। কণ্ডাক্টারকে অন্যলোকে মারল। আমারও ইচ্ছে করেছিল দু’চারটে চড় চাপড় মারি। তবু কেমন জবুথবু হয়ে রইলুম। এইটেই দোষ। আসল কাজের সময় কিছু করতে পারি না। ওরা আমার হয়ে করে দিল।
ওদের ফেলে আমি পালিয়ে এলুম। আমি কেন এলুম। অন্যায় করেছি? ওখানে গিয়ে যদি এখন বলি আমার জন্যই এই কাণ্ড ঘটেছে, আমিই আসল দোষী, তা হলে মহত্ত্ব দেখান হয়। কিন্তু যদি জেল হয়! আগে বুদ্ধিমান, তারপর মহৎ হওয়া উচিত। মহত্ত্ব আমার সংসারকে বাঁচাবে না। পয়সায় সংসার বাঁচে আর আমি একটা নয়া পয়সা বাঁচাতে ঝগড়া শুরু করেছিলুম। আসলে সংসারের মুখ চেয়েই মহৎ হওয়া না হওয়া নির্ভর করে। জন্মগত মহত্ত্ব গুণ বাজে কথা।
তবু কর্তব্য বলে একটা জিনিস আছে। আমি সেটা করিনি। ওরা আমার জন্যই মারল। ওদের জন্য আমার উচিত ছিল পালিয়ে না আসা। এখন যদি ফিরে যাই!
দিনেশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেকখানি পথ হেঁটে এসেছি। ফিরতে গেলে ক্লান্ত হতে হবেই। ফিরে যাওয়া উচিত। শরীর ক্লান্ত লাগছে, বাড়িও বেশিদূর নয়। মাথা গরম হয়ে উঠল দিনেশের। হঠাৎ নজর পড়ল চাকরটার ওপর। একটা বাচ্চচা কোলে নিয়ে দাঁত খিঁচুচ্ছে ওপরে দাঁড়ান একটা ছোট্ট ছেলেকে। বেড়াতে বেরিয়েছে, বোধ হয় একটু পিছিয়ে পড়েছিল তাই একসঙ্গে রাস্তা পার হতে পারেনি। রাস্তাটায় ট্রাম, বাস দুই-ই চলে। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ছেলেটা। চাকরটার উচিত ওকে হাতেধরে পার করে নিয়ে আসা, তা’ না করে খিঁচুচ্ছে। হয়ত আড়ালে মারবে। মারের ভয়ে এখুনি অন্ধের মত ছুটে আসবে ছেলেটা।
ছুটে গিয়ে চাকরটাকে থাপ্পড় কষাল দিনেশ।
-উল্লুক কাঁহাকা। ওইটুকু ছেলে পার হতে পারে? তুমি বুড়োদামড়া পার হয়ে এসেছ বলে কি সবাই পারে?
আরও কয়েক ঘা লাগাল দিনেশ। ভিড় জমে গেল। সকলেই সমর্থন করল তাকে। পুলিশ এল না। চাকরটাই সরে পড়ল গুটিগুটি।
ভীষণ ঝরঝরে লাগছে এখন নিজেকে। মনে একফোঁটা গ্লানি নেই। চোখে পড়ল রাস্তার এমাথা ওমাথা পর্যন্ত টাঙান শালুটা। পুজো আসছে। রমাকে, মাধবীকে একখানা করে শাড়ি দিতে হবে।
দিনেশ দু পয়সায় চারটে লজেন্স কিনে, একটা মুখে পুরল। শালু হাওয়ায় দুলছে। পেছনের আকাশটা নীল। কতকগুলো ঘুড়ি উড়ছে। লাটালাটি চলছে দুটো ঘুড়িতে। দিনেশ ওদের শেষ দশাটুকু দেখার জন্য রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়াল।
.ছাদে কাপড় শুকোতে দেবার সময় চীৎকার শুনেছিল মাধবী। ছাদের ধার ঘেঁষে ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করেছিল। শৈলদের বাড়ির উঠোনটুকু ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। শৈলর দু’টি ছেলে সারা সময় হুটোপাটি করে। একটিকেও উঠোনে দেখা গেল না। একবার চেঁচিয়ে উঠেই শৈল থেমে গেছল।
দুপুরে খাওয়া সেরে মাধবী শৈলদের বাড়িতে হাজির হল। ছেলেগুলো শুকনো মুখে তাকাল তার দিকে। শৈল রান্নাঘরের সামনে বসে আছে। উনুন জ্বলে যাচ্ছে। খুঁচিয়ে নামিয়ে পর্যন্ত দিতে ভুলে গেছে। রান্না হয়ে গেছল, ছেলেরা খেয়ে নিয়েছে। মাধবীকে দেখে ধড়মড় করে দাঁড়াল শৈল।
-চেঁচিয়েছিলি কেন?
চুপ করে রইল শৈল। ছেলেরা গুটিগুটি কাছে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মাধবীর অস্বস্তি লাগছে। চেঁচাবার কারণ একটা কিছু ঘটেছে নিশ্চয়। কিন্তু সেটা কি ধরনের। হয়ত নিকট আত্মীয় কেউ মারা গেছে। হয় বাবা নয় মা। সান্ত্বনা দিতে হবে। বাবা-মা মারা গেলে কতকগুলো বাঁধা গৎ আছে, আউড়ে যেতে হবে। আগে জেনে নিতে হয়, তাদের বয়স কত। প্রকৃতি কেমন ছিল, কি ভালবাসত, তাদের অবর্তমানে সংসারের কতখানি ক্ষতি হবে। না জানলে ঠিক বোঝা যায় না শোকটা কত গভীর।
-কি হয়েছে কি, অমন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
-উনি মরবেন বলছেন।
কথাটা বুঝতে যতটুকু সময় লাগে, তারপরই মাধবী ভেবে পেল না সে হাসবে না কাঁদবে। ছ’ ছেলের মা হয়েও শৈলর বয়স আর বাড়ল না। এখনো তাহলে ওদের ঝগড়া খুনসুটি চলে। আছে ভাল!
-মরবে, তা মরুক না! অমন কথা ওরা অনেকে বলে, তুইও গ্যাঁট হয়ে বসে থাক।
বেশ লাগছে মাধবীর এখন নিজেকে। এই ধরনের কথাবার্তায় সময় কাটাতে সুখ আছে। বছর তিরিশ বয়স শৈলর। পর পর ছ’টা বাচ্ছার পর ফরসা রঙটা ফ্যাকাশে হয়েছে। কনুই আর গলার হাড়গুলোও ঠেলে উঠেছে। তাছাড়া মুখটা মিষ্টি, গালে এখনো টোল পড়ে। বয়সে শৈল অনেক ছোট, চিনুর থেকে দুচার বছরের বড়। মাধবী ওকে একই সঙ্গে সখি আর মেয়ে ভাবতে পারে। ঠাট্টা মস্করা করা যায় আবার ধমক-ধামকও দেওয়া চলে। সেদিন ইলিশ আসায় মাধবীর সর্বপ্রথমে মনে পড়েছিল শৈলকে। ওর সংসারে অনেকগুলো পেট। দিতে হলে অনেকগুলো দিতে হয়। নিজের সংসারের জন্য রেখে দাতব্য করা উচিত। তাই মাধবী বাধ্য হয়েছিল সেদিন শৈলর নামটা ভুলে যেতে।
-আজ আপিস যায় নি?
-না।
-ছুটি নিয়েছে?
-না।
-তবে!
-আর যেতে হবে না, চাকরি গেছে।
-কবে থেকে!
-ন’দিন হ’ল। ও বলছে মরবে। আজ সকাল থেকেই বলছে ডুবে মরব, নয়তো বাসের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ব।
-তোর বাবা কোথায় রে?
-নিমাই জ্যাঠাদের রকে বসে আছে।
বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে শৈল। ফাঁপরে পড়ল মাধবী, এখন সে কি বলবে। কেউ মারা গেলে তবু কিছু বলা যায়, কিন্তু এই কান্না সে কি বলে সান্ত্বনা দেবে। চাকরি কেন গেল, একথা জিগ্যেস করার কোন মানে হয় না। যে ভাবেই চাকরি যাক, এখন এই কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে শৈলর কি হাল হবে সেটাই বড় কথা।
শৈল কাঁদছে। মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলছে। ছেলেরা তাকিয়ে আছে।
-তুই কি বললি?
-কি আর বলব।
-একটা মানুষ মরবে বলল, আর কিছু বললি না।
-কোন লাভ আছে?
-ক্ষতি তো আছে।
চুপ করে রইল শৈল। মাধবী আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। শৈলর স্বামী যদি মারা যেত তাহলে সে অনেক কথা বলতে পারত। কিন্তু মরবার ভয় দেখিয়েছে-এখনো মরেনি, সেক্ষেত্রে কি বলা যায়! মানুষটা যদি না মরে তাহলেই অবস্থাটা কি বদলাবে? গোটা সংসারটাই তো মরতে বসছে। চল্লিশ বছর বয়স হল শৈলর স্বামীর। এ বয়সে কি এমন কাজ জোটাতে পারবে। পেটে দুমুঠো ভাতই শুধু নয়, ছেলেগুলোকেও মানুষ করে তুলতে হবে। শৈলর কান্নাটা নতুন ধরনের। সান্ত্বনা দেওয়ার এখনো কোন বাঁধা গৎ তৈরী হয়নি। একটা মানুষ নয়, গোটা পরিবার মরতে বসেছে। এখনো মরেনি কিন্তু মরবেই তো।
-খেয়েছিস?
চুপ করে রইল শৈল।
-না খেলেই কি মানুষের মন বদলায়? নে, খেয়ে নে।
-ওর এখনো খাওয়া হয়নি।
-এই যাতো, বাবাকে ডেকে নি আয়।
পাঁচটা ছেলে ছুটে বেরিয়ে গেল। ছোটটা শৈলর কোলে গড়িয়ে পড়ল মাই খাবার জন্য।
-তুই ব’সে পড়।
-ও আগে আসুক।
এখন কাজ রইল শুধু শৈলর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা। ঘষে ঘষে চোখের কোল লালচে হয়েছে। চোখের পাতা ভিজে। চটচটে হয়ে জুড়ে যাচ্ছে। ছোট হয়ে গেছে চোখ দুটো। মানুষের মুখের দিকে তাকান মানেই তার চোখের দিকে তাকান।
মেঝের দিকে মুখ নামিয়ে রাখল মাধবী। একটা কিছু বলা দরকার এখন। কি বলা যায়। কথা আসছে না মনে। প্রাণপণে হাতড়াতে শুরু করল মাধবী। মনের এ-কোণ সে-কোণ থেকে এক টুকরো অভিজ্ঞতাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যা দিয়ে একটা কিছু বলার মত কথা তৈরী হয়। এতখানি বয়স তাহলে কি দিয়ে গেল। এখনো কিছুদিন বাঁচতে হবে, অনেক কিছুই দেখতে হবে, অনেক অবস্থার মধ্যে নিজেকে পড়তে হবে, কিন্তু কি দিয়ে সেই অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নোব! কেউ মরলে এক ধরনের সান্ত্বনা দেওয়া যায়। বাপঠাকুর্দার আমল থেকে তা চলে আসছে। কিন্তু এই নতুন ধরনের, সকলে মিলে মরার কি সান্ত্বনা? নতুন কথা তৈরী করতে হবে, কিন্তু একটা কথাও তৈরী করা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞতা হার মানছে। ভয় ভয় করছে। ছোটবেলায় ভূতের গল্প শুনে, জানলা দিয়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙে একটা দুটো তারা চোখে পড়লে যে গা-ছমছমানি ভয় লাগত অনেকটা সেরকম। শৈল একদৃষ্টে তাকিয়ে। পাঁচটা ছেলে, বাপকে ধরে আনতে গেছে। ছোটটা মাই খাচ্ছে। উনুনটা জ্বলছে খাঁ খাঁ করে। ভাত বাড়াই আছে। এরপর উনুন ধরবে না, ভাতের হাঁড়ি চাপবে না, বাচ্ছাগুলো ক্ষিদের জ্বালায় ঘ্যানঘ্যান করবে। শৈলর স্বামী হয়তো সত্যিই বাসের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে আর শৈল কি করবে?
হাতের ধাক্কায় বাচ্ছাটাকে ফেলে দিল শৈল। কেঁদে উঠল বাচ্ছাটা, ওকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মাধবী।
-তুই মাথা ঠাণ্ডা করে রাখ। এলেই ভাত খাইয়ে দিবি। ওকে পাগলামো চিন্তা করতে বারণ করিস। এটাকে নিয়ে যাচ্ছি, চুপ করলে পাঠিয়ে দোব।
ঊর্ধ্বশ্বাসে শৈলর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মাধবী।
.মাধবী ঘরে নেই। রমা চুপি চুপি তিনতলায় উঠে এল।
ছাদেই ছিল বিশ্ব। জামা শুকোচ্ছিল। তুলে নিয়ে ঘরে ফেরার পথে রমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
-টালিগঞ্জে গেছলুম। হঠাৎ এমন বৃষ্টি নামল!
-কই, এদিকে তো বৃষ্টি হয়নি।
-ওই তো মজা।
-টালিগঞ্জে কে আছে?
অফিসের এক বন্ধু। বেচারার কাল থেকে চাকরি থাকবে না।
-কি করে জানলে?
-ভেতর থেকে খবর পাওয়া গেছে। আরো দু-তিন জনের চাকরি যাবে।
-কেন যাবে?
-ভগবান জানেন। কেন যাবে জানলে তো কোর্টে মামলা লড়া যেত। শুধু জানিয়ে দেবে তোমার চাকরির আর দরকার নেই। ব্যস, তারপর কলা চোষো। চল এখানে দাঁড়িয়ে কি হবে।
-কেন বেশ তো আছি।
-ঘরে চলো না।
রমার কনুই ধরে টানল বিশ্ব।
-কি হবে গিয়ে।
-কি আবার হবে, ব’সে ব’সে পরলোক-তত্ত্ব আলোচনা করব।
টেনে নিয়ে এল বিশ্ব রমাকে। আশা তার দেওরের বাড়ি বেড়াতে গেছে। সন্ধ্যার আগেই ফিরবে। বিশ্ব উঁকি মেরে দেখে নিল মা ঘুমোচ্ছে কি না। দরজাটা ভেজিয়ে দিতেই রমা আপত্তি করল।
-ওটা খোলা থাক না।
-কেন!
-বন্ধই বা কেন করবে!
-একই ব্যাপার।
ব্যাপারটা বুঝেছিল রমা। বুঝে ভালই লাগছে। কিন্তু না বোঝার ভান করলে জিনিসটা আরো মিষ্টি লাগে। সময় কাটানোটাই বড় কথা, তার ওপর ফাউ এই মিষ্টি-মিষ্টি ভাবটুকু। কিন্তু আগেকার সময় কাটানোর থেকে এখন তফাত আছে। আগে যে অনিশ্চিত ভাবটুকু ছিল এখন আর তা নেই। বিশ্ব চাকরি করে। বুক ঠুকে এখন সে সংসার পাততে পারে। এখন ও যে কথা বলবে তা’ সত্যিকারের আন্তরিক। তার ওপর নির্ভর করা যায়।
উঠে গিয়ে রমা খুলে দিল দরজাটা। বিশ্ব ছুটে এসে কপাটটা চেপে ধরল।
-না, বন্ধ থাক।
-ধ্যেৎ, লজ্জা করে না।
-লজ্জা আবার কার কাছে!
মুখ ঘুরিয়ে রইল রমা। জানলা দিয়ে শুধু পাঁচিলটা দেখা যায়। এক’পা এগিয়ে গেলে আকাশটা দেখা যাবে। আকাশ দেখতে ইচ্ছে করল রমার।
দুহাতে জড়িয়ে ধরল বিশ্ব। আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে না এখন আর। নাকটা ঘষতেই বিশ্বর বুকের লোমে খসখস শব্দ হল।
-সেদিন যা বলেছিলে তা ভুলে গেছ!
-কি বলেছিলুম।
-বারে, বাবার কাছে গিয়ে বলবে।
রমাকে ছেড়ে দিল বিশ্ব। কাঁধটা ঝুলে পড়েছে। ন্যাকড়ার পুতুলের মত হাত দুটো নড়বড়ে দেখাচ্ছে।
-কি হবে বলে।
-কেন?
-চাকরি থাকবে কিনা তার ঠিক কি।
-কেন থাকবে না?
-আমি তার কি জানি। দেখছি চোখের সামনে চাকরি চলে যাবে বিনা কারণে। আমার যদি যায়? যতক্ষণ না পাকা হচ্ছি ততক্ষণ আমার সঙ্গে একটা বেকারের কি তফাত? বরং বেকাররা আরো সুখী। তাদের আমার মত যন্ত্রণা পোয়াতে হয় না। কিচ্ছু করতে পারব না আমি। যাই করতে যাই না কেন একটা ভয় সব সময় তাড়া করে ফিরছে; যদি চাকরি না থাকে! কোন কিছুতেই আমি স্থির হতে পারছি না। নিজেকে এক মুহূর্তও নিরাপদ ভাবতে পারছি না।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেন স্বীকারোক্তি করছে বিশ্ব। ওর পেছনের জানলার রেলিংগুলো আরো মজবুত দেখাচ্ছে। জানলার ওপরেই আকাশ। রমার আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে।
চুপ করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল দুজনে। বিশ্বর মুখ দেখতে পাচ্ছে না রমা। আলোটা আসছে পিছন থেকে। রমা বলল:
-তা হলে?
-জানি না।
-আমি কি করব?
-জানি না।
-এমন করে চললে আমি মরে যাব। আমি আর বাঁচব না।
-তা’ আমি কি করব।
কালো দুটো টুনি যেন জ্বলে উঠল বিশ্বর আবছা অন্ধকার মুখে। ঝুলে পড়া কাঁধটা শান্ত হয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে সে রমাকে ছুঁল।
পেছিয়ে যাবার চেষ্টা করা মাত্রই আঁচলটা টেনে ধরল বিশ্ব। বাধা না দিয়ে রমা শুধু শাড়িটা আঁকড়ে দেয়ালে লেপ্টে গেল।
-তুমি জানোয়ার হয়ে যাচ্ছ।
-জানোয়ারের হাতে পড়লে এতক্ষণে তোমার কিছুই থাকত না। আমি মানুষ।
-না, তুমি মানুষ নও।
দুপাশে হাত ঝুলিয়ে, খাড়া দাঁড়িয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল বিশ্ব। বুকের মধ্য থেকে বাতাসের এক একটা ঝাপটা মুখ আর নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে বেরিয়ে আসছিল। আলো এসে পড়েছিল পিছন থেকে। পিছনে জানলা। জানলার ওপারে আকাশ। তখন আর আকাশ দেখতে ইচ্ছে করেনি রমার। ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
.-চিনু তুইও অ্যাপ্লিকেশন কর।
অদ্ভুত লাগছে চিনুর কথাটা শুনে। সাড়ে সাতটাতেও অফিস-ফেরত ট্রাম বাসগুলোতে ভিড়ের কামাই নেই। হরেক রকমের পুরুষ-মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। বাতাস দিচ্ছে। কাঁধের ওপর পত পত করল কলারটা। বুকে সেঁটে আছে জামাটা।
অমলের বুকটা ভীষণ সরু। আশ্চর্য ওর এখনো টি-বি হয়নি। ওর বাবাকে এখনো তিনটি মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। অমল থার্ড ইয়ারেই পড়া ছেড়েছে। কলেজে বেশ কবিতা লিখত, এখন মাঝে-সাঝে লেখে।
-চিনু তুইও অ্যাপ্লিকেশন কর।
-হবে কি কিছু?
-কিছু হবে না ভাবলে, সত্যিই কিছু হবে না।
করুণ সুরে প্রায় মিনতি করল অমল। চিনু তাকাল পুব মুখো। এদিকে বইয়ের পাড়া। ছোট-বড় বইয়ের দোকান। খুঁজলে দু’একটা লেখককে রাস্তায় পাওয়া যাবে। একজন আসছে, ওকে চিনু দু’দিন আগেই দেখেছে। অমলের মত গলা করে বইয়ের দোকানের সেলসম্যানের কাছে আবেদন করছিল, খদ্দের এলে তার বইটাকে যেন আগে সুপারিশ করে। দুজনে বলার ভঙ্গিটা হুবহু এক। অমলের বাড়ির খবর চিনু জানে, ওই লেখকটিও জানে না। এখন যেন জানা গেল।
-তুই কবিতা লেখা ছাড়লি কেন?
-কি হবে লিখে। এ্যাদ্দিন লিখলুম, দু’চারজন ছাড়া কেউ পড়েও না, চেনেও না। তাছাড়া পয়সাও পাওয়া যায় না। আমার পয়সার দরকার চিনু।
-তাই বলে কবিতা লেখা বন্ধ করবি কেন?
-ঈশ্বর, মেয়েমানুষ, সমাজ, অস্তিত্ব,-এই সবগুলোকে চুলচেরা বিচার করে, অনেক হীরে-জহরতই তো দেখলুম, কিন্তু একটাও গয়না গড়াতে পারলুম না। আসলে তছনছ করতেই আমরা পারি, গড়তে পারি না। যদি নিজেকে গুছোতে পারি, জীবনকে পরিপূর্ণ করতে পারি তাহলেই একটা কিছু করতে পারব। সব আগে সংসারের ভাবনা থেকে রেহাই পেতে চাই, একটা চাকরি চাই। চিনু তুই আমার কথা শুনছিস না?
-শুনছি।
চিনু বাসের জানলা থেকে, চোখটা অমলের চোখে রাখল। জ্বলছে চোখজোড়া। সারা মুখটাও। সরু বুক বাতাসের চাপে চুপসে যাচ্ছে, আবার ফুলে উঠছে দ্বিগুণ হয়ে।
মুখ ফিরিয়ে চিনু আবার ডবল ডেকার দেখতে থাকল। অমল ভাবে নির্লিপ্ত না হলে কবি হওয়া যায় না। সংসারের কথা অত ভাবলে কি করে কবি হবে? কবিতে আর সাধারণ মানুষে তফাত কি? আমাতে আর অমলে কি তফাত? ও সুন্দর করে একটা কথা লিখতে পারে, আমি পারি না। গুছিয়ে কিছু করতে পারাটাই যদি কবি হওয়ার উপায় হয়, তাহলে ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে যে লোক মরে সেও কবি। এযুগে কি কেউ নির্লিপ্ত থাকতে পারে? তার মানে কি, এযুগে বড় কবি জন্মাবে না!
-অমল হাঁটবি একটু।
-কোন দিকে, শ্যামবাজারে?
-হ্যাঁ।
-তুই মণীষের সঙ্গে গেলি না?
কাঁধঝাঁকুনি দিয়ে চিনু বলল:
-ক্লান্তি লাগে। চিরকালতো আর এমন গা ভাসিয়ে চলা যায় না। মেয়েমানুষের গল্প করেই সময় কাটল, কোন মেয়ে আর জীবনে এল না।
দুজনেই হাসল। অন্য ফুটে ভিড় কম। দুজনে রাস্তা পার হয়ে এল।
-চারটে পয়সা আছে? তাহলে আলুর চপ কেন।
-দুটো আছে। ভাগাভাগি করে খাওয়া যাবে।
অমল আলুর চপ কিনে আধখানা ভেঙে দিল।
-দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এই খাচ্ছি। ভীষণ ক্ষিদে পায়। রোজ পায়। মণীষটা আজ আধখানা কেকও খাওয়াল না। মিছিমিছি গালাগাল হজম করলুম।
অমলের আধখানা আলুর চপ খাওয়া দেখল চিনু। মুখে পুরে গিলে ফেলল, আবার তুলে এনে চিবুতে লাগল। চোখাচোখি হতেই হাসল চোখ বুজে।
-বেশ করে।
-তুই এটাও খা।
-নাঃ। কাল যখন বাড়িতে ঢুকলুম উনুনে হাঁড়িচাপান। বাবা তক্ষুনি চাল কিনে এনেছে। বোনগুলো চুপচাপ ব’সে। দেখে কষ্ট হল। ভাবলুম বলি খাব না, বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছি। বলতে পারলুম না। ক্ষুধার্তের কানে নেমন্তন্ন শব্দটা ভয়ানক। খালি পেটে ডিম ভাঙার শব্দ শুনে দেখিস!
এই নিয়েই তো লিখতে পারিস।
-তোর জানাশুনো টিউশনি আছে?
-না। পেলেতো আমিই করি।
-দুটো টাকা দিতে পারিস?
-কোথায় পাব টাকা।
-তবে এতটা পথ হাঁটালি কেন?
আর একটি কথাও না বলে অমল উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে দিল।
.লজেঞ্জুস ক’টা শেষ হয়ে গেছে। দিনেশ এধার ওধার তাকাল। রেলের গুদাম। মালগাড়ি। ভিখিরি। কতকগুলো ঝকঝকে পানের দোকান।
এধারে রেলিং, স্টীমারঘাট। ওপারে আলো। ডানদিকটা ঘুটঘুটে। বাঁদিকে আলোর সরলরেখা, হাওড়াপুল। নিমতলা শ্মশান, কুকুর, পুলিশ। পাগল। মড়াকান্না। মাংসপোড়ার গন্ধ। ভূতনাথের মন্দির। স্তোত্রপাঠ।
আর দুপয়সার লজেঞ্জুস কিনে আনলে হয়। উঠবে বলে মন ঠিক করেও দিনেশ উঠল না। জোয়ার আসছে। ঢেউয়ের শব্দ হচ্ছে। সমুদ্র দেখিনি। এর কতগুণ বড় ঢেউ আর শব্দ সেখানে! অনেকদিন চান করিনি গঙ্গায়। বাড়ি থেকে বেশ দূরে, চান করে ফিরে আবার বাড়িতে চান করতে হয়। তবু ছোট বেলায় আসতুম। জেটি থেকে ঝাঁপ খেতুম। এখান থেকে উত্তরে আরো মিনিট দশ। হাঁটলে দেখা যাবে। যাবে কি?
আছে কি এখনো জেটিটা! একবার দেখে এলে হয়। অনেকদিন আসি না গঙ্গায়। মা’কে পুড়িয়েছিলুম কাশি মিত্তির ঘাটে। বাবাকেও। সেই শেষ আসা। জেটি থেকে ঝাঁপ খেতে গিয়ে পশুপতি মারা গেল। জেটির তলায় শেকলে জড়িয়ে গেছল। সেদিন থেকেই গঙ্গায় চান করা হয়ে গেছে। পশুপতি বানের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেসে গিয়ে উঠত বরানগর কি দক্ষিণেশ্বরে। এটা তার খেলা ছিল। সে মারা যেতেই ভয় পেলুম। গুরুজনের নিষেধ সেদিন প্রথম মান্য করলুম।
জলের ধারে নেমে এসে মাথায় জল ছিটোল দিনেশ। গাঁজা খাচ্ছে দুটো লোক। আর একটু ওপাশে গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে কেত্তন হচ্ছে। বুড়ীগুলোকে এতদূর থেকেও ঠিক চেনা যায়। ওদের বসার কায়দাটাই অদ্ভুত।
বয়স হলে ধর্মকথা শুনতে ইচ্ছে করে। কেন করে কে জানে। ভয়েতে বোধ হয়। মৃত্যুর পর বিচার হবে ইহলোকে কাজ-কম্মের। বিচারে ঠিক হবে কে স্বর্গে আর কে নরকে যাবে। স্বর্গে খুব সুখ। শুনলে স্বর্গে যেতে লোভ হয়। বুড়োরা খুব লোভী হয়। খেতে আর গালাগালি দিতে ওরা খুব ভালবাসে।
আমি কি লোভী হয়ে পড়ছি! আমার কি বয়স বাড়ল। বাবু হয়ে জলের ধার ঘেঁষে দিনেশ বসে পড়ল। এখন ঘাড় ফেরালে তিন দিকে শুধু সিঁড়ি দেখা যাবে আর সামনে জল।
আমি কি বুড়ো হয়েছি? আমার কি সব ফুরিয়ে গেছে? ঘণ্টা-দিন-মাসের হিসেবে আমার শরীরের বয়স বেড়েছে। আর কি বেড়েছে? পৃথিবীটা একটু বদলেছে। আর কি? মানুষ!
আমাদের ছোটবেলার-দেখা মানুষ আর আজকের-চোখে দেখা মানুষে তফাত হয়েছে। পশুপতির বাবা নিমাই কাকা রাত্তিরে বাড়ি থাকত না। ভাইরা সম্পত্তি ঠকিয়ে নিল। ছোট ভাই কলেরায় মারা যেতে তার সংসারটাও যেচে ঘাড়ে নিল। নিমাই কাকা দেনা রেখে মরল। আজকের দিনে এমন গল্প শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। নিমাই কাকা যখন মরে তখন আমাদের জোয়ান বয়স। সৎকার সমিতি ওকে পোড়ায়। দেখে কষ্ট হয়েছিল। জোয়ান বয়সের কষ্ট বড় বেশি অন্তরে বেঁধে। জোয়ান বয়সের সুখও বড় আন্তরিক।
চীৎকার করে হরিবোল দিল কারা! মুখ ফেরাল দিনেশ। মানুষ দেখা যায় না। রাস্তাটা বেশ উঁচুতে। আবার হরিবোল দিল। দিনেশ জলের দিকে মুখ ফেরাল।
কষ্ট হচ্ছে। মানুষ মরলে কষ্ট হয়। এ কষ্ট আমাদের সময়েও পেয়েছি। কিন্তু তফাত আছে যেন কোথায়। ‘আমাদের সময়’, এই কথাটা বলার কি মানে হয়? যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণই তো আমাদের সময়, আমার সময়। তবে কি বয়স বেড়েছে! না হলে তফাত গড়ে উঠবে কেন? সুখকেই মানুষ চায়। নিজের ভাবে। যৌবনের সঙ্গেই সুখের সম্পর্ক। বুড়ো বয়সের এই দিনগুলোকে অস্বীকার করতে ইচ্ছে করে। জোয়ান বয়সই আমার সময়। আমার সুখের সময়। এ যৌবন আর ফিরবে না। আর ফিরবে না। সুখ আর আসবে না। আর আসবে না।
জলে পা ডোবাল দিনেশ। ঢেউয়ের ধাক্কায় শিরশির করে উঠল পা’টা। ছোটবেলায় ভয় করত। কামঠে নাকি পা কেটে নিয়ে যায়। টেরটিও পাওয়া যাবে না। যন্ত্রণাও হবে না। এমন নাকি অনেকের হাঁটু থেকে কেটে নিয়ে গেছে। কিন্তু এমন পা’ কাটা একটা লোকও আজ পর্যন্ত দেখলুম না।
পা তুলে তাকিয়ে রইল দিনেশ। গোটাই আছে। আলতো হাত বুলোল। লোমগুলো লেপটে সরু দেখাচ্ছে, পা’টাকে অদ্ভুত লাগছে। যেন আর কারুর পা।
জেটিতে ভেড়ার সময় স্টীমারে অদ্ভুত এক শব্দ করে। শব্দটা একটুও বদলায় নি। ছোটবেলায় ঝাঁপ খেতুম স্টীমার থেকে। খালাসিরা দেখলে তাড়া করত। ঝপাঝপ লাফিয়ে পড়তুম দল বেঁধে। মাঝ গঙ্গা থেকে এক দমে পাড়ে আসতুম।
আজ আর পারব না। বয়স হয়েছে। ভয় করবে। তবু ঝাঁপাতে সাঁতরাতে পারব? দশ হাত। বিশ হাত। ওই নৌকোটা চলে যাবে। ওটা কি ধরতে পারব!
চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়। জোয়ার এসেছে। খাড়াই সাঁতরিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ফিরে আসার দম নেই। জোয়ান বয়স হলে পারতুম। এখন বুদ্ধি খাটাতে হবে। পোর্ট কমিশনার্সের টোলটার কাছ থেকে যদি জলে নামি। অল্প সাঁতরে, ভেসে থাকলে স্রোতের টানে নৌকোটার কাছে যেতে পারব। তারপর একটু সাঁতরালেই হালটা ধরা যাবে।
কাপড় জামা ভিজে যাবে। খুলে রেখে নামলে যদি চুরি হয়ে যায়! অন্ধকার জায়গাটা চোর কি দেখতে পাবে? কি আর এমন পকেটে আছে। তাছাড়া জল থেকে তো দেখাই যাবে। চীৎকার করলে চোর পালাবে।
ঠাণ্ডা লাগবে কি! বেশ ঠাণ্ডা জলটা। নিউমোনিয়া না ধরলেও সর্দি হবে নির্ঘাত। জ্বর হতে পারে। অফিসে এ সময়ে ছুটি নেওয়া কি উচিত। ছুটি পাওনা আছে তবুও কাজের চাপ পুজোর মুখেই বেশি। অফিসারকে চটিয়ে লাভ কি। ছাঁটাইয়ের গুজব উঠেছে। কুড়ি বছর চাকরি করেও রেহাই পায়নি এমন লোকও আছে।
নৌকোটা জোয়ারে গা ভাসিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। অস্পষ্ট কতকগুলো ছায়া সমান তালে সামনে-পিছে দুলছে। দাঁড় টানছে। বোধ হয় খুব তাড়াতাড়ি আছে।
আমার বয়স হয়েছে। আমি ভয় পাচ্ছি। হিসেবি হয়ে গেছি। জোয়ান বয়স হলে কি এত ভাবতুম। সিধে সাঁতরে গিয়ে নৌকোটাকে ধরে ফেলতুম। ভয়ে জলে নামতে পারলুম না। ভয়টা কি বুড়ো বয়সের, না কি এই দুঃসময়ের। চিনু কি পারবে জোয়ার ভেঙ্গে সাঁতরাতে?
এ যুগের জোয়ানদের তাড়াতাড়ি বয়স বেড়েছে। দম ফুরিয়ে গেছে। চিনু রেস খেলেছে। বিনা আয়াসে টাকা রোজগার করতে চায়। লড়বার সাহস ওর নেই। লড়ে জিততে পারলেই সুখ। সুখ চিনু পেল না। ও একদিন বুড়ো হবে। সেদিন অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর হবে। আমার মতন তখন হয়ত একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে ভাববে। কি ভাববে? আমাদের সময়ে বেশি সুখ ছিল? কি করে বসবে চিনু। সুখ কোথায়। ওর বুড়ো বয়সে ও কোন দিনের কথা ভাববে! জোয়ান বয়সেই হেরে বসে আছে। পরিবেশে সুখ পাবে না। স্মৃতিতেও পাবে না। কি ভয়ঙ্কর দিন আসছে ওর জীবনে! কেমন করে বাঁচবে!
আমি কি ভয় পেয়েছি? আমি কি হিসেবি হয়ে গেছি? ওই কেত্তনের দলে গিয়ে কি আমায় বসতে হবে? বৈরেগি হয়ে কি ওই গেঁজেল দুটোর কাছে ধরনা দোব? আমি কি করতে পারি! আমার দরকার কি ফুরিয়েছে?
জল ছুটছে। উত্তর দিকে অন্ধকার, ওই দিকে জল ছুটছে। দক্ষিণে হাওড়ার পুল। গমগম শব্দ আসছে ট্রাম চলার। আলোর টানা লাইন। ওপারে আলো। লাউডস্পীকারের গান এপারেও শোনা যাচ্ছে। জেটিতে ভেড়ার সময় স্টীমারের বিদঘুটে আওয়াজ হচ্ছে। আলো পড়ছে জলে। জল ছুটছে। জলের আলো কাঁপছে। দিনেশ জলের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
ছোট্ট একটা ছেলে সিঁড়ি বেয়ে জলের ধারে এসে দাঁড়াল। দিনেশ ওর দিকে তাকাল।
কতটুকু আর, সানুর বয়সী হবে। ফিতে দেওয়া জুতো, পায়ে মোজা। হাতে একটা থলি। কাপড় রয়েছে থলিতে। একা ও কেন জলের ধারে এল? পিছু ফিরে দেখল দিনেশ। কেউ নেই।
-কোথায় যাচ্ছ খোকা?
ছেলেটা একধাপ উঠে দাঁড়াল।
-কার সঙ্গে এসেছ?
-বাবার সঙ্গে।
-বাবা কোথায়!
থুতনি ঘুরিয়ে দেখাল ছেলেটা। ওদিকে নিমতলা শ্মশান-ঘাট। অনুমান করল দিনেশ, হয়তো কোন আত্মীয় মারা গেছে।
-ওতে বুঝি বাবার কাপড় আছে?
-না, মার জন্য লিচু।
-বেড়াতে বেরিয়েছিলে?
-না, মাকে দেখতে গেছলুম।
-কোথায়?
-হাসপাতালে।
-কি হয়েছে?
-অসুখ করেছিল।
দিনেশ তীক্ষ্ন চোখে ওর মুখের দিকে তাকাল। সানুর বয়সী। কচি মুখ। মুখটা ফেটে যাচ্ছে। পলিমাটি যেমন চড়া রোদে ফেটে যায়। ঠোঁটের পাশ দিয়ে চোখের কোল পর্যন্ত আঁকাবাঁকা কতকগুলো ফাটল ধরেছে। গাল দুটো ডেবে গেল। চাপা শব্দ উঠছে গলা থেকে। জল জমেছে চোখে। খোসা ছাড়ান রসাল লিচুর মত ভাসছে চোখের সাদা অংশটা।
ওকে বুকের কাছে টেনে নিল দিনেশ। কাঁপছে শরীরটা। মুঠো দিয়ে চোখ কচলাতে শুরু করেছে।
-কি হয়েছে। কান্না কেন? কি হয়েছে!
-মরে গেছে।
ছেলেটা কাঁদছে। দিনেশ গলাটা ওর মাথায় চেপে ধরে পিঠে হাত বুলোতে লাগল। কি বলবে সে এখন। কোন কিছু বোঝার মত বুদ্ধি হয়নি। হাজার কথা বলেও একে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না। চুপ করে রইল সে। ওর কান্না আর জোয়ারের শব্দ মিশে গেছে। বুকের মধ্যে কলকল করছে।
চুপ করল ছেলেটা। ওকে টেনে পাশে বসিয়ে দিল দিনেশ।
-খেয়েছ?
-না।
-খাবে?
-না।
-কখন মরে গেছে?
-বিকেলে। ইস্টিশনে লিচু কিনে, হাসপাতালে যেতেই একটা লোক বলল, মরে গেছে।
-কি অসুখ করেছিল?
-জানি না। অনেকদিন হাসপাতালে ছিল, তারপর পেট কেটেছিল।
-বাড়িতে কে কে আছে?
-বাবলু আর দিদমা।
-আর?
-আর কেউ না।
-সঙ্গে কেউ আসেনি?
মাথা নাড়ল ছেলেটা।
-গাড়িতে করে নিয়ে এসেছে। আমিও ওই গাড়িতে এসেছি। খুব জোরে চালাচ্ছিল। একবার একটা লোক আর একটু হলেই চাপা পড়ত।
দিনেশের বুক থেকে মাথাটাকে দূরে সরিয়ে ছেলেটা মুখের দিকে তাকাল। ঝকমক করছে চোখ দুটো। গাল দুটো বেশ ফুলো-ফুলো।
-তোমার বাবা এখন কোথায়?
-ওইখানে, অফিসে কি সব লিখছে, দাঁড়িয়ে আছে।
চুপ করল ছেলেটা। দিনেশ কূলকিনারা পাচ্ছে না, এখন কি বলবে। ছেলেটা তাকিয়ে আছে ঘাটের দিকে। ঢেউ এসে ওখানে শব্দ করছে।
-আমাদের বাড়িতে একটা ময়না আছে। আমি রোজ তাকে সন্ধ্যেবেলায় ছাতু খেতে দি।
ঘাটে শব্দ হচ্ছে। দিনেশ শুনল। মালগাড়ির ইঞ্জিন হঠাৎ হুইসল দিল। ছেলেটা ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল। দেখা যাচেছ না। তরতর করে উঠে গেল। ইঞ্জিন দেখে আবার ফিরে এল।
-আমি যখন হাসপাতালে দাঁড়িয়েছিলুম তখন দু’টো দোতলা বাস গেছল। একদিকে গেছল।
-তুমি দোতলা বাসে চেপেছ?
-হুঁ। ইস্টিশন থেকে তো দোতলা বাসে করে হাসপাতালে আসতুম। এগিয়ে এসে দিনেশের কাঁধের ওপর ঝুঁকে ছেলেটা বলল।
-আমি একটা লিচু খাব?
-খাও না।
দিনেশ নিজেই খোসা ছাড়িয়ে দিতে লাগল। ক্ষিদে পেয়েছে ছেলেটা বীচিগুলো নিয়ে জলের দিকে ছুঁড়তে লাগল। খেলা করছে দুটো কুকুর। টিপ করে সেদিকে ছুঁড়ল। কেঁউ করে কুকুর দুটো পালাল। ছেলেটা হেসে উঠল।
শরীর গরম লাগছে দিনেশের। নখ বসে যাচ্ছে নরম শাঁসে। হাত কাঁপছে। জল ছুটছে। ঘাটে শব্দ হচ্ছে। শাণ্টিং-এর শব্দ হল। মন্দিরে জোর স্তোত্র পাঠ হচ্ছে। ছেলেটা ওপাশে সরে গেল কুকুর দুটোকে খুঁজতে। দেখতে পেলে আবার বীচি ছুঁড়ে মারবে। হাসবে।
ওর কান্না দেখে বুকের মধ্যে কথাগুলো জমাট হয়ে গেছল। ওর হাসির আঁচে বুক গলছে। সারা শরীরে গরম ছড়িয়ে পড়ছে। হাত পা খেলাতে ইচ্ছে করছে। জোয়ান বয়সের জোর শিরার মধ্যে ছুটছে।
গঙ্গার জল ছুটছে। উত্তরমুখো জল ছুটছে। জোয়ার আসে সমুদ্র থেকে। দূরে অন্ধকারে কালো মত একটা কি নড়ছে। বয়া? অন্ধকারে বয়া থাকে না। নৌকো? তাই হবে। ওটাকে ধরা যায় তো!
-খোকা তুমি এখানে আছ তো? আমার কাপড় জামাগুলো একটু দেখ। একটা ডুব দিয়েই উঠে আসছি।
আণ্ডারওয়্যার পরে জলে নামল দিনেশ। আঙুলগুলো কুঁকড়ে গেল। কতদিন জলে পা ডোবে না যে! টান লাগছে পায়ে। পা সরে যাচ্ছে। ঠিকমত শরীরটাকে খাড়া রাখা যাচ্ছে না, টলমল করছে।
-সাঁতার দিতে পারেন?
সাঁতরালে ও খুশি হবে। ওর গলার স্বরে তারই জানান দিল। দূরে কালোমত কি একটা নড়ছে। ওটাকে ধরা যায় কি!
ঝাঁপিয়ে পড়ল দিনেশ। জলটা ঠাণ্ডা কনকনে নয়, শরীর জুড়িয়ে যায়। স্রোত চলেছে। গা ভাসালে হবে না। কাঁধে, বগলে চড়চড় করে উঠল মাংস। এককালে মেসিনের মত হাত চলত। জং ধরেছে। মুখে জল ঢুকছে। কুলকুচো করে ফেলল। আবার জল ঢুকছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভুল হচ্ছে। ডান হাত টেনে তোলার সময় মুখটা ডান দিকে ফেরাতে হবে। পাড়ি মারতে হবে সামনে। গুড়িগুড়ি ফেনা উঠবে! ডান হাত জলে পড়বে, মুখও জলে ডুববে, তখন শ্বাস ছাড়তে হবে। কতকালের অনভ্যাস!
কোথায় সেই কালোমতন জিনিসটা! এধার ওধার তাকায় দিনেশ। কিছু নেই। জায়গাটা অন্ধকার। দূর থেকে কিছু একটা আছে বলে মনে হয়। বুকে ব্যথা করছে। এখন যদি কিছুক্ষণ ভেসে থাকা যায়! না, তাহলে অনেক দূর টেনে নিয়ে যাবে।
চীৎকার করছে ছেলেটা। অন্ধকারে দেখতে পায়নি। ভেবেছে বোধ হয় ডুবে গেছে। দিনেশ চীৎকার করে সাড়া দিল। হয়তো কেঁদে ফেলবে। আহা কাঁদুক। ওর কান্না ভারি ভালো, ও কাঁদুক!
একটা লোক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে ছেলেটার কাছে দাঁড়াল। কি যেন বলল, ছেলেটা ওর সঙ্গে চলে গেল। যতক্ষণ দেখা যায় দিনেশ ছেলেটাকে দেখল, তারপর গা ভাসিয়ে দিল।
.যমুনা শনিপুজো দিতে যায়। মাধবী বলল আজ সে’ও যাবে। যাবে ভাল কথা। যমুনার কোন আপত্তি নেই তা’তে।
শৈলর ছেলেটাকে রমার কোলে দিয়ে মাধবী বেরিয়ে পড়ল। গরদের শাড়িটা পোকায় কেটেছে! যমুনার আটপৌরে শাড়ি দেখে গরদ না পরার ক্ষোভটা মিটে গেল মাধবীর। গরদ পরলে গিন্নি-বান্নি দেখায়।
অনেকগুলো মোড় ঘুরলে গলিটা পড়ে মাঝারি রাস্তায়, সেখান থেকে সিধে বড় রাস্তা। বাস চলে। সে রাস্তাটা পার হলেই শনিঠাকুরের মন্দির।
দুটো মোড় ঘুরতেই জমজমাট ভিড় পথ আটকাল মাধবীদের। চীৎকার করছে দু’একজন মুখে রক্ত টেনে, সকলে শুনছে। বেশি চেঁচাচ্ছে যে ছেলেটি তাকে মাধবী খুব ছোট অবস্থায় দেখেছে। ওর নাম দুলাল। দুর্গাপুজোর কমিটিতে ওর নাম থাকবেই। ইলেকশনের সময় ভোট চাইতে এসেছিল। বাঁ হাতের দুটো আঙুল বোমা বাঁধতে গিয়ে উড়ে গেছে।
-প্রথমে দেখেই আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। কোবরেজ মশাইকে আমি বলেছিলুম ব্যাপার ভাল নয়। উনি তো বললেন পুলিশে জানিয়ে রাখ। আরে বাবা পুলিশ কি করবে! এসব কারবার যারা করে তারা কি অত সহজে ধরা দেবার পাত্তর। রইলুম তক্কে তক্কে।
-কি, কি হয়েছে রে দুলে!
বাজারে থলি হাতে মাঝবয়সী একজন ভিড় কেটে দুলালের মুখোমুখি হল।
-সেই মেয়েটা গুলোদা। বলেছিলুম না সেদিন চালচলন সুবিধের নয়। রোজ নতুন নতুন বন্ধু। বুঝি না কিছু যেন। আর ভদ্দর ঘরের মেয়েই যদি হবি, তার অত সাজগোজ কিসের! ঘরে বসে জানলা খুলে হি হি করে হাসা, দোকান থেকে চপ-কাটলেট আনা, এসব আসে কোত্থেকে? পুরুষমানুষ তো একটা বুড়ো অথর্ব বাপ। দিনরাত ঘরে বসে থাকে। সংসার চলে তাহলে কার পয়সায়? ওর ছোট বোনটাকে গোবরা জিগ্যেস করেছিল। এই নিয়ে রাস্তায় যাচ্ছেতাই অপমান করেছিল। গোবরাটা ন্যাকা, আমি থাকলে ধুধ্বুড়ি ছুটিয়ে দিতুম।
যমুনা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সরু গলিতে অল্প কয়েকটা লোক জমলেই ভিড় হয়ে যায়। এখন গোটা পাড়াটাই ভেঙে পড়েছে। এমন হয় চোর ঠ্যাঙাবার সময়। আর হোত দাঙ্গার সময়।
মাধবী চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। চমকে উঠল ঠিক কানের কাছে কার গলার স্বর শুনে।
-ঘোল ঢেলে লাথি মেরে বার করে দিক। ভদ্দর পাড়ায় ব্যবসা খুলেছে, মাগির সাহসও কম নয়!
মাধবী ফিরে তাকাল। জানলার আধখানা কপাট খুলে একটি বৌ নিজের মনেই কথাটা বলল।
-নতুন এসেছে বুঝি?
-না দিদি, আজ মাস তিনেক হল আছে। আমার জানলা থেকে তো ওদের সবই দেখা যায়। রাত এগারটা, বারোটায় বাড়ি ফেরে রোজ। উনি একদিন রাত্তিরে ধর্মতলায় একটা পাঞ্জাবির সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠতে দেখেছিলেন। মদ-টদও বোধহয় খায়। আচ্ছা আপনিই বলুন, এমন মেয়েকে পাড়ায় রাখতে আছে? উনি বলছিলেন দু’পা গেলেই তো আসল আড্ডা। সেখানে গিয়ে বাড়ি ভাড়া নিলেই তো হয়, ভদ্দর পাড়ায় থাকা কেন! কি বলুন?
-তা’ত ঠিক।
মাধবী ছোট্ট কথা বলে চুপ করে গেল। গলায় বোধহয় সূতিকার মাদুলি। চওড়া সিঁদুর। টকটক গন্ধ বেরোচ্ছে শাড়ি থেকেই। ঘরটা অন্ধকার করা, ফলে ওকে আর দেখতে পাচ্ছে না, তার ওপর জানলার আধখানাও ভেজানো।
-বেরিয়ে আসুন। আজ একটা হেস্তনেস্ত ক’রে তবে ছাড়ব।
-চেঁচালে বেরোবে নারে। মার, লাথি মার দরজায়।
-পুলিশে খবর দে’না!
-পুলিশ-টুলিশ দিয়ে কি হবে, আমরাই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
মাধবী খুঁজল যমুনাকে। ভিড়ে কোথায় মিশে আছে। শনিপুজো দিতে যাবে, সে কথা কি ভুলে গেল!
-আপনি বুঝি এ পাড়ায় থাকেন?
-হ্যাঁ।
-কোন বাড়িতে?
-পঁচিশ নম্বরে।
-কটি ছেলেপুলে?
-তিনটি। দুই ছেলে এক মেয়ে।
-মেয়ের বিয়ে হয়েছে?
-না। পাত্তর খুঁজছি।
-ভাল ছেলে পাওয়া আজকাল ভারি শক্ত।
দুজনেই চমকে উঠল। কে যেন দরজায় লাথি মেরেছে। ভিড়টা আঁট হয়ে উঠেছে। যমুনা কাছে এল মাধবীর।
-কি কাণ্ড দেখলেন দিদি। পাড়ায় থাকি অথচ এসব কিছু জানি না।
-এসব কি আর ঢাকঢোল পিটিয়ে কেউ জানায়।
ঘরের মধ্যে থেকে কচি গলায় কান্না উঠতেই বউটি সরে গেল জানলা থেকে।
-চল, পুজো দিতে যাবে না!
-যাব। আর একটু দাঁড়ান না।
-ওদিকে পুজো শেষ হয়ে যাবে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও যমুনা পা বাড়াচ্ছিল। তখনই হটাশ করে দরজাটা খুলে গেল। ভিড়টা দরজার কাছ থেকে একটু পিছিয়ে এল।
-কি পেয়েছেন আপনারা, দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন?
সব চুপ। কতকগুলো মুহূর্ত কাটল। তারপর চীৎকার করল গুলোদা।
-এসব চলবে না ভদ্দর পাড়ায়।
-কি চলবে না?
-কারবার করা চলবে না।
-মেরে তুলে দোব।
-আসল পাড়ায় ঘর নিন না!
-মা বোন নিয়ে আমাদের বাস কত্তে হয়।
আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সকলেই চীৎকার করতে শুরু করে দিয়েছে। যমুনার হাত ধরে মাধবী টানল।
-আর একটু দেখে যাই না।
-পুজোর দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদূর গিয়েই দরজা বন্ধের শব্দ শুনে ফিরে তাকাল মাধবী। বন্ধ দরজায় ওরা আবার লাথি মারতে শুরু করেছে।
দরজার ধার ঘেঁষে ঘোমটা দিয়ে কে একজন দাঁড়িয়েছিল, বয়স্ক মনে হয়েছিল। বোধ হয় মেয়েটির মা। মেয়ে যখন বলল, কি চলবে না? তখন হাত ধরে টানছিল আর কি যেন বলছিল নিচু গলায়, ঘরের মধ্যেটাও একটুখানি দেখা গেছল, বুড়োমতন একজন বাটি থেকে কি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। মুখ তুলে কা’কে যেন কি বলল। একটা ফ্রক-পরা মেয়ে এসে ঠোঙা থেকে বাটিতে কি সব ঢেলে দিল।
-কাণ্ড দেখেছেন!
-হুঁ।
-কি দিন কাল পড়েছে যে।
যমুনা এরপর বকবক করে যাবে। যাকগে। কান না দিলেও চলবে। মাধবী রাস্তা চলতে সাবধান হল। জলের কল-মিস্তিরী রাস্তা খুঁড়েছে। ঢিপি হয়ে আছে। কথা বলছে যমুনা, বলুকগে। বারান্দা আর জানলা, কোন বাড়িরই খালি নেই। ওরা মজা দেখছে। খুশি হচ্ছে।
মাধবী ঠিক খুশি হতে পারছে না। ঘোমটা দেওয়া সেই মেয়েমানুষটি আর বাটি থেকে খুঁটে খুঁটে-খাওয়া বুড়ো মানুষটির চেহারা মনে পড়ছে। ওরা মজা দেখছে। দেখবেই তো।
অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে। এটাও একটা ঘটনা। ঘটনা আচমকা ঘটে না। কারণ থাকে। এরও একটা কারণ আছে নিশ্চয়। শৈলর স্বামীর চাকরী যাওয়াও একটা ঘটনা। কিন্তু এমন করে কি বারান্দা জানলায় ভিড় জমবে যদি শৈলর স্বামী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়! তফাত আছে দুটো ঘটনায়। চাকরি যাওয়াটায় যতটুকু গুরুত্ব আছে তার থেকেও বেশি ভদ্রপাড়ায় একটা মেয়ের বেশ্যাবৃত্তিতে।
রাগ ধরছে মাধবীর। শৈলর কান্নাটা কেন গুরুত্ব পাবে না? পাড়ার লোকেরা এটুকুতেই কেন এত মাতামাতি শুরু করেছে। একটা মেয়ে তেড়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল আর একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে বসে কাঁদল। এ দুটোয় তফাত কতটুকু? দুটো ঘটনাই তো তৈরী হয়েছে একই কারণ থেকে। সংসারের কথা দুটো মেয়েই ভাবে। ভাবনার ফলেই একজন কাঁদে, আর একজন রুখে দাঁড়ায়। ওপরে তফাত বটে কিন্তু ভেতরের কারণ এক।
কিন্তু একটা বেশ্যার সঙ্গে কি একটা ঘরের বৌয়ের, আসল জায়গায় কোন তফাত নেই? রাগ ধরছে মাধবীর। যারা মজা দেখছে, তারা কি ধরনের খুশি পাচ্ছে? ঘেন্না করছে। অন্যকে ঘেন্না করলে সুখ পাওয়া যায়। অনেক ধরনের সুখের মধ্যে এও একটা। সংসারে সুখ কোথায়! তাই ঘেন্না করতে হয়। টাকা পয়সা দিয়ে দিনেশ সুখ আনতে পারেনি, তার পাল্টা শোধ নিতে হচ্ছে ওকে ঘেন্না করে। তার মানে কি দিনেশও ঘেন্না করে বেঁচে আছে! আমরা কি পরস্পরকে ঘেন্না করি?
-দেখে পার হোন।
হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল যমুনা। গাড়ি আসছে। ভয় করল মাধবীর। অতবড় বাসটা যে চালাচ্ছে তার হাতটা যদি একটু ঘুরে যেত। ছিটকে ধাক্কা খেতে হত আলোর থামটার সঙ্গে। মাথাটা ফেটে চুল আর ঘিলু মাখামাখি হত। কালো চাকায় রক্ত লেগে পানের ছোপ ধরত। ছিবড়ে ছিবড়ে মাংস রাস্তায় আটকে থাকত।
যমুনার হাতটা চেপে ধরল মাধবী। গাড়ির যেন আর শেষ নেই। ওর মধ্যেই হাত ছেড়ে সাইকেল চালাচ্ছে একটা ছেলে। দেখলে বুক ঢিপ ঢিপ ঢিপ করে। মুখোমুখি গাড়িগুলো কেমন সাঁই সাঁই করে ছুটছে। ধাক্কা লাগছে না। ওরা নিয়ম মাফিক চলছে। তবু তো ধাক্কা লাগে, তখন সেটাকে বলে ঘটনা।
আমরা সব্বাই নিয়ম-মাফিক চলছি। এই চলাটা কোথাও বিগড়োলেই ঘটনা ঘটে। নিয়ম নিশ্চয় বিগড়েছে, নইলে বেশ্যা হবে কেন! চাকরি যাবে কেন!
আমি কি নিয়ম-মাফিক চলছি? আমার মধ্যে কিছু কি বিগড়োয়নি? স্বামীকে ঘেন্না করাটা কি পাপ নয়! আমি পাপ করেছি!
-কতক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকব?
-নইলে কি গাড়ির তলায় যাবেন!
-তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে না।
গাড়ির ভিড়টা পাতলা হয়েছে, মাধবীর হাত ধরে এক ফাঁকে ছুটে রাস্তাটা পার হল যমুনা। হাঁফিয়ে উঠেছে দুজনেই এইটুকু ছুটে আসতে।
-বাব্বা, রাস্তায় বেরোনোও দায়।
যমুনা হাসল। মাধবী পাল্টা না হেসে ফুটপাথের ধার থেকে সরে গেল। মস্ত একটা বাস আসছে।
পুজোর আদ্দেক সারা হয়ে গেছে! রাস্তার ওপর বেঞ্চিতে পুরুষরা বসে। ছোট্ট একটা ভিড় করে অনেকে দাঁড়িয়ে। মেয়েদের বসার জায়গাটা ভিতর দিকে। পুরুষ আর মেয়ের ভিড় সমান।
ওরা বসতেই অনেকে ফিরে তাকাল। মাধবী এখানে এই প্রথম। সব কিছুই নতুন লাগছে। পুজো করছে যে তার নামের একটা সাইন বোর্ড লম্বালম্বি ঝুলছে ঘরের মধ্যে। নামের শেষে অনেক কিছু লেখা। খুঁটিয়ে পড়ল মাধবী। মামলা জেতা, মেয়ের সুপাত্র জুটিয়ে দেওয়া থেকে বশীকরণের মাদুলি পর্যন্ত পাওয়া যায়।
মানুষকে বশ করার জন্য মন্তর খাটাতে হয়! এতে মানুষের কোন জিনিসটা বশ হয়? দিনেশ যদি অমন একটা মাদুলি পরে তাহলে পারবে কি সে আমায় বশ করতে?
বিরক্ত হল মাধবী। পুজোরী হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরতি করছে। শরীরটা অল্প কাঁপছে। কোমরের কাছে দুটো ভাঁজ দলমল করছে। কালো হয়ে গেছে কসি গোঁজবার জায়গাটা। সারা গায়ে লোম নেই। চশমা টপকে এধার-ওধার তাকাচ্ছে। যন্ত্রের মত পুজো করছে।
হাতজোড় করে আছে সকলে। বিড়বিড় করে ওরা কি বলছে। মাধবী নতুন মানুষ। সে দেখছে সব কিছুই।
শেতলা, মহাকালী আর শনি পাশাপাশি। নীচে শালগ্রাম আর শিবলিঙ্গ। শ্বেতপাথরের মেঝে। পাথরে অনেক কিছু লেখা। থালাভর্তি প্রসাদ। গরুর মত চোখ করে একটা লোক ঘণ্টা বাজিয়ে যাচ্ছে।
পাশে তাকাতেই অস্বস্তি বোধ করল মাধবী। ওকে সে চেনে। খেঁদার মা। তিনবাড়ি ঝিয়ের কাজ করে। গলায় আঁচল জড়িয়ে হাতজোড় করে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ঠাকুরের দিকে। ওর সামনেই মোটাসোটা এক গিন্নী। হাত ভরা চুড়ি। নাকছাবিটাও দেখা যাচ্ছে। অস্বস্তিটা অল্প কেটে গেল। তবু খেঁদার মা’র গা বাঁচিয়ে সরে গেল মাধবী।
নতুন বিধবা বোধ হয়। ভঙ্গি থেকে এখনো সধবা ভাবটা ঘোচেনি। চুলটি বেশ কোঁকড়া। কুমারী বলে এখনো বিয়ে দেওয়া যায়। কাদের বৌ ও!
যমুনার দিকে তাকাল মাধবী। গদগদ হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর পাশের বুড়িটা চোখ বুজিয়ে ঝিমোচ্ছে। ঝিমোচ্ছে আর জাবর কাটার মত কি বলছে। বোধ হয় মন্তর। কি মন্তর!
বৌটির শাশুড়ী নিশ্চয়! নরম সরম গড়ন। বারবার বৌয়ের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। বৌটি মাথা নিচু করে কেন? বোধ হয় এখনো ছেলেপুলে হয়নি।
বয়স হয়েছে মেয়ে দুটোর। মুখের আদল এক রকমের। দুই বোন নিশ্চয়। তিরিশের কম কেউই নয়। এখনো বিয়ে হয়নি কেন!
ওই কি সতীন দত্তর ভালবেসে বিয়ে-করা বৌ! পোস্টাপিসে চাকরি করে। সতীন দত্ত অনেকবার জেল খেটেছে স্বদেশী করে। পাড়ায় খাতির আছে, সামনের বার কর্পোরেশনের ভোটে নামবে। ওর বৌ এখানে কেন?
-পা ঢেকে বসুন।
খেঁদার মা কথাটা বলল। শান্তিজল দেওয়া হবে। মাধবী আঁচলে পা মুড়ল। ঘাড় হেঁট করে বসল সকলে। মুখে দু’চার ফোঁটা পড়ল। পড়ছে পুরুত। ছ’দিন অন্তর তাকে এই কাজ করতে হয়। যন্ত্রের মত তার প্রতিটি নড়াচড়া।
প্রসাদ মাথায় ঠেকিয়ে খুঁটে বাঁধল খেঁদার মা। দুকুচি শশা আর একটা খেজুর পেল মাধবী। বাড়ির জন্য সে-ও রেখে দিল। সকলেই তাই করছে। এই জিনিসটা অদ্ভুত মনে হল তার কাছে। প্রসাদ সকলেই রেখে দিচ্ছে বাড়ির জন্য। একইভাবে সকলে ভাবে, সংসারের কথা ভাবে। একা সে-ই শুধু ভেবে মরে না। দুনিয়ায় সংসার শুধু একা তারই আছে তা নয়। ভাবাটা মানুষের ধর্ম। তবে বেশ-কম আছে। তা’ থাক, তবু এতগুলো মানুষের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই যেন দেখা যাচ্ছে। সান্ত্বনাও পাওয়া যাচ্ছে। নিজেকে সবাই সব কিছুর থেকে বেশি ভালবাসে। এদেরও ভালবাসতে ইচ্ছে করছে।
শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। পাপ জমেছিল মনে। মনটা এখন হাল্কা বোধ হচ্ছে। এদের সঙ্গে আমার মিল আছে। এমন মিল হয়তো আরও মানুষের সঙ্গে আছে। ক’জনকেই বা দেখেছি। একটা বাড়ির দুটো ঘরের মধ্যেই তো জীবন কাটল। বাইরে এলে নিজেকে কত বড়ো মনে হয়।
ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে মাধবীর আবার মনে হল, বাইরে এলে নিজেকে কত বড়ো যে লাগে!
-চিনতে পার গো!
-কেন পারব না। তোমার জামাইয়ের খবর কি, শুধরেছে না আগের মতই আছে?
-ও হারামজাদা আবার শোধরাবে। আজ ছ’বছর বে’ হয়েছে, পরশু এসে বলে বে’র সময় আংটি দেবার কথা ছিল দাওনি, এখন দাও। আমিও তেমন মেয়ে কিনা। মেয়েকে যদি সুখে রাখতিস, আংটি কেন সোনার ঘড়ি পর্যন্ত দিতাম।
-মেয়ে কোথায়-তোমার কাছে?
-তবে না’তো কি! শাউড়ীটা খাণ্ডার মাগি। পাঠালে কি আর জন্মে মেয়ের মুখ দেখতে পাব। কোট-ঘর-পুলিশ, যে করে পারিস নিয়ে যা দেখি। আমি অত সহজে ছাড়বার পাত্তর নই।
এবার রাস্তা পার হতে হবে। মাধবী দাঁড়াল। খেঁদার মা একটু দূরে সরে দাঁড়াল। যমুনা কার সঙ্গে যেন কথা বলতে বলতে আসছে। হাতভরতি চুড়িপরা গিন্নীটি খেঁদার মা’কে দেখে জিগগেস করল:
-কি হলো গো আমার লোকের?
-চেষ্টা তো কচ্ছি মা, পেলে জানাবো।
-আর জানিয়েছ। মেয়েকে বসে বসে খাওয়াচ্ছ, আমার কাছেই দাও না। কি আর এমন কাজ আমার বাড়িতে! তিনটিতো লোক।
-না মা। জামাই শুনলে রাগ করবে।
-করে করবে। ভাত কাপড়তো আর দেয় না। যাই হোক বাপু তাড়াতাড়ি একটা লোক দিও।
গিন্নীটি চলে গেল। যমুনা এসে পড়েছে। খেঁদার মা গম্ভীর। মাধবী বলল:
-কে গা?
-পাড়াতেই থাকে। হালে পয়সা ক’রে গাড়ি কিনেছে।
-তুমি বললে না কেন, তোমার মেয়ে হলে পারতে জামাইয়ের মত ছাড়া কাজ করতে পাঠাতে?
-কি দরকার মা ওসব বলে।
-না বললে যে আস্কারা পেয়ে যায়, মুখ বেড়ে ওঠে। দাঁড়াও, দেখে পার হও।
খেঁদার মা’র হাত ধরে মাধবী পিছিয়ে গেল। বাসটা চলে যেতে, এক ছুটে তিনজনে এপারে চলে এল।
গলির মুখে খুচরো দু’চারটে জটলা। জানলা বারান্দায় এখনো কেউ কেউ রয়ে গেছে। গলিটা অন্য যে কোন দিনের মত আবার মিইয়ে পড়েছে।
মাধবী বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। ভাঙেনি ওটা। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি ঘটল কে জানে। এপাশে সেই বউটির জানলা খোলা। থালায় ভাত বাড়ছে। মাধবীর ইচ্ছে করেছিল জিগ্যেস করতে। জানলার ধারে পৌঁছে আবার সরে এল। খেঁদার মা আর যমুনা কথা বলছে। গলা বাড়িয়ে মাধবী বলল:
-ওখানে মোটেই সস্তায় তাঁতের শাড়ি পাওয়া যায় না। তার থেকে বরং ফেরিওয়ালাকে ডেকে দরজায় দরদাম করে কিনলে অনেক সস্তা পাওয়া যাবে।
.শৈলর ছেলেটাকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ছিল রমার। সে দায় চুকিয়ে ফিরছিল, ডাকল আভার ছোটবোন।
-দিদি এসেছে, রমাদি।
-কখন রে?
-দুপুরে, জামাইবাবুও এসেছে।
-আমার কথা জিগ্যেস করেছে!
-হুঁ।
একটা বাঁক ঘুরলে আভাদের বাড়ি। একবার ঘুরে এলে কেমন হয়। বিয়ে হয়ে গেছে, এখন তো ও আর হটহট করে পাড়া বেড়াতে পারবে না। গিয়েই দেখা করতে হবে। আজ এক বছর হতে চলল বিয়ে হয়েছে, বোধহয় ছেলেপুলে হবে তাই এসেছে। মধ্যে দু একবার এসেছিল দেখা হয়নি। শ্বশুর শাশুড়ী গ্রামে থাকে। ওরা এখানে ঘরভাড়া নিয়েছে। দু’জায়গায় সংসার-খরচ টানা সোজা ব্যাপার নয়। তবু গ্রাম থেকে আভাকে আনিয়ে সংসার পেতেছে ওর বর। কি নাম যেন, রবীন না সুবল!
সদর দরজায় হুটপাট শুরু করেছে বাচ্ছারা। বাটি হাতে কুলপিওলাকে ঘিরে চেঁচামেচি। আভার বর খাওয়াচ্ছে। আভাও দাঁড়িয়ে।
রমাকে দেখে খলবল করে উঠল আভা:
-কি ভাগ্যি আমার।
-তোর না আমার।
ওদের কথা শুনছিল আভার স্বামী। কথার শেষ নেই কোন। হাবি-জাবি আলাপ। রমা হাসিমুখে কয়েকবার ওর দিকে তাকাল।
সুবল! নামটা এতক্ষণে মনে পড়ল। এমন হয়, অনেক কথা পেটে থাকলেও মুখে আসে না। আচমকা এসে যায়। তখন স্বস্তি লাগে!
-কেমন আছেন?
বেশ সহজ সুরে রমা জিগ্যেস করল। অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে চট করে সহজ হওয়া যায় না! কিন্তু অবস্থা বিশেষে হওয়া যায়।
আমতা আমতা ক’রে কিছু একটা জবাব দেবার চেষ্টা করল সুবল। শেষে বলল, মালাই খাবেন?
উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই ফরমাশ করল সুবল।
-খুব লাজুক না রে?
-তুই নতুন কিনা তাই।
-নতুন কোথায়! তোর বিয়ের সময় কতক্ষণ ধরে বকবক করেছি না! মালাই বরফ এগিয়ে ধরল সুবল। রমা ইতস্ততঃ করছে।
-নে’না।
-বারে আমি একা খাব নাকি, তুইও নে।
-আমি তো খাবই। আমিই তো ডাকিয়েছি। সিদ্দির খাবি?
রমাকে মালাই আর সিদ্ধির বরফ গোটাকতক খেতে হল। আভার বাবা-মা’ও বাদ গেল না। ছোটরা জামাইবাবুকে ঘিরে হৈ চৈ করছে। সুবলকে দেখে মনে হল এসব তার ভাল লাগছে।
দোতলার একটা ঘর মেয়ে-জামাইয়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ও ঘরটা আভার আইবুড়ো কাকার। কাকা রাতে ঘুমোবে ছাদের ঢাকা দেওয়া চাতালটায়।
বাড়িতে সবাই খুশি। জামাই আজ রাতে থাকবে। ফিসফাস হচ্ছে আভার মায়েতে বাবাতে। ছোট ভাইটা গেছে পাশের বাড়ি থেকে ট্রামের মান্থলিটা চেয়ে আনতে। ও এলেই আভার বাবা নতুন বাজার যাবে। আর একটা ভাই মুদির দোকান থেকে ফিরলে জামাইয়ের লুচি ভাজা শুরু হবে।
রান্নাঘরে চা করছে আভা। রমা চৌকাঠে বসে শুনছে ওর কথা। চোখ দিয়ে দেখছে আভার শরীরটাকে, ভাবভঙ্গির খুঁটিনাটিকে।
-এই কদিনেই ওর অব্যেস পালটে দিয়েছি। এখন আমার হাতের চা ছাড়া একদম খেতে পারে না। তুই করে দে ঠিক ধরে ফেলবে। খাবে না, ফেলে দেবে।
-কেন আমরা কি চা করতে পারি না? দে’না, কেমন ধরতে পারে দেখি!
ছাঁকনিটা শক্ত করে আঁকড়ে কাপটা একটু সরাল আভা রমার নাগালের বাইরে।
-হ্যাঁ, শেষকালে চা ফেলে দিক। তারপর যত ঝাল আমার ওপর ঝাড়ুক। কম রাগী মানুষ! একটু এদিক-ওদিক হলেই একটা কাণ্ড বাধিয়ে দেয়।
আভা হাসল। রমাও হাসল। তাই দেখে হঠাৎ ঘাড় নিচু করে চিনি গুলতে শুরু করল আভা।
-কাণ্ড যে বাধায় তা’ত দেখতেই পাচ্ছি।
-ধ্যেৎ, তোর বড় মুখ আলগা।
-দেশে থেকে যে কলকাতায় এলি? ওখানে বুঝি রাগারাগির সুবিধে হচ্ছিল না!
-আহা, তাই বটে। ও এখন যে দোকানটায় কাজ করে সেটাতো উঠে যাচ্ছে।
-সেকি!
রমার গলার স্বরে বাড়াবাড়ি ধরনের বিস্ময় ছিল। সে জানত, সুবল ঘড়ির দোকানের কারিগর। মাস গেলে প্রায় শ’ দুই টাকা রোজগার করে। দোকান উঠে গেলে ওরা খাবে কি?
-উঠে যাচ্ছে চালাতে পারছে না বলে। ঘড়িতো আর তেমন বিক্রি হয় না। যা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে গরমেণ্ট, চালান আসা বন্ধ হয়ে গেছে। মেরামত করে কোম্পানির আর কত আয় হয়, দোকান ভাড়া, কারিগরের মাইনে দিয়ে কোন লাভই থাকে না। তাই তুলে দিচ্ছে।
-তা হ’লে কি করবি!
-ওই জানে। নিজে দোকান দেবে, নইলে আর কি করবে! ঘড়ি, ষ্টোভ, কলম, সাইকেল-সব মেরামত করতে পারে। একটা ঘর পেয়েছে শেয়ালদার কাছে।
চা হয়ে গেছে। দুহাতে দুটো কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়াল আভা। আঁচলটা খসে পড়ল মাটিতে।
-তুলে দেনা রে।
-উহুঁ। ওমনি যা।
-মাথার কাপড় না দিয়ে গেলে মা ভীষণ রাগ করবে।
-করে করবে, বলবি আমি খুলে দিয়েছি।
-মা না থাকলে ঠিক দিতুম, বাড়িতে তো ঘোমটা দিলে ও রাগ করে।
-ভালই তো, বলবি, জামাই ঘোমটা দেওয়া পছন্দ করে না।
-তর্ক করতে পারি না বাপু, দিবি তো দে। আবার কাপদুটো নামিয়ে কাপড় ঠিক করতে হবে। নিচু হলেই ব্যথা করে।
হাসল আভা। এমন হাসি রমা কখনো দেখেনি। সুখী হয়েছে আভা। ভাবনা চিন্তা নেই। কিংবা থাকলেও গ্রাহ্য করে না। বরের সঙ্গে মনের মিল হয়েছে। আলাদা একটা ঘর পেতেছে। সুবল হাতের কাজ জানে, চাকরি গেলেও ভাবনা নেই। নিশ্চিন্তির সঙ্গে মনের মিল খাপ খেয়ে গেছে। শান্তিতে আছে আভা। ওর হাসিটা ঠাণ্ডা। দেখলে মন জুড়োয়।
আভার আঁচলটাকে ঠিকমত জড়িয়ে দিতে দিতে নিচু সুরে রমা বলল:
-বাপের বাড়িতেই খালাস হবি?
-ও বলছিল হাসপাতালে দেবে। সেটাই ভাল।
-হ্যাঁ, তাই ভাল। তবু প্রথম পোয়াতি, মা’র কাছে থাকলে সাহস পাবি।
-দেখি ও কি বলে। তোর খবর কি?
-আমার আর কি খবর।
-জুটল কিছু।
-তা দিয়ে তোর কি, তোর তো জুটেছে।
-তোদের বাড়ি যাব কাল। মাসিমাকে আচ্ছা করে বলে আসব’খন। তুই কিন্তু কালো হয়ে গেছিস।
ওদের কথা বন্ধ হল। আভার মা এসে পড়েছে। মেয়েকে তাড়া দিয়ে আবার ছুটল স্বামীর কাছে। কিসমিস আনতে বলা হয় নি।
রমা বাড়ি চলে যাচ্ছিল। আভা যেতে দিল না।
-এর মধ্যে যাবি। চ’ কথা বলবি না?
-তোর বরটা বড্ড হাঁদা।
-আহা, গায়ে পড়া হলে বুঝি খুব ভাল হ’ত।
-হ’তই তো। তাহলে আইবুড়ি নাম খণ্ডাতে চেষ্টা করতুম।
-করে দেখ না একবার।
.সুবলের শালা-শালী অনেকগুলো। ঘরে চুপ করে একা বসেছিল সে। কেউ পড়ার বই, কেউ চটের আসনের নক্সা এনে জামাইবাবুকে দিয়ে পরখ করিয়ে নিচ্ছিল।
রমাদের দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সুবল। ওকে ভাল করে দেখল রমা। খুব সাধারণ দেখতে। মুখটায় ভোঁতামি সাধারণের তুলনায় একটু বেশি। আঙুলগুলো বেঁটে। হাতের হাড় চওড়া। পায়ের নখে ময়লা জমে। পেয়ালায় চা ঢেলে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ক’রে খেল।
রমা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। কি কথা বলবে সে। মানুষটা কি ধরনের না জানলে আলাপটা শুরু করা যায় না। পুরুষদের কথার বিষয় যা হয় তাতে বেশিক্ষণ মেয়েদের পক্ষে কথা চালানও শক্ত। ঘর সংসারের কথায় জোয়ান ছেলেরা তো একটুও রস পাবে না।
-কিরে খুব তো তখন বলেছিলি, এখন নিজেই তো লজ্জাবতী লতা হয়ে গেলি।
-হলুম আর কোথায়। উনি আগে কথা বলুন। পুরুষদেরই আগে কথা বলতে হয়।
-তুমি বলতো কথা।
সুবল নড়ে চড়ে বসল। বার কয়েক হেসে, মুখ লাল করে শেষকালে ঘড় ঘড় করে বললঃ
-এখন তো মেয়েদেরই যুগ। ট্রামে, বাসে, পোস্টাপিসে, সিনেমায়, সব জায়গাতেই লেডিজ ফার্স্ট!
রমা তাকাল আভার মুখের দিকে। টকটকে মুখ।
-কথায় পারার জো নেই। একটু বেফাঁস কিছু বলেছি কি ক্ষেপিয়ে মারবে।
আভাকে এখন বেশ লাগছে রমার। এত কথা বলত না। এখন চোখে মুখে খই ফোটে। কথা বলে যাচ্ছে ও। সুবলের মুখের ভাব পালটে যাচ্ছে। সুবলের পদ্যের খাতা আছে। নিজহাতে মাংস রাঁধে। মাউথ অর্গ্যানে নিখুঁত গানের সুর তুলতে পারে। মেয়েদের একা রাস্তায় বার হওয়া পছন্দ করে না।
গানের মত লাগছে আভার কথাগুলো। মুখে হাসি রেখে শুনে শুনে গেল রমা। সুবলের দিকে তাকাচ্ছে আভা। চাউনিতে কি যেন আছে। সুখী হয়েছে ও। আগে ওদের পরিচয় ছিল না। কিন্তু এক বছরেই মনে হয় যেন জন্ম-জন্মান্তরের ভাব। আভার ভয় ছিল স্বামী সম্পর্কে। সব মেয়েরই বিয়ের আগে থাকে। সুবল ওকে সুখী করেছে। সব চেয়ে বড় ভয় থেকে মুক্তি দিয়েছে। না খেয়ে মরতে হবে না। ছা-পোষা ঘরের মেয়ে এটুকুতেই সুখী।
চাকরি গেলেও সুবল ভয় পায় নি। হাতের কাজ জানে। দোকান দেবে। কিন্তু তার মানেই পায়ের ওপর পা তুলে বসে খাওয়া নয়। খাটতে হবে। তখন ফাঁকি দেওয়া মানেই নিজে ফাঁকিতে পড়া। এখন ঘাড়ে দায়িত্ব পড়বে।
সুবল নিশ্চয় খাটতে পারে। এরপর তো ওকে আরো বেশি খাটতে হবে। আভার সঙ্গে যদি বিয়ে না হত, তা হলে কি ও খাটবার, কিংবা দোকান দেবার জোর পেত? পে’ত নিশ্চয়। বিয়ে-না-করা দোকানদার কি নেই! তবু, খাটুনির জোরটা অমনি আসে না। বিয়ে করে যেমন দায়িত্ব এসেছে তেমনি আভা যদি না ওকে খুশি করতে পারত, তা হলে সুবল কমজোরি হয়ে পড়ত। আর যে খাটতে পারে তাকে কোন দিক দিয়েই হারিয়ে দেওয়া সহজ নয়। তবে একথাও মানতে হবে, সুবল যদি খাটিয়ে না হত, তা হলে আভারও এত খুশি করবার জোর থাকত না। দুটো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব দুজনেরই।
-সিনেমায় যাবি?
-না।
-চ’না। কি এমন কাজ আছে শুনি?
-তোরা দুজনেই যা না। আবার মাঝে একজন কেন!
-খুব ন্যাকামো হয়েছে। যা দিকি চটপট সেজেগুঁজে আয়।
আভা একা নয়, সুবলও ওর সঙ্গে অনুরোধ জুড়ে দিল। মামুলি কতকগুলো আপত্তি করে রমা রাজী হয়ে গেল। আভা মাধবীর অনুমতি আদায় করার ভার নিল।
মাধবী তখন সবে বাড়ি ফিরেছে শনিপুজো দেখে। দিনেশ বা চিনু বাড়ি নেই। রমা যা ভাবেনি তাই হল। আভার এক কথায় মাধবী রাজী হয়ে গেল।
রাত নটায় ছবি আরম্ভ। আভার ভাই বোনেদের নিয়ে দু’খানা ট্যাক্সিতে ওরা রওনা হল। মাকে যাবার জন্য পেড়াপীড়ি করেছিল আভা। ওর মা রাজী হয়নি। মেয়েদের সাধ আহ্লাদের ব্যাপারে বয়স্কাদের থাকতে নেই।
ছবি আরম্ভ হতে কিছু দেরি ছিল। সিঁড়ির পাশের একটা জায়গায় বসার ব্যবস্থা। তখনো সন্ধ্যার শো ভাঙেনি। ওরা সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। সুবল চকোলেট কিনে আনল।
ছবিঘরটা ঝকঝকে সাজানো। এমন জায়গায় রমা প্রথম এল। অনেক মেয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের সে গোগ্রাসে দেখল। সাজগোজ ছাড়া কেউ সিনেমায় আসে না। তাই কাউকেই খারাপ দেখায় না। দেয়ালে ফটো সাজান রয়েছে। আভা উঠে গিয়ে দেখতে লাগল। রমারও ইচ্ছে করছে দেখতে। কিন্তু কেমন একটা সঙ্কোচ লাগল তার। এতগুলো মেয়ের সামনে দিয়ে উঠে গিয়ে, দাঁড়িয়ে ছবি দেখতে হবে ওরা সকলে নিশ্চয় তাকাবে তার দিকে। সকলের চাউনি বিশেষ করে তাকেই লক্ষ্য করবে, এ কথা ভাবতেই পা জমে যায়। অথচ আভা কত সহজে উঠে গেল। এটা সম্ভব হয়েছে আভার সিনেমা দেখার অভ্যাস আছে তাই, না কোন কিছুকে পরোয়া না করার জোর পেয়েছে বলে? রমা আভার দিকেই তাকিয়ে রইল।
হাতছানি দিয়ে আভা ডাকল। উঠে এল রমা। দু একজন তার দিকে তাকাল শুধু। আভা ছবির মানুষগুলোর নানান গুণপনার ব্যাখ্যা শুরু করল। শুনতে শুনতে রমার নজর এড়াল না অনেক পুরুষমানুষই তাকে আড়ে আড়ে দেখছে।
ঘণ্টা পড়তেই তাড়া দিল সুবল। ওরা ভেতরে গিয়ে বসল, রমার পাশে আভা তার পাশে সুবল। দেয়ালের গায়ে ছবি। জমকালো পর্দা, ফিটফাট পোশাক পরা কর্মচারী, নরম চাপা আলো, চাপা কথার শব্দ, সব জড়িয়ে রমার স্নায়ুতে ঝিম ধরিয়ে দিল।
ছবি শুরু হতে অল্প দেরি আছে। সুবল আর আভা কানে-কানে কি বলে হেসে উঠল। রমা মুখটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল, ওরা যাতে না অসুবিধা বোধ করে।
-এ্যাই, এদিকে দেখ না।
চাপা গলায় আভা ডাকল। চোখের ইশারায় রমাকে সে সামনের দিকে তাকাতে বলল। দু তিনটে সিট পরেই একটা লোক মুখ ঘুরিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে।
কি দেখছে লোকটা! মাথা নিচু করে ফেলল রমা। আভা আবার হাসছে। সুবলও।
-তোকে দেখছে।
-যাঃ, আমাকে নয় তোকে।
-বারে, আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে।
-হলেই বা, তোকে এখন খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
আভা আবার সুবলের সঙ্গে কানাকানি শুরু করল। মুখ না তুলেই রমার মনে হল, সারা ঘরের লোক এখন তার দিকেই তাকিয়ে আড় চোখে দেখল, আভার আঙুলগুলো আলগোছে ছুঁয়ে আছে সুবল।
ঘাড় নামিয়ে রমা জিজ্ঞাসা করল: আরম্ভ হতে আর কত দেরী রে?
.অমলটা চলে গেল, এর মধ্যেই বাড়ি ফিরে কি হবে। অভ্যাস হয়ে গেছে এমন যে এখন ভাত খেলে রাত এগারটা বারটায় ঠিক ক্ষিদে পেয়ে যাবে। অভ্যাসে অভ্যাস তৈরী হয়।
চিনু ফিরে হাঁটতে শুরু করল। পুজো আসছে এবার বোঝা যাচ্ছে। কলকাতায় এত মানুষ থাকে কি করে! থার্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়িগুলো আজকাল উঠে গেছে। ওই রকম ঘরে ঠাসাঠাসি হয়ে মানুষ থাকে। থাকে নেহাত খাওয়া-শোওয়ার জন্য। সে কাজ হয়ে গেলেই পিলপিল করে বেরিয়ে পড়ে। গায়ে হাওয়া লাগায়। হাত পায়ের খিল ভাঙে। মেয়েদের অবস্থাটা কি হয় তাহলে! মা কিংবা রমাটা এখনো তবু দিনভর খাটে কি করে!
চিনুর মনে হল অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁটছে তবু কিছুই এগোয়নি। বিরক্ত হল সে। এতলোক এই কলকাতায় ভিড় করার কি দরকার। হাত পা খেলিয়ে দু’পা হাঁটা যায় না। ট্রাম-বাসে জামার ভাঁজ থাকে না। বাড়িতেও তিষ্ঠোন যায় না। তাহলে মানুষ করবে কি! পার্কে গিয়ে বসবে? একা অন্ধকারে বসার কোন মানে হয় না। ওরা যদি কেউ থাকত এখন!
ওরা থাকলেই বা কি এমন বসার মানে হ’ত? একঘেয়ে কথা, একই ভঙ্গিতে শোনা আর তাতে রসান দেওয়া, এ আর কতদিন চলে। এতে কি লাভ হয়? লাভ লোকসান খতিয়ে না চললে এ সময়ে টিঁকে থাকা যায় না।
তার মানে কি আমি টিঁকে নেই! লাভ লোকসান খতিয়ে চলিনি। তার মানে কি আমার কোন সঞ্চয় নেই ভবিষ্যতের জন্য? দু’বেলা বাড়িতে দুমুঠো খাই, তাছাড়া নোংরা গল্প, হাসিঠাট্টা, আর মাঝে মাঝে গম্ভীর সাহিত্য আলোচনা এতেই তো দিন কাবার হয়। এমনি করে অনেকগুলো বছর কাবার হয়ে গেল। তা’তে কি হল! কোনদিন তো মনে হল না আমি কোন এক সময়ে সকলের থেকে বিশিষ্ট। আমার এমন কতকগুলো বোধ বা অনুভূতি আছে যা আর কারুর নেই। আমি নিজেকে ভালবাসলুম না, শ্রদ্ধা করলুম না, আস্থা রাখতে পারলুম না। মুহূর্তের জন্যও কি একবার মনে হয়েছে যে আমি টিঁকে আছি? আড্ডায় ব্যক্তিত্ব রেখে চলতে গেলে আড্ডা জমে না। দিনের পর দিন আড্ডা জমাতে গিয়ে সকলেই ব্যক্তিত্ব খুইয়ে পুঁয়ে পাওয়া হয়ে গেছি। ক্রমশ নিজেকে ক্ষইয়েছি। নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছি। আমায় দিয়ে কোন কাজ হওয়া কি সম্ভব?
পৃথিবীতে যদি কিছু অকেজো লোক থাকে তাহলে ক্ষতি কি? আড্ডা দেওয়াটা কি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একান্তই দরকার? মনের কুৎসিত চিন্তাকে বার করে দেবার জন্য কি খিস্তি করতেই হবে?
এর উল্টোটি যদি ঘটে তা হলেই বা ক্ষতি কি? আড্ডা বা খিস্তি না করে যদি কাজের মানুষ হই তা হলে কি যান্ত্রিক হয়ে পড়ব? বন্ধুরা ব্যঙ্গ করবে? এতে লাভ কার? আবার সেই লাভ লোকসানের কথা এসে পড়ছে। অন্যদিকে যদি ভাবি! এতে ক্ষতিটাই বা কি? নিজের কথা ছেড়ে দিলেও সংসারের কথা ভাবতে হবে। কোন দায়িত্ব নেই একথা ঠিক। কিন্তু যুক্তি দিয়ে কি মানবিক সম্পর্কের দায় চুকান যায়, পয়সার অভাবে মা যদি ঝিয়ের কাজ করে, তাহলে কি চোখ ঘুরিয়ে চিন্তা করব, এতে আমার কোন দায় নেই! বাবা যে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে সেটা কি শুধু নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য! যুক্তির পরেও আরো কিছু থাকে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না কথা দিয়ে। অস্বীকারও করা যায় না। কিন্তু স্বীকৃতিই বা দিই কেমন করে। সকলকে সুখী করতে হবে। অসুখী সংসারের মধ্যে একা কেউ সুখী হতে পারে না। সুখ আজকের দিনে টাকা ছাড়া আসে না। কিন্তু নিজে সুখী না হলে কি অপরকে সুখী করা যায়? যায় না। আমি নিজে যদি সুখ না পাই, নিজের ওপর বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা না রাখি তা হলে আমার টিঁকে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। নিজেকে ভারী করে তুলতে হবে, যাতে এই পৃথিবীর ওপর ওজনটা বেশ ভাল করেই পড়ে।
-হাঁ করে দেখছ কি, জুতো কিনবে ভেবেছ নাকি! চলে এস।
চমকে ঘাড় ফেরাল চিনু। তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে, লজ্জায় এতটুকু হয়ে যাওয়া মুখখানা বিরক্ত ভদ্রলোকের পিছনে হাঁটতে শুরু করল। লজ্জা করল চিনুর নিজেরই। দোকানদার ওদের ডাকবার জন্য তৈরী হচ্ছিল, সেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। চিনুর সঙ্গে চোখ মিলতেই মুখ ঘুরিয়ে নিল দোকানী।
শিরশির করে উঠল চিনুর শরীর। মহিলাটির লজ্জা অপমানে মেশানো অভিব্যক্তি আর দোকানদারের দরদ একসঙ্গে জড়িয়ে ঘা দিচ্ছে। শরীরের ভেতরটা কাঁপছে। এমন জিনিস দেখা যায় না। যায়, চারদিকেই এমন ঘটে, দেখতে জানলে অনেক দেখা যায়। মানুষ দেখলে বোঝা যায় যে টিঁকে আছি। নইলে শরীরে এই কাঁপন এল কেন!
সারি সারি জুতোর দোকান। তারপরে কাপড়ের। প্রত্যেকটি শো-কেসের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে জিনিস দেখতে দেখতে চিনু একসময়ে একঘেয়ে বোধ করল। ফুটপাথের ধার ঘেঁষে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল ট্রাম-বাস; লোকজনের হাঁটা চলা।
এ লোকগুলো সব কাজের। একটা কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছে। হয়তো আত্মীয়বাড়ি যাচ্ছে, দুটো সুখদুঃখের কথা, হাসি-মস্করা করে নিজেকে হাল্কা করতে। অফিস থেকে ফিরছে কেউ হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে। পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছে কেউ। সকলেরই উদ্দেশ্য আছে, অপরকে খুশি করে নিজেকে খুশি করা। তাহলে এতগুলো মানুষ স্বার্থপর! পৃথিবীতে বিশুদ্ধ নিঃস্বার্থপরতা বলে কিছু আছে নাকি! সব মানুষই আগে নিজেকে ভালবাসে। আমি কি নিজেকে ভালবাসি? তাহলে বুঝতে পারছি কই যে আমি টিঁকে আছি!
কাজের মানুষ কাউকে কি দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোজ চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে! না বোধহয়। আসে, চা খায়, বন্ধু দেখলে দুচারটে কথা বলেই চলে যায়। কাজের মানুষের উদ্দেশ্য আছে। আমি কোন কাজই করি না।
ট্রাম-বাস, লোকজন দেখতেও বিরক্ত বোধ করল চিনু। আবার হাঁটতে শুরু করল। ওর সামনে চলেছে একটি পরিবার। মেয়েটি রমার বয়সী, ঝলমলে শো-কেসের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। খেয়াল নেই যে কখন সে একলা হয়ে গেছেন কি একটা বলার জন্য ঘাড় ফিরিয়ে, ঠিক চিনুকেই পিছনে দেখে থতমত খেল। অজস্র লোক এই একটা ফুটপাথেই। অর্ধেকটা জুড়ে ফিরিওয়ালারা বসে গেছে। মুখ শুকিয়ে এধার-ওধার তাকাচ্ছে মেয়েটি।
-আপনার সঙ্গের ওরা ওইখানে, ফ্রক দর করছেন।
আঙুল দিয়ে চিনু একটা থাম দেখিয়ে দিল। ওখানে স্তূপাকার ফ্রক নিয়ে চীৎকার করছে দুটি ফেরিওলা। মেয়েটি হাসল একবার, তারপরই পড়ি মরি প্রায় ছুটে গেল।
দোষ নেই মেয়েটার। যা ঝলমলে সাজিয়ে রেখেছে শো-কেসগুলো! জোঁকের মত লেগেছে ছেলে দুটো। ওরা ঠিক তাক করে ধরে। সঙ্গে মেয়ে থাকলে কখনো পুরুষদের কাছে ভিক্ষে চায় না। আশেপাশে হাঁটবে হাত বাড়িয়ে, কখনো পায়ে হাত দেবে। একটা পয়সা দিলেই বিদেয় করা যায়। তবু দিচ্ছে না লোকটা। দিয়েছে। খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে। সঙ্গে কে, বৌ? বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। ভিখিরী দুটো তাকাচ্ছে। এবার আমাকেই ধরবে। কাছে পয়সা নেই বললেও বিশ্বাস করবে না। ঘ্যান ঘ্যান করে জ্বালাবে।
ট্রাম রাস্তা পার হয়ে এপারে এল চিনু। কটা বাজে এখন? এতগুলো দোকান, ঘড়ি নেই একটাতেও!
-আসুন বাবু।
-না ঠিক আছে।
-ভেতরে এসে দেখুন না।
দোকানটায় ঘড়ি নেই। শো-কেসের মধ্যের জুতোগুলোর ওপর চোখ বোলাল চিনু।
-ভেতরে আরো ডিজাইনের আছে। আসুন না।
-এটার দাম কত?
-সাড়ে চোদ্দ।
-বিনুনি ছাড়া শুধু স্ট্র্যাপ দেওয়া ওই রকমের চটি আছে?
-আছে।
-ওই রঙের?
-না, শুধু কালো রঙের হবে।
পাশের দোকানের লোকটা ওদের কথা শুনছিল। চিনুকে নড়াচড়া করতে দেখেই ডাকল। হেসে তাকে ছাড়িয়ে হাঁটতে লাগল চিনু। ঘড়ি নেই। যাকগে সময় দেখে কোন লাভ নেই। বরং জুতোর দর করতে করতে সময় কাটান যাবে।
-আসুন বাবু।
-না ঠিক আছে।
-ভেতরে এসে দেখুন।
ভেতরে তাকিয়েই চমকে উঠল চিনু। কাবেরী জুতো কিনছে।
-না, ভেতরে যাব না। এইতো এখানেই কত রকমের রয়েছে।
-আরো অনেক ডিজাইনের আছে। ভাল করে বসে দেখবেন।
-জুতোর ভয়ানক দাম।
-কম দামেরও আছে। দর না পোষায় নেবেন না। তা’ বলে দেখতে দোষ কি!
তিনটে বাক্স কাবেরীর সামনে। হাত নেড়ে কি বোঝাচ্ছে। বোধ হয় পছন্দ হয়নি। কতদিন ওকে দেখি না। পাঁচ-ছ’ মাস! হাত নাড়াটা বদলায় নি। উঠেছে। এবার বেরিয়ে আসবে। দোকানদার কি বলল। দাঁড়াল। ঘাড় ফিরিয়ে কি বলল। মাথা নাড়ল দোকানদার। ও এবার বেরোবে।
-ওমা, চিনুদা!
-আরে, তুমি এখানে কি কচ্ছ, জুতো কিনতে এসেছ?
-হ্যাঁ। বডড দাম। আপনি?
-আমিও। বডড দাম!
-চলুন, না, সস্তায় কোথাও থেকে কেনা যাক।
-চল।
দু’চারটে দোকানের শো-কেস দেখার পরই এদিকের জুতোর দোকান শেষ হয়ে গেল।
-চলুন, ও ফুটে যাই।
-ও ফুটে! আমি ঘুরে এসেছি, ভীষণ দাম।
-আপনি কি কিনবেন?
-আট-দশ টাকার মধ্যে যা হয়।
-আমিও তো তাই কিনব! পুজোর সময় কি এরা দাম বাড়ায়? এইটে কিনেছিলুম ন’ টাকায় আর ঠিক এই জিনিসই চাইল সাড়ে দশ!
চিনু কথা না বলে শুধু তাকিয়ে রইল। কাবেরী এধার ওধার তাকাচ্ছে। ঘষে ঘষে ঘাড়ের ময়লা তুলছে। দু একজন ওদের লক্ষ্য করে গেল। শুধুই পাশ দিয়ে চলে গেল।
-চলুন দাঁড়িয়ে আর কি হবে। আপনি কোন দিকে যাবেন?
-কোন ঠিক নেই। এগারোটার আগে তো বাড়ি ঢুকি না। তুমি কোন দিকে এখন, বাড়ি?
-বারে, বাড়ি কেন, হোস্টেল!
-হোস্টেল!
-হ্যাঁ, দিদি বলেনি?
-না’তো।
-আমি তো নার্সেস ট্রেনিংয়ে আছি।
-পড়াশুনো?
-আই-এ ফেল করেই ছেড়ে দিয়েছি। ঘরে বসে গুরুজনদের দুশ্চিন্তা আর কেন বাড়াই, তাই দুগগা ব’লে লেগে পড়লুম তো এখন।
-কি করে তুমি বুঝলে যে বিয়ের বাজারে তোমার দাম নেই?
-জানা আছে।
খোঁপার কাঁটায় চাপ দিতে দিতে ঘাড়টা কাত করে হাসল কাবেরী। হাসিটা অচেনা মনে হল চিনুর।
-বড় চা খেতে ইচ্ছে করছে।
চায়ের দোকানের খোঁজে এধার-ওধার তাকাল কাবেরী। ভয় ধরল চিনুর। বন্ধুরা যদি কেউ তাদের দুজনকে চা খেতে দেখে, তাহলে নিজেদের মধ্যে খিস্তির ঝড় বয়ে যাবে। বহুদিন নিজেকে এক মিথ্যা অশ্লীল গল্পের নায়ক হতে হবে। এখন যদি কেউ দেখে তবু বলা যাবে-দূর সম্পর্কের এক বোন, হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। অবশ্য এক সঙ্গে বসে চা খেলেও ওই একই সাফাই দেওয়া যায়।
কিন্তু তার থেকেও বড় ভয় চায়ের দামটা কে দেবে! নিশ্চয় আমাকেই দিতে হবে। তাই দেওয়া উচিত। কাছে পয়সা নেই বলা যাবে না। খালি পকেটে কি কেউ জুতো কিনতে আসে!
কি দরকার ছিল মিথ্যা বলার। ইচ্ছা ছিল না তবু মুখে এসে গেছল। ঘাবড়ে গেছলুম কেমন যেন। হঠাৎই দেখা হয়ে গেল, কোন যোগসাজস ছিল না। তবু মনে হল, কাবেরী হয়ত ভাবতে পারে এটা হঠাৎ নয়। তাই কৈফিয়ত একটা মুখে এসে গেল। অমনি অমনি কৈফিয়ত আসে না নিশ্চয়। ওর সম্পর্কে কি আমি অন্যায় চিন্তা করেছি কখনো? ওর শরীরটা ভাল। ওর শরীর নিয়ে চিন্তা করেছি। কুৎসিত চিন্তা। অমন চিন্তা তো পথে-ঘাটে কতবার মনে হয়েছে। আবার মন পরিষ্কার হয়ে গেছে। কাবেরী সম্পর্কে তা হয়নি। শরীর ছাপিয়েও আরো বেশি কিছু গুণ ওর মধ্যে আছে। দেখতে মোটেই সুন্দরী নয়, তবু সব জড়িয়ে ও যেন কেমন। কিন্তু তাই বলে ওকে ভয় করব কেন! আমি কি কিছু অপরাধ করেছি? কাবেরীকে চিন্তা করার অধিকার নেই, ও আমার কেউ নয়, ওর সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা হবার কোন সুযোগ নেই, হলেও সেটা বৈধ ব’লে চালু-সমাজ-নীতি গণ্য করবে না। সমাজে বাস করি, ছোট থেকেই এই নীতির আওতায় বড় হয়েছি, অথচ গোপনে তাকে অস্বীকার করেছি। আমি অপরাধ করেছি। আমি অপরাধী সমাজের কাছে না কাবেরীর কাছে? সমাজকে দেখতে পাই না, কাবেরীকে পাই। তাই কি ওকে দেখেই মিথ্যা বললাম! কাবেরী কি সমাজ? গোটা না হলেও অংশ তো বটে। একটা মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করা মানেই কি সমাজকে ছুঁয়ে থাকা? কাবেরীকে ভয় ক’রে কি আমি সমাজকেই ভয় করলুম? এমনি করে রোজই তো কত সামাজিক নীতিকে গোপনে অস্বীকার করছি। তার মানে অপরাধ করছি। অপরাধ-বোধের বোঝা মনের মধ্যে ঢিপি হয়ে উঠছে। মনের সুন্দর বৃত্তিগুলো চাপা পড়ছে, ধুঁকছে, মরে যাচ্ছে। এর থেকে উদ্ধার কোথায়। চিন্তাকে আমি ঠেকাবো কি করে। নীতিবোধ যদি না পাল্টায় তাহলে আমার সঙ্গে সমাজের ঠোকাঠুকি চলবেই। কিছুর সঙ্গেই নিজেকে মেলাতে পারব না। তার মানে কি চিরকালই যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
-কি হ’ল, বলছি না চলুন!
-কোথায় যাবে?
-চায়ের দোকানে।
-চল।
খুঁজতে খুঁজতে একটা চায়ের দোকান পেয়ে গেল। দোকানটা ওদের জন্য মোটেই তৈরী ছিল না। চমক খেয়ে একটা টেবিল খালি হয়ে গেল। বাচ্ছাটার নড়াচাড়ায় অনেকখানি ছেলেমানুষি ভাব এল। চেয়ার থেকে পা নামিয়ে কাপড়টা টেনে দিল ক্যাশ-বাক্সের লোকটা। ছাড়া ছাড়া কথা শুরু হল বাকি দুটো টেবিলে।
-কি আছে কি?
-চা, টোস, মামলেট, বিসকুট।
-আর?
-আর কিছু নেই।
-কি খাবেন?
-কিছু না, শুধু চা।
-খান না।
-না।
বাচ্ছাটা তবু কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চিনুর বিশ্রী লাগল দোকানটা। ঘিঞ্জি, নোংরা। না ঢুকলেই হোত। বেরিয়ে যাবার পর লোকগুলো নিশ্চয় নোংরা আলোচনা শুরু করবে। চা’টাও বিচ্ছিরি। এখানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, অসুখ-বিসুখ আর জিনিসপত্রের দাম বাড়ার মত, নিরীহ বিষয় ছাড়া, অন্য বিষয়ে মুখ খুলতে পারে না।
মুখ বুজে চা খেল দুজনে। কথা হয়েছিল বাড়িতে কে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করে। খাওয়া শেষ হতেই একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে কাবেরী দাম চোকাল। তার ধারণা হয়তো চিনুই দামটা দিয়ে দেবে। যেন আহত হয়েছে এমন একটা মুখের ভাব করল চিনু।
-কোনদিকে যাবেন?
-তুমি কোন দিকে?
-ঠিক নেই, যেদিকে হয়।
-ফেরার কোন নিয়ম নেই!
-আছে। সাড়ে ন’টার পর সই করে ঢুকতে হয়।
-এখন কটা?
-য’টাই হোক না। আপনার তো তাড়া নেই, চলুন না বেড়াই। সারাদিনে যা খাটুনি আর কিছু ভাল লাগে না।
মুখের দিকে তাকাল চিনু। চান করা তাজা মুখ। বোঝা যায় না যে শরীরের ওপর দিয়ে খুব খাটুনি গেছে।
-কি ভিড় দেখেছেন রাস্তায়।
-হ্যাঁ পুজো এসেছে তো!
-শুধু পুজো নয়, সব সময়েই এমন ভিড়।
-হ্যাঁ।
-একটু বসার জায়গা পর্যন্ত কোথাও নেই।
-কোলকাতাটা বিশ্রী হয়ে উঠেছে।
-গোলদীঘিতে যাবেন?
-চল।
কড়কড়ে মাড় দেওয়া ধুতি পাঞ্জাবি পরলে এমন অবস্থা হয়। কাপড়গুলো ফুলে ফেঁপে থাকে, গায়ে লাগে না। মনে হয় শরীরটা আ-ঢাকা। অস্বস্তি হয় খুব। তেমনি অস্বস্তি লাগছে এখন। সম্পর্কটা শুধু আলাপের। বিশেষ কোন কাজেও আমি যাচ্ছি না। ও ডাকল, আমি না বললুম না। তবু অস্বস্তি! ওকে দেখে মনে হয় খুশি হয়েছে। আমারও খুশি হবার কথা। হচ্ছি না। গোলদীঘিতে গিয়ে যদি বসি তা হলে কথা হবে আমাদের। কাজ-কর্ম, সাহিত্য, বন্ধুবান্ধব, রাজনীতি? ওসব ভাল লাগে না। তা হলে আর কি বলার থাকে।
-আপনি এখন কি কচ্ছেন?
-আগের মতই আছি।
-চাকরি পাননি!
ওরা দুজন কথা না বলে হাঁটল কিছুটা।
-বি-এ পরীক্ষাটা তো দিতে পারতেন।
চিনু কথা বলল না। আরো কিছুটা হাঁটল দুজনে।
-আপনার একখানা বই আমার কাছে আছে।
-থাক। আমার আর দরকার নেই।
-ডিউটির পর যে সময়টা থাকে তাতে বাড়ি যাওয়া যায় না। যেতে ইচ্ছেও করে না। সংসার সেই একই ধরনের রয়ে গেছে। একটুও বদলায়নি। বাড়ি গেলেই আরো ক্লান্ত লাগে।
কাবেরীর গলার স্বরে চিনু বুঝল সত্যিই ওকে খাটতে হয়।
-তোমার আগে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ছিল না?
হাসল কাবেরী। ব্লাউসের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা ব্যাগ বার করে দেখাল।
-ওসব বাতিল করে দিয়েছি।
চিনু এবার লক্ষ্য করল, সাজগোজ বদলে গেছে কাবেরীর।
-তুমি বদলে গেছ।
-বদলাবো না?
পাল্টা প্রশ্ন করল কাবেরী। অবশ্য উত্তরটাও তারই দেবার কথা ছিল না। গোলদীঘি এসে গেছে।
-চিনেবাদাম খেতে কিন্তু বেশ লাগে।
-আমার একটুও ভাল লাগে না। একটা একটা করে ভেঙে খাওয়ার ধৈর্য আমার নেই।
-ছাড়ানোও পাওয়া যায়।
-না থাক। তুমি যদি খেতে চাও খেতে পার, আমি খাব না।
বাদাম না কিনে ওরা গোলদীঘিতে ঢুকল। একটা বেঞ্চও খালি নেই। ঘাসের ওপর এমনভাবে লোক বসেছে যে নীচু সুরে ছাড়া কথা বলা যাবে না।
-কোলকাতাটা বিশ্রী হয়ে উঠেছে।
-হ্যাঁ, একটুও বসার জায়গা নেই। চলুন আমাদের ওখানে।
-কোথায়, তোমাদের হোস্টেলে!
-হ্যাঁ, বসার জায়গা আছে।
হাসপাতালের বড় গেট ছাড়িয়ে মিনিট দুই তিন হাঁটার পর কাবেরী বললঃ
-ওই আমাদের হোস্টেল।
চার তলা বাড়ি। তিন তলাতেও বারান্দা আছে। চার তলায় নেই। মনে হয় ওটা নতুন হয়েছে। বাঁদিকের বাড়ির ছাঁচটা অন্য ধরনের। বোধহয় পরে তৈরী করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
-চার তলায় থাকি। ওই জানলাটা আমাদের ঘরের।
হারমোনিয়াম বাজিয়ে কে গান করছে। চিনু শুনল। সুর শুনে বোঝা যাচ্ছিল না। কানে এল ‘মহাবিশ্ব’ আর ‘করুণা’ শব্দ দুটো। আঁচ করল রবীন্দ্রসঙ্গীত।
-ওই বাড়িটা কিসের?
-ডেলিভারি কেস ওখানে হয়। মাঝখানটায় নার্সারি। দোতলায় অপারেশন হয়।
-ওরা কোথায় যাচ্ছে?
সাদা পোশাকে গুটি পাঁচ-ছয় মেয়ে গল্প করতে চলেছে।
-ডিউটিতে যাচ্ছে।
একটা ট্যাক্সি এসে থামল। জমকালো শাড়ি পরা একটি মেয়ে নামল, সঙ্গে পুরুষ।
-ও কে?
-প্রতিভাদি। হালে বিয়ে হয়েছে। রেজিস্ট্রি।
-ওরা কারা।
এক টুকরো মাঠের দিকে তাকিয়ে চিনু বলল। কয়েক জোড়া মেয়েপুরুষ বসে। মাঠটা আবছা। হোস্টেলের দেয়ালে একটা আলো আছে। তবে মাঠের অন্ধকার ভাঙার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
-চলুন ওখানে বসি।
-ওরা কারা?
কথা না বলে কাবেরী এগিয়ে গেল। চিনু পিছু নিল। হোস্টেল থেকে হাসপাতালে যাবার পথটা টালি দিয়ে ঢাকা। তার গায়েই এই মাঠটা। মাঠের সামনে রেলিঙ। মাঝখানে দুটো ছোট্ট গাছের ঝোপ। অন্ধকারে গাছ চেনা যায় না। আলো থাকলেও চিনু গাছ চিনত না।
-কি বলছিলেন?
-কিছু না।
ঘাসের ওপর মুখোমুখি বসল দুজনে। অবাক লাগছে চিনুর। এমন একটা জায়গাও তা হলে আছে। মেয়ে-পুরুষ জোড়ায় বসে গল্প করছে। নিজেদের নিয়েই সবাই ব্যস্ত। অন্যের সম্পর্কে অসভ্য কৌতূহল নেই। কাবেরীর মত এরাও সারাদিন খেটে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এখন দু’দণ্ড জুড়িয়ে নিচ্ছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিনু তাকাচ্ছে। কাবেরী দেখছে চিনুর ভাবভঙ্গী। দূরের একটা ওয়ার্ড থেকে মেয়ে গলায় কে চীৎকার শুরু করেছে।
-ওখানে কী হচ্ছে!
-হয়তো কোন পেসেণ্ট। ও রকম প্রায়ই হয়।
চিনু এখানে নতুন, তাই উত্তেজিত হয়ে উঠল সহজেই। চীৎকারটা এখনো চলছে। মাঠের অন্য মানুষরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না। সকলেই ব্যস্ত। অন্যদিকে কান দেবার ফুরসত নেই।
এখানকার মানুষগুলো কি নিষ্ঠুর? এই বীভৎস চীৎকারে কেউই চঞ্চল হ’ল না। অথচ আমি হচ্ছি। নাকি আমার কোন উদ্দেশ্য নেই বলেই চট করে বাইরের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে পড়ছি। এখানে যারা আছে তারা কেউই দরকার ছাড়া বসেনি। এ দরকারটা হাঁফ ছাড়ার জন্য। যতটুকু পারা যায়, সারাদিনের একঘেয়ে কষ্টের হাত থেকে কিছুটা বৈচিত্র্য ছিনিয়ে নিতে সবাই ব্যস্ত। চীৎকারে কে কান দেবে? অথচ হয়তো, ওখানে একটা মানুষ মারা যাচ্ছে।
-চুপ করে আছেন যে!
-কি বলব।
-যা হোক। ভাল লাগে না চুপ করে থাকতে। যাহোক কিছু বলুন।
চিনু ঘাড় নামিয়ে কয়েক মুঠো ঘাস ছিঁড়ল। বলার মত একটা কথাও মুখে আসছে না।
-মালা নেবেন দিদি।
গামছায় তৈরী থলে হাতে, পাশে দাঁড়িয়েছে এক বিধবা।
-নিন দিদি একজোড়া। চার পয়সা ক’রে।
চিনুর দিকে তাকালও না। এখানকার মেয়েদের ও বোঝে। ফুল বড় নরম জিনিস। দু’দণ্ড জিরোবার জন্য যে মেয়েরা মাঠে এসেছে, তাদের কাছে এখন ফুল ভাল লাগবে।
দু’ছড়া রজনীগন্ধার মালা কাবেরীর সামনে ধ’রল। সরু সরু মালা। ওর দাম চার পয়সা হওয়া উচিত নয়।
দু’আনা দিয়ে মালা কিনল কাবেরী।
-হঠাৎ কিনলে যে!
-এমনি।
-বড্ড দাম।
-হোক। গরীব মানুষ!
লজ্জা পেল চিনু। কাবেরী রোজগার করে। ওর সঙ্গে মনের তফাত হবেই।
মালাজোড়া দুজনের মাঝখানে, ঘাসের ওপর রাখল কাবেরী। ফুল বড় নরম জিনিস।
কাকে দেখে, ‘আসছি’ বলে কাবেরী উঠে গেল। হেসে মহিলাটি কথা বললেন। তাকালেন কয়েকবার মাঠের দিকে। ফিরে এল কাবেরী।
-আমাদের স্টাফ, অনিমা-দি। বাড়ি থেকে ফিরলেন। বেশ লোক।
-মনে হ’ল যেন আমার সম্বন্ধে কথা হ’ল।
-হ্যাঁ, জিগ্যেস করলেন কার সঙ্গে কথা বলছি।
-কি বললে?
-বললুম আমার ভিজিটার।
-ভিজিটার কি?
-বাঃ যারা দেখা করতে আসে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব তারাই ভিজিটার।
-বাড়ি থেকে কেউ আসে না?
-না, দরকার কি। আমিই তো বাড়ি যাই।
মালা দু’টো আঙুলে জড়াতে লাগল কাবেরী। দুটি ছেলেমেয়ে রেলিঙের ওপর এসে বসল। হোস্টেলের দোতলার বারান্দার হঠাৎ ক’টি মেয়ে, হৈ চৈ করে কি একটা কাড়াকাড়ি করতে করতে আবার ঘরে ঢুকে গেল। এ্যাম্বুলেন্সের হেডলাইটের আলো মাঠটাকে ঝলসে দিয়ে ঘুরে গেল। টালির শেডের নিচে অনেকক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি মাথা নিচু করে হোস্টেলের দিকে চলে গেল। মুঠো-মুঠো ঘাস ছিঁড়ল চিনু।
-তাহ’লে তোমার কোন ভিজিটার নেই।
-না। আমার কোন ভিজিটার নেই।
হাতে মালা জড়ান বন্ধ করল চিনু। মুখ তুলে তাকাল সে আকাশের দিকে। কলকাতার সব আলোর ছাট গিয়ে লেগেছে আকাশে। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ মিলেমিশে কোথাও চলেছে। মেঘের গায়ে ধাক্কা খেয়ে কলকাতার সব আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। আকাশটা কুচকুচে। আকাশটা এখন নরম নরম। আকাশটা এখন গভীর গভীর। আকাশটা এখন মস্ত বড়। আগাগোড়া দেখা যাচ্ছে না। তবু বোঝা যাচ্ছে ওটা বিরাট।
কাবেরীর হাতে ফুল। ফুল নরম। কাবেরী নরম। ওর থুতনি পায়রার মাথার মত। ওর ঘাড়ের বাঁকান ছাঁদটা কচি শশার মত। ওর গোড়ালি বাছুরের নাকের মত। ওর চুল মাকড়সার ঘন জালের মত।
ঘাড়ে একটা ব্যথা করছে। আঙুলগুলো শক্ত হয়ে বেঁকে যাচ্ছে। গলার কাছে বাতাস জমেছে। সারা শরীরে নতুন ব্লেডে দাড়ি কামাবার আমেজ লাগছে। এখন আমি কাবেরীকে কি কথা বলব!
-তোমার খাওয়া হয়েছে?
-হ্যাঁ।
-কি খেয়েছ?
-এখানে যা দেয়।
-তুমি রোগা হয়ে গেছ।
এখন আমি কাবেরীকে কি বলব!
-তোমার সঙ্গে কি অদ্ভুতভাবে দেখা হল। ভাবতেও পারিনি। একদিন তোমার কলেজে গেছলুম, খুঁজতে।
-কবে!
-অনেকদিন হ’য়ে গেল।
-বাড়ি গেলেন না কেন?
আর কি বলব কাবেরীকে।
-আজ আমি জুতো কিনব বলে যাইনি। এমনি দর কচ্ছিলুম।
-কেনা তো দরকার।
-হ্যাঁ।
-জামাটাও ছিঁড়ে গেছে।
-হ্যাঁ। একটা কিনবো। পুজো না গেলে কাপড়ের দাম কমবে না।
-হ্যাঁ।
-ডিউটির পর কি তুমি একলা ঘুরে বেড়াও?
-হ্যাঁ।
ঝমঝম করে কোথায় ভারি কড়া নাড়ার শব্দ হল। উঠে দাঁড়াল কাবেরী।
-এবার চলি।
-যাবার সময় হল?
-আমাদের আর বাইরে থাকার নিয়ম নেই।
-আচ্ছা যাও।
-ওই পর্যন্ত চলুন।
হোস্টেলের দরজার কাছে এসে ওরা দাঁড়াল। আরো অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা যেন এখনো ফুরোয় নি।
-আসবেন না আর?
-আসবো। তোমার কি রোজ এই সময় ছুটি থাকে।
-না, তবে কাল ছুটি আছে।
-আসবো। আজ চলি।
-এটা নিয়ে যান।
একটা মালা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে এগিয়ে ধরল কাবেরী। চারপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকাল চিনু। কেউ জানে না কি আছে ওর মুঠোতে। চিনু হাত বাড়িয়ে দিল।
ভারী লাগছে। গোটা শরীরটা টলমল করছে। পা পড়ছে না ঠিকমত। আমি ফিরছি। আমার ফেরার একটা অর্থ আছে। কিছু একটা করে ফিরছি। আমি কি করলুম! কি উদ্দেশ্য পূর্ণ হল? এতে সংসারের কতটা লাভ হবে? চুলোয় যাক লাভ লোকসান।
আকাশে একটা আলো। কলকাতার সব আলো। কলকাতাটা ভীষণ সুন্দর। মানুষ কেন এই সময় আকাশের দিকে তাকায় না। উচিত। অমল ঠিকই বলেছিল, প্রত্যেক মানুষ যেন আকাশের কথা ভাবে। নরম নরম। গভীর গভীর। মস্ত বড়। বিরাট। আকাশকে দেখলে শ্রদ্ধা হয়। আকাশকে দেখলে বিশ্বাস হয়। আকাশের দিকে তাকাবো।
এখন কোথায় যাই! পয়সা নেই, হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়ি অনেক দূর। কটা বাজে? যটাই বাজুক। আজ তাড়াতাড়ি ফিরব। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোব। কিন্তু তার আগে সেই লোকটার কাছে যেতে হবে। ও চেষ্টা করলেই কণ্ডাক্টারীর চাকরিটা হয়ে যাবে। এত রাতে গেলে কি রাগ করবে? করুক, গরজ আমার। কাবেরী বলল, বি-এ পরীক্ষাটা দিতে পারতেন। মাসকয়েক যদি খাটি তা হ’লে পাশ করে যাব। কাবেরীও খাটে। আহ কি সুন্দর এই দোতলা বাসগুলো!
.মাধবী বিছানা ছেড়ে উঠল। আজ অন্যদিনের থেকে শিগগির চিনু বাড়ি ফিরেছে। ভাত খেয়ে আবার বেরিয়েছে। সানু এখন ঘুমে কাদা। রমা সিনেমা দেখে ফেরেনি।
দিনেশের বিছানার ধারে মাধবী দাঁড়াল। দিনেশ এখনো ঘুমোয় নি।
-শরীর ক্লান্ত লাগছে বলছিলে কেন?
-বললুম না গঙ্গায় চান করেছি!
-হঠাৎ চান করতে গেলে কেন! এ বয়সে কি অনিয়ম সহ্য হয়?
-ইচ্ছে হ’ল কেমন যেন।
বিছানায় সরে গেল দিনেশ, মাধবীকে বসবার জায়গা করে দেবার জন্য।
-তারপর যদি অসুখ-বিসুখ হয়?
-হবে না। অনেকদিন সাঁতার কাটি না, আজ কাটলুম।
-কেমন লাগল?
-আমার বয়স বেড়েছে মাধু। আমি বুড়ো হয়ে গেছি।
অন্ধকার ঘরটা যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেল দিনেশের গলার স্বরে। মাধবী ওর পায়ের ওপর হাত রাখল। জোয়ান বয়সে দিনেশ মাধু ব’লে ডাকত।
-চেষ্টা করলুম সাঁতরাতে আগের মতন। পারলুম না। ভেসে রইলুম। ভাসতে ভাসতে অনেকদূর গেলুম, তারপর খেয়াল হ’ল বাড়ি ফিরতে হবে।
-তাই বুঝি জল থেকে উঠলে!
-হ্যাঁ, এ বয়সে আর ভাসা যায় না। তাছাড়া রাতও হয়ে গেছে। অন্ধকারে কোথায় ধাক্কা খাব শেষকালে। তাই ডাঙ্গায় উঠে পড়লুম।
-ভালই করেছ।
খসখস শব্দ হল। দিনেশের পায়ের চেটোয় মাধবী হাত বোলাচ্ছে। শব্দটা অন্ধকারকে চষে নরম করে দিচ্ছে। নরম অন্ধকারে দিনেশ টান টান ক’রে পা ছড়িয়ে দিল।
-ওই গঙ্গাতেই বনমালী ডুবে মরেছিল। অথচ কি আশ্চর্য দেখ যতক্ষণ জলে ছিলুম, সে কথাটা মনে পড়েনি।
-তাই তো নিয়ম। ছেলেমেয়েরা এ সংসারে ক’ত বুড়ো-বুড়ী দেখছে। তাই বলে কি তারা বয়সের কথা ভাবে!
-মাধু, ভাল করে উঠে বোস।
সরে গেল দিনেশ। দু’পা তুলে মাধবী বিছানায় গুছিয়ে বসল। দিনেশের পিঠে হাত রাখল।
-সেই কাটা দাগটা এখনো রয়েছে।
-আছে! কি করে বুঝলে?
-এই তো জায়গাটা কেমন তেলা।
মাধবী হাত বুলোল। শব্দ হল না। অন্ধকার জমাট বেঁধে রইল ওদের আশেপাশে।
-আমার খেয়াল ছিল না।
-আমারও।
-ও জায়গাটা আর তেলা থাকবে না। চামড়া ক্রমশই কুঁকড়ে আসছে।
-হ্যাঁ, বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। আমরা দুজনেই হয়ে যাচ্ছি।
-হ্যাঁ, আমরা দুজনেই।
ঘরটা বড় হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার টানটান হয়ে উঠেছে। কাঁপছে।
-ছেলেমেয়েরা কি আমাদের কথা ভাবে?
দিনেশ চেপে ধরল মাধবীর আঙুল কটা। আঙুল কাঁপছে।
-জানি না।
-কেন, তুমিই তো বললে, এইটেই নিয়ম।
-অন্য কথা বলো।
-সেই ভাল। নিয়ম আমরা পালটাতে পারি না। অনেক জিনিস পালটান যায় না। আমাদের কথা মনে আছে?
-আছে।
মাধবী কাত হয়ে দিনেশের পাশে শুয়ে পড়ল। ওর মাথায় গাল রাখল দিনেশ। গালে হাত রাখল মাধবী।
-তুমি দাড়ি কামাও নি।
-ছেলেমেয়েরা এখুনি ফিরবে।
-উঠে যাব?
-না না, আর একটু থাকো।
মাধবীর চুলে দিনেশ হাত বোলায়। শরীরটাকে আলগা ক’রে মাধবী শুয়ে তাকে। নিঃশ্বাস ফেলে দুজনেই জোরে জোরে। হঠাৎ একটা আরশুলা উড়ে আসে মাধবীর গায়ে। ধড়মড় ক’রে ওঠে সে।
-উঠো না। পরে মেরো’খন।
-তুমি ঘুমোতে পারবে না। তোমার ঘুম দরকার। নয়তো শরীর ম্যাজম্যাজ করবে, এতদিনের অনভ্যাস।
-পুরনো অভ্যাস কিছু কিছু আবার ঝালাই করা দরকার। পইতে পুড়িয়ে ভগবান হয়ে বসে থাকলে আর চলবে না। অফিসে কথা উঠেছে, ছাঁটাই হবে।
-তোমাকেও করবে?
-জানি না। অনেক পুরনো লোকওতো ছাঁটাই হয়।
-কি করবে?
-কি জানি। বুঝতে পারি না কি করব। দিনকালতো আগের মত নেই। ছেলে-ছোকরারা যা করবে, তাই করব। ওরা আমাদের থেকে বেশি বোঝে।
-হ্যাঁ, অনেক জিনিস আমরা এখনো বুঝি না।
-ওরাও এখনো অনেক কিছু বোঝে না। বয়স হলে বুঝবে।
-বয়স হলে অনেক কিছু লাভ হয়। আবার খোয়াও যায়।
-চিনু না বুঝে নিজেকে নষ্ট করছে।
-ওদের কথা ভাবলে ভয় করে।
-আমরা শুধু ভাবনা নিয়েই বেঁচে থাকব।
ঘরটা বড় হয়ে গেছে। অন্ধকারগুলো থিতিয়ে নেমে এসেছে। কড়ি-বরগার ঢাকনাটা খুলে যেন আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশ তারায় ভরতি। তারার আলোয় ওরা দুজন শুয়ে আছে। ওদের নিঃশ্বাসে কাঁপছে তারাগুলো।
-আমাদের আর বাড়ি করা হ’ল না।
-আর আমরা পারব না।
-ছেলেরা করবে।
-আজকাল গ্রামে খুব দুর্ভিক্ষ হচ্ছে। মানুষ মরছে।
-আমি গ্রাম দেখিনি। কলকাতার বাইরেও যাইনি।
-আমাদের আর কোথাও যাবার উপায় নেই।
কড়া নাড়ার শব্দ হ’ল। ওরা কথা থামাল। কড়ি-বরগার ঢাকনাটা নেমে এল। দু’ফোঁটা আলোর বিন্দুর মত ওরা স্থির হয়ে রইল। আবার কড়া নাড়ল।
-বোধ হয় রমা এসেছে।
-তুমি এবার শুয়ে পড়।
-তুমি আর জেগে থেকো না।
-না। তুমিও।
-হ্যাঁ, আমিও।
.চান করার পর সামান্য হাওয়াও গায়ে লাগলে হালকা লাগে নিজেকে। ফুটের ওপর পায়চারি করছে চিনু। রাত করে বাড়ি ফিরে খেয়েই ঘুম। ঘুমোলেই রাত কাবার। কিন্তু ঘুম আসার আগে পর্যন্ত সারাদিনের ঘাম আর ময়লায় চটচটে শরীরটাকে নিয়ে অস্বস্তি ভোগ করতে হয়। আজ চান করেছি। সকাল সকাল খেয়েছি। খাওয়ার পর পায়চারি করছি। নিজেকে হালকা লাগছে। অন্যদিনের থেকে আলাদা লাগছে। স্নায়ুগুলো ঢিলে হয়ে গেছে।
ফুটপাথে সারি দিয়ে ঘুমোচ্ছে অনেকগুলো মানুষ। দুধারে দুটো সারি। মাঝখানে চলবার পথ। চলতে গিয়ে একজনের পায়ে চিনুর পা বেধে গেল। লোকটার ঘুম তাতে একটুও চটকাল না।
সাবধানে হাঁটল চিনু। দাঁড়িয়ে মাথাগুলো গুনল; দু’সারিতে ত্রিশের কাছাকাছি। খালি গা, জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে। দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। লোকগুলো অবাঙালী। কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। গতর খাটিয়ে রোজগার করে। রাস্তায় ঘুমোয়।
একটা মিষ্টির দোকান। দোকান বন্ধ হবে তাই ধোয়া মোছা চলছে। ফুটপাথে জল গড়াচ্ছে। পাশে পানের দোকান। খোলা। আবার ঘুমন্ত মানুষের সারি। চিনুর মনে পড়ল এইখানে সে দাঁড়িয়েছিল বুলগানিন খ্রুশেভকে দেখার জন্য। এ রাস্তা দিয়ে যাবার কথা থাকলেও সেদিন ওরা যায়নি। কয়েকঘণ্টা মিছিমিছি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ও পারের বাড়িটার বারান্দায় তিনটে মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। খুব সাজগোজ করা। তিন বোন মনে হয়েছিল। কিছুদিন আগে শোনা গেল-ওরা একসঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বোম্বে থেকে পুলিশ ওদের ধরে আনে। কালকেও ওদের দেখেছি সাজগোজ করে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল।
চিনু আর একটু এগোল। মানুষের সারি এখানে শেষ হয়েছে। খাটিয়া পেতে ঘুমোচ্ছে একজন। কোলে একটা বাচ্ছা। গোটা দশেক ছাগলও ঘুমোচ্ছে খাটিয়ার ধারে।
একটা রিকশা থামল। সওয়ারি মাতাল। রিকশাওলা সন্দেহ করছে, লোকটার কাছে যত পয়সা আছে তা দিয়ে ভাড়া দেবার সামর্থ্য হয়ত হবে না। বিড়বিড় করে কি বলে লোকটা নেমে পড়ল। পকেট থেকে একমুঠো রেজগি বার করে রিকশাওলার হাতে দিয়ে, কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল। পয়সাগুলো গুনে পেট কাপড়ে বাঁধতে বাঁধতে চিনুকে দেখে শুধু শুধুই রিকশাওলা হাসল।
-আস্তে ভাই।
ঝাঁটা চালান থামাল মিষ্টির দোকানের ছোকরাটা। রাস্তায় নেমে ফুটপাথটাকে এড়িয়ে গেল চিনু।
কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করতে হয়েছিল ওকে। তাতেই মুখে বিরক্তির দাগ তুলেছিল। বোধহয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে, তাই একটু তরও সইছিল না। আমার উচিত হয়নি একটুর জন্যও ওর কাজ থামান।
-ওম্মা, চিনুদা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাকে খুঁজছেন?
চমকে উঠল চিনু। সিনেমা দেখে ওরা ফিরছে। রাস্তাটা পরিষ্কার। দূর থেকেই দেখা যায় কেউ হেঁটে এলো। অথচ সে দেখতে পায়নি।
-তোমাদের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে ভাবলুম যাই খোঁজ করি।
-তাই বুঝি এখানে দাঁড়িয়ে আকাশে আমাদের খুঁজছেন। খুব বাবা দরদ দেখালেন। ভয় নেই আপনার বোনকে নিয়ে পালাব না। এই নিন।
রমাকে ঠেলা দিল আভা। সুবল হেসে উঠল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে আভার ভাইবোনেদের। ওরা হাঁটতে শুরু করল।
-চিনুদাকে বলেছিলুম আমাদের ওখানে যেতে, তা বুঝি আর মনে নেই। থাকবে কি করে? বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা তাদের ফেলে কি আর আমাদের কথা মনে থাকে।
-বা রে, যার বাড়ি, যে কত্তা সে যদি না বলে তাহলে যাব কেন?
-আর গিন্নী বললেই যত দোষ। ওগো একবার যেতে বলতো। দেখি কেমন যায়।
-নিশ্চয় আসবেন।
-আর রমাকেও সঙ্গে করে আনবেন।
-আনবো।
সুবল বা আভা লেখাপড়া করে না। ওরা যা বলে তা অন্তর থেকে বলে। অন্তরের কথা শোনা মহাপুণ্য। এতদিন এমন কথা শুনিনি। মন স্নিগ্ধ হচ্ছে। আমি বললুম, ওদের বাড়ি যাব। এটাও আমার অন্তরের কথা। অন্তরের কথা বলাও মহাপুণ্য। ওরা আমার পুণ্য সঞ্চয়ের কারণ। ওরা মনের গ্লানি ধুইয়ে দেয়।
আভাদের বাড়ি আগে পড়ে। ওরা বাড়ি ঢুকে গেল। চিনু আর রমা নিজেদের পথ ধরল।
-কেমন দেখলি।
-ভাল।
রমা আড়ষ্ট হয়ে উত্তর দিল। চিনুর এ ধরনের প্রশ্নে সে অভ্যস্ত নয়।
-যাবার সময়ও কি হেঁটে গেছলি?
-না, ট্যাক্সিতে।
-হেঁটেই যেতে পারতিস। মিছিমিছি কতকগুলো টাকা নষ্ট হল।
-আমিতো বলেছিলুম। আভা শুনল না।
-খোঁড়াচ্ছিস কেন?
-জুতোটা ছোট হয়ে গেছে।
-জুতো কখনো ছোট হয়! হাঁটার অব্যেস নেই বলে এমন হয়েছে। বেরোতে পারিস তো। রোজ একবার পার্কটায় অন্তত চক্কোর দিয়ে আসবি।
বাড়িতে ওরা ঢুকল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রকটা এক জায়গায় গর্ত হয়ে গেছে। রমাকে হাতে ধ’রে জায়গাটা পার করে দিল চিনু।
-আজ কাবেরীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
-ও অনেকদিন আসে না।
-নার্স হবে বলে ট্রেনিং নিচ্ছে। হোস্টেলেই থাকে। তোকে একদিন নিয়ে যাব ওর কাছে।
এরপর কড়া নাড়ল চিনু।
ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ, উঠছে পড়ছে। ঘরের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এ বাড়ির সব ঘরের সব মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। গোটা বাড়িটাই ভারী ঠেকছে।
চুড়িকটা কনুইয়ের দিকে চেপে বসিয়ে পা-টিপে ঘর থেকে রমা বেরোল। দালানে দাঁড়িয়ে চোখে অন্ধকার সইয়ে দরজার খিল খুলল। সিঁড়িগুলো মুখস্থ। বিশ্বর ঘরের জানলায় পৌঁছল নিঃশ্বাস বন্ধ ক’রে।
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি একটিপ আগুন জ্বলছে। এক একবার উসকে উঠেই বাসি রক্তের ছোপ ধরেছে। এ ঘরে বিশ্ব ছাড়া কেউ শোয় না। জানলায় হাত রেখে শব্দ করল রমা। কাঠের ওপর দিয়ে আরশুলা চলে বেড়ালে যতটুকু শব্দ হয়।
আগুনটা কিছুক্ষণ একভাবে রইল। নিভে গেল। সামান্য খসখস। জানলা জুড়ে বিশ্বর ছায়া পড়ল।
-এত রাত্রে, কি ব্যাপার!
-কিছু না, এমনি। ঘুম আসছে না।
-তাই ব’লে ওপরে কেন!
-ইচ্ছে হ’ল।
-নিজের ইচ্ছেমত সবসময় চলা যায় না। এখন যদি কেউ দেখে ফেলে?
-ফেলে ফেলবে। আমি বুঝব।
জানলা থেকে সরে গেল বিশ্ব। বেরিয়ে এল ছাদে। শক্ত মুঠোয় রমার হাত ধরে সিঁড়ি পর্যন্ত টেনে আনল।
-চলে যাও।
-কেন?
-হ্যাঁ।
-না যাব না।
-কেন যাবে না?
চুপ করে রইল রমা। হাত ছেড়ে দিল বিশ্ব।
-তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?
চুপ করে রইল বিশ্ব। রমা ওর হাত ধরল।
-কেন? আমি কি দোষ করেছি?
-কিছু না।
-তবে!
বিশ্বর হাতদুটো কাঁধের ওপর তুলে নিল রমা। একরাশ কাপড় ঝোলান দড়ির মত হয়ে রইল হাতদুটো।
-তুমি আমায় ভালবাস না রমা।
-কে বলল!
-কেউ না। না বললেও বুঝতে পারি। হিসেব ছাড়া কেউ চলে না। বলতে পার আমার কি আছে, কেন তুমি আমায় ভালবাসবে? আমার চাকরিটাই কি তোমার ভালবাসাকে টেনে এনেছে?
-চাকরি পাবার আগে থেকেই ভালবাসি।
-কিন্তু কেন?
-জানি না।
-মিথ্যে কথা। শুধু শুধু এমনি ভালবাসা জন্মায় না। তুমি ব’ল?
-বললুম তো জানি না।
-আমায় ভালবাসার কোন কারণ নেই। এখন আর সে সময় নেই যে চিরন্তন ভালবাসার নাম ক’রে, জীবনটাকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। তাহলে, কেন এ সময়ে তুমি এলে?
-জানি না।
-তুমি আমায় জানোয়ার বলেছিলে।
ঝুঁকে পড়ল বিশ্ব। ওর নিঃশ্বাস রমার মুখে পড়ল। চুপ করে রইল সে।
-পেশাদার হতে চাও!
-তার মানে।
মুখ সরিয়ে পিছিয়ে গেল রমা। পিছনে দেয়াল। শব্দ হল। বিশ্বর হাতটা কাঁধ থেকে খসে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে আবার রমার কাঁধ দুটো শক্ত করে ধরল। দাঁত দিয়ে গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে বিশ্ব কথা বলল।
-জানোয়ারের কাছে এসেছ কেন? প্রেমের ব্রত পালন করতে? বল, বল?
ঝাঁকুনি দিল বিশ্ব। অস্ফুটে রমা কি যেন বলল। রাস্তা থেকে শব্দ এল। ভিজিলেন্স পার্টি লাঠি ঠুকে চলেছে। দোতলার নর্দমায় কেউ জল ঢালল। মা-মরা বেড়ালবাচ্ছাটা আবার ভয় পেয়েছে।
-আমার লাগছে। ছেড়ে দাও।
বিশ্বর হাত ছাড়াতে রমা চেষ্টা করল। আরো জোরে ধরে রইল বিশ্ব।
-ছাড়তে পারি, কথা দাও আমার সঙ্গে মনের কোন সম্পর্ক রাখবে না।
-না, কথা দেবো না।
-তোমায় বিয়ে করবো না, জেনে রেখ।
-কেন? তোমার কাছে এসেছি ব’লে?
-না, আমরা কেউ কাউকে ভালবাসি না ব’লে। আমাদের মন আর পরিষ্কার নেই। নিশ্চিন্তে সুখের জীবন, কোনরকমেই আর আমরা পাব না। নদীর মতন আমরা এঁকেবেঁকে এগোব। কোনদিনই দু’পার ছুঁতে পারব না। কি হবে বিয়ে ক’রে, সংসার পেতে!
বেড়াল কাঁদছে। ছাদের দরজার শিকলিটা হাওয়ায় খুটখুট করল। পায়রার বাসায় বোধহয় ইঁদুর ঢুকেছে। বড় রাস্তার গর্তে লরীর চাকা পড়ল। রমার কাঁধ থেকে হাত নামাল বিশ্ব। ওর আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরল রমা।
-আমার বয়স কত জান?
-এখন তা’ দিয়ে কি হবে?
-জান, আভা আমারই বয়সী, ওর ঘর হয়েছে, ভালবাসার লোক হয়েছে, ও মা হবে!
ফিসফিস ক’রে বলা কথাগুলো বিশ্বকে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল। পাক খেল। পাকিয়ে স্থির হয়ে রইল ওদের দুজনের মাঝে।
-তা’তে আমার কি?
-আমি পালাতে চাই। তুমি আমায় বিয়ে কর। নাহ’লে কি ক’রে বাঁচব।
হঠাৎ জড়িয়ে ধরল রমা। গলা থেকে প্রাণপণে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল বিশ্ব।
-এমন করে বাঁচা যায় না। আর আমরা মিলতে পারব না। আমাদের অনেক চাই, অনেক কিছু চাই। আমরা লোভী, স্বার্থপর হয়ে গেছি।
বুকের কাছে হাত ঠেকল। ঝটকা দিয়ে বিশ্ব সরিয়ে দিল। হাত দুটো আবার আঁকড়ে ধরতে এল। পিছিয়ে গেল বিশ্ব।
-নেমে যাও। নেমে যাও।
-তোমায় ভালবাসি।
ফিসফিসে কথাটা আবার পাকিয়ে উঠল ওদের মাঝে। কথাটাকে গুঁড়িয়ে দেবার জন্যেই বিশ্ব হাতটা ছুঁড়ল। দাঁতে দাঁত ঠোকার শব্দ উঠল। দেয়ালে টলে পড়ল রমা।
-আমায় বাঁচতে দাও। তুমি আমায় মেরো না।
দু’হাত মেলে রমা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরল বিশ্বর পিঠ। জ্বালা করছে। ছাল উঠে গেছে। ঘাম গড়িয়ে নামছে। রমা ফোঁপাচ্ছে।
আলতো ক’রে কাঁধে হাত রাখল বিশ্ব। হাতটা কাঁধ বেয়ে গলায় উঠল। তুলতুল করছে মাংস। চাপ দিল। আঙুলগুলো ছড়িয়ে গলাটাকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে, মুঠোটা ছোট করতে শুরু করল।
শব্দ হচ্ছে। টিউব থেকে অল্প অল্প বাতাস সরু নল দিয়ে যেন বেরিয়ে আসছে। হাঁ করে মুখ তুলল রমা। পিঠের হাত ঝুলে পড়ল। শব্দ করল মুখ দিয়ে। তারপরই বিশ্বর মুখে ঘুঁষি মারল।
আলগা হয়ে গেছে মুঠোর চাপ। ঠোঁট চাটল বিশ্ব। নোনতা স্বাদ। ঘাম নামছে। জ্বালা করছে পিঠ। জোর নিঃশ্বাস পড়ছে। মুখটা যন্ত্রণায় ভোঁতা হয়ে গেছে। বেড়াল বাচ্ছাটা সমানে ডাকছে। খুটখুট শিকলি নড়ল।
হাত বাড়াল বিশ্ব। চুল, গাল, গলা, কাঁধ। টেনে আনল। নোনতা স্বাদ। রমার ঠোঁট কেটে গেছে। নোনতা স্বাদ। রমার গাল গলা কপাল ঘামে ভেজা।
শব্দ হল। টিউব থেকে যেন বাতাস বেরিয়ে আসছে। বিশ্বর চিবুকে লেগে খসখস করল রমার চুল। মুখ তুলল। আবার নোনতা স্বাদ। বিশ্বর বুকে শব্দ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল রমা।
সেদিন কোন তারাটাকে দেখেছিলুম। সেটাকে এখন কি খুঁজে বার করা যাবে! হারিয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ। আমিও হারিয়ে যাব। আমায় কি কেউ খুঁজবে?
তারাটা ছুটে গেল। ওটা উল্কা। ওটা কি সেই তারাটা! আমি কি অমন করে ছিটকে পড়ব? যদি পড়ি কোথায় যাব! নরকে? আমি কি পাপ করেছি? যাদের অনেক আছে তারাই হিসেবী হয়। আমার কি আছে? বিশ্বর কি আছে? বুলাদের ঘরের বৌ হতে পারব না, কাবেরীর মত চাকরি করতে পারব না। কিন্তু ওদের মত আমারো মন আছে, শরীর আছে।
উল্কার মত আমি ছুটতে পারব না। ভয় করে। বিশ্বরও ভয় করে। ওই তারাগুলোর মধ্যে কোনটে বিশ্ব! বুলা, কাবেরী, বাবা, মা, সানু ওরা কোথায় হারিয়ে গেছে ভিড়ের মধ্যে। আমি এখন একা। এখন আমি সুখী। কিন্তু তারপর? তারপর কি আছে? ও হাঁপাচ্ছে। মরা ইঁদুরের মত মুখ গুঁজরে পড়ে আছে। অমনি ক’রে কি আমরা ভবিষ্যতেও থাকব! ক্ষেপামির ক্লান্তি ঘুচবে কি দিয়ে? চিরজীবন এইভাবে চলবে? আমরা যন্তর হয়ে যাব! আমরা মানুষ থাকব না।
-আঃ কেঁদ না।
রমার মাথায় হাত রাখল বিশ্ব। চুলে বিলি কেটে দিল।
-ওঠ, নিচে যাও, ঘুম পাচ্ছে।
রমা চুপ ক’রে রইল। শরীরে যন্ত্রণা, শরীরের মধ্যে যন্ত্রণা। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে শুয়ে রইল। এক সময় হাত রাখল বিশ্বর পিঠে। অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
নিঃশব্দে রমা নিচে নেমে গেল।
ছয়
গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই সানু বায়না ধরল গ্যাস বেলুনের। দিনেশ একটা কিনে দিতে মাধবী গা টিপল। হুঁশ হল দিনেশের। শৈল মুখ ঘুরিয়ে মানুষজন দেখতে শুরু করল আর তার দুই ছেলে ঘাড় তুলে দেখছে সানুর বেলুনটা। আরো দুটো বেলুন কিনে দিল দিনেশ।
-আয়রে শৈলী।
ওরা ফুটপাথ ধরে হাঁটা শুরু করল। তিনটে ছোট ছেলে বেলুন উড়িয়ে আগে তার পেছনে দিনেশ, আর একটু পিছিয়ে মাধবী, শৈল আর রমা।
-আজ কত লোক ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে বলতো?
-কত?
শৈল ছেলে দুটোর ওপর নজর রাখতে রাখতে বলল। মাধবী যেন লোক গুনতে শুরু করেছে। কথা না বলে এধার-ওধার তাকাতে লাগল। রমা একটু জোরে হেঁটে দিনেশের পাশে এল।
-বাবা, কলকাতায় কত লোক থাকে?
-কেন?
-বল না, এমনি জিগ্যেস করছি।
পঞ্চাশ ষাট লাখ হবে।
সানুরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। দিনেশ কাছে আসতেই সানু আঙুল দিয়ে দেখাল।
-বাবা, খাব।
-এই মাত্তর খেয়ে বেরিয়েছিস না?
শুধু একটা ধমকেই রমা চুপ করিয়ে দিল। রঙীন শরবতের গ্লাসগুলোর দিকে তাকিয়ে সানু তবু দাঁড়িয়ে থাকে।
-সানু, অসভ্যতা করলে মা’কে বলে দোব।
-আচ্ছা, পরে কিনে দোব।
দিনেশই শেষ পর্যন্ত সানুকে হাঁটাল। শৈলর ছেলে দুটি জুলজুল করে এতক্ষণ তাকিয়েছিল দিনেশের দিকে।
ওরা হেঁটে পৌঁছল একটা ছোট প্যাণ্ডেলে। পুরুষদের পথে দিনেশ ঢুকে গেল। সানুর বয়সী ছোট্ট একটা ভলাণ্টিয়ার ওকে সাবধান করে দিল, দড়িতে যেন হাত না দেয়। দিনেশ তার গাল টিপে দিতেই গম্ভীর হয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
বেলুন নিয়ে ওরা ঢুকেছিল। পাখায় লেগে শৈলর বড় ছেলেরটা ফেটে গেল। মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই সে শঙ্কিত হয়ে রইল।
ছোট্ট প্রতিমা। মামুলি ঢঙ। এক কাঠামোতেই সব কটা মূর্তি। আলোর বাহাদুরি নেই। ঝুড়ি-চুপড়ির কারচুপি নেই। এ্যামপ্লিফায়ারে সিনেমার গান। তবু লোকের ভিড়।
ভক্তিভরে প্রণাম করল মাধবী আর শৈল। সিঁদুরের টিপ নিল। চরণামৃত ছেলেদেরও খাওয়াল। খুশি হয়ে ওরা বেরিয়ে এল সেখান থেকে।
ওরা হাঁটল। পথে যতগুলো প্যাণ্ডেল পড়ল ওরা ঢুকল। প্রণাম করল। চরণামৃত খেল। সিঁদুরের টিপ পরল।
এক নাগাড়ে হাঁটা যায় না। রাস্তাপার হতে হবে। গাড়ি চলেছে। কলকাতার সব গাড়ি যেন একটা রাস্তা দিয়েই যাবে বলে ঠিক করেছে। হঠাৎ ব্যাজ-আঁটা একটা ছেলে বাঁশি বাজিয়ে রাস্তার মাঝখানে হাত তুলে দাঁড়াল। গাড়ি চলা থামল। সকলে রাস্তা পার হল। ওরাও পার হল।
-শৈলী, তুই বড় ঢিকিয়ে হাঁটিস।
-কি করব। অব্যেস নেই।
-রমা, আঁচল দিয়ে গলাটা ঢাক। লোকটা তখন থেকে আমাদের সঙ্গে ঘুরছে।
সরু একচিলতে হারটাকে রমা আঁচলে ঢাকল।
-বাচ্ছাগুলোর ওপর নজর রাখ।
-সন্ধিপুজো আরম্ভ হতে দেরী আছে।
-হ্যাঁ, সেই মাঝরাতে। দেখবি নাকি?
শৈল মাথা নাড়ল।
-না। উনি বাড়িতে একা। বাচ্ছাগুলো উঠে পড়লে সামলাতে পারবেন না।
মাধবী দিনেশকে ডাকল।
-কোন দিকে যাচ্ছ! গঙ্গার ধার দিয়ে চল না। এ রাস্তায় বড্ড ভিড়।
-এখনো তো বড় বড় গুলো দেখা হয়নি। কুমোরটুলি, আহিরীটোলা, বাগবাজার, তারপর ফায়ার-ব্রিগেড।
-তা হলে গঙ্গার ধার দিয়েই তো ভাল!
-অনেক ঘুরতে হবে।
-এ ভিড়ের চেয়ে তাই ভাল। বরং একটু জিরিয়ে নি। রমা ছেলেগুলোকে ডাক।
উবু হয়ে মাধবী ফুটের ধারে বসল। সানুর পায়ে ফোস্কা! জুতো খুলে ফেলল সে।
-কুলপী-বরফ খাবে?
মাধবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে দিনেশ বলল।
-এই খোলা রাস্তায়?
-কে আর দেখছে।
-ও শৈলী, বরফ খাবি?
-না দিদি।
মাধবী বুঝল শৈলর বাধাটা কোথায়।
-তুই না খেলে আমারও খাওয়া হবে না। কতদিন যে খাই না।
অপ্রতিভ হয়ে শৈল তাকিয়ে রইল। দিনেশকে ইশারা করল মাধবী।
রাস্তায় বসে ওরা বরফ খেল। হাঁটার অভ্যাস নেই কারুর, দিনেশ ছাড়া। উঠতে ইচ্ছে করছে না। হাঁটু ভেঙে আসছে।
-দিদি বাড়িতে উনি একা আছেন।
-আছে তো কি হবে। ওরা বেরোয়, বুঝুক একটু বাড়িতে বসে ছেলে আগলানোর মজাটা।
-ওর মন মেজাজ ভাল নেই।
-পুরুষ মানুষের এত অল্পেই ভেঙে পড়া ভাল নয়। তার ওপর তুইও জুটেছিস তেমনি।
কবে কার একটা তোলা তাঁতের শাড়ি শৈলর পরনে। হাতে শুধু লোহা আর প্লাষ্টিকের চুড়ি। ওর তুলনায় মাধবীর সাজ স্বচ্ছল। তাই লজ্জা পেল সে। শৈল ভেঙে পড়লে ওদের সংসারও পড়বে। ওর মনের জোর যাতে থাকে সেই কথাই বলতে হবে। অল্প বয়সে অনেকগুলো কুচোকাঁচার মা হয়ে ওর যন্ত্রণার শেষ নেই। আহা, ভালয়-ভালয় সবগুলো মানুষ হোক।
ফেরার সময় রিকশা কোরো।
দিনেশকে মুখ আড়াল করে মাধবী বলল।
-দুটো হলেই হয়ে যাবে। শৈলীটা একদম হাঁপিয়ে গেছে।
-ওকে না আনলেই হোত।
-বাঃ পুজোয় বেরোবে না? বচ্ছরকার একটা দিন। বাড়ির মধ্যে বসে থাকবে?
একদল অবাঙালী মেয়ে পুরুষ বরফ খেতে বসল ওদের পাশেই। মাধবীর গা টিপল শৈল। একটা জোয়ান তার কচি বৌকে হাতে করে বরফ খাওয়াচ্ছে। হাসল ওরা সকলেই।
রমা চারদিকে তাকাচ্ছে। বিশ্বকে বলা ছিল তারা রাত্রে বেরোবে। বিশ্ব বলেছিল রাস্তায় দেখা করবে। এতক্ষণেও দেখা হয়নি। এমন করে বসে থাকতে বিশ্রী লাগল রমার! হয় তো একটু এগোলেই দেখা হয়ে যেতে পারে।
-এমনি করে বসেই থাকবে?
-আর একটুখানি।
মাধবীর মজা লাগছে কচি-বৌটা আর তার জোয়ান স্বামীর হাবভাবে। তাড়া দিল দিনেশ।
-এখনো তো বড় প্রতিমাগুলো দেখা হয় নি। যত দেরী করবে ততই ভিড় বাড়বে।
বাচ্ছা তিনটের হাই উঠছে। সানু জুতো জোড়া রাস্তায় ফেলে রেখেছে। হাতে তুলে রাখল রমা। একটা ছেলে ঢুলছে। তাকে কোলে নিল শৈল।
ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। পথে ছোট ছোট প্যাণ্ডেল পড়ল। মানুষের ভিড়ে জমজমাট। ওরা থামল না। ভিড়ের মধ্যে মিশিয়ে ওরা হাঁটছে। তাঁবু খাটিয়ে ম্যাজিক দেখান হচ্ছে। আগুনে মানুষ। লোকটা যা ছোঁবে তাইতেই আগুন ধরে যাবে। ওদের হাঁটার বেগ কমে এল। দিনেশ এগিয়ে গেল বলতে বলতে।
-এখানে থেমো না। এখনো অনেক দেখার বাকি।
আবার জোরে হাঁটতে শুরু করল। সানুর বেলুনটা হঠাৎ হাত ফসকে উড়ে গেল। ওরা দাঁড়িয়ে দেখল। হেলে দুলে বেলুনটা উঠে যাচ্ছে।
-দাঁড়িয়ে থেকো না। অমন কত বেলুন আজ উড়বে, ফাটবে।
ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। এখানে আর্টের ঠাকুর। কেমন শোলা-শোলা ঠেকছে। কাঠেরও হতে পারে। না মাটিরই বোধ হয়। কি দরকার এত খেটে-খুটে পয়সা খরচ করে তৈরী করার। বিসর্জন তো দিতে হবেই। কিন্তু চোখ জুড়োয়। একঘেয়ে ঢঙ দেখে দেখে আলুনি লাগছিল। রোজকার দেখা রান্না ঘরটার মত। এই ভাল। রঙ দেখলে চোখ জুড়োয়। নতুন ঢঙ। এই বেশ।
-হাঁটো হাঁটো, থেমো না। দিনেশ কেমন মানুষের ফাঁক ফোকর দিয়ে গলে যাচ্ছে। যাবেই তো। পুরুষমানুষ, রাস্তায় চলার অভ্যাস আছে যে।
-শৈলী, ওই গাড়িটার দিকে তাকা। বৌটাকে গয়না পরিয়েছে কেমন। বেচারা! নিশ্চিন্তি হয়ে গাড়ি থেকে নামবে কি করে!
রাস্তা পড়েছে। ওরা দাঁড়াল। চারদিক থেকে মানুষ আসছে। এই মানুষের ধাক্কা সামলাতে হবে। গাড়ি দেখে পার হতে হবে। শৈল ঘুমন্ত ছেলের ভারে বেঁকে পড়েছে।
-অ শৈলী, ছেলেটাকে দে।
-না দিদি, পারব।
-না পারবি না। রমা ওকে কোলে নে।
চটকা লেগে ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেল। রমার কোলে কাঁদতে শুরু করল।
-ওগো, এখানে বটঠাকুর-ঝির দ্যাওরের বাড়ি না?
-না, এখানে নয়, কম্বুলিটোলায়। সে এখান থেকে অনেক দূর।
-কত নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে, দেখেছ?
-আমি আর কি দেখব, তুমি দেখ।
-এখানে বাড়ির ভাড়া কত করে?
-অনেক।
-অ দিদি ছেলেগুলো কোথা?
-তাই’ত রে শৈলী!
ওরা দাঁড়াল। আগে আগে যাচ্ছিল দুটো ছেলে।
-তোমরা এখানে দাঁড়াও আমি দেখি।
দিনেশ ভিড়ে ঢুকে পড়ল। এখান থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। রাস্তাটা খুব চওড়া নয়। মানুষ অজস্র। তাই দু’পা হাঁটলেই আর দেখা যায় না। একবার ভিড়ে মিশলে উল্টোদিকে ফিরে আসা দুঃসাধ্য। ঠেলতে ঠেলতে সেই প্যাণ্ডেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে। ছেলে দুটো যদি ভিড়ের মুখে পড়ে তাহলে আর ফিরতে পারবে না।
একটু পরেই ফিরল দিনেশ মুখ শুকনো। চাউনিটা বেঠিক।
-ওরা আসেনি?
-কই না তো!
-দিদি কি হবে!
-কি আর হবে, খোঁজ করতে হবে। প্যাণ্ডেলের ভেতর অফিস, সেখানে গিয়ে বলতে হবে। ওরা মাইকে বলে দেবে। সানুটাতো পড়তে পারে, চিনে চিনে ঠিক অফিসে হাজির হতে পারবে।
-তাহলে দেরী করে লাভ কি। হয়তো ওরাও আমাদের খুঁজতে, কোথায় ছিটকে পড়বে!
ওরা ভিড়ের দিকে এগোল। ঝুরঝুর মানুষ প্রথমটায়। যত এগোয় মানুষ জমাট হচ্ছে। প্যাণ্ডেলের গেট অনেকদূরে, তবু মানুষ চাপ বাঁধছে। এই চাপটা এগোবে। গেটের মুখে ভলাণ্টিয়ার দড়ি আর বাঁশি বাজিয়ে চাপটাকে আটকাচ্ছে। খণ্ড করছে। এক একটা খণ্ড ভেতরে ঢুকবে। আবার দড়ি পড়বে। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ততক্ষণে পিছনে মানুষ জমেছে। সামনে পিছনে দুদিক থেকে ঠেলা আসছে। মানুষ হাঁপসাচ্ছে। ঠেলা খেয়ে চাপটা দুলছে। টলে টলে উঠছে। ওরই মধ্যে প্রত্যেকটা মানুষ চেষ্টা করছে স্বস্তিতে থাকবার। হাত তুলে সামনের মানুষটাকে ঠেলে কিছুটা জায়গা ফাঁকা করতে চাপ দিচ্ছে। সব মানুষই নিজের সুবিধের জন্য চাপছে। একটা বিরাট চাপ তৈরী হচ্ছে।
হঠাৎ দড়িটা খুলল। হুড়মুড় করে একটা খণ্ড ভিতরে ঢুকে গেল। খানিকটা জায়গা ফাঁকা হল। ফাঁকা জায়গার লোভে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই।
ছেলে কোলে রমা টলে পড়ল। ওকে আঁকড়ে ধরল শৈল।
-দিদি এমন করে চললে রাত কাবার হয়ে যাবে। বাড়িতে উনি একা।
-তা’বলে ছেলে দুটোকে ফেলে রেখে যাবি নাকি!
বিরক্ত হয়ে ধমকাল মাধবী। দিনেশ বুকের কাছে হাত জড়ো করে সামনের মানুষকে ঠেলছে।
-ভুলপথে এসেছি। মেয়েদের ঢোকার রাস্তা এদিকে নয়।
-এখন আর ওসব ভেবে লাভ কি। আমাদের তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে।
মাধবীকে ঠেলছে পেছন থেকে। মুখ ফিরিয়ে দেখল, একটা পুরুষ মানুষ। দু’হাতে মাধবীর কাঁধ ধরেছে। চোখাচোখি হতে কেমন করে তাকাল। হাতটা নামিয়ে নেবার জায়গাও নেই। ধরুক! এখন আর অন্য কিছু ভাবার ফুরসতও নেই।
ভিড় চাপ খাচ্ছে। রমার কোলে ছেলেটা কান্না ভুলেছে। হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পিঠের আঁচল খসে পড়েছে। ব্লাউজটা উঠে গিয়ে কোমর বেরিয়ে পড়েছে। পড়ুক, হাত নাড়াবার জায়গা নেই। এই ভিড়ে কেউ এখন তাকাবে না।
কে চেঁচিয়ে উঠল। গলার হার কেটেছে। রাস্তার ধারে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে কে যেন। অজ্ঞান হয়ে গেছে। দিনেশকে মাধবী বলল।
-আমাদের না আসাই উচিত ছিল। বুড়োরা কি পারে এই ধকল সামলাতে।
-আমরা কি ইচ্ছে করে এসেছি। ছেলেদের জন্যই তো আসতে হল।
দূরে সরে গেছে শৈল। তিন চার পরত মানুষের ব্যবধান। কাছে আসার জন্য ভিড় ঠেলছে। মানুষের চাপে আঁচল আটকে গেছে। নিজের শরীরটাকেই ও ঝাঁকুনি দিল। ভিড় আলগা হ’ল না। চেঁচিয়ে ডাকল শৈল। মাধবী, দিনেশ, রমা মুখ ফেরাল।
হঠাৎ সামনের ভিড়টা পাতলা হল। বোধ হয় দড়ি উঠেছে। পেছনের ধাক্কায় মানুষগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টাল সামলাতে পারেনি দিনেশ। পড়ে গেল।
হুড়মুড়িয়ে ভিড় আসছে। পায়ে পায়ে চটকে দিয়ে যাবে দিনেশকে। চীৎকার করে মাধবী ভিড় আটকাতে গেল। ঝুঁকে পড়ল দিনেশকে তোলবার জন্য। পেছনের লোকটা শক্ত খোঁটার মত ভিড় রুখতে চেষ্টা করল। নড়বড় করে দুলছে মানুষটা। এখুনি ভেঙে পড়বে।
হঠাৎ শৈল ক্ষেপে উঠল। কোন রকমে পা তুলে হাঁটু দিয়ে সামনের লোকটার কোমরে চাড় দিল। নিঙড়ে গেল যেন মাংস। একটু জায়গা হয়েছে হাত খেলাবার মত। দু হাতে এলোপাথাড়ি ঘুষি ছুঁড়ল শৈল।
-দিদি টেনে তোল।
শৈল চীৎকার করল।
-পড়ে গেছে। হাত তুলে থামতে বলুন। ভিড়কে থামতে বলুন।
কে যেন চীৎকার করে হাত তুলল। কে শুনবে, একটা মানুষের কথা। যেমন করেই হোক মানুষ আগে পৌঁছতে চায়। ওই প্যাণ্ডেলের গেটটুকু পেরোলেই রেহাই। তারপর রঙ-বেরঙের আলোর সাজান দোকান। হরেক রকমের জিনিস। বিচিত্র মানুষ। দোকানে দোকানে হাতে করে জিনিস নাড়াচাড়া, দরদাম, সাধাসাধি।
-এখানে একটা মানুষ পড়ে গেছে।
একটা লোক তার পাশের লোককে বলল। পেছনের লোকও শুনল। ওরা কজন শক্ত হয়ে পেছনের ভিড় রুখল।
-কি হয়েছে এগোচ্ছেন না কেন?
-একটা লোক পড়ে গেছে।
-একটা লোক পড়ে গেছে?
ওরা পেছনে চাপ দিল। পেছনের মানুষ এগোতে চাইল। বিরক্ত হল। রেগে উঠল।
-একটা লোক পড়ে গেছে।
মানুষের বিরাট চাপ থমকে গেল। রেগে উঠল।
ছিঁড়ে গেল শৈলর এতদিনকার তোলা শাড়িটা। ঘড়ির স্টীলের ব্যাণ্ডে কনুই ছড়ে গেছে। মুখে রক্ত জমেছে। হাতের লোহা তুবড়ে বসে গেছে। পা মাড়িয়ে দিয়েছে কার জুতোর গোড়ালি। পাঞ্জাবি আর সার্টের হাতা, আঁকড়ে টেনে ধরে, ফাঁক দিয়ে গলে এল শৈল।
দিনেশকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কারা। ভিড় আবার চলেছে একটু একটু। ঝুঁটি-ভাঙা পায়রার মত লটকাচ্ছে দিনেশের মাথা। ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল শৈল।
-দিদি তুমি সামনে যাও।
মাধবীর হাত ধরে শৈল ঠেলে দিল।
-রমা, ইদিকটায় আয়। খোকাকে কোল ফিরিয়ে আমার দিকে রাখ।
শৈল দু’হাতে রমা আর দিনেশকে ঘিরে রাখল। মাধবী ওদের দুজনের সামনে রইল।
-ঠেলছেন কেন?
পাশের মানুষটাকে রুখে উঠল শৈল।
-ইচ্ছে করে কি ঠেলছি।
সমান রুখে জবাব এল। মাধবী বলল:
-আর পারা যায় না।
-এই তো এসে গেছি। গেট দেখা যাচ্ছে। ছেলে দুটোর এই ভিড়ে কি যে হয়েছে কে জানে।
-ওরা কি পারবে আমাদের মত সহ্য করতে।
-পেরেছে নিশ্চয়, নইলে হৈ-চৈ হ’ত। একটা কিছু জানতে পারতুম।
শৈল হাঁপাচ্ছে। তবু শান্ত স্বরে কথা বলল। কেউ যেন না ভয় পায়, তাই নিজের ব্যস্ততা দেখাল না। এদের তিনজন আর নিজের ছেলেটাকে সামলে এগোতে হচ্ছে। রাস্তায় খোয়া উঠেছে। জলের পাইপ বসাবার জন্য খুঁড়েছিল বোধ হয়। পায়ে ফুটছে। পেছন থেকে জুতোর ঠোক্কর লাগল গোড়ালিতে। এমন ভিড়ে লাগবেই। তার জন্য ঝগড়া করে লাভ নেই। যে করে হোক এগিয়ে যেতে হবে। দিনেশ আর মাধবীর বয়স হয়েছে, ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রমাটা আনকোরা। ঘাবড়ে গেছে। খোকার যেন কষ্ট না হয়। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা এখনো ওর হয়নি। এদের সামলে এগোতে হচ্ছে শৈলকে।
পৌঁছে গেছে। একটা খণ্ড ভেঙে বেরিয়ে যেতেই ওরা দড়ির সামনে পৌঁছে গেল। ওপাশ দিয়ে আর একদল মানুষ আসছে। ওরা প্যাণ্ডেল থেকে বেরিয়েছে। ওদের যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাঁশিতে ফুঁ পড়বে। দড়ি ঘুরে ওপাশে যাবে। ওরা আটকে পড়বে। এরা তখন ছাড়া পাবে।
অপেক্ষা করছে এরা। সামনে দিয়ে ভিড় চলেছে। কথা বলছে। হাতে হাত দিয়ে ছুটছে। আর এক প্যাণ্ডেলে। সেখানেও হয়তো এমন ভিড়। আজ সারারাত ওরা এমনি করে ভিড় ঠেলবে।
-মানুষ এতও পারে।
রমা বলল কথাটা। ও এমন ভিড় আগে দেখেনি।
.-এই বেশ লাগে। মানুষ চলছে ফিরছে, ওদের চলা দেখতে বেশ লাগে।
দু হাতে ভর দিয়ে শরীরটা হেলিয়ে বসল চিনু। কাবেরী রাস্তার দিকে তাকিয়ে। পার্কের এই দিকটা অন্ধকার। থোকো থোকো মানুষ বসে আছে। জিরোতে এসেছে। আবার উঠে যাবে।
চিনু বা কাবেরী ক্লান্ত নয়। মানুষের ভিড় এড়িয়ে ওরা বসেছে সময় কাটাতে। ঘুরে বেড়াতে ওদের ভাল লাগছে না।
-তোমার ফিরতে দেরি হলে কিছু হবে না ত?
-না। সাড়ে ন’টার পর হলে সই করে ঢুকতে হবে।
কিছুটা ঘাস ছিঁড়ল কাবেরী। লুকোচুরি খেলতে খেলতে দুটো বাচ্ছা তাদের ঘিরে নাচানাচি শুরু করল। ওপাশ থেকে ডাকল ওদের মা। মস্ত পার্ক। মধ্যে আলো নেই। তাই অন্ধকার মাঝখানটা। বাচ্ছা দুটো নিজের মনেই হারিয়ে যেতে পারে। ওদের মা উঠে এসে ধরে নিয়ে গেল।
-কেমন লাগছে বলতো?
-বেশ লাগছে।
আবার ঘাস ছিঁড়ল কাবেরী। রাস্তা কমাবার জন্য অনেকে কোণাকুণি পার্কের মধ্যদিয়ে চলেছে। ধমকাচ্ছে একজন তার বৌকে নিড়বিড়িয়ে হাঁটার জন্য। খলবল করে গেল কতকগুলো মেয়ে। কাঁধে হাত রেখে ছেলেটি কি যেন বলল মেয়েটিকে। ওরা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। রাস্তা থেকে একঝাঁক বেলুন ছেড়ে দিয়েছে কে।
-কাল সকাল সাতটায় ডিউটি।
কাবেরী ঘাস ছেঁড়া বন্ধ করে বেলুন দেখতে লাগল।
-তোমার দিদির কাছে ছুটির দিন তো আসতে পার।
-আসব। দু’হাতে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়ল চিনু। মিষ্টি গন্ধ আসছে। কাবেরী কিছু একটা মেখেছে। উঁচু করে খোঁপাবাঁধা। গঙ্গামাটির মত ঘাড়। ঘাড় ফেরাল। ছলকে উঠল মাংস। গলায় সরু সরু দাগ। থুতনির নীচে একটু পল-তোলা। হাতের চেটোয় মাথা রেখে শুয়ে পড়ল চিনু।
-সারারাত এমনি করে এখানে বসে থাকা যায়, না?
-ঘুম পেয়ে যাবে। কেমন একটা না একটা শব্দ হচ্ছে যেন ট্রেনে চেপেছি। আপনার ঘুম পায় না ট্রেনে উঠলে?
-ঘুমোবার মত জার্নি কখনো করিনি।
-আপনি ভয়ানক কুঁড়ে।
-কিসে বুঝলে!
-আমি বসে রয়েছি অথচ শুয়ে পড়লেন।
-তাতে কি প্রমাণ হয় আমি কুঁড়ে?
-নিশ্চয় হয়।
সময়-কাটানো তর্ক একটা তৈরী হবার মুখে, এমন সময় জনাছয়েক ওদের কাছেই গোল হয়ে বসে হৈ-চৈ শুরু করল। ওদের পরনে সরু চোঙার মত প্যাণ্ট। নাইয়ের নীচ দিয়ে বেল্ট। ক’জনের মাথায় বেতের টুপি। হাতে হুঁকো। ওরা মানুষকে মজা দিতে বেরিয়েছে।
চুপ করে গেল চিনু। জায়গাটা এতক্ষণ নিরিবিলি ছিল। কয়েকজন এদিকে তাকিয়ে কি ফিসফিস করল। হেসে উঠল সবাই ভীষণ জোরে। পার্কের অনেকেই তাতে মুখ ফিরিয়ে দেখল। অস্বস্তি হচ্ছে। চিনু উঠে বসল।
-হঠাৎ কেমন গরম পড়েছে। ক’দিন ধরে।
-হ্যাঁ, গুমোট গুমোট ভাব।
-বৃষ্টি হবে কি?
-মেঘ কই!
ওরা মেঘ খুঁজতে লাগল। হৈ-চৈ করছে ছেলেগুলো। গান ধরেছে একজন। গলাটা মিষ্টি। হাত তালি দিচ্ছে সকলে। হঠাৎ একজন লাফিয়ে উঠে নাচতে শুরু করল। হাত ধরে, কোমর ভেঙে, ঘাড় নাড়া দিয়ে নাচছে। কে একজন হুঁকোটা হাতে তুলে দিল।
-আপনার ক্ষিদে পায়নি?
-না, তোমার পেয়েছে?
-হ্যাঁ, সেই কখন খেয়ে বেরিয়েছি।
-তাহলে ওঠো।
ওরা উঠে পড়ল। দেখে দেখে খুপরিওলা একটা রেস্টুরেণ্টে ঢুকল। দোকানের বাচ্ছাটা চিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল। চিনু তাকাল কাবেরীর দিকে।
-কি খাবে?
-যা হোক।
-তবু?
-খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
-তাহলে মাংস আর পরোটা।
খাওয়ার পর বিল নিয়ে এল বাচ্ছাটা। মৌরির প্লেটে বিলটা রাখল চিনুর সামনে। বিলটা তুলে নিয়ে সে পড়তে শুরু করল। বাচ্ছাটা দাঁড়িয়ে। দোকানে আজ অনেক খদ্দের। একজায়গায় আটকা থাকলে চলবে না। উশখুশ করল সে।
চিনু তাকাল কাবেরীর দিকে। বাচ্ছাটাকে এক-গ্লাশ জল আনতে পাঠাল কাবেরী।
-কত হয়েছে?
-দু’টাকা চার আনা।
ছোট্ট ব্যাগটা থেকে তিনটে টাকা বার করল কাবেরী বাচ্ছাটা আসার আগেই। রাস্তায় বেরিয়ে খুচরোগুলো ফেরত দিচ্ছিল চিনু। কাবেরী নিল না।
-এরপর কিন্তু সিগারেট খেতে দেবো না। গন্ধটা আমার বিচ্ছিরি লাগে। খাবেন তো এখানেই খেয়ে নিন।
অর্থহীন কথা। কথা না বাড়িয়ে পয়সাগুলো পকেটে রাখল চিনু। আঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে তালগোল পাকাচ্ছে একরাশ নিঃশ্বাস।
-কোন দিকে যাবেন?
-যেদিকে হয়।
সামনের দিকেই হাঁটতে শুরু করল। উল্টোদিক থেকে মানুষ আসছে। পথ ছেড়ে দেবার জন্য কখনো ওরা ঘেঁষে এল, কখনো দূরে সরে গেল। রাস্তা পার হবার জন্য পাশাপাশি দাঁড়াল। কথা না বলে ওরা হাঁটছিল। হঠাৎ চিনু বলল:
-একটা চাকরির চেষ্টা করেছিলুম স্টেট বাসে, হোল না।
-কেন?
-আর লোক নিচ্ছে না।
-অন্য কোথাও?
-খুঁজছি।
-অবস্থা খুব খারাপ, চাকরির।
-আরো খারাপ হবে।
ওরা দাঁড়াল। ডানদিকের রাস্তায় খুব ভিড়। রাস্তাটা একটা প্যাণ্ডেলে পৌঁছেছে।
-যাবেন।
-ভিড় দেখেছ?
-দেখেছি, তা’ ত কি হয়েছে।
ভীষণ ঠেলাঠেলি করতে হবে। কষ্ট হবে তোমার।
-তাহলে কি করব। পার্কে বসে থাকব!
-আচ্ছা চল। ওদিক দিয়ে এস, মেয়েদের রাস্তা ওদিকে।
-একা একা ঘুরতে আমার ভাল লাগে না।
-কিন্তু পুরুষদের দিকের অবস্থা দেখেছ?
-আমার যে দু’একটা জিনিস কিনতে হবে!
-কিনবে।
-আমি দরদাম করতে পারি না। সব সময় ঠকে যাই।
-আমার জিনিস কেনা অব্যেস নেই। এদিকে সরে এস।
ওরা ফুটপাতে উঠে দাঁড়াল। দুজনেই তাকাল ভিড়ের দিকে। নির্ঝঞ্ঝাটে দাঁড়াবার জো নেই। ধাক্কা দিয়ে মানুষ চলেছে।
-একটা বেড-কভার কিনতে হবে।
-ভিড় দেখেছ, যাবে?
-চলুন না।
-চল।
ওরা গুটিগুটি এগিয়ে এল ভিড়ের দিকে। পাতলা ঝুরঝুরে প্রথমটায়। যত এগোয় মানুষ জমাট হচ্ছে। প্যাণ্ডেলের গেট অনেকদূরে, তবু মানুষ চাপ বাঁধছে।
-এই তো সবে শুরু।
-হ্যাঁ, সবে শুরু।
কি একটা ঠেকল চিনুর হাতে। হাতটা সরিয়ে নিচ্ছিল। কাবেরী টেনে ধরে ব্যাগটা গুঁজে দিল।
-রাখুন। আমি দরদাম করতে পারি না।
-এবার বোধ হয় ছাড়া পাব।
দড়িটা ওদের বুকের কাছে কাঁপছে। টুলের ওপর বাঁশি মুখে দিয়ে দাঁড়ান ভলাণ্টিয়ারটির দিকে সকলেই তাকিয়ে। সে ভুরু কুঁচকে মানুষ মাপছে। হিসেব কষছে, বাঁশিতে ফুঁ দেবার সময় হয়েছে কি না।
-পৌঁছে গেলুম।
আবার বলল দিনেশ। তাকাল সে মাধবীর দিকে। ঘোমটা তুলে দিল মাধবী।
-ছেলে দুটোর জন্যই যত কাণ্ড।
-হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে কি থাকতে দেয়। এখন আবার ভলাণ্টিয়ারদের সঙ্গে ছোটাছুটি করতে হবে।
বাঁশিতে দুবার ফুঁ পড়ল। তার মানে দড়ি-ধরা ভলাণ্টিয়াররা তৈরী হও, দড়ি সরাতে হবে। বড় ফুঁ পড়লেই দড়ি সরবে। আটকান মানুষগুলো ছাড়া পাবে। হঠাৎ ওই জায়গার মানুষগুলোর শব্দ কমে গেল। নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়েছে সকলে।
-ছেলেটাকে আমার কোলে এবার দাও।
রমার কাছ থেকে ছেলেকে তুলে নিল শৈল। রমা পিছু ফিরে একবার তাকাল। বিশ্ব বলেছিল দেখা করবে রাস্তায়। দেখা হয় নি।
-এতক্ষণ বুকে একটা ব্যথা করছিল। অভ্যাস নেই তো। সেদিনও করেছিল, সাঁতার কাটার পর।
-করবেই তো, কম খাটুনির ব্যাপার!
-ছেলে দুটো বোধ হয় ভেতরে মজাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-না, বোধ হয়। কাঁদছে। হয় তো আমাদের দেখতে না পেয়ে কাঁদছে।
নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান
নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান – মতি নন্দী – উপন্যাস
এক
ঝকঝকে আকাশি-নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা, আট হাত চওড়া জয়রাম মিত্র লেন আর কুড়ি হাত চওড়া তারক কবিরাজ স্ট্রিটের মোড়ে, তারক কবিরাজের বাড়ির সামনে অসীমকে লক্ষ করেই থেমে গেল। অসীম তখন ভাবছিল, এখুনি ত্রিশটা টাকা কোথা থেকে জোগাড় করা যায়। ড্রাইভার-আসন থেকে প্রশ্ন হল, ”এটাই কি জয়রাম মিত্র লেন?”
অসীম দাঁড়িয়েছিল বাঁ পায়ের উপর ভর দিয়ে, কোবরেজদের রকে বাঁ হাত রেখে শরীরটাকে হেলিয়ে, যাতে ডান পা ভারমুক্ত থাকে। ডান পায়ের হাঁটুতে গত বছর চোট পেয়েছিল নবদ্বীপে এক শীল্ডের ফাইনালে খেলতে গিয়ে। দিন পঁচিশ ভুগিয়েছিল হাঁটুটা। তারপর একটু ভয়ে ভয়েই খেলত। মাঝে মাঝেই খচখচ করে ওঠে ব্যথাটা। লাফিয়ে ট্রামে উঠতে গিয়ে কী স্লাইডিং ট্যাকল করতে গিয়ে অসীম বুঝেছে চিকিৎসা করানো দরকার। ডাক্তার দেখিয়েছিল। এক্সরে করানোর পরামর্শ নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরে। করাবো করাবো মনে রেখে প্রায় একটা বছর তারপর কেটে গেছে।
গতকাল তারকেশ্বরের মাইল ছয়েক দূরে এক গ্রামে ফোর্থ রাউন্ড খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছে আবার ডান হাঁটুতে। রাইট-ইনটা প্রথম থেকেই পা চালিয়ে খেলছিল। হাফ-টাইমের আগেই অসীমের লেফট-হাফকে মাঠ থেকে বার করে দিল মুখ ফাটিয়ে। অসীম রাইট-ইনের কাছে গিয়ে বলেছিল-”এটা কী খেলা হচ্ছে, ফুটবল?” রাইট-ইন কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, ”তবে নয় তো কি।” দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে অসীম বলেছিল, ”বটে।”
”শুনছেন, এই গলিটাই কি জয়রাম মিত্র লেন?”
মোটর চালকের মুখ জানলা থেকে একটু বেরিয়ে এসেছে। তারক কবিরাজ স্ট্রিটের রাস্তার বালবগুলো খুলে ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাগানো হয়েছে। কাউন্সিলর কুমার চৌধুরীর এইটিই আপাতত সর্বশেষ কৃতিত্ব জনগণকে তার সেবা সরবরাহে। এই আলোয় মোটর চালকের গৌরবর্ণ কপালের টিকোলো নাকের এবং চিবুক ও গালের কিছুটা অংশ অসীমের চোখে পড়ল। ওর মনে হল, মুখখানি যেন চেনা-চেনা।
অসীম কৌতূহলী হয়ে, চোখ দুটি তীক্ষ্ন করে তাকাল। কোথায়, কোথায়, কোথায় যেন দেখেছে।
হেরাল্ডের দরজা খুলে নেমে এল আরোহী। দোহারা গড়ন, লম্বায় প্রায় পাঁচ-দশ, ধুতি-পাঞ্জাবি, চুলগুলি অবিন্যস্ত। দরজায় চাবি দেবার জন্য পিছন ফিরতেই ঘাড়ে দুটি ভাঁজ দেখতে পেল অসীম। ওর কাছে হেঁটে এল হালকাভাবে, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে দেহের ওজন জমিতে রেখে, মাথাটা ঝুঁকিয়ে।
সামনে এসে দাঁড়াতেই অসীম চমকে উঠল। আশ্চর্য, এতক্ষণ চিনতে পারেনি কেন সে। এই গলির মোড়ে, সন্ধ্যাবেলা এমন অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি, অসীমকে অভিভূত করে ফেলল।
”আলোটা বড্ড কম ঠিক বুঝতে পাচ্ছি না, আচ্ছা এটাই কি জয়রাম মিত্র লেন?”
সেই ভরাট গলা, নিরাসক্ত ভঙ্গি, শব্দগুলো শিথিল করে মুখ থেকে বার করে দেওয়া। বছর পাঁচেক আগের, নিউ থিয়ের্টাস দু’নম্বর স্টুডিয়োর ফ্লোরের একটি দৃশ্য ঝলসে উঠল অসীমের চোখে। ডিরেক্টর শেষবারের মতো সিচুয়েশন বুঝিয়ে দিচ্ছে। শুনতে শুনতে একবার চোখ তুলে ওদের কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ”তাহলে, প্রথম ঘুষিটা খেয়েই পড়ে যাব। সেটা মারবে কে?” অসীমের মনে হয়েছিল স্বর কেমন যেন ক্লান্ত। ডিরেক্টর আঙুল দিয়ে দেখাল অসীমের পাশে দাঁড়ানো দাঁত উঁচু লোকটিকে। তখন হেসে বলল ”দেখবেন ভাই, খুব জোরে কষাবেন না। তেবড়ে-তুবড়ে গেলে রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।” তাই শুনে লোকটার দাঁত আরও খানিকটা বেরিয়ে আসে এবং চাপা গলায় একমাত্র অসীমকে শুনিয়ে বলেছিল, ”গাল দুটো তো বাবা, লাখ টাকার ইন্সিয়োর করে রেখেছ, রোজগার বন্ধ হলেই বা কি!” শুনে সির সির করে উঠেছিল অসীমের দুই বগল। চাপা গলায় সে বলেছিল, ”এইরকম একস্ট্রার পার্ট করতে হয়েছিল ওকেও।” দাঁত-উঁচু তাই শুনে অসীমের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিল, ”নায়ক হবার সাধ হয়েছে? ভালো ভালো।” শুনে জ্বালা করে উঠেছিল অসীমের মাথার ভিতরটা।
”ক’ নম্বর খুঁজছেন?”
অসীম গলার স্বরে ব্যক্তিত্ববান হবার চেষ্টা করল। এ পাড়ায় তার ওজন আছে, এবাড়ি-ওবাড়ির মধ্যে ঝগড়া হলে মধ্যস্থতা করে, ছোটোদের বেচাল দেখলে কড়কে দেয়, অন্য পাড়ায় গিয়ে সোডার বোতলও ছুঁড়ে আসে, নানাবিধ রাজনৈতিক আন্দোলনে যখন পুলিশ রাইফেল তুলে তাড়া করে, সে ইঁট ছোঁড়ে। জয়রাম মিত্র লেন তার স্টুডিয়ো ফ্লোর।
”নীরবালা ভটচায, তিনের বি, বছরখানেক এসেছেন, স্কুলে পড়ান।”
”বিধবা, একলা থাকেন, চুলগুলো ধবধবে, কর্পোরেশন স্কুলে পড়ান?”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, কতটা ভেতরে হবে বলুন তো ভাই?”
অসীম দু’ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। উদাসীন বা ক্লান্ত, ভরাট কণ্ঠস্বরের ‘ভাই’ শব্দটি তার ভালো লেগেছে।
”চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”
”গাড়িটা কি ভেতরে নিয়ে যাব, না এখানেই রাখব?” অসীমের মুখের দিকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইল নির্দেশের অপেক্ষায়। এটা অসীমকে অভিভূত করল আবার। তার ইচ্ছা হল, মোটরটা জয়রাম মিত্র লেনের মধ্যে ঝকঝকে একটুকরো আকাশের মতো ভেসে আসুক।
”গলির ভেতরেই রাখুন। চোরের উৎপাত বেড়েছে আজকাল এখানে। এই সেদিন একটা গাড়ির হেডলাইট খুলে নিয়ে গেছে। আসুন জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”
”তাই নাকি! কেরিয়ারের লকটা আবার ভেঙে গেছে, স্পেয়ার টায়ারটা ভেতরে। বলে ভালোই করলেন।”
অসীমকে অনুসরণ করে ঝকঝকে আকাশি-নীল মোটরটা গলির মধ্যে ঢুকল। তেইশ নম্বর বাড়ির লাগোয়া কর্পোরেশন টিউবওয়েলে স্নান করছিল সত্যচরণ। দু’বেলা স্নান করে এবং অফিস যাওয়ার আগে ও ফিরে এসে তার একমাত্র কাজ বালতি বালতি জল টিউওয়েল থেকে এনে সারা বাড়ি ধোওয়া এবং ভাতের কণা কী মাছের কাঁটা বাড়ির কোথাও পড়ে আছে কিনা খুঁটিয়ে লক্ষ করা।
সত্যচরণের আট বছরের ছেলেটি হাতলে বুক দিয়ে পাম্প করে বালতিটা ভরে চলেছে। জলটা ঠান্ডা। মগে করে জল তুলে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বুজে মাথায় ঢেলে ঢেলে সত্যচরণ আনন্দ করছিল। মোটরের ইঞ্জিনের শব্দে চোখ খুলেই আঁতকে উঠল সে।
”দ্যাখো দ্যাখো, কাণ্ড দ্যাখো, চাপা দেবেন নাকি মশাই!”
গামছার কসি চেপে ধরে সত্যচরণ উঠে দাঁড়াল। অসীম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”চুপ করুন তো, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, এখনও শিখলেন না।”
”কেন, ইনি কি চিফ সেক্রেটারি।” সত্যচরণ খিঁচিয়ে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে বলল, ”মাড়িয়ো না, মাড়িয়ো না, জুতো পরে মাড়িয়ো না, ধুয়ে রেখেছি যে জায়গাটা।”
অসীম টিউবওয়েলের চারপাশে ধুয়ে রাখা অঞ্চলের উপর পা রেখেই সত্যচরণের কানের কাছে মুখ এনে শুধুমাত্র দুটি শব্দ চাপা স্বরে বলেই পিছিয়ে গেল। সত্যচরণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আ মোলো, যত রাজ্যের গু-মুত লাগানো চাকা একেবারে চান করার জায়গায়!”
”এই গলির মধ্যে তিনের-বি, চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”
অসীম হাত তুলে তাঁতিদের গলিটা দেখাল। চওড়ায় দু’হাত, দৈর্ঘ্যে প্রায় চল্লিশ হাত। এর মধ্যে আছে চারটি বাড়ির ঠিকানা। এরকম শাখা গলি জয়রাম মিত্র লেনে গুটি পনেরো আছে। কোনোটির নাম উকিলদের গলি, কোনোটি চক্রবর্তীদের গলি, কোনোটির নাম ময়রাদের গলি।
”আপনি না থাকলে ট্রাবলে পড়তাম।”
তাঁতি গলির মুখেই কর্পোরেশনের আলো। অসীম লক্ষ করল, দুজনের ছায়াই দৈর্ঘ্যে যেন সমান। কথা বলতে গিয়ে ঘড়ঘড় করে উঠল তার গলাটা।
”নতুন লোকের পক্ষে একটু ট্রাবল হবেই।”
তিনের বি-র দরজা বন্ধ। দরজার পাশেই জানলা। তার একটা পাল্লা খোলা। অসীম উঁকি দিয়ে দেখল পিছন ফিরে নীরবালা ভটচায ঠোঙা থেকে কৌটোয় কিছু একটা ঢালছেন। অসীম গলাখাঁকারি দিতেই জানলার দিকে তাকালেন।
”আপনাকে একজন খুঁজছেন।” অসীম নামটা উচ্চচারণ করতে গিয়ে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল।
”আমাকে?”
অবাক হয়ে তিনি জানলার ধারে এলেন। আবছা গলিতে ঠাওর করার চেষ্টা করছেন মুখটিকে, তখন অসীমের পিছন থেকে ক্লান্ত অথচ ব্যক্তিত্বে ভরাট স্বর বলে উঠল, ”পিসিমা, আমি হাঁদু, দরজাটা খুলুন।”
অসীমের মনে হল, তার মতো খুবই সাধারণ একজন, এই লোকটা। বাড়ির এবং পাড়ার অনেকেই এখনও তাকে ফ্যালা নামে ডাকে। পিসিমা থাকলে তার বাড়ি গিয়ে হয়তো এইভাবেই সে বলত, ”আমি ফ্যালা, দরজাটা খুলুন।”
অসীম এই কথা ভেবে, সমান-সমান একরকমের বোধের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ঝকঝকে আকাশি-নীল মোটরটির গায়ে সে যত্নে হাত রাখল। এটিকে এখন তার নিজের বলেই মনে হচ্ছে। এখন ইওসেবিয়ো-র পর্যায়ের ফুটবলার হিসেবে নিজেকে ভাবতে ইচ্ছে হল তার। ঝুঁকে ডান হাঁটুতে হাত ছোঁয়াল। মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে এল, ”শাললা।”
পা-টা সরিয়ে নিতে মুহূর্তের জন্য দেরি হয়ে গেছল। রাইট-ইন বুট তুলেছে দেখতে পেয়েও অসীম এগিয়ে দিয়েছিল ডান পা, বলটাকে টাচ লাইনের ওধারে ঠেলে দেবার জন্য। না দিলে বল যেত রাইট-আউটের কাছে। সে চিপ করলেই, ওৎ-পাতা সেন্টার ফরোয়ার্ড বল পায়। সেখান থেকে নেট করা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। রাইট-ইনের পা-টা ঠিক হাঁটুতেই লাগল। বাকি সময়টা অসীম লেফট-আউটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয়। খেলায় এক গোলে হেরেছিল। খেলা শেষে একদল লোক লাঠি নিয়ে তাড়া করে তাদের চারজনকে-যারা কলকাতা থেকে এসেছিল টাকা নিয়ে খেলতে। অন্ধকারে ধান খেতের মধ্যে দিয়ে ছোটবার সময় অসীম দু’বার পড়ে যায়। দু’মাইল ছুটে এসে বাসে ওঠে। বাসে উঠে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ওরা। অবশেষে একজন চাপা গলায় বলে, ”বাকি টাকাটা আর দিল নারে।” আর একজন বলেছিল, ”বড্ড খিদে পেয়ে গেছে, জিতলে মুরগি খাওয়াবে কথা ছিল।” অসীম হাঁটু চেপে ধরে মাথা নামিয়ে শুধু বসে ছিল। হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছবার পয়সা মাত্র তার পকেটে। তখনও সে জানত না বাড়িতে তার বাবা কী কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে।
”হ্যাঁরে ফ্যালা, কাদের বাড়িতে এল রে?”
অসীম উপর দিকে তাকাল। সতেরো নম্বরটা একতলা। ছাদের পাঁচিল নেই। ও বাড়ির সেজোমেয়ে শেফালি, বয়স প্রায় চল্লিশ, সময় পেলেই ছাদের কিনারে এসে বসে থাকে। বিয়ের ছয় মাস পরই স্বামীর ঘর থেকে চলে এসে, শেফালি পনেরো বছর যাবত বাপের বাড়ি রয়েছে। কেন রয়েছে তাই নিয়ে পাড়ায় প্রভূত জল্পনা হয়ে গেছে এক সময়। নতুন ভাড়াটেরা কৌতূহল দেখালে শেফালি একই জবাব দেয়, ”সন্ন্যাস নিয়ে বেরিয়ে গেছেন।” তবে পাড়ার প্রত্যেকেরই ধারণা, শেফালির কর্কশ কণ্ঠস্বর, রোমশ, কঠিন পেশি সম্বলিত দেহে কোমল বক্রতার নিদারুণ অভাব, পুরুষোচিত চলাফেরা, সতেরো বছরের কিশোরের মতো গোঁফ, কুচুটে স্বভাব ইত্যাদির জন্যই স্বামী সংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে গেছে। কেউ বলে, মোটেই সন্ন্যাসী হয়নি, আবার বিয়ে করেছে, চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে, বউ নিয়ে দিব্যি সংসার করছে। বাগবাজারে স্টেশনারি দোকান আছে, বিশ্বাস না হয় যে-কেউ গিয়ে ভজিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কেউ ভজিয়ে এসেছে বলে জানা যায়নি।
শেফালির বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। দাদা এবং তিন ভাই বিবাহিত। সে থাকে রান্নাঘরের পাশের ঘরটিতে। বাড়ির আঠারো জনের রান্না করে যে সময়টুকু পায়, সেটা ব্যবহার করে ছাদের কিনারে বসে আর এবাড়ি-ওবাড়ি করে। শেফালির আনন্দ প্রতি বাড়ি থেকে সংবাদ সংগ্রহে ও বিতরণে। ছাদের কিনার তার পর্যবেক্ষণ-ঘাঁটি। পাড়ার বউ-ঝিরা দুপুরে সাজগোজ করে বেরোলেই ছাদ থেকে অবধারিত প্রশ্ন ঝরবে-”কোথায় গো, সিনেমা?” ছোটো ছেলেমেয়ের হাতে শালপাতার ঠোঙা কী ভাঁড় দেখলে প্রশ্ন হয়-”কে এসেছে রে?”
শেফালি যখন যে বাড়িতে হাজির হয়, সঙ্গে সঙ্গে চালু আলোচনা ধামাচাপা পড়ে। পাশের বাড়ির বউ ইলার শোবার ঘরের জানলাটি শেফালিদের ছাদের লাগোয়া। সন্ধ্যা থেকেই সে জানলা বন্ধ রাখে, যেহেতু গল্পচ্ছলে শেফালি তাকে জানিয়েছে, ”বুঝলে গো, এ পাড়ার সব ঘরেই কোনো-না-কোনো ব্যাপার আছে, শুধু তোমাদের ঘরেই যা নেই।”
শুনেই ইলা বুঝে গেছে, শেফালি নজর রাখছে তার ঘরে এবং একটা ‘ব্যাপার’ আবিষ্কার না করা পর্যন্ত ও স্বস্তি পাবে না। অশোক প্রায়ই রাতে মদ খেয়ে ফেরে। কিন্তু মাতলামো করে না। সে কথা কি আর জানেনা শেফালি, নিশ্চয় জানে। তবু বলেছিল, ”সব ঘরেই আছে, জোর দিয়ে অমন কথা বলবেন না, ঠাকুরঝি।”
”বেশ, তাহলে বলো কোন ঘরে নেই?”
”তা কী করে বলব।” ইলা অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে ওঠে। কোন ঘরের নাম করলে সেটাকে মোচড় দিয়ে শেফালি কী অর্থ করে পাড়ায় চাউর করবে কে জানে!
”তাহলে! বলতে তো পারলে না।” শেফালি খুশি হয়ে বলল।
ইলা তখন বলে, ”প্রফেসারদের ঘরে কিন্তু আপনি খুঁজে পাবেন না। বেশ ছিমছাম পরিবার, বউ, ছেলে আর শালি। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে রেডিয়োয় বলে, গলাটি বেশ। ওর বউ নাকি স্কুলে পড়ায়। উনি বলছিলেন, মাসে হাজার সাতেক টাকা রোজগার করে।”
শেফালি নিমীলিত চোখে, মুখে হাসি ফুটিয়ে কথাগুলি শুনে যায়। অবশেষে বলে, ”তা ঠিকই বলেছ, তবে বউকে ফেলে আইবুড়ো যুবতী শালির সঙ্গে সিনেমা যাওয়া, দিদি বাড়ি থেকে বেরোলেই বোনের অমনি ভগ্নিপতির গা ঘেঁষে বসা, শ্বশুর তো বোর্ডিংয়ে রেখেই মেয়েকে পড়াতে চেয়েছিল, অমনি জামাই হাঁই-হাঁই করে বলে উঠল, ‘আমি থাকতে আভা বোর্ডিংয়ে থাকবে কি!’ লক্ষ করেছ তোমার প্রফেসারের বউ কেমন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে! আসলে রস মরে গেছে, বুঝলে গো, রস মরে গেছে। আর ওদিকে বোনের চেকনাই ফুটেছে। নদীর এ-কূল ভেঙে ও-কূল গড়ে উঠছে। তুমি বাপু, রোজ ও লোকটার বেরোবার সময় জানলায় অমনভাবে দাঁড়িয়ো না, খারাপ দেখায়।”
শেষ বাক্যটিতে বিবর্ণ হয়ে গেছল ইলার মুখ।
”এই ফ্যালা, কাদের বাড়ি বল না?”
অসীম ভেবেছিল না শোনার ভান করে চলে যাবে। কিন্তু হাঁটুটার হঠাৎ চিড়িক দিয়ে ওঠায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। আভাকে বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনের কার্ড দিতে গেছল অসীম, আধুনিক গানের দিন। আভা নেয়নি। বলেছিল, ”একা কোথাও যাওয়া দিদি পছন্দ করে না। দিদির কাছে থাকি, সুতরাং তার পছন্দ-অপছন্দ মেনে চলতে হবে তো।” অপ্রতিভ হয়ে অসীম বলেছিল, ”আমি পৌঁছে দেব, নিয়েও আসব আপনাকে।”
”না, দিদি ভীষণ স্ট্রিক্ট, একা কিছুতেই যেতে দেবে না।”
কথাগুলো হয়েছিল চার মাস আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। জয়রাম মিত্র লেন, তারক কবিরাজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে যেখানে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুয়ে পড়েছে, সেই মোড়ে। আভা তখন কলেজ যাচ্ছিল। কিন্তু শ্যামলের কাছে থেকে অসীম তিনদিন পরই শোনে, ”কিরে, কার্ড নিল না তো।” এবং শ্যামল জানায়, খবরটা সে বাড়িতে আলোচিত হতে শুনেছে মেয়েমহলে এবং শেফালি তখন হাজির ছিল।
”আপনাকে আর বলব কী, ঠিকই জেনে যাবেন।” অসীম মুখ তুলে বিরক্ত স্বরে বলল। ”যে এসেছে, তার মতো লোক এ গলির বাপের জন্মে ঢোকেনি, ঢুকবেও না।”
”কে, কে, নামটা বল নারে।” শেফালি হামা দিয়ে ঝুঁকে পড়ল।
অসীমের কী খেয়াল হল, নামটা চেঁচিয়ে বলল। শোনা মাত্র শেফালি লাফিয়ে উঠে ইলার বন্ধ জানলায় কিল মারতে মারতে চাপা চিৎকার শুরু করল, ”শিগগিরি খোল গো ইলা, পাড়ায় কে এসেছে দেখে যাও।”
এরপর অসীমের ইচ্ছা হল, খবরটা আভাকে দেয়। তিরিশের একের বাড়ির একতলার ঘরগুলির জানলায় গাঢ় খয়েরি পর্দা। পিছনে এবং উপরে তাকিয়ে, দেয়াল ঘেঁষে আস্তে চলতে চলতে অসীম তৃতীয় জানলায় একবার থমকে, পর্দার কিনারের ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাল। দেখল আভা টেবিলটার ধারে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে। চেয়ারে বসা হিরণ্ময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। ঘরে টেবিল ল্যাম্পের চাপা আলো।
দুই
”তোমার দিদি জানে?”
”না।”
”কোথায় গেছে?”
”বলে যায়নি, টিপুকে নিয়ে বেরিয়েছে। বোধহয় দর্জির দোকানে।”
হিরণ্ময় চুলের মধ্যে আঙুল ঢোকাল। মুঠোয় চেপে চুল টানল। অভ্যাসমতো আঙুলগুলো চোখের সামনে ধরে দেখল কটা চুল উঠেছে। কয়েকটা ফুঁ দিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। অ্যাশ-ট্রের উপর রাখা সিগারেট থেকে ধোঁয়া উঠছে পেনসিলের মতো সরু হয়ে। হিরণ্ময় তাকাল আভার দিকে। ধোঁয়ার স্তম্ভটি পাতলা হয়ে ভেঙে যাওয়ার জায়গাটিতে স্থির চোখে তাকিয়ে ও। হিরণ্ময় সিগারেটটা তুলে ঠোঁটে রাখল।
”তাহলে?” হিরণ্ময় বলল।
আভা ওর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বুক-কেসের দিকে তাকাল। অর্থনীতির লেকচারারের পড়ার ঘর। বই আর পত্রিকা ইতস্তত ছড়ানো। বুক-কেসের উপর ব্রোঞ্জের বুদ্ধের মাথা। ধুলোয় কালো হয়ে রয়েছে। তার পাশে একটি মাটির ফুলদানি। ফুল নেই। সরকারি এক কারুশিল্প বিপণি থেকে শোভা বছরখানেক আগে ও দুটো কিনে এনেছিল। প্রথম মাস-দুয়েক মুছত, ফুল রাখত। লম্বা সোফার বিপরীতে একটি ছোটো তক্তপোশ। পাতলা তোশকের উপর ঝালর দেওয়া গাঢ় খয়েরি খদ্দরের চাদর। তাতে পাখি উড়ছে আর তাই দেখার ব্যস্ত ছেলে কাঁধে এক গ্রাম্য বধূর গুটি ত্রিশ ছাপে ভরা চাদরটি। লিখতে লিখতে বা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে হিরণ্ময় তাকিয়া টেনে তক্তপোশে শোয়। কখনো বা সোফায় হেলান দিয়ে নিচু ছোট্ট টেবিলটায় পা তুলে দেয়। ছাত্ররা এলে সে চেয়ারে বসে। ওদের সোফায় বসতে বলে।
”এমন যে ঘটবে জানতুম।” হিরণ্ময় চশমাটা হাতে নিয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোর দিকে ধরল। জলের দাগ লেগে আছে। ধুতির খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ”তোমার কোনো দোষ নেই।” গলাটা সামান্য ধরা। কথা বলল চাপা গম্ভীর স্বরে। সাধারণত উত্তেজিত হলে ওর স্বর সরু হয়ে যায়।
”কেন, দোষ নেই কেন?” আভা যেন তর্ক করতে চায়। কিন্তু ভঙ্গিটা উৎকণ্ঠার।
”কীসের দোষ তোমার?” চশমাটা চোখে এঁটে স্পষ্ট করে হিরণ্ময় তাকাল।
আভা উত্তর দেবার জন্য কথা খুঁজছে। টেবিলের ধারে দাঁড়িয়েছে বলে হিরণ্ময় ওর নাভি থেকে ঊর্ধ্বাংশটুকু শুধু দেখতে পাচ্ছে। ভয়েলের ছাপা শাড়ির পাড় নেই। নাভির উপরটা সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে কাপড়ের কুচির জন্য। আঁচলের কিনারে কোমরের মসৃণ তেলতেলা চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। ভাঁটার সময় গঙ্গার পাড়ে যেমন ফেলে যাওয়া পলিতে ভাঁজ দেখা যায়। অমন ভাঁজ ওর গ্রীবাতেও দেখা যায়, যখন মুখটা ফিরিয়ে বা ঘাড় কাত করে থাকে। আভা বেশ লম্বা, বাঙালি মেয়েদের তুলনায়। কাঁধ দুটি পুরুষালি ঢঙে প্রশস্ত। ব্লাউজের গলার ঘের কাঁধের প্রান্তে এসে ঠেকেছে, পিঠে শিরদাঁড়ার চতুর্থ গ্রন্থিটিও দেখা যাবে যদি পিছন ফেরে। হাঁটলে, পুরুষমাত্রেই ওর নিতম্বে চোখ রাখতে বাধ্য হয়। ওর স্বাস্থ্যের দৃঢ়তা বিষয়ে যাবতীয় অনুমান দর্শকরা এইখান থেকে করতে শুরু করে এবং গলা পর্যন্ত পৌঁছে অভ্রান্তই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ওর থুতনি চাপা, গালের হনু উঁচু, ঠোঁট দুটি পুরু, মুখ গোলাকৃতি। চোখ দুটি বড়ো হওয়ায় মাত্রা-হারানো ভাব সারা মুখে।
”দোষ আমার, যেহেতু আমি বিবাহিত। স্ত্রী ছাড়া অপর কোনো স্ত্রীলোকের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার অধিকার আমার নেই। হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপন অপরাধ, দেহ স্পর্শ করা পাপ। অথচ তিনটি অন্যায়ই আমি করেছি। সুতরাং আমি দোষী নয়তো কী?”
হিরণ্ময় থেমে থেমে এমনভাবে বলল, যেন ক্লাশের ছেলেমেয়েদের নোট দিচ্ছে-লিখে নিতে অসুবিধা না হয়।
”ভালো কথা, তুমি কি সিওর যে-” হিরণ্ময় অসমাপ্ত রাখল।
”হবার তারিখ ছিল ফিফথ।” আভা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে হিরণ্ময়ও। সমুদ্রতীরে জেলে-ডিঙি, ঝাউবন এবং আবছা কয়েকটা মূর্তি ক্যালেন্ডারে। দিন গুণতে গুণতে মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল হিরণ্ময়ের মুখ।
”আজ টোয়েন্টি ফিফথ, এতদিন বলোনি কেন?”
”ভেবেছিলাম-” আভা মাথা নামিয়ে রাখল।
”কী ভেবেছিলে?”
”এমন তো আগেও হয়েছে দু-একবার। ছ’দিন, সাতদিন পর্যন্তও দেরি হয়েছে।” আভা ফিস ফিস করে বলল। ডান হাতে টেবিলের প্রান্ত আঁকড়ে ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। আঙুলগুলোয় উত্তেজনার প্রবাহ স্পষ্টই দেখতে পেল হিরণ্ময়। ”আচ্ছা, আপনার যে একজন ডাক্তার বন্ধু আছে, সে তো ব্যবস্থা করে দিতে পারে!”
আভা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে। কথাটির প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটা আদ্যপ্রান্ত সে দেখতে চায়। আভাকে তার মনোভাব বুঝতে না দেবার জন্য হাত বাড়িয়ে হিরণ্ময় বুদ্ধ-মস্তকটি তুলে নিল। হিমাংশুকে বললে ব্যবস্থা করে দেবে। একটা করুণ, শোচনীয়, বিয়োগান্ত গল্প বানিয়ে বললেই হবে। হিমাংশু আর্ত-আতুরকে সেবার সুযোগ পেলে ছাড়ে না।
কিন্তু আমি তো জানতামই। আমি তো বহুদিন আগে, একমাস, ছ’মাস, এক বছর আগে থেকেই জানতাম কিছু একটা ঘটবে। হিরণ্ময় বুদ্ধের মাথার ধুলো তর্জনী দ্বারা মুছতে মুছতে ভাবল। তোমার কোনো দোষ নেই আভা। আমি অপেক্ষা করেছি বহুদিন কিছু একটা ঘটাবার জন্য। কারণ আমি হাঁফিয়ে পড়েছি। আমি বদল চাইছিলাম এই নিত্যদিনের একঘেঁয়েমির থেকে। যখনই কলকাতায় কোনো কারণে পুলিশ গুলি চালায়, আমি রাস্তায় বেরিয়ে যেতাম এই আশায় একটা গুলি যদি গায়ে লাগানো যায়। তাহলে বেঁচে যেতাম রোজ এই চেয়ারে বসে ছাত্র-পাঠ্য বই লেখার দায় থেকে। ও-ঘরের বিছানাটায় শোবার দায় থেকে। ক্লাশে দম দেওয়া পুতুল হওয়ার দায় থেকে। আভা, আমি তৈরিই ছিলাম কিছু একটা ঘটাবার জন্য।
”না, হিমাংশুর কাছ থেকে এরকম ব্যাপারে সাহায্য নেওয়া যায় না। ও আমাকে শ্রদ্ধা করে খুব।”
”তাহলে?” ভয় এবং যন্ত্রণা, একসঙ্গে আভার মুখের চামড়া টেনে ধরল। লাল ঢাকনা মোড়া টেবিল ল্যাম্পের আলো থুতনির নীচে গাঢ় অন্ধকার তৈরি করে মুখটাকে কঠিন করে দিয়েছে। হিরণ্ময়ের মনে হল, মেয়েটি মোটেই যেন আবেগপ্রবণ নয়।
”তাহলে আর কি।” বুদ্ধের মাথাটি বুক-সেলফের উপর যত্ন ভরে বসিয়ে দিয়ে হিরণ্ময় লক্ষ করতে লাগল।
”যখন সবাই জানবে, দিদি জানবে? তখন আপনার কি হবে?”
”কিছু একটা নিশ্চয় হবে, সেটা এখনও জানি না।”
”আমি তো হতে দেব না।”
”কীভাবে?”
”চলে যাব এখান থেকে।”
”কোথায়, বাবা-মার কাছে?”
”জানি না কোথায় যাব। তবে শেষ পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ার কী ছাদ থেকে ঝাঁপ দেবার পথ তো খোলাই আছে।”
”আমিও তাই করব।’
শোনামাত্র আভা নিজের মুখগহ্বর তালু দিয়ে বদ্ধ করে দিল। তবু একটা ক্ষীণ শব্দ হিরণ্ময় শুনতে পেল।
”না, লক্ষ্মীটি না। এমন চিন্তা কোরো না।” আভা টেবিলে অনেকখানি ঝুঁকে বলল।
হিরণ্ময় হেসে উঠল নিঃশব্দে।
”বিবাহিতদের এমন চিন্তা করারও অধিকার নেই। তাহলে স্ত্রী-পুত্রের কী দশা হবে, তাই না?”
এরপর আভা মুখ নিচু করে দু’ হাতে টেবিলে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করল। হিরণ্ময় উঠে দাঁড়াবার আগেই সে হাঁটু গেড়ে বসে টেবিলের পায়া জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠল বিকৃত স্বরে।
”আমি শত্রুতা করেছি নিজের দিদির সঙ্গে। আমি জানি, দিদির সর্বনাশ করেছি, আমার জন্যই ছারখার হল এ সংসার। আমি মুখ দেখাতে পারব না আর।”
”ওঠো, ওঠো। এটা বাইরের ঘর। রাস্তা থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে, ওঠো।” বিরক্তি চাপার চেষ্টা করতে করতে হিরণ্ময় ধমক দিল।
আভা টেবিলের পায়ায় মাথা ঘষতে শুরু করেছে একগুঁয়ের মতো। হিরণ্ময় জানলার পাল্লাগুলো বন্ধ করে এসে বলল, ”ও ঘরে চলো।”
”আমার জন্য তোমারও মান-মর্যাদা রইল না।”
”আগে উঠে দাঁড়াও।” তীব্রস্বরে হিরণ্ময় বলল। এইবার সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
আভা গ্রাহ্যে আনল না সে তীব্রতা। ”কিন্তু আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না তোমার সম্মান। আমি দুঃখ দেব না দিদিকে।”
হিরণ্ময় নিচু হয়ে আভাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। এবং পারল না। দেহে যে পরিমাণ শক্তি থাকলে এ কাজে সফল হওয়া সম্ভব, তা নেই বুঝতে পেরে একটা হিংস্র রাগে তাকে পেয়ে বসল। বগলের নিচ দিয়ে আভাকে দু’ হাতে জড়িয়ে সে আবার টানল ওকে দাঁড় করাবার জন্য। কুঁজো হয়ে টেবিলের পায়া আঁকড়ে আভা শরীরটাকে শক্ত করে রেখেছে।
”ওঠো, ওঠো বলছি।” আভার কানের কাছে মুখ রেখে হিরণ্ময় অক্ষম রাগে চাপা চিৎকার করল। আবার ওকে টেনে তোলার জন্য সে নিজেকে ধনুকের মতো বাঁকাল। দম বন্ধ করে, আভাকে দু’ হাতে বেড় দিয়ে সোজা হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করে এবারও পারল না। আভাও হাঁফাচ্ছে। দশটা আঙুলকে বেঁকিয়ে থাবার মতো করে হিরণ্ময় ওর বুকের কোমল মাংসে বসিয়ে উপড়ে ফেলার জন্য টেনে ধরল। সারা শরীর অন্ধ জেদে টনটন করছে। নিশ্বাস ফেলে আবার বুক ভরে নিল। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু একটিই কথা-ভাঙব, ওর অবাধ্যতা আমি ভাঙবই। ধীরে ধীরে সে মোচড়াতে শুরু করল তার থাবা দুটো। একটু একটু করে আভার মুখ ঊর্ধ্বমুখী হল। যন্ত্রণায় ঠোঁট দুটি ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। তারপর জিভ দেখা গেল। গলার দুটো পেশি দড়ির মতো পাকিয়ে উঠল আর চোখের কোল বেয়ে জল কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামল। এবং আরও জোরে সে আঁকড়ে ধরল টেবিলের পায়াটা।
হিরণ্ময় ওকে ছেড়ে দিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল। কপালে চিটচিটে ঘাম ফুটেছে। দপদপ করছে রগের শিরা দুটো। নিজেকে তার মনে হচ্ছে অক্ষম, দুর্বল, পরাভূত। শুধুমাত্র গায়ের জোরে আভা তাকে অগ্রাহ্য করতে পারল। আভা টেবিলের পায়ায় কপাল ঠেকিয়ে কাঁদছে। টেবিল ল্যাম্পের চাপা আলোয় ওকে দেখতে দেখতে হিরণ্ময়ের মনে হল একটা কুকুর টেবিলের পায়া ধরে দাঁড়িয়ে কুঁই কুঁই করছে।
নিজের উপর সে হঠাৎ রেগে উঠল। বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরে এসে, চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল খাটে। আলো থেকে চোখ আড়াল করতে ডানবাহু চোখের উপর রাখল। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, সম্মান, মর্যাদা, দুঃখ! আশ্চর্য নির্বোধ! আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখাতে ট্রেনে কাটা পড়বে! যদি বলি এই মুহূর্তে ছাদ থেকে ঝাঁপ দাও, নিশ্চয় দেবে। পাড়ার লোকগুলো অমনি পিলপিল করে পিঁপড়ের মতো এসে ওকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াবে। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ঘাড়গুলো শুঁড়ের মতো নাড়াবে। আর আভার থেঁতলানো দেহ থেকে ছিটকানো রক্ত এত লাল কেন তাই নিয়ে বলাবলি করবে। আভা মরার আগে ওদের শুনিয়ে স্বীকারোক্তি দেবে-পাঁচিলে ঝুঁকতে গিয়ে ভার সামলাতে পারিনি। তারপর পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স আসবে। হাসপাতালে পোস্ট-মর্টেম করা হবে এবং তখন জানা যাবে-”ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো।”
আভা পর্দা সরিয়ে ঘরের ভিতর এল। হিরণ্ময় আপাদমস্তক দেখল ওকে। শোভার থেকে আট বছরের ছোটো। একই উচ্চচতা, একই গড়ন, একই রঙ দুজনের। শুধু আলাদা হয়ে যায় চুম্বনের সময়, চাহনিতে, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষেপণে, দেহের তাপে।
”আমাকে-” আভা দ্বিধায় থেমে রইল। কিছু চুল ওর গালে লেপটে রয়েছে। ব্লাউজটা কুঁকড়ে কোমর থেকে উঠে গেছে খানিকটা। চওড়া কাঁধ যেন ঝুলে পড়েছে। ওকে দেখাচ্ছে ভগ্নস্তূপের মতো।
”বলো”। ধীর মৃদু হবার চেষ্টা করল হিরণ্ময়।
”আমাকে আর তুমি ভালোবাসবে না নিশ্চয়।”
”কেন!”
”ক্ষতি করলাম।”
”আগের থেকেও এখন বেশি ভালোবাসব।”
আভার মুখের উপর বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। বোধহয় বিশ্বাস করছে না। হিরণ্ময় মমতা বোধ করল ওর জন্য। পোস্ট-মর্টেম থেকে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জানা যাবে। সবাই তখন বুঝবে এটা আত্মহত্যা। কিন্তু এজন্য কে দায়ী সেটা জানা যাবে না। তাকে ধরা যাবে না। হিরণ্ময় টের পেল, তার মনের কোথাও যেন একটুখানি স্বস্তি দানা বাঁধল। তাইতে সে এই বলে নিজেকে বোঝাল-আর পাঁচজনের মতো তাহলে আমিও নিরাপদে বাঁচতে চাই! সব মানুষের মধ্যেই জানোয়ার আছে, আমিও বাদ নই।
তাহলে গুলি খাবার জন্য রাস্তায় বেরোই কেন? হিরণ্ময় পরমুহূর্তেই এলোমেলো হতে শুরু করল। মরতে চাওয়া এবং বাঁচার ইচ্ছার মধ্যে কোনটি খাঁটি। শোভা একটা সরল অঙ্কের ছকের মধ্যে এসে গেছে। ধাপে ধাপে নেমে যাবে নির্ভুলভাবে। স্বাভাবিক একটা গেরস্ত উত্তরও পাওয়া যাবে। উত্তরমালা খুলে শুধু মিলিয়ে নেওয়া। আভা অন্য কিছু। ওর অঙ্কটাই প্রশ্নমালায় নেই। পাঁচজনের মতো নিরাপদে বা জানোয়ার-বোধ দিয়ে এ অঙ্কের উত্তর মেলানো যায় না। সারাজীবনই কষে যেতে হবে শুধু। হঠাৎ এমন এক উটকো অঙ্কে কেন হাত দিলাম।
সব মিলিয়ে হিরণ্ময় যখন একটা ফর্মূলা তৈরি করার চেষ্টা করছে তখন আভা বলল, ”দিদি আপনাকে খুব ভালোবাসে।”
”জানি।”
”যদি জানতে পারে?”
”জানবে। আমিই ওকে সব বলব।”
”সে কি!” আভা দ্রুত কাছে এল হিরণ্ময়ের। ”না, কিছুতেই না। তাহলে দিদিকে আমি জ্যান্ত মুখ দেখাতে পারব না।”
মাত্র এক হাত উপরে ঝুঁকে রয়েছে মুখটা। হাত বাড়িয়ে কপাল, গাল অথবা চিবুক স্পর্শ করা যায়। হিরণ্ময়ের মনে হল, আর বোধহয় নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। আভাকে বুকের উপর চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠবে কিংবা টানতে টানতে ছাদের পাঁচিলের কিনারে নিয়ে যাবে ঠেলে ফেলে দেবার জন্য।
”বড্ড ছেলেমানুষ তুমি আভা। এভাবে ব্যাপারটার সমাধান হয় না। আত্মহত্যা আমিও তো করতে পারি। কিন্তু তাতে অপমানের হাত এড়াতে পারব মাত্র। কেউ হয়তো বড়োজোর বলবে, লোকটার প্রবল আত্মমর্যাদা বোধ ছিল। তুমিও বোধহয় আমার প্রতি আনুগত্য দেখাতে কিছু একটা করে বসবে। কিন্তু এসব করার জন্যেই কি আমরা ভালোবেসেছি?”
”আমি যদি মুখ ফুটে না জানাতাম, হিরণ্ময়, তোমায় আমি ভালোবাসি, তাহলে ব্যাপারটা এই পর্যন্ত গড়াত না।” কথাগুলো আভা কাঁপা গলায় বলল। হিরণ্ময়ের নাম উচ্চচারণের সময় ওর ভিতরটা প্রতিবারই নড়ে ওঠে।
”একটা কিছুতে গড়াত।” হিরণ্ময় আনমনা হয়ে গেল সামান্য। যেভাবে ক্লাসে চাহিদা ও জোগান তত্ত্ব বোঝায়, সেই ক্লান্ত স্বরে থেমে থেমে বলল, ”একটা কিছু ঘটাবার জন্য আমি অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বুঝছি না, কেন আমি তা চাই। বাঁচার জন্য না মরার জন্য, সেটা বুঝছি না।”
রাস্তায় জানলার কাছে টিপুর গলা শোনা গেল। সদর দরজায় খিল দেওয়া। কড়া নাড়ার শব্দ হল। ঠাকুর রান্নাঘর থেকে গিয়ে খিল খুলে দিল। টিপু বাড়ি ঢুকতে চাইছে না। শোভার ধমক শোনা গেল সদরের দরজায়।
আভা ফ্যাকাশে মুখে হিরণ্ময়ের দিকে তাকাল। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার আগে চাপা স্বরে শুধু বলল, ”আমি তোমাকে মরে যেতে দেব না।”
হালকা চটির শব্দ ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে থেমে রইল। শোভা এসেছে। হিরণ্ময় প্রাণপণে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ”কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে রইলে!”
”আসব?”
”তার মানে!”
হিরণ্ময় সত্যিই অবাক হল এবং সেই সঙ্গে বুঝতে পারল স্নায়ুগুলো, হঠাৎ প্রখর আলোয় ধাঁধানো চোখের মতো অনুভবরহিত হয়ে পড়েছে। শোভা কি জানতে পেরেছে? জানার পর লক্ষ করে যাচ্ছে? নিশ্চয় তুমুল একটা কিছু করবার জন্য তৈরি হচ্ছে। বিশ্রী কুৎসিত একটা নাটক। রাস্তার জানলায় দর্শক জমবে, মনে মনে তারা হাততালি দিতে দিতে এনকোর এনকোর বলবে। দৃশ্যটি চকিতে ভেসে উঠল হিরণ্ময়ের চোখে। নিজেকে সে বলল, তার আগে আমিই ওকে সব জানাব। ওকে চিৎকার করার সুযোগ দেব না। ওকে বলব, কেন আমি আভার সর্বনাশ করেছি।
চোয়াল কঠিন করে হিরণ্ময় বলল, ”ভেতরে এসো, তোমাকে একটা খবর দেব।”
”সে খবরটা আমিও জানি!” পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল শোভার মুখ। ”রাস্তায় বেশ ভিড় জমে গেছে। আশ্চর্য, ওই টিচারের বাড়িতে আসবে ভাবতেই পারিনি। আভা কোথায়, ওর তো ফেবারিট হিরো।”
তিন
জয়রাম মিত্র লেনের এক থেকে ত্রিশ নম্বর পর্যন্ত চুয়াত্তরটি বাড়ির রঙই পাণ্ডুর, কলিচটা। প্রায় দুশোটি উনুনে আঁচ পড়ে প্রতি ভোরে। অধিকাংশ বাড়ির পলেস্তারা খসে জিরজিরে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। এই গলিতে ভোটার সংখ্যা সাতশো, খবরের কাগজ রাখে বত্রিশটি, বছরে বিয়ে হয় গড়ে তিনটি, শ্রাদ্ধ তিনটি, অন্নপ্রাশনও তিনটি। সাতটি আস্তাকুঁড়ে, একটি টিউবওয়েল, রাস্তার আটটি ইলেকট্রিক বাতি, একটি খাটাল, একটি পাঠশালা, গুটি পঞ্চাশ রেডিয়োর শব্দ এবং কমপক্ষে পঞ্চাশটি শিশুর চিৎকার জয়রাম মিত্র লেন দিয়ে হেঁটে গেলে চোখে বা কানে আসবে।
তারক কবিরাজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে গলির দিকে তাকালেই চোখে পড়বে তিন নম্বর বাড়ির ছাদে ভাঙা-ট্যাঙ্কের পাশে অশ্বত্থ গাছটাকে। ওটা বাড়তে চাইলেই ও-বাড়ির ভাঁড়ু বা হাবু লাঠি-পেটা করে ডালগুলো ভেঙে দেয়। ফলে গাছটা বাড়তে না পেরে ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। শিকড়ের ঝুড়ি নেমেছে দোতলা পর্যন্ত। বৃষ্টি জলের পাইপগুলো রাস্তা পর্যন্ত নামানো, কিন্তু ছেলেদের বলখেলার ধকল সইতে না পেরে সবকটিরই তলার অংশ ভাঙা। বহু বাড়ির জানলার পাল্লা লটপটে বুক পকেটের থেকেও অর্থহীন-ঝড়, বৃষ্টি, রোদে সামাল দিতে পারে না।
জয়রাম মিত্র লেনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে হলে মুখটাকে তুলতে হয় যতক্ষণ না ঘাড়ে টান পড়ে। সূর্যকিরণ একমাত্র গ্রীষ্মে ছাড়া রাস্তা স্পর্শ করতে পারে না। সারা বছর স্যাঁতস্যাঁতে, ভ্যাপসা গন্ধ গলিতে অনড় হয়ে থাকে। নতুন মানুষরা ঢুকলেই অনুভব করে, দেড়শো বছরের বন্ধ সিন্দুকের ডালা যেন খুলে গেল। তারা কৌতূহলে এপাশ-ওপাশ তাকাতে তাকাতে পথ চলে। পাড়ার বৃদ্ধদের সন্দিগ্ধ চোখ দেখে দ্রুত হয়ে যায়।
অনন্ত সিংহের মেয়ে পুতুল ষোলোয় পড়েছে! দুবছর আগে, ক্লাস সিক্সে ওঠামাত্র স্কুল ছাড়িয়ে ওকে সংসারের কাজে লাগানো হয় অনন্তের নির্দেশে। সেই সময় থেকে পাত্রের সন্ধান করে করে অবশেষে আহিরিটোলার শীলেদের পঞ্চম পুত্রটির খোঁজ পেয়ে অনন্ত দ্রুত কথা চালিয়ে ব্যাপারটা প্রায় পাকা করে এসেছে। ছেলেটি দু’বার স্কুল ফাইনালে ব্যর্থ হয়ে পৈতৃক হার্ডওয়ার দোকানে বসছে। ত্রিশ হাজার টাকা যৌতুক পেলে আলাদা দোকান করবে বরানগরে। অনন্ত ত্রিশ হাজারকে পনেরো হাজারে এবং দশ ভরি গহনাকে আট ভরিতে নামাতে পেরেছে ছয় মাসে। পাত্রের বাড়ির মেয়েরা পুতুলকে দেখে গেছে। আজ আসবে পাত্র তার দুই বন্ধুকে নিয়ে। মাসখানেক আগে অনন্ত কলি ফিরিয়েছে বাড়ির। দেখলে মনে হয় গলিটার কপালে শ্বেতি হয়েছে।
ঝকঝকে নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা যে টিউবওয়েলের ধারে রাখা হয়েছে, সেটি অনন্তর সদর দরজারই লাগোয়া। টিউবওয়েলটি এখানে বসানোর ব্যাপারে ওর সঙ্গে বাসুদেব ধরের প্রচণ্ড একচোট হয়ে গেছল। কুমার চৌধুরী কাউন্সিলর হয়েছে তারই কৃপায়, এরকম একটা ধারণা অনন্ত বরাবরই পোষণ করে আসছে।
পাড়ার প্রাচীন এবং বনেদি বাড়ি হিসাবে সিঙ্গি বাড়ি জয়রাম মিত্র লেনে বিদিত। তিনতলায় গোপীনাথ জীউয়ের বিরাট ঘর। তার মেজে শ্বেতপাথরের। পালা পার্বণে অনন্ত খরচ করে। এখনও পাড়ায় যে তিন-চারটি বাড়িতে বৈঠকখানা আছে, তার মধ্যে বৃহত্তমটি অনন্তের। চারটি নিচু তক্তপোশের উপর শতরঞ্চি পাতা। দেয়ালে পাগড়ি মাথায় ওর ঠার্কুদা পূর্ণচন্দ্র এবং তার ভাই নারায়ণচন্দ্রের তেলরঙা প্রতিকৃতি। ধুলায় বিবর্ণ। এক বাণ্ডিল কোম্পানির কাগজ এবং চারটি বাড়ি দিয়ে যায় পুত্র গৌরচন্দ্রকে। বছর দশেকের মধ্যে তার অর্ধেক ফুঁকে দিয়ে যৌনব্যাধিতে ভুগে দুই পুত্র অনন্ত ও দুলালকে রেখে গৌরচন্দ্র মারা যায়। বাবা মারা যাবার আট মাসের মধ্যেই সম্পত্তি ভাগ করে অনন্ত ও দুলাল আলাদা হয়ে যায়।
তেইশ নম্বরের ভিতরের অংশে থাকে দুলাল। পিতার দোষগুলি সে পূর্ণ মাত্রায় আয়ত্ত করে দুখানি বাড়িই বিক্রি করে দিয়েছে। এখন সন্ধ্যা থেকেই দিশি মদের দোকানে বসে থাকে। অপরপক্ষে, অনন্ত পৈতৃক সম্পত্তি পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করে, নিজে একটি বাড়ি কিনেছে, শেয়ার বাজারে দালালি থেকে অর্জিত অর্থ, তিনটি বাড়ির ও চারটি রিকশার ভাড়া এবং তেজারতি ও বন্ধকি কারবার থেকে মাসে তার যা আয়, তাতে জয়রাম মিত্র লেনের মধ্যে ধনী হিসাবেও সে খাতির পেয়ে থাকে।
কাজেই ইলেকশনের সময় কুমার চৌধুরী এ পাড়ায় প্রথম অনন্তর কাছেই এসেছিল। ওকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ার প্রতি বাড়িতে যায়। শুধু ছাব্বিশ নম্বর বাড়িটি ছাড়া। বাসুদেব ওর বাল্যবন্ধু কিন্তু বাক্যালাপ বন্ধ যৌবন থেকেই। কুমার সতেরো ভোটে জিতেছিল। বৈঠকখানায় তাকিয়া কোলে নিয়ে দুলতে দুলতে অনন্ত বলেছিল, ”আমি না বেরোলে ওই সতেরোটা ভোট পেত কি?”
তাই শুনে সত্যচরণের চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল। বিস্ময় দমন করে এক সময় বলতে পারল সে, ”সিঙ্গিমশাই যার হয়ে নিজে ক্যানভাস করছেন, সে জিতবে না তো কে জিতবে! এগেনস্টে নেহরু দাঁড়ালেও যে হেরে যাবে। সামনের বার আপনিই বরং দাঁড়ান, কমপক্ষে দু’হাজার ভোটের মার্জিনে জিতবেন।”
অনন্ত অপ্রতিভ হয়ে বলে, ”না না, এসব ঝামেলায় আমি যেতে চাই না। পাবলিক ওয়ার্ক বড়ো কঠিন কাজ সত্য, বড়ো কঠিন কাজ। ভালো করলেও ব্যাটা চোর, খারাপ করলেও ব্যাটা চোর। এ হচ্ছে শাঁখের করাত।”
কিন্তু শাঁখের করাত, অনন্তর মনের মধ্যে তারপর থেকে প্রতিদিনই একটি কথা কেটে চলেছে-”কমপক্ষে দু’হাজার ভোটের মার্জিনে জিতবেন।” পাড়ায় পাড়ায় কুমারের খাতির, বৈঠকখানা ভর্তি অনুগ্রহপ্রার্থীদের দেখে মাঝে মাঝে লোভ হয় অনন্তের। নিজের পাড়ার বাইরে কেউ তাকে চেনে না, পাত্তাও দেয় না। ইদানীং সেটা বেশি করে সে বুঝেছে। গত বছর সার্বজনীন পুজোর জেনারেল মিটিংয়ে সত্যচরণ সহ-সভাপতি পদে অনন্তর নাম প্রস্তাব করেছিল। বাসুদেব বানচাল করে বেপাড়ার এক আগরওয়ালার নাম ভোটে পাশ করিয়ে নেয়।
তাছাড়া আর একটি কারণ অনন্তর অবচেতনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে, যেটা সে কোনোক্রমেই তুলে ফেলতে পারেনি। কুমার চৌধুরীর বাবা ভুবনের ছিল সাইকেল সারাই ও ভাড়ার দোকান। স্কুল পালিয়ে অনন্ত এক আনা ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া নিয়ে সাইকেল চালানো শিখত। সহায়ক ছিল বাসুদেব। অনন্ত সাইকেলে বসত, এক হাতে সিট আর অন্য হাতে হ্যান্ডেল ধরে বাসু নির্দেশ দিতে দিতে ছুটত-”চাকার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? ম্যাড়া কোথাকার, সামনে তাকা…..ব্রেক কর গাধা, ব্রেক কর…আরে রাঙামূলো বেলটা আছে কী করতে, বাজা, বাজা।”
কয়েকদিন পর হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়েই বাসু ছুটত। তারপর চুপিসারে সিট ধরা হাতটাও ছেড়ে দিত মাঝে মাঝে। অনন্ত যখন ব্যাপারটা বুঝত অমনি হাত কেঁপে বেটাল হয়ে পড়ে যেত। বাসু সামনের উঁচু দাঁত দুটো বার করে হাসত, ”অমন টুকটুকে গতর নিয়ে কী আর সাইকেল শেখা হয়রে ব্যাটা। এবার আমায় দে দেখি।” বলেই তড়াক করে সাইকেলে উঠে পাঁই পাঁই চালিয়ে উধাও হয়ে যেত বাসুদেব। ওদের চুক্তিই ছিল, প্রথম আধঘণ্টা অনন্ত সাইকেল শিখবে, শেষ আধঘণ্টা বাসুদেবের। ভাড়ার পয়সা অবশ্য অনন্তের। বাসু আধঘণ্টায় ধর্মতলা কী শেয়ালদা কী কাশিপুর ঘুরে আসত। সেন্ট্রাল অ্যাভিনু তখন কয়েক বছর মাত্র তৈরি হয়েছে। এত মোটর, ট্রাক, মানুষজনের ভিড় তখন ছিল না।
একদিন বাসুদেব ফিরল পিছনের মাডগার্ডটা তুবড়ে। সাইকেলটা অনন্তের হাতে গছিয়ে দিয়েই বাসুদেব সটকে পড়ে। ভুবন দেখামাত্র আট আনা ফাইন চেয়ে বসে এবং না পেলে অনন্তর ঠাকুর্দার কাছ থেকে আদায় করে আনবে বলে হুমকি দেয়। পূর্ণচন্দ্রের বয়স তখন ঊনসত্তর। বদরাগী, রাশভারী। কয়েকদিন আগেই চার টাকার বদলে সাড়ে চার টাকার গামছা কেনার জন্য লাঠি হাতে দুই সন্তানের পিতা গৌরচন্দ্রের দিকে তেড়ে গিয়ে বলেছিল, ”রক্ত জল করা পয়সা আমার, আর বাবুয়ানি করে ফুঁকে দেওয়া হচ্ছে?” এমন লোকের কাছে আট আনা এবং পৌত্রের পিঠের চামড়া সমান বস্তু।
অনন্ত ভয়ে কেঁদে ফেলে। তাই দেখে হঠাৎ নরম হয়ে গেল ভুবনের মন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে ওকে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেল ভুবন। ন-দশ বছরের কুমার বসেছিল দোকানের মধ্যে। তাকে ধমক দিয়ে বার করে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। অনন্ত যখন বেরিয়ে এল তখন বাসুদেব দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কুমারের সঙ্গে। অনন্তকে দেখে মিটমিট হেসে বলল, ”ফাইন শোধ হয়ে গেছে তো, ব্যস। এবার থেকে তোর ভাড়ার পয়সাও আর লাগবে না।” শুনে কুমারও হেসে ওঠে।
ওইদিন থেকেই অনন্ত চটতে শুরু করে বাসুদেবের উপর। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না। বাসু যদি ব্যাপারটা রটিয়ে দেয়, লজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না। তারপর পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে। ভুবন মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানও উঠে যায়। কুমার এখন দু’শো টাকা ফি-এর উকিল। ওকে দেখলেই অনন্তর মনে পড়ে, দোকান থেকে বেরোবার আগে কেমন অদ্ভুতভাবে ও তাকিয়েছিল তাদের দুজনের দিকে আর হেসেছিল। নিশ্চয় বুঝেছিল ব্যাপারটা। এখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে আর ভেতরে দুঃসহ জ্বালা বোধ করে অনন্ত। ইলেকশনে দাঁড়িয়ে কুমারকে হারিয়ে দিতে পারলে বোধহয় কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে-এই চিন্তা তখন জেঁকে বসে।
কিন্তু কুমার তাকে যথোচিত সমীহ ও সম্ভ্রম দেখায়। কুমারের নির্দেশে, তার সদর দরজার মাথায়ই রাস্তার আলো লাগানো হয়েছে। তাই নিয়ে বাসুদেব গণ-দরখাস্ত সংগ্রহ করে প্রতিবাদ পাঠিয়েছিল কমিশনারের কাছে। টিউবওয়েলও বসেছে অনন্তর বাড়ির লাগোয়া।
”কর্পোরেশন কি কারুর বাপের সম্পত্তি।” টিউবওয়েল বসাবার সময় বাসুদেব চিৎকার করেছিল পাড়ায় দু-তিনজনকে দাঁড় করিয়ে। ”দেখুন, কোথায় বসানো হচ্ছে দেখুন। এখানে টিউবওয়েল বসলে পাড়ার একটা বাড়ি ছাড়া আর কার লাভ হবে, বলতে পারেন? সকলের বেনিফিটের কথাটা ভাবুন একবার। আমরা কি ট্যাকসো দিই না? ধরুন, হঠাৎ কারুর রান্নার জল ফুরিয়ে গেল, বাড়িতেও তখন কোনো পুরুষ কি ছোটো ছেলেপুলে নেই যে দৌড়ে এক বালতি জল এনে দেয়। এমন অবস্থা হতে তো পারে? বলুন, আপনারই বলুন, তখন কি বাড়ির মেয়েরা এত দূরে এসে কল থেকে পাম্প করে জল নিয়ে যাবে? যুবতী মেয়েও তো অনেক বাড়িতে রয়েছে, তারা কি এখানে আসবে জল নিতে?”
বাসুদেবের কথা শুনে একজন বললে, ”পাড়ার আরও ভেতর দিকে বসলেই ভালো হত, বেপাড়ার লোক এসে দিনরাত জল নিয়ে নিয়ে কলটা খারাপ করে দিতে পারবে না।”
আর একজন বলল, ”ভিতরের বসাবার স্থান কোথায়! কল বসলে রিকশাও আর যাইতে পারবো না। এখানে রাস্তাটা চওড়া, ঠিকই বসানো হচ্ছে। রাত্রদিন খ্যাচাং খ্যাচাং শব্দ আর জলকাদায় রাস্তা মাখামাখি হয়ে তো থাকব, বরং বাইরের দিকেই বসানো ভালো। পিপাসা পাইলি বাইরের লোক এসে খ্যায়া যেতে পারবো।”
”দেখুন মশাই, আপনাদের মাথায় মেয়েদের প্রেস্টিজ জিনিসটা একদমই আসে না। আপনাদের মেয়েরা যেটা অনায়াসে পারে, ওয়েস্ট বেঙ্গলের মেয়েদের সেটা করতে বাধে। টিউয়েলটা এখানে বসানো কেন উচিত নয়, সেটা অন্য পয়েন্ট থেকে দেখছি আমরা, আপনি আর কথা বলতে আসবেন না।” বাসুদেব এক বেঁটেখাটো নিরীহদর্শন লোকের নাকের কাছে ঘন ঘন হাত নাড়ল চপেটাঘাতের ভঙ্গিতে। এরপর দেখা গেল পাড়ার এক-চতুর্থাংশ বাসুদেবের বিরুদ্ধে চলে গেছে এবং টিউবওয়েলও অনন্তের সদরের পাশেই বসেছে।
প্রথম জল নেয় সত্যচরণ। টিউবওয়েলকে স্নান করিয়ে চারপাশের তিন হাত পর্যন্ত রাস্তা জল দিয়ে ধুয়ে বালতি পাতার আগে সে চেঁচিয়ে বলেছিল, ”যুবতী মেয়েদের জন্য ভেবে ভেবে তো আমাশা হয়ে গেল ব্যাটার। নিজের মেয়ের কী হল সেটা খোঁজ কর আগে।”
বাসুদেব কথাগুলো স্বকর্ণে শোনেনি। গল্পচ্ছলে শেফালি বলে আসে বাসুর বউকে এবং সত্যচরণ দোতলার পিছন দিকে লুকিয়ে একটা পায়খানা করেছে সে তথ্যও জানিয়ে দিল। বাসুদেব দ্রুত কর্পোরেশনে বেনামা চিঠি দিয়ে সত্যচরণের একশো টাকা খসিয়ে দেয়। রাগটা তাতে অনেকখানি কমে।
অনন্ত এই সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে দেখল, সদরের অর্ধেক আড়াল করে একটা ঝকঝকে নীল মোটর দাঁড়িয়ে। সুতরাং চিৎকার করল, ”গাড়ি কার, অ্যাঁ রাখার কি আর জায়গা পেল না। এটা লোকের বাড়ির সদর সেটা খেয়াল হল না।”
”কী হয়েছে অত চেঁচাচ্ছেন কেন?”
পা টেনে টেনে অসীম এগিয়ে এল। ওর গম্ভীর গলা, যেটা-‘চুপ কর শালা’ বলার সময় প্রয়োগ করে-শুনে অনন্ত থতমত হল। আঠারোর-সি-র দ্বারিক চক্রবর্তী অর্থাৎ ভোম্বল দোতালার জানলা থেকে উঁকি দিল।
”আমিই বলেছি ওখানে রাখতে। পাড়ার মধ্যে মোটর রাখার আর জায়গা কোথায়? যা একখানা গলি। রিকশা ছাড়া আর কিছুতে চড়া মানুষ তো কোনো জন্মে ঢোকেনি। অসুবিধে হয় তো একটু ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছি বরং।”
”একটু পরেই পুতুলকে দেখতে আসবে তো। তাই বলছিলুম”, অনন্ত কণ্ঠস্বর মোলায়েম করে বলল, ”কে এল অসীম, কার বাড়িতে?” ফ্যালা নামে ডাকার ভরসা হল না তার।
উত্তর পেয়ে অনন্ত অবাক হয়ে মোটরটার দিকে তাকিয়ে রইল। অসীম চলে যাচ্ছে একটু খুঁড়িয়ে। অনন্ত ব্যস্ত হয়ে বলল, ”হল কী পায়ে?”
”চোট লেগেছে।” অসীম মুখটুকুও ফেরাল না।
”চিকিৎসা করাচ্ছ তো?” অনন্তকে চেঁচিয়ে বলতে হল, কেননা জবাব দিতে অসীম দাঁড়ায়নি।
কিন্তু শুনেছে। দাঁত চেপে অসীম নিজেকে শুনিয়ে বলল, ”দরদ দেখাচ্ছে।” এখুনি তার ত্রিশটা টাকা দরকার, কেননা ওর বাবা এক কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে। যেভাবে হোক এখুনি তাকে টাকা জোগাড় করতে হবে।
অনন্ত চিন্তায় পড়ে গেল। গাড়িটা এখানে থাকলে, ওরা এসে দেখে কিছু ভাববে না তো। এসব লোক লম্পট দুশ্চরিত্র হয় বলেই তার ধারণা। ত্রিশ বছরে গুটি চারেক সিনেমা সে দেখেছে, কিন্তু ফ্যালাটা যার নাম করে গেল তার ‘বই’ একটাও দেখেনি। পুতুলের ডিসকোয়ালিফাই হবার কারণ, এই গাড়িটা হতে পারে কি না, সেটা কার কাছ থেকে জানা যাবে, তাই ভাবতে শুরু করল অনন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ঝি ভিতর থেকে এসে বলল-
”বাবু, মা তাড়া দিচ্ছে। আর বলে দিল সন্দেশগুলো বড়ো বড়ো চারটাকাওলার আনতে। ওম্মা, গাড়ি কার গো, এসে গেছে নাকি!”
”অন্য লোকের গাড়ি।” অনন্ত গম্ভীর স্বরে বলল। এইসময় তার মনে হল, সদরে এমন ঝকঝকে একটা মোটর দাঁড়িয়ে থাকলে মন্দ দেখায় না। গৃহস্বামীর মানও বাড়ে। পুতুলের মামা কি মেসোর গাড়ি বলেও তো চালিয়ে দেওয়া যায়!
বাসুদেব ধর অফিস থেকে ফিরছে। দূরে ওকে দেখতে পেয়েই অনন্ত সিংহ মোটরটার বাম্পারে একটা পা তুলে দিল। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে, এটার মালিক তার খুবই নিকট আত্মীয় এতই নিকট যে পা পর্যন্ত তোলা চলে, এমন একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে অনন্ত আকাশে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
যাবার সময় বাসুদেব আড়চোখে একবার মাত্র তাকাল।
চার
দ্বারিক ওরফে ভোম্বল জয়রাম মিত্র লেনে সবথেকে ভালো ছেলে হিসাবে ঘরে ঘরে সুখ্যাত। স্কুল ফাইনালে অঙ্কে লেটার পায়। বি.কম-এ উঁচু সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে। কিছুদিন জোড়াবাগানে এক আখড়ায় কুস্তি শিখেছিল। লাইব্রেরি থেকে বই আনে হপ্তায় চারবার। দ্বারিক স্কুলজীবনে মোহন সিরিজ, শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর শেষ করে ফেলেছে। কলেজে ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হয়ে কিছুদিন বিবেকানন্দ এবং মাও-সে-তুং পড়ে। ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকে এখন রবীন্দ্রনাথ পড়ছে। তবে ছোকরা লাইব্রেরিয়ানটি যেদিন বসে, সেদিন ক্যাটালগে যৌন-বিজ্ঞানরূপে চিহ্নিত বইগুলি থেকেই একটি নেয়। নিজের ঘরে তোশকের নীচে সেই বই রাখে। দরজা বন্ধ করে গভীর রাতে পড়ে এবং শরীরে খুবই চঞ্চলতা অনুভব করে। লুকিয়ে হিন্দি ফিল্ম দেখছে প্রায়শই। সন্ধ্যার পর চৌরঙ্গী অঞ্চলে সে অলসভাবে হেঁটে ফেরে। সুগঠিতা মহিলারা এই অঞ্চলে মানসিক জড়তামুক্ত হয়ে চলাফেরা করে এবং তাদের দেখতে দেখতে দ্বারিক ঝিমঝিমে এক ধরনের অনুভবের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে কাউকে অনুসরণ করে, কখনো সিনেমায়, কখনো মনুমেন্টের নীচে রাজনৈতিক প্রতিবাদ সভায়, কখনো বাসে উঠে গড়িয়া বা হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারপর বাড়ি ফেরার সময় নিজেকে প্রভূত ধিক্কার দিতে দিতে প্রতিজ্ঞা করে ”এই শেষ। আর এভাবে ইন্দ্রিয়ের দাস হবে না। কিছুতেই না।” পরদিন থেকেই সে শীর্ষাসন শুরু করে, এবং সপ্তাহকাল অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসে। ট্রামে বা বাসে লেডিজ সিটের দিকেও তাকায় না। কিন্তু পরশু দিনই গড়ের মাঠ থেকে কিছু নিয়ে একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের পার্ক সার্কাসের বাড়ির দরজায় পৌঁছেই বিবেকের এক প্যাঁচে নিজেকে মাটিতে ফেলে কষে লাথি মেরেছে আর বলেছে ”এই শেষ, এই শেষ।”
প্রকৃতপক্ষে দ্বারিক কিন্তু মুখচোরা, দায়িত্ববান যুবক। চাকরিতে ঢুকেই ব্যাঙ্কিং-এর প্রথম পরীক্ষা পাশ করে পঞ্চাশ টাকা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছে, দ্বিতীয়টির জন্য তৈরি হচ্ছে। তাহলে আরও দুটি ইনক্রিমেন্ট পাবে। এখন তার বেতন প্রায় চার হাজার। এম.কম. পরীক্ষা সামনের বছর দেবেই। অফিসে পরিশ্রমী হিসাবে সুনাম অর্জন করেছে। দ্বারিকের বারো বছর বয়সে মা এবং ষোলো বছরে বাবা মারা যায়। দুই দাদার যৌথ সংসারে সে এখন মাসিক হাজার টাকার সদস্য। দোতলার রাস্তার দিকের ছোটো ঘরটি তার ফলে সম্পূর্ণই তার একার। পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবনবিমা করেছে সে। ব্যাঙ্কে প্রতি মাসে দু’হাজার টাকা জমা দেয়। প্রতিদিন জমা খরচের হিসাব লেখে, রাত্রে শোবার আগে। প্রতি রবিবার কাগজে জমিবাড়ি-সম্পত্তির বিজ্ঞাপনগুলি খুঁটিয়ে পড়ে। কলকাতার আশেপাশে চার-পাঁচ কাঠা জমি কিনে রাখার ইচ্ছা সম্প্রতি তার হয়েছে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
সাতটি নাবালকের বাবা অফিসের ভোলানাথ পাঁড়ুই এক বিকেলে ট্রামে উঠতে গিয়ে পিছলে বাসের চাকার নিচে চ্যাপটা হয়ে যায়। হাসপাতাল এবং শ্মশান হয়ে দ্বারিক ভোলানাথের বাড়িতে গেছল। সেখানে ছেলেমেয়েগুলির অসহায় মুখ এবং ভোলানাথের স্ত্রীর কান্না শুনে, দ্বারিকের বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। নিজেকে ভোলানাথের জায়গায় কল্পনা করে, তারপর থেকে সে, মাঝে মাঝেই ভয় পাচ্ছে। সাবধানে রাস্তা পার হয়, নিশ্চল না হওয়া পর্যন্ত ট্রামে-বাসে ওঠে না, কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে বসন্তের টিকা নিয়ে এসেছে। এমনকি বিয়ে না করার কথাও সে ভেবেছে। বড়োবউদি তার বিবাহযোগ্যা এক মাসতুতো বোনের অসাধারণ রূপ ও গুণাবলির কথা ইদানীং দ্বারিককে প্রায়ই শোনাচ্ছে। মেজোবউদি আড়ালে তাকে বলেছে, ”সব বাজে কথা, মানুর থেকেও দেখতে খারাপ।”
মানু অর্থাৎ মনীষা এইবার বি.এ. পরীক্ষা দেবে। বছর পাঁচেক আগে এ পাড়া থেকে উঠে গিয়ে শ্যামপুকুরে রয়েছে। মেজোবউদির থেকে বয়সে দশ-বারো বছরের ছোটো, কিন্তু সখীস্থানীয়া। এ পাড়ায় থাকার সময় ফ্রক পরে রোজই আসত। তখন ওকে দেখে দ্বারিকের সাধ হত হাস্য-পরিহাসের, সান্নিধ্যলাভের। কিন্তু ঘড়ঘড়ে গলায় ”এই যে” বলা ছাড়া আর কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি।
তারপর হঠাৎ একদিন অফিস যাবার জন্য বাস স্টপে দাঁড়িয়ে দ্বারিক দেখল, মানু শাড়ি পরে কলেজে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে দ্বারিকের মনে হল মানুতো বেশ সুন্দর! সঙ্গে সঙ্গে কিছু বাসনার উদয় হল এবং তারই প্রকোপে সে মুগ্ধ হয়ে তাকাল। মানু ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় লাজুক হয়ে মাথাটি নামিয়ে আঁচলটি বুকে টেনে দেয় এবং কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এরপর, প্রায়ই দ্বারিক বাস স্টপে দাঁড়িয়ে তিন-চারটি বাস ছেড়েও অপেক্ষা করে। মাঝে মাঝে দেখা হয় মানুষ সঙ্গে। কিন্তু প্রথম দিনের মতোই মানু মাথা নামিয়ে চলে যায় এবং দূরে গিয়ে তাকায়। দ্বারিকের খুব ইচ্ছা করলেও আজও কথা বলা হয়ে ওঠেনি।
মানু গড়নে রোগা এবং ঢ্যাঙা। মাথায় প্রচুর চুল, গায়ের রঙ মিশকালো। হাসে হো হো করে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শেষের দুটি ধাপ লাফিয়ে নামবেই, কণ্ঠস্বর অসম্ভব মিষ্টি এবং ভালোই গান গায়, তর্ক করতে ভালোবাসে, যুবকদের নাজেহাল করার সুযোগ পেলে ছাড়ে না, কলেজ স্পোর্টসে দৌড়ায় এবং কলেজ ইলেকশনে বক্তৃতা দেয়। মা-বাবা এবং পাঁচ ভাইবোনের সংসারে কোনো কাজ করতে তার ভালো লাগে না। দ্বারিকের মেজোবউদি প্রায়ই ভালোমন্দ শখের রান্না করে, ঘরে হিটার জ্বেলে। কীভাবে যেন মানু তখন ঠিক হাজির হয়ে যায়। ও অসম্ভব খেতে ভালোবাসে। অকপটেই বলে, ”ভাত-ডাল-চচ্চচড়ির বেশি তো আর জোটে না। তাই যেখানেই খাবার গন্ধ পাই ঠিক হাজির হই। কলেজে অ্যায়সা খিদে পায়, মাঝে মাঝে ভাবি বেশ পয়সাওলা ছেলে যদি পাই তো প্রেম করি!” তারপরই হো হো করে হেসে উঠে বলে, ”যা রক্ষেকালীর মতো চেহারা আমার। একটা ছেলেও কাছে আসে না।”
এই সময় হঠাৎ মানু এসে হাজির। দ্বারিক তখন সদর দরজায় দাঁড়িয়েছিল। অসীমের চেঁচিয়ে বলা কথায় উঁকি দিয়ে ঝকঝকে আকাশি-নীল একটা মোটর দেখে কৌতূহলী হয়ে নিচে নেমে আসে। সত্যচরণ বালতি হাতে যাচ্ছিল জল নিতে। দ্বারিককে দেখে বলল, ”হ্যাঁগো, গাড়িটা এখানে রাখা কি উচিত হল, বলো তো তুমি?”
”কার গাড়ি?”
”ওম্মা, এখনও শোননি। ওই যে বায়স্কোপের হিরো গো। যাকে দেখলে মেয়েরা পাগল হয়ে যায়।”
নামটা শুনে খুবই অবাক হল দ্বারিক। বিশ্বাসই করতে পারল না। অসীমকে আসতে দেখে সে ইতঃস্তত করল, জিজ্ঞাসা করবে কি না।
”ওগো, এটাকে তো পাড়ায় ঢোকালে”, সত্যচরণ অসীমকে লক্ষ করে বলল, ”চাকায় চাকায় যত রাজ্যের গু-মুত এবার থেকে ঢুকতে শুরু করবে তো।”
”তা করবে।” অসীম তার প্রায় ছ’ফুট দেহটিকে তেরিয়া করে দাঁড়াল। সত্যচরণ কথা না বাড়িয়ে ডিঙি মেরে কিছু একটা অতিক্রম করে টিউবওয়েল পৌঁছে গেল।
”চাকায় চাকায় আসে আর লোকের পায়ে পায়ে আসে না? রাস্তাটা কি আপনার শোবার ঘর?” অসীম আরও কিছু বলত, ওর ছোটোভাইকে ছুটে আসতে দেখে চুপ করল।
”দাদা, সেই লোকটা এসেছে।”
”কিছু বলেছে?” চাপা গলায় অসীম বলল।
”হ্যাঁ, রাগারাগি করছে, টাকা ফেরত চাইছে আর তোমাকেও খুঁজছে।”
কিছুক্ষণের জন্য পাংশু হয়ে রইল অসীমের মুখ। দ্বারিক তাকিয়ে আছে দেখে ছোটোভাইকে বলল, ”আমি ঠাকুরের চায়ের দোকানে আছি, চলে গেলেই খবর দিবি।”
অসীম চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মানু এল। দ্বারিক তখনও সদরে দাঁড়িয়ে। মানুকে দেখামাত্র বলল, ”কার গাড়ি বল তো?”
মানু অবাক হল। এমন উত্তেজিত ছেলেমানুষি গলায় দ্বারিককে কথা বলতে শোনেনি কখনো। তাছাড়া চারটি শব্দবিশিষ্ট বাক্য দ্বারা তাকিয়ে যেচে কথাও শুরু করেনি। মোটরের দিকে এক পলক তাকিয়ে সে বলল, ”কী জানি।”
”যদি বলতে পারো তাহলে মিত্র কাফের ফাউল দোপেঁয়াজি খাওয়াব, ফুল প্লেট।”
”ওরে ব্বাস, তবে বলতেই হয়।” মানু কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আকাশ-পাতাল ভাবার ভান করল। দ্বারিক সেন্টের মৃদু গন্ধ পেল। খোঁপায় লাল গোলাপ দেখল। শাড়িটি সিল্কের। ব্লাউজের হাতা নেই।
সত্যচরণ বালতি ভরে জল নিয়ে যেতে যেতে দুজনের দিকে তাকিয়ে গেল। দ্বারিক তাইতে অস্বস্তি বোধ করল। মেজোবউদি বিকেলে বাপের বাড়ি গেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। মায়ের নাকি অসুখ করেছে, রাতে ফিরবে। বড়োবউদি ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী। অফিস থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দ্বারিকের কানে আসে বড়দা বাঁকা সুরে বলছে, ”রান্নাঘরে যেতে হবে কিনা, তাই বোধহয় মায়ের অসুখ হয়েছে।”
মেজোবউদি না থাকলে মানুর এ বাড়িতে ঢোকার কোনো কারণই থাকে না। বড়োবউদির সঙ্গে ওর আলাপটা নেহাতই সৌজন্যমূলক। দ্বারিক সাহস করে বলে ফেলল, ”এখানে দাঁড়িয়ে ভাবলে আর বলতে পারবে না। মেজোবউদি তো নেই বরং আমার ঘরে বসে ভাবতে পারো।”
”কোথায় গেছে মেজোবউদি!”
”বাপের বাড়ি, মায়ের অসুখ করেছে। কোথাও যাচ্ছ নাকি, এত সেজেছ যে?”
”ধ্যেৎ, একে আবার সাজা বলে নাকি। এই চেহারায় সাজবোটা কোথায়।”
হেসে উঠতে গিয়ে দ্বারিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মানুর বুকের মধ্যেটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। দ্বারিকের চোখে ভর্ৎসনা এবং আহত হওয়ার মিশ্র একটা রূপ ফুটে রয়েছে। অস্ফুটে সে বলল, ”চলুন”।
দুজনেই পা টিপে চুপিসারে দোতলায় এসে দ্বারিকের ঘরে ঢুকল। কেন যে এমন করে লুকিয়ে এল, ওরা তার কৈফিয়ৎ খোঁজার জন্যই বোধহয় পরস্পরের মুখের দিকে, তাকাল। দ্বারিকের চোখ চাপা উত্তেজনায় ঝকঝক করছে। ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলল, ”দাঁড়িয়ে কেন, বসো।”
”আপনার ঘরে এই প্রথম এলুম।”
”সে কি! এত বছর আসছ অথচ-”
”যা গম্ভীর আপনি। ভয় করে আপনাকে দেখলে।”
”এখন করছে না?” দ্বারিক খুশি হয়ে দরজার পর্দাটা ভালো করে টেনে দেবার জন্য পিছু ফিরল।
মানু ঘরের সর্বত্র চোখ বুলিয়ে, টেবিলের উপর পাতা খুলে উপুড় করে রাখা একটি বই দেখে বলল, ”পড়ছিলেন বুঝি?”
ফ্যাকাশে মুখে ঘুরে দাঁড়াল দ্বারিক। বইটা তোশকের নিচে রেখে একতলায় যাওয়া উচিত ছিল তার।
”হ্যাঁ, ব্যাঙ্কিংয়ের সেকেন্ড পার্টটা দেব ভাবছি।”
দ্বারিক পায়ে পায়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। তবু রক্ষে বইটা কালো মলাটে বাঁধানো। টেবিলে আরও কয়েকটা বই রয়েছে। মানুর দিকে পিঠ ফিরিয়ে বইটা চটপট গুঁজে দিল অন্যগুলোর মধ্যে।
”কি, বললে না তো, এখন তো ভয় করছে কিনা?” হাঁফ ছেড়ে দ্বারিক মুখোমুখি চেয়ারে বসল।
”বলুন না গাড়িটা কার?”
”উঁহু, আগে আমার কথাটার উত্তর দাও।”
”কী উত্তর দেব!”
”বারে, সেটা কি আমি বলে দেব।”
”দিন না বলে।” হেসে মুখ ফিরিয়ে মানু আলনায় ঝোলানো পোশাকগুলো দেখতে মন দিল। দ্বারিকের মনে হল, এত সুন্দর মুখ আর হয় না।
”বললে কী খাওয়াবে?”
”আমার পয়সা কোথায় যে খাওয়াব?”
”পয়সা লাগে বুঝি খাওয়াতে!”
মানু চট করে দ্বারিকের মুখটা দেখে নিল একবার। বেপরোয়া দুঃসাহসে পেয়ে বসল দ্বারিককে। জীবনে এই প্রথম একঘরে একটি বিংশোত্তীর্ণা অনাত্মীয়া কুমারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ সে পেয়েছে, জীবনে আর কোনোদিন আসবে কিনা কে জানে। এলেও হয়তো তখন সে আর যুবক থাকবে না। কিংবা কালই ভোলানাথ পাঁড়ুইয়ের মতো বাস চাপা যেতে পারে।
”পয়সা লাগে না এমন জিনিসও তো মেয়েরা খাওয়াতে পারে!”
”সে আবার কি জিনিস?” মানু সন্ত্রস্ত হয়ে খোলা বাঁ-কাঁধটি আঁচলে ঢাকল। দ্বারিকের চোখে অদ্ভুত মিষ্টি এক চাহনি।
”বলব?”
হ্যাঁ, বলতে গিয়ে কিছু না বলে, মানু মাথা নুইয়ে চুপ করে রইল। দ্বারিক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ভাবল, শেষ পর্যন্ত বোধহয় যুবক হতে পারব।
মনে মনে সে দ্রুত বলল, আসলে আমি খুব ভিতু। কোনোদিন মেয়েদের সঙ্গে মেশার সুযোগ তো হয়নি। আমার গাম্ভীর্যটা পুরোপুরিই নকল। আমায় তুমি ভয় পেয়োনা, কেমন।
দম বন্ধ করে উৎকণ্ঠিত চোখে দ্বারিক তাকিয়ে রইল। মানু মুখ তোলেনি।
”মনীষা, উত্তর দিচ্ছ না যে?”
মুখ তুলে মানু তাকাল। দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। দ্বারিকের বুকের মধ্যে মোচড় দিল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে, অসহায়ভাবে এধার-ওধার তাকাল। দারুণ একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তার এবং কোনোক্রমে আবেগ সংযত করে বলল, ”ওই নীল গাড়িটায় আমাদের পাড়ায় কে এসেছে জানো!”
নামটা শুনেও কোনো ভাবান্তর ঘটল না মানুর। তাইতে দ্বারিকের মনের গভীরে নিরুদ্বিগ্ন সুখের সঞ্চার ঘটল। হেসে বলল, ”বেরিয়ে যখন মোটরে উঠবে আমার এই জানলা দিয়ে দেখা যাবে। তুমি ততক্ষণ বসবে?”
মানু ঘাড় নেড়ে বলল, ”আমার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না দেখার।”
পাঁচ
”অ বউ, কোথায় গেলি, সন্ধে দেখিয়েছিস? অ বউ, শুনতে পাচ্ছিস? খোকাকে বলিস কাল বাজার থেকে যেন কচুরমুখী আনে। মনে করে দিস ওকে। বড়ি দিয়ে ঝাল করিস।”
থুত্থুড়ে শাশুড়ি এক তলায় দালানের এক কোণায় সকাল-সন্ধে উবু হয়ে বসে থাকে। হামা দিয়ে নর্দমা পর্যন্তও যেতে পারে না। চোখে দেখে না, কানে কম শোনে।
”অ বউ, খোকা দোকান থেকে ফিরেছে?”
কোনো সাড়া না পেয়ে অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলল, ”আঁটকুঁড়ির গেরায্যই নেই। মর তুই, খোকার আবার বিয়ে দোব, টুকটুকে বউ আনব, বছর বছর বিয়োবে, দেখি তোর দেমাক থাকে কোথায়।”
বুড়ি এখন ঘণ্টাখানেক এইভাবে বকবক করে যাবে। কিন্তু যাকে শোনাবার জন্য, সে তখন দোতলায় ইলার রান্নাঘরের দরজায়।
”বলিসকি লো, সত্যি!” পারুল ধাক্কাটা সামলে ওঠার জন্য দরজাটা চেপে ধরল।
”হ্যাঁরে গুঁপো-ঠাকুরঝি এই তো জানালা দিয়ে বলল। তিনের-বি-তে যে বিধবা মাস্টারনি থাকে, ওই যে রে, রাস্তায় কুকরদের বিস্কুট কিনে খাওয়ায়, ওরই কাছে এসেছে।” ইলা বেগুনের পিঠ ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল।
”যাঃ, বাজে কথা, অন্য কেউ হবে।” পারুল বিশ্বাস করতে পারছে না। ”এই গলিতে কী কত্তে আসবে, ওর মতো দেখতে কেউ হয়তো হবে।”
”তোর অমনি অবিশ্বাস।” ইলা চটে উঠল। বেগুনটাও পুড়ে গেছে। কড়াটা ঠকাস করে উনুন থেকে নামিয়ে রাখল। ”কেন, আসতে পারে না নাকি এ পাড়ায়? এক সময় কত বড়ো বড়ো লোক ছিল জানিস! ওই যে ছুঁচিবেয়ে সত্যচরণ, ওর ঠাকুর্দার নামে মেডিকেল কলেজে একটা বেড আছে। স্যাকরা বাড়ির পাশে বাসু ধর, ওদের বাড়িটা তো তিন মহলা ছিল, ওই পেছনের কালী ঘোষ স্ট্রিটে ছিল সদর দরজা, এখন তো ওরা থাকে আগের বাড়ির খিড়কির দিকে। সব বিক্রি হয়ে গেছে। ওর যে কাকা ব্রাহ্ম হয়ে গেছে, সে হাইকোর্টের জজ হয়েছিল, এই পাড়াতেই তো মানুষ! আর এখনও কি নেই ভেবেছিস? ওই প্রোফেসারের কাছে কত বড়ো বড়ো লোক আসে তা জানিস?”
ইলার রুদ্ধশ্বাস বাক্যস্রোতে পারুল ভেসে গেল। ধুপ করে উবু হয়ে বসে ইলার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ”চল না, এখটুখানি দেখে আসি। সিনেমায় কত দেখেছি, রক্তমাংসের মানুষটাকে সামনা-সামনি একবারও দেখিনি। দ্যাখ না, রোজই তো বাপু এই সময় রাস্তার জানলার ধারে এটা করি ওটা করি, কেউ গেলে চোখে পড়েই। আর আজকেই এমন বরাত যে-আরে বলব কী, বিকেল থেকেই বুড়িটা খালি খাবো খাবো করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। চুপ করে শুয়ে ছিলুম। মনে হল বটে মোটরগাড়ির মতো কী একটা যেন ঢুকল। বুড়ি যে কবে ঘাটে যাবে।”
অন্য সময় হলে পারুলের শাশুড়ির বিষয়ে শোনার সময় হত ইলার, এখন সেও ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ওনারও মাথা ধরেছে, শুয়ে আছেন খোকাকে নিয়ে।”
”ভালোই তো হল, চট করে তাঁতি গলিতে ঢুকে জানালা দিয়ে দেখেই চলে আসব। মাইরি, একবার চল।” পারুল দু হাতে ইলাকে জড়িয়ে শব্দ করে গালে চুমু খেল এবং বগলের নিচে খামচে ধরল।
”অই অই, আবার যা-তা শুরু হল তো। ইলা সরিয়ে দিল পারুলের হাত। গলা নামিয়ে বলল, ‘উনি রয়েছেন ঘরে, পাগলামি করিসনি’।”
”ওরে বাবা, আজ যে বড়ো তাড়াতাড়ি! দশটা-এগারোটার কম তো ফেরে না।”
”মাথা ধরেছে ভীষণ।”
”শনিবার দিন তো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছল, আমি না থাকলে আর উঠতে হত না-বাব্বাঃ মুখে কী ভুরভুরে গন্ধ।”
ইলা তীক্ষ্ন চোখে তাকাল পারুলের দিকে। আঁটকুঁড়িটার বড্ড নজর অশোকের দিকে। রোজ রাতে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য জেগে বসে থাকে। যখন তখন উপরে উঠে আসে অশোক থাকলে। গায়ে মাথায় কাপড় ঠিক থাকে না। এর জন্যই শেফালিদের ছাদের দিকের জানলাটা বন্ধ রাখতে হয়। শনিবার রাতে অশোককে ধরে তুলেও দিয়েছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ইলা, হঠাৎ মনে পড়ল দোকান থেকে আট গজ মারকিন আনিয়ে দিয়ে পারুল দাম নেয়নি।
”কী দেখছিস, যাবি তো তাড়াতাড়ি কর।”
পারুল এইভাবে ইলার তাকানোয় অস্বস্তি বোধ করল। তাও সে বলেনি, অশোক বারবার ঝুমি ঝুমি, তোমাকে ঝুমির মতো দেখতে, বলে ঘাড়ে চুমু খেয়েছিল। ঝুমিটা কে, কদিন ধরে পারুল তাই জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেনি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নামটা ইলার সামনে করেছে কিন্তু ইলা কখনো শুনেছে বলে মনে হয়নি তার।
পারুল উঠে দাঁড়াল। শোবার ঘরের আধখানা দেখা যাচ্ছে। খাটে আট মাসের বাচ্চচাটা ঘুমোচ্ছে। তার পাশে অশোকের পিঠ আর মাথা। ফুটফুটে, উলের বান্ডিলের মতো নরম ছেলেটা। সারা দুপুর ওকে নিয়ে পারুল চটকায়, কাঁদায় হাসায়। অমন একটা বাচ্চচা তার চাই। বাপের বাড়ি গিয়ে, লুকিয়ে যে ডাক্তার দিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বাঁজা নও। তোমার স্বামীকে পরীক্ষা করা দরকার, তাকে নিয়ে এসো। মৃত্যুঞ্জয়কে সে কথা আজও জানায়নি পারুল। মা হবার ক্ষমতা তার আছে, এইটুকু জেনে সে স্বস্তি পেয়েছে। আঁটকুড়ি আঁটকুড়ি শুনে এখন তার প্রচণ্ড রাগ হয় অপদার্থ হোঁৎকা স্বামীর উপর। ময়না কিনে দিয়েছে, টিয়া কিনে দিয়েছে অথচ সাজানো তকতকে ঘরটা তছনছ নোংরা করে দেবার মতো একটা দস্যি নিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। দোকান থেকে রোজ রাতে বাড়ি ফিরে টাকার হিসেব নিয়ে বসবে। একটা সিকি এধার-ওধার হয়ে গেলে রাতে ঘুমোবে না। মাদুলি, জলপড়া, হত্যে দেওয়া, মানসিক করা-সবকিছুই মৃত্যুঞ্জয়ের নির্দেশে করে যায় পারুল। শুধু ডাক্তারের বলা কথাটা জানায়নি।
ইলা পিছন ফিরে রান্না ঢাকা দিয়ে রাখছে। পারুল শোবার ঘরে বাচ্চচার দিকে আবার তাকাল। হঠাৎ অশোককে পাশ ফিরতে দেখে সে চোখ সরিয়ে নিল। ইলা ন্যাতা দিয়ে রান্নাঘরের মেঝে নিকোচ্ছে। পারুলের মনে হল যেন, অশোক ওঘর থেকে তার দিকে তাকিয়ে। সন্তর্পণে সে চোখ ফেরাল। সোজা তার মুখের উপর একদৃষ্টে অশোক তাকিয়ে। ওর চোখে পারুল কী যেন দেখতে পেল আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে থরথর করে উঠল।
”আমার শরীরটা কেমন করছে রে ইলা।”
”সেকি রে!”
”হ্যাঁ, বুকের ব্যথাটা শুরু হবে মনে হচ্ছে। বোধহয় আমি আর যেতে পারব না।” পারুল দেয়ালে হাতের ভরে শরীর রেখে চোখ বুজল।
”সেকি! তোরই লাফানি বেশি আর তুই-ই এখন যেতে পারবি না বলছিস। কী যে ঢঙ বুঝিনা বাপু।” ইলা গরগর করে উঠল ক্ষোভে।
”আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, মাথা ঘুরছে, তুই বরং শেফালি ঠাকুরঝিকে সঙ্গে নে, আমি আর যাব না। শুয়ে পড়ি।” বলতে বলতে পারুল সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল দ্রুত। শেষের তিনটে ধাপ আগে পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেল সে। তাড়াতাড়ি উঠে ঘরে গিয়ে, আলো নিভিয়ে আছড়ে পড়ল খাটে। তার সারা শরীর এখন কেমন করছে।
দালানের কোণ থেকে শাশুড়ি বলে উঠল, ‘অ-বউ, কী পড়লে রে?’
অশোক একদৃষ্টে পারুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আসলে সে পারুলকে দেখছিল না। ভাবছিল গত চার ঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া কতকগুলো ঘটনা।
চার ঘণ্টা আগে সুকুমারের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল চৌরঙ্গীর পুব ফুটপাথে, বাস স্টপে। জেনারেল ম্যানেজারের কাছে এগারো দফা দাবি পেশ করার জন্য ব্রাঞ্চগুলো থেকে যে মিছিল শ্লোগান দিতে দিতে হেড অফিস পর্যন্ত আসে তার মধ্যে অশোকও ছিল। গেটের সামনে জমায়েত হয়ে বক্তৃতা শুরু হতেই সে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে। একঘেঁয়ে কথাগুলো শোনার উৎসাহ তার আর নেই। ধর্মতলা-চৌরঙ্গীর মোড়ে পৌঁছে ভাবল, এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী করব। এখন সিনেমার ম্যাটিনি শো মাঝামাঝি অবস্থায়, ফুটবল লিগের খেলা শুরু হতেও ঘণ্টা দেড়েক বাকি। হাসপাতালে কেউ পরিচিত রুগি হয়েও নেই যে দেখে আসা যায়, শুঁড়িখানায় বসার মতো পকেটে যথেষ্ট টাকাও নেই। তাহলে কি ইউসিস লাইব্রেরিতে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে হবে?
বিরক্ত হয়েই অশোক বাস স্টপে দাঁড়িয়েছিল, এমন সময় সাহেবি পোশাক পরা পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ হাতে বেঁটেখাটো একটা লোক ওর সামনে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। অশোক দেখেই বুঝল মদ খেয়ে চুর হয়ে আছে। লোকটা চেনার চেষ্টা করছে কিন্তু অশোক চিনতে পারল সুকুমারকে। বেশ মোটা হয়ে গেছে।
”অশোক ভাটাচারিয়া আই প্রিজিউম।”
”হ্যাঁ, আর তুমি সুকুমার গুহ।”
”অনেকদিন পর, কত বলো তো?”
”প্রায় আট বছর।”
”করছ কী?”
এইবার অশোক মনে মনে রেগে উঠল, কেননা সুকুমার দিব্যি মদ সাঁটিয়ে মেজাজে কথা শুরু করেছে এবং বলছে ভারিক্কি চালে, যেন উত্তর দিতে বাধ্য এমন কারুর সঙ্গে। তখন অশোক স্থির করে ফেলে সুকুমার চাল মারতে পারে এমন একটা প্রশ্নও সে করবে না, অর্থাৎ কবে আমেরিকা থেকে ফিরলে, এখন কোথায় কাজ করছ, কত মাইনে পাচ্ছ, কলকাতার কোন মহল্লায় থাকো এবং কত ভাড়া দিচ্ছ, গাড়ি কিনেছ কি না, ছেলে বা মেয়ে কোন ফিরিঙ্গি স্কুলে পড়ে, পুজোয় কোথায় ঘুরে এলে-এইসব প্রশ্ন। আর স্থির করল চাল মেরে ব্যাটার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
”আপাতত একটা সিনারিও নিয়ে ব্যস্ত।”
অশোক মোটামুটি নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে হিসেব করে ফেলেছে কতটা দামি করা যায় নিজেকে। ধুতি-পাঞ্জাবি-চটি-ঘড়ি এবং চেহারাটা দিয়ে সিনারিও রাইটার, বড়োজোর এম.এল.এ-এর বেশি ওঠা যায় না।
”বাংলা না হিন্দি?”
অশোক লক্ষ করল কথাগুলো জড়িয়ে গেল, এবং স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মদ খেত না, এখন খাচ্ছে। কেন? একটু সদুপদেশ দিয়ে দিলে কেমন হয়! ওর বউ অর্থাৎ ঝুমি তো খুবই মাতালদের ঘেন্না করে বা একদা করত!
”হিন্দি।”
”পয়সা আছে হিন্দিতে।”
যেন তারিফ করল। এটা ভালো লাগল না অশোকের। ঈর্ষা করাতে না পারলে চাল মেরে সুখ নেই।
”তেমন আর কই, মাত্র পঞ্চাশ হাজার দেবে।”
”ওতেই রাজি হয়ে যাও। নয়তো অন্য কেউ দেখবে বাগিয়ে নেবে। কোথা থেকে টুকলে? লিখতে-টিখতে পারতে বলে তো শুনিনি।”
”কলিন কাউড্রের একটা ছোটো গল্প থেকে।”
”হু ইজ কাউড্রে?”
”সে কি!”
আকাট মুখ্যু বানিয়ে দেওয়া যাক। এই ভেবে অশোক খুশি হল বিস্তর।
”ওহ তুমি কি খবর-টবর আর রাখো না নাকি?”
”না, মানে, আজকাল এত কাজের চাপ, কাউড্রে নামটা অবশ্য শোনা-শোনা লাগছে, ইজ হি এ ক্রিকেটার।”
”নো নো, এ কানাডিয়ান রাইটার।”
”ওহোঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ পড়েছি। ব্রিলিয়ান্ট তবে কিছুটা সেন্টিমেন্টাল, বোধহয় আটলান্টিক মান্থলিতে ওকে নিয়ে”-
”না, না, তুমি ভুল করছ, এনকাউন্টারে একটা রিভিউ বেরিয়েছিল বিল লরির করা, বছরখানেক আগে।”
”আটলান্টিক মান্থলি নয়? আর ইউ সিওর? কী জানি পড়াশুনোর সময় একদমই পাইনা তো। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শুধু…টাকা টাকা টাকার পিছনেই তাড়া করে চলেছি। ব্যাপারটা এত অশ্লীল আগে বুঝিনি, এই সংসার-ধম্মো করা। তুমি কি বিয়ে করেছ?”
”ন্নাঃ” অশোকের মুখ দিয়ে আপনা থেকেই শব্দটা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এল। সুকুমারের ঘোলাটে এলোমেলো চাউনিতে যেন এখনই সে পরশ্রীকাতরতা ফুটে উঠতে দেখল।
”আজকাল বড্ড বেশি খাটতে হচ্ছে। একদিন এসো-না আমাদের বাসায়। একটা ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছি তখন থেকে অথচ পাচ্ছি না। কী যে জঘন্য এই চৌরঙ্গীটা।”
”কোথায় আছ?”
সুকুমার বাঁ হাতে কোটের ভিতর পকেট থেকে পার্স বার করল। হাতে ঝোলানো ব্যাগটা ফুটপাথে রেখে, পার্স থেকে কার্ড বার করে দিল। ঠিকানাটা পড়ে অশোক বলল, ”টালায় আছ? আমি শুনেছিলাম যোধপুর পার্কে!”
”ঝুমির জন্য। দক্ষিণ কলকাতায় বাপের বাড়ি তাই ওদিকে যাবে না। জানোই তো ওরা আমাদের উপর কি ভীষণ খাপ্পা। বুঝিনা অশোক, আমি এমন কি অপাত্র! ঝুমির মতো মেয়ে কি আমার থেকেও ভালো স্বামী জোটাতে পারত! তুমি জানো, স্বভাবটাও ওর সত্যিই মিষ্টি কিন্তু কী ভীষণ ডাল।”
সুকুমারের কথা আরও জড়িয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে দুলে উঠছে। গলা চড়ছে। দু-একজন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।
”বড্ড একঘেঁয়ে, কোনো ভেরিয়েশান নেই। অথচ আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। জানো অশোক, আমার মাঝে মাঝে কী ইচ্ছে করে?”
এলোমেলো চোখ দুটো অশোকের মুখের কাছে এগিয়ে এনে সুকুমার বলল, ”ইচ্ছে হয় ওকে খুন করি। আমাকে ঠকিয়েছে। ওর সেক্স দিয়ে আমাকে চিট করেছে। তুমি খুব বেঁচে গেছ, ওযে তোমায় রিফিউজ করেছিল সেটা তোমার পক্ষে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তবে শিগগিরিই একদিন সকালে কাগজ খুলে দেখতে পাবে হেডিং-স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন। কিন্তু নিশ্চিত জেনো, আমি ফেরার হব না। আমি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করব। ডিফেন্ড করব না। কোর্টে। শুধু বলব, জেল-টেল নয়, আমাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। আই ওয়ান্ট টু ডাই!”
ঝুঁকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে সুকুমার কোনোরকম বিদায় না জানিয়ে হাঁটতে শুরু করল উত্তর দিকে। ভিড়ের মধ্যে একাকার হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত অশোক ওকে লক্ষ করল। শরীরটা ডানদিকে একটু হেলে রয়েছে, পা ঠিকমতো পড়ছে না, মাথা ঝুঁকিয়ে গুলি খাওয়া শুওরের মতো রাগে দিশাহারা হয়ে যেন ও লন্ডভন্ড করতে চলেছে।
অশোক ঘড়ি দেখল। সাড়ে চারটে মাত্র। সুকুমারের দেওয়া কার্ডটা তখনও হাতে। আর একবার চোখ বুলিয়ে পকেটে রাখল। এখনও কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাতে হবে। জয়রাম মিত্র লেনে রাত না বাড়লে কোলাহল থামে না। অশোক আনমনে রাস্তার ওপারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, আউটরাম ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখবে ঠিক করে, রাস্তা পার হবার জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে বাঁদিকে তাকাল, তারপর ডানদিকে।
দূরে কী যেন হয়েছে। মানুষ ছুটে ছুটে জড়ো হচ্ছে রাস্তার মধ্যে। একটা ডবল-ডেকার বাস দাঁড়িয়ে। অশোক সময় কাটাবার রগরগে একটা উপলক্ষ্য পেয়ে আশ্বস্ত হল এবং জোরে হেঁটে ভিড়ের কাছে পৌঁছল। যা প্রথমে ভেবেছিল, তাই-ই ঘটেছে। একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ”কী করে চাপা পড়ল?”
”যা করে পড়ে। চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে!”
”একদম শেষ হয়ে গেছে কি?”
”সঙ্গে সঙ্গে।”
অশোকের ইচ্ছা হল চটকানো মাংস আর রক্ত একটুখানি দেখে। ভিড় ঠেলে গোড়ালিতে ভর দিয়ে উঁকি দিল।
একি! থরথর করে কেঁপে উঠল সে। কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাগটা পুলিশের জিম্মায় দেখেই চিনতে পারল। ভয় তাকে কোণঠাসা করে ফুটপাতের কিনারে হাজির করল। কাঁপুনি থামেনি। এখন কী করবে? ছুটে কোথাও পালাতে ইচ্ছে করল তার। যে চাপা পড়েছে আমি তার বন্ধুস্থানীয় বা পরিচিত বললে অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে এসে যাবে। হাসপাতাল-পুলিশ-মর্গ-শ্মশান এত ঝঞ্ঝাটে জড়াতে হবে। অশোক বিরক্ত বোধ করল সুকুমারের উপর। এভাবে তার উপর পাষাণ ভার চাপিয়ে দেবে, আট বছর পর, অযথা অকারণে, বুঝলে সে গঙ্গার ধারে গিয়ে সূর্যাস্তই দেখত। রক্ত মাখা নাড়িভুঁড়ি দেখতে আসত না। তবু কিছু একটা করা দরকার।
একটি লোককে দেখে অশোকের মনে হল অনেকগুলি সন্তানের পিতা, স্বল্প আয় কিন্তু টাকা জমায়। ওর কাছেই বুদ্ধি নেওয়া যাক এই ভেবে সে জিজ্ঞাসা করল, ”সঙ্গে কেউ নেই লোকটার?”
”থাকলে তো দেখতেই পাওয়া যাবে।”
”তা বটে, তবে থেকেই বা কী করত, করার মতো কিছু তো আর নেই এখন।”
”তবু বাড়িতে খবরটা তাড়াতাড়ি পৌঁছত।”
”ঠিকানা কী?”
”কী জানি, পকেটে নিশ্চয় মানিব্যাগ-ট্যাগের মধ্যে আছে।” এই বলে লোকটা বুক পকেটের উপর হাত রেখে, সন্দেহের চোখে চারধারে তাকিয়ে ভিড়ের থেকে দূরে সরে গেল।
বাড়িতে খবর দেওয়া! ভারতী অর্থাৎ ঝুমিকে জানানো! তাড়াতাড়ি কার্ডটা বার করে অশোক পড়ল। পুলিশ নিশ্চয় খবর দেবে। সুকুমারের পার্সে অনেকগুলো এই কার্ড আছে। তার আগেই পৌঁছে খবরটা দিতে হবে। সময় কাটাবার একটা চমৎকার কাজ পাওয়া গেছে, অশোক উত্তেজিত হয়ে ধাবমান একটি ট্যাক্সির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল। থামল না। আর একটি খালি ট্যাক্সি দেখে হাত তুলে ছুটে গেল। কিন্তু সেটিও ওকে গ্রাহ্য করল। এরপর উন্মত্তের মতো অশোক ছোটাছুটি শুরু করে দিল।
ওর পৌঁছবার আগেই ঝুমি পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে গেছল। সুকুমারের কার্ডে ফোন নম্বর লেখা ছিল অশোক সেটা লক্ষ করেনি। বাড়িওয়ালারা বলল, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেছে। তাই শুনে অশোক হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়েছে। মাথা মোটেই ধরেনি। আসলে ইলার ভ্যাজভ্যাজানি বন্ধ রাখতে চায়। এখন চোখ বন্ধ করে বালিশটা বুকে আঁকড়ে ঝুমিকে ভাবতে ইচ্ছে করছে। আট-দশ বছর আগের ঝুমিকে। ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে পারুলের গলার শব্দ পেয়ে তাকাল সে।
পিঠ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত চড়াই-উৎরাইগুলো হুবহু ঝুমির মতো। গলার স্বরও। প্রথমদিন পারুলকে দেখে সে চমকে উঠেছিল। গত শনিবার নেশার ঘোরে কী করেছে অশোক কিছুতেই মনে করতে পারেনি সকালে। শুধু মনে হয়েছিল পারুল যেন বলছিল, ”বড্ড নেশা হয়েছে। না না এসব এখন থাক। শুয়ে পড়ুনগে।” ঝুমিও বলেছিল, ”বিয়ের কথাবার্তা এখন থাক। তুমি বরং বাড়ি চলে যাও।” আর সুকুমার বলল, ”ঈশ্বরের আশীর্বাদ।”
অশোকের সঙ্গে এই সময়ই চোখাচোখি হল পারুলের। মনে পড়ল ঠিক ঝুমির মতো গলায় এই দুর্দান্ত স্বাস্থ্যের বউটি বলেছিল, ”না না, এসব এখন থাক।” কী থাক? পারুলের শরীর বেয়ে অশোক চোখ নামিয়ে আনল। ঝুমিরই শরীর। ওই শরীরটাকে দখল করার প্রবল ইচ্ছা ন-দশ বছর আগে ভর করেছিল তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। তখন দুজনেই ফিফথ ইয়ারে। ঝুমি প্রশ্রয় দিত। ওদের বাড়িতে যাতায়াতের সুযোগ করে দিয়েছিল। ইচ্ছে করলেই অশোক একতলার বৈঠকখানায় না বসে দোতলায় উঠে যেতে পারত। ওদের বাড়িতে তখন অনেকেই উপরে আসত।
সেদিন বারান্দায় ঝুমি দাঁড়িয়েছিল। অশোক ভেবেছিল তারই জন্য অপেক্ষা করছে। লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি টপকে উপরে উঠল।
ঝুমি পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর ঘাড়ে চুমু খাবার প্রবল বাসনা নিয়ে অশোক এগোচ্ছে আর তখুনি সুকুমারের কণ্ঠস্বর শোনা গেছল এক তলায়-”খবর দাও আমি এসেছি।” তখুনি নিচে নেমে গেল ঝুমি। শুধু যাবার আগে মাথা হেলিয়ে বলে, ”আর একদিন, কেমন?”
সেই আর একদিন আর আসেনি। অশোকের মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। ঠিক এইভাবে, এখন যেভাবে পারুল নেমে গেল, এইভাবেই ঝুমি তাকে ফেলে রেখে, নেমে গেছল। এখন সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বালিশটাকে কামড়ে মনে মনে হেসে বলল : আসবে, যেভাবেই হোক। তোমায় আমি দেখে নেব।
”খোকন রইল, ওকে একটু দেখো। আমি একবার ঘুরে আসছি শেফালি ঠাকুরজির কাছ থেকে। জানো পাড়ায় কে এসেছে?” ইলা কাছে এসে দাঁড়াল।
”মাথা ধরেছে এখন বকবক কোরোনা। যেখানে যাচ্ছিলে যাও।”
ছয়
মাস দুয়েক আগে শচীন দত্তগুপ্ত একদিন পারসোনেল ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরে চেয়ারে বসেই বাসুদেব ধরকে বলেছিল :
”এখানকার মায়া কাটাবার নোটিশ পেলুম বাসু। এক্সটেনশন দিল না। আমি নাকি ফিজিক্যালি আনফিট। পঁয়ত্রিশ বছর কাটালুম এই ঘরেই, সামনের মাস থেকে আর আসতে হবে না।” এই বলে ঘরের সকলের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করেছিল ষাট বছরের শচীন দত্তগুপ্ত।
বাসুদেব অবাক হয়ে বলে, ”শচীনদা, আপনি ফিজিক্যালি আনফিট! তাহলে আমরা কী হব?”
শচীন মাথা নামিয়ে যোগ-বিয়োগের হিসেবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাসুও মনে মনে হিসেব কষে নেয়, তার রিটায়ার করতে আর ক’ বছর বাকি। এখনও এগারো বছর। ছোটোছেলেটার বয়স হবে তখন চোদ্দো, ছোটোমেয়ের এগারো। তারপর ওদের লেখাপড়া বা বিয়ে দেওয়ার কী হবে? প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটির টাকা ফুঁকে দিলে বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রী খাব কী?
মোট চার মেয়ে ও দুই ছেলের হিল্লে না হওয়া পর্যন্ত তার রেহাই নেই। তাছাড়া সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে। প্রদীপ নামে অ্যাকাউন্টসের ছোকরাটা কদিন আগে ক্যান্টিনে চেঁচিয়ে বলছিল, ভ্যাসেকটমি করিয়ে এসেছে, যে ভয় করেছিল তা হয়নি, বউ খুব হ্যাপি। কিছু অসুবিধে হচ্ছে না। ওর দুটিমাত্র ছেলে।
বাসুদেব এরপর ফিজিক্যাল ফিটনেস ও ভ্যাসেকটমি, এই দুই জাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হতে শুরু করে। কখনো সে রেগে ওঠে নিজের উপর এই ভেবে যে, সাতটি সন্তানের পিতা কেন হতে গেল। কেন রাধারানি নামে একটা অশিক্ষিত মাংসের বস্তা তার বউ হল। আবার ভয়ে সিঁটিয়ে যায় জেনারেল ম্যানেজারকে দেখলে। এই বুঝি ফিজিক্যালি আনফিটরূপে তার নামের পাশে ঢ্যাঁড়া দিয়ে রাখল। এগারো বছর পর সেই ঢ্যাঁড়া দেখে নিশ্চয় মাথা নেড়ে বলবে-সরি, নো এক্সটেনশন।
বাসুদেব রাতে ঘুমোতে পারে না। রাধারানি গায়ে হাত রাখলে, দাঁত কিড়মিড় করে খাট থেকে নেমে মেঝেয় মাদুর পেতে শোয়। ফিজিক্যাল ফিটনেসের প্রমাণ দিতে হাঁটার চলন বদলে ফেলল। একজোড়া ট্রাউজারস কিনেছে তিনশো টাকায়, জুতো দু’শো টাকায়। কলপ লাগাচ্ছে কানের উপরের চুলে। দাড়িও কামাচ্ছে রোজ।
ওকে দেখে অফিসের অনেকেই ঠাট্টা করল। অল্পবয়সিরা বলল, ”দাদার কি দ্বিতীয় পক্ষ নেবার ইচ্ছে হয়েছে?” তবে সমবয়সি দু-একজন ঈর্ষাতুর গলায় যখন বলল, ”ইয়ং-ইয়ং লাগছে হে বাসু, ব্যাপার কী?” খুশিতে খান খান হয়ে গেছল বাসুদেবের ভিতরটা। কিন্তু এরা বললেই তো আর নিরাপদ বোধ করা যায় না। আসল লোকটির বলা চাই।
অফিসের একতলাটা রাস্তা থেকে বেশ উঁচু। আটধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। জেনারেল ম্যানেজার আসে ঠিক দশটায়। মোটর থেকে নেমে সিঁড়ি ভেঙে উঠেই লিফটে ঢুকে পড়ে। কোনোদিকে তাকায় না। বাসুদেব পৌনে দশটা থেকে উলটো ফুটপাতে অপেক্ষা করে। জি.এম. মোটর থেকে নামছে দেখলেই রাস্তা পার হয়। তারপর ওর সামনে দুই লাফে আটধাপ সিঁড়ি টপকে উঠে যায়। পরপর তিনদিন করেছে। চতুর্থ দিন নতুন জুতোর জন্য পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ল। জি.এম.-ই ওকে টেনে তুলে বেশ সহানুভূতির সঙ্গেই বলল, ”সাবধানে উঠুন, এই বয়সে হাত-পা ভাঙলে আর সারবে না।”
ভয়ে কুঁকড়ে গেল বাসুদেব। ‘এই বয়সে’ বলতে কী বোঝায়? শারীরিক অক্ষমতা? ফিজিক্যালি আনফিট? পরদিনই আঁশবটি দিয়ে জুতোর তলা ঘষে খরখরে করে নেয় এবং জি.এম. যাতে ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারে সেজন্য ওর চলাফেরার পথের ত্রিসামানাও বাসু আর মাড়ায় না।
এর কিছুদিন পরই অফিসের স্পোর্টসের তারিখ নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হয়। দড়ি টানাটানি, ক্রিকেট বল ছোঁড়া, ফুটবলে লাথি মারা-এইসব বিষয়গুলোর উপর চোখ বোলাতে-বোলাতে বাসুদেব পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করেছিল, ”প্রাইজ দেবে কে?” উত্তর পেয়েই মাথায় বুদ্ধি খেলতে শুরু করে। একটা থার্ড প্রাইজও জি.এম.-এর হাত থেকে যদি নেওয়া যায়, তাহলে সেটা এগারো বছর পরও কি কাজে লাগবে না!
স্পোর্টস সেক্রেটারির কাছে নাম দিতে হবে। বাসুদেব সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝল, দড়ি টানাটানিতে ডিপার্টমেন্টের টিম তৈরি হয়ে গেছে। টিমের কারুর ওজনই দু মণের কম নয়। বল ছোঁড়ায় বা লাথি মারায় ছোকরাদের সঙ্গে সে পারবে না। শুধু আধমাইল হাঁটার রেসে বয়স বেঁধে দেওয়া আছে-৪৫ ঊর্ধ্বে। বাসুদেব ঠিক করে, হাঁটায় নামবে।
তারপর থেকে সে রোজ ভোরে উঠে পার্কে চক্কর দেয়, ঘড়ি ধরে আধঘণ্টা। শরীরের প্রত্যেকটি গাঁট জং-ধরা কবজার মতো ক্যাঁচক্যাঁচ করে। প্রথম প্রথম হাঁপিয়ে পড়ত বাসুদেব জোরে পনেরো মিনিট হাঁটলেই। তারপর সয়ে গেছে। ওয়াকিং রেসে যারা নাম দিয়েছে, গোপনে তাদের লক্ষ করে দেখেছে। একমাত্র রামরাজ সাইকেল পিয়োন ছাড়া আর কারুর সম্পর্কে তার দুশ্চিন্তা নেই। ডেসপ্যাচের শৈলেন রায় এখনও ক্রিকেট খেলে বলে শোনা গেছে। কিন্তু ওর একটা পা ছোটো, খুঁড়িয়ে হাঁটে। বাসুদেব তাইতে উদ্বিগ্ন হচ্ছে না। বেয়ারা ভক্তিপদ-র বয়সটা স্টাফ সেকশান থেকে জেনে এসেছে-চুয়াল্লিশ বছর আটমাস এগারো দিন। ওকে ডিসকোয়ালিফাই করার প্রমাণ বাসুদেব সংগ্রহ করে রেখেছে।
দিন দিন মেজাজটা খোশ হয়ে আসছিল বাসুদেবের। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে শুনল, বড়োমেয়ে সুমি অর্থাৎ শর্মিলা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বয়স হয়েছিল আঠারো। দেখতে ছোটোখাটো, গত বছর পর্যন্ত ফ্রক পরে কাটিয়েছে, ক্লাস নাইনে পড়ে। বাসু শুনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। স্কুল যাবার পথে ছেলেটার সঙ্গে নাকি ভাব হয়। মেজোমেয়ে প্রমীলা তাকে একবার মাত্র দেখেছে পাড়া দিয়ে হেঁটে যেতে। আর কেউ তাকে দেখেনি বা জানে না কোথায় থাকে। ব্যাপারটা এমনই কারুর কাছে খোঁজ নিতে যাওয়া মানেই কেলেঙ্কারিটা ছড়িয়ে দেওয়া। সুমি দু’লাইনের চিঠি রেখে গেছে-”আর ফিরব না, সুতরাং খোঁজ কোরো না। মনে কোরো আমি মরে গেছি।”
”খোঁজ নেবে না?” রাধারানি ব্যাকুল স্বরে বলেছিল।
”কোথায়!” দিশাহারা বাসুদেব জানতে চেয়েছিল।
”সুমির স্কুলের বন্ধুরা হয়তো বলতে পারে।”
”খোঁজ নেব কেন, ফিরিয়ে আনবার জন্য?”
”তাহলে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেওয়া যায়। এখন লোকের কাছে বলব কী?”
”কী আবার বলবে, মেয়ে যা বলে গেছে তাই বলবে-মরে গেছে গঙ্গায়। চান করতে গিয়ে ডুবে মরেছে, ওলাওঠায় মরেছে। করো কি সারাদিন শুধু রান্নাঘরে বসে ঘুটুর ঘুটুর করা ছাড়া? নজর রাখতে পারোনি, মেয়ে বিগড়োচ্ছে বুঝতে পারোনি?”
বাসুদেব চাপা গলায় চিৎকার করেছিল। রাধারানির চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ছে। পাশের ঘরে ছেলেমেয়েরা না শোনার ভান করে কাঠ হয়ে বসে।
”বংশের মান গেল, কলঙ্ক লেপে দিয়ে গেল সকলের মুখে। ছি ছি, শেষে কিনা বেরিয়ে গেল! দুদিন পরে তো মেয়েটাকে ফেলে পালাবে। তারপর গিয়ে উঠতে হবে সোনাগাছিতে। যাক, ওই ওর কপালে আছে। ফল ওকে ভুগতেই হবে। শুধু এতবড়ো বনেদি বংশের মাথাটা হেঁট করে দিয়ে গেল। মুখ দেখাব কী করে পাড়ায়, আত্মীয়দের কাছে।”
”যদি ও ফিরে আসে-”
”তাহলে পিঠের চামড়া তুলে নেব। তুমি, তুমি, তোমার জন্যই ছেলেমেয়ে একটাও মানুষ হল না।” বাসুদেব দুহাতে মাথা চেপে ধরে ঘরে দ্রুত পায়চারি করে। ”শুধু দু’বেলা ভাত রাঁধা আর ছেলেপুলের জন্মো দেওয়া ছাড়া আর কী পারো তুমি? একা রাস্তায় বেরোতে পারো না, লোকের সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারো না, পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে জানো না, একটা বই কোনোদিন পড়তে দেখলুম না। এমন মায়ের মেয়ে বেরোবে না তো কী? সব কটা বেরিয়ে যাবে, আমি লিখে দিচ্ছি, একটাও মানুষ হবে না।”
চোখের জল ফেলতে ফেলতে রাধারানি ঘর থেকে বেরিয়ে ঢোকে রান্নাঘরে। অফিস ফেরত স্বামীকে এখনও খাবার দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পায়চারি করে বাসুদেব পাশের ঘরে এসে ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে-”সবই জেনেছ তোমরা। তোমাদের বোন যে কলঙ্ক দিয়ে গেল তা যেন বাইরে না বেরোয়। তোমাদের মেজোপিসিমা থাকে এলাহাবাদে, কেউ সুমির কথা জিগ্যেস করলে বলবে এলাহাবাদ গেছে, মেজোপিসির খুব অসুখ। দেখাশোনার জন্য নিয়ে গেছে, কবে ফিরবে ঠিক নেই। মনে থাকবে তো?”
সবাই হাঁপ ছেড়ে ঘাড় নেড়েছিল।
এই কদিনে বাসুদেব যতটা ফিজিক্যাল ফিটনেস অর্জন করেছিল, সুমি তা ধসিয়ে দিয়ে গেছে। রাত্রে ঘুমোতে পারে না, দাড়ি কামাতে ভুলে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে, পরিচিতদের এড়িয়ে যাচ্ছে অফিসে এবং পাড়ায়, পিঠ নুয়ে পড়েছে, চোখে বিষাদ ফুটে উঠেছে। সুমির থেকেও তার ভাবনা, বংশের মান-মর্যাদা নিয়ে। জানাজানি হয়ে গেলে কী হবে? ছেলেমেয়েরা অবশ্য যথাযথভাবেই রটিয়ে দিয়েছে শেখানো কথাটা।
শেফালি একদিন এসে জেরা করে গেছে রাধারানিকে। ”কই, আগে তো কখনো মেজোপিসির বাড়ি থেকে খোঁজখবর করেছে বলে শুনিনি। যাক, তবু এলাহাবাদটা দেখা হয়ে যাবে এই তলে। ফিরবে কবে গা?”
রাধারানি নেহাতই ভালো মানুষ। বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা বলে যেতে পারে না। তবু প্রাণপণে বুদ্ধি খরচ করে বলল, ”ফেরার কি কিছু ঠিক আছে। অসুখ না সারা পর্যন্ত থাকবে, আর কবে যে সারবে কে জানে।”
”তদ্দিন স্কুল কামাই হবে তো?”
”তা হবে।”
”ভালোই হয়েছে। স্কুল যাবার পথে বখাটে একটা ছেলে বড্ড ওর পিছু লাগত। চিঠিফিটিও দিত। আর দেখছই তো আজকাল ছেলেমেয়েরা কিনা কাণ্ড করছে। এইভাবেই রাস্তাঘাটে ভাব-সাব হয়, তারপর একদিন বাড়ি থেকে পালায়। আর বাপ-মা তার ঠ্যালা সামলাতে নাকানি-চোবানি খায়। তবে একটা উপকার বাপু করে দেয়, বিয়ে দিতে যে খরচটা হত সেটা বেঁচে যায়। বলো, ঠিক কিনা?”
রাধারানি কোনোমতে ঘাড় নাড়ে আর শুধুই তার মনে হয়, শেফালির কথাগুলো যেন কেমন বাঁকা ধরনের। রাত্রে চুপি-চুপি বাসুদেবকে বলা মাত্র, বাসু উঠে বসে বিছানায়।
”সর্বনাশ হবে, আমি জানি হবেই। ধুলোয় লুটোবে ধর-বাড়ির মান-মর্যাদা। তোমার জন্য, সব তোমার জন্য।” বলতে বলতে বাসুদেব কাটা তালগাছের মতো লুটিয়ে পড়ে।
রাধারানি স্তব্ধ হয়ে বসে ভাবে, তার কী দোষ। কেন সবকিছুর জন্য সেই দায়ী। গভীর রাতে তার মনে হয় সুমি চুপিসারে ফিরছে। রাস্তার ইলেকট্রিক আলোয় তাকে দেখা যাবে, এই ভয়ে সে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ময়রা গলিতে। রাধারানির ইচ্ছে হয়, বেরিয়ে গিয়ে সব রাস্তার আলো নিভিয়ে পাড়াটা অন্ধকার করে দেয়।
এক এক রাত্রে সে সদর দরজার খিল খুলে একটা পাল্লা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুমি আসছে দেখলেই ছুটে গিয়ে আঁচল দিয়ে ওকে ঢেকে ঘরে নিয়ে আসবে। মেয়েটা লজ্জায় আসতে পারছে না, নইলে সুমি তেমন মেয়ে নয় যে বাপ-মাকে কষ্ট দিয়ে বেশিদিন দূরে থাকতে পারবে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস সুমি ফিরে আসবেই, শুধু এত আলোর মধ্যে দিয়ে আসতে হবে বলে লজ্জায় পারছে না।
এক রাতে বাসুদেব নিঃশব্দে উঠে এসে, সদরে দাঁড়ানো রাধারানির কাঁধে হাত রাখল। চমকে উঠে সিঁটিয়ে গেল সে। বোধহয় যাচ্ছেতাই করে এইবার কিছু বলবে।
”ওকি আর ফিরবে।” বাসুদেব ক্লান্ত স্বরে বলল। রাধারানি কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না।
”এমন কাজ করার কী যে দরকার ছিল ওর।” বিষণ্ণ সুর ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকারে। ”কতই বা বয়স, জীবনের কী-ই-বা দেখল, জানলো। ও কি ভেবেছিল, বাবা বিয়ে দিতে পারবে না? গরিব হয়ে গেছি বটে, কিন্তু কোনোদিন কারুর কাছে তো হাত পাতিনি। যেভাবেই হোক, বাইশ বছর ধরে সংসার তো চালিয়ে আসছি। এত কষ্ট করি সকলের জন্য, কিন্তু আমার মুখ চাইল না।”
”এখনও ছেলেমানুষ। বুঝবে ঠিকই, ফিরেও আসবে।” রাধারানি আলতো করে হাত রাখল বাসুদেবের বুকে।
”চলো, দাঁড়িয়ে লাভ নেই।”
”ও এলে তুমি কিছু বলো না। যা বলার আমি বলব। ওকে আমি মারব, ভীষণ মারব, এমন মারব যে জীবনেও ভুলতে পারবে না।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রাধারানি। বাসুদেব ওকে টেনে নিয়ে গেল ঘরে।
অফিস স্পোর্টসে বাসুদেব চারজনের পর হাঁটা শেষ করল। প্রথম তিনজন প্রাইজ নিল জেনারেল ম্যানেজারের হাত থেকে। প্রাইজ দেবার সময় জি.এম. হেসে দু-চারটে রসিকতা করে। কেষ্ট দত্ত একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি হাতে ডগমগ হয়ে বলল, ”কী বলল শোন, আমি নাকি তিরিশ বছর বয়স ভাঁড়িয়ে রেসে নেমেছি। কালই সার্ভিস রেকর্ড খুলে বয়স চেক করবে।”
টেবল ল্যাম্পটা ছেলের হাতে দিয়ে প্রমোদ বোস বলল, ”আর আমায় কী বলল জানিস, নিশ্চয় মিসেস বোস এখানে আছেন, নয়তো এমন ইনসপায়ারড ফিনিশিং সম্ভব হত না।” ফুলদানিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে রামরাজ বলল, ”এটা নিয়ে হামি কী কোরব। কৌন কামে লাগবে হামার।”
অদ্ভুত একটা শূন্যতা বোধ নিয়ে ফিরছিল বাসুদেব। পাড়ায় ঢুকেই দূর থেকে দেখল অনন্ত সিংহের বাড়ির দরজায় একটা নীল মোটর দাঁড়িয়ে। ওর মেয়েকে আজ দেখতে আসবে, বোধহয় গাড়িটা তাদেরই। পুতুলের থেকে সুমি দু-তিন বছরের বড়ো। সুমির বিয়ে দেবার কথা এক-আধবার মনে এসেছিল, কিন্তু অন্যান্য চিন্তায় তলিয়ে যায়। এখন আর মনে করার দরকার হবে না।
অনন্ত মোটরের বাম্পারে পা তুলে দিল। বাসুদেব বুঝল, সেটা তাকে দেখেই। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার কায়দাটা যে অহঙ্কার বোঝাবার জন্য সেটাও বুঝল সে। মাথার মধ্যেটা গরম হয়ে উঠল বাসুদেবের। আজকাল বাড়িতে পা দিয়েই সে জিজ্ঞাসা করে,-”প্রমি কোথায়?” ষোলোয় পড়েছে। এখন থেকে আর চোখের আড়াল করা নয়।
”কোথায় গেছে?” বাসুদেব চিৎকার করে উঠল।
”আমায় বলেই গেছে?” রাধারানি রান্নাঘর থেকে ছুটে এল। ”কে এক সিনেমার হিরো এসেছে বুঝি তিনের-বি বাড়িতে, দেখতে গেছে।”
”কার সঙ্গে গেছে?”
”একাই গেছে।”
‘শিগগিরি ডেকে পাঠাও, সিনেমার হিরো দেখে আর কাজ নেই।’
এই বলে বাসুদেব দ্রুত ঘরে ঢুকল; অফিস থেকে ফিরেই আর একবার পায়খানা যাওয়া তার অভ্যাস। অভ্যাসটি পালন করতে গিয়ে টের পেল প্যানের মধ্যে কিছু একটা পড়ে রয়েছে, যার ফলে গর্তটা বোজা। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এসে চিৎকার করল, ”জেনেশুনেও কি তোমরা চুপ করে মজা দেখছিলে? যখন ঢুকলুম তখন বলতে পারতে তো, বল পড়েছে। বাঁ হাত দিয়ে তুলে নিতুম। এখন তুলি কী করে?”
এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্রদ্বয়কে বেধড়ক কয়েক ঘা দিল বাসুদেব। ”পড়াশুনো নেই, দিনরাত শুধু খেলা আর খেলা। এখন এই বল তুলবে কে?”
”একটা ধাঙড় ডেকে আনলেই তো হয়।” রাধারানি বুদ্ধি করে বলল। অবশ্যই ভয়ে ভয়ে।
”সন্ধের পর ধাঙড় বসে আছে বল তোলার জন্য।” বাসুদেব রাগে গজগজ করে কয়েক বালতি জল ঢেলে বাঁ হাতে বলটা তুলল।
বল আর বেড়ালে কোনো তফাত নেই। যেখানেই ছেড়ে এসো না ঠিক ফিরে আসবে। দূরে গিয়ে ফেলে আসতে হবে নয়তো ছেলে দুটো এই বল নিয়ে আবার খেলা শুরু করে দেবে। তারক কবিরাজ স্ট্রিটে যে ডাস্টবিনটা আছে তার মধ্যে ফেলার উদ্দেশ্যে বেরোতে গিয়ে বাসুদেব সদরেই থমকে গেল। নীল ঝকঝকে মোটরে পা তুলে দাঁড়ানো অনন্তের ধোঁয়া ছাড়ার অহঙ্কারি ভঙ্গিটি মনে পড়ল তার। আবার তাকে দেখলে আবার পা তুলবে, আবার ধোঁয়া ছেড়ে মিটমিট করে তাকিয়ে হাসবে।
হাসাচ্ছি তোকে! বাসুদেব তরতরিয়ে ছাদে উঠে এল। যেদিকে দু চোখ যায় ছুঁড়ে দেবে! এধার-ওধার তাকিয়ে কোনদিকে ছুঁড়বে ঠিক করে উঠতে পারল না সে। বলটা ছাদের মেঝেয় রাখল। নর্দমার ঢালু দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে পা দিয়ে আটকাল। পা তুলতেই বলটা আবার গড়িয়ে যাচ্ছে। পায়ের চেটো দিয়ে বাসুদেব বলটাকে টানল। বলটা পিছিয়ে পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে আবার গড়িয়ে এল।
বাসুদেবের মন্দ লাগল না ব্যাপারটা। আস্তে সট করল বলটায়। পাঁচিলে লেগে আবার তার কাছেই ফিরে এল। অন্ধকার ছাদে ভালো করে নজর করা যাচ্ছে না, তবু বাসুদেব আন্দাজে ব্যাপারটা চালিয়ে যাওয়ার একটা মজা পেয়ে গেল। এখন তার মনে হচ্ছে চল্লিশ বছর আগের বয়সে যেন ফিরে যাচ্ছে সে।
সাত
অসীম কাল রাতে বাড়ি ফিরেই শোনে, গুণোদা একজনকে পাঠিয়েছিল। বসিরহাটে সেমিফাইনাল খেলতে হবে। গুণোদার পেশা বিভিন্ন ক্লাবে খেলোয়াড় কম পড়লে জোগাড় করে দেওয়া। এজন্য কমিশন পায়। মফসসল ক্লাব-কর্মকর্তাদের ভিড় লেগেই আছে ওর বাড়িতে। ট্রফি পাইয়ে দেবার কনট্রাক্টও গুণোদা নেয়। ওর তালিকায় জনা তিরিশ খেলোয়াড়ের নাম আছে, যাদের অর্ধেকই কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে। তাদের অনেকে ভারতের জার্সিও পরেছে। নাম অনুযায়ী গুণোদা ওদের দাম দেয়। গুণোদার অনুগ্রহে কেউ কেউ বছরে পাঁচ হাজার টাকাও সংগ্রহ করে। ওর তালিকায় অসীমও আছে। দূর গ্রামাঞ্চলে, অখ্যাত টুর্নামেন্টে খেলতে ‘নামীরা’ যেতে চায় না। তখন অসীমের ডাক পড়ে।
কাল গুণোদার লোকটি অসীমের জন্য বাড়িতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। বারকয়েক রাস্তায় বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে প্রভাতের হাতে অগ্রিম বাবদ তিরিশ টাকা দিয়ে, পরদিন সন্ধ্যায় আসবে জানিয়ে চলে গেছে। টাকা পাওয়া মাত্র তাই থেকে কুড়ি টাকা তখনি খরচ হয়ে যায়। বহুদিন পর রাত্রে ওদের উনুনে রুটি সেঁকার বদলে ভাতের হাঁড়ি চড়ে।
অসীমের বাবা প্রভাত রায় ত্রিশ বছর আগে রোভারস কাপেও খেলেছে। আটাশ বছর আগে আই.এফ.এ শিল্ডের ফার্স্ট রাউন্ডের খেলায় গোড়ালিতে চোট পেয়ে জখম হয়। ফোর্থ রাউন্ডে ক্লাব-কর্তারা জোর করে নামায়, ইঞ্জেকসন দিয়ে ব্যথা অসাড় করে। সে খেলায় ওরা হেরে যায় এবং সমর্থকদের ধারণা প্রভাতের জন্যই। খেলা শেষে বাড়ি ফেরার সময় ময়দানের অন্ধকারে টেনে নিয়ে কারা ওকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে যায়। সেদিন থেকে প্রভাত রায় আর ফুটবলে পা দেয়নি। সেদিন অজ্ঞান হবার আগে ওর কানে শুধু এই কথা কটি ঢুকেছিল-”ঘুষ নিয়ে বড়োলোক হবি শালা? হওয়াচ্ছি। ক্লাব কি টাকা দেয় না তোকে? তবুও অত লকলকে নোলা কেনরে বেইমান, নেমকহারাম। ঘুষ নিয়ে আমাদের ইজ্জত ডোবানো বার করছি।”
”ইজ্জত”! অসীম বুনো মোষের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ”টাকা নেবার সময় মনে ছিল না ইজ্জতের কথা। এই পা নিয়ে আমি হাঁটতে পর্যন্ত পারছি না, আর খেলে এসে তোমার ইজ্জত বাঁচাব? কে বলেছিল হাত পেতে টাকা নিতে? কে, কে, কে, বলেছিল? আমার পা কি পা নয়? আমার জীবনটা কি আমার নয়? সব দান করে যেতে হবে তোমাদের খাওয়াবার জন্য?”
চিৎকার করতে করতে অসীম পায়চারি করে। মা, বাবা, ভাই, বোন আর ঠাকুমা মাথা নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ভাত খাওয়া এঁটো থালাগুলো বাইরে দালানে পড়ে, চেটেপুটে খেয়েছে ভাইগুলো।
”যেখান থেকে পারো, জোগাড় করে দিয়ে দাও। কাল এলেই দিয়ে দেবে। ইজ্জত আমারও আছে।”
”কোথায় পাব ত্রিশ টাকা, কালকের মধ্যেই।” প্রভাত করুণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়।
”কোথায় পাবে তার আমি কি জানি? এ সংসার কি আমি তৈরি করেছি?”
”তুই বড়োছেলে, তোরও তো খানিকটা দায়িত্ব নেওয়া উচিত। বড়োতো হয়েছিস।” ঠাকুমা ভয়ে ভয়ে বলল।
”তুমি চুপ করো তো। আমি কি টাকা দিই না? আমার নিজের জন্য কি কিছুই খরচ করব না? এই পা দুটো আমার ভবিষ্যৎ, আমার জীবন। এর একটা শেষ হয়ে গেলে আমি কোথায় দাঁড়াব? কে তখন আমায় দেখবে? পয়সার জন্য চোটটা সারাতে পারছি না। চোট আছে জানলে কেউ আর পয়সা দিয়ে ডাকবে না। তাই জানাতেও পারি না।”
বলতে বলতে অসীম থেমে গেল! গলা আটকে গেছে অবরুদ্ধ বাষ্পে। প্রভাতের দিকে ঘরের সবাই তাকাল। পুরু কাচের চশমাটা খুলে প্রভাত গেঞ্জি তুলে মুছতে লাগল ঘাড় হেঁট করে।
”দেখি, অফিসে কারুর কাছে ধার পাই কি না। এই বাজারে একসঙ্গে তিরিশ টাকা পাওয়া-” প্রভাতের গলা ক্ষীণ হয়ে থেমে গেল।
ঘুম থেকে উঠেই অসীম আজ বেরিয়ে পড়ে। পাওয়া সম্ভব এমন লোকেদের কাছে চেষ্টা করে টাকা ধার পেল না। তারপর বেলা বারোটা পর্যন্ত ঠাকুরের চায়ের দোকানে কাটিয়ে বাড়ি ফেরে।
গুণোদার পাঠানো সেই লোকটা এসেছিল। ছোটোবোন নিলি অসীমকে আড়ালে ডেকে বলল, ”বাবাকে যাচ্ছেতাই করে বলে গেল লোকটা। বলল, কালকেই ম্যাচ খেলা আর এখন বলছে যেতে পারবে না, পায়ে চোট! সব বাজে কথা।”
”বাবা বলেছিল পায়ে চোট থাকার কথা!” অসীম অবিশ্বাস ভরে তাকিয়ে রইল।
”বারে, লোকটা যে বলল, প্যাঁচ কষে টাকা বাড়াবার জন্য মিথ্যে করে এখন বলা হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ আছে। বাবা তো প্রথমে তাই বলেছিল। লোকটা চিঠি দেখতে চায়। বাবা বলে অসীমের কাছে আছে। তখন ওইসব বলতে শুরু করে-বাবা শেষকালে বলল, পায়ে লেগেছে, বিশ্বাস না হয় রাতে এসে দেখে যাবেন। হাঁটতে পর্যন্ত কষ্ট হয়। তাইতে লোকটা বলে সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ইঞ্জেকশানের খরচ আমরাই দোব। তাইতে বাবা কী ভীষণ রেগে উঠল। বেরিয়ে যান এখুনি, আপনার ট্রফির থেকেও আমার ছেলের জীবন দামি। লক্ষ টাকা দিলেও ও খেলতে যাবে না। ভারি তো আপনার তিরিশটা টাকা, নিয়ে যাবেন রাতে এসে, এইসব বলে খুব চেঁচাতে থাকে।”
”লোকটা কী বলল?”
”টাকা নিতে আসবে আজ রাতে। অন্য প্লেয়ার জোগাড় করতে টাকাটা আজই দরকার। না পেলে কেলেঙ্কারি করবে বলে শাসিয়ে গেল।”
”হ্যাঁ, কেলেঙ্কারি করবে! শালাকে তাহলে আর জান নিয়ে ফিরতে হবে না।”
অসীম গা-ঝাড়া দিয়ে প্রসঙ্গটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু ওর ভালো লেগেছে প্রভাতের কথাগুলো। ছেলেকে কোনোদিন খেলায় উৎসাহ দেয়নি বা বারণও করেনি। ফুটবলের কথা উঠলে কখনো মুখ খোলেনি। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা করত অসীমের, বাবা কোনোদিন তার খেলা দেখেছে কিনা! জানতে পারেনি। প্রভাত তার সময়ে নাম-করা উঠতি প্লেয়ারদের একজন ছিল বলে, বুড়োরা যখন অসীমকে গল্প শোনায় তখন গর্ব হয় তার। প্রভাত রায়ের ছেলে বলে অনেক জায়গায় সে খাতিরও পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল। একটা ভালো চাকরিও জোগাড় করতে পারেনি প্রভাত। পা খুইয়ে বিদায় নিল মাঠ থেকে। ক্লাবও আর খবর নিল না। এইরকমই হয়।
অসীম দুপুরে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখল। পর্তুগালের বেনফিকা ক্লাব থেকে লোক এসেছে জয়রাম মিত্র লেনে। প্রভাতের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা, হাতে চেক বই।
”আপনি টাকার ফিগারটা বসিয়ে নিন।”
প্রভাত দিশাহারা হয়ে আমতা-আমতা শুরু করেছে দেখে লোকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, ”ইওসেবিওকে যত টাকা দিয়ে আমরা এনেছিলাম, তার থেকে বেশি দিতেও আমরা রাজি।”
”কিন্তু আমার ছেলেকে আপনারা নেবেন কেন?”
”তার মানে?”
সাহেবটা খুব অবাক হয়ে গেল। তারপর মুচকি হেসে বলল, ”আপনার ছেলের খবর আমরা পেয়েছি, আমাদের ক্লাবের কোচ মারফত। তিনি জাপান যাচ্ছিলেন। কলকাতায় প্লেন বিগড়ে যাওয়ায় একদিন থাকতে বাধ্য হন। সেদিন মোহনবাগান মাঠে একটা খেলা দেখেন। সেই রাতেই ট্রাঙ্ককল করেন লিসবনে। বলেন, ইওসেবিওর থেকেও দারুণ একটা ছেলের খোঁজ পেয়েছি, এখনি ধরতে হবে। পরের প্লেনেই আমি কলকাতায় পৌঁছে পর পর অসীমের তিনটে খেলা দেখে তারপর আপনার কাছে এসেছি। আমরা ইওসেবিওকে রিপ্লেস করতে চাই। ক্লাব প্রেসিডেন্ট রওনা হওয়ার আগে বলে দিয়েছেন, যদি বোঝ কোচের কথা সত্যি, তাহলে সই করা সাদা চেক এগিয়ে দেবে।”
প্রভাতের হাতে চেকবই আর কলম দিয়ে পর্তুগিজ সাহেব হাসল। অন্যমনস্ক হয়ে প্রভাত একটা তিন আর শূন্য বসাল চেকের উপর। তারপর কী ভেবে বলল, ”লক্ষ টাকা দিলেও ওকে আমি খেলতে দেব না। ওর জীবনের দাম অনেক অনেক বেশি। পায়ে যদি চোট পায় তাহলে ও শেষ হয়ে যাবে।”
চেক বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রভাত উঠে দাঁড়াল, সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে।
”নো, নো, গেট আউট। আমি দেব না, লক্ষ লক্ষ টাকাতেও দেব না। গেট আউট, গেট আউট।”
ঘুম ভেঙে গেল অসীমের। এক্ষুনি উঠতে ইচ্ছে করল না তার। কাত হয়ে শুয়ে রইল। স্বপ্নটা দেখার জন্য তার লজ্জা করছে। অথচ চাপা এক ধরনের মমতায় ফেঁপে উঠছে তার বুকটা। চোখ বুজে সে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল-”ওর জীবনের দাম অনেক অনেক বেশি।”
সারা শরীরের উপর কে যেন আদর বুলিয়ে যাচ্ছে। অসীম প্রবল সুখে আচ্ছন্ন হল। একবার সে হাসল আপনমনে। তিরিশের পাশে আরও চারটে শূন্য বাবা অনায়াসেই বসিয়ে দিতে পারত। তিন লক্ষ! গোটা জয়রাম মিত্র লেন কুড়িয়ে তিন লক্ষ টাকা বেরোবে না। শুনলে পাড়ার লোকগুলোর মুখ কেমন হয়ে উঠবে কিছুক্ষণ ধরে অসীম তাই ভাবল। ভাবতে ভাবতে আভার মুখটা ভেসে উঠল। তারপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত! আর অসীমের দেহ থেকে আচ্ছন্ন সুখটা উবে যেতে শুরু করল।
আভার মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটবে না। হাসবে ভদ্রতা করে। হয়তো বলবে, ”তিন লাখ টাকা ফুটবল খেলে পাওয়া যায়, জানতাম না তো! ভালোই হল।” খুবই নিরাসক্ত গলায় বলবে। বি.এ. এম.এ. পাশ করার থেকে ফুটবল খেলা সোজা নয়-এটা ওদের কেউ বুঝবে না। কত খাটুনি কষ্ট সয়ে যে খেলা শিখতে হয় তা জানে না। শুধু বোঝে আর জানে চেয়ারে বসে খুচ খুচ করে লেখা, নাকের কাছে বই ধরে বিছানায় চিত হয়ে পড়ে থাকা, আর চিবিয়ে চিবিয়ে বড়ো বড়ো বাত ঝাড়া। একটা বাইশ-চব্বিশ বছরের মেয়ে অমন গম্ভীর, উদাসীন হয়ে থাকে কী করে? ওর কী কোনো প্রেমিক আছে?
অসীম বিরক্ত মনে উঠে পড়ে। ত্রিশ টাকা জোগাড় করে প্রভাত ফেরে কিনা দেখার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। প্রভাত অফিস থেকে ফিরে সকলের দিকে তাকিয়ে যখন মাথা নামিয়ে জামার বোতাম খুলতে শুরু করল অসীম তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারক কবিরাজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তারপর আসে ঝকঝকে আকাশি-নীল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডটা।
ঠাকুরের চায়ের দোকানে রাজনীতির তর্ক চলেছে। ওরা কেউ তিরিশ টাকা এক্ষুনি দিতে পারবে না। অসীম একধারে চুপ করে বসে। লোকটা চলে গেলেই ছোটোভাই এসে খবর দেবে। আধঘণ্টা কেটে গেল এখনও আসছে না। তাহলে কি কিছু ঘটছে বাড়িতে?
লোকটা কী চিৎকার করে লোক জমিয়েছে? নাকি গুম হয়ে বাইরের রকে বসে আছে অসীমের অপেক্ষায়। সত্যিই দেখে যাবে পায়ে চোট হয়েছে কিনা। কিন্তু হাড়ভাঙা নয়, কাটাকুটি নয় যে প্লাস্টার কী ব্যান্ডেজ করা থাকবে। অসীম ডান হাঁটুতে হাত বোলাল। উপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যাবে না। মাথাধরা পেট কামড়ানো কী দেখে বোঝা যায়? ব্যথা রয়েছে, ডান পায়ে ভর পড়লেই যন্ত্রণা হচ্ছে এটা কী করে বোঝাবে।
লোকটা কি অপমান করছে বাবাকে? সকালে জোর গলায় প্রভাত বলেছে, ভারি তো তিরিশ টাকা! লোকটা হয়তো এখন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কথা দিয়ে কাটছে আর নুন ছিটোচ্ছে প্রভাতের গায়ে। পাড়ার খচ্চচর লোকগুলো মুচকি হাসছে। এই দৃশ্য বারবার ভেসে উঠতে লাগল অসীমের চোখে। ছটফট করে সে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। ব্যাটাকে পুঁতে ফেলব যদি বাবাকে অপমান করে। যদি একটু বেইজ্জতি কথা বলে থাকে তাহলে জান নিয়ে ফিরতে দেব না।
অসীম দ্রুত বাড়ির দিকে চলল। পায়ের ব্যথাটা এখন লাগছে না। তারক কবিরাজ স্ট্রিট থেকে পাড়ার মধ্যে ঢুকতেই দেখল ছোটোভাইটা ছুটে আসছে। ওর আসা দেখে ঠান্ডা হয়ে গেল অসীমের সর্বাঙ্গ।
”লোকটা বসে আছে দাদা।”
”চেঁচায়নি?”
”না। একবার ভেউভেউ করে কাঁদল। বলছে, এখনও প্লেয়ার জোগাড় হল না, শিল্ডটা বোধহয় হাতছাড়া হয়ে গেল। একজনের কাছে গেছল, সে পঞ্চাশ টাকা চেয়েছে। বাবার পায়ে ধরে বলল, হয় অসীমকে দিন নয়তো টাকাটা এক্ষুনি দিন।”
”বাবা কী বলল?”
”চুপ করে বসে আছে। দিদি চুপিচুপি এইটে দিল তোমায় দেবার জন্য।”
পকেট থেকে একটা আংটি বার করে অসীমের দিকে এগিয়ে ধরল।
”অনন্ত সিংগীর কাছে এটা বাঁধা দিয়ে তিরিশটা টাকা নিয়ে আসতে বলল দিদি।”
আংটিটা হাতে নিয়ে অসীম ইতস্তত করে বলল, ”আচ্ছা যা।”
কোনোদিন নিলির আঙুলে এটা সে দেখেনি। অসীম অবাক হয়ে গেল। দেখতে ঝকঝকে, তার মানে ব্যবহার হয়নি, তোলা ছিল। ওর কাছে এটা এল কী করে? বাবা-মা দেয়নি, দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। নিলির হাতে দু’গাছা ফিনফিনে সোনার চুড়ি ছিল, গত বছরই অনন্তের সিন্দুকে উঠেছে। তাহলে এটা পেল কার কাছ থেকে? প্রেম ট্রেম করছে নাকি!
অসীম রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়েই ভাবল, আংটিটা বাঁধা দেব কি দেব না। চোখে পড়ল সত্যচরণ বালতি হাতে বেরিয়ে টিউবওয়েলের দিকে যেতে যেতে মোটরটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর উবু হয়ে গাড়ির নিচে তাকিয়ে হুশ হুশ শব্দ করছে হাত নেড়ে। কিছু একটা তাড়াচ্ছে।
অসীম এগিয়ে এসে বিরক্তস্বরে বলল, ”কী করছেন?”
”দ্যাখ তো ফ্যালা, একটা বেড়াল-বাচ্চচা কোত্থেকে এসে জুটল। আরে ঢুকবি তো একেবারে মোটরের নিচেই। গাড়িটা চললেই তো চটকে যাবে। রক্তে মাংসে রাস্তাটার কি না হবে! কাক এসে ঠুকরে নিয়ে এবাড়ি-ওবাড়িতে বসবে, ছড়াবে, ছয়লাপ হবে। ডেঞ্জারাস। এভাবে তলায় বসে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।”
অসীম নিচু হয়ে দেখল। সত্যিই পিছনের চাকার সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে একটা বেড়াল-বাচ্চচা। মিউ মিউ করে যাচ্ছে অনবরত।
”আছে থাক। স্টার্টের আওয়াজ পেলেই সটকান দেবে।”
”বলছিস পালাবে?” বলেই সত্যচরণ অনমনস্ক হয়ে গেল। কালীর মা অর্থাৎ আঙুরবালা টিউবওয়েলে জল নিতে এসেছে। আগে বাসন মাজতো সত্যচরণের সংসারে। চারুশীলা বছর তিনেক আগে ওকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। আঙুর তারক কবিরাজ স্ট্রিটের বস্তিতে থাকে। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ।
এই সময় অনন্তের সদরে ওর ভাই দুলাল এসে দাঁড়াল। অসীমকে লক্ষ করে বলল, ”গাড়িটা কার রে ফ্যালা?”
প্রশ্নের সুরটা অসীমের পছন্দ হল না। তাচ্ছিল্য ভরে বলল, ”কে জানে।”
দুলালের মুখে দিশি মদের গন্ধ। অনন্তের সঙ্গে ওর মুখ দেখাদেখি নেই যদিও একই বাড়ির পিছনের অংশে থাকে। অনন্তের সঙ্গে দেখা করতে হলে, ডেকে দেবার জন্য কাকে বলা যায়। কাউকে দেখার আশায় অসীম উঁকি দিল রাস্তা থেকেই। চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করতে তার বাধল।
”কাকে খুঁজছিস?” দুলাল বলল।
”অনন্ত জ্যাঠাকে।”
”ও ব্যাটাকে আবার কী কম্মে দরকার। আমায় বল।” দুলাল বিড়ি বার করল পকেট থেকে।
”পারসোনাল টক আছে।”
”ওরে বাব্বা, অনন্ত সিংগীর সঙ্গেও লোকে পারসোনাল টক করে। কতই দেখব বাওয়া, দিনে দিনে। দ্যাখ, দ্যাখ, সত্যটা কেমন করে মাগিটার দিকে তাকাচ্ছে।”
অসীম দেখল ঘাড় ফিরিয়ে। প্রশ্রয় পেলে দুলাল অশ্রাব্য ভাষায় কেচ্ছা শুরু করে দেবে। তাছাড়া ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলে অনন্ত একটা পয়সাও বার করবে না, দোরগোড়া থেকেই ভাগিয়ে দেবে। আংটিটা বাঁধা দিয়ে তিরিশ টাকা পাওয়া যাবে কি না অসীমের সন্দেহ আছে! এক আনা সোনাও বোধহয় নেই। দুলালের সঙ্গ এড়াবার জন্য সে এগিয়ে গেল সত্যচরণের দিকে। সত্য কী বলছিল কালীর মাকে, চুপ করে গেল।
”অনন্ত জ্যাঠাকে কী করে ডাকি বলুন তো?”
”ও মা, সে তো এই খানিক আগে বেরোল। মিষ্টির দোকানে গেছে, এখুনি ফিরবে। ওর মেয়েকে আজ যে পাত্র নিজে দেখতে আসছে। আইরিটোলার শীলেদের বাড়ির ছেলে।”
অসীম আর দাঁড়ানোর দরকার বোধ করল না। মোড়টা ঘোরার সময় মনে হল তিরিশের-একের বসবার ঘরের জানলার খয়েরি পর্দা সরিয়ে কেউ মাথা হেলিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। আভা কি না দেখার জন্য সে কৌতূহলী হয়ে উঠল। কাছাকাছি হতেই খুব অবাক হয়ে দেখল শোভা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
অসীম একটু দূরে সরে যেতেই সত্যচরণ থেমে যাওয়া কথাটার খেই ধরল।
”আমি কি আর তোমায় ছাড়িয়েছি গো। তোমার বউদিকে তো চেনই কেমন মানুষ।”
”আপনিও কেমন মানুষ তা আমার জানা আছে। একজোড়া বালা মেয়েকে গড়িয়ে দেবেন বলে তো আজ পাঁচ বচ্ছর ধরে ঘোরাচ্ছেন।”
”ওমা, এইতো গত বছর সবে বললুম, আর বলছ পাঁচ বছর।”
কথা না বলে কালীর মা পাম্প করতে থাকল। সত্যচরণ প্রবল আগ্রহে প্রতিটি ঝাঁকির সঙ্গে ওর সারা শরীরের দুলুনি লক্ষ করায় তৎপর হল। তার মনে হল, আঙুরবালা আর অতটা আঁটো-সাটো নেই। একজোড়া বালা, চোদ্দো ক্যারট হলেও কম করে গোটা হাজার টাকা খসবে। অত টাকা এখন আঙুরের উপর ইনভেস্ট করা উচিত হবে না বলেই তার মনে হচ্ছে। চারুশীলা যদি ওকে তাড়াবার উদ্দেশ্যে চুক্তি ভঙ্গ করে, বাসনের সঙ্গে দুটোর জায়গায় তিনটে পোড়া বার করে না দিত, তাহলে বালা গড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিটা হঠাৎ মুখ ফস্কে কি বেরিয়ে যেত? তবুও আঙুর কাজ ছেড়ে দিল। দেখে দেখে চিমড়েপোড়া এক বুড়িকে চারুশীলা কাজে লাগিয়েছে। এর আগে তিনজনকে তাড়িয়েছে, একই ছুতোয়। ঝিগুলো আসে হতকুচ্ছিত রোগাপটকা চেহারা নিয়ে, তারপর চারুশীলার নজরে, কেমন যেন পরিপাটি হয়ে যায়, ঢলানি-ঢলানি ভাব ধরা পড়ে, আর সত্যচরণও যেন উঠোনের জানলার ধারে বসে বড়ো বেশিক্ষণ সময় নেয় দাড়ি কামাতে। এই নিয়ে রাতে বহুবার তুলকালাম হয়ে গেছে ওদের। আঙুরের চতুর্থ মেয়েটির পাশে সত্যচরণের দুই মেয়ে ভুতি আর টুনুকে দাঁড় করিয়ে দিলে কার সাধ্য বলে ওরা তিন বোন নয়-এই কথাটি কে যেন একবার পাড়ায় চাউর করেছিল। সত্যচরণের দৃঢ় ধারণা কাজটা শেফালিরই। কেননা, একদিন শেফালিই বাড়ি বয়ে জানিয়ে গেছল, ”সত্যদার মতো লোকের চরিত্র নিয়ে কথা বলার সাহস পায়, বউদি, কী হয়েছে যে পাড়ার কী বলব।”
জলের বালতি হাতে ঝুলিয়ে কালীর মা মিষ্টি করে হেসে নিচু গলায় বলল, ”বড্ড ঠ্যাকায় পড়ে গেছি, পাঁচটা টাকা দিতে পারেন।”
”পাঁচ! এখুনি?” সত্যচরণ গামছার কসি আঁট করতে করতে হাসল। বাঁ হাতে ঘোমটাটা আর একটু টেনে দিতে দিতে কালীর মা ঘাড় নাড়ল।
”আচ্ছা! আজই তাহলে দিয়ে আসব।”
সত্যচরণ হঠাৎ প্রফুল্ল বোধ করল। গুন গুন সুর বেরোল মুখ দিয়ে। পিছু ফিরে, আঙুরের চলন দেখে এখন তার মনে হল, মেয়েটাকে বালা গড়িয়ে দিতে কতই বা আর খরচ।
আট
”আশ্চর্য”, শোভা উত্তেজিত হয়ে আবার ঘরে ঢুকল। ”আভাকে এত করে বললাম, অথচ কানেই নিল না। সিনেমায় দেখা আর এমনি সামনা-সামনি দেখায় কত তফাত। আচ্ছা, তুমি কখনো কাউকে সামনা-সামনি দেখেছ?”
হিরণ্ময় বই থেকে মুখ তুলে তাকাল।
”না।”
”খুব ছোটোবেলায়, এই টিপুর মতো বয়সে আমি একবার অশোককুমারকে দেখেছিলাম। তখন বাবা বোম্বাইয়ে বদলি হয়েছিলেন।”
খাটের উপর খালি সিগারেটের প্যাকেটগুলো সাজিয়ে টিপু খেলা করছে। নিজের নাম শুনে মায়ের দিকে তাকাল। হিরণ্ময় পা দিয়ে একটা প্যাকেট ফেলে দিল ওকে রাগাবার জন্য। প্রায়ই এমন করে সে।
টিপু একটা কিল মারল হিরণ্ময়ের পায়ে। ”উঃ” বলে হিরণ্ময় পায়ে হাত বুলোতে শুরু করল। কিছুক্ষণ টিপু লক্ষ করবে না ব্যাপারটা। ক্রমাগত উঃ, আঃ করে যেতে হবে। তখন ওর ডাক্তারি শুরু হবে। সেটা দেখার জন্য মা ও মাসির অবশ্যই হাজির থাকা চাই।
”আজ থাক।” শোভা একটু চাপা গলায় হিরণ্ময়কে বলল। ”আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে, কী করে দেখা যায় বলো তো?”
”জানলায় দাঁড়িয়ে থাকো। বেরিয়ে এসে যখন গাড়িতে উঠবে দেখে নেবে।”
”কী যে বলো! জানলায় হাঁ করে দাঁড়াই আর যত রাস্তার বাজে লোক তাকিয়ে তাকিয়ে যাক! তুমি কলেজ থেকে ফিরে খেয়েছ তো?”
”থাকগে। একদম খিদে নেই।”
”আভা দেয়নি? ঠাকুরকেও তো বলে গেছলাম। জানো, ব্লাউজের ছিটটা থেকে কুড়ি সি.এম. কাপড় বাঁচবে, ওটা দিয়ে কী করা যায় বলো তো?”
হিরণ্ময় লক্ষ করল টিপু ঘনঘন তাকাচ্ছে তার পায়ের দিকে। গেঞ্জি বা ব্লাউজ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে, বগলে পেনসিল দিয়ে জ্বর দেখে, কাগজে ঘসঘস করে প্রেসক্রিপসান লিখবে। নিজেই ওষুধ কিনতে যাবে পাশের ঘরে। জলভরা একটা শিশি হাতে ঢুকবে এবং ঢক করে সবটা খেতে হবে। তারপর গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিয়ে ঘুমোতে বলবে। না ঘুমোলেই বিপদ। ঘুমের জন্য বারবিটুরেড ট্যাবলেটগুলো আছে আলমারিতে। শোভার কাছে চাবি। বার করে দেওয়ার জন্য বায়না ধরবে। ঘুমের ট্যাবলেট মাঝে মাঝে হিরণ্ময় খায়। হিমাংশুর ডাক্তারখানা থেকে শিশি ভর্তি এনে রেখে দিয়েছে। টিপুর হাতে কোনোক্রমে এই বিষাক্ত বস্তুটি যাতে না পড়ে, সেজন্য আলমারির মধ্যে তোলা।
হিরণ্ময় বুঝতে পারছে, একবার পায়ে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃতি করলেই টিপুর চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে। মাস ছয়েক আগে পা মচকে যাওয়ায় হিমাংশু এসে যা যা করেছিল সেইগুলিই হুবহু অনুষ্ঠিত হবে।
”টিপু আজ নিয়ে পর পর তিনদিন তুমি পড়তে বসোনি। যাও মাসির ঘরে।”
”বাবার পায়ে যে ব্যথা হয়েছে।” টিপু মাসির ঘরে না যাওয়ার অজুহাত খাড়া করল।
”হোক ব্যথা, চলো।”
শোভা ওকে টানতে টানতে আভার ঘরের দিকে নিয়ে গেল। হিরণ্ময় হাতটা কপালের উপর রাখল। প্রায় প্রত্যেকদিনই এই ব্যাপার ঘটে। শুধু মজা লাগে টিপুর অজুহাতগুলো শুনতে। ওকে কিছুক্ষণ কাছে নিয়ে রাখার ইচ্ছা হল হিরণ্ময়ের। উঠে বসল সে।
ড্রেসিং টেবিলের উপর দুজনের ছবি মুখোমুখি। শোভা আর হিরণ্ময়। বিয়ের একমাস পর, দার্জিলিংয়ে তোলা। ফ্রেমের কিনারে হলুদ দাগ ধরেছে। সিগারেট ধরাতে ধরাতে হিরণ্ময় তাকাল। নিজেকে লক্ষ করল আয়নায়। বয়সের লক্ষণগুলো বেশ প্রকট মনে হচ্ছে। একমাস আগে চুল কাটার সময় নাপিত বলেছিল, ঘাড়ের উপরে দু-তিনটে চুল পেকেছে। শোভার চোখে আজও পড়েনি, নয়তো ও নিজেই কলপ কিনে আনত দু-তিনটে পাকা চুলকে ঘায়েল করতে। কোমরের বেড়ও বেড়েছে। চোখের চাউনিতে কীসের ছাপ ফুটেছে দেখার জন্য সে আয়নার কাছে এগিয়ে গেল।
”একদম পড়তে চায় না আজকাল, আর আভারও যে কী হয়েছে”-বলতে বলতে শোভা থেমে পড়ল ঘরে ঢুকেই। ”কী দেখছ অমন করে?”
”বয়স।”
”তার মানে।”
”কতটা বেড়েছে দেখছি।”
শোভা ভেবে পেল না এরপর কী বলবে। বালিশটা চাপড়ে সমান করতে করতে একবার শুধু তাকাল হিরণ্ময়ের দিকে।
”তোমার কী মনে হয়, খুব বুড়ো দেখাচ্ছে?” হিরণ্ময় ঘুরে দাঁড়াল।
”খুব আর কোথায়। তবে আগের মতো আর হাসিখুশি থাকো না, সবসময়ই মুখ গম্ভীর, একটুতেই খিটখিট শুরু করো।”
”কেন বলো তো?” হিরণ্ময় যেন ক্লাশে একচেটিয়া-তত্ত্ব বোঝাতে হঠাৎ একটা প্রশ্ন এমনিই করে ফেলল।
”আমি কী করে বলব।” শোভার স্বর একটু গম্ভীর।
ধীরে পায়চারি শুরু করল হিরণ্ময় ঘরের অবশিষ্ট ফাঁকা মেঝের উপর।
”আমার গায়ে আর জোর নেই। কোনোকালেই খুব বেশি অবশ্য ছিল না। কিন্তু এখন একদমই নেই। সেটা আজ বুঝেছি। কিন্তু আমি-”
হিরণ্ময় থমকে পড়ল। সিগারেটের ছাই ঝাড়ল মেঝের উপর, যা দেখেও শোভার ভ্রূ কুঞ্চিত হল না।
”আজই কীভাবে বুঝলে?”
দ্বিধায় পড়ল হিরণ্ময়। একটা মেয়েকে দুহাতে টেনে তুলতে পারিনি এবং মেয়েটি আভা, একথা বলার সময় হয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না সে। যদিও এক সময় মনে হয়েছিল শোভাকে বলব-কেন আমি আভার সর্বনাশ করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বলার কোনো অর্থ হয় না, যুক্তিও নেই। স্বীকারোক্তি দিয়ে কোনো লাভ হয় না। আসলে যা করার করে যেতে হয়।
”বুক-কেসের পিছনে এই বইটা পড়ে গেছল। কেসটা সরাতে পারলাম না একা। একটুও না। আভাকে ডাকলাম, ও এসে সরিয়ে বার করে দিল।”
”এইতেই বুঝলে!” শোভা স্পষ্টভাবে হেসে উঠল এবং উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, ”আমি একটু মোটা হয়ে গেছি না?”
হিরণ্ময় তাকাল এবং মনে মনে বলল, একটা সরল অঙ্ক ছাড়া আর কী? কিন্তু আমি জটিল অঙ্কে হাত দিলাম কেন? পুলিশ গুলি চালাচ্ছে খবর পেয়ে রাস্তায় বেরিয়েই বা গেছলাম কেন? আর আভা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে বলায় যৎসামান্যও আশ্বস্তবোধ করলাম কেন?
”দিদি দ্যাখো, টিপু পড়তে চাইছে না, ঘুম পাচ্ছে বলছে।”
আভা পর্দা সরিয়ে ঘরের দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকল। হিরণ্ময়ের দিকে একদমই তাকাচ্ছে না।
”ওই ওর বজ্জাতি। তিনটে শ্লেট ভাঙল, চারটে প্রথম ভাগ ছিঁড়ল, এখনও ক, খ-র বেশি এগোল না। ঘুম পাবে না তো কী? সারা দুপুর চোখের পাতা এক করে!”
”খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। মন যখন নেই, তখন আর পড়া হবে না। মিছিমিছি যন্ত্রণা দিয়ে লাভ কী?”
হিরণ্ময় শোভাকে উদ্দেশ্য করে বলল। অবশ্য সরাসরি আভাকেই বলতে পারত, কেননা টিপুকে খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানোর কাজটা তার। আভা তাকাল তার দিদির মুখে নির্দেশের জন্য। অবশ্য হিরণ্ময়ের কথা শুনেই সে টিপুকে খাইয়ে দেবার জন্য চলে যেতে পারত, কেননা এর উপর আর কারুর কথা খাটবে না।
”তাই দে।”
আভা চলে যেতেই আয়নার দিকে আবার তাকিয়ে শোভা বলল, ”হাসিদি বলছিল, আমি আগের থেকে বেশ মোটা হয়ে গেছি। ট্যাবলেট খেতে বারণ করে দিল। যারা খাচ্ছে সবাই নাকি মোটা হয়ে পড়ছে।” কিছুক্ষণ ঘাড় হেলিয়ে চুপ থেকে অনিশ্চিত স্বরে বলল, ”ভাবছি মাস দুই-তিন খাওয়া বন্ধ রাখব, কী বল?”
”তোমার খুশি।”
”আহা একা যেন আমারই খুশি।” আদুরি গলায় শোভা বলল এবং লাজুক চোখে তাকাল। পাউডার পাফটা দিয়ে আলতো করে গালে সুড়সুড়ি দিতে দিতে হঠাৎ শিউরে উঠে বলল, ”না বাবা, একটাই থাকা ভালো। একজনকে সামলাতেই হিমসিম খাচ্ছি, আর হয়ে দরকার নেই। তোমায় কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছি আর তিনটে ট্যাবলেট মাত্র রয়েছে।”
”তুমি নিজেই কিনতে পারো।”
”না বাপু, কেমন লজ্জা করে।”
শোভা ব্যস্ত হয়ে টেবিলে রাখা টাইমপিসটায় সময় দেখল। প্রতিদিন রাত আটটায় সে ট্যাবলেট খায়। কিছুতেই এর নড়চড় হয় না।
আসলে যা করার করে যেতে হয়, এই কথাটা ভাবতে ভাবতে হিরণ্ময় বাইরের ঘরে এল। ওর পিছনে শোভাও।
”কেউ বুঝতে পারবে না অথচ দেখাও হয়ে যায়, কীভাবে সেটা করা যায় বলো তো?”
হিরণ্ময় সোফায় গা এলিয়ে শোভার দিকে তাকিয়ে ভাবল : একটা উত্তর বার করতেই হবে আভাকে নিয়ে এখন কী করা যায়!
”আমার কী মনে হয় জানো”, শোভা বসল হিরণ্ময়ের গা ঘেঁষে। ”তোমার তো ব্লেড ফুরিয়ে গেছে, টুথপেস্টও কিনতে হবে। যদি এখন কিনতে বেরোই, যদি আস্তে আস্তে যাই আর ফিরি তার মধ্যে কি দেখে নেওয়া যাবে না?”
”কিন্তু তার মধ্যে যদি না বেরোয়!” হিরণ্ময় ভাবনার মধ্যেই কথাটা বলে দিয়ে আবার শুরু করল: গুলি খাওয়ার ইচ্ছাটাই কি ছদ্মবেশ ধরে ভালোবাসা হয়ে এল? একজনের মধ্যে এ দুটো জিনিস এল কী করে! মরা আর ভালোবাসা কি একই ব্যাপার!
”ওই সিংগী বাড়িতে গেলে অবশ্য দেখা যায়, কিন্তু আমার সঙ্গে তো চেনা নেই।”
”চেনা করে নাও।”
”নাঃ। ও বাড়িতে একটা মাতাল থাকে।” শোভার নাক কুঁচকে উঠল।
অতঃপর হিরণ্ময় শুরু করল : দুটোর একটা বেছে নেওয়া দরকার। হয় হিমাংশুর কাছে গিয়ে আভার ব্যবস্থা করা, নয়তো যেমন আছে তাই থাক। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা প্রকাশ হোক। শোভা জানুক, ওর বাবা-মা জানুক। ছ্যা ছ্যা করুক, আলাদা হয়ে যাক। তারপর পরিচিতরা জানুক, হাসাহাসি করুক, দুশ্চরিত্র লম্পট বলে নাক সিঁটকোক। আর তার মাঝে বেপরোয়ার মতো চলাফেরা, খাওয়া শোওয়া, কলেজ-পাবলিশার নিয়ে এক ধরনের বেঁচে থাকা। যা করার তাই করে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। জিনিসটা আভাকে বলা দরকার, এখনি।
”তুমি বরং ওই ছেলেটার সাহায্য নিতে পারো। ওই যে কদিন আলাপ জমাতে এসেছিল। ফুটবল খেলে বেড়ায়।”
”অসীম!”
”মোটরের কাছাকাছি যে-কোনো একটা বাড়িতে জানলা কী বারান্দায় ও তোমাকে হাজির করে দিতে পারবে।”
শোভা নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবল। তারপর জানলায় গিয়ে পর্দা সরিয়ে খুঁজতে লাগল অসীমকে।
অতঃপর হিরণ্ময় শুরু করল : আভাকে বলতে হবে, আমার মানমর্যাদা, তোমার দিদির সংসার এসব নিয়ে চিন্তা না করে নিজের কথা ভাব। যতক্ষণ না নির্দিষ্ট একটা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, অঙ্কটা কষেই যেতে হবে। তোমাকে টেনে তুলতে পারিনি, যেহেতু তুমি গায়ের জোরে আমার বিরুদ্ধতা করেছ, অথচ আমি বললেই তুমি ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই ধরনের উলটোপালটা ব্যাপারগুলোর মধ্যে একটা সমতা আনা দরকার। বিবেক দংশনের যন্ত্রণায় এভাবে কাতর হয়ে পড়ার কোনো দরকারই নেই। বিবেক চেহারা বদলায় তোমার-আমার অস্তিত্বের টানাপোড়েনের উপর।
আভার গলা শোনা যাচ্ছে শোবার ঘর থেকে। গল্প না শোনালে টিপু ঘুমোতে চায় না। ওকে ঘুম পাড়ানো-র কাজও আভার। হিরণ্ময় কান পাতল আভার গলা শোনার জন্য।
”ওই তো অসীম!” শোভা হাতছানি দিয়ে ডাকল।
অসীম কাছে আসতেই শোভা ফিসফিস করে বলল, ”একটু দেখিয়ে দিতে পার?”
”দেখবেন।” অসীম ঠোঁট কামড়ে ভাবতে শুরু করল কীভাবে দেখাবার ব্যবস্থা করা যায়।
”চার নম্বর বাড়ির একতলায় যারা ভাড়া থাকে, তাদের ঘরের জানলা আর ওই মাস্টারনির জানলাটা একদম মুখোমুখি, যদি চার নম্বরে যান, তাহলে-”
”ওরা কিছু মনে করবে না তো? আমি অবশ্য বেশিক্ষণ থাকব না।”
”মনে আবার করবে কী, আমি নিয়ে যাচ্ছি না!” অসীম তার ক্ষমতার বহর গলার স্বর দিয়ে শোভাকে বোঝাবার চেষ্টা করল।
শেফালি আর ইলা সেই সময় তাঁতি গলিতে ঢুকছে। তাই দেখে অসীম শোভাকে বলল, ”দুজন ঢুকছে, বোধহয় ওইজন্যই। দাঁড়ান, জিগ্যেস করে দেখি, তাহলে ওদের সঙ্গেই ভিড়ে যেতে পারবেন।”
অসীম দ্রুত গেল এবং এল। ”হ্যাঁ, আপনি আসুন, ওরা নিয়ে যাবে।”
শোনামাত্র শোভা চটি গলিয়ে সদরের দিকে ছুটে গেল প্রায়। খিলে হাত দিয়ে আবার ছুটে এল শোবার ঘরে। ট্যাবলেট খাবার সময় হয়েছে তার। ওর দৃঢ় ধারণা প্রতিদিন ঘড়ি ধরে না খেলে কোনো ওষুধেই ফল ফলে না। চাবি দিয়ে আলমারি খুলে মোড়ক থেকে একটি ট্যাবলেট বার করে মুখে ছুঁড়ে দিয়ে ”খোলা রইল, চাবি বন্ধ করে দিস”, আভাকে এই বলেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল।
হিরণ্ময় শুনতে পেল রাস্তায় অসীম হতাশস্বরে বলছে, ”আপনি একাই যাবেন?”
উঠে দাঁড়াল সে। টিপু ঘুমিয়ে পড়েছে কি? আভাকে বলতে হবে, হেস্তনেস্ত করে জীবনটাকে বেশ একটা নাড়া দেওয়া দরকার। সেইজন্যই তো ব্যাপারটা ঘটালাম, জেনেশুনে, ইচ্ছে করেই।
ইলা ভাবল সিল্কের শাড়িটা পরবে কিনা। মনস্থির করতে করতে, চিরুনি টানল চুলে। একটু ক্রিমও লাগাল গালে। অবশেষে অশোকের মতামত নেওয়াই উচিত মনে করল।
”হ্যাঁগা, এই শাড়িটা পরেই যাব?”
অশোক বিরক্ত হয়ে মুখ তুলল বালিশ থেকে, ”তবে কী পরে যাবে? যাচ্ছ তো পাশের বাড়ি!”
ইলারও মনে হল কথাটা ঠিকই বলেছে। তাছাড়া সিল্কের শাড়িটা সবে আড়াই টাকা দিয়ে কাচিয়ে আনা হয়েছে। এইরকম ব্যাপারে বার করলে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়।
নিচে এসে দেখল পারুলের দরজা ভেজানো। খুলে দেখল, পারুল শুয়ে, কপালে হাত, চোখ বন্ধ।
”কীরে, মাথা-ধরা কমলো?”
”না ভাই, আরও যেন মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে। তুই বরং যা।” বলে পারুল মুখচোখে যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলল। তাই দেখে ইলা আর কথা বাড়াল না।
শেফালি ভাতের হাঁড়িটা নামিয়ে তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে ইলাকে চুপ থাকতে ইশারা করল।
”বাড়ির কেউ জানে না। তাহলে বউয়েরা হাতে কাজ ধরিয়ে বেরোনো বন্ধ করে দেবে।” ফ্যান গালতে গালতে ফিসফিস করে শেফালি বলল। ”বউগুলোকে জানোই তো। বিনি-পয়সায় দুমুঠো খাওয়া আর থাকার বদলে এই দাসীবৃত্তি আজীবন আমার ভাগ্যে লেখা আছে।”
সমবেদনায় ইলার অন্তর ভরে উঠল। শেফালি হাঁড়িটা মেঝেয় উপুড় করে বলল, ‘আসছি ভাই।”
রেডিয়োয় নাটক হচ্ছে। দুই ঘরে দুটি রেডিয়ো। বাড়ির সবাই দুই ঘরে ভিড় করে শুনছে। শেফালির হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে সিঁথেয় একটু চওড়া করে সিঁদুর দেয়। ঘরে এতলোক দেখে সে ফিরে গিয়ে অন্ধকার বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়াল। কী যেন তার হচ্ছে বুকের মধ্যে। হঠাৎই এখন পঞ্চাননকে মনে পড়ছে বারবার। মাস দুয়েক আগে দেখা করেছিল ওর সঙ্গে। বাগবাজারের দোকানটা আগেই সে চিনে রেখেছিল। অনেকদিন সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে, পঞ্চাননকে এক ঝলক দেখে নেবার আশায়। একদিন সে বেপরোয়ার মতো ঢুকেও পড়েছিল।
পনেরো বছর পর দেখে চিনতে পারেনি পঞ্চানন। খদ্দের ভেবে এগিয়ে এসে কাউন্টারে ঝুঁকে বলল, ”কী চাই বলুন।”
নিজের নাম বলতে শেফালির সঙ্কোচ হল। শুধু কোনোক্রমে বলে, ”কিছু কিনতে আসিনি।”
চশমার কাচের পিছনে পঞ্চাননের চোখ দুটিতে বিস্ময় ফুটতে ফুটতে হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে তীক্ষ্ন হয়ে গেল।
”তাহলে কী চাই?”
স্বরের গাম্ভীর্য পরিমাপ করে শেফালি বুঝল, চিনতে পেরেছে।
”কথা ছিল।”
পঞ্চানন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ডান গালের আঁচিলটার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেনি। গোঁফটা আগের থেকে ছোটো হয়েছে, জামার কলার ময়লা, নখগুলো বড়ো, চামড়া খসখসে, অন্তত দু’দিন দাড়ি কামায়নি, অনেকগুলো চুল পেকেছে।
”আমার সম্বন্ধে কী ঠিক করেছ?” শেফালি স্পষ্ট স্বরে জানতে চাইল। তেজ দেখাবার বয়স আর নেই। লজ্জা করলেও চলবে না। বিয়ে করা বউ তো বটে, এই ভেবে সে সরাসরি পঞ্চানন্দের চোখের দিকে চেয়ে রইল।
”আমার তো ঠিক করার কথা নয়।”
”স্ত্রীর সম্পর্কে স্বামী ঠিক করবে না তো কে করবে? সেটাই তো নিয়ম।”
”তুমি যে আমার স্ত্রী, কে বলল?”
”আইন বলবে।”
”ওঃ, আইন দেখাতে এসেছ।”
পঞ্চাননের শরীর শিকার দেখা হিংস্র প্রাণীর মতো কুঁজো হয়ে গেল।
”দরকার হলে তাই দেখাব।”
থতমত হল পঞ্চানন। ঝাড়ন দিয়ে কাউন্টারের ধুলো মুছতে শুরু করল। এই সময় এক খদ্দের এল পাঁউরুটি কিনতে। শেফালি একধারে সরে দাঁড়াল। যাবার সময় লোকটি অভিযোগ করল, ”কালকের রুটি কিন্তু বাসি ছিল।”
”কী করব বলুন, কোম্পানি যেমন দেয়।”
”কোম্পানিকে জানান।”
লোকটি চলে যেতেই শেফালি বলে, ”তাহলে? ভায়েদের সংসারে এইভাবেই পড়ে থাকব? শাড়ি গয়নার তো আমার দরকার নেই, খাই-খরচ পেলেই চলবে।”
”যদি না দিই।”
”তাহলে মামলা করে আদায় করব।” শেফালি কাউন্টারে চাপড় মারল।
”যদি বলি স্বেচ্ছায় চলে গেছ, আমি বরাবরই তোমায় আমার কাছে রাখতে রাজি ছিলুম, এখনও রাজি?”
”এখনও রাজি!” শেফালি এবার থতমত হল। অবিশ্বাসের সুরে বলল, ”আমি স্বেচ্ছায় আসিনি, তুমিই তাড়িয়ে ছিলে। মদ খেয়ে এসে আমায় লাথি মেরে কী বলেছিলে আজও আমার তা মনে আছে। আমি মেয়েমানুষ নই, আমাকে নিয়ে তোমার সুখ হয় না-”
কান্নায় গলা বুজে গেল শেফালির। দুচোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ল। পঞ্চানন কাউন্টারের তলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল। দোকানের দরজার পাল্লা আধ-ভেজিয়ে, ফিরে এসে বলল, ”দাঁড়িয়ে কেন, এই টুলটায় বোসো।”
শেফালি বসল।
”এই তো দোকান দেখছ। মাসে কতই বা রোজগার, বড়োজোর হাজার দুই। এর থেকে তিন-চারশো টাকা খোরপোশ দিতে হলে আমার সংসার অচল হয়ে যাবে। তাছাড়া তোমায় যদি বলি, এখন আমার কাছে এসে থাকো, পারবে?”
”ছেলেমেয়ে ক’টি?” ইতস্তত করে শেফালি বলল।
”বড়োটি মেয়ে, তেরোয় পড়ল। এখনও স্কুলে পড়ছে। তবে আর পারব না। পরের চারটি ছেলে। এই আয়ে এতগুলোকে নিয়ে আর চালাতে পারছি না। ভিখিরিরও অধম হয়ে থাকি। চাকরি খুঁজছি। এই বয়সে পাবই বা কোথায়!”
পঞ্চানন করুণ চোখে তাকাল। শেফালি চোখ সরিয়ে অস্পষ্টভাবে বলল, ”ওরা কি আমার কথা জানে?”
”জানে।”
”কিছু বলে।”
”তোমায় নিয়ে কোনো কথাই হয় না।”
”আর কেউ কিছু বলে না।”
”গীতা তোমায় শুধু একবার দেখতে চেয়েছিল।” পঞ্চানন ইতস্তত করে, কিছু ভেবে নিয়ে যোগ করল, ”আমি বলেছিলাম কিনা তুমি ওর থেকেও সুন্দরী।”
শোনামাত্র উঠে দাঁড়াল শেফালি।
”রোগে ভুগে ভুগে গীতার আর কিছু নেই। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। হয়তো আর বাঁচবেই না। তুমি একদিন এসে দেখে যেতে পারো, সত্যি বলছি কিনা।”
শেফালি দরজার দিকে এগোল।
”আমার এই সামান্য আয়ে আর ভাগ বসিয়ো না। ছাপোষা মানুষ আমি। জোড় হাতে মিনতি করছি শেফালি। মনে করো তুমি বিধবা হয়ে গেছ।”
কথা না বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে শেফালি।
দোতলা থেকে শেফালি নেমে আসতেই ইলা ব্যস্ত হয়ে বলল, ”দেরি হয়ে গেল বোধহয় ঠাকুরঝি। আপনার সঙ্গে চেনা আছে তো ওবাড়ির লোকেদের?”
”আমি এ পাড়ার মেয়ে, জম্মো থেকেই রয়েছি। চার নম্বর বাড়ির ভাড়াটেদের সঙ্গে নাইবা চেনা থাকল, জানলা দিয়ে একবার দেখব, তা কি আর দেখতে দেবে না? ওঘরে আগে থাকত লক্ষ্মীরা। তখন কত যাতায়াত ছিল।”
ওরা দুজন রাস্তায় নামল। অনন্ত সিংহ হাতে সন্দেশের বাক্স নিয়ে ফিরছে। শেফালি বলল, ”পুতুলকে সাজাচ্ছে কে গো, কাকিমা?”
”হ্যাঁ। আর আজকালকার যা সাজগোছের বহর, নিজেরাই সেজে নিতে পারে।”
অনন্ত এড়িয়ে গেল শেফালিকে। সত্যচরণ পাম্প করে যাচ্ছে টিউবওয়েল। শেফালি বলল, ”কীগো সত্যদা, জল নেওয়া যে আর শেষই হয় না। তখন থেকে তো হ্যান্ডেল চালাচ্ছ।”
‘দ্যাখ না, কালীর মা কিনা কীসের একটা বালতি এনে জল নিয়ে এল। সব ধুয়ে টুয়ে-”
”অ, কালীর মা জল নিচ্ছিল এতক্ষণ!” শেফালি মুখ টিপে ইলার দিকে তাকিয়ে হাসল। লক্ষ করে সত্যচরণের বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। কাল দুপুরে নির্ঘাৎ হারামজাদিটা গল্প করতে আসবে চারুশীলার কাছে। আঙুরকে পাঁচটা টাকা দিয়ে আসতে হবে। টাকা থাকে চারুর কাছে। চেয়ে নিতে হবে। কিন্তু আঙুরের সঙ্গে এই দেখা হওয়ার কথা কানে গেলেই, পাঁচ টাকার সঙ্গে সেটি গেঁথে তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে। দাঁত কিড়মিড় করে সত্যচরণ তাঁতি গলির দিকে তাকাল। সেখানে অসীমের সঙ্গে কথা বলছে শেফালি।
শোভা আসতেই শেফালি বলল, ”আপনি এতদিন রয়েছেন পাড়ায়, অথচ ভাবসাব হয়নি। যাক আজ হয়ে গেল।”
”আমার কেমন আড়ষ্টতা লাগে। একদমই মিশুক নই, তবে ইচ্ছে করে খুবই।” শোভা নম্রস্বরে বলল।
”বউদিকে সেজন্য পাড়ায় বলে ডাঁটিয়াল।” অসীম হাসল শোভার দিকে তাকিয়ে।
”ওসব পাড়ার লোকের কথায় কান দিতে হবে না আপনাকে। সবাইকে আমার চেনা আছে। চলুন।” শেফালি তাঁতিগলির মধ্যে ঢুকল।
ইলা এতক্ষণ শোভার আপাদমস্তক দেখছিল খুঁটিয়ে। তাঁতিগলিতে ঢুকে শোভার পিছনে যেতে যেতে বলল, ”আপনার বোন এল না?”
”ও পড়ছে। ফাইনালের তো আর বেশি দেরি নেই।”
”আমি আর যাব না।” অসীম চার নম্বর বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
”কেন রে, তুইও আয় না।”
”আপনারা দেখুন; আমি অনেক দেখেছি, কথাও বলেছি।”
অসীম গলি থেকে বেরিয়ে অনন্ত সিংহের বাড়ির সদরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করল। তারপর কড়া নাড়ল।
নয়
”আপনি সিগারেট খান!”
ভোম্বল অর্থাৎ দ্বারিক সিগারেটের বাক্সটা সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রাখল টেবিলে।
”কেন, আমি কি খেতে পারি না?”
”কোনোদিন তো দেখিনি।” মানু অর্থাৎ মনীষা খাটের উপর বালিশে কনুই ভর দিয়ে হেলে পড়ল।
”দেখবে কী করে, কোনোদিন কী তাকিয়ে দেখেছ?”
”আহা, এতবার এসেছি এ বাড়িতে আপনাকেই তো দেখতে পাই না।”
”মিথ্যে কথা বলো না। বাসস্টপে একদিনও তো ফিরে তাকাওনি। বড্ড ডাঁট তোমার।”
”আহা-হা, ডাঁট আবার কোথায় দেখলেন। আমি রোজই দেখতে পাই, আপনিই তো গম্ভীর হয়ে থাকেন। কথা বললে উত্তর দেবেন কী দেবেন না-” মনীষা মুখ টিপে হাসল।
দ্বারিক জোরে সিগারেটের টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং তৈরি করতে করতে ভাবল, এই নিয়ে দুবার ‘গম্ভীর’ শব্দটি ব্যবহার করল। গম্ভীর লোক তাহলে একদমই পছন্দ করে না ও। কিন্তু মুখ টিপে হাসলে মানুকে দারুণ দেখায়, আর কী বলা যায়, যাতে মানু এইভাবে হাসে।
”আমাকে তাহলে তুমি খুবই অভদ্র মনে করো।”
”করিই তো।” বলেই মনীষা ভাবল, ভোম্বলদা কি আবার গম্ভীর হয়ে যাবে এই শুনে! বড্ড হাসি পায় এইভাবে ওকে দেখলে।
”বেশ তাহলে আর কোনো কথা বলব না।”
ভোম্বল খুব খুশি হয়ে মুখখানাকে থমথমে করে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত হল। চপল লঘু সুরে কথা বললেই মানুকে মানায়।
”না বললে আমার বয়েই গেল। আমি এখন কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাহলে গল্প করব।”
”মেয়ে না পুরুষ বন্ধু?” ভোম্বল কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বলল।
”পুরুষ বন্ধু।” মনীষা মুখটিপে হাসল, ভোম্বলের মনে হল, খুনসুটি না করলে মানু এমন করে হাসবে না।
”তোমার তো অনেক পুরুষ বন্ধু।”
”আছেই তো।”
”আমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই।”
”হবে কী করে, আপনি নামেও ভোম্বল, কাজেও ভোম্বল।”
”মোটেই না। অনেকেই এসেছিল বন্ধুত্ব করতে, কাউকেই পাত্তা দিইনি। সব বাজে চিপ-টাইপের।” কথাগুলোকে যুক্তিবান করার জন্য ভোম্বল আর একটু যোগ করল, ”ব্যাঙ্কিং-এর সেকেন্ড পার্টটা পাশ করলে অফিসার গ্রেডে যাবার চান্স আরও সহজে পাব, জানে তো, তাই এসে জুটছে।”
শুনতে শুনতে কালো হয়ে উঠল মনীষার মুখ। অন্যমনস্কের মতো আলতো আঙুলে খোঁপার গোলাপটি স্পর্শ করার জন্য হাত তুলতেই কাঁধ থেকে সিল্কের শাড়ির আঁচলটি পড়ে গেল।
”তুমি আবার কবে থেকে হাত কাটা ব্লাউজ পরা শুরু করলে?”
আঁচলটা বাহুর উপর টেনে সিধে হয়ে বসল মনীষা। বিব্রত স্বরে বলল, ”অনেকেই পরছে, ভাবলুম, দেখি একবার পরে।”
ভোম্বল গম্ভীর হয়ে সিগারেট ধরাল। দরজার পর্দাটা মনে হল যেন একটু সরে রয়েছে। বড়দা দেখে ফেলতে পারে ভেবে, টেনে-টুনে ঠিক করে দিল।
”এইরকম ব্লাউজ চিপ মেয়েরা পরে। আর ওইভাবে কোমরের অত নিচে শাড়ি পরা।”
”আমি তো চিপই।”
ভোম্বল আহত চোখে তাকাল। মানু কী রাগ করল তার কথায়? হয়তো চলে যেতে চাইবে এখুনি।
”তবে অনেককে পরলে ভালো দেখায়। বিশেষত যাদের গায়ে চর্বি নেই, ছিপছিপে লম্বা। তোমাকে বেশ মানিয়েছে।” বলে ভোম্বল হাঁফ ছাড়ল। মনীষা তবু মেঝের দিকে তাকিয়ে। মুখটা থমথমে হয়ে আছে।
”তোমাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে আজ।”
মনীষা মুখ তুলে একবার তাকাল। একটু হাসি ঠোঁটে লাগিয়ে বলল, ”আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।”
”মোটেই না, যা সত্যি তাই বলছি।” সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ভোম্বল জানলায় গেল।
”চিপ মেয়েরা আবার সুন্দর হয় নাকি।”
ভোম্বলের আর ছাই ঝাড়া হল না। পাংশু মুখে ফিরে তাকাল সে।
”তুমি রাগ করেছ?”
”না না, রাগ করব কেন, আপনি তো ঠিকই বলেছেন। সবাই তো আমায় তাই ভাবে।” মনীষা শান্ত গলায় বলল বটে, কিন্তু অভিমান চাপতে পারল না।
”সবাই কী ভাবে, তা দিয়ে কিছু এসে যায় না।” ভোম্বল খাটের উপর বসল। ”আসলে পাত্তা না দিলেই হল। সত্যিই তোমাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ফুলটা চেয়ে নিই।”
”সুন্দর বলে তো ঠাট্টা করলেন। তার উপর ফুল চেয়ে আর নুনের ছিটে দিতে হবে না।”
”সত্যি সত্যিই চাইছি।” ভোম্বল সিগারেট ধরা হাতই বাড়াল।
”নিয়ে কী করবেন?”
চট করে উত্তর দিতে পারল না ভোম্বল। দারুণ একটা কিছু বলার জন্য সে ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল। এমন একটা কিছু বলতে হবে যাতে এইসব ধানাই-পানাই শেষ হয়ে আসল ব্যাপারে আসা যায়। অর্থাৎ, ভোম্বল ভাবল, মানু যেন ঠাট্টা না করে এবার সিরিয়াস কথা বলতে শুরু করে।
গোলাপটা খোঁপা থেকে হাতে নিয়ে মনীষা গন্ধ শুঁকছে। মুখে চাপা হাসি। ঠোঁটে হালকা বেগুনি রঙ, আঁচলটি পিঠের দিকে সরে যাওয়ায় ডান বাহুটি অনাবৃত, বাঁ পায়ের উপর ডান পা-টি রেখে ধীরে ধীরে নাচাচ্ছে।
”আজ একজন ঠিক আপনার মতোই চাইল ফুলটা।”
ভোম্বলের মনে হল ভূমিকম্প ঘটছে, দাঙ্গা হচ্ছে, আগুন লেগেছে, বন্যা হচ্ছে। নিশ্বাস ত্যাগের প্রথম ফুরসত পেয়েই সে বলল, ”কে?”
”নাম বললে আপনি চিনবেন না।”
”কেন চাইল?”
”তা কী করে বলব!”
”কে হয় তোমার? কোনো বন্ধু?”
”কে আবার, কেউ না।”
”তাহলে চাইল কেন?”
”আপনিই বা চাইছেন কেন, আপনি কি কেউ হন? তাছাড়া কেউ না হলে বুঝি চাইতে পারে না!”
”নিশ্চয় পারে যদি চাইবার মতো ঘনিষ্ঠতা থাকে।”
মনীষা এবার থেমে উত্তর খোঁজার জন্য খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তাই গোলাপটি হাত থেকে পড়ে গেল খাটের উপর। আর সঙ্গে সঙ্গে ভোম্বল সেটি তুলে নিল। মনীষা চমকে বলল, ”একি!”
ঘরের আলো নিভে গেছে।
”বোধহয় মেন ফিউজ হয়ে গেছে।” ভোম্বল উঠে দরজার দিকে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর এবং আবেগপূর্ণ স্বরে বলল, ”মনীষা, অন্ধকারে ভয় পেয়ো না।”
”না।”
ভোম্বলের বুক চিতিয়ে উঠল তাই শুনে। একটা চাপা কলরব শুনতে পেল সে। সারা পাড়া যেন হঠাৎ একবার হইহই করে উঠল। জানলায় এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ”সেরেছে। আজও আবার হল। শুধু আমাদের বাড়িতেই নয়, গোটা পাড়াটাই। দেখবে এসে, কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে রাস্তাটা, বাড়িগুলো এই অন্ধকারে।”
মনীষা উঠে এসে ভোম্বলের পাশে দাঁড়াল। সেন্টের গন্ধ পেল ভোম্বল। মিষ্টি একটা আবেশ তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করল। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়।”
বৈঠকখানার তক্তপোশে চারটি ভব্যযুক্ত হয়ে বসে। অনন্ত ঝিয়ের হাত থেকে চায়ের ট্রে তুলে নিয়ে ওদের সামনে রাখল।
”প্রায়ই তা আসে। গাড়িটা বরাবর আমার বাড়ির সামনেই রাখে। একদিন পুতুল দোতলার ঘরে গাইছে, গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়েই শুনে পিসিকে গিয়ে বলে, একটি মেয়ের গলা শুনলুম, ভারি মিষ্টি তো! জিগ্যেস করো তো যদি সিনেমার গান গাইতে রাজি থাকে, তাহলে এখনি কনট্রাক্ট করব। পুতুলের মা’র কাছ থেকে শুনে আমি বললুম, দরকার নেই বাপু। আগে বিয়ে হোক, তারপর শ্বশুরবাড়ি যদি চায় তখন নয় সিনেমা-জলসায় গাইবে। আমি আবার একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। অনেকে তো তাই বলে, অনন্ত সিংগী মরে গেলেও বনেদিপনা ছাড়বে না কিছুতেই।”
খাবারের প্লেট হাতে ঝি ঢুকতেই অনন্ত কথা বন্ধ করে প্লেটগুলি ওদের সামনে সাজিয়ে রাখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন যুবক চতুষ্টয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে-
”গলির মধ্যে তাই হেরাল্ডটা এনেছে। নয়তো ছ’টা হেডলাইট-ওয়ালা সেই ফোর্ডটাতেই চড়ে।”
”জিতু বলছিল, ওটার কারবুরেটারটা গোলমাল করছিল বলে ওদের গ্যারেজে একবার পাঠিয়েছিল।”
”জিতুর কথা তো! চেপে যা বাবা। কোনোদিন হয়তো শুনবি বোম্বাই থেকে রাজকাপুর গাড়ি এনেছিল অ্যাক্সেল বদলাতে।”
যে যুবকটি কথা বলেনি অর্থাৎ পুতুলের হবু স্বামীকে অনন্ত বলল, ”নাও বাবাজি, আগে একটু মিষ্টিমুখ হয়ে যাক।”
এই সময় সদরে কড়া নাড়ার শব্দ হল। অনন্ত বৈঠকখানা থেকেই হাঁক দিল,”কে?”
”আমি অসীম।”
শুনেই উদ্বিগ্ন হয়ে অনন্ত বেরিয়ে এল।
”কী ব্যাপার?”
আংটিটা বার করে অসীম বলল, ”পাঁচশো টাকা দিতে পারেন এক্ষুনি।”
”এখন তো পারব না, সিন্দুক আজকের মতো বন্ধ করে ফেলেছি। কাল সকালে বরং এসো।”
এরপর অনন্ত আংটিটা হাতে নিয়ে আলতোভাবে দুবার লুফে বলল, ”তিনশো টাকার বেশি তো হয় না।”
”আমার এখুনি পাঁচশো টাকা দরকার।”
”কাল সকালের আগে দিতে পারব না। এখন আমি খুবই ব্যস্ত রয়েছি, কাল বরং এসো চারশো পর্যন্ত দিতে পারব।”
অনন্তের পা দুটো জড়িয়ে ধরবে কিনা অসীম ভাবল। লোকটা হয়তো এতক্ষণে আবার চিৎকার শুরু করেছে। ঘরের কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে প্রভাত মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করছে। এবাড়ি-ওবাড়ি উঁকিঝুকি দিচ্ছে।
অসীম হাত বাড়িয়ে নিচু হতে যাচ্ছে, অনন্ত এক পা পিছিয়ে গেল।
”একি, এসব কেন! বলছি তো কাল এসো। আজ কিছুতেই পারব না। লোক বসে রয়েছে, তুমি এখন এসো, আমি খুব ব্যস্ত।”
বলতে বলতে অনন্ত পিছিয়ে যেতে লাগল। এই সময় ছাদের ঠাকুরঘরে ঝনঝন শব্দ উঠল বাসন পড়ার। দোতলার বারান্দায় উবু হয়ে যারা বৈঠকখানার জানলা দিয়ে পুতুলের হবু-বরকে দেখার চেষ্টা করছিল, তাদের কেউ ছুটে গেল তিনতলায়।
অসীম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখল অনন্ত বৈঠকখানায় ঢুকে গেল। রাগে অন্ধকার হয়ে এল তার দৃষ্টি। বাবা, মা, ভাইবোন, ঠাকুমা প্রত্যেককে অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে নিজের ডান হাঁটুকে কিল মারতে শুরু করল। ”এইটে, এইটেই যত নষ্টের গোড়া।”
”এই এক ঝামেলা” বৈঠকখানায় ঢুকেই অনন্ত চারজনের প্লেটের উপর চোখ বোলাল, ”একি হাত যে চলছে না। অ্যাঁ, ইয়ংম্যান সব, এখনও এতগুলো পড়ে রইল যে।”
”এত দিয়েছেন, দশজনেও যে শেষ করতে পারবে না।”
”তার উপর আসার আগে রেস্টুরেন্টে একটা করে কাটলেট সাঁটিয়ে এসেছি।”
”অবিশ্যি আমাদের পল্টুকে আনলে কোনো ভাবনা ছিল না। মনে আছে রে, গত বছর দমদমের সেই পিকনিকে?”
ওরা সবাই মুচকি হাসল।
”কাউন্সিলার কুমার চৌধুরী আবার লোক পাঠিয়েছিল। এই এক ঝামেলা।” অনন্ত গুছিয়ে বসল, ”আমিই ওকে দাঁড় করিয়েছি। ছোটো থেকেই বলতে গেলে আমাদের বাড়িতেই মানুষ। বাবা তো একটা সাইকেল মিস্তিরি ছিল, সাইকেল ভাড়া দিত। আমরা শিখেছি ভুবনের সাইকেল ভাড়া নিয়ে। সেই ভুবনের ছেলে কুমার। কিছুতেই রাজি ছিল না ইলেকশানে নামতে। জেতার কোনো চান্স অবিশ্যি ওর ছিল না। পাড়ার লোকেরা ধরল এসে, অনন্তদা তুমি বেরোও একবার, কুমারও এসে ধরল। একদিন বেরোলুম ওর জন্য। আমার যত মামলা-মোকদ্দমা সব তো ওই করে, এক পয়সাও ফি নেয় না। ওকি, সন্দেশটা পড়ে রইল কেন! না, না, কিচ্ছু ফেলা চলবে না। এইমাত্র কুমার একটা ছেলেকে পাঠিয়েছিল, যদি আমার কাছ থেকে চিঠি আনতে পারে, তবেই ওকে কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেবে। আমি না বললে হবে না। ছেলেটা তো পা জড়িয়ে ধরল। এ যে কী জ্বালা কী বলব। দিনরাত কড়া নড়েই চলেছে। কী? না, কুমারবাবু পাঠিয়ে দিল। এমন শত্রুতা করবে জানলে কী আর ওটাকে জেতাতুম।”
অনায়াসে কথাগুলো বলার সুখে ঝকমক করতে লাগল অনন্তের চোখ। লক্ষ করল, যুবক চতুষ্টয়ের বসার ভঙ্গিতে সমীহের ছাপ লেগেছে। ঝি ব্যস্ত হয়ে এসে বলল, ‘বাবু একবার ভেতরে আসুন, কাণ্ড হয়েছে এক।”
অনন্ত বেরিয়ে দেখে ওর স্ত্রী দাঁড়িয়ে, হাতে একটা সবুজ রবারের বল।
”এই দ্যাখো, কে ছুঁড়ে মেরেছে ঠাকুরঘরে সোজা গুপীনাথের গায়ে। গুপীনাথ উলটে পড়ে গেছেন। কী যে অমঙ্গল ঘটবে। আমার কেমন বুক কাঁপছে ভয়ে। কে এমন শত্রুতা করল গো।” ডুকরে কেঁদে উঠল অনন্ত গৃহিণী।
ভয়ে অনন্তের মুখ শুকিয়ে গেল। হঠাৎ এই সময় কে বল ছুঁড়ল? তাও সোজা গোপীনাথের গায়ে। নিশ্চয় কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। ক্ষতি করতে চায়, নয়তো অত ভারী বিগ্রহ পড়ে যাবেই বা কেন! কাছে থেকেই ছুঁড়েছে। ঠাকুরঘরের দরজার সামনেই তো বাসুদেবের ছাদটা।
”হ্যাঁগা, কী হবে!”
”গুপীনাথ কি পড়েই আছেন?”
”হ্যাঁ, মেঝেয় একেবারে মুখ থুবড়ে।”
”থাকুন ওইভাবে, কেউ যেন ওঁকে টাচ না করে। আমি থানায় ডায়রি করে আসছি। মন যেন কেমন কু-গাইছে। দেখি, বলটা দাওতো।”
বলটা ফুটো। টিপতেই হাওয়া বেরিয়ে চুপসে গেল। হঠাৎ অনন্তর মনে হল, এটা যেন চেনা। আজই সকালে তার বাড়ির সামনে বাসুদেবের ছেলেটা একটা সবুজ বল টিপে টিপে চোপসাচ্ছিল।
”হারামজাদা।” দাঁতে দাঁত ঘষে অনন্ত তিরবেগে সদর দরজার দিকে ছুটে গেল। লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ল। ভারী শরীরটা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে সামনের বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেল। ঘুরে সোজা হয়েই দেখল বাসুদেব তাঁতিগলির মুখে দাঁড়িয়ে ছোটোছেলেকে বলছে-”যা দিদিকে ডেকে নিয়ে আয়, আর বাড়ির বাইরে থাকতে হবে না। বল বাবা ডাকছে, এখুনি না এলে জুতিয়ে পিঠের চামড়া তুলে নেবে।”
”শালা তোরই চামড়া তুলব।” চিৎকার করে অনন্ত এগিয়ে গেল বাসুদেবের দিকে।
বাসুদেবের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল অনন্তের কথাগুলো কার উদ্দেশ্যে, বুঝতে। বোঝার পর আর সময় পেল না।
”এটা কীরকম ছোটোলোকমি হল অ্যাঁঃ? আমি থানা-পুলিশ করব।” অনন্ত রবাবের বলটা তুলে ধরল। সেটা দেখে বাসু মিইয়ে গেল।
”কেন, থানা-পুলিশ কীজন্য?”
”ন্যাকা, জানো না? এ বল আমার ঠাকুরঘরে ছুঁড়ে গুপীনাথকে ইনজিওরড করা হয়েছে, আর এ বল তোরই ছেলের।”
”কে বলেছে ওটা আমার ছেলের বল?” বাসু তেরিয়া হবার চেষ্টা করল।
”বলটা তবে কার?”
”কার তা আমি কী করে বলব! উইদাউট এনি প্রুফ বললেই হল? ওরকম বল হাজার হাজার, থাউজেন্ড অ্যান্ড থাউজেন্ড ছেলের কাছে পাওয়া যাবে।”
”তোর ছেলের হাতে আজ সকালেই আমি দেখেছি। এই দ্যাখ, এইভাবে”-বলটা বাসুর মুখের সামনে ধরে অনন্ত টিপল। ”তোর ছেলে, এইতো এই ছেলেটাই, টিপছিল।”
বাসুর ছেলে তখন তার দিদি প্রমীলাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোচ্ছে তাঁতিগলি থেকে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে কেঁদে উঠল ভয়ে।
”হোয়াট ইজ দিস!” বলের হাওয়া মুখে লাগতেই বাসু আঁতকে পিছিয়ে গেছল। ”অ্যাঁ নোংরা বলের হাওয়া মুখের উপর? আমার ছেলেকে থ্রেট করে কাঁদানো? আই উইল কল পুলিশ। আমিও থানায় যাব। তেল বার করে ছাড়ব।”
বাসুদেব চিৎকার শুরু করল লোক জড়ো করার জন্য। বারান্দা এবং জানলা ভরে গেল। বাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে এল। পথচলতিরা কৌতূহলে দাঁড়াল।
”কী হয়েছে বাসুবাবু?” একজন জিজ্ঞাসা করল।
”এই দ্যাখো না ভাই”, বাসু খুশি হল প্রশ্নটা হওয়ায়। ”অনন্তর ঠাকুরঘরে কে ওই বলটা ছুঁড়েছে, আর এসে গালাগাল দিয়ে বলছে, বলটা আমার ছেলের অর্থাৎ ওই ছুঁড়েছে।” ”আমি জানতে চাই” বাসু বাঁ তালুতে ডান হাতের চাপড় মারল। ”আই ডিমান্ড, আমার ছেলেকে কেন, কীসের ভিত্তিতে দায়ী করা হল? প্রুফ নেই, উইটনেস নেই। আর তম্বি করা হচ্ছে থানা-পুলিশ করবে! করুক না, দেখি কত তেল হয়েছে।”
অনন্ত থিতিয়ে যাচ্ছিল। বাসুর শেষ কথাটায় ভেসে উঠল। ”হয়েছেই তো। একশো বার তেল হয়েছে। তুই তোর নিজের চরকায় তেল দে না। জানেন মশাই, ব্যাটা কী বলেছে মুদিকে! আমার ঠাকুর্দা নাকি নোট জাল করত, ডাক্তারবাবুকে বলেছে, আমার বাবার নাকি খারাপ রোগ ছিল।”
”কোন শালা আমার বাপ-ঠাকুর্দা তুলে কথা বলেছে।”
হঠাৎ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল দুলাল। নাকে কাপড় দিয়ে কাছের লোকেরা একটু সরে গেল।
”আমি বলেছি”, বাসু সমান তেজে চিৎকার করল, ”গরম, পয়সার গরম দেখাবে অনন্ত সিংগী? গাড়িতে পা তুলে একদিন আমার বাপ-ঠাকুদা ও দাঁড়াত রে, তখন তোর বাপ-ঠাকুর্দা এসে আমাদের বৈঠকখানায় জুতো খুলে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকত, বসতে বললে তবেই বসতে পারত। পয়সা আজ আছে কাল নেই, কিন্তু বংশের শিক্ষা-দীক্ষা চিরকাল রক্তে থেকে যায় রে থেকেই যায়।”
”ব্যাটার মাসের মধ্যে দশ দিন তো উনুন ধরে না।” অনন্ত ভাইকে পেয়ে প্রচণ্ড বলশালী বোধ করছে। নিশ্চিন্তে এবার সে বলটা বাসুর নাকের কাছে আবার টিপল।
”আমার উনুন ধরে কি না ধরে তোর বাপের কী?”
”চপরাও শালা, বাপ তুলবি না।” দুলাল টলে পড়ে যাচ্ছিল, অনন্তই ধরে ফেলল। রক্তারক্তি করে দোব। অনন্ত সিংগীকে যা খুশি বল শালা, বাপ-ঠাকুর্দা নিয়ে টানাটানি করলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দোব।”
”ব্যাটা, ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারিস না। বড়োমেয়েটা তো সেজন্যই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।” অনন্ত বলটা কচলাতে লাগল মুঠোয়।
”থাক গে অনন্তবাবু, ওসব পারিবারিক কেলেঙ্কারি আর রাস্তার মাঝে বলার দরকার কী।” একজন শ্রোতা অনুরোধ জানাল অনন্তকে উসকে দেবার জন্য।
”বাসুদা বাড়ি যাও, বাড়ি যাও। আর চেঁচাতে হবে না। তোমার আবার ব্লাডপ্রেশার আছে।” এক শুভানুধ্যায়ী বাসুর হাত ধরে টানল।
বিমূঢ় বাসুদেব ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। অনন্ত গোলাকার ভিড় থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির সদরের দিকে এগোল। গোলমাল শুনে তার বাড়ির সবাই এসে সদরে দাঁড়িয়েছে। ঝি এসে ফিসফিস করে অসমাপ্ত পারিবারিক কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। পাত্রী দেখতে আসা চার-যুবকও সদরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। অনন্তর মনে হল, তার প্রতাপের সম্যক পরিচয় পেয়ে নিশ্চয় ওরা পুতুলকে পছন্দ করার সময় খানিকটা কন্সিডার করবে।
হঠাৎ পাগলের মতো ছুটে গিয়ে বাসুদেব হাত ধরল অনন্তের।
”বলব? সেই কথাটা বলব? কেন তুই কুমার চৌধুরীকে দেখলে ভয় পাস, কেন তুই কুমারের কথায় ওঠ-বোস করিস-এবার বলে দিই পাড়ার লোককে? ভেবেছিস ভুলে গেছি, অ্যাঁ, পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা বলে, ভেবেছিল ভুলে গেছি, অ্যাঁ-আমার মেয়ে পালিয়েছে, অ্যাঁ।”
অনন্ত দেখল সারা জয়রাম মিত্র লেন আবার কৌতূহলে তাকিয়ে। এমনকি চার যুবকও। হঠাৎ তার চোখে সবকিছু অন্ধকার হয়ে এল। মাথার মধ্যে শুধু সোঁ সোঁ শব্দ। তার মনে হল বন্যা ছুটে আসছে-এবার সে ভেসে যাবে। আশ্রয়ের জন্য সে এধার-ওধার তাকাতেই দেখল টিউবওয়েলের পাশে একটা আধলা ইঁট পড়ে।
”এবার বলি ব্যাটা রাঙ্গামুলো? বলি, ভুবন চৌধুরী তোকে ওই কুমারের সামনেই দোকানের মধ্যে-”
এই সময়ই অনন্তের ছোঁড়া ইটটা ওর মুখে এসে পড়ল। আর তখনি দপ করে সারা জয়রাম মিত্র লেনের বাড়ির আলোগুলো নিভে গেল।
”আবার!” একজন বলল।
”দ্যাখো, আজ কতক্ষণ অন্ধকার থাকে।” আর একজন বলল।
”চল চল, দরজা খোলা রয়েছে, চুরি-টুরি না হয়।”
ভিড়টা খসে পড়তে লাগল অন্ধকারে।
.
”অ বউ, কোথায় চললি। খোকা ফিরল? অ বউ সাড়া না দিয়ে যাচ্ছিস কোথা?
”যমের বাড়ি।” দাঁতে দাঁত চেপে পারুল বলল।
”অ বউ, কাল খোকাকে বাজার যাবার সময় মনে করিয়ে দিস।”
পারুল ততক্ষণে বেড়ালের মতো হালকা পায়ে নিঃশব্দে উপরে উঠে গেছে। শোবার ঘরের দরজা খোলা, অশোক চোখ বুজে চিত হয়ে শোওয়া, বাচ্চচাটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
পারুল সামান্য ইতস্তত করে, ঘরে ঢুকে মৃদুস্বরে বলল, ”মাথাধরার ওষুধটা আছে।”
অশোক চমকে উঠল। এতক্ষণ ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে সুকুমার আর ঝুমিকে নিয়ে কতকগুলো দৃশ্য তার মনের মধ্যে আসা-যাওয়া করছিল। এইমাত্র তার দেখতে ইচ্ছে করছে ঝুমিকে। মেডিকেল কলেজে না গিয়ে বাড়ি ফিরে আসাটাকে সে অন্যায় বলে মনে করতে শুরু করেছে। এখনই ঝুমির দরকার একজন পুরুষ মানুষের। অথচ কেন যে সে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে এল, পথে চিনেবাদামও কিনেছিল, তার কারণ বুঝে উঠতে পারছে না অশোক। হয়তো ঝুমিকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখবে এবং সে দৃশ্য না দেখার ইচ্ছাতেই ফিরে এসেছে। কিংবা সুকুমারকে দেখলেই বরাবর যে এক ধরনের আড়ষ্টতা বোধ করত এবং তুলনায় নিজেকে নগণ্য বোধ করার সেই ভয়টা থেকেই হয়তো মেডিকেল কলেজে যায়নি। সুকুমারকে মাতাল অবস্থায় পেয়েছিল বলেই না ওর সঙ্গে তামাশা করতে পেরেছিল। নয়তো বিদ্যা-বুদ্ধি-রূপে-ব্যক্তিত্বে মদ-না-খাওয়া সুকুমার অন্য ব্যাপার।
অশোক নিজেকে অল্পবিস্তর কাপুরুষও মনে করল। একটা মাতালকে যে-কেউই পরিহাস করতে পারে। তার বোধশূন্যতার সুযোগ ভাঙিয়ে ব্যঙ্গ করার মধ্যে সাহস নেই। দুঃসংবাদ পাওয়া ঝুমির, যে একদিন একটা চুমু দেবে বলেও দেয়নি, সামনে যেতে পারেনি এই সাহসের অভাবের জন্যই। জীবনে কোনো উন্নতিই করতে পারেনি সে সাহসহীনতার জন্য।
ভাবতে ভাবতে অশোক তেতে উঠতে শুরু করে, সাহসী একটা কিছু করার জন্য। এমন একটা কিছু যাতে তার মনে হয়, ঝুমিকে সে অনায়াসেই পেতে পারত, নেহাতই সুকুমারের প্রতি অনুগ্রহবশত-
”ছিঁড়ে পড়ছে মাথাটা।”
পারুল দু’হাতে কপাল চেপে যন্ত্রণাসূচক একটা শব্দ করল অস্ফুটে। অশোক উঠে বসল।
”ওষুধ তো ফুরিয়ে গেছে।”
অশোকের মনে হল, একথা শুনে ঝুমির শরীরওলা বউটি মোটেই হতাশ হল না।
”তাহলে কী করি?”
”আসুন, বরং মাথাটা টিপে দি।”
”থাক থাক। বউ নেই কিনা তাই খুব সাহস দেখাচ্ছেন।”
‘সাহস’ কথাটা শুনেই অশোকের চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল, আপনা থেকেই দুই চোয়াল শক্ত হয়ে পড়ল। এই অশিক্ষিত বউটির ঠাট্টা তার ভালো লাগেনি। কেমন যেন চ্যালেঞ্জ রয়েছে ওর গলার স্বরে।
”বউয়ের সামনে অনেক সাহস না দেখানোই তো সাহসের কাজ।”
”খুব বীরপুরুষ আপনি।” পারুল মাথা হেলিয়ে চোখ দুটো আধবোজা করে হাসল। ”শনিবার যা ধাক্কা দিয়েছিলেন মাথায়।”
”আমি! মাথায় ধাক্কা!” অশোক খুব অবাক হবার চেষ্টা করল।
”শুধু ধাক্কা!” পারুল পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ”ঘাড়ে এই দাঁতের দাগ কীসের?”
”কই দেখি”। অশোক এগিয়ে গেল। পারুলের পিঠ-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর মাথার নারকোল তেলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আলতো করে কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল। ”এইখানে?”
”শুধু ওখানে?” পারুল হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, ”ব্লাউজের একটা বোতামও তো আস্ত রাখেননি। ইলা যদি তখন এসে পড়ত!”
”এখন তো আর ইলা নেই।”
”এখন তো আপনি মদও খেয়ে নেই। সাহস হবে কী করে।”
অশোকের আঙুলগুলো কুঁকড়ে চেপে বসল পারুলের কাঁধে। হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে সে পারুলকে গায়ের উপর এনে ফেলল।
”মদ না খেয়ে সাহস হয় কিনা দেখবে?”
পারুল ঘাড় ফিরিয়ে অশোকের চোখে চোখ রাখল। ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোল মুচড়ে হাসল এবং দেহটিকে আলতো করে চেপে ধরল অশোকের সঙ্গে।
”ঝুমি হলে নিশ্চয় আপনার সাহস হত।”
শোনামাত্র অশোকের শরীরের ভিতরে এবং বাইরে শক্ত হয়ে উঠল। একটু পিছিয়ে গিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ”ঝুমিকে জানলে কী করে।”
”জেনেছি।” পারুল ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে তেরছা চোখে তাকাল। ”ভয় নেই, ইলা জানে না।”
”জানুক, আমি কেয়ার করি না।”
”ঝুমিটা কে?” পারুল বলল।
”একটা মেয়ে। এখন দুটো ছেলের মা। কয়েক ঘণ্টা আগে বিধবা হয়েছে।”
”প্রেম ছিল?”
”হ্যাঁ।”
”বিয়ে হল না কেন?”
”আমি ভীতু, তাই সাহস নেই। নিজের উপর ভরসা নেই, তাই তোমাকে-”
হাত বাড়িয়ে অশোক বুকের উপর পারুলকে টেনে এনে চেপে ধরল। প্রচণ্ডভাবে চুমু খেল এবং ছেড়ে দিল। স্থির দৃষ্টিতে পারুল তাকিয়ে রয়েছে।
”দেখলে তো। ঘরে আলো জ্বলছে, দরজাও খোলা, সাহস আছে কি না দেখলে?” অশোক হাঁফাচ্ছে। চোখের জ্বালা বাড়ছে। ধীরে ধীরে দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে বউটির মুখ। সেখানে ঝুমির মুখ সে বসাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু বসছে না।
”আপনি মদ খেয়ে আসুন।”
”কেন।” অশোকের মনে হল তার গালে এই অশিক্ষিত বউটি ঠাস করে চড় মারল।
”আপনি সত্যিই ভীতু।”
শোনামাত্র অশোকের চোখ থেকে মুছে গেল ঘরের আলো এবং পারুল। ঠিক এই গলাতেই ঝুমি বলেছিল। আট-ন বছর আগে। একই কথা। সেদিন লজ্জা পেয়েছিল, আজ রাগে দিশেহারা হয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে সে পারুলের গলাটা দু মুঠোর মধ্যে ধরল।
”আহ।” অস্ফুটে পারুল চাপা চিৎকার করল। আর তখনই দপ করে নিভে গেল ঘরের আলোটা।
”কী হল।” পারুল ছিটকে সরে গেল দরজার দিকে।
”হয়তো আবার সেদিনের মতো নিভল।”
পারুল জানালায় গিয়ে উঁকি দিল। সারা পাড়া অন্ধকার। রাস্তায় কোথায় চিৎকার করে কে চেঁচাচ্ছে। নিচে থেকে বুড়ির গলা ভেসে এল, ”অ বউ, কোথায় আছিস, খোকা ফিরল?”
তখন অশোক টেনে আনল পারুলকে খাটের উপর।
.টিপু ঘুমিয়ে পড়েছে। আভা ওর পাশে কাত হয়ে শুয়ে। টিপুর গায়ে ডান হাতটা আলতো করে রাখা। হিরণ্ময় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলায় শব্দ করল। আভা ব্যস্ত হয়ে গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়াল।
”কী ভাবছ?” দরজার কাছ থেকেই হিরণ্ময় প্রশ্ন করল।
”কিচ্ছু না।” মুখ নামিয়ে আভা উত্তর দিল।
”হ্যাঁ ভাবছিলে। বলব? তোমার দিদির কথা। জানাজানি হলে আমার মানমর্যাদা ধুলোয় লুটোবে, সেই কথা। আর নিজের কথাও ভাবছিলে।”
”আমার কথা?” আভা মুখ তুলল। ”ওসব আমি ভাবিনি।”
”মিথ্যে কথা, মানুষ মাত্রেই নিজের কথা ভাবে। আমিও ভাবি। ভাবাটা অন্যায় নয়, স্বার্থপরতাও নয়। আমি চাই তুমি নিজের কথা ভাব।”
”কী ভাবব?”
”তোমার ইচ্ছা, যা তোমার নিজস্ব, সেগুলো যাতে পূর্ণ হতে পারে। মায়া-মমতার মতো বাজে জিনিসগুলো যাতে তোমায় চেপে কুঁকড়ে ছোটো করে না দেয় সেজন্য পথ খুঁজে বার করার উপায় ভাববে। সে পথ ট্রেনে কাটা পড়া বা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়া নয়।”
”কিন্তু আর কী পথ আছে?” আভা অসহায় স্বরে বলল। ”আপনি যদি অবিবাহিত হতেন, যদি আমার ভগ্নিপতি না হতেন তাহলে-”
”তাহলে কী?” হিরণ্ময়ের চোখও তীক্ষ্ন হল, কথার মতো।
”তাহলে কোনো সমস্যাই উঠত না।”
”তার মানে বিয়ে?”
আভা মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। হিরণ্ময় বিরক্ত স্বরে বলল, ”এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না? বিয়ে করলেই কি মোক্ষলাভ হবে, বিয়ে করলেই কি ভালোবাসা প্রেম সার্থক হয়ে উঠবে?”
”হ্যাঁ।” হঠাৎ উদ্ধত ভঙ্গিতে অধৈর্য স্বরে আভা বলে উঠল। এতক্ষণ ধরে হিরণ্ময়ের ক্রমান্বয় প্রশ্নে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়তে পড়তে ক্ষেপে উঠছিল। কথাগুলোর মধ্যে নিছকই কথা ছাড়া, আসল এবং আসন্ন বিপদ থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় সে খুঁজে পাচ্ছিল না।
”তাহলে আমায় ভালোবাসলে কেন?” হিরণ্ময়ের স্বরে এতক্ষণে রাগ ফুটে উঠল। ”তাহলে আমায় বাধা দিলে না কেন? তোমার এই অবস্থা করার সুযোগ দিলে কেন? তুমি কি জানতে না, বিয়ে করার উপায় আমার নেই? বলো, জবাব দাও আমার কথার?”
আভা কথা না বলে হিরণ্ময়ের পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরোবার জন্য এগোতেই, হাত তুলে দরজা আটকে দাঁড়াল হিরণ্ময়। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, আভার গায়ের জোর তার থেকেও বেশি। ইচ্ছে করলে তাকে ঠেলে সরিয়ে, বেরিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু আভা তা করল না। তাতে হিরণ্ময় মনে করল, এটা ওর বিনয়। উত্তেজিত স্বরে আবার প্রশ্ন করল, ”জানতে না, তুমি অন্যায় কাজ করছ। জানতে না, তুমি পাপ করছ?”
”না। আমি জানতাম না, সত্যি বলছি বুঝতে পারিনি তখন আমি কী করছি। কিন্তু আমি ভালোবাসি আপনাকে, এখনও ভালোবাসি। আপনি আমায় ছেড়ে দিন। আমি পারব না আপনার মতো নিষ্ঠুর হতে। আপনি যা চাইছেন তা হয় না।”
আভা কান্নার দমকে কাঁপতে শুরু করল। হিরণ্ময় দরজা থেকে হাতটা নামাল। আভা দুহাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে বলে উঠল।
”সারাক্ষণ আমি ভেবেছি আর বারবার মনে হয়েছে, কী অপরাধ আমি করেছি! কার কাছে আমি অপরাধী?”
”তোমার দিদির কাছে।”
”হ্যাঁ, তাই। জানেন, একদিন স্বপ্ন দেখেছি দিদি মারা গেছে ট্রেনে কাটা পড়ে। আমার কতদূর যে অধঃপতন হয়েছে। আমি ওর মৃত্যু নিশ্চয় চুপিচুপি কখনো কামনা করেছিলাম। ভাবতে পারেন, আমি খুনি হতে চেয়েছিলাম!”
”আমিও চেয়েছি। স্বপ্নে নয়, জেগেই আমি চাই। তোমায় বিয়ে করতে পারব বলে নয়, শুধুই রেহাই চাই। কীসের রেহাই, কেন রেহাই, অত বোঝাতে পারব না এখন। তবে, হাত-পা ছড়িয়ে আমি একা ঘুমোতে চাই ওই বিছানাটায়। আর কিছু নয়, আর কিছু নয়।”
মুখ থেকে হাত নামিয়ে ফেলেছে আভা। ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। শুকনো স্বরে বলল, ”আপনি চাইতে পারেন কিন্তু আমি পারব না। আমি জানি, আমি পাপ করেছি, তার জন্য শাস্তিই আমার প্রাপ্য।”
”শাস্তি তাহলে আমারও প্রাপ্য। কিন্তু নিজেকে তিল তিল খুন করে অপরকে সুখী করতে হবে, এমন কোনো শর্ত পূরণ করার কথা আমাদের আছে কি?” হিরণ্ময়ের স্বর তীব্র। চোখ দুটি জ্বলজ্বলে। সে উত্তেজনায় কাঁপছে।
”অনেক কিছুই তো নেই আমাদের।” আভা কথাগুলোকে টেনে টেনে বলল। ”সবই কি আমরা চাইলেই পেতে পারি?”
”যা পাওয়া সম্ভব, তা কেন চাইব না?”
”আপনি দিদিকে খুন করতে পারেন?”
উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেল হিরণ্ময়। আভা লক্ষ করে হাসল। হিরণ্ময় ক্ষিপ্ত, মরিয়া স্বরে বলল, ”পারব। আভা, তোমার জন্য আমি পারব। তুমি যদি-”
আভার চিৎকারে চমকে উঠে চুপ করে গেল হিরণ্ময়। ”চুপ করুন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আপনার এইসব কথা। জেনে রাখুন, আমি আর আপনাকে ভালোবাসি না। হ্যাঁ, তাই। আপনাকে কেউ ভালোবাসতে পারে না, পারে না, পারে না। আমি ভুল করেছি, ভীষণ ভুল করেছি। আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।”
বলতে বলতে আভা ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে যখন, তখনই দপ করে নিভে গেল সব আলো। রান্নাঘর থেকে ঠাকুর চেঁচিয়ে উঠল, ”আবার আজও!”
হিরণ্ময় একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হচ্ছে, অন্ধকার আবার তাকে ঘিরে ধরবে। আবার তার ইচ্ছা হবে রাস্তায় পুলিশ গুলি চালাচ্ছে খবর পেলে বেরিয়ে পড়তে। আবার সহজ অঙ্কটা কষে কষে যেতে হবে। আবার মরে যাওয়া!
মনে মনে বলল, আমি ব্যর্থ, ব্যর্থ, ব্যর্থ।
.
”ওই ঘরটা।” শেফালি বলল।
শোভা আর ইলা তাকাল। ঝুপসি অন্ধকার, ভাঙাচোরা দেয়াল, ভ্যাপসা গন্ধ, আর ছেঁড়া কাগজে ভরে আছে একতলাটা। তিনটির মধ্যে দুটি ঘর ভাড়া দেওয়া রাস্তায়-কুড়োনো ছেঁড়া নোংরা কাগজের এক কারবারিকে। শুধু সিঁড়ির পাশের ঘরটিতে বাস করে এক ফেরিওলা পরিবার। ওরা দেখতে পেল ঘরের মধ্যে একটি বছর তিনেকের শিশু মেঝেয় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। একটি বছর পনেরো-ষোলোর মেয়ে কলাইয়ের থালায় কিছু একটা মাখছে আর তার সামনে দুটি ছেলে, আট থেকে বারোর মধ্যে বয়স, একদৃষ্টে থালার দিকে তাকিয়ে। ঘরের আলো অনুজ্জ্বল, পাণ্ডুর। কোনো আসবাব ওদের চোখে পড়ল না। দেয়ালের তাকে কয়েকটা মাটির হাঁড়ি আর পুরনো কৌটো।
শোভা ফিসফিস করে বলল, ”ওদের মা নেই?”
”কী জানি।” শেফালি বোধহয় এই প্রথম পাড়ার একটি পরিবার সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করল।
”জানলাটা কোথায়?” শোভা আবার বলল।
”ডানদিকে। ঘরে ওই একটাই জানলা।”
বোধহয় ওদের কথার শব্দ পেয়েই, ঘরের তিনজন তাকাল। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। শীর্ণ দেহে ফ্রকটি ঢোলা দেখাচ্ছে। মেয়েটির চোখ দু’টি বড়ো, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে।
ওরা তিনজন ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। এইবার পুরো ঘরটা দেখতে পাচ্ছে। ডানদিকে জানলাটা বন্ধ। তার নিচেই ছেঁড়া চিটচিটে তোশকের উপর একটি স্ত্রীলোক শুয়ে, চোখ আধবোজা, মণি দুটি কোণে সরে গিয়ে সাদা অংশটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, হাত দুটি পাশে এলানো। স্ত্রীলোকটির মুখ খোলা। হলদে দাঁত দেখা যাচ্ছে। দেহের কাঠামো দেখলে মনে হয় বহুকালের বিসর্জিত প্রতিমা জল থেকে তুলে এনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বসন বিস্রস্ত। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় উঠে-থাকা পা দুটি যেন প্লাস্টিকের দু-গাছা লাঠি পেতে রাখা। ব্লাউজের বোতাম উন্মুক্ত। জিরজিরে বুকের উপর দুটি চর্মসার স্তন। পায়ের আঙুলে হাজা। স্ত্রীলোকটির নিশ্বাস পড়ছে কিনা বোঝা গেল না।
শেফালির মনে হল, মরে গেছে। শোভারও তাই মনে হল, ইলারও। ওরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ঘরের ডানদিকের কোণে একটি সাত-আট মাসের বাচ্চচা মেঝে থেকে খুঁটে খুঁটে মুড়ি খাচ্ছে একমনে। তিনজনকে দেখে সে ভয় পেল। হামা দিয়ে স্ত্রীলোকটির কাছে সরে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকল।
”কী চাই আপনাদের?” বড়োমেয়েটি জানতে চাইল। ওর কণ্ঠ কর্কশ। বলার ভঙ্গি শীতল নিস্পৃহ।
”কী হয়েছে তোমার মায়ের?” শেফালি আন্দাজেই ধরে নিল স্ত্রীলোকটি এদের মা।
”অসুখ।”
”কী অসুখ, কতদিন ধরে?” শেফালিই বলে গেল।
”অনেকদিন হাসপাতালে ছিল, ছেড়ে দিয়েছে।”
”সেরে গেছে?”
”না। বাঁচবে না বলে ছেড়ে দিয়েছে।”
ওরা তিনজন আবার তাকাল স্ত্রীলোকটির দিকে। একসঙ্গে তিনজনের মনে হল মরে গেছে। একসঙ্গে তিনজন ভাবল, তাহলে জানলাটা খুলতে বলা উচিত হবে কি! বিছানাটা না সরালে জানলা দিয়ে দেখা যাবে না।
”জানলাটা বন্ধ কেন, খুলে দাও না।” শোভা বলল। কেন খুলতে হবে, তার কারণটা বলতে আটকাল তার।
”না। বাবা বারণ করেছে। এরা চিৎকার গোলমাল করে, পাশের বাড়ির লোকেরা খুব বিরক্ত হয়।”
”বাচ্চচা ছেলেপুলে থাকলে গোলমাল তো হবেই। তাই বলে অসুস্থ মানুষটার কথাও তো ভাবতে হবে। এই বন্ধ ঘরে থাকলে অসুখ তো বেড়ে যাবে। খুলে দাও, বলুক ওরা যা বলার।” শেফালির স্বর কোমল এবং অন্তরঙ্গ।
”না, বাবা বকবে।” মেয়েটি গোঁয়ার গলায় বলল।
”তাহলে?” ইলা ফিসফিস করে শেফালির কাছে জানতে চাইল। শেফালি তা গ্রাহ্য না করে মেয়েটিকে বলল, ”বাবা কখন আসবে?”
”এগারোটা-বারোটা হয়ে যায়।”
”তুমি করছিলে কী?”
”ছাতু মাখছিলুম।”
”ভাত কিংবা রুটি করোনি?”
”না। মাঝে মাঝে ভাত হয়।”
ওরা কথা বলছে সেই ফাঁকে ছেলে দুটি থালা থেকে খামচা দিয়ে মাখা ছাতু তুলে নিল। মেয়েটি দেখতে পেয়ে ধমকে উঠল।
”তুমি স্কুলে পড়ো না?” শোভা প্রশ্ন করল।
মেয়েটি উত্তর না দিয়ে, ছাতু মাখায় ব্যস্ত হল। ইলা আবার বলল, ”তাহলে?”
”তাহলে আবার কী!” শেফালি ঝাঁঝিয়ে উঠল বিরক্ত হয়ে। ”দেখছ একটা মানুষ মরছে, এতগুলো বাচ্চচা ভাই-বোন নিয়ে একা ওইটুকু মেয়ে হিমসিম খাচ্ছে, আর এখনও তোমার শখ গেল না।”
ইলা লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল। শোভা মনে মনে অপ্রতিভ হল। স্ত্রীলোকটি নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে, তার বুকের উপর উপুড় হয়ে বাচ্চচাটি স্তন চুষছে। মেয়েটি ছাতুর একটা গোল্লা পাকিয়ে ডাকল-”আয়, বাবু আয়।” বাচ্চচাটি সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বুক থেকে নেমে হামা দিয়ে মেয়েটির কাছে গেল। ওকে কোলে বসিয়ে মেয়েটি একটু একটু করে খাওয়াতে লাগল।
শেফালি এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীলোকটির হাঁটু থেকে কাপড়টা গোড়ালি পর্যন্ত নামিয়ে দিল। ঝুঁকে কপালে হাত রাখল। শোভার মনে হল, তারও কিছু একটা করা দরকার। করার মতো কিছুই সে দেখতে পেল না। ইলা তাকে বলল, ”ঘরটায় একদম হাওয়া নেই, কী ভ্যাপসা!”
শেফালি বলল, ”বোধহয় ডাক্তার ডাকতে হবে। তেমন সুবিধের মনে হচ্ছে না। জানলাটা খুলে দাও তো ইলা।”
মেয়েটি কী বলতে যাচ্ছিল, শেফালি হাত নেড়ে চাপা দাবড়ানি দিল, ”যা বলার আমিই বলব তোমার বাবাকে। যা করছ তাই করো। দাঁড়িয়ে কেন? খুলে দাও, হাওয়া আসুক।”
বিছানা ঘেঁষে ইলা দাঁড়াল। ছিটকিনিটা আঁট হয়ে রয়েছে। টানাটানি করতে ওর মনে হল কার ঠান্ডা হাত যেন তার পায়ে ঠেকল। শোভা তাকিয়েছিল জানলার দিকে। ওর মনে হল, আধবোজা নিথর চোখে কে যেন তার দিকে তাকিয়ে। দুজনেই হঠাৎ শিউরে উঠল। আর জানলাটা যে মুহূর্তে খুলল, তখনই দপ করে ঘরের আলোটা নিভে গেল। ইলা জড়িয়ে ধরল শোভাকে। বাচ্চচাটা ভয়ে ঢুকরে উঠল। শেফালি স্থির গলায় বলল, ”আঁচলে পয়সা বাঁধা আছে। খুলে দাও তো ইলা, মোমবাতি আনুক।”
দশ
তখন ভোম্বল আর একটু কাছে সরে এল মানুর।
এতক্ষণে অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। এখন মানুর অবয়ব জমাট বেঁধে গেছে। ভোম্বলের চোখ সেটি খোদাই করে অন্ধকার থেকে একটা মূর্তি বার করে নিয়েছে। দীর্ঘ, ছিপছিপে, মাথায় প্রচুর চুল, নাকের ডগাটি তীক্ষ্ন। ভোম্বল তার হাতের গোলাপটি মানুর গালে বুলিয়ে দিল।
”আমি কিন্তু সত্যি বলেছি।” মানু খুব সহজভাবে বলার চেষ্টা করল।
”তুমি তাকে দিলে না কেন?” ভোম্বল লঘু হতে গিয়েও পারল না।
”দিয়েছি নাকি! পড়ে গেল আর আপনি তুলে নিলেন।” মানু সহজভাবে বলার চেষ্টা করল।
”তাহলে দরকার নেই আমার, এই নাও।” ভোম্বল আর