• বইয়ের নামঃ কিশোর সাহিত্য সমগ্র ২য় খণ্ড
  • লেখকের নামঃ মতি নন্দী
  • প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
  • বিভাগসমূহঃ সমগ্র

০. মতি নন্দী : ব্যক্তি ও সাহিত্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মতি নন্দী : ব্যক্তি ও সাহিত্য

একটা সিনেমা পত্রিকার পক্ষ থেকে একবার একটি উপন্যাস প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হয়েছিল। অনেক রচনার মধ্যে যে তিনটি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান পায়, সেই তিনটিরই লেখক পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছিলেন। প্রথম স্থান মতি নন্দীর, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে পূর্ণেন্দু পত্রী ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।

উপন্যাসের লেখক হিসেবে মতি নন্দী পুরস্কৃত হলেও এর পরে বেশ কয়েক বছর তিনি ছোট গল্পের লেখক হিসেবেই বেশি সার্থক ছিলেন। এক একটা গল্প যেন এক একটি উজ্জ্বল রত্নের মতন। এখানে আমরা সেসব রচনার আলোচনার মধ্যে যাবো না। শুধু তার ছোটদের লেখাগুলি নিয়েই কিছু কথা বলবো।

সব লেখকই ছোটদের জন্য লিখতে পারেন না। অনেক মহান লেখকও ছোটদের জন্য কলম ধরেন নি। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যৎসামান্য। আবার রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অজস্র। এবং সুকুমার রায়ের মতন এক অসাধারণ লেখক তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে অধিকাংশই লেখাই লিখেছেন শুধু ছোটদের জন্য, যেগুলি বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ। কেন কোনও কোনও লেখক ছোটদের জন্য লিখতে চান না, কেন কেউ কেউ শুধু ছোটদের জন্য লেখাতেই মন ঢেলে দেন, আবার কেন কোনও কোনও লেখক ছোটদের এবং বড়দের জন্য সমানভাবে লেখেন, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো খুব শক্ত। হয়তো কোনও কোনও লেখকের মানসিক গড়নই এমন থাকে, যা ছোটদের রচনার ঠিক উপযোগী নয়। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন, বোধহয় ছোটদের নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। মতি নন্দীকেও আপাতদৃষ্টিতে সেই ধরনেরই মানুষ মনে হয়।

অনেকেরই ধারণা, মতি নন্দী খুব শক্ত ধরনের মানুষ এবং দুর্মুখ। লোকের মুখের ওপর শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তিনি মিথ্যে কথা আর ন্যাকামি একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। সময়রক্ষার ব্যাপারে তিনি নিজে ছিলেন যেমন কঠোর, অপরের কাছ থেকেও তেমনই আশা করতেন। একদিনের ঘটনা মনে আছে। এক পত্রিকার সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে একটি লেখা চেয়েছিলেন। সেই শনিবার সন্ধ্যে আটটার সময় এসে তাঁর সেই লেখাটি সংগ্রহ করে নেওয়ার কথা। মতি গল্পটি লিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় বসে অপেক্ষা করছেন। আটটা, সোয়া আটটা, সাড়ে আটটা বেজে গেল, সম্পাদকের দেখা নেই। আটটা বেজে চল্লিশের সময় মতি আর আমি দু’জনেই অফিস থেকে বেরুচ্ছি, এমন সময় সেই সম্পাদক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত। ট্র্যাফিক জ্যাম বা এই ধরনের কোনও কারণে তাঁর দেরি হলো, তিনি সেটা বোঝাবার চেষ্টা করতে গেলেও মতি নন্দী তা শুনতেই চাইলেন না। ক্রোধে আগুন হয়ে তিনি বললেন, এতক্ষণ বসিয়ে রেখে আপনি আমাকে অপমান করেছেন, আপনাকে আমি লেখা তো দেবই না, আর কোনওদিন আমার সামনে আসবেন না। ভদ্রলোক তবু কাকুতি মিনতি করে বলতে চাইলেন যে তিনি সঙ্গে টাকাও নিয়ে এসেছেন। তাতে আরও জ্বলে উঠে মতি বললেন, আপনার টাকায় আমি থুতু ফেলি, আপনাকে আমি এ লেখা তো দেবই না, বরং এটা আপনার সামনেই আমি ছিঁড়ে ফেলবো। মতি নন্দী সত্যি সত্যি লেখাটা ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হলেও আমি কোনওক্রমে বাধা দিয়ে সেটা রক্ষা করতে সক্ষম হই। কিন্তু মতি সেই সম্পাদককে আর কোনওদিনও কোনও লেখা দেন নি।

এই রকম ব্যবহারের জন্য অনেক সম্পাদকের সঙ্গেই মতি নন্দীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। অনেক লেখক বা বন্ধুর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়ে যেত। ‘দেশ’ পত্রিকার গল্প বিভাগ দেখতেন তখন প্রখ্যাত লেখক বিমল কর। তাঁর সঙ্গেও মতি নন্দীর মনোমালিন্য হয়েছিল। এবং সেজন্য প্রায় আঠারো বছর তিনি দেশ পত্রিকায় একটি লেখাও দেননি। বিমল কর মহাশয় অবসর নেওয়ার পর কিছুদিন গল্প বিভাগটি দেখার ভার পড়ে আমার ওপর। তখন আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে মতি নন্দী অত বছর পর আবার দেশ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন।

আমার সঙ্গে, সুদীর্ঘ জীবনে মতি নন্দীর একদিনের জন্যও মন কষাকষি হয়নি। কখনও একটুও সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। কেন? এটা খুব আশ্চর্যের না? কারণটা সম্ভবত এই যে, মতি নন্দীর কথা ও ব্যবহারে যে কঠিন আবরণ, তার আড়ালে যে একটা খুব নরম ও সংবেদনশীল মন আছে, সেটা আমি জেনে ফেলেছিলাম। উত্তর জীবনে, অনেকদিন দেখা হোক বা না হোক, তবু আমরা ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এবং অনেকের ধারণা, অনেক গল্প—উপন্যাস যেমন কবিতা—টবিতা পড়েন না, মতি নন্দীর মতন কাঠখোট্টা মানুষও কবিতার ধার ধারেন না। কিন্তু সেটা ভুল। আমি জানতাম, নিজে কবিতা না লিখলেও মতি মন দিয়ে পড়তেন একালের অনেকের কবিতা, এমনকি কিছু কিছু কবিতা তাঁর মুখস্থও ছিল। সেই জন্য, আমি আমার কোনও গল্প উপন্যাসের বদলে কাব্য সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ড উৎসর্গ করেছিলাম মতি আর তাঁর স্ত্রী নিতি নন্দীর নামে।

মতির মনের সেই নরম দিকটিই তাঁকে ছোটদের জন্য লিখিয়েছে। অনেক মানুষ তাদের শৈশব বা কৈশোরের দিনগুলির কথা হুবহু মনে রেখে দেয়, আবার অনেকে ভুলেও যায় বা ভুলতেই চায়। যারা মনে রাখে, তারাই ছোটদের জন্য সার্থক কিছু সৃষ্টি করতে পারে। মতির বড়দের লেখায় খুন, আত্মহত্যা কিংবা হিংসার কথা বড় বেশি দেখা যায়। কিন্তু তাঁর কিশোর সাহিত্যে এসবের কিছুমাত্র চিহ্ন নেই। রয়েছে দরিদ্র, অসহায় ছেলেমেয়েদের জীবনে উন্নতি করার জেদ, তাদের প্রতি রয়েছে লেখকের অসীম মমতা।

মতি নন্দী বাংলা তথা ভারতের খেলার জগতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতেন। সেইসব কাহিনি নিয়ে লিখেছেন এবং সেইসব রচনাকে সত্যিকারের সাহিত্যমূল্য দিতে পেরেছেন। আমার মনে আছে, ‘স্ট্রাইকার’ উপন্যাসটি পড়ে আমি খুব কেঁদেছিলাম, ‘কোনি’ পড়েও চোখের জল ফেলেছি, তা আনন্দের অশ্রু। কারণ, মতি এই গল্পের ছেলেমেয়েদের শেষপর্যন্ত হারতে দেননি, তাদের জিতিয়ে দিয়েছেন। ছোটদের রচনায় মতি নন্দী অত্যন্ত সহৃদয় একজন মানুষ। কোথাও বিন্দুমাত্র তিক্ততা নেই, আছে আশার উদ্দীপনা। তাঁর অন্যান্য অনেক ছোটদের রচনা পড়েই আমার চক্ষু সজল হয়ে এসেছে।

বড়দের রচনার জন্যও মতি নন্দী একালের একজন অগ্রগণ্য লেখক। আর ছোটদের রচনাতেও সেই লেখকই সার্থক হতে পারেন, যাঁর লেখা ছোটদের সঙ্গে বড়োরাও সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ে। যেমন, সুকুমার রায় তো আর শুধু শিশুপাঠ্য নয়, সর্বজনপাঠ্য। আনন্দমেলায় প্রতি বছর আমি মতি নন্দীর উপন্যাসই প্রথম পড়েছি। শেষ কয়েক বছরে তাঁর লেখা না পেয়ে আমি হতাশ হয়েছি। খেলার জগৎ নিয়ে এমন সার্থক রচনা মতি নন্দীর আগে বাংলা ভাষায় আর কেউ লিখতে পারেননি। এবং এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কোনি

কোনি – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।। ১।।

আজ বারুণী। গঙ্গায় আজ কাঁচা আমের ছড়াছড়ি।

ঘাটে থৈ থৈ ভীড়। বয়স্কদের ভীড়টাই বেশি। সদ্য ওঠা কাঁচা আম মাথার উপর ধরে, ডুব দিয়ে উঠেই ফেলে দিচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে আম। কেউবা দূরে ছুঁড়ে ফেলছে।

ছোট ছোট দলে ছেলেরা জলে অপেক্ষা করে আছে আম সংগ্রহের জন্য। কেউ গলাজলে দাঁড়িয়ে, কেউবা দূরে ভেসে রয়েছে। আম দেখলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। একসঙ্গে দু—তিনজন চীৎকার করতে করতে জল তোলপাড় করে এগিয়ে যায়। যে পায়, প্যান্টের পকেটে রেখে দেয়, পকেটটা আমে ভরে গিয়ে ফুলে উঠলে, জল থেকে উঠে ঘাটের কোথাও রেখে আসে। সেই আমে হাত দেয়ার সাধ্য কারুর নেই। পরে আমগুলো ওরা বিক্রি করে পথের ধারে বসা বাজারে, অনেক কম দামে।

আজ গঙ্গায় ভাঁটা, জল অনেকটা সরে গেছে ঘাট থেকে। সিঁড়ি এবং তার দু’ধারে ইঁট বাঁধানো ঢালু পাড় শেষ হয়ে কিছুটা পলিমাটি, তারপর জল। স্নান করে, কাদা মাড়িয়ে বিরক্ত মুখে উঠে আসতে হচেছ। তারপর অনেকে যায় ঘাটের মাথায়, ট্রেন লাইনের দিকে মুখ করে বসা বামুনদের কাছে, যারা পয়সা নিয়ে জামাকাপড় জমা রাখে, গায়ে মাখার সর্ষে বা নারকোল তেল দেয় এবং কপালে চন্দনের ছাপ আঁকে। রাস্তার একধারে বসা ভিখারীদের অনেকে উপেক্ষা করে, কেউ কেউ করে না। দু’ধারের ছোট ছোট নানান দেবদেবীর দুয়ারে এবং শিবলিঙ্গের মাথায় ঘটি থেকে গঙ্গাজল দিতে দিতে, কাঠের, প্লাস্টিকের, লোহার, খেলনার ও সাংসারিক সামগ্রীর দোকানগুলির দিকে কৌতূহলী চোখ রেখে অধিকাংশই বাড়ির দিকে এগোবে। পথের বাজার থেকে ওল বা থোড় বা কলম্বা লেবু ধরনের কিছু হয়তো কিনলেও কিনতে পারে। তারপর, রোদে তেতে ওঠা রাস্তায় খালি—পা দ্রুত ফেলে বাড়ি পৌঁছবে বিরক্ত মেজাজে।

তেলচিটে একটা ছেঁড়া মাদুরে উপুড় হয়ে বিষ্টুচরণ ধরও ডলাই—মালাই করাতে করাতে বিরক্ত মুখে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। বিষ্টু ধর (পাড়ায় বেষ্টাদা) আই. এ. পাশ, অত্যন্ত বনেদী বংশের, খান সাতেক বাড়ি ও বড়বাজারে ঝাড়ন মশলার কারবার এবং সর্বোপরি সাড়ে তিনমণ একটি দেহের মালিক। ওরই সমবয়সী চল্লিশ বছরের একটি বিশ্বস্ত অস্টিন সর্বত্র ওকে বহন করে।

বিষ্টু ধরের বিরক্তির কারণ, হাত পনেরো দূরের একটা লোক। পরনে সাদা লুঙ্গি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে রঙিন ঝোলা। তার দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে। বিষ্টু বুঝতে পেরেছে, লোকটা হাসছে তার দেহের আয়তন দেখে। এরকম হাসি বাচ্চচা ছেলেরাও হাসে। বিষ্টু তখন দুঃখ পায়, তার ইচ্ছা করে ছিপছিপে হতে।

কিন্তু বিষ্টু বিরক্ত হচ্ছে যেহেতু এই লোকটা মোটেই বাচ্চচা নয়। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। নুন আর গোলমরিচের গুঁড়ো মেশালে যেমন দেখায়, মাথার কদমছাঁট চুল সেই রঙের। বয়সটা পঞ্চাশের এধারে বা ওধারে বছর পাঁচেকের মধ্যে হতে পারে। লোকটার গায়ের রঙ ধুলোমাখা পোড়ামাটির মত; আর চোখের চাহনি! ধূসর মণি দুটো দেখলে মনে হবে বোধহয় সূর্যের দিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তাকিয়ে থেকেই মণির কালো রঙটা ফিকে হয়ে গেছে। চাহনিটা এমন, দেখলে মনে হয় যেন তার মনের সঙ্গে মেলে না সেইসব ব্যাপারগুলো ব্লোটর্চের মত পুড়িয়ে দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে যাবে। চোয়াল দুটোকে শক্ত করে ধরে আছে জেদ।

মালিশওলা ডান হাঁটুটা বিষ্টুর কোমরে চেপে ধরে মেরুদণ্ড বরাবর ঘাড় পর্যন্ত দ্রুত ওঠানামা করাতে লাগল। পিস্টনের মত। বার দশেক এইভাবে হাঁটু ব্যবহারের পর মালিশওলা নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতের তালু জোড়া করে বিষ্টুর পিঠে জোড়াতালুর কোদাল চালাল।

এরপর বিষ্টু চিত হবার চেষ্টা করল। পারছিল না, মালিশওলা ঠেলেঠুলে গড়িয়ে দিতেই সে অভীষ্ট লাভ করল। আব্রুরক্ষাকারী গামছাটি ঠিকঠাক করে বিষ্টু গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিল, ”তানপুরো ছাড়।”

মালিশওলা দশ আঙুল দিয়ে বিষ্টুর সারা শরীরের চর্বিগুলো খপাখপ খামচে টেনে টেনে ধরে ছেড়ে দিতে লাগল।

”তবলা বাজা।”

মালিশওলা দশ আঙুল দিয়ে বিষ্টুর গলা থেকে কোমর অবধি ধপাধপ চাঁটাতে শুরু করল। চোখ বুঁজে প্রবল আরামে নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে তার মনে হল, লোকটা নিশ্চয় এখন ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। বিষ্টু তখন খুবই বিরক্ত বোধ করে বলল, ”সারেগামা কর।”

মালিশওলা নির্দেশ পেয়েই আঙুলগুলো দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে লাগল বিষ্টুর সর্বাঙ্গে। আঙুলগুলো শরীরে কিলবিল করায় সুড়সুড়ি লাগছিল এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় চর্বি থলথল করে কেঁপে উঠতেই বিষ্টু শুনল খুকখুক হাসির শব্দ।

চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষ্টু বলল ”এতে হাসির কি আছে, য়্যা?”

সেকেন্ড কুড়ি পর বিষ্টু জবাব শুনল, ”ম্যাসেজ হচ্ছে না সঙ্গীতচর্চা হচ্ছে?”

”যাই হোক না তাতে আপনার কি?”

”ব্লাডপ্রেশারটা মেপেছেন?”

”আপনার দরকার?”

”ব্লাড শু্যগার পরীক্ষা করিয়েছেন? কোলেসটেরল লেভেলটাও দেখেছেন কি?”

‘কে মশাই আপনি, গায়ে পড়ে এত কথা বলছেন। চান করতে এসেছেন, করে চলে যান।”

”তা যাচ্ছি। তবে আপনার হার্টটা বোধহয় আর বেশিদিন এই গন্ধমাদন টানতে পারবে না।”

”কি বললেন!”

বিষ্টু ধর উঠে বসার জন্য প্রথমে কাত হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথাটা তুলল। তারপর দু’হাতে মেঝেয় চাপ দিয়ে উঠে বসল।

লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”অবশ্য হাতি কিংবা হিপোর কখনো করোনারি অ্যাটাক হয়েছে বলে শুনিনি, সুতরাং আমি হয়তো ভুলও বলতে পারি।”

বিষ্টু ধর রাগে কথা বলতে পারছে না, শুধু চোখ দিয়ে কামান দাগতে লাগল। লোকটি পাঞ্জাবি খুলল। লুঙ্গি খুলল। ভিতের হাফ প্যান্ট।

অবশেষে বিষ্টু ধর কোনক্রমে বলল, ”আপনাকে যে কি বলব ভেবে পাচ্ছি না।”

”আমার বৌও ঠিক এই কথাই বলে।”

”আপনি একটা ন্যুইসেন্স।’

”আমার ক্লাবের অনেকে তাই বলে।”

”আপনার মত লোককে চাবকে লাল করা উচিত।”

লোকটি আবার ছেলেমানুষের মত পিটপিট করে তাকাল।

”আচ্ছা, আমি যদি আপনার মাথায় চাঁটি মারি, আপনি দৌড়ে আমায় ধরতে পারবেন?”

কথাগুলো বলেই লোকটি এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছোটার ভঙ্গিতে জগিং শুরু করল। অনেকে তাকাল, অনেকে ভাবল পাগল।

বিষ্টু হতভম্ব হয়ে লোকটির জগ করা দেখতে লাগল। চাঁটি মারার ভঙ্গিতে হাতটা তুলে লোকটি হঠাৎ বিষ্টুর দিকে ছুটে এল। বিষ্টু ডুব দেবার মত মাথাটা নিচু করল। লোকটি হাত তুলে রেখেই পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

”পারবেন ধরতে যদি চাঁটিয়ে যাই? আমার কিন্তু আপনার থেকে অনেক বয়েস।”

জগ করতে করতে লোকটি আবার এগিয়ে আসছে। বিষ্টু ধর বুনো মোষের মত তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল। তাইতে লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নাচের ভঙ্গিতে শরীরটাকে পেন্ডুলামের মত ডাইনে এবং বামে দুলিয়ে তিড়িং তিড়িং লাফালাফি শুরু করল। বিষ্টু থাবার মতো দুটো হাত তুলে অপেক্ষা করছে। দৃশ্যটা অনেককে আকৃষ্ট করল।

”আমি রোজ একসারসাইজ করি। আইসোমেট্রিক, ক্যালিসথেনিক, বারবেল, বুঝলেন রোজ করি। দারুণ খিদে পায়। আপনার পায়?”

বিষ্টু ধর কথা না বলে শুধু ঘোঁৎ’ ধরনের একটা শব্দ করল।

”খিদের মুখে যা পাই তাই অমৃতের মত লাগে, এই সুখ আপনার আছে?”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই লোকটি জগ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে শেষ ধাপ পর্যন্ত গিয়ে আবার উঠে এল।

তিনবার এইভাবে ওঠানামা করে সে বিষ্টু ধরের পাঁচ গজ তফাতে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। হাত দুটো নামিয়ে বিষ্টু তখন খানিকটা দিশাহারার মতই লোকটির কাণ্ড দেখছিল। ওর চোখে এখন রাগের বদলে কৌতূহল। মনে মনে সে ছিপছিপে শরীরটার সঙ্গে নিজের স্থূলত্ব বদলাবদলি করতে শুরু করে দিয়েছে।

”খাওয়ায় আমার লোভ নেই। ডায়টিং করি।” ভারিক্কি চালে বিষ্টু ধর ঘোষণা করল এবং গলার স্বরে বোঝা গেল এর জন্য সে গর্বিত।

লোকটি দু’পা এগিয়ে এসে বলল, ”কি রকম ডায়টিং!”

”আগে রোজ আধ কিলো ক্ষীর খেতুম, এখন তিনশো গ্রাম খাই; জলখাবারে কুড়িটা নুচি খেতুম এখন পনেরোটা; ভাত খাই মেপে আড়াইশো গ্রাম চালের, রাতে রুটি বারোখানা। ঘি খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, গরম ভাতের সঙ্গে চার চামচের একবিন্দুও বেশি নয়। বিকেলে দু’ গ্লাস মিছরির সরবত আর চারটে কড়াপাক। মাছ—মাংস ছুঁই না, বাড়িতে রাধাগোবিন্দ বিগ্রহ আছে। আর হপ্তায় একদিন ম্যাসেজ করাই এখানে এসে। আমার অত নোলা নেই, বুঝলেন, সংযম কেচ্ছাসাধন আমি পারি। হাটের ব্যামো—ফ্যামো আমার হবে না, বংশের কারো হয়নি। বাজি ফেলে সত্তরটা ফুলুরি খেয়ে কলেরায় বাবা মারা গেছে, জ্যাঠা গেছে অম্বলে।”

”এত কেচ্ছাসাধন করেন! বাঁচবেন কি করে?”

লোকটি এগিয়ে এসে বিষ্টু ধরের ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিল।

”আঃ, সুড়সুড়ি লাগে,” বিষ্টু হাতটা সরিয়ে দিয়ে ক্ষুণ্ণস্বরে বলল, ”আমার বৌও ওই কথা বলে। সকাল থেকে রাত অবধি ব্যবসা দেখি। সর্ষে, চিনি, ডাল নানান জিনিসের কারবার। এত খাটুনির পর এইটুকু খাদ্য! তারপর এই অপমান।”

”কে করল?”

লোকটি আবার হাত বাড়াতেই বিষ্টু একপা পিছিয়ে বলল, ”না, সুড়সুড়ি লাগে।”

”কে অপমান করল?”

”কেন, আপনি হাতি—হিপো বললেন না! জলহস্তির ইংরিজি হিপো তা কি আমি জানি না, আমি কি অশিক্ষিত?”

”না না, আমি আপনাকে অশিক্ষিত তো বলিনি।” লোকটি বিব্রত হয়ে চশমা মুছতে মুছতে বলল, ”আপনার ওজনটা খুব বিপজ্জনক হার্টের পক্ষে।”

”বিপজ্জনক মানে?” বিষ্টু ধর তাচ্ছিল্য প্রকাশের চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত স্বর। ”আমি কি মরে যেতে পারি!”

”তা পারেন। আর নয়তো কেচ্ছসাধনের কষ্ট করতে করতে, রোগে ভুগে ভুগে বেঁচে থাকবেন কয়েকটা বছর।”

বলেই লোকটি দু’ হাত তুলে সামনে ঝুঁকে পিঠটা ধনুকের মত বেঁকাল। হাতের আঙ্গুল পায়ে ছুঁইয়ে আবার সিধে হল।

”আপনি আমার থেকে চার হাজার গুণ বড়লোক, কিন্তু চার লক্ষ টাকা খরচ করেও আপনি নিজের শরীরটাকে চাকর বানাতে পারবেন না।”

”কি রকম! কি রকম!”

লোকটি তার ডান কনুই শরীরে লাগিয়ে পিস্তল ধরার মত হাতটা সামনে বাড়াল।

”এইবার আমার হাতটা নামান তো।”

অবিশ্বাসভরে বিষ্টু ধর হাতটার দিকে তাকাল। শিরা উপশিরা গাঁট সমেত হাতটাকে শুকনো শিকড়ের মত দেখাচ্ছে।

”নামান নামান।”

ফুলো ফুলো আঙুল দিয়ে বিষ্টু লোকটার কব্জি চেপে ধরে নিচের দিকে চাপ দিল। নড়ল না এক সেন্টিমিটারও। ঠোঁট কামড়ে বিষ্টু জোরে চাপ দিল। হাতটা একই জায়গায় রয়েছে। বিষ্টু এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করল। কপালে ঘাম ফুটছে। কিছু লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। তাদের চোখে বিস্ময়, লোকটার সাফল্যে না বিষ্টুর ব্যর্থতায় বোঝা যায় না। বিষ্টু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে পাতলা হাসি আর চোখ পিটপিটানি দেখতে পেল। হাতটা সে নিচে নামাতে পারছে না। বিষ্টু হাল ছেড়ে দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল।

”কি করে পারলেন!”

”জোরে বলতে শুধু গায়ের জোরই বোঝায় না। মনের জোরেই সব হয়। ইচ্ছা শক্তি দিয়ে শরীরের দুর্বলতা ঢাকা দেওয়া যায়। শরীর যতটা করতে পারে ভাবে, তার থেকেও শরীরকে দিয়ে বেশি করাতে পারে ইচ্ছার জোর। সেজন্য শুধু শরীর গড়লেই হয় না, মনকেও গড়তে হয়। শরীরকে হুকুম দিয়ে মন কাজ করাবে। আপনার মন হুকুম করতে জানে না তাই শরীর পারল না।”

বিষ্টু ধর বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, ”ইচ্ছে করে, খুব রোগা হয়ে যাই।”

ঠিক এই সময়ই গঙ্গার তীর থেকে তীক্ষ্ন চীৎকার ভেসে এল, ”কো ও ও ও… নি ই ই ই। কো ও ও ও……নি ই ই ই”

লোকটি গঙ্গার দিকে তাকাল।

।। ২।।

গঙ্গায় একটা আম ভেসে চলেছে ভাঁটার টানে। তিনজন সাঁতরাচ্ছে সেটাকে পাবার জন্য। কোমর জলে দাঁড়িয়ে দু—তিনটি বছর চৌদ্দ—পনেরোর ছেলে জল থাবড়ে হৈচৈ করে ওদের তাতিয়ে তুলছে। সমানে—সমানে ওরা যাচ্ছে। মাথা তিনটে দু’ধারে নাড়াতে নাড়াতে, কনুই না ভেঙে সোজা হাত বৈঠার মত চালিয়ে ওরা আমটাকে তাড়া করেছে।

হঠাৎ ওদের একজন একটু একটু করে এগিয়ে যেতে শুরু করল, অন্য দু’জনকে পিছনে ফেলে। তখনই চীৎকার উঠল—”কো ও ও ও….নি ই ই। কো ও ও ও…নি ই ই ই।” পিছিয়ে পড়া দু’জনও গতি বাড়াল।

আমটা প্রায় প্রথম ছেলেটির মুঠোয় এসে গেছে। হঠাৎ সে থমকে গেল। হাত ছুঁড়ছে কিন্তু এগোল না। বার দুয়েক তার মাথাটা জলে ডুবল। তারপর সে রাগে চীৎকার করে ঘুরে গিয়ে লাথি ছুঁড়ল।

ততক্ষণে পিছন থেকে একজন ওকে অতিক্রম করে আমটা ধরে ফেলেছে।

”পা টেনে ধরেছিল।” বিষ্টু ধর বলল।

লোকটি হেসে চশমাটা খুলে ঝোলায় রাখল। ঘাটের বাইরের দিকে সেখানে কয়েকজন উড়িয়া ব্রাহ্মণদের একজনের কাছে ঝোলাটা রেখে এসে, লোকটি অতি সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। চশমা ছাড়া মনে হচ্ছে, লোকটি যেন অন্ধ।

জলের কিনারে কাদার উপর তখন মারামারি হচ্ছে, একজনের সঙ্গে দু’জনের। কাদা ছিটকোচ্ছে। লোকেরা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে সরে গেল। দু’—তিনটি ছেলে ওদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।

”ঠিক হ্যায়, চালা, আরো জোরে।”

পা থেকে মাথার চুল কাদায় লেপা কঞ্চির মত সরু চেহারাটা তার লম্বা হাত দুটো এলোপাথাড়ি ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। অন্য দুজন সেই বিপজ্জনক বৃত্তের বাইরে কুঁজো হয়ে তাক খুঁজছে।

”ফাইট কোনি ফাইট। চালিয়ে যা বক্সিং।”

দু’জনের একজন পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। পড়ে গেল দু’জনেই।

”অ্যাই অ্যাই ভাদু চুল টানবি বা কোনির। তাহলে কিন্তু আমরা আর চুপ করে থাকব না।”

কোনির পিঠের ওপর বসা ভাদু, চুল ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে কোনির মাথা ধরে, কাদায় মুখটা ঘষে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। কোনি পা ছুঁড়ল।

কোমরে চাড় দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করল। তারপর ঝটকা দিয়ে ভাদুর ডান হাতটা মুখের কাছে টেনে নিয়ে এসে কামড়ে ধরল দুটো আঙুল।

চীৎকার করে ভাদু লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কোনি উঠে দাঁড়িয়ে ভাদুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

”খুবলে নোব তোর চোখ, বার কর আম। আমাকে চোবানো! পুঁতে রাখব তোকে এই গঙ্গামাটিতে। হয় আম দিবি নয় চোখ নোব।”

দু’হাতের দশটা আঙুল ঈগলের নখের মত বেঁকিয়ে চিত হয়ে পড়া ভাদুর চোখের সামনে কোনি এগিয়ে আনতেই, দু’টি ছেলে ওকে ঠেলে সরিয়ে আনল।

”ছেড়ে দে চন্ডু, হাত ছাড় কান্তি। শোধ নিয়ে ছাড়ব। আমাকে চোবানো?”

কোনির ঠোঁটের কোণে ফেনা, সামনের দাঁত হিংস্রভাবে বেরিয়ে রয়েছে। হিলহিলে লম্বা দেহটা সামনে—পিছনে দুলছে কেউটের ফণার মত।

”এই ভাদু, ও আম কোনির। বার করে দে। নয়তো সত্যিই চোখ তুলে নেবে কিন্তু!”

ভাদু ডান হাতটা চোখের সামনে ধরে দেখছিল। শিউরে উঠে বলল, ”রক্ত বেরোচ্ছে! দাঁত বসিয়ে গত্তো করে দিয়েছে।”

কোনির হাত ছেড়ে দিয়ে কান্তি এগিয়ে এসে ভাদুর প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল। কয়েকটা কাঁচা আম বার করে, বড়টি বেছে নিয়ে কোনির দিকে ছুঁড়ে দিল।

লুফে নিয়েই কোনি কামড় বসাল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত মুখে বলল, ”কি টক রে বাবা। মা গঙ্গাকে এমন আমও খেতে দেয়!”

আমটা জলে ছুঁড়ে দিয়ে সে মুখ থেকে ছিবড়ে ফেলতে ফেলতে ভাদুর কাছে এল।

”দেখি তো কেমন গত্তো হয়েছে।”

খপ করে ভাদুর হাতটা ধরে সে ভ্রূ কুঁচকে আঙুলটা তুলে দেখল।

”ভাগ, কিছছু হয়নি। নাম নাম জলে নাম। যেমন কাজ করেছিস তেমনি ফল পেয়েছিস। আমাকে রাগালে কি হয়, এবার বুঝলি তো।”

কয়েকটি ডুব দিয়ে লোকটি কোমরজলে দাঁড়িয়ে গামছা ঘষছিল পিঠে। কানে এল পাশের এক বৃদ্ধের আপনমনের গজগজানি।

”জ্বালিয়ে মারে হতভাগারা। গঙ্গার ঘাটটাকে নোংরা করে রেখেছে হাঘরে হাভাতের দল। মা গঙ্গাকে উচ্ছুগ্গো করা আমই রাস্তায় বসে বেচবে। জুটেছে আবার এক মেয়েমদ্দানী বাপ—মাও কিছু বলে না।”

লোকটি আবার ডুব দিতে যাচ্ছিল, থেমে গিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল।

”মেয়েমদ্দানীটা কে!”

”কে আবার, দেখতে পাননি, চোখ তো একজোড়া রয়েছে।”

লোকটি মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। চশমাছাড়া ঝাপসাভাবে দেখল, ভাদুর হাত ধরে কোনি টানাটানি করছে। কাদামাখা কোনির মধ্য দিয়ে এক একবার একটি মেয়ে ফুটে ফুটে উঠছে যেন। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা কাদামাখা চুল মাথায় বসে। প্যান্টে গোঁজা গেঞ্জী শরীরের সঙ্গে লেপটে দ্বিতীয় পরত চামড়া হয়ে আছে। দীর্ঘ সরু দেহ। সরু পা, সরু হাত। লোকটি ঠাওর করতে পারছে না, কোনি ছেলে কি মেয়ে।

দুটো ঢেউ পর পর লোকটিকে ধাক্কা দিল। বিষ্টু ধর জলে নেমেছে।

”আচ্ছা শরীরটাকে চাকর বানানো, সেটা কি ব্যাপার?”

”সোজা ব্যাপার। লোহা চিবিয়ে খেয়ে হুকুম করবেন হজম করো, পাকস্থলী হজম করবে। বলবেন পাঁচ মাইল হাঁটিয়ে নিয়ে চলো, পা জোড়া অমনি পৌঁছিয়ে দেবে। সখ হল গাছের ডাল ধরে ঝুলবেন, হাত দুটো আপনাকে ঝুলিয়ে রেখে দেবে। এইসব আর কি।”

লোকটি জল থেকে উঠে আলতোভাবে মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে সিঁড়িতে দাঁড়াল। ভিজে গামছাটা নিংড়ে পায়ে লাগা মাটি ধুয়ে গঙ্গার দিকে তাকাল। ঝাপসাভাবে দেখল, পাড়ের কাছে জলে কিলবিল করছে মানুষ। তার মধ্যে কোনিকে চিনে নেওয়া সম্ভব হল না।

লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে, ঝোলা কাঁধে চশমা মুছতে মুছতে লোকটি একবার সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াল, চশমা চোখে দিয়ে পাড়ের ডাইনে—বাঁয়ে তাকাল, হঠাৎ নজরে এল গঙ্গার বুকে চারটি কালো ফুটকি। তারা সিকি গঙ্গা পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

লোকটি আপনমনে একবার বলল : ”কোনি। কো ও ও নি।”

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভিজে গামছাটি পাগড়ির মত মাথায় জড়িয়ে লোকটি বাড়ির পথে রওনা হল।

মিনিট পনেরো পর, সরু গলির মধ্যে একতলা টালির চালের একটি বাড়িতে লোকটি ঢুকলো। সদর দরজার পরই মাটির উঠোন। টেনেটুনে একটি ভলিবল কোর্ট তাতে হয়ে যায়। লঙ্কা, পেঁপে, জবা থেকে চালকুমড়ো পর্যন্ত উঠোনটা নানান গাছে দখল হয়ে আছে। একদিকে টিনের চালের রান্নাঘর ও কলঘর আর একদিকে দালান ও তার পিছনে দুটি ঘর। একতলা বাড়িটি চারদিকের উঁচু বাড়িগুলোর মধ্যে খুব শান্তভাবে যেন উবু হয়ে বসে। উত্তর দিকের বাড়ির মালিক হলধর বর্ধন এই একতলা বাড়িটি কেনার জন্য বার দুয়েক প্রস্তাব করেছে, কিন্তু লোকটি সংসারে যার স্ত্রী এবং দুটি বিড়াল ছাড়া আর কেউ নেই, বিনীতভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করে।

বাড়ির কলে জল আসে সামান্য। লোকটির স্ত্রী নাম লীলাবতী। জল খরচ করাটা লীলাবতীর সখ, বিড়াল পোষার মতই। ফলে লোকটিকে স্নান করার জন্য প্রায়ই রাস্তার টিউবওয়েলটির সাহায্য নিতে হয়। আজ সকাল থেকে টিউবওয়েলের মুখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে না। তাই বহুকাল পর সে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল।

লোকটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে উঠোনে টানানো তারে ভিজে প্যান্টটা মেলেছে, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল ঢলঢলে প্যান্ট পরা বেঁটে, হৃষ্টপুষ্ট একজন।

”’ক্ষিদ্দা, তোমার জন্য অনেকক্ষণ বসে আছি, আর বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। দোকান থেকে কে বৌদিকে ডাকতে এসেছিল, ‘আসছি’ বলে সেই যে গেছে—”

”ভেলো, চটপট একটু চা বানা দেখি।”

”বৌদি যদি এসে পড়ে!”

ক্ষিদ্দা অর্থাৎ ক্ষিতীশ সিংহ কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, ”তাহলে থাক, বরং তুই কি জন্যে এসেছিস বল?”

”ক্লাবের আজকের মিটিংয়ে যাবে নাকি?”

”নিশ্চয় যাব ছেলেরা খাটবে না, ডিসিপ্লিন মানবে না, জলে নেমে শুধু ইয়ারকি ফাজলামো করবে। এসব ছেলেদের ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে বলাটা কি এমন দোষের! একজনও কি তাই নিয়ে কিছু ভাবে? আর ক্ষিতীশ সিঙ্গি কি বলল অমনি তাই নিয়ে কাউনসিলের মিটিং ডাকা হল।”

”সেজন্য তো নয়, আসলে হরিচরণদা আর তার গ্রুপটার রাগ আছে তোমার ওপর। ওরাই শ্যামল আর গোবিন্দকে উসকে তোমার এগেনস্টে চার্য আনিয়েছে।”

”আমি তা জানি। হরিচরণের বহুদিনের ইচ্ছে চিফ ট্রেনার হওয়ার। আমাকে বলেওছিল গত বছর। আমি বলেছিলুম, হরি, একটা চ্যামপিয়ন শুধু খাওয়া—দাওয়া আর ট্রেনিং দিয়েই তৈরী করা যায় না রে। তার মন—মেজাজ বুঝে তাকে চালাতে হয়। ট্রেনারকে মনস্তাত্ত্বিক হতে হবে, তার মানে কমনসেন্স প্রয়োগ করতে হবে। গুরুকে শ্রদ্ধেয় হতে হবে শিষ্যের কাছে। কথা কাজ, উদাহরণ দিয়ে মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা বাসনা জাগিয়ে তুলতে হবে। তাকে মোটিভেট করতে হবে। এসব তোর দ্বারা সম্ভব নয়। তুই শুধু চেঁচামেচি গালাগালি করেই খাটাতে চাস, চিফ ট্রেনার হওয়া তোর কম্মো নয়।”

”ক্ষিদ্দা, তোমার এই লেকচার দেবার বদ অব্যেসটা ছাড়ো। এককথায় যেখানে কাজ হয়, তুমি সেখানে দশ কথা বলো। হরিচরণদাকে অত কথা বলার কি দরকার ছিল। যাকগে, আজ তুমি মিটিংয়ে যেও না, ওরা ঠিক করেছে তোমাকে অপমান করবে।”

”করে করবে।” এই বলে ক্ষিতীশ তার পায়ে মাথা ঘষায় ব্যস্ত বিশুকে কোলে তুলে গলা চুলকে দিতে লাগল। চোখ বুঁজে বিশু ঘরর ঘরর শুরু করল।

”তাহলে যাবেই!” নেমে যাওয়া প্যান্ট এবং কণ্ঠস্বর হ্যাঁচকা দিয়ে টেনে তুলে ভেলো বলল।

ক্ষিতীশ ঘরের দিকে যেতে যেতে অস্ফুটে বলল, ”হুঁ।”

তখনই বাড়িতে ঢুকল লীলাবতী সিংহ। অতি ছোট্টখাট্ট, গৌরবর্ণা এবং গম্ভীর। পায়ে চটি, হাতে ছাতা। দু’জনের দিকে তাকিয়ে অবশেষে ভেলোকে বলল, ”বেলা অনেক হয়েছে, চাট্টি ভাত খেয়ে যেও।”

ভেলোর হঠাৎ যেন কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল। ঘড়ি দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল, ”না না বৌদি, ইসস বড্ড দেরী হয়ে গেল। বাড়িতে ভাত নিয়ে বসে আছে। আমি এখন যাই। ক্ষিদ্দা, তোমার কিন্তু না গেলেই ভাল।”

ভেলো চলে যেতেই লীলাবতী প্রশ্ন করল ক্ষিতীশকে ”না গেলেই ভাল মানে?”

”আজ ক্লাবের একটা মিটিং আছে। ও বলছে সেখানে আমাকে নাকি কেউ কেউ অপমান করবে যাতে ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে যাই।”

”তাহলে তো ভালই হয়। ক্লাব—ক্লাব করে তো কোনদিন ব্যবসা দেখলে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকেই কিনা দোকান দেখতে হয়। নেহাত ছেলেপুলে নেই তাই। যদি ক্লাব তোমায় তাড়ায় তাহলে আমি বেঁচে যাই।”

লীলাবতী রান্নাঘরে ঢুকল। ক্ষিতীশ বিষণ্ণ চোখে দালানে বসে বিশুর মাথায় আনমনে হাত বোলাতে লাগল। এই সময় খুশি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডন দিয়ে, হাই তুলে ধীরে ধীরে সে চামরের মত কালো লেজটি উঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল ক্ষিতীশের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে।

”কই এসো।” রান্নাঘর থেকে ডাক এল।

ক্ষিতীশ অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে গিয়ে ভাত খেতে বসল।

খাওয়ার আয়োজন সামান্য। রান্না হয় কুকারে। প্রায় সবই সিদ্ধ। এটা খরচ, সময় ও শ্রম সংক্ষেপের জন্য নয়। ক্ষিতীশ বিশ্বাস করে, বাঙালিয়ানা রান্নায় স্বাস্থ্য রাখা চলে না। এতে পেটের বারোটা বাজিয়ে দেয়। সেইজন্যই বাঙালীরা শরীরে তাগদ পায় না, কোন খেলাতেই বেশি উঁচুতে উঠতে পারে না। খাদ্যপ্রাণ যথাসম্ভব অটুট থাকে সিদ্ধ করে খেলে এবং সর্বাধিক প্রোটিন ও ভিটামিন পাওয়া যায় এমন খাদ্যই খাওয়া উচিত।

প্রথম দিকে লীলাবতী বিদ্রোহী হয়েছিল, সরষে বাটা, শুকনো লঙ্কাবাটা, পাঁচফোড়ন, জিরে, ধনে প্রভৃতি বস্তুগুলি রান্নায় ব্যবহারের সুযোগ হারিয়ে। তুমুল ঝগড়া এবং তিনদিন অনশন সত্যাগ্রহেও কাজ হয়নি। ক্ষিতীশ তার সিদ্ধান্তে গোঁয়ারের মত অটল থাকে। তার এক কথা : ‘শরীরের নাম মহাশয় যা সহাবে তাই সয়।” অবশেষে লীলাবতী সপ্তাহে একদিন সরষে ও লঙ্কাবাটা ব্যবহারের অনুমতি পায়, শুধুমাত্র নিজের খাবারের জন্য। ক্ষিতীশ কখনো যজ্ঞিবাড়ির নিমন্ত্রণে যায় না। ক্লাবের ছেলেমেয়েদের সে প্রায়ই শোনায়: ‘ডাক্তার রায় বলতেন, বিয়ে বাড়ির এক একটা নেমন্তন্ন খাওয়া মানে এক এক বছরের আয়ু কমে যাওয়া। বড় খাঁটি কথা বলে গেছেন।’

ক্ষিতীশ কথা না বলে খাওয়া শেষ করল।

ও যে রাগ করেছে লীলাবতী বুঝতে পেরেছে। বলল, ”ক্লাব থেকে তাড়াবে কেন? কি দোষ করলে?”

ক্ষিতীশ পাল্টা প্রশ্ন করল, ”তুমি এখন আবার দোকানে গেছলে কেন?”

গ্রে স্ট্রিটে ট্রামলাইন ঘেঁষে একফালি ঘরে দোকানটি। নাম ‘প্রজাপতি’। আগে নাম ছিল ‘সিনহা টেলারিং’। দুটি দর্জিতে জামা—প্যান্ট তৈরী করত, আর দেয়াল আলমারিতে ছিল কিছু সিন্থেটিক কাপড়। ক্ষিতীশ তখন দোকান চালাত। দিনে দুঘণ্টাও দোকানে বসত না। দুপুর বাদে তাকে সর্বদাই পাওয়া যেত জুপিটার সুইমিং ক্লাবে। তারপর একদিন সে আবিষ্কার করল আলমারির কাপড় অর্ধেকেরও বেশি অদৃশ্য হয়েছে, দোকানের ভাড়া চার মাস বাকি এবং লাভের বদলে লোকসান শুরু হয়েছে।

তখনই লীলাবতী হস্তক্ষেপ করে, দোকানের দায়িত্ব নেয়। টেলারিং ডিপ্লোমা পাওয়া দুটি মহিলাকে নিয়ে সে দোকানটিকে ঢেলে সাজায় নিজের গহনা বাঁধা দিয়ে। নাম দেয় ‘প্রজাপতি’। পুরুষদের পোশাক তৈরী বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র মেয়েদের এবং বাচ্চচাদের পোশাক তৈরী করে। দোকানে পুরুষ কর্মচারী নেই এবং চার বছরের মধ্যেই ‘প্রজাপতি’ ডানা মেলে দিয়েছে। আগে তিনদিনে ব্লাউজ তৈরী করে দেওয়া হত, এখন দশদিনের আগে সম্ভব হচ্ছে না। লীলাবতী তার গহনাগুলির অর্ধেকই ফিরিয়ে এনেছে।

”এখন তো আর জায়গায় কুলোয় না, তাই বড় ঘর খুঁজছি। হাতিবাগানের মোড়ে একটা খোঁজ পাওয়া গেছে। আমাদেরই এক খদ্দেরের বাড়ি। বাড়ির গিন্নি এসেছিল মেয়ের ফ্রক করাতে। তাই গেছলুম কথা বলতে।” লীলাবতী এঁটো থালাটা টেনে নিয়ে তাতে ভাত বেড়ে, ডাল মাখতে মাখতে বলল।

ক্ষিতীশের প্রবল আপত্তি ছিল তার খাওয়া থালায় লীলাবতীর ভাত খাওয়ায়। ‘আনহাইজীনিক। এইসব কুসংস্কারেই বাঙালী জাতটা গোল্লায় গেল।’ এই বলে ক্ষিতীশ তর্ক শুরু করেছিল। কিন্তু লীলাবতী যখন অতিরিক্ত ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘এটা আমার ব্যাপার, মাথা ঘামিও না।’ তখন মুহূর্তে বুঝে যায় আর কথা বাড়ালে তাকেই গোল্লায় যেতে হবে। তবে ক্ষিতীশ তার প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। লীলবতীর খাওয়ার সময় তাই কখনোই সে সামনে থাকে না।

শোবার ঘরের দেয়ালে ক্ষিতিশের বাবা—মা, ধ্যানমগ্ন মহাদেব, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণ এবং ম্যাগাজিন থেকে কেটে বাঁধানো মেডেল গলায় ডন শোলান্ডার ও ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দু’হাত তুলে দাঁড়ানো ডন ফ্রেজারের ছবি, পাশাপাশি টাঙানো। এ ছাড়া আছে—সাধারণত যা থাকে—খাট, আলমারি, বাক্স, আলনা এবং টুকিটাকি সাংসারিক জিনিস। পাশের ঘরে বই, ম্যাগাজিন, একটা তক্তপোশ এবং তার নীচে ট্রেনিংয়ের জন্য রবারের দড়ি, স্প্রিং, লোহা ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঘরে ক্ষিতীশ দুপুরে এক ঘণ্টা ঘুমোয়। পাখা নেই, বিছানা নেই। ওর মতে, চ্যামপিয়ন হতে গেলে শুধু শিষ্যকেই নয়, গুরুকেও কঠোর জীবন যাপন করতে হবে। অবশ্য তার কোন শিষ্য নেই।

তক্তপোশে শুয়ে চোখ বুঁজে ক্ষিতীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিষ্য কোথায়!

ঘুম আসার ঠিক আগের মুহূর্তে, ক্ষিতীশের আবছায়া চেতনায় ফুটে উঠল লম্বা দুটো হাত বৈঠার মত গঙ্গার জলে উঠছে আর পড়ছে।

মিলিয়ে গিয়ে নতুন আর একটি ছবি সে দেখল। ফণা তোলা কেউটের মত হিলহিলে কাদায় লেপা, সরু একটা দেহ। লম্বা লম্বা হাত এলোপাথাড়ি ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। ‘ফাইট’ কোনি, ফাইট।’

ঘুমিয়ে পড়ার আগে ক্ষিতীশ অকারণেই অস্ফুটে উচ্চচারণ করল, ”কো ও ও নি।”

সম্ভবত নামটা তার ভাল লেগেছে।

।। ৩ ।।

টেবল টেনিস বোর্ডটায় কাপড় বিছিয়ে টেবল। সেটা ঘিরে সাত জন বসে। তার মধ্যে একটি চেয়ার খালি। ওরা চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ঘরের বাইরে কয়েকটি ছেলে, কার যেন প্রতীক্ষায়।

জুপিটার সুইমিং ক্লাবের নতুন প্রেসিডেন্ট এবং এম এল এ বিনোদ ভড়, ডানদিকে ঝুঁকে সম্পাদক ধীরেন ঘোষকে বলল, ”একটাই অ্যাজেন্ডা, না আরো আছে?”

ধীরেন ঘোষ তার সরু গলাটি যথাসম্ভব লম্বা করে চশমার নীচের অংশের প্লাস পাওয়ারের মধ্য দিয়ে টেবলে রাখা কাগজের দিকে তাকাল।

”মেন আইটেম একটাই, আর যা আছে তা খুবই মাইনর।”

”কোরাম হয়েছে তো?”

”হ্যাঁ, সবাই হাজির।” ধীরেন ঘোষ এরপর ব্যস্ত হয়ে বলল, ”জগু, চা—সন্দেশ দিতে বল।”

যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে মাত্র, তখনই দরজাটা খুলে গেল। ক্ষিতীশ সিংহ ঘরের প্রতিটি লোকের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে প্রেসিডেন্টের মুখোমুখি খালি চেয়ারটায় বসার আগে সভাকে নমস্কার জানাল।

জগু জিজ্ঞাসু চোখে ধীরেন ঘোষের দিকে তাকাল, মাথা হেলিয়ে ধীরেন ঘোষ বলল, ”একটু পরে আনবি।”

”আমার দেরী হয়ে গেল।” ক্ষিতীশ ফিকে হেসে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল।

”না না, মিনিট চারেক মাত্র দেরী হয়েছে।” বিনোদ ভড় ঘড়ি দেখে ধীরেন ঘোষকে বলল, ”আমার কিন্তু একটু তাড়া আছে।”

”নিশ্চয়, নিশ্চয়, এখুনি শুরু করছি। বেশিক্ষণ লাগার মত কিছুই নেই, শুধু সুইমারদের চিঠিটা ছাড়া। আর সেটা আগেই সারকুলেট করা হয়েছে, সুতরাং নতুন করে বলার কিছু নেই।”

”হ্যাঁ আছে।”

সবাই ক্ষিতীশের দিকে তাকাল।

”আমার বিরুদ্ধে চার্জগুলো স্পষ্ট করে চিঠিতে বলা নেই। সেগুলো জানতে চাই।”

সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।

বিনোদ ভড় বলল, ”ধীরেনবাবু, ওর বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছে সেগুলো তাহলে বলুন।”

ধীরেন ঘোষ বিব্রতভাবে হরিচরণ মিত্তিরের দিকে তাকাল, হরিচরণ নড়ে—চড়ে বসল।

”ক্ষিদ্দা সম্পর্কে অভিযোগ ছেলেদের, মানে সুইমারদের। যারা সাত বছর, আট বছর আমাদের ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নামছে, মেডেল আনছে। মানে, আমাদের মুখোজ্জ্বল করছে।”

”বাজে কথা।” ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল, ”মেডেল হয়তো আনে কিন্তু মুখোজ্জ্বল করার মত কিছুই করেনি। শ্যামল চার বছর আগে এক মিনিট চার সেকেন্ডে হানড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল টানতো, এখনো তাই টানে। এটা কি মুখোজ্জ্বল করার মতো ব্যাপার?”

হরিচরণ কথাগুলো না শোনার ভান করে বলতে লাগল, ”এইসব সুইমাররাই হচ্ছে ক্লাবের প্রাণ। এদের নিয়েই ক্লাব টিকে আছে। এগিয়ে চলেছে। এরা উচ্ছ্বল, এরা চঞ্চল। এদের হ্যান্ডেল করতে হলে এদের মত হয়ে এদের সঙ্গে মিশতে হবে, বুঝতে হবে, আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হবে।”

”তার মানে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারবে, পড়াশুনো করবে না, ট্রেনিং করবে না—একে উচ্ছলতা বলে মানতে হবে! এদের সঙ্গে তাল রেখে আমাকে আধুনিক হতে হবে, তবেই এদের হ্যান্ডেল করা যাবে?”

”কিন্তু ওদের মন—মেজাজ বোঝার ক্ষমতা, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ক্ষিদ্দার নেই।”

হরিচরণ সকলের মুখের দিকে তাকাল। তিন—চারটি মাথা নড়ে উঠল এক সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে। ক্ষিতীশের চোখ পিটপিট করতে লাগল, পুরু লেন্সের ওধারে।

”ক্ষিদ্দা জুনিয়ার ছেলেদের সামনেই শ্যামলকে তার টাইম আর আমেরিকার ১২ বছরের মেয়েদের টাইমের তুলনা করে অপমান করেছেন; গোবিন্দ এখনো ব্রেস্ট স্ট্রোকে বেঙ্গল রেকর্ড হোল্ড করছে, লাস্ট ইয়ারেও বোমবাই ন্যাশনালে গেছল, তাকে বলেছেন কান ধরে ক্লাব থেকে বার করে দেবে। সুহাস ইনফ্লুয়েঞ্জায় পড়ে দিন দশেক আসতে পারেনি। তার বাড়িতে গিয়ে ক্ষিদ্দা সুহাসের বাবাকে যা তা কথা বলে এসেছেন। অমিয়া আর বেলা জুপিটার ছেড়ে অ্যাপোলোয় গেছে শুধুই ক্ষিদ্দার জন্য। উনি ওদের চুল কাটতে চেয়েছিলেন। পুরুষদের মত ওদেরও বারবেল নিয়ে একসারসাইজ করার জন্য ঝগড়া করতেন। ওদের ড্রেস, ওদের সাজ নিয়ে রোজই খিটখিট করতেন। লাস্ট ইয়ারে আপনারা দেখেছেন, ওই দুটি মেয়ের জন্যই স্টেট মিটে অ্যাপোলো টিম চ্যাম্পিয়নশিপ পায়।”

হরিচরণ থামল। ক্ষিতীশের দিকে এতক্ষণ সে তাকায়নি। দেখল মুচকি মুচকি হাসছে। তাইতে সে অস্বস্তি বোধ করে ধীরেন ঘোষ, প্রফুল্ল বসাক এবং বদু চাটুজ্জের মুখের দিকে তাকাল।

নস্যির কৌটো বার করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে বদু চ্যাটুজ্জে সিধে হয়ে বসল।

”প্রেসিডেন্ট স্যার, আমার একটা কথা বলার আছে। ট্রেনার যে হবে তার উপর ছেলেদের বা মেয়েদের শ্রদ্ধা থাকা চাই, আস্থা থাকা চাই। সে যেটা বলবে ওরা যেন নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজে সেটা করতে পারে। কিন্তু ক্ষিতীশ ওদের যা বলে সেটা ওরা বিশ্বাসভরে নিতে পারে কি?”

বদু চাটুজ্জে নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য কথা থামিয়ে রুমাল বার করল। নাক মুছল গভীর মনোযোগে। রুমাল পকেটে রাখল।

”ক্ষিতীশ নিজে কখনো সাঁতার কাটেনি। কমপিটিশনে কখনো নেমেছে বলে জানি না। ওর কথা ছেলেমেয়েরা কেন গ্রাহ্য করবে?”

”সে কি!” প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় অবাক হয়ে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। ”আপনি সাঁতার জানেন না?”

ক্ষিতীশ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”সাঁতার জানি না বলতে বদু নিশ্চয় মিন করছে, আমি কখনো কোন কমপিটিশনে মেডেল পাইনি। তাই না?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তাই—ই বলছি।” ব্যস্ত হয়ে বদু বলল। ”কোচের রেপ্যুটেশন থাকা দরকার। নয়তো ছেলেমেয়েরা মানবে কেন? হরিচরণকে ওরা মানে কেন? ইন্ডিয়া চ্যামপিয়ান ছিল, অলিম্পিকেও গেছে। গঙ্গায় ১৩ মাইলের কমপিটিশন পর পর তিনবার জিতেছে।”

”আপনি ওলিম্পিকে গেছলেন!” বিনোদ ভড়ের বিস্মিত ভ্রূ কপাল বেয়ে চুলে গিয়ে ঠেকল।

কিঞ্চিৎ গদগদ স্বরে হরিচরণ বলল, ”লণ্ডনে ফরটি এইট ওলিম্পিকে আমি দেড় হাজার মিটারে ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করেছি। ওয়াটারপোলো টিমেও ছিলুম।”

”কি রেজাল্ট করেছিলেন?” প্রেসিডেন্ট ঝুঁকে পড়ল টেবলে।

হরিচরণ দ্রুত সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ঢোঁক গিলে বলল, ”পয়েন্ট ফাইভ সেকেণ্ডের জন্য ব্রোনজটা মিস করেছি।”

হঠাৎ বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল ক্ষিতীশ। সবাই তার দিকে তাকাল।

কাশি থামিয়ে ক্ষিতীশ বলল, ”আই অ্যাম সরি। মাঝে মাঝে আমার এরকম হয়।”

প্রেসিডেন্ট বিরক্ত চোখ দুটো সরিয়ে নিয়ে আবার রাখল হরিচরণের মুখে।

”গোল্ড পেয়েছিল আমেরিকার ম্যাকলেন। জল থেকে উঠে আমায় বলেছিল, তুমি পাশে ছিলে তাই এত ভাল চার্জ পেয়েছি।”

”বটে বটে, তা আপনি কি বললেন?”

”আমি আর কি বলব, ওকে কনগ্র্যাচুলেট করে বললুম, ইন্ডিয়াতে যে টাইম করে এসেছি সেটা যদি আজ করতে পারতুম তাহলে…”

হরিচরণ থেমে গেল।

খুক খুক একটা শব্দ হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বিরক্ত হয়ে বলল, ”আবার আপনি কাশছেন? নিশ্চয় আপনার কাশির অসুখ আছে।”

ক্ষিতীশ মুখ নীচু করে ফিসফিসিয়ে বলল, ”হরি, গোল্ড না সিলভার, তাহলে কোনটা হত?”

হরিচরণ উত্তেজিত স্বরে বলল, ”মেডেলের কথা তো আমি বলিনি, তুমি হঠাৎ গায়ে পড়ে টিপ্পুনি কাটছ কেন?”

”জেলাসি।”

নস্যির কৌটোয় চাঁটা দিয়ে বদু মন্তব্য করল।

”ক্ষিতীশ বড় ফালতু কথা বলে।” কার্তিক সাহা এতক্ষণে মুখ খুলল। ”বারবার দেখেছি কখনই ও হরিকে সহ্য করতে পারে না।”

”জেলাসিই হোক ফেলাসিই হোক, আমাকে পাঁচজনের সামনে বিদ্রূপ করে তুমি কি আনন্দ পাও ক্ষিদ্দা বলো তো?”

ক্ষিতীশ চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে টেবলে রাখল। কঠিন স্বরে বলল, ”আমার বিরুদ্ধে আর কি অভিযোগ আছে ধীরেন?”

ধীরেন ঘোষ তাড়াতাড়ি ঝুঁকে কয়েকটা কাগজ উল্টেপাল্টে বলল, ”এই সবই আর কি। অভিযোগ এনেছে সুইমাররা। ওরা বাইরেই আছে। প্রেসিডেন্ট যদি বলেন তো ওরা নিজেরাই এখানে এসে বলতে পারে।”

”না, তার দরকার নেই।” ক্ষিতীশ চশমাটা চোখে পরল, ”অভিযোগগুলি সত্যি।”

টেবলের মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কেউ মাথা নাড়ল, কেউ নড়েচড়ে বসল। ওদের ভাবভঙ্গিতে এই কথাটাই ফুটে উঠল—এইবার, তাহলে বাছাধন এইবার কি বলবে?

”আমি জানি ওরা কি বলবে। বলবে, আমি জলে নামি না, খাটতে বলি, না খাটলে গালাগালি করি। আপনারা বলবেন, আমি রেজাল্ট দেখাতে পারিনি তিন—চার বছর, আমার ব্যবহারে সুইমাররা বিদ্রোহ করেছে।”

”এমনকি মারবেও বলেছে।” যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য কথাটা বলেই, ধীরেন ও হরিচরণের ভ্রূকুটি দেখে থতমত হয়ে, ”কি কাণ্ড, এখনো চা দিয়ে গেল না।” বলতে বলতে উঠে বেরিয়ে গেল।

”অভিযোগের জবাব নিশ্চয় আমাকে দিতে হবে।”

প্রেসিডেন্ট গম্ভীর হয়ে বলল, ”সেটা আপনার ইচ্ছে। কিছু বলার থাকলে নিশ্চয় আমরা শুনব।”

সারা ঘর উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। চশমাটা আবার টেবলে রেখে ক্ষিতীশ চোখ বোঁজে।

”এই ক্লাবে আমি প্রথম আসি পঁয়ত্রিশ বছর আগে। ধীরেনও তখন আসে। বছর পাঁচেক পর হরিচরণ। ওদের মত জুপিটারকে আমিও ভালবাসি। আমিও চাই জুপিটারের গৌরব, চাই ভারতের সেরা হয়ে উঠুক জুপিটার। এই গৌরব এনে দেয় সাঁতারুরা, ওয়াটারপোলো প্লেয়াররা, ডাইভাররা। ওদের পারফরমেন্স যত উঠবে, গৌরবও তত বাড়বে। আমার যা কিছু চেষ্টা, তা ওদের উন্নতির জন্যই। এজন্য আমি কঠোর হয়েছি, গালিগালাজও দিয়েছি।”

ক্ষিতীশের বলার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে ঘরটা গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠল।

”সাঁতারে অবিশ্বাস্য রকমে পৃথিবী এগিয়ে গেছে। আর আমরা? আমাদের এক একটা রেকর্ডের বয়স দশ বছর পনেরো বছর। পঁচিশ বছর হতে চললো শচীন নাগের রেকর্ডের বয়স! কেন এই থমকে থাকা? যেভাবে পৃথিবী এগোচ্ছে, আমাদেরও সেইভাবে এগোতে হবে।”

”এসব এমন কিছু কথা নয়; আমাদেরও জানা আছে। শুনতে ভালই লাগে।” হরিচরণ ভারিক্কি চালে বলল এবং প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। ”আসল যে জিনিস ফুড সেটা কই? খাটবে যে খাদ্য কই? তা যখন পাওয়া যাবে না তখন খাটিয়ে খাটিয়ে টিবি রোগ ধরিয়ে দিয়ে লাভ কিছু হবে?”

”ঠিক কথা। ফুড কই?”

যজ্ঞেশ্বর টেবল চাপড়ে বলে উঠল।

প্রেসিডেন্ট এবং ধীরেন ঘোষ মাথা নাড়ল। বদু কৌটো থেকে বড় এক টিপ নস্যি বার করল।

”বাজে কথা।”

ক্ষিতীশ চাপা এবং দৃঢ়স্বরে বলল।

”আজ পর্যন্ত কেউ টি বি রুগী হয়েছে সাঁতার কেটে, এমন কথা শুনিনি। আসলে এটা অলস ফাঁকিবাজদের, যাদের উচ্চকাঙ্ক্ষা নেই তাদের অজুহাত। যতটুকু খাদ্য আমরা জোটাতে পারি, সেই অনুপাতে আমরা ট্রেনিং করি না। শ্যামল, গোবিন্দ বিদ্যেবুদ্ধির জন্য নয়, সাঁতারের জন্যই চাকরি পেয়েছে। কিন্তু সাঁতারকে তারা এর বিনিময়ে কি দিচ্ছে? এরা অকৃতজ্ঞ। এরা গুছিয়ে রোজ পাঁচ টাকাও যদি খাওয়ার জন্য খরচ করে, ডিসিপ্লিনড লাইফ লীড করে, নিয়মিত কঠিন ট্রেনিং করে, তাহলে দু’বছরেই এরা এক মিনিটে একশো মিটার ফ্রি স্টাইল কাটবে, এক পাঁচে ব্যাক স্ট্রোক কাটবে।”

”তাহলে এদের ট্রেনিং করাতে পারেননি কেন?” ধীরেন বলল।

”ছেলে ফেল করলে দোষটা মাস্টার মশায়েরও।” কার্তিক কনুই দিয়ে বদুকে খোঁচা দিল।

”নিশ্চয়, শুধু ওদের অকিতজ্ঞ বলে নিজের দোষ খালন করলে কি চলে!”

”না, আমি দোষ স্খালন করতে চাই না। বরং আমি বলতে চাই, এদের দিয়ে আর কিছু হবে না। এদের বয়স হয়ে গেছে, এদের মনে পচ ধরেছে। এদের পিছনে পরিশ্রম করে লাভ নেই।”

”আমি বিশ্বাস করি না।” হরিচরণের তীব্র স্বরে ক্ষিতীশও বিস্মিত হল।

”কি বিশ্বাস করিস না?”

”এদের দিয়ে এখনো টাইম কমানো যায়। আমি করাতে পারি। আমি পারি এদের খাটাতে। পচ—টচ ধরেছে এসব বাজে কথা।”

ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ হরিচরণের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

”তাহলে তুই দায়িত্ব নে। আমি আজ থেকে চিফ ট্রেনারের পদ ছেড়ে দিলাম। রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেব। আমি কাল থেকে আর আসব না।”

”না না, আসবে না এটা কি কথা!” বদু ব্যস্ত হয়ে উঠল। ”এতদিনকার মেম্বার!”

ক্ষিতীশ হাসল ম্লানভাবে, তারপরই চোখ দুটো পিট পিট করে উঠল। প্রেসিডেন্টকে লক্ষ করে বলল, ”ট্রেনার হতে গেলে নাম করা সাঁতারু হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। পৃথিবীর নাম করা কোচেরা—ট্যালবট, কারলাইল, গ্যালাঘার, হেইন্স, কাউন্সিলম্যান এরা কেউ ওলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন নয়। জলে নেমে এদের কোচ করতে হয় না। এরা সুইমারদের কোচ, নভিসদের নয়। জলের উপর থেকেই অনেক ভাল লক্ষ করা যায়, তাই ডাঙ্গাতেই আমি থাকি।”

”ক্ষিদ্দা, তুমি দেখছি ওইসব কোচেদের সঙ্গে নিজেকে এক পংক্তিতে ফেললে।” যজ্ঞেশ্বর কৃত্রিম বিস্ময় চোখে ফোটাল।

”ওরা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন তৈরী করছে, তুমি তো একটা বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নও তৈরী করতে পারনি!” কার্তিক সাহার গলায় বিদ্রূপ মোচড় দিল।

”পারবে পারবে, নিশ্চয় পারবে। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড আমরা শিগ্গিরিই পাব, তাই না ক্ষিতীশ?” ধীরেন ঘোষ মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

”চ্যাম্পিয়ন সুইমার তৈরী করা এদেশে সম্ভব নয়।” প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড় এতক্ষণে কথা বলল।

ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল।

”কোন দেশেই সম্ভব নয়। চ্যাম্পিয়নরা জন্মায়, ওদের তৈরী করা যায় না। ওদের খোঁজে থাকতে হয়, লক্ষণ মিলিয়ে চিনে নিতে হয়।” ক্লান্তস্বরে কথাগুলো বলে ক্ষিতীশ দরজার দিকে এগোল।

”সেই ভাল, এবার থেকে তপস্যা শুরু করো ক্ষিদ্দা।”

”ক্ষিতীশ, চা—টা খেয়ে যাও।”

”ক্ষিতীশবাবু ক্লাবে আপনার কিন্তু রেগুলার আসা চাই।”

ঘর থেকে বেরিয়েই ক্ষিতীশ দেখল শ্যামল, গোবিন্দ এবং আরো চার পাঁচটি ছেলে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল সে। ওরা হঠাৎ কাঠের মতো হয়ে গেল।

”তোদের অনেক বকেছি—ঝকেছি, কটু কথাও বলেছি। আর এসব শুনতে হবে না। আজ থেকে আমি আর এ ক্লাবের ট্রেনার নই। সাঁতারটা মন দিয়ে করিস।”

ক্ষিতীশ মাথা নামিয়ে ধীর পায়ে ক্লাবের বাইরে এসে দাঁড়াল।

কমলদিঘির কালো জলের উপর পার্কের আলোগুলো খড়ির মত দাগ টেনেছে। জুপিটার ক্লাববাড়ির চুড়োর ঘড়িতে আটটা বাজতে পাঁচ। দিঘিটা আকারে গোল। তাকে ঘিরে ইঁট বাঁধানো রাস্তা। নারী পুরুষ শিশুর ভীড়ে রাস্তাটা গিজগিজ করছে। আলোগুলোর নীচে তাস খেলা চলছে, অকসন ব্রিজ বা টোয়েন্টিনাইন। মাঝে মাঝে দমকা চীৎকার উঠছে তাসের আড্ডা থেকে। বেঞ্চগুলোয় বসার স্থান নেই। ফুলগাছের ঝোপগুলো লোহার বেড়ায় ঘেরা। বেড়ায় ঠেস দিয়ে যুবকরা গল্প করছে। ঘুগনি, আলুকাবলি, বাদাম, ঝালমুড়ি বা কুলফি মালাইওয়ালারা ব্যবসায়ে ব্যস্ত।

দুটি হাত রেলিংয়ে রেখে ক্ষিতীশ দিঘির অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে। জুপিটারের ঠিক উল্টোদিকেই অ্যাপোলোর ক্লাববাড়ি। ডাইভিং বোর্ডের কংক্রিট কাঠামোর থামগুলো অন্ধকারে ব্রহ্মদত্যির পায়ের মতো জল থেকে উঠেছে।

”ক্ষিদ্দা!”

চমকে পেছনে তাকাল ক্ষিতীশ।

”ভেলো!”

”কি হল ক্ষিদ্দা?”

”কি আবার হবে, ছেড়ে দিলুম।”

”ভালই করেছ। ঝগড়াঝাটি, গোলমাল হয়নি তো?”

”না।”

ক্ষিতীশ মুখটা আবার জলের দিকে ঘোরাল। হাওয়া বয়ে আসছে জলের উপর দিয়ে। বাতাসে জলের কণা, আর শ্যাওলা আর ঝাঁঝির আঁশটে গন্ধ। পঁয়ত্রিশ বছর এই শুঁকে আসছে ক্ষিতীশ। তার কাছে এর থেকে সুবাস পৃথিবীতে নেই।

ভেলো পাশে এসে দাঁড়াল।

”ভেলো, কি করি এখন বল তো রে। একেবারেই বেকার হয়ে গেলুম।”

”এবার প্রজাপতিকে বরং দেখাশুনো করো। বৌদি একা মেয়েমানুষ, অন্যরাও মেয়ে, পুরুষমানুষ একজন থাকা দরকার। কখন কি মুশকিলে ওরা পড়ে যাবে তার ঠিক কি!”

”তোর বৌদি মানুষটি ছোট্টখাট্ট, কিন্তু আমার থেকে দশগুণ লম্বা কাজের বেলায়। প্রজাপতিতে দারোয়ানি ছাড়া আমায় দিয়ে আর কোন কাজ হবে না।”

”তাহলে?”

ক্ষিতীশ আবার জলের দিকে তাকিয়ে রইল।

”ক্ষিদ্দা, যদি রাগ না করো তো একটা কথা বলি।”

ক্ষিতীশ মুখ ফেরাল।

”তুমি অ্যাপোলোয় চলো।”

”না, ওরা জুপিটারের শত্রু। কতকগুলো স্বার্থপর লোভী মূর্খ আমায় দল পাকিয়ে তাড়িয়েছে বলে শত্রুর ঘরে গিয়ে উঠব?”

”কিন্তু ওখানে তুমি জল পাবে, শেখাবার ছেলেমেয়ে পাবে, কাজ চাইছ কাজ পাবে। অপমানের শোধ তোমায় নিতে হবে। শত্রু—মিত্র বাছবিচার করে কি লাভ?”

ক্ষিতীশ বিব্রতমুখে চুপ করে রইল। তার মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে সেটা তাকে এই মুহূর্তে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে দিচ্ছে না। জুপিটারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক, কিন্তু সাঁতারু তৈরী করা তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, ব্রত। লক্ষ্যপূরণ করতে হলে নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে বেরোতেই হবে। কিন্তু তা কি সে পারবে? ক্ষিতীশ মাথাটা ঝাঁকালো।

”তাহলে হেদো কিংবা গোলদিঘির কোন ক্লাবে চলো।”

”কোথাও গিয়ে আমি টিকতে পারবো না রে।” ক্ষিতীশ হাঁটতে শুরু করল একটু জোরেই।

”চুপচাপ বসে থাকবে?” ভেলো হ্যাঁচকা দিয়ে প্যান্ট টেনে তুলে ক্ষিতীশের পাশাপাশি থাকার জন্য প্রায় ছুটতে শুরু করল।

”আমি এবার সত্যিকারের কাজ করতে চাই। সবাইকে দেখিয়ে দেব একবার। চ্যাম্পিয়ন তৈরী করব আমি। গড়ব আমি মনের মতো করে। একবার, শুধু একবার যদি তেমন কারুর দেখা পাই।”

মাথা নীচু করে ক্ষিতীশ হনহনিয়ে কমলদীঘির গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে গেল। ভেলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গেটের পাশে দাঁড়ানো আলু কাবলিওলাকে বলল, ”জাস্তি ঝাল দিয়ে চার আনার বানাও।”

।। ৪ ।।

সকাল আটটা প্রায়।

ক্ষিতীশ বাজার করে ফিরছে। জুপিটারে আর সে যায় না। সকাল—বিকাল এখন তার কোন কাজ নেই। অবশ্য বাজার করাটা তার নিত্যদিনের কাজগুলির অন্যতম। সে বাজারে যায় বাড়ির কাছের বস্তির সরু গলি দিয়ে, ফেরে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে চিলড্রেনস পার্কটাকে ঘুরে অন্য পথ ধরে।

আজ ফেরার পথে দেখল পার্কে খুব ভীড়। বিশ্রাম চালাটায় টেবল চেয়ার পাতা। লাউডস্পীকারে বালক সঙ্ঘের উদ্যোগে কুড়ি ঘণ্টা অবিরাম ভ্রমণ প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কাল রাত আটটায়। শেষ হবে আজ বিকেল চারিটায়।”

লাউডস্পীকারে অন্য একটা চাপা গলা শোনা গেল: ”এই শালা, চারিটায় কি রে বল চারি ঘটিকায়। অ্যালাউনস করতে হলে শুদ্ধু করে বলতে হয়।”

”যা লেখা আছে তাই তো পড়ছি।”

”দে দে, আমাকে মাইক দে।”

এরপর অন্য এক কণ্ঠে শোনা গেল: ”প্রতিযোগিতা শুরু হইয়াছে কল্য রাত্রি আট ঘটিকায়, উদ্বোধন করেন অতীতদিনের খ্যাতকীর্তি ফুটবল খেলোয়াড় শ্রীকৃষ্ণপ্রসাদ মাইতি। পতিযোগিতা সমাপ্ত হইবে অদ্য বৈকাল চারি ঘটিকায়। পুরস্কার বিতরণ করিবেন সদ্ধেয় জননেতা ও আমাদের সঙ্ঘের প্রধান পিষ্টপোষক শ্রীবিষ্টুচরণ ধর মহাশয়। পতিযোগিতায় নেমেছিল বাইশজন পতিযোগী, আটজন অবসর নিয়েছে ইতিমধ্যে।”

ক্ষিতীশের চোখ হঠাৎ আটকে গেছে কঞ্চির মতো লম্বা, নিকষকালো একটি চেহারাতে।

গোলাকৃতি পার্কটিকে ঘিরে রেলিং। তার থেকে ছয় হাত ভিতরে সিমেন্টের পথটা বেড় দিয়েছে মধ্যস্থলের ঘাসের জমিকে। প্রতিযোগীরা পথ ধরে হাঁটছে ক্লান্ত মন্থরগতিতে। অধিকাংশেরই বয়স ১৬—১৭। বৈশাখের ভয়ঙ্কর রোদ মাথায় নিয়ে তপ্ত সিমেন্টের ওপর ওদের সারা দুপুর হাঁটতে হবে।

পরনে ঢিলে ফুল প্যান্ট, ঢলঢলে বুশ শার্ট, পায়ে হাওয়াই চটি। চুলটা ছেলেদের মত হলেও, ঘাড়ের কিনারে পৌঁছে গেছে। রাস্তার মাঝ থেকে ক্ষিতীশ রেলিংয়ের ধারে সরে এল।

ক্ষিতীশের চোখ অনুসরণ করতে লাগল শুধু একজনকেই। পার্কের মধ্যে শিশু ও বালকদেরই ভীড়। বয়স্করা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে শুধুমাত্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রতিযোগীদের চোখে রাত্রি জাগরণ, ক্লান্তি আর ক্ষুধার ছাপ। পার্কের চক্কর প্রায় ৭৫ মিটারের। ওদের কেউ কেউ চেনা লোকেদের দেখে শুকনো হাসছে, দু—চারটে কথা বলছে। গঙ্গায় সাঁতারের সঙ্গী সেই তিনটি ছেলে পার্কের মধ্যে ঘাসের উপর দিয়ে কোনির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ওর সঙ্গে কথা বলল। কোনি হাত নেড়ে ওদের চলে যেতে বলছে। চটিজোড়া খুলে পথের পাশে রাখল। উদ্যোক্তাদের দেওয়া লজেঞ্জস পকেট থেকে বার করে ওদের তিনজনকে দিয়ে, একটা মুখে পুরল। হাঁটতে হাঁটতে সে মুখের কাছে হাত তুলে জলপানের ইশারা করতেই নেতাজী বালক সঙ্ঘের একজন ছুটে গিয়ে তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে এল। তিন—চার চক্করের পর আবার সে চটি পরল।

ক্ষিতীশের হুঁশ ফিরল যখন তার প্রতিবেশী অমূল্যবাবু অফিস যাবার পথে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ”কি দেখছেন ক্ষিতীশবাবু, বাঙালীদের ক্রীড়াচর্চা?”

লোকটিকে ক্ষিতীশ একদমই পছন্দ করে না, শুধুই নাটকীয় ঢঙে বাঁকা বাঁকা কথা বলে।

”কি আর করবে বলুন, আমরা ওদের ক্রীড়াচর্চার জন্যে কিছু ব্যবস্থা তো করে দিইনি। ওরা ওদের মতোই যা হোক ব্যবস্থা করে নিয়েছে।”

কথায় কথা বাড়ে। তাই ক্ষিতীশ আর না দাঁড়িয়ে বাড়িমুখো হল।

সদর দরজা তালাবন্ধ। লীলাবতী বেরিয়েছে। অবশ্য দ্বিতীয় চাবি ক্ষিতীশের কাছে আছে। ঘড়ি দেখে সে জিভ কাটল। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট দেরী হয়েছে অর্থাৎ লীলাবতী এতই রেগেছে যে রান্না না চাপিয়েই বেরিয়ে গেছে।

ক্ষিতীশ রান্নার উদ্যোগ শুরু করল। আনাজ কুটতে বসে বারবার তার ইচ্ছে করল পার্কে গিয়ে কোনিকে দেখতে। এই দ্বিতীয়বার সে ওকে দেখলে।

অবিরাম হাঁটা ব্যাপারটা সে একদমই পছন্দ করে না। এতে বুদ্ধির দরকার হয় না আর বলদের মত শুধু পাক খাওয়া। স্পীড দরকার হয় না, পেশীর জোর লাগে না, পাল্লা দিতে হয় না আর একটা মানুষের সঙ্গে। একে স্পোর্ট বলতে ক্ষিতীশের ভীষণ আপত্তি।

একবার সে গোলদিঘিতে চীৎকার করে তার আপত্তিটা জানিয়েছিল ৯০ ঘণ্টা সাঁতার কেটে বিশ্বরেকর্ড লাভে প্রয়াসী এক সাঁতারুকে। ”ওরে বুদ্ধু, এখনো যে একটা ওলিমপিক মেডেল সাঁতার কেটে আমরা পাইনি আর এসব বুজরুকি দেখিয়ে রেকর্ড করে কি তুই দেশের মান বাড়াবি?”

ক্ষিতীশকে জনাচারেক চেনা লোক টেনে সরিয়ে না দিলে হয়তো সে তখুনি জলে ঝাঁপিয়ে সম্ভাব্য বিশ্ব রেকর্ডটিকে তছনছ করে দিত। তবে সে এইটুকু মাত্র মানে, এইসব অবিরাম ব্যাপারগুলোর মধ্য দিয়ে কার কেমন সহ্যশীলতা কেমন একগুঁয়েমি সেটা বোঝা যায়। কিন্তু কি লাভ তাতে হয় যদি না সুশৃঙ্খল ট্রেনিং আর টেকনিকের মারফত সেগুলো বড় কাজে লাগানো হয়!

অপচয়। ক্ষিতীশ এই সব অপচয় দেখে বিরক্ত বোধ করে। খুব বিরক্ত বোধ করে। কিন্তু এখন সে ছটফট করছে পার্কে যাবার জন্য। উঠে গিয়ে ঘড়ি দেখল। হিসেব কষে বার করল কোনি প্রায় চোদ্দ ঘণ্টা হাঁটছে। এখনো ছ’ঘণ্টা বাকি। ভয়ঙ্কর এই শেষের ছ’ ঘণ্টা। টিকতে পারবে কি!

.

কুকারে রান্না চাপিয়ে ক্ষিতীশ দরজায় তালা এঁটে আবার বেরিয়ে পড়ল।

পার্কে দর্শকদের সংখ্যা ক্ষীণ। গাছের ছায়ায় কিছু আর বিশ্রাম—চালায় উদ্যোক্তারা। কোনি হাঁটছে, মাথায় ছেঁড়া বেতের টুপি। ক্ষিতীশ গুনে দেখল ওরা তেরোজন। একজন বসে গেছে। পার্কে ঢুকে সে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়াল। কোনি যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন সে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কোনির গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে চিবুকে, চোখ দুটি বসে গেছে, গালের উঁচু হাড় দুটো আরো উঁচু, ঠোঁটের চামড়া শুকনো। কিন্তু মাথাটা তুলে যেভাবে পাতলা দেহটাকে সে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাইতে ক্ষিতীশের মনে হল, আকাশ থেকে আগুন ঝরলেও কোনির চলা থামবে না।

কেন মনে হল, ক্ষিতীশ তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না। শুধু এইটুকুই সে বলবে, এমন একটা লোক নিজের সম্পর্কে কি ভাবে, সেটা বোঝা যায় চলার সময় মাথাটা সে কেমনভাবে রাখে তাই দেখে।

ক্ষিতীশ বাড়ি ফিরল বারোটায়। লীলাবতী কথা বলছিল দোকানের দুটি মেয়ের সঙ্গে। ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ”হাতিবাগানের ঘর কি হল?”

”অনেক টাকা সেলামি চায়। সম্ভব নয়।”

সে ঘরে ঢুকে গেল। অন্যমনস্কর মত স্নান ও খাওয়া সেরে সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগল। তিনটে বাজার সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে পড়ল।

তেরো থেকে আট, বসে গেছে পাঁচজন। পার্কে এখন বেশ ভীড়। লাউডস্পীকার রেকর্ড বাজানো বন্ধ করে নানাবিধ ঘোষণায় মত্ত। তারই মাঝে প্রতিযোগীদের জানিয়ে দেওয়া হল, আর মাত্র পঞ্চাশ মিনিট বাকি।

কোনি হাঁটচ্ছে। ক্ষিতীশ জানতো ও হাঁটবে এবং শেষ করবে। ক্লান্তি ওর পদক্ষেপে ধরা পড়ছে। সকালের সেই তিনটি ছেলে ওর পাশাপাশি ঘাসের উপর দিয়ে চলছে। কোনি দু’একবার ওদের কথা শুনে হাসল। ক্ষিতীশ লক্ষ করল ডান পা—টা টেনে টেনে হাঁটছে। অন্য প্রতিযোগীদের মধ্যে দুটি বছর দশেকের ছেলে, বেশ তাজাই দেখাচ্ছে।

”আমাদের আজকের সভাপতি বরেণ্য জননেতা ও এই সঙ্ঘের হিতষ্যি শ্রীযুৎ বিষ্টুচরণ ধর মহাশয় তার শত কাজ ফেলে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। এজন্য আমরা গর্বিত।”

ক্ষিতীশ লাউডস্পীকার থেকে কান সরিয়ে চোখ পাঠাল চালার নীচে। সেখানে টেবলের উপরে ইতিমধ্যে একটি সাদা চাদরের ও তোড়াভরা দুটি ফুলদানির আবির্ভাব ঘটেছে। তার পিছনে বসে আজকের সভাপতি।

আরে, এ তো গঙ্গার ঘাটে দেখা সেই হিপোটা! ক্ষিতীশ অবাক হয়ে গেল।

”আর কুড়ি মিনিট বাকি প্রতিযোগিতা শেষ হতে। তারপরেই পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান।”

লাউডস্পীকারে ফিসফাস আলোচনা শোনা গেল। ”বলতে ভুল হয়ে গেছে, পুরস্কার বিতরণের আগে সভাপতি মহাশয় তার ভাষণ দেবেন।”

আটজনেই শেষ করল প্রতিযোগিতা। পার্কে হাজির প্রায় একশো শিশু, বালক ও বয়স্ক ভীড় করে দাঁড়াল চালার সামনে। ক্ষিতীশও এগিয়ে গেল।

তার চোখ খুঁজতে খুঁজতে কোনিকে পেল। সিমেন্টের সিঁড়ির ধাপে বসে পা ছড়িয়ে দু’হাতে টিপছে ডান ঊরু।

”ওরে বাব্বা, আর আমি হাঁটার রেসে নামছি না। দুর দুর ফাস সেকেন থাড নেই।”

”তোকে তো পই পই বলেছিলুম, নাম দিস না। আমি আর ভাদু একবার নেমেই টের পেয়ে গেছলুম, বোগাস ব্যাপার।”

”কান্তি যে বলেছিল লোকেরা এসে পিন দিয়ে টাকা আটকে দেয় জামায়, কই দিল না তো!”

”এসব ছোটখাটো কম্পিটিশনে দেয় না।”

”তোকে বলেছে! কোনি যদি ফ্রক পরে নামতো দেখতিস, অন্তত বিশ—পঁচিশ পেয়ে যেত। প্যান্ট শার্ট পরলে তো ওকে ছেলে দেখায়।”

”ঘোড়ার ডিম দিত, এখানকার লোকেরাই কঞ্জুস।”

”না রে, ঠিকই বলেছে ভাদুটা, আমাকে প্যান্ট পরলে ছেলেদের মতই তো দেখায়। এই দ্যাখ তো চণ্ডু, প্রাইজ—ফ্রাইজ কি দেবে, পুরো একদিন বাড়ির বাইরে, মা মেরে ফেলবে যদি কিছু হাতে করে না নিয়ে যাই।”

লাউডস্পীকারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাগুলি শেষ হয়েছে। সভাপতি বিষ্টু ধর বক্তৃতা দিতে শুরু করেছে।

ক্ষিতীশ হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে কোনিদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, ”তুমি সাঁতার শিখবে?”

মুখটা তুলল সে। কাঁচা—পাকা কদমছাঁট চুলে ভরা মাথা আর পুরু লেনসের পিছনে জ্বলজ্বলে দুটি চোখের দিকে একটু বিরক্তভরেই তাকাল। তারপর আবার সে নিজের পা টিপতে লাগল।

”শিখবে সাঁতার?”

”সাঁতার আমি জানি।”

”না, জান না।”

ঝটকা দিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে কোনি আবার মুখ তুলল।

”আপনি জানেন?”

”হ্যাঁ জানি। আমি দেখেছি তোমায় গঙ্গায়। ও সাঁতার চলবে না। সাঁতার শেখার জিনিস।”

”যা জানি তাতেই গঙ্গা এপার ওপার করতে পারি, শেখার আবার আছে কি?”

”অনেক কিছু শেখার আছে।”

”আমার দরকার নেই, শিখে, যা জানি তাই যথেষ্ট।”

ক্ষিতীশের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে কোনি দাঁড়াল। চেঁচিয়ে ডাকল, ‘অ্যাই গোপলা শুনে যা।”

টেবলে স্তূপীকৃত নানাবিধ প্রাইজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা খালি পা, ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে বছর বারোর একটি ছেলে এগিয়ে এল।

”হ্যা রে, মা কিছু বলেছে?”

”যাও না বাড়িতে, পিটিয়ে তোমার চামড়া তুলে নেবে।”

”দাদা?”

”দাদা আজ কাজে যায়নি, জ্বর হয়েছে। মা’র সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তোমাকে নিয়ে। দাদা বলেছে, বেশ করেছে কোনি।”

ক্ষিতীশ ভাবল, আর একবার কোনির সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু ততক্ষণে কোনিকে ডেকে নিয়ে গেছে নেতাজী বালক সঙ্ঘের কর্মকর্তারা। প্রতিযোগীদের হাতে একটি করে খাবারের ঠোঙা দেওয়া হচ্ছে।

”এই যে শরীর, একে চাকর বানাতে হবে।”

ক্ষিতীশ ফিরে তাকাল বক্তৃতাকারীর দিকে। মাইক্রোফোনের পিছনে একটি ধুতি পাঞ্জাবি পরা চর্বির ঢিপি। ক্ষিতীশ ভীড় কেটে চাতালের দিকে এগোল।

”কি করে তা সম্ভব? আপনার লক্ষ লক্ষ টাকা আছে কিন্তু পারেন কি আপনি আর্চ করতে, পীকক হতে? যদি কেউ আপনাকে চাঁটি মেরে পালায়, পারবেন কি তাকে দৌড়ে গিয়ে ধরতে? না, পারবেন না, আমি জানি আপনি পারবেন না।”

সভাপতির পিছন থেকে কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ”একবার পরীক্ষা করে দেখব নাকি?”

বিষ্টু ধর পিছন দিকে তাকাল। ক্ষিতীশকে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল। মাইকে হাত চাপা দিয়ে চাপা গলায় বলল, ”সব জায়গায় ইয়ারকি করবেন না।” তারপর হাত সরিয়ে বলতে শুরু করল, ”কেন পারবেন না, জানেন কি কারণটা? কারণ, আপনার শরীর ফিট নয়। আর ফিটনেস আসে নিয়মিত ব্যায়াম থেকে।”

বিষ্টু ধর পিছন ফিরে তাকাল। ক্ষিতীশ মাথা হেলিয়ে তারিফ জানাল।

”ব্যায়াম সেইজন্যই সকলের করা দরকার। হাঁটাও একটা ব্যায়াম। তাই নেতাজী বালক সঙ্ঘের তরুণ কর্মীদের, যারা দিনরাত পরিশ্রম করে আজকের এই প্রতিযোগিতাকে সফল করে তুলেছে, তাদের বললাম তোমরা হাঁটার ব্যবস্থা করো, আমি আছি, তোমাদের সাথী। এটা সমাজসেবার কাজ, আমি থাকব তোমাদের পাশে পাশে।”

”উহুঁ, আগে আগে। নেতৃত্ব দিতে হলে সামনে থাকতে হয়।”

বিষ্টু ধর পিছনে তাকিয়ে ভ্রূ কোঁচকাল। তারপর মাথা হেলাল, ”পাশে পাশেই বা বলি কেন, আমি থাকব আগে আগে। সমাজের কল্যাণের জন্য মানুষকে সুস্থ সবল করার জন্য যখনই সংগঠন গড়ে উঠবে, সবার আগে আমাকে ছুটে আসতেই হবে।”

”ছোটার কথা চেপে যান।” পিছন থেকে ফিসফিস শোনা গেল, ”যদি কেউ বলে একটু ছুটে দেখান!”

বিষ্টু ধর ঢোঁক গিলে বলল, ”কিন্তু ছুটেই বা আসব কেন! মানুষ ছোটে কখন? যখন সে ভয় পায়, দিশাহারা হয়। কিন্তু জনগণ সহায় থাকলে আমি ভয় পাব কেন? জনগণই পথ বলে দেবে, সুতরাং দিশাহারা হবো কেন? না, আপনাদের আশীর্বাদ থাকলে আমি ভয় পাব না। সঠিক পথেই আপনাদের সেবা, দেশের ও দশের সেবা করে যেতে পারব। তাই আজ প্রতিযোগীদের এই কথা বলেই বক্তব্য শেষ করব, শরীরকে ফিট না করলে পরিশ্রম করতে পারবে না। পরিশ্রম না করলে দেশ গড়ে তুলতে পারবে না। তাই আজ যে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তোমরা হাঁটা শুরু করলে…”

বিষ্টু ধর পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে লাগল। ”এই যে হাঁটা, এ হাঁটা জীবনের পথে…”

বিষ্টু ধর অসহায়ভাবে পিছনে তাকাল।

”ভুলে গেছেন?”

ঘাড় নেড়ে অসহায়ভাবে বিষ্টু ধর ফিসফিস করে বলল, ”রবি ঠাকুরের একটা পদ্য লিখে এনেছিলুম, পাচ্ছি না।”

”বলুন এই যে যাত্রা শুরু হল ছোট্ট এই পার্কে—”

মাইক্রোফোনে গমগম করে উঠল সভাপতির আবেগভরা কণ্ঠ, ”এই যে যাত্রা শুরু হল, ছোট্ট পার্কে—

”ধীরে ধীরে তা বৃহত্তর জীবনের দিকে, সুখ—সমৃদ্ধিভরা জীবনের দিকে তোমাদের নিয়ে যাক। এই পার্ক পরিক্রমা রূপান্তরিত হোক বিশ্ব পরিক্রমায়, জয় হিন্দ।”

বিষ্টু ধর হুবহু বলে গেল ক্ষিতীশের প্রম্পট শুনে। শুধু জয় হিন্দের পর গলা কাঁপিয়ে যোগ করল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”

পুরস্কার দেওয়া হল; প্লাস্টিকের কিট ব্যাগ আর তোয়ালে পেল যারা ২০ ঘণ্টা সম্পূর্ণ করেছে। ১৬ ঘণ্টার পরে যারা অবসর নিয়েছে তাদের শুধুই ব্যাগ আর ১২ ঘণ্টার পরে যারা তাদের শুধুই তোয়ালে। কোনি পুরস্কার নিয়ে ব্যাগটা উল্টেপাল্টে দেখল। সভাপতিকে নমস্কার জানানোর দরকারও মনে করল না। খাবারের ঠোঙাটা ব্যাগের মধ্যে ভরে সে ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, ”চ বাড়ি যাই, এটা মাকে দিতে হবে।”

ভাইয়ের কাঁধে হাতে রেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনি চলে যাচ্ছে।

ক্ষিতীশ একদৃষ্টে তাকিয়ে। মাথাটা উঁচু, কঞ্চির মত শরীরটা দুলছে। সঙ্গে ওর বন্ধু ভাদু আর চণ্ডু। পার্ক থেকে বেরিয়ে ওরা ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্ষিতীশের মনে হল, ওর বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে রাখলে হতো।

”আপনাকে বেষ্টা দা ডাকছে।”

‘কে বেষ্টা দা?” অন্যমনস্ক ক্ষিতীশ বলল।

”আজ যিনি সভাপতি।”

ক্ষিতীশকে দেখেই বিষ্টু ধর একগাল হেসে বলল, ”ফিনিশিংটা সবাই বলছে দারুণ হয়েছে। ” তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ”ইনকিলাব জিন্দাবাদটা অ্যাড করলুম, তার কারণ আছে। আমার প্রগ্রেসিভ নেচারটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। চলুন চলুন, আমার গাড়ি রয়েছে, আপনাকে সব বলছি, আমার বাড়ি চলুন।”

বিষ্ণু ধর আগামী সাধারণ নির্বাচনে দাঁড়াবে। তাই এখন থেকেই সে তোড়জোড় শুরু করছে। পাড়ায় পাড়ায় নানান ব্যাপারে টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছে আর তাতে সভাপতি হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। নির্দলীয় সমাজসেবক হিসাবে সে ভোট চাইবে।

বিষ্টু ধর গাড়িতে বসে কথাগুলো জানিয়ে দিল।

বাড়ি পৌঁছে বলল, ”আপনাকে আমার দরকার।”

”আমাকে!”

”হ্যাঁ, আপনি আমার ইস্পীচ—রাইটার হবেন, বক্তৃতা লিখে দেবেন। অবশ্য এজন্য টাকা দোব। রাজী?”

”আমি তো খেলার ব্যাপার ছাড়া আর কিছু জানি না!” ক্ষিতীশ বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে বলল।

”সেইজন্যেই তো আপনাকে চাই। খেলা নিয়েই বক্তৃতা দিতে চাই, আর কিছু নিয়ে নয়। বিনোদ ভড় হচ্ছে সিটিং এম এল এ। খেলার লাইনের লোক। অনেক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। আমিও খেলার লাইন ধরে ক্যামপেন করব। বিনোদ ভড় মিনিস্টার হতে চায়।”

সিঙ্গাড়া মুখে দিয়ে ক্ষিতীশ বলল, ”ভেবে দেখি।”

।। ৫ ।।

রবীন্দ্র সরোবরে এক মাইল সাঁতার প্রতিযোগিতা।

পঁচিশজন প্রতিযোগী। বাইশটি ছেলে ও তিনটি মেয়ে।

স্টারটিং পয়েন্টে ভীড়। প্রতিযোগীরা তেল মাখায় ব্যস্ত। উদ্যোক্তা ঢাকুরিয়া স্পোর্টস ক্লাবের অনুরোধে ক্ষিতীশ প্রতিযোগিতার রেফারী অফ দ্য কোর্স। সাঁতারুদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে নৌকোয়।

স্টারটিং পয়েন্ট থেকে একটু এগিয়ে সে আর ভেলো নৌকোয় বসে।

”ক্ষিদ্দা, কে জিতবে বলো তো? সুবীরই মনে হচ্ছে।”

”সুবীরের নামা অন্যায় হয়েছে। এসব কম্পিটিশনে নামীদের থাকা উচিত নয়। ও তো ন্যাশনাল জুনিয়ার রেকর্ড হোল্ড করছে।”

”যা বলেছ। তবে বেশির ভাগই আনকোরা দেখছি।”

ভেলো সারি দিয়ে দাঁড়ানো সাঁতারুদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল, ”ওই লাল কস্ট্যুমপরা মেয়েটা কে বলো তো? কখনো তো দেখিনি!”

এত দূর থেকে ক্ষিতীশ, পুরু লেনসের মধ্য দিয়ে, শাদা টুপি মাথায়, লাল রঙে মোড়া তুষারধবল একটি দেহমাত্র দেখতে পেল।

”কে, তা আমি জানব কি করে!”

”না, এমনিই বলছি। বালিগঞ্জ ক্লাবের ট্রেনার প্রণবেন্দু বিশ্বাসকে দেখলুম কিনা মেয়েটার সঙ্গে। খুব বড়লোক মনে হল। ওই যে সবুজ মোটরটা, ওটায় করে এসে নামল। সঙ্গে বাবা—মাও যেন রয়েছে।”

”তুই বড্ড বেশি দেখিস।”

”না দেখে উপায় আছে, মোমের পুতুলের মত চেহারা! ওর পাশেই দ্যাখো, পোড়ামাটির কেলে পিলসুজের মত একটা। কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে দ্যাখো।”

ক্ষিতীশ দেখার চেষ্টা করল। সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা শব্দ ”কোনি!”

ঠিক তখনই স্টার্টারের বন্দুক গর্জে উঠল।

সাঁতারুরা এগিয়ে যাবার পর ক্ষিতীশদের নৌকোটা পিছু নিল।

সুবীর এবং আরো গুটি দশেক ছেলে এক ঝাঁকে এগিয়ে গেছে। তারপরেও আর এক ঝাঁক। সব শেষে তিনটি মেয়ে ও দুটি বাচ্চচা ছেলে।

পাঁচশো মিটার পর্যন্ত এরা পাঁচজন প্রায় একসঙ্গেই ছিল। তারপরই লাল কস্ট্যুম ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে শুরু করল।

”ক্ষিদ্দা, স্ট্রোক দেখেছ! শরীরটা কেমন ভাসিয়ে রেখেছে!”

ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ লক্ষ করে বলল, ”মাথাটা ঠিকমত নাড়ানো হচ্ছে না। সেন্ট্রাল পোজিশনে না থাকলে শরীরের ব্যালান্স নষ্ট হয়, স্পীডও কমিয়ে দেয়; শরীরটা রোল করছে বড্ড বেশি। কনুই আরো উঠবে…”

”অ্যাই, অ্যাই, অমনি তোমার শুরু হয়ে গেল খুঁত ধরা।’

”খুঁত না ধরলে দোষ সারবে কি করে!”

”ও কি তোমার ছাত্তর?”

”নাইবা হলো।”

সামনের দু ঝাঁকের সাঁতারুদের কেউ কেউ এবার মন্থর হয়ে পিছিয়ে পড়ছে। ক্ষিতীশ ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল। বাচ্চচা ছেলে দুটির সঙ্গে কোনি আসছে বৈঠার মত হাত চালিয়ে, দু’ধারে মাথা নাড়াতে নাড়াতে। ওদের থেকে অন্তত কুড়ি মিটার সামনে আর একটি মেয়ে, সমান তালে একই গতিতে সাঁতরে চলেছে। লাল কস্ট্যুমের মেয়েটি তার থেকে আরো তিরিশ মিটার সামনে এবং একটি ছেলের থেকে হাত দশেক পিছনে।

”কো ও ও নি ই ই।”

সরোবরের পূর্ব তীর থেকে একটা চীৎকার ভেসে এল।

ক্ষিতীশ আর ভেলো একসঙ্গেই তাকাল বছর পঁচিশের শ্যামবর্ণ একটি রুগ্ন যুবক পাড় ঘেঁষে ছুটছে। পরণে ধুতি ও নীল শার্ট। চটি জোড়া হাতে।

”কো ও ও নি ই।”… কো ও ও নি ই ই।”

গলার স্বরটা আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। পাড়ে ভীড় জমেছে। সাঁতার দেখতে। তাদের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে ছুটছে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকাচ্ছে। মুখখানি অসহায়।

”কো ও ও নি ই।”

চীৎকারটা হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল। ক্ষিতীশ দেখল কোনিকে পিছনে ফেলে বাচ্চচা দুটি এগোচ্ছে। লাল কস্ট্যুম দুটি ছেলেকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।

”কে বলো তো ক্ষিদ্দা?”

”জানি না, কোনো কম্পিটিটারের বাড়ির লোক হবে হয়তো।”

পাড়ের রাস্তা ধরে ধীর গতিতে সবুজ রঙের একটা ফিয়াট চলেছে। গাড়ির জানলায় উৎকণ্ঠিত একটি পুরুষ ও একটি মহিলার মুখ। মাঝে মাঝে হর্ন দিচ্ছে।

”কো ও ও ন ই ই।”

নৌকোটা ছপছপ শব্দে দাঁড় ফেলে এগোচ্ছে। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে নীলশার্ট পরা যুবকটি দাঁড়িয়ে। ক্রমশ সে ক্ষিতীশের চোখে ছোট হয়ে ঝাপসা হতে শুরু করল। জলের উপর, অনেক পিছনে, দুটি হাতের ওঠানামা হচ্ছে। তারপর আর দেখা গেল না হাত দুটো। পড়ন্ত রোদে মাঝে মাঝে চিকচিক করে উঠছে ছিটকে ওঠা জল।

সামনে হৈ চৈ শোনা গেল। প্রথম প্রতিযোগী সাঁতার শেষ করেছে। সম্ভবত সুবীরই।

কোনি জল থেকে উঠছে। সাঁতার শেষ করে অনেকেই তখন চুল পর্যন্ত আঁচড়ে ফেলেছে। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ঢাকুরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সারা বছরের কার্যকলাপের বিবরণ পাঠ করে চলছে একঘেঁয়ে সুরে। কেউ লক্ষ্যই করল না শেষ প্রতিযোগীর সীমায় পৌঁছনোটা।

পাড়ের কাছে কাদা। কোনির পায়ের গোছ কাদায় ডোবা, শরীরটা সামনে ঝোঁকান, পাড়ে উঠতে গিয়ে সেই অবস্থাতেই সে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটি লাল। সস্তার একটা কালো কস্ট্যুম শীর্ণ দেহের সঙ্গে লেপটে। হাঁপাচ্ছে, পিঠের দিকে পাঁজরের হাড়গুলো চামড়ার নিচে বারবার কেঁপে উঠছে। কাঁধের হাড় দুটো উঁচু। সরু লম্বা হাত দুটো ঝুলছে কাঁধ থেকে। একটু দূরে নীলশার্ট পরা রুগ্ন যুবকটি দাঁড়িয়ে, মনোযোগে লাডউস্পীকারে কান পাতার ভান করে।

টলতে টলতে কোনি উঠে এল। ওর বয়সীই দুটি ছেলে একটু জোরেই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল।

”তবু তো শেষ করেছে।”

”পরের বছরের কম্পিটিশনে প্রথম প্লেস পেতো যদি আর একটু দেরীতে পৌঁছতো।”

কোনি আর একবার তাকাল। নীলশার্ট পরা যুবকটির মুখ চড় খাওয়া মানুষের মত অপ্রতিভ, অপমানিত।

.

”সাঁতার শিখবে?

চমকে কোনি পিছনে ঘুরল।

সেই লোকটা। কাঁচাপাকা কদমছাঁট চুল। পুরু কাঁচের চশমা।

”লাল কস্ট্যুমপরা মেয়েটি সাঁতার শিখেছে তাই তোমাকে হারালো। তুমিও ওকে হারাতে পারবে যদি শেখো।”

হঠাৎ কোনির দু’চোখ জলে ভরে এল। থরথরিয়ে ঠোঁট দুটি একবার কেঁপে উঠল। তারপরই চোয়াল শক্ত হয়ে বসে গেল।

ক্ষিতীশের চাহনির দপ করে ওঠা শুধু ভেলোই লক্ষ করল এবং অস্বস্তি ভরে সে মাথা নাড়ল।

”ওই যে দাঁড়িয়ে, ও কে?”

”আমার দাদা।”

নিজেকে টানতে টানতে কোনি ড্রেসিং রুমের দিকে চলে গেল। ক্ষিতীশ এগিয়ে গেল কোনির দাদাকে লক্ষ করে।

”আমি একজন সাঁতারের কোচ। আমার নাম ক্ষিতীশ সিংহ। আমি আপনার বোনকে সাঁতার শেখাতে চাই।”

ক্ষিতীশ কোন ভূমিকা না করে সোজাসুজি কথাগুলো বলল।

”আমার নাম কমল পাল। আমি একসময় সাঁতার কেটেছি অ্যাপোলোয়। তখন আপনাকে আমি দূর থেকে দেখতাম।” কমল তার পাণ্ডুর অসুস্থ চোখ দুটোয় ঔজ্জ্বল্য আনার চেষ্টা করল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, ”আমরা খুবই গরীব। সাঁতার শেখবার পয়সা নেই।”

”আমাকে পয়সা দিতে হবে না।”

”তা বলছি না। সাঁতার শিখতে হলে খরচ আছে, খাওয়া—দাওয়ার খরচ। আমি পারিনি সেইজন্য, পয়সা ছিল না খাওয়ার। বাবা প্যাকিং কারখানায় কাজ করত, টি বি—তে মারা গেল। সাঁতার কেটে এসে খিদেয় ছটফট করতুম। স্কুলে ঘুমিয়ে পড়তুম। বাবা মারা যেতে স্কুল ছাড়লুম, সাঁতার ছাড়লুম। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল।”

”কি করেন আপনি?”

”আপনি বললে লজ্জা পাব।”

”বেশ। তুমি কি করো, বাড়িতে আর কে কে আছেন?”

”সাত ভাই—বোন, মা। আমি বড়ো, গত বছর মেজো ভাই ট্রেনের ইলেকট্রিক তারে মারা গেছে, সেজো কাঁচড়াপাড়ায় পিসির বাড়িতে থাকে। তারপর কোনি আর দু’ বোন এক ভাই। আমি রাজাবাজারে একটা মোটর গ্যারেজে কাজ করি, ওভারটাইম করে শ’ দেড়েক টাকা পাই, তাতেই সংসার চলে। থাকি শ্যামপুকুরে বস্তিতে।”

কমল হাঁপিয়ে পড়ল এই ক’টি কথা বলেই। ভিতরে ভিতরে যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কোন কুণ্ঠা বা সংকোচ না করে সাধারণভাবেই নিজেদের অবস্থার কথা বলল। ওর হাঁপিয়ে ওঠার ধরনটা ক্ষিতীশের ভাল লাগল না। ওর বাবা টি বি—তে মারা গেছে, এটা মনে পড়ে অস্বস্তি বোধ করল।

”নামকরা সাঁতারু হবার সখ আমার ছিল। কোনিটাকে দেখতুম ছোট থেকেই ওর খেলাধুলোয় আগ্রহ। আমার ইচ্ছে করে ওকে কোনো একটা খেলায় দিই। গঙ্গায় সাঁতার কাটে শুনেছি, দেখিনি কখনো। দিনরাত টো টো করে শুনেছি ছেলেদের সঙ্গে। অনেকে অনেক কথা বলে আমাকে। আমি তো বাড়িতে ফিরি শুধু ঘুমোবার জন্য। কে কি করছে কিছুই জানি না। তবু মাথা গরম হয়ে উঠলে দু’চার ঘা লাগাই। এর বেশি ওদের জন্য আমি আর কিছু করতে পারি না। ইচ্ছে থাকলেও ওকে সাঁতার শেখাবার সামর্থ্য আমার নেই।”

”সে দায়িত্ব আমার।”

”তার মানে?” ভেলো ব্যস্ত হয়ে এতক্ষণে মুখ খুলল। ”দায়িত্ব তোমার মানে?”

”মানে বলতে যা বোঝায় তাই।” ক্ষিতীশ বিরক্তি জানিয়ে কমলকে লক্ষ করে বলল ”গার্জেনরা সাহায্য না করলে কোন ছেলেমেয়েকে শুধু কোচিং দিয়ে বড় করা যায় না। আমি শুধু বাড়ির সহযোগিতাটুকু চাই। বাদবাকি দায়িত্ব আমার।”

”আপনি দায়িত্ব নেবেন, সে তো ভাগ্যের কথা।” কমলের চোখের পাণ্ডুরতা চকচক করে উঠল। ”কিন্তু আমি এক পয়সাও খরচ করতে পারব না। ধার করে কালকেই বারো টাকা দিয়ে ওকে কস্ট্যুম কিনে দিয়েছি। খুবই বাজে জিনিস। কখনো ওর সাঁতার দেখিনি, এই প্রথম দেখলাম। কথা দিয়েছিল, মেয়েদের মধ্যে প্রথম হবেই। দেখলেন তো কি হল!”

ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল।

ভেলো বলল, ”স্ট্রেংথই নেই, আদ্দেকের পর আর টানতে পারছিল না। ওকে এখন খুব খাওয়াতে হবে। তাই না ক্ষিদ্দা?”

”আমরা এখন চলি।”

ক্ষিতীশ পিছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখল দূরে কোনি দাঁড়িয়ে। ফ্রক পরে। কাঁধে প্লাসটিকের ব্যাগ।

”আমার খুবই ইচ্ছে, ও সাঁতার শিখুক, বড় হোক, নাম করুক।” তারপর ইতস্ততঃ করে কমল বলল, ”আর, যতটুকু পারি টেনেটুনে চালিয়ে খরচ করার চেষ্টা করব।”

ওদিকে প্রাইজ দেওয়া হচ্ছে। নাম ডাকা এবং হাততালির শব্দ লাউডস্পীকারে ভেসে আসছে।

”মেয়েদের মধ্যে প্রথম…”

ক্ষিতীশ তাকিয়ে ভাইবোনের দিকে। প্রাইজ না নিয়ে চলে যাছে উল্টোদিকের পথ ধরে। ভাঙ্গা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে গলে রাস্তায় পড়বে। কমল গলে বেরিয়েছে। কোনি কাত হয়ে মাথা নিচু করে। ঝটকা দিয়ে সে এবার ফিরে দাঁড়াল।

”…বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবের হিয়া মিত্র। টাইম—পঁয়ত্রিশ মিনিট আঠারো সেকেন্ড।”

কোনি মাথা নামিয়ে রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

”তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি ক্ষিদ্দা!”

”কি করে বুঝলি।”

”ওই পিলসুজমার্কা সিড়িঙ্গে, কেষ্ট তুলসীর মত রঙ, খেতে পরতে পায় না, ওকে তুমি সাঁতার শেখাবে, আবার দায়িত্ব নেবে?”

”হ্যাঁ, তা না হলে কি শেখানো যায়?”

”দায়িত্ব কথাটার মানে?”

”মানে, খাওয়া—পরার দায়িত্ব, মানসিক গড়ন, যেটা সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট, তাই গড়ে তোলার দায়িত্ব, রেগুলার ট্রেনিং করানোর দায়িত্ব, এইসব আর কি।”

”তা হলে তো ওকে বাড়িতে এনে রাখতে হয়।”

”দরকার হলে রাখতে হবে। এককালে গুরুগৃহে থেকেই তো শিষ্যরা শিখতো। সিস্টেমটা খুব ভালো।”

”সিস্টেমের মধ্যে বৌদির কথাটা মনে রেখেছো তো!”

ক্ষিতীশ রেগে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। থেমে, কান পাতল, লাউডস্পীকারে।

”কনকচাঁপা পাল, আন—অ্যাটাচড। কনকচাঁপা পাল।” তারপর মৃদু ফিসফিস শোনা গেল, ”বোধহয় চলে গেছে। থাক রেখে দাও।”

ক্ষিতীশ দেখল, সবুজ ফিয়াটের ধারে লাজুক মুখে হিয়া দাঁড়িয়ে। আনন্দ ফেটে পড়েছে ওর দুই গালের টোলে। এক মহিলা বাক্সটা তুলে মেডেলটা দেখছে আর হাসছে। প্রণবেন্দু ওদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে। সুপুরুষ, সুবেশ এক ভদ্রলোককে সে কি একটা বোঝাবার জন্য হাত পাড়ি দিয়ে বাটারফ্লাই স্ট্রোকের ভঙ্গি করল।

”সামনের বছর দেখা যাবে।” নিজেকে উদ্দেশ করে আপন মনে ক্ষিতীশ বলল।

”কিছু বলছ ক্ষিদ্দা?”

ক্ষিতীশ জবাব দিল না।

”শেখাবে যে, জল কোথায়? জুপিটারে তুমি আর ট্রেনার নও। তাহলে মেয়েটাকে কোথায় নামিয়ে শেখাবে? অন্য ক্লাবে তোমায় যেতেই হবে।”

”না, আমি জুপিটারেই ওকে শেখাব। দেখি কে আমায় আটকায়। তার আগে আমাকে রোজগারে নামতে হবে রে ভেলো। এখন আমার টাকা চাই। বিষ্টু ধরের সঙ্গে দেখা করা দরকার।”

।। ৬ ।।

ওরা তখন খেতে বসেছে।

হঠাৎ দরজায় ক্ষিতীশকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

”তোমাকে দরকার, একটু বাইরে এসো।”

কোনিকে লক্ষ করে কথাগুলো বলে, সে দরজা থেকে সরে গেল। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সে দেখে নিয়েছে কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ, ফ্যান এবং সম্ভবত তার মধ্যে কিছু ভাত আছে আর তেঁতুল। পাঁচটি প্রাণী কলাই আর অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে বসে। ঘরে একটা তক্তপোশ। তোষক নেই, শুধু চিটচিটে ছোট একটা বালিশ। দেয়ালে টাঙানো দড়িতে কিছু ময়লা জামা—প্যান্ট। খোলার চালের এই ঘরে একটি মাত্র জানলা, যার নিচেই থকথকে পাঁকে ভরা নর্দমা।

কোনি কৌতূহলী চোখে বেরিয়ে এল।

”এই ফর্মটায় সই করে দাও, আর আজ বিকেলে আমার সঙ্গে জুপিটার ক্লাবে যাবে।”

ফর্মটা হাতে নিয়ে কোনি যেন কেমন এক ফাঁপরে পড়ল। ”কলম আছে আপনার কাছে?”

ক্ষিতীশের কাছে নেই

”পেন্সিলে লিখলে হবে?”

”না, কালিতে সই করতে হবে।”

কোনি ছুটে গিয়ে কোথা থেকে কলম যোগাড় করে আনল। ক্ষিতীশের দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় কলম বাগিয়ে সে জানতে চাইল, ‘ইংরিজিতে না বাঙলায়?”

”যা খুশি।”

ধরে ধরে, বিড়বিড়িয়ে বানান করে কোনি ইংরাজীতেই সই করল। সেটা দেখে ক্ষিতীশ বলল, ”কোন ক্লাশে পড়ো?”

”ফাইভে।”

”স্কুলে যাও?”

”নাম কেটে দিয়েছে।”

”আজ ঠিক চারটের সময় কমলদিঘির পশ্চিম দিকের বড়গেটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে। তোয়ালে, কস্ট্যুম সব নিয়ে যাবে।”

”তোয়ালে নেই।”

”আমি নিয়ে যাব। তুমি ঠিক সময়ে আসবে।”

ঠিক সময়েই কোনি হাজির ছিল। ক্ষিতীশ ওকে নিয়ে ক্লাবে ঢুকল। অফিস ঘরে হরিচরণ আর প্রফুল্ল বসাক। ক্ষিতীশ ফর্মটা প্রফুল্লের হাতে দিল। সেটা পড়ে প্রফুল্ল বলল, ”সুইমার?”

”হ্যাঁ।”

”ট্রায়াল দিতে হবে।”

”তার মানে!” ক্ষিতীশ বিরক্ত হয়েই বলল, ”আমি বলছি তাতে হবে না?”

”তা কি করে হয়! ক্লাবের একটা নিয়ম আছে তো। ট্রেনার যদি বলে তবেই সুইমার। যে—সে, যাকে—তাকে এনে সুইমার বলবে আর জলে নেমে যদি ডুবে যায় তখন আমরাই তো হাঙ্গামায় পড়ব।”

প্রফুল্ল কথাগুলো বলতে বলতে হরিচরণের দিকে তাকাল। জানলার বাইরে তাকিয়ে হরিচরণ তখন মুচকি হাসছে।

”যে সে! আমি তাহলে যে সে?” ক্ষিতীশ বিড়বিড় করল থমথমে স্বরে। কোনি অবাক হয়ে দেখছে, দলে দলে ছেলেরা কস্ট্যুম পরে ক্লাব থেকে বেরোচ্ছে। তিন—চারটি মেয়েও আছে তার মধ্যে। বাইরে হৈ চৈ জলের ধারে ‘নভিস’ ছেলেদের।

”বেশ তাহলে ট্রায়াল নেওয়া হোক।”

হরিচরণ মুখ ফেরাল এতক্ষণে। কোনিকে আপাদমস্তক দেখে বলল, ”মেয়েটি কে?”

”আমার চেনা মেয়ে। গুড মেটিরিয়াল। স্ট্রোক শেখাতে হবে।”

”গুড মেটিরিয়াল!” হরিচরণ ঠোঁট বেঁকিয়ে শব্দগুলো দুমড়ে মুখ থেকে বার করল। কোনিকে আর একবার দেখে নিয়ে, গম্ভীরস্বরে বলল, ”এ ক্লাবের কাউকে স্ট্রোক শেখাতে হলে শেখাবে ক্লাবেরই ট্রেনাররা। কাল সকালে আসুক। বন্দনা কি টুনু ওর ট্রায়াল নেবে।”

ক্ষিতীশ কয়েক সেকেন্ড হরিচরণ ও প্রফুল্লর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আচ্ছা।”

বেরিয়ে এসে কোনি বলল, ”কি হল, ভর্তি করাল না?”

”পরীক্ষা দিতে হবে। কোনি আমাদের দুজনকেই পরীক্ষা দিতে হবে।”

কথাটা বুঝতে পারল না কোনি। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ”দুজনকেই! কেন, আপনি সাঁতার জানেন না?”

”সাঁতার নয়, আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে অপমান সহ্য করার।”

ক্ষিতীশ জলের ধারের রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। দুটি ক্লাবের প্রায় চারশো ছেলে কমলদিঘিতে দাপাদাপি করছে, কয়েকটি মেয়েও আছে। দুটো ডাইভিং বোর্ডে কয়েকটি ছেলে। তারা জলে লাফাচ্ছে নিছকই লাফাবার জন্য। বিষণ্ণচিত্তে ক্ষিতীশ মাথা নাড়ল। কাজের কাজ কেউই করছে না। সুহাস জলে নামছে। একবার সে তাকাল মাত্র তার দিকে।

হরিচরণ ক্লাব অফিসের জানলা থেকে চেঁচিয়ে বলল, ”সুহাস, দুটো ফোর হানড্রেড তারপর হানড্রেড বাটারফ্লাই, ব্যাক অ্যান্ড ব্রেস্টস্ট্রোক ইচ, মনে আছে তো?”

সুহাস ঘাড় নাড়ল।

ক্ষিতীশ হাসল। মাত্র এগারোশো মিটার, এই ট্রেনিংয়ে এরা উন্নতি করবে! তবে সুহাসের স্ট্রোক নিখুঁত। ক্ষিতীশ বলল ”কোনি ওই যে ছেলেটা জলে নামল ওকে লক্ষ করো, দেখো কেমনভাবে হাত পাড়ি দেয়।”

কোনি একাগ্র হয়ে তাকিয়ে রইল সুহাসের সাঁতারের দিকে। ক্ষিতীশ এক সময় বলে উঠল, ”হাতটা মাথার ঠিক সামনে জলে ঢুকে সামনে চলে যাচ্ছে, তারপর নীচে নামছে, তারপর টেনে ঊরু পর্যন্ত আনছে। সব থেকে দরকার স্পীডে হাত চালানো। তার মানে এলোপাথাড়ি গঙ্গায় যেভাবে করো তা নয়। সুন্দরভাবে জলে হাতের ঢোকাটা আর শক্ত কব্জি খুব দরকার। আসল স্পীডটা আসে কাঁধের, পিঠের আর হাতের মাসলের শক্তি থেকে। এজন্য তোমার একসারসাইজ করতে হবে। এই শক্তিটাকে গুছিয়ে কাজ করালে তবেই স্পীডটা আসবে। মাথাটা কিভাবে রয়েছে দেখেছ? তুমি যেমন এধার ওধার নাড়াও, সেই রকম করছে কি? মুখ জলে ডুবিয়ে কেমন এগোচ্ছে। শুধু নিঃশ্বাস নেবার জন্য মাথাটা, ওই দ্যাখো পাশে ঘোরাল। বেশি মাথা নাড়ালে স্পীড কমে যায়। কাঁধটা জল থেকে উঠে আছে।”

কোনি শুনছে কি শুনছে না বোঝা গেল না। সাঁতারুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সে বলল, ”আচ্ছা ওই মেয়েটার নাম কি?”

ক্ষিতীশ একটু হতাশ হয়েই বলল, ”জানি না।”

”ওর কস্ট্যুমটা কিসের, গেঞ্জির?”

”নাইলনের—খুব দামি।”

‘খুব সুন্দর রঙটা।”

ক্ষিতীশ কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, ”তোমাকে কিনে দেবো একটা—”

কোনি ঘুরে দাঁড়াল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।

”যেদিন তুমি ওই রকম স্ট্রোক দিতে শিখবে।” ক্ষিতীশ আঙুল দিয়ে সাঁতরে যাওয়া সুহাসকে দেখাল।

কোনি তীক্ষ্ন চোখে সুহাসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ”দু’দিনে শিখে নেব।”

”ভাল। কাল সকাল ঠিক সাড়ে ছ’টায় আজ যেখানে দাঁড়িয়েছিলে, সেখানে দাঁড়াবে। কস্ট্যুম সঙ্গে আনবে। পাশ তুমি করে যাবেই, সেজন্য ভাবছি না। কিন্তু স্ট্রোক শেখানোর ভার পান্না কি নির্মলের উপর যদি পড়ে তাহলে তো সব মাটি হয়ে যাবে।”

কিন্তু কোনি পাশ করেও ভর্তি হতে পারল না।

সকালে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া দেখল। কোনি অনায়াসে দু’শো মিটার সাঁতরালো, জলে দু’হাত তুলে রইল, ঝাঁপ দিল ডাইভিং বোর্ডের নীচতলা থেকে।

বিকেলে অফিস ঘরে প্রফুল্ল তাকে বলল, ”সম্ভব নয়, আর মেম্বার নেওয়া যাবে না। সেক্রেটারির স্ট্রিক্ট অর্ডার। জলে আর হাত—পা ছোঁড়ারও জায়গা নেই, এত ভীড়। আজকেই তো দুজনকে রিফিউজ করতে হল।”

”তাহলে আগেই সেটা আমাকে বলা হল না কেন?” ক্ষিতীশ রাগে ফেটে পড়তে গিয়েও সামলে নিল।

”বলার কথাটা মনে ছিল না।”

বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসার মতো ক্ষিতীশ ক্লাব থেকে বেরিয়েই দেখল স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মে হরিচরণ দাঁড়িয়ে। কথা বলছে, দুটি ছেলের সঙ্গে।

”হরিচরণ” ক্ষিতীশ চীৎকার করে উঠল, ”চিফ ট্রেনার হতে চেয়েছিলিস, হয়েছিস। এরপরও এসব কি হচ্ছে?”

হরিচরণ বিরক্তিভরে ফিরে তাকিয়ে বলল ”কি আবার হচ্ছে?”

”আমার মেয়েটাকে ভর্তি করলি না কেন?”

”প্রফুল্লের কাছে যাও।”

”ওসব ছেঁদো ওজর অনেক শোনা আছে। তবে এই বলে রাখলুম, দেখবি ওই মেয়ে তোদের মুখে চুনকালি দেবে। সেদিন আফসোস করবি।”

”ওই মেয়ে, যাকে কাল এনেছিলে! ভালো, ভালো, তাই দিক। একটা মেয়ে সুইমার বেঙ্গল পাচ্ছে তাহলে!”

”বেঙ্গল নয়, ইন্ডিয়া পাবে।” রেলিংয়ে ধরা মুঠোটা শক্ত করে নিজেকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ক্ষিতীশ ভাঙ্গা গলায় চেঁচিয়ে যেতে লাগল, ”ওলিম্পিকের গুল মেরে সুইমার তৈরী করা যায় না রে, ধরা একদিন পড়বিই।”

প্রফুল্ল ক্লাব থেকে বেরিয়ে এল।

”কি আবোলতাবোল চীৎকার করছ ক্ষিদ্দা।”

”বেশ করছি। কর্পোরেশনের জমিতে আমি দাঁড়িয়ে। তোদের ইতরোমোটা শুধু দেখছি। মেয়েটাকে তোরা ভর্তি করলি না, ভেবেছিস আর বুঝি ক্লাব নেই। পৃথিবীতে শুধু জুপিটারই একমাত্র ক্লাব।”

”তা হলে যাও না অন্য ক্লাবে।” হরিচরণ চেঁচিয়ে উঠল। ”ওই তো পাশেই একটা ক্লাব রয়েছে।”

”তাই যাব, তাই যাব।”

ক্ষিতীশ হনহন করে এগিয়ে গেল অ্যাপোলোর দিকে। পিছনে জমে যাওয়া ভীড়টাকে উদ্দেশ্য করে প্রফুল্ল বলল, ”পাগল মশাই, পাগল।”

অ্যাপোলোর গেটে পৌঁছে সংবিৎ ফিরল ক্ষিতীশের। দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের প্রতি অবাক হয়ে ভাবল, এখানে আমি এলাম কেন? এরা তো জুপিটারের শত্রু। আমি নেমকহারাম হলাম!

ক্ষিতীশকে দেখতে পেল অ্যাপোলোর অন্যতম ভাইস—প্রেসিডেন্ট নকুল মুখুজ্জে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেটের কাছে এসে বলল, ”কি ব্যাপার, ক্ষিতীশ যে! তুই এখানে?”

হঠাৎ ক্ষিতীশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ”তোমাদের এখানে জায়গা হবে নকুলদা! জুপিটার আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।”

”যাঃ কি আজেবাজে বকছিস। তোকে তাড়াবে কে?”

”সত্যি বলছি নকুলদা, তাড়িয়ে দিয়েছে। আমায় টাকা পয়সা দিতে হবে না। একটা মেয়ে পেয়েছি, তাকে শেখাবার সুযোগটুকু দিও তা হলেই হবে।”

”ভেতরে আয়, আগে সব শুনি।”

”তার আগে বলে রাখি, আমি কিন্তু জুপিটারের লোক, অ্যাপোলো কোনদিনই আমার ক্লাব হবে না।”

”তাহলে তোকে আমরা নোব কেন?”

”আমাকে নয়, মেয়েটাকে নাও। আমি ওকে শেখাব। ও যদি সম্মান আনে তাহলে সেটা হবে অ্যাপোলোর।”

”আচ্ছা আচ্ছা, ভেতরে চল।”

”আগে বলো, আমার শর্তে রাজী! অ্যাপোলোর তুমিই সব, তোমার কথায় ক্লাব ওঠে বসে। তুমি কথা দিলে তবেই ঢুকব।”

নকুল মুখুজ্জে কিছুক্ষণ স্থির চোখে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ”তোর জুপিটার থেকে বেরিয়ে আসা মানে আমাদের শত্রুর দুর্গের একটা খিলেন ভেঙ্গে পড়া। অ্যাপোলোর ছাদের নীচে যদি তুই আসিস, সেটাই আমাদের ভিকট্রি হবে। আচ্ছা কথা দিলাম।”

গেট অতিক্রম করার আগে ক্ষিতীশ একবার পিছন ফিরল। কমলদিঘির জলে ছায়া পড়েছে পশ্চিমের দেবদারু আর রাধাচূড়া গাছের। জুপিটারের বিরাট ঘড়িটার কালো ডায়ালে কাঁটা দুটো আবছা লাগল ক্ষিতীশের পুরু লেনসে। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড একটা মোচড় সে অনুভব করল। চিকচিক করে উঠল চোখ দুটো।

সেই রাতে ঘুম এল না ক্ষিতীশের। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রাতটা কাটাল। বারবার একটা কথাই তার মনে পাক দিয়ে ফিরল : ”আমি কি ঠিক কাজ করলাম? অ্যাপোলোয় যাওয়া কি উচিত হল?”

ভেলো উত্তেজিত হয়ে হাজির হল সকালেই।

”ক্ষিদ্দা, তুমি অ্যাপোলোয় জয়েন করেছ? বেশ করেছ। তোমাকে তো সেই কবে বলেছিলুম এটা হল যুদ্ধ। ন্যায়—অন্যায় বলে যুদ্ধে কিছু নেই, শত্রু—মিত্র বাছ—বিচার করে কোন লাভ নেই।”

ক্ষিতীশ চুপ করে রইল।

”জুপিটারকে এবার শায়েস্তা করা দরকার। বুঝলে ক্ষিদ্দা, তুমি শুধু ওই নাড়ির সম্পর্ক—টম্পর্কগুলো একটু ভুলে যাও…”

”ভেলো!”

ক্ষিতীশের একটা হাত তোলা। চোয়াল শক্ত। পুরু লেনস ভেঙ্গে চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে। ভেলো এক পা পিছিয়ে গেল।

”আর একটা কথা যদি বলেছিস তো—”

ভেলো বিড়বিড় করে বলল, ”আমার ভুল হয়ে গেছে। আমায় মাপ করো ক্ষিদ্দা।”

।। ৭ ।।

”না না, না, কতবার বলব কনুইটা অতটা ভাঙ্গবে না—হাতটা অমন তক্তার মতো লাফিয়ে উঠল কেন? উহুঁ উহুঁ… হল না, বাঁ হাতটা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাঁ কাঁধটাও এগোচ্ছে আর ডান কাঁধটা পিছিয়ে যাচ্ছে, এতে স্কোয়ার শোল্ডার পোজিশানটা যে ভেঙ্গে যাচ্ছে… নে নে, আবার কর…ওকি! জলের বাইরে হাত নিয়ে যাবার সময় শরীরের পাশের দিকটা বেঁকে তেউড়ে শুঁয়োপোকা চলার মতো হয়ে যাচ্ছে যে!..দ্যাখ আমাকে দ্যাখ। তোর কনুইটা কেন বাঁক খাচ্ছে না বোঝার চেষ্টা কর…এইভাবে, এই রকম। আর হাতের আঙুল জল টানবার সময় ফাঁক করবি না। জলের ওপর থাবড়ে থাবড়ে হাত ফেলিস দেখেছি, ওভাবে নয়। পরিষ্কারভাবে সোঁত করে ঢুকে যাবে। আগে আঙুল তারপর কব্জি থেকে পুরো হাতটা । আর নিঃশ্বাস নেওয়াটা ভালো করে বুঝে নে। যদি ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে নিঃশ্বাস নিস, তাহলে বাঁ হাতটার কব্জি যখন জলে ঢুকছে তখন মাথা ঘোরাবি। মাথা নিচু রাখার জন্য থুতনিটা বুকের দিকে টেনে রাখবি। মাথার লাইন এধার—ওধার হবে না। ডান হাতটা যখন উঠবে তার তলা দিয়ে উঁকি দেবে হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে। আর ডান হাত যেই জলে ঢুকছে সেই সঙ্গে তোর মুখও আবার জলে ডুবছে। যা যা আবার কর। দু’হপ্তা হয়ে গেল এখনো একটা জিনিসও ঠিক মতো করতে পারলি না।”

জলের ধারে সিমেন্ট বাঁধানো সরু পাড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ সমানে বকবক করে চলেছে। কোনি পাড়ের ধারে খানিকটা সাঁতরায় আর থেমে থেমে ওর দিকে তাকায়। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে এই ব্যাপার চলেছে। এখন সাড়ে আটটা।

”আর পাচ্ছি না ক্ষিদ্দা”

”কেন! বলেছিলি দু দিনেই সুহাসের মতো স্ট্রোক শিখে নিবি। দু’দিন ছেড়ে তো সতেরো দিন হয়ে গেল।”

জলের মধ্যে দাঁড় সাঁতার কাটতে কাটতে কোটি চাপা রাগ নিয়ে বলল, ”করছি তো আমি। আপনি খালি হচ্ছে না হচ্ছে না বলেই যাচ্ছেন।”

”না হলে কি বলব, হচ্ছে?”

”হচ্ছেই তো।”

”কিচ্ছু হয়নি। যা বলছি আবার কর।”

”আমার ভাল লাগছে না।”

কোনি পাড়ের দিকে এগিয়ে এল। ক্ষিতীশ কি করবে ভেবে না পেয়ে বলল, ”স্ট্রোক শিখলে কিন্তু নাইলন কস্ট্যুম দেবো।”

”দরকার নেই আমার।”

বাঁধানো পাড়ে দু’হাতের ভরে কোনি জল থেকে উঠে এল। ক্ষিতীশ বুঝতে পেরেছে ওকে খাটাতে হলে জোরজবরদস্তিতে কাজ হবে না। কিছু একটা প্রাপ্তিযোগ না থাকলে ওকে উৎসাহিত করা যাবে না।

”উঠে পড়লি যে, ক্ষিদে পেয়েছে?”

কোনি কথা বলল না। এগিয়ে গেল, রেলিংয়ের গেট লক্ষ করে।

”ক্ষিদে তো পাবেই। ভাবছি দুটো ডিম, দুটো কলা আর দুটো টোস্টের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়।”

কোনি দাঁড়িয়ে পড়েছে। ক্ষিতীশ মনে মনে হিসেব করে দেখল প্রায় একটাকার ধাক্কা।

”আজ থেকে?”

ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল। কোনি কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, ”আমি কিন্তু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাব।”

ক্ষিতীশ একটু কৌতূহলী হয়েই বলল, ”বাড়িতে কেন!”

”এমনিই। বাইরে আমি খাব না।”

”তাহলে আরো একঘণ্টা জলে থাকতে হবে।”

ক্ষিতীশ কথাটা বলেই মনে মনে ব্যথিত হল। লোভ দেখিয়ে ক্ষুধায় অবসন্ন কোনিকে আরো পরিশ্রম করানো অমানুষিক কাজ হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, সাধ্যের বাইরে গিয়ে পরিশ্রম করে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবেই, নয়তো কিছুতেই সাধ্যটাকে বাড়ানো যাবে না। খাটুক, আরো খাটুক। যন্ত্রণায় ঝিমঝিম করবে শরীর, টলবে, লুটিয়ে পড়তে চাইবে যন্ত্রণার পাঁচিলের সামনে। আর তখন জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জ দিতে হবে ওই পাঁচিলটাকে। এজন্য চরিত্র চাই, গোঁয়ার রোখ চাই।

…”নাম নাম, দাঁড়িয়ে আছিস কেন। দুটো ডিম, দুটো কলা, দুটো মাখন টোস্ট।”

যন্ত্রণা কি জিনিস সেটা শেখ। যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় না হলে, তাকে ব্যবহার করতে না শিখলে, লড়াই করে তাকে হারাতে না পারলে কোনদিনই তুই উঠতে পারবি না।

…”ঠিক আছে, ঠিক আছে, কনুই অতটা উঠবে না। মুখ ডুবিয়ে।”

যন্ত্রণা আর সময় তোর অপোনেন্ট। ও দুটোকে আলাদা করা যায় না। যন্ত্রণাকে হারালে সময়কেও হারাতে পারবি। সময়কে হারালে পারবি যন্ত্রণাকে হারাতে।

রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ মনে মনে কোনির সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চীৎকার করে উঠছে। কমলদিঘিতে এখন সাঁতার কাটছে একমাত্র কোনি। মাঝখানের চওড়া ঘাটে তিনচারজন বাইরের লোক স্নান করছে। বাসন ধুচ্ছে একটা স্ত্রীলোক। জুপিটার এবং আপোলোর নম্বর খেলা স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মগুলো পাশাপাশি প্রায় পঞ্চাশ মিটারের ব্যবধানে। সেগুলো এখন জনশূন্য। শুধু জুপিটারের স্প্রীং বোর্ড থেকে ঝাঁপ দিয়ে যাচ্ছে গোটাচারেক উটকো বাচ্চচা ছেলে। জুপিটারের ক্লাবের বারান্দায় বেঞ্চে বসে দুটি লোক তেলেভাজা খেতে খেতে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে।

অ্যাপোলো ক্লাবের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অমিয়া আর বেলা। কোনির সাঁতার দেখতে তারা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়াল। অমিয়া দিন সাতেক পর আজ জলে নেমেছিল। কলেজের পরীক্ষার জন্য সে ব্যস্ত। অমিয়া না থাকলে বেলা নাকি ট্রেনিংয়ে জুত পায় না। দু’জনে আজ আধ মাইল করে সাঁতরেছে।

”কে রে মেয়েটা?” অমিয়া জিজ্ঞাসা করল।

”ক্ষিদ্দার আবিষ্কার।” বেলা চোখ পাকিয়ে বলল, ”শুনিসনি, হরিচরণদা কি বলছিল সেদিন? ক্ষিদ্দা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে জুপিটারকে ডাউন দেবে ওই মেয়েটাকে দিয়ে।”

”সে কিরে, ও তো এখনো হাতের টান দিতেই শেখেনি। সামনের বছরই আমি কিন্তু জুপিটারে ফিরে যাব। যেখানে ক্ষিদ্দা আছে যেখানে আমি নেই। পাঁচজনের সামনে ট্যাঁকোস ট্যাঁকোস করে কথা শোনাবে, ও আমার সহ্য হয় না।”

”আমিও তাহলে যাব।”

দুজনে আর একবার কোনির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তখন অমিয়া হেসে বলল, ”কম্পিটিশনে পড়লে মেয়েটা তো আমার পা ধোয়া জল খাবে।”

.

প্রায় পৌনে দশটা। বাজার নিয়ে ফিরতে আজ দেরি হবেই। ক্ষিতীশ ব্যস্ত হয়ে হাঁটছে, পিছনে কোনি। একটা অস্টিন ফুটপাথ ঘেঁষে ক্ষিতীশের পাশে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে বেরিয়ে এল বিষ্টু ধরের মুখ।

”ও ক্ষিতীশবাবু, আপনাকেই খুঁজছি যে। যে ইস্পিচটা লিখে দিলেন সেটা কেমন যেন ঠিক বাগে আনতে পাচ্ছি না, একটু ডিসকাসন করলে ভাল হতো। আজকেই তো বিকেলে সভা।”

”কিন্তু আমার যে এখুনি বাজার করে বাড়ি পৌঁছতে হবে।”

”গাড়িতে উঠুন। বাজার সেরে গাড়িতেই পৌঁছে দিয়ে ডিসকাসটা করে ফেলব।”

বিষ্টু ধর মোটরের দরজা খুলে দিল। ব্যস্ত হয়ে ক্ষিতীশ গাড়িতে উঠছে, তখন জামায় টান পড়ল।

”খাবারের কি হবে!”

”ওহ তোর ডিম—কলা।” ক্ষিতীশ বিব্রত হয়ে, কি বলবে ভেবে পেল না।

”আমাকে বরং পয়সাটা দিয়ে দিন, কিনে নোব।”

কথা না বলে ক্ষিতীশ পকেট থেকে একটা টাকা বার করে কোনির হাতে দিয়ে বলল, ”বিকেলে ঠিক সময়ে আসিস।”

গাড়ি চলতে শুরু করলে বিষ্টু ধর জিজ্ঞাসা করল, ”কে মেয়েটা?”

”আমার ভবিষ্যৎ।” ক্ষিতীশ হেসে বলল।

.

লীলাবতী যথারীতি তালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

ক্ষিতীশ রান্নার উদ্যোগ না করে বিষ্ণু ধরকে নিয়ে বারান্দায় বসল। বিশু আর খুশি এগিয়ে এল ক্ষিতীশকে দেখে। বিষ্টু কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ”ও দুটোকে সরান। দেখলে গা সিরসির করে।”

বিড়াল দুটিকে ক্ষিতীশ ছোট্ট ধমক দিতেই ওরা বারান্দা থেকে নেমে গেল।

”দারুণ ট্রেনিং তো।”

”ওদের ভালবাসি তাই কথা শোনে। ভালবাসলে সবকিছু করিয়ে নেওয়া যায়, মানুষকে দিয়েও।”

”তার মানে মানুষ আর জানোয়ারকে একই লাইনে ফেলছেন।”

”তা কেন। জানোয়ার দেখলে মানুষের গা সিরসির করে, কিন্তু মানুষ দেখলে জানোয়ারের করে কিনা জানি না।”

”অই, অই, অমনি ত্যারাব্যাকা কথা শুরু হয়ে গেল।” বলতে বলতে বিষ্টু ধর পকেট থেকে বক্তৃতা লেখা কাগজটা বার করল। ”আমি দাগ দিয়ে রেখেছি জায়গাগুলো। রাস্তায় রবারের বল ফাইনাল, চিফ গেস্ট বিনোদ ভড়। বুঝলেন না, ওর দলের ছেলেরা থাকবে। ফস করে যদি কিছু প্রশ্ন করে বসে আর যদি জবাব দিতে না পারি তাহলে আওয়াজ খাবো, বেইজ্জত হবো।”

ক্ষিতীশ কাগজটা মন দিয়ে পড়ে বলল, ”হুঁ, কি জানতে চান?”

”ওই যে লিখেছেন, ‘ট্যালেন্ট ঈশ্বরের দান। সেটা ফুটিয়ে তোলা যায় কিন্তু তার বদলি হিসাবে কোনকিছুই সে জায়গায় বসানো যায় না। যার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে, সেটা যদি সে ব্যবহার না করে তাহলে তাকে অপরাধী হিসাবে গণ্য করতে হবে।’ কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে বহু ট্যালেন্টওলা লোক আছে, যারা শুধু খাওয়া—পরার ধান্দাতেই হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব আগে মানুষের দরকার বেঁচে থাকা, এটা তো মানেন?”

ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল।

”রাশিয়া—টাশিয়ায় বড় বড় খেলোয়াড়দের খাওয়া—পরার চিন্তা করতে হয় না। গভরমেন তাদের গুরুত্ব স্বীকার করে, স্টেটই তাদের সব কিছু দেয়। সেই রকম আমাদের দেশেও গভরমেনকে দেখা উচিত যাতে প্লেয়াররা খাওয়া—পরার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। এসব কথা একটু বলা দরকার, বুঝলেন না, পাবলিক এখন লেফটিস্ট ধরনের তো।”

”কিন্তু ভারত বা বাংলা তো কম্যুনিস্ট দেশ নয়, এখানে গণতন্ত্র। এখানে প্লেয়ারকে সব কিছুরই জন্য লড়তে হবে। গণতন্ত্রে এই স্বাধীনতাটা আছে—লড়াইয়ের স্বাধীনতা।”

”আপনি কি সব কিছুরই, মানে খাওয়া—পরার জন্যও জানোয়ারের মতো কামড়াকামড়ি করে বাঁচতে চান?”

”মানুষ হিসেবে নিশ্চয় চাই না, কিন্তু সুইমিং কোচ হিসেবে, হ্যাঁ চাই। আরামে সব জিনিস পাওয়া যায় না, বুঝলেন, আপনার পাবলিককে বলবেন যে, একটা সুইমারকে খেটে, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে উঠতে হয়। পড়ুন পড়ুন লেখাটা পড়ুন তো।”

ক্ষিতীশ উত্তেজিত হয়ে বারান্দায় পায়চারি শুরু করল। বিষ্টু ধর ভীরুচোখে ক্ষিতীশের দিকে এবং বিশু—খুশির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পড়তে লাগল—”বিরাট বিরাট খেলোয়াড়ের গৌরবের ছটায় আলোকিত হয় তার দেশ। যদি প্রশ্ন করি, অসট্রেলিয়ার কথা উঠলে সব আগে কাদের নাম আপনার মনে ভেসে উঠবে? নিশ্চয় ডন ব্র্যাডম্যান, ডন ফ্রেজার,কেন রোজওয়ালের নাম। যদি বলি ব্রাজিলের প্রধানমন্ত্রীর নাম কি? পারবেন কেউ বলতে? কিন্তু পেলের নাম আপনারা সবাই শুনেছেন। ইথিওপিয়া ছোট্ট দেশ, গরীব দেশ, অখ্যাত দেশ। কিন্তু বিকিলা যখন দৌড়ল, দেশটা বিখ্যাত হয়ে গেল।”

বিষ্টু ধর দম নেবার জন্য থামল। ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে পড়ে একমনে শুনছিল। বলল, ”কিন্তু শুধু মেডেল ধোয়া জল খেয়ে আপনার কি আমার চলবে না। মেডেল তুচ্ছ ব্যাপার, কিন্তু একটা দেশ বা জাতির কাছে মেডেলের দাম অনেক, হিরোর দাম অনেক। দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে একজন হিরো, সে সাঁতারুই হোক আর সেনাপতিই হোক, আদর্শ স্থাপন করে। তবু ওদের মধ্যে তফাত আছে, বড় সাঁতারু জীবনের ও প্রাণের প্রতীক, সেনাপতি মৃত্যুর ও ধ্বংসের। সাঁতারু অনেক বড় সেনাপতির থেকে। যুদ্ধজয়ী সেনাপতি সমীহ পায়, আবার ঘৃণাও পায়। কিন্তু বিরাট সাঁতারু সারা পৃথিবীকে প্রেরণা দেয়।”

”আপনি খালি সাঁতারু সাঁতারু বলছেন কেন, ফুটবলার ক্রিকেটার এদের নাম করুন। বাঙালিরা যা ভালবাসে মিটিংয়ে তাইতো বলব।”

”যা খুশি বলুন, কিছু যায় আসে না। শুধু বলবেন, যারা আমাদের জন্য প্রাণ নিয়ে আসে, আমরা তাদের অবহেলা করি। ভুলে যাই তাদের খাদ্য দরকার, মাথার উপর ছাদ দরকার, খড়ের চালা যদি হয় তাও। আমরাই বাধ্য করি তাদের উঞ্ছবৃত্তি করতে। আমরাই তাদের শেখাই চালাকি করতে, মিথ্যে বলতে। … এইসব বলার পর আপনার লাইনের কথাবার্তায় চলে আসবেন। খুব কড়া কড়া কথায় গভরমেন্টকে এক হাত নেবেন।”

”তাহলে একটু গুছিয়ে লিখে দিন। আমার যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে।”

ক্ষিতীশ ভ্রূকুটি করে তাকাল। বিষ্টু ধর তাড়াতাড়ি বলল, ”এজন্য নিশ্চয়ই ফি দোব।”

”ফি চাই না, একটি চাকরি চাই। যে কোনো চাকরি, অন্তত শ’দেড়েক টাকার।”

”চাকরি!” বিষ্টু ধর অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ”কোথায় পাব?”

”আপনার তো ব্যবসা আছে। আমার এখন নিয়মিত টাকার দরকার। এইভাবে, বক্তৃতা তো সারা জীবন লেখা যাবে না।”

”আচ্ছা আমি দেখব’খন।”

আধঘণ্টার মধ্যেই ক্ষিতীশ লিখে দিল। বিষ্টু ধর চলে যাবার পর রান্না চাপিয়ে দিল। উঠোনের দেয়ালে গাঁথা বড় হুকে রবারের দুটো দড়ির প্রান্ত আংটায় বেঁধে আটকাবার কাজে লেগে পড়ল। রবার দুটোর অপর প্রান্তে দুটো হাতল। এই রবার পুলি টেনে ব্যায়াম করবে কোনি। কাজটা শেষ করে সে ছোট পাশ—বালিশের মতো চটের থলে সের দশেক বালি দিয়ে ভরতে শুরু করল। ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের সময় এই ওজন ঘাড়ে নিয়ে কোনিকে ব্যায়াম করতে হবে।

লীলাবতী বাড়িতে ঢুকে ক্ষিতীশের কাজ দেখে অবাক হয়ে বলল, ”এগুলো আবার যে বার করলে ব্যাপার কি?”

”কোনির জন্য।”

”কে কোনি!”

”একটা মেয়ে। ওকে তৈরী করব, মেয়েটার মধ্যে জিনিস আছে। একেবারে আকাঁড়া মাটি, গড়তে পারলে দারুণ সুইমার হবে। তোমাকে এনে দেখাব। ভীষণ গরীব।”

লীলাবতী ঘরে ঢুকে গেল। ক্ষিতীশ ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ”ভীষণ গরীব, খেতে পায় না। ভাবছি এখানেই ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করব।”

ঘরের মধ্যে লীলাবতীর শুকনো কঠিনস্বর ভেসে এল, ”ঘরটা নেওয়াই ঠিক করলুম। ওরা রাজী হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা সেলামিতে, এখন টেনেটুনে চলতে হবে বাজে খরচ একদম বন্ধ।”

ক্ষিতীশ আর কথা বাড়াল না। বিকেলে অ্যাপোলোয় গিয়ে দেখল কোনি আসেনি। পরদিন সকালে কোনি এল আধঘণ্টা দেরীতে। ক্ষিতীশ রেগে তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কোনি বলল, ”খাবারের বদলে বরং আমাকে রোজ একটা করে টাকা দেবেন।”

ক্ষিতীশের রাগটা মুহূর্তে অবাক হয়ে গেল।

”তার মানে? রোজ একটা করে টাকা দিতে হবে আমাকে তুই সাঁতার শিখবি বলে? এটা কি আমার পিতৃদায়?”

”অতো খাটাবেন আর খেতে দেবেন না?”

কোনির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ক্ষিতীশ হেসে ফেলল, কোনিও হাসল। দুজনের মধ্যে নিঃশব্দে যেন একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল।

”তুই একটা আস্ত শয়তান। আমাকে চিনে ফেলেছিস দেখছি। দাঁড়া, তোকে আগে সাঁতারের মজাটা পাইয়ে দি, তারপর দেখব জলে নামিস কি নামিস না। এখন আমি তোকে খাটাচ্ছি, তখন তুই খাটার জন্য পাগল হয়ে উঠবি।”

কোনি কথাগুলো শুনল মুখে অবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়ে। ক্ষিতীশ সেটা লক্ষ করে আবার বলল, ”লেকে একমাইল সাঁতারে যে মেয়েটার কাছে হেরেছিস, তার নাম হিয়া মিত্র। নামটা মনে রাখিস।”

কোনির চোখ দুটো সরু হয়ে এল। মুখ ঘুরিয়ে সে কস্ট্যুমের কাঁধের পটি ঠিক করতে লাগল।

”মনে রাখিস, অমিয়া বলেছে তোকে পা ধোয়া জল খাওয়াবে।”

কোনি ঘুরে দাঁড়াল। শীর্ণ দেহটা ঝাঁকিয়ে রুক্ষস্বরে বলল, ”কস্ট্যুম সাত দিনে আমি আদায় করব। কিন্তু লাল রঙের আমি পরব না, আমার রঙ কালো।”

অমিয়া আর বেলা পঞ্চাশ মিটার কোর্সে কিকিং বোর্ড নিয়ে প্র্যাকটিস করছে। কোনি পাড়ের কাছাকাছি। ক্ষিতীশ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। দু চোখে শুধু অনুমোদন আর কণ্ঠে বিড়বিড় : ‘হারামজাদী কোথাকার, আমাকে নিয়ে এতদিন রসিকতা হচ্ছিল! দাঁড়া, তোর ওষুধ আমি পেয়েছি—হিয়া মিত্তির।’

”ক্ষিতীশ, চলছে কেমন?”

নকুল মুখুজ্জে রেলিংয়ে দু’হাত রেখে শুকনো গলায় বলল, ”তুই কি কিছুই খবর রাখিস না! বি এ এস এ—র সিলেকশন কমিটি থেকে আমাকে আউট করে দিয়েছে। এ সবই জুপিটারের ধীরেনের কারসাজি। এদিকে অ্যাপোলোর আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। দু—একটা টাকাওলা লোক যোগাড় করে দিতে পারিস, প্রেসিডেন্ট করে রাখব।”

ক্ষিতীশের হঠাৎ মনে পড়ল বিষ্টু ধরকে। বলল ”চেষ্টা করব। কিন্তু নকুলদা, বি এ এস এ থেকে আউট হয়েছে বলে দুঃখ পাচ্ছ কেন! একটা ক্লাব ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্টেট অ্যাসোসিয়েশনের থেকে। ক্লাবই সুইমার তৈরী করে ওরা করে মোড়লি।”

”কিন্তু মোড়লদের দলাদলি ঝগড়া প্রতিপত্তির লোভ সুইমারের জীবন শেষ করে দিতে পারে।” নকুল মুখুজ্জে হেসে উঠে বলল, ”জেনে রাখ এবার অ্যাপোলোর কেউ বেঙ্গল টিমে আসছে না, শুধু ওই দুটো মেয়ে ছাড়া।” আঙুল দিয়ে সে অমিয়া আর বেলাকে দেখাল। ”ওরা, জেনে রাখ, সামনের বছরই জুপিটারে ফিরে যাচ্ছে।”

নকুল মুখুজ্জে চলে যাবার পর ক্ষিতীশ আবার কোনির দিকে মন দিল।

”হাঁটু ভেঙ্গে পায়ের পাড়ি…হাঁটু ভেঙ্গে। বলে দিয়েছি না, পা যখন পিছনে ঠেলবি তখন হাঁটু ভাঙ্গবে, ওঠার সময় সোজা থাকবে?”

এই পর্যন্ত চীৎকার করে বলেই তার মনে হল, অমিয়া বা বেলা শুনে নিয়ে যদি এইভাবে কিকিং শুরু করে! তারপরই ভাবল এখন আর ওদের পক্ষে আদ্যিকালের সিজার—কিক ছেড়ে এই শক্ত কিকিংয়ে আসা সম্ভব নয়। তা হলেও, শুনে নিয়ে ওরা হরিচরণকে বলে দিতে পারে। হরিটা অন্যদের এইভাবে শেখাবে হয়তো।

হাত নেড়ে ক্ষিতীশ ডাকল কোনিকে। পাড়ের কাছাকাছি আসতেই ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ”যা বলছিলুম হচ্ছে না কেন? গোড়ালিটা টানটান থাকবে… এইরকম পিছন দিকে টান করে ঠেলে রাখবি। আর কিক করার সময় যতটা না নিচের দিকে, তার থেকে পিছন দিকেই পায়ের ধাক্কা বেশি দিতে হবে। এইভাবে শোলান্ডার সাঁতার কেটে চারটে গোল্ড জিতেছে টোকিওয়। ….আবার কর… সিক্স বিট, এক চক্কর হাত পাড়ি আর সেই সঙ্গে ছ’টা করে পা মারবি…করে যা, করে যা।”

ট্রেনিং শেষে ফেরার পথে ক্ষিতীশ জিজ্ঞাসা করল, ”তোর দাদার খবর কি রে, আসতে বলিস একদিন। দেখে যাক কেমন তুই শিখছিস।”

কোনি জবাব দিল না। ক্ষিতীশ লক্ষ করল ওর মুখটা কেমন যেন করুণ আর গম্ভীর হয়ে উঠল।

”দাদার অসুখ হয়েছে। দু’দিন কাজে যায়নি।”

”তাহলে তো দেখতে যেতে হয়। আচ্ছা পরে একদিন দেখতে যাব। আর শোন, আজ বিকেলে তোর ওজনটা নোবো। এবার থেকে একসারসাইজ শুরু করতে হবে। খাওয়াও বাড়াতে হবে। ট্রেনিং চার্ট, ডায়ার্ট চার্ট আমি তৈরী করেছি। ভিটামিন কি কি লাগবে সেটা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। হেমোগ্লোবিন লেভেল যদি পারি তো টেস্ট করাব।”

ক্ষিতীশ কথা বলতে বলতে বাজারের কাছে এসে দাঁড়াল। একটা টাকা কোনির হাতে দিয়ে বাজারের দিকে এগোচ্ছে, কোনি ডাকল—

”ক্ষিদ্দা, আর দুটো টাকা দেবেন? তাহলে দু’দিন আর আমায় দিতে হবে না।”

”টাকা? কিসের জন্য?” ভ্রূ কুঞ্চিত হল ক্ষিতীশের।

”চাল কিনব। দাদা তো কাজে যেতে পারছে না।”

কোনি চুপ করে গিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে রইল।

প্রশ্ন না করে ক্ষিতীশ আরো দুটো টাকা দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝেও গেল, প্রতিদিন ডিম—কলা খাওয়ার জন্য যে টাকা দিয়েছে সেটা কিসে ব্যয় হয়।

ঘণ্টাখানেক পরই ক্ষিতীশ হাজির হল কোনিদের ঘরের দরজায়। তক্তপোশে ময়লা ছেঁড়া কাঁথার উপর কমল শুয়ে। একদৃষ্টে জানলার বাইরে তাকিয়ে। সব ছোট ভাইটি আর মা উনুনে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির সামনে বসে। ঘরে আর কেউ নেই। ক্ষিতীশ গলা খাঁকারি দিতে কমল তাকাল, অবাক হল এবং উঠে বসতে গিয়ে দুর্বলতার জন্য টলে পড়ল।

”আসুন। একটু আগেই কোনি বলছিল আপনি একদিন আসবেন। কি আর দেখবেন আমায়!” কমল চট করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘দেখার আর কিছু নেই। আমি ফিনিশ হয়েই গেছি।”

ক্ষিতিশ তক্তপোশের ধার ঘেঁষে বসল।

”কি হয়েছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা?”

মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে কমল মাথা হেলিয়ে বলল, ”হ্যাঁ। আপনি কিন্তু বেশিক্ষণ বসবেন না। ছোঁয়াচে রোগটা।”

”ওষুধ খাচ্ছ?”

কমল প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ”কোনির দ্বারা কিছু হবে কি? ও আমাকে রোজ বলে কি কি শিখল। খুব রোখা মেয়ে। যদি বলে করব, তাহলে করবেই। ওকে দিয়ে যদি করাতে পারেন, ওর একটা ভবিষ্যৎ যদি গড়ে দিতে পারেন—”

”হবে। প্রথম প্রথম একটু চঞ্চল ছটফটে থাকে, মন বসলে আমার মনে হয় ও কিছু একটা পারবে।”

”একটা ভাইকে চায়ের দোকানের কাজে দিয়েছি, পনেরো টাকা মাইনে। কোনিকে একটা সুতোর কারখানায় লাগিয়ে দেব ভাবছি। কথাবার্তা বলেছি, ষাট টাকা দেবে। কিন্তু ওর সাঁতার তাহলে আর হবে না।”

কোনি ঘরে ঢুকল। ক্ষিতীশকে দেখে অবাকই হল। দাদার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সে কমলের মাথায় হাত রাখল।

”আমি চাই না কোনি সাঁতার বন্ধ করুক। আমার নিজের খুব ইচ্ছে হতো বড় সাঁতারু হব, অলিম্পিকে যাব। আমার দ্বারা কিছুই হল না, এখন যদি কোনি পারে। আপনি বলছেন, ওর হবে?”

ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল, ”যদি খাটে, যদি ইচ্ছে থাকে।”

”কি রে, শুনলি তো।” কমল মুখ উঁচু করে তাকাল। ”ইচ্ছে থাকলে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। ইন্ডিয়া রেকর্ড ভাঙ্গতে হবে তোকে। তারপর এশিয়ান, তারপর অলিম্পিক। পারবি না?”

কমলের স্বর অদ্ভুত করুণ একটা আবেদনের মতো শোনাল। কোনির মুখে ধীরে ধীরে অস্বস্তি, তারপর চাপা ভয় ফুটে উঠল। ঘরের মধ্যে তখন কেউ কথা বলছে না। হাঁড়িতে ভাত ফোটার শব্দটা শুধু সেই মুহূর্তে একমাত্র জীবন্ত ব্যাপার।

কমল আবার বলল, ”পারবি না?”

কোনি আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল।

।। ৮ ।।

ক্ষিতীশ সারা সকাল অ্যাপেলোয় অপেক্ষা করেছে, কোনি আজও আসেনি। গত দু’সপ্তাহে একবেলাও সে কামাই করেনি। ক্ষিতীশ ভয়ে রয়েছে, এই বুঝি কস্ট্যুম দাবী করে বসে। এখনো সে সমানে বলে যাচ্ছে, ”হয়নি হয়নি, ইঞ্চি খানেকের বেশি জল হাত থেকে উঠবে না। … অতটা পাশের দিকে হাত যাচ্ছে কেন—ওকি, দুটো হাত ঠিকমতো সমানে চলছে না কেন?”

বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিতীশ মাথা নাড়ে। আর ভাবে কস্ট্যুম আজই কিনতে হবে দেখছি। কখনো কখনো সে জলে নেমে সাঁতার কেটে স্ট্রোক দেখিয়ে দেয়। ওদের পাশ দিয়েই অন্যরা সাঁতার কেটে যায়, বেলা গড়িয়ে যায়, কমলদিঘির জল জনশূন্য হয়ে আসে। কোনি যখন বিরক্ত হয়ে ওঠে, ক্ষিতীশ বলে, ”দাদার কাছে তো খুব ঘাড় নেড়েছিলিস! ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ওঠা খুব সহজ ব্যাপার ভেবেছিস! রেকর্ড করাটা গঙ্গায় আম কুড়োনো নয়, বুঝলি?” ফেরার পথে গল্প করেছে পৃথিবীর বড় বড় সাঁতারুর, তাদের আন্তরিকতার, নিষ্ঠার, পরিশ্রমের।

অপেক্ষা করে অবশেষে ক্ষিতীশ বেরিয়ে পড়ল অ্যাপোলো থেকে। বিষ্টু ধরের বাড়ি পৌঁছল মিনিট দশেকের মধ্যে। তাকে দেখেই বিষ্টু ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এই একটু আগে দর্জিপাড়া বয়েজ লাইব্রেরির লোকেরা এসেছিল ওদের অ্যানুয়াল সোশ্যালে চিফ গেস্ট করার জন্য। প্রেসিডেন্ট হবে কে জানেন? ঐ বিনোদ ভড়। আমি রাজী হয়ে গেছি। ওখানে দারুণ একটা ইস্পিচে ওকে ডাউন দিতে হবে। বুঝলেন, ক্ল্যাপ ওকে পেতে দোব না।”

বিষ্টু ধরের উত্তেজিত মুখ দেখে ক্ষিতীশ চটপট মতলব ভেঁজে নিয়ে বলল ”শুধু একটা বক্তৃতায় ডাউন দিয়ে কি লাভ হবে। লোকে কিছুদিন মনে রেখে তো ভুলে যাবে। তার থেকে এমন একটা কিছু দরকার যাতে বিনোদ ভড় রেগুলার ডাউন খায়।”

”কি রকম?” বিষ্টু কৌতূহল দেখাল। ”রেগুলার ডাউন কিভাবে সম্ভব!”

”ভাবতে হয়েছে, তিনদিন ধরে ভেবেছি।” ক্ষিতীশ নিজেকে গুরুত্ব দেবার জন্য গলার স্বর ভারিক্কি করে তুলল । ”ভেবে দেখলুম বিনোদ ভড় যে যে অর্গানাইজেশনে আছে,তার পাল্টাগুলোয় ঢুকতে হবে। ও যদি ড্রামা ক্লাবে থাকে, আপনাকেও একটি হরিসভায় ঘাঁটি করতে হবে। ও যদি কোন সুইমিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়…”

”আছে!” বিষ্টু ধর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ”জুপিটারের প্রেসিডেন্ট বিনোদ ভড়।”

ক্ষিতীশ মাথা হেলিয়ে বলল, ”আপনাকে জুপিটারের রাইভল ক্লাবে ঢুকতে হবে।”

”সেটা তো অ্যাপেলো। কিন্তু ঢুকব কি করে?” বিষ্টু ধর বিমর্ষ গলায় বলল। ”পারেন একটা কিছু করে দিতে?”

”চেষ্টা করতে হবে। আজও আমি নকুল মুখুজ্জের সঙ্গে কথা বলেছি। সাত হাজারের কমে রাজী হচ্ছে না।”

”সাত হাজার! মানে?”

”মানে, প্রেসিডেন্ট হতে গেলে ডোনেশান তো দিতে হবে। অমনি অমনি কি আর হওয়া যায়। বিনোদ ভড়ও তলায় তলায় চেষ্টা করছে ওর দাদাকে অ্যাপোলোয় ঢোকাবার জন্য। পাঁচ হাজার পর্যন্ত অফার করেছে।”

”কিন্তু সাত হাজার! কমসম করা যায় না?”

”কতো কমাবেন? পাঁচ হাজার অফার তো পেয়েই গেছে। বিনোদ ভড় এম এল এ, মন্ত্রী হবারও চান্স খুব, ওকে তো সবাই হাতে রাখতে চাইবে। আপনি যদি বেশি টাকা না দেন তাহলে ওদের লাভটা কি হবে বলুন?”

”তা তো বটেই!” বিষ্টু ধর চিন্তিত হয়ে পেটে হাত বুলোতে লাগল।

ক্ষিতীশ কিছুক্ষণ ওকে লক্ষ করে আবার বলল, ”দেরী করলে চলবে না। দু—একদিনের মধ্যেই ঠিক করে ফেলতে হবে। বিনোদের পার্টি উঠে—পড়ে লেগেছে।”

”বেশ সাত হাজারই দোব। কিন্তু…”

বিষ্টু ধরের কথা শেষ হবার আগেই চাকর ঘরে ঢুকে জানাল, একজন মাইজি’ দেখা করতে এসেছে।

এরপর ক্ষিতীশকে অবাক করে ঘরে ঢুকল লীলাবতী। ক্ষিতীশকে এখানে দেখে সেও অবাক। তবে কোন কথা বলল না।

”টাকাটা এনেছি।” লীলাবতী তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যে বিষ্টু ধরকে বলল।

ব্যস্ত হয়ে বিষ্টু বলল, ”পাশের ঘরে আসুন, আপনার রসিদ—টসিদ সব রেডি করা আছে।”

ওরা দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং মিনিট পাঁচেক পরই বিষ্টু একা ঘরে ফিরে এল। ক্ষিতীশ তখন কৌতূহলে ফেটে পড়ার মতো অবস্থায়।

”কি ব্যাপার, কিসের টাকা?”

”ওই একটা ঘর নেওয়ার ব্যাপারে। হাতিবাগানে আমার একটা বাড়িতে, এরা দোকান করবে টেলারিং শপ। তাই কিছু টাকা দিয়ে গেল।”

”পাঁচ হাজার টাকা!”

বিষ্টু ধর চমকে উঠল। ”কি করে জানলেন!”

”টাকাটা যার কাছ থেকে নিলেন সে আমার স্ত্রী। ওর কাছ থেকে সেলামি নেওয়া মানে আমার কাছ থেকেই নেওয়া।”

বিষ্টু ধর ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল ক্ষিতীশের গম্ভীর মুখ দেখে। তোতলা স্বরে বলল, ”আমি তো তা জানতাম না।”

”আমিও জানতাম না আপনিই বাড়িওলা। যাই হোক, এবার আমরা দুজনেই জানলাম। জানার পর, আপনি কি টাকাটা এখন নেবেন?”

বিষ্টু আরো তোতলা হয় গেল। ”ইয়ে এটা তো ব্যবসার ব্যাপার…আমাকে তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে।”

ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল। ”চলি। বিনোদ ভড় কোর্টে বেরিয়ে গেছে। তা রাত্তিরেই দেখা করব ওর সঙ্গে।”

”না না প্লিজ যাবেন না।”

”হাজার দুয়েক টাকা ডোনেশন আর একটা নাইলনের কি বেলনের কস্ট্যুম কেনার জন্য একশো টাকা যদি দিতে পারেন তা হলে গ্যারান্টি দিচ্ছি অ্যাপোলোর প্রেসিডেন্ট করে দেবই। তবে এই সেলামির টাকটা ফেরত দিতে হবে। তাছাড়া বক্তৃতাও আমি আর লিখে দিতে পারব না।”

বিষ্টু ধর চূর্ণ বিচূর্ণ। কথা বলার আর ক্ষমতা নেই। দুই চোখ ছলছলিয়ে উঠছে। শুধু মাথাটি নেড়ে বলল, ”গাছে অনেক দূর উঠে গেছি। মই কেড়ে নিলে নামতে পারব না।”

বিষ্টু ধর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং একশো টাকার নোটের বান্ডিল নিয়ে ফিরে, সেটা ক্ষিতীশের হাতে দিয়ে বলল, ”উনি আপনার স্ত্রী হন তো?”

”আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি!”

বিষ্টু জিভ কেটে কান মুলল। ক্ষিতীশ আর অপেক্ষা করল না। বেরিয়ে আসছে, তখন শুনল বিষ্টু কাতর কণ্ঠে বলছে, ”আমার বক্তৃতাটার কি হবে!”

”দোব দোব, লিখে দোব।”

বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশ নোটের বাণ্ডিলটা নিজের বাক্সে রেখে দিয়ে ভাবতে শুরু করল, এবার কি করবে! টাকাগুলো লীলাবতীকে ফেরত দিতেই হবে, কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু আদায়ও করে নিতে হবে। এবং তা করতে হবে কোনিরই জন্য।

লীলাবতী বাড়িতে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল, ”ওখানে তুমি কি করছিলে?”

”মাঝে মাঝে যাই বুদ্ধি পরামর্শ দিতে। তুমি কেন গেছলে?”

”ওর কাছ থেকেই তো ঘর নিয়েছি। সেলামির টাকাটা দিতে গেছলুম।”

ক্ষিতীশ হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, ”আগে যদি আমায় বলতে তাহলে টাকাটা দিতে হতো না। আমি বারণ করলে বিষ্টু ধরের সাধ্যি নেই টাকা নেবার, তবে বললে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে।”

”দ্যাখো না একবার বলে, অনেকগুলো টাকা। দেবার সময় গা করকর করছিল।” লীলাবতী ব্যগ্র হয়ে বলল।

”কিন্তু কোনিকে যে ওর বাড়িতেই খাওয়ার ব্যবস্থা করব ভাবছিলাম। এরপর কি অতগুলো টাকা ফেরত দেবার কথা বলা যায়! মেয়েটাকে যে খাটাব, তার জন্য কিছু তো করতে হবে! দাও গামছাটা, চান করে আসি।”

বিকেলে লীলাবতী অন্য মূর্তি ধরে বলল, ”পরের মেয়ের জন্য তো খুব মাথা—ব্যথা। আর আমি যে এত কষ্ট করে দোকানটা দাঁড় করালাম, তিল—তিল করে টাকা জমিয়ে ব্যবসাটা বড় করার চেষ্টা করছি, তাতে একটু সাহায্যও কি করবে না!”

ক্ষিতীশ বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবার আগে শুধু বলে গেল, ”আচ্ছা দেখছি।”

”অ্যাপোলোয় সারা বিকেল অপেক্ষা করল ক্ষিতীশ, কোনি এল না। নকুল মুখুজ্জের সঙ্গে দেখা হল।

”প্রেসিডেন্ট পেয়েছি, কত টাকা ডোনেশান চাও, নকুলদা?”

নকুল একটু হকচকিয়ে বলল, ”কত টাকা মানে? এখন বটুবাবু পাঁচশো দিচ্ছে, তাও টিপে টিপে দেয়।”

”ঠিক আছে। আমি দু’হাজারী ধরেছি।”

ক্ষিতীশ তারিয়ে তারিয়ে নকুল মুখুজ্জের অবস্থাটা লক্ষ করার পর বিষ্টু ধর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে বলল, ”কিছু ভেব না তুমি, টাকা এসে যাবে। তবে আমার ওই মেয়েটার পুরো ট্রেনিং ফেসিলিটি দিতে হবে কিন্তু।”

নকুল মুখুজ্জে একগাল হেসে মাথাটা হেলিয়ে বলল, ”নিশ্চয়।”

অ্যাপোলো থেকে বেরিয়ে ক্ষিতীশ ভাবল, মেয়েটা কেন আজ এল না, একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। বড্ড ফাঁকিবাজ। কিছুর একটা লোভ না দেখালে খাটতেই চায় না। তবে একটা দুর্বলতা আছে, সেটা ওর অপমানবোধ। ক্ষিতীশের প্রায়ই মনে পড়ে, প্রাইজ না নিয়ে লেক থেকে কোনির চলে আসা আর ঘুরে দাঁড়িয়ে তার বিজয়ীর নামটি শোনার সেই ভঙ্গিটি। দাদার কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে থাকা মেয়েটি হঠাৎ যেন দপ করে জ্বলে উঠেছিল।

বস্তির মধ্যে আলো নেই। ক্ষিতীশ একটু অসুবিধায় পড়ল ঘরটা খুঁজে বার করতে। অবশেষে একটা বাচ্চচা ছেলে তাকে দেখিয়ে দিল। ঘরের মধ্যে কুপি জ্বলছে। কোনির ছোট ভাই দুটো মেঝেয় ঘুমিয়ে। তক্তপোশে সম্ভবত ওর মা শুয়ে। ক্ষিতীশ ডাকল, ”কোনি।”

ঘর থেকে নিঃশব্দে কোনি বেরিয়ে এল।

”ব্যাপার কি তোর! আজ যাসনি কেন? এভাবে কামাই দিলে, আর তাহলে যেতে হবে না। তোর দাদাকে আমি জানিয়ে দেব, হবে—টবে না কিছু তোর দ্বারা।” বিরক্তস্বরে ক্ষিতীশ বেশ জোরেই কথাগুলো বলল।

কোনি কথা না বলে একইভাবে দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ ক্ষিতীশের পিছন থেকে খনখনে স্বরে কে বলে উঠল, ”কেমন লোক গা তুমি, কাল রাতে মেয়েটার দাদা মরে গেল আর তুমি এখন তাকে ধমকাতে নেগেছ?”

ক্ষিতীশ প্রথমে বুঝতে পারেনি সে কি শুনল। পিছনে তাকিয়ে বলল, ”কে মরে গেছে?”

”জান না দেখছি! কাল বিকেল থেকে মুখে অক্ত উঠল, ভলকে ভলকে, রাত্তিরেই কাবার। কোনির দাদা গো!”

ক্ষিতীশ বার দুয়েক কেঁপে উঠল এবং শুনল কোনি খুব ক্লান্ত এবং শান্ত স্বরে বলছে, ”ক্ষিদ্দা, এবার আমরা কি খাব?”

।। ৯ ।।

রাগে চীৎকার করে উঠল ক্ষিতীশ, ”পারতেই হবে, পারতেই হবে। কোন কথা শুনব না।”

পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঢিলটা তুলে সে কোনির দিকে ছুঁড়ে মারল।

”পায়ে পড়ি ক্ষিদ্দা, আর আমি পারছি না।”

”মাথা ফাটিয়ে দোব তোর…মরে যা তুই… মরে যা, মরে যা।” ক্ষিতীশ ঢিল খুঁজে পেল না। এধার ওধার তাকিয়ে মালির ঘরের গায়ে দাঁড় করানো সরু বাঁশের লগাটাকে দেখতে পেল।

”ক্ষিদ্দা, আমি আর পারব না।”

ক্ষিতীশ রেলিং টপকে ছুটে গিয়ে লগাটা আনল। কোনি পাড়ের কাছে এগিয়ে এসেছে। ক্ষিতীশ দু’হাতে লগাটা তুলে জলে আঘাত করল। কোনির মুখের হাত তিনেক সামনে সেটা পড়ল। আবার সে লগাটা দু’হাতে উঁচু করে জলে আঘাত করল।

”মাথা ভেঙ্গে দেব। জল থেকে উঠবি তো মরে যাবি। এখনো দুশো মিটার বাকি।”

কোনি জল থেকে ওঠার জন্য পশ্চিমের স্টাটিং প্ল্যাটফর্মের পিছন দিকে এগোতেই ক্ষিতীশ লগা তুলে পাড় ধরে ছুটল। কোনি থমকে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের কিনার ধরে উঁকি দিতে লাগল। ক্ষিতীশ প্ল্যাটফর্মে উঠতে পারছে না, কেননা পাড় থেকে সেটা অন্তত বারো হাত দূরে এবং মাঝে কোন সেতু নেই।

”ক্ষিদ্দা ক্ষিদ্দা, আমায় এবেলা ছেড়ে দাও। ওবেলা আমি পুষিয়ে দোব।” কোনি ফোঁপাচ্ছে।

”কোন কথা আমি শুনতে চাই না। আমার রুটিন অনুযায়ী কাজ চাই। যতক্ষণ না কাজ পাচ্ছি আজ তোকে উঠতে দোব না।”

প্ল্যাটফর্ম ধরা দু’হাতের মধ্যে মুখটা গুঁজে কোনি কাঁদছে। ক্ষিতীশ পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে। সকাল ন’টা বেজে গেছে। কমলদিঘির জলে আর কেউ নেই এখন। বেঞ্চগুলোয় অনেকেই বসে, কমলদিঘির ভিতরের পথ দিয়ে পথিকের আনাগোনা। তাদের অনেকে কৌতূহলে তাকাচ্ছে ক্ষিতীশের দিকে। কেউ কেউ দাঁড়িয়েও পড়ছে।

কোনি সাঁতরাচেছ। পশ্চিম থেকে পুবের প্ল্যাটফর্মের দিকে। ক্ষিতীশও লগা হাতে পাড় ধরে পুবদিকে হাঁটছে। বিশ্বাস নেই, হয়তো ওপারে পৌঁছেই কোনি জল থেকে উঠে পড়তে পারে।

ওর ক্লান্ত হাত দুটো যেন কেউ জল থেকে টেনে তুলে আবার নামিয়ে রাখছে। মুখ ফিরিয়ে হাঁ করে বাতাস গিলছে। তখন চোখ দুটো দেখাচ্ছে যেন ঘুমে আচ্ছন্ন। গলায় ঝোলান স্টপওয়াচটা মুঠোয় ধরে ক্ষিতীশ বিড়বিড় করে আপন মনে বকে যাচ্ছে: জানি রে, জানি কষ্ট হচ্ছে, হাত—পা খুলে খুলে আসছে, কলজে ফেটে যাচ্ছে। যাক যাক, তুই যন্ত্রণা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যা। তুই জানিস ক্ষিদে যখন থাবা মারে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, তখন কেমন লাগে। তুই পারবি বুঝতে যন্ত্রণা কি জিনিস। ফাইট কোনি ফাইট—

…মার খেয়ে ইস্পাত হয়ে উঠতে হবে। যন্ত্রণাকে বোঝ, ওটাকে কাজে লাগাতে শেখ, ওটাকে হারিয়ে দে। …কাম অন কোনি, জোর লাগা, আরো জোরে—

… ট্রেনিং করে করে নিজেকে বাড়াতে হবে কোনি। যন্ত্রণাকে তুই বল, ‘দেখে নেব আমাকে কাঁদাতে পারিস কিনা, আমাকে ভয় দেখাতে পারিস কিনা,’ বলে যা কোনি, ‘ক্ষিদ্দা তোমাকে খুন করব। তুমি শয়তান, ছিঁড়ে খাবো তোমাকে।’ কমলদিঘিকে টগবগ করে ফুটিয়ে তোল তোর রাগে।

…মানুষের ক্ষমতার সীমা নেই রে, ওরা পাগলা বলছে, বলুক। মূর্খ, মূর্খের দল সব। ঘণ্টাখানেক আরামে হাত—পা ছুঁড়িয়ে ওরা চ্যামপিয়ন বানাবার স্বপ্ন দেখে। … ট্রেনিং ট্রেনিং—

—আরো পঞ্চাশ মিটার এখনো যেতে হবে, শরীরটাকে যন্ত্রণায় ঘষে ঘষে শানিয়ে তোল। দেখবি কি অবাক তোকে করে দেবে ওই শরীর, যা অসম্ভব ভাবছিস তাকে সম্ভব করে দেবে। সোনার মেডেল ফেডেল কিছু নয় রে, ওগুলো এক একটি চাকতি মাত্র। ওগুলোর মধ্যে যে কথাগুলো ঢুকে আছে সেটাই আসল—মানুষ পারে, সব পারে।

কোনি সাঁতার শেষ করে দু’হাতে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁপাচ্ছে মাথা নিচু করে। একবার সে মাথা ঘুরিয়ে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। দু’চোখে ঘৃণা আর আক্রোশ। ক্ষিতীশ সেটা লক্ষ করল। লগাটা যথাস্থানে রেখে সে ক্লাবে ঢুকে একটা মোটা খাতা খুলে বসল। এটা কোনির লগ—বুক। প্রতি বেলার ট্রেনিং—এ কাজের ও সময়ের হিসাব ছাড়াও খাওয়ার, ওজনের, নাড়ির স্পন্দনের, রক্তের হেমোগ্লোবিন স্তর পরীক্ষার, আয়রন ও ভিটামিন ট্যাবলেটের তালিকাও এতে লেখা আছে।

লগ—বুকে লিখতে লিখতে ক্ষিতীশ দেখল কোনি ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল ক্লাব থেকে। প্রতিদিন বেরোবার আগে একবার ‘যাচ্ছি’ বলে যায়। আজ বলল না। ক্লাব থেকে কোনি যায় ক্ষিতীশের বাড়ি। সেখানেই ওর খাওয়া। ঠিক দশটায় তাকে ‘প্রজাপতি’—র রোলার শাটারের তালা খুলতে হয়। দোকান ঝাঁট দিয়ে, কাউন্টার মুছে, কুঁজোয় জল তুলে, তাকে ফাইফরমাশ খাটতে হয়। দুপুরে আবার আসে ভাত খেতে। তখন ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে পনেরো মিনিট ব্যায়াম করে অ্যপোলোয় যেতে হয়। সাঁতার থেকে আবার প্রজাপতিতে। দোকান বন্ধ করে সে লীলাবতীর সঙ্গে ফেরে। রাত্রে খেয়ে ফিরে যায় বস্তিতে মা ও ভাইয়েদের কাছে। কোনি মাইনে পায় চল্লিশ টাকা।

আজ কোনির দেরী হয়ে গেছে। ক্ষিতীশের বাড়ি না গিয়ে, সে প্রায় ছুটতে ছুটতে প্রজাপতিতে এল। লীলাবতী নিজেই দোকান খুলেছে। পাশের ফোটগ্রাফি দোকানের ছেলেটি ভারী শাটারটা তুলে দিয়ে গেছে। লীলাবতী ওকে দেখেই রাস্তার দিকে আঙুল তুলে বলল, ”বেরিয়ে যাও। তোমায় আর দরকার নেই।”

ফ্যাকাসে হয়ে গেল কোনির মুখ। মুখ নামিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকল। এই সময় খদ্দের আসায় লীলাবতী আর কিছু বলল না। কোনি একে একে তার কাজগুলো করে গেল। ক্লান্তিতে এবং খিদেয় তখন সে ঝাপসা দেখছে, পা টলছে। তার খুব ঘুমোতে ইচেছ করছে কিন্তু দোকানে বসার মতো জায়গাও তার জন্য নেই। একবার সে ভয়ে ভয়ে লীলাবতীকে বলল, ”বৌদি, একটু বাড়ি যাব?”

বিরাট একটা মোটা খাতার উপর ঝুঁকে ফ্রকের মাপ লিখতে লিখতে লীলাবতী কড়া স্বরে বলল, ”না।”

কোনি সরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। কাজটা থেকে বরখাস্ত হলে চল্লিশটা টাকা থেকে তাদের সংসার বঞ্চিত হবে।

ওদিকে ক্ষিতীশ বড় একটা থলি হাতে অ্যাপোলো থেকে বেরিয়ে তখন একটার পর একটা দর্জির দোকান ঘুরছে কাপড়ের ছাঁট কেনার জন্য। তিনটে লন্ড্রির সঙ্গে তার বন্দোবস্ত হয়েছে। মার্কা দেওয়া নম্বর টুকরো কাপড় লিখে জামাকাপড়ে বেঁধে কাঁচতে পাঠাবার জন লন্ড্রিগুলোর দরকার হয় এই ছাঁট। ছাঁট থেকে সমান মাপে কাপড় টুকরো করে কেটে ক্ষিতীশকে বিক্রি করতে হয়। ওরা দৈনিক প্রায় তিন কিলো কেনে। ক্ষিতীশ টাকা ছয়—সাত লাভ করে।

দুপুর প্রায় একটা নাগাদ ক্ষিতীশ ছাঁট ভর্তি থলি নিয়ে কোনিদের ঘরের দরজায় হাজির হল। কোনির মা বেরিয়ে আসতেই সে ঝাঁজিয়ে উঠল, ”কাল রাতে কোনি কখন ঘুমিয়েছিল?”

”কেন, রোজ যেমন সময়ে ঘুমোয়।” জড়োসড়ো হয়ে কোনির মা বলল।

”ঠিক বলছ?” ক্ষিতীশ তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। ”আজ এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ল কেন তাহলে? দ্যাখো মেয়ে, আমার কাছে কিছু লুকোলে কিন্তু ঠিক ধরা পড়ে যাবে। ঠিক করে বলো, কখন কোনি ঘুমিয়েছে।”

”না বাবা, আপনার কাছে মিছে বলব না। কাল রাতে কোনি যাত্রা শুনতে গেছল। রাত একটা নাগাদ ফিরে শুয়েছে।”

”হুঁ।” থলিটা এগিয়ে দিয়ে ক্ষিতীশ বলল, ”এগুলো কেটে রেখো, আজই, কাল সকালে কোনির হাত দিয়ে ক্লাবে পাঠিও।”

পাঁচটা টাকা কোনির মার হাতে দিয়ে, ফেরার আগে ক্ষিতীশ বিষণ্ণ স্বরে বলল,”ছোট মেয়ে,ওর তো সখ হবেই। কিন্তু ওর ভালর জন্যই তোমাকে কড়া হতে হবে। কে কোন খেলা সাধনার জিনিষ। সিদ্ধিলাভ করতে হলে সন্ন্যাসীর মতোই জীবন যাপন করতে হয়। বহু ছোটখাট ব্যাপার আছে সাধনার পক্ষে যা ক্ষতিকর। যাত্রা নিশ্চয় দেখবে, কিন্তু এখন এই ট্রেনিংয়ের সময় বিশ্রাম নষ্ট করে নয়। এগুলো তোমায় বুঝতে হবে।”

বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশ দেখল লীলাবতী অপেক্ষা করছে। তখুনি সে খেতে বসে গেল। খেতে খেতে খুবই সাধারণভাবে জিজ্ঞাসা করল, ”কোনি খেয়েছে?”

লীলাবতী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ”ওকে দিয়ে, আমার কোন কাজ হবে না, ঝিমোয় শুধু। বসতে দিই না, দাঁড়িয়েই আজ ঘুমোচ্ছিল।”

”আজ ওকে খুব খাটিয়েছি।”

”তাতে আমার কি লাভ। পাঁচ হাজার টাকা বাঁচিয়ে দিয়ে অন্যদিক থেকে সেটা নিয়ে নিচ্ছ।”

”ওর খাওয়ার জন্য তো মাসে পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি।”

”রোজ দুধ ডিম মধু, মাসে পঞ্চাশ টাকায় কি হয়।”

ক্ষিতীশ তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে উঠে পড়ল। ঘরে এসে দেখে কোনি মেঝেয় অকাতরে ঘুমোচ্ছে। বালিশের বদলে দুটি হাত জড়ো করে মাথার নিচে রাখা। ক্ষিতীশ ওর পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। একটু পরেই কোনি নড়ে উঠে আরো গুটিসুটি হয়ে সরে এল ক্ষিতীশের দিকে। বিড়বিড় করে কি যেন বলল। ক্ষিতীশ ঝুঁকে পড়ল শোনার জন্য।

”দাদা?”

”হ্যাঁ।”

একটা পাতলা হাসি কোনির মুখে চারিয়ে গেল। ”আমায় কুমীর দেখাবে বলেছিলে।”

”দেখাব, চিড়িয়াখানায় তোকে নিয়ে যাব।” ফিসফিস করে ক্ষিতীশ বলল। ”আরো অনেক জায়গায় আমরা যাব—বেলুড় মঠ, ব্যান্ডেল চার্চ, ডায়মন্ড হারবার, জাদুঘর, অনেক অনেক জায়গায়। তারপর তুই যাবি দিল্লী, বোমবাই, মাদ্রাজ; তারপর যাবি আরো দূরে টোকিও, লন্ডন, বার্লিন, মস্কো, নিউইয়র্ক।”

ঘুমের মধ্যেই কোনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

”ক্ষিদ্দা আমাকে কষ্ট দেয় দাদা। আমি ঠিক মেডেল এনে দোব তোমায়।”

কোনি মুখে হাসি নিয়ে ঘুমের মধ্যে ডুবে গেল। ক্ষিতীশ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ”তোকে আরো কষ্ট দেব রে, আরো দেব।”

রবিবার প্রজাপতি বন্ধ থাকে। সেদিন কোনির ট্রেনিংয়েও ছুটি। ক্ষিতীশের কাঁধে ঝুলছে থলি। তাতে আছে, কাগজের মোড়কে রুটি, আলু ছেঁচকি, গুড়, সিদ্ধডিম আর কলা।

ওরা দুজন বাড়ি থেকে দশটায় বেরিয়েছে। চিড়িয়াখানায় ঘণ্টা তিনেক ঘুরে পুকুরধারে ঘাসে বসেছে। ক্ষিতীশ খাবারের মোড়ক দুটো বার করে বলল, ”জল খাওয়াটাই মুশকিল হবে। ওয়াটার বটলটা আনলে হতো।”

ওদের থেকে কিছু দূরে স্কুল ইউনিফর্ম পরা জনা তিরিশ মেয়ে হৈ চৈ করে হাজির হল। সঙ্গে চারজন টিচার। দুজন দরোয়ান খাবারের ঝুড়ি বয়ে আনল। ওরা গোল হয়ে খেতে বসেছে। কোনি কৌতূহলভরে মাঝে মাঝে ওদের দিকে তাকাচ্ছে। আর রুটি চিবোচ্ছে।

”ক্ষিদ্দা, ওদের কাছে জল আছে। চাইব?”

”কি করে বুঝলি?”

”ওই তো বড় ড্রামটা থেকে জল দিচ্ছে।”

”দ্যাখ তাহলে।”

কোনি এগিয়ে গেল ড্রামের কাছে দাঁড়ানো টিচারের দিকে। ক্ষিতীশ দেখল, কোনি তাকে কিছু বলতেই তিনি কোনিকে আপাদমস্তক দেখে মুখ ফিরিয়ে কি একটা জবাব দিলেন। তাইতে কোনি অপ্রতিভ হয়ে ফিরে এল।

”দিল না তো।”

কোনির মুখটা থমথমে। শুধু বলল, ”বড়লোকদের মেয়েদের স্কুল।”

”তাই দিল না বুঝি!” ক্ষিতীশ কৌতুকের সুরে বলল।

”বড়লোকরা গরীবদের ঘেন্না করে।”

ক্ষিতীশ এবার একটু অবাক হল। এইসব ধারণা এইটুকু কোনির মাথায় ঢুকল কি করে!

”তোকে কে বলল, বড়লোকরা গরীবদের ঘেন্না করে?”

”আমি জানি। দাদা আমায় বলেছিল, টাকা থাকলেই সবাই খাতির করে।”

”চল, জল খেয়ে আসি কল থেকে।”

ওরা দু—চার পা এগিয়েছে, তখনই একটি মেয়ে ”শুনুন, শুনুন” বলতে বলতে ছুটে এল। হাতে জলভরা প্লাস্টিকের দুটি গ্লাস।

ওরা ঘুরে দাঁড়াল। এবং দুজনেই চিনতে পারল জলের গ্লাস হাতে মেয়েটি হিয়া মিত্র।

”আপনারা জলে চেয়েছিলেন না? আমাদের মিস নন্দী বড্ড কড়া মেজাজের। ওর ব্যবহারের জন্য মাপ চাইছি।”

হিয়া জলভরা একটা গ্লাস এগিয়ে ধরল কোনির সামনে। কোনি তখন অদ্ভুত আচরণ করে বসল। ধাঁ করে সে গ্লাসে আঘাত করল হাত দিয়ে। গ্লাসটা হিয়ার হাত থেকে ছিটকে ঘাসে পড়ল। হতভম্ব শুধু হিয়াই নয়, ক্ষিতীশও।

”চাই না তোমাদের জল। আমাদের কলের জলই ভাল।”

কোনি হন হন করে একাই এগিয়ে গেল। ক্ষিতীশ অপ্রতিভ হয়ে বলল, ”আমি মাপ চাইছি এবার তোমার কাছে।”

হিয়া ব্যথিত মুখে বলল, ”এই গ্লাসের জলটা তাহলে আপনি খান।”

”নিশ্চয় নিশ্চয়।”

কোনিকে দারুণ বকবে ভেবেছিল ক্ষিতীশ। কিন্তু সে কিছুই বলেনি। হিয়াই যে কোনির ভবিষ্যৎ প্রতিদ্বন্দ্বী এটা ক্ষিতীশ বুঝে গেছে। বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবে চারদিন সে গেছে নিছকই পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করার ভান করে। হিয়ার ট্রেনিং সে দেখেছে। শুধু তাই নয়, পকেটে হাত ঢুকিয়ে লুকিয়ে স্টপওয়াচে হিয়ার পুরো দমে সাঁতারের সময় নিয়েছে। ক্ষিতীশের মনে হয়েছে, হিয়ার প্রতি কোনির হিংস্র আক্রোশটা ভোঁতা করে দেওয়া ঠিক হবে না। এটা বুকের মধ্যে পুষে রাখুক। এটাই ওকে উত্তেজিত করে বোমার মতো ফাটিয়ে দেবে আসল সময়ে।

ক্ষিতীশ তাই বকুনি দেওয়ার বদলে বলেছিল, ”হিয়া তখন আমাকে কি বলল জানিস? বলল, মেয়েটা আমার কাছে মার খেয়েছে তাই জ্বলে পুড়ে মরছে।”

এরপর ক্ষিতীশ লক্ষ করল কোনি জল থেকে উঠতে দেরী করছে।

।। ১০ ।।

দুর্গা পুজোর আগেই ক্লাবগুলোর প্রতিযোগিতা একটার পর একটা হয়ে গেল। ক্ষিতীশ একটিতেও কোনিকে নামায়নি, এমনকি অ্যাপোলোর প্রতিযোগিতাতেও নয়। যদিও এখন তার সময় অমিয়ার সময়ের প্রায় সমান, তবু ক্ষিতীশের ধারণা এখনো তার প্রকাশের উপযুক্ত সময় আসেনি। হিয়ার সময় এখন কত, সেটা না জানা পর্যন্ত কোনিকে সে বার করতে চায় না। এখন অনেকেই জেনে গেছে, ক্ষিতীশ একজন সাঁতারু তৈরী করছে। বালিগঞ্জ ক্লাবে সে গেলেই প্রণবেন্দুর নির্দেশে হিয়া এমনভাবে সাঁতার কাটে কিংবা জল থেকে উঠে পড়ে, যার ফলে ক্ষিতীশ ওর সময় নিতে পারে না। হিয়াও কোন প্রতিযোগিতায় নামেনি। তাইতে ক্ষিতীশ কিছুটা ভাবনায় পড়ল। প্রত্যেক ক্লাবের, এমনকি স্টেট চ্যামপিয়নশিপের ভিকট্রি স্ট্যান্ডেও অমিয়া আর বেলাকে উঠতে দেখা গেল।

একদিন খবরের কাগজে একটা খবর দেখে ক্ষিতীশ কেটে রেখে দিল। বোম্বাইয়ে মহারাষ্ট্র স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে রমা যোশি নামে একটি মেয়ে ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে সময় করেছে ১ মিনিট ১২ সেকেন্ড। এক—কুড়ির উপরে সময় করাই ভারতীয় মেয়েদের রেওয়াজ, সেখানে এক বারো! ক্ষিতীশ এরপর কোনির ট্রেনিং আরো কঠিন করে তুলল।

এবার জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ দিল্লীতে। পুজোর পর বাংলা দল রওনা হয়ে গেল। অমিয়া মেয়েদের দলের অধিনায়িকা। বাংলার মেয়েরা একটি সোনা দুটি রুপো, দুটি ব্রোঞ্জ নিয়ে ফিরল। সোনাটি অমিয়ার ১০০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে। রমা যোশি একাই ছয়টি সোনা জিতল চারটি ব্যক্তিগত রেকর্ড করে।

শীত এসে গেছে। কমলদিঘির জলও কমে গেছে। সোয়েটার পরা লোকেরা এখন সেখানে বেড়ায়। কেউ আর জলে নামে না। কিন্তু অব্যাহত কোনির দুবেলা জলে নামা। আপত্তি করেছিল অনেকেই। ক্ষিতীশ জবাবে শুধু বলেছে, ”যদি পারে তাহলে নামবে না কেন? সারা বছরই ট্রেনিংয়ে থাকা দরকার। প্র্যাকটিশ চাই, প্র্যাকটিশ। মুভমেন্টগুলো যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়, স্বাভাবিক হয়ে আসে। তা না হলে স্পীড বাড়ান যাবে না। এদেশে মাত্র ছ’মাস সাঁতার হয়, তাই তো এই শোচনীয় দশা।”

কোনিকে বাকি তিনটি স্ট্রোকও ক্ষিতীশ ইতিমধ্যে শিখিয়ে দিয়েছে। ফ্রি স্টাইল, বাটার ফ্লাই, ব্যাক এবং ব্রেস্ট এই চার রকমের স্ট্রোক মিলিয়ে কোনি এখন দিনে দু’মাইল হাড়ভাঙ্গা সাঁতার কাটে। কঞ্চির মতো শরীরটার ওজন বেড়ে হয়েছে ৫০ কেজি।

বছর ঘুরে নতুন বছর এল।

একদিন ভেলো, প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়ানো ক্ষিতীশকে বলল, ”ক্ষিদ্দা, এ বছর ওকে কম্পিটিশনে নামাবে তো?”

ক্ষিতীশ তখন কোনির দুটো পায়ের গোছ বাঁধছিল রবারের দড়ি দিয়ে। পা বাঁধা অবস্থায় শুধু মাত্র হাতের পাড়িতে ওকে ‘পুল’ করতে হবে। ক্ষিতীশ অন্যমনস্কের মতো বলল, ”সিজন শুরু হয়ে গেছে?”

”সিজন কি তোমার জন্য বসে থাকবে নাকি। কর্পোরেশন তো অনেকদিন কমলদিঘিতে জল ছেড়েছে, হুঁশ নেই—”

ভেলো কথা থামিয়ে ফেলল। ক্ষিতীশ হাত তুলে রয়েছে। কোনি স্টার্টিং পজিশ্যনে।

”অন ইওর মার্ক… গেট সেট….” ক্ষিতীশ হাতটা নামাল। কোনি ঝাঁপাবার সঙ্গে সঙ্গে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে পিছন ফিরে বলল, ”কি বলছিলিস?”

”হরিচরণরা ভয় পেয়ে গেছে।”

ভেলোর ধারেকাছে কেউ নেই, তবু সে এধার ওধার তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ”অমিয়া ও বেলা জুপিটারে আবার চলে এসেছে তো, সে খবর রাখো কি? ওদের ট্রেনিং চার্ট তৈরী করছে হরিচরণ। অমিয়া বলছে অতো ট্রেনিং লোড নিতে পারবো না। তাই নিয়ে হরির সঙ্গে তক্কাতক্কি হয়েছে। হরি বলছে, ”যদি ক্ষিদ্দার মেয়েটার হাতে মার না খেতে চাস তো হার্ড ট্রেনিং আরম্ভ কর।”

”করেও কোন লাভ নেই। কোনি এখন যে টাইম করছে, অমিয়ার পক্ষে সেখানে পৌঁছন সম্ভব হবে না।”

”তা হলে এবার ওকে জুপিটারের চ্যাম্পিয়নশিপে নামিয়ে, অমিয়াকে মার খাওয়াও। মনে আছে কি বলে অপমান করেছিল!”

জলে কোনির দিকে চোখ রেখে ক্ষিতীশ জবাব দিতে ভুলে গেল। ভেলো ধড়মড়িয়ে বলল, ”যা বলতে এসেছিলুম সেটাই বলা হয়নি। আর একটা দরজির দোকান ঠিক করেছি। দিনে প্রায় হাপ কেজি মাল হয়। ওরা তোমার জন্য রেখে দেবে, তুমি কালই যেও। এই নাও ঠিকানাটা।”

ভেলো চলে যাবার পর ক্ষিতীশ স্টার্টিং ব্লকের উপর বসে ওর কথাগুলো মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল। তখনই দেখল ধীরেন ঘোষ আর বদু চাটুজ্জে কমলদিঘির পশ্চিম গেট নিয়ে ঢুকে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকেই।

”ক্ষিদ্দা দেখছি উঠে—পড়ে লেগেছে। কদ্দুর হল?”

ক্ষিতীশকে যথাসম্ভব নিরাসক্ত হবার চেষ্টা করে ধীরেনকে বলল, ”কিসের কদ্দুর!”

”এই তোমার চ্যামপিয়ন তৈরী করার। এবার দিল্লীতে দেখলুম বোমবাইয়ের রমা যোশিকে। অসাধারণ, ফ্যান্টাস্টিক। ইন্ডিয়ায় এ রকম মেয়ে সুইমার কখনো হয়নি।”

”হ্যাঁ, ভালোই টাইম করেছে।” ক্ষিতীশ নিষ্প্রাণস্বরে বলল।

”তোমার এই গঙ্গা থেকে কুড়োনো মেয়েটা কেমন টাইম করছে?” বদু চাটুজ্জে নস্যির ডিবেটা রেলিংয়ে ঠুকে ঢাকনিটা খুলতে খুলতে বলল, ”ডন ফ্রেজারের টাইম ধরে ফেলেছে?”

”আর একটু বাকি আছে। কাল পরশুই ধরে ফেলবে।” ক্ষিতীশের চোখজোড়া মিটমিট করে উঠল।

কোনি তখন কিকিং বোর্ড ধরে স্প্রিন্ট করে যাচ্ছে। বদু চাটুজ্জে সেদিকে তাকিয়ে বলল, ”ঠাট্টা করলে আমার সঙ্গে!”

”ঠাট্টা! জলে নেমে এক বছরেই ডনের টাইম ধরে ফেলেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। এমন সিরিয়াস কথার পর কি ঠাট্টা চলে? আগে অমিয়াকে বিট করুক, তারপর বড় বড় ব্যাপার ভাবা যাবে।”

”তা বটে।” ধীরেন ঘোষ বিজ্ঞের মতো বলল। ”তবে অমিয়াকে বিট করা আর সম্ভব হলো না। এইটেই ওর লাস্ট সিজন। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বিয়ের পরই চলে যাবে কানাডায়।”

ক্ষিতীশ সচকিত হয়ে উঠল। কোনি যদি অমিয়াকে না হারায়, তাহলে বিরাট একটা অপূর্ণতা ক্ষিতীশের জীবনে যেন রয়ে যাবে। চিরকাল যেন তাকে অতৃপ্ত থেকে যেতে হবে।

”তাহলে কোনিকে এবার তো নামিয়ে জানতে হয় বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নের থেকে কত পিছনে রয়েছে।”

”না না, তা করতে যেওনা।” বদু চাটুজ্জে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ”সবে শুরু করছে। বাচ্চচা মেয়ে এখুনি বড় রকমের মার খেয়ে গেলে সেটব্যাক হবে। তাতে ওর ক্ষতিই হবে।”

”হোক। তবু তো পরে বলতে পারবে, অমিয়ার পা ধোয়া জল খেয়েছি।”

সেইদিনই নকুল মুখুজ্জেকে ক্ষিতীশ জানাল, এবার জুপিটারের কম্পিটিশনে কোনির এন্ট্রি অবশ্যই যেন দেওয়া হয়।

ক্ষিতীশ এবার আরো সতর্ক, আরো হিসেবী, আরো কঠিন হল কোনির ট্রেনিং সম্পর্কে। তীক্ষ্ন নজর রাখল কোনির হাবভাব, শোয়া, খাওয়া এবং বিশ্রামের দিকে। প্রতিমাসে একবার রক্তে হেমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করে পরিশ্রমের ভার বাড়িয়ে যেতে লাগল। অ্যাপোলের ছেলেদের সঙ্গে এখন তাকে প্রতিযোগিতা করিয়ে সময় নেয়। ক্ষিতীশ একদিন কাগজে বড় অক্ষরে লাল কালিতে ‘৭০’ লিখে ক্লাবের বারান্দায় দেয়ালে সেঁটে দিল। কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে সে হেসে বলল, ”অত বছর আমায় বাঁচতে হবে কিনা, সেটা যাতে মনে থাকে তাই চোখের সামনে রাখলাম রোজ দেখার জন্য।”

আসলে ওটা হচেছ ৭০ সেকেন্ড। সময়টা কোনির চোখে প্রতিদিন ভাসিয়ে রাখার জন্য শুধু ক্লাবেই নয়, বাড়িতেও দেয়ালে লিখে রেখেছে। রমা যোশি এখন লক্ষ্যের পাত্রী। এক মিনিট ১০ সেকেন্ডে কোনিকে এই বছরই সাঁতরাতে হবে।

”অসম্ভব বলে কিছুই নেই রে।” কোনিকে রাত্রে খাওয়ার পর বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় ক্ষিতীশ বলে, ”বুঝলি, আমাদের শত্রু হচ্ছে সময়। এই ঘড়িটা।”

ক্ষিতীশ পকেট থেকে স্টপ ওয়াচটা বার করে কোনির চোখের সামনে ধরে। কোনি সেটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে থাকে। বারবার চাবি টিপে দেখে কাঁটাটা থরথরিয়ে কেমন এগোচ্ছে।

”ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের দিকে এগোতে হলে, ছোটখাট রেকর্ডগুলো ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগোতে হবে।”

”ক্ষিদ্দা, অমিয়াদির রেকর্ড কবে ভাঙ্গবো?”

ঘড়িটা কানে লাগিয়ে কোনি হঠাৎ প্রশ্নটা করল।

ক্ষিতীশ হেসে বলল, ”কেন!”

”আজ দোকানে এসেছিল ব্লাউজ করাতে। আমাকে সকলের সামনে বলল, তুই এখানে ঝিয়ের কাজ করিস? জানো ক্ষিদ্দা, আমার খুব লজ্জা করল। আমার হাতের লেখাটা এতো খারাপ, নইলে খাতায় মাপ লেখার কাজ করতে পারতুম। তুমি বৌদিকে একটু বলবে? আমি রোজ তাহলে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করব।”

”বলব।” ক্ষিতীশ মৃদু স্বরে বলল। ”লজ্জা কখনো পুরোটা জিততে পারবি না। কাউন্টারের ওধারে বসলে খানিকটা জেতা হবে। ক্ষমতা দিয়ে জিততে হয়। তোর আসল লজ্জা জলে, আসল গর্বও জলে। যখন তোর ক্ষমতা খানিকটা বাড়াতে পারবি, শুধু তোর কেন, তখন আমারও মান তাতে বাড়বে, মানুষের মান বাড়বে।”

”মানুষেরও!” কোনি হকচকিয়ে বলল।

ক্ষিতীশ ওর পিঠে চাপড় দিয়ে ঝুঁকে ভারী গলায় বলল, ”হ্যাঁ, মানুষেরও। মানুষ শব্দের থেকে জোরে আকাশে উড়েছে, দশ সেকেন্ডের কমে ডাঙ্গায় একশো মিটার ছুটছে, জলে মেয়েরা এক মিনিটের বাধা ভেঙ্গেছে। স্বপ্নেও ভাবা যায়নি এমন সব পদ্ধতি লেবরেটরিতে, অপরেশন টেবলে মানুষ শিখেছে এই শরীরের আয়ু বাড়াতে। একদিন আসবে যখন আলোর গতিকে মানুষ হার মানাবে, ইচ্ছামত বয়সটা বাড়াবে। এই যে রেকর্ড ভেঙ্গে মানুষ জলে, স্থলে, আকাশে এগোচ্ছে, এ সবই মানুষের মুক্তির চেষ্টা, এই ঘড়িটার হাত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। একদিন সব ঘড়ি ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে মানুষ, সময়কে হারিয়ে দেবে মানুষ—”

”ক্ষিদ্দা, কাঁধে লাগছে।’ কোনি অস্ফুটে কাতরে উঠল। কোনির কাঁধে উত্তেজিত আঙুলগুলো চেপে বসে গেছে। ক্ষিতীশ লজ্জা পেয়ে হাতটা নামিয়ে নিল।

”অনেক সময় আবোলতাবোল বকি। তুই এসব কথা বুঝতে পারিস?”

কোনি মাথা নাড়ল। ক্ষিতীশ যেন তাতে নিশ্চিন্ত হল, এমন স্বরে বলল, ”তোর পক্ষে এসব শক্ত কথা। তবে আরো বড়ো হ, বুঝতে পারবি।”

”ক্ষিদ্দা, তুমি কিন্তু বললে না, আমার টাইম অমিয়াদির রেকর্ডের থেকে কত পেছনে।”

”বলব বলব, একেবারে কম্পিটিশনেই দেখিয়ে দেব ব্যাটাদের, কে কার পায়ের জল খায়।”

এর তিনমাস পরই ক্ষিতীশ অ্যাপোলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠল, ”বদমাইসি, এসব হচ্ছে ধীরেনের মদমাইসি। কোনির এন্ট্রি নেবে না কেন? অ্যাপোলোর সঙ্গে ঝগড়া, তাই বলে সুইমারদের ওপর ঝাল ঝাড়বে! প্রোটেস্ট করো, ইনজাংশন দাও… যা খুশি ইচ্ছে মতো করবে, এটা কি মগের মুল্লুক!”

নকুল মুখুজ্জে আর বিষ্টু ধর এবং আরো অনেকে সেখানে বসে। ক্ষিতীশ পায়চারি করছিল, থমকে জুপিটার ক্লাবের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ”কোথায় নেমে গেছে—অপদার্থরা ক্লাবটাকে কোথায় নামিয়ে এনেছে! এখন ভয়ে ইতরোমো শুরু করেছে। ভেবেছে এইভাবে ক্ষিতীশ সিংগীকে আটকাবে।”

ফিসফিস করে বিষ্টু ধর বলল, ”এসব বিনোদ ভড়ের পরামর্শে হয়েছে। পাবলিককে এটা জানানো উচিত। প্রেস কনফারেন্স ডাকবো আমি।”

নকুল মুখুজ্জে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।

”এন্ট্রি রিফিউজ করার অধিকার ক্লাবের আছে! ওরা বলেছে ডেট পেরিয়ে গেছে তাই নেবে না। লাস্ট ডেট কবে সেটা তো ওরা বলে দেয়নি, সুতরাং আইনের ফাঁক রেখেছে। প্রোটেস্ট, ইনজাংশন কিছুই চলবে না।”

”এটা মরালিটির ব্যাপার।” ক্ষিতীশ অধৈর্য ভঙ্গিতে নিজের বুকে চাপড় দিল। ”এটা খেলার, এটা সাহসের, এটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।”

নকুল মুখুজ্জের ঠোঁট বিদ্রূপে মুচড়ে উঠল। বিষ্টু ধর উত্তেজিত হয়ে বলল, ”তাহলে একটা ডিমনস্ট্রেশন করলে কেমন হয়। বিক্ষোভ প্রতিবাদ জুপিটারের সামনে, বিনোদ ভড়ের বাড়ির সামনে? একটা মিছিলও যদি পাড়ায় পাড়ায়—”

”ওতে অনেক ঝামেলা।” নকুল ঠাণ্ডা স্বরে বিষ্টু ধরকে মিইয়ে দিল। ”জুপিটারেরই পাবলিসিটি হবে, ওদের ইজ্জৎ একটুও তাতে কমবে না। আপনার ইলেকশন পর্যন্ত লোকে এসব মনেও রাখবে না। তার থেকে বরং অন্য কিছু ভাবা যেতে পারে। ক্ষিতীশ, তুই কি নিশ্চিত যে, কোনি এখন অমিয়াকে হারাতে পারে?”

”নিশ্চয়।” ক্ষিতীশ বলল দাঁতে দাঁত চেপে।

।। ১১ ।।

”কম্পিটিটরস ফর দ্য লেডিজ হান্ড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট, প্লিজ কাম টু দিয়ার স্টার্টিং ব্লকস।”

জুপিটার সুইমিং ক্লাবের কম্পিটিশন প্রতি বছরই এইরকম জাঁকালোভাবে হয়। কমলদিঘির অর্ধাংশের চারটে গেট বন্ধ করে, জুপিটারের অংশটুকু টিন দিয়ে ঘেরা হয়েছে। কাঠের গ্যালারি তৈরী করা হয় দিঘির তিন—চতুর্থাংশ ঘিরে। সাঁতার শুরু হয় যেদিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে, তার পিছনে তিন সারি বিশিষ্ট অতিথিদের চেয়ার এবং পিছনেও গ্যালারি। প্ল্যাটফর্মের একধারে টেবিল। সেখানে মাইক্রোফোন নিয়ে ঘোষক আর জনা পাঁচেক টাইম রেকর্ডার। বুকে ব্যাজ ঝুলিয়ে, কয়েকটা স্যুভেনির হাতে ধীরেন ঘোষ বিশিষ্ট অতিথিদের তদারকিতে ব্যস্ত। কম্পিটিশনের চিফ রেফারি হরিচরণ।

ভিড়ে আজ ফেটে পড়ছে কমলদিঘি। গ্যালারি ভেঙ্গে কয়েকজন মাটিতে পড়েছে। একজনের হাত ভেঙ্গেছে। রেলিংয়ের ভিতরে পাড় ঘিরে লোক দাঁড়িয়ে। দুটি ছেলে ভিড়ের ধাক্কায় জলে পড়েছিল। অবশ্য তারা সাঁতার জানে। ডাইভিং বোর্ডে উঠেছে বহু ছেলে। জুপিটারের এলাকা যেখানে শেষ হয়েছে অর্থাৎ টিনের বেড়ার পরেই অ্যাপোলোর এলাকায় রেলিং ঘিরে হাজার দুয়েক মানুষ। তারা দূর থেকেই প্রতিযোগিতা দেখবে।

প্রতিযোগিতার আজ শেষ দিন। দুপুর আড়াইটে থেকে শুরু হয়েছে। ছেলেদের এবং ছোট মেয়েদের তিনটি বিষয়ের ফাইনাল হয়ে যাবার পর ঘোষণা শোনা গেল : ”কম্পিটিটরস ফর দ্য লেডিজ হান্ড্রেড মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট, প্লিজ। … উইল কম্পিটিটরস কাম টু দিয়ার পোজিশনস? দিস ইজ সেকেন্ড কল…”

কমলদিঘির অ্যাপোলোর অংশে এতক্ষণ একজন, পাড়ের কাছে মন্থরভাবে সাঁতার কাটছিল। অ্যাপোলোর স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মটা জুপিটারেরই পঞ্চাশ মিটার পাশে। সেখানে চুপচাপ বসে চোখে পুরু কাঁচের চশমা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল একটি লোক! কেউ তাকে লক্ষ করছে না। আজ কমলদিঘির আনাচে—কানাচে সর্বত্রই লোক, সকলের চোখ জুপিটারের এলাকার দিকে।

ঘোষণা শেষ হতেই ক্ষিতীশ উঠে দাঁড়াল।

”কোনি!” শান্ত নরম গলায় সে ডাকল। জল থেকে কোনি প্ল্যাটফর্মে উঠে এল। রেলিংয়ের ভীড়ের চোখ এদিকে ফিরল।

জুপিটারে প্ল্যাটফর্মে সাঁতারুরা এসে দাঁড়িয়েছে। অমিয়াকে দেখা গেল হেসে কথা বলছে অতিথিদের মধ্যে বসা এক বৃদ্ধার সঙ্গে। অত্যন্ত ঢিলেঢালা নিশ্চিন্ত ভঙ্গি। বেলা জলে নেমে মিনিট দুয়েক হাত ছুঁড়ে উঠে এল। এখন তোয়ালে দিয়ে জল মোছায় ব্যস্ত। অন্য ছয়টি মেয়ে কিঞ্চিৎ নার্ভাস। তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করেই মুখ শুকিয়ে ফেলেছে।

হরিচরণ উত্তেজিতভাবে ধীরেন ঘোষের কানে ফিসফিসিয়ে কি বলল। ধীরেন ঘাড় ফিরিয়ে অ্যাপোলোর প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকাল। সেটা লক্ষ করে অমিয়াও তাকাল। পাঁচ নম্বর ব্লকের পিছনে দাঁড়ানো কালো কস্ট্যুমে পরা মেয়েটিকে চিনতে তার অসুবিধা হল না। কোনির পাশে ঘড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ। সারা কমলদিঘি হঠাৎ যেন বুঝতে পেরেছে, এবার একটা কিছু ব্যাপার হতে চলেছে। চোখগুলো অ্যাপোলের দিকে নিবদ্ধ হচ্ছে।

হরিচরণ কিছু একটা অমিয়াকে বলতেই অমিয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল। অ্যাপোলো ক্লাবের বারান্দা থেকে বিষ্টু ধরের চীৎকার ভেসে এল: ”ডাউন দিতেই হবে, কোনি।”

”অন দ্য বোর্ড।” স্টার্টারের চীৎকার শোনা গেল। এয়ার রাইফেলের নলটা আকাশমুখো তোলা। জুপিটারের ব্লকের উপর আটটি মেয়ে উঠল। অ্যাপোলোর পাঁচ নম্বর ব্লকে উঠেছে কোনি। সারা কমলদিঘি ঘিরে ভেসে উঠল মর্মর শব্দ।

ওরা ব্লকের কিনারে পায়ের আঙুলগুলো আঁকড়ে রেখে হাঁটু ভেঙ্গে, কাঁধ ঝুঁকিয়েছে। দু’হাত পাখির ডানার মতো পিছনে—যেন এখনি উড়বে।

”গেট…সেট…।”

অমিয়া ও কোনি ছাড়া বাকি মেয়েরা ঝপঝপ জলে পড়ল। এয়ার রাইফেলের ক্যাপ ফোটেনি। কমলদিঘি ঘিরে বিদ্রূপ ও আক্ষেপ এক চক্কর ঘুরে গেল। অমিয়া আড়চোখে কোনির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল।

নতুন ক্যাপ লাগানো হয়েছে।

”অন দ্য বোর্ড।”

মেয়েরা আবার ব্লকের উপর উঠল।

”গেট… সেট…।’

এয়ার রাইফেলে ‘ফটাশ’ শব্দ হল।

এক সঙ্গে নয়টি মেয়ে জলে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কমলদিঘির উপর গড়িয়ে পড়ল চাপা একটা গর্জন। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়েছে ফুটবল মাঠের মতো। তাদের চোখ ডাইনে—বামে ৫০ মিটার যাতায়াত করছে আগুয়ান দুটি সাঁতারুকে লক্ষ করতে করতে।

তিরিশ মিটার পর্যন্ত কোনি আর অমিয়া সমান রেখায়। বাকিরা ৭/৮ মিটার পিছনে। এরপর অমিয়া একটু একটু করে এগোতে শুরু করল।

”কোও—ও—নিই।” অ্যাপোলোর দিকে ভীড়ের মধ্যে থেকে কে চীৎকার করে উঠল। ”কোও—ও—নিইই।”

”গো, অমিয়া গো।” জুপিটার থেকে চীৎকার শোনা গেল।

ক্ষিতীশ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে কোনির দিকে তাকিয়ে। মুখে ভাবান্তর নেই।

অমিয়া দু’হাত এগিয়ে গেছে। বেলা তার পিছনে প্রায় আট মিটার দূরত্বটা সমানে রেখে চলেছে। বাকিদের দিকে কেউ তাকাচ্ছেই না।

অমিয়া সবার আগে ৫০ মিটার বোর্ড ছুঁয়েছে। ঘুরে গিয়ে সে কোনিকে অতিক্রম করার সময় একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কোনি যেন থমকে গেল। তারপরই বোর্ড ছুঁয়ে ঘুরেই টর্পেডোর মতো ছিটকে এল।

রোগতপ্ত মানুষের মতো কমলদিঘি ভুল বকতে শুরু করেছে।

”কোও—ও—নিই।”

”এটা ছেলে না মেয়ে, মশাই!”

”মেয়ে মেয়ে, আমাদের ক্লাবের মেয়ে—কোনি।”

”পারবে না। এক বডি পেছনে পড়ে গেছে। কেন যে ক্ষিদ্দা এমন হাস্যকর ব্যাপার করলো।”

৬০ মিটার। অমিয়া এগিয়ে চলেছে।

৬৫ মিটার। কোনি উঠছে।

৭০ মিটার। কোনি সমান রেখায় অমিয়ার সঙ্গে। নিঃশ্বাস নেবার জন্য অমিয়া ঘনঘন হাঁ করছে। পায়ের পাড়ি এলোমেলো হয়ে এসেছে। হাত দুটো উঠছে—পড়ছে যেন নিয়ম রক্ষার জন্য। জলের গভীরে ডুবিয়ে টেনে কোমরের পিছন পর্যন্ত আনার জোরটুকু আর নেই। অমিয়া নিভে আসছে।

”কাম অন অমিয়া, কাম অন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন।”

”ফাইট কোনি, ফাইট।”

হঠাৎ কমলদিঘি ঘিরে বিরাট একটা চীৎকার হাউইয়ের মতো আকাশে উঠল। কোনি পিছনে ফেলেছে অমিয়াকে। ওর ছিপছিপে শরীরটার মধ্যে দিনে দিনে সঞ্চিত যন্ত্রণায় ঠাসা শক্তির ভাণ্ডারটিতে যেন বিস্ফোরণ ঘটল। ছন্দোবদ্ধ ওঠা—নামা করে চলেছে দুটি হাত, তার সঙ্গে তাল রেখে চলেছে পা দুটি; ওর দু’পাশে ইংরাজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো ঢেউয়ের রেখা ছড়িয়ে পড়ছে। পায়ের আঘাতে বিরামহীন স্ফীত জলতরঙ্গ ওকে অনুসরণ করছে।

মসৃণ, স্বচ্ছন্দ কিন্তু হিংস্র ভঙ্গিতে কোনি নিজেকে টেনে বার করে নিয়ে গেল। ফিনিশিং বোর্ডে হাত লাগিয়েই সে উদ্বিগ্ন ব্যগ্র চোখে পাশে মুখ ফেরাল। তখনো অমিয়া পৌঁছয়নি। ‘উইইই’ শব্দে তীক্ষ্ন চীৎকার করে কোনি চিত হয়ে বোর্ডে পায়ের ধাক্কা দিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল আনন্দে।

”তিন বডি, ক্লিয়ার তিন বডিতে মেরেছে।”

”কোওওন্নি…কোওওন্নি।” ভীড়ের মধ্যে তিনটি ছেলে তালে তালে সুর করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কোনি হাত নাড়ল তাদের উদ্দেশে।

”কি রকম ডাউন খাওয়াল দেখলে! জুপিটার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তারই শোধ নিল।”

”অনেকদিন এমন মজা পাইনি কিন্তু!”

হঠাৎ সব আলোচনা, উত্তেজনা থমকে গিয়ে এবার দ্বিগুণ জোরে হৈ হৈ চিৎকার উঠল। হাততালি পড়ছে, শিস উঠছে একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে। অ্যাপোলোর স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মে এতক্ষণ ধরে প্রস্তরবৎ, ভাবলেশহীন ক্ষিতীশ এখন তিড়িং তিড়িং লাফাচ্ছে।

”কোথায় হরিচরণ, মুখখানা একবার দেখা।” লাফাতে লাফাতে ক্ষিতীশ চীৎকার করে চলল। ”ওলিম্পিকের গুল মেরে কি আর সুইমার তৈরী করা যায় যে পাঁটা? বুদ্ধি চাই, খাটুনি চাই, নিষ্ঠা চাই…গবেট গবেট সব।”

ব্যস্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর ভেলো উঠে এসে ক্ষিতীশকে জড়িয়ে ধরল। ”হচ্ছে কি ক্ষিদ্দা, এত লোকের সামনে, তোমার কি মাথাটা বিগড়ে গেল নাকি! চলো চলো, ক্লাবে চলো। বিষ্টু ধর ওদিকে একসাইমেণ্টে সেন্সলেশ হয়ে পড়েছিল। অ্যাই কোনি, উঠে আয়।’

ক্লাবের বারান্দায় বেঞ্চে শুয়েছিল বিষ্টু ধর। ক্ষিতীশকে দেখে ওঠার চেষ্টা করতেই দু’জন তাকে সাহায্য করল।

”দশ কেজি রসগোল্লা আনতে পাঠিয়েছি।” ক্ষীণস্বরে বিষ্টু ধর বলল। ”ব্যান্ড পার্টি আনাবো। কোনিকে সারা নর্থ ক্যালকাটা ঘোরাবো।”

”খবরদার, ও কাজটি করবেন না। তাহলে হাজার পাঁচেক ভোট কমে যাবে।”

বিষ্টু ধর ফ্যালফ্যাল করে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে থেকে, অস্ফুটে আপন মনে বলল, ”কিন্তু আমার যে জেনুয়িন আনন্দ হচ্ছে।”

ক্ষিতীশ কোনিকে ডেকে গম্ভীর মুখে বলল, ”টার্নিংয়ে ভুল হল কেন?”

”তখন কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল। অমিয়াদি টার্ন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, টাম্বল টার্নের কথা আর মনেই এল না।”

”আসলে নিজের ওপর তখন ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলিস। মনে এলে সময় আরো কমতো।”

”আমার সময় কত হল ক্ষিদ্দা?”

বুক পকেট থেকে ঘড়ি বার করে তাকিয়েই ক্ষিতীশ ভ্রূ কুঞ্চিত করল এবং ক্রমশ মুখটা অপ্রতিভ হয়ে উঠল।

”ভুলে গেছি রে! ফিনিশের সময় এমন একসাইটমেন্ট চারদিকে…তবে বেঙ্গল রেকর্ড নিশ্চয় আজ ভেঙ্গেছিস। ইসস সময়টা যদি রাখতুম।”

”ক্ষিদ্দা, আমায় যে এখন প্রজাপতিতে যেতে হবে, দেরী হলে বৌদি রাগ করবে।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেরী করিসনি আর।” ক্ষিতীশ ব্যস্ত হয়ে বলল। কিন্তু কোনি ইতস্তত করছে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ”কি হল?”

”কানে কানে বলব।”

ক্ষিতীশ নিচু করল মাথাটা।

”রসগোল্লা আনতে পাঠিয়েছে না!”

”তাই তো! নিশ্চয় ভেলোটা আনতে গেছে। তাহলে আজ আর তোর বরাতে রসগোল্লা নেই।”

”কে বললে নেই।” বিষ্টু ধর গর্জন করে উঠল। ”ব্যান্ড পার্টি ঘোরান গেল না, রসগোল্লার হাঁড়িটাই তার বদলে প্রজাপতি ঘুরে আসবে।”

”তাহলে তোর বৌদির রাগও জল হয়ে যাবে।”

সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে ক্ষিতীশের প্রতি লীলাবতীর প্রথম উক্তি হল : ”অত লোকের সামনে এই বুড়ো বয়সে ধেই ধেই করে নাচছিলে কেন? লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। সবার সামনে অসভ্যতা, দোকানের মেয়েরাও দেখল তো!”

ক্ষিতীশ মাথা চুলকোতে চুলকোতে কোনির দিকে তাকাল। ”তোর বৌদি জানল কি করে?”

ফিসফিস করে কোনি বলল, ”বৌদি দেখতে গেছল। আমি বলেছিলুম আজকের সাঁতারের কথাটা, নইলে ছুটি পেতুম না যে।” তারপর হেসে বলল, ”বৌদি আমার মাপ নিয়েছে, একটা ফ্রক করে দেবে।” লাজুক স্বরে আবার বলল, ” বৌদি বলেছে, ইন্ডিয়া রেকর্ড করলে সিল্কের শাড়ি দেবে।”

কোনিকে বাড়ি পৌঁছে দেবার পথে ক্ষিতীশ জিজ্ঞাসা করল, ”কি মনে হচ্ছিল রে তোর, যখন সাঁতরাচ্ছিলিস।”

কোনি অনেকক্ষণ চুপ করে হাঁটল, তারপর স্বপ্নের ঘোরে যেন কথা বলছে, এমনভাবে বলল,”জানো ক্ষিদ্দা, রোজ যখন প্র্যাকটিস করি, তখন জলের মধ্যে নিচের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আমার সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখও এগিয়ে চলছে। বড্ড ভয় করে তখন।”

”মুখটা কেমন দেখতে রে?”

”দাদার মতন। আজও ছিল আমার সঙ্গে।”

।। ১২ ।।

অবশেষে কোনি বাংলা সাঁতার দলে জায়গা পেল।

এবারে জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ হচ্ছে মাদ্রাজে। বি এ এস এ নির্বাচন সভায় ধীরেন ঘোষ, বদু চাটুজ্জেরা প্রবল বিরোধিতা করেছিল অ্যাপোলোর কাউকে দলে নেওয়ায়। শুধু তাই নয়, জুপিটারের কম্পিটিশনে অ্যাপোলোর তরফ থেকে ‘অমার্জনীয় অখেলোয়াড়ি আচরণ করার জন্য” ওই ক্লাবকে সাসপেন্ড করা হোক দাবীও তোলে।

জুপিটার দলে ভারি ছিল, তাদের প্রস্তাব গৃহীতও হচ্ছিল। এমন সময় আচমকা বালিগঞ্জ ক্লাবের প্রণবেন্দু বিশ্বাস অর্থাৎ হিয়ার কোচ প্রস্তাব দিল, ”অ্যাপোলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হোক, ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ সম্পর্কে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রণবেন্দু তারপর বলল, ”বেঙ্গলের স্বার্থেই কনকচাঁপা পালকে টিমে রাখতে হবে।”

তুমুল হৈচৈ পড়ে গেল প্রণবেন্দুর এই কথায়। অ্যাপোলোর কোন প্রতিনিধি সভায় নেই। ওরা ভেবেছিল প্রস্তাবটা বিনা বাধায় পাশ হয়ে যাবে। কেউ ভাবতেই পারেনি হিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষ নিয়ে প্রণবেন্দুই কিনা লড়াই শুরু করবে। ধীরেন ঘোষ ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ”স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে কি হল সেটা তো তুমি নিজেই দেখেছ।”

”হ্যাঁ দেখেছি।” প্রণবেন্দু স্থির চোখে ধীরেনের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল, ”কি হয়েছিল আমি দেখেছি।”

শুধু প্রণবেন্দু নয়, আরো অনেকেই দেখেছে।

কোনির প্রতিদ্বন্দ্বিতা অমিয়ার সঙ্গে নয়, হয়েছিল হিয়ার সঙ্গে। ব্রেস্টস্ট্রোকের ১০০ মিটারে ছিল কোনি, অমিয়া, হিয়া। চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম রেফারি ছিল ধীরেন ঘোষ। স্ট্রোক জাজদের মধ্যে ছিল হরিচরণ ইনসপেক্টর অফ টার্নস এবং টাইম কীপারদের মধ্যে কার্তিক সাহা, বদু চাটুজ্জে, যজ্ঞেশ্বর ভটচাজ ছাড়াও জুপিটারের গোষ্ঠিভুক্ত কয়েকটি ক্লাবের লোকেরা ছিল।

একই সঙ্গে কোনি আর হিয়া ৫০ মিটার থেকে টার্ন নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বদু চাটুজ্জে লাল ফ্ল্যাগ নাড়তে শুরু করে। রেফারী ধীরেন ঘোষ ছুটে গিয়ে ফ্ল্যাগ দেখাবার কারণটা জেনে, বলল, ”কনকচাঁপা পাল ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে। টার্ন করেই আন্ডারওয়াটার ডাবল—কিক নিয়েছে।”

শুনে অবাক হয়ে গেল ক্ষিতীশ। শুধু বলল, ”এরকম ভুল করার কথা তো নয়।”

হিয়া প্রথম এবং তার থেকে ৬ মিটার পিছনে কোনি, ৭ মিটার পিছনে অমিয়া সাঁতার শেষ করে। কোনিকে ২০০ মিটারে নামতে দেয়নি ক্ষিতীশ। ব্রেস্ট স্ট্রোকে পায়ের উপর অত্যধিক খাটুনি পড়ে, অথচ তার পরেই রয়েছে ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট। কোনি মূলতঃ ফ্রি স্টাইলার। কিন্তু এতেও কোনি পারল না। সাঁতার শেষ করে ফিনিশিং বোর্ড ছুঁয়েই সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল অমিয়া হাতে ছোঁয়াল। কোনি একগাল হেসে মুখ তুলে ক্ষিতীশের দিকে তাকাল। ঘড়িটা উঁচু করে ধরে গ্যালারি থেকে ক্ষিতীশ হাত নাড়ল। ঘোষণায় শোনা গেল অমিয়া প্রথম হয়েছে।

ক্ষিতীশ প্রথমে থ হয়ে গেল, তারপর ধীরেনের কাছে ছুটে গিয়ে বলল, ”এসব কি হচ্ছে?”

”কি আবার হবে!” ধীরেন অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছিল, ক্ষিতীশ ওর হাত টেনে ধরল।

”আমিও টাইম রাখছি। কোনি আগে টাচ করেছে, ওর টাইম—”

”তোমার জাপানী ঘড়ির টাইম তোমার কাছেই রাখ।”

নকুল মুখুজ্জে প্রতিবাদ জানাল জুরি অফ অ্যাপীলের কাছে। প্রতিবাদ নাকচ হয়ে গেল। পনেরো মিনিট পরেই ছিল ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলি। কোনি বাটারফ্লাইয়ে হিয়া এবং অমিয়ার কাছে পিছিয়ে পড়ল, ব্যাক স্ট্রোকে অমিয়াকে ধরে ফেলে টার্ন নিতেই দেখা গেল যজ্ঞেশ্বর ভটচার্য লাল ফ্ল্যাগ তুলে রয়েছে।

”ব্যাপার কি!” ক্ষিতীশ গ্যালারি থেকে নেমে এল। ”ধীরেন জোচ্চচুরির একটা সীমা আছে। জগু তো আগে থেকেই ফ্ল্যাগ তুলেছিল।”

”কে বলল আগে থেকে! তোমার মেয়েটা ফলটি টার্ন নিয়েছে, তারপর ফ্ল্যাগ দেখিয়েছে। শেখাও শেখাও, টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো শেখাও। জুপিটারকে অপদস্থ করা ছাড়া আর কিছু তো শেখাওনি।” ধীরেন উত্তেজিতভাব হাত নেড়ে বকের মতো গলাটা লম্বা করে বলতে লাগল, ”আইনটাও শিখো যে, ব্যাক স্ট্রোকে টার্ন নেবার জন্য বোর্ডে হাত ছোঁয়াবার আগে নরম্যাল পজিশন অন দি ব্যাক থাকতে হবে। কনকচাঁপা ঘুরে গিয়ে হাত ছুঁইয়েছে, নরম্যাল পজিশনে থেকে ছোঁয়ায়নি। যাও যাও, গিয়ে বোসো এখন।”

হিয়ার কাছে অমিয়া হেরে গেল এক সেকেন্ডের তফাতে। কোনি আড়ষ্ট হয়ে গেল দু’বার বাতিল হয়ে এবং প্রথম হয়েও দ্বিতীয় হয়ে যাওয়ায়। বাড়ি ফেরার সময় ক্ষিতীশ বাসে সারা পথ গজরাল এবং অবশেষে বলল, ”কাল হানন্ড্রেড মিটার, দেখি ধীরেনরা কি করে তোকে আটকায়।”

কিন্তু আটকাবার যে অনেক পন্থা আছে ক্ষিতীশ তা ভেবে দেখেনি।

পরদিন স্টার্টিং ব্লকে যখন প্রতিযোগীরা এসে দাঁড়াল ক্ষিতীশ একটু অবাকই হল। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগীদের মধ্যে যারা সেরা তাদের মাঝখানে রাখা হয়,—৩, ৪, ৫ নম্বর লেনে। হিয়া ৩ নম্বরে, কোনি ৪ নম্বরে, অমিয়া ৬ নম্বরে আর তাদের মাঝে জুপিটারের ইলা ৫ নম্বর লেনে। হিটে কোনক্রমে তৃতীয় হয়ে ইলা ফাইনালে উঠেছে। দু’ বছর আগে প্রি—ইউ পরীক্ষায় টোকার সময় ধরা পড়ে ইলা গার্ডকে কামড়ে দিয়েছিল।

ক্ষিতীশ এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরেনের দিকে। একজন ভলান্টিয়ার তাকে আটকে দিয়ে বলল ”প্ল্যাটফর্মে কম্পিটিটাররা আর অফিসিয়ালরা ছাড়া কেউ যেতে পারবে না।”

ফিরে এসে ক্ষিতীশ ঘড়ি হাতে নিয়ে বসল। শুরু থেকেই প্রচণ্ড রেস। অমিয়া বদ্ধপরিকর চ্যাম্পিয়নশিপ বজায় রেখে সাঁতার থেকে বিদায় নিতে। হিয়া মসৃণ ছন্দোবদ্ধ এবং দ্রুততালে নিখুঁত ভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে। কোনি যেন তাড়া খাওয়া ব্যস্ত উদ্বিগ্ন জলকন্যা। জল তোলপাড় করে সে যেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলেছে। বাকিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ওই তিনজনের পিছনে অন্তত ২০ মিটারের মধ্যে থাকতে। ইলার ব্যস্ততাটা একটু কম, সে বারবার মুখ তুলে তাকাচ্ছে আর ক্রমশই সরে যাচেছ কোনির লেনের দিকে।

বোর্ড ছুঁয়ে সবার আগে টার্ন নিল কোনি। তারপর অমিয়া। ব্রেস্ট স্ট্রোকাররা ভাল ফ্রি স্টাইলরা হয় না—হিয়া প্রায় দু মিটার পিছিয়ে পড়েছে। বাকিরা তখনো ৪০ মিটারেও পৌঁছয়নি। টার্ন নিয়ে কোনি সবে মাত্র দু—তিনটি স্ট্রোক দিয়েছে, তখনই ব্যাপারটা ঘটল।

ইলা ঢুকে পড়েছে কোনির লেনে। দুজনে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ! উঃ” বলে কোনি চেঁচিয়ে উঠল একবার, দেখা গেল ওরা জড়াজড়ি অবস্থায় এবং হাঁকপাক করে সে যেন নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে। কয়েক সেকেন্ড এভাবেই কাটল। ততক্ষণে অমিয়া এবং হিয়া ওদের অতিক্রম করে বেরিয়ে গেছে। বদু চাটুজ্জে লাল ফ্ল্যাগ উঁচিয়ে ইলার দিকে তাকিয়ে বলল, ”ইউ ডিসকোয়ালিফায়েড।” ইলা আবার নিজের লেনে সরে গিয়ে চিত সাঁতার কেটে স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মের দিকে ফিরে যেতে লাগল।

কোনি শুধু একবার সামনে তাকিয়ে দেখল। তারপরই বড় হাঁ করে অনেকখানি বাতাস বুকে ভরে নিয়ে তাড়া করল সামনের দুজনকে। অনেক দেরী হয়ে গেছে, তবু শেষ চেষ্টা এঞ্জিনের পিস্টনের মতো ওঠানামা করছে দুটো হাত, পায়ের কাছে টগবগিয়ে ফুটছে জল।

”কাম অন পল, কাম অন।” দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচাচ্ছে আর কেউ নয়, হিয়ার বাবা। গ্যালারির হতভম্ব ভাবটা তাতে যেন ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়ল।

”জোরে জোরে, আরো জোরে!” শুধু এই চীৎকার ধাপে ধাপে উঠে অবশেষে আক্ষেপে ভেঙ্গে পড়ল। কোনি পারল না। অমিয়া তার খেতাব রক্ষা করল। দ্বিতীয় হল হিয়া। কোনি তৃতীয় হল বেলার সঙ্গে।

তারপর আর একটি ব্যাপার ঘটল। ধীরেন জলের কাছে ঝুঁকে এক গাল হেসে অমিয়াকে কিছু বলছিল, সেই সময় ভিড় ঠেলে ছুটে এসে ক্ষিতীশ তার পিছনে লাথি কষাল। ধীরেন উল্টে গিয়ে জলে পড়ল। তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। কয়েকটি ছেলে ক্ষিতীশকে হিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে গেল সেখানে থেকে। তখন শোনা গেল চীৎকার করে সে বলে যাচ্ছে, ”পারবি না, এভাবে পারবি না।…”

রাস্তায় বেরিয়ে এসে কোনির তোয়ালে দিয়ে ক্ষিতীশ মুখ মুছল। ঠোঁটের কষ বেয়ে তখনো রক্ত গড়াচ্ছে। কোনির কপাল ফুলে উঠেছে। একটা পানের দোকান দেখে ক্ষিতীশ বরফ কেনার জন্য দাঁড়াল। ঠিক তখনই ওর পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হিয়ার বাবা নেমে এল।

”সরি মিস্টার সিনহা। এমন ডাটিঁ ব্যাপার এখানে হবে আমি জানতাম না। হিয়া, তার মা, আমরা কেউই খুশি হতে পারছি না। এভাবে মেডেল জেতায় কোন আনন্দ নেই।”

ভদ্রলোক কোনির পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, ”দুঃখ কোরো না। জোরে সাঁতার কাটার দরকারটা আজ তুমি অনুভব করতে পেরেছ, তুমি লাকি। তোমার লাস্ট ফরটি মিটারস আমি ভুলব না।”

ক্ষিতীশ প্রথমে বিভ্রান্ত তারপর অভিভূত হয়ে গেল। গাড়ির জানালা দিয়ে হিয়া এবং তার মা দেখছে। ক্ষিতীশ এগিয়ে এসে হিয়ার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ”বড়ো হও মা।” তারপর ইতস্তত করে বলল, ”সেদিন কোনিকে আমি খুব বকেছি।”

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির ছেঁড়া বুক পকেটটা টান মেরে ক্ষিতীশ খুলে ফেলল।

”তোর বৌদিকে এসব কিছু বলিসনি।”…

প্রণবেন্দু ঘরের সকলের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ”কি হয়েছিল, আমরা জানি। সেকথা এখন আলোচনা করে লাভ নেই। বাংলার মান—সম্মানের কথাই এখন আমাদের ভাবতে হবে, টিমটা যাতে সেরা হয় তার জন্য তুচ্ছ দলাদলি ভুলে যেতে হবে। মহারাষ্ট্রই আমাদের মেয়েদের একমাত্র রাইভ্যাল। ওদের রমা যোশির সঙ্গে ফ্রি স্টাইলে পাল্লা দেবার কেউ নেই, একমাত্র কনকচাঁপা পাল ছাড়া। ফ্রি স্টাইলের তিনটে ইনডিভিজুয়াল, আর একটা রিলে, এই চারটের মধ্যে অন্ততঃ দুটোতে, একশো আর দু’শোয় কনকচাঁপার সিক্সটি পারসেন্ট চান্স আছে।”

”কিসে বুঝলে যে আছে?” একজন জানতে চাইল।

”শুধু ওর সেদিনের ফিনিশ করা দেখেই বুঝেছি। যেরকম রোখা জেদী সাঁতার ও দেখাল, তাতে স্প্রিন্ট ইভেন্টে ওর সমকক্ষ এখন বাংলায় কেউ নেই। আমি ওর ট্রেনিংয়ের খবর রাখি, দু তিনবার দেখেও এসেছি, জোর দিয়েই বলছি মহারাষ্ট্রের কাছ থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ ছিনিয়ে নিতে হলে এই মেয়েটিকে চাই।”

”শুধু ফ্রি স্টাইল জিতেই আমরা চ্যামপিয়ন হয়ে যাব? ধীরেন ঘোষ তাচ্ছিল্যভরে বলল এবং অন্যান্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো হাসল। কিন্তু তাকে সায় দিয়ে কেউ মাথা নাড়ল না এবার।

”হিয়ার কাছ থেকে আমি তিনটে গোল্ড আশা করছি। দুটো ব্রেস্ট স্ট্রোকে, একটা ব্যাক স্ট্রোকে। মেডলিতেও ফিফটি—ফিফটি চান্স আছে। এছাড়াও অঞ্জু, পুষ্পিতা, বেলা ও অমিয়া পয়েন্ট আনবে। এ বছর আমরা লেডিজ চ্যামপিয়ন হতে পারি।”

”কিন্তু কনকচাঁপা পাল এ বছর কোন ক্লাব স্পোর্টসে নামেনি, স্টেট চ্যামপিয়নশিপে দুটোতে ডিসকোয়ালিফাই হয়েছে আর একটায় প্রথম দুটো প্লেসের মধ্যে আসতে পারেনি,বাকিগুলোয় আর নামেনি। ওর টাইমিং কি, আমরা তা জানি না। সুতরাং কি করে ওকে সিলেক্ট করা যায়!” ধীরেন ঘোষ টেবলে ঘুঁষি মেরে চেঁচিয়ে উঠল।

কয়েক সেকেন্ড সভাঘর নিস্তব্ধ রইল। সবশেষে ধীর শান্ত গলায় প্রণবেন্দু বলল, ”তাহলে বালিগঞ্জ সুইমিং ক্লাবের সুইমারদের বাদ দিয়েই আপনাদের টিম করতে হবে। আমার মেয়েদের আমি উইথড্র করে নিচ্ছি।”

”তা কি করে হয়!” সভায় গুঞ্জন উঠল। একজন বলল, ”কনকচাঁপা পালকে সিলেকশন দিলে ক্ষতিই বা কি! যাবে তো নিজের টাকায়।”

এরপর শুরু হল তর্কাতর্কি। সেটা পৌঁছল চীৎকারে। এক সময় ধীরেন রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলল, ”প্রণবেন্দু ব্ল্যাকমেল করে অ্যাপোলোর সুইমার টিমে ঢোকাতে চায়। এতে ওর কি যে স্বার্থ আছে বুঝছি না।”

প্রণবেন্দু জবাব দিল, ”রমা যোশির সোনা কুড়োনো বন্ধ করা ছাড়া আমার আর কোন স্বার্থ নেই।”

.

কোনি মাদ্রাজ যাওয়ার মনোনয়ন অবশেষে পেল। বাংলার ম্যানেজার হয়েছে ধীরেন ঘোষ। মেয়েদের বিভাগে ম্যানেজার বেলেঘাটা সুইমিং ক্লাবের প্রণতি ভাদুড়ি এবং কোচ হরিচরণ মিত্র। মাদ্রাজ মেলে ওরা সন্ধ্যায় রওনা হবে। ক্ষিতীশ এসেছে ট্রেনে কোনিকে তুলে দিতে। আর এসেছে কান্তি, চণ্ডু, ভাদু। কোনির ভাই গোপাল।

কামরায় জানলার ধারে বসেছে কোনি। জানলা থেকে দূরে সবার থেকে একটু তফাতে প্ল্যাটফর্মে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে। কোনি কথা বলছে কান্তিদের সঙ্গে। ধীরেন ঘোষ হাঁকডাক করে তদারকিতে ব্যস্ত। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসছে, এখনো নাকি কয়েকজন পৌঁছয়নি।

কোনির মুখে চাপা ভয়। কলকাতার বাইরে সে কখনো যায়নি। সাড়ে চোদ্দশ’ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় ৩৫ ঘণ্টা ট্রেনে বাস। কামরার আর এক কোণে জুপিটারের অমিয়া আর বেলা। ওরা অভ্যস্ত। এটা ওদের পঞ্চম ন্যাশনাল চ্যামপিয়নশিপ। হিয়া বাবা—মা’র সঙ্গে দু’দিন পর প্লেনে যাবে।

কোনি কথা বলছে আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে ক্ষিতীশের দিকে। তখন চোখ সরিয়ে নিচ্ছে ক্ষিতীশ।

”মাদ্রাজ একেবারে সমুদ্রের ওপর। তবে নামিসনি যেন। গঙ্গা আর সমুদ্রে অনেক তফাত। সমুদ্রের তলায় কারেন্ট আছে।” ভাদু সাবধান করে দিল।

”কোনি মুশকিলে পড়বি খাবার নিয়ে। ইডলি ধোসা যা জিনিস, খেলেই মালুম পাবি। বাঙালীদের পেটে ওসব ঠিক সহ্য হবে না। ওখানে পৌঁছেই খোঁজ করবি বাঙালী হোটেল—ফোটেল কোথায় আছে।” কান্তি পরামর্শ দিল।

”না রে আমাদের সঙ্গে রান্নার জিনিসপত্তর, ঠাকুর সব যাচ্ছে।”

”তোর ভয় কচ্ছে?” ভাদু জিজ্ঞেস করল।

কোনি ছল ছল চোখে তাকাল।

”আরে ধেৎ তোর থেকেও কতো ছোট ছোট মেয়ে ওয়ার্ল্ড ঘুরছে একা। আর তুই তো অ্যাতোগুলো লোকের সঙ্গে যাচ্ছিস। ঘাবড়াসনি।” চণ্ডু হাত ধরল কোনির।

ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা পড়ল। ক্ষিতীশ কথা বলছিল একজনের সঙ্গে। মুখ ফিরিয়ে দেখল। কোনি তার দিকে তাকিয়ে, দু’গাল বেয়ে জল পড়ছে।

”ক্ষিদ্দা।” কোনি ধরা গলায় ডাকল।

ক্ষিতীশ না শোনার ভান করল।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।

”আমার ভয় করছে ক্ষিদ্দা।”

ট্রেনের সঙ্গে হাঁটছে কান্তিরা। মুখ কাত করে কোনি জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল ক্ষিতীশকে, দেখতে পেল না।

ঘণ্টা দুয়েক পর খড়্গপুর স্টেশনে ট্রেন থামল। কৌতূহলে কোনি প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পাশ থেকে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল ক্ষিতীশ।

”ক্ষিদ্দা!” কোনির চীৎকারে শুধু কামরারই নয়, প্ল্যাটফর্মেরও অনেকে ফিরে তাকাল।

”মনে আছে তো ঠিক দশটায় ঘুমোবি।”

”না।” অবাধ্য গোঁয়ারের মতো কোনি ঘনঘন মাথা দোলাল। টপ টপ করে চোখ থেকে জল ঝরছে। ”আমি কিচ্ছু শুনবো না, করবোও না। তুমি মাদ্রাজ যাবে, এটা আমার কাছে লুকিয়েছিলে কেন?”

একজন টিকিট চেকারকে এগিয়ে আসতে দেখে ক্ষিতীশ আড়ষ্ট হয়ে গেল। লোকটি তার পিছন দিয়ে চলে যাবার পর কোন কামরায় ওঠে, সেদিকে আড়চোখে নজর রাখতে রাখতে সে বলল, ”যাচ্ছি কে বলল, এখান থেকেই আমি কলকাতায় ফিরে যাব।”

”ইসস।” কোনি দু হাতে আঁকড়ে ধরল ক্ষিতীশের পাঞ্জাবির হাতা। ”যাও তো দেখি।”

”কেন আমি যাব! তুই কি কখনো আমার কথা ভাবিস?”

”ভাবি কি না ভাবি, তুমি তা জানো?”

”জানিই তো। জলে ডাইভ দিয়ে পড়ার পরই তো আমাকে ভুলে যাস।”

টিকিট চেকারটি আবার আসছে। কোনি উত্তর দেবার আগেই ক্ষিতীশ, ”কাল সকালে বহরমপুরে আসব,” এই বলেই সরে গেল।

কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে হরিচরণ একজনকে বলল, ”আপদটা দেখছি সঙ্গে চলেছে।”

কিন্তু সকালে ক্ষিতীশকে দেখা গেল না। বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য রাত্রেই চেকারের হাতে ধরা পড়ে সে তখন রেল পুলিশের হেফাজতে।

।। ১৩ ।।

ঘরের একধারে এককোণে খাটে কোনি শুয়েছিল। রঙ ওঠা শতরঞ্চি আর বালিশ, গায়ে দেবার সুতির চাদর, মাথার কাছে টেবলে ক্যাম্বিসের ছোট ব্যাগ। তাতে আছে গোটা দুয়েক ফ্রক, আর ওর সব থেকে মূল্যবান সম্পত্তি কস্ট্যুমটা। টেবলে মাজন, ব্রাশ আর অর্ধেক দাঁত পড়ে যাওয়া একটা চিরুনী। খাটের নীচে চটি।

দুই বাহুতে চোখ ঢেকে কোনি শুয়েছিল, আর অন্যান্য মেয়েরা তখন বাইরে থেকে ফিরল। ওরা মাদ্রাজ শহর দেখতে, বাজার করতে বেরিয়েছিল। কোনি যায়নি, হাতে মাত্র পনেরোটি টাকা, তাই নিয়ে বাজার করা যায় না। শহর দেখার ইচ্ছাও নেই। ওর সঙ্গে কেউ কথা বলে না, হাবেভাবে মেয়েরা বুঝিয়ে দেয় সে ওদের সমপর্যায়ভুক্ত নয়। কোনিও এড়িয়ে চলে ওদের।

আজ আবার সকালে বেরোবার সময়, বেলা হঠাৎ বলে, ”প্রণতিদি, আমাদের সঙ্গে কোনি যাবে না?”

”না বলেছে তো, শরীর খারাপ, জ্বর—জ্বর লাগছে।”

খাটে শুয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইল কোনি।

”তা হলে ঘরে কি ও একা থাকবে! কাল আমার ক্রিমের কৌটোয় খাবলা দেওয়া দেখেছি।”

”ওম্মা, বেলাদি, আমারও যে পেস্টের টিউবটা অনেকখানি খালি। ভয়ে আমি বলিনি, কি জানি কে আবার কি মনে করবে!”

”ঘরে তালা দিয়ে যাওয়া উচিত প্রণতিদি।”

”তা হলে কোনি কোথায় থাকবে!” প্রণতি ভাদুড়ির কড়া স্বরে ওরা চুপ করে গেছল।

লজ্জায় আর ভয়ে খাটের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে কোনি শুয়েছিল। থেকে থেকে চাপা একটা অভিমান গুমরে উঠছিল বুকের মধ্যে। ক্ষিদ্দা তাহলে সত্যি সত্যিই খড়্গপুর থেকে কলকাতায় ফিরে গেল! যদি এখানে সঙ্গে আসত তাহলে কষ্ট অনেক কমে যেত। অনেকের সঙ্গেই তো বাবা—মা এসেছে। ক্ষিদ্দা তাহলে এল না কেন!

হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল হিয়া। ওর বাবা—মা হোটেলে রয়েছে। তারা সকালে এসে হিয়াকে নিয়ে বেরিয়েছিল। ঘরে কাউকে না দেখে হিয়া প্রথমে থমকে গেল। তারপর কোনিকে দেখতে পেয়ে বলল, ”বাবার বন্ধু মিস্টার সারঙ্গপানির বাড়িতে আমি যাচ্ছি, প্রণতিদিকে বলে দিও। ঘণ্টা দুই পরে ফিরব।”

ঘরের আর একদিকে হিয়ার খাট। সেখানে তার বিরাট স্যুটকেশে অজস্র রকমের জিনিস। ইংরাজি কমিকস, আর ট্রানজিস্টর রেডিও বিছানায়, খাটের নীচে তিন রকমের জুতো আর চকোলেটের মোড়ক ছড়ান। হিয়া চটপট ফ্রক বদল করে চুলে ব্রাশ বোলাল। হাত ব্যাগটার মধ্যে একটা চকোলেটের বার দেখতে পেয়ে আধখানা মুখে ঢুকিয়ে বাকিটুকু ভেঙ্গে কোনির দিকে ছুঁড়ে দিল।

টুকরোটা এসে পড়ল কোনির বুকের কাছে। সেটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল হিয়ার দিকে। হিয়ার গায়ে লাগল।

একটু অবাক হয়ে হিয়া প্রশ্ন করল, ”খাও না তুমি?’

”দিলেই খেতে হবে নাকি!” কোনি শুকনো স্বরে বলল।

চকোলেট টুকরোটা কুড়িয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে হিয়া বলল, ”বুঝেছি কেন খাবেনা।’

”কি বুঝেছ?” স্প্রিংয়ের মতো কোনি ছিটকে উঠে বসল।

”যা বোঝার ঠিকই বুঝেছি। তুমি কমপ্লেক্সে ভুগছ, অযথা আমার ওপর রেগে আছ।”

হিয়া কথা বলতে বলতে বেলার টেবলের দিকে এগিয়ে গেল। ক্রিমের কৌটোটা খুলে আঙুল ডুবিয়ে খানিকটা ক্রীম তুলে গালে লাগাল। ”বাবা বলেছিলেন, রমা যোশি গতবারের মতো ছ’টা গোল্ড এবার পাবে না যদি স্টেট মীটে যেভাবে হানড্রেড ফিনিশ করেছিলে সেইভাবে তুমি কাটতে পারো। কিন্তু আমি বলছি তুমি তা পারবে না।”

হিয়া আর একটু ক্রিম তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে থমকে গেল। কোনির কাছে এসে, ওর মুখে সেটুকু লাগিয়ে দিয়েই হেসে উঠল সে এবং ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ”অত হিংসে ভাল নয়।”

কোনিকে বিভ্রান্ত করল হিয়ার এই কথাটা। আপন মনে সে বলল, ‘বয়ে গেছে আমার হিংসে করতে। বড়লোকমি দেখিয়ে চকলেট দেওয়া… কে চায় তোর ভিক্ষে, নিজের জিনিস অন্যকে দিতে হিয়া কার্পণ্য করে না, পরের জিনিস নেওয়াতেও কুণ্ঠা নেই। মুখে ক্রিমটুকু অন্যমনস্কের মতো বুলিয়ে নিয়ে কোনি আবার বলল, ‘এসব হচ্ছে বড়লোকি চাল। লোককে দেখানো আপন—পর জ্ঞান আমার নেই, বুঝি না যেন কিছু!”

ঘরে ঢুকল হরিচরণ।

”অঃ তুই একা রয়েছিস, ওরা গেল কোথায়? কি ঝামেলা দ্যাখতো, তোর নাম চারটে ইভেন্টে পাঠান হয়েছিল অথচ কোনটাতেই নাম দেখছি না। নিশ্চয় গোলমাল হয়েছে কোথাও। খোঁজ নিয়ে দেখব’খন। অমিয়া ফিরলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস তো।”

যেমন বেগে এসেছিল তেমনিভাবেই হরিচরণ বেরিয়ে গেল। আর থ হয়ে রইল কোনি। এতদূরে এসে চ্যাম্পিয়নশিপে সে নামতে পারবে না। আর কিছু সে ভাবতে পারল না। আস্তে আস্তে একটা কান্না তার সারা শরীরটাকে ঝাঁকাতে শুরু করল। ফাঁকা, বিরাট ঘরটা একটু একটু করে ভরে উঠতে লাগল মৃদু চাপা করুণ একটা স্বরে। আর তার মধ্যে একটা শব্দ মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে—”ক্ষিদ্দা, ক্ষিদ্দা।”

মেয়েরা ফিরল তর্ক করতে করতে। এবারের ওলিম্পিককে মেক্সিকো না মেক্সিকো সিটি ওলিম্পিক, কোনটা বলা সঠিক হবে। ওরা লক্ষই করল না কোনিকে।

হঠাৎ তীক্ষ্ন চীৎকারে সবাই সচকিত হয়ে বেলার দিকে তাকাল। হাতে খোলা ক্রিমের কৌটো, বেলা ক্ষিপ্তের মতো বলে উঠল,”আমার ক্রিম! আবার কে নিয়েছে এখান থেকে। কে নিয়েছে? আমি আজ বার করবই, বেরিয়ে যাবার সময় যা ছিল, এখন তার থেকে অনেক কমে গেছে।”

কে একজন বলল, ”ঘরে তো কোনি ছাড়া আর কেউ ছিল না।”

অমিয়া হঠাৎ বলল, ”দ্যাখ তো কোনির ব্যাগটা, সরিয়ে—ফরিয়ে রেখেছে কিনা।”

বেলা ছুটে গিয়ে ক্যাম্বিসের ব্যাগটা খুলে উপুড় করল। সামান্য জিনিস ক’টা মেঝেয় পড়ল। কোনি বিস্ফারিত চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে। কথা বলার ক্ষমতা যেন লোপ পেয়েছে, এই ঘটনার আকস্মিকতায়। বেলা পা দিয়ে কোনির কস্ট্যুমটা সরাতেই, ”আহ” বলে সে নিচু হল কস্ট্যুমটা তোলার জন্য। বেলা সেই মুহূর্তে ওর চুল মুঠোয় টেনে মুখ উঁচু করে ধরল।

”কি মেখেছিস? অ্যাঁ, কি মাখা রয়েছে তোর মুখে?” আবিষ্কারের উত্তেজনায় বেলার দম বন্ধ হয়ে এল।

মেয়েরা এগিয়ে এল কোনিকে ঘিরে। অমিয়া একটা আঙুল দিয়ে কোনির গাল ঘষে, আঙুলটা নাকের কাছে ধরে বিচারকের মতো গম্ভীর স্বরে রায় দিল, ”ক্রিম।”

”আমার ক্রিম।” বেলা চীৎকার করে উঠল।

তারপর ওরা সদ্য আবিষ্কৃত একটি দ্বীপের দিকে তাকিয়ে থাকা নাবিকদের মতো কোনিকে দেখতে লাগল। কোনি পা ঝুলিয়ে খাটে বসে। মুখের বিস্ময়ভাব কাটেনি তখনো, অসহায় চোখে সকলের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য তার ঠোঁট নড়ছে কিন্তু বলতে পারছে না।

”কোনি বোধহয় ফরসা হতে চায়।” একজন মন্তব্য করল।

”বাব্বা, আমি যা ভয়ে ছিলুম বেলাদি বোধহয় আমাকেই চোর সন্দেহ করছে।”

”আমার পেস্টও তাহলে কে কমিয়েছে এবার বোঝা গেল।”

কোনি এতক্ষণে কথা বলল, ”হিয়া ক্রিম বার করে আমার মুখে মাখিয়ে দিয়েছে। আমি কখনো ক্রিম মাখি না।”

”কি বললি? হিয়া?” বেলা ঠাস করে কোনিকে চড় মারল। ”হিয়ার নামে অপবাদ দিচিছস? জানিস ও কতো বড়লোক! তোর মতো দশটা মেয়েকে ও ঝি রাখতে পারে। শেষকালে কিনা হিয়াকেই চোর বানাচ্ছিস!”

”সত্যি বলছি বেলাদি। আমায় বিশ্বাস করো। হিয়া এসেছিল, আবার বেরিয়ে গেল ওর বাবার বন্ধুর বাড়িতে। চকলেটের আধখানা আমায় দিল আর তোমার কৌটো থেকে ক্রিম নিয়ে নিজে মাখল আর আমাকেও মাখিয়ে দিল।”

”গপ্পো লেখ কোনি, তুই মস্তো লেখক হবি।” বেলার ধীরস্বরে বিদ্রূপ চাবকে উঠল।

”তাহলে তো একটা দ্বিতীয় ভাগ আগে কিনে দিতে হবে।” অমিয়া তার খাটে শুয়ে মিটিমিটি হেসে বলল।

”আমি সত্যি বলছি।” কোনির স্বর দুমড়ে মুচড়ে গেল কান্নায়। ”তোমরা বিশ্বাস করো। হিয়া এলে ওকে জিজ্ঞেস কোরে দেখো।”

ওরা আর বেশি কথা বলল না। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি, ফিসফাস করল কিছুক্ষণ। কোনি দেয়ালে ঠেস দিয়ে কাঠের মতো বসে। প্রণতি ভাদুড়ি আর ধীরেন ঘোষ ঘরে ঢুকল। ওরা যেভাবে কোনির দিকে তাকাল তাতে বোঝা যায় যে ব্যাপারটা ওদের কানেও ইতিমধ্যে কেউ পৌঁছে দিয়ে এসেছে।

”হিয়া না আসা পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষা করা উচিত ছিল।” প্রণতি ভাদুড়ি ঘরের সবাইকে লক্ষ করে বলল। ”যাও, খেয়ে রেস্ট নাও।”

”অমিয়া, কাল সকালে তোর ফোর আর টু হানড্রেড হীট। যোশি ছাড়া আর কেউ তোর কম্পিটিটার নেই। তা হলেও হীটে টাইম ভাল করতে হবে। বেলা শুনে রাখ, যোশি পড়েছে তোর গ্রুপে। চেষ্টা করবি, পাঞ্জাবের কাউর বলে একটা মেয়ে শুনলাম ভাল টাইম করে এসেছে।”

ধীরেন ঘোষ প্রত্যেককে নির্দেশ দিতে দিতে শেষকালে কোনির দিকে তাকাল। ”তোর নাম যে কেন বাদ গেল বুঝছি না। বলছে তো পাঠানোই নাকি হয়নি। সব বাজে কথা, নিজেদের দোষ ঢাকতে এখন এইসব বলছে। আমি অবশ্য প্রোটেস্ট করেছি, দেখি কি হয়। তবে প্র্যাকটিসে ঢিলে দিলে চলবে না, ওটা রেগুলার করতেই হবে। মন খারাপ করিসনি, ন্যাশনাল তো বছর বছরই হয়, সামনের বছর আবার আসবি।”

মেয়েরা খাওয়া সেরে এসে বিছানায় শুয়েছে, এমন সময় হিয়া ফিরল। কোনি না খেয়েই শুয়েছিল, হিয়াকে দেখা মাত্র উঠে বসে চেঁচিয়ে বলল, ”এই তো হিয়া এসেছে।”

বেলা হাত ধরে হিয়াকে নিজের বিছানায় বসিয়ে বলল, ”আজ একটা ব্যাপার ঘটেছে। কোনি তোমাকে চোর বলেছে।”

”হোয়াট!” ঝটকা দিয়ে হিয়া উঠে দাঁড়াল দু’চোখে আগুন নিয়ে।

”বোসো বোসো, আগে আমার কথাটা শুনে নাও।” বেলা হাত ধরে টেনে হিয়াকে বসাল আবার।

”আমি জানি আমার প্রতি ও জেলাস। কিন্তু এমন নোংরা অপবাদ দেবে ভাবিনি।”

”আমরাও ভেবেছি নাকি! ক্রিম চুরি করে মুখে মেখে ধরা পড়ে গিয়ে বলেছে তুমি নাকি মাখিয়ে দিয়েছ। এমন বোকার মতো মিথ্যে কথা কেউ বলে!”

হিয়া থতমত খেয়ে গেল। প্রচণ্ড রাগটা মাথা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে যে ধাক্কাটা দিচ্ছে তা সামলে উঠে সে বলল, ”ক্রিম তো আমিই ওর মুখে লাগিয়ে দিয়েছি।”

”য়্যা!”

”হ্যাঁ তোমার কৌটোটা থেকে আমি মাখলাম, কোনির মুখেও লাগিয়ে দিলাম। কি করব বলো, তোমার পারমিশন নেবার সময় তখন ছিল না। কালও মেখেছিলাম।”

হিয়া ব্যাপারটা সেখানেই শেষ করে দিয়ে, পোশাক বদলাতে ব্যস্ত হল। সারা ঘর চুপ। আড়চোখে পরস্পরকে দেখে নিয়ে অনেকেই ঘুমের ভান করল। কোনি একদৃষ্টে হিয়ার দিকে তাকিয়ে। মনে মনে সে বলল, ‘তোমার খেয়ালখুশির জন্য আজ আমি চড় খেয়েছি, খারাপ কথা শুনেছি।’

বেলা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেছল। এখন তার রাগটা পড়ল হিয়ার উপর। বিরক্ত স্বরে সে বলল, ”পরের জিনিস না বলে ব্যবহারটা খুব অন্যায়। তোমার নয় অনেক টাকা আছে, আমার এই একটুখানি ক্রিম থেকে যদি সবাই মাখে…”

”আচ্ছা আচ্ছা, নয় তোমায় একটা কিনে দেব, হয়েছে তো।” হিয়া হেসে অপরাধীর মতো মুখ করে হাতজোড় করল। ঠিক সেই সময়ই কোনি ছুটে এসে ওকে চড় মারল।

হিয়া গালে হাত দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। বিছানায় মুহূর্তে সবাই উঠে বসেছে। কোনি ধীর পায়ে নিজের খাটে ফিরে এসে বসল।

”এটা তোমার পাওনা ছিল। বেলাদিকে জিজ্ঞাসা করো, জানতে পারবে। তোমার জন্যই আমি আজ চড় খেয়েছি, চোর বদনাম পেয়েছি।” কোনি একটু থেমে আবার বলল, ”তোমাকে আমি একটুও হিংসে করি না। আমি বস্তির মেয়ে, লেখাপড়াও জানি না, তোমার সঙ্গে পারব কেন। তবে একবার কখনো যদি জলে পাই…” দাঁতে দাঁত চেপে বাকি কথাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ায় কিছু শোনা গেল না।

।। ১৪ ।।

চিপকে সমুদ্রতীরে সুইমিং পুল।

কোনি আগে কখনো এমন পুল দেখেনি। যন্ত্রের সাহায্যে অবিরাম পরিশোধিত স্বচ্ছ জলের মধ্য দিয়ে পুলের তলদেশ দেখা যায়। একটা পিন পড়ে থাকলেও নজরে আসে। কোনি শুনেছে কলকাতায় সাহেবদের ক্লাবে এমন পুল আছে।

তিনদিকে কাজুবাদাম গাছের ডাল দিয়ে তৈরী হয়েছে গ্যালারি, মাথায় নারকেল পাতার ছাউনি। পাশেই ডাইভিং পুল। পুলের জলে প্রথম নেমে কোনি অস্বস্তি বোধ করেছিল। জলের সঙ্গে পরিচয়ের অনুভব পেতে অবশ্য তার বেশি সময় লাগেনি। হাতে স্টপ ওয়াচ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে নেই অথচ সে সাঁতার কাটছে, কোনি গত একবছর আর তা ভাবতে পারে না। কিন্তু মাদ্রাজে সে জলে নামার আগে পিঠে পরিচিত একটা হাতের স্পর্শ অভ্যাস মত না পেয়ে মুষড়ে পড়ল। কি ট্রেনিং সে করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। কেউ কিছু বলছে না, দেখিয়েও দিচ্ছে না। হিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত প্রণবেন্দু। হরিচরণের অধিকাংশ নির্দেশ অমিয়ার জন্য। তবু কোনি মোটামুটি জোরে ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইল,কয়েকটা ২৫ মিটার স্প্রিন্ট, আবার ৪০০ মিটার, মিনিট পাঁচেক টার্ন ও স্টার্ট, তারপর ২০০ মিটার মেডলি কাটলো।

স্টার্টিং ব্লকে বসে কস্ট্যুম পরা একটি মেয়ে ওদের ট্রেনিং দেখছিল। কোনি জল থেকে উঠে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় মেয়েটি হাসল।

”হোয়াটস ইওর নেম?”

”মাই নেম ইজ কনকচাঁপা পাল।”

”ইউ হ্যাভ এ বিউটিফুল স্টাইল।”

কোনি এবার ফাঁপরে পড়ল। ইংরাজীতে জবাব দেওয়ার দায় এড়াবার জন্য সে শুধু হাসল। মেয়েটি আঙুল তুলে হিয়াকে দেখিয়ে বলল, ”ইজ শী এ ফ্রি স্টাইলার?”

”কেয়া বোলতা?”

”উও ফ্রি স্টাইলার হ্যায়?”

”হাম হ্যায়। ও হ্যায় ব্রেস্ট স্ট্রোককা, মেডলিকা। তোমার স্ট্রোক কেয়া?”

মেয়েটি হেসে বলল, ”রমা যোশি।”

কোনি এবার ভাল করে তাকাল। শ্যামলা মাজা রঙ, দোহারা গড়ন। চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই দেখতে। হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল ‘৭০’ সংখ্যাটা। কোনি দ্রুত ড্রেসিং রুমের দিকে পা চালাল।

বাংলাকে প্রথম গোল্ড এনে দিল হিয়া। পাঁচটির বেশি মেয়ে ভারতবর্ষে পাওয়া যায়নি ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতার কাটার জন্য, তাই হিট করার দরকার হয়নি। হিয়া ৩ মি ৩২ সে. সময় নিল।

প্রতিযোগীদের জন্য নির্দিষ্ট গ্যালারিতে বসেছিল কোনি। দেখল ভিকট্রি স্ট্যান্ডে হিয়া উঠল আরো দুটি মেয়ের সঙ্গে। ওর গলায় মাদ্রাজের এক মন্ত্রী মেডেল ঝুলিয়ে দিল। ব্যান্ড বাজল। আর তার বুকের মধ্যে অসহ্য একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল। পুলের ওধারে বসেছে হিয়ার বাবা—মা। ছুটে গেল হিয়া। বাবা জড়িয়ে ধরে চুমু দিল। হিয়াকে কোলে টেনে নিল মা। হিয়া তোয়ালের ক্লোলটা গায়ে দিয়ে এধারে এল।

”দেখি দেখি মেডেলটা।”

হিয়াকে ঘিরে ধরল মেয়েরা।

”কনগ্র্যাটস হিয়া।”

”থ্যাঙ্কয়ু।”

”দারুণ ফিনিশ করেছে। আমি তো ভাবলুম গুজরাট যেরকম নেক অ্যান্ড নেক যাচ্ছে, টারনিংয়ে যদি হিয়া ওকে না মারতে পারে তাহলে বোধহয়—”

”আমার শুধু ওই একবারই তখন ভয় হয়েছিল। টারনিংটা আমার এত খারাপ।”

”মাইশোরের মেয়েটাকে দেখেছিস কেমন যেন আগাগোড়াই মুখ তুলে রইল।”

কোনি তফাতেই বসে রইল। হিয়া বারকয়েক গ্যালারিতে চোখ বোলাবার সময় কোনির মুখের দিকে তাকিয়েছিল মাত্র। মেয়েদের একটিই ফাইনাল ছিল, বাকিগুলি ফ্রি স্টাইলের হিট। অমিয়া ফ্রি স্টাইলের তিনটিতেই ফাইনালে উঠেছে, বেলা ২০০ মিটারে এবং হিয়া ১০০ মিটারে। কথা ছিল হিয়া ২০০ ও ৪০০ মিটারেও নামবে কিন্তু প্রণবেন্দু শেষ মুহূর্তে ওর নাম প্রত্যাহার করিয়ে নেয় এই যুক্তিতে যে, ওর অন্য ইভেন্টগুলো, যাতে ওর গোল্ড পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে, সেগুলোর ক্ষতি হবে।

তর্ক তুলেছিল হরিচরণ, ”কি এমন ক্ষতি হবে? দুটো ব্রোঞ্জ তো শ্যিওর আসতো, তারমানে বেঙ্গলের দুটো পয়েন্ট। এবার চ্যামপিয়নশিপের জন্য বেঙ্গলের খুব ভাল চান্স রয়েছে। প্রণবেন্দু তুমি শুধু হিয়ার কথাই ভাবছ, বেঙ্গলের কথাটা ভাবছ না।”

শোনা মাত্র প্রণবেন্দু দপ করে উঠেছিল। ”বেঙ্গলের কথা আমি ভাবি না, শুধু আপনারাই ভাবেন! তাহলে মেয়েটা ওখানে বসে আছে কেন?” প্রণবেন্দু আঙুলটা গ্যালারিতে বসা কোনির দিকে তুলে বলল, ”ও থাকলে বেঙ্গল শ্যিওর চ্যামপিয়নশিপ পেত, কিন্তু আপনারা ক্ষিতীশ সিঙ্গিকে জব্দ করার জন্য ওকে ভিক্টিমাইজ করলেন। আর এখন এসে বাংলার জন্য কাঁদুনি গাইছেন? এবার আমি দেখব আপনার মেয়েরা কি করে, কতো পয়েন্ট আনে!”

কোনি জানত না তাকে কেন্দ্র করে দুটো দল পাকিয়ে উঠে ঝগড়া শুরু করেছে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ফাইনাল, বিকালে ১০০ মিটার বাটার ফ্লাইয়ের। অমিয়া আর বেলা পুল থেকে ফিরে এসেই বিছানায়। ধীরেন ঘোষ বিস্কুট আর কমলা লেবু এক হাতে, অন্য হাতে মধু ভর্তি শিশি নিয়ে ঘরে ঢুকল।

”কাল সকালের জন্য। দুধ দুজনের জন্য দু’গ্লাস রেডি করে রেখো প্রণতি। ঠিক আটটায় পুলে পৌঁছনো চাই। এখন একদম রেস্ট, সাতটার মধ্যে খেয়ে নিয়েই ঘুম।”

যথাসাধ্য নির্দেশ দিয়ে ধীরেন ঘোষ ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল।

”তোমাদের একটা কথাই বলব, প্রথম গোল্ড বাংলা আজ এনেছে। শুভ জয়যাত্রায় আমরা বেরিয়েছি, শেষ গোল্ডও আমাদের, আমরা চ্যামপিয়ন হবোই। মনে রেখো, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বাঙালী তোমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারা অধীরভাবে অপেক্ষা করছে বাংলার মেয়েরা চ্যামপিয়নশিপ নিয়ে ফিরবে…ফিরবেই। একটা গোল্ড পেয়েছি, বাকি আটটাও আমরা নোব। আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না।”

পরদিন দুটি ইভেন্টের দুটিতেই প্রথম হল রমা যোশি। ২০০ মিটারে অমিয়া ব্রোঞ্জ পেল। রূপো নিল মহারাষ্ট্রের নতুন মেয়ে সাধনা দেশপান্ডে। বেলা পঞ্চম স্থান পেল। চীৎকারের গোল্ড মেডেল থাকলে সেটা পেত হরিচরণ। অমিয়া যথাসাধ্য করেছে। কিন্তু গত বছরের থেকে তার সময় ৬ সেকেন্ড কম হল।

গম্ভীর মুখে অমিয়া জল থেকে উঠে গেল। বেলা ফুঁপিয়ে উঠল কয়েকবার। হিয়া এগিয়ে এসে যোশিকে অভিনন্দন জানাল। এরপর ঘোষণা, ভিকট্রি স্ট্যান্ডে গলায় মেডেল পরা, ব্যান্ডের বাজনা। কোনি উদাস চোখে সব কিছু দেখল মাত্র।

বিকেলে মেয়েরা দল বেঁধে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গেল। কোনি পুলেই রয়ে গেল। বাটারফ্লাইয়ে রমার ধারে—কাছে কেউ আসতে পারল না। বাংলার কোন মেয়ে ফাইনালে নেই। দিল্লি আর গুজরাট বাকি মেডেল দুটি নিল। কোনি নিরুৎসুক চোখে সব কিছু দেখল।

শুক্রবার সকালে সোনা জিতল হিয়া আর রূপো পুষ্পিতা ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে। ব্রোঞ্জ গুজরাটের। চ্যামপিয়নশিপের মাঝপথে বাংলার ১৪ ও মহারাষ্ট্রের ১৬ পয়েন্ট। হিয়া ও রমার দুটি করে সোনা। চাপা একটা উত্তেজনা বাংলার ক্যামপে মৃদু কম্পন তুলল। কোনি কোন কথায় যোগ দিল না।

দুপুরে খেতে বসার আগে ধীরেন ঘোষ এসে বলে গেল, ”বাংলা আবার ভারতের সাঁতারে নিজের জায়গায়”—ডান হাতের তর্জনী মাথার উপর তুলে গলা কাঁপিয়ে বলল,”উঠেছে।”

হিয়ার ট্রানজিস্টরে রক মিউজিক বাজছিল। প্রণতি ভাদুড়ি রেডিওটা বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে ধমক দিল, ”শোনো, শোনো। ইনসপিরেশন পাবে তা হলে।”

”কিপ আপ দি ফ্ল্যাগ, এখন সমান চলেছে কিন্তু আমরা বেরিয়ে যাবই।”

রমা যোশি বিকেলে অমিয়ার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ১৫০ মিটারে টার্ন নিয়েই এবং অমিয়া যখন শেষবার টার্ন নিচ্ছে তখন সে ৪০০ মিটার শেষ করল। যেন ১০০ মিটারে প্রতিযোগিতা করছে এমন বেহিসাবীভাবে অমিয়া শুরু করেছিল। সওয়াশো মিটার পর্যন্ত রমা পিছিয়ে ছিল প্রায় ১০ মিটার। তারপরই অমিয়া মন্থর হতে শুরু করে। রমা তার সমান গতিতে কোন হেরফের না ঘটিয়ে তিনশো মিটারের পর গতি বাড়াল এবং শেষ ৫০ মিটার একা সাঁতরে এল। পাঞ্জাবের মঞ্জিত কাউর ব্রোঞ্জ নিল।

অমিয়া সকলের আগেই ট্যাক্সি করে একা ক্যামপে ফিরে আসে। শনিবার সকালে হিয়ার দুটি হিট, মেডলি এবং ব্যাক স্ট্রোকের। সব মেয়ের চোখ এখন হিয়ার দিকে। গম্ভীর হয়ে গেছে সে। ধীরেন ঘোষ আজ আর বক্তৃতা দিল না। মাথা নেড়ে বলল, ”অমিয়ার মতো ভেটারেনের কাছ থেকে এমন ব্যাডলি জাজড রেস কেউ আশা করেনি। আমরা চার পয়েন্টে পিছিয়ে পড়লুম।”

”হরিচরণদা যদি অমিয়াদিকে একটু বলেও দিত!” বেলা ক্ষীণস্বরে বলল।

”যাকগে যা হবার হয়েছে। এখন অনেক কিছু হিয়ার উপর নির্ভর করছে। কাল সকাল দুটো হিট, রাতে মেডলির ফাইনাল। তোমরা ওকে কনসেনট্রেট করতে দাও।”

ধীরেন ঘোষ চলে যাবার পর সবাই হিয়ার দিকে তাকাল, একমাত্র কোনি ছাড়া।

হিয়া শনিবার সকালের দুটো হিট থেকে অনায়াসেই ফাইনালে উঠল। ব্যাক স্ট্রোকে রমা যোশি নেই। কিন্তু মেডলির দ্বিতীয় হিট থেকে রমা ফাইনালে উঠল হিয়ার সময়কে দুই সেকেন্ড ম্লান করে। ঘোষণায় রমার সময় শোনা মাত্র হিয়া পুল ছেড়ে চলে গেল বাবা—মার সঙ্গে।

মেয়েরা ফিসফাস কথা বলছে। খাটে উপুড় হয়ে রেডিওয় হিন্দি গান শুনছে হিয়া। গত চারদিন কোনির সঙ্গে কারুর বাক্যালাপই হয়নি। অমিয়া কখনো বিছানায় শুচ্ছে, উঠে এসে জানলায় দাঁড়াচ্ছে, টেবলের এটা ওটা নাড়ছে। প্রণতি ভাদুড়ি তার খাটে শুয়ে কমিকস পড়ছে।

”অমিয়াদি শুয়ে পড়ো।”

অমিয়া বিরক্তমুখে বেলার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। ”ভীষণ মাথা ধরেছে। তখন থেকে রেডিওটা জ্বালাচ্ছে। হিয়া, ওটা বন্ধ করো।”

হিয়া রেডিও বন্ধ করার উদ্যোগ দেখাল না।

”বলছি, রেডিও বন্ধ করো।”

হিয়া একটু জোর করে দিল রেডিওর শব্দ। অমিয়া চীৎকার করে উঠল, ”বন্ধ করবে কি করবে না, আমার ভাল লাগছে না।”

”রেডিও শুনতে আমার ভাল লাগছে।” হিয়া শুকনো গলায় বলল, ”আপনি চেঁচাবেন না।”

কি ঔদ্ধত্য! অমিয়া অবাক হয়ে ঘরের সকলের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কেউই তার দিকে তাকিয়ে নেই, এমনকি বেলাও গভীর মনোযোগে রহস্য কাহিনী পাঠে ব্যস্ত। এতদিন বাংলার মেয়ে সাঁতারু মহলে সে সম্রাজ্ঞীর মতো বিরাজ করছে। এই মুহূর্তে সে বুঝল তার মাথা কেটে মুকুট তুলে নিয়েছে হিয়া। এবার ওকে মধ্যমণি করেই ওরা ঘুরবে ওদের প্রশংসা, মনোযোগ এবার থেকে পাবে হিয়া। তার দিন ফুরিয়ে গেছে। বিছানায় এসে বসল অমিয়া। দিন কি সত্যিই ফুরিয়ে গেছে! কাল আছে ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল, ৪×১০০ রিলে। দেখা যাক সত্যিই ফুরিয়ে গেছি কিনা, অমিয়া ভাবল, কাল আমাকে দেখাতেই হবে।

কিছু পরে প্রণতি ভাদুড়ি উঠে এসে রেডিওটা বন্ধ করে দিল। হিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।

.

সন্ধ্যায় পুলের হাজার হাজার ওয়াটের আলোয় স্টার্টিং ব্লকের উপর হিয়ার লাল কস্ট্যুম একটি স্থির শিখার মতো অপেক্ষা করছে। তার পাশে রমা যোশি, তার পাশে গুজরাটের আমি পটেল। স্টার্টারের বন্দুকের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠল হিয়া।

বাটারফ্লাইয়ে রমার তুল্য ভারতে কেউ নেই। প্রায় দশ মিটারে সে হিয়াকে পিছনে ফেলে গেল। শুশুকের মতো ঢেউ খেলানো গতিতে। বোর্ড ছুঁয়েই ব্যাক স্ট্রোক। হঠাৎ গ্যালারী উদগ্রীব হয়ে উঠল। হিয়া এবার ব্যবধান কমাচ্ছে।

”গো হিয়া, গো।”

”কান অন রমা।”

গ্যালারী তোলপাড় হতে শুরু করল পুলের জলের মতোই। ব্যাক স্ট্রোকের শেষে রমা তখনো প্রায় চার মিটার এগিয়ে। এবার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং হিয়া জানে এইবারই তাকে বড় ব্যবধান তৈরী করতে হবে। এরপরই ফ্রি স্টাইল এবং রমার সঙ্গে এখানে সে পারবে না।

প্রচণ্ডভাবে হিয়ার দুটো হাতের সঙ্গে তাল দিয়ে পা দুটো জলে ধাক্কা দিতে শুরু করল। রমার সঙ্গে পাশাপাশি এসে গেল পুলের মাঝামাঝি এবং এই প্রথম সে রমাকে ছাড়িয়ে গেল। পাশে মুখ ফিরিয়ে হিয়াকে দেখতে দেখতে রমাও জোর বাড়াল।

গ্যালারীতে প্রলাপ চীৎকার শুরু হয়েছে। বাংলার মেয়েরা একসঙ্গে তীক্ষ্ন কণ্ঠে চীৎকার করে যাচ্ছে ‘হিয়া হিয়া।’ শুধু অমিয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে অনুত্তোজিত বসে কোনির পাশে, মুখে পাতলা একটা হাসি নিয়ে। আপন মনেই সে বলল, ”হিয়া জিতবে।”

এবং হিয়া জিতল।

ফ্রি স্টাইল শুরু করেছিল হিয়া চার মিটার এগিয়ে থেকে। সেই ব্যবধান থেকে রমা অর্ধেকটা কেড়ে নিল সাঁতার শেষের তিরিশ মিটার বাকি থাকতেই। এবার শুরু হয় দুজনের মধ্যে বাঁচা—মরার লড়াই। ইনচি—ইনচি করে রমা এগিয়ে আসতে থাকে। ফিনিশিং বোর্ডে টাইম কীপাররা ঘড়ি হাতে ঝুঁকে অপেক্ষা করছে। গ্যালারীতে লোকেরা সরে আসছে ফিনিশ দেখার জন্য।

হিয়ার হাত বোর্ড ছোঁয়ার আধ সেকেন্ডের মধ্যেই রমার হাত পৌঁছল।

”বলেছিলুম।” অমিয়া আবার আপন মনে বলল।

কে জিতেছে জানার জন্য ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল এবং মেয়েরা যখন হিয়াকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের চোখের জল তার গালে মাখিয়ে দিচ্ছিল, তখন একমাত্র কোনিই দেখতে পেল, অমিয়ার চোখের কোণে জল।

বাংলা এখনো দু’ পয়েন্ট পিছিয়ে। হিয়া ও রমার সোনা তিনটি করে। ধীরেন ঘোষ উত্তেজিত হয়ে রাত্রে খাবার আগে মেয়েদের বলে গেল, ”কাল সকালে আর একটা গোল্ড পাচ্ছে হিয়া! বেঙ্গল এগিয়ে যাবে।”

”ধীরেনদা, ভুলে যাবেন না, তারপরও দুটো ফ্রি স্টাইল ইভেন্ট আছে।” অমিয়া ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনে বলল, ”রমা যোশি ইন্ডিয়া রেকর্ড হোল্ড করছে।”

রবিবার সকালে অমিয়া পুলে গেল না। মেয়েরা চীৎকার করতে করতে যখন ঘরে ঢুকল, সে তখন একমনে চিঠি লিখছিল। মুখ না তুলেই বলল, ”হিয়ার তাহলে চারটে গোল্ড হল।’

”অমিয়াদি, দারুণ ব্যাপার, অঞ্জু একটুর জন্য ব্রোঞ্জ মিস করল।”

”অমিয়াদি, যোশিকে বিট করতে পারবে না?”

”অমিয়াদি, সবাই বলছে এখন তোমার ওপরই চ্যামপিয়নশিপ নির্ভর করছে। বাংলা—মহারাষ্ট্র এখন সমান পয়েন্ট।”

কোনির চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে। সে তখন একটা সেফটিপিন দিয়ে সেটাকে ব্যবহারযোগ্য করার চেষ্টায় ব্যস্ত। এইসব উত্তেজনা তাকে স্পর্শ করছে না।

অমিয়া লেখা বন্ধ করে বলল, ”চেষ্টা করব।”

জাতীয় সাঁতারের আজ শেষদিন। সন্ধ্যায় ছটি মাত্র অনুষ্ঠান। প্রথমটিই মেয়েদের ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ফাইনাল। আটজন প্রতিযোগীর মাঝের লেনগুলিতে রমা, অমিয়া, হিয়া। আজ গ্যালারী উপচে পড়ছে। কোনি খালি পায়ে বসে। সেফটিপিনে চটিটাকে চলার যোগ্য করা যায়নি।

অমিয়া বন্দুকের শব্দের আগেই জলে পড়ল। দ্বিতীয়বার ফলস—স্টার্ট নিল মহারাষ্ট্রের সাধনা দেশপান্ডে এবং হিয়া। এরপর একসঙ্গেই আটজন জলে পড়ল বন্দুকের শব্দে। তিরিশ মিটারে দেখা গেল দুজন এগিয়েছে বাকিদের থেকে—রমা ও অমিয়া। তারপরেই প্রচণ্ডভাবে নিজেকে বিস্ফোরিত করে অমিয়া পিছনে ফেলল রমাকে। টার্ন নিয়েই সে রমার থেকে এক মিটার এগিয়ে গেছে। রমার কিছুটা পিছনে হিয়া, তার পাশেই সাধনা। হরিচরণ চীৎকার করতে করতে কুঁজো হয়ে পড়েছে।

একটা অস্ফুট কাতরানি শোনা গেল। অমিয়া জলে ভাসছে আর ছটফট করছে পেট চেপে ধরে। মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত।

”ক্র্যাম্প, ক্র্যাম্প ধরেছে।”

জলে লাফিয়ে পড়ল দুজন। ছুটে গেল বাংলার অফিসিয়ালরা। হরিচরণ কপালে হাত দিয়ে বসল। রমা যোশি তখন ফিনিশিং বোর্ড ছুঁয়েছে। তার পিছনে হিয়া এবং সাধনা।

মহারাষ্ট্র তিন পয়েন্ট এগিয়েছে। শেষ ইভেন্ট ৪×১০০ মিটার রীলেতে। সোনা জিতে ১০ পয়েন্ট আনতে না পারলে বাংলার চ্যামপিয়ন হওয়া সম্ভব নয়। এখন হিয়া ও রমা দুজনেরই চারটি সোনা। পয়েন্টে দুজনেই সমান হয়ে ব্যক্তিগত সোনা পাওয়ায় কে এগিয়ে যাবে, সেটাও নির্ভর করছে এই ইভেন্টের উপর।

আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই চ্যাম্পিয়নশিপের শেষ অনুষ্ঠান মেয়েদের ৪×১০০ রীলে শুরু হবে। ছেলেদের ফাইনাল এইমাত্র শেষ হল।

অমিয়া মেডিক্যাল রুমের টেবলে শুয়ে। ঘরের বাইরে ধীরেন ঘোষ বিষণ্ণকণ্ঠে বলল, ”এত কাছে এসে ভরাডুবি হল। বাংলা তাহলে চ্যামপিয়নশিপটা পেল না, ভাগ্য, ভাগ্য!”

হরিচরণ থমথমে মুখে বলল, ”অমিয়া তো নামতে পারবে না, তাহলে রীলে টিমটা কি হবে? আর ক’মিনিট মাত্র সময় রয়েছে। হিয়া, পুষ্পিতা, বেলা…ফোর্থ মেয়ে কী হবে?”

”রিজার্ভে আছে অঞ্জু আর—” ধীরেন ঘোষ থেমে গেল। হরিচরণ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে।

প্রণবেন্দু এবং আরো তিন—চারজন ব্যস্ত উত্তেজিত হয়ে হাজির হল।

”একি, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে! রীলে টিমের কি হবে, আর যে সময় নেই।” প্রণবেন্দু বলল।

”সেইটেই তো ভাবছি।”

”ভাবাভাবির কিছু নেই, কনকচাঁপা পালকে নামান, অমিয়ার জায়গায়।” একজন রুক্ষ স্বরে বলল।

”কিন্তু—”

”কিন্তু—ফিন্তু কিছু নেই ধীরেনদা। বেঙ্গলের এখনো একটা আউটসাইড চান্স আছে ওকে নামালে। অঞ্জু একদমই পারবে না।”

”আপনারা বসে বসে ভাবুন তাহলে, আমরাই ব্যবস্থা করছি।”

প্রণবেন্দু প্রায় ছুটেই চলে গেল। ধীরেন ঘোষ একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে তারপর আচমকা ঘুম ভাঙ্গা মানুষের মতো অনুসরণ করল প্রণবেন্দুকে। হরিচরণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

কোনি যথারীতি গ্যালারিতে বসে। বাংলার মেয়েরা শুকনো মুখে অনিশ্চিত স্বরে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। পুরুষদের মেডলি রীলে ফাইনাল এবার শুরু হবে। প্রতিযোগীরা স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মে আসছে।

”কোনি, কোনি!”

হাত নেড়ে প্রণবেন্দু এবং আরো কয়েকজন ডাকছে। কোনি বুঝতে পারল না, তাকেই ওরা ডাকল কিনা।

”কোনি তাড়াতাড়ি, কুইক।”

অবাক হয়ে কোনি তখনো বসে। ধীরেন ঘোষ হাত নাড়ছে তার দিকে। ”কোনি, আর সময় নেই, তোমায় নামতে হবে রীলেতে অমিয়াদির জায়গায়।” হিয়া গ্যালারীতে উঠে এসে ওর হাত ধরল।

শিরশির করে উঠল কোনির শরীর।

”আমি!”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি। কস্ট্যুম পরে নাও।”

”না, আমি নামব না।” কোনি হাত সরিয়ে নিল।

”বেঙ্গল চ্যামপিয়ন হতে পারবে না।”

”তুমি বেঙ্গলকে ভালবাস না?”

”না, বাসি না।” কোনি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। বুকের থেকে উঠে আসা একদলা অভিমান ওর কণ্ঠে আটকে গেল। ”ভালবাসতে হয় তুমি বাসো। আমি গরীব, আমাকে দেখতে খারাপ, লেখাপড়া জানি না, কত কথা শুনলুম। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। জোচ্চচুরি করে আমাকে বসিয়ে রেখে এখন ঠেকায় পড়ে এসেছ আমার কাছে—”

হিয়া ঝুঁকে কোনির দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দাঁত চেপে চাপাস্বরে বলল, ”আমি নিজের জন্য আসিনি। বেঙ্গলের হয়েই তোমাকে ডাকতে এসেছি।”

”না। এসেছ নিজের জন্য। তুমি নিজের জন্য আর একটা গোল্ড চাও, রমা যোশিকে—” কোনি থেমে গেল।

চড় মারার জন্য হিয়ার হাতটা উঠেছে। কোনিও হাত তুলেছে। ছোরার মতো চারটে চোখের প্রচণ্ড সংঘর্ষ স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ল। ধীরস্বরে হিয়া বলল ”কোনি তুমি আনস্পোরটিং।”

”কি বললে?” ছিলে—ছেঁড়া ধনুকের মতো কোনি উঠে দাঁড়াল। ”আমি কস্ট্যুম আনিনি।”

”আমার একস্ট্রা আছে।”

.

অ্যামপ্লিফায়ারে ঘোষণা হচ্ছে, এবার শেষ অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে। মেয়েদের টিম চ্যামপিয়নশিপ নির্ধারিত হবে এই রীলে সাঁতারেই। একে এক টিমের নাম পড়া হচ্ছে। পুলের প্রধান ফটকে এই সময় একটা হৈ চৈ উঠল। একটা পাগলা লোক তীরের মতো দৌড়ে পুলিস ও ভলান্টিয়ারদের ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তাকে তাড়া করেছে দু—তিনজন। প্রতিযোগীরা জলে নেমে শরীর ভিজিয়ে উঠে এসেছে। এখন তোয়ালেতে গা মোছায় ব্যস্ত। হিয়ার হাত থেকে তোয়ালেটা টেনে নিল কোনি।

”অন দা বোর্ড।” স্টার্টারের গলা শোনা যেতেই সারা পুলে ঝপ ঝপ করে স্তব্ধতা নেমে এল। ব্লকের উপর উঠেছে মহারাষ্ট্রের সাধনা, পাঞ্জাবের মঞ্জিত, বাংলার হিয়া, এবং আরো দুটি মেয়ে। পাঁচটির বেশি টিম হয়নি।

”গেট সেট…”

নিখুঁতভাবে জলে পড়ল হিয়া ও সাধনা। পুলের গ্যালারীতে মর্মরধ্বনি ক্রমশ ধাপেধাপে উঠতে শুরু করল যখন হিয়া আগাগোড়া সাধনাকে পিছনে রেখে পুষ্পিতাকে তিন মিটার আগুয়ান থাকার সুবিধা দিল।

কিন্তু পুষ্পিতা এই সুবিধাটা ৫০ মিটারের বেশি ধরে রাখতে পারল না। মহারাষ্ট্রের লিন্ডা ডিসুজা তাকে অবহেলায় দুই লেংথে পিছনে ফেলল। ব্লকের উপর দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত বেলা দেখল তার পাশের লেনে ঝাঁপিয়ে পড়ল মহারাষ্ট্র।

ব্লকের পিছনে দাঁড়ানো হিয়া ফিসফিসিয়ে বলল, ”বেলাদি অল আউট… বেলাদি লড়ে যাও।”

বেলা লড়ে গেল। সাধ্যের থেকেও নিজেকে বাড়িয়ে বেলা সাঁতার দিল। যে—কোনো দিন, যে—কোনো সময় দীপ্তি কারমারকার অন্তত চার লেংথে বেলাকে পিছনে ফেলবে। কিন্তু আজ বেলারই দিন। দীপ্তি দু’ লেংথের ব্যবধানটা এক ইঞ্চিও বাড়াতে পারল না। বেলা যে এই ফারাকটা বজায় রাখতে পারবে, বাংলার কেউ আশা করেনি।

হিয়া হাতটা চেপে ধরেছে কোনির। একটা মোটর এঞ্জিন স্টার্ট নেবার চেষ্টায় থরথর করে উঠেই আবার থেমে যাচ্ছে। এমনভাবে কোনির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একদৃষ্টে সে জলে বেলার দিকে তাকিয়ে। স্টার্টিং ব্লকে ওঠার জন্য সে যখন পা তুলতে যাবে তখন—

”কো ও ও ও নিইইই!”

পা—টা নেমে এল।

”কো ও ও নিইইই!”

তিন দিকের গ্যালারি সাঁতার থেকে একবার চোখ ফেরাল। পুলের পাশে দু—তিনটি ভলান্টিয়ারের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে ময়লা পাঞ্জাবি মাথায় কাঁচাপাকা চুল পুরু লেন্সের চশমা পরা একটি লোক।

”ফাইট, কোনি ফাইট।”

বকসিংয়ের ভঙ্গিতে দুটো হাত চালাচ্ছে, ”ফাইট, কোওওনিই।”

একটা আট সিলিন্ডার এঞ্জিনে হঠাৎ যেন স্পার্ক প্লাগ থেকে বিস্ফোরণের বার্তা পৌঁছেছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ধ্বক ধ্বক করে উঠল কোনি। চমকে হাতটা টেনে নিল হিয়া।

”ক্ষিদ্দা!”

হিয়া ঠেলে দিয়ে বলল, ”কোনি ওঠো, কুইক।”

ব্লকে উঠতে উঠতে কোনি বলল, ”ক্ষিদ্দা এসেছে।”

রমা যোশি জলে পড়ল। তিন সেকেন্ড পর কোনি।

পুলে যদি জলের বদলে মাটি থাকত তাহলে বলা যেত একটা কালো প্যান্থার শিকার তাড়া করেছে। কোনির শিকার টাইম—কীপারদের হাতের ঘড়ি।

তিরিশ মিটার পর থেকেই দর্শকরা বুঝতে পারল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তারা নিশ্বাস ফেলার সময়টুকু দিতেও ভুলে গেল। গলায় স্বর নেই। পলক পড়ছে না। গ্যালারির বহু লোক নেমে এসে পুলের ধারে দাঁড়িয়েছে। ভলান্টিয়াররাও।

জলকণায় তৈরী একটা আচ্ছাদনের ঘেরাটোপের মধ্যে কোনি যেন অশরীরী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। টার্নিংয়ের পরই দেখা গেল সে রমা যোশির পাশে। বিপদ এসে গেছে, এটা বুঝতে পেরেছে যোশি। জোর দিল সে। কোনি তবুও পাশে। আরো চল্লিশ মিটার পাশাপাশি রইল ওরা।

এরপরই অবরুদ্ধ উত্তেজনা ফেটে পড়ল পুলের চারধারে। কোনি প্রায় এক হাত এগিয়ে এসেছে। আর দশ মিটার বাকি। রমা বুকে বাতাস ভরে জলের উপর যেন লাফিয়ে উঠল হাতের প্রচণ্ড টানে।

চারিদিকে অন্ধকার, কোনি কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর একটা যন্ত্রণা তার শরীরকে কামড়ে ধরেছে। সেটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে বারবার নিজেকে ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার থেকে বেরোবার জন্য দাপাদাপি করছে তার শরীর। একটা শেষ চেষ্টা তাকে মরিয়া করে তুলল।

”কো ও ও নি ই ই!”

দীর্ঘ সুরেলা ধ্বনি জলের উপর দিয়ে ভেসে কোনির শরীরে মৃদু মৃদু আঘাত দিল। শিশু যেমন হাত বাড়িয়ে দীর্ঘ অদর্শনের পর মাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেইভাবে তার হাত সে বাড়াল এবং বোর্ড স্পর্শ করল। রমা যোশির আগেই।

.

হিয়া আর বেলার হাত ধরে কোনি জল থেকে উঠেই টলে পড়েছিল, ধীরেন ঘোষ জড়িয়ে ধরল। ছুটে আসছে বাংলার মেয়েরা। রমা যোশির ক্লান্ত হাত কোনির পিঠে চাপড়ে দিয়ে গেল। কোনি চোখ বন্ধ করে হাঁফাচ্ছে। ওকে ঘিরে একটা ভীড় বৃত্ত রচনা করেছে। অভিনন্দন আর আদরে সে ডুবে যাচ্ছে।

এরপর ভিকট্রি স্ট্যান্ডে। একে একে গলায় মেডেল পরা, ব্যান্ড বাজনা। গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে কোনি পুলের ধার দিয়ে ফিরতে ফিরতে থমকে দাঁড়াল। ক্ষিতীশ পিটপিট করে তাকিয়ে। মুখে দশ—বারো দিনের দাড়ি। শরীরটা আরো শীর্ণ হয়ে গেছে।

”কোথায় ছিলে?”

”বল তো কোথায় ছিলুম!”

কোনির ঠোঁট দুটি থরথর করে উঠল। জলে ভরে আসছে দু’চোখ। মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।

”মুখ্যুরা তোর টাইমটা রাখেনি, রাখলে দেখতে পেত…কি পেত বল তো?”

কোনি কথাগুলোকে অগ্রাহ্য করে রেগে উঠল। ”কোথায় লুকিয়ে ছিলে তুমি? খালি বল তো আর বল তো!”

”কোথায় ছিলুম জানিস, ওইখানে। কুঁজো হয়ে ক্ষিতীশ ডানহাতের তর্জনীটা তুলে পুলের জলের দিকে দেখাল। ”ওই জলের নীচে লুকিয়ে ছিলুম আর বলছিলুম—সব পারে, মানুষ সব পারে…ফাইট কোনি, ফাইট।”

”মিথ্যুক, মিথ্যুক।” কোনি ছুটে এসে ক্ষিতীশের বুকে দুমদুম ঘুসি মারতে শুরু করল। ‘কিচ্ছু দেখিনি, কিচ্ছু শুনিনি। যন্ত্রণায় তখন আমি মরে যাচ্ছিলুম।”

”ওইটেই তো আমি রে, যন্ত্রণাটাই তো আমি।”

বলতে বলতে ক্ষিতীশ হা হা শব্দে দরাজ গলায় হেসে উঠল। তখন অনেকেই তাদের দিকে তাকাল এবং দেখল পাগলটে একটা লোকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ফোঁপাচ্ছে—যে মেয়েটি আশ্চর্য সাঁতার দিল, আর তার মাথায় টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে।

কুড়োন

কুড়োন – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

এই নিয়ে পরপর চারদিন অনিরুদ্ধ শব্দটা শুনল। সে ভারত দলে, বাংলা রাজ্য দলে খেলেছে, ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান ক্লাবে আট বছর আগেও ফুটবল খেলেছে। শব্দটা তার কাছে খুবই পরিচিত। কিন্তু রাত বারোটায় কেন? দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে অবাক হয়ে ভাবল, এত রাতে যে ফুটবলে লাথি মারছে সে পাগল ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

শিমুলহাটিতে পাগল! ফুটবলে শট নেওয়ার মতো পাগল বালিগঞ্জ থেকে ট্রেনে দশ কিলোমিটার দূরে এই আধা—শহুরে শিমুলহাটিতে কে থাকতে পারে? অনিরুদ্ধ মনে মনে চৌধুরিপাড়া, কালীতলা, মণ্ডলদিঘি এলাকার চেনা বাড়িগুলোয় খোঁজাখুঁজি করে কাউকে পেল না। জনাদশেক অল্পবয়সী ছেলে, কালীতলা স্পোর্টিয়ে ফুটবলের ট্রেনিং নেয় বটে, কিন্তু ফুটফুটে জোছনায় মাঝরাতে স্বামী স্বরূপানন্দ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঁচিলঘেরা মাঠে ফুটবল খেলবে, এতটা পাগল তারা নয়।

আগামীকাল পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় মাঠ ভেসে যাচেছ, তা ছাড়া চৌধুরিবাড়ির সদর দেয়ালের ইলেকট্রিক আলো সারারাত জ্বলে। তাতে মাঠের পুবদিকের কিছুটা আলোকিত থাকে। এই আলো আর জ্যোৎস্না মিলিয়ে মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অনিরুদ্ধ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পাঁচিল ঘেঁষে বটগাছটার মগডাল তিনতলা ছাড়িয়ে উঠে রয়েছে দৃষ্টি আড়াল করে। সে বারান্দার এধার থেকে ওধার গেল। মাঠের একটা ফালি দেখতে পেল বটে কিন্তু কোনও জনমানব নেই।

দশ—বারো সেকেন্ড অন্তর শব্দটা হয়েই চলেছে। স্কুলমাঠের দু’দিকে বাড়ি, চৌধুরিদের আর ঘোষেদের। ওরা কি কেউ শুনতে পাচ্ছে না? তা ছাড়া স্কুলের বুড়ো বেয়ারা রাখালদা তো ওই স্কুলবাড়ির পেছনে একটা ছোট্ট ঘরে থাকে, সেও কি কালা হয়ে গেছে? অনিরুদ্ধ শব্দের ধরনটা কান পেতে শুনল। কেউ একজন ফুটবলে শট নিচ্ছে দেয়াল লক্ষ্য করে। ধপাস ধপাস শব্দটা দেয়ালে বল লাগারই, মনে হচ্ছে যেন টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। এত রাতে প্র্যাকটিস! একবার স্কুলমাঠে গিয়ে দেখে এলে কেমন হয়।

অনিরুদ্ধ একতলায় নেমে সদর দরজার খিল খুলতেই দোতলা থেকে তার বিধবা দিদি অমলার গলা শোনা গেল।

”কে রে অনি নাকি? এত রাতে কোথায় বেরোচ্ছিস?”

”অনেকক্ষণ ধরে নাগাড়ে শব্দ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফুটবলে কেউ শট নিচ্ছে। একবার দেখে আসি পাগলটা কে?”

দরজা খুলে অনিরুদ্ধ রাস্তায় বেরোল। বাড়ি থেকে স্কুলের মাঠটা পঞ্চাশ মিটার দূরে। কিন্তু পাঁচিল ঘুরে স্কুলের ফটক দিয়ে মাঠে ঢোকার জন্য হাঁটতে হয় প্রায় তিনশো মিটার।

অনিরুদ্ধ পঁচিশ বছর আগে এই স্কুলমাঠেই প্রথম ফুটবল খেলেছে, তখন সে পড়ত এই স্বামী স্বরূপানন্দ স্কুলে। ইন্টার—ক্লাস খেলা ছিল। ক্লাস সিক্সের সঙ্গে এইটের খেলা। তখন সে সিক্সে পড়ে। ক্লাসের টিমে তার নাম ছিল না। বাড়ির পাশেই মাঠ আর তার নিজের ক্লাসের খেলা, তাই সে মাঠে হাজির হয়েছিল কৌতূহল নিয়ে।

মাঠের ধারে তাদের ক্লাসের ছেলেদের জটলা দেখে সে এগিয়ে যায়। ছেলেরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বারবার তাকাচ্ছে ফটকের দিকে, যেন কারও আসার কথা কিন্তু সে এখনও এসে পৌঁছয়নি।

”নির্মল কি জানে আজ ওর খেলা আছে?”

”নিশ্চয় জানে, আমি নিজে ওকে টিফিনের সময় মনে করিয়ে দিয়েছি।”

”তা হলে! ও তো কথার খেলাপ করার মতো ছেলে নয়, খুব সিরিয়াস। সনৎ, আর ক’মিনিট আছে রে?”

”পাঁচটা বাজতে সাত। ঠিক পাঁচটায় মাঠে না নামলে সার ওয়াকওভার দিয়ে দেবেন। ক্লাস টেনকে, মনে আছে কী করেছিলেন সেদিন? জাস্ট তিন মিনিট টাইম দিয়েছিলেন। ওরা কেতা দেখিয়ে ইচ্ছে করে দেরিতে নামতে গেছল। একেবারে স্ক্র্যাচ।”

নির্মলের বাড়িতে কেউ একজন এখুনি দৌড়ে যা। টিমের গোলকিপার, ও না এলে তো ক্লাস সিক্স ডুবে যাবে। টিমের সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট পজিশান।”

একজন ছুট লাগাল নির্মলের বাড়ির দিকে। ক্লাস এইট মাঠে নেমে গোলে শট নিচ্ছে। গোলকিপার চঞ্চল ফুলহাতা কালো গেঞ্জি পরে দুদিকে দারুণ স্টাইলে ঝাঁপিয়ে খপাখপ বল ধরছে। গেমস টিচার প্রতাপবাবু হাফপ্যান্ট পরে মাঠের সেন্টার সার্কেলে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজিয়ে অপেক্ষা করছেন।

নির্মলের বাড়ি খুব কাছেই, ছুটে গেলে আধমিনিট। ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল।

”ওর বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছেন, তবে চাপা যাননি। নির্মল হাসপাতালে গেছে।”

ছেলেটি শুধু এইটুকু জেনেই ফিরে এসেছে। সর্বনাশ! তাহলে এখন কী হবে?

”ঘনা, তুই এখনি প্রতাপবাবুকে গিয়ে বল দু’মিনিট একস্ট্রা সময় দিন। আমাদের গোলকিপারের বাবা হাসপাতালে, নির্মল সেখানে গেছে। জাস্ট দু’মিনিট টাইম চাই।” টিমের ক্যাপ্টেন শঙ্কর ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে উত্তেজিত চোখে এধার—ওধার তাকাল গোলকিপার খুজতে।

”এই তো অনিরুদ্ধ। বেশ লম্বা, নেমে পড়, নেমে পড়।”

হতচকিত অনিরুদ্ধ দু’পা পিছিয়ে গেল ভয়ে। পেছনে তাকিয়ে দেখে নিল গেটটা কত দূরে। ঘুরে দৌড়তে যাবে, ততক্ষণে তিনজন ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরেছে।

অনিরুদ্ধর গলা দিয়ে দুটো শব্দ বেরোল, ”আমি!”

ধমক দিয়ে শঙ্কর বলল, ”হ্যাঁ তুই। জামাটা খোল, সনৎ তোর জামাটা ওকে পরিয়ে দে। শোন, তুই জীবনে গোলে খেলিসনি আমরা জানি। গোল খেলে আমরা কিছু মনে করব না। যেভাবে পারিস বল আটকাবি আর ওদের যারই পায়ে বল দেখবি তারই পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বি।”

কথা বলতে বলতে শঙ্কর জামাটা টেনে অনিরুদ্ধর মাথা গলিয়ে বার করে নিল। সনৎ তার সাদা টি—শার্টটা অনিরুদ্ধর মাথা গলিয়ে পরাতে পরাতে বলল, ”পা চালাবি, কনুই দিয়ে গুঁতোবি, দেখবি ভয়ে তোর কাছে কেউ আসবে না।”

অনিরুদ্ধ বিব্রত মুখে বলল, ”তখন তো দূর থেকে শট মারবে।”

”নিশ্চয়। দূর থেকেই তো মারবে। ভগবান তা হলে তোকে দুটো লম্বা লম্বা হাত দিয়েছেন কীজন্য? হাতদুটো এবার কাজে লাগা। যা, মাঠে নাম।”

সনৎ পিঠে একটা চড় মেরে ধাক্কা দিল। পুরো সাইজের মাঠ নয়, প্রতি দলে সাতজন। ছয়জনের পিছু নিয়ে অনিরুদ্ধ দক্ষিণ দিকের গোলের দিকে এগিয়ে গেল। মাথায় গুনগুন করছে শঙ্করের উপদেশ: ‘যার পায়ে বল তার পায়ে ঝাঁপ।’

পনেরো—পনেরো তিরিশ মিনিটের ম্যাচ। প্রথম মিনিটেই অনিরুদ্ধ কাজে লাগাল শঙ্করের উপদেশ। বলটা উঁচু হয়ে ডানদিক থেকে এসে পড়ছে পেনাল্টি সীমানার দাগের ওপর। অনিরুদ্ধ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল। ছেলেটি পা দিয়ে বলটা সবেমাত্র চেপে ধরেছে। তখনই অনিরুদ্ধ দু’হাত বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল পায়ের ওপর।

”উহহহ” বলে ছেলেটি পায়ের গোছ দু’হাতে চেপে জমিতে গড়িয়ে পড়ল। বলটা বুকে জড়িয়ে অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়াতেই শঙ্কর ছুটে এসে তার পিঠ চাপড়ে বলল, ”দারুণ। এইভাবে খেলে যা।”

সেইভাবেই সে খেলে গেল। ক্লাস এইটের দু’জনকে সে শুধু পায়ের ওপর ঝাঁপিয়েই মাঠের বাইরে পাঠাল পায়ে বরফ ঘষার জন্য। মাঠে ফিরে তারা প্রায় দর্শক হয়েই থেকে যায়। প্রতাপবাবু তিনবার ওয়ার্নিং দিলেন অনিরুদ্ধকে। চতুর্থবার দিলেন পেনাল্টি। খেলা শেষ হতে তখন দু’মিনিট বাকি, ফল ০—০।

শঙ্কর এসে কানে কানে বলে গেল, ”আগে দেখে নিবি কোন পায়ে শট নিচ্ছে আর কোন দিকে তাকাচ্ছে, তারপর জয় মা কালী বলে একদিকের পোস্ট লক্ষ্য করে ঝাঁপাবি, এসপার—ওসপার যা হয় হবে।”

অনিরুদ্ধ তাই করল। শটটা যে নিচ্ছে সে কোনদিকে তাকাল আর কোন পায়ে শট নিতে যাচ্ছে, এই দুটো ব্যাপার লক্ষ করে সে ডান দিকে ঝাঁপাল। কী আশ্চর্য, বলটা তার ডানদিকেই জমি ঘেঁষে এল। ডানহাত বাড়িয়ে বলটাকে সে ঠেলে বারপোস্টের পাশ দিয়ে গোল লাইনের বাইরে পাঠাল। কর্নার। নিজের কাজে সে নিজেই অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। পেনাল্টি সেভ করার গৌরবটা সে উপভোগ করেছিল পরের দিন ক্লাসে গিয়ে।

”সত্যি বলছি বিশ্বাস কর, এটাই আমার জীবনে প্রথম গোলকিপিং!” কথাটা অন্তত সাত—আটবার তাকে স্কুলে বলতে হয়েছিল। সে নিজেও অবাক হয়েছিল নিজেকে নিয়ে, এভাবে খেলা সম্ভব হল কী করে! মা—কালীর নাম, শঙ্করের কথামতো তখন নিতে ভুলে গেছল। বুকের মধ্যে শুধু ধড়াস ধড়াস শব্দ। ‘এসপার—ওসপার যা হয় হবে’ শুধু এই কথাগুলোই মাথায় ভোঁ ভোঁ করছিল।

প্রতাপবাবু পরদিন টিচার্স রুমে ডেকে পাঠিয়েছিলেন টিফিনের সময়।

”দারুণ খেলেছ কিন্তু গোলকিপিংয়ের অ আ ক খ—ও তুমি জানো না। স্রেফ সাহস আর অনুমান ক্ষমতার জোরে কাল গোল খাওনি।”

অনিরুদ্ধ জানিয়ে দেয় আগে কখনও ক্রসবারের নীচে সে দাঁড়ায়নি।

”বয়স কত?”

”সাড়ে বারো।”

”হাইট?”

”পাচ ফুট দু’ ইঞ্চি”

”একটা ম্যাচেই তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছ। আরও খ্যাতি কি তুমি পেতে চাও?”

অনিরুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতাপবাবু তীক্ষ্ন চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

”গোলকিপার হওয়ার জন্য যেসব গুণ থাকা দরকার তার প্রথম দুটো তুমি জন্মগত ভাবে পেয়ে গেছ, আর পেয়েছ হাইটটা। বাকিগুলো পেতে হলে পরিশ্রম করে অর্জন করতে হবে। যদি খাটতে চাও তাহলে আমাকে বোলো, তোমাকে কালীতলা স্পোর্টিং ক্লাবের হারাধন দত্তের কাছে নিয়ে যাব। হারাধনের নাম শুনেছ?”

অনিরুদ্ধ অস্ফুটে বলে, ”হ্যাঁ।”

হারাধন দত্তের নাম এ—তল্লাটে কে না শুনেছে? মোহনবাগান, বেঙ্গল, ইন্ডিয়া টিমে খেলেছেন। ভারতজোড়া নাম। বছরকুড়ি আগে খেলা ছেড়েছেন। এখন বাজারে মুদির দোকান, চাষবাস আর পাড়ার ক্লাব নিয়ে থাকেন।

সেইদিনই রাত্রে বাড়িতে খেতে বসে অনিরুদ্ধ বাবাকে বলে, ”আমি গোলকিপার হব। প্রতাপবাবু বলেছেন আমি যদি খাটি তা হলে বড় গোলকিপার হতে পারব।”

অঘোর চক্রবর্তী আঙুলে লেগে—থাকা কুমড়োর ছোঁকা চেটে সাফ করছিলেন। চাটা বন্ধ করে ছেলের দিকে, তারপর ছেলের মা অসীমার দিকে ভ্রূ কোঁচকালেন।

”গোলকিপার হবি কী!” অসীমা অবাক হয়ে বললেন, ”লেখাপড়া করবি না?”

”করব।”

”তা হলে?”

”তা হলে আবার কী? খেলব আর পড়বও।” অনিরুদ্ধ সহজভাবে মায়ের সমস্যাটা মিটিয়ে দিল।

বাবা কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ”ফুটবল প্লেয়াররা তো এখন ভাল চাকরি পায়, রেলে, ব্যাঙ্কে, স্টিলে, এক্সাইজে। সেন্ট্রাল গরমেন্টের অফিসগুলোয় প্লেয়ারদের জন্য অনেক চাকরি আছে। আমাদের রতনবাবুর মেয়ে সাঁতারে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান। পি অ্যান্ড টি—তে চাকরি পেয়েছে, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বিদ্যে। অনি তোকে মাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করতে হবে। ক্লাস ফোর স্টাফ হয়ে যদি ঢুকতে হয় তা হলে গোলকিপার হয়ে কাজ নেই।”

অনিরুদ্ধ বুঝে গেল বাবার আপত্তি নেই তার খেলার ব্যাপারে। খেলে চাকরি পাওয়া যায় এটা বাবা জেনে গেছে। সে গলায় জোর দিয়ে বলল, ”মাধ্যমিক কেন, আমি বি.এ. পাশও করব।”

অঘোর বললেন, ”তা হলে তো খুব ভাল।” এর পর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে,”চাকরির যা বাজার অনি তা হলে গোলকিপারই হোক, দেশে এখন আর গোলকিপার কোথায়? অনি তো এখনই বয়সের তুলনায় লম্বা, আরও লম্বা হবে, থঙ্গরাজের পর তো লম্বা কাউকে পাওয়াই গেল না। যদি মনে করিস বড় হতে পারবি তা হলে মন দিয়ে চালিয়ে যা, দেখছি তো কত বি.এ, এম.এ ফ্যা ফ্যা করে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

শুনতে শুনতে অসীমা মাথা কাত করে স্বামীর কথাগুলোয় সমর্থন জানাতে থাকেন। শুধু একটা চাকরির কথা ভেবেই অনিরুদ্ধর বাবা—মা তার গোলকিপার হওয়াতে রাজি হয়ে গেলেন শুধু একটা শর্তে—”লেখাপড়া জানা ঘরের ছেলে, বি.এ—টা পাশ করতে হবে।”

পরদিনই সে প্রতাপবাবুকে জানিয়ে দেয়, খাটতে রাজি।

”আমি আজ হারাধনের বাড়ি যাব, কথা বলব ওর সঙ্গে।”

প্রতাপবাবু দু’দিন পর অনিরুদ্ধকে বললেন, ”কথা বলেছি। কাল সকালে কালীতলার মাঠে ওদের প্র্যাকটিসের সময় হারাধন থাকবে, তুমি যেয়ো, তোমাকে দেখবে।”

লাল গোলগলা গেঞ্জি, কালো শর্টস, সাদা কেডস পরা হারাধন, গলায় সুতোয় বাঁধা হুইসল ঝুলছে। ছোট্ট একটা ভুঁড়ি, কাঁচাপাকা চুল, বয়স বোঝা যায় না, সম্ভবত পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন—র মধ্যে; মাঠে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন যে কাজটা একঘণ্টা ধরে করান সেই পাসিং আর রিসিভিং প্র্যাকটিস করাচ্ছিলেন। গোলে দাঁড়িয়ে দুটি ছেলে নানান জায়গা থেকে নেওয়া শট ধরছে। গোলকিপার দু’জনের একজন অনিরুদ্ধর ক্লাসেরই বীরেশ্বরের দাদা ধীরেশ্বর, কলকাতায় কলেজে পড়ে, তাকে চেনে।

অনিরুদ্ধকে দেখে ধীরেশ্বর অবাক হয়ে বলল, ”তুই এখানে!”

”গোলকিপিং শিখব।”

”শিখে কী করবি, এখানে খেলার চান্স পাবি না। আমরা দু’জন রয়েছি, থার্ড গোলকিপার চান্স পায় না খেলার।”

”তা হলে একতায় চেষ্টা করব।” অনিরুদ্ধ দমে গিয়ে শুকনো গলায় বলল, একতা মানে শিমুলহাটি একতা সঙ্ঘ, কালীতলার প্রতিদ্বন্দ্বী। দুই ক্লাবের মধ্যে আকচাআকচি এই তল্লাটে মুখরোচক আলোচনার বিষয়।

”তুই বরং একতার মাঠে গিয়ে খেলা শেখ।”

ধীরেশ্বর কথা বলছিল ক্রসবারের নীচে দাঁড়িয়ে, গোলে জাল খাটানো নেই। অনিরুদ্ধ কথা বলতে বলতে দেখল একজন পেনাল্টি দাগের কাছ থেকে শট নিতে ছুটে আসছে পেছন ফিরে কথা বলা ধীরেশ্বরকে লক্ষ্য করে। শট নেওয়া বলটা প্রচণ্ড জোরে আসছে ধীরেশ্বরের উচ্চতায়।

অনিরুদ্ধ হুঁশিয়ারি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ”ধীরুদা, বল, বল!”

বলের দিকে না তাকিয়ে ধীরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কুঁজো হয়ে বসে পড়ল। বলটা ওর পিঠের ওপর দিয়ে সোজা এল অনিরুদ্ধর বুকের দিকে। বিদ্যুৎগতিতে সে বুকের সামনে হাত তুলে দুই তালু দিয়ে বলটা ধরে নিল।

মাঝমাঠ থেকে হারাধন দত্ত ব্যাপারটা দেখে ভুরু কোঁচকালেন, একটি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ”সাদা গেঞ্জি পরা ঢ্যাঙা ছেলেটা কে রে?”

”জানি না হারুদা।”

”জিজ্ঞেস কর তো প্রতাপ মাস্টার ওকে পাঠিয়েছে কিনা।”

অনিরুদ্ধ বোকার মতো হেসে বলটা ছুড়ে দিয়েছে ধীরেশ্বরকে। বল ধরে নিয়ে সে বলল, ”এখানে আর দাঁড়াসনি, বেটপকা লেগেটেগে যেতে পারে।”

সেই সময় ছেলেটি এসে অনিরুদ্ধকে বলল, ”তোমাকে কি প্রতাপ মাস্টারমশাই পাঠিয়েছেন?”

”হ্যাঁ।”

”হারুদা তোমায় ডাকছেন।”

হারাধন দত্ত তার আপাদমস্তক দেখে প্রশ্ন করলেন, ”কতদিন গোলে খেলছ।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”একদিন ক্লাসের একটা ম্যাচে।”

ভুরু তুলে হারাধন বিস্ময় চেপে বললেন, ”তা হলে আজ বিকেলে দ্বিতীয় ম্যাচটা খেলবে। পার্টি করে ট্রেনি ছেলেদের মধ্যে ফ্রেন্ডলি খেলা হবে, ঠিক পাঁচটায় হাজির থাকবে। না না, বড়রা খেলবে না।”

সেই ফ্রেন্ডলি ম্যাচটা হারাধন দত্ত লাইনের ধারে চেয়ারে বসে পাথরের মতো চোখ করে দেখলেন, একটিও কথা না বলে, অনিরুদ্ধ দুটো গোল খেয়েছিল। ম্যাচের পর ক্লাবের সহ—সচিব পঞ্চানন ঘোষ অনিরুদ্ধকে ডেকে জানিয়ে দেন, ”কাল থেকে দু’বেলা প্র্যাকটিসে। হারুদা নিজে তোমায় দেখবেন।”

কথাটা শুনে অনিরুদ্ধ খুবই অবাক হয়েছিল। দুটো বাজে গোল খাওয়ার পর সে ধরেই নিয়েছিল হারাধন দত্ত তাকে বাতিল করে দেবেন। তাকে নির্বাচনের কারণটা কী, সেটা জানার জন্য কৌতূহলে ছটফট করে উঠলেও সাহস করে সে পঞ্চাননকে তখন কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারেনি। আজও সে জানে না কী দেখে হারাধন তাকে দু’বেলা আসতে বলেছিলেন।

তারপর পঁচিশ বছর কেটে গেছে, হারাধন দত্ত আজও জীবিত, এখন তাঁর বয়স সাতাত্তর। রোজ মাঠে আসেন, প্রায়ই দেখা হয় তবু অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করতে পারেনি—হারুদা সেদিন কী দেখে আমাকে বেছে নিয়েছিলেন?

পঁচিশ বছরে অনিরুদ্ধ বি.এ পাশ করেছে, কলকাতার বড় ক্লাবে খেলেছে, ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে এখন গড়িয়াহাট শাখায় কাজ করছে। বাড়ি থেকে অফিস দশ কিলোমিটার সে স্কুটারে যাতায়াত করে ইর্স্টান বাইপাস দিয়ে।

.

স্বরূপানন্দ বিদ্যালয়ের লোহার ফটকটা রাত্রে বন্ধ থাকে। খোলা আর বন্ধের দায়িত্ব অনিরুদ্ধর সময় থেকে আজও রাখালের। ফটকের লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে অনিরুদ্ধ মাঠের দিকে তাকাল। দেয়ালে বল লাগার শব্দটা এখনও হয়ে চলেছে। চাঁদের আলোয় সে ছায়ার মতো একটা আকৃতিকে ছোটাছুটি আর দেয়ালে শট নিতে দেখল স্কুলবাড়ির পশ্চিম দিকে যেখানে দুটো জানলার মধ্যে দেয়ালটা প্রায় পনেরো ফুট চওড়া। সে জানে জানলা দুটো হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরের আর টিচার্স রুমের।

কিছুক্ষণ তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে থেকে অনিরুদ্ধ বুঝল খুব অল্পবয়সী, খালি গা একটি ছেলে একা একাই দেয়ালে বল মেরে মেরে টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। মাত্র পাঁচ গজ চওড়া দেয়ালে মারা বলটা ফিরে আসামাত্র কখনও হেড করছে, কখনও ভলি মারছে, কখনও ড্রপ শট নিচ্ছে। দেয়ালে লেগে বলটা সবসময় সোজা ওর কাছে না এসে এদিক—ওদিক চলে যাচ্ছে। ছেলেটা ছুটে গিয়ে প্রতিবারই বলটা ধরে অদৃশ্য কোনও ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য শরীরটাকে ডাইনে—বাঁয়ে দুলিয়ে পায়ে বল নিয়ে অদৃশ্য পাস দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। অবাক হয়ে অনিরুদ্ধ একবার দেখল দেয়ালে লেগে ফিরে আসা উঁচু বলটাকে বাইসাইকেল কিক নেওয়ার চেষ্টা করল, অবশ্য কিকটা ফসকাল। কিন্তু চেষ্টা করেছিল!

”অ্যাই অ্যাই, এত রাতে তুই কে রে?”

অনিরুদ্ধর ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলা কথাটা শোনামাত্র ছেলেটা থমকে দাঁড়াল। ফটকের বাইরে একটা লোকের ছায়া দেখেই বলটা হাতে তুলে ছুট লাগাল স্কুলবাড়ির পেছন দিকে। প্রথম বন্ধনীর মতো দেখতে একতলা স্কুলবাড়িটার আড়ালে ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই অনিরুদ্ধ বুঝল আর ওকে এত রাত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বুঝে গেল ছেলেটা খুব কাছাকাছিই থাকে।

কাল সকালে অফিস যাওয়ার সময় রাখালদাকে ধরে বার করতে হবে, কে এই ছেলেটা যে ঘুমোতে দিচ্ছে না! একটা পাগল ছেলে ধপ ধপাস শব্দ করে চলেছে আর রাখালদা স্কুলের পেছনে একটা ঘরে কি না ঘুমিয়ে আছে! কুম্ভকর্ণেরও তো ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা, ফাঁকিবাজ, একদম ফাঁকিবাজ, ওর এখন রিটায়ার করা উচিত। কয়েকদিন আগে অফিস যাওয়ার সময় রাখালের সঙ্গে তার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। গালে সাতদিনের না কামানো সাদা দাড়ি, নীচের পাটিতে দুটো দাঁত নেই, ময়লা ধুতির ওপর হলুদ ফুলহাতা শার্ট, ধুলোকাদার আস্তরণের নীচে চটির আসল রং বোঝা যায় না। রুগণ বুক ভেতর দিকে ঢুকে গেছে। হাতে ছিল বাজারের থলি।

রাখাল শুধু বেয়ারাই নয়, তার আরও একটা পদ তখন স্কুলে ছিল, স্পোর্টস অ্যাসিস্ট্যান্ট। বাংলায় লেখা হত ক্রীড়া সহায়ক। তবে ছেলেরা বলত, মালি। অন্য কোনও গ্রামের বা শহরের মাঠে খেলা থাকলে জার্সি, বল, গোটা দশেক পাতিলেবু, খাওয়ার জলের বালতি, ফার্স্ট এইড বক্স ইত্যাদি তাকিয়ার খোলের মতো বিশাল একটা ক্যানভাসের থলিতে ভরে রাখাল স্কুল টিমের সঙ্গে যেত।

গত পরশু দিন রাস্তায় রাখালের সঙ্গে দেখা হতেই অনিরুদ্ধ পথ আটকে তার স্কুটারকে দাঁড় করায়।

”কী রাখালদা, আর তো তুমি চিনতেই পারো না।” রাখালকে অপ্রতিভ করার জন্য অনিরুদ্ধ বলেছিল।

স্কুলের প্রাক্তন আর বর্তমান ছাত্ররা ওকে রাখালদা বলে ডাকে। রাখাল স্কুল শুরুর আর ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে। অনিরুদ্ধর বাবা অঘোর যখন এই স্কুলে ক্লাস টেন—এ পড়ত তখন তার সমবয়সী ষোলো বছরের রাখাল কয়াল সুন্দরবনের বরুণহাটি গ্রাম থেকে মাসির সঙ্গে এসে স্বরূপানন্দ স্কুলে চাকরিতে বহাল হয়, মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে। মাসি ছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়ির রাঁধুনি।

বাবার কাছে অনিরুদ্ধ শুনেছে, স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে রাখাল কবাডি আর ফুটবল খেলত। খেলার সময় বোকামি বা কোনওরকম দক্ষতার ঘাটতি দেখলে রাখাল তার দলের ছেলেদের মাথায় চাঁটি মেরেছে। অঘোর স্বীকার করেছিলেন ছেলের কাছে, ‘একটা ওপেন নেট গোল মিস করার পর রাখু আমায় চড় মেরেছিল।’ রাখাল ছিল সমবয়সী ছাত্রদের কাছে ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’, কিন্তু বরুণহাটির পাঠশালায় সে ‘থ্রি ক্লাসের’ বেশি ওঠেনি। যতই তার বয়স বাড়তে লাগল রাখাল ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যেতে থাকে ছাত্রদের থেকে, অবশেষে সে ‘রাখু’ থেকে একসময় হয়ে যায় রাখালদা।’

অনিরুদ্ধর স্কুটারের সামনে থতমত রাখাল ভাঙা দাঁত বার করে সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, ”চিনব না কেন খুব চিনি। তবে তুমি কিনা অনেক বড় হয়ে গেছ, অনেক নাম করেছ, তোমারে ডেকে কথা বলতে এখন লজ্জা করে।”

”লজ্জাটজ্জা থাক। তুমি আছ কেমন?”

”ভাল, ভালই আছি। শুধু মাঝে মাঝে বুকে একটা ব্যথা হয়, হাঁফ ধরে। তুমি একটু ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারো?”

রাখালের কথা শুনে অনিরুদ্ধর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। তার বাবাও ঠিক এই কথাগুলো বার দুয়েক বলেছিলেন, তারপর হঠাৎই একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য ভাত খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়েন, তারপর জ্ঞান আর ফেরেনি। মা অবশ্য মারা যান ক্যান্সারে মাস ছয়েক ভুগে।

”ঠিক আছে রাখালদা আমি দেখব, আমার বন্ধু এক ডাক্তার আছে এন আর এস হাসপাতালে, ওকে দিয়ে তোমায় দেখিয়ে দেব। তুমি এখন স্কুলে করো কী?”

”কী আর করব, সেই ঘণ্টাই পিটিয়ে যাচ্ছি। নতুন একটা ছোকরা এসেছে, নাম ভবা, সে—ই আমার অন্য কাজগুলো করে।”

”খেলাটেলাগুলো কে দেখছে, ভবা?”

রাখাল হেসে মাথা কাত করল।

”চলি রাখালদা, তোমাকে খবর দেব।”

অনিরুদ্ধ স্কুটারে স্টার্ট দিল। রাখাল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ”অনি একটা কথা বলব?”

অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

”তোমার ভাগ্নের ছেঁড়া জামাপ্যান্ট যদি থাকে তা হলে একটা দিতে পারো?”

”কার জন্য?” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। সে জানে রাখালের কোনও ছেলেমেয়ে নেই, বউও বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে। একা থাকে স্কুলের পেছনে একটা টালির চালের ঘরে। ঘরের পাশে স্কুলের শৌচাগার। নিজের হাতে রান্না করে খায়।

”আমার ভায়ের নাতিটারে কাছে এনে রাখিছি। তোমার ভাগ্নের বয়সী।”

”দিদিকে বলব অলুর যদি কিছু পুরনো থাকেটাকে, তুমি কালপরশু এসে দিদির সঙ্গে দেখা কোরো।” এই বলে সে স্কুটার চালিয়ে দিল।

.

অনিরুদ্ধ বলেছিল বটে দিদিকে বলব কিন্তু বলতে ভুলে গেছল। এমনকী, ডাক্তারবন্ধুকে সে রাখালের কথা বলেনি। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজার সময় একতলায় দড়িতে শুকোতে দেওয়া অলুর জামা আর হাফপ্যান্ট দেখে তার মনে পড়ল রাখালের কথা। মনে মনে জিভ কেটে তখুনি সে নীচে নেমে এসে দিদি অমলাকে বলল, ”রাখাল কি তোমার কাছে এসে অলুর পুরনো জামা—প্যান্ট চেয়েছে? ওকে আমি তোমার কাছে আসতে বলেছিলুম।”

অমলা অবাক হয়ে বলল, ”কই না তো, রাখাল তো আমার কাছে আসেনি।”

”ওকে দেওয়ার মতো অলুর প্যান্ট—জামা কিছু যদি থাকে তা হলে দাও আমি অফিস যাওয়ার সময় ওকে দিয়ে যাব, আছে কিছু?”

”থাকবে না কেন, এখন তো ছ’মাস অন্তর ওর জুতো—জামা প্যান্ট ছোট হয়ে যাচ্ছে। বাব্বা! লাউডগার মতো তরতর করে লম্বা হচ্ছে ছেলেটা।”

অলু অর্থাৎ অলক দিদির একমাত্র সন্তান, স্বরূপানন্দে ক্লাস এইটে পড়ে, ওর ইচ্ছে মামার মতো গোলকিপার হবে। অনিরুদ্ধ ওকে কালীতলা ক্লাবে তার গুরু সাতাত্তর বছরের হারাধন দত্তের হাতে দিয়ে এসেছে।

অনিরুদ্ধর আধঘণ্টা আগে অমলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে যাবে চারটে স্টেশন পরে দৈজুড়িতে। সেখানে মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে সে সহ—প্রধানশিক্ষিকা। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে অমলা একটা পলিব্যাগ ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, ”রাখালকে এটা দিস, অলুর জামাপ্যান্ট আর একজোড়া কেডসও দিয়ে দিলুম, যদি পায়ে লাগে তো পরবে নয় তো তুলে রাখতে বলিস।”

অনিরুদ্ধ যখন স্কুটার চালিয়ে স্কুলের মাঠে ঢুকল প্রাইমারি সেকশনের ক্লাস তখন চলছে। হেডমাস্টারের ঘরের সামনে দালানে রাখাল কথা বলছিল এক ছাত্রের বাবার সঙ্গে।

”ও রাখালদা, একবার এদিকে এসো।”

রাখাল কাছে আসতে অনিরুদ্ধ পলিব্যাগটা তার হাতে দিয়ে বলল, ”বলেছিলুম দিদির সঙ্গে দেখা করতে, যাওনি। কেন? দিদি এটা তোমাকে দিতে বলল, দ্যাখো কী আছে।”

”যাব কী! তোমার সঙ্গে সেদিন কথা বলার পর ঘরে গিয়ে ভাত চড়াইছি তারপরই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বুকে ব্যথা।” রাখাল এর পর অনিরুদ্ধর কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল, ”বড় সার জানতি পারলে সঙ্গে সঙ্গে বলবে ‘রাখাল এবার কাজ ছাড়ো।’ রিটায়ার করলি খাব কী, এই ঘর ছাড়ি চলি যেতে হবে, যাব কোথায়? আমার তো মরা ভাইয়ের এই নাতিটা ছাড়া কেউ নাই। কুড়োনরে বড় করতি হবে, কোথাও একটা কাজে ঢুকোতি হবে। এখন চাকরি গেলে মুশকিলে পড়ে যাব। তুমি কিন্তু আমার অজ্ঞান হওয়ার কথা কারুরে বোলো না।” রাখাল অনিরুদ্ধর হাত চেপে ধরল।

”না বলব না।” কথাটা বলেই অনিরুদ্ধ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আজই সে দুপুরে তরুণের বাড়িতে ফোন করে রাখালকে দেখাবার ব্যবস্থা করবে। তারা দু’জনে কলেজ ফুটবল টিমে একসঙ্গে খেলেছে। তরুণ ফুটবলারদের চিকিৎসার জন্য ফি নেয় না। রাখাল ফুটবলার না হলেও অনিরুদ্ধর ধারণা তার পাঠানো গরিব মানুষের কাছ থেকে তরুণ টাকা নেবে না। অবশ্য সরকারি হাসপাতালে দেখালে কোনও টাকা লাগে না।

অনিরুদ্ধর কাছ থেকে সব কথা শুনে তরুণ জানাল, কাল তার কার্ডিয়াক বিভাগে আউটডোর ডিউটি রয়েছে, রাখাল যেন সেখানে সকালে এসে টিকিটটা করে নেয়, তারপর সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওর বুক দেখার ব্যবস্থা করে দেবে। সন্ধ্যার মুখে অনিরুদ্ধ ফিরল তার অফিস থেকে। বাড়ি না গিয়ে সে সোজা হাজির হল রাখালের চালা ঘরে। তখন সে হারিকেনের চিমনি সাফ করছিল ন্যাকড়া দিয়ে।

অনিরুদ্ধ কাল তাকে কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ”ভোরবেলাতেই ট্রেনে উঠে শেয়ালদায় চলে যেও। স্টেশনের কাছে এন আর এস হাসপাতাল। চিনতে পারবে তো?”

”আরে, ও হাসপাতালে অনেক বার গেছি। ভাইরে সাপে কাটল তখন তো ওখানেই নিয়া গেছল। কুড়োনের বাপেরে বাঘে ধরল মাছ ধরতি গিয়া। নওবাকি নদীর খাড়িতে জাল পাততি গেছল, লৌকা থেকে বাঘে তারে তুলা নেয়। সঙ্গের তিনটে লোক তাড়া করতি শশধররে ফেইল্যা বাঘ সুশান্তরে তুইল্যা জঙ্গলে ঢুইকা যায়। পত্থমে ক্যানিং তারপর এই শেয়ালদার হাসপাতালে শশধররে নে আইল, চারদিন বেঁচে ছিল, আমি রোজ দেখতে গেছি।”

রাখাল যখন ভাইয়ের জামাই শশধরের মৃত্যু বৃত্তান্ত শোনাচ্ছিল অনিরুদ্ধ তখন দেখছিল টিউবওয়েলে জল খাচ্ছে ছোট্টখাট্ট পাতলা গড়নের একটা ছেলে। গায়ের রং ঘোর কালো, মাসখানেক আগে ন্যাড়া হওয়া মাথায় এখন কদমফুলের মতো চুল। মুখে মাথায় জল থাবড়ে ছেলেটা তাদের দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে হেঁটে স্কুলবাড়ির আড়ালে চলে গেল। গায়ে ঢলঢলে হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা সবুজ রঙের গেঞ্জি। অলুকে এই গেঞ্জিটা সে একসময় পরতে দেখেছে। সে বুঝে গেল এটা দিদিই দিয়েছে রাখালের নাতির জন্য।

”অই হল কুড়োন। বাপরে বাঘে লয়, মারে লয় কুমির। চিংড়ির মীন তুলতে অর মা নদীতে নামছিল দু—তিনজনের সঙ্গে, কুমিরে টাইন্যা লইয়া যায়। আমার ভাই অরে নিয়া আসে তখন চার বছর বয়স, ভাইরেও সাপে কাটল। শেষে অরে আমি এখানে নিয়া আইলাম। এখন বয়স বারো।”

অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ”সারাদিন ও করে কী?”

রাখাল মাথা নেড়ে বলল, ”কিসসু করে না, খালি ঘুইরা বেড়ায়।

অনিলের হোটেলে ফাইফরমাশ খাটার কামে দেছিলাম, দুই টাকা রোজ আর খোরাকি। তিনদিন কাম কইরা বলল, আর করব না। অরে ধরছে ফুটবলের ভূতে।”

কথাটা শুনেই অনিরুদ্ধর মনে হল, রাতে ধপধপাস শব্দগুলো তা হলে কুড়োনেরই তৈরি।

অনিরুদ্ধের কৌতূহল বেড়ে গেল, বলল, ”ফুটবলের ভূত ব্যাপারটা কী?”

”ব্যাপার আর কী, সকালে কালীতলার মাঠে গিয়া ছোটদের সঙ্গে খেলতে চাইত। ছেলেরা ওকে তাড়ায়ে দিত, খেলায় নিত না। একদিন একটা বল পায়ে নিয়া তিনটা ছেলেরে কইল আমারে আটকাও তো, ছেলেগুলাকে চারবার কাটায়ে কুড়োন হাসতাছিল, তহনই একজন খুব রাইগা গিয়া অর বুকে ঘুসি মারে, কুড়োনও পালটা মারে। পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করে দীপক। অরে চেনো তো, তোমার ছারকেলাস উঁচুতে পড়ত, এখন কালীতলা কেলাবে ছোটদের খেলা শিখায়, কোচ।”

দীপক কর্মকারকে অনিরুদ্ধ চেনে, পাশের মোচাবেড়িয়ায় বাড়ি। সে যখন ইন্টার—ক্লাস প্রথম ম্যাচে খেলে বিখ্যাত হল, দিপুদা সেই বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়তে যায় কলকাতায়। রাজস্থান, বাটা হয়ে শেষে ইস্টার্ন রেলে খেলেছিল। চাকরি করে শিয়ালদায়, রেলের অফিসে।

”দীপক কুড়োনরে মাঠ থেকা বাইর কইরা দেয় দুইটা থাপ্পড় লাগায়ে। বলে দেয় আর কক্ষনও তার পারমিশান না লইয়া ক্লাবের ছেলেদের সনে যেন না খেলে। তুমি বরং তোমার ভাগ্নারে জিজ্ঞাসা কইরা লইও, সে তখন ওখানে ছিল।”

আর কথা না বাড়িয়ে অনিরুদ্ধ চলে আসে। আসার আগে রাখালকে মনে করিয়ে দিল, ”কাল সকালে ঠিক যেও কিন্তু রাখালদা।” স্কুটারটা মাঠের ওপর দিয়ে চালিয়ে গেটের দিকে যাওয়ার সময় সে দেখল অন্ধকারে স্কুলের লম্বা দালানে পা ঝুলিয়ে একটা ছায়ামূর্তি বসে রয়েছে। অনিরুদ্ধর ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল। তার মনে হল ফুটবলের ভূত ওর ঘাড়ে বসেনি, কুড়োন নিজেই ভূত হয়ে ফুটবলের ঘাড়ে বসেছে।

রাতে অলু আর অনিরুদ্ধ মুখোমুখি টেবলে খেতে বসেছে। একসময় অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ”হ্যাঁ রে অলু, রাখালের নাতি সকালে তোদের সঙ্গে খেলতে যেত এখন আর যায় না, কেন রে?”

অলু অবাক হয়ে বলল, ”তোমায় কে বলল!”

”যেই বলুক, কুড়োনকে দিপুদা চড় মেরে বলেছে আর যেন তোদের সঙ্গে না খেলে?”

”হ্যাঁ। ও আমাদের ভেংচি কেটেছিল। অলু গম্ভীরস্বরে বলল।

”কেন কেটেছিল?”

অলু ইতস্তত করছে দেখে অনিরুদ্ধ বলল, ”তোদের তিনটে ছেলেকে ও চারবার কাটিয়ে বল নিয়ে গিয়ে হেসেছিল। তখন তোদের একজন ওকে ঘুসি মারে, ঠিক কি না?”

”হ্যাঁ। কিন্তু ও হাসল আবার বকও দেখাল। তাই তো রেগে গিয়ে শুভেন্দু ওকে মারল। মামা, কুড়োনও কিন্তু হাত চালিয়েছে। তখনই দীপুদা এসে ওকে চড় মারে।”

”তোদের তিনজনকে চারবার কাটিয়ে যে বল নিয়ে বেরিয়ে গেল সে তো তোদের থেকে ভাল খেলে, তা হলে তো তোদের উচিত ওকে দলে টেনে নেওয়া।”

”রাখালের নাতিকে দলে নেব!” অলু অবাক হয়ে মামার দিকে তাকাল এমনভাবে, যেন এক পাগলকে দেখছে, যে পাঁচ সেকেন্ড আগেও সুস্থ মস্তিষ্কের ছিল।

”ছেঁড়া গেঞ্জি, ময়লা প্যান্ট, খালি পা। কুড়োন আমাদের সঙ্গে খেলবে, বলো কী?”

”ধর তোদের কালীতলার সঙ্গে দুর্গাতলা স্পোর্টিং নামে একটা টিমের খেলা হচ্ছে কোনও টুর্নামেন্টে, দুর্গাতলার হায়ে নেমেছে কুড়োন। ময়লা গেঞ্জি আর ময়লা প্যান্ট পরনে, পায়ে বুটও নেই। তোরা কি বলবি কুড়োন খেললে আমরা খেলব না? তা হলে তো লোকে হাসবে, ছ্যা ছ্যা করবে।”

অমলা এতক্ষণ মামা—ভাগ্নের কথা শুনে যাচ্ছিল, এবার ভর্ৎসনার সুরে ছেলেকে বলল, ”রাখালদার নাতি বলে তোরা ওর সঙ্গে খেলবি না? এরকম মানসিকতা হল কী করে তোর অলু? চারবার যে তিনটে ছেলেকে কাটায় সে তো তোদের থেকে অনেক গুণী। গুণের কদর করতে শেখ, হলেই বা ময়লা ছেঁড়া গেঞ্জি প্যান্ট!”

অনিরুদ্ধ মিটিমিটি হাসছিল দিদির ঝাঁঝালো স্বর শুনে আর অলুর চোখে লজ্জার ছায়া পড়তে দেখে। সে বলল, ”জানো দিদি একবার ইম্ফলে সন্তাোষ ট্রফিতে মণিপুরের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলায় আমাদের স্ট্রাইকার সুধীর মুর্মু হ্যাটট্রিক করার পর খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। বেধড়ক পা চালিয়েছিল মণিপুরের ডিফেন্ডাররা সুধীরের পা লক্ষ্য করে। দু’দিন পরেই ম্যাচ ওড়িশার সঙ্গে। আমাদের গোল দেওয়ার লোক বলতে ওই সুধীর মুর্মু, ঝাড়গ্রামের ছেলে, সাঁওতাল। আমরা তো ঝাঁপিয়ে পড়লুম সুধীরের পায়ের ওপর। আমি ওর পা ধরে বরফ ঘষছি, মালিশ করছি, হাতে মাত্র দুটো দিন, ওকে ফিট করে মাঠে নামাতেই হবে। বেচারা সুধীর খালি বলছে, অনিদা পায়ে হাত দিও না, তুমি বামুনের ছেলে, আমার পাপ হবে। আমি বললুম ধেত্তোরি বামুনের ছেলে, এখন ভুলে যা ওসব! খেলার মাঠে তুই বামুন আর সব সিডিউল ট্রাইব। বেচারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল আমার কথা শুনে।”

অলু চোখ বড় করে মামার কথা শুনছিল। বলল, ”মুর্মু ফিট হল?”

”না পায়ের গোছ ফুলেই রইল। ইঞ্জেকশন দিয়েও ব্যথা কমানো গেল না।”

”ওড়িশার সঙ্গে ম্যাচটার কী হল?”

”টাইব্রেকারে জিতলুম, ফাইভ—ফোরে। একসময় ছিল ফোর—ফোর।”

”লাস্ট শটটা কাদের ছিল?” অলু উৎকণ্ঠিত কৌতূহল নিয়ে বলল।

”ওদের।’ নিস্পৃহ গলায় বলল অনিরুদ্ধ।

”বাইরে মারল?” অলুকে আরও উৎকণ্ঠিত দেখাল।

অনিরুদ্ধ মুখ নামিয়ে রুটি ছেঁড়ায় ব্যস্ত হল। অমলা বলল, ”অনি বলবে কী, আমি বলছি। তোর মামা ডানদিকে ঝাঁপিয়ে বলটা ধরে নেয়। কাগজে বড় করে হেডিং দিয়েছিল ‘বাংলাকে ফাইনালে তুলল অনিরুদ্ধ’। অলু তুই তখন একমাসের, তোর এসব জানার কথা নয়। হ্যাঁরে অনি তোর কাছে কাগজের কাটিংটা আছে?” ভাইয়ের জন্য গর্বে অমলার চোখমুখ ঝকঝক করে উঠল।

”কাটিং ফাটিং আমি রাখি না। বুড়ো বয়সে বেতো শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিং দেখব আর লোকেদের দেখাব আমি কী ছিলুম। ওসব ব্যাপারে আমি নেই। যদি কিছু খেলে থাকি তা হলে লোকে এমনিই মনে করে রেখে দেবে। দেশের লোকে কপিলদেব, গাওস্করকে মনে করে রেখে দেবে, লিয়েন্ডার পেজকেও মনে রাখবে, আমি তো তেমন কিছু করিনি যে মনে করে রাখবে, তাহলে কাটিং জমিয়ে রেখে লাভ কী?” অনিরুদ্ধ নিচু স্বরে ধীরে ধীরে বলল। এর পর সবাই নীরবে খাওয়া শেষ করল।

রাতে খাওয়ার পর অন্তত আধঘণ্টা ছাদে পায়চারি করে অনিরুদ্ধ। এটা সে ছেলেবেলায় বাবাকে দেখে শেখে। ‘এই পায়চারিটা খুব দরকার। হজম সাহায্য করে স্বাস্থ্যকে। স্বাস্থ্য সাহায্য করে খেলাকে।’ অঘোর ছেলেকে কথাগুলো বলেছিলেন। তারপর থেকেই সে খেলায় সাহায্য করে এমন সবকিছুকেই মেনে চলতে শুরু করে। আর এটা সে অলুর মাথাতেও ঢুকিয়ে দিয়েছে।

ছাদে পায়চারির সময় অনিরুদ্ধ গোলকিপিংয়ের নানান বিষয় নিয়ে কথা বলে, নিজের অভিজ্ঞতার গল্প ভাগ্নেকে শোনায়। আজ সে অলুকে জিজ্ঞেস করল, ”তোদের তিনটে ছেলেকে কুড়োন কাটালো চারবার, কী করে করল বল তো?”

”প্রথমে দেবুর মুখোমুখি হল, তারপর শরীরটা বাঁয়ে হেলিয়েই ডান দিকে হেলাল, দেবু একটু টলে গেল তখুনি বিদ্যুৎগতিতে কুড়োন শরীরটাকে একটু বাঁ দিকে ফিরিয়ে দেবুকে আড়াল করে ওর বাঁদিক দিয়ে বল পায়ে রেখে চলে গেল, বলটা ডান পায়ে আঠার মতো লেগে ছিল আর একটা ঝলকানির মতো এত ফাস্ট চলে গেল না! দেবু ঘুরতে ঘুরতে কুড়োন তখন শ্যামলকেও কাটিয়ে ফেলেছে, ওইভাবেই আবার জ্যোতিকে। একবার বাঁ দিক দিয়ে আর দু’বার ডান দিক দিয়ে—কী বলব মামা, ওই রোগা কালো ছেলেটা যেন কেউটের মতো তিনটে ছোবল দিয়ে বলটা নিয়ে গেল। আমরা তো থ! দেবুর মুখ থমথমে হয়ে গেল। ও দাঁত চেপে বলল, ‘অ্যাই ব্যাটা আবার কর তো।’ তিনজনেই রেডি হয়ে দাঁড়াল ওকে আটকাবার জন্য। কুড়োন এবার করল কী, প্রথমবার দেবুর বাঁ দিক দিয়ে গেছল এবার গেল ডান দিক দিয়ে একইভাবে, তারপর শ্যামল আর জ্যোতিকে কাটিয়ে আমার সামনে এসে পড়ল।”

”তুই তখন করলি কী?” অনিরুদ্ধ বলল।

”কী আবার করব, দিলুম একটা ডাইভ ওর পা লক্ষ্য করে।”

”ও তখন করল কী?”

”ও যেন জানত আমি কী করব, টুক করে বলটা পায়ে সরিয়েই আলতো করে আমার মাথার ওপর দিয়ে গোলে পাঠিয়ে দিল।” অলুর গলা দিয়ে ঝরে পড়ল একরাশ লজ্জা। অনিরুদ্ধ বুঝে গেল কুড়োনের শুধু অসাধারণ স্কিলই নয়, আছে বুদ্ধি আর ঠান্ডা মাথা, আর এই ছেলেটাকেই দিপুদা কিনা চড় মেরে বার করে দিল!

”অলু, তুই বড় গোলকিপার হতে চাস?”

অবাক হয়ে অলু বলল, ”কে না চায়?”

অনিরুদ্ধ হাঁটা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে অলুর দু’কাঁধে হাত রেখে বলল, ”তা হলে কুড়োনের সঙ্গে প্র্যাকটিস কর। কালীতলার মাঠে তো হবে না, অন্য কোথাও। কুড়োন এখন খেলে কোথায়?”

”ঠিক জানি না। খোঁজ নিয়ে বলব তোমায়।”

পরের দিনই অলু খোঁজ নিয়ে তার মামাকে বলল, ”তেলিপাড়ায় ন্যাড়া মন্দিরের পাশে যে পোড়ো জমিটা রয়েছে, কুড়োন সেখানে গিয়ে ওখানকার ছেলেদের সঙ্গে খেলে। ন্যাড়ামন্দির বালক সঙ্ঘ নামে ওদের একটা ক্লাবও আছে।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”ন্যাড়ামন্দির তো এখান থেকে দেড়—দু’মাইল দূরে! খেলবে বলে কুড়োন রোজ অতদূর যায়!” ফুটবল খেলার জন্য ছেলেটার এই উৎসাহ তাকে আরও কৌতূহলী করে তুলল। সে ঠিক করল স্কুলের হেডমাস্টারমশাইকে বলে সকালে স্কুলের মাঠে ছেলেদের খেলা শেখাবে আর কুড়োনকে ছাত্রদের দলে ভিড়িয়ে নেবে। স্কিল আর টেকনিকের সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা এই বয়সেই দরকার।

অনিরুদ্ধ ভারত দলের ক্যাম্পে বিদেশি কোচের প্রশিক্ষণ পেয়েছে। কোচিং সম্পর্কে তার জ্ঞানের পুঁজি সেটাই। তা ছাড়া ক্লাব স্তরের কোচদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছে। সে মনে করে ছোটদের প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার মতো ফুটবল—বিদ্যে তার আছে। খরচ করার মতো টাকাও তার আছে বা জোগাড় করতে পারবে। আসল দরকার নিজের উৎসাহটাকে জিইয়ে রাখা। তার বিশ্বাস, আমাদের মতো ফুটবলে পিছিয়ে থাকা গরিব দেশে, বড় বড় অ্যাকাডেমি করার আগে বেশি দরকার খেলা শেখার ছোট ছোট পাঠশালা। সে পাঠশালাই খুলবে। ফুটবল তাকে নাম যশ অর্থ দিয়েছে। এখন তার কিছুটা সে ফুটবলকে ফিরিয়ে দেবে, এটা তার নৈতিক কর্তব্য।

.

স্কুল থেকে তিন মিনিট হাঁটলে হেডমাস্টার শিবেনবাবুর একতলা ভাড়াবাড়ি। অনিরুদ্ধ স্থির করল রবিবার ওঁর বাড়িতে গিয়েই দেখা করবে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল পর্যায়ের ম্যাচগুলো চারদিন পর শুরু হতে চলেছে। টিভি সেটে ছবি ভাল আসছে না, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো দেখাচ্ছে, বোধ হয় কেবলের তারে গোলমাল। কেবল অপারেটরকে সে বাড়ি থেকে দু’বার ফোন করেছিল, রিং হয়ে গেছে, কেউ ধরেনি। সে বুঝে গেল ফোন খারাপ, ঠিক করল শনিবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় খবর দিয়ে আসবে।

শনিবার বিকেলে অনিরুদ্ধ স্কুটার চালিয়ে কলাইখোলার মোড়ে পৌঁছে ইতস্তত করে ডান দিকে ন্যাড়ামন্দিরের রাস্তাটা ধরল। রাস্তা না বলে এটাকে মাইন বিস্ফোরিত যুদ্ধক্ষেত্র বলাই ভাল। সিটে বসে ঝাঁকুনির দাপটে তার মনে হল বোধ হয় স্কুটার থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। মিনিট দুই পর সে যখন ভাবছে, আর নয় এবার ফিরে যাই, তখনই চোখে পড়ল ভাঙা একটা শিবমন্দির। তার পাশে একটা পোড়ো জমি। দু’দিকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি গোল, ক্রসবার হয়েছে নারকেলদড়ি।

অ্যাশশ্যাওড়া আর ফণিমনসা গাছের ফাঁক দিয়ে অনিরুদ্ধ দেখতে পেল গুটিদশেক ছেলে আদুড় গায়ে একটা লালরঙের বড় রবারের বল নিয়ে খেলছে। কুড়োনকে সে একনজরেই চিনতে পারল তার গায়ের ঢলঢলে সবুজ গেঞ্জি আর পায়ের কেডস দেখে। ওকে মনে হচ্ছে হাঁসের দলে যেন একটা বক। মাঠটা বড় বড় ঘাসে ঢাকা কিন্তু উঁচু—নিচু বেশিরভাগ ছেলেই মাঝমাঠে বল নিয়ে এলোমেলো পা চালাচেছ। বলে পা লাগলে বলটা একজনের গায়ে লেগে ছিটকে আর একজনের কাছে যাচ্ছে। কুড়োন এই গোঁতাগুঁতির বাইরে দাঁড়িয়ে। একবার বলটা ছিটকে তার কাছে এল, কুড়োন বল ধরে গোলকিপারকে দেখল, তারপর প্রায় পনেরো গজ দূর থেকে বলটা আলতো মারলো। দড়ি আর বাঁশের কোণ দিয়ে গোল হয়ে গেল।

.

এইটুকু দেখেই অনিরুদ্ধ স্কুটারে স্টার্ট দিল। তার যা দেখার আর বোঝার, তা হয়ে গেছে। ছেলেটা এখানে খেলে নিজেকে নষ্ট করছে। খানাখন্দ, ঢিবির উপর দিয়ে স্কুটারটা টলতে টলতে চলেছে। সে লক্ষ করেনি শিংওলা একটা গোরু তার সামনে দশহাত দূরে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। পেছনে একটা বাছুর। অনিরুদ্ধ হর্ন বাজাল। টিয়াপাখির কর্কশ ডাকের মতো আওয়াজ শোনায় অনভ্যস্ত গোরুটা চমকে উঠে মাথা নামিয়ে এগিয়ে এল, অনিরুদ্ধ তাড়াতাড়ি স্কুটারটা ডান দিকে ঘোরাতেই একটা গর্তে পড়ে গেল চাকা। কাত হয়ে সে স্কুটারসমেত গড়িয়ে পড়ল। পাশ দিয়ে চলে গেল গোরুটা।

স্কুটারের তলা থেকে ডান পা টেনে বার করে সে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল হাঁটুতে গোলমাল ঘটে গেছে, যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বছরদশেক আগে ওখানে যে চোটটা পেয়েছিল একটা লাথি খেয়ে, যার জন্য লিগের সাতটা খেলায় মাঠে নামতে পারেনি। দুটো ম্যাচ খেলেই আবার বসে গিয়েছিল সারা সিজনের জন্য, ঠিক সেখানেই চোটটা লাগল। স্কুটারটা তুলে দাঁড় করিয়ে সে স্টার্ট দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসল। কেবল অপারেটরের কাছে যাওয়া এখন শিকেয় তোলা থাক, অলুকে দিয়ে খবর দিলেই হবে, হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেও পরে যাওয়া যাবে। তার আগে এখন বাড়ি ফিরে বরফজল আর গরমজল পরপর হাঁটুতে ঢেলে যন্ত্রণাটা কমাতে হবে, তারপর ডাক্তার দেখানো।

সেই রাত্রেই অলু ডাক্তার ডেকে আনল। সব শুনে এবং হাঁটু পরীক্ষা করে তিনি জানালেন গুরুতর কিছু নয় সাতদিন বিছানায় থাকতে হবে, নড়াচড়া একদম নয়। বাড়িতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ ছিল। তাই দিয়ে হাঁটুটা শক্ত করে জড়িয়ে দিয়ে তিনি একটা মলম লিখে দিলেন, দিনে তিনবার পুরু করে লাগাতে হবে।

ডাক্তারের নির্দেশমতো অনিরুদ্ধ বিছানাবন্দি হল। অলু কেবল অপারেটরকে খবর দিতেই তাদের লোক এসে তার ঠিক করে টিভির ছবি স্পষ্ট করে দেয়। টেবলে রাখা টিভি সেটটা ঘুরিয়ে দিতে হল, কেননা বিছানায় পা ছড়িয়ে বালিশে ঠেশ দিয়ে দেখতে হলে সেইটাকে দরজার দিকে মুখ করে রাখতে হবে।

টেলিফোন করে ম্যানেজারকে অনিরুদ্ধ জানিয়ে দিল তার দুর্ঘটনার ব্যাপারটা। কবে অফিস যেতে পারবে তা এখনই বলতে পারছে না, ডাক্তার অনুমতি দিলেই যাবে। ম্যানেজার রসিক মানুষ, তিনি বললেন, ”বিশ্বকাপে বাহান্নটা ম্যাচ, সবগুলো দেখলে চোখের বারোটা বেজে যাবে।”

শুনে আঁতকে উঠে অনিরুদ্ধ বলে, ”না না স্যার, পায়ের চোটটা কিন্তু সত্যি—সত্যিই। বড়জোর সাতদিন রেস্ট নেব।”

প্রৌঢ় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আহত স্বরে জবাব দিলেন, ”আহহা, আমি কি বলেছি তুমি মিথ্যে মিথ্যে বলছ। এই দ্যাখো না তিনটে ছুটির দরখাস্ত পেলাম, একজনের মায়ের গলব্লাডার অপারেশন হবে, আর একজনের বউয়ের বাচ্চচা হবে, তৃতীয়জনের দেশের বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়েছে, মেরামত করতে যাবে। সবাই ছুটি চেয়েছে যে তারিখগুলোয়, তার মধ্যেই পড়ছে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল—সাতটা খেলা, সবক’টাই স্যাংশন করে দেব।”

শোনামাত্র অনিরুদ্ধ স্থির করল সাতদিনের মধ্যে সে অফিসে যাবে। একটা দিনও কামাই করবে না, ডাক্তারের নির্দেশ কঠোরভাবে মেনে চলবে, কাঠের গুঁড়ির মতো বিছানায় পড়ে থাকবে। সাতদিনও গেল না তিনদিনের মাথায় সে খাট থেকে নেমে ঘরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করল। হাঁটুতে খচখচ করতেই সে হাঁটা থামিয়ে শুয়ে পড়ে। সেইদিনই ছিল বিশ্বকাপের প্রথম খেলা।

রাতের খাওয়া চুকিয়ে অমলা আর অলু টিভির সামনে দেয়াল ঘেঁষে দুটো চেয়ারে বসল, খাটে অনিরুদ্ধ। ওপেনিং সেরিমনি শেষ হতেই অমলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল; স্কুলে যাওয়ার জন্য সাড়ে আটটায় তাকে বেরোতে হয়, তাই ভোরে ঘুম থেকে ওঠার জন্য তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াটা খুব জরুরি। প্রতি রাতে দুটি করে ম্যাচ, দ্বিতীয়টি শেষ হতে হতে রাত আড়াইটে বেজে যাবে, সুতরাং অলু দ্বিতীয় ম্যাচ দেখবে না, পরদিন তার স্কুল আছে। তবে মামাকে ধরে মায়ের কাছ থেকে সে দ্বিতীয় ম্যাচ দেখার জন্য অনুমতি নিয়ে রেখেছে, অবশ্য যদি জার্মানি, ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, ইতালি বা হল্যান্ড তাতে খেলে। অনিরুদ্ধ দিদিকে বুঝিয়েছিল এই বলে—”সারা পৃথিবীর ছাঁকা ছাঁকা সেরা প্লেয়াররা খেলতে আসবে। ওদের খেলা দেখাটাও অলুর কাছে শিক্ষার ব্যাপার। তা ছাড়া পৃথিবীর ফুটবল এখন কোন জায়গায় রয়েছে বা পৌঁছতে যাচ্ছে তার আন্দাজ পাবে, কীভাবে খেলাটা হচ্ছে সেটা ওর বোঝা দরকার, শুধু কলকাতা আর শিমুলহাটির ফুটবল দেখে ও তো এক পাও এগোতে পারবে না। দিদি ওকে দেখতে দাও, ক’টা দিন মাত্র তো খেলা হবে, তারপর তো আবার চার বছর বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা করা!” গজগজ করতে করতে অমলা ভাইয়ের কথা মেনে নেয়।

রাতের পর রাত মামা—ভাগ্নের বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ দেখা চলতে লাগল। অনিরুদ্ধ তার প্রতিজ্ঞামতো সাতদিন পরই স্কুটার চালিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে অবাক ম্যানেজারের হাতে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে বলল, ”আমার মা নেই, বিয়েও করিনি, অতএব বউ নেই, দেশেও কোনও বাড়ি নেই, সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন ছুটির জন্য আর দরখাস্ত করব না।”

বিশ্বকাপ একসময় কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছল। এবার আটটা দল নকআউট ম্যাচ খেলবে। অনিরুদ্ধ দাগিয়ে রেখেছে ইউরোপের বাইরের একমাত্র দল ব্রাজিলকে। ওদের খেলা হল্যান্ডের সঙ্গে। ম্যাচটা তাকে মন দিয়ে দেখতে হবে। গত ষোলো বছর ব্রাজিল সেমিফাইনালে ওঠেনি, এবার পারবে কি? যদি পারে তা হলে অলুকে নিক্কো পার্ক দেখিয়ে আনবে। বলা বাহুল্য, অলু তক্ষুনি ব্রাজিলের সমর্থক হয়ে পড়ল।

ব্রাজিল প্রথম আধঘণ্টা চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে অসাধারণ ফুটবল খেলল কিন্তু গোল পেল না। গোল হব হব হলেই অলু বিছানায় ঘুসি মারতে থাকে উত্তেজিত হয়ে, তারপরই মাথায় হাত চেপে ফ্যালফ্যাল করে মামার দিকে তাকায়। অনিরুদ্ধ তার পিঠে হাত রেখে বলে, ”শান্ত হয়ে বোস। গোল ঠিকই হবে।” হলও, তবে সেকেন্ড হাফে, পরপর দুটো গোল দিল ব্রাজিল। অনিরুদ্ধ মুখ টিপে হেসে বলল, ”কী বলেছিলুম, একটা নয় দু—দুটো গোল। তোকে তা হলে নিক্কো পার্কে নিয়ে যেতেই হচ্ছে।” বাজি হারার জন্য তাকে খুশিই মনে হচ্ছে।

কিন্তু খুশির ভাবটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুখ থেকে মুছে গেল যখন হল্যান্ড খেপে উঠে পনেরো মিনিটের মধ্যে গোল দুটো শোধ করে দিল। এর পর হল্যান্ডের পেনাল্টি এরিয়ার প্রায় দশ গজ বাইরে ফ্রিকিক পেল ব্রাজিল। অনিরুদ্ধর মনে হল না এটা ফাউল, রেফারি বাড়াবাড়ি করল। শট নেমে ব্র্যাঙ্কো, সামনে পাঁচজনের দেয়াল। ব্রাজিলের দু’জন সেই দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিরুদ্ধ বলল, ”অলু, গোলকিপারকে দেখ কোথায় দাঁড়াচ্ছে। বল দেখতে পাচ্ছে না, চেঁচিয়ে নিজের প্লেয়ারদের বলছে একটু ফাঁক হয়ে দাঁড়াবার জন্য।”

গোলকিপার দুই পোস্টের মাঝামাঝি জায়গায় কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকে ব্র্যাঙ্কো শট নেবে। সে শট নিল। দেয়ালে একটা ছোট্ট ফাঁক। শটটা বাতাসে বেঁকে সেই ফাঁকের মধ্য দিয়ে গলে গিয়ে আরও বাঁকতে বাঁকতে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকা গোলকিপারকে দাঁড় করিয়ে রেখে দূরের পোস্টে ধাক্কা দিয়ে গোলে ঢুকে গেল। সারা মাঠের মতো ঘরের দু’জনও স্তম্ভিত!

উত্তেজনা চেপে অনিরুদ্ধ প্রথম কথা বলল, ”ওইরকম আউট সুইঙ্গার! গোলকিপারের কিছু করার ছিল না।” দেয়াল—ঘড়ি দেখে বলল, ”আধঘণ্টায় পাঁচটা গোল, খেলা বটে!”

”বাব্বা, কতখানি বেঁকে গেল বলটা!” অলু চোখ প্রায় কপালে তুলে ফেলল।

”দেখলি তো ওয়ার্ল্ড ক্লাস শট কাকে বলে?”

ফ্রিকিকটা রিপ্লেতে তিনবার তিনদিক থেকে দেখাল। ওরা গভীর মনোযোগে যখন দেখছে তখনই বারান্দার বাইরে বটগাছটায় ঝর ঝর ঝর ঝপাত করে শব্দ হল। যেন গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। চমকে উঠে অলু মামার গা ঘেঁষে সরে এল। ওর একটু ভূতের ভয় আছে।

”কী ব্যাপার রে অলু, দ্যাখ তো!”

খাট থেকে ঝুঁকে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অলু বলল, ”ঘুটঘুটে অন্ধকার।”

অনিরুদ্ধ বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলল, ”তোদের টর্চটা নিয়ে আয়। চোরটোর হতে পারে। বটগাছ দিয়ে উঠোনে নামল কিনা দেখি।”

অলু ঘর থেকে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ আনল, সঙ্গে ঘুম থেকে ওঠা অমলা। সে বলল, ”আমার ছোটবেলায় একবার একটা চোর বটগাছ ধরে নেমে উঠোনে লাফিয়ে পড়েছিল। ধরা পড়ে বাবার হাতে বেদম মার খায়।”

অনিরুদ্ধ টর্চ জ্বালিয়ে বটগাছের মগডাল দেখল, তারপর রশ্মিটা নীচের দিকে নামাতে নামাতে থেমে গিয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করল, ”আরে!”

অলু আর অমলাও বলে উঠল ”এ কী!”

দু’হাতে গাছের ডাল ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলছে কুড়োন।

”অ্যাই, তুই এখানে এত রাতে?” অনিরুদ্ধ চেঁচাল।

”নেমে আয়, নেমে আয়।” হাত নেড়ে অমলা বলল।

”কী কত্তে গাছে উঠেছিস?” জানতে চাইল অনিরুদ্ধ।

”খেলা দেখব বোলে।” মিনমিনে অপরাধী গলায় কুড়োন বলল।

”কী বললি? খেলা দেখব বোলে? এইভাবে খেলা দেখা? নাম, নাম, শিগগির নাম।” অনিরুদ্ধ হাসবে না রাগবে ঠিক করতে পারছে না।

পাঁচিল থেকে দু’হাত ওপরে ঝুলছে কুড়োন, অনিরুদ্ধর কথায় ডাল থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে জোড়াপায়ে পাঁচিলে পা ঠেকিয়েই ছ’ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে নামল উঠোনে। অনিরুদ্ধ একতলায় নেমে গিয়ে আলো জ্বালল। কান ধরে কুড়োনকে টেনে নিয়ে দোতলায় এল।

ওকে দেখেই অমলা বলল, ”এই বাঁদর, গাছে ঝুলে ফুটবল খেলা দেখা, তাও মাঝরাত্তিরে! অনি, ওর কানটা ছিঁড়ে দে তো! যদি পড়ে যেতিস তা হলে তো মরে যেতিস, নয়তো হাত—পা ভেঙে চিরকাল নুলো খোঁড়া হয়ে থাকতিস।”

”কার খেলা দেখতে গাছে উঠেছিলি?” অনিরুদ্ধ কৌতূহলী হয়ে জেরা শুরু করল।

চোখ নামিয়ে কুড়োন চুপ।

অনিরুদ্ধ খোলা দরজা দিয়ে ঘরের টিভি সেট আর বটগাছের দিকে তাকিয়ে দূরত্বটা মাপল, প্রায় বারো—চোদ্দো গজ তো হবেই। অত দূর থেকে কি টিভিতে খেলা দেখা যায়?

”বল তো ক’টা গোল হয়েছে?” অনিরুদ্ধ পরীক্ষা করার জন্য বলল।

”পাঁচটা।” কুড়োন কিছুটা ভরসা পেয়ে সহজ গলায় বলল।

”শেষ গোলটা দেখেছিস? বল তো কী করে হল?”

”লোকগুলো লাইন করে দাঁড়াল, তাদের মদ্যি দিয়া শট লইয়া চালায়ে দিল বলটা।” কুড়োনের গলায় উদ্দীপনার ছোঁয়া লাগল।

কী ভেবে অনিরুদ্ধ বলল, ”তুই পারবি অমন শট করতে?”

কুড়োন চুপ করে রইল পাঁচ—ছ’ সেকেন্ড, তারপর বলল, ”শিখিয়ে দিলে পেরাকটিস করব।”

ওরা তিনজন মুখ—চাওয়াচাওয়ি করল। অনিরুদ্ধ আশা করেনি এমন একটা উত্তর পাবে, মনে মনে সে খুশি হল। ছেলেটা ‘পারব না’ বলেনি।

”কবে থেকে গাছে উঠছিস?” অমলা বলল।

”পেরথমদিন থেকে।”

অমলার মুখ থেকে একটা ‘উউউ’—এর মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল বিস্ময় চাপতে গিয়ে, ”কুড়ি—পঁচিশদিন ধরে রোজ গাছে উঠছিস খেলা দেখার জন্য! অনি, এটা তো পাগল।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”খেলা দেখবি তো বললেই পারতিস, অলুকে তো চিনিস, ওকে বললি না কেন খেলা দেখব।”

কুড়োন দু’বার অলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ”ওরা আমায় খেলতে নেয় না, টিভি দেখতে দেবে?”

”হ্যাঁ দেবে।” অনিরুদ্ধ বলল, ”কাল থেকে তুই এই ঘরে বসে খেলা দেখবি, এখন যা। তোর দাদু কেমন আছে?”

”ভালা আছে।”

কুড়োন নীচে নেমে গেল, তার সঙ্গে অলু, সদর দরজায় খিল দেওয়ার জন্য। নামতে নামতে অলু বলল, ”তুই মামাকে বলতে গেলি কেন খেলতে নেয় না? আমি নেওয়া না—নেওয়ার কে? দিপুদা আর দেবুই তো নাটের গুরু।”

ভ্রূ কুঁচকে কুড়োন বলল, ”এখন তো এই কথা বলছ, তখন তো কিছু বলো নাই, পতিবাদ করো নাই।”

”করলে আমাকেও বার করে দিত।”

”দিত তো দিত। খেলতে জানলি তুমি সব কেলাবে চান্স পাবে।” ঠোঁট ওলটাল কুড়োন তাচ্ছিল্যভরে।

অমলা তখন অনিরুদ্ধকে বলছে, ”এরকম পাগল ছেলে আর কাউকে কখনও দেখেছিস?”

মাথা নেড়ে অনিরুদ্ধ বলল, ”না দেখিনি। তবে সুযোগ পেলে এরকম পাগলামি কিন্তু অনেকেই দেখাবে, কুড়োন সুযোগ পেয়েছে তাই দেখাচ্ছে। ওর পাগলামিটাকে এবার ঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে হবে।”

”ছেলেটার আছে কে? মুখখানি বেশ মিষ্টি, দেখলে মায়া হয়।”

”ওর মায়ের জ্যাঠা রাখাল। সে ছাড়া কুড়োনের আর কেউ আছে বলে জানি না। দাদামশাইকে সাপে কেটেছে, বাবাকে বাঘে নিয়ে গেছে, মাকে কুমিরে, ছেলেকে নিয়েছে ফুটবলের ভূতে, ভাবছি এবার ওকে নেব আমি।”

পরদিন থেকে কুড়োন খেলা দেখতে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে সে সহজ হয়ে গেল এই বাড়ির লোকেদের সঙ্গে, অনিরুদ্ধকে সে অলুর মতোই মামা বলে ডাকতে শুরু করল, অমলাকে মাসিমা। দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় টিভি সেটের মুখোমুখি হয়ে খেলা দেখে, খাটে অনিরুদ্ধ আর অলু।

”অলু, গোলকিপারকে দ্যাখ দ্যাখ, গোল খাবে এবার…আহহ বাইরে মারল।” খেলার সঙ্গে অনিরুদ্ধর ব্যাখ্যাও চলে। ”তুই কী করতিস অলু? ওইভাবে গোললাইনে দাঁড়িয়ে থাকতিস ব্যাক পাস করছে দেখে?”

”হ্যাঁ থাকতুম।” বেশ জোর দিয়েই অলু বলল, ”অপোনেন্টের দুটো ফরওয়ার্ড সামনে। ব্যাক পাসটা কে পাবে জানি না। হুড়মুড় করে বেরিয়ে পাসটা ধরে ফেলতে যদি না পারি তা হলে কী হবে? তার থেকে বরং গোলে দাঁড়িয়ে এসপার—ওসপার একটা চেষ্টা করা যায়।”

”এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা, কখন কোথায় বেরোব কি বেরোব না, আমার খুব ভাল ছিল না।” অনিরুদ্ধ স্বীকার করে নিয়ে বলল, ”দু—তিন সেকেন্ডের মধ্যেই তোকে ঠিক করে নিতে হবে কী করব…আরে আরে কী স্পিডের ওপর বলটা না থামিয়েই ঘুরিয়ে পাসটা করে দিল, দেখেছিস কুড়োন?

দেয়ালে ঠেস দেওয়া কুড়োন তখন সিধে হয়ে বসে দু’চোখ দিয়ে সেটটাকে গিলছিল। শুধু বলল, ”হ।”

”পারবি ওভাবে পাস দিতে?”

সেট থেকে চোখ না সরিয়ে কুড়োন বলল, ”পেরাকটিস করতে হবে।”

চব্বিশ বছর পর ফাইনালে উঠল ব্রাজিল, অন্যদিক থেকে ইতালি এবার নিয়ে পঞ্চমবার। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে অনিরুদ্ধ খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়েছে, লক্ষ রেখেছে নামীরা কে কেমন ফর্মে রয়েছে। ইতালির সেরা স্ট্রাইকার রোবার্তো বাজ্জিও প্রথম রাউন্ডে খোঁড়াচ্ছিল, ডান গোড়ালিটা ফুলে রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে সে ঝকমক করে উঠল। নকআউট পর্যায়ের তিনটি ম্যাচে পাঁচটি গোল দিয়ে এই লোকটি ইতালিকে প্রি—কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে টেনে এনেছে ফাইনালে। অনিরুদ্ধ দেখেছে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যাচের শেষ মিনিটে জয়সূচক গোলটি দেওয়ার পর রোবার্তো ক্লান্তিতে টলে পড়ে যাচ্ছিল, দু’হাত তুলে উচ্ছ্বাস জানাবার মতো জোরও ছিল না শরীরে।

ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে অনিরুদ্ধ অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ দুই বালককে বলল, ”বিশ্বকাপ ফুটবল কী জিনিস এই বাজ্জিওকে দেখে বুঝতে পেরেছিস?”

অলু বলল, ”শুধু বাজ্জিও কেন, ওদিকে রোমারিও, সেই বা কম কীসে?”

”ঠিক। সেমিফাইনালে দেখেছিস ডান দিক থেকে আসা ক্রসটায় কীভাবে হেড করে সুইডেনকে গোলটা দিল?”

কুড়োন বলে উঠল, ”দুটো লোকের মদ্যিখান থেকে লাফিয়ে উঠে যে হেডটা করল, সেইটা? খুব বড় পেলেয়ার!”

অনিরুদ্ধ বুঝল, রোমারিওর হেড করার দৃশ্যটা কুড়োনের মনে ছবির মতো ছাপা হয়ে গেছে, যেমন ব্র্যাঙ্কোর ফ্রিকিকের আউট সুইঙ্গারটা। এইসব টুকরো টুকরো স্কিলগুলোই ছেনির মতো ঠুকে ঠুকে মনের মধ্যে খোদাই করে ফুটবলের মূর্তি গড়ে দেয়।

প্রচণ্ড চমক তিনজনের জন্য অপেক্ষা করছিল ফাইনাল ম্যাচের শেষ মুহূর্তে। নব্বই মিনিট খেলায় গোল হল না। অতিরিক্ত সময়ের কুড়ি মিনিটে গোলের এক গজ দূর থেকে রোমারিও যখন পোস্টের বাইরে বল মারল, কুড়োন তখন ঝুঁকে কপাল মেঝেয় ঠুকে বলে উঠল, ”মামা, আমাদের দেবুও তো ওখান থেকে গোল দিয়া দিত। ইসস।” কুড়োনের ধারণা, দেবু আর একটা রামছাগল একই রকম ফুটবল খেলবে।

খেলা গড়াল টাই ব্রেকারে। ব্রাজিলের প্রথম চারটি পেনাল্টি কিকের তিনটিতে গোল হল, একটি বাঁচাল গোলকিপার। ইতালির দুটি কিকে গোল হল, একটি গেল বারের ওপর দিয়ে, চতুর্থটি আটকাল গোলকিপার। ব্রাজিল ৩—২ গোলে এগিয়ে। ইতালির পঞ্চম কিক নেবে বাজ্জিও। অলু আর কুড়োন তো বটেই, অনিরুদ্ধও টানটান হয়ে বসল। কী হয়, কী হয় ভাব, তিনজনের বুকের ধকধকানি ঢাক বাজাচ্ছে। গোল দিলে ৩—৩ হবে, দিতে না পারলে ইতালি ২—৩ হেরে যাবে।

বাজ্জিও কিক নিল। বাঁ দিকের পোস্ট আর ক্রসবারের ওপর দিয়ে বলটা চলে গেল। তিনজন পাথরের মতো বসে রইল। ম্যাচটা এইভাবে শেষ হবে, কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।

অনিরুদ্ধ বলল, ”লাক, ব্যাড লাক। টায়ার্ড শরীর, টায়ার্ড ব্রেন, আগের ম্যাচে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট, তার ওপর শেষ কিক নেওয়ার প্রেসার। এত বছরের এত পরিশ্রম আর বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন একটা বাজে কিকে চুরমার হয়ে গেল, একেই বলে নিয়তি!”

অলু বলল, ”টাইব্রেকারটা অনেকটা লটারির মতো। একটা ভাল টিমও হেরে যেতে পারে, যেমন আজ হল।”

কুড়োন বলল, ”দুই দুইডা প্লান্টি মিস করল তারে ভাল টিম বলব? হ্যাঁ মামা, আপনি বলেন, ভাল টিম?”

অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল। অলু যা বলল তাতে যুক্তি আছে, কুড়োনের কথাও যুক্তিহীন নয়। দু’জনের মাঝামাঝি একটা রাস্তায় সে হাঁটল। ”এবার থেকে তোরা প্লান্টি কিক পেরাকটিস কর। কুড়োন গোল দেবে আর অলু গোল বাঁচাবে।”

.

হেডমাস্টার শিবেনবাবুর ভাড়াবাড়ি স্কুল থেকে হেঁটে মিনিট তিনেক দূরে। আগে ছিলেন কোলাঘাটের একটি স্কুলে। দেড় বছর আগে এসেছেন স্বামী স্বরূপানন্দে। পরিবারবর্গ রয়েছে মেচেদায় পৈতৃক বাড়িতে। শিবেনবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ছিপছিপে গড়ন। অনিরুদ্ধ শুনেছে, খুব ভোরে হাফপ্যান্ট আর কেডস পরে রোজ জগ করেন শিমুলহাটিকে চক্কর দিয়ে। কিন্তু ধবধবে ধুতি—পাঞ্জাবি ছাড়া ওঁকে স্কুলে কেউ দেখেনি। কথা কম বলেন এবং বলেন ধীর গম্ভীর স্বরে। অনিরুদ্ধর সঙ্গে আগের হেডমাস্টারমশাই নারায়ণবাবুর আলাপ ছিল। নিপাট ভালমানুষ, সাতেপাঁচে থাকতেন না। ভারত বিশ্বকাপ ক্রিকেট জেতায় তিনি একদিন স্কুল ছুটি দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে মিছিল করে ‘ক্রীড়াপ্রেমিক’ খেতাব পান। তাঁর সময়েই স্কুলের ফুটবল টিমটা উঠে যায় অর্থের ও উৎসাহের অভাবে।

রবিবার সকাল সাতটায় অনিরুদ্ধ হাজির হল শিবেনবাবুর বাড়ি। একতলা, দু’খানি ঘর। একটা ছোট বারান্দা, সেটাই বসার জায়গা। দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ধুতি আর গেঞ্জিপরা একটি ছেলে। অনিরুদ্ধ একে চেনে না। মনে হল বাড়ির কাজের লোক, বছর কুড়ি বয়স।

”হেডমাস্টারমশাই আছেন?”

”আছেন।”

”বলো—।”

”অনিরুদ্ধ চক্কোত্তি দেখা করতে এসেছেন। আপনাকে চেনে না, এই শিমুলহাটিতে এমন লোক আছে নাকি? বসুন, উনি চান কচ্ছেন, একটু আগে দৌড়ে এলেন।’

”তোমার নাম কী?” অনিরুদ্ধ কৌতূহল বোধ করল ওর কথা শুনে। বলার ধরনে মনে হল মুখ্যু কাজের লোক নয়, লেখাপড়া করেছে।

”ভবতোষ… সবাই ডাকে ভবা বলে। হেডমাস্টারমশাইয়ের বেয়ারা। আমি এখানেই থাকি, সারের সব কাজকম্মো করি।”

ভবা ভেতরে চলে গেল। মিনিট তিনেক পর একটা সাদা কালো চেক লুঙ্গির ওপর খদ্দরের পাঞ্জাবি চাপিয়ে শিবেন ঘোষ বেরিয়ে এলেন। অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বলল, ”আমি আপনার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, নাম—।”

”শুনেছি শুনেছি, ভবা বলেছে। বসুন, চা খাবেন?”

সকালের চা খেয়েই অনিরুদ্ধ বেরিয়েছে। তার মনে হল খাব না বললে উনি ভাবতে পারেন ওজন দেখাচ্ছে।

”হ্যাঁ খাব।”

শিবেনবাবু ভেতরে গেলেন। দু’মিনিট পর ফিরে এসে বসলেন।

”প্রথমেই একটা কথা নিবেদন করি, আপনি নয়—তুমি বলবেন।”

শিবেনবাবু ভ্রূ তুলে কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, ”তাই বলব। বয়সে বড়, তার ওপর হেডমাস্টার; বলো তোমার আগমনের কারণ।”

”এই স্কুলেই আমার গোলকিপিংয়ের হাতেখড়ি। তখন নিয়মিত ইন্টার—ক্লাস ম্যাচ খেলা হত স্কুলমাঠে। গেমস টিচার প্রতাপবাবু টিম করতেন, খেলাতেন। স্কুলের ফুটবল টিম ছিল, আমরা সাবডিভিশনাল, ডিস্ট্রিক্ট স্কুল টুর্নামেন্টে খেলতুম, চ্যাম্পিয়ানও হয়েছি। এই স্কুল থেকেই দু’জন বেঙ্গল টিমে খেলেছি অল ইন্ডিয়া স্কুল চ্যাম্পিয়ানশিপে কুড়ি বছর আগে। এই স্কুলের চারজন কলকাতায় ফার্স্ট ডিভিশনে খেলেছে। ফুটবলের একটা ঐতিহ্য ছিল স্বরূপানন্দ স্কুলের, সেটা এখন আর নেই।”

বলতে বলতে অনিরুদ্ধ লক্ষ করছিল শিবেনবাবুর মুখ, মন দিয়ে শুনছেন আর ভেবে চলেছেন। সে আবার শুরু করল, ”তখনকার মাস্টারমশাইরা রিটায়ার করে গেলেন, কেউ কেউ মারা গেলেন, স্কুল থেকে ফুটবলের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার উৎসাহটাও ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল, এখন একেবারেই চড়া পড়ে গেছে। খেলার স্রোতটা আবার ফিরিয়ে আনা দরকার। এ—ব্যাপারে স্কুল যে সাহায্য আমার কাছে চাইবে তা আমি দেব।”

শিবেনবাবুর মুখের পাতলা হাসিটা এবার মিলিয়ে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ”স্কুলের সমস্যাটা কী জানো, টাকা নেই। বেঞ্চ চেয়ার ভেঙে রয়েছে, দেয়ালের প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে, খাওয়ার জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে গেছে, এর পর খেলার জন্য টাকা দেওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে উঠবে।”

ভবা ট্রে—তে করে দু’কাপ চা নিয়ে এল, সঙ্গে বিস্কুট। নীরবে তারা চায়ে চুমুক দিতে থাকল। অনিরুদ্ধ এইটুকু বুঝেছে, শিবেনবাবু ফুটবলের বিরুদ্ধে নন, বরং পক্ষেই। যদি টাকা থাকত তা হলে এখনই হ্যাঁ বলে দিতেন। খালি কাপ নামিয়ে অনিরুদ্ধ একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে বলল, ”খরচ খুব বেশি নয়। আপাতত দরকার গোটাচারেক বল, একটা মাঠ, যেখানে দু’বেলা প্র্যাকটিস করতে পারবে। স্কুলের মাঠটায় মাটি ফেলে লেভেল করা দরকার, খেলার অযোগ্য হয়ে রয়েছে। গোল পোস্ট, বারও করাতে হবে।”

চিন্তিত মুখে শিবেনবাবু বললেন, ”সকালে প্রাইমারি স্কুল বসে, ক্লাসের গায়েই মাঠ। সকালে তো মাঠে খেলা যাবে না, তা হলে স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য বিকেলে খেলা যাবে।”

এও এক সমস্যা। সকালের প্র্যাকটিসটা খুবই দরকার। স্কুলের মাঠ না হলে অন্য কোনও মাঠে। দুটো মাঠ আছে শিমুলহাটিতে, কালীতলার আর একতার। কালীতলায় সকালে কোচিং করায় দিপুদা, ওরা স্কুলকে মাঠ ছাড়বে না। একতার নাম কা ওয়াস্তে ফুটবল টিম আছে বটে, তবে ওরা জোর দিয়েছে ক্রিকেটে। সকালে মাঠটা পড়েই থাকে। টাকা দিয়ে একতা চালায় দেবেন গায়েন, মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার, মাছের ভেড়ি, আর ধানজমি থেকে আয় ছাড়াও জমি কিনে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি করে বিক্রির ব্যবসাও আছে। টিভি—র আর ওষুধের দোকান দিয়েছে, এখন বিউটি পার্লার খোলার তোড়জোড় করছে। যথেষ্ট ধনী লোক। স্বরূপানন্দ স্কুল ম্যানেজিং কমিটির মেম্বার। অনিরুদ্ধ মনে মনে ঠিক করে ফেলল, দেবেন গায়েনকে ধরতে হবে একতার মাঠটা পাওয়ার জন্য।

”মাঠ আছে একতা সঙ্ঘের। দেবেন গায়েন পেট্রন ইন চিফ, ওকে একবার বলে দেখতে পারি। স্কুলমাঠে মাটি ফেলার খরচটা যদি উনি দেন, সেজন্য যদি একটু তোয়াজ করে কথা বলতে হয়—।” কথা অসম্পূর্ণ রেখে অনিরুদ্ধ হাসল।

”স্কুলের জন্য প্রাক্তন ছাত্রের কিছু একটা করার ইচ্ছা দেখে খুব ভাল লাগছে। যেচে এভাবে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখিনি। তুমি কাজ শুরু করো, আমি আছি।” শিবেনবাবু গম্ভীরস্বরে বললেন।

অনিরুদ্ধ মনে মনে বলল, স্কুল নয়, আসলে কুড়োনের জন্যই নাড়া খেয়ে উদ্যোগী হয়েছি। ছেলেটাকে তৈরি করে দিতে পারলে কাজের মতো একটা কাজ করা হবে। মুখে সে বলল, ”সার, বহু প্রাক্তন ছাত্র স্কুলের জন্য কিছু একটা করতে পারলে ধন্য বোধ করবে। কেউ যদি উদ্যোগী হয়ে তাদের কাছে সাহায্য চায় তা হলে অবশ্যই তারা হাত বাড়িয়ে দেবে। এই উদ্যোগটাই কেউ নেয়নি এতকাল। স্কুলের ফুটবল টিম আমি করবই। আপনি শুধু দেখুন ছেলেরা যেন নিয়মিত মাঠে আসে, ট্রেনিং কোচিং যা দেওয়ার আমিই দেব।”

শিবেনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনিরুদ্ধ ভাবল, একবার পার্থর কাছে যাই। পার্থ মুখুজ্জে তার সঙ্গেই পড়েছে, একসঙ্গে তারা স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। পার্থ এখন যাদবপুরে ফিজিকস পড়ায়। খেলাধুলো করত না কিন্তু সাহায্য চাইলে নিশ্চয় বিমুখ করবে না। অনিরুদ্ধ হাঁটতে হাঁটতে দেখল বাড়ির লোহার গেটের সামনে একজন বেঁটে, গোলগাল, শ্যামবর্ণ, পাজামা আর প্রায় গোড়ালি ছোঁয়া পাঞ্জাবি পরা লোকের সঙ্গে কথা বলছে ধীরুদা অর্থাৎ তাদের ক্লাসের বীরেশ্বরের দাদা ধীরেশ্বর, যে একদিন অনিরুদ্ধকে কালীতলার মাঠে গোলপোস্টের মাঝে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘শিখে কী করবি…তুই বরং একতার মাঠে গিয়ে খেলা শেখ।’ ধীরেশ্বরকে দেখলেই কথাগুলো তার মনে পড়ে আর মনে মনে হেসে ওঠে।

”এই অনি শোন, শোন, এদিকে আয়।” ধীরেশ্বর মাতব্বরি ঢঙে হাত নেড়ে ডাকল। অনিরুদ্ধ অনিচ্ছুক পায়ে এগিয়ে গেল।

”তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি কপিল ঘোষ আমার বন্ধু, সিরিয়াল ডিরেক্টর, এখন ওর একটা সিরিয়াল চলছে টিভি—তে, আটশো পর্ব পেরিয়ে গেছে, কী যেন নাম?”

ডিরেক্টর বলল, ”সোনার খাঁচা।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, সোনার খাঁচা। এর পরের সিরিয়ালটা করবে খেলা নিয়ে। গল্পটল্প সব রেডি, কাজও শুরু হয়ে গেছে। একজন ফুটবলারের উত্থান—পতন, আবার উত্থান নিয়ে গল্পটা। কপিল আমার কাছে এসেছে আমার জানা কোনও ছেলেটেলে আছে কিনা খোঁজ নিতে। ভাল কথা কপিল, তোর সঙ্গে এর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। এ হচ্ছে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী, বিখ্যাত গোলকিপার, ইন্ডিয়া টিমে খেলেছে।”

কপিল ঘোষ যেন বাড়ির উঠোনে মোহর ভর্তি একটা ঘড়া দেখতে পেয়েছে এমন একটা ভাব তার চোখেমুখে ফুটিয়ে বলল, ”আপনিই অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী! কী আশ্চর্য, আপনার অনেক খেলা আমি দেখেছি। বছর দশেক মাঠে যাই না, তখনই শেষ আপনাকে দেখেছি।”

ধীরেশ্বর বলল, ”জানিস কপিল, অনির গোলকিপার হওয়ার পেছনে কিন্তু সবচেয়ে বড় অবদান আমার। কালীতলা স্পোর্টিংয়ে ট্রায়াল দিতে এসে এমন বাজে খেলল অনি যে, ওকে বাদই দিয়ে দেওয়া হয়। ও একতা সঙ্ঘে যাবে বলে ঠিক করল। তখন আমিই হারাধন দত্তকে বলি ছেলেটার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা আছে, রেখে দিন। আমি ওকে তৈরি করে নোব। তখন আমি কালীতলার ফার্স্ট গোলকিপার। অনি হল সেকেন্ড গোলকিপার, সেই ওর শুরু, তারপর তো বিরাট নাম করল।” বলেই ধীরেশ্বর বড়দার মতো অনিরুদ্ধর কাঁধে হাত রেখে একগাল হাসল।

ধীরেশ্বরের কথা শুনে অনিরুদ্ধ অবাক হল না, রাগলও না। সে ওর স্বভাবটা জানে। নিজেকে বড় করে দেখাবার জন্য নির্লজ্জের মতো মিথ্যা বলে যেতে পারে। অনিরুদ্ধ আলতোভাবে কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে দিয়ে সামান্য সরে দাঁড়িয়ে কপিল ঘোষকে জিজ্ঞেস করল, ”কীরকম ছেলে চান, তাকে কী করতে হবে?”

দু’হাত নেড়ে কপিল ঘোষ বলল, ”নায়কের ছোটবেলার খেলার কয়েকটা শট নেব, দশ থেকে চোদ্দ বছর বয়স হলেই হবে, দু—চারটে কথা বলবে আর বল নিয়ে একটু খেলা করবে, ব্যস। তবে খেলাটা দেখে যেন বোঝা যায় ভবিষ্যতে ছেলেটা বড় প্লেয়ার হবে। আর ছেলেটাকে দেখতে যেন একটু ভাল হয়। নায়কের মুখের সঙ্গে মিল থাকলে তো খুবই ভাল।”

অনিরুদ্ধর মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল কুড়োন। সে বলল, ”ছেলে একটা আছে, যেমন চাইছেন তেমনই, দেখতেও ভাল। তবে কথা বললেই মুশকিল, লোকে হেসে ফেলবে, গ্রাম্য উচ্চচারণ।”

কপিল ঘোষ হাতপাখার মতো তালু নেড়ে বলল, ”ও কিছু নয়, ও কিছু নয়, ডাব করে নেব। অন্য একটা ছেলের গলা ওর গলায় বসিয়ে দেব। বয়স কত?”

”বছর চোদ্দ। ছেলেটার খেলা দেখতে হলে তো তা হলে একটা ম্যাচ খেলাতে হবে।”

”তা তো হবেই।” কপিল ঘোষের বলার ধরন দেখে অনিরুদ্ধর মনে হল, ম্যাচের কথাটা বোধ হয় আগে ওর মাথায় ছিল না।

”সেই ম্যাচটা কি আমাকেই অ্যারেঞ্জ করতে হবে? অন্তত গোটা পনেরো—ষোলো ছেলে চাই।”

”করে দিলে তো খুবই ভাল হয়।” কপিল ঘোষের গলায় কৃতজ্ঞ থাকার আগাম প্রতিশ্রুতি ঝরে পড়ল।

অনিরুদ্ধ দ্রুত চিন্তা করে নিল, তাকে এখন টাকার জোগাড় করতে হবে। এই লোকটা বা ওর প্রোডিউসার সিরিয়াল নাম দিয়ে ব্যবসা করে টাকা রোজগার করবে। ওর ব্যবসায় বা টাকা রোজগারে আমি সাহায্য করব কেন? যদি স্কুলের ফুটবলের জন্য টাকা দেয় তা হলে করব, নয়তো নয়।

”দেখুন একটা সাজানো ফুটবল ম্যাচকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা খুব সোজা কাজ নয়। বাংলা সিরিয়ালে আর সিনেমায় তো দেখেছি ফুটবল খেলা দেখে বাড়ির মেয়েরাও হাসে।”

কপিল ঘোষের মুখের হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল, ”কম টাকার মধ্যে সিরিয়াল করতে গেলে হাসির ছবি হবে না তো কী হবে?”

অনিরুদ্ধ এবার স্বর বদলে একটু কঠিন স্বরে বলল, ”লোকে এখন বিশ্বকাপের খেলা দেখছে, ফুটবল খেলাটা সম্পর্কে একটা ধারণা তারা গড়ে তুলছে। তাদের আপনি হাস্যকর ফুটবল দেখিয়ে নিজের নাম খারাপ করবেন কেন?”

নাম খারাপের কথা শুনে কপিল ঘোষের আত্মমর্যাদায় বোধ হয় আঘাত লাগল। টান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ”নাম খারাপের প্রশ্ন উঠছে কেন? ম্যাচটা তো আপনি অ্যারেঞ্জ করবেন। বাস্তবসম্মত হবে বলেই তো আপনাকে পেতে চাই। যেভাবে যা দরকার বলবেন সেইভাবে করব।”

”আপনার গল্পে দরকার একটা ছোটদের ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ, তা হলে ব্যাপারটা জমবে। সাতজন করে দুটো টিম খেলবে, চাঁদোয়ার নীচে ডায়াস, তাতে কাপ শিল্ড সাজানো, সভাপতি, প্রধান অতিথি বসে, ম্যাচ শেষে বিজয়ী নায়ক দু’হাতে ট্রফি তুলে হাসছে, কেমন হবে?” অনিরুদ্ধ এমনভাবে বলল, যেন চোখের সামনে সে ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছে।

কপিল ঘোষ চোখ বুজে দৃশ্যটা কল্পনায় দেখছিল। একগাল হেসে চোখ খুলে বলল, ”ফাইন। তবে চাঁদোয়া আর ডায়াসটা বাদ দিন, খরচ বেড়ে যাবে, আর কাপ শিল্ড টিল্ড জোগাড় করতে হবে। আর কী দরকার?”

ধীরেশ্বর এতক্ষণ মুখ বন্ধ রেখে দু’জনের কথা শুনে যাচ্ছিল। আর থাকতে না পেরে বলল, ”কাপ শিল্ডের কথা ভাবতে হবে না। ধবধবি আর খড়দায় খেলে দুটো কাপ পেয়েছিলুম, তোলা আছে আলমারিতে, ঝেড়ে মুছে নিলে চলে যাবে।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”দুটো টিমের জন্য চোদ্দোটা জার্সি আর বল চাই। মাঠ নয় কালীতলা কি একতার সঙ্গে ব্যবস্থা করে নেব। ছেলেরা নিজেদের বুট পরে খেলবে। একজন রেফারি আর প্রাইজ দেওয়ার জন্য একজন সভাপতি চাই। শুটিং হচ্ছে শুনলে মাঠে দর্শক আপনা থেকেই হয়ে যাবে। আসলে আপনার দরকার তো বাচ্চচা নায়কের কেরামতি দেখানো?”

”হ্যাঁ।” চিন্তিত মুখে কপিল ঘোষ বলল, ”দুটো টিমের জন্য দু’ সেট জার্সি! ওরে বাবা সে তো অনেক খরচ! আচ্ছা, সাদা কি লাল গেঞ্জি পরিয়ে খেলিয়ে দিলে হয় না?”

অনিরুদ্ধ বলল, ”এই তো হাসার মতো কথা বললেন। একই জামা পরে দু’ দল খেললে সব তো গুলিয়ে যাবে।”

”কেন, একদল সাদা, অন্য দল লাল গেঞ্জি পরবে।” ধীরেশ্বর ফোড়ন কাটল।

হাতঘড়ি দেখে কপিল ঘোষ ব্যস্ত হয়ে বলল, ”জরুরি একটা কাজ আছে, আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব। এখন ছেলেটাকে একবার দেখাতে পারেন?”

”এখন!”

অনিরুদ্ধ ফাঁপরে পড়ল। কুড়োন এই মুহূর্তে কোথায় আছে কে জানে! রাখালের কাছে খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে। কপিল ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে সে রাখালের ঘরের দিকে এগোল। স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছেই পরিচিত শব্দটা তার কানে এল, দেয়ালে বল মারার শব্দ। রবিবার স্কুল বন্ধ, তাই একা একা কুড়োনের ‘পেরাকটিস’ চলেছে সকাল থেকেই।

কপিল ঘোষকে নিয়ে অনিরুদ্ধ স্কুলবাড়ির পশ্চিমদিকে এসে কুড়োনকে পেল। সবুজ ঢলঢলে গেঞ্জি আর কেডস পরা কুড়োন এই অসময়ে অনিরুদ্ধ আর একটা লোককে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। তারপরই মুখে ভয় ফুটে উঠল।

নিচু গলায় অনিরুদ্ধ বলল, ”এই ছেলেটার কথাই বলেছিলুম।”

কপিল ঘোষ তীক্ষ্ন চোখে কুড়োনের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা অনুমোদকের ভঙ্গিতে হেলিয়ে বললেন, ”চলবে। খেলে কেমন?”

”আপনি কখনও একটু—আধটু ফুটবল খেলেছেন?”

”ছোটবেলায় পাড়ার গলিতে খেলেছি।”

”আপনার দিকে ও বল নিয়ে এগোবে। যেভাবে পারেন ওকে আটকাবেন, হাত দিয়ে পা দিয়ে যেভাবে হোক।”

কুড়োনকে ডেকে অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল, ”লোকটাকে কাটিয়ে বল নিয়ে বেরোতে পারবি?”

কুড়োন একনজর কপিল ঘোষকে দেখে নিয়ে বলল, ”ওই কুমড়োটারে!” সে আর কিছু বলল না। বলে একটা টোকা দিয়ে এগোল কুঁজো হয়ে দু’ পাশে হাত ছড়ানো কপিল ঘোষের দিকে। তার একগজের মধ্যে এসে কুড়োন শরীরটাকে ডাইনে ঝুঁকিয়েই বাঁয়ে হেলিয়ে আবার ডাইনে ঝোঁকাল। কপিল ঘোষ টলে পড়ে যাচ্ছিল, অনিরুদ্ধ তাকে ধরে নিল। বল পায়ে কপিল ঘোষের বাঁ দিক দিয়ে পেছনে গিয়ে কুড়োন একগাল হাসল।

”ভাগ্যিস ধরলেন”, কপিল ঘোষ শুকনো মুখে হেসে উঠল, ”অনেকদিন খেলি না তো, আচ্ছা আর একবার করুক।”

অনিরুদ্ধ ইশারা করল কুড়োনকে। এবারও একই ব্যাপার ঘটল। ডান দিক দিয়ে যাবার সময় কপিল ঘোষ টলে পড়তে পড়তে হাত দিয়ে কুড়োনকে ধরার চেষ্টা করেও পারল না। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কুড়োন বেরিয়ে গেল।

হতভম্ব কপিল ঘোষ বলল, ”অদ্ভুত তো! আচ্ছা, মারাদোনার মতো বল নাচাতে পারে?”

অনিরুদ্ধ ডাকল কুড়োনকে। ”টিভি—তে সেদিন মারাদোনার যে বলের খেলা দেখাল, সেটা করে দেখাতে পারবি?”

”হ।” কুড়োনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

বলটা নিয়ে সে ডান এবং বাঁ পায়ের পাতার ওপরে নাচাতে নাচাতে তুলে দিল ডান ঊরুর ওপর, তারপর বাঁ উরুতে এইভাবে ডান—বাঁ করতে করতে মাথার ওপর তুলে কপাল দিয়ে বার দশেক নাচিয়ে কপালের ওপরই স্থির করে রেখে তারপর পিঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে দিল। বলটা জমির দিকে নামছে, সে বাঁ পায়ের গোড়ালি দিয়ে টুক করে মাথার ওপর দিয়ে বলটা তুলে সামনের দিকে এনে ডান পা সামনে বাড়িয়ে ধরে নিয়ে পাতার ওপর বলটাকে স্থির করে বসিয়ে রেখে একগাল হাসল।

কপিল ঘোষ দমবন্ধ করে এতক্ষণ দেখছিল, এবার শ্বাস ফেলল, ”অদ্ভুত তো! প্রায় চার মিনিট বলটাকে জমিতে পড়তে দেয়নি। অনিরুদ্ধবাবু ছেলেটাকে আমার চাই।”

”আমাদেরও কিছু চাই। লোহার টিউবের গোলপোস্ট অর ক্রসবার, নম্বর দেওয়া রঙিন গেঞ্জি চোদ্দটা, চারটে বল আর কুড়োনের একজোড়া বুট।”

কপিল ঘোষ ভয়ে ভয়ে বলল, ”কত পড়বে এজন্য?”

”বলতে পারব না লোহার টিউবের দাম না জেনে। তবু আন্দাজে বলছি হাজার কুড়ি টাকা।”

আঁতকে উঠল কপিল ঘোষ। ”ওরে বাবা আমি মরে যাব। লোহার বদলে কাঠের গোলপোস্ট করলে হয় না?”

অনিরুদ্ধ হালকা চালে বলল, ”হবে না কেন, তা হলে কুড়োনের বদলে জুড়োনকে নিয়ে আপনাকে শুটিং করতে হবে। কপিলবাবু, আপনি একটা সাজানো ফাইনাল ম্যাচ পাবেন, আপনাকে নামী অভিনেতা—অভিনেত্রীর জন্য টাকা খরচ করতে হবে না, সেট সাজাবার খরচটাও বেঁচে যাবে, এই সব সুবিধে পেয়েও হাজার কুড়ি শুনে আঁতকে উঠছেন? কুড়োন যা দেখাল তাইতে আপনি অবাক হলেন, আপনার দর্শকরাও অবাক হবে, সেটা কি আপনি চান না? আমি টাকা চাইনি, জিনিস চেয়েছি। তাও নিজের জন্য নয়। যদি রাজি থাকেন তা হলে বলুন নয়তো—”

”না না না, জুড়োন নয়, কুড়োনকেই চাই। হাজার কুড়ির মধ্যেই হবে তো? ঠিক করে বলুন।” কপিল ঘোষ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল।

”আমি আন্দাজে বললুম। বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে, যদি রাজি থাকেন তা হলে তিনদিনের মধ্যে আমাকে জানান। ওই যে দেখছেন বাড়িটা,” অনিরুদ্ধ আঙুল তুলে বটগাছের পেছনের বাড়িটা দেখাল, ”ওটায় আমি থাকি। ছেলে জোগাড় করা, মাঠের ব্যবস্থা করা, সভাপতি, প্রধান অতিথি ঠিক করা, এটা কিন্তু আমি ঠিক করব। এজন্য আপনাকে খরচ করতে হবে না। আর দেখুন ধীরুদা যে বলল দুটো কাপ ওর কাছে আছে, তার হাইট দেখলে আপনার দর্শকরা হাসবে, পাঁচ ইঞ্চি লম্বা! গলির ফুটবলেও ওরকম ট্রফি দেয় না। গুপ্ত ব্রাদার্সকে বলে একটা শিল্ড আর একটা বড় কাপ ধার করে আনব। শুটিংয়ের আগেই গোলপোস্ট, বল আর বুট চাই, নইলে কিন্তু জুড়োন।” অনিরুদ্ধ কঠিন স্বরে জানিয়ে দিল। কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে এইসব লোকেদের আর টিকি দেখা যাবে না, নিজের খেলার অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা জানে।

”আপনার বাড়ি আর অফিসের ফোন নাম্বারটা দিন।” বলে কপিল ঘোষ পকেট থেকে নোটবই বার করল।

দুটো ফোন নম্বর বলে কপিল ঘোষকে ধীরেশ্বরের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অনিরুদ্ধ দেবেন গায়েনের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ির বৈঠকখানায় দেবেন দুটি লোকের সঙ্গে ব্যবসার কথাবার্তা চালাচ্ছিল, দু’জনের বসার ধরনে মনে হল ওরা অনুগ্রহপ্রার্থী। অনিরুদ্ধকে দেখে অবাক হয়ে দেবেন বলল, ”অনিরুদ্ধ! কী সৌভাগ্য! হঠাৎ তুমি?”

”দু—একটা কথা ছিল স্কুলের খেলাধুলোর ব্যাপার নিয়ে। আপনি তো ম্যানেজিং কমিটির একজন প্রভাবশালী মেম্বার। আপনার কথাতেই তো কমিটি চলে, খেলাধুলো ভালবাসেন তাই আপনারই দ্বারস্থ হলুম।” বিনীত ভাবে কথাগুলো বলে অনিরুদ্ধ দেখল, দেবেন গায়েনের মুখচোখ ঝকমক করে উঠল আর বাইরের লোক দুটির বসার ভঙ্গিতে ফুটে উঠল সম্ভ্রম। প্রচুর অর্থ রোজগার করলেও কেউ মান্যগণ্য বা অভিজাত বলে তাকে স্বীকার করে না, এটা দেবেন গায়েন এবং অনিরুদ্ধও জানে।

”তুমি জানলে কেমন করে, আমি খেলাধুলো ভালবাসি?” মিটমিটি হেসে দেবেন গায়েন বুঝিয়ে দিল খেলার প্রসঙ্গে কথা বলতে সে উৎসাহী।

”আপনি পাঁচ মাইল রোড রেসে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউট করেছিলেন, যোগাসন কম্পিটিশনে সংগঠক সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন, এসব কথা লোকে ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি, আর সেজন্যই প্রথমে মনে পড়ল আপনার কথা। স্কুল থেকে ফুটবল খেলা তো উঠে গেছে, মাঠের অবস্থাটা দেখেছেন?”

”দেখব না কেন, খারাপ খুব খারাপ।” দেবেন গায়েন মাথা নাড়ল খেদ জানাতে।

”সামান্য একটু মাটি ফেলে মাঠটা কিন্তু সমান করা যায়।” অনিরুদ্ধ তীক্ষ্ন নজরে লক্ষ করল শ্রোতার মুখ। কোনও ভাবান্তর দেবেন গায়েনের মুখে দেখতে পেল না।

”টিভি সিরিয়ালের ডিরেক্টর কপিল ঘোষ আজ এসেছিল ধীরুদার কাছে, বীরেশ্বর ঘোষকে চেনেন তো?”

”চিনি না? কালীতলা তো ওকে ভাগিয়ে তোমাকে নিল। তারপর এল আমার কাছে, একতায় খেলার জন্য তদ্বির করতে। অবশ্য খেলতে দিয়েছিলুম। তা সেই ডিরেক্টর ওর কাছে কেন?”

”ওর বন্ধু হয়। কপিল ঘোষ সিরিয়াল করবে একজন ফুটবলারকে নায়ক করে। সেই নায়কের ছোটবেলার ভূমিকায় নামাবার জন্য একটা ছেলে খুঁজছে। ধীরুদা ওকে গছিয়ে দিল আমার কাছে। আমি বললুম একটা ফুটবল ফাইনাল দেখান, সেই খেলায় আপনার ছোট নায়ককে খেলান। সে গোল দিয়ে টিমকে জেতাবে। ট্রফি নেবে বিশাল জনতার সামনে অনুষ্ঠানের প্রেসিডেন্টের হাত থেকে। কপিল ঘোষ রাজি হয়ে গেল। ওকে বললুম ফাইনালটা আমাদের এখানেই হোক। প্লেয়ার, প্রেসিডেন্ট, জনতা সবই এখানকার, মাঠটাও হবে এখানকার। উনি বললেন এতসব পাবেন কী করে? আমি বললুম, এই শিমুলহাটিতে এমন একজন লোক আছেন যিনি খেলাধুলো প্রসারের জন্য ইচ্ছে করলেই তুড়ি মেরে সব ব্যবস্থা একঘণ্টায় করে দিতে পারেন, এমনকী, স্কুলের মাঠটা মাটি ফেলে সমানও করে দিতে পারেন।”

দেবেন গায়েন হাসি হাসি মুখে শুনে যাচ্ছিল। এবার ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর হয়ে বলল, ”লোকটা কে, সুরথ নাকি?”

সুরথ চাটুজ্জে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান দেবেন গায়েনের প্রতিপক্ষ দলের নেতা। অনিরুদ্ধ জানে এই দু’জনের মধ্যে রয়েছে প্রবল রেষারেষি। সুরথের আছে দলের জোর, দেবেনের আছে টাকার জোর। কিন্তু অনিরুদ্ধর দরকার এমন টাকার জোরকে, যা দিয়ে সে স্কুলের মাঠ, স্কুল ফুটবল দল এবং কুড়োনকে তৈরি করার কাজ শুরু করতে পারবে।

দেবেন গায়েনের মুখভাবটা দেখে নিয়ে অনিরুদ্ধ বলল, ”আপনি ভাল করে আমার কথাটা বোধ হয় শোনেননি। আমি বললুম এমন একজনের কথা যিনি খেলাধুলা প্রসারের জন্য ইচ্ছে করলেই তুড়ি মেরে…।” অনিরুদ্ধ থেমে গেল।

বাইরের দু’জনের একজন তখন বলল, ”এমন লোক তো একজনই আছে এ তল্লাটে, দেবেনবাবু।” বলেই লোকটি হেঁ হেঁ করে হাসল।

অন্যজন বলল, ”বটেই তো!”

অনিরুদ্ধ মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করল লোক দুটির প্রতি। দেবেনকে ভজাবার কাজটা ওই দু’জন অনেকটা এগিয়ে দিল। খুশিতে আপ্লুত দেবেন বলল, ”বলো আমায় কী করতে হবে।”

”আপনাকে পুরস্কার দিতে হবে।” অনিরুদ্ধ এবার তার ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করল। ”বললুম না টিভি সিরিয়ালে একটা ফাইনাল খেলা হবে, সেই খেলার পর তো পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপার আছে। আপনাকে ছাড়া আর কারুর কথা আমি ভাবতে পারছি না।”

”মানে আমাকে টিভি—তে দেখা যাবে! আমি ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছ না! শুনলে তো তোমরা, অতবড় গোলকিপার বলল আমি ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছে না। তখন কী যেন বললে, স্কুলের মাঠটায় মাটি ফেলতে হবে? কবে দরকার? চন্দনপুরে রাস্তা তৈরির জন্য মাটি কাটার কাজ চলছে, কালই দু’ লরি মাটি স্কুলের মাঠে ফেলিয়ে দেব। তোমার সিরিয়ালের ফুটবল ম্যাচটা কবে? দু’দিন আগে আমায় বোলো, আমি শিমুলহাটির মোড়ে মোড়ে পোস্টার লাগিয়ে দেব। টিভি সিরিয়ালের শুটিং বলে কথা!”

অনিরুদ্ধ এতটা সফল হবে, ভাবেনি। এ তো ট্রাইব্রেকারে তিনটে কিক আটকে দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে গেল। ভরসা পেয়ে এবার সে বলল, ”ম্যাচটা কিন্তু হবে একতার মাঠে, ব্যবস্থাটা আপনাকে করে দিতে হবে।”

”ও নিয়ে ভাবতে হবে না, মাঠ তুমি পেয়ে যাবে। চা খাবে?”

অনিরুদ্ধ না বলতে গিয়েও বলল না। চা খেয়ে বেরিয়ে এসে সে আবার গেল হেডমাস্টার শিবেনবাবুর কাছে। তাকে সে কপিল ঘোষ ও দেবেন গায়েনের সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে, সবিস্তারে জানাল। শুনতে শুনতে শিবেনবাবু খুব হাসলেন। বললেন, ”কুড়োন দেখছি স্কুলের একটা সম্পদ হয়ে উঠল। ওকে ভাঙিয়ে এত যে কিছু করা হতে যাচ্ছে, তা কি ও জানে?”

”কিচ্ছু জানে না আর জানার দরকারও নেই। আপনি এবার স্কুলে একটা নোটিস দিন। স্কুল ফুটবল টিম গড়ার জন্য ট্রায়াল হবে, যারা ট্রায়ালে যোগ দিতে চায় তারা যেন সামনের রবিবার সকাল আটটায় স্কুলের মাঠে হাজির হয়ে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করে। আপনিও সার তখন কিন্তু থাকবেন, তা হলে ব্যাপারটা গুরুত্ব পাবে।”

”অবশ্যই থাকব। চাই কি তোমাকে সাহায্যও করতে পারি ট্রেনিংয়ে।” শিবেনবাবু এর পর হাসতে হাসতে বললেন, ”কলকাতায় এম.এ পড়ার সময় দু’ বছর ফুটবল খেলেছি ফার্স্ট ডিভিশনে চন্দ্র মেমোরিয়ালের হয়ে। তেমন কিছু ছিলাম না, কাগজে কখনও নাম ওঠেনি।”

শুনে অবাক হয়ে গেল অনিরুদ্ধ। এই খবরটা তো তার জানা ছিল না! তার সময়ে ফুটবলার শিক্ষক ছিলেন প্রতাপ চাটুজ্জে, তিনি ডিস্ট্রিক্ট টিমে খেলেছেন, তারপর এই আর একজন শিক্ষককে সে দেখছে।

”আপনি রোজ ভোরে দৌড়তে বেরোন, শরীরটাও রেখেছেন ফুটবলারের মতো, দেখে আমার বোঝা উচিত ছিল একসময় খেলতেন। দেখেছি তো, খেলা ছাড়ার পর বেশিরভাগই আর ডিসিপ্লিনড থাকে না। থলথলে হয়ে যায়।”

শিবেনবাবু নিজের খেলার প্রসঙ্গে না গিয়ে অন্য কথা পাড়লেন।

”ভাবছি ইন্টার—ক্লাস ম্যাচ আবার শুরু করলে কেমন হয়!”

”মনে মনে আমি কিন্তু ওটাই ভেবে রেখেছি। মুশকিল হল, অফিস থেকে ফিরতে ছ’টা—সাড়ে ছ’টা হয়ে যায়। আমার পক্ষে তো ছুটির দিন ছাড়া সাহায্য করা সম্ভব হবে না।”

”ঠিক আছে, আমিই শুরু করে দেব, আগে মাটিটা পড়ুক।”

.

দু’দিন পরই স্কুলমাঠে মাটি পড়ল। দেবেন গায়েন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দু’ লরি মাটি মাঠের উঁচু—নীচু এবং গর্ত হয়ে যাওয়া জায়গাগুলোয় ফেলিয়ে সমানভাবে চারিয়ে দিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির হাতে টানা ভারী রোলার চালিয়ে সমান করে বলে দিল, ”এখন এর ওপর খেলাধুলো দাপাদাপি একদম বন্ধ। এখন আষাঢ় মাসের শেষ, বর্ষার জলে আগে মাটি বসুক ভাল করে, ঘাস গজাক, তারপর পুজোর পর খেলা যা করার করবে। ততদিন স্কুলের ফুটবল হবে একতার মাঠে।” তারপর হেডমাস্টারের ঘরে এসে বলল, ”আপনি ক্লাসে ক্লাসে নোটিস পাঠিয়ে জানিয়ে দিন খেলাধুলো তো দূরের কথা, মাঠে হাঁটাচলাও বন্ধ। মাঠটাকে আমি ইডেনের মাঠ করে ছাড়ব। স্কুলের ছেলেরা চিরকাল মনে রাখবে দেবেন গায়েনকে, খেলাধুলার প্রসারের জন্য একটা আসল কাজ করে দিয়ে গেছে!”

শিবেনবাবু দ্বিধাভরে বললেন, ”একতার মাঠে ফুটবল খেলা হবে কী করে, ওখানে তো ক্রিকেট খেলা হয়!”

দেবেন রেগে উঠে বলল চড়া স্বরে, ”ফুটবলটাকে তুলে দিল এই ক্রিকেট। আরে বাবা, বাঙালির প্রাণের খেলা হল ফুটবল, আর সেই ফুটবলকে গোল্লায় দিয়ে ক্রিকেট নিয়ে নাচানাচি, তাও কিনা একদিনের ক্রিকেট? একসময় একতার ফুটবল টিম ছিল, এখন নেই। তবু ফুটবল টিমটাকে কালীতলা ধরে রেখেছে, সে ওই বুড়ো হারাধন দত্তর জন্য আর দিপুর ট্রেনিং সেন্টারের জন্য। ক্রিকেটে আর টাকা ঢালব না আমি, আবার একতার ফুটবল টিম করব, অনিরুদ্ধ তুমি দায়িত্ব নেবে?”

হঠাৎ তার ঘাড়ে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধটা এসে যাওয়ায় অনিরুদ্ধ বিব্রত হয়ে পড়ল। দেবেন গায়েনকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেওয়ার আছে, তার মধ্যে একটা বড় কাজ তো সত্যি সত্যি করে দিল—স্কুলমাঠটাকে তৈরি করে দেওয়া। এবার ওটার নিয়মিত পরিচর্যা দরকার এবং তা করার সামর্থ্য স্কুলের নেই, ওটা দেবেন গায়েনকে দিয়েই করাতে হবে। তা ছাড়া সিরিয়ালের শুটিংয়ের জন্যও লোকটির সাহায্য দরকার। কুড়োনকে নিয়মিত খেলাতে হবে, সেজন্য একটা ক্লাব চাই। স্কুলে পড়ে না সুতরাং স্কুল টিমে খেলার প্রশ্নই নেই, কালীতলা স্পোর্টিংয়ে দিপুদা যতদিন আছে কুড়োন ওখানে জায়গা পাবে না, ওকে খেলাতে হবে একতা সঙ্ঘে।

অনিরুদ্ধ বলল, ”আপনি পাশে থাকলে যথাসাধ্য আমি করব।”

দেবেন আশ্বস্ত করে বলল, ”ব্যস ব্যস, তা হলেই হবে। আমি একতার জন্য জার্সি করে দেব, মোজা কিনে দেব, তাই পরে ছেলেরা এখানে—ওখানে টুর্নামেন্ট খেলবে, শিমুলহাটির নামটা লোকে জানবে। ক্রিকেট দেখার জন্য মাঠে সারাদিন লোক বসে থাকে না, তাদের কাজকম্মো আছে। ফুটবলই ক্লাবকে পপুলার করে। কালীতলা তো কোথাও খেলতে—টেলতে বিশেষ যায় না, টাকা কোথায় যে যাবে? হেডমাস্টারমশাই, অনিরুদ্ধ, আজ স্বীকার করছি ছেলেবেলায় আমার বিশেষ ইচ্ছে ছিল, জার্নাল সিং—এর মতো দাপুটে প্লেয়ার হব, ঠাণ্ডা করে দেব ফরওয়ার্ডদের, হল না ইচ্ছেপূরণ, সেটা এখন পূরণ করতে চাই।”

অনিরুদ্ধ ক্রমশ আবিষ্কার করছে এই লোকটির চরিত্রের অন্য আর—একটা দিক। মনে মনে সে দেবেনের পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য দুর্বলতাকে নিয়ে মজা পেয়েছে, লোকটিকে এতদিন ভেবেছে মোটা মাথার টাকাসর্বস্ব একটা ব্যবসায়ী। এবার সে সমীহ করতে শুরু করল।

কপিল ঘোষকে তিনদিন সময় দিয়েছিল অনিরুদ্ধ। সাতদিন পর সে অনিরুদ্ধকে তার ব্যাঙ্কের অফিসে টেলিফোন করে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে বলল, ”সোনার খাঁচার শুটিংয়ে খুব ব্যস্ত ছিলুম, সিরিয়ালটা এখন শেষের দিকে। আপনার কথামতো গেঞ্জি, চারটে বল, কুড়োনের বুট হয়ে যাবে। বলছিলুম কী, খেলবে তো স্কুলের ছোট ছোট ছেলে, ওদের তো ছোট গোলপোস্ট আর বার হলেই চলে যাবে, বড় ফুল সাইজ গোলের কি দরকার আছে?”

অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বলল, ”আছে। এখনকার স্কুলের ছেলেদের চেহারা কেমন জানেন কি? তাদের হাইট কত জানেন কি? আমার ভাগ্নে এইটে পড়ে, গোলকিপার হতে চায়। ও লাফিয়ে আট ফুট উঁচু বারে হাত লাগায়। শুনুন কপিলবাবু, গোলপোস্টের সাইজ এক ইঞ্চিও কমানো যাবে না, আট ফুট বাই চব্বিশ ফুট রাখতেই হবে। খরচ বাঁচানোর কথা চিন্তা করলে চলবে না। তা করলে কিন্তু কুড়োনের বদলে জুড়োন!”

”না না না, ফুলসাইজ গোলেই হবে, আপনি মেপে নেবেনে। রবিবার সকালে লোহার টিউব আর বল নিয়ে লোক যাবে। আপনি থাকবেন তো?”

”অবশ্যই থাকব।”

রবিবার সকালে স্কুলমাঠের দু’দিকে গোলপোস্টের মাথায় ক্রসবার বসানোর কাজ ভিড় করে দেখল স্কুলের বহু ছেলের সঙ্গে শিবেনবাবু ও অনিরুদ্ধ। ছেলেরা অবশ্য এসেছিল স্কুল টিম গড়ার জন্য ট্রায়ালের নোটিস পেয়ে। আট থেকে বারো ক্লাস পর্যন্ত ছাত্রদের থেকে এসেছে চল্লিশজন। তাদের মধ্যে রয়েছে কালীতলার দীপকের কাছে কোচিং নিচ্ছে এমন পাঁচজন—শুভেন্দু, দেবু, জ্যোতি, শ্যামল আর অলু।

অনিরুদ্ধ সবাইকেই সোমবার সকাল ছ’টায় একতার মাঠে আসতে বলল। প্রথমে দুটো দলে ভাগ করে তাদের খেলাবে এবং তখনই বুঝে নেবে কাদের বাদ দিয়ে কাদের রাখবে। কুড়িটা ছেলে বেছে নিয়ে সে সকালে প্রাথমিক স্কিলগুলো, যা কলকাতার সুপার ডিভিশনের বেশিরভাগ ফুটবলারের আয়ত্তে ঠিকমতো নেই, সেইগুলোর অনুশীলন করাবে। শিবেনবাবু বলেছেন বিকেলে তিনি দল করে খেলাবেন এবং কীভাবে খেলতে হবে সেটা বলে দেবেন। সকাল—বিকেল দু’ বেলাই কুড়োন থাকবে ছাত্রদের সঙ্গে।

এই শেষের কথাটা শুনে ইলেভেন ক্লাসের শুভেন্দুর মুখ থমথমে হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে পাশে দাঁড়ানো দেবু আর জ্যোতিকে কী যেন বলল। তারপর অনিরুদ্ধকে জানাল, ”আমি সকালে আসতে পারব না, আমায় ট্রেনিং নিতে যেতে হবে দিপুদার কাছে। তা ছাড়া বিকেলে আসতে হলে ওর পারমিশান নিতে হবে।”

একই কথা বলল দেবু জ্যোতি শ্যামল, চুপ করে রইল অলু। অনিরুদ্ধ বলল, ”ঠিক আছে, সকালে দিপুদার কাছেই কোচিং নিও, কিন্তু বিকেলে দল করে খেলাটা হবে স্কুলটিম গড়ার জন্য। এখানে স্কুলের ছাত্র হিসেবে তোমাদের থাকাটা দরকার, বোঝাপড়াটা নয়তো গড়ে উঠবে কী করে?”

দেবু চোখ পিটপিট করে বলল, ”আচ্ছা অনিদা, ট্রেনিং তো হবে স্কুলটিম গড়ার জন্য, তা হলে কুড়োন কেন এতে থাকবে?”

অনিরুদ্ধ তাকাল শিবেনবাবুর দিকে। তিনি একবার ভ্রূ কুঁচকে তারপর মুখে হাসি এনে সহজ গলায় বললেন, ”সবাই তো আর দু’বেলাই আসতে পারবে না, লোক ঠিকই কম পড়বে, তখন ওকে সাহায্যের জন্য দরকার হবে ভেবে আমি রেখেছি। এতে কি তোমার আপত্তি আছে?”

শুনে দেবু ঢোক গিলল। ‘আমি রেখেছি’ শব্দ দুটো যথেষ্ট ভয়ঙ্কর মনে হল তার কাছে। আর ক’মাস পরে টেস্ট পরীক্ষা, আটকে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা ইংরেজি আর লাইফ সায়ান্সে। সে আমতা—আমতা করে বলল, ”না সার, আপত্তি কেন হবে, কুড়োন খেলুক না আমাদের সঙ্গে, ভালই তো খেলে।”

সোমবার ঠিক ছ’টায় একতার মাঠ ভরে গেল ছাত্রদের ভিড়ে। ন’জনের দল করে পনেরো মিনিটের দুটি ম্যাচ খেলা হল। অলু বাদে দিপুদার কোচিংয়ের কেউ আসেনি। অনিরুদ্ধ আর শিবেনবাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করে নেন, ছেলেদের কাছে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা তারা আশা করবেন না শুধু দেখবেন ফুটবল—বোধ কতটা রয়েছে আর শরীরটা কেমন। তাঁরা মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা শুধু দেখে গেলেন। দেখেই বুঝে গেলেন অর্ধেকের বেশিকে বাদ দেওয়া যায়।

কুড়িজনকে শিবেনবাবু বলে দিলেন, ”কাল ভোর পাঁচটায় এই মাঠে আসবে, আমার সঙ্গে তোমরা দৌড়বে, শিমুলহাটি, মোটাবেড়িয়া পেরিয়ে চাঁদা নদীর পোল পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসব। তারপর ব্যায়াম, তারপর বেসিক স্কিলের ট্রেনিং করাবেন অনিদা। সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় বসে যাবে। যারা রেগুলার আসবে না তারা কিন্তু বাদ যাবে।”

যারা বাদ গেল তাদের তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ”তোমরা নিশ্চয় চাও স্কুলের টিমটা ভাল হোক। তোমাদের থেকে ওরা একটু এগিয়ে রয়েছে তাই ওদের আসতে বললুম। ভেবো না তোমরা একেবারে বাদ গেলে, রোজ আসবে, দেখবে, দরকার হলে মাঠেও নামবে। কাল তোমরাও দৌড়তে আসবে, ব্যায়ামও করবে একসঙ্গে, এটায় কিন্তু কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।”

ছাত্রদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কুড়োন সব শুনছিল। অনিরুদ্ধ আর অলু যখন বাড়ি ফিরছে, কুড়োন তাদের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ”মামা, আমারে তো হেডমাস্টারমশায় আসতে কইলেন না!”

”হেডমাস্টারমশাই বললেন না স্কুলের টিম করার জন্য এই ট্রেনিং হবে। স্কুলটিমে তো ছাত্ররাই খেলবে, তুই তো ছাত্র নোস।”

কুড়োনের মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল। মিনিটখানেক পর সে বলল, ”মামা, আমি যদি ছাত্তর হই তাইলে আমারে নেবে?”

”হ্যাঁ নেবে।”

”তাইলে আমারে ছাত্তর কইরা লন।”

এবার অলু বলল, ”তুই ছাত্র হবি কী, অ আ ক খ—ই তো জানিস না।”

গম্ভীর মুখে কুড়োন বলল, ”জানি না তো কী হইছে, পেরাকটিস করলাই তো শিখা লওয়া যায়।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”তা হলে পেরাকটিস শুরু কর।”

আর কথা না বলে কুড়োন পাশের রাস্তা ধরে হনহনিয়ে চলে গেল। মামা—ভাগ্নে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে উঠল।

পরের দিন একঝাঁক ছেলে নিয়ে শিবেনবাবু দৌড় শুরু করলেন। মোচাবেড়িয়া পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ ভাল, তারপরই খানাখন্দ আর ভাঙা ইট রাস্তাটাকে চাঁদানদীর কাঠের পোল পর্যন্ত দৌড়বার পক্ষে যন্ত্রণাকর করে রাখায় ওরা পোল পর্যন্ত গেল না। ফিরে আসার সময় কালীতলার মাঠের পাশ দিয়ে যখন আসছে তখন জনা পনেরো ছেলে কালীতলার মাঠটাকে পাক দিয়ে জগ করছিল। দীপক মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে। স্কুলের অত ছেলেকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল।

দেবু বলল, ”ওদের সঙ্গে দেখছি কুড়োনটাও রয়েছে।”

দীপক চেঁচিয়ে বলল, ”দাঁড়ালি কেন, ছোট ছোট। কুড়ি পাক এখনও হয়নি।”

জ্যোতি চাপা গলায় গজগজ করল, ”কলুর বলদের মতো রোজ মাঠে একঘেয়ে পাক দেওয়া, ভাল্লাগে না।”

ব্যায়াম করার পর অনিরুদ্ধ বল বায়ে রেখে কী ভাবে দৌড়তে হয় দেখাল। সবার থেকে ভালভাবে করে দেখাল কুড়োন। শিবেনবাবু এজন্য সবার সামনে ওকে প্রশংসা করলেন না। শুধু বললেন, ”ঠিক আছে।”

এর পর অনিরুদ্ধ বলল, ”এবার তোমাদের খেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলব—পাসিং আর রিসিভিং। তোমার টিভি—তে নিশ্চয় দেখেছ বড় বড় টিম চমৎকার মুভ করে গোলের দিকে এগোচ্ছে, খুব ভাল জায়গায় দাঁড়ানো প্লেয়ারকে বল দিল কিন্তু এমন বাজে ভাবে যে, সেই প্লেয়ার বলটার নাগাল পেল না, ফলে খেটেখুটে তৈরি করা মুভটাই মাটি হয়ে গেল। আবার উলটোভাবে, কেউ একজন দারুণ সুন্দর একটা পাস দিল, যেটা ধরে গোল করা যায়, কিন্তু পাসটা যাকে দেওয়া হল সে ভাল করে বাগে রাখতে পারল না পা থেকে বেরিয়ে গেল, ফলে একটা গোলের মোক্ষম সুযোগ নষ্ট হল। পাস দেওয়া আর নেওয়া শুনলে মনে হয় খুব সাধারণ ব্যাপার কিন্তু মোটেই তা নয়। পৃথিবীর বড় বড় প্লেয়াররা রোজ এই দুটো প্র্যাকটিস করে শান দিয়ে রাখে।” ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে ফেলল অনিরুদ্ধ। লক্ষ করল ছেলেরা গভীর মনোযোগে শুনল। সে একটি ছেলেকে ডেকে বলল, ”আমি পাস দিচ্ছি, তুমি পা দিয়ে ধরো। সবাই লক্ষ করো।”

এইভাবে শুরু হল স্বামী স্বরূপানন্দ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দল গড়ার কাজ, তাদের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য। অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরে শুনল কপিল ঘোষ ফোন করেছিল এবং ফোন নম্বর দিয়ে বলেছে ন’টার মধ্যে তাকে ফোন করতে। অনিরুদ্ধ তখনই ফোন করল। অন্যপ্রান্তে কপিল ঘোষ বলল, ”আমি রেডি, আপনি কি রেডি? মানে দুটো টিম, প্রাইজ, মাইক, সভাপতি ইত্যাদি আর কুড়োন এই সব।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”সব ঠিক আছে, শুধু চব্বিশ ঘণ্টা আগে বলবেন।”

কপিল ঘোষ বলল, ”সামনের শনিবার দুপুরে শুটিং করব। চারদিন আগে জানালুম। গেঞ্জিগুলো তখনই নিয়ে যাব আর কুড়োনের জন্য বুটও, আপনি চিন্তা করবেন না। কুড়োনের একটা—দুটো ডায়লগ থাকবে, বলতে পারবে তো?”

”হ। পারবে।”

”হ, মানে?” কপিল ঘোষ থমকে গেল।

”হ, মানে হ্যাঁ, এটাই কুড়োনের ডায়লগ।”

টিভি সিরিয়ালের জন্য দুটো টিম করার মতো চোদ্দটা ছেলে স্কুল থেকে পাওয়া যাবে না অনিরুদ্ধ সেটা বুঝে গেছে। তাকে কালীতলা স্পোর্টিংয়ের কাছ থেকে কয়েকজন ফুটবলার চাইতেই হবে। সকালে সে কালীতলার মাঠে গিয়ে দীপকের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।

”দিপুদা, এটা স্কুলকে সাহায্য করার জন্য বলছি।”

”অবশ্যই সাহায্য করব।” দীপক উদার ভঙ্গিতে দু’হাত ছড়িয়ে বলল। সে জানে টিভি মানে তার ট্রেনিং সেন্টারের বিরাট পাবলিসিটি, আরও ছেলে পাওয়া যাবে। তার মানে আরও টাকা। ”তুই চোদ্দটা ছেলেই আমার এখান থেকে নিতে পারিস।”

”না, না, তার দরকার হবে না। এটা তো একটা সাজানো ম্যাচ টিভি শুটিংয়ের জন্য খেলা হবে। তুমি বরং হোম টিমের কোচ হও।” দীপকের মুখ দেখে অনিরুদ্ধ বুঝল খুশি হয়েছে।

”হ্যাঁ রে অনি, তোদের কোচিং তো শুধু স্কুলের ছেলেদের জন্য, তা হলে ওই কুড়োন ছেলেটা কী করে কোচিং নিচ্ছে?”

”ওটা হেডমাস্টারমশাইয়ের নিজস্ব ব্যাপার, স্কুল কর্মচারীর নাতি বলে কুড়োনকে উনি ছাত্রদের সঙ্গে রেখেছেন।”

এর পর অনিরুদ্ধ দেখা করল দেবেন গায়েনের সঙ্গে। মাঠে গণ্যমান্যদের বসার জন্য বাড়ি থেকে তিনি সোফা পাঠাবেন এবং দর্শক জড়ো করার জন্য সাইকেল রিকশায় মাইক দিয়ে প্রচার চালাবেন বলে কথা দিলেন এবং মনে করিয়ে দিলেন ক্যামেরা বসাবার জন্য মাঠের দু’ ধারে আর গোলপোস্টের পেছনে মাচা তৈরি করা দরকার। ইটাখালি স্কুলে পড়ান সি আর এ রেফারি হর্ষ গুহ, তাঁকে খবর দেওয়া হল। গুপ্ত ব্রাদার্স জানাল শিল্ড ও কাপ শুটিংয়ের আগেই পৌঁছে যাবে। অনিরুদ্ধর বড় কাজ এখনও বাকি, খেলোয়াড়দের শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করে রাখা। পরদিন সকালে সে অলু আর কুড়োনকে মাঠের একধারে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে বলল, একটা দল তিন গোলে হারছে তাদের একজনের বদলি প্লেয়ার হয়ে যখন কুড়োন নামবে, তখন খেলা শেষ হতে দশ মিনিট বাকি, তারপর দশ মিনিটে কুড়োন চারটে গোল দিয়ে তার দলকে জেতাবে। এই হল ঘটনা, এরই ওপর ভিত্তি করে খেলাটা হবে। অলুকে বলল, ”তোকে কিন্তু চারটে গোল খেতে হবে।”

শুনেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল অলুর মুখও, ”না মামা, না। অত গোল খেলে স্কুলে আমায় আওয়াজ দেবে।”

কুড়োন সহানুভূতির স্বরে বলল, ”চারটা গোল খাওয়ার মতো গোলকিপার অলু নয়, একটা কমায়ে দেন মামা।”

অলু প্রায় আঁতকে উঠল। ”তিনটে? না না, আমাকে বরং তুমি বাদ দাও।”

অনিরুদ্ধ বোঝাতে লাগল, ”আরে বোকা এটা সাজানো খেলা সবাই তা জানে, এ ম্যাচে গোল খেলে তোর সম্মান নষ্ট হবে না। কত ভাল সৎ লোক সিনেমায় ভিলেনের পার্টে দারুণ অভিনয় করে অ্যাওয়ার্ড পায়। তুইও অভিনয় করে গোল খাবি।”

কুড়োন বলল, ”মামা দুটো প্লান্টি বসায়ে দেন, আমি মারব অলু দুডাই আটকাবে, অর সম্মান তাইলে বাড়বে।”

শেষমেষ স্থির হল অলু চার গোলই খাবে তবে কুড়োনকে সবার কাছে স্বীকার করতে হবে অলু অভিনয় করেছে, নয়তো ওকে গোল দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই।

”হ, ঠিক কথাই তো। অলুরে চাইর গোল মারা কি সোজা কথা, আমার দ্বারা কি সম্বব।”

অনিরুদ্ধর একটা বড় সমস্যা মিটল। সে জানে দু—তিনজনকে কাটানোটা কুড়োনের কাছে জলভাত। সুতরাং আর কাউকে আলগা খেলার জন্য কিছু না বললেও হবে। কপিল ঘোষ ছবি তুলে তার দরকারমতো কাটছাঁট করে সাজিয়ে নেবে। মোদ্দা কথা, এই খেলাটার উদ্দেশ্য হচ্ছে কুড়োনের কেরামতি দেখানো।

”চল, তোরে পেরাকটিস করাই।” অলুর পিঠে ঠেলা দিল কুড়োন।

ছেলেরা গোলে বল মারা, পাসিং ট্র্যাপিং—এ ব্যস্ত ছিল। গোলকিপার গোল ছেড়ে দিল, ছেলেরা সরে এল গোলের সামনে থেকে। অলু গোলে দাঁড়াল, আঠারো গজ দূরে বল বসালো কুড়োন। জোরে শট নিল সোজা অলুকে লক্ষ্য করে, বলটা বুকের কাছে সে ধরল, দুই তালুতে আটকে রইল আঠার মতো। বলটা ফিরিয়ে দিল। কুড়োন এবার ডান পায়ে অলুর পাঁচ হাত বাঁ দিকে জমি ঘেঁষে বল মারল। অলু ঝাঁপিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল বলটা। সাফল্যে উত্তেজিত মুখে সে হাসি নিয়ে বলল, ”ঠিক করে মার।”

এবার কুড়োন ডান পায়ের পাতার বাইরে দিয়ে মারল। গোলের মাঝে দাঁড়ানো অলুর মুখের চার হাত সামনে এসে ডান দিকে বলটা বেঁকে গোলে ঢুকে গেল।

”কী হল! ধরলি না ক্যান, ঠিক কইরা মারা হয় নাই?” নিরীহ মুখে কুড়োন জিজ্ঞেস করল।

অলু মুখ লাল করে ঠোঁট কামড়ে বলল, ”আবার মার।”

সে কুঁজো হয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। এবারের শটটা একই ভাবে এল, তবে বেঁকে গেল অলুর বাঁ দিকে এবং সে অপ্রস্তুত মুখে বলের গোলে ঢোকা দেখল। এক পর কুড়োন বলটা বাঁ পায়ের পাতায় তুলে দু’বার নাচিয়ে মাথার চার হাত ওপরে তুলে দিয়েই চিৎ হয়ে মাটিতে পড়তে পড়তে বাইসাইকল কিক নিল।

বলটা ক্রসবারে লাগল, বল বারে ধাক্কা খেয়ে মাঠে ফিরে আসছে, কুড়োন স্প্রিংয়ের মতো জমি থেকে লাফিয়ে উঠে বলটাকে বুক দিয়ে থামাল। বল জমিতে পড়ার আগেই সে ভলি মারল, অলুর মাথার পাশ দিয়ে বল গোলে ঢুকল।

অনিরুদ্ধ অস্ফুটে ”শাবাশ” বলেই দৌড়ে গেল কুড়োনের কাছে, জড়িয়ে ধরে বলল, ”তুই এসব শিখলি কখন?”

”আপনি য্যামনটা দেখায়ে দিছেন সেইভাবে রোজ বিকালে পেরাকটিস কইরে গেছি দেয়ালে মাইরে মাইরে।”

”দেয়ালে মেরে কেন? মাঠে এসে তো সবার সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে পারিস।”

”এতগুলান ছেলে, একা একা মারনের জন্যি বলই তো পাওয়া যায় না।”

”বলটা তুই পেলি কোথায়?”

”ভবাদা দেছে। মাস্টারমশায়েদের বসার ঘরে আলমারির মাথা থিকে একদিন পুরনো খাতা নামাইতে গিয়া ভবাদা বলটা পাইছিল।” কথা শেষ করেই কুড়োন ব্যস্ত হয়ে অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, ”মামা বাজে কয়ডা?”

ঘড়ি দেখে অনিরুদ্ধ বলল, ”পৌনে সাতটা।”

”ইঃ, লেট হইয়া গেল।” বলেই কুড়োন ছুট দিল।

অনিরুদ্ধ একটু অবাক হল ওকে এভাবে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে দেখে। অলুকে বলল, ”গেল কোথায় বল তো? ও তো সবাই চলে গেলেও একা একা বল নিয়ে ছোটাছুটি করে!” তারপর বলল, ”কুড়োনের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে তোকে কেন বলেছিলাম এবার সেটা বুঝতে পারলি তো? যে গোলগুলো দিল তাতে আমারও অবস্থা তোর মতো হত, তোর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”

অলু শুকনো হেসে বলল, ”আমাকে আর অভিনয় করে গোল খেতে হবে না।”

বিকেলে শিবেনবাবু ম্যাচটা কীভাবে খেলা হবে শুভেন্দু, জ্যোতিদের তা বুঝিয়ে দিলেন। শেষ দশ মিনিটে কুড়োন চারটে গোল দেবে শুনে ওরা চোখ আর ভুরু কোঁচকাল, কিন্তু অলুর মতো আপত্তি তুলল না। শুধু বলল, ”ঠিক আছে।”

শনিবার এসে গেল।

সকাল থেকে শিমুলহাটিতে সাজ—সাজ রব। উৎসাহ বেশি মেয়েদের। টিভি সিরিয়ালে যদি একঝলক নিজের মুখ দেখানো যায় এই আশায় দলে দলে বাচ্চচা—বুড়ো একতা সঙ্ঘের মাঠের দিকে রওনা হল দুপুর হতে—না—হতেই। দুটো মোটরগাড়িতে কপিল ঘোষ কয়েকজন লোক, ক্যামেরা যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির। তারা মাঠ আর মাচাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল। ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে বা বসিয়ে কোথা থেকে এবং কীভাবে ছবি তুলবে, নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করতে লাগল।

টেবলে রাখা গুপ্ত ব্রাদার্সের পাঠানো দুটো ট্রফির সঙ্গে ধীরেশ্বরের দেওয়া ছোট্ট দুটো কাপও। সে নিজে থেকেই পকেটে করে এনেছে। তার পাশে রয়েছে কিছু তোয়ালে আর নাইলনের ব্যাগ। দেবেন গায়েন এগুলো নিজে বুদ্ধি করে বাজার থেকে কিনে আনিয়েছে। অনিরুদ্ধ মাথা চুলকে বলল, ”এসব তো আমার মনে ছিল না।” দেবেন মুচকি হেসে বলল, ”প্রাইজ দিতে কত জায়গায় তো যেতে হয়, দেখেছি তো!”

একতা সঙ্ঘের ক্লাবঘরে ছেলেরা ড্রেস করে মাঠে নেমে গোলে বল মারছে। তখন দেবেন গায়েন ডাকল অনিরুদ্ধকে। ”প্লেয়ারদের ইনট্রোডিউস করাবে না সভাপতির সঙ্গে?”

”নিশ্চয় করাব।” বলেই অনিরুদ্ধ ছুটে গেল কপিল ঘোষের দিকে।

মাঠের মাঝে রেফারি ও লাইন্সম্যানদের সঙ্গে খেলোয়াড়রা লাইন দিয়ে দাঁড়াল। গরদের পাঞ্জাবি আর পাট করা মটকার চাদর কাঁধে রাখা দেবেন গায়েন প্রত্যেকের সঙ্গে শেকহ্যান্ড করল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে।

অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে কপিল ঘোষকে বলল, ”এটা কিন্তু ভাল করে দেখাবেন।”

”হ্যাঁ, পাঁচ সেকেন্ড।”

পুরস্কারের টেবলের পাশে মাইক্রোফোন। তাতে অনিরুদ্ধর লিখে দেওয়া কাগজ দেখে বলে চলেছে ধীরেশ্বর, ”দু’ সপ্তাহব্যাপী স্বরূপানন্দ ফুটবল চ্যালেঞ্জ শিল্ড প্রতিযোগিতার আজ শেষ দিন। ফাইনালে খেলছে শিমুলহাটির বালক সঙ্ঘ—সবুজ গেঞ্জি, আর কলকাতার সেভেন বুলেটস—লাল গেঞ্জি। খেলার পর পুরস্কার বিতরণ করবেন প্রখ্যাত ক্রীড়াপ্রেমী শ্রী দেবেন গায়েন, প্রধান অতিথি অতীত দিনের বিখ্যাত গোলকিপার…।”

সোফায় বসে দেবেন গায়েনের দু’পাশে শিবেনবাবু আর বৃদ্ধ হারাধন দত্ত। ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে মাঠের মধ্যে একজন, আর একজন তিনপায়া স্ট্যান্ডে ক্যামেরা বসিয়ে গোলের পেছনের মাচায়। টস করে কিক—অফ হল। মাঠের মধ্যে যে ক্যামেরাম্যান ছিল সে এইবার মাঠের ধারে সরে এসে ছবি তুলতে লাগল। মাচার লোকটিও ক্যামেরা চালিয়ে দিল। দ্রুত ওঠানামা করতে লাগল বল, চারটে ফাউলও হয়ে গেল এবং প্ল্যানমতো লাল গেঞ্জির দেবু পাঁচ মিনেটেই প্রথম গোলটা তিরিশ গজের উঁচু শটে দিয়ে দিল। গোলকিপার মিলন বারপোস্টে হতাশায় মাথা ঠুকে কিছু দর্শকের সহানুভূতি আদায় করল। জনা চারেকের সঙ্গে দু’ হাত তুলে দেবুর হাই ফাইভ করা ক্যামেরা ধরে রাখল।

দ্বিতীয় গোলটি করল শুভেন্দু পেনাল্টি থেকে। ব্যাক খেলছে যে দু’ হাত দিয়ে বলটা মাথার ওপর ধরে নেয়। কিক নেওয়ার আগে চোখের ইশারায় সে দেখায় ডান দিকে মারব। মিলন বাঁ দিকে ঝাঁপাল। দু’গোলে কলকাতার টিম এগিয়ে যেতে মাঠ জুড়ে উত্তেজনা। বিদ্রূপ আর ধিক্কার বর্ষণ শুরু হল শিমুলহাটির সবুজ গেঞ্জির ওপর।

”পাবলিক রিঅ্যাকশনটা দারুণ হচ্ছে। আমরা কথাবার্তা রেকর্ড করছি।” কপিল ঘোষ পাশে দাঁড়ানো অনিরুদ্ধকে বলল।

”আরও হবে, থার্ড গোলটা খাক।” অনিরুদ্ধ ঠোঁট টিপে বলল। ”ক্লাইম্যাক্সে ধাপে ধাপে উঠতে হবে তো।”

হাফ টাইমে দু’ গোলই রইল। দীপক হাত—পা নেড়ে প্লেয়ারদের নির্দেশ দিচ্ছে, সেটা ক্যামেরা—বন্দি হল। ইতিমধ্যে দু’ দলের একজন করে ইয়োলো কার্ড দেখে ফেলেছে। খেলা আবার শুরু হল।

”কুড়োন কখন নামবে?” কপিল ঘোষ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

”ব্যস্ত হচ্ছেন কেন।” অনিরুদ্ধ ঠাণ্ডা গলায় বলল, ”সাধন এর পর আর একটা ইয়োলো কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরোবে, সবুজ গেঞ্জির একটা ছেলে কমে যাবে। সাপোর্টররা তখন হতাশ হয়ে বলবে, ‘জেতার আর কোনও চান্স নেই। অবধারিত হার।’ ওই কোণে ক্যামেরা নিয়ে এখুনি চলে যান, দেখবেন কয়েকটা ছেলে কপাল চাপড়াবে, হতাশায় মাথা নাড়বে। দেখেননি গায়করা অভিনেতারা হলে লোক রাখে হাততালি দেওয়ার জন্য? সেইরকম আর কি।” অনিরুদ্ধ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্যামেরাকে কোথায় যেতে হবে। কপিল ঘোষ ছুটে গেল সেই দিকে।

তৃতীয় গোলটিও করল শুভেন্দু। বলটা তুলে মেরেছিল শ্যামল, ধরার বদলে মিলন চাপড়ে ফেলল শুভেন্দুর পায়ে, সে শুধু বলটা গোলের মধ্যে ঠেলে দিল। তিন গোলে শিমুলহাটি পিছিয়ে, জেতার আর কোনও আশা নেই।

ক্যামেরা দেবেন গায়েনের মুখের সামনে, পাশে টেপ রেকর্ডার। হাতের ঘড়ি দেখে সে পাশে বসা শিবেনবাবুর দিকে ঝুঁকে বলল, ”আর তো মাত্র বারো মিনিট বাকি। আপনার কি মনে হয়ে শিমুলহাটি পারবে শিল্ড জিততে?”

শিবেনবাবু বললেন, ”দেখুন না এখনও তো বারো মিনিট বাকি রয়েছে, ফুটবলে মিরাকল তো ঘটে থাকে।”

”কাট।” কপিল ঘোষ বলে উঠল।

এর ঠিক দু’ মিনিট পর শিমুলহাটির স্ট্রাইকার বাদল মাঝমাঠে বল ধরে বুলেটসের গোল লক্ষ্য করে দৌড় শুরু করতেই তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল নিমাই। বাদল হুমড়ি খেয়ে পড়ে একটু বেশিই ছটফটাতে লাগল। মাঠের মধ্যে ছুটে এল দীপক ও ক্যামেরাম্যান। দেখা গেল বাদলকে পাঁজাকোলা করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল আর তার বদলে মাঠে নামল কুড়োন।

বাদলকে ফাউল করার জন্য ফ্রিকিক পেয়েছে শিমুলহাটি। কুড়োন পেনাল্টি এলাকার ভেতরে গোল থেকে পনেরো গজ দূরে দাঁড়িয়ে, তার পাশে ও পেছনে দু’জন লাল জার্সি। অরুণের মারা ফ্রি কিকটা উঁচু হয়ে এসে পড়ছে কুড়োনের পাঁচ গজ সামনে, সে ছুটে গিয়ে পড়ন্ত বলটা বুক দিয়ে ধরেই পাশে একটু ঠেলে দিল। তারপর শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে জমির সঙ্গে শরীরটাকে প্রায় সমান্তরাল করে বাঁ পায়ে ভলি মেরেই জমিতে পড়ে গেল। অলুর বাড়ানো হাতের আঙুল ছুঁয়ে বল গোলে ঢুকল।

মাঠের চারধারে শাবাশ জানানো শব্দ উঠল। অনিরুদ্ধ কপিলকে বলল, ”গোলটা অসাধারণ, শটটায় কী কন্ট্রোল ছিল দেখলেন? আর কী বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে গিয়ে মারল!”

কপিল ঘোষ বিজ্ঞের মতো বলল, ”এটাই তো বড় প্লেয়ারের লক্ষণ। এটা আমি দু’বার দেখাব।”

সেন্টার হল। বলটা দুটো পা ঘুরে পেয়ে গেল বাদল। কুড়োনকে সে বাড়িয়ে দিল। বলটা না থামিয়ে সে অরুণকে ঠেলে দিয়েই ফাঁকা জমিতে ছুটে গেল। অরুণ পাসটা দিল কুড়োনের চার হাত সামনে। ছুটতে ছুটতেই সে শট নিল গোল লক্ষ্য করে। বলটা কলার মতো বাঁক নিয়ে বার আর পোস্টের কোণ ছুঁয়ে গোলে ঢুকল। অলু শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

দর্শকরা এবার বুঝেছে সত্যিকারের খেলা তারা দেখছে আর সেটা বুঝে এবার নাড়া খেয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। তিন—দুইটা যে তিন—তিন হয়ে যেতে পারে সেই আশায় তারা ”কুড়োন কুড়োন” বলে মাঠটাকে আকাশে তুলে দিল।

কুড়োন দু’ মিনিট পরই তিন—তিন করে দিল হেডে গোল দিয়ে। অরুণের কর্নার কিকটা রামধনুর মতো বেঁকে গোল এরিয়ায় নেমে আসছে। অলু বেরিয়ে এসে ধরবে কি ধরবে না ইতস্তত করল। কুড়োনের হাতটা ধরে আছে দেবু। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে হেড করতে লাফাল, বলটা মাথায় সবে ছুঁইয়েছে আর তখনই দেবু ওর পেটে ঘুসি মারল। দু’ হাতে পেট চেপে ধরে কুড়োন মাঠে গড়িয়ে পড়ল। ঘটনাটা দর্শকরা দেখতে পায়নি কিন্তু অনিরুদ্ধ আর দীপক ঠিকই দেখেছে।

একটা ভাল নাটক যেমন ধাপে ধাপে উত্তেজনার চুড়োয় ওঠে, কুড়োন মাঠে নামার পর থেকেই খেলাটা নাটকীয় ভাবে জমে উঠল। দীপকের সঙ্গে অনিরুদ্ধও মাঠে ছুটে এসেছে। অনিরুদ্ধ কুড়োনের পেটে মালিশ করতে করতে শুনল দীপক দাঁত কিড়মিড় করে দেবুকে বলছে, ”ফের যদি এইসব করিস তা হলে লাথি মেরে কালীতলা থেকে বার করে দেব। সারাজীবন তপস্যা করেও ওর মতো তো খেলতে পারবি না।” তারপর উদ্বেগ নিয়ে দীপক তাকাল কুড়োনের দিকে। ”খুব লেগেছে? আর একটা, যেমন করে হোক আর একটা, পারবি না?”

কুড়োন গেঞ্জিটা প্যান্টের মধ্যে গুঁজতে গুঁজতে বলল, ”হ। পারব।”

কুড়োনের ‘পারব’ যে কী ব্যাপার সেটা ম্যাচের শেষ মিনিটে দেখা গেল। তার আগে কপিল ঘোষ মরিয়ার মতো অনিরুদ্ধর মুখের কাছে হাত নেড়ে বলল, ”হ্যাঁ মশাই খুব তো টাকা খরচ করিয়ে দিলেন, ম্যাচটা এবার জিতুন।”

অনিরুদ্ধ মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল, ”এবার দেখুন ওদিকে।”

মাঝমাঠে কুড়োন একজনকে কাটিয়ে আর একজনকে টলিয়ে দিয়ে জমিতে ফেলে, তৃতীয়জনকে পেছনে রেখে শুভেন্দুর সামনে পৌঁছে গেছে। দু’ হাত পাশে ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে শুভেন্দু পা চালাল কুড়োনের গোড়ালি লক্ষ্য করে। চকিতে পা সরিয়ে কুড়োন বল নিয়ে শুভেন্দুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দেবু তেড়ে এল। কুড়োন শরীরটা ডাইনে—বাঁয়ে করে দেবুর দু’ পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে ওর পাশ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে আবার বলটা ধরল।

এবার শুভেন্দু যোগ দিল দেবুর সঙ্গে। কুড়োন সাহায্যকারীর আশায় দু’ ধারে তাকাল। সাত—আট গজ দূরে বাদল।

কবজি তুলে ঘড়ি দেখে দীপক অধৈর্য হয়ে অনিরুদ্ধকে বলল, ”কুড়োনটা করছে কী! আর তো তিরিশ পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড বাকি।”

”শোধ না নিয়ে ছাড়বে না।” অনুত্তেজিত গলায় বলল অনিরুদ্ধ।

বলটা বাদলের দিকে ঠেলেই কুড়োন দু’জনের মাঝ দিয়ে তিরবেগে ছুটে গেল। বাদল না থামিয়েই পাসটা সামনে বাড়িয়ে দিল। চলন্ত বলেই কুড়োন দ্বিতীয় গোলটার মতো শট নিল। অলু পায়ের ওপর ঝাঁপাবার জন্য এগিয়ে এসেছিল। শটটা তার মাথার উপর দিয়ে জালে আটকাল। গোলের বাঁশি বাজিয়ে রেফারি খেলা সমাপ্তির বাঁশিও বাজালেন।

”উফফফ, বুকে হাত দিয়ে দেখুন এখনও ধুকপুক করছে।” কপিল ঘোষ অনিরুদ্ধর হাতটা টেনে নিয়ে বুকে রাখল।

”আপনি যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন তো?”

কপিল ঘোষ শুধু একগাল হাসল। খেলোয়াড়রা বেরিয়ে আসছে। জনতা স্বতস্ফূর্তভাবে কুড়োনকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। ক্যামেরা ছবি তুলছে। মানুষজন ছুটে যাচ্ছে ট্রফি রাখা টেবলের দিকে।

বিজয়ী আর বিজিত দলের অধিনায়কদের হাতে শিল্ড ও কাপ তুলে দেওয়ার পর দেবেন গায়েন যখন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় কুড়োন মণ্ডলের নাম ঘোষণা করল তখন তুমুল হাততালি পড়ল।

কপিল ঘোষ অনিরুদ্ধকে কানে কানে বলল, ”কাপটা মাথার ওপর যখন তুলে ধরবে তখন যেন চোখ দিয়ে জল গড়ায়, এটা তো ওর জীবনের প্রথম প্রাইজ পাওয়া। যান যান, বলুন গিয়ে।”

ভিড় ঠেলে অনিরুদ্ধ যাওয়ার আগেই কুড়োনের হাতে কাপ এবং সেটি সে মাথার ওপর তুলে সবক’টি দাঁত বার করে হাসছে।

”চোখের জলের শটটা নেওয়া হল না। ঠিক আছে, লোকজন চলে গেলে পরে নিয়ে নিচ্ছি।”

কপিল ঘোষ নাছোড়বান্দা, চোখের জল তার চাইই। গল্পে আছে প্রথমবার হাতে ট্রফি পেয়ে বাচ্চচা নায়কের মনে পড়বে তার মৃত ফুটবল গুরুর কথা আর তখনই গাল বেয়ে নেমে আসবে চোখের জল। কিন্তু এই কুড়োন ছেলেটা চোখের জল বার করার বদলে কিনা দাঁত বার করল!

দেবেন গায়েন হাতছানি দিয়ে অনিরুদ্ধকে ডাকল, ”আমার তো একটা বক্তৃতা থাকা দরকার, নয়তো অনুষ্ঠানটা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে না, কী বলো?”

অনিরুদ্ধ দেখল ট্রফি বিতরণ শেষ হতেই লোকজনেরা মাঠ ফাঁকা করে চলে যাচ্ছে। মাচা থেকে ক্যামেরাম্যান শেষবারের মতো ঘরে ফেরা দর্শকদের শট নিচ্ছে। একদল ছেলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে নাচানাচি করে স্লোগান দিচ্ছে, ”জিতল কে…শিমুলহাটি আবার কে।” ”সেরা প্লেয়ার হল কে…কুড়োন মণ্ডল আবার কে।”

অনিরুদ্ধ চারধার দেখে দেবেন গায়েনকে বলল, ”প্রাইজ দেওয়ার আগে বক্তৃতা দিলে শোনার লোক পাওয়া যেত, এখন তো শোনার লোক বিশেষ নেই।”

দেবেন গায়েনও চারদিক দেখে বলল, ”তা হলে বক্তৃতা থাক। আচ্ছা অনিরুদ্ধ, তোমার ওই ডিরেক্টর বাদাম গাছটার নীচে কুড়োনের সঙ্গে কী কথা বলছে, সঙ্গে ক্যামেরাম্যানও রয়েছে! আলাদা ছবি টবি তুলছে নাকি?”

শিবেনবাবু আগাগোড়া চুপচাপ ছিলেন, এইবার মন্তব্য করলেন, ”প্রথমে ম্যাচটা সাজানো ছিল, পরে কিন্তু সত্যিকারের হয়ে গেল।”

হারাধন দত্ত লাঠি হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ”অনি, যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”

”করাই আছে হারুদা।” অনিরুদ্ধ হাতছানি দিয়ে অপেক্ষমাণ সাইকেল রিকশাটাকে কাছে আসতে বলল। তিনি রিকশায় উঠে বসতে প্রণাম করে অনিরুদ্ধ বলল, ”কেমন দেখলেন ছেলেটাকে?”

”তোকে আমি এই ছোট জায়গায় আটকে না রেখে ছেড়ে দিয়েছিলুম, না দিলে তুই বাড়তে পারতিস না। এই ছেলেটাকে এবার ছেড়ে দে, আরও কঠিন জায়গায় গিয়ে ও নিজেকে তুলে ধরুক। শুধু স্কিল দিয়েই বড় হওয়া যায় না, আরও অনেক কিছু জানতে বুঝতে শিখতে হয়।” হারাধন দত্ত থেমে থেমে কথা বলে রিকশাওলাকে তাড়া দিলেন, ”চল রে।”

অনিরুদ্ধ চলে যাওয়া রিকশার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল হারুদার কথাগুলো।

বাদামতলায় কুড়োন বিব্রত মুখে শিল্ডটা মাথার ওপর তুলে ধরে, ক্যামেরার চোখ তার মুখের দিকে তাকিয়ে, কপিল ঘোষ বলে যাচ্ছে, ”বার করো, চোখ দিয়ে জল বার করো। আহহ, এই সামান্য কাজটা তুমি করতে পারছ না।”

ক্যামেরাম্যান বলল, ”কপিলদা, চোখে গ্লিসারিন দিয়ে জল বার করান।”

”গ্লিসারিন দরকার হবে জানলে সঙ্গে করে আনতুম, এখন কোথায় পাই।” কপিল অসহায়ভাবে এপাশ—ওপাশ তাকিয়ে অনিরুদ্ধকে এগিয়ে আসতে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, ”এই যে মশাই, আপনার চেলার চোখ দিয়ে জল বার করান তো, জল আমার চাই। এই চোখের জলের মধ্য দিয়ে নায়কের দুঃখকষ্টের ছেলেবেলাটা বেরিয়ে আসবে দর্শকদের চোখের সামনে।”

অনিরুদ্ধ তাকাল কুড়োনের মুখের দিকে। তার মনে হল, ওর দ্বারা কান্না এখন সম্ভব নয়। তবু কপিল ঘোষকে খুশি করার জন্য বলল, ”কুড়োন পারবি না? দ্যাখ না চেষ্টা করে! মনে—মনে কষ্টের কথা দুঃখের কথা ভাবতে থাক।” এর পর সে কপিল ঘোষকে বলল হালকা অনুযোগের সুরে, ”আপনাকেও বলিহারি যাই, যে কাজটা অভিনেতার করার কথা সেটা কিনা একটা ফুটবলারকে করতে বলছেন? এইটুকু ছেলের পক্ষে কি বলামাত্র চোখের জল বার করা সম্ভব? দুঃখকষ্ট বোঝাতে হয়তো অন্যভাবে করে দেখান।”

আমতা আমতা করে কপিল ঘোষ বলল, ”ঠিক আছে, পরে ওকে স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে গ্লিসারিন দিয়ে টেক করব।” কুড়োনকে আর স্টুডিও নিয়ে যাওয়া হয়নি, কেননা গল্পটার ধাঁচ এর পর বদলে ফেলা হয়। বাতিল হয়ে যায় চোখের জল।

দলবল নিয়ে কপিল ঘোষ চলে যাওয়ার পর অনিরুদ্ধ আর কুড়োন বাড়ির পথ ধরল।

”হ্যাঁ রে কুড়োন, তুই কখনও কেঁদেছিস?”

প্রশ্নটা তাকে অবাক করলেও জবাব দিল সঙ্গে সঙ্গে। ”না মামা কেঁদেছি বলে তো মনে পড়ে না।”

”বাবা মারা যেতে, মা মারা যেতে, দাদু মারা যেতে কাঁদিসনি?”

”আরে তখন তো আমি অ্যাত্তোটুকু, মরা কী জিনিস তাই আমি বুঝি না, কান্না আসবে কী করে।”

”এখন বুঝিস?”

”না। এখন তো কেউ মরে নাই, মরলে বুঝতে পারব।”

অনিরুদ্ধ এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৌতূহল চাপতে না পেরে বলে ফেলল, ”ধর তোর বড়দাদু রাখাল যদি মারা যায় তা হলে কাঁদবি?”

শুনেই কুড়োন থমকে দাঁড়াল। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। কথা না বলে মাথা নিচু করে অনিরুদ্ধর পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।

.

সকালের ট্রেনিংয়ের মাঝে কুড়োন বহুদিনই জিজ্ঞেস করে ”মামা বাজে কয়টা?” অনিরুদ্ধ ঘড়ি দেখে যদি বলে ”পৌনে সাতটা”, কুড়োন তখন বলে, ”অহন চলি, দরকার আছে।”

ব্যাপার কী? অনিরুদ্ধ একদিন জিজ্ঞেস করেও ফেলল, ”তুই রোজ রোজ সাতটার আগেই চলে যাস কেন রে? কী এমন দরকার?”

কুড়োন সপ্রতিভভাবে জবাব দেয়, ”ঘরে গিয়া উনান ধরাতে হয়। ডাক্তার কইছে, ঠিক সাড়ে সাতটায় গরমজল দিয়া দাদুরে চান করাতে হবে। তাইতে বুক ভাল থাকবে।”

বুক ভাল থাকার এমন দাওয়াইয়ের কথা অনিরুদ্ধ জীবনে শোনেনি। লোকে কত কী যে বিশ্বাস করে এটাও হয়তো তাই, এই ভেবে সে কুড়োনকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

স্কুলের জন্য একটা ফুটবল টিম মোটামুটি দাঁড় করানো গেছে। এবার টিমটাকে পরীক্ষা করা দরকার। তিনটি রবিবারে স্বরূপানন্দ স্কুল তিনটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলল দুটি ক্লাব ও একটি স্কুলের সঙ্গে। খেলাগুলি হল দু—তিন মাইলের মধ্যে। দলের সঙ্গে গেছল অনিরুদ্ধ এবং একটি খেলায় যান শিবেনবাবুও। কুড়োনকে দলে রাখা হয়নি যেহেতু সে স্কুলছাত্র নয়, তবে দলের সঙ্গে সে গেছে। বহু বছর আগে রাখাল যে কাজটা করত, সেই খেলার বল, বালতি, গ্লাস, মেডিক্যাল বক্স ইত্যাদি বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ কুড়োন যেচে নিয়েছিল। ছেলেরা বাড়ি থেকে ড্রেস করে বেরোত। ওদের সঙ্গেই সে সবুজ গেঞ্জিটা পরে থলিটা পিঠে ঝুলিয়ে বাসে উঠত।

নলপুকুর সবুজসাথীর সঙ্গে ম্যাচটায় তারা দু’ গোলে হারে, কলাইখোলা প্রগতি সঙ্ঘকে তিন—দুই গোলে হারায়, শুধু চাঁদপানা হাই স্কুলের সঙ্গে খেলাটি শেষ মিনিটে ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় দাঁড়ায় একটা পেনাল্টিকে কেন্দ্র করে। ম্যাচ তখন প্রায় শেষ মিনিটে, কোনও গোল হয়নি। বল দুই প্রান্তে দ্রুত যাতায়াত করছে, যে—কোনও সময় যে—কোনও দল গোল খেয়ে যেতে পারে। উত্তেজনায় মাঠভরা দর্শকরা ফুটছে। এমন সময় স্বরূপানন্দর বিরুদ্ধে পেনাল্টি।

পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে বলে দুই পক্ষের খেলোয়াড়রা এলোমেলো শট নিতে নিতে চাঁদপানার একজন গোলে দ্রুত জোরে শট নেয়, দেবু ছিল পোস্ট ঘেঁষে গোললাইনে দাঁড়িয়ে, পা বাড়িয়ে বলটা আটকাতে গিয়ে বল তার কনুইয়ে লেগে ছিটকে গোললাইনের বাইরে যায়। রেফারি সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে পেনাল্টি স্পটের দিকে আঙুল দেখান।

শুরু হয়ে যায় তুলকালাম হট্টগোল। কিছু লোক মাঠে নেমে পড়ে রেফারিকে ঘিরে বলতে থাকে, ‘হ্যান্ডবলটা ইচ্ছে করে করেনি, এটা পেনাল্টি নয়।’ আর—এক দলের দাবি, রেফারি ঠিক কাজ করেছেন। কুড়োন তখন উন্মাদের মতো একটা প্লাস্টিকের গ্লাস হাতে ছুটে গেছল। ভিড়ের মধ্যে গ্লাসটা দিয়ে সে রেফারির কানের পাশে বেশ জোরেই মারে, রেফারি কান চেপে ধরে বসে পড়েন। ঘিরে ধরা জনতা থতমত হয়ে পিছিয়ে আসে। তারা ভাবেনি কেউ রেফারিকে মারবে। সেই ফাঁকে কুড়োন ভিড়ের মধ্য দিয়ে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসে। কেউ তাকে লক্ষ না করলেও শিবেনবাবুর নজর সে এড়াতে পারেনি।

রেফারির কানের পাশটা ফুলে ওঠায় বরফ ঘষা হল, শিবেনবাবু তাঁকে অনুরোধ করলেন পেনাল্টি সিদ্ধান্ত থেকে তিনি যেন সরে না আসেন। অলুকে বললেন গোলে গিয়ে দাঁড়াতে। মাঠের মধ্য থেকে লোকজন বেরিয়ে যেতে চাঁদপানা হাই স্কুলের ব্যাক পেনাল্টি শট নিয়ে গোল দেয়।

শিমুলহাটি ফেরার বাসে সামনের দিকে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিবেনবাবু। পেছনের দিকে ছিল কুড়োন এবং সাত—আটজন ছেলে। কেউই বসার জায়গা পায়নি। বাকি ছেলেরা কাছাকাছি থাকে, তাই বাসে ওঠেনি, হেঁটেই বাড়ি যাবে। বাসে সারাক্ষণ বকবক করে কুড়োন।

”ওটা কিছুতেই প্লান্টি ছিল না, দেবু তো ইচ্ছা করে বল আটকায় নাই, তাইলে কোন আইনে প্লান্টি দিল? এই দেবু কসনা তুই কি ইচ্ছা কইরা বলে হাত দিছিস?”

দেবু জবাব না দিয়ে ফিকে হাসল, শিবেনবাবু কুড়োনকে দেখার চেষ্টা করে ভিড়ের জন্য দেখতে পেলেন না।

কুড়োন কথা বলেই চলেছে। ”রেফারিটা ওইখানকার, চাঁদপানায় বাড়ি। নিঘঘাৎ ঘুস খাইছে।”

শিবেনবাবু গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠলেন, ”কুড়োন এবার চুপ কর।”

এর পর আর কুড়োনের গলা শোনা যায়নি। বাস থেকে নেমে ছেলেরা যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়, কুড়োন থলি—পিঠে শিবেনবাবুকে এড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে স্কুলের দিকে।

”কুড়োন শোন।” থমথমে মুখে শিবেনবাবু ডাকলেন। কুড়োন কাছে এল। ”এবার থেকে স্কুলের খেলা থাকলে তুই সঙ্গে যাবি না। রেফারিকে মারলি কেন? তোর ভাগ্যি ভাল কেউ তোকে গ্লাস দিয়ে মারতে দেখেনি, দেখলে গোটা টিম ওখানে মার খেত, আমিও খেতুম। ছি ছি ছি, স্কুলের বদনাম তো হতই, আমাদের টিমের সঙ্গেও আর কেউ খেলতে চাইত না, শুধু তোর জন্য।”

রাগে কাঁপছিলেন শিবেনবাবু। কুড়োন হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে।

”এরকম একটা অসভ্য ছেলে টিমের সঙ্গে থাকলে সেই টিম কখনও সুনাম পায় না। কেন মারলি রেফারিকে?”

কুড়োন চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলল, ”আমরা হাইরে যাব ভাবতেই মাথাটা কেমন যেন গরম হইয়ে গেল।”

”রেফারিকে মারলে কি জিতে যেতুম?”

কুড়োন চুপ রইল। শিবেনবাবু কয়েক সেকেন্ড উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে বললেন, ”যা বললাম, আর কখনও টিমের সঙ্গে যাবি না।”

কুড়োনের রেফারিকে মারার কথা শিবেনবাবু কাউকে বলেননি, এমনকী অনিরুদ্ধকেও নয়। শুধু ভবতোষকে বলেছেন, ”এবার থেকে তুমি যাবে খেলার থলিটা নিয়ে।”

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা সাবডিভিশনাল স্কুল ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশিপে স্বরূপানন্দ স্কুল খেলার জন্য নাম দেবে কিনা শিবেনবাবু জানতে চাইলেন অনিরুদ্ধর কাছে। সকালে ট্রেনিংয়ের পর ওরা বাড়ি ফিরছিল।

অনিরুদ্ধ বলল, ”না সার, স্বরূপানন্দ এখনও চ্যাম্পিয়ানশিপ খেলার মতো তৈরি হয়নি। যে তিনটে ফ্রেন্ডলি খেলল তারা খুব ভাল টিম নয়, আমরা একটামাত্র ম্যাচ জিতেছি, তাও অফসাইড থেকে উইনিং গোলটা দেয় শুভেন্দু। জেলায় অনেক স্কুলটিম আছে যারা আমাদের গোলের মালা পরিয়ে দিতে পারে। সমস্যাটা কী জানেন সার, অনেক স্কুল বাইরের ছেলে খেলায় যাদের বয়স অন্তত কুড়ি বছরের ওপর।”

শিবেনবাবু কৌতূহলী হলেন, ”কীভাবে খেলায়? বাইরের ছেলে মানে তো ছাত্র নয়!”

”হ্যাঁ, ছাত্র নয়। কিন্তু স্কুলের খাতায় ছাত্র হিসাবে নাম লেখানো আছে। থাকে হয়তো স্কুল থেকে দশ—পনেরো মাইল দূরে, কোনওদিন স্কুলেও আসে না কিন্তু খেলে স্কুলের হয়ে। এরা একটু বেশি বয়সীই হয়। এদের সঙ্গে যথার্থ ঠিক বয়সীরা পেরে উঠবে কী করে! তাই বলছিলুম প্রথমেই ধাক্কা খেয়ে বিশ্রী একটা অভিজ্ঞতা পেলে সেটার ফল ভাল নাও হতে পারে, বরং আর একটু তৈরি হয়ে মাঠে নামুক, আরও দু—চারটে ফ্রেন্ডলি খেলুক।”

”আমারও মনে হয়েছে ছেলেরা কাঁচা রয়েছে। তবে জলে ঠেলে না দিলে সাঁতারটা শিখবে কেমন করে, ভয়টা তো প্রথমে ভাঙানো চাই। এই দ্যাখো না কুড়োনকে, ভয়ডর বা জড়তা বলে কিছু নেই, অপোনেন্ট যেই হোক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব, সবসময় ওর এই মনোভাব। এটা একদিক দিয়ে ভাল।”

”ভাল কথা সার, কুড়োন কিন্তু বেশ কিছুদিন সকালে ট্রেনিংয়ে আসছে না! খেলাপাগল ছেলে, কখনও তো কামাই করেনি। অসুখবিসুখ করল কিনা… খোঁজ নিতে হবে।” অনিরুদ্ধকে চিন্তিত দেখাল।

বাড়ি ফেরার জন্য স্কুলের ফটকের সামনে দিয়ে অনিরুদ্ধকে আসতে হয়। প্রতিবারই সে ফটকের গরাদের ফাঁক দিয়ে স্কুল—মাঠটা দেখার জন্য দাঁড়ায়। দেবেন গায়েনের কথাটা এখন মনে পড়ে।—’মাঠটাকে আমি ইডেনের মাঠ করে ছাড়ব।’ মিথ্যে জাঁক করেনি দেবেন গায়েন, সবুজ মখমল যেন বিছিয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির বারান্দা থেকে অনিরুদ্ধ অনেকদিন শুনেছে কেউ মাঠের ধার দিয়ে হাঁটলেও রাখাল চিৎকার করে, ”হেই গোরু মাঠে নামছিস ক্যান, ঘাস খাবি বলে?” বুট পরে ছোটাছুটির ধকল নেওয়ার মতো জোর ঘাসগুলোর এখনও হয়নি, গোড়াগুলো আরও একটু চেপে বসা দরকার।

অনিরুদ্ধ মুগ্ধ হয়ে মাঠটা দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল স্কুলের টানা দাওয়ায় একটা ক্লাসঘরের বাইরে দরজার পাশে কুড়োন বসে। হাতে খাতা আর ডটপেন, পাশে একটা কী দুটো বই। মাথাটা ঝুঁকিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ক্লাসঘরের ভেতরে তাকিয়ে খাতায় কী যেন লিখল। তারপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে আঙুলের কর গুনে বিড়বিড় করে আবার খাতায় লিখে ঝুঁকে ক্লাসঘরের মধ্যে কিছু একটা দেখল আর মুখে হাসি ফুটল।

স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের ক্লাস চলছে। একঝাঁক বোলতার গুনগুনানির মতো শব্দ হয়ে চলেছে। সন্তর্পণে ফটক ঠেলে অনিরুদ্ধ ঢুকল। কিছুটা হেঁটে গিয়ে দাওয়ায় একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে এক চোখ দিয়ে লক্ষ করতে লাগল কুড়োনকে। ঠিক সেই সময় টিচার্স রুম থেকে অল্পবয়সী এক দিদিমণি বেরোলেন। একটি অচেনা লোককে থামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে প্রায় চোরের মতো তাকাতে দেখে তাঁর চোখ কুঁচকে উঠল।

”কে আপনি? এখানে কী করছেন?”

অনিরুদ্ধ থতমত হয়ে বলল, ”ওকে দেখছি।” আঙুল দিয়ে সে দূরে বসা কুড়োনকে দেখিয়ে বলল, ”ওকে চেনেন?”

কুড়োনের দিকে না তাকিয়ে দিদিমণি বললেন, ”কুড়োন, আমরা সবাই ওকে চিনি।”

”ও কী করছে বলুন তো ওখানে বসে?”

”লেখাপড়া করছে।”

কেউ যদি এখন অনিরুদ্ধকে বলে শতাব্দীর সেরা ভারতীয় গোলকিপার তুমি, তা হলে সে এতটা চমকে উঠবে না যতটা চমকাল এখন। কুড়োন এবং লেখাপড়া! সে দুটোকে মেলাতে না পেরে বলল, ”ওখানে বসে কেন?”

”ক্লাসে ছোটদের সঙ্গে বসতে লজ্জা করে বলে বাইরে বসে।”

”ওটা কোন ক্লাস?”

”ক্লাস টু, তবে সামনের মাসেই ওর পরীক্ষা নিয়ে ক্লাস থ্রি—তে তুলে দেওয়া হবে।” দিদিমণির স্বরে চাপা কৌতুক আর গর্ব। ”দারুণ মাথা আর পরিশ্রম করে।”

”এভাবে ইচেছমতো পরীক্ষা নিয়ে কাউকে ক্লাসে তুলে দেওয়া যায়?” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে জানতে চাইল।

”যে ছেলে ক্লাস থ্রি—র যোগ্য, ক্লাস টু—য়ে অযথা তাকে একটা বছর আটকে রেখে লাভ কী? ও তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাক, এটাই আমরা চাই।” দিদিমণি চটি ফটফটিয়ে একটা ঘরে ঢুকে গেলেন।

এইসময় টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাখাল পিরিয়ড শেষ হওয়া জানান দিতে তারে ঝোলানো ঘড়িতে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে একটা ঘা দিল। অনিরুদ্ধ চটপট স্কুল থেকে বেরিয়ে এল। কুড়োন কেন যে ”মামা বাজে কয়টা?”—জিজ্ঞেস করত, সেই রহস্যটা এখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। যে ছেলে চোদ্দ গজ দূর থেকে টিভি—তে খেলা দেখার জন্য গাছে উঠতে পারে, তার পক্ষে ঘরের দরজায় বসে ব্ল্যাকবোর্ড দেখা বা দিদিমণিদের কথা শোনা তো অতি সামান্য ব্যাপার।

বাড়ি ফিরে অনিরুদ্ধ দিদিকে কুড়োনের লেখাপড়া শেখার অভিনব পদ্ধতির বিবরণ দিয়ে বলল, ”আমার মনে হয় যেদিন হেডমাস্টারমশাই ট্রেনিংয়ের জন্য কুড়িজনের নাম বললেন তাতে কুড়োনের নাম ছিল না। ও পরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন তার নাম নেই, অলু ওকে বলে এটা শুধু স্কুলের ছাত্রদের জন্য তাই তোর নাম নেই। ও বলে আমাকে ছাত্র করে নিন। অলু বলে তুই অ আ ক খ—ই তো জানিস না, ছাত্র হবি কী করে? তাইতে কুড়োন ওর ট্রেডমার্ক উত্তর দিয়েছিল— পেরাকটিস করলাই শিখা লওয়া যায়।

”দিদি, আমার মনে হয় সেই মুহূর্তেই কুড়োন ঠিক করে ছাত্র হবে। নিজের ওপর কী অগাধ বিশ্বাস—প্র্যাকটিস করলেই শিখে নেওয়া যায়। আর সত্যি সত্যিই শিখে নিল! ঠিকমতো শুরু করলে এখন তো ওর অলুর সঙ্গে পড়ার কথা। অবশ্য ওয়ান, টু—র পড়া যদিও সামান্য তা হলেও এই ক’ মাসেই হজম করে এখন থ্রি—তে উঠতে যাচ্ছে। অবাক করার মতো নয়? তার মানে কী প্রচণ্ড খেটেছে ভাবো! মনে হয় কেউ ওকে নিশ্চয় হেলপ করেছে।”

অফিস থেকে ফিরে সকালে চোখ বুলিয়ে যাওয়া খবরের কাগজটা ভাল করে পড়ে অনিরুদ্ধ (অলু পড়ছে তাই সে টিভি চালায় না)। বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বেরোল, উদ্দেশ্য, রাখালের কাছ থেকে কুড়োনের খবর নেওয়া। চৌকিতে শুয়েছিল রাখাল, উঠে বসল অনিরুদ্ধকে দেখে। কোনও ভূমিকা না করে সে জিজ্ঞেস করল, ”কুড়োনকে পড়ায় কে রাখালদা?”

প্রশ্নটা ঠিকমতো বুঝতে পারল না রাখাল। বলল ”পড়ায় কে মানে?”

”কুড়োন সকালে প্রাইমারি স্কুলে পড়ছে এটা তুমি জানো। ওকে তুমিই ভর্তি করিয়েছ, তাই তো?”

”না। আমি করাইনি, প্রথমে আমি তো জানতামই না।”

”তা হলে ও ভর্তি হল কী করে?”

”ভবা অরে ভর্তি করাইছে।”

অনিরুদ্ধর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ঘরে চোখ বুলিয়ে তার চোখে পড়ল মুকুল গণিত, কিশলয় নামে দুটো বই আর দু—তিনটে খাতা টিনের একটা বাক্সের ওপর। অঙ্কের বইটা তুলে নিয়ে খুলে দেখল কে এক অভিজিৎ ঘোষালের নাম লেখা, বইটা পুরনো।

”ভবাই অরে পড়ায়। অর দেশের বাড়ি তো আমাদের গেরামের কাছেই লাইরিপুরে। তালদির হস্টেলে থেইকে মাধ্যমিক পাশ করেছে। অর কথাবার্তার ধরন দেখে বোঝো না লেখাপড়া করা ছেলে, কুড়োনরে ভাইয়ের মতো দেখে। পাইমারির বড়দিরে বলে অই তো কুড়োনরে ভর্তি করাইছে, অই তো পুরানা বই জোগাড় করে দেছে। কুড়োন রোজ সন্ধ্যায় অর কাছে পড়তি যায়, ঘরে এসে অনেক রাইত অবদি পড়ে, দুপুরেও পড়ে। খাতাকলমও ভবা দিচ্ছে।”

অনিরুদ্ধ আর কোনও প্রশ্ন না করে অন্য প্রসঙ্গে এল। ”তোমার বুকের ব্যথাটা এখন কেমন, আর অজ্ঞান—টজ্ঞান হওনি তো? ওষুধ ঠিকমতো খাচ্ছ?”

”ব্যথা তো লাগে নিচু হয়া কিছু তুললে, জোরে হাঁটলি ব্যথা হয়, হাঁপ ধরে। ওষুদ খাওয়া কি সোজা কথা! ডাক্তারবাবু যা লিখা দেছে তাতে তো মাসে দুইশো টাকা করে পড়ে। অত টাকা পাব কোথা? মাসে তাই অর্ধেক দিন খাই।” রাখাল করুণ চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। অনিরুদ্ধের বন্ধু তরুণ হাসপাতালে রাখালের ইলেকট্রো কার্ডিওগ্রাম করিয়েছিল। পরে অনিরুদ্ধ তরুণের কাছে জেনে নিয়েছিল, ধমনী দিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত পৌঁছচ্ছে খুবই কম। ফলে রাখালের হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে। বেশি পরিশ্রম যেন না করে। ওষুধ ওকে নিয়মিত আজীবন খেয়ে যেতে হবে।

”রাখালদা তোমার প্রেসক্রিপশনটা আমায় দাও, আমি মাসে মাসে তোমায় কিনে দিয়ে যাব। কিন্তু রোজ তোমায় খেতে হবে।” কথাটা বলে রাখালের বিহ্বল কৃতজ্ঞ দুটি ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে অনিরুদ্ধ অত্যন্ত তৃপ্ত বোধ করল। তারপর বলল, ”কুড়োনকে বোলো ওর বইখাতা যা লাগবে আমাকে যেন বলে।”

পরের দিনই অনিরুদ্ধ অফিস ফেরত গড়িয়াহাট থেকে রাখালের এক মাসের ওষুধ কিনে হাজির হল রাখালের ঘরে। ধুতি—শার্ট পরা এক অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে রাখাল তখন কথা বলছিল। পলিথিনের ঠোঙায় ভরা ট্যাবলেটের পাতাগুলো রাখালের হাতে দিয়ে বলল, ”সামনের মাসে আবার দিয়ে যাব, মনে করে খাবে কিন্তু!”

”খুব ভাল করলা এগুলো কিনা দিয়া। এই দ্যাখো আমার বড় বোনের নাতি আইছে আমারে নিয়্যা যাইতে, অর বোনের বিয়া। পাশের গেরাম চরখেরিতে ছেলের বাড়ি, ছেলেডা মাছ ধরে; আজ পনেরো—বিশ বছর বোনরে দেখি না, ভাবতাছি এই উপলক্ষে বোনডারে দেখে আসি। যাওয়া কি কম ধকলের ব্যাপার, সকালে বাইরালে সেই বিকালে পৌঁছানো—বাস, লঞ্চ, টেম্পো, তারপর পাঁচ মাইল হাঁটা!”

”ওষুধগুলো সঙ্গে নিয়ে যেও।”

”তা আর বলতে! দশ মাইলের মধ্যে ডাক্তারবদ্যি নাই, ওষুধের দোকান নাই।”

”কুড়োনও সঙ্গে যাচ্ছে?”

”নাঃ।” রাখাল হতাশা মেশানো বিরক্তি নিয়ে বলল। ”ওর নাকি পড়ায় বিঘ্ন হবে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের এটাই তো সুযোগ, তা হতচ্ছাড়ার কাছে পড়াটাই নাকি বড় কাজ। ও নিজে রেঁধেবেড়ে খাবে, বললুম কত করে, শুনলই না।”

অনিরুদ্ধর সঙ্গে রাখালের এটাই শেষ কথাবার্তা। সাতদিনের ছুটির দরখাস্ত ভবাকে দিয়ে লিখিয়ে শুক্রবার সকাল দশটায় হেডমাস্টারমশাইয়ের হাতে সেটা দিয়েই রাখাল তার বোনের নাতির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে রাখাল সাতদিনের ছুটি তিন—চারবারের বেশি নেয়নি। দরখাস্তটা যে মঞ্জুর হয়ে যাবে, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল।

পরদিন শনিবার বিকেলেই রাখালের বোনের সেই নাতি এবং সঙ্গে আর একটি লোক বন্যায় ডোবা একতলা বাড়ির চালে বসে থাকা মানুষের মতো মুখ করে স্কুলে এসে হাজির। ভবা তখন ঘরে ঘরে তালা লাগাচ্ছিল। সেই প্রথম দুঃসংবাদটা শুনল—রাখাল কাল বিকেলেই টেম্পো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মাইল তিনেক যাওয়ার পরই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। মুখে জল দেওয়ার বা কানে হরিনাম জপ করার সুযোগও কেউ পায়নি। ”ডেডবডি এখনও রাখা আছে। কুড়োন গিয়ে মুখে আগুন দিলে তবেই দাহ করা হবে,” বলল সঙ্গের লোকটি।

কুড়োন তখন একতা সঙ্ঘের মাঠে। ভবা ওই দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে আসে।

”জানো মামা, আমরাও শুনলুম ওর সঙ্গে।” অলু সন্ধ্যাবেলায় অনিরুদ্ধকে বলে ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে আসামাত্র। ”ভেবেছিলুম ও কেঁদে উঠবে হাউহাউ করে। কিছুই করল না। মুখখানা কেমন শক্ত হয়ে গেল। শুধু বলল, ‘আমারে কি এখন যাইতে হইব?’ তারপর একটা কথাও না বলে ওদের সঙ্গে চলে গেল।”

শুনে গুম হয়ে অনিরুদ্ধ অনেকক্ষণ শুয়ে রইল, কিছু খেলও না। তার শুধু চোখের সামনে দিয়ে সার বেঁধে চলেছে স্কুলজীবন এবং রাখাল। টুকরো টুকরো ঘটনা আর রাখালের গলার স্বর। এত বছর এখানে রইল অথচ কথার ভাষা আর উচ্চচারণ একদম পালটাল না। স্কুলের সামান্য মাইনেতে নিজেরই দু’ বেলা ভাল করে খাওয়া জোটে না তবু ভাইয়ের নাতিকে কাছে এনে রাখল। তা না হলে কুড়োন কোথায় ভেসে যেত কে জানে! রাখালই ছিল কুড়োনের একমাত্র আশ্রয়, সেই রাখালের মৃত্যুসংবাদ শুনেও কুড়োনের চোখে জল এল না! একবারও মনে এল না এবার ওর কী হবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে!

রাত্রে সে শিবেনবাবুর কাছে গিয়ে কথা বলল। তিনি বললেন, ”ভবা আমায় সবই বলেছে, রাখাল যে ঘরটায় থাকত সেখানেই কুড়োন থাকুক আর রাখাল যে কাজ করত, দুপুরে সেটাই করুক। ওর পড়াটা সকালে যেরকম চলছে চলুক। আপাতত জরুরি ভিত্তিতে ওকে নিয়োগ তো করা যায়, মনে হয় না কমিটি তাতে আপত্তি করবে। ছেলেটাকে তো খেয়েপরে বাঁচতে হবে, তবে ওর ফুটবলে সময় কমে যাবে।”

ফিরে এসে অনিরুদ্ধ দিদিকে জানাল শিবেনবাবুর সঙ্গে যা—যা কথা হয়েছে। শুনে অমলা বলল, ”ছেলেটাকে আমাদের বাড়িতে এনে রাখ না! নীচে তো ঘর পড়ে রয়েছে, একটা লোক বাড়লে এমন কিছু খরচও বাড়বে না।”

অমলার প্রস্তাবটা অনিরুদ্ধর মনে ধরল। সে ঠিক করল কুড়োন ফিরে এলে তাকে এই বাড়িতে থাকার কথা বলবে। সোমবার স্কুলে হাফছুটি দেওয়া হল, শোকসভাও হল। মাস্টারমশাইদের অনেকেই রাখাল সম্পর্কে দু—চার কথা বললেন। কুড়োন মুখাগ্নি করে রবিবার রাতেই ফিরে এসেছিল। শোকসভায় সে ঘরভর্তি ছাত্রদের পেছনে দাঁড়িয়ে পাথরের মতো মুখ করে বক্তৃতা শুনে যায়।

পরদিন সকালে কুড়োন ছেলেদের সঙ্গে চাঁদানদীর পোল পর্যন্ত ছুটে ফিরে এল একতার মাঠে। অনিরুদ্ধ লক্ষ করল অন্যান্য দিনের মতোই কুড়োন মনপ্রাণ ঢেলে শুটিং ট্র্যাপিং হেডিং করে গেল এমনভাবে, যেন ওর মরণবাঁচন নির্ভর করছে এই প্র্যাকটিসের ওপর। একসময় সে বলল, ”মামা প্ল্যান্টি মারা পেরাকটিস করব। এখন তো খুব ট্রাইবেকার হয়।”

দু’দিন আগে দাদুর মুখে আগুন দিয়ে এসেছে যে, পেনাল্টি কিক নেওয়ার কৌশল শেখার জন্য তার আগ্রহ অনিরুদ্ধের মনের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করল। তার মনে হল, এইটুকু ছেলের পক্ষে খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এই কঠিন হয়ে ওঠাটা। অনিরুদ্ধ সাতটি ছেলেকে দিয়ে পেনাল্টি কিক নেওয়াল, প্রত্যেকে মারল পাঁচটি করে। পালা করে তিনজন গোলে দাঁড়াল। কুড়োনের তিনটে শট বারপোস্ট ঘেঁষে গোলে ঢুকল, বাকি দুটো অলুর কাঁধের পাশ দিয়ে জালে গিয়ে লাগল। পাঁচটাতে গোল পাঁচটাই। ওর মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি।

”কুড়োন, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।” প্র্যাকটিস শেষে অনিরুদ্ধ কুড়োনকে ডাকল।

”কী মামা?”

”তুই এখন থাকবি, খাবি কোথায়?”

”কেন, যেখানে আছি সেখানেই থাকব! দাদুর চাকরিটা পেলি খাওয়াও আমার চলে যাবে।” কুড়োন নিশ্চিতভাবে বলল।

”তুই যদি আমাদের বাড়িতে থাকতে চাস তা হলে থাকতে পারিস, খাওয়াও আমাদের ওখানে।” কথাটা বলে অনিরুদ্ধ ওর মুখভাব লক্ষ করল। কুড়োনের চোখে প্রথমে একটা ঝিলিক দিল, তারপর হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারামুখে।

”না মামা, আমি কোথাও যাব না, ওই ঘরেই থাকব, কোনও অসুবিধা হবে না।”

অনিরুদ্ধ ওর সংক্ষিপ্ত, দৃঢ় গলার স্বরে বুঝে গেল এই ব্যাপারে আর কথা বলে লাভ নেই। তার মনে পড়ল হারুদার কথাটা, ‘এই ছেলেটাকে এবার ছেড়ে দে। আরও কঠিন জায়গায় গিয়ে ও নিজেকে তুলে ধরুক।’

অনিরুদ্ধ শুধু বলল, ”তোর যখন যা দরকার পড়বে আমাকে বলবি।”

”বলব।”

অনিরুদ্ধ ওর চোখে নরম আলো ফুটে উঠতে দেখল। কুড়োন মৃদু চাপা স্বরে বলল, ”মামা রাইগ করলান?”

”না রে, রাগ করব কেন, নিজে নিজে বড় হওয়াই তো আসল বড় হওয়া। খুব চেষ্টা কর, নিশ্চয় বড় হবি।”

.

ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে যারা সুদের টাকা দিচ্ছে না তাদের তালিকা তৈরি করছিল অনিরুদ্ধ, এমন সময় নির্মল ঘোষ টেবলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। শান্ত নিরীহ মধ্যবয়সী, কখনও কাজে ফাঁকি দেন না, সহকর্মীদের সবসময় সাহায্য করেন, সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। ঝুঁকে অনিরুদ্ধর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ”একটা অনুরোধ করব, রাখবে?”

অনিরুদ্ধ সিধে হয়ে বসল, ”বলুন নির্মলদা, সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয় রাখব।”

”সাধ্যের মধ্যেই এটা। আমাদের গ্রামে ঠাকুর্দার নামে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় গণপতি চ্যালেঞ্জ শিল্ড আর ঠাকুমার নামে রানার্স কাপ। চল্লিশ বছরের টুর্নামেন্ট। জেলার তা বটেই, কলকাতারও বহু নামকরা প্লেয়াররা খেলে গেছে। এবারও অনেকে খেলেছে। রবিবার পনেরো তারিখে ফাইনাল। এবার তুমি যদি ফাইনালে বিশেষ প্রধান অতিথি হও, তা হলে অর্গানাইজারদের বলে দেব।” নির্মল ঘোষ প্রার্থীর মতো মুখ করে তাকিয়ে রইলেন।

অনিরুদ্ধ ফাঁপরে পড়ল। জীবনে সে দুটি কি তিনটি ফুটবল ফাইনালে পুরস্কার দিয়েছে, দু—তিন মিনিটের বক্তৃতা কোনওক্রমে দিয়েই চেয়ারে বসে পড়েছে। এই একটি জিনিস সে মনেপ্রাণে অপছন্দ করে—বক্তৃতা দেওয়া। খেলোয়াড়রা ক্লান্ত, দর্শকরা যখন উল্লসিত বা বিমর্ষ, তখন বক্তৃতা কারও মাথায় ঢোকে না। কিন্তু উদ্যোক্তারা চান একটা লম্বা বক্তৃতা, যা কেউ শোনে না অন্তত সে নিজে কখনও শুনত না। ফুটবল ম্যাচ দেখতে বা পুরস্কার হাতে তুলে দিতে তার ভালই লাগে, শুধু ওই বক্তৃতাটি ছাড়া।

অনিরুদ্ধকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখে নির্মল ঘোষ বললেন, ”আমাদের চণ্ডীপুরকে খুব ছোট ভেবো না, দুটো ফুটবল টিম শুধু আমাদেরই গ্রামে আছে, আগের বছর সুবোধ ব্যানার্জি, তার আগের বছর কল্যাণ সেন সবাই ওলিম্পিয়ান, তারও আগে কাল্টু ভট্টাচার্য, বিশু গুঁই—রা প্রধান অতিথি হয়ে গেছে। সভাপতি বরাবরই হয়েছে এস ডি ও বা এম এল এ। আজেবাজে লোককে আমরা ডায়াসে তুলি না।”

”বিশেষ প্রধান অতিথি মানে একজন অবিশেষ প্রধান অতিথিও আছেন, তিনি কে?”

”অশোক ভদ্র, সল্ট লেকে সাই—এর ফুটবল কোচ। আমাদের সি এ সি, মানে চণ্ডীপুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের নরেন বেরা নামে একটা ছেলে দারুণ খেলে, ওর খেলা অশোক ভদ্রকে দেখাবার জন্যই ওকে আনা হচ্ছে। পছন্দ হলে সাই—এর স্কুলে নরেনকে নিয়ে নিতে পারে, ওকে চেনো নাকি?”

”না, চিনি না; নির্মলদা, সি এ সি কি ফাইনালে খেলছে? অন্যদিকে কে?”

”সি এ সি—র অপোনেন্ট নারিকুল স্পোর্টিং। ওদের টিমে চারটে ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার আছে। জুনিয়ার বেঙ্গলে খেলেছে। অনিরুদ্ধ তা হলে অর্গানাইজারদের জানিয়ে দিই তুমি আসছ, কার্ডে নামটা ছাপাতে হবে তো। তোমাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে, পৌঁছেও দেবে।”

”নির্মলদা, একটা কথা, বক্তৃতা আমি দিতে পারি না, দেবও না।”

”ও ঠিক আছে, দু—চারটে কথা বললেই হবে। দুপুর একটায় গাড়ি যাবে, তিনটেয় খেলা আরম্ভ।”

অনিরুদ্ধ ঠিক করল, রবিবার অলু আর কুড়োনকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, খেলা দেখা হবে আর বেড়ানোও হবে। আসল গ্রাম দেখার সুযোগ তো ওদের হয় না, তা ছাড়া যাতায়াত মোটরে, স্বচ্ছন্দে যাবে আসবে। ওদের দু’জনকে সে বলে রাখল একটার সময় যেন রেডি হয়ে থাকে। কুড়োনের জামা—জুতোর সমস্যাটা মিটিয়ে দিল অমলা। অলুর হাওয়াই শার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট ফিট করে গেল, জুতোটা কপিল ঘোষের দেওয়া।

একটা—দশে পুরনো একটা অ্যাম্বাসাডার এল। ড্রাইভারের সঙ্গে একটা লোক।

”বাড়ি চিনে বার করতে অসুবিধে হয়নি তো?” মোটরে মিনিট পনেরো যাওয়ার পর অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল।

এতক্ষণ চুপ করে থাকা লোকটি একগাল হেসে বিগলিত ভাবে বলল, ”একদম নয়। আপনার বাড়ির কাছের মোড়ে এক দোকানদারকে আপনার নাম বলতেই দেখিয়ে দিল বাড়িটা। আপনার মতো ফেমাস লোকের বাড়ি চিনে বার করা এ আর কী এমন শক্ত! আচ্ছা অনিরুদ্ধদা, আপনি এশিয়ান গেমসে খেলেছেন?”

”না।”

”ওলিম্পিকে খেলেছেন?”

মোটর তখন হাওড়া ব্রিজ দিয়ে গঙ্গা পার হচ্ছে।

”না।”

”তা হলে!” লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এমনভাবে, যেন অনিরুদ্ধ তাকে হাওড়া ব্রিজ থেকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে বলল। ”আপনি ইন্ডিয়া খেলেননি?”

”এশিয়ান গেমস, ওলিম্পিক ছাড়া ভারত কি আর কখনও কারুর সঙ্গে খেলেনি?”

”আচ্ছা অনিরুদ্ধদা, আপনি কি মোহনবাগানের সাপোর্টার?”

”না।”

”ইস্টবেঙ্গলের?”

”না।”

লোকটা এবার গঙ্গায় পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল।

”তা হলে কার সাপোর্টার?”

”ওই দুটো ক্লাবের সাপোর্টার হতেই হবে এমন কোনও কথা আছে কি?”

অনিরুদ্ধর ডান দিকে বসা কুড়োন তখন বলে উঠল, ”উনি স্বামী স্বরূপানন্দ স্কুলটিমের সাপোর্টার।”

”অ।” লোকটা কী বুঝল কে জানে! মাথা কাত করে পেছনে তাকিয়ে বলল, ”আচ্ছা, আপনার ফেভারিট প্লেয়ার কে?”

অনিরুদ্ধর বাঁ দিকে বসা অলু মুখ টিপে বলল, ”কুড়োন মণ্ডল, খুব ফেমাস প্লেয়ার।” একটু থেমে চাপা গলায় বলল, ”হবে।”

কুড়োন হাত বাড়িয়ে অলুর হাঁটুতে চিমটি কাটল।

রবিবার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। ওদের মোটর হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে জি টি রোড ধরে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেল চণ্ডীপুরে। নির্মল ঘোষ ওদের প্রথমে নিয়ে গেলেন নিজেদের পৈতৃক বাড়ির বৈঠকখানায়। ওঁরা এখানকার প্রাচীন ধনী পরিবার। ব্যবসা আছে কলকাতার পোস্তায়, ঢালাই লোহার কারখানা সালকিয়ায়। নির্মল ঘোষ থাকেন টালিগঞ্জে নিজের বাড়িতে।

সাই—এর কোচ অশোক ভদ্র তখনও এসে পৌঁছননি। ওরা অপেক্ষা করতে লাগল। অনুষ্ঠান—প্রধান এস ডি ও ঠিক পৌনে তিনটেয় হাজির হলেন, অবাঙালি তরুণ, বাংলা বলতে পারেন। অলু আর কুড়োন কিছুক্ষণ উসখুস করে গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে তখন জনাপাঁচেক বাইরের লোক। নির্মল ঘোষ সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন, তখন ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক মধ্যবয়সী উদ্বিগ্ন মুখে তাঁকে বাইরে ডাকল। মিনিট তিনেক পর তিনি ফিরে এসে অনিরুদ্ধকে চাপা গলায় বললেন, ”একটা বিপদ হয়ে গেছে, নরেনের পা মচকে গেছে আজ সকালে। বেলপাতা পাড়তে গাছে উঠেছিল। পিঁপড়ে কামড়ায় হাতে, জ্বালা করে উঠতেই চুলকোতে গিয়ে ডাল থেকে হাত স্লিপ করে মাটিতে পড়ে যায়, ডান পায়ের গোছটা মচকায়। পাশের বাড়ির ফ্রিজ থেকে সঙ্গে সঙ্গে বরফ এনে লাগায় কিন্তু ফুলে উঠেছে, অল্প অল্প যন্ত্রণাও রয়ে গেছে। কী যে এখন করা যায়! ছেলেটা বলছে বটে, ও কিছু নয় আমি ঠিক খেলে দেব। কী মুশকিলে পড়া গেল বলো তো?”

নির্মল ঘোষ অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলেন অনিরুদ্ধর মুখের দিকে, তাঁর চোখে পরামর্শ পাওয়ার জন্য আবেদন। অনিরুদ্ধ বলল, ”খেলাবেন না নির্মলদা, একদম খেলাবেন না। ও খেলতে তো পারবেই না, তার থেকেও মারাত্মক, এই চোট ওর অনেক ক্ষতি করে দেবে।”

”কিন্তু নরেন নিজে খেলতে চায়। ও জানে অশোক ভদ্র আজ ওর খেলা দেখবে। তা ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই যাকে নরেনের জায়গায় নামানো যায়,” কথাগুলো নির্মল ঘোষ বিপন্ন মুখে বললেন। ”খেলা শুরুর তো সময় হয়ে গেল, চলো এবার মাঠে যাওয়া যাক, আসুন সার।” এস ডি ও—কে নিয়ে তিনি রওনা হলেন, বাড়ি থেকে মাঠ হেঁটে চার মিনিট। মাঠে ওরা সবে পৌঁছেছে তখনই আর একটা অ্যাম্বাসাডার এসে থামল, নামল অশোক ভদ্র। অনিরুদ্ধকে দেখে সে বলল, ”চিনতে পারো?”

অনিরুদ্ধ মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। চিনতে পারছে না বুঝে অশোক বলল, ”রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে ষোলো বছর আগে শিল্ডের ফার্স্ট রাউন্ডে লাল কার্ড দেখেছিলে আমার মুখে ঘুসি মেরে।” বলেই হো হো করে হেসে উঠল সে।

অনিরুদ্ধর মুখে রক্ত ছুটে এল। ঢোক গিলল। তখন সবে নাম করেছে, বড় ক্লাবে অফার আসছে, খেলার মধ্যে কিছু কিছু অভব্যতা করেছে ছোট টিমের সঙ্গে। এবার মনে পড়ল ম্যাচটা ছিল এরিয়ানের সঙ্গে বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টের, সে তখন ছিল এরিয়ানে।

”তোমার এখনও মনে আছে?”

”থাকাই তো উচিত। বড় গোলকিপারের ঘুসি, সেটা কি ভোলা যায়?”

দু’জনে খুব একচোট হেসে এগিয়ে গেল টেবলপাতা মঞ্চের দিকে। মঞ্চের দু’ধারে গণ্যমান্যদের জন্য চেয়ার। অন্য একটা টেবলে ঢাউস একটা শিল্ড, রানার্সের জন্য বড় একটা কাপ, বেস্ট প্লেয়ারের কাপ আর বাইশজন খেলোয়াড়, রেফারি, লাইন্সম্যানদের জন্য তোয়ালে, ওয়াটারবটল, ছোট কিটব্যাগ।প্রাইজের জিনিসগুলো দেখে অনিরুদ্ধ মনে মনে বলল : ”কিছুই বদলায়নি, এইসব জিনিস আমিও পেতাম টুর্নামেন্ট খেলে। এর থেকে বরং প্রত্যেককে ফুটবল আইনের বই একটা করে দিলে ভাল হত। বেশিরভাগ ছেলেই তো আইন না জেনে খেলে।

অনিরুদ্ধর মনে পড়ে গেল একতা সঙ্ঘের মাঠে টিভি শুটিংয়ের জন্য সাজানো ম্যাচটার কথা। প্রায় একই রকম লাগছে। সেই কাপ—শিল্ড, বেস্ট প্লেয়ারের কাপ, প্রাইজ, তোয়ালে, সেই প্রাইজ দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট, চিফ গেস্ট, মাঠ ঘিরে উপচে পড়া ভিড় আর মাইকে ঘোষণা। মাঠের মাঝে সার দিয়ে থাকা দুটো টিমের সঙ্গে পরিচয় আর হ্যান্ডশেক করা। তফাত শুধু সেটা ছিল নকল আর এটা আসল। মাঠ থেকে ফিরে এসে ডায়াসে ওঠার সময় দেখতে পেল সামনেই দুটো স্টিলের চেয়ারে অলু আর কুড়োন পাশাপাশি বসে।

মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় তারা নিজেদের নাম বলছিল। একটি ছেলে হ্যান্ডশেক করে বলল, ”নরেন বেরা।” শুনেই ভ্রূ কুঁচকে অনিরুদ্ধ তার ডান পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। যদি নিজে মনে করে খেলতে পারবে তা হলে খেলুক। নারিকেল স্পোর্টিং নাকি চারজন ফার্স্ট ডিভিশন প্লেয়ার খেলাচ্ছে! তাদের ট্যাকলিং নরেনকে সামলাতে হবে।

.

খেলা শুরুর তিন মিনিটের মধ্যে নরেন গোল দিল বাঁপায়ের দুর্দান্ত একটা নিচু শটে। নরেনকে পেনাল্টি এলাকার মাথায় রেখে সি এ সি শুরু করে। দু’মিনিটেই নারিকুল প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে সবাই এগিয়ে যায় দু’জনকে ডিফেন্সে রেখে। একটা বল এই সময় ছিটকে আসে নরেনের কাছে। বল নিয়ে গোলের দিকে এগোতে গিয়ে দেখল দু’জন ডিফেন্ডার তার সামনে ও পাশ থেকে ছুটে আসছে। নরেন দেরি না করে পনেরো গজ দূর থেকেই ডান বারপোস্ট ঘেঁষে শট নেয়। ঝাঁপানো গোলকিপারের আঙুলে ছুঁয়ে পোস্টে লেগে বল গোলে ঢোকে।

”খুব প্রম্পট শটটা নিয়েছে, দেরি করলে বলটা পায়ে রাখতে পারত না। ব্রেন কুইক কাজ করেছে।” অশোক ভদ্র ঈষৎ উত্তেজিত স্বরে এস ডি ও—কে নরেনের কৃতিত্বটা ব্যাখ্যা করে দিল। অনিরুদ্ধর ভাল লেগেছে গোল করার ধরনটা।

নারিকুল এবার হঁশিয়ার হয়ে গেল, বিশেষ করে নরেনের পেনাল্টি এলাকায় উঠে থাকাটায় তারা নজর রাখল। বল ধরার জন্য সে একটু দৌড়লেই নারিকুলের স্টপার তেড়ে যাচ্ছে বা বল ধরলেই তাকে কেউ না কেউ ট্যাকল করছে। অনিরুদ্ধ একবার দেখল নরেনকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতেও। উঠে দাঁড়িয়ে সে দু’পা খুঁড়িয়ে হাঁটল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ল।

দশ মিনিটের সময় নারিকুল গোলটা শোধ করে দিল। গোলের সামনে এলোমেলো শট হচিছল, একজনের পায়ে লেগে বল আচমকা গোলে ঢুকে গেল। এরপর দ্বিগুণ উৎসাহে নারিকুল কোণঠাসা করে রাখল সি এ সি—কে। খেলার ধরন আর চালচলন দেখে অনিরুদ্ধ আন্দাজ করেছিল কোন চারজন কলকাতা থেকে এসেছে। সেন্টার স্টপার, গোলকিপার, সেন্ট্রাল স্ট্রাইকার আর একজন মিডফিল্ডারকে সে চিহ্নিত করে ফেলল।

হাফটাইমের পাঁচমিনিট আগে কে একজন কোনাকুনি থ্রু বাড়াল ডান দিকের ফাঁকা জায়গায়। নরেনকে প্রায় পনেরো গজ দৌড়ে বলটা ধরতে হবে। ধরে বল নিয়ে আধা—ঘুরলেই সামনে পড়বে লেফট ব্যাক, তার পেছনে গোলকিপার অথবা বল ধরে গোল লাইনের কাছে ব্যাকটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ব্যাক সেন্টার করতে পারে। অনিরুদ্ধ চেয়ারে সিধে হয়ে বসল, এবার নরেনের আসল পরীক্ষা।

থ্রু—টা ধরার জন্য নরেন ঝটকা দিয়ে ছোটা শুরু করল, পাশাপাশি তার সঙ্গে কয়েক গজ ছুটেই লেফটব্যাক পা বাড়িয়ে দিল বলটা সরিয়ে দিতে। ট্যাকলটা পরিচ্ছন্ন ও বিধিসম্মতভাবে হলেও নরেন পায়ে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে মাঠে পড়ে গেল। চিত হয়ে সে এ—পাশ ও—পাশ করে দু’বার গড়াগড়ি দিয়েই ডান পায়ের গোছ চেপে ধরে উঠে বসল। ঘটনাটা পেনাল্টি এলাকার মধ্যে ঘটেছে, কলকাতার রেফারি বাঁশি বাজিয়ে পেনাল্টি স্পটের দিকে আঙুল দেখালেন। মাঠ ঘিরে তুমুল উল্লাস।

অনিরুদ্ধ তাকাল অশোক ভদ্র—র দিকে। সে মাথা নেড়ে বলল, ”ভুল দিল।”

”ভুল কেন?” এস ডি ও ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন অশোক ভদ্রের দিকে, ”মেরে ফেলে দিল এ তো পরিষ্কার পেনাল্টি।”

অনিরুদ্ধ মহকুমা শাসককে বোঝাবার চেষ্টা করে শুধু বলল, ‘ছেলেটা আর মাঠে থাকতে পারবে না।”

পেনাল্টি শটটা নিল নরেনই, অবশ্যই বাঁ পায়ে। বাঁ—দিকের পোস্ট ঘেঁষে নিচু শট। গোলকিপার যেন জানতই, ঝাঁপিয়ে গোললাইনের বাইরে ঠেলে দিল।

”নন—কিকিং ফুটে জোর নেই। উচিত হয়নি শটটা নেওয়া।” অনিরুদ্ধ জানাল অশোক ভদ্রকে।

”ইনজুরিটা কি আগেই ছিল?”

অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল।

লজ্জায় মাথা নামিয়ে নরেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে সাইড লাইনের দিকে চলে গেল। সি এ সি বস্তুত দশ জনে খেলে হাফটাইম পর্যন্ত কয়েকটা মিনিট আটকে রাখল নারিকুলকে।

হাফটাইম হতেই অনিরুদ্ধ ডায়াস থেকে নেমে গিয়ে নির্মল ঘোষের সঙ্গে দেখা করল। অভিযোগের সুরে সে বলল, ”আমি বারণ করেছিলুম ওকে খেলাতে। দেখলেন তো এখন ও মাঠে দাঁড়াতে পারছে না। সাবস্টিটিউট নামান।”

নির্মল ঘোষ পাংশু মুখে বললেন, ”নরেনের জায়গায় নামাবার মতো কোনও ছেলে তো আমাদের নেই। দেখি আমাদের সেক্রেটারি প্রবোধের সঙ্গে কথা বলে।”

খেলোয়াড়রা মাঠের ধারে কেউ বসে কেউ শুয়ে। নির্মল ঘোষ সেই দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। অনিরুদ্ধ দেখল তিনি ধুতি শার্ট পরা এক মাঝবয়সীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। বোধহয় ইনিই প্রবোধ। মাথা নেড়ে প্রবোধ কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। অনিরুদ্ধ এগিয়ে গেল।

”আপনাদের কোনও সাবস্টিটিউট প্লেয়ার নেই?” অনিরুদ্ধ যতটা সম্ভব শোভনতা বজায় রেখে ধমকে উঠল।

প্রবোধ বলল, ”আছে গোলকিপার। একজন ফরওয়ার্ড ছিল, মামার বিয়েতে বরযাত্রী গেছে, সকালে ফেরার কথা ছিল, এখনও ফেরেনি। আর একজন রাগ করে মাঠেই আসেনি। তাকে বলেছিলুম পুরো ম্যাচ খেলাতে পারব না, তার প্রেস্টিজে লেগেছে।”

”তা হলে তো আপনাদের দশ জনে খেলতে হবে। খেলা দেখে মনে হচ্ছে আরও গোটা দুই গোল খাবেন।”

”ভাগ্যে থাকলে খাব, কী আর করা যাবে!” প্রবোধ আকাশের দিকে তাকাল।

”একটা কাজ করুন, আমি একটা ছেলে দিচ্ছি তাকে নামান। এমনিই তো দশজন হয়ে গেছেন, একটা প্লেয়ার মাঠে থাকলে লাভ বই ক্ষতি তো হবে না!” অনিরুদ্ধ মরিয়া হয়ে ফাটকা খেলার মতো বলল।

নির্মল ঘোষ অবাক হয়ে বলল, ”কে ছেলে? কোথায়?”

অনিরুদ্ধ পেছন ফিরে দেখল অলুর কোনও কথায় বোধ হয় কুড়োন হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে গেল।

”ওই ছেলেটা। বুট, প্যান্ট লাগবে না শুধু একটা জার্সি দিন।” বলেই কুড়োনের দিকে এগিয়ে গেল।

অনিরুদ্ধকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে কুড়োন অভিমানী গলায় বলল, ”মামা, সকলরে সফট ড্রিঙ্কস দেছে আমাদের দেয় নাই।”

”কুড়োন।” অনিরুদ্ধ কঠিন গম্ভীর স্বরে বলল, ”আমি যা বলব এখন একটিও কথা না বলে তুই তাই করবি। জামা খোল। এরা যে জার্সি দিচ্ছে সেটা পর, পরে মাঠে নাম।”

কুড়োন হকচকিয়ে তাকিয়ে রইল।

অনিরুদ্ধ মৃদু স্বরে প্রবোধকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি জার্সিটা এনে দিন।”

”মামা, আমারে এখন খেলতে বলছেন?”

”বলছি।”

”কী জইন্য?”

”তোর ওপর আমার বিশ্বাসের সম্মান রাখার জন্য। তুই ইচ্ছে করলে ম্যাচটা বার করে আনতে পারবি, এই আমার বিশ্বাস। পারবি?”

”মামা, এমন কথা কেউ আমারে কোনওদিন কয় নাই।”

কুড়োনের গলা ভারী হয়ে এল, চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল, চোখে বিহ্বল চাহনি।

”পারবি?”

”চেষ্টা করব।”

অনিরুদ্ধ প্রায় ছুটে ডায়াসে চেয়ারে এসে বসল। অশোক ভদ্র জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকাল। ”নরেনকে কি ওরা বসাচ্ছে?”

”হ্যাঁ। বসাতে বলে এলুম।”

”কাকে নামাবে?”

”কেউ একজন হবে।” অনিরুদ্ধ গা—ছাড়া উত্তর দিল। দু’দলের খেলোয়াড়রা তখন মাঠে নেমে পড়েছে, দর্শকরা সবই স্থানীয়, তারা দেখল নরেনের বদলে অচেনা একটা কিশোরকে। গুঞ্জন উঠল: ‘এ আবার কে!’ ফল তখন এক—এক।

কিক—অফের সঙ্গে সঙ্গে নারিকুল বল পাঠাল চণ্ডীপুরের ডান কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে। রাইট আউট আগেই দৌড় শুরু করেছিল, বলটা ধরে সে লেফট ব্যাককে কাটিয়েই গোলমুখে উঁচু করে পাঠাল। দ্বিধাগ্রস্ত গোলকিপার কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করে বেরোবার আগেই নারিকুলের স্ট্রাইকারের হেড গোলে ঢুকে গেল। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গোল। তাজ্জব, মাঠে টুঁ শব্দটি নেই। নারিকুল এক গোলে এগিয়ে গিয়ে মাঝমাঠটা দখল করে নিল।

সি এ সি গোলটার ধাক্কা সামলাতে না পেরে এলোমেলো খেলছে। কুড়োন সামনে উঠেছিল। এতক্ষণ একটা বলও পায়নি। এবার সে নেমে এসে পায়ে বল রেখে নিজের টিমকে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করতে লাগল।

”এই ছেলেটাকে শুরু থেকে খেলায়নি কেন!” অশোক ভদ্র মন্তব্য করল। ঝুঁকে ডায়াসের পাশে দাঁড়ানো একজনকে জিজ্ঞেস করল, ”ছেলেটা কে?”

বিব্রত মুখে লোকটি বলল, ”বলতে পারব না। এখানকার কেউ নয়।” বলেই সে পাশের লোককে জিজ্ঞেস করল, ”চেনেন নাকি?” সেই লোকটিও মাথা নাড়ল।

অনিরুদ্ধ একমনে কুড়োনকে দেখে যাচ্ছিল। বল চেয়েও বল পাচ্ছে না, বল দিয়ে বল ফেরত পাচ্ছে না। মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। অবশেষে মাঝমাঠে একটা বল পেয়ে সে সামনে অনেকটা খোলা জমি দেখে বলটা ঠেলে দিয়েই ছুটতে শুরু করল। দু’দিক থেকে দুজন ছুটে এল ওকে বাধা দিতে। একজন বলের দিকে বেপরোয়া পা চালাল পাশ থেকে, কুড়োন টুক করে বলটা সরিয়ে নিয়েই ছুটল, সামনে এসে গেল দ্বিতীয় জন। ছোটার গতি একই রকম রেখে শরীরটা একটু পাশ ফিরিয়ে দ্বিতীয়জনের গা ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়ে তাকে পেছনে ফেলে দিল।

অনিরুদ্ধ সামনে ঝুঁকে টেবল ক্লথ আঁকড়ে ধরে বলে উঠল, ”এবার গোল হবে।”

অশোক ভদ্র আর এস.ডি.ও. তার মুখের দিকে তাকাল।

কুড়োনের সামনে এখন স্টপার। ট্যাকলিংয়ে না গিয়ে স্টপার পিছিয়ে যাচ্ছে, কুড়োনকে কাছে আসতে দিচ্ছে, মোক্ষম সময়ে চূড়ান্তভাবে বাধা দেবে। কুড়োন তার চার হাতের মধ্যে এল, প্রায় মুখোমুখি হয়ে সে শরীরটাকে ডাইনে বাঁয়ে দ্রুত নাড়িয়েই স্টপারের দু’ পায়ের ফাঁক দিয়ে বলটা গলিয়ে দিল।

”আশ্চর্য তো!” এস.ডি.ও.—র মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল কথাটা।

”অবিশ্বাস্য, একদৌড়ে তিনজনকে!” অশোক ভদ্র স্তম্ভিত।

স্টপার ঘুরে গিয়ে কুড়োনকে যখন তাড়া করল তখন সে পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া গোলকিপারের পাশ দিয়ে বলটাকে গোলে ঠেলে দিয়েছে।

সারা মাঠের দর্শকরা হতভম্ব চোখে কুড়োনের কাণ্ড দেখছিল। গোলটা হতেই কয়েকটি ছেলে পাগলের মতো মাঠের মধ্যে ছুটে এসে কুড়োনকে জড়িয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করল।

”গোল হবে তুমি জানলে কী করে?” অশোক ভদ্র কৌতূহল মেটাতে জানতে চাইল।

অনিরুদ্ধ ঠোঁট টিপে রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ”জ্যোতিষবিদ্যা।”

”তা হলে বলো ম্যাচের রেজাল্ট কী হবে?”

”চণ্ডীপুর জিতবে। ওই কুড়োনই জেতাবে।”

”কুড়োন!” অশোক ভদ্র তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধর মুখের দিকে।

”নামটা জানো, তার মানে ওকে চেনো।”

”চিনি।”

খেলা আবার শুরু হয়ে গেছে। ম্যাচের ফল দুই—দুই। মাঠ ঘিরে ঝোড়ো আওয়াজ ওঠে, যখনই কুড়োন বল ছোঁয়। তাকেই শুধু বল দিতে চায় দলের খেলোয়াড়রা। আর নারিকুলিরা সযত্নে চেষ্টা করে যায় বল নিয়ে সে যেন এক পা—ও না এগোতে পারে। নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য কুড়োন অবিরত ঘোরাফেরা করে চলেছে। কিন্তু ছিনে জোঁকের মতো একজন তার সঙ্গে সর্বদা লেগে রয়েছে। চণ্ডীপুরিরা এখন ভীষণ উদ্দীপ্ত হয়ে বাধা দিয়ে চলেছে অবশ্য গোল করার ইচ্ছাটা জাগিয়ে রেখে।

অশোক ভদ্র ঘড়ি দেখে বলল, ”আর চার মিনিট বাকি, মনে হচ্ছে ড্র হবে। তোমার জ্যেতিষবিদ্যা এবার আর কাজ দিল না।”

অনিরুদ্ধ চুপ করে রইল। ঠিক তখনই একটা বল ধরার জন্য কুড়োন ছুটল। তার সঙ্গে লেগে থাকা খেলোয়াড়টি ওর সঙ্গে ছুটতে গিয়ে যখন বুঝল ওকে আর ধরা যাবে না তখন নিরুপায় হয়ে ট্রিপ করে ফেলে দিল পেনাল্টি এলাকার দু’গজ বাইরে।

অবধারিত ফ্রি—কিক দিলেন রেফারি। অনিরুদ্ধ নড়েচড়ে বসে মনে মনে ভগবানকে ডাকল—কুড়োন যেন ফ্রিকিকটা মারে। ভগবান বোধ হয় প্রার্থনাটা শুনলেন এবং মঞ্জুর করলেন। বসানো বলটা থেকে দশ হাত দূরে চারজন নারিকুলি পাঁচিল দিয়ে দাঁড়াল। চণ্ডীপুরের লেফটব্যাক এসেছে শট নিতে। কুড়োন হাত নেড়ে তাকে সরিয়ে কী যেন বলতে সে চারজনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে পঞ্চমজন হয়ে দাঁড়াল। গোলকিপার ক্রসবারের এধার—ওধার সরে—সরে বলটাকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে আর চেঁচিয়ে পাঁচিলটাকে সাজিয়ে নিচ্ছে।

”মনে আছে কি ওয়ার্ল্ড কাপে ব্র্যাঙ্কোর ফ্রিকিকটা, যাতে ব্রাজিল হারিয়েছিল হল্যান্ডকে?” অনিরুদ্ধ ধীরভাবে বলল। ”এবার পেরাকটিস করা সেই কিকটা দেখবে।”

”হুমম।” অশোক ভদ্র মাঠ থেকে চোখ সরাল না। কুড়োন কিক নিতে যাচ্ছে।

পাঁচ সেকেন্ড পর বলটা উড়ল। পাঁচিলের পঞ্চমজন হঠাৎ বসে পড়ায় যে ফাঁকা জায়গাটা তৈরি হল সেখান দিয়ে উড়ে গিয়ে বলটা অপ্রত্যাশিত বাতাসে বাঁক নিয়ে গোলকিপারের অবাক চোখের সামনে দিয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে গেল, গোলের পেছনের জাল বলটাকে ধরবে বলে যেন অপেক্ষা করছিল। অনিরুদ্ধ মাথা নামিয়ে কপালটা টেবলে দু—তিনবার ঠুকল।

এস.ডি.ও হাতঘড়িটা খুলে টেবলে রেখে বললেন, ”এটা আজ ওকে আমি দেব।”

নির্মল ঘোষ পড়িমরি সিঁড়ি ভেঙে ডায়াসে উঠে অনিরুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলে যেতে লাগলেন, ”তোমার জন্য আমরা জিতব, তুমিই ওকে নামাতে বলেছিলে।”

অশোক ভদ্র শুধু তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধর মুখের দিকে।

মাঠের মধ্য থেকে উন্মত্ত দর্শকদের বার করে দেওয়ার দু’মিনিট পরই রেফারি খেলা—শেষের বাঁশি বাজালেন। এর পর জনতা মাঠে নামল, অনিরুদ্ধ আর কুড়োনকে দেখতে পেল না।

”ছেলেটা এখানে এল কী করে?” অশোক ভদ্র প্রশ্ন করল।

অনিরুদ্ধ বলল, ”আমার সঙ্গে এসেছে। আমাদের ওখানেই থাকে।”

”ওর বাড়িতে কে কে আছে?”

”কেউ নেই, ও একা।”

”তার মানে!”

”বাবা—মা মরে গেছে, ছিল এক দাদামশাই, সেও মরে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই কুড়োন একা। ওর অবলম্বন, আশ্রয় যাই বলো সেটা হল ফুটবল।”

”ভালই হল, ওকে আমি সাই—তে নেব।”

.

মোটরে কলকাতা ফেরার সময় অনিরুদ্ধ চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল মিনিট দশেক। অলু আর কুড়োন নাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছে, কখনও হাসতে হাসতে ওরা নুয়ে পড়ছে। ওদের কোনও কথা তার মাথায় ঢুকছে না। শুধু তার কানে বাজছে অশোক ভদ্রর কথাটা : ”ওকে আমি সাই—তে নেব।” একটা হিরে সে প্রায় কুড়িয়েই পেয়েছিল, অনুজ্জ্বল সাধারণ একটা কাচের ঢেলার মতো, সেটাকে সে যথাসাধ্য পরিষ্কার করে সবে কাটতে শুরু করেছে আর তাইতেই যে আলো ঠিকরে বেরিয়েছে, জহুরি তার বাহার দেখতে পেয়েছে। আরও কেটেকুটে পালিশ করে নিলে ভবিষ্যতে সেই আলো ঝকঝক করে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। এই হিরেটাকে সে কি হাতছাড়া করবে? পৃথিবীতে কত বড় বড় ফুটবলার এসেছে, তাদের প্রথম আবিষ্কারকের নাম কে মনে রেখেছে? কুড়োন মণ্ডল ভারতবিখ্যাত হওয়ার পর সবাই বলবে ও সাই—এর আবিষ্কার। কেউ জানবে না ওকে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সে কীভাবে চেষ্টা করেছে। কাঁটা বেঁধার মতো একটা খচখচানি সে বুকে অনুভব করল।

”আচ্ছা মামা, এই ঘড়িটার দাম কত?”

কুড়োন হাতের মুঠোয় এস.ডি.ও—র দেওয়া ঘড়িটা ধরে রয়েছে।

তুমুল হাততালির মধ্যে ওর হাতে পরিয়ে দিতেই ঘড়িটা কব্জি থেকে নেমে পড়ে যাচ্ছিল, কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল অলু, ঘড়িটা তার হাতে দেয় রাখার জন্য।

”অলু কয় দুই—তিন হাজার টাকা, সত্যি?”

”হতে পারে।” অনিরুদ্ধ আবার বাইরে তাকাল।

”এত দামি ঘড়ি নিয়া আমি কী করব। এটা আপনি নেন।”

অনিরুদ্ধ জবাব দিল না। একটু পরে তার হাতে কঠিন একটা ছোঁয়া পেতেই মুখ ঘুরিয়ে দেখল কুড়োন ঘড়িটা তার হাতে ঠেকিয়ে রয়েছে।

”আমি নেব কেন, তুই খেলে পেয়েছিস, এটা তোর জিনিস।”

”না, এটা আপনার। আপনিই তো শট মারা শিখাইছেন, নয়তো গোলটা দিতা পারতাম কি? আমি তো শুধু পেরাকটিস করা গেছি।”

”আচ্ছা কুড়োন,” অনিরুদ্ধর মুখে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল, ”আচ্ছা কুড়োন, দশ বছর পর তোর এসব কথা মনে থাকবে? কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি তো আমি তোকে শট মারা শিখিয়েছি!”

কুড়োনের ঠোঁটে দেখা দিল ক্ষীণ একটা হাসি, চোখে হালকা অভিমান, ”কী যে কন। দশ বছর কেন, মরণকাল পর্যন্ত বলব কুড়োনরে খেলা শিখাইছে তার মামা।”

”তা হলে দে।” অনিরুদ্ধ কুড়োনের হাত থেকে ঘড়িটা তুলে নিল। ”মামা গুরুজন তার কথা অমান্য করতে নেই।” কুড়োনের শীর্ণ হাতটা টেনে নিয়ে সে ঘড়িটা ওর হাত গলিয়ে ব্যান্ডটা এঁটে দিল। ”তোর মামা এটা তোকে দিল, এটা রেখে দিলে জানব আমাকে তুই মনে করে রাখবি।”

অনিরুদ্ধ এর পর অবাক হয়ে দেখল কুড়োনের চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। আশ্চর্য, কুড়োন কাঁদতেও পারে! তার মনে পড়ল অনেকদিন আগে সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কখনও কেঁদেছিস? জবাব দিয়েছিল, কেঁদেছি বলে তো মনে পড়ে না। বাবা, মা, দাদু, মারা যেতেও কাঁদেনি, বয়স এত কম ছিল যে মরা কী জিনিস তাই বোঝেনি। বলেছিল ‘কান্না আসবে কী করে?’ তখন সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এখন বুঝিস?’ তাইতে কুড়োন উত্তর দেয়, ‘না। এখন তো কেউ মরে নাই, মরলে বুঝতে পারব।’

অনিরুদ্ধ চমকে উঠল, কে এখন মরল যে কুড়োনের চোখে জল এল? ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে—থাকতে তার মনে হল কুড়োন বড় হয়ে উঠছে, ওর অতীত মরে যাচ্ছে, অনিশ্চিত ভাবটা আর মুখে নেই, তার বদলে ফুটে উঠেছে প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস। কুড়োনকে এবার বাইরের জগতে ঠেলে দেওয়ার সময় এসেছে।

হাওড়া ময়দানের পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। অলুর হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে কুড়োন বলল, ”আমার কাছে রাখার জায়গা নাই, এখন এটা তোর কাছে থাক। মাসিমারে দিস, তুলে রাখবে।”

অনিরুদ্ধ বলল, ”অশোকের সঙ্গে কথা হয়েছে, পরশু সকালে তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব, তৈরি থাকিস।”

জীবন অনন্ত

জীবন অনন্ত – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

।। এক ।।

”কাল খবরের কাগজে কী হেডিং বলতে পারিস?”

”পারি।”

”কী হবে?”

”শেষ বলে বান্ধব সমিতির নাটকীয় জয়।”

”বাজে হেডিং।”

”তা হলে, সি এ বি নকআউটের রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তি।”

”আরও বাজে।”

”তা হলে….”

জীবন খোলা বুটজোড়া পাশে সরিয়ে রেখে পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে অনন্তর মুখের দিকে তাকাল। ঘামে—ভেজা জামাটা খোলার জন্য অনন্ত মাথা হেলিয়ে টেনে বার করতে কুঁজো হয়েছে, সেই অবস্থাতেই বলল, ”আজকাল সাহিত্য করে খেলার হেডিং হয়।” তারপর হাত থেকে জামা ছাড়াতে বলল, ”জীবনের ছক্কায় বান্ধবের জীবন লাভ, কিংবা জীবনের হাতে অগ্রগামীর জীবনান্ত।”

”এর থেকে বাজে আর কিছু হতে পারে না।” জীবন জোড়া—পা সামনের খালি চেয়ারে তুলে দিল। ”এরকম নাম বাচ্চচাদের অ্যাডভেঞ্চার গল্পের হয়।”

”চানটা করে আসি তারপর হেডিং বলব।” অনন্ত কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে প্যান্ট খুলতে লাগল।

”আরে দাঁড়া, দাঁড়া, আমি আগে। যা গরম পড়েছে। মে মাসের দুপুরে ক্রিকেট খেলা? অন্তু প্লিজ, আমি চান করে এলে তুই যাস।”

জীবন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছ’ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, আটষট্টি কিলোগ্রাম ওজনের দেহটা যেন ছাড়া পাওয়া স্প্রিংয়ের মতো টান হয়ে উঠল। স্নানের ঘরের দিকে সে পা বাড়াবার আগেই অনন্ত ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ”হেডিং কী হবে জানিস? জীবন রঞ্জি দলে আসার দাবি রাখল।”

”সিজন শেষ হয়ে গেল আর এখন দাবি রাখা!”

”সামনের সিজনে এই পারফরম্যান্স কাউন্ট করবে বেঙ্গল টিম সিলেকশনের সময়।” ভিতরে শাওয়ার থেকে জল পড়ার শব্দ ছাপিয়ে অনন্তর গলা ড্রেসিংরুমে পৌঁছল।

জীবনের মুখে হালকা হাসি আর বেদনা একই সঙ্গে ভেসে উঠল। বারো বছর বয়স থেকে টেস্ট ম্যাচ খেলার স্বপ্ন সে দেখছে। গত বছর আটটা আর এ—বছর এগারোটা সেঞ্চুরি করেছে স্থানীয় ক্রিকেট—ম্যাচে। কিন্তু এখনও সে বাংলার হয়ে প্রথম শ্রেণীর একটা ম্যাচও খেলার সুযোগ পায়নি। জাতীয় নির্বাচকরা তার খেলা না দেখলে তাঁদের বিবেচনায় সে আসবে কী করে?

খেলা শেষ হতেই সি এ বি—র ক্লাব হাউসে বান্ধব সমিতির ড্রেসিংরুমে প্রায় একঘণ্টা ধরে তুমুল উচ্ছ্বাস চলেছিল। এখন নির্জন। একে একে সবাই বান্ধব সমিতির তাঁবুতে চলে গেছে। আনন্দ করার জন্য যা কিছু—ভূরিভোজ, পটকা ফাটানো, মালা পরানো, উপহারের প্রতিশ্রুতি, পতাকা তোলা—এখন ক্লাবেই হবে।

ঘরে এখন ক্লাবের মালি মোহন। খেলার সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে লম্বা ব্যাগে ভরায় ব্যস্ত। কয়েকদিন পরই তাদের পি. সেন ট্রফির খেলা। খেলার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রগুলো কেউ আর আজ বাড়ি নিয়ে যাবে না। জীবন জানলায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়েই ভ্রূ কোঁচকাল।

”মোহনদা, আকাশের অবস্থা দেখেছ?”

”কালবোশেখি আসছে।”

পশ্চিমে গঙ্গার ওপারে কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। চিলের মতো তিন—চারটে পাখি শাঁ—শাঁ করে নীচের দিকে নেমে আসছে। বাতাস থমথমে। মেঘ যেন পুবের দিকেই এগিয়ে আসছে। গত তিন—চার দিন গুমোট ভ্যাপসা ছিল। কলকাতার মানুষ বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করেছে। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে সুযোগ পেলেই প্রতি বছর সকলে তাই বলেছে, এরকম গরম আর কখনও পড়েনি। অবশেষে বৃষ্টির কালো ঝাণ্ডা উঠেছে আকাশে। কালবোশেখির কুচকাওয়াজ এগিয়ে আসছে। জীবন ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে প্রেসিডেন্টস এনক্লোজারে এসে দাঁড়ানোমাত্র ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রথম ঝলকটা মুখে লাগল।

”আহহ।” আপনা থেকেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল স্বস্তির শব্দ। আজ শেষ বলে ছয় মেরে সে এক উইকেটে তার ক্লাব বান্ধব সমিতিকে জিতিয়ে দেবার সময় ঠিক এইরকমই একটা আওয়াজ তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়েছিল। সেটা ছিল প্রচণ্ড টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বস্তি। তার আগের ওভারেই সে সেঞ্চুরিটা পূর্ণ করেছিল।

আজ গরম কত ডিগ্রি হবে মনে হয়? জীবন চোখ বন্ধ করে মুখটা ঠাণ্ডা বাতাসের স্রোতে রেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করল। কাল ছিল ঊনচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাবা বলেছিলেন, ‘এভাবে খেলার কোনও মানে হয় না। কেউই তার সেরা জিনিস বার করে আনতে পারবে না এ অসহনীয় অবস্থায়। তা ছাড়া শরীরেরও ক্ষতি করবে। রঞ্জি ট্রফির নকআউট পর্যায়ের আগে এইসব খেলা হলে তবু তার মূল্য থাকে, এইসব খেলায় কেউ ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়ে টিমে আসতে পারে। কিন্তু বাংলা তো কোয়ার্টার ফাইনালেই আউট হয়ে গেছে, তা হলে এখন এই ঝাঁ—ঝাঁ গরমে টুর্নামেন্ট খেলে লাভ কী? তবু রক্ষে জে.সি. মুখার্জি ট্রফিতে সেমিফাইনালে হেরে বেঁচে গেছিস, ফাইনালটা খেলতে হবে না।’ জীবন তখন মৃদুস্বরে বাবাকে বলে, ‘সেমি—ফাইনালে অগ্রগামীর কাছেই সাত উইকেটে হারের বদলাটা নেওয়া দরকার। আমাকে যে রান—আউটটা দেয়, সেটা যে…’ সে থেমে গেছল। থেমে যাওয়ার কারণ, অন্তুর একটা কথা মনে পড়ায়। রান—আউট হয়ে ফিরে গিয়েই ব্যাটটা ছুঁড়ে ফেলে সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ”জোচ্চচুরি, জোচ্চচুরি, ক্রিজের ছ’ ইঞ্চি ভেতরে ব্যাট ফেলার তিন—চার সেকেন্ড পর বলটা উইকেটে লাগল।” তখন অন্তু দুটো হাত তার দু’ কাঁধে রেখে বলেছিল, ‘আউট হয়ে কখনও অভিযোগ করিসনি। মাথার উপর ঈশ্বর আছেন। আম্পায়ার ভুল করতেই পারেন। তিনি তো মানুষ। উপরের ওই লোকটা মানুষের ভুল শুধরে দেন। ক’দিন পরে এদের সঙ্গেই তো নকআউট ফাইনাল। উনি যদি তোর দুঃখের কারণটা বুঝে থাকেন তা হলে তোকে দেখবেন। কিন্তু কখনও আর কমপ্লেন করিসনি। তা হলে টেস্ট খেলার মতো লেভেলে যেতে পারবি না।’

জীবন এখন ক্লাব হাউস থেকে মাঠ আর বিশাল স্ট্যান্ডের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে হাসল। উপরের ওই লোকটাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে আকাশের দিকে মুখ তুলল। ঘন মেঘ দ্রুত ধেয়ে আসছে, চারদিকে অন্ধকারের ছায়া ঘিরে ধরছে। গাছের মাথা পাগলের মতো দুলছে। পাখিরা ডানা ঝাপটাতে—ঝাপটাতে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। জীবনের বুকটা কেঁপে উঠল অজানা ভয়ে। ঈশ্বর কি এভাবেই দেখা দেন? বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে নমস্কারের ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে রইল।

”কী রে, কতবার ডাকলুম—ম্যাচ জিতিয়েছিস বলে কি প্রশংসা ছাড়া আর কিছু কানে ঢোকাবি না? এতক্ষণ ধরে তো পিঠ—চাপড়ানি খেলি, যা, এবার পিঠটা ঠাণ্ডা করে আয়।”

”আচ্ছা, অন্তু তুই ঈশ্বর—বিশ্বাসী না?”

”বাবা বলতেন, কোথাও একটা বিশ্বাস রাখবে। সেটা নোঙরের মতো কাজ করবে, তোমাকে ভেসে যেতে দেবে না। বিশ্বাসটা ঈশ্বরে রাখতে পারো, জন্মভূমিতে রাখতে পারো, দেশের মানুষের উপর রাখতে পারো, বন্ধুত্বের উপরও রাখতে পার।”

”তুই কোনটাতে রাখিস?”

”সব ক’টাতেই।”

শব্দ করে বৃষ্টির বড়—বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। এলোমেলো হাওয়ার ঝাপটায় জলকণা এসে লাগছে ওদের অনাবৃত দেহে। জীবন জ্বলজ্বল চোখে দু’হাত বাড়িয়ে হঠাৎ ”ইয়াহুউউ” বলে চিৎকার করে উঠে ছুটল সিঁড়ির দিকে। লোহার দরজাটা দড়াম করে খুলে দোতলা থেকে মাঠে নামার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে ছুটতে—ছুটতে মাঠের ঘাসের উপর গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মুখ তুলে অনন্তর দিকে তাকিয়ে সে দু’হাত মাথার উপর তুলল।

”অন্তু, আমি টেস্ট খেলব,” চিৎকার করে জীবন আবার বলল, ”শুনতে পাচ্ছিস অন্তু, আমি টেস্ট খেলব। ঈশ্বর খবর পাঠিয়েছেন, আমি টেস্ট খেলব।”

অঝোর বৃষ্টির শব্দ ছাড়া অনন্ত শুনতে পাচ্ছে না আর কিছু। উদ্বিগ্নস্বরে সে চেঁচিয়ে বলল, ”ভিজিস না। নিউমোনিয়া হবে।”

ফাঁকা ইডেন মাঠে ঝাপসা দেখাচ্ছে জীবনকে। সে মাঠে গড়াগড়ি দিচ্ছে পুলকে, আনন্দে।

”জীবনের হল কী! পাগল—টাগল হয়ে যাবে নাকি?”

মোহন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

অনন্ত মাথা নেড়ে বলল, ”দেখো মোহনদা, জীবন একদিন টেস্ট খেলবেই।”

”আর তুমি?”

হেসে মাথা নাড়ল অনন্ত এমনভাবে যার অর্থ বোঝা শক্ত।

”জীবনের স্কুটারটা নীচে রয়েছে। এতক্ষণে ভিজে সেটার যে কী অবস্থা হল কে জানে। আমি নীচে যাচ্ছি, ওটাকে সরিয়ে কোথাও ঢাকা জায়গায় রাখতে হবে।”

একতলায় যাবার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়েও অনন্ত একবার ঘুরে তাকাল। ঝাপসা বৃষ্টির মধ্যে দেখতে পেল পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির, অর্থাৎ তার থেকে ঠিক এক ফুট খাটো মাথার জীবন চিত হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে দু’ হাত ছড়িয়ে শুয়ে। নিথর একটা মৃতদেহের মতো। তার বুকের মধ্যে পলকের জন্য ধক করে উঠল।

আধঘণ্টা পর বৃষ্টি থামতে বান্ধব সমিতির তাঁবুর দিকে ওরা রওনা হল। বৃষ্টিতে ভিজলেও স্কুটারের এঞ্জিন গোলমাল করেনি। সি এ বি ক্লাব হাউস থেকে তাঁবু তিন মিনিটের পথ। জীবন আকাশবাণীর সামনের গোলাকার ভূখণ্ডটি খুব জোরের উপর কাত হয়ে ঘুরল। পিছনে বসা অনন্ত তার কাঁধটা খামচে ধরে বলল, ”অত স্পিডের ওপর টার্ন করাসনি, বৃষ্টিতে রাস্তা পেছল হয়ে আছে।”

জীবন জবাব দিল না, স্পিডও কমল না। অনন্ত আর কিছু বলল না। জীবন এভাবেই চলে সর্ব ব্যাপারেই। সেটা ওর ব্যাটিংয়ের মধ্যেও ফুটে ওঠে। ঝুঁকি নিয়ে অদ্ভুত সব শট নেয় যা বিশুদ্ধবাদীদের ভ্রূ তুলে দেয়। তারা হতাশায় মাথা নাড়ে আর বলে, এভাবে খেললে বেশিদূর এগোতে পারবে না, টেস্ট লেভেলে যেতে পারবে না।” অথচ জীবন ঝুড়ি—ঝুড়ি রান পায়, সেঞ্চুরি পায়!

অনন্তও একবার বলেছিল, ”শুনছিস তো তোর সম্পর্কে কী বলা হচ্ছে? তোর বিগম্যাচ টেম্পারামেন্ট নেই।” জীবন অবাক হবার ভান করে বলেছিল, ”বিগ ম্যাচটা খেললাম কোথায় যে আমার টেম্পারামেন্ট মাপা হয়ে গেল! ব্যাটসম্যানের কাজটা কি মাঠে নেমে টেম্পারামেন্ট দেখানো না রান তোলার কাজ করা? ব্যাটিংটাকে আমি সহজ—সরলভাবে বুঝি মারার বল পেলেই মারো। যেটা মারতে পারবে না সেটা ছেড়ে দাও বা আটকাও। টেম্পারামেন্টওয়ালারা এই শেষের কাজ দুটোয় খুব ভাল, প্রথমটায় কুঁকড়ে থাকে। ফলে জেতার ম্যাচ হারি।”

”আর হারার ম্যাচ বাঁচায়।”

”আমি হারার বা ড্র করার চিন্তা নিয়ে খেলার মাঠে আসি না।”

আজ জীবনই ম্যাচটা জিতিয়েছে। সাতষট্টি বলে সেঞ্চুরিই শুধু নয়, সমিতির ইনিংস একসময় সাত উইকেটে ছিল একান্ন। সেখান থেকে একশো বাহাত্তরে টেনে নিয়ে গেছে জীবন।

তাঁবুতে তখন হই—হুল্লোড় ঝিমিয়ে এসেছে। ওদের দুজনকে দেখে আবার সেটা জেগে উঠল। অনন্ত একত্রিশ রানে একটি উইকেট পেয়েছে, একটি রান আউট হয়েছে মিড উইকেট থেকে তার ছোঁড়া বলে। তার পিঠে একটা—দুটো আলতো চাপড় ছাড়া আর কিছুই জুটল না। সেজন্য অনন্ত কিছু মনে করল না। আজ সবাইকে ছাপিয়ে একজনই নায়ক। ক্রিকেট সেক্রেটারি বাদল দে তার দামি ঘড়িটা হাত থেকে খুলে জীবনের ডান হাতে পরিয়ে দিল।

”এ কী এ কী, আ রে বাদলদা, আমার যে হাতে ঘড়ি রয়েছে। আর একটা দিয়ে কী করব?”

”দু’হাতে দুটো পরবি। পাকিস্তানে গাওস্কর একটা টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি করায় ম্যানেজার গায়কোয়াড় তাঁর ঘড়িটা উপহার দিয়েছিলেন। আমিও তোকে দিলুম।”

উজ্জ্বল মুখে বাদল দে থুতনি তুলে চারপাশে তাকাল। এই বারই প্রথম ক্রিকেট সেক্রেটারি হয়ে একটা ট্রফি জেতা মানে সে লাকি সেক্রেটারি। সবার চোখ তাকে বাহবা দিচ্ছে। একজন বলেই ফেলল, ”ইনসেনটিভ না দিলে ছেলেরা খেলবে কেন? নেক্সট রয়েছে পি সেন ট্রফির খেলা। যার পারফরম্যান্সে ট্রফি জিতব তাকে আমি একটা সোনার আংটি দোব।”

প্রশংসার মৃদুগুঞ্জন উঠল।

জীবন তার দুটো হাত তুলল। দু’হাতেই ঘড়ি। ”কী মুশকিলে পড়লাম। কোন হাতেরটায় সময় দেখব গায়কোয়াড়দা?

অনন্ত চাপা গলায় বলল, ”গাওস্করকে জিজ্ঞেস করে নিস।”

”তার সঙ্গে আমার দেখা হবার কোনও আশাই নেই। যখন আমি বেঙ্গল টিমে চান্স পাব, ততদিনে গাওস্কর ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট থেকে রিটায়ার করে যাবে।”

”কে বলল বেঙ্গল টিমে ঢুকতে তোর দেরি হবে? সামনের সিজনেই আসছিস, লিখে রাখ। দু’ সিজনে উনিশটা সেঞ্চুরি, এখন কার আছে?” বাদল দে হঠাৎ চিৎকার করে তাঁবুটাকে নীরব করে দিল। অনন্ত একটা সফট ড্রিঙ্কসের বোতল নিয়ে চুপিচুপি তাঁবুর বাইরের চাতালে এসে দাঁড়াল।

ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। স্যাঁতসেঁতে ভাব রয়েছে বাতাসে। সন্ধ্যা এরই মধ্যে কোন এক ফাঁকে নেমে আসবে। বৃষ্টির জলে ধুলো ধুয়ে গিয়ে গাছের পাতা সবুজে গাঢ় হয়ে উঠেছে। দূরে রাস্তায় অল্পস্বল্প জল জমে। মা এতক্ষণে কলেজ থেকে বাড়ি পৌঁছে গেছে। সকালে বেরোবার সময় অনন্ত যখন প্রণাম করে, মা বাধা দিয়ে বলেছিলেন, ”আগে ওনাকে কর।” বসার আর খাবারের জন্য ছোট দালানটার দেওয়ালে বাবার রঙিন ছবি। বেলফুলের বাসী একটা মালা তাতে ঝুলছে। চারদিন আগে বাবার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল।

ছবিতে কপাল ঠেকিয়ে অনন্ত যা বলেছিল, সেটাই এখন তার মনে পড়ছে। ”আমি তোমার সব কথা মনে রেখেছি বাবা। আমি পরিশ্রম করব, অপেক্ষা করব।” তারপর মুখ ফিরিয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে সে দ্যাখে, বাবার ছবির দিকে মা নির্নিমেষে তাকিয়ে, একটা সুন্দর হাসি চোখ দুটি থেকে ঝরে পড়ছে। সে মাকে প্রণাম করল।

”অন্তু, খেলায় হারজিত আছে। যাই হোক না কেন, তোর বাবা যা বলতেন সেটাই বলব, চেষ্টা করবি, হাল ছাড়বি না।”

অনন্ত আজ হাল ছাড়েনি। শুধু চেষ্টা নয় কিছুটা ভাগ্যও দরকার হয়। তার বলে দুটো ক্যাচ পড়েছে, সাত—আটবার ব্যাটসম্যানরা হেরে গেছে, তার পেসের কাছে কিন্তু স্টাম্পে বল লাগেনি। এজন্য সে নিজের উপরই রেগে উঠেছিল। প্রত্যেক ফাস্ট বোলারের মতো তারও ইচ্ছে করে স্টাম্প উড়ে যাওয়া দেখতে। কেন সে স্ট্যাম্পে বল লাগাতে পারছে না? তখন বাবার গলার স্বর যেন সে শুনতে পেয়েছিল, ”অন্তু তুমি পরিশ্রম করোনি। ফাস্ট বোলার হতে হলে অসম্ভব খাটতে হয়। লেংথ, আর ডিরেকশন নিয়ে কাজে অবহেলা করে তুমি শুধু পেসের উপরই জোর দিচ্ছ। ভুল করছ।”

হঠাৎ পিঠে একটা থাপ্পড় পড়ায় অনন্ত চমকে উঠল।

”একদৃষ্টে আকাশে তাকিয়ে কী করছিস, ধ্যান?”

জীবন উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হয়ে রয়েছে। তার হাতে সন্দেশের বাক্স। এগিয়ে ধরল। অনন্ত একটা তুলে নিল।

”বাদলদাকে সবাই ধরেছে পার্ক স্ট্রিটে ডিনার খাওয়াতে হবে। যাবি?”

”হোটেল—রেস্টুরেন্টে খেতে আমার ভাল লাগে না।”

”আমারও। কাঁটা—চামচ—ফামচ দিয়ে খাওয়া, মনে হয় যেন পেট ভরল না। বাবাকে সকালে মানিকতলা বাজার থেকে একটা কেজি দেড়েকের ইলিশ নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি, চল আমাদের বাড়ি।”

”এখন বোশেখ মাসে ইলিশ!”

”বাংলাদেশী, দুর্দান্ত টেস্ট।”

ইলিশের নামে অনন্তর জিভ আনচান করে উঠল। সে গলা নামিয়ে বলল, ”স্কুটারটা বার করে স্টার্ট দে, রেস্টুরেন্টে খেতে না গিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি দেখলে আটকে দেবে। চটপট কেটে পড়তে হবে।”

দু’জনে কেটেই পড়ল।

.

জীবনরা অবস্থাপন্ন। বাবার ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রাংশ তৈরির ব্যবসা। একবছর আগে কাঁকুড়গাছির নতুন বাড়িতে ওরা উঠে এসেছে। বাবা, মা আর দুটি ছেলে নিয়ে এই পরিবারটির সবাই তাদের উচ্চতার মতোই ছোট। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির উপর কেউ নেই। অনন্ত প্রথম দিনে নিজেকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেছিল। জীবনের বাবা দেবেনবাবু আমুদে প্রকৃতির মানুষ। অনন্তর মনের অবস্থাটা বুঝে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ”এ যে দেখছি গালিভার! লিলিপুটদের বাড়িতে এসে মুশকিলে পড়ে গেলে তো? ঠিক আছে, তোমার বসার জন্য একটা নিচু টুল কিনে রাখব আর আমাদের জন্য রণ—পা।” অনন্তর ভাল লেগে গেছল সবাইকেই। তারপর বহুবারই সে এসেছে গত দেড় বছরে। পিতৃহীন বলে অনন্তকে ওঁরা আলাদা স্নেহ যত্ন করেন, নিজেদের ছেলের মতো।

স্কুটারে আসার সময় অনন্ত বলল, ”তুই যখন ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ইডেনে নেমে গেলি তখন হঠাৎই প্রথম দিনের কথাটা মনে পড়ে গেছল, এ যে দেখছি গালিভার!”

জীবন মুখ ঘুরিয়ে বলল, ”কেন মনে পড়ল?”

”সুইফট তাঁর গালিভারস ট্র্যাভেলসে একটা কাল্পনিক জাতির নাম দিয়েছেন ইয়াহু।” অনন্ত ঝুঁকে জীবনের কানের কাছে মুখ রেখে বলল।

”তুই খুব বই পড়িস?”

”মাঝে—মাঝে পড়ি।”

”আমার পড়তে ভাল লাগে না।” বলেই গিয়ার বদলে জীবন স্কুটারের গতি বাড়াল।

”তুই স্পিড খুব ভালবাসিস।” অনন্ত বলল।

জীবন মাথাটা দোলাল শুধু।

”আজ স্পিড তুলিস না। বৃষ্টিতে রাস্তাটা ভাল নয়, বড্ড গর্ত রয়েছে।”

”আমার মুখস্থ। কোথায় কোথায় গর্ত আর ঢিপি আমার জানা আছে।”

বাড়িতে জীবনের ঘরটি দোতলায় পুব—উত্তর কোণে। ঘরের একটা দেওয়াল শুধু ক্রিকেটারদের রঙিন ব্লো—আপ ছবিতে ঢাকা। মাথায় খাটো ব্যাটসম্যানদের, যেমন ব্রাডম্যান, গাওস্কর, উইকস, বিশ্বনাথ, কালীচরণ প্রভৃতির ছবিই চোখে পড়বে সবার আগে। অগোছালো ঘর। অনন্ত বহুবার থেকে গেছে রাত্রে।

আজও তাকে থেকে যেতে বলেছিল জীবন। অনন্ত রাজি হয়নি। শুধুই ছ’টা ইলিশভাজা আর তেল দিয়ে ভাত মেখে সে খেয়েছে। দু’বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়েও ইলিশের গন্ধ হাত থেকে যায়নি। ডান হাতের তালুটা শুঁকতে—শুঁকতে অনন্ত বলল, ”আজ যা আনফিট হয়ে গেলাম কাকিমা, এখন পুরো এক হপ্তা লাগবে শরীর ঠিক করতে। সামনেই আর একটা টুর্নামেন্ট রয়েছে।”

”এই ক’টা ভাত খেয়েই শরীর বসে যায় যদি তা হলে বাপু খেলাধুলো করার দরকার নেই। তোমাদের যত রাগ এই ভাতের উপর, খেলেই নাকি আনফিট হয়ে যাবে!”

অনন্ত মিটমিটিয়ে হাসতে থাকল। আগে সে রাতে রুটি খেত, মাস ছয়েক হল দু’বেলাই রুটি খাচ্ছে। কিন্তু কাকিমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিপছিপে লম্বা ছেলেটা, তাঁর ধারণায় দুর্বল আর রুগণ শুধু পেট ভরে ভাত না খাওয়ার জন্যই। তিনি হাতা হাতা ভাত থালায় ঢালবেনই আর অনন্তও দু’হাত মাথায় তুলে, ”আনফিট হব, আনফিট হব” বলে করুণস্বরে ডাক ছাড়বে। আজও তাই হল। তবে একটা কথা অনন্ত যোগ করল, ”পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টের থেকে অনেক তৃপ্তি করে খেলাম, তাই না রে?”

বাদলদা’র দেওয়া ঘড়িটা ডান হাতে পরতে—পরতে জীবন বলল, ”বাঙালির কাছে মাছ—ভাতের থেকে সেরা খাদ্য পৃথিবীতে আর কিছু আছে নাকি?”

”অনন্ত রাত হয়ে গেছে আজ নাইবা গেলে।” কাকাবাবু টুথপিক দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বললেন।

”মা’কে বলে আসিনি, ভাববেন।”

”এত রাতে বাস পাবে কি?”

”বিধাননগর স্টেশন থেকে ট্রেনে দমদমায় গিয়ে বাকিটা হেঁটে চলে যাব।

জীবন ঘড়িতে সময় দেখে বলল, ”চল, তোকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

গেট থেকে স্কুটার বার করার সময় জীবন বলল, ”ফাঁসির খাওয়া খেয়েছি, পেট ব্যথা করছে।”

”তা হলে তুই পেছনে বোস, আমি চালাই।”

জীবন বিনা প্রতিবাদে পিছনে বসল। স্টার্ট দিয়ে ক্লাচ ছাড়তেই ঝাঁকুনি দিয়ে স্কুটারটা এগোল। অনন্তর হাত কেঁপে টলমল করে উঠল। সে থামিয়ে দিল এঞ্জিন।

”রেগুলার চালানো অভ্যেস নেই।” অপ্রতিভ হয়ে অনন্ত বলল।

”না চালালে অভ্যেস হবে কি করে, চালা এখন। কতবার বললুম একটা কিনে ফেল।”

অনন্ত আবার স্টার্ট দিয়ে সন্তর্পণে ক্লাচ ছাড়ল। মসৃণভাবে স্কুটার যাত্রা শুরু করল।

”মা রাজি নন। টু হুইলারে মা’র ভীষণ ভয়। কলকাতায় রাস্তার যা দশা, এসব গাড়ি চালান উচিত নয়।”

”অত ভয় করলে তুই কোনওদিনই ফাস্ট বোলার হতে পারবি না। আমিও কোনও দিন ফাস্ট বোলিং ফেস করতে পারব না।”

অনন্ত জবাব না দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ ও মন নিবদ্ধ রাখল। বৃষ্টির জল রাস্তা থেকে এখনোও সরেনি। ফুটপাথ থেকে মাঝ—বরাবর রাস্তা জলে ডুবে। শুধু মাঝখানটায় কালো শিরদাঁড়ার মতো রাস্তার পিঠটুকু জেগে রয়েছে। অনন্ত মন্থর গতিতে মাঝখান দিয়ে স্কুটার নিয়ে চলল। রাস্তার আলোয় তেজ নেই। দোকানপাট বন্ধ, অন্ধকার লাগছে দু’ধারটা। অন্যান্য গাড়ির হেডলাইটের আলোয় মাঝে—মাঝে রাস্তা আলোকিত হচ্ছে। সামনে থেকে আসা গাড়ির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তখন সে বাঁ ধারে সরিয়ে নেয় স্কুটার। দ্রুত ধাবমান গাড়ি পেছনে এসে হর্ন বাজিয়ে পথ ছাড়তে বলে। অনন্ত তাড়াতাড়ি ফুটপাথের দিকে সরে আসে।

”জোরে চালা, জোরে চালা। পথ ছাড়ছিস কেন?” জীবন একটু অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে। অনন্ত তাই শুনে স্পিড বাড়াল।

জীবনের এই স্কুটারটা নিয়েই সে চালানো শিখেছে। যখনই সে রাতে থেকেছে ভোরবেলা এই অঞ্চলের নির্জন রাস্তাগুলোয় জীবন তাকে স্কুটার চালানোর তালিম দিয়েছে। অজস্র ফ্ল্যাটবাড়ি। পড়তে মজা লাগত। বিবেকানন্দ, সুরেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র, বিধানচন্দ্র। কলকাতার এই পুব দিকটায়। কো—অপারেটিভ প্রথায় মালিকানা ভিত্তিতে তৈরি আবাসনগুলোর নাম পূর্বাশা, উদীচী, আইডিয়াল, এলিট। নাম থেকেই কিছুটা বোঝা যায় বাসিন্দাদের রুচি আর মানসিকতা। একটা রাস্তার নাম বিধান শিশু সরণি। হাসি পেয়ে গেছল তার। জীবন বলেছিল, ”বোধহয় এখানে শিশুরা বাস করে বলেই এই নাম।” একটা চারতলা আবাসনের নাম স্কাইলাইন দেখে জীবন মন্তব্য করেছিল, ”আমার মত হাইট তারই এই নাম তা হলে কুড়ি তলা বাড়ির কী নাম হবে?” অনন্ত বলেছিল, ”হেভেন লাইন”।

পেছন থেকে একটা বিরাট ট্রাক আসছে কান—ফাটানো এয়ার হর্ন বাজিয়ে।

”পথ ছাড়বি না, সরবি না” পিঠের কাছে রাগী গলায় জীবনের নির্দেশ।

”বড় গাড়িকে সবসময় পথ ছেড়ে দেওয়াই নিয়ম।”

”রাখ তোর নিয়ম। আমাদের গাড়িটা কি গাড়ি নয়, ফ্যালনা?”

ট্রাকটা প্রায় ধাক্কা দেবার মতো দূরত্বে এসে গেছে। জীবনের পিঠের থেকে হাত—তিনেক পেছনে। ড্রাইভারের পাশে খালাসিটা মুখ বার করে চিৎকার করছে।

স্কুটারের দুই আরোহীকে ধুইয়ে দিচ্ছে দুটো হেডলাইটের আলো।

কী একটা গালাগাল দিল খালাসিটা। জীবন চেঁচিয়ে উঠল। ”থামা তো, থামা। ব্যাটাকে টেনে নামিয়ে পেটাব। অন্তু থামা।”

”না।”

”বলছি থামা।” গর্জন করে উঠল জীবন।

পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে সে হান্ডেল ধরা অনন্তর ডান হাতটায় টান দিল। টলে উঠল স্কুটারটা। বাঁ দিকে চাকার মুখটা ঘুরে গিয়েই জলে ঢাকা একটা গর্তে পড়ল। তারপরই ডান দিকে ছিটকে স্কুটারটা রাস্তায় কাত হয়ে পড়ল।

ট্রাকটার ব্রেক কষার কর্কশ আর্তনাদ অনন্ত শুনতে পেল। ফুটপাতের দিকে চিত হয়ে সে পড়েছে জলের উপর। একটা পাতা ভরা গাছ, ডালপালার ফাঁক দিয়ে অন্ধকার আকাশ সে দেখতে পাচ্ছে। মাথার মধ্যে শূন্যতা। ট্রাকের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

অনন্ত ধড়মড় করে উঠে বসল। দূর থেকে একটা মোটর আসছে। তার হেড লাইটের আলোয় সে দেখল রাস্তার মধ্যে ওলটানো আরশোলার মতো স্কুটারটা পড়ে। এঞ্জিন বন্ধ, পেছনের চাকাটা আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে আর বাঁ হাতে ভর দিয়ে জীবন রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিজেকে বসানোর চেষ্টা করছে। দেহের বাঁ দিকটা জলের মধ্যে ডোবানো।

মোটর গাড়িটা কাছে এসে পড়েছে। হেড লাইটের আলোয় জায়গাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

”জীবন!” আর্ত চিৎকার করে অনন্ত উঠে দাঁড়াল। জীবন মুখটা ঘুরিয়ে উপর দিকে তুলে বলল, ”অন্তু তুই বড্ড লম্বা, নিচু হ।”

অনন্ত ঝুঁকে পড়ল।

”আমার আর টেস্ট খেলা হবে না রে।”

জীবন নিজের ডান হাতের দিকে তাকাল। অনন্ত দেখল আঙুলের ডগা থেকে কব্জি পর্যন্ত মাংস, হাড় থেঁতলে চটকে লাল একটা কাগজের মতো আর তার মাঝে ঘড়ির ডায়ালটা বসানো।

”না জীবন, না। তুই টেস্ট খেলবি। আমি তোকে খেলাব।”

অনন্ত কেন যে বুকফাটা চিৎকার করে কথাটা বলল তা সে জানে না।

।। দুই।।

এই দুর্ঘটনার তিরিশ মাস পর, পনেরো নভেম্বরের আনন্দবাজার পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার দিল্লি থেকে লিখলেন এই প্রবন্ধটি :

”না, না, আর কিছু নেব না। আমাকে শুধু একটা লিমকা দিন।” অবাক হয়ে দেখলাম, এই বলে বক্তা কম্পিত হাতে গ্লাস ভর্তি থামস আপ তুলে নিলেন। নেশার ঘোরে নয়, তখন তিনি হঠাৎ পাওয়া আঘাত, টেনশন, সব মিলিয়ে প্রকৃতিস্থ—অপ্রকৃতিস্থর সীমারেখায়। ভদ্রলোকের নাম এস পাণিগ্রাহী। ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।

”অত্যন্ত গম্ভীর, ব্যক্তিত্ববান এই ভদ্রলোককে এমন অসহায় অবস্থায় এভাবে দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। বোর্ডসচিব হরিহরণ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হরিহরণ পেশায় আইনজীবী এবং শোনা যায় দুঁদে আইনজীবী। তাঁরও প্রায় এই হাল। তার আগে মিনিট—পনেরো রীতিমত নাটক হয়ে গেছে দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে, সাংবাদিক সম্মেলনে।

”ঘটনাটি এইরকম, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পাঁচ টেস্ট—ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচটির প্রথম বল হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে, হঠাৎ বোর্ডের এক সদস্য ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে এসে নেট প্র্যাকটিস দেখায় ব্যস্ত সাংবাদিকদের জানালেন, হোটেলের চারশো দুই নম্বর ঘরে একটা প্রেস কনফারেন্স বিকেল তিনটেয় ডাকা হয়েছে। আপনারা অনুগ্রহ করে আসবেন।

”প্রথম টেস্টম্যাচ শুরুর আগে কিছু মামুলি কথাবার্তা হবে ভেবে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক যাননি। এবং যাঁরা যাননি একটা বড় অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন। ঘরে ঢুকে দেখি, মাথা নিচু করে বসে রয়েছেন বোর্ড—প্রেসিডেন্ট ও সচিব। চোখের চাহনিতে বিষাদ ও অবসন্নতা।

”পাণিগ্রাহীই শুরু করলেন, ‘আপনাদের একটা খবর দেবার আছে। টেস্ট—ম্যাচের জন্য নির্বাচিত চোদ্দজন ক্রিকেটারকে যে—চুক্তিপত্র আমরা দিয়েছিলাম মাত্র চারজন (অরবিন্দ নবর, চাঁদ গৌড়া, দেশরাজ আনোখা ও মহম্মদ উসমানি) তার সব শর্ত মেনে নিয়েছে। বাকি দশজনও চুক্তিপত্রে সই করেছে, তবে তিনটি ধারা কেটে দিয়ে। এই ধারাগুলি হচ্ছে বোর্ডের বিনা অনুমতিতে পত্র—পত্রিকায় লিখতে না পারা, অন্য কোনও লোগো ব্যবহার করতে না পারা এবং যে—কোনও টুর্নামেন্টে খেলতে না পারা।”

”নামগুলি তিনি একে একে পড়লেন—মধুরকর, পিল্লাই, পুষ্করনা, ভোজানি, কাপুর, ফরজন্দ আহমেদ, গুপ্তা, ধারাদ্ধার, দুয়া এবং অধিনায়ক মকরন্দ ভার্দে। ভেঙে—পড়া গলায় বোর্ড—সচিব যোগ করলেন, ‘এরা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। আজ সকালেও প্রত্যেকে আশ্বাস দিয়ে গেছে সব শর্ত মেনে নিয়ে সই করবে। শেষ মুহূর্তে এভাবে ডোবাবে ভাবিনি।’

”ভেঙে পড়ার কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। কাল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম টেস্ট—ম্যাচ। খেলোয়াড়দের নাম ঘোষিত হয়ে গেছে। চূড়ান্ত এগারোজনকে ম্যাচ শুরুর এক ঘণ্টা আগে বেছে নেওয়া হবে। এখন এই অবস্থা। বোর্ড—প্রেসিডেন্ট সরাসরিই সাংবাদিকদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনাদের কী মত? বোর্ডের কী করা উচিত?’

”জনৈক সাংবাদিক ততক্ষণে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। উঠে বললেন, ‘বাদ দিয়ে দিন। সবক’টাকে বাদ দিন। দেশের মাঠে খেলা, কোথায় ভাল রেজাল্ট করার চেষ্টা করবে তা নয়, কোথা দিয়ে টাকা পেটা যায় তার ধান্দা করছে।’ তার বক্তব্য সমর্থন করলেন অন্যরাও। কিন্তু বোর্ডের দুই কর্তার কিন্তু—কিন্তু ভাব গেল না। পাণিগ্রাহী বললেন, ‘কড়া ব্যবস্থা নিতে আমরাও চাই। কিন্তু বাদ দিলে প্রতিক্রিয়া কি হবে ভেবে দেখেছেন? গোটা দেশ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। আর এই মুহূর্তে তা করা সম্ভবও নয়। খুব বাজে রেজাল্ট হবে।’

”বোর্ড—কর্তাদের বোঝানোর বহু চেষ্টা হল, এই ইস্যুতে ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিলে দেশবাসীর সায় তাদের পক্ষেই থাকবে। কিন্তু পাণিগ্রাহীরা ঝুঁকি নিতে রাজি নন। তখন উত্তেজনাটা এমনই চরমে পৌঁছে যায় যে, দিল্লির এক প্রবীণ সাংবাদিক বলেই ফেললেন, ‘আসলে আপনারা মেরুদণ্ডহীন বলেই ক্রিকেটাররা এতটা বেয়াড়া হবার সাহস পায়।’

”একেবারেই না চটে পাণিগ্রাহী প্রতিশ্রুতি দিলেন, ‘এখন আমাদের হার হল ঠিকই, কিন্তু আমার কথা মিলিয়ে নেবেন, এই সিরিজেই ওদের ঢিট করব।’ জানি না কীভাবে তিনি ঢিট করবেন, কেন না খেলোয়াড়দের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই ওই সই না করা দশজনই বিদ্রোহ করবে। গতকাল হোটেলে অধিনায়ক ভার্দের ঘরে বেশ কিছু সিনিয়র ক্রিকেটার মিলে শলা—পরামর্শ করে ঠিক করেছেন, অধিনায়ককে খবরের কাগজে প্রতিদিনের খেলা সম্পর্কে লিখতে দিতেই হবে। বিপক্ষ অধিনায়করা লিখে চাপ সৃষ্টি করতে পারে যদি তা হলে ভারতের অধিনায়কই বা লিখবেন না কেন? জানা গেল এই ‘বিদ্রোহীরা’ বোর্ডকে চিঠি দিয়ে তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন। চিঠির খসড়া রচনার ভার কাপুর ও মধুরকরকে দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের প্রচণ্ড এক সংঘর্ষ আসন্ন। দু’পক্ষই শর্তের ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত করতে চায়।

”প্রথম টেস্টের ঠিক আগে এমন অবস্থা তৈরি হওয়ায় খেলোয়াড়দের মানসিক ভারসাম্য যে সুস্থির থাকবে না, তা বোধহয় না বললেও চলে। তবে যদি প্রথম টেস্ট—ম্যাচে ভারত—দল জিততে পারে, বা সম্মানজনক ড্র—ও করতে পারে, তা হলে জনমত ক্রিকেটারদের দিকেই যাবে। তখন বোর্ডের পক্ষে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে না। আর যদি হারে, তা হলে ক্রিকেটাররা কোণঠাসা হয়ে পড়বেই। বোর্ড তখন ‘ঢিট’ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে মনে হয় দ্বিধা করবে না। কিন্তু কী ব্যবস্থা তাঁরা নেবেন? সারা দলটিকে সাসপেন্ড করবেন? তা হলে খেলবে কারা? যাই হোক, এর উত্তর কয়েকদিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।”

টিভি সেট বন্ধ করে জীবন বাঁ হাতে আজকের খবরের কাগজটা তুলে নিল। প্রবন্ধটি দু’বার পড়া হয়ে গেছে। তবু আবার চোখ বুলিয়ে সেই জায়গাটায় দৃষ্টি রাখল। যেখানে লেখা ‘আর যদি হারে, তা হলে ক্রিকেটাররা…।”

এবার সে লেখার প্যাডটা তুলে নিল। টিভি—তে টেস্ট—ম্যাচ দেখতে—দেখতে সে স্কোর লিখে রেখেছে। ভার্দে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। লাঞ্চের সময় ভারতের সাত উইকেটে ৫৮ রান। লাঞ্চের পর চার ওভারে ইনিংস শেষ ৭৪। ৫৩ বলে ২৪ রান দিয়ে লটন পাঁচটি, ৬৬ বলে ২০ দিয়ে ব্রাইট তিনটি আর একটি করে উইকেট নিয়েছে অ্যামরোজ ও স্টিল ১৭ ও ১৩ রান দিয়ে। অতিরিক্ত রান হয়েছে ছয়টি। সবচেয়ে বেশি রান করেছে ভোজনি—২০, তারপর ভার্দে—১০ আর নট আউট রয়ে গেছে গুপ্তা ১২ রানে। তিনজনে শূন্য রান—ফরজন্দ, দুয়া আর পিল্লাই। মধুরকর খেলেনি পিঠে ব্যথা হওয়ায়। তার জায়গায় নেওয়া হয় অরবিন্দ নবরকে। আটটি বল খেলে একরান করে সে বোল্ড হয়। কর্ণাটকের মহম্মদ উসমানির এটি প্রথম টেস্ট খেলা। ৪২ মিনিটে ২৫ বল খেলে সে পাঁচ রান করেছে।

জীবন পাতা ওলটাল। ভ্রূ কুঁচকে সে স্কোরগুলো দেখতে দেখতে মনে মনে কী যেন হিসাব করল। অস্ট্রেলিয়া বাকি তিন ঘণ্টায় আট উইকেট হারিয়েছে ১১৮ রানে, ৪৪ ওভার খেলে। ভারতও তা হলে পালটা ঘা দিয়েছে! একদিনে আঠারোজন আউট! টিভি কমেন্টেটররা বারবার উইকেটের কথা বলেছে। কেউ বলেছে আন্ডার প্রিপেয়ার্ড, কেউ বলেছে মেঘলা আবহাওয়ায় আর বাতাসে বল লেট সুইং করেছে, সিম করেছে, লাফিয়ে বুকের কাছে উঠেছে। একজন তো বলল, ভারতের ব্যাটসম্যানদের ফাস্ট বল খেলার টেকনিক জানা নেই, সাহসটাও নেই।

কিন্তু সত্যিই হতভম্ব—করা ক্রিকেট আজ খেলা হল। লটন আর ব্রাইটের বল সত্যিকারের ফাস্ট। দুজনেই চল্লিশটার বেশি টেস্ট খেলেছে, দুজনেরই উইকেট সংখ্যা দুশোর কাছাকাছি। তা ছাড়া পৃথিবীর সেরা অলরাউন্ডারদের একজন জন আরউইন, যার প্রায় তিন হাজার রান আর তিনশো আঠাশ উইকেট, এই টেস্টে খেলছে না। তাতেই মনে হচ্ছে ম্যাচটা আড়াই দিনে শেষ হয়ে যাবে! ভারতের মাটিতে টেস্ট—ম্যাচ প্রথম দিনেই আঠারো উইকেট আগে কখনও পড়েছে কি?

স্বীকার করতেই হবে, ভারতের বোলাররাও সমানে টক্কর দিয়েছে। বোলানের মতো ব্যাটসম্যান, টেস্টে যার ছ’হাজার রান, সতেরোটা সেঞ্চুরি, সেও মাত্র নয় রান করল। নট আউট আছে ওপেনার রজার্স ৪৪ রানে আর ব্রাইট ১২ রানে। লটন ১৯ করেছে। তা ছাড়া বাকি সাতজন ডাবল ফিগারেই পৌঁছতে পারেনি। চমৎকার বল করল কাপুর আর দুয়া। আটটির মধ্যে দুয়া চারটি, কাপুর তিনটি উইকেট পেয়েছে। একটি রান আউট।

জীবন অস্থিরবোধ করতে লাগল। ম্যাচটায় যদি ভারত জেতে? বলা যায় না, ক্রিকেটে কিছুই বলা যায় না? যদি জিতে যায় তা হলে ক্রিকেট—বোর্ড ঢিট করার সুযোগ হারাবে। ক্রিকেটারদের নিয়ে দেশ জুড়ে নাচানাচি শুরু হয়ে যাবে। কার ঘাড়ে তখন ক’টা মাথা থাকবে ওদের বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেবার জন্য! বরং ওদের সমর্থন করেই ওইসব সাংবাদিকরা, যারা বলে আপনারা মেরুদণ্ডহীন বলেই ক্রিকেটাররা বেয়াড়া হবার সাহস পায়, তারাই তখন বলবে কাগজে লিখতে দিতে ক্ষতি কি? খুশিমতো লোগো পরলে ক্রিকেট অশুদ্ধ হয় না। ম্যাচ জেতাটাই তো আসল কথা।

কিন্তু জীবনের কাছে এই ম্যাচটা জেতা আসল কথা নয়। প্রবন্ধটায় পাণিগ্রাহীর একটা কথা তার মাথায় গেঁথে আছে সকাল থেকে। ‘আমার কথা মিলিয়ে নেবেন এই সিরিজেই ওদের…।’ আর জনৈক সাংবাদিকের প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বলা কথাটাও, ‘বাদ দিয়ে দিন। সবক’টাকে বাদ দিন’। দুটো কথা মিলিয়ে তার মধ্যে যে ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছিল, সেই ফেনানো আবেগ নিয়েই সে টিভি—তে দেখল ভারতের ব্যাটিংয়ের চুরমার ধ্বংস, তখন সে মনে—মনে চেয়েছিল, হারুক, ভারত হারুক। এই ক্রিকেটারদের ঢিট করতে হলে এইরকম একটা ধাক্কা দরকার। সবক’টাকে বাদ দিক। নতুন টিম হোক। তা—হলে…।

কিন্তু সেই ‘তা হলে’টা মুছে দিল দুয়া আর কাপুর। ভারত আবার খাড়া হয়ে উঠেছে। সেকেন্ড ইনিংসেও কি এইরকম একটা সমান সমান অবস্থা তৈরি হবে?

জীবন পায়চারি শুরু করল। বারান্দায় এসে রাস্তার দিকে অন্যমনস্ক হয়ে লোকজন, গাড়ির চলাচল কিছুক্ষণ দেখে আবার ঘরে এল। উইকেট, কোনও সন্দেহ নেই উইকেটের জন্যই আঠারোজন আউট হয়েছে। ভার্দে বা বোলানের মতো টেকনিক্যালি অত বড় ব্যাটসম্যানরাও কীভাবে আউট হল! টিভির রিপ্লেটা জীবনের চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল। উইকেটে বল পড়ে সিম করে ঢুকল, কোমরের কাছে উঠে এল, দু’জনেই ছ’ফুট লম্বা, ব্যাট সরাতে পারল না।

কিন্তু উইকেট কি এই রকমই থাকবে? এদের চরিরত বদলায়। এমনকী এবেলা—ওবেলাও বদলে যায়। কাল যদি স্বাভাবিক হয়ে যায় ভারত কি আড়াইশো তুলতে পারবে? ফোর্থ ইনিংসটা খেলতে হবে অস্ট্রেলিয়াকে। পিচ যদি ডিটোরিয়েট করে! ধারাদ্ধার আর ফরজন্দের অর্থডক্স লেফট আর্ম স্পিন, পুষ্করনার অফ স্পিন যদি লাইন পেয়ে যায় আর ভালভাবে ঘোরে, তা হলে…।

বাঁ হাতে ফলসটা নিয়ে প্যাডের কাগজে সে কাঁপা কাঁপা লাইনে একটা মুখের স্কেচ করতে লাগল। তা হলে এই টিমই থাকবে। অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে দু—তিনজন ছাড়া কেউই উঁচুদরের স্পিন খেলতে পারে না। জীবন দীর্ঘশ্বাস চাপল। ঘসঘস করে স্কেচটার নীচে লিখল, ”কোনও আশা নেই টেস্ট খেলার।”

অক্ষরগুলো ধ্যাবড়া, বাঁকা এবং ছোট—বড়। বাঁ হাত দিয়ে লেখার অনুশীলন রোজই সে করে। ধীরে—ধীরে লিখলে পরিচ্ছন্ন লেখা হয়। দ্রুত লিখতে গেলেই অসমান হয়ে যায়। সেই দুর্ঘটনার পরের দিনই ডান হাতের কবজির চার ইঞ্চি উপর থেকে হাতটি কেটে বাদ দিতে হয়েছে। নকল একটা হাত এখন লাগান। সেটা ঢাকতে সে গায়ের চামড়ার রঙের সুতির গ্লাভস পরে আর ঢিলে লম্বা—হাতা পাঞ্জাবি। ডান হাতে হালকা ছোটখাটো কাজ যেমন বই ধরে পড়া বা পরদা সরানো থেকে চলন্ত মোটর গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে থাকার মতো কাজও পারে। ঘুড়িও উড়িয়েছে, অসুবিধে হয়নি।

প্যাডটা টেবলের উপর ছুঁড়ে রেখে সে নিজের ঘরে এল। ঘরের দেওয়াল পরিষ্কার, একটা ছবিও নেই। ক্রিকেট খেলার কোনও সরঞ্জামও নেই। একটা হাতকাটা সোয়েটার পরে নিয়ে তার উপর পাঞ্জাবি পরল। গাড়ির চাবি আর টাকার পার্স পকেটে রেখে সে একতলায় নেমে এল।

বাবা কাজে বেরিয়েছেন, মা তার বন্ধুর বাড়ি গেছেন, ভাই কোথায় গেছে কে জানে। জীবনকে দেখে বাড়ির কাজের লোক বলল, ”বড়দা কি গাড়ি বার করবেন?”

”হ্যাঁ, গ্যারাজের শাটারটা তুলে দাও।”

এই গাড়ি কেনা নিয়ে আপত্তি ছিল তার মায়ের। স্বাভাবিকই। দু’চাকারই হোক বা চার চাকারই হোক, তিনি ছেলেকে গাড়ি চালাতে দিতে নারাজ কিন্তু বাবা রাজি। স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, ‘জীবন তো স্বাভাবিকই, ও তো পঙ্গু হয়ে যায়নি। একটা হাতের একটুখানি শুধু নেই, তা ছাড়া সবই তো ঠিকঠাক রয়েছে। তা হলে ওকে অসহায়, অনুপযুক্ত ভাবছ কেন? তার থেকেও বড় কথা, ও নিজে যাতে নিজের সম্পর্কে এইরকম না ভাবে সেটাই তো আমাদের দেখা দরকার। নিজেকে অক্ষম মনে করলে সে কষ্ট পায়, দুঃখ পায়, জীবনে দাঁড়াতে পারে না। নিজেকে বোঝা মনে করলে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। তুমি কি তাই চাও? জীবনকে ভুলে যেতে দাও ওর অঙ্গহানি ঘটেছে। ওকে বুঝতে দাও, আর পাঁচজনের মতোই সে স্বাভাবিক।’

তখন মা বলেন, ‘কিন্তু ও যে মারা যেতে পারত। ভগবানের দয়ায় শুধু বেঁচে গেছে।’ বাবা হেসে বলেছিলেন, ‘আমরা যে—কেউই তো যে—কোনও সময়, যে—কোনও জায়গায় দুঘর্টনায় মারা যেতে পারি। তাই বলে কি কেউ গাড়ি চালায় না? জীবন নিশ্চয় ওর অসুবিধেগুলো কাটিয়ে উঠবে।’

পুরনো এই প্রিমিয়ারটা বাবা কিনে দিয়েছিলেন দেড় বছর আগে। সেই থেকে স্বচ্ছন্দে নিখুঁতভাবেই জীবন গাড়ি চালাচ্ছে। আজও সে গাড়ি নিয়ে কাঁকুড়গাছি মোড়ে, রাস্তা জুড়ে দাঁড়ানো মিনিবাসের জন্য তৈরি জ্যামের মধ্য দিয়ে পথ করে এগোল।

পথে শুধু একটা জায়গায়, একটা মোটা গুঁড়িওলা গাছের কাছে সে অ্যাক্সিলেটরের থেকে পায়ের চাপ তুলে গাড়িটাকে মন্থর করল। দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করে তারপর সে ডান পায়ে অ্যাক্সিলেটর চেপে, মেঝেয় মিশিয়ে দিল। একটা খ্যাপা ষাঁড়ের মতো প্রিমিয়ারটা ছুটল দমদমের দিকে, অনন্তদের বাড়ির উদ্দেশে।

.

।। তিন ।।

রেল লাইনের পুবে একটা টানা লম্বা ঝিল। ঝিলের পুব দিকের পাড় ঘেঁষে একতলা বাড়ি। একটা দালানকে ঘিরে তিনটি শোবার ঘর, রান্নাঘর ও স্নানঘর। দালানের পশ্চিমটা বাইরে খোলা তবে কোলাপসিবল লোহার দরজা আছে। দালানের লাগোয়া বাইরে একটা চাতাল, যার মাথার উপরে ঢালু করে নামানো লাল টালির ছাদ। চাতালটা থেকে দু’ধাপ নেমে সামনের রাস্তা পর্যন্ত তিরিশ ফুট ঘাসের জমি। সেখানে কিছু ফুল গাছ। ঘাসের এই আঙিনাতেই ইজিচেয়ারে স্বামী—স্ত্রী বিকেল সন্ধ্যায় বসতেন। পশ্চিমে ঝিল তারপর রেললাইন, তারপর অস্তগামী সূর্য। ওরা দেখতেন, মৃদুস্বরে এটা—ওটা নিয়ে কথা বলতেন। একমাত্র ছেলে কাছাকাছি মাঠ থেকে খেলা সেরে ফিরে এসে ওদের কাছে বসত। তিনজনে কিছুক্ষণ গল্প করার পর ছেলেটি হাত—মুখ ধুয়ে, কিছু খেয়ে পড়তে বসত। বাবা—মা দু’জনেই কলেজ শিক্ষক। তাঁরাও তখন অধ্যয়নে বা ছাত্রদের খাতা দেখার কাজ নিয়ে বসতেন। রান্নার ও সংসারের জন্য এক প্রৌঢ়া আছে। ঠিক দশটায় বাড়ির আলোগুলি নিবে যেত, ঠিক ভোর পাঁচটায় দালানের কোলাপসিবল দরজার তালা খুলে ছেলেটি দৌড়তে বেরোত বাবার সঙ্গে।

বাড়িটা একটা ষাট ফুট লম্বা জমিতে। জমির এক ধার ঘেঁষে বাড়ি, অন্য ধারে কুড়ি ফুট চওড়া খালি জমি। সেখানে পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, কাগজিলেবু, পালংশাক, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদির কিচেন গার্ডেন। এই তরকারি—বাগানের পরিচর্যাই ছিল স্বামী—স্ত্রীর অবসর বিনোদন।

একদিন ছেলেটি বাবার কাছে পয়সা চাইল রবারের বল কেনার জন্য। সে এবং কয়েকজন মিলে ক্রিকেট খেলবে। বাবা পয়সা দিলেনই শুধু নয়, ওদের খেলা দেখার জন্য বাড়ি ফেরার সময় মাঠের ধারে দাঁড়িয়েও পড়তেন। তিনি স্কুল ও কলেজ টিমে ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলেছেন। বাচ্চচাদের সেই খেলা দেখতে—দেখতে তাঁর মনে হল, ছেলের মধ্যে খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওর শরীরের পটুত্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছাটা অন্য ছেলেদের থেকে বেশি। তিনি স্থির করলেন ছেলেকে উৎসাহ দেবেন ক্রিকেটার হয়ে ওঠার জন্য।

তিনি প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখতে ইডেন গার্ডেনসে যান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ভারতে দ্বিতীয়বার সফর করতে আসে। রয় গিলক্রিস্ট এবং ওয়েস হলের ফাস্ট বোলিং তাকে স্তম্ভিত করে। তিনি অদ্ভুত এক সিরসিরানি অনুভব করেছিলেন রোমকূপে, হৃৎস্পন্দনের গতি দ্রুত হয়েছিল বল করার জন্য বোলারদ্বয়ের ছোটার সময়। বিস্ফারিত চোখে প্রবল গতিতে এক উচ্ছ্বাসের ধেয়ে যাওয়া এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণে শক্তিমত্তার ফেটে পড়া দেখতে—দেখতে তিনি যে শিহরণ অনুভব করেছিলেন, যে মুগ্ধতায় তাঁর দু’চোখ ভরে গেছল তা আর ভুলতে পারেননি। অরুণ সেন স্থির করলেন অনন্তকে ফাস্ট বোলার তৈরি করবেন।

তিনি খেলা শেখার বই কিনে পড়তে শুরু করলেন। ফাস্ট বোলিং সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। বই পড়ে কিছুটা ধারণা হল। তবে একটা জিনিস তিনি বুঝলেন শুধু বই পড়ে নয় আসল শিক্ষাটা হয় প্রত্যক্ষ করে, ভাল বোলারদের বল করা দেখে। শীতকালে রবিবারে ঝুলি কাঁধে তিনি ছেলেকে নিয়ে কলকাতার ময়দানে খেলা দেখাতে আসতেন। ঝুলিতে থাকত খাবার। খেলায় যখন লাঞ্চ হত, ওরাও তখন মাঠের ধারে বসে খেয়ে নিত। খেলা চলার সময় অনন্তকে তিনি বুঝিয়ে দিতেন বোলিংয়ের কলাকৌশল। বাড়ির গায়ে লম্বা সরু জমি, যেখানে তাদের রান্নার বাগান, সেখানে অরুণ সেন ছেলেকে অনুশীলন করাতে লাগলেন পিচ তৈরি করে। বাগান উঠে যাওয়ায় তনিমা সেন আপত্তি করেননি। স্বামী এবং পুত্রের উৎসাহ ও নিষ্ঠাকে তিনি আড়াল থেকে সমর্থন করেছেন। তাঁদের ছিল শান্তির এবং সুখের সংসার।

ছোট একতলা বাড়িটা তার বাসিন্দাদের মতোই সাদাসিধে, বাহুল্যবর্জিত। আকর্ষক কিন্তু দামি আসবাবহীন। অরুণ এবং তনিমা ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’, এই নীতিতে বিশ্বাসী। ওঁরা মনে করেন, জীবনকে নানা ধরনের আরাম ও বিলাসের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলে তাঁদের মন ও সময় নানারকম হাবিজাবিতে জড়িয়ে শুধু তাতেই মগ্ন হয়ে যাবে, মুক্ত স্বাধীন অবস্থাটা হারাবে। জীবনকে অনেক তীক্ষ্ন, চেতনাকে অনেক উজ্জ্বল এবং মনকে কালিমামুক্ত রাখার জন্য ওঁরা প্রয়োজনের বেশি কোনও কিছু দিয়ে নিজেদের ঘেরাও করতে দেননি।

এই ধরনের মানসিকতার জন্যই অরুণ সেন এককথায় বড় প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা মূল্যের ভাল অবস্থার রাসায়নিক জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে বলে সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দিচ্ছিল তাঁর উপরওয়ালা। যন্ত্রগুলো খারাপ হয়ে গেছে তাই কম দামে বিক্রি করা এবং যাকে বিক্রি করা হবে তার কাছ থেকে টাকা খাওয়ার এই ষড়যন্ত্রে অরুণ সেন নিজেকে মেলাতে রাজি হননি। তাঁকে তখন প্রলোভন দেখানো হয় আরও বেশি বেতন, আরও বড় ফ্ল্যাট, আরও বড় গাড়ি, সেরা চিকিৎসা, প্রতি বছর পাহাড়ে কি সমুদ্রতীরে সপরিবার ছুটিযাপন সবই কোম্পানির খরচে তিনি পাবেন। এখনও তিরিশ বছর বাকি অবসর নেওয়ায়। তিরিশ বছর ধরে তিনি এইসব ভোগ করতে পারবেন।

সেদিন অফিস থেকে ফিরতে—ফিরতে অন্যান্য দিনের মতই রাত প্রায় ন’টা হয়ে গেছল। অন্তু ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনওদিনই তাকে জাগা অবস্থায় পান না। সারাদিনে একবারও ছেলেকে সঙ্গ দিতে, ওর সঙ্গে গল্প করতে, খেলা করতে পারেন না। এই যে সময় দিতে পারছেন না, এর বিনিময়ে তা হলে অন্তুকে তিনি কী দিতে পারেন? কয়েক বান্ডিল টাকা? সন্তানকে দিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু এটাই কি পিতার সেরা জিনিস? উত্তরাধিকার হিসাবে তাঁর মনে হয়নি টাকাটাই যথেষ্ট।

অরুণ সেন তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যদি চাকরি ছাড়ি তা হলে এখনকার স্বাচ্ছন্দ্য, এই ফ্ল্যাট, এই গাড়ি, কিছুই থাকবে না। তোমার কি তাতে অসুবিধা হবে?’ তিনি জানতেন তনিমা কী উত্তর দেবেন। তবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন। অনন্তর তখন পাঁচ বছর বয়স। ‘অন্তু নোংরা টাকায় মানুষ হোক, নিশ্চয় তা চাই না।’ তনিমা এই জবাব দিয়েছিলেন। এর সাতদিন পরই দমদমের এই বাড়িটা কিনে, অরুণ সেন চাকরিতে ইস্তফাপত্রটি লিখে ফেলেন। স্বামী—স্ত্রী দু’জনেই রসায়নবিদ্যার প্রথম শ্রেণীর এম এসসি। দু’জনেই কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেয়ে যান একমাসের মধ্যে।

.

অনন্তর বয়স যখন এগারো, একদিন সে রাস্তা থেকে একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পায়। ব্যাগটা সে বাবাকে দেয়। ব্যাগে ছিল একশো তেরো টাকা আর মালিকের নাম ও ঠিকানা।

‘এই টাকাটা দিয়ে একটা ব্যাট কেনা যাবে না?’

‘অন্য একজনের নাম—ঠিকানা—লেখা ব্যাগের টাকা নেওয়াটা আমাদের পক্ষে সৎ না অসৎ কাজ হবে বলে মনে করো?’

‘অন্যের ব্যাট নিয়ে খেলতে আমার বিচ্ছিরি লাগে।’

‘আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’

‘অসৎ কাজ, এটা তো তুমি জানোই, তা হলে আর—।’

‘কিন্তু তুমি এটা জানো কি না আমি সেটাই জানতে চাই।’ তীব্র স্বরটাকে কোমল করে অরুণ সেন তারপর বলেন, ‘অন্তু, জীবনটাকে সোজা সরল রাখো। যেমন ঠিক কাজ আছে তেমনিই বেঠিক কাজও আছে আর সোজাভাবে যদি এদের দিকে তাকাও, তা হলে দেখবে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। যখন কোনও কিছুকে বেঠিক বলে জানবে, তখন সেটা করার চেষ্টা করে সময় নষ্ট কোরো না। কারণ সেটা করে তুমি আনন্দ পাবে না।’

‘এটা একশো তেরো টাকা না হয়ে যদি এক লক্ষ টাকা হত?

‘সংখ্যাটা বিরাট হলেই ভাল বা মন্দের নীতিটা বদলে যায় না। টাকাটা যদি রাখি, আমি তো জানবই এটা অন্যায় আর নিজেকে তখন আমার খুব খারাপ লাগবে। লাখ টাকা আমার দরকার নেই কিন্তু আমার ভীষণ দরকার নিজেকে ভাল লাগা।’ অরুণ সেন ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজেকেই যদি তোমার প্রিয় না লাগে তা হলে কাউকে, কোনও জিনিসকেই তোমার আর প্রিয় লাগা সম্ভব নয়।’

দু’দিন পরেই অরুণ সেন দেখলেন বিকেলে অন্তু বাড়ির দেওয়ালকে উইকেট করে একা—একাই বল করে যাচ্ছে মাঠে খেলতে না গিয়ে।

‘কী হয়েছে?’

‘ওরা আমায় গাধা বলেছে, আরও অনেক কিছু বলেছে মানিব্যাগটা তোমায় দিয়েছি বলে।’

‘সেজন্য ওদের সঙ্গে খেলবে না?’

‘না। তুমিই তো বললে, ঠিক কাজ করলে নিজেকে নিজের ভাল লাগে।’

‘তোমার নিজেকে ভাল লাগছে?’

‘হ্যাঁ।’ বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে অন্তু বলেছিল, ‘কিন্তু কেউ আমাকে পছন্দ করে না।’

‘আমি করি। তোমাকে খুব বড় মনে করি। আমার ছেলে বলে সেজন্য গর্বও হচ্ছে।’

মুখের হাসিতে অন্তুর মুখ ছলছলিয়ে উঠল। সে শুধু বলল, ‘আমি তোমার ছেলে।’

‘নিশ্চয়।’

দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে নীরবে বসে রইল। বাবা আর ছেলে, শিক্ষক আর ছাত্র।

.

অরুণ সেন বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা বড় ক্লাবে অনন্তকে নিয়ে গেলেন। তাঁর এক ছাত্র সেই ক্লাবের খেলোয়াড়। জেলার লিগে খেলে। স্কুলের টিমেও অনন্ত সুযোগ পেয়েছে। ১৫ বছরের কম বয়সী স্কুল ছাত্রদের বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে বাংলা দল গড়ার ট্রায়াল ম্যাচে সে হ্যাটট্রিক করায় দুটি ইংরেজি কাগজে সেটা উল্লিখিত হয়। পড়াশুনোয়ও সে ভাল। কিন্তু খেলা এবং পড়ায় ভাল হওয়ার জন্য, তার উপর বাংলা স্কুল দলে খেলায়, ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের এক হাজার টাকা স্কলারশিপ পাওয়ায় আর বাঙ্গালোরে একমাসের সর্বভারতীয় ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হওয়ায় ক্রমশ সে ক্লাসের বন্ধুদের কাছে প্রায় একঘরে হয়ে যেতে লাগল। অরুণ সেন এতে বিস্মিত হননি। কোনও কিছুতে সেরা হওয়া মানেই নিঃসঙ্গ হওয়া। সেরা মানেই হল চরম বা পরম, এর অর্থ নাম্বার ওয়ান। আর সেটা একজনই মাত্র হতে পারে। ‘স্কুলে সব ছেলের মধ্যে খেলাধুলোয় সেটা তুমি।’ অনন্তর কাঁধ—ধরা মুঠোটা শক্ত করে তিনি বলেছিলেন, ‘একা হয়ে যাচ্ছ? তাই যাও। কিন্তু তুমি মোটেই একা নও। এখন অবশ্য সেরকমই মনে হবে, কিন্তু পৃথিবীতে তোমার মতো আরও অনেক একা মানুষ রয়েছে। কোন—না—কোনওভাবে, কোনও—না—কোনওদিন, এক নম্বররা পরস্পরকে খুঁজে পেয়ে যাবে।’

অরুণ সেন আরও অনেক কথা তাঁর ছেলেকে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু সব কথা একসঙ্গে বললে এত অল্পবয়সী মন বুঝতে পারবে না ভেবে আর বলেননি। সেই রাতে তিনি একটা নোটবইয়ে লেখা শুরু করেন। প্রথম পাতায় বড়—বড় অক্ষরে লিখলেন, ‘অন্তুর জন্য বাবার পরামর্শ’। তিনি স্থির করলেন, অন্তুর জানা দরকার এমন সব কথা যখনই তার মনে উদয় হবে সেগুলো লিখে রাখবেন। যখন বড় হয়ে কথাগুলোর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে তখন নোট বইটা ওকে দেবেন।

তিনি প্রথম দিন লিখেছিলেন :

যতই তোমার বয়স বাড়তে থাকবে ততই তুমি শুনবে, যেসব মহৎ গুণাবলীর দ্বারা আমাদের এই বিরাট প্রাচীন দেশ বিদেশী শাসকের সঙ্গে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেইসব গুণাবলীকে লোকে ব্যঙ্গ—বিদ্রূপ করছে। সেগুলি হল : সততা, বিনয়, কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ়তা, গুরুজনদের ও নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা—সম্মান, প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস, দেশকে ভালবাসা।

অন্তু, সততা গুণের জন্যই তুমি মানিব্যাগটা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে। সেজন্য বন্ধুরা তোমায় বোকা গাধা বলেছিল। তারা চেয়েছিল টাকাগুলো খরচ করতে। এটা চুরিরই সমান অপরাধ। পুত্র, নিজের জায়গায় অটল হয়ে দাঁড়াও। নির্বান্ধব হয়ে পড়ার ভয়ে, যেসব শিক্ষা তুমি পেয়েছ, তা যদি কয়েকটা চোরকে বন্ধু হিসেবে পাবার জন্য বিসর্জন দাও তা হলে সেটা খুব ভালদরের লাভ বলা যাবে না।

‘অন্তু, টেলিভিশন—সেট এখন তোমার দরকার নেই।’ অরুণ সেন বললেন। ‘তুমি টিভি সেট চাও, আমিও চাই। কিন্তু আমি তোমাকে শুধু সেইটাই দিতে পারি, যা তোমার সত্যিকারের দরকার—খাদ্য, গৃহ, শিক্ষা, সেইরকম মা আর বাবা যাঁদের সময় এবং যোগ্যতা আছে তোমাকে ভালবাসা দেবার।’

‘আমাদের ক্লাসের দু’জনের বাড়িতে ইনস্টলমেন্টে টিভি সেট কিনেছে। ওইভাবে তো আমরাও কিনতে পারি।’

‘হয়তো পারি। কিন্তু তার আগে বলো, একজন দোকানি কেন এভাবে কিস্তিতে টাকা নিয়ে একটা জিনিস তোমাকে দিচ্ছে? তার কারণ, সে ধারে দেওয়ার জন্য সুদও নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেখবে আড়াই হাজার টাকার জিনিসের জন্য তুমি তিন হাজার টাকা দিয়েছ। যেহেতু তুমি প্রথমেই একবারে টাকাটা দিতে পারছ না তাই বেশি টাকা নিয়ে জিনিস নিচ্ছ, এর কি কোনও মানে হয়? অন্তু আমি এখন টিভি সেট কিনতে পারব না, এই নিয়ে তুমি আর কোনও কথা বলবে না।’

সেই রাতে অরুণ সেন লিখলেন:

অন্তু, ভীষণভাবে চাই তোমাকে একটা টিভি সেট কিনে দিতে, কিন্তু তা করতে হলে আমাদের জমানো টাকা থেকে তুলে সেটা কিনতে হবে। অথচ ওই সঞ্চয়টাই আমাদের মনের শান্তি। আমি বা তোমার মা প্রাইভেট কোচিং করি না, করলে আমাদের আয় অনেক বেড়ে যেত। আমাদের চলতে হয় নির্দিষ্ট একটা সামর্থ্যের গণ্ডির মধ্যে। এইজন্যই যাতে আমরা তোমার সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারি, আরও বেশি মানসিক স্বাধীনতা আমরা পাই যাতে সততা ও নির্ভীকতার পথে, জীবনের শুভ দিকগুলো খুলে দেবার পথে তোমাকে এগিয়ে দিতে পারি, যাতে তুমি সুখী হতে পারো। তোমার মা আর আমি এইরকমই ভেবেছি আর আমাদের বিশ্বাস সেটা কার্যকরও হচ্ছে। টিভি সেট আমাদের সকলেরই আনন্দের কারণ হবে কিন্তু তার জন্য আমাদের পরিকল্পনাটাও বদলাতে হবে।

কিন্তু জীবনের একটা ধরন আছে। একটা জিনিসের পর আর—একটা। আমাদের সঞ্চয়টা চলে গেলে আমাকে তখন টিউশনির কথা ভাবতে হবে, তখন আমি তোমার সঙ্গে, তোমার মায়ের সঙ্গে আর সন্ধ্যাটা কাটাতে পারব না।

বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মধ্যাঞ্চলের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা হয় কলকাতায়, সি সি অ্যান্ড এফ সি মাঠে। অনন্ত দলের সঙ্গে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক হোটেলে ছিল। হোটেলে যাওয়ার আগের দিন রাতে তনিমা ইস্ত্রি করছিলেন অনন্তর প্যান্ট—শার্ট। এক গ্লাস দুধ খাচ্ছিল সে। গ্লাসটা হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গেল। অরুণ সেন বই পড়ছিলেন। মুখ তুলে বললেন, ‘নার্ভাস হচ্ছ?’

লজ্জিত অনন্ত প্রতিবাদ করে। তনিমা বলেন, ‘নার্ভাস হওয়া তো স্বাভাবিকই। এত বয়স্ক সব ছেলে বয়স ভাঁড়িয়ে শিং ভেঙে বাছুর সেজে খেলছে, তাদের সঙ্গে এইটুকু ছেলে—’

‘খেললেই বা! অন্তুকে লড়তে হবে জেতার জন্য, তাই না অন্তু? ক্রিকেটে তো আর হাতাহাতি যুদ্ধ হয় না! স্কিল আর বুদ্ধি থাকলে বয়স্করা ছোটদের কাছে হার মানে। জেতাটাই মূল ব্যাপার, এর কোনও বিকল্প নেই।’

‘বাবা, ভাগ্যেরও তো কিছু সাহায্য চাই।’

‘হ্যাঁ তাও দরকার। তবে কী জানো, সবার উপরে থাকাটা যদি অভ্যাস করে ফেলতে পার তা হলে তুমি ধরেই নেবে, ওটাই তোমার জায়গা আর জায়গায় থাকার জন্য সবসময়ই চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু অভ্যাসটা যদি চার—পাঁচ নম্বরে থাকাতেই আটকে যায় তা হলে উপরে ওঠার চেষ্টাটাও বন্ধ হয়। বাংলার ক্রিকেটের যা হয়েছে।’ এই বলে অরুণ সেনের মনে হল অল্পবয়সী ছেলের কোমল মনের উপর বোধহয় অযথা চাপ তুলে দিলেন। তাই যোগ করলেন, ‘আবার সবসময় সবাই যে জেতে তাও নয়। ম্যাচ হেরে গেলেই যে পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে তাও নয়। সবথেকে বড় কথা হল, চেষ্টা করে যাওয়া। হারো বা জেতো, তুমি জানবে তুমি চেষ্টা করেছিলে।’

তনিমা ইস্ত্রি—করা জামা—প্যান্ট সযত্নে ভাঁজ করে ছোট একটা সুটকেসে রাখছিলেন। তাই দেখে অন্তু বলেছিল, ‘যেন লর্ডসে খেলতে যাচ্ছি, মা এমন ভাবে সুটকেস সাজাচ্ছে না! আরে এটা আন্ডার—ফিফটিন বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির খেলা।’

‘তুই তো একদিন লর্ডসেও খেলতে যেতে পারিস।’

‘ওরেব্বাবা! লর্ডসে?’ মায়ের দিকে তাকিয়ে অন্তু এমন মুখ করল যেন একদলা তেঁতুল মুখে দিয়ে ফেলেছে। ‘বিল্ডিং ক্যাসল ইন দ্য এয়ার? স্বপ্নটপ্ন পরে দেখব, আগে তো এই ট্রফিটা জিতি।’

‘পরে কেন দেখবে? দেরি করে দেখলে কাজে নামতেও দেরি হয়ে যাবে। আকাশে প্রাসাদ বানানোটা মোটেই বোকাদের কাজ নয়। আজ থেকে প্রায় একশো চল্লিশ বছর আগে হেনরি ডেভিড থরো নামে এক আমেরিকান প্রকৃতিপ্রেমী দার্শনিক তাঁর বাড়ি থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে ওয়ালডেন নামে এক ঝিলের ধারে একটা ছোট্ট কাঠের ঘর, ছ’ হাত বাই দশ হাত, তৈরি করে সেখানে কিছুকাল থাকেন। ঘরটা বানাতে খরচ হয়েছিল মাত্র আঠাশ ডলার। তারপর থরো লেখেন,—’ তনিমা মুচকি হেসে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী যেন লাইনটা?’

‘যদি আকাশে প্রাসাদটা বানিয়ে ফেলেই থাক, তা হলেও সেটা ভেঙে পড়বে না, ওটা ওখানেই থাকবে। শুধু এইবার তুমি ওর নীচে ভিতটা তৈরি করে ফেলো।’ অরুণ সেন তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পালটা মুচকি হাসলেন। ‘পরীক্ষায় পাশ তো?’

সেই ম্যাচের প্রথম দিনে মধ্যাঞ্চল আট উইকেটে ৩১৭ রান তুলেছিল। মহম্মদ উসমানি তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১৪৬ নট আউট থেকে যায়। অনন্ত ১৬ ওভার বল করে ৬৫ রান দিয়ে একটিও উইকেট পায়নি। অরুণ সেন মাঠের ধারে বসে খেলা দেখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, উইকেটে পেস নেই, বল উঠছেও না, জোরালো বাতাসে সুইং করানো বল লাইনে থাকছে না, একটা রিটার্ন ক্যাচ ধরার চেষ্টায় মাটিতে ঝাঁপিয়ে অন্তু ডান কাঁধে চোট পেয়েছে, তা ছাড়া উসমানি ছেলেটির পেস বল খেলার টেকনিকটা ভাল। তাঁর আরও মনে হয়েছিল, মাঠের ধারে বাবাকে দেখে অন্তু যেন অস্বস্তিতে ভুগছিল।

পূর্বাঞ্চল জিতেছিল ম্যাচটা ছয় উইকেটে। মধ্যাঞ্চল ৩১৭—তেই ইনিংস শেষ করে পরের দিন। প্রথম ওভারেই অনন্ত চার বলে উইকেট দুটি পায়, উসমানিকে সে ইয়র্ক করে। জীবন গুহঠাকুরতা নামে একটি ছেলে প্রচণ্ড পিটিয়ে খেলে ১৭১ করায় পূর্বাঞ্চল ১৩ রান এগিয়ে যায় প্রথম ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসে মধ্যাঞ্চল ১৪৭ রানে সবাই আউট। অনন্ত পায় প্রথম তিনটি উইকেট। পূর্বাঞ্চল চার উইকেট হারিয়ে জিতে যায়, জীবন আবার ৫৩ রানের একটা প্রচণ্ড ইনিংস খেলে।

সেমি—ফাইনালে পশ্চিমাঞ্চলের কাছে টসে হারে পূর্বাঞ্চল। ২৯৪ রানে ছিল জীবনেরই ৯১। অনন্তর সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ৫৩ রান ওঠার পর জীবন রান আউট হয়েছিল। অরুণ সেন মাঠে গেছলেন কিন্তু নিজেকে ছেলের দৃষ্টির আড়ালে রাখেন। তিনি বুঝতে পারেন দোষটা ছিল অনন্তরই। দ্রুত দৌড়বার মতো পেশী ও ফুসফুসের ক্ষমতা তখন আর তার ছিল না বলেই অনন্ত দ্বিতীয় রান নিতে ইতস্তত করে জীবনকে ফেরত পাঠিয়েছিল। জীবন ক্রিজে ফিরতে পারেনি। রানটা কিন্তু নেওয়া সম্ভব ছিল। জীবনের পরপর দুটো সেঞ্চুরি পাওয়া আর হয়নি। অরুণ সেন ব্যথিত হন।

পশ্চিমাঞ্চলের ইনিংস যখন আট উইকেটে ২১১ তখন ম্যাচের সময় ফুরিয়ে যায়। ম্যাচের মীমাংসা হয়েছিল টস করে। অনন্ত ছয়টি উইকেট নিয়েছিল ৬০ রানে।

বাড়ি ফিরে আসার দু’দিন পর বিকেলে অনন্ত অবাক হয়ে দেখল, বাবা লোহার ভারী—ভারী চাকতি, পুলি আর লোহার দড়ি কিনে আনলেন। আর একটা মোটা ক্যানভাসের ব্যাগ, যা পিঠে বেঁধে ছেলেরা বই নিয়ে স্কুলে যায়।

‘জীবন গুহঠাকুরতার সেঞ্চুরিটা হল না তোমার জন্য কারণ তোমার শরীর আর বইতে পারছিল না বুট, প্যাড, ব্যাটের ভারসমেত নিজের ওজন। রানিং বিটুইন দ্য উইকেট খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কাল থেকে তোমাকে সকালে আরও বেশি দৌড়তে হবে, ছ’ মাসের মধ্যে অন্তত স্বচ্ছন্দে দিনে পাঁচ মাইলে পৌঁছনো চাই। এই ব্যাগে লোহা ভরে পিঠে বেঁধে পুশ—আপ আর কাঁধের কাছে ধরে সিট—আপ করতে হবে দু’বেলা। তোমার খাওয়ার চার্টও বদলাতে হবে। এই দ্যাখো সয়াবিন এনেছি। মাছ, মাংসটা খুব দরকারি নয়। লো ফ্যাট, হাই নিউট্রিশন ডায়েটের জন্য ডাল, তরিতরকারি, ফল আর দুধই তোমার প্রধান খাদ্য হবে। ভুসি—মেশানো আটার রুটি এখন থেকে আমরা সবাই খাব। খেতে খারাপ লাগবে, লাগুক, দু’দিনেই সয়ে যাবে। চকোলেট, আইসক্রিম, রসগোল্লা, সন্দেশ, যা কিছু চিনির জিনিস একদম ছোঁবে না। খাওয়ার ব্যাপারটা যেন বাঙালি ঘরের মতো না হয়, তা হলে কোনও দিনই তুমি মজবুত শরীর পাবে না।’

এরপরই অরুণ সেন একটু তীব্রস্বরে বলেছিলেন, ‘ছ’টা উইকেট নেওয়ার জন্য নিশ্চয় তুমি প্রশংসা আশা করছ?’

অনন্ত তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিল তীক্ষ্ন সমালোচনা এবার আসছে। সেটা নরম করে দেওয়ার জন্য সে বলে, ‘এসব খেলায় ছ’টা কেন দশটা উইকেটেরও কোনও দাম নেই।’

‘সে কী! রীতিমত একটা ম্যাচ খেলে তুমি এগুলো সংগ্রহ করেছ, খেলার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে পেরেছ, এটার দাম কি কম? আগের খেলায় একই মাঠে একই পিচ থেকে তুমি উইকেট পাওনি। কেন? অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই তো তুমি এরপর প্রতি ম্যাচেই পাবে—ফেদারবেড পিচ, ড্রপড ক্যাচেস, ব্যাড কন্ডিশনস, ইনজুরি, আরও অনেক কিছুই, যার ফলে তোমার স্বাভাবিক ছন্দে তুমি বল করতে পারবে না। এজন্য তোমাকে ভাল বোলার হয়ে উঠতে হবে, আরও আরও ভালো, যাতে এইসব বাধাবিঘ্ন ছাপিয়ে যেতে পার, যাতে ভাঙ্গা পা নিয়েও বল করে উইকেট পেতে পার এমনভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।’

‘বাবা, আমি পরিশ্রম করলে ডেনিস লিলি বা অ্যান্ডি রবার্টসের মতো বোলার হতে পারব কি? তুমি মনে করো?’

‘কেন পারবে না! তোমার ট্যালেন্ট আছে তুমি কঠিনভাবে খাটতেও ইচ্ছুক। যে—কোনও বিষয়ে সাফল্য পেতে হলে যে তিনটি জিনিস দরকার, তার দুটো হল ওইগুলো। তৃতীয়টি হল, সাফল্যের জন্য প্রচণ্ড একটা খিদে থাকা দরকার। সাফল্যের মতো দুষ্প্রাপ্য কোনও—কিছু যখন আকাঙ্ক্ষা করবে তোমাকে তখন বাকি পৃথিবীকে পিছনে ফেলে দিয়ে সেটা ছিনিয়ে নিতে হবে। তোমাকে এও তীব্রভাবে আকাঙ্ক্ষা করতে হবে যে, তখন কোনও খাটুনিকেই আর কষ্টকর মনে হবে না, কোনও যন্ত্রণাই যথেষ্ট মনে হবে না, কোনও একাকিত্বই অসহ্য লাগবে না।’

সেদিন সন্ধ্যায়ই বাড়ির সবজি বাগানে স্টাম্প পুঁতে পিছনে জাল খাটিয়ে অনন্ত বল করতে শুরু করল। বাইরের ইলেকট্রিক আলোটা যথেষ্ট জোরালো নয় তাই টেবল ল্যাম্পটাও আনা হয়েছে। দৌড়ে আসার জন্য তাকে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে রাস্তার ওপার থেকে দৌড় শুরু করতে হচ্ছে। গুড লেংথে, অফ স্টাম্পের এক ফুট বাইরে খাতার একটা সাদা পাতা জমিতে চুলের কাঁটা দিয়ে আটকানো। দুটি মাত্র পুরনো বল। ওই কাগজে ফেলে বল কাট করিয়ে লেগ স্টাম্পে মারতে হবে।

প্রায়ান্ধকার রাস্তা দিয়ে দুটি লোক যাচ্ছিল। তারা থমকে পড়ল।

‘দ্যাখ দ্যাখ, কাণ্ডটা দ্যাখ।’

‘কী দেখব, ছেলেটার তেকাঠিতে বল লাগানো?’

‘আরে না, জালের কাছে, বোধহয় মা হবে, বল কুড়িয়ে কেমন হাত ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেরত পাঠাচ্ছে দ্যাখ!’

.

সেবার বাঙ্গালোরে ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ১৫ বছরের কম বয়সীদের জন্য এক মাসের কোচিং ক্যাম্প করে। ভারতের নানা জায়গা থেকে একুশটি ছেলে সেজন্য নির্বাচিত হয়। বাংলা থেকে শুধু অনন্ত।

ট্রেনে মাদ্রাজ। সেখানে ট্রেন বদল করে বাঙ্গালোর। দুটো রাত ট্রেনে থাকতে হবে। রওনা হবার দিন সকালে অরুণ সেন ছেলেকে একশোটি টাকা দিয়ে বলেন, ‘ট্রেনে কিছু কিনে খাবে না। তোমার মা যা দিয়েছে তাতে বাঙ্গালোর পর্যন্ত চলে যাবে। ফেরার সময় শুকনো কিছু কিনে নেবে। ট্যাক্সি বা রিকশা ভাড়ার জন্য খরচ করেও হাতে কিছু থাকবে। মনে রেখো তুমি এক্সকার্শনে যাচ্ছ না। অনেক কিছুই তুমি জানো না, অনেক কিছু শেখার বাকি। সেইসব জানার, শেখার সুযোগ এসেছে। সুযোগটা কাজে লাগাও। নিজেকে নিজে ঠেলে তুলতে হবে। বাবা—মা চিরকাল তোমাকে গাইড করবে না। একটা সময় আসবে যখন নিজেকেই নিজে চালনা করতে হবে। ক্রিকেট খেলাটা হল টাইটরোপ ওয়ার্কিং। দুটো পাহাড়ের চুড়োর মাঝে দড়ি—বাঁধা তার উপর দিয়ে হাঁটা। যদি ব্যর্থ হও, পড়ে যাবে। আর পড়লেই, মৃত্যু। সুতরাং তোমাকে সেরা হতেই হবে যদি টেস্ট খেলতে চাও।’

‘চিঠি দিবি তো?’

অনন্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছিল। বাঙ্গালোর থেকে সে চারখানা চিঠি লিখেছিল। শেষ চিঠিতে সে বাবাকে লেখে :

এখানে এসে আমার যে কী উপকার হল সেটা সামনের সিজনেই আমি বুঝিয়ে দিতে পারব। আমার দু—তিনটে ভুল শুধরে নিচ্ছি, বিশেষ করে ফলো থ্রু—র। পুরনো বলেও সুইং করাতে পারি দেখে সবাই অবাক হয়েছে। আমি যখন বললাম, রাতে বাড়ির বাগানে প্র্যাকটিস করি, ওরা তাই শুনে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভিডিও ফিল্মে বড়—বড় বোলারদের অ্যাকসন দেখলাম। লিলি, টমসন, হোল্ডিং, রবার্টস, হ্যাডলি, কপিলদেব, উইলিস। তা ছাড়া ট্রুম্যান আর লিন্ডওয়ালেরও ক্লিপিং দেখেছি।

পরপর দুটো ম্যাচ হল, আমাদের মধ্যেই দুটো টিম করে। দুটোতে আমি তিন আর পাঁচ, মোট আটটা উইকেট নিয়েছি। উসমানি দু’বারই আমার অপোনেন্ট টিমে ছিল। দু’বারই আমার অফ কাটারে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে, এল বি ডব্লু হয়ে আউট হয়েছে। ও আমার উপর বেশ চটেছে এজন্য। আমাকে দেখলে মূখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমি কী করতে পারি? শুনলাম ও নাকি বলেছে, এরপর কোনও ম্যাচে পেলে আমার বল ছাতু করবে। উসমানির কিন্তু সত্যিই ভাল ব্যাট। স্টাইলিসও। মধ্যপ্রদেশ রঞ্জি টিমে এবারই আসত যদি না আঙুলে ইনজুরি হত। টেস্ট ও খেলবেই।

আর একজন প্রেসারকে আমার ভাল লাগল। পঞ্জাবের দেশরাজ আনোখা। আউট সুইংটা আমার থেকেও ভাল। বলের প্রেস আমারই মতো। ব্যাট করে খুব স্বচ্ছন্দে আর ছয় মারতে ওস্তাদ। টেস্ট টিমে আসার জন্য এর সঙ্গেই আমাকে কমপিট করতে হবে মনে হচ্ছে। এজন্য আমাকে ব্যাটিংয়ের উপর আরও জোর দিতে হবে। দুটো ম্যাচের প্রথমটায় আমার ব্যাট করার সুযোগ আসেনি। দ্বিতীয়টায় ২৩ নট আউট ছিলাম। আমি যে অনেকের থেকে ভাল ব্যাট করতে পারি সেটা এখানে প্রমাণ করা গেল না। তবে আর একটা ম্যাচ খেলা হবে কর্ণাটকের ভেটারেনদের সঙ্গে। এই একটা ব্যাপারে আনোখা আমার থেকে এগিয়ে রয়েছে। ছেলেটা রগচটা কিন্তু সরল। আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। স্টেডিয়ামে আমাদের খাট দুটো পাশাপাশিই। একদিন রাতে কথায়—কথায় বলল, প্রত্যেক ব্যাটসমানকেই ও শত্রু বলে ভাবে। খেলার বাইরেও কোনও ব্যাটসম্যানের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায় না। তা হলে নাকি ওদের সম্পর্কে মন নরম হয়ে যাবে। অদ্ভুত, তাই নয়? সবসময় ও ঘৃণা করে ব্যাটসম্যানদের। ওর যুক্তি হল, তা হলে বল করার সময় বাড়তি একটা তেজ ও পায়, কখনও ঝিমিয়ে পড়ে না। আমাকে পরামর্শ দিল, ‘তুমিও হেট করো ব্যাটসম্যানদের। দেখছ তো তোমাকে কেমন হেট করে উসমানি। ও ঠিক বদলা নেবে তোমাকে।’ আনোখাকে আমি বললাম, ‘তুমি আমার রাইভাল। ও শুনে হোহো করে হাসল। বলল, ‘অনন্ত তোমাকে মোটেই রাইভাল ভাবি না। একটা টিমে বল ওপেন করতে দু’দিক থেকে দুটো লোক দরকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম হলে তো চারটে লোক চাই। আমাদের দেশে চারটে কোথায়, শুধু তো একজনই এখন টেস্ট ক্লাসের মিডিয়াম ফাস্ট বোলার, সে হল দুয়া। চার—পাঁচ বছরের মধ্যেই আমি টেস্টে বল ওপেন করব আর অন্য দিক থেকে করবে তুমি।’ আনোখার কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কি বিশ্বাস নিজের সম্পর্কে!

এখানে খাঁটি চন্দন কাঠ পাওয়া যায়, চন্দন পাউডারও। কাঠের নানারকম মজার মজার পুতুলও দোকানে দেখলাম। মার জন্য চন্দন কাঠ, পাউডার, ধূপ আর তোমার জন্য পুতুল নিয়ে যাব।

.

অনন্ত কলকাতায় ফেরার আগের দিন যখন বাঙ্গালোরে মহাত্মা গান্ধী রোডে কাবেরি থেকে চন্দন কাঠ কিনছিল সেই সময় প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে কলেজে ক্লাস নিতে—নিতে অরুণ সেন হঠাৎ মাথায় তীব্র যন্ত্রণা বোধ করেন। সংজ্ঞা হারিয়ে তিনি চেয়ার থেকে পড়ে যান। ডাক্তার আসেন। কাছাকাছি এক নার্সিং হোমে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান আর ফেরেনি এবং সন্ধ্যায় তিনি যখন মারা যান তনিমা সেন তখন তাঁর হাত ধরে ছিলেন।

।। চার ।।

প্রিমিয়ারটা বাড়ির সামনে থামিয়ে, একবার হর্ন বাজিয়ে জীবন জানিয়ে দিল সে এসেছে।

চাতালের একধারে দেওয়ালে লাগান পুলি টেনে অনন্ত তখন ব্যায়াম করছিল। নভেম্বরেও দরদর করে ঘাম ঝরছে তার গলা ঘাড় বেয়ে। কাঁধের এবং পিঠের ফুলে ওঠা পেশীগুলো ঘামে ঝকঝক করছে। হর্নের আওয়াজে তার ব্যায়াম বন্ধ হল না।

জীবন চাতালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মিনিটখানেক অপেক্ষা করে বলল, ”আজকের খেলাটা দেখেছিস?”

”প্রথম এক ঘণ্টা, তারপরই লোডশেডিং হল।”

”আজকের রেজাল্ট জানিস?”

পুলি ছেড়ে দিয়ে, দু’হাতের তালু ঘষতে—ঘষতে অনন্ত বলল, ”টি—এর চল্লিশ মিনিট পর কারেন্ট এল। মাঝে কি হল জানি না। তবে স্কোরগুলো জানি। ফ্যান্টাস্টিক ম্যাচ হবে।”

গত সিজনে শিলিগুড়িতে একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অনন্ত ফাইনালে খেলতে গেছল সেখানকার এক ক্লাবের পক্ষে। কড়ার ছিল, তাকে একটা সাদা—কালো টিভি সেট দিতে হবে। সে আটটা উইকেট ১১ রানে পায়। বাকি দু’জন রান আউট হয়েছিল। সেটটা দালানে খাবারের টেবলের পাশে রাখা। খবরের সময় এবং বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য সময় সেট বন্ধই থাকে। দায়সারা লঘু ব্যাপার মা ও ছেলের কেউই পছন্দ করে না।

”ম্যাচটাই শুধু নয়, মাঠের বাইরেও কিছু ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার হবে বলে মনে হচ্ছে। তুই আজকের আনন্দবাজারটা পড়েছিস?”

”পড়েছি।”

”তোর কি মনে হয় না, বোর্ডের সঙ্গে প্লেয়ারদের একটা প্রচণ্ড গণ্ডগোল ঘনিয়ে আসছে? একটা এসপার—ওসপার এবারই হয়ে যাবে?”

”পাণিগ্রাহি আর হরিহরণের কথা থেকে তাই—ই যেন মনে হচ্ছে। এই সিরিজেই ওদের ঢিট করব বলেছে যখন, মনে হয় বোর্ড কিছু একটা করবে।”

”কী করবে?” জীবন বাঁ পকেট থেকে লবঙ্গ বার করে দাঁতে কাটল, ”আজ ইন্ডিয়া টিমের যা পারফরম্যান্স তাতে ওদের গায়ে হাত দিতে বোর্ড সাহস পাবে ভেবেছিস?”

”খেলার এখনও চারদিন বাকি।” অনন্ত হাত বাড়াল। ”একটা লবঙ্গ দে।”

”এই উইকেটে খেলা পাঁচদিন যাবে না, থার্ড কি ফোর্থ ডে লাঞ্চ পর্যন্ত, তার বেশি নয়।”

”কে জিতবে?” লবঙ্গটা চিবোতে—চিবোতে অনন্ত তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ”ফুলু কোথায় যাচ্ছিস” বলে চাতাল থেকে দৌড়ে নেমে গেল। পাঁচিল দিয়ে একটা সাদা বেড়াল গুটি—গুটি যাচ্ছিল। অনন্ত সেটাকে ধরে নিয়ে এসে চেয়ারে বসল। ফুলুকে কোলে বসিয়ে তার গলা চুলকে দিতে দিতে বলল, ”ম্যাচটা এমন জায়গায় এসে আজ দাঁড়াল, তাতে বলা শক্ত কে জিতবে।”

”আমি চাইছি ইন্ডিয়া হারুক।”

”সে কী? না, না, আমি চাইছি জিতুক।”

”না হারলে বোর্ড কোনও অ্যাকশনই নিতে পারবে না।”

”সেজন্য দেশকে হারতে হবে?”

”একটা টেস্ট হারলে কিছু আসে যায় না। গণ্ডা—গণ্ডা টেস্ট তো আমরা হেরেছি, তার সঙ্গে নয় আর একটা যোগ হবে। কিন্তু তাতে লাভ হবে এই যে, প্লেয়াররা যেরকম ইনডিসিপ্লিনড হয়ে পড়েছে, বোর্ডকে পর্যন্ত জোট বেঁধে শাসাতে শুরু করেছে, সেটা তা হলে বন্ধ করা যাবে। আর এখনই বন্ধ না করলে এর জের পরের জেনারেশনগুলোকেও প্রভাবিত করবে।”

”কিন্তু প্লেয়াররা যা চায় সেটা কি খুব অনায্য?”

”টাকা?”

”হ্যাঁ। তাদের ভাঙিয়ে লক্ষ—লক্ষ নয়, কোটি টাকার উপর বোর্ড তহবিল গড়েছে। অবিরত তাদের দিয়ে টেস্ট ম্যাচ, বছরে তিনটে করে সিরিজ খেলিয়েছে, অসংখ্য ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল। মুখের রক্ত তুলে তারা টাকা এনে দিয়েছে বোর্ডকে। জীবন, আগে ক্রিকেটাররা কত বছর ধরে, কটা করে টেস্ট খেলত?”

”এখনকার থেকে বেশি বছর ধরে কিন্তু কম টেস্ট।”

”ব্রাডম্যানের কথা বাদই দিচ্ছি, কুড়ি বছরে মাত্র বাহান্নটা। হ্যামন্ড, উলি হবসদের ফার্স্টক্লাস কেরিয়ার কত বছর ধরে বলত? এক—একজনের প্রায় তিরিশ বছর ধরে। তার মধ্যে হ্যামন্ড পঁচাশিটা, উলি চৌষট্টিটা, হবস একষট্টিটা টেস্ট খেলেছে। আমাদের মার্চেন্ট, মুস্তাক, মাঁকড়, হাজারেরা কত বছরে ক’টা টেস্ট খেলেছে? পঙ্কজ রায় দশ বছরে বিয়াল্লিশটা, ফাড়কর দশ বছরে একত্রিশটা, মাঁকড় বারো বছরে মাত্র চুয়াল্লিশ…”

”হয়েছে, হয়েছে, রেকর্ড চালানো বন্ধ করো। আমি মানছি এখনকার সুপারস্টাররা দশ বছরেই সত্তর—আশিটা টেস্ট, একশোর উপর ওয়ান ডে খেলে নিজেদের জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলছে কিন্তু এর সঙ্গে এইসব বিশৃঙ্খলা, নিয়ম ভেঙে ফেলা, ঔদ্ধত্য দেখানোর সম্পর্ক কি? খেলছে বেশি, টাকাও তেমনি বেশি পাচ্ছে। আনন্দবাজারের ওই লেখাটার এক জায়গায় রয়েছে প্লেয়াররা বিদ্রোহ করবে, বোর্ডকে চিঠি দিয়ে তারা জানাবে ভার্দেকে রোজ খবরের কাগজে লিখতে দিতেই হবে নইলে…”

”ব্ল্যাকমেইলিং?”

”তা ছাড়া আর কি!”

”আমি তা মনে করি না।” অনন্ত এই বলে ফুলুকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। ছাড়া পেয়ে সে আড়মোড়া ভেঙে ল্যাজ তুলে গদাই লশকরি চালে ভিতরে চলে গেল।

”বোর্ড যদি শোষকের মতো কাজ করে, তার প্রতিবাদ হবে না?” অনন্ত এবার উত্তেজিত গলায় বলল, ”যদি সাহস থাকে বোর্ড এদের বরখাস্ত করছে না কেন?”

”হয়তো সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে আর সেই সময়টা বোধহয় ঘনিয়েও আসছে।” জীবন ঝুঁকে পড়ল। গলা নামিয়ে বলল, ”অন্তু তা হলে তোর সুযোগ এলেও আসতে পারে।”

”কী বললি?” ঝাঁকুনি খেয়ে অনন্তর মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে এল। ”আমার সুযোগ কি করে আসবে?”

”সাত—আটজন যদি বাদ পড়ে তা হলে নেক্সট যারা জায়গা নেবার জন্য রয়েছে তাদের মধ্যে তুইও পড়িস। উসমানি আর নবর সই করেছে, ওরা থাকবে। মধ্যপ্রদেশ ছেড়ে উসমানি কর্ণাটকে এসে খুঁটি পেয়েছে হরিহরণকে। দুয়া আর কাপুরের জায়গায় আসবে আনোখা আর তুই। দলিপ ট্রফিতে, ইরানি ট্রফিতে তোর এবারের পারফরম্যান্স যথেষ্ট ভাল। রঞ্জিতে গতবার তোর আটত্রিশটা উইকেট! অন্তু আজ ইন্ডিয়ান বোলাররা যেভাবে হিটব্যাক করেছে তাতে মনে হয়েছে তোর আর আশা নেই টেস্ট খেলার। কিন্তু এখানে আসার পথে মনে হল, আশা এখনও আছে যদি ইন্ডিয়া এই টেস্ট হারে। সেইজন্যই আমি চাই ইন্ডিয়া হারুক।”

এই সময় রাস্তা থেকে একটি লোক চেঁচিয়ে বলল, ”এই যে বাড়িতেই আছিস দেখছি!”

”আরে শচীনদা আপনি, কি ব্যাপার?” অনন্ত এগিয়ে গেল ফটকের দিকে।

”দু’বছর আগে একবার এসেছিলুম আর আজ। জীবনও রয়েছে দেখছি।” শচীনদা নামক টাকমাথা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, লম্বা লোকটি চাতালে উঠে চেয়ারে বসল। বান্ধব সমিতির সহ সচিব গত পনেরো বছর ধরে।

”আজ নেটে যাসনি?”

”টিভি দেখব বলে আর বেরোইনি। কালও যাব না। খেলাটা দেখতে হবে।”

”খেলাটা জব্বর জমেছে, প্রথম দিনেই আঠারোটা উইকেট। চা খাওয়া।”

অনন্ত বাড়ির ভিতরে গেল। জীবন রাস্তার দিকে তাকিয়ে, দূরে দেখল তনিমা আসছেন। কালো পাড়ের সাদা তাঁতের শাড়ি, বুকের কাছে ধরা চামড়ার ব্যাগ। কালো ফ্রেমের চশমা। ছিপছিপে, দীর্ঘ সমুন্নত দেহের গড়নের মধ্যে অনন্তর আদলটা খুব স্পষ্ট।

”শচীনদা আপনাকে অনেকদিন পর দেখছি।”

”আমিও তোমাকে। সেই অ্যাকসিডেন্টের পর তুমি আর একদিনও ময়দানে পা দাওনি। তিনবছর বোধহয়।” শচীনদা ব্যথিত চোখে জীবনের ডান হাতটার দিকে তাকালেন। অস্ফুটে একবার বললেন, ”কপাল!”

অনন্ত ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। ‘কপাল’ প্রসঙ্গটা যাতে না গড়ায় তাই জীবন তাড়াতাড়ি বলল, ”শচীনদা আজ খেলা দেখলেন?”

”দেখব কোত্থেকে, অফিসে কি টিভি আছে?”

”আপনার কি মনে হয় পিচ আন্ডার প্রিপেয়ার্ড না একেবারেই আন প্রিপেয়ার্ড?”

”কে জানে কী করেছে, ওরে অন্তু যে জন্যে আসা, নারানদা কালই তোকে সি এ বি—তে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন, খুব জরুরি। দুপুরে আমাদের টেন্টে লোক দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন, তোকে যেন এক্ষুনি, আজকেই জানিয়ে দেওয়া হয়।”

”কী ব্যাপার? কী জন্য?” অনন্তর সঙ্গে—সঙ্গে জীবনও অবাক হয়ে শচীনদার দিকে তাকিয়ে থাকল। নারায়ণ সরকার সি এ বি—এর সেক্রেটারি। রাশভারী লোক। অপ্রয়োজনে কোনও কাজ করেন না। বাজে কথা বলেন না। তনিমা সেই সময় বাড়িতে ঢুকলেন। জীবন দাঁড়িয়ে উঠল।

”মা ভাল আছেন?”

”হ্যাঁ। বলছিলেন আপনি কবে আসবেন?”

”যাব। সময় আগে যেমন ছিল এখন তো ঠিক ততটা পাই না। যাব একদিন।” তনিমা ভিতরে গেলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর আর্থিক অনটনে পড়েছিলেন। সেটা কাটাতে প্রাইভেট কোচিং শুরু করেছেন। দুটি মেয়েকে তাদের বাড়িতে গিয়ে সপ্তাহে দু’দিন পড়ান আর পাঁচটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে সন্ধ্যায় এই চাতালেই শতরঞ্চ