আমাকে চিন্তায় বিব্রত হতে দেখে বললেন, ”ফরটি—এইট লন্ডন অলিম্পিকে ইন্ডিয়ান ফুটবল টিমে নাকি স্ট্যান্ডবাই ছিল। আমি অবশ্য বলতে পারব না কথাটা সত্যি কি মিথ্যে তবে কথাবার্তা ফুটবলারদের মতো রাফ, মুখে অনর্গল খিস্তি, আর গোঁয়ার। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়েস কিন্তু এককালে যে লম্বা চওড়া দারুণ স্বাস্থ্য ছিল সেটা বোঝা যায়।”
মনে পড়ল, ছোটবেলায় দাদাদের কাছে বিজন নামটা শুনেছি। ও যখন পা ভেঙে খেলা ছেড়ে দেয় তখনও আমি ময়দানে ফুটবল দেখতে যাওয়া শুরু করিনি। তাছাড়া মোহনবাগান ক্লাবে বিজন দত্ত কখনো খেলেনি। সুতরাং আমার পক্ষে না চেনাই স্বাভাবিক। ওয়ার্ড এবং বেড নম্বর জেনে নিয়ে একদিন বিকেলে আলাপ করতে গেলাম।
ঘরে চারটি মাত্র বেড। দেয়াল ঘেঁষে ওর খাট। তার পাশেই দরজা, বারান্দায় যাওয়া যায়, মাথার নিচে দু—হাত রেখে চিত হয়ে শুয়েছিল। লম্বায় ছ’ফুটের বেশি বই কম নয়। চুল কদমছাঁট, অর্ধেক পাকা, মাথাটি ঝুনো নারকেলের মতো দেখাচ্ছে। খাটের পাশে দাঁড়াতেই কৌতূহলটা বিস্ময়ের রূপ নিয়ে ওর ঘন ভ্রূয়ের নিচে জ্বল জ্বল করে উঠল।
”আপনার নাম শুনে আলাপ করতে এলাম।” সঙ্কোচ কাটাবার জন্য হাসতে গিয়ে বুঝলাম এ—লোকের কাছে সৌজন্য দেখানো নিরর্থক।
”কেন, আমি কি ফিল্ম—স্টার না টেস্ট—প্লেয়ার?”
দমে না গিয়ে বললাম, ”ফুটবল ভালোবাসি, রেগুলার খেলা দেখিও।”
”জীবনে কখনো তো বলে পা দেননি।” কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসতে বসতে বিজন দত্ত বলল, ”চেহারা দেখেই বুঝেছি।”
কথাটা নব্বুই ভাগ সত্যি, তাই প্রতিবাদ করার মতো জোর পেলাম না।
”গত বছরই, আপনার মতো পটকা চেহারার এক ছোকরা এল, ফুটবল সেক্রেটারির বন্ধুর ছেলে। আমাকে বলা হল একটু দেখতে।” বিজন দত্ত পিটপিটিয়ে হাসল। ”সকালে প্রথম দিন প্র্যাকটিসে আসতেই কুড়ি পাক দৌড়তে বললুম, পাঁচ—ছ পাক দিয়েই বাছাধনের কোমরে হাত। গোলের মুখে উঁচু করে বল ফেলে ওকে হেড করতে বললুম আর আমার স্টপারকেও বলে রাখলুম কোঁতকা ঝাড়তে। প্রথম বার উঠেই পাঁজর চেপে বসে পড়ল। তারপর ট্যাকলিং প্র্যাকটিস। ছোকরার একটা ভালো ডজ ছিল। দুবার আমায় কাটিয়ে বেরলো। থার্ড টাইমে, লাট্টুর মতো পাক খেয়ে সাইড লাইনের দশ হাত বাইরে ছিটকে পড়ল। পরদিন থেকে আর আসেনি।”
বিজন দত্ত দুই ঊরুতে চাপড় মেরে পুরনো মোটর স্টার্ট দেবার মতো শব্দ করে হেসে উঠল। দেখলাম নিচের পাটির সামনের দুটি দাঁত নেই।
”ফুটবল পুরুষমানুষের খেলা। বুঝলেন, সেইভাবেই আমরা খেলেছি। মার দিয়েছি, মার খেয়েছি। বাঁ হাঁটুর দুটো কর্টিলেজই নেই, আর এই পায়ের সিনবোনটা—” বিজন দত্ত লুঙিটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে ডান পা ছড়িয়ে দিল। ঘন লোমের মধ্যে দিয়েও কয়েকটা কাটা দাগ দেখতে পেলাম।
”এই পা—টা ভাঙার পরই খেলা ছাড়তে হল।”
কোনোরকম প্রয়াস ছাড়াই আমার মুখে বোধহয় স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছিল। বিজন দত্ত কঠিনচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”আপনি কী করেন?”
”এখানকার স্কুলে পড়াই, সায়ান্স।”
”মাস্টার। আমিও মাস্টারি করি, ফুটবলের। আমার লেখাপড়া ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত।”
”আপনি কি এখন কোচ করেন?”
”শোভাবাজার ইয়ং মেনস। গতবার ফাস ডিভিশানে ওঠার কথা ছিল, ওঠেনি।” বলতে বলতে বিজন দত্তর মুখ চাপা রাগের আক্রমণে মুচড়ে যেতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”ব্যাটা টাকা দিয়ে ম্যাচ কিনল। জানতো খেলে আমার টিমের কাছ থেকে পয়েন্ট নিতে পারবে না।”
”কার কথা বলছেন?”
”রতন সরকার। ব্যাটা খেলার আগের দিন হাজার টাকা নিয়ে আমার গোলকিপারের বাড়ি গেছে; স্টপারের বৌটা মরো—মরো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেবে বলেছে, দুটো হাফব্যাককে জিনসের প্যান্ট দিয়েছে। নয়তো প্রদীপ সঙ্ঘের সাধ্যি ছিল কি চ্যাম্পিয়ান হয়! পাঁচটা ম্যাচ কিনেছে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে। নিজেকে কোচ বলে বড়াই করে! বরাবর, সেই যখন আমরা একসঙ্গে খেলতাম তখন থেকে ওকে জানি, পয়লা নম্বরের জোচ্চচর। হাত দিয়ে কতবার যে গোল করেছে! পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে মাটিতে পড়ে ছটফটিয়ে এমন কাতরাতো যে মনে হত যেন ওকে দারুণ মেরেছে। এইভাবে অনেক পেনাল্টি আদায় করেছে। গোলকিপার বল ধরতে লাফাচ্ছে, রতন অমনি প্যান্ট টেনে নামিয়ে দিল। যত রকমের ছ্যাঁচড়ামো আছে কোনোটাই বাদ দিত না।”
শুনতে শুনতে আমি হেসে ফেলেছিলাম, ওর যত রাগ রতন সরকারের বিরুদ্ধে অথচ নিজের টিমের যারা ঘুষ নিল তাদের সম্পর্কে একটি কথাও বলল না। আমার হাসি দেখে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ”আপনি কোন ক্লাবের সাপোটার?”
”মোহনবাগানের।”
অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে বলল, ”কাঁপে, বুঝলেন ছোট টিমের কাছেও ভয়ে কাঁপে। তিনটে ক্লাবের অফার আছে আমার কাছে। এখনও ঠিক করিনি কোনটা নোব, তবে নোবই। রতনকে এমন শিক্ষা দেব যে জীবনে ভুলবে না। আর মোনবাগান ইসবেঙ্গলের কাছ থেকে পয়েন্ট নেবই। ইজিলি পয়েন্ট নেব। একশো টাকা বাজি রাখছি।”
বললাম, ”যদি রতন সরকার আবার আপনার প্লেয়ারকে ঘুষ খাওয়ায়?”
ওর চোখে দপ করে ওঠে রাগটা ধীরে ধীরে বিচলিত হতে থাকল, তারপর স্তিমিত হয়ে পড়ল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে শুধু বলল, ও সব পারে, ওর কাছে খেলাটা কিছু নয়, যেনতেন করে জেতাটাই বড় কথা।”